2 of 2

বিবাহ-মঙ্গল

বিবাহ-মঙ্গল

বিয়ের ব্যাপারটা আগের চেয়ে অনেক ছিমছাম হয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই। বরপক্ষের স্টিম রোলার আর আগের মতো কনেপক্ষের ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে না। চক্ষুলজ্জা এসেছে। শিক্ষা দীক্ষা বাড়ার ফল। লোকসংখ্যা বেড়েছে। বাসস্থানের সমস্যা বেড়েছে। চাপে পড়ে জীবনীশক্তিও কমে আসছে। অসভ্যতা করার মেজাজটাই নষ্ট হয়ে গেছে। কন্যাপক্ষের সঙ্গে পাত্রের দরদাম নিয়ে একটা রফা হয়ে গেলেই সুড়সুড় করে বিয়ে হয়ে যায়। লাভম্যারেজ হলে তো কথাই নেই। দু-পক্ষই ঠান্ডা। হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা। কাল বউ ছিল না, আজ আছে। গ্রহণ করতে হয় করো, না করতে পারো তো বলো। স্ট্যান্ডবাই ব্যবস্থা আছে। বিয়ে করব আমরা ম্যাও সামলাব আমরা! তাই পাড়া কাঁপানো উলু, ঘন ঘন শাঁখের শব্দ তেমন আর শোনা যায় না। ফুসফুসে আর তেমন বাতাস খেলে না। মেজোবউদি সাবেক আনন্দে এক ভলক উলু ঝেড়ে বিছানায় উলটে পড়ে আছেন। মেজদা পাম্প করে হাওয়া বের করছেন। বড় ছেলের বিয়েতে একটা দরজা খুলে পড়ে গিয়েছিল। দশ বছরের ব্যবধানে ছোট ছেলের বিয়ে হচ্ছে। কত্তা সকলকে সাবধান করেছেন—সেবারের মতো গায়েহলুদ কোরো না। কাঠের দাম এখন মানুষের দামের চেয়েও বেশি। সেবার গৌরী ছিল। এবার আর কে থাবা থাবা হলুদ নিয়ে হুল্লোড় করবে? আমাদের আর সে তেজ নেই। প্রশান্তও ওসব পছন্দ করে না। প্রফেসারের বিয়ে। বাড়াবাড়ি করলে বাড়ি ছেড়ে পালাবে।

কন্যাপক্ষের সঙ্গে বরপক্ষের এখন জেন্টলম্যানস এগ্রিমেন্ট হয়। ফ্রিজ চেয়েছিলেন দিয়েছি। টিভি দিয়েছি। এক বছর শীতের তত্ব, ষষ্ঠী, পুজোর প্রণামী, গ্রীষ্মের ল্যাংচা, লিচু, খরমুজ, তরমুজ করার মুচলেকা দিচ্ছি। বিয়েতে বত্রিশটা শাড়ি প্রণামী দিয়েছি। একটা অনুরোধ, তিরিশ জনের বেশি বরযাত্রী দয়া করে আনবেন না। আমরাও এদিক থেকে পনেরো জনের বেশি যাব না। আমার বাড়ি ছোট, আপ্যায়ন করতে পারব না। কোঁচা দুলিয়ে পাম শু পরে বর এলেন। সঙ্গে পুঁদে পিতাঠাকুর। কন্যাপক্ষ তটস্থ। পান থেকে চুন খসলেই নন্দী-ভৃঙ্গির দল আটচালা উপড়ে দেবে। দয়া করে মেয়েটিকে নিতে এসেছেন, মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্টের মতো মেয়ের বাবা। বেয়াইয়ের পায়ে পায়ে ঘুরছেন। এমন ঘটনাও শোনা গেছে, পাত থেকে কমলাভোগ তুলে তুলে ছাদের তেরপল ফাঁক করে নীচে ফেলে দিয়ে পৈশাচিক উল্লাসে চিৎকার তুলেছে, কই হে, নিয়ে এসো, নিয়ে এসো, সব ফুরিয়ে গেল নাকি হে! বদমাইশিটা বুঝতে পেরে বিব্রত পাত্রীপক্ষ নীচে দুজনকে দাঁড় করিয়ে দিলেন চাদর ধরে। কমলাভোগ পড়ছে, আবার ফিরে যাচ্ছে পাতে। শঠে শাঠ্যং।

পরিবেশনকারী দু-খণ্ড মাছ দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। ছুঁচোলো গোঁফ পাকিয়ে বরপক্ষের আমন্ত্রিত ব্যঙ্গের সুরে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ ছোকরা পুরোটাই নামিয়ে রেখে যাও। ছেলেখেলা কোরো না। খেতে এসেছি, ইয়ার্কি মারতে আসিনি। মাছ পেরিয়ে দইয়ে এসে আবার হুলুস্থূল, এটা কী জোলো মাল, কচি খোকার দুধ তোলার মতো ছিড়িক ছিড়িক ছেড়ে যাচ্ছে! মাথা আনো, মাথা। যত না খেলেন তার চেয়ে নষ্ট করলেন বেশি। লাটঘাট মাল কলাপাতাসমেত রাস্তায় গিয়ে পড়ল। ভিখিরিতে আর পাল পাল কুকুরে সারারাত ছেঁড়াছিড়ি। প্রতিবেশীর ঘুম মাথায় উঠল। তিন দিন সকলের নাকে রুমাল! চিংড়ি মাছের খোলাপচা গন্ধে প্রাণ যায়।

মানুষ ঠেকে শেখে। পরিবেশন একটা আর্ট। অরগানাইজড ব্যাপার। পাড়ায় পাড়ায় প্রোফেশনাল পরিবেশনকারী তৈরি হয়ে গেল। যে-কোনও কাজেই এঁদের ডাক পড়ে। সমাজসেবীর মতো। পরিবেশন এক্সপার্ট। কোনটা কখন কী ডোজে ছাড়তে হবে কুঁচকি-কণ্ঠা ঠেসে আহারকারীর মুখ কীভাবে মেরে দিতে হবে—সব এঁদের জানা। যেমনি ম্যানেজমেন্ট, তেমনি স্পিড! কাউকে নাভিশ্বাস ফেলতে দেবেন না। খেলে খেলে কেঁকে বেঁকে খাবে ওটি হচ্ছে না। ধপাধপ ফেলো আর সরে পড়ো। একবারের বেশিদু-বার নয়। খুব ঝুলোঝুলি করলে আর একবার ঘুরিয়ে দাও। কথায় আছে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ। জন্মের ব্যাপারে ডাক্তার। কিন্তু বিবাহ আর মৃত্যুতে এইসব পরহিব্রতীর তুলনা নেই। পোড়ানোর দল আর পরিবেশনকারীর দল সব পাড়াতেই আছেন। দাবি সামান্য। শ্মশানে যাবার সময় নতুন গামছা, পরিবেশনের জন্যে একটি তোয়ালে, পরে। একদিন খাওয়া।

আগে খাওয়ানো হত পাতা পেড়ে। সে একটা লন্ডভন্ড ব্যাপার। শ্যাওলা-পিছল উঠোনের ওপর দিয়ে স্কেট করতে করতে রকে গিয়ে ওঠো। সেখান থেকে ডাইনে বাঁক নিয়ে খাড়া সিঁড়ি। সিঁড়িটা ওপরে উঠেছে। অপ্রশস্ত। সরু। একদল খেয়ে নামছে, আর একদল খেতে উঠছেন। দেয়ালে কনুই লেগে ঘেঁচে নুনছাল উঠে যাচ্ছে।

এরই মাঝে দমকা নেমে আসছেন খোঁপায় ফুল গোঁজা কোনও উত্তাল তরুণী। তাঁর আর চোখে কানে দেখার মতো অবস্থা নেই। পুষ্পিতা, পুষ্পিতা! পা বাড়িয়ে, আঁচলের ঝাপটা মেরে চশমা সরিয়ে, টালমাটাল খাইয়ে তিনি নেমে চলেছেন, দুটো মানব বাচ্চা গুতোতে তোতে উপরে উঠছে। লাল সিঁড়িতে জল আর রসগোল্লার রস মাখামাখি। পিছন পথে এই অভিসার। শেষ হবে। ছাদে গিয়ে। সিঁড়ির দরজাটা নীচু হওয়াই স্বাভাবিক। ধাঁই করে প্রথম ব্যক্তিটির কপাল ঠুকে গেলে আলু হওয়া মাত্রই গৃহস্বামীর তরফের কেউ একজন ওপরে উচ্চারণ করবেন, মাথা নীচু করে, মাথা থেকে, আহ, আহা, করে সাবধানবাণী, নীচু করে। ছাদের একপাশে ডাঁই করে জুতো জমবে। জুতোর ওপর জুতো, তার ওপর জুতো।

ছাদের কড়কড়ে কালো বালির ওপর সরাসরি ছেঁড়া, ফাটা কলাপাতা। একপাশে নেতিয়ে পড়ে আছে বেগুনভাজা, ছোলা দিয়ে শাকভাজা। কড়কড়ে নুন, লেবুর টুকরো। ম্যাগনাম সাইজের একটা ঠান্ডা লুচি। দখিনা বাতাস ছাদে হালকা আঁচল ছড়িয়ে দিয়েছে। সারি সারি চেটাইয়ের আসন। বালিমাখা মাটির গেলাস, দই খাবার খুরি একটি। কম জায়গায় অনেককে বসাতে হবে। এর পশ্চাদ্দেশ ওর পশ্চাদ্দেশে ধাক্কা মারছে। পাশের ভদ্রলোকের হাঁটুর ওপর হাঁটু উঠে পড়েছে। পাতের সামনে দিয়ে অনবরতই ব্যস্ত পায়ের আনাগোনা। জল আর নুন দেওয়ার দায়িত্ব ছোটদের। জলের জাগ নিয়ে পঙক্তির সামনের দুজনে ধুম কাড়াকাড়ি। এ বলে আমি দোব, ও বলে আমি। ফ্যাচাক করে জল ছিটকে সব ভিজে গেল। জলের গেলাসে গোটাকতক ফুটো থাকবেই। জল ঢালার সঙ্গে সঙ্গে শুষে নেওয়ার চিনচিন শব্দ উঠবে। কিছু গেলাসের তলা থেকে ফোঁস করে জলের ধারা বেরিয়ে আসবে। ওরে, ফুটো, ওরে ফুটো বলতে বলতেই লয়াবয়া জলের ধারা ঢাল বেয়ে বিপরীত দিকের পাতা ছুঁড়ে আসন ভেদ করে কাছাকোঁচা ভিজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। আহা গেল গেল বলে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে বিপর্যয় আরও বেড়ে বেল। দু-চারটে গেলাস আবার উলটে গেল। বেশ থই থই ব্যাপার। থিতোবার আগেই পাতে দমাদ্দম পড়তে লাগল ছ্যাঁচড়া, কুমড়োর ছক্কা, মাছের মুড়ো ঘাঁটা আসল ডাল। চিঙ্কার উঠল, গরম লুচি আনো, গরম লুচি আনন। পরিবেশনকারীরা সামনে মত্ত হাতির মতো ছোটাছুটি করছেন। মাথার ওপর। দিয়ে লুচির ঝুড়ি টপকে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় পাঞ্জাবিতে ফোঁটা ফোঁটা তেলের স্মৃতিচিহ্ন ফেলে যাচ্ছে। নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ডালের বালতি, পোলাও, ছ্যাঁচড়া। অনবরতই কানের কাছে নামতার মতো শুনছি, আপনাকে, আপনাকে। লাজুক লাজুক গলায় যেই বললেন, একটু। নাগরদোলার মতো বালতি ঝপ করে ওপর দিয়ে উঠে গেল। ঘটাং করে হাতার শব্দ হল। গোল করে পাতে পড়ল কিছু। পড়েই গড়াতে আরম্ভ করল কোলের দিকে। না-খাওয়া জিনিস পাতার মাথার দিকে ঠেলতে ঠেলতে চিনের প্রাচীর তৈরি হয়েছে। কলাপাতার ফাটা অংশ দিয়ে বালি উঠে এসেছে। মাঝখানের ছিটে উঠোনে সর্বধর্মসমন্বয়ের খেলা চলছে। ডালেতে, ছ্যাঁচড়াতে, মাছের ঝোলেতে, মাংসের হাড়েতে ধাপার মাঠের চেহারা। সেই রসে যুক্ত হল আর এক রস। ছ্যাৎ করে একঝলক চাটনি এসে পড়ল। তখন প্ল্যাস্টিক-স্ল্যাস্টিক চালু হয়নি। আমড়ার আঁটি তেলতেলে রসে চুর হয়ে আছে। আঁটিটা হাত দিয়ে চেপে ধরতে গিয়ে স্লিপ করে বুলেটের মতো পাতা থেকে বেরিয়ে তার স্বাচ্ছন্দ্য বিহারের উলটো দিকের জ্যাঠামশাইয়ের পাতে দইয়ের ওপর ল্যান্ড করল।

যাক, খাওয়া শেষ। মুখে পান। গেলাসে গেলাসে নুন দিয়ে লেবু দিয়ে হাত ধোওয়া ঘোলা ঘোলা জল। প্রচুর অপচয়ের রণক্ষেত্র পেছনে পড়ে রইল। গৃহস্বামী হাত কচলে বলছেন, কিছু অসুবিধে হয়নি তো! হয়ে থাকলে মাপ করবেন। জুতোর জায়গায় এসে চক্ষুস্থির। ওয়াটালুর যুদ্ধক্ষেত্রের মতো অবস্থা। উলটে পালটে চিত হয়ে উপুড় হয়ে রামবাবু, শ্যামবাবু, যদুবাবু একাকার। শেষ পর্যন্ত শুধু পায়ে রাস্তায়। কে মেরে দিয়েছে নতুন চটিজোড়া। গায়ে গরদের পাঞ্জাবি, পরনে চুনোট করা কাঁচি ধুতি, খালি পা—নিমন্ত্রিতরা খাওয়া শেষে বাড়ি ফিরছেন।

এখন আর সেসব সমস্যা নেই। টেবিলে খাওয়ার চলন হয়েছে। সারি সারি ফোল্ডিং চেয়ার। দু পাশে দুটো কাঠের এক্স, ওপরে একটা তক্তা পাতা। তার ওপর নিউজপ্রিন্ট, তার ওপর কলাপাতা। খেয়ে আরাম, খাইয়ে আরাম, তদারকি করে আরাম। হাঁটুর ধাক্কা লেগে খাট খুলে। মাঝেমধ্যে টেবিল খুলে কোলের ওপর পড়তে পারে। তবে কথায় আছে, নো রিস্ক নো গেন। ফোল্ডিং চেয়ার উলটে অবোধ শিশু হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে। তা পড়ুক। তেমন সব বেপরোয়া খাইয়েও আর নেই যাঁরা প্রাণের মায়া ছেড়ে এক-একটা আইটেম ফাঁক করে সারারাত বাড়ির ছাদে মাদুর পেতে খুঁড়িতে ভিজে গামছাটা চাপিয়ে শুয়ে থাকবেন। পাশে এক ঘড়া খাবার জলে রবারের নল। চুকচুক করে চুষে চুষে জল খাচ্ছেন। ভোরেই সব হজম। এখনকার পেটে সামান্য কিছু ঢুকলেই শেয়ারহোল্ডারদের মিটিং শুরু হয়ে যায়। কত রকমের প্রিকশান? প্রথমে অ্যান্টিঅ্যামিবিক ওষুধ বিছিয়ে তার ওপর কালিয়া পোলাও ফেলো! তার ওপর আর এক পরত অ্যান্টিঅ্যামিবিক, তার ওপর ঝুরো ঝুরো অ্যান্টাসিড।

খাইয়েদের একটা নতুন শাস্ত্র গড়ে উঠেছে। পাতের আজেবাজে মাল ঠুকরে যাও। অপেক্ষায়। থাকো। এক চামচে ফ্রায়েড রাইস মেরেই খানচারেক পাকা পোনার দাগা উড়িয়ে দাও। ঝোল টাচ করবে না। মাংস না ছোঁয়াই ভালো। দই পেট ভার করবে। একটু প্লাস্টিক চাটনি। গোটাকতক মিষ্টি। ভিজে লেবুর টাকনা। জল স্পর্শ করবে না। হাতে নুন মেখে গেলাসে ডুবিয়ে দাও। খানিকটা নিউজপ্রিন্ট ছিঁড়ে হাত মুছে ধরি মাছ না ছুঁই পানি করে বেরিয়ে এসো। প্রেজেন্টেশান আগেই দেওয়া হয়ে গেছে।

ইতিমধ্যে কেটারিং সার্ভিস চালু হয়ে আমন্ত্রণকারীদের ঝঞ্জাট অনেক কমে গেছে। ভোর-রাতে শেয়ালদা ছুটতে হবে না মাছ কিনতে, নতুনবাজারে ছানা, বউবাজারে মাংস। সারাদিন। হালুইকরদের চোখে চোখে রাখতে হবে না, হুঁকোর মধ্যে তেল ভরল কী পেটকাপড়ে মশলা। মেজোকত্তাকে চেয়ার পেতে ভাঁড়ারে বসতে হবে না পাহারা দিতে। সন্ধে হয়ে গেল এখনও দই এল না বলে বড়গিন্নি বাড়ি মাথায় করবেন না। উর্দিপরা পরিবেশনকারী কাচের প্লেটে ছাঁকা ছাঁকা চোখা চোখা জিনিস সামনে ধরে দেবেন। শেষ পাতে একটি আইসক্রিম। গলায় মাফলার জড়িয়ে খাও। কাশতে কাশতে বাড়ি যাও। এদিকে অর্কেস্ট্রায় ঝমক ঝমক করে হিন্দি গানের সুর বাজছে, কুরবানি, কুরবানি, কুরবানি হো।

কার কোরবানি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *