বিবাহ বিবরণ
পাত্র দেখতে পাত্রীপক্ষ আসছে, তাও আবার ছয়জনের দল, যার অর্ধেক ছেলে, অর্ধেক মেয়ে, বেশ অবাক হলেন মুকুন্দচন্দ্র। খবরটা এনেছিল তার শালা শ্যামাপদ। বাউন্ডুলে স্বভাবের লোক, বউ মরে যাওয়ার পর যেন সব ব্যাপারে উৎসাহ বেড়ে গেছে। টেবিল চাপড়ে বলল, ‘বুঝলেন জামাইবাবু, মেয়েটিকে দেখে আমি যাকে বলে মুগ্ধ, তাই হয়ে গিয়েছি।’
মুকুন্দচন্দ্র শালাকে বোঝার চেষ্টা করলেন, ‘মুগ্ধ হওয়ার কারণ?’
‘একেবারে কল্পনার মতো। দেখলে মনে হবে যমজ।’ শ্যামাপদ বলেছিল।
কল্পনা মারা গিয়েছে বছর দশেক আগে। বেশ মিষ্টি দেখতে ছিল মেয়েটা। মুকুন্দদাস ওকে খুব পছন্দ করতেন। দিঘার সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছিল। সাঁতার না জানা সত্ত্বেও শ্যামাপদ নাকি জলে ঝাঁপিয়েছিল বউকে বাঁচাতে যা মুকুন্দদাস পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি।
জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত লোকের আসার কী দরকার, দুজন এসে কথা পাকা করে গেলেই তো হত।’
‘বুঝছেন না,’ শ্যামাপদ মাথা নেড়ে বলল, ‘তিনজন পাত্রীর মায়ের তরফের তিনজন বাপের দিকের। আমি অনেক অনুরোধ করেছিলাম দুপুরে এসে খাওয়া—দাওয়া করে পাত্রকে দেখতে কিন্তু ওরা আসবে সকাল আটটায়। নটা—দশটায় ফিরে যাবে জলখাবার খেয়ে!’
মুকুন্দচন্দ্র সোজা হলেন, ‘সেকি! অত সকালে কেন?’ বশিষ্ঠ, ভৃগু ও নারদ—ইত্যাদি ঋষিদের উদ্দেশে জলদান করা হয়। এরপর পিতামহ ভীষ্মের উদ্দেশে তর্পণ করা হয়, তারপরই পিতৃলোকের উদ্দেশে চলে জলদান। সমস্ত অনুষ্ঠানটির মধ্যে আমাদের ভারতবর্ষের সংস্কৃতির মূল ভাবনাটি, বা ভিত্তিভূমিটি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। মহালয়ার পরেই চন্দ্রের গতি অনুযায়ী শুরু হয় শুক্লপক্ষের বা দেবী পক্ষের। এই অমাবস্যা থেকে পরের পূর্ণিমা পর্যন্ত আমাদের আরাধনার কাল। সেই আরাধনার সূচনা হয় মহালয়ার পিতৃঅর্চনার মধ্য দিয়ে। এরপরেই দেবীপূজার মূল অংশে ধীরে ধীরে প্রবেশ করি আমরা।
শরৎকালে দেবীর আরাধনা হয় বলে এই পূজা শারদীয়া। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে ও কাঠক সংহিতায় দেবী অম্বিকাকে ‘শত’ রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে ‘শরদ্বৈ অম্বিকা’। শরৎ রূপিণী অম্বিকার পূজা বলেই তা শারদীয়া। পণ্ডিতগণ বলেন, এ হল অকালবোধন। সূর্যের গতিপথে এ সময় দক্ষিণায়ন। শ্রাবণ থেকে পৌষমাসে দক্ষিণায়নের সময়। এ সময় দেবতারা নিদ্রিত থাকেন। ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র রাবণবধের উদ্দেশে নিদ্রিত দেবীকে উদবোধিত করে পূজা করেছিলেন। তাই এই পূজা অকালবোধন নামে খ্যাত। যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি তাঁর ‘পূজা—পার্বণ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ঋগবেদের ঋষিগণ রবির উত্তরায়ণ হইতে বৎসর আরম্ভ করিতেন। হিম অর্থাৎ শীত ঋতুতে আরম্ভ এই কারণে তাঁহারা ‘হিম’ শব্দে বৎসর বুঝিতেন। শত হিম বললে শত বৎসর বুঝাইত। কতকাল পরে কে জানে, তাঁহারা শরৎ ঋতু হইতেও আর এক বৎসর গণিতে আরম্ভ করেন। এই বৎসরের নাম ছিল শরৎ। শতং শরদঃ জীবতু—শত শরৎ বাঁচিয়া থাক—এইরূপ আশীর্ব্বচন ছিল। ইহা অদ্যপি শুনিতে পাই।’ এই শরৎকালকে কেন্দ্র করেই পরিস্ফুট হয়েছে দেবীর শস্যদায়িনী রূপ।
শস্যের সঙ্গে দেবীর নিগূঢ় সম্পর্ক! মহেন—জো—দারোর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে আমরা এমন এক নারীর দেখা পাই, যাঁর গর্ভ একগুচ্ছ শস্যে শোভিত। দেবীর আর—এক রূপ হল তাঁর শস্যবধূ রূপ। এই শস্যবধূকে আমরা বলি নবপত্রিকা। নয়টি গাছের সমাহার নবপত্রিকায় কলাগাছের সঙ্গে থাকে কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, মানকচু, অশোক এবং ধান। আবার প্রত্যেকটি শস্যের জন্য পৃথক পৃথক দেবী নির্দিষ্ট আছেন। কলা গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ব্রাহ্মণী, কচুর কালিকা, হরিদ্রার দুর্গা, জয়ন্তীর কার্তিকী, বেল গাছের জন্য দেবী শিবা, ডালিম গাছের দেবী রক্তদন্তিকা, অশোকের শোকরহিতা, মানকচুর চামুণ্ডা এবং ধান্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন লক্ষ্মী। নবপত্রিকার নয়টি শস্যতে দেবীর অধিষ্ঠান কেন? এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে দেবীর গাত্রবর্ণ হলুদরঙের তাই নবপত্রিকায় হলুদের স্থান দেবী জয়রূপিণী বলে জয়ন্তী দেবী রূপে পূজিতা। তিনি মানদায়িনী তাই মানকচুর সঙ্গে তাঁর যোগ। বেল শঙ্করের প্রিয়, তাই দেবীর বিল্ববৃক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড়। তিনি মানবের শোকহরণ করেন তাই অশোক গাছ তাঁর অধিষ্ঠান। জীবের প্রাণস্বরূপিণী দেবী জীবের প্রাণ প্রদানকারী মূল অন্ন ধান্যে বিরাজিতা। তাই ধান নবপত্রিকায় স্থানলাভ করে। অসুরবিনাশকালে দেবীর দন্ত ডালিমফুলের মতো রক্তবর্ণ ধারণ করেছিল। দেবী এর ফলে রক্তদন্তিকা নামে খ্যাত হন। দেবীর রক্তদন্তিকা রূপের জন্য ডালিম স্থান পান নবপত্রিকাতে। এইভাবে বিভিন্ন শস্যের সঙ্গে দেবীকে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেবীর শাকম্ভরী রূপটিও সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে। শস্যদায়িনী রূপে দেবীর দশটি অস্ত্রের সঙ্গে দশরকমের শাককেও যুক্ত করা হয়েছে। এরা হল, পত্র অর্থাৎ পাতা, অগ্র, মূল, করীর, ফল, কাণ্ড, অস্থিরূঢ়ক, ত্বক, ফুল, কবক। এখানে দশরকমের শাকের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলি হল বৃক্ষেরই এক একটি অংশ। আমাদের জীবনের নানা অংশ, পিতৃপুরুষ বন্দনা থেকে শাকান্ন পর্যন্ত দেবীপূজার সঙ্গে জড়িত।
বর্তমানে দেবী পূজা কয়েকটি পদ্ধতি মতে সম্পন্ন করতে হয়। সাধারণত বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণোক্ত পদ্ধতি, দেবী পুরাণ ও কালিকা পুরাণোক্ত পদ্ধতিকে ব্যবহার করা হয়। কালিকাপুরাণে দেবীর মূর্তি তিন রকম—একবার ইনি উগ্রচণ্ডা অষ্টাদশ ভুজা, একবার ভদ্রকালী ষোড়শভুজা, একবার দুর্গা, কাত্যায়নী দশভুজা। এই তিনমূর্তিতেই দেবী মহিষমর্দিনী। এই পুরাণে ষাট অধ্যায়ে দেখা যায়—প্রথম সৃষ্টিতে মহিষাসুরকে উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয় সৃষ্টিতে ভদ্রকালীরূপে, এখন দুর্গারূপে তাঁকে বধ করছেন দেবী। দেবীপুরাণে শুক্লপক্ষের প্রতিপদ থেকে নয় রাত্রি দেবীর পূজার কথা বলা হয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রামায়ণের অকাল বোধনের কাহিনি। সীতা উদ্ধারের জন্য রাবণকে বধ অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু দেবীকৃপায় পুষ্ট লঙ্কারাজকে বধের জন্য দেবীর আরাধনা করা প্রয়োজন। তাই দেবকুলের নিদ্রার সময়, দেবীকে জাগরিত করে পূজার আয়োজন করেছিলেন দশরথ পুত্র রাম। শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে তাই বিল্ববৃক্ষে দেবীর বোধনের আয়োজন এবং তারই মাধ্যমে দেবী পূজার সূচনা। ঘুমন্ত দেবীকে প্রথমে জাগ্রত করতে হবে, তারপর তাঁর পূজার আয়োজন! তাই অকালবোধনের কাহিনি, দেবী পূজায় একটি নতুন মাত্রা সংযোজিত করেছে। সব নিয়েই আমাদের বর্তমান দুর্গোৎসব।
‘পাত্রীর মামা বললেন, সকালে মন ভালো থাকে, সত্যিকারের চেহারাটা ভালো বোঝা যায়। মানে, সকালে তো কেউ চট করে মেকআপ নেয় না, তাই।’
‘মেকআপ! কী আশ্চর্য! ওরা কি মেয়েছেলে পাত্র দেখতে আসছে?’
‘এই আপনার মুশকিল জামাইবাবু। চিরকাল ব্যাকডেটেড থেকে গেলেন। আজকাল কেউ ছেলে বা মেয়ে নয়। সবাই ইউনিসেক্স। যাই, দিদিকে সব ভালো করে বুঝিয়ে বলে যাই।’ শ্যামাপদ ভেতরে চলে যেতেই বাইরে থেকে শান্তিময় মুখ নিচু করে ঘরে ঢুকল। মুকুন্দচন্দ্রের সামনে দিয়ে সে ভেতরে চলে যাচ্ছিল, কাশি শুনে দাঁড়াল।
মুকুন্দচন্দ্র বললেন, ‘তোমার মামা খবর এনেছেন, আগামী রবিবার সকাল আটটায় পাত্রীপক্ষ তোমাকে দেখতে আসছেন। তুমি ভোর ছটার আগেই ঘুম থেকে উঠে দাঁত মেজে, দাড়ি কামিয়ে স্নান সেরে নেবে। তারপর পরিষ্কার পাজামা—পাঞ্জাবি পরে ওদের জন্যে অপেক্ষা করবে।’
শান্তিময় মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
‘তোমাকে ওরা যা যা প্রশ্ন করবে তার ঠিকঠাক জবাব দেবে।’
শান্তিময় এবার মুখ তুলল, ‘কী কী প্রশ্ন?’
‘সেটা আমি কী করে বলব?’ মুকুন্দচন্দ্র বিরক্ত হলেন।
‘আঁচ পেলে ভালো হত, তৈরি থাকতাম।’
‘তোমার মামাকে জিজ্ঞাসা করো, তিনি বলতে পারবেন। যাও।’
প্রশ্ন শুনে শ্যামাপদ ভাগ্নের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলেন, ‘তোর নাম জিজ্ঞাসা করবে, কত মাইনে পাস জানতে চাইবে। অসুখবিসুখ আছে কিনা, ঘুমালে নাক ডাকে কিনা জেনে নিয়ে হয়তো হাঁটতে বলবে।’
‘হাঁটতে বলবে কেন?’ শান্তিময় অবাক হল।
‘পুরুষোচিত হাঁটা কিনা দেখতে চাইবে। হয়তো গান গাইতে বলবে।’
‘গান? ওরে বাবা, আমি তো…।’
‘জানি, তোদের বংশে কারও গলায় সুর নেই তা জানি। মায়ের কোনো গুণ যদি এক ফোঁটা পেতিস তাহলে বর্তে যেতিস।’
পাশে বসা মা আপত্তি করল, ‘আঃ, কী যা তা বলছিস?’
‘থামো তো? সত্যি কথা শুনতে খারাপই লাগে। আর হ্যাঁ, বিয়ের পর বউমাকে তুই, তুমি, আপনি, কী বলে সম্বোধন করবি জানতে চাইতে পারে।’
‘এ আবার একটা প্রশ্ন হল? আপনি বলব।’
‘হয়ে গেল! যেমন বাপ তেমন ছেলে! ওসব ব্যাকডেটেড ব্যাপার। আজকালকার ছেলেমেয়েরা বিয়ের পর তুই তোকারি করে শুনিসনি!’
মা বলল, ‘ইস। শুনলে সাঁওতাল মনে হয়।’
‘কালচার, লোকসংস্কৃতি। লেটেস্ট ফ্যাশান।’
পাত্রীপক্ষ এল, জমিয়ে গল্প করল, চা—জলখাবার খেয়ে চলে গেল, পাত্রকে একটাও প্রশ্ন করল না। যাবার সময় সম্মতি জানিয়ে গেল।
এবার মুকুন্দচন্দ্র শ্যালক শ্যামাপদকে নিয়ে পাত্রী দেখতে গিয়ে একইরকম সৌজন্য দেখানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু শ্যামাপদকে সামলাতে পারলেন না। জামাইবাবু কেন প্রশ্ন করছেন না দেখে শ্যামাপদ মুখ খুলল, ‘আচ্ছা মা, বিয়ের পর তুমি তোমার স্বামীকে কী বলে সম্বোধন করবে? তুমি, তুমি বা আপনি?’
‘আমার ঠাকুমা ঠাকুরদাকে আপনি বলতেন। আমার মা বাবাকে তুমিই বলে।’ পাত্রী, যার নাম দীপাঞ্জনা থামল।
শ্যামাপদ উৎসাহিত হল, ‘তাহলে তোমার তো তুই বলা উচিত।’
‘কেন? আমি কোনো সম্বোধন না করেও কথা বলতে পারি।’
‘যেমন?’ হকচকিয়ে গেল শ্যামাপদ।
‘কাগজটা পড়া হয়েছে? কতক্ষণ পরে বেরুনো হবে?’ দীপাঞ্জনা হেসে বলল, ‘এইরকম আর কী!’
আর প্রশ্ন করেনি শ্যামাপদ। মুকুন্দদাস দিন পাকা করলেন।
শান্তিময়ের বন্ধু সংখ্যা তিনজনের বেশি নয়। তারা দীপাঞ্জনার ছবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে বলল, ‘বাঃ বেশ দেখতে।’
বন্ধুদের কারও বিয়ে হয়নি কিন্তু বিস্তর পড়াশুনা। চারজনের একটা মিল আছে, কেউ সিনেমা দূরের কথা, টিভিও দ্যাখে না। বই ওদের জগৎ।
একজন বলল, ‘বিয়ের পর তুই বদলে যাবি শান্তি।’
‘কেন? বদলে যাব কেন?’ শান্তিময় প্রশ্ন করল।
‘সবাই নাকি যায় আমার ঠাকুমা এখনও বলে, বাবা নাকি বিয়ের পর বদলে গিয়েছে।’ প্রথমজন গম্ভীর মুখে বলল।
দ্বিতীয়জন বলল, ‘সবাই বদলে যায় না। কেউ কেউ ঠিক থাকে। যারা বউকে স্বভাবিত করতে পারে তারা ঠিক থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা আগুনের মতো। তুই সরাসরি আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে। কিন্তু একটা কাচের পাত্রে আগুন রেখে সেই পাত্রকে ধরলে কিছুই হবে না, উলটে ঘর আলোয় ভাসবে।
তৃতীয়জন বলল, ‘তাই বোধহয় প্রথম রাতে যারা বেড়াল মারতে যায় তারা সারাজীবন বউ—এর বেড়াল হয়ে থাকে।’
শান্তিময় এসব শুনে হকচকিয়ে গেল। বলল, ‘তাহলে আমি কী করব?’
বন্ধুরা পরামর্শ দিল, ‘প্রথম রাতেই বেড়াল মারতে যাস না।’
‘বেড়াল? সে কি বাপের বাড়ি থেকে বউ বেড়াল সঙ্গে নিয়ে আসবে?
প্রথমদা বলল, ‘প্রকাশ্যে বেড়াল নিয়ে কেউ যায়! অযাত্রা। এমনি বেড়াল নয়, প্যানিশ ছোট গল্পে পড়েছিলাম, বিয়ের ঘরের ভিতরে একটা পুষি বেড়াল থাকে। খুব আদুরে, তাকে চোখে দেখা যায় না। বুঝলি?’
শান্তিময় অনুমান করতে চেষ্টা করেও সক্ষম হল না।
বিয়ে হয়ে গেল। ছাঁদনাতলাতেই কয়েকবার আড়চোখে দেখার চেষ্টা করেছিল। শান্তিময় কিন্তু দীপাঞ্জনার চিবুক যেহেতু বুকের কাছে নামানো ছিল তাই হতাশ হয়েছিল। বিয়ের লগ্ন ছিল শেষরাতে, তাই বাসরের প্রশ্ন উঠল না। রাত জেগে মেয়ে নাকি ঘুমিয়ে কাদা। পরের দিন ফিরে আসা এবং কালরাত্রি। দেখাদেখি নেই।
তারপর ফুলশয্যার রাত, বন্ধুদের বিদায় দিয়ে ঘরের দিকে এগোনো মাত্র শ্যামাপদ তাকে ডেকে বলল, ‘আজ থেকে তোমার সত্যিকারের সংসারজীবন শুরু হচ্ছে। তুমি এমন কিছু করো না যা বউমাকে দুঃখ দেবে।’
ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল শান্তিময়।
শ্যামাপদ বলল, ‘যাও।’
ঘরের দরজা ভেজানো, বাইরে থেকে শব্দ করল শান্তিময়। দ্বিতীয়বারে দীপাঞ্জনার গলা ভেসে এল ভেতর থেকে, ‘দরজা খোলাই আছে।’
সামান্য চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে আবার সেটা বন্ধ করে তাকাল শান্তিময়।
ফুল দিয়ে চমৎকার সাজানো বিছানায় একপাশে বসে আছে দীপাঞ্জনা। তার হাতে বই। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল শান্তিময়ের, খাটের পাশে গিয়ে বলল, ‘বসতে পারি?’
‘অবশ্যই।’ হাসল দীপাঞ্জনা।
‘কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?’ কথা খুঁজছিল শান্তিময়।
‘বিন্দুমাত্র নয়।’
কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ চলে গেল। আবার মুখ খুলতে গিয়ে মামার উপদেশ মনে পড়ল, সোজা হয়ে বসল শান্তিময়। তারপর বলল, ‘তো—তো—তো—।’
‘শুনছি।’ দীপাঞ্জনা শব্দটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই বলল।
‘ঘুম পাচ্ছে নাকি?’ শান্তিময় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
‘একটু একটু।’
‘তাহলে শুয়ে প—প—।’ কিছুতেই ‘শুয়ে পড়’ মুখ থেকে বের হল না দীপাঞ্জনা হাসল, ‘শুয়ে পড়া যাক।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ—।’—শুয়ে পড়ল শান্তিময় বিছানার একপাশে।
মাঝখানে পাশবালিশ, দীপাঞ্জনাও বালিশে মাথা রাখল। কয়েক সেকেন্ড পরে শান্তিময় বলল, ‘ইয়ে, আমার না কোনো অভিজ্ঞতা নেই। মানে এক্সপেরিয়েন্স আর কী!’
‘ও।’
‘ভাবিনি তো।’
‘ও। স্কোপও ছিল না বোধহয়।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই।’ তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মুখ ফেরাল, ‘আছে নাকি?’
দীপাঞ্জনা গম্ভীর হল, ‘কী?’
‘ওই যে, এক্সপেরিয়েন্স!’
‘থাকলে কী হবে?’ বাঁকা গলায় জিজ্ঞাসা করল দীপাঞ্জনা।
‘তার মানে আমারই মতন, তাই না?’
‘হুঁ।’ দীপাঞ্জনা চোখ বন্ধ করল।
‘তাহলে আজ ঘুমিয়ে পড়া যাক।’
‘হ্যাঁ। গুডনাইট।’ হাসি চাপল দীপাঞ্জনা।
‘গুডনাইট।’ শান্তিময় বড় শ্বাস ফেলল।
বালিশে মাথা দিয়ে শান্তিময়ের মুখে একটা হতাশ্বাস বেরিয়ে এল।
—এ—দিনটা এ—রাতটা নিয়ে মানুষের কত স্বপ্ন থাকে, আমাদের ঝগড়া দিয়ে শুরু হল।
—বিয়ের আগে এক্সপেরিয়েন্সের কথাটা বলাই অন্যায় হয়েছিল। দীপা বলল।
শান্তিময় বলল—ঠিকই। আসলে আমার মুখে না—কথা আসছিল না।
এইবার দীপা বললে—তবে আমার ঠাকুমা বলেন, ফুলশয্যায় ঝগড়া হলে, পরে বাকি জীবন সুখে কাটে। আর যারা ফুলশয্যায় মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, পরে বাকি জীবন ঝগড়া করে। তোর ঠাকুরদার মতন।
শান্তি এবার উৎসাহে উঠে বসে। পাশবালিশটা সরিয়ে বলে — তাহলে তো জমিয়ে ঝগড়া করা যাক। তবে কী জানো— একটা শ্লোক আছে—অজা—যুদ্ধে ঋষিশ্রাদ্ধে প্রভাতে মেঘডম্বর। দাম্পত্যকলহে চৈব বহবারম্ভে লঘু ক্রিয়া। এর মানে হল— ছাগলে ছাগলে লড়াইয়ে মনে হয় কত না কী হবে, শেষে একটা ঢুঁ, ঋষিমশাই সকাল থেকে তোড়জোড় করছেন শ্রাদ্ধের, দান করলেন কি না একটা হরতকী, ভোরবেলায় মেঘ ডাকলে কদাচিৎ বৃষ্টি হয়। আর দাম্পত্যকলহ—ফাটাফাটি ঝগড়া—এই বুঝি দুজনে দুদিকে চলে গেল—আবার পরদিন দেখ—নিশ্চিন্তে ঘর—সংসার করছে।
প্রথম আড়ষ্টতা ভাঙতে শান্তি অনেকক্ষণ বকে গেল।
সব শুনে দীপা বলল—সর্বনাশ!
শান্তিময় অবাক হল। বলল—এতে সর্বনাশের কী হল?
দীপা জিজ্ঞেস করল—তুমি কি সংস্কৃতের পণ্ডিত নাকি! আমার দিদি, মাসতুতো দিদি রমাদি, বলেছিল—দীপু, খবরদার মাস্টার স্বামীর পাল্লায় পড়বি না। নয়তো আমার মতো, হেডমাস্টার স্বামীর পাল্লায় পড়ে জীবন ছারখার হয়ে যাবে! এটা উচিত নয়, ওটা উচিত নয়।
শান্তি হেসে বলল—মাস্টারও নই, সংস্কৃতপণ্ডিতও নই। আমি তো ব্যাংকে কাজ করি। শ্লোকটা জানা ছিল, তাই তোমার কাছে একটু বিদ্যে জাহির করলাম। এই মাত্র।
দীপাও এতক্ষণে সহজ হয়েছে। ঘরের আলো অনেকক্ষণ নিভেছে। দীপা বলল—ভাগ্যিস তোমাদের বাড়িতে ফুলশয্যায় আড়ি পাতার সেরকম কেউ নেই। না হলে আমাদের কথাবার্তা শুনে হইচই পড়ে যেত।
শান্তি বলল—ফুলশয্যা নিয়ে সব থেকে মিষ্টি মজার গল্প আছে শরদিন্দুর।
দীপা বলল—আমি পড়েছি। বর সবাইকে তাড়িয়ে যখন দরজা বন্ধ করতে যাবে, তখন ঘরের মধ্যেই কে বললে—এই কী হচ্ছে! বর আবার বাইরে যাবে, বউ তার জামা ধরে টেনে দেখালে, কড়িকাঠে একটা ময়না না কাকাতুয়া বসে।
শান্তি বলল—পাখিটা শেষকালে কী বলেছিল জানো?
দীপা বলল—জানি। জ্বালালে!
শান্তি মৃদু হেসে বলল—কেন বল তো?
দীপা এইবার লজ্জা পেল। বালিশে মুখ গুঁজে বলল—তুমি একটা অসভ্য। ধ্যেৎ।
শান্তি সাহস পেয়ে দীপার মুখটা তুলে নববধূকে প্রথম চুম্বন করল।