বিবাহবার্ষিকী

বিবাহবার্ষিকী

অপর্ণার পায়ের বুড়ো আঙুল ঝিনঝিন করছে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল। এখনই সামলাতে না পারলে এই ঝিনঝিন ভাবটা ছড়িয়ে পড়বে অন্য আঙুলগুলোতেও। বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার হবে।

রাগ হল মাথার জিনিস। রাগের লক্ষণ যদি কিছু ঘটে, তবে তাকে ঘটতে হবে মাথার কাছাকাছি। মাথা টিপটিপ করবে, ঘাড়ে টান লাগবে, ব্ৰহ্মতালুতে জ্বালা জাতীয় একটা অনুভূতিও হতে পারে। অপর্ণার ক্ষেত্রে উলটো ঘটে। তার রাগের লক্ষণ পায়ের দিকে শুরু হয়। ঝিঁঝিঁ ধরনের একটা ব্যাপার। অনেকে রাগ হলে মাথায় জল দেয়। অপর্ণা পায়ে জল ঢেলে দেখেছে। রাগ কমেনি, বরং পুরনো রাগের সঙ্গে নতুন আর একটা রাগ তৈরি হয়েছে। জল ঢালার রাগ।

সুতরাং আজও জল ঢেলে লাভ হবে না। অন্যভাবে কিছু করতে হবে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে অপর্ণা নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল।

আজ অপর্ণা এবং সুমিতের বিবাহবার্ষিকী। একাদশতম বিবাহবার্ষিকী। এগারো নম্বর বিয়ের দিন আহামরি কোনও ব্যাপার নয়। জন্মদিন আর বিবাহবার্ষিকীর এই একটা গোলমাল। তারা প্রথমদিকে এবং পরের দিকে গুরুত্বপূর্ণ। মাঝের দিকগুলো হেলাফেলার। গতকাল রাতে অপর্ণা-সুমিত দু’টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক নম্বর সিদ্ধান্ত হল, কোনও বাড়াবাড়ি নয়। নো অনুষ্ঠান। দু’নম্বর সিদ্ধান্ত হল, আজ তারা কিছুতেই ঝগড়া করবে না। শত প্রলোভন এলেও না।

অপর্ণার এখন মনে হচ্ছে, বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। ঝগড়া বিষয়ে সিদ্ধান্তটি নেওয়া ঠিক হয়নি।

এই সকালেই তার রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করছে। বিবাহবার্ষিকীর দিন যে-স্বামী বাজার থেকে বড়সড় একটা থোড় কিনে আনে, তার সঙ্গে ঝগড়া না-করাটা একটা অন্যায় কাজ। পটলের মা গত সপ্তাহে খুব স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, থোড় সে কাটতে পারবে না। তার জন্য যে-কোনও রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে সে রাজি। এমনকী সেরকম হলে থোড়ের জন্য সে কাজ ছেড়ে দেবে। সুমিত এই হুমকির কথা জানে না তা নয়। তবু জেনেশুনে সে আজও একটা নধর গোছের থোড় নিয়ে এসেছে। শুধু নিয়ে আসেনি, আনার পর নিশ্চিন্ত মনে সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে।

অপর্ণার মনে হচ্ছে, এই সময় আলোচনা হওয়া উচিত এরকম:

— থোড় এনেছ কেন?

— এ প্রশ্ন করছ কেন, অপর্ণা? খাওয়া ছাড়া থোড়ের অন্য কোনও ইউজ কি তোমার জানা আছে? আমার নেই। ভাল করে রান্না করো। ঝাল কম দিয়ো। আজকাল তোমার হাতে ঝালটা একটু বেশি হচ্ছে।

—খুবই অন্যায় হচ্ছে। মাপ করে দিয়ো। তবে তুমি একটা কাজ করো। ভবানীপুরে ফোন করে তোমার মাকে বরং একবার এখানে আসতে বলো। আজকাল ওনার মুখে ধারটা একটু বেশি হচ্ছে। থোড় কাটতে ধার একটু বেশিই লাগে। উনিই বরং কেটে দিয়ে যান।

— আহা, তুমি অমন করে বলছ কেন? ভাবটা এমন করছ যেন আমি আজ বাজার থেকে শুধু থোড় এনেছি! তা তো নয়। গলদা চিংড়িও এনেছি। চিংড়ি তো তোমার হট ফেভারিট— তাই না? জানোই তো আমার চিংড়ি স্যুট করে না। খেলে কান চুলকায়। জানো না? জানো, অবশ্যই জানো। তোমার বাপের বাড়িতেও সকলে জানে। তবু নেমন্তন্ন করলে ওরা চিংড়ি আনায়। আমার মনে হয়, ইচ্ছা করেই আনায়— যাতে আমার কান চুলকোয়। তোমার কী মনে হয়?

— আমার মনে হওয়াটা বড় কথা নয়। আমার বাপের বাড়িতে না হয় দুশো টাকার চিংড়ি খাওয়ায়, তোমার বড়লোক মামা-মাসির বাড়িতে কী খাওয়ায় সেটা কি তোমার মনে আছে? বেশিরভাগ দিনই চা, শুধু চা। সারাগায়ে অত হিরে মুক্তো পরে শুধু চা দিতে বারণ কোরো। এতে শরীরে মেটালিক রিঅ্যাকশন হয়।

কিন্তু এ আলোচনা আজ করা যাবে না। আজ সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আজ তাই আলোচনাটা হল এরকম:

অপর্ণা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘থোড় এনে ভালই করেছ। ক’দিন ধরে আমি থোড়ের কথাই ভাবছি।’

সুমিত খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, ‘আরে না না, আজ একদম থোড়ফোড় আনতে চাইনি। আজ এসব ঝক্কির জিনিস কেউ আনে? আনাজওলা জোর করে গছিয়ে দিল। বিচ্ছিরি লাগছে।’

অপর্ণা বলল, ‘থাক, আর ছি ছি করতে হবে না। তোমার প্রিয় জিনিস। আজ আনবে না তো কবে আনবে? ভাল করে রাঁধব’খন। একটু বেশি মিষ্টি দেব ভাবছি। আর থোড় খাওয়া ভাল। নীচের ফ্ল্যাটের জেঠিমা বলছিল, থোড়ে দারুণ রক্ত হয়। বাপিরও ভাল হবে। সেদিন খেলতে গিয়ে কতটা যে কেটে এল। ইস! অনেকটা রক্ত গেছে।’

বাপির নাম শুনেই সুমিতের শরীরে একটা কাঁপুনি এল। মানুষের শরীরে কাঁপুনি আসে প্রধানত দুটো কারণে। ভয়ে আর ম্যালেরিয়ায়। সুমিতের আসে রাগে। কাঁপুনি বাইরে থেকে দেখা যায় না। ভেতরে ভেতরে তরঙ্গের মতো ছড়াতে থাকে। তখন সুমিতকে উঠে পায়চারি করতে হয়। ফ্ল্যাটের এ-মুড়ে থেকে ও-মুড়ে। এই পর্যায়ে অপর্ণা গুনগুন করে গান করবে। রবি ঠাকুরের ঋতু পর্যায়ের কোনও গান। তবে গানের ভান সে বেশিক্ষণ টেকাতে পারবে না। সুমিত চেঁচালে সেও গলা তুলবে। এবং অবধারিতভাবে জিতবে। সুমিতের ধারণা, খারাপ জিনিস ভগবান কম করে দেন। ভালর সময় তাঁর হাত থাকে দরাজ। যেমনটা ঘটেছে অপর্ণার ক্ষেত্রে। সুন্দর মুখ, সুন্দর হাসি, সুন্দর রান্নার গুণের সঙ্গে ভগবান তাকে সুন্দর ঝগড়ার ক্ষমতা দিয়েছেন।

ক্লাস ওয়ানে পড়া ছেলের নাম শুনলে বাবার রেগে যাওয়ার কোনও যুক্তিসম্মত কারণ নেই। কিন্তু ছেলে যদি স্কুলের ডিকটেশন পরীক্ষায় শূন্য পেয়ে আসে, তা হলে বাবার না রেগে বসে থাকাটা নীতিগতভাবে অন্যায় কাজ।

বাপির ক্লাস পরীক্ষা ছিল গতকাল। গতকালই যদি সে জানত নম্বর শূন্যে নেমে এসেছে, তা হলে অপর্ণার সঙ্গে ঝগড়া সংক্রান্ত কোনও চুক্তিতেই যেত না। বাপির খাতা সে কাল দ্যাখেনি। দেখল আজ। বাপির পড়ার টেবিলে পড়ে ছিল। আচ্ছা, এর জন্যই অপর্ণা ঝগড়ার ব্যাপারটা বানায়নি তো? হতেও পারে। কারণ এই শূন্য তো বাপির শূন্য নয়, এই শূন্য হল অপর্ণার শূন্য।

সুমিতের খুব ইচ্ছে করছে, এখন অপর্ণাকে সে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি জানো, বাপি কাল ডিকটেশনে কত পেয়েছে?’ বললেই আলোচনাটা দাঁড়াবে এই রকম:

— এমন করে কেন বলছ? বাপির পড়াশোনার কোনও খবর তুমি রাখ কি? সারাদিন তো ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকো। আমি জানি ও জিরো পেয়েছে।

— বাঃ জানো দেখছি। আচ্ছা, তুমি কি এটাও জানতে যে বাপির পরীক্ষা হবে?

— হ্যাঁ, জানতাম।

— ভেরি গুড়। একে বলে মার্ডার ইন কনসেন্‌স। সজ্ঞানে হত্যা। তুমি তা হলে জেনেশুনে বাপির পরীক্ষাটাকে খুন করেছ?

— কেন? পরীক্ষা তো আমি দিতে যাইনি। তোমার কি মনে হয়, আমি দিয়েছি?

— না, পরীক্ষা দিতে যাওনি ঠিকই, কিন্তু পরীক্ষার আগের দিন বাপিকে নিয়ে দাদার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলে।

— বেড়াতে মোটেই যাইনি। বউদির পায়ে চোট লেগেছে, তাই দেখতে গিয়েছিলাম। গতবার বাপির ফাইনালের আগে তুমি তিনবেলা ঠেলে হাসপাতালে তোমার পিসিকে দেখতে পাঠাতে না? তাও যদি নিজের পিসি হত! শুনেছি মাসতুতো পিসি।

— পিসির অপারেশন হয়েছিল। তোমার বউদির তো অপারেশন হয়নি।

— আজকাল পয়সা থাকলে ইনফ্লুয়েঞ্জাতেও অপারেশন হয়। ওটা বড় কিছু নয়।

কিন্তু ইচ্ছে হলেই সব বলা যায় না। এখনও গেল না। চুক্তি যদি ভাঙতে হয়, তা হলে অপর্ণাই আগে ভাঙুক। সে কেন দোষের ভাগী হবে? ফলে যা বলার, মনের ইচ্ছে গোপন করে বলতে হল। সে বলল, ‘অপর্ণা, বাপি দেখলাম ডিকটেশনে তেমন ভাল করেনি।’

অপর্ণা মনমরা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘তুমি অত চিন্তা কোরো না। ক্লাসপরীক্ষায় ওরকম এক-আধবার হয়। বাচ্চার পরীক্ষা নিয়ে বাড়াবাড়ি ভাল নয়।’

‘না গো, দোষটা আমারই। আগের দিন ফট করে দাদার ওখানে চলে গেলাম।’

‘আরে, সে তো যেতেই হবে। বউদি আছে কেমন? ছিঃ, আমার একটা ফোন করা উচিত ছিল।’

অপর্ণা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘রাখো তো বউদি। চোট না ছাই। খাটের কোনায় একটু লেগেছে, তাই নিয়ে একেবারে তুলকালাম। এক্সরে ফেক্সরে করিয়ে একাকার।’

‘না না, এক্সরে করিয়ে ভালই করেছে। আজকাল ছোট থেকে কত কী বড় হয়ে যায়। আমাদের অফিসে..’

‘রাখো তোমাদের অফিস। বউদির এসব বানানো। রান্নাঘরে না ঢোকার প্ল্যান। ক’দিন বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়বে। এরকম আলটুসকি হলে চলে? তোমার পিসিমাকে একবার দ্যাখো তো! দেখলে কত ভাল লাগে। অ্যাঁ! অত বড় একটা অপারেশন হল, তারপরেও গটমট করে চলছেন। বয়স তো কম হল না!’

সুমিত অপর্ণার মুখের কথা একেবারে লুফে নিল, ‘শুধু আমার পিসির কথা বলছ কেন? তোমার দিদিরটাও বলো। মহিলা কিছু কাজ করতে পারেন বটে। তোমার বিয়ের সময় কী খাটানটাই খেটেছিলেন! আজও মনে আছে।’

সুমিতের মনে হল, সে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছে। যে-কোনও সময় পড়ে যেতে পারে। সারাটা দিন তাকে এইভাবে হাঁটতে হবে? সুমিতের দমচাপা একটা ভাব আসিছে।

অপর্ণাদের রান্নাঘরের আয়োজন আধুনিক এবং মূল্যবান। গ্যাস, মাইক্রোওয়েভ উনুন, রাইস কুকার, মিক্সি সবই আছে। রান্না করার পরিশ্রম নেই বললেই চলে। তবু আজ অপর্ণার অসম্ভব পরিশ্রম হচ্ছে। পেঁয়াজ যেমন রান্নাঘরে রাঁধুনিকে কাদিয়ে দিতে পারে, থোড় তেমনি পারে খাটিয়ে নিতে। থোড় কাটা এবং রান্না করাকে পর্বত অভিযানের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। একটা সময় অপর্ণার নিজেকে বাচেন্দ্রি পালের মতো মনে হল। তার মনে হচ্ছে, এত সব যন্ত্রের বদলে তার একটা থোড় কাটা এবং রান্নার মেশিন থাকা উচিত ছিল। উলটোপালটা ভাবলে মনঃসংযোগ নষ্ট হয়। অপর্ণারও হল। বঁটিতে তার ডানহাতের কড়ে আঙুল খানিকটা কেটে গেল। কলের তলায় হাত পেতে অপর্ণা ভাবল, নাঃ, ঝগড়া বন্ধ করার কাজটা মোটেই ভাল হয়নি। এগারো নম্বর বিয়ের দিনে এই ন্যাকামিটা না করলেও চলত। ঝগড়া চেপে রাখায় শরীরে গ্যাসের মতো বিশ্রী একটা এফেক্ট হচ্ছে।

একাদশতম বিবাহবার্ষিকীতে এরপর দুটো ঘটনা ঘটল। খুবই মারাত্মক ঘটনা। ঘটনা এই মাপের মারাত্মক হলে যে-কোনও দুটো দেশের মধ্যে শান্তি-চুক্তি ভেঙে যেতে পারে, অপর্ণা-সুমিতের ঝগড়া তো নস্যি। তবু তারা দাঁতে দাঁত চেপে রইল।

প্রথম ঘটনা এরকম:

দুপুরে খাওয়ার পর অপর্ণা বলল, ‘ছুটি যখন নিছেই, চলো, একটা কাজ সেরে আসি।’

সুমিতের ভুরু কুঁচকে গেল। ইচ্ছে ছিল একটু গড়িয়ে নেওয়ার। অপর্ণার বেরোনোর প্রস্তাব মানেই ভয়ংকর। এই প্রস্তাবের প্রথম পর্বের পরই আসবে দ্বিতীয় পর্ব। সেই পর্ব হল আদেশ-পর্ব। সে গম্ভীর গলায় বলবে— গাড়ি কি অফিসে রেখে এসেছ নাকি এখানেই আছে?

আদেশ অনুরোধের ঢঙে আসার ফলে সুমিতের শরীরে কাঁপুনি বাড়বে। কাঁপনি থেকে পায়চারি। পায়চারি থেকে রাগ।

নিজেকে সামলে সুমিত বলল, ‘আজ বেরোলে কিন্তু আমি গাড়ি নিয়ে বেরোব অপর্ণা। তা ছাড়া বিয়ের তারিখে বউকে পাশে বসিয়ে গাড়ি চালানোর মধ্যে একটা থ্রিল আছে। একটা পালানো পালানো ফিলিংস হয়।’

রোমান্টিকতার দিক থেকে বিচার করলে বিয়ের এগারো বছরের মাথায় এই রসিকতা যথেষ্ট নিম্নমানের। অপর্ণার খুশি হওয়ার কোনও কারণ নেই। গাড়ি সুমিতের একার নয়। জয়েন্ট ফ্যামিলির গাড়ি। বেশিরভাগ সময়টাই ব্যাবসার কাজে ব্যস্ত থাকে। অপর্ণা মনে করে ভাগের গাড়িতে চড়াও যা, প্রাইভেট বাসে ওঠাও তাই। কবে গাড়ি সুমিতের ভাগে পড়বে তার দিনক্ষণ জেনেশুনে অপর্ণাকে বেরোনোর প্রোগ্রাম ঠিক করতে হয়। এটা শুধু যে অপমানের তা নয়, যথেষ্ট অনিশ্চয়তারও। এই যেমন দিদির মেয়ের জন্মদিন আসছে। সুমিতের ভাগে কি গাড়ি পড়বে? যদি পড়ে, তা হলে প্ল্যান হবে একরকম। তসরের শাড়িটা ভাঙা যাবে। সুমিতও না হয় পাঞ্জাবি-পাজামা পরতে পারবে। গয়নাগাঁটিও খুশিমতো পরা যায়। আর গাড়ি যদি সেদিন ভাগে না পড়ে? প্ল্যান বদলে ফেলতে হবে। ট্যাক্সির কথা মাথায় রেখে তসর পরা যায় না। পরতে হয় সিল্ক। গয়নার তো প্রশ্নই ওঠে না।

সেই গাড়িকে জড়িয়ে প্রেমের গল্প শুনে খুশি হওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। তবু চুক্তির কথা মনে করে চোখেমুখে খুব খুশিখুশি ভাব আনল অপর্ণা। নরম গলায় বলল, ‘কোথায় পালাবে?’

‘কোথায়? এই ধরো, এই ধরো ডায়মন্ডহারবার।’

ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত যেতে হল না। গড়িয়াহাট পর্যন্ত যাওয়ার আগেই মারাত্মক ঘটনাটা ঘটল। আসলে অপর্ণা বেরিয়েছিল দিদির মেয়ের জন্য ফ্রক কিনতে। জন্মদিনের ফ্রক পার্টি ফ্রক। পাটি ফ্রকের দাম একটু ওপরের দিকে হয়। দু’দিন আগে সুমিতের সঙ্গে সে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিল। তখন তুমুল ঝগড়াও হয়।

সুমিত বলেছিল, ‘জন্মদিনে সাড়ে পাঁচশো টাকার ফ্রক! একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? বিয়েটিয়ে হলে না হয় কথা ছিল!

‘আমার মনে হয়, বিয়েতে ফ্রক দেওয়াটা আরও বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। যখন কথা বলবে, একটু ভেবেচিন্তে বলবে।’

‘না, আসলে একটা হিসেব করছি। তোমার দিদির তিন ছেলেমেয়ে। জন্মদিনপিছু সাড়ে পাঁচশো। মানে বছরে সাড়ে ষোলোশো। হিসেব করে দ্যাখোনি বোধহয়।’

সেই ফ্রক কিনতে আজ বেরোনোর পর বাইপাসের ওপর দুধসাদা মারুতি ভ্যানের তৈল ফুরিয়ে গেল। স্টার্ট বন্ধ করে সুমিত বলল, ‘যাঃ বাবা, তেল নেই!ইস, একটু দেখে বেরোনো উচিত ছিল।’ মুখটা তার খুবই লজ্জালজ্জা। যেন বউয়ের কাছে লজ্জাটাই এখন মুখ্য ব্যাপার, তেল ফুরিয়ে যাওয়াটা এমন কিছু নয়।

অপর্ণার প্রথমে সন্দেহ হল, এটা গট আপ। ফ্রক যাতে কেনা না হয়—তারই ফন্দি। পরে এই সন্দেহ দৃঢ় হল। বাইপাসে তেলফুরনো গাড়িতে বসে থাকাও যা, পাশের চলন্ত গাড়ির তলায় ঝাঁপ দেওয়াও তাই। বরং সামান্য ভাল হলেও হতে পারে। এই লোক সম্পর্কে আজ রাতের আগেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে বলে ঠিক করল।

দু’নম্বর মারাত্মক ঘটনাটা ঘটল সন্ধের পরে।

নিয়ম অনুযায়ী মাঝারি সময়ের বিবাহবার্ষিকীগুলোতে একটা-না-একটা আদিখ্যেতা পাটি আসে। তাদের নিমন্ত্রণ করতে হয় না। এ-বাড়িতেও আজ এল। চন্দনা আর তার স্বামী। দরজা খুলেই সুমিতের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। যাঃ সন্ধেটা গেল। চন্দনা অপর্ণার কলেজের বন্ধু। অনার্সের বন্ধু নয়, পাশ ক্লাসের বন্ধু। কলেজের পাশক্লাসের বন্ধুরা বিয়েতে আসতে পারে কিন্তু বিবাহবার্ষিকীতে আসে না। নিশ্চয় অপর্ণা গোপনে নেমন্তন্ন করেছে। অতিথিদের চা এবং ডিমের পকোড়া দেওয়া হল। রান্নাঘরে চন্দনা অপর্ণাকে সাহায্য করতে গিয়ে একটা কাটগ্লাসের দামি জাগ ভেঙে ফেলল।

অপর্ণা তাকে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘চন্দনা, তুমি বাইরে গিয়ে বোসো।’

বেরোনোর সময়ে লাজুক মুখে চন্দনা বলল, ‘অপর্ণা, তোদের জন্য একটু ফুল এনেছিলাম।’

সুমিত চমকে উঠল। উফ্‌! সেই ফুল ! সঙ্গে কাচের বাটি আনেনি তো? বিবাহবার্ষিকীতে এই ধরনের জোর করে আসা অতিথিরা এক ধরনের বাসি ফুল নিয়ে আসে। নইলে ফুটপাত থেকে কাচের সস্তা বাটি কেনে। তারপর এমনভাবে সেই বাটি বের করে যেন সিঙ্গাপুর থেকে আনা হয়েছে। চন্দনার অগা ধরনের স্বামী লোকটা তার কাঁধের ঝোলা থেকে দোমড়ানো একটা কাগজের মোড়ক বের করল। মোড়কের বাইরে থেকে সবুজ ডাঁটি দেখা যাচ্ছে। কী ফুল বোঝা যাচ্ছে না। বোঝার দরকারও নেই। এরা চলে গেলে অপর্ণার সঙ্গে একটা চরম হেস্তনেস্থ করা প্রয়োজন।

রাতে শোবার ঘরে এসে জানলাটা খুলে দিল সুমিত। পাঁচতলার ফ্ল্যাটে এমনিতেই খুব হাওয়া। আজ যেন মনে হচ্ছে হাওয়াটা বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। গতকাল বাপিকে ওর মামারা নিয়ে গেছে। দু’দিন কাটিয়ে, সোমবার একেবারে কল করে ফিরবে। সুমিত একটা সিগারেট ধরাল। অপর্ণা চুল আঁচড়াচ্ছে। তারা দুজনেই বড় ধরনের ঝগড়ার জন্য প্রস্তুত। সারাদিন যা যা ঘটেছে, তার যে-কানও একটা দিয়েই শুরু করা যেতে পারে।

অপর্ণা উঠে এসে টোপে একটা ক্যাসেট চাপাল। রবীন্দ্রসংগত। ইচ্ছে করেই চাপাল। রাতে রবীন্দ্রসংগীত শুনলে সুমিত বিরক্ত হয়। রাতে সে হালকা করে শোনে পিঙ্ক ফ্লয়েড। সুমিতের মনে হল, এখনই বদলা নেওয়া উচিত। অ্যাশট্রেতে সিগারেট ফেলে সে উঠে এল। তারপর চন্দনার, অনা ফুলসমেত কাজের মোড়টা ছুড়ে দিল জানলা দিয়ে। আর তখনই কেলেঙ্কারিটা ঘটল ! ফুল নীচে পড়ে গেল ঠিকই, কিন্তু পড়বার আগে হাওয়ার জোর খুলে গেল কাগজের মোড়কটি। একগাদা হলুদ পাপড়ি জানলার ফাঁক দিয়ে উড়ে এসে ঘরের মেঝেতে আর বিছানায় ছড়িয়ে পড়ল।

স্বামীর ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে প্রথমে হাসল অপর্ণা। তারপর হাসল সুমিত। আইর্যের বিষয় হল, একসময় দু’জনেই হাসতে লাগল।

গভীর রাতে সুমিত এবং অপর্ণার ঝগড়া ঠিক কী পর্যায়ের হয়েছিল, তা বলা যাচ্ছে না। কারণ সেই সময় বিছানায় পড়ে থাকা কিছু পাপড়ি এবং জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি চাঁদ ছাড়া কেউ সেই ঘটনার সাক্ষী ছিল না। মুশকিল হল, মানব-মানবীর রহস্যময় ভালবাসার সময় এরা বারবার সাক্ষী থাকে, কিন্তু কখনও মুখ ফুটে বলে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *