বিবর মুক্ত

বিবর মুক্ত 

আমি আমার সেই পুরনো দিনগুলিকে স্মরণ করতে চাই। কারণ আমি বুঝতে পারছি, আমার দিন যেন ঘনিয়ে আসছে। অবধারিত মৃত্যুই কি না সেই অনাগত, পা টিপে টিপে আসা ভয়ংকর ছায়াটি, তা জানি নে। মৃত্যুর কি কোনও রূপ আছে? কিন্তু যে-ছায়াটি আমাদের চারদিকে, খুব ধীরগতি চোখ-খাবলার মতো এগিয়ে আসছে একটু একটু করে, সে মৃত্যুই কি না আমি জানি নে। হলে আমি অবাক হব না। 

কেন? 

না, আমি পুরনো দিনগুলির কথা চিন্তা করতে চাইছি। চাইছি। বললে ভুল বলা হয়। প্রাকৃতিক নিয়মের মতো একটি অপ্রতিরোধ্য গতিতে পুরনো দিনের সেই সব স্মৃতি যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে আসছে। অনেকদিন ধরেই, বোধ হয়, মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকা সেইসব দিনের কাহিনী আমার পাথুরে প্রতিরোধকে ভাঙছিল। একটু একটু করে। ফাটল সে পেয়েছে। এক বার যখন তা চোঁয়াতে আরম্ভ করেছে, এ বাঁধ ভাঙতে আর দেরি হবে না।

কেন এত ভয় আমার সেই পুরনো দিনগুলিকে স্মরণ করতে? কারণ, স্মৃতির এই অন্ধকার বন্ধ দরজা যেন আমার রক্ষাকবচ রক্ষিত কুঠরি। এইখানে আমার মৃত্যুবাণ। তাকে যতদিন রক্ষা করা যায়, ততদিনই জীবন। হারায় যেদিন, সেদিনই মৃত্যু। পুরনো দিনগুলিকে মনে করা আমার পক্ষে তেমনি। তাকে যতদিন ভুলে থাকা যায়, ততদিনই রক্ষা। কিন্তু একবার যদি সেই যখ-দেওয়া অন্ধকারের চিরবন্ধ। দরজাকে ভোলা যায়, তা হলে অন্ধকারের অদৃশ্য বাহু আমাকে আর কোনওদিন ছেড়ে কথা কইবে না। কিন্তু কোন সোনার হরিণ আজ আমার চোখে পড়ল, জানিনে। আমার সব গণ্ডি গেল ঘুচে। ভয়ংকরের সব ত্রাস তুচ্ছ হয়ে গেল আমার কাছে। 

বসন্তের সেই ঘোর দুপুর দিনটির মুখোমুখি দাঁড়ালাম আমি। বিশ বছর? না, বিশ নয়, বাইশ বছর। এটা উনিশশো কত? ও! হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ঠিক বাইশ বছরই হবে। বাইশ বছর আগের সেই প্রথম চৈত্রের ঘোর দুপুর দিনটিও যেন অনেক বুঝে সুঝে মোকাবিলা করতে দাঁড়াল আমার মুখোমুখি।

যা ভাবছি, এ সব কথা ঠিক এভাবে লিখতে পারলে আমাকে হয়তো লেখক বলা যেতে পারত। কিন্তু লেখা মানেই তো প্রেম। মেয়ে পুরুষের প্রেম। প্রেম নেই, বিরহ মিলন নেই, আমি লিখলেই বা কী আসে যায়। লোকে কি তাই বলে না? আমি তো তাই জেনে এসেছি। তাই শুনে এসেছি।

তা ছাড়া আমি লিখতে পারব না। আমি যে লিখতে পারি নে তা নয়। কিন্তু আমি যা ভাবছি তা লেখা যায় না। লিখতে গেলেও হয়তো কলম কোথাও থেমে যেতে পারে। কারণ, বাইশ বছর ধরে নিজের সঙ্গে সব ফাঁকি আমি নিজের কাছে খুলে ধরব। সে সব কথা কি লেখা যায়? আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কি কেউ লিখতে পেরেছেন? আমি জানি নে। শুনেছি, কেউ কেউ পেরেছেন। সত্যি? সত্যি পেরেছেন? তাঁদের লজ্জা করেনি? সংকোচ হয়নি? ভয় হয়নি? আত্মসম্মানের ভয়ের কথা বলছি নে। পাগল কিংবা বিকৃত পশুসুলভ জীব ভেবে লোকের পীড়নের ভয়।

তা হলে সেটাই ছিল বোধ হয় তাঁদের লেখার কায়দা। না, ভুল ভাবছি। তাঁদের লেখার কায়দা এ কথাটি বললেই লোকে আমার ওপর রুষ্ট হবে। আসলে, তাঁরা মহৎ বলেই বোধ হয় তাঁদের পাপের কথা পরিষ্কার করে লিখতে পেরেছেন। 

পাপ? কিন্তু আমি তো কোনও পাপ-ই করিনি। কারণ, কোনও পাপ করবার যোগ্যতাই আমার নেই। মহাত্মা গান্ধী পতিতালয়ে গিয়েছিলেন, আমি তাঁর জীবনীতে পড়েছি। এরকম আরও হয়তো দেশি কিংবা বিদেশি মহৎ মানুষের জীবনীতে আমি পড়েছি। বেশ্যাবাড়ি যাওয়া শুধু নয়, আরও নানানরকম ওই জাতীয় অপরাধের স্বীকারোক্তি। সেগুলি ঠিক অপরাধ কি না জানি নে। কিন্তু লোকে জানে, ও সব অপরাধ। এবং স্বীকারোক্তিটাই এত বিস্ময়কর যে, মুহূর্তে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। ভক্তিতে মন গদগদ হয়ে ওঠে। 

আর সমাজে যেন ওই একটিই মাত্র অপরাধ আছে। যিনি ওই বিষয়ে তাঁর সব কিছু স্বীকার করতে পেরেছেন, তিনিই আশ্চর্যরকম সৎ বলিষ্ঠ ও সাহসী মানুষ বলে খ্যাত হয়েছেন। 

কিন্তু আমি তো কখনও মেয়েদের গায়ে হাতই দিইনি। পনেরো বছর বয়সের পর থেকে এমন সুযোগ কখনও আসেনি যে মেয়েদের গায়ে হাত দিতে পারি একটু। আমি জানি না, মেয়েদের গা কেমন। এখন আমার সাঁইত্রিশ বছর বয়স। যদিও আমাকে দেখে কেউ সে কথা বলবে না। এতখানি বয়সেও আমি জানিনে, মেয়েদের গা কেমন। হাত দিলে কেমন লাগে। 

আচ্ছা, বোবা কি জানে, কথা কী? জানে, নিশ্চয় জানে। বোবা যেরকম জানে, কথা কী, আমি। সেরকমই জানি মেয়েদের গা কেমন। তার বেশি কিছু নয়।

 বোবা কথা বলতে পারে না। কিন্তু বলার জন্যে তার সমস্ত ইন্দ্রিয় পশুর মতো আঁ আঁ করে। যেন। তার কথা বলবার মুখে কেউ টুটি টিপে ধরে রাখে। 

মেয়েদের সম্পর্কে এই বোবার মতো কথা বলার ইচ্ছেটা আমার খুবই চাপাচাপি চুপি চুপি বিষয় নয় কি? এই সব মহৎ মানুষদের পাপের স্বীকারোক্তির চেয়ে, আমার অক্ষম বাসনা অনেক বেশি অশ্লীল বলে আমার ধারণা। তাই সে সব কথা লেখা দূরের কথা, যার প্রমাণ থাকে না, সেই মুখের কথাও মুখ ফুটে বলা যায় না। কিন্তু বাসি খবরের কাগজে যে সব লোমহর্ষক অপরাধের সংবাদ আমি পড়ি, ফুসলানো, ভুলানো, ধর্ষণ, খুন, কিংবা আরও সব সামাজিক অপরাধ, যেমন, বেশ্যাবাড়ি যাওয়া, মাতলামি, চুরি, জোচ্চোরি, আমি এ সবের ধারে কাছেও কোনওদিন যাইনি। কারণ, আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। আমার পা নেই। হাঁটুর বেশ খানিকটা ওপর থেকে আমার দুটি পা-ই কাটা। আমি বাইশ বছর ধরে, রাস্তার ধারের এই ঘরের দরজায় বসে আছি। দরজার নীচেই মানুষডোবা নর্দমা। তারপরে খোয়া-ওঠা সরু রাস্তা। রাস্তার ওপাশে আরও একটি ছোট নর্দমা। ওই নর্দমায় এই ঘোর দুপুরে তিনটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বসে আছে, একটি মেয়ে, দুটি ছেলে। ওদের আমি জন্ম থেকেই চিনি। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে নিতাই ময়রার। আর একটি ছেলে নিতাইয়ের দাদা গৌরের। 

এখানে, ঠিক আমার দরজার মুখোমুখি ওরাই বেশি বসে। ওদের দাদা দিদিরাও বসত। তারা এখন বড় হয়ে গেছে। বিয়েও হয়ে গেছে কারুর কারুর। বিশেষ করে মেয়েদের। এমনকী ছেলেপিলেও হতে শুরু করেছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে এলে দেখতে পাই। সময় হয়ে এল, এবার তাদের বাচ্চাকাচ্চারাও মুখোমুখি নর্দমায় এসে বসবে।

এখন যে তিনজন বসেছে, শুধু এরাই নয়। আরও অনেক আসে। বেচু পাল, গগন সাধুখাঁ, বিপিন ঠাকুর, সকলের বাড়ির ছেলেমেয়েরাই আসে তবে ময়রাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরাই বেশি আসে। আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা, (আমাদের বাড়িকে সাধু কুণ্ডুর বাড়ি বলা হয়) এ বাড়ির ছেলেমেয়েরাও আসে।

ওরা যখন প্রথম প্রথম আসতে শেখে নর্দমার ধারে, তখন আমার দিকে ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপরে আস্তে আস্তে ভুলে যায়। আমি যে একটা মানুষ, একটা জীব এখানে বসে আছি–সে কথা একবারও ওদের মনে হয় না আর। দেয়াল রাস্তা খোয়া দূর্বা এ সব যেমন অলক্ষ্যে থেকে যায়, আমি ওদের কাছে তেমনি। কিন্তু একটা পাখি এসে বসুক। ওরা ঢিল ছুড়বে, ভ্যাংচাবে পাখিটাকে। একলা হলে কথাও বলবে। কিন্তু আমার দিকে তাকাবার কথা মনে থাকে না ওদের। আমি অবশ্য নতুন মুখ দেখলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে জেনে নিই, এই তুই কোন বাড়ির ছেলে রে? কোন বাড়ির মেয়ে তোরা? 

ওরা প্রথমে ভয়ে ভয়ে জবাব দেয়। তারপরে ঘৃণা করে। তারপরে ভুলে যায়। অনেকদিন দেখতে দেখতে ভুলে যেতেই হয়। আমিও যেমন ভুলে যাই এক এক সময়। ভুলে যাই, খেয়াল থাকে না, ওরা কখন এল, কখন গেল। আমি যেমন আমার এই পদবিহীন, বিরাট লোমশ, দাড়ি গোঁফওয়ালা চেহারাটা নিয়ে ওদের চোখের সামনে একাকার হয়ে মিশে যাই; মানুষ-ডোবা নর্দমায়, শেওলা ধরা দেয়ালে, খোয়া ওঠা রাস্তায়, রাস্তার কুকুরের সঙ্গে কিংবা শহরের ভ্রাম্যমাণ শুয়োরের সঙ্গে। তেমনি ওরাও হারিয়ে যায়। সামনের দেয়ালটায়, পথের লোকের মধ্যে, গগন সাধুখাঁর বাড়ির সদর দরজার মাথায় গজানো বড় বড় ঘাসে, ঘাস পার হয়ে সাতু চক্কোত্তির দোতলার জানালায়, জানালা পার হয়ে আকাশটায়। আমার ঘরের পাশে রাধাবল্লভের মন্দিরের নানান কথায়, শাঁখ-ঘণ্টার শব্দে। উলঙ্গ শিশুগুলি একাকার হয়ে যায় ধূপ-চন্দনের গন্ধে, খোল-করতালের সঙ্গে গানে, আর আমার নিজের জন্যে চিন্তার অন্যমনস্কতায়। আর নিজের জন্যে চিন্তার অন্যমনস্কতা, ওটাই সবচেয়ে ভয়ংকর। ওটা অন্যমনস্কতা নয়। একটা আধমরা পিঁপড়ে, যখন নিজের হুল নিজের মুখে ঢুকিয়ে, গোল হয়ে পাক খায়, সেরকম। তখন সে তার জগতের সংবাদ রাখে না। কালা হয়ে যায়। অন্ধ হয়ে যায়। কুৎসিত হয়ে যায় দেখতে। আগে আগে কাট-পিঁপড়েকে ওরকম করতে দেখে হাসি পেত আমার। 

আমার সঙ্গে আমার লড়াই সেটা। আমি চুল টানি, দাড়ি টানি। রাত্রে দেয়ালে আমার ছায়াটার গায়ে। আমি থুথু ছিটিয়ে দিই। নিজের কাছে মিছে বলা যায় না। এ সব কথা কি আত্মজীবনীতে লেখা যায়? আরে? আমার আত্মজীবনীর কথা আসছে কেন? না, যদি লিখতে চাই, লেখা যায় কি এ সব? এ সবই তো নিশ্চয়ই একটা বিকার। নিশ্চয়ই বিকার। মিছে নয়, তার পরমুহূর্তেই হয়তো আমি একটা স্বপ্ন দেখতে চেয়েছি।

একটি স্বপ্ন, আমার শরীরে, আমিই জাগিয়েছি, আমার রক্তে। আমার রক্তে কোষে কোষে, কণায় কণায় উল্লাস, উন্মত্ত আনন্দের স্বপ্ন। ভীষণ ব্যথিত, অসহ্য যন্ত্রণা, ভয়ংকর নিষ্ঠুর। এবং ওই স্বপ্নটার সময় নিশ্চয় আমাকে জেলে ধরে নিয়ে যাওয়া উচিত। কিংবা কোনও পাগলা গারদে। কিন্তু তারপরে। শুধু কষ্ট। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা ছাড়া আমার কোনও উপায় থাকে না। আর অবসাদ আসতে থাকে। তখন মুক্তি আসতে থাকে। ঘুম নামে। কিংবা অন্ধকার ঘর থেকে বাইরের আর একটা স্বপ্নের মধ্যে যাই। 

আর একটা স্বপ্ন, যেখানে রাস্তার আলোয় ছায়া ফেলে ফেলে পায়েরা যায়। আমার চোখ তখন পা ছাড়িয়ে ওঠে না। আমি শুধু পায়ের মিছিলের স্বপ্ন দেখি। নানা ধরনের জুতো, স্যান্ডেল-পরা কিংবা খালি পা। রোগা-মোটা, দুর্বল-সবল, পুরুষ-মেয়ে, যুবক-বৃদ্ধদের পা। নানান শব্দে, নানান ভঙ্গিতে আমার স্বপ্ন-দেখা চোখের ওপর দিয়ে পায়েরা যেতে থাকে। আর ওই পাগুলি মুখের ছায়ার মতোই আমার কাছে ধরা দেয়। মুখ কিংবা একটি মানুষকে দেখে যে চরিত্র ফুটে উঠে, পায়েদের মধ্যে আমি তা দেখতে পাই। তারপর হাততালি। মায়ের হাততালি আর, থি, থি, থি! খোকন হাঁটে, বাবু হাঁটে, থি, থি, থি!…

ঘুম নামতে থাকে। স্বপ্নময় ঘুম। কেবল, আমার উরুতের নীচে একটা শূন্য স্থান কাঁপতে থাকে থরথর করে। আর মন্দিরের ভিতর থেকে সাতু চক্কোত্তির ভাগবত পাঠ ভেসে আসতে থাকে। আমি জানি নে, ভাগবতে কী আছে। শুনেছি, সাতুঠাকুর নাকি রোজই রাত্রে ভাগবত পাঠ করে। কিন্তু আমার বরাবর মনে হয়েছে, সাতুঠাকুর যেন আমাকে বলছে, এবার তুই ঘুমো। নরেন্দ্র! এবার তুই ঘুমো।’…

আমি ঘুমোই। কিন্তু স্বপ্ন আমাকে ছেড়ে যায় না। আমি ঘুমোই। আমি ঘুমন্ত স্বপ্নের ঘোরে নিজেকেই বলতে থাকি, ঘুমো, নরেন্দ্র, এবার তুই ঘুমো। আর আমি দেখি, সাধু কুণ্ডুর ছেলে, নরেন্দ্র কুণ্ডু, ঠিক একটি মরা বুনো মোষের মতো, ফাটা চটা দুর্গন্ধময় মেঝের ওপর পড়ে আছে। 

তারপর সকালবেলা সেই বুনো মোযটা আবিষ্কৃত হয় অপরের চোখে। আমাদের ভিতর বাড়ির লোকেদের চোখে। আমাদের ভিতর বাড়ি, যেখানে প্রায় বারো-তেরোখানি ঘর আছে একতলা দোতলায়। সাধু কুণ্ডুর বাবার তৈরি বাড়ি। তিন পুরুষেই বাড়িটার পলেস্তরা খসে গেছে। শ্যাওলা ধরেছে। ফাটলে ফাটলে ইট ঘাস আর অশ্বথের চারা গজিয়েছে। কিন্তু বিজলি বাতি আছে ঘরগুলিতে। সুরেন্দ্রর ঘরে রেডিও আছে। বীরেন্দ্রের ঘরেও আছে। সত্যেন্দ্র ও সব পছন্দ করে না। নামগুলি সাজাতে হলে, এভাবে সাজাতে হয়, সত্যেন্দ্র, সুরেন্দ্র, তারপরে একটা ফাঁক দিয়ে বীরেন্দ্র। মাঝখানের ফাঁকটা পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত নরেন্দ্র ভরতি করত। এখন আর করে না। এখন সাধু কুণ্ডুর তিন ছেলে। ধান চাল তিল তিসি খৈল তেলের পৈতৃক ব্যবসা যাদের। শুধু একজন বাদ পড়ে গেছে। 

শুধু একজন বাদ পড়ে গেছে, কারণ সে অন্য কিছু হতে চেয়েছিল। আর তাই সে এই বাইরের বাড়ির মানুষ-ডোবা নর্দমার ধারের ইঁদুরের আড্ডায় বাসা পেয়েছে। 

আমার ভয় করছে সেই দিনটিকে স্মরণ করতে। সেই দিনটি, যে দিনটি আমাকে অন্য পথে যেতে দেয়নি। এখানে ফেলে দিয়েছে। এই বাইরে। আমার ভয় করছে, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য সেই চুঁইয়ে আসার স্রোত। ফাটল সে পেয়েছে। আমার বাইশ বছরের বাঁধ ভাঙছে। আমি ভাঙতে চাইনি। 

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো, অনেক পায়ের সঙ্গে সেই পা দুটি আজ আমি দেখেছি। অনেক পায়ের সঙ্গে সে দুটি পায়ের কোনও মিল নেই। কোটি পায়ের মধ্যেও সেই পা দুটি চিনতে আমার কোনওদিন ভুল হবে না। 

বাইশ বছর বাদে সেই পা দুটি আমি দেখলাম। আমার অন্ধ বদ্ধ ভুলে যাওয়া স্মৃতির কুঠরিতে তার পদাঘাত আমি অনুভব করেছি। দরজা ভেঙেছে। আচমকা ঝড়ের মতো। ঘুমন্ত স্তব্ধ রাত্রে সহসা বন্যার মতো। আমি জানি, একটা কী আসছে আমাকে ঘিরে। বুকে-হাঁটা, ক্লেদাক্ত সরীসৃপের মতো, খুব ধীরে ধীরে, চারদিক থেকে গণ্ডি বেঁধে ঘিরে আসছে। তার অপলক স্থির চোখ আমি দেখতে পাচ্ছি শুধু। যে-চোখের মধ্যে প্রতিবিম্বিত দেখছি বাইশ বছর। এই বিবরে। এই অন্ধকার গর্তে। 

–এই, এই ছেলেটা, শোন বাবা। আমাকে এক বালতি জল এনে দে না বাবা ওই কল থেকে। অনেকক্ষণ জল খাইনি। আমাকে রাস্তার ছেলেদের ডেকে জল আনিয়ে নিতে হয়। সবাই এনে দেয় না। কেউ ভ্যাংচায়। কেউ কেউ ঢিল মেরে পালায়। কেউ ফিরে না তাকিয়েই চলে যায়। তা যাক। এখন আর এ সব আমার গায়ে লাগে না। একজন না একজন কেউ এনে দেবেই। দরজার ওপরে, নর্দমাটার ওপর হুমড়ি খেয়ে এরকম ঘ্যান ঘ্যান করতে করতে কেউ না কেউ এক সময়ে এনে দেবে। কারুর না কারুর দয়া হবেই। তবে আমি ছোট ছোট ছেলেদের কাছেই বেশি চাই। কারণ বড়রা কখনওই সাহায্য করে না। ছোটরা এনে দেয়। ওদের দয়া বেশি। কৌতূহল বেশি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখে অনেক ছেলেরা যারা নতুন আসে এ শহরে। কেউ কেউ ওদের কোমল, কৌতূহলিত, এমনকী আমার বয়সকে শ্রদ্ধা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছিল আপনার পায়ে? 

আমি চুপ করে থাকি। পালাক ছেলেটা। পালাক। এ সব কথা আমার একদম ভাল লাগে না। আমি মাথা নিচু করে থাকি। আমার মনে পড়ে না কী হয়েছিল। আমি ভুলে গেছি। 

জবাব না পেয়ে আমাকে পাগল ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না। হতাশ হয়ে, বিরক্ত হয়ে চলে যেতে হয় সেই সব ছেলেদের। 

কিন্তু আমি ভুলিনি। ভুলে থাকতে চেয়েছি। মনে করেছিলুম, আমৃত্যু পারব। পারলাম না। আজ আমি সেই দিনটির মুখোমুখি দাঁড়াতে যাচ্ছি। সেই দিন, ফাল্গন না চৈত্র? চৈত্র মাসেরই ঘোর দুপুরে, মানদা পুলের কাছে, কালাসাহেবের বাগানের ধারে। 

কিন্তু একটু জল? আর একটু বাদেই কলের জল বন্ধ হয়ে যাবে। এই যে, ও ভাই, ও মশাই..। 

অথচ আমি শুনতে পাচ্ছি, জল পড়ছে ছল ছল করে, আমাদের বাড়ির ভিতরের চাতালে। শ্যাওলা-ধরা পিছল উঠোনটা চারদিকের ঘরের ছায়ায় অন্ধকার। সেখানে একটা কুয়ো আছে। আর আছে জলের কল। সেখানে জল পড়ছে ছরছর করে। ঝিয়েরা আর বউয়েরা কাজ করছে, শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ওরা আমাকে একটুও জল দেবে না। চিৎকার করে মরে গেলেও না। উপরন্তু নানা অঙ্গভঙ্গি করবে, হাসবে, বাসন মাজার ছোবড়া ছুঁড়ে মারবে জানালা দিয়ে। দরজাটা খোলা পায় না। আমার দাদা আর ভাইয়েরা দরজায় একটা ভারী তালা মেরে রেখে দেয়। জানালাটা বন্ধ করে দেয় না। এইখান দিয়ে আমি বাড়িটার ভিতরে দেখতে পাই। কাল, সুরেনের স্ত্রী, আমার মেজোবউদি, এক ঘটি জল আমার গায়ে ঢেলে দিয়েছে। আমি জল চেয়েছিলাম। 

আজ সকাল বেলাই তো মার খেলাম? হ্যাঁ, আজ সকালেই বীরেন এসে মেরে গেছে আমাকে। চন্দ্রনাথ বলে কোথায় নাকি একটা তীর্থ আছে? পাহাড় আছে নাকি সেখানে? যেখানে গেছল আমার বাবা। সেখান থেকে নিয়ে এসেছিল একটা লাঠি। লাঠির সারা গা খোঁচা খোঁচা। ছেলেবেলায় আমি ওটা তলোয়ার হিসেবে ব্যবহার করতাম। কারণ ডগাটা বেশ সরু আর ছুঁচলো, আগাটি মোটা। সেই লাঠিটা এখন ছোট ভাই বীরেনের ঘরে থাকে। ওইটা দিয়ে সে আমাকে মেরে গেছে। কারণ, আজ সকালেও আমাকে বাড়ির বউয়েরা আর ঝিয়েরা ওইভাবেই আবিষ্কার করেছে। কুড়ি বাইশ চব্বিশে যে-মোযটা রোজ মরে পড়ে থাকত, সে এখনও মাঝে মাঝে মরে পড়ে থাকে। সেই সাঁইত্রিশ বছর বয়সে। 

এই সাঁইত্রিশ বছর বয়সে, সাতু চক্কোত্তির দোতলায় নীল আলো জ্বলা ওই ঘরটায় কাল রাত্রে আবার আমার দৃষ্টি পড়েছিল। আমি জানিনে, ওই জানালায় যা দেখছিলাম, কিংবা প্রায়ই দেখে থাকি, তার মানে কী? আমি খালি দেখি, একজন একজনের হাত ধরে টানে। যাকে টানে, তার যেন হাড়গোড় নেই। লতিয়ে বুকে পড়ে যায়। দু জোড়া যেন জাদুকরের খেলার মতো নানান ভঙ্গিতে নড়াচড়া করতে থাকে। মুখে মুখ ঠেকায়। 

তৎক্ষণাৎ আমি দেয়ালে আশ্রয় খুঁজি। ফাটা-ফুটো, আরশোলা বিছে-ঘোরা দেয়ালের কোথাও নিজেকে ঢোকাবার জন্যে, লুকোবার জন্যে আমি মাথা কুটতে থাকি। হামা দিয়ে পাক দিতে থাকি সারা ঘরটার মধ্যে। নিজেকে গালাগাল দিই কুৎসিত ভাষায়। নিজের দাড়ি ধরে চুল ধরে টানি। ঘৃণা উথলে উঠতে থাকে আমার বুকের মধ্যে। ঘৃণায় থুথু ছিটিয়ে দিই নিজের গায়ে।

শুধু সেই নিষ্ঠুর স্বপ্নের সব লক্ষণ আমার শরীরে ফুটে ওঠে। ঘৃণায় এবং আনন্দে, আমার রক্তের উল্লাসকে আমিই উন্মত্ত খেলায় মাতাই। সাতু চক্কোত্তি, হে রাধাবল্লভ, তোমরা নিশ্চয় জান, আমি সত্যি জ্ঞান হারাই না। আমি সত্যি পাগল নই। তবু সেই ক্ষ্যাপা মোযটাকে আমি মরতে দেখি। একটি অদৃশ্য বিষাক্ত তীরের মার খেয়ে, ওকে আমি মরতে দেখি। অবসাদ, ঘুম, মুক্তি আসতে থাকে। তারপরেই সেই তালার মধ্যে চাবি ঢোকাবার শব্দ। আমার ঘুম ভেঙে যায়। নিজের দিকে ফিরে তাকাবার খেয়াল থাকে না আমার। সামনে রুদ্র মূর্তি। আমার ছোট ভাই বীরেন। হাতে সেই কাঁটা-ওঠা চন্দ্রনাথের লাঠি। জানালায়, মুখের হাসি আঁচল চাপা বউ ঝিয়েরা। তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমি আমার কাপড়টা খুঁজতে থাকি। আর তখনই সপাং সপাং লাঠি পড়তে থাকে।–আবার, হারামজাদা, আবার তুই ন্যাংটো হয়ে ভেতরবাড়ির জানালার কাছে শুয়েছিলি? 

আমি চিৎকার করি। কারণ কাঁটাগুলি আমার গায়ে বেঁধে। রক্ত বেরোয়। ঘরময় হামা দিয়ে ছুটোছুটি করি, আর চিৎকার করে বলি, আমি জানি না বীরু, মাইরি বলছি আমি জানি না, কখন কাপড় খুলে গেছে। বিশ্বাস কর, আপন গড’– 

আপন গড। আমাদের পনেরো বছর বয়সে কথাটা বলা একটা অদ্ভুত ফ্যাশান ছিল। কিন্তু বীরেন বিশ্বাস করে না। চিৎকার শুনে বড়দা ভুঁড়ি কাঁপাতে কাঁপাতে আসে। মেজদা দোতলার জানালা থেকেই উঁকি মেরে দেখে। আর বীরেন মারতে থাকে অন্ধের মতো। শয়তান, বদমাইস, পাগলামির ভান তোমার? 

সপাং। সপাং। রাস্তার ধারের জানালায় ভিড় জমে যায়। কারুর মার খাওয়া দেখতে লোকের এত ভাল লাগে! নর্দমা টপকে, ছোট ছেলেগুলি জানালার গরাদ ধরে ঝুলে দেখতে থাকে। আমি বুঝতে পারি, বীরেনের সম্মান তাতে নষ্ট হয় না। বাইরের লোক দেখে, ওর মারের নেশা আরও বাড়ে। আর বউ ঝিয়েরা হাসে। 

তারপরে এক সময়ে বীরেন থামে। তালাটা এঁটে দিয়ে চলে যায়। কাপড়টা খুঁজে পাই। পাঁচ হাত কাপড়টা আমারই চোখের সামনে পড়ে থাকে। মার খাওয়ার সময় আমার চোখে পড়ে না। আর তখন ঘুম ভাঙে রাধাবল্লভের।

তখন রাধাবল্লভের ঘুম ভাঙানো হয় ঘন্টা বাজিয়ে। টিং টিং টিং…। রাধাও আছে মন্দিরটার মধ্যে। আমার মনে আছে, কালো পাথরের রাধাবল্লভ। অপলক দুটি চোখ। যেন একটি কচি কালো ছেলে, বড় বড় চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সোনার অলংকার তার সারা গায়ে। আর সাদা পাথরের রাধা। কপালে লাল টিপ বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা। মনে হয়, রাধাবল্লভের চেয়ে বয়সে বড়, ভরাট শরীর একটি সুন্দর মেয়ে। আমার জ্যাঠামশায়ের প্রতিষ্ঠিত। আমার বাবা মারা গেছে। মা মারা গেছে। জ্যাঠামশাইও মারা গেছে। কিন্তু দু চোখ অন্ধ জ্যাঠাইমা বেঁচে আছে। সে মন্দিরেই থাকে। মন্দিরের পাশে একটা ছোট ঘরেই তার ঘরকন্না। ভোগ খেয়ে বেঁচে থাকে জ্যাঠাইমা। ভোগ রান্না করে একজন ব্রাহ্মণ বিধবা। শুনেছি, সে সাতু চক্কোত্তির বিধবা শালী। 

রাধাবল্লভের ঘুম ভাঙানো হয়। জ্যাঠাইমা তখন তাঁর সরু ভাঙা ভাঙা চড়া গলায় গান গাইতে থাকে, 

এ আঁধারে অন্নবো ও ও ও,
পার কর রাধাবল্লভভা ও ও ও…। 

মরার কথা আমার একটুও মনে হয় না তখন। তবু আমিও গানটা গাইতে থাকি। কাপড়টা পরতে পরতে, মনে মনে গাই। কারণ, চেঁচিয়ে গাইলে, আবার হয়তো বীরেন ছুটে আসবে। ওরে, আবার ধম্মের গান গাওয়া হচ্ছে? 

যদিও ধর্ম নয় সত্যি, এমনি আমি মনে মনে আওড়াই। আমার গলা শুনলে হয়তো জ্যাঠাইমা-ই গান থামিয়ে দেবে। মুখ ঝামটা দিয়ে বলবে, আ মলো, নরা খোঁড়াটাও গাইছে নাকি?নরা হল নরেন্দ্র। 

আর আমার মার খাওয়া অতিরিক্ত লোমশ গায়েও দু-এক জায়গায় রক্ত ফুটে ওঠে তখন। হাত দিয়ে মুছি। কিন্তু আমার যন্ত্রণাবোধ কি নেই? কী জানি। খুব তাড়াতাড়ি আমার কষ্ট দূর হয়ে যায়। হামা দিয়ে এগিয়ে আসি, দরজা খুলি। আমার ভোলার সুবিধার জন্য দরজার কুলুপটা নীচের দিকে। দরজা খুললেই, রাস্তার ওপারের নর্দমায় সারি সারি ছেলেমেয়েদের চোখে পড়ে। উলঙ্গেরা বসেছে পাইখানায়। তবু ওরা গল্প করে। নর্দমার ধারটা ওদের যেন প্রাতঃকালীন আসর। 

–আমাল অ্যাত্তা ফিতে আথে।

 –তোল তো নদেন নেই, হ্যাঁ।

আর গোঁয়ার ছেলেটা গৌর মোদকের। সেটা প্রায় গাঁজাখোরের মতো গলা করে একরাশ কথা বলে উঠবে, না তোদেল ফিতে নেই। নদেন নেই। আমাল অ্যাত্তা ঘোলা আথে। গোলা (অর্থাৎ গোরা, অর্থাৎ গৌর, বাবাকে ও নাম ধরে আদর করে ডাকে, কারণ শেখানো হয়েছে) আমাকে ঘোলা এনে দিয়েথে। তোদেল তাপতে দেব না। গোলা নদেন আনবে, ফিতে আনবে, দেখিত। গোলাকে বলে তোদেল পিতুনি খাওয়াব, দেখিত। তোদেল কিথু নেই। 

কারুর কিছু নেই, ওর সব আছে। আর কারুর কিছু থাকলেই ওর রাগ। যদিও ওই সঙ্গিনী দুটি ছাড়া, গোঁয়ারটাকে আমি কখনও একলা দেখতে পাইনে।

ওরা বক বক করে নর্দমায় ঝুলে বসে। তবু জ্যাঠাইমা ঘণ্টাটা বাজাতে থাকে ঢিমে তেতালায়। আর এ আঁধারো অন্নবো’…গাওয়া হতে থাকে। কাকেরা আসে। কুকুরটা এসে বসে থাকে নর্দমাটার ধারে। আমাকেও এই সময়, আমার ঘরের পাশে মানুষ-ডোবা নর্দমাটায় ঝুলে বসতে হয়। আশে পাশে জানালা দরজা বন্ধ হতে থাকে ঠাস ঠাস করে। রাস্তার লোক হাসে, গালাগাল দেয়। দু-চারটে ঢিল পাটকেল এসে গায়ে পড়ে। কিন্তু আমার কোনও উপায় নেই। আমাকে আর বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেওয়া হয় না।

আবার আমি ঠিকঠাক হয়ে বসি দরজায়। পায়েরা যাতায়াত শুরু করে। স্কুলের পা, বাজারের পা, অফিসের পা, বেড়াবার পা, ডাক্তারখানায় যাবার পা, রাত জেগে ফিরে আসা পা, ভিক্ষেয় আসা পা, পালানো পা। নানান পায়ের মিছিল। 

এই মিছিলেই সেই পা দুটি আজ.. 

-এই, এই খোকা, আমাকে এক বালতি জল এনে দাও না।

 চলে গেল। কেন? আমার মুখটা নিশ্চয় বদলে গেছে। গলার স্বরটা শুনেও তবে দয়া হতে চায় না কেন?

গায়ের মধ্যে কী যেন একটা বেয়ে বেড়াচ্ছে। হাত দিয়ে চেপে ধরলাম। এক ফোঁটা রক্ত। বেয়ে পড়ছিল। বীরেন মেরেছে আজ সকালেও। অথচ, কই সাতু চক্কোত্তির ছেলের জানালাটা শুধু গরাদের ওপারে একটি চৌকো অন্ধকার। এখন সেখানে কিছুই নেই। রাত্রের সেই স্বপ্নময় আলোয় দেখা দুটি ছায়ার আশ্চর্য খেলা। আঃ। কী যে খেলা। আমার শরীরে বীরেনের আঘাতের চেয়ে তা অনেক নির্মম। 

কবে আমাকে বীরেন প্রথম মেরেছিল? বীরেন নয়। মেজদা প্রথম মেরেছিল। সুরেন্দ্র। তখন মেজোবউদি আমাকে খেতে দিতে আসত। দাঁড়িয়ে খাওয়াও দেখত। গেলাসে জল ঢেলে দিত। এঁটো পেড়ে নিয়ে যেত খাওয়া হয়ে গেলে। 

মেজোবউদির দিকে চোখ তুলে তাকাতে গেলে, আমার দৃষ্টি নেমে যেত। কেন? আমি জানতাম না। তখন কত বছর বয়স আমার? বাইশ? চব্বিশ? ছাব্বিশ? মনে নেই। দৃষ্টি আমার নেবে যেত। কিন্তু কোনও কোনও সময় ভুলে যেতাম, চোখ নামাতে মনে থাকত না। 

মেজোবউদি হেসে মুখঝামটা দিত, অমন বাঁদরের মতো তাকিয়ে কী দেখছ?

তাড়াতাড়ি লজ্জায় চোখ নামাতাম। কী দেখতাম আমি? আমার রক্তের মধ্যে একটি দুর্বোধ্য ইচ্ছা, একটি দুর্বিনীত আকাঙ্ক্ষাকে আমি দেখতাম। মেজোবউদি কি আমার গায়ে একটু হাত ঠেকিয়ে আদর করতে পারে না? পোষা বাঁদরকে আদর করার মতোই না হয় হল। একটু কাছে এসে বসে দুটি কথা? আমাকে আমার কথা একটু আধটু জিজ্ঞেস করা? 

তা কি কখনও হয়? অমন সেজেগুজে পান খেয়ে, তেল স্নোর গন্ধ ছড়িয়ে, একটু যে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়া দেখে যেত, সে-ই তো অনেক। তবু হে, সাতু চক্কোত্তি, হে রাধাবল্লভ, তোমরা জানতে, আমার জ্ঞান ছিল। আত্ম ও পর-সম্মানবোধ ছিল। এমনকী সাধু কুণ্ডুর বাড়ির এই ঘষে ঘষে টাকা গোনা আর সিন্দুকে ভরা জীবনের রীতিনীতি আমার ভাল লাগত না। স্কুল মনে হত। অযোগ্য, নিচু, হীন মনে হত নিজেকে। তবু, কালো কুচকুচে একটা ক্ষ্যাপা মোষ কেন দাপিয়ে উঠত আমার রক্তে? কেন আমি বলতে গেছলাম, মেজোবউদি, একটু বসো আমার কাছে? 

-কেন?

একটা বাঁকা তীক্ষ্ণ শলা যেন আমার চোখে বুকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল মেজোবউদি।-কেন, কী দরকার? 

আমার হাত আমার কথা শোনেনি। হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরেছিলাম। একটু বসো না, একটু কথা বলো। মেজদার ব্যবসা আজকাল কেমন– 

একটি ঝটকাতেই আমার হাত ছিটকে পড়েছিল। আমি অবাক হয়ে, প্রায় কাঁদতে গিয়ে থমকে তার ছিটকে বেরিয়ে যাবার পথের দিকে তাকিয়েছিলাম। পরমুহূর্তেই দরজায় আবির্ভাব হয়েছিল মেজদার। সে বুঝি তখুনি তার গদি (দোকান) থেকে ফিরেছিল। আমার সারা গায়ে কিল চড় লাথি পড়েছিল মুহুর্মুহু।–’ খোঁড়া বদমাইস, ভাজের গায়ে হাত দিতে শিখেছ? এতবড় সাহস তোমার? কানে শুনেছ বুঝি, তোমার প্রাণের বন্ধু হারাণ ঘটক বে’করেছে। তাই আর সামলাতে পারছ না নিজেকে?’ বলা আর মার। 

সেই প্রথম আবিষ্কার হল, আমি আর মানুষ নই। সেই প্রথম সবাই জানল, আমার এ ঘর একটি অন্ধকার সুড়ং। সেই থেকে নরেন্দ্রের অতীত বলে আর কিছু রইল না। 

আর হারাণ ঘটক? আমার বুকের মধ্যে আমি প্রলয় শঙ্খের গর্জন শুনতে পেলাম। আজ বাইশ বছর। বাদে। বাইশ বছর পরে, এই চৈত্রের বেলায়, প্রতি পলে পলে সেই দিনটি আমার মুখোমুখি এগিয়ে। আসছে। হারাণ ঘটক। নামটা মনে পড়ল, আর মুহূর্তে আমি আমার উরুতের নীচে শূন্য ঘৃণ্য জায়গাটার দিকে ফিরে তাকালাম। জল চাইনে। তৃষ্ণা নেই আমার। দরজাটা জোরে ঠেলে দিয়ে, ঠ্যাং ঘষে ঘষে আমি ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। হারাণ ঘটক! হারাণ ঘটক! আজ আমি তোমাকে অফিস-যাওয়া পায়ের মধ্যে দেখতে পেয়েছি। বাইশ বছর পরে, এই প্রাণকৃষ্ণ কুণ্ডু লেনের রাস্তায় তোমার নিউকাট-পরা পা দুটি আমি দেখতে পেয়েছি শক্ত পা, মোটা গোড়ালি, চকচকে জুতো। দেখেছি। দেখেছি, তোমার শক্ত পা তবু একবার থমকে গিয়েছিল আমাকে দেখে। মাটি বোধ হয় কেঁপে উঠেছিল তোমার পায়ের তলায়। শুধু ভয় নয়, একটা বিতৃষ্ণা দেখলাম তোমার পায়ে। নিউকাটের ঝলকে তোমার মনের কথা পড়লাম আমি, ইস! ভুল করে এ পথে চলে এসেছি। 

ভুল নয় হারাণ, বাইশ বছর পরে, তোমার নিয়তি তোমাকে টেনে এনেছে এ রাস্তায়। আমার শেষ, তার আগে তোমার নিষ্কৃতি নেই। 

আমার ঘুঁটে কয়লা যে কোণে থাকে, সেখানে ছুটে গেলাম আমি উরুত ঘষটে ঘষটে। কিন্তু যেতে গিয়ে থমকে গেলাম আবার। কে? ও জানালায় কে? বীরেন। বীরেন আর তার বউ। বীরেন বউয়ের চোখ টিপে ধরেছে। আমি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম, দেখতে পেলে বীরেন এসে মারবে আমাকে। বলবে, ছোট ভাইয়ের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা করে না পাজি?

বলেই মারবে। আমি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। দেখলাম জানালা দিয়ে কখন গুটিকয় আল, দু-একটা পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা ফেলে দিয়ে গেছে। নিজের রান্না নিজেকেই করে নিতে হয় আমার। অনেকদিন, প্রায় দশ বছর আর ওরা আমাকে রান্না করে দেয় না। 

নিয়মটা বীরেনই করে দিয়েছিল। যখন ও আমাকে প্রথম মারতে শুরু করেছিল। তখন নতুন বিয়ে করেছে বীরেন। আমাকে জানালা দিয়ে বিয়ে দেখতে হয়েছে। বড়দা মেজদার বিয়ে আমি বাইরে, সকলের সঙ্গে বসেই দেখেছিলাম। বীরেনের বিয়ের সময় আর সে সুযোগ পাইনি। কারণ, আমি যদি মেয়েদের গায়ে হাত দিই। আমি তো বিকারগ্রস্ত জড়বুদ্ধি পশু ওদের কাছে। নইলে, আমি কখনও মেজোবউদিকে ও কথা বলতে পেরেছিলাম? আমি কেন দেয়ালে মাথা ঠুকি? আমি কেন এক এক সময় আপন মনে কাঁদি? আমাকে কেন উলঙ্গ পাওয়া যায় ঘরের মধ্যে? মার খেয়েও আমি মরিনে কেন? নিশ্চয়ই আমি আর মানুষ নেই। কিন্তু হে সাতু চক্কোত্তি হে রাধাবল্লভ! তোমরা জানতে, বীরেনের বউকে আমি জেনেশুনে ইচ্ছে করে ভয় দেখাইনি। কতটুকুন ছেলেমানুষ তখন মেয়েটি। আমার ভাদ্রবউ না? আমি ভাশুর। কখনও ভয় দেখাতে পারি?

তবু বউটি ভয় পেয়েছিল। বীরেনের খেয়াল ছিল না। জানালার সামনেই বউকে আদর করছিল ও। আমার ঘরে আলো জ্বলছিল। আমি কালো ছায়ার মতো আমার জানালায় ছিলাম। প্রথমে খেয়াল করিনি। কিন্তু যখন খেয়াল হয়েছিল, তখন আর সরে আসতে পারিনি। বীরেনের গায়ে যে রক্ত, আমার গায়েও সেই রক্ত কি ছিল না? মনে হয়েছিল, আমার হাতও যেন কাউকে জড়িয়ে ধরেছে। আদর করছে। সেই বোবার কথা বলার মতো। একটা অবোধ যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতিতে আমার বুকের মধ্যে নীরব আর্তনাদ উঠছিল। 

ঠিক সেই সময়েই, একটি মেয়েলি আর্তনাদ উঠেছিল, ওগো, ওটা কী? ওটা কী ওই নীচের জানালায়? 

বীরেন তৎক্ষণাৎ ছুটে এসেছিল। সেই প্রথম চন্দ্রনাথের লাঠি আমার গায়ে কেটে কেটে বসেছিল।–জানোয়ার, ভাদ্দরবউয়ের দিকেও তোমার নজর? 

দাদারা বউদিরা বলেছিল, এটাকে এবার বিষ দিয়ে মেরে ফেলা উচিত। 

আমি পারি, এ সব কথা আমি লিখতে পারি। কিন্তু হায়, এমন আত্মকথা কখনও লেখা যায়? এতে কোনও নতুন সংবাদ নেই। কোনও মহত্ত্ব নেই। অথচ সংসারের সহস্র রকমের পাপের সঙ্গে আমার কোনও সংস্রব নেই। তবু আমার কথা লেখা যায় না। বলা যায় না। আমি যদি বলি, আমার দেহ বলে এখন আর কোনও কিছু অবশিষ্ট নেই। তাই শরীরে আঘাত করলে, এখন আর আমার লাগে না। দেহটা একটা পাথরের মতো, তার তলায়, কোথায় যেন আমি আছি। আমি নিজেও সেটা ভাল জানিনে। এও নিশ্চয় পাগলের প্রলাপ। কিন্তু কথাগুলি তো সত্যি। আমার দেহের কষ্ট এখন আর নেই বললেই চলে। সত্যি, আমার কোনও প্রতিবাদ কেউ শুনল না। মার খেয়ে খেয়ে, আমিও কেমন যেন ঘাঁটা পড়া, অবাক অবুঝ রাস্তার কুকুরটার মতো হয়ে গেছি। আমি নিজেও সেটা বুঝি।

তবু পাথরের তলায় চাপা-পড়া নরম মাটিতে কচি ঘাস গজানোর মতো এ জীবনটার কথা প্রতিনিয়ত কেন নতুন করে অঙ্কুরিত হত? কেন হয়? 

আমি বুঝতে পারতাম, ওরা আমাকে বিষ দিয়ে মারতে ভয় পায়। ভয় পায়, তার কারণ, আমি সাধু কুণ্ডুর সম্পত্তির মালিক। আমি যে খাই, সেটা আমারই টাকায় খাই। বাড়িতে আমার অংশটা তিন ভাই কিনে নিয়েছে। তার দরুন যে টাকা আমার পাওনা, তাই দিয়ে আমার খাওয়া চলে। যদিও ওরা বলে, আর আমার টাকা নেই। সবই ওরা দয়া করে দেয় এখন। বাইরের দিকে এ ঘরটা মা আমাকে জীবন-স্বত্ব দিয়ে গেছে। তাই ওরা আমাকে তাড়াতে পারে না। 

কিন্তু যদি ওরা আমাকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলে, তা হলে পুলিশ আসবে। এ কথা ওরা আমার সামনেই আলোচনা করে। পুলিশ এসে নাকি ওদের হেনস্থা করবে। বলবে নাকি, লোকটার সম্পত্তি বিক্রির টাকাটা তোমরা মেরে দেবার জন্য মেরে ফেলেছ। জীবনস্বত্ব ঘরটা ভাড়া খাটাবার লোভে লোকটাকে চিরজীবনের জন্য সরিয়েছ।

বাবা রে! ওরা এত কথাও চিন্তা করতে পারে? আমি পারি না। আমি শুধু নিজের চিন্তায় ভোর হয়ে থাকি। একটি জড় পদার্থ, অচৈতন্য থাকতে গিয়েও আমি দেখলাম, অনুভূতি আমার মরছে না। বোধ শূন্য হচ্ছে না। আমার রক্তের মধ্যে সে চুপি চুপি জেগে থাকে। দশজনের দশ রকমের কথা যেগুলি আমার কানে আসে, তার মধ্যে আমি আমার বোধকে দেখতে পাই। 

তবু নিজের প্রতি ঘৃণাটা আমার যায় না। কারণ, মাঝে মাঝে একটা কালো কুচকুচে ক্ষ্যাপা মোষকে আমি দেখতে পাই। এ মোষটা নিশ্চয়ই পৃথিবীর কোনও সুস্থ মানুষের মধ্যে নেই? এ নিশ্চয় শুধু আমারই রক্তে? মহৎ সৎ জীবনচরিত্র মালা’ সিরিজের ব্যক্তি চরিত্রগুলির কথা বাদই দিই। আর যাঁরা আত্মচরিত লিখতে পেরেছেন, তাদের কথাও বাদ। কারণ, তাদের হয়তো কিছু পাপের কথা বলা আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষদের সচ্চিন্তার সঙ্গে নিশ্চয় আমার তুলনা চলে না। আমি কী? আমি কি পাপ? একটা বলির পশু কি পাপ? তা নয়। বলির জন্যই পশু। আমি বোধ হয় তেমনি পশু। 

অথচ যুদ্ধ গেল, মন্বন্তর গেল, স্বাধীন হল দেশ। আমি চেয়ে চিন্তে খবরের কাগজ পড়েছি। আমি কোনও কিছুতেই অবুঝ হইনি। 

তবু আমার সর্বাঙ্গ কুৎসিত। আর এই কুৎসিতের মধ্যে সৃষ্টিহীনের যন্ত্রণাটা তবু গেল না কোনওদিন। সেই যন্ত্রণা আমার কখনও কমল না চারিদিকের মানুষকে দেখে। পুরুষ মেয়েদের দেখে। দেখে দেখে, নিজের মুখে নিজের হুল পুরে দেওয়া, পাকখাওয়া পিঁপড়েটার মতো মরছি।

এটাই তো আমার জীবন। বাইশ বছরের স্মৃতিতে আমার এইটুকু তো ওলট পালট করে দেখা। এই দেখাটাকেই আমি ভয় পেয়েছি। কারণ, এই দেখাটাই তো জীবনের শেষ। আর আমার কী দেখা বাকি থাকে? কিছু না।

আজ আমার ভয় গেল। আজ সেই বাঁধ ভাঙল। আজ আমি হারাণ ঘটককে দেখেছি। আর আমার ভয় নেই। এই তো আমি দাঁড়িয়েছি সেই দিনটির মুখোমুখি। অনেকক্ষণ আগে দাঁড়িয়েছি। শুধু গিয়ে পৌঁছুতে যেটুকু সময় লাগে। যে মুহূর্তে আমি হারাণ ঘটকের অফিস যাওয়া পা থমকাতে দেখলাম, সেই মুহূর্তেই আমার যাত্রা শুরু হয়েছে। আমি বাইশ বছর পেছিয়ে তোমার পা দেখলাম হারাণ ঘটক। তোমার নিয়তি তোমাকে আজ বাইশ বছর বাদে টেনে নিয়ে এসেছে এই প্রাণকৃষ্ণ কুণ্ডু লেনে। বাইশ বছর আমাকে ছেড়ে কথা কইবে না। আমিও আর ছেড়ে কথা কইব না। আজ রাত্রে তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হবে। আজ রাত্রে আমি বাইশ বছর বাদে প্রথম বেরুব আমার এই গর্ত থেকে। আমার পলাতক, মার-খাওয়া কুণ্ডলী আমি আজ ধীরে ধীরে খুলব। হে সাতুঠাকুর, হে রাধাবল্লভ, আর আমি ঘুমোব না। আর আমি নিজের ছায়াকে মারব না। তারপরে গিয়ে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব হারাণ ঘটক! হারাণ! হারু! কেন দেখা করব তুই বুঝতে পারছিস? সমস্ত যন্ত্রণাটাকে শেষ করব বলে। কোন যন্ত্রণা, তোর মনে আছে? 

মনে আছে, সেই গঙ্গার ধারে, মাদারতলায়, তুই আর আমি বসেছিলাম? বাইশ বছর আগে, আমরা পনেরো বছরের দুইজন। হারাণ ঘটক আর নরেন্দ্র কুণ্ডু। দুই প্রাণের বন্ধু। 

তুই বললি, পারবি তো নরেন?

আমি বললাম, খুব পারব। তুই পারবি তো হারু?

 তুই বললি, আমার আর কোনও ভয় নেই। চল তবে যাই।

দুজনেই উঠে পড়লাম। আমাদের দুজনের জীবনের সব লজ্জা, সব বিদ্রূপ, সব মিথ্যা এক ঠাঁই এক প্রাণ করে দুজনেই গেলাম সেই মানদার রেল পুলের নীচে। কালা-সাহেবের বাগানের শুকনো পাতা মাড়িয়ে আমরা এগুতে লাগলাম। মরণের চেয়েও খারাপ, কেমন বীভৎস অশুভ একটা সাঁই সাঁই শব্দ হচ্ছিল বাতাসে। শুকনো পাতার শব্দগুলি কেমন যেন বুকের মধ্যে মরমর করছিল। আমরা দুজনেই পরস্পরের দিকে তাকিয়েছিলাম। আমরা হাসতে চেয়েছিলাম। পারিনি। শুধু মনে হয়েছিল, আমাদের দুজনেরই জ্বর হয়েছে। 

তোকে বাড়িতে মেরেছিল। আমাকে মারেনি, কিন্তু বাবা দাদা মা অপমান করেছিল। সবাই আমাদের দুজনকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে বলেছিল, এই যে মানিকজোড়। গোল্লায় গেছ দুটিতে। 

আমরা সেই সব স্মরণ করে ক্রমেই এগিয়ে গিয়েছিলাম কালাসাহেবের বাগান দিয়ে। বাগান শেষে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙোতে গিয়ে আমাদের গা ছড়ে গিয়েছিল। (এখন মনে হলে কী ঘেন্না করে! কত অবাস্তব! না হারু?) আমরা দেখেছিলাম, ডাউন দিয়েছে, ট্রেনটা আসছে। যদিও ট্রেনটা দেখা যায় না। কারণ আমরা একটা বাঁকের মুখে ছিলাম। 

তুই প্রথমে একটা লাইনে গলা পেতে দিলি। বললি, আর একটা লাইনে, মুখোমুখি গলা পাত নরেন। 

আমরা দুজনেই গলা পেতে দিয়েছিলাম। তুই বলেছিলি, আর একবার পরীক্ষা দিলে নিশ্চয়ই ম্যাট্রিক পাশ করতে পারতাম। কিন্তু কেন মারল আমাকে? 

আমি বলেছিলাম, ওরা আমাদের অবিশ্বাস করে। এ লজ্জা নিয়ে আমি বাঁচতে চাই না। কেন আমরা কি লেখাপড়া করিনি? আমরা কি খালি ফাঁকি দিয়েছি? 

তুই বললি, ওরা বলে আমি নাকি নস্যি নিই, বিড়ি খাই।

আমি বললাম, আমাকে বলে, আমি নাকি পয়সা চুরি করে সিনেমা দেখতে যাই। অথচ 

–অথচ তুই কখনও মুদিখানার ব্যবসা করতে চাসনি। তুই খুব বিদ্বান হতে চেয়েছিলি নরেন।

–আর তুই রবিঠাকুরের মতন কবি হতে চেয়েছিলি হারাণ। 

তখন লাইনে ঝমঝম শব্দ হচ্ছিল। আমাদের মনে হয়েছিল, আমাদের বুকেই শব্দ হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন পিছন থেকে আমার পা দুটি ধরে টেনে তুলে নিতে চাইছে লাইন থেকে। আর তোর হাত দুটি কাঁপছিল থরথর করে। গাড়িটা দেখা দিতে না দিতেই, আমাদের কাছে এসে পড়ল! ঘন ঘন হুইসল দিল। তুই মাথা তুললি, আমি দেখলাম। সেই যে মাথা তুললি, আর পাততে পারলিনে। লাফ দিয়ে উঠে পড়ে বলেছিলি, পারব না নরেন, আমি পারব না। 

তোকে উঠতে দেখেই আমিও লাফ দিয়ে উঠেছিলাম। ভুল করে তোর দিকে ছুটে গেলাম। কিন্তু যাওয়া হল না। এঞ্জিনটা আমার গায়ের ওপর দিয়ে চলে গেল। 

তারপরে যখন আমার জ্ঞান হল, আমি জানলাম, আমি মরিনি।

আমি মরিনি, হারাণ ঘটক! সে দিন তুমি মনস্থির করতে পারনি। আজ কিন্তু আমার মন স্থির। 

না, আমার জল চাইনে। আমার তৃষ্ণা নেই। সন্ধ্যা বুঝি হয়ে এল। আমার ক্ষুধাও নেই। আমার সামনে থেকে তরকারিগুলি আমি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। উরুত ঘষে ঘষে আমার রান্নার জায়গায় গেলাম। কোথায় সেটা? আমার তরকারি কাটার ধারালো ছোট বঁটিটা। যেটা অনেকদিন অনেক রকমভাবে আমার চোখের সামনে নেচেছে, ডেকেছে, হেসেছে। 

এই যে! পেয়েছি। আমার হাতে অসুরের বল পেলাম। নোড়া দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে, কাঠ থেকে বঁটিটাকে আলাদা করে নিলাম। 

হারাণ ঘটক, আজ প্রাণকৃষ্ণ লেনে তুমি তোমার অন্তিম দিনে ঢুকেছিলে। তুমি পরের বছর ম্যাট্রিক পাশ করেছিলে। ভাল চাকরি পেয়েছ, বিয়ে করেছ। তোমার কয়েকটি ছেলে মেয়ে হয়েছে। চাকরিতে তোমার বেশ উন্নতি হয়েছে। তুমি আজকাল নাকি মদ্যপানও কর। স্ত্রীতে অনাসক্তির দরুন বেশ্যালয়ে নাকি তোমার আনাগোনা। আরও শুনেছি, তোমার উন্নতির মূলসূত্র নাকি চটকলের রেশন চুরি। একবার তোমার চাকরি যেতে গিয়েও, ঘুষ দিয়ে বেঁচে গেছ। 

মহৎ নও জানি। আত্মচরিত আমার তোমার কারুরই লেখবার মতো নয়। তবু তুমি সাধারণ মানুষদের রঙ্গমঞ্চে লীলা করছ। আমি সেই মঞ্চের তলায়, কাঠের আর পেরেকের খাঁচায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি। কেন হারাণ? 

তখন আমরা ছেলেমানুষ ছিলাম। শুধু সেই একটুখানি ছেলেমানুষির জন্য? না, তা হবে না। আজ আমি আবার যাব হারাণ। আমরা আবার দুজনে মরব। আমার সঙ্গে মরণের নিয়তির হাত থেকে তোমাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। 

.

ঢং ঢং ঢং! কাঁসর ঘণ্টা বাজনা আরম্ভ হয়ে গেল। রাধাবল্লভের আরতি শুরু হয়ে গেল। কাঁসরের শব্দটা আমি কোনওদিনই ভালবাসিনে। আজকে আমার কানে ঢুকল না। আমি জামা গায়ে দিলাম। ধারালো বঁটিটা গুঁজে নিলাম কোমরে। তারপর দরজায় গিয়ে বসলাম। 

পায়েরা চলেছে। পাগুলি সবই প্রায় ঘরমুখো। উজানে কিছু বেড়ানো পা। আজ আর আমি কোনওদিকে তাকাব না। সাত চক্কোত্তির দোতালায় নয়। আজ আর আমি আমার রক্তের সঙ্গে মিশে নিজেকে হারাব না। 

কাঁসর থামতেই ভাগবত পাঠ শুরু হল। না, হে সাতু ঠাকুর, আজ আমি ঘুমোব না। আমি জানি, তুমি আমাকে শান্ত করতে চাইবে। কিন্তু তুমি জানো, এ সেই বাসুকীর কুণ্ডলী স্থলন। আজ তুমি বোলো না, ‘নরেন্দ্র ঘুমোও।’ 

থেমেছে ভাগবত পাঠ? হ্যাঁ, থেমেছে। আবার জ্যাঠাইমার সেই গলা, 

এ আঁধারো অন্নবো। 
পার কর রাধাবল্লভো।

অভ্যাসবশে আমিও মনে মনে আওড়ালাম। রাস্তা একেবারে নির্জন হল। দরজা বন্ধ হল মন্দিরের। এবার আমি যাব। হারাণ, আমি সারারাত্রি কোথায় অপেক্ষা করব তুমি জান? তোমাদের বাড়ির পিছনে একেবারে বাগানের ধারে। কারণ, সেখানেই তোমাকে আমি একলা পাব। আমি দেখতে পাচ্ছি মিলে যাবার আগে, ভোররাত্রেই তুমি গামছাটি পরে গাড়ু হাতে আসছ নির্জন বাগানে, খিড়কির দোর খুলে। তোমার কানে থাকবে হয়তো পৈতা জড়ানো। তুমি তো আবার সাত্ত্বিক মানুষ।

কোনখান দিয়ে ঢুকব? কেন, তোমাদের বাড়ির যে দিকটায় পুকুর, সেই পুকুরের পাড় দিয়ে, সেই ঝুপসি বটগাছটার তলা দিয়ে, বাগানে যাব। কারণ খিড়কির দোর খুললেই, বাগানের হাতায় তোমাদের পায়খানা। গিয়ে পায়খানার অন্ধকার সিঁড়ির পাশে লুকোব। তুমি যে মুহূর্তে সিঁড়িতে পা দেবে, সেই মুহূর্তেই আমার শক্ত হাতে তোমার পা ধরে হেঁচকা টান দেব। টেনে মাটিতে ফেলব, যাতে তুমি দৌডুতে না পার। তারপর তোমার বুকে চেপে 

বীরেন! চলি ভাই। আমাকে দেখে আর তোর রাগ হবে না। আমার কিন্তু ভাদ্দর বউয়ের সশ্রদ্ধ ভাশুর হতে খুব ইচ্ছে ছিল রে। মেজদা, চলি। আমার মুখ দেখে আর তোমার অযাত্রা হবে না। মেজোবউদি, মিছে বলব না। তোমার কাছে আমি চিরকাল ধরে বসতে চেয়েছি। কিন্তু তোমায় দুঃখ। দেবার জন্যে নয়। একটু বসে থাকা, তীর্থের কাকের মতো। তোমার ঘর গৃহস্থালির দুটি-চারটি কথার, কাজের ফাঁকে, ঠাকুরপো’ বলে এক আধবার তুমি ডাকবে, একটু বা ধমকাবে তোমার চোখ তুলে, অমন রাক্ষসের মতন দেখছ কী গো!’ এইটুকু চেয়েছি। 

একটু হাসবে নয় রাগবে। চলতে ফিরতে তোমার চুলের, তোমার শাড়ি জামার একটু গন্ধ বাতাসে ভাসতে থাকবে। এইটুকু চেয়েছি। 

আঃ! মেজোবউদি, আঃ! শুধু একটু দেখায়, শুধু একটু শোনায়, বিরাট এক ক্ষ্যাপা কালো কুচকুচে মোষ একেবারে নিঃশব্দে, বিকারহীনভাবে বলি হতে পারত। কিন্তু, বোধ হয়, ভাগ্য আমার যদিও বলির মানত করা পশুর সঙ্গে জড়িয়ে, তবু, সময়ের আগেই বহু কলঙ্কের ক্ষতে আমি নষ্ট হয়েছি। ভ্রষ্ট হয়েছি। এ বলি তুমি নিলে না। মেজোবউদি, তোমার স্বামী যেদিন রাত্রে বাড়ি থাকে না, সেই ঘুম-না-আসা, চেয়ে থাকা অন্ধকারে, কখনও কি আমাকে দেখতে পাও?

না থাক। পেলে তুমি ভয় পাবে। আমার প্রতি ঘৃণা আরও বাড়বে। আমার দোষ নেই মেজোবউদি, এ ঘরে আমার অস্তিত্বের কথা, তোমাদের অভ্যাস অনেকদিন ভুলতে দেবে না। কিন্তু আজ আমার। শেষ। বড়দা, বড়বউদি, তোমাদের আমি আমার বাবা মায়ের মতো দেখেছি। তোমাদের দুজনের কি। মাঝে মাঝে মনে হত, আমার জীবনটা সত্যি বড় অসহায়, করুণ! কাল কিন্তু তোমরা সবাই চমকে উঠবে। জেঠি, মরতে চাইনি। তবু তোমার গান ছাড়া আমি আর গান শিখিনি। 

কোমর থেকে বঁটিটা খুলে, আগে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেললাম। আমাকে ঝাঁপ দিয়ে নর্দমাটা পার হতে হবে। কারণ মাঝখানে কিছু পাতা নেই। আমি যদি বেরিয়ে যাই, সেইজন্যই কখনও কিছু পেতে দেওয়া। হয়নি। ঝাঁপ দিতে গিয়ে পড়ে গেলে, আমি আর উঠতে পারব না। কালকে বীরেনরা মারতে মারতে তুলবে। 

তবু এই গর্তে আর নয়। আমি ঝাঁপ দিলাম।

একী? আমার গায়ে এ কীসের স্পর্শ? আমি লুটিয়ে পড়লাম রাস্তায়। হাতড়ে হাতড়ে ঠাণ্ডা বস্তুটি অনুভব করলাম। ও! মাটি! নিচু হয়ে আমি গন্ধ নিলাম। মাটি! আমি মাটির স্পর্শ ভুলে গেছি? ওই গর্তটায় এতদিন এ গন্ধ তো পাইনি। 

আমার গায়ে বাতাস লাগল। আমি তো এ বাতাস কখনও পাইনি আমার গায়ে! এ কোথাকার বাতাস? এই পৃথিবীর? 

আমার উচ্ছিষ্টভোগী পরিচিত কুকুরটা এসে দাঁড়াল কাছে। বঁটিটা শুকল। বঁটিটা তুলে আমি কোমরে গুঁজলাম। প্রাণকৃষ্ণ কুণ্ডু লেনটা পার হতে লাগলাম উরুত ঘষটে ঘষটে। আমার মনে পড়ল আমার গন্তব্য। আশ্চর্য! এমন অন্যমনস্ক আমি? 

আচ্ছা, ডান দিকের এ বাড়িটা কাদের? বিশুদের তো? আর বাঁ দিকে? নয়ন স্যাকরার না? তা কী করে হবে। বাঁ দিকেরটায় তো সেই একুশ আঙুল ডাক্তারবাবু ছিলেন। আমি কি সব ভুলে গেছি? 

বাতাস লাগল আবার। এ কী, এটা কোথাকার বাতাস? এই পৃথিবীর? আমার গায়ে কাঁটা দেয় কেন তবে? আমার গায়ের লোমগুলি এমন শিউরে শিউরে উঠছে কেন? 

প্রাণকৃষ্ণ কুণ্ডু লেনের মোড়ে এলাম আমি। আমি যেন একটা বড় ব্যাং। হাতে ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এলাম। এ রাস্তাটার নাম যেন কী? হাচিনসন রোড? না, এটা তো সেই পুরনো হাড়িপাড়া। নাম ছিল হরিলক্ষ্মী রোড। 

এ কী! কীসের গন্ধ লাগছে আমার নাকে? ফুল, ফুলের গন্ধ? আমি পাগলের মতো চারদিকে তাকাতে লাগলাম। বহু জন্ম আগে যেন এ গন্ধটাকে আমি চিনতাম? ও! এ কি সেই বাতাবি লেবু ফুলের গন্ধ? আমি তো এ গন্ধ বড় ভালবাসি। 

এ জন্য কেন কাঁদি? আমি কি জানতাম, এ সব রয়েছে এ পৃথিবীতে? হঠাৎ চমকে উঠলাম একটা শব্দে। গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। আমি হরিলক্ষ্মী রোডের ডানদিকে তাকালাম। যেদিকে আলকাতরা ঢালা বড় রাস্তাটা দেখা যায়। আমার চোখের উপর দিয়ে একটা মোটর গাড়ি চলে গেল। মোটর গাড়ি! মোটর গাড়ি! আমি কখনও বুঝি দেখিনি। সহসা আমার সমস্ত স্মৃতি তোলপাড় করে উঠল। আমি ছেলেমানুষের মতো বড় রাস্তার দিকে ছুটতে গেলাম আর সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেলাম মুখ থুবড়ে। 

কিন্তু আবার! আবার মোটর গাড়ি। ওই তো যাচ্ছে। আরে? আমার হাততালি দিয়ে উঠতে ইচ্ছে করল। 

আজকাল অনেক মোটর গাড়ি হয়েছে, শুনতে পাই। যুদ্ধের পরে সব নাকি বদলে গেছে। যাব নাকি একবার আমাদের ইস্টিশনের দিকে?

কুকুরটা এসে দাঁড়াল আমার মুখোমুখি। আমার গন্তব্যের কথা মনে পড়ল। কিন্তু ডান দিকে তো আমার যাওয়া চলবে না। বাঁ দিকে যেতে হবে। বাঁ দিকে গিয়ে, তারপর ডানদিকে, রক্ষাকালীতলার পথে যেতে হবে। আমার সব মনে পড়ছে। বাঁয়ে মোড় নিলাম আমি। 

কিন্তু সেই গন্ধটা তো বিদায় হয়নি। ধুলো উড়ছে বাতাসে। আঃ! ধুলো হাতে নিয়ে ঘাঁটতে এত ভাল লাগে? আমার হাতের প্রতিটি বিন্দু, ধুলোর প্রতিটি চূর্ণকে যেন অনুভব করছে। 

এ আবার কীসের গন্ধ? এটা সেই হরিআনন্দদের বাড়ি না? হ্যাঁ, তাই এত কনকচাঁপার গন্ধ। এ গন্ধটা তা হলে এ পৃথিবীতে ছিল? মাগো, তুমি না কত ভালবাসতে এ ফুল? ও নরু বাবা, আমায় দুটি কনকচাঁপা এনে দিস কোথাও থেকে। মা, আমিও যে বড় ভালবাসতাম এ গন্ধ। 

আ, আমি কেন কাঁদি? এত আনন্দ আমার কোথায় ছিল? সত্যি, কেমন করে গন্ধ হয়? আঃ, ইস! পাকা বেলের গন্ধ লাগছে আমার নাকে। আরে, তুলসী পাতার এমন গন্ধ তো আমি কখনও পাইনি। জ্যাঠাইমা না আমাকে কত বলত, ও বাবা নরু, আমাকে ভাল তুলসী পাতা তুমি এনে দিয়ে। তোমাকে বাতাসা দিয়ে তুলসী পাতা খেতে দেব। রাধাবল্লভ তোমাকে খুব ভালবাসবে। 

আমার বুক থেকে একটা অসহ্য বেগ মুখ দিয়ে উঠে আসতে চাইছে। ধুলোতেই মুখ চেপে ধরলাম আমি। আঃ! আমার এত আনন্দ আমি আর ধরে রাখতে পারছি নে। এ সব যে ছিল, আমি তো জানতাম না। এত আনন্দ হলে বুকে বড় ব্যথা লাগে। 

হঠাৎ দুটো কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এল আমার দিকে। আমি শক্ত হয়ে উঠলাম। যদি কামড়ে ছিঁড়ে দেয়! কিন্তু আমার সঙ্গে সেই কুকুরটা ছিল। সে রুখে দাঁড়াল। কুকুরটা তা হলে আমাকে ভালবাসে।

এই-ই তো সেই জগত। আমি জগতটাকে ভুলেই গিয়েছিলাম। কিংবা আমি আবার গত জন্মে এ পৃথিবীতে এসেছিলাম। আমি যে চোর নই, অরক্ষণীয় নই, এটা যেন বুঝল কুকুর দুটো। কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে চলে গেল! 

ওই যে রক্ষাকালীতলা। ঝুড়ি নামা সেই বটগাছ। অন্ধকার দিনেও থাকে। রাত্রে আরও, নীর, নিকষ কালো। একটি মাত্র টিমটিমে বিজলি আলোয়, পিছনের অন্ধকারে কারুর লুকিয়ে থাকাটা যেন আরও বেশি মনে করিয়ে দেয়। 

আবার গন্ধ। জুই, এ জুই ফুলের গন্ধ। না কি বেলি? রক্ষাকালীতলা পার হয়ে, বাঁ দিকে মোড় নিতেই, সেই বাগান। তাই এত উঁই বেলির গন্ধ। 

মনে আছে হারু, এ বাগান থেকে আমরা অনেক উঁই বেলি তুলেছি। আর সেই মোহনদা, মোহন রক্ষিত, আমাদের বাংলা পড়াতেন স্কুলে, কবিতা লিখতেন, সুন্দর দেখতে, আর ভালবাসতেন গার্লস স্কুলের হেডমিস্ট্রেস বিধবা হেনাদিকে, যে জন্য তাঁর অনেক দুর্নাম ছিল, সেই মোহনদাকে আমরা জুই আর বেল ফুল দিয়ে আসতাম। কারণ, আমরা জানতাম, সেই সব ফুলই মোহনদা হেনাদিকে দেন। হেনাদির খোঁপায় পরিয়ে দিতেন। তাঁদের বিয়ে হবার কথা হয়েছিল! কিন্তু, কাল রোগে ধরল মোহনদাকে। যক্ষ্মা। আর হেনাদি কলকাতায় গিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করেছেন। 

কী ভয়ংকর ব্যর্থতা, কিন্তু আর একজনের তাতে কী আসে যায়, এ সংসারে।

মোহনদা বলতেন, আমাকে আর তোকে তোমরাও ফুলের মতন। 

আঃ, ফুলের মতো। এই জীবন ফুলের মতো। কুষ্ঠ কুৎসিত কীটের গর্ত থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর সেই কথাগুলি আমার মনে পড়ছে। 

কীসের শব্দ আসছে? ওই দুরে, আকাশের গায়ে ওটা কী? এ কী, আকাশে ওটা কালপুরুষ না? ওই তো বুঝি সপ্তর্ষিমণ্ডল। এই তো ছায়াপথ আমার ডাইনের আকাশে। মৃগশিরা নক্ষত্র যেন কোথায়? 

সবই তো আছে? এ পৃথিবীতে কিছুই তো হারায়নি। আমি না কী হতে চেয়েছিলাম? বিজ্ঞানী! আরে! কাঁচা আমের গন্ধ পাচ্ছি যেন। কীসের শব্দ আসছে? দূরে আকাশের গায়ে ওটা কী? হারাণদের বাগানের পাশ দিয়ে আমার চোখে পড়ল। 

আমি এগিয়ে গেলাম। এ কী, গঙ্গা! গঙ্গা ঠেকে আছে আকাশে? গঙ্গার জলের গন্ধ আমার চেনা। নিরু আমাদের বড় পুণ্যিমন্ত ছেলে। হ্যাঁ বাবা নরু, এক কলসি গঙ্গা জল এনে দিয়ে। তোমার জেঠির লাগবে, আমারও লাগবে। ভগবান তোমাকে বছর বছর পাশ করিয়ে দেবে।’

মা গো, তুমি কী করে বলেছিলে? না, আমি কেন কাঁদি? আসলে তো আমার হাসিই পাচ্ছে। আমি কি তখন বুঝতাম? আমি তো ছেলেমানুষ ছিলাম। 

আমি গঙ্গার জল একটু ছোঁব। মা কত সন্ধ্যায় গঙ্গার জল ছিটিয়ে দিয়েছে গায়ে।–দেখি রে নরু, একটু বাইরের দোষ কাটিয়ে ঘরে ঢোক। তবে না লেখাপড়ায় মন বসবে রে।’ 

আহা! আহা! মা গো, ও জেঠি, আমি একটু গঙ্গা জল ছোঁব। বড্ড যে ঢালু এ জায়গাটা। তবু নামি। সাবধান গড়িয়ে গড়িয়ে নামি।

এই তো, বিষকাটারির জঙ্গল। হাত পা কাটলে, এ পাতা থেঁতো করে কত লাগিয়েছি। আঃ, কী নরম মাটি! পলি মাটি।-ও বাবা নরু, একটু গঙ্গা মাটি আমাকে এনে দিয়ে বাবা, রাধাবল্লভের আসনের নীচে একটু নেপে দেব। রাধাবল্লভ তোমাকে সুমতি দেবেন।

আঃ, এই না সেই মাটি! না, আমার এত আনন্দে বড় কষ্ট হচ্ছে। হামা দিয়ে আমি জলের কাছে গেলাম। হাত দিলাম জলে। আর আমি আমার বুকে-চেপে-রাখা তীব্র আনন্দময় কান্নাটার চিৎকার থামাতে পারলাম না। এখানে আমি কত ভেসেছি। কত ডুবেছি। কী আশ্চর্য! এ পৃথিবীতে তেমনি গঙ্গা গান গেয়ে যায়?

ওটা কী? সহসা নদীর বুকে একটি কালো ছায়া আমার চোখে পড়ল। একী, একটা নৌকা? কালো নৌকা। পালটাও কি কালো? কে আসে ওই নদীতে। রাত্রি কি নেই? তাই তো, আকাশে যে আলোর রেখা দেখি! হারাণ, আমার যে সময় হল না। আর আমি সময় চাইনে। আমি কি জানতাম, বাইরে পৃথিবীটা আছে। সেখানে এত আনন্দ আছে? শুধু আমিই গর্তের মধ্যে বাইশ বছর ধরে, একটা ধিক্কার, বিকার, কষ্ট, দুঃখ, অনুশোচনা, যন্ত্রণাকে বাড়িয়েছি। বিরাট করেছি, বিশাল করেছি। 

আর করব না। ওই নৌকোটা কোথায় যাচ্ছে? জেলে নৌকা না কি? কী রকম কালো, কিন্তু ঢেউয়ে কেমন নাচছে। ওর মধ্যেও একটা হিল্লোল আছে। তরঙ্গে চলছে। আরও বেলা হলে অমন কালো ছায়া দেখাবে না। 

হারাণ, তুই কাজে যা। আজ বুঝি শুধু তোর কাছেই আমার বিদায় নেওয়া বাকি ছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য মোটা আমার হাড়। চামড়াও। বঁটিটা ভেদ করেও রক্ত কেমন থমকে রইল পাঁজরায়। আমার বুকের হাড়ও খুব শক্ত। এত জোরে বঁটিটার ওপর শুয়েও, তার আমূল আমি অনুভব করছি হৃৎপিণ্ডে। এখনও আমি গঙ্গার জলের ছলছলানি শুনছি। কিন্তু আমার শরীরে অনুভূতি তো কবেই মরেছে। 

পৃথিবীর এমন হাসি আমি কতদিন শুনিনি। আমার পাথরের তলায় নরম ঘাসগজানো মাটিতে সেই জল ঘা খাচ্ছে। আমি ওখানেই ছিলাম। শেষ মুহূর্তেও রইলাম।