বিবর্তনশীল হিন্দুধর্ম
‘ঈশ্বর এক তাঁর রূপ অনেক’ এই বিশ্বাসের মধ্যে হিন্দুর বর্তমান ঈশ্বর ভাবনার একটা পরিচয় পাওয়া যায়। আবার এ বিশ্বাসেই লুক্কায়িত আছে হিন্দুর বিবর্তনের ইতিহাসও। এ বিবর্তন বহুকাল ধরে ঘটেছে। প্রথমাবস্থায় হিন্দুর কল্পনায় ‘একেশ্বরের’ কোনো ধারণা ছিল না। এ অঞ্চলের আদি অধিবাসীদের (ভূমিপুত্র) বিশ্বাস ছিল বহু দেব- দেবীতে। এর সাথে যোগ হয় বহিরাগত আর্যদের নিজস্ব দেবতামণ্ডলী যাদের বৈশিষ্ট্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নতর। ফলে উদ্ভূত হয় দুই শ্রেণির দেবতামণ্ডলী। একদিকে ভূমিপুত্রদের দেব-দেবী ও অন্যদিকে আর্যদের দেবতামণ্ডলী। এই দুই শ্রেণিভুক্ত দেব- দেবী এক দীর্ঘস্থায়ী দৈব-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত আপোষরফার পথ ধরে। আত্মীকরণের মাধ্যমে তৈরি হয় সমন্বিত দেবতামণ্ডলী। দেব-দেবীর এই রূপান্তরের একটা সুন্দর বর্ণনা ও বিশেষণ পাওয়া যায় ড. সুকুমারী ভট্টাচার্যের গ্রন্থে (দি ইণ্ডিয়ান থিয়গনি: ব্রহ্মা বিষ্ণু এ্যাণ্ড শিব : পেঙ্গুইন বুকস : ইণ্ডিয়া : ২০০০)।
ড. ভট্টাচার্য হিন্দুর দেবতামণ্ডলীকে দুটো ভাগে ভাগ করেছেন। এ দুটো ভাগ হচ্ছে : ক. শিব ও শিব সংশিষ্ট দেবতামণ্ডলী এবং খ. বিষ্ণু ও বিষ্ণু সংশিষ্ট দেবতামণ্ডলী। প্রথমোক্ত ভাগে আছেন: মাতৃদেবীগণ, যম ও যমী, কার্তিক, গণেশ, রুদ্র-শিব ও উমা- অদিতি-লক্ষ্মী ইত্যাদি। দ্বিতীয় ভাগে আছেন: সূর্য, সাবিত্রী, মিত্র, ভগ, অশ্বিন, ইন্দ্র ও কৃষ্ণ ইত্যাদি। এই দুই শ্রেণির দেবতামণ্ডলীকে পৌরাণিক কালে (খ্রিস্ট-পূর্ব ২০০ থেকে খ্রিস্টাব্দ ৬৯০) নানা পুরাণ কাহিনীর মাধ্যমে একটি সমন্বিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এতেই গড়ে ওঠে হিন্দুর ‘ত্রি-দেবতা’ অর্থাৎ ‘ত্রিমূর্তি’ ধারণা। এই ত্রিমূর্তির তিন দেবতা হচ্ছেন: ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। স্পষ্টতই বোঝা যায় এই ত্রিমূর্তির মধ্যে যেমন স্থান পেয়েছে আর্যদের দেবতা ব্রহ্মা ও বিষ্ণু, তেমনি স্থান পেয়েছে ভূমিপুত্রদের দেবতা শিব। এটি নিশ্চিতভাবেই একটা সমঝোতার ফল।
ত্রিমূর্তির ধারণা বহুকাল ধরে প্রচারের এক পর্যায়ে আসে মধ্যযুগ। এ যুগে মুসলমান আগমনের পর লোকায়ত দেব-দেবীগণ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে চলে প্রচণ্ড দৈব সংগ্রাম। আবার সমঝোতা স্বরূপ অনেক লোকায়ত দেব-দেবীকে শিবের সাথে সম্পর্কিত করা হয়। শিব বস্তুত মহাদেব বা মহেশ্বর রূপে আবির্ভূত হন। বলা যায় মহেশ্বর রূপ একেশ্বরেরই রূপ। কিন্তু একেশ্বর ধারণার সাথে অন্যান্য দেব- দেবীকে সম্পর্কিত রাখারও প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এরই ফলস্বরূপ আমরা পাই ‘ঈশ্বর এক তাঁর রূপ অনেক’ এ ধারণা।
ওপরে বর্ণিত প্রেক্ষাপটে বোঝা যায় ‘একেশ্বর’ কল্পনাকে ঘিরে হিন্দুর দেব-দেবী সৃষ্টি হয় নি। একেশ্বর বিভক্ত হয়েও বহু দেব-দেবীও সৃষ্ট হয় নি। বরং বহু দেব- দেবীকে সমন্বিত রূপ দিতে গিয়েই ‘একেশ্বরের’ কল্পনা করতে হয়েছে। কারণ ভূমিপুত্রদের মধ্যে প্রচলিত বহু দেব-দেবীর ধারণাকে অস্বীকার করে ‘হিন্দু’ ধারণাটি সৃষ্টি করা সম্ভব ছিল না। ধর্মবেত্তারা তাই শেষ পর্যন্ত বহু দেব-দেবীর সাথে ‘একেশ্বরবাদের’ ধারণা সংযুক্ত করে। মনে হয় খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম ধর্মের একেশ্বরবাদের ধারণা এ ক্ষেত্রে কিছুটা অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু লক্ষণীয় এতদসত্ত্বেও একেশ্বরবাদের কল্পনা হিন্দুর মনে দৃঢ়মূল হয় নি। এই কল্পনাটি শিক্ষিত হিন্দুর একাংশের মধ্যে কাজ করে বলে বোঝা যায়। অপরদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু মাতৃদেবী ও বহু দেব-দেবী কল্পনার সাথেই অধিকতর যুক্ত। তাই দেখা যায় সাধারণ হিন্দু তার প্রাচীনতম শিবের ধারার দিকেই ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছে। ত্রিমূর্তির (ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব) মধ্যে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর প্রভাব ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। ভূমিপুত্রদের দেবতা শিব ‘মহেশ্বর’ নামে হিন্দুর কাছে ‘সুপ্রিম গড’ হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন।
দেব-দেবীর এই বিবর্তন প্রক্রিয়ার সাথেই হিন্দুর বিশ্বাসও বিবর্তিত হচ্ছে। হিন্দু কোনো সংগঠিত (অর্গানাইজড) ধর্ম না হওয়ায় এর বিবর্তন সম্ভব হচ্ছে। সংগঠিত ধর্ম একটি ছকে বাধা। এতে মূল বিশ্বাস অপরিবর্তনীয়। কিন্তু হিন্দু বিবর্তনশীল। তা হিন্দুর বিবর্তন পর্যালোচনা করলেই নজরে পড়ে। দেখা যায় দেব-দেবীর মতই ‘হিন্দু’ শব্দের অর্থও বিবর্তিত হয়েছে। যেমন ‘হিন্দু’ শব্দের সাথে প্রাথমিকভাবে ধর্মের কোনো সম্পর্ক ছিল না। পরবর্তী কালে ‘হিন্দু’ শব্দটি ধর্মের সমার্থক হয়। বর্তমানে ‘হিন্দু’ শব্দ, ‘হিন্দুধর্ম’ ও ‘হিন্দু সভ্যতা’ সমার্থক। একটি অবিচ্ছিন্ন ধারায় সিন্ধু সভ্যতা (দ্রাবিড় সভ্যতা) ও ঐতিহ্য বিবর্তনের মাধ্যমে ‘হিন্দু’ ধর্মে পরিণত হয়। এই বিবর্তনে গ্রহণ ও বর্জনের একটি প্রক্রিয়া বরাবর ক্রিয়াশীল ছিল। বলা যায় এই ক্রমবিকাশের ধারা এখনও বহমান। বর্তমানে ‘হিন্দু’ ধর্মকে আমরা যেরূপে পাচ্ছি তা কমপক্ষে ঐতিহাসিক চারটি যুগে সংঘটিত জটিল ধর্মীয় ও সামাজিক প্রক্রিয়ার ফসল। মোটা দাগে এই চারটি স্তর হচ্ছে: ক. বৈদিক কাল, খ. জৈন-বৌদ্ধ কাল, গ. পৌরাণিক কাল ও ঘ. মধ্যযুগ ও পরবর্তী কাল। নিচে এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হল:
১. বৈদিক কাল : আর্যদের আগমনের সাথে সম্পর্কিত বৈদিক কাল। ভারতে আর্যদের আগমনকাল নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি আছে। মোটামুটি ধরে নেওয়া হয় যে, তারা আজ থেকে ৩০০০/৪০০০ হাজার বছর পূর্বে ভারতে আসা শুরু করে। বলা বাহুল্য আর্য-পূর্ববর্তীকালে এদেশে মানুষ ছিল। ছিল তাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস। কী ছিল এই বিশ্বাস? এর একটা পরিচয় পাওয়া যায় ড. অতুল সুরের (হিন্দু সভ্যতার বনিয়াদ: বিশ্ববিদ্যা পরিচয়: প্রথম প্রকাশ : ১৯৯১) গ্রন্থে। এই গ্রন্থের আলোচনা থেকে দেখা যায় এই অঞ্চলের লোকেরা অর্থাৎ সিন্ধু (মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা) সভ্যতার লোকেরা ছিল: ক. কৃষি নির্ভর ও মাতৃতান্ত্রিক খ. মাতৃ পূজায় ও দেবীতে বিশ্বাসী গ. পরলোকে বিশ্বাসী ঘ. শিবের অনুসারী এবং ঙ. নিরামিশাষী। অপর পক্ষে আর্যরা ছিল: ক. পিতৃতান্ত্রিক খ. যাযাবর ও শিকারী (অকৃষিজীবি), গ. মাংসাশী ঘ. যজ্ঞে বিশ্বাসী ও ঙ. দেবরাজ ইন্দ্রের অনুসারী।
আর্যরা ছিল ভারতে আক্রমণকারী (ইনভেডার) ও বহিরাগত। তাদের কোনো সভ্যতা ছিল না। অপরপক্ষে সিন্ধু সভ্যতা অর্থাৎ দ্রাবিড়, মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতার লোকেরা ছিল একটি উন্নত সভ্যতার লোক। উচ্চতর সভ্যতার জনগোষ্ঠী অর্থাৎ ভূমিপুত্রদের সাথে নিচু মানের সভ্যতাবিহীন আর্য জনগোষ্ঠীর বিবাদ-সংঘর্ষ তাই ছিল অবধারিত। এই সংঘর্ষে ছিল দুইপক্ষ। একপক্ষে শিবের ধর্ম, অন্যপক্ষে আর্য-ধর্ম অথবা ব্রাহ্মণ্যধর্ম। এই সংঘর্ষ দীর্ঘস্থায়ী হয়। বহুকাল ধরে চলা এ সংঘর্ষের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে দুইয়ের সংশ্লেষণ বা পারস্পরিক বোঝাবুঝি। কালের ব্যবধানে সামাজিক মেলামেশা ও বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে এই দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধীরে ধীরে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
রামায়ণ ও মহাভারতের প্রধান প্রধান চরিত্রের জন্ম কাহিনীই ভূমিপুত্র ও আর্যদের মেলামেশার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। দেখা যায় মহাভারত রচয়িতা ব্যাসদেবের মাতৃকুল ধীবর জাতির (ভূমীপুত্রী)। ব্যাসদেবই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস নামে পরিচিত। কারণ তিনি বেদকে বিন্যাস করেন। তার চেহারা ছিল কালো। আর্যদের চেহারা কালো হওয়ার কথা নয়। এই ব্যাসদেবের দুই সন্তান ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু মহাভারতের যুদ্ধের প্রবল দুইপক্ষ। দু’য়ের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ও পাণ্ডু পাণ্ডুর বর্ণের। ব্যাসদেবের ‘বীভৎস’ ও কালো চেহারাই যে এর জন্য দায়ী এ কথা মহাভারতেই উল্লেখিত আছে। বলা বাহুল্য রক্তের মিশ্রণ ছাড়া এটি সম্ভব নয়। এদিকে রামায়ণের রচয়িতা বাল্মীকিও অন্ত্যজ শ্রেণির লোক বলে অন্নদাশঙ্কর রায় (গ্রন্থ : সাতকাহন : করুণা প্রকাশনী : কলকাতা, ১৩৮৬) মনে করেন। রক্তের এই ধরনের মিশ্রণের বহু উদাহরণ থেকে বোঝা যায় ভূমিপুত্র ও আর্যদের মধ্যে মেলামেশা শুরু হয় বহুকাল পূর্বেই। এই মেলামেশার ফলে দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতার পরিবেশ তৈরি হয়।
২. জৈন-বৌদ্ধ কাল : ভূমিপুত্র ও আর্যদের এই সংঘর্ষ, সমন্বয় ও সংশ্লেষণের এক পর্যায়ে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর দিকে জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীর বর্ধমান ও বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক ভগবান গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব। জৈনধর্ম ভূমিপুত্র ও আর্যদের সংঘাত পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে অহিংসার অমর বাণী প্রচার করে। এ ধারায় গৌতম বুদ্ধ যোগ দিয়ে সামাজিক ও ধর্মীয় সাম্যের বাণীতে সারা ভারতবর্ষের মন জয় করে নেন। প্রতিষ্ঠিত হয় জনপ্রিয় বৌদ্ধধর্ম। বৌদ্ধধর্ম প্রায় হাজার বছর ভারতের প্রধান ধর্ম ছিল। পরে অবশ্য বৌদ্ধধর্ম বহুভাগে বিভক্ত হয়। প্রধান দুটো ভাগ হচ্ছে : হীনযান ও মহাযান। এ বিভক্তির সূত্র ধরে আর্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়। মহাযানী বৌদ্ধ দেব-দেবী, অনুষ্ঠান, রীতি ও তান্ত্রিক বৌদ্ধমত আর্যধারার সাথে মিলে হিন্দুধর্মের প্রাথমিক ভিত্তি রচনা করে।
৩. পৌরাণিক কাল : এই কালটি নিশ্চিতভাবে বৌদ্ধ-পরবর্তী কাল। মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব দুই-তিন শতক থেকে খ্রিস্টাব্দ পাঁচ-ছয় শতক পর্যন্ত সময়কে পৌরাণিক কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথ এই পর্যায়কে আর্যভারত ও হিন্দুভারতের মধ্যবর্তী কাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই পর্যায়েই বর্তমান হিন্দুধর্মের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। নানা পুরাণ কাহিনী এই সময়েই রচিত হয়। এই পুরাণগুলোই হিন্দুধর্মের অন্যতম ভিত্তি বলে বিবেচিত।
পুরাণগুলোতে শৈবধর্ম (প্রাক-বৌদ্ধ), আর্যধর্ম (বৈদিক), জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও লোকায়ত বিশ্বাসের একটা সমন্বয় সাধন করা হয়। বলা বাহুল্য এগুলো রচিত হয় বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়কালে। তাই পুরাণগুলোতে প্রাচীন ধর্ম মতগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয়ের প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেলেও ব্রাহ্মণ্যধর্মের নানা বৈষম্যমূলক বিশ্বাস চোরাগোপ্তা পন্থায় এতে সংযোজিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় বহু পৌরাণিক কাহিনীতে অনেক প্রক্ষিপ্ত বা অবান্তর, অবাস্তব ও অলৌকিক ঘটনা ধর্মের নামে স্থান করে নেয়। উদাহরণস্বরূপ মহাভারতের কথা বলা যায়। মহাভারতের মূল কাহিনী ‘জয়’ নামীয় লোকগাথায় ছিল। অনেক প্রক্ষিপ্ত গল্প-কাহিনী যোগ করে রচিত হয় ‘ভারত’ এবং তারপর ‘মহাভারত’। বর্তমান মহাভারতের দুই-তৃতীয়াংশই প্রক্ষিপ্ত বা ব্ৰাহ্মণ্য সংযোজন বলে অনুমিত। এমতাবস্থায় কোনটি মূল, কোনটি প্রক্ষিপ্ত তা চিহ্নিত করা কঠিন তবে এটা নিশ্চিত যে, এই প্রক্ষিপ্ত অংশ দ্বারাই হিন্দুধর্মটিকে ব্রাহ্মণকেন্দ্রিক বা ব্রাহ্মণপ্ৰধান করার একটা দৃষ্টিকটু চেষ্টা করা হয়। তাই এই কালকে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুণরুত্থানের কালও বলা যায়। তবে এই অভ্যুত্থান নিরঙ্কুশ হয় নি। কারণ দেখা যায় প্রাক-বৈদিক দেবতা শিব এই পর্যায়ে বুদ্ধের স্থলাভিষিক্ত হন। বিষ্ণুর ধারার পাশাপাশি শিবের প্রবল ধারাও চালু হয়।
৪. মধ্যযুগ ও পরবর্তীকালঃ পৌরাণিককালের পর চতুর্থ পর্যায়ে অর্থাৎ মধ্যযুগেই ব্রাহ্মণ্যধর্মের পাশাপাশি লোকায়ত বিশ্বাসগুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়া মোগল শাসন ও পরে আধুনিক যুগের ব্রিটিশ শাসনকাল পর্যন্ত চলতে থাকে। ব্রাহ্মণ্য সমাজ এইসময়ে শাসকদের আনুকূল্য পায়। কিন্তু আনুকূল্য সত্ত্বেও লোকায়ত ধারার প্রাবল্যের কারণে ব্ৰাহ্মণ্য সমাজকে এর সাথে আপোষ করতে হয়। ফলে লোকায়ত দেব-দেবীদেরকে তারা শিবের পরিবারভুক্ত করতে বাধ্য হয়। শিবের ধারা ধীরে ধীরে প্রবলতর হয়। পরিশেষে সমাজের ওপরের স্তরে শ্রীকৃষ্ণ ও গীতা এবং বেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সমাজের মধ্য ও নিম্নস্তর অর্থাৎ বৃহত্তর হিন্দু সমাজে শিবের আধিপত্য নিষ্কণ্টক হয়।
উপরোক্ত চারটি স্তরে যে সংশ্লেষণ ঘটে তাতে স্পষ্টতই দেখা যায় শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় সিন্ধু ও দ্রাবিড় সভ্যতা এবং লোকায়ত ধারা। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের গ্রন্থে (ভারত সংস্কৃতি: মিত্র ও ঘোষ : ১৪০০) তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন : ভারতের সভ্যতায় দ্রাবিড়ের আহৃত উপাদান আর্যের দানের চেয়ে অনেক বেশি এখানে উল্লেখ্য, দ্রাবিড়দের ধর্ম ভক্তিপ্রধান এবং আর্যদের ধর্ম কর্মপ্রধান (যজ্ঞকর্ম)। দ্রাবিড় ধারাতেই মধ্যযুগে বৈষ্ণবের ভক্তি আন্দোলনে জোয়ার আসে। অবৈদিক সংস্কৃতির অবদান সম্পর্কে ক্ষিতিমোহন সেনও একই মত পোষণ করেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে (ভারতে হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা: বিশ্বভারতী : ১৩৯৭) বলেছেন : প্রাচীনকাল থেকেই এই দেশে অবৈদিক বহু সংস্কৃতি ও ধর্ম ছিল। সেইসব অবলম্বন করেই হিন্দুধর্ম গড়ে ওঠেছে। তিনি আরও বলেছেন : নানা ধর্মের সংস্পর্শে এসে ভারতীয় আর্যদের মন উপনিষদ ও নানাবিধ জ্ঞান পন্থার দিকে ধাবিত হয়। এতে ক্রমে ক্রমে বেদ-বেদান্ত গড়ে ওঠে। সেনের এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায় বেদ-বেদান্ত শুধু আর্যদের দান নয়। এতে ঘটেছে সংশ্লেষণের প্রতিফলন।
সংশ্লেষণ ও বিবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রাক-আর্য জনগোষ্ঠী ও বৌদ্ধের প্রভাব কত সুদূর প্রসারী ছিল তা রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য থেকে আরও পরিষ্কার হয়। তিনি তাঁর গ্রন্থে (ইতিহাস: বিশ্বভারতী : ১৩৮৬) বলেছেন : ভারতবর্ষে সামাজিক মিলন ঘটে ‘ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর’ এই ত্রিমূর্তি কল্পনায়। তাঁর মতে, ব্রহ্মায় আর্য সমাজের আরম্ভ কাল, বিষ্ণুতে মধ্যাহ্ন কাল এবং শিবে তার শেষ পরিণতি। অর্থাৎ শিবই শেষ পর্যন্ত টিকে রইলেন। তবে বিষ্ণুও টিকলেন। কিন্তু অন্যরূপে। বিষ্ণু রূপান্তরিত হলেন রাম অথবা কৃষ্ণে। অর্থাৎ একদিকে হরির ধারা (রাম ও কৃষ্ণ), অন্যদিকে হরের। এর থেকেই ‘হরি-হর’ আত্মা ধারণার সৃষ্টি। হরি হচ্ছেন বিষ্ণু এবং বিষ্ণুর অবতার হিসেবে রাম ও কৃষ্ণ। আর হর হচ্ছেন মহাদেব বা শিব। এই দু’য়ের মিলনের মাধ্যমেই ভূমিপুত্র ও আর্যদের শেষ পর্যন্ত মিলন ঘটে। তাই বর্তমানে হরি ও হর উভয়েই হিন্দুর পূজ্য। বলা বাহুল্য এই ‘হরি-হরই’ হিন্দুর বিবর্তিত রূপ