বিপ্লব মহানগর মধ্যবিত্ত এবং মার্কসবাদ
জলের উপর আগুন জ্বলছে/জ্বলন্ত আগুন জলে নিভছে না/কলিকালে হচ্ছে কী/উপাচার্য অপমানিত শিক্ষক লাঞ্ছিত/অশোভন উদ্ধত ভঙ্গি বিদ্রোহী তরুণ ছাত্রদের/তরুণীরা বেণী দুলিয়ে স্কুটারের পেছন সিটে দুরন্ত বেগে উধাও/ লোকসভা—বিধানসভায় কেবল হাও—হাও—হল্লা/কর্পোরেশন থেকে পরিবার বা শ্মশান কোথাও স্যাংটিটি নেই শুধু ধস্তাধস্তি ঘুসোঘুসি ছুরি—ভোজালি/চাঁদে হাঁটছে নভশ্চর বাহাদুর আর্মস্ট্রং ভূচর দ্বিপদ চতুষ্পদ বেবাক অবাক/কোটি কোটি ডলারের বন্যায় যদি চন্দ্রগ্রহে ঘাঁটি গেড়ে কোনো মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করে এই দুষ্টগ্রহ পৃথিবীটাকে আবার চাঁদের মতো জীবনশূন্য জীবশূন্য করা যায়/ঢাল নেই তলোয়ার নেই হতভাগ্য নিধিরামরা গেরিলাফোকো থেকে বল্লম আর হাতবোমা নিয়ে নিউক্লিয়ার বোমার মালিকদের শাসায়/দুর্গাপুর দমদম ক্যানিং কেরল রুশ—চীন সীমান্ত সর্বত্র কমরেডি কাটাকাটি কে সাচ্চা কে ঝুটা বিপ্লবী লেনিনশাস্ত্রমতে/এদিকে মন্দির মসজিদ মোল্লা পুরোহিত রক্ষা করা দায়/তার উপর মাছের পেটে বোমা কিশোর ছেলের হাতে বোমা সিনেমার সিটে বোমা পোস্টব্যাগে বোমা হাসপাতালে বোমা বিবাহবাসরে বোমা শবযাত্রায় বোমা পরীক্ষা হলে বোমা/কালে কালে হল কী ঘোর কলি এল কি বুড়োবুড়িদের কান্না বানপ্রন্থীদের উষ্মা চেয়ারম্যানদের দেড়বেগতি হাঁই দুর্ভাবনায় পুঁজিপতিদের পেট ফুলে ঢাঁই/মহানগরের পথে পথে দেহ—বেচা দুটো—টাকায় ফুচকা চৌরঙ্গির স্ট্যান্ডে স্ট্যান্ডে ময়দানে ঘুরপাক খাওয়া হোটেল—বারে খানাপিনার হল্লা বাজার মন্দা মদ্যপানাধিক্যে সরকারি আয়বৃদ্ধি খাদ্যাভাবে বেসরকারি আয়ুক্ষয়/বাবা তারকনাথের জয়ধ্বনিতে আকাশ কম্পমান পার্টি নেতার বক্তৃতার করতালিতে মেদিনী কম্পমান/মহানগরের অলিগলিতে শত শত আশ্রমে ঐশী গুরুদের আত্মপ্রকাশ/হরিসভায় ভিড় ব্রাহ্মণসভার শূন্য গৃহে চামচিকের উপদ্রব/ উত্তর অক্টরলোনি শহিদ মিনারের পাদপীঠে বেকার সমকামুকদের দিবানিদ্রা/মুক্ত মেলায় কবিতাপাঠ বাউলগান হিপি তরুণ—তরুণীদের বিচরণ/বম্বে ডায়িং—এর সুইটহার্ট শাড়ি স্কুটার শাড়ির বিবস্ত্র বিজ্ঞাপন/মুক্ত অঙ্গনে অ্যাবসার্ড ড্রামার অভিনয়/বিবসনা চিত্রতারকার পোস্টার দেয়ালে/চীনে হোটেলে গ্লাটনদের কিউ/পার্ক স্ট্রিটের ম্যাডহাউসে মত্ততার কলরব/লেনিন সরণির অলিগলিতে বোতল আর ছিপি আর পিপে আর পাপের বন্যাস্রোত শিককাবাব আর গোস্ত/পলিমাটির স্যাঁতসেঁতে মহানগরের অন্ধকার কানাচে গেরিলাফোকো/শেক্সপিয়র সরণির চারিদিকে রূপচাঁদ পক্ষীর গান ‘ক্ষুদ্র লোক হয় রুদ্র ধন অহংকারে/ধনহীনে ত্রিভুবনে মান্য কে করে’/চায়ের পেয়ালার ধোঁয়ায় সশস্ত্র বিপ্লবের আগুন আর চে গ্যেভারার কথা/রাইটারস’ বিল্ডিংস—এ খাঁটি বিপ্লবীদের পদধ্বনি এবং উত্তম চিত্রতারকাদের পদধূলিতে অভূতপূর্ব শিহরন চিত্তচাঞ্চল্য/হরিনাম সত্য না ভিয়েতনাম সত্য কামানজয়ী ক্ষমতা সত্য না ভোটজয়ী ক্ষমতা সত্য তা ঈশ্বর জানেন অথবা লেনিন/মনে হয় প্রতিদিন মৃতের মর্মরমূর্তিতে আর সরণির নামকরণে যেন মহানগরটা একটা প্রাগৈতিহাসিক মেগালিথিক মহাশ্মশান তার মধ্যে আবার অতিবৃদ্ধ ফকিরের কণ্ঠে গান ‘জগতে মানুষ কেহ নাই, মনের মানুষ কোথা পাই’/তার মধ্যে আবার মুণ্ডিতমস্তক গৈরিকধারী বিদেশি কৃষ্ণভক্তদের চৌরঙ্গির পথে পথে খোলকরতালসহ নামগান হরেকৃষ্ণ হরেরাম, সমস্তই যেন তান্ত্রিক বীজমন্ত্র হ্রীং ক্রীং হুঁ ফট—এর মতো দুর্বোধ্য।
সমাজজীবনের এই বিচ্ছিন্ন খণ্ডচিত্র দিয়ে কোনো ‘মন্তাজ’ রচনা করা সহজসাধ্য নয়। পরিবার থেকে বৃহত্তর সমাজ—পর্যন্ত মনে হয় যেন জীবনের সুর—তাল—ছন্দ—মাত্রা সব ভেঙেচুরে গেছে, কোথাও আর পরিচিত রাগরাগিণীর আলাপ তেমন শোনা যায় না। এত বিচিত্র বেসুর দিয়ে সিম্ফনি রচনা করা অসম্ভব। কিন্তু গড়নের যেমন ছন্দ আছে, ভাঙনেরও তেমন ছন্দ আছে, সৃষ্টির যেমন তাল আছে, স্থিতির তেমন তাল আছে, লয়েরও তেমন তাল আছে। আজকের বেসুর বেতাল বেআবরু জীবন যত আপাতবিসদৃশ উৎকট হোক—না কেন, তারও একটা আন্তরমিল আছে এবং সেটা খুঁজে বার করার দায়িত্ব আছে বুদ্ধিমান মানুষের অর্থাৎ ‘বুদ্ধিজীবীদের’।
মাত্র একপুরুষকালের মধ্যে মানুষের ধ্যানধারণা রীতিনীতি আশাভরসা স্বপ্ন—বাসনা আদর্শ আস্থা সমস্ত কিছুর মূল পর্যন্ত যেন উপরে গেছে হঠাৎ। একটা বেয়াড়া ঝড়ে। বহুকালের বাহ্যসুস্থিতি এবং এই অকস্মাৎ নির্মন্থনের মধ্যে কালিক দূরত্ব এত কম বলেই বুদ্ধিমানদের বিভ্রান্তি এত বেশি। অথচ পুরোনো ঘোলাটে চশমা খুলে একটু তাকালেই দেখা যায় যে যুগযুগান্তের বহুবিঘোষিত হৃষ্টপুষ্ট আদর্শের বিস্তীর্ণ ভাগাড় থেকে এই ঝড়ের উৎপত্তি। বেশি নয়, একটা দৃষ্টান্তই এক্ষেত্রে যথেষ্ট। ‘ফ্রিডম’ (স্বাধীনতা) বা মুক্তির আদর্শের কথা অনেককাল ধরে আমরা শুনে আসছি। আর্থিক স্বাধীনতা, বাণিজ্যিক স্বাধীনতা, রাষ্ট্রিক স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, কত রকমের স্বাধীনতার নিটোল গোলাকার চকচকে সব বুলি। কিন্তু আজ শোনা যায় এই সমস্ত ‘স্বাধীনতা’র গোরস্থান থেকে কেবল পাগলের আকাশফাটা অট্টহাসি। বিগত তিন—চারশো বছরের ইতিহাসের ময়লা পাতাগুলোর উপর একবার চোখ বুলোলেই দেখা যায় সভ্যতার অগ্রগতির পথে সাধারণ মানুষের উপর যত অত্যাচার ও বর্বরতার নির্বিকার অনুষ্ঠান হয়েছে তার অধিকাংশই এই ‘স্বাধীনতা’র নামে। প্রচার করা হয়েছে ‘স্বাধীনতা’ যেন ‘দেবতা’, কিন্তু সেটা মিথ্যা প্রচার, আসলে ‘স্বাধীনতা’ ধনতান্ত্রিক যুগের অভ্যুদয়কালের জারজ সন্তান। যেমন আর্থিক—বাণিজ্যিক স্বাধীনতার নামে সমাজে দারিদ্র্যের প্রসার এবং শোষণযন্ত্রের বিস্তার হয়েছে, যার ফলে সমাজে ও মানুষের জীবনের স্তরে স্তরে পরাধীনতার নাগবন্ধন দৃঢ় হয়েছে। ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতার মুখোশ পরে ব্যক্তিদাসত্বের অভিনব নৃত্য চলেছে। এক—একটা বিপ্লবের বিলোড়ন থেকে এক—একটি ‘স্বাধীনতা’র প্রত্যয় উদ্ভূত হয়েছে, তারপর সেই বিপনলবের নায়কদের প্রভুত্ব বজায়ের স্বার্থে রচিত বিধিবিধানের বেদিমূলে সেই স্বাধীনতা বিসর্জিত হয়েছে। আজও ইতিহাসের এই আবৃত্তি শেষ হয়নি। ধনতান্ত্রিক—সমাজতান্ত্রিক কোনো সমাজেই হয়নি। চণ্ডসিদ্ধদের চতুরালিতে বহুকালের ভূত যে তাদের স্কন্ধ থেকে নামেনি এবং কোনো পরাধীনতার ছাঁদন ছেঁড়েনি, সে বিষয়ে আজ সাধারণ চৈতন্যের উদয় হয়েছে। অবিমিশ্র ঘৃণা, প্রতিহিংসা, জ্বালানি জিঘাংসা দিয়ে এই সমুত্থিত চৈতন্যের প্রতিটি পরত গঠিত। এবং কেবল শাসক—শোষক, চতুর চণ্ডসিদ্ধ, বুলিসর্বস্ব বিপ্লবী বা স্বেচ্ছাচারীদের দিকে এই চৈতন্য ধাবিত নয়, তাদের প্রতিমূর্তি এই সমাজের সংস্থা—প্রতিষ্ঠানসহ সমগ্র গঠন বিলোপের দিকে চালিত। প্রাজ্ঞরা বলবেন, এ হল হাস্যকর নৈরাজ্যবাদ, বালখিল্যের বিদ্রোহবিলাস। তা নয়, একেবারেই তা নয়। ন্যাপলামের সঙ্গে হাতবোমা, হাইড্রোজেন বোমার পাশে বল্লম, তিরধনুক, বাসি বুদ্ধির বিচারে হাস্যকর মনে হওয়াই স্বাভাবিক। বিশেষ করে আমাদের মতো স্বার্থচতুর আরামকেদারি বুদ্ধিবিলাসীদের কাছে ভয়ংকর হাস্যকর এবং গৌতম—গান্ধীর দেশে তো বটেই। কিন্তু একেবারেই তা নয়। আমাদের মতো ঔপনিবেশিক বুদ্ধিজীবী অথবা ধনতান্ত্রিক সমাজের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে পূর্বসংস্কার পরিহার করে অথবা বদ্ধ ধারণার মোহমুক্ত হয়ে বর্তমান সামাজিক—রাষ্ট্রিক নৈরাজ্যের আন্তর তাৎপর্য বোঝাই সম্ভব নয়, কারণ শ্রেণি হিসেবে শাসন—শোষণের নির্যাতনযন্ত্রণা বুদ্ধিজীবীদের কোনোদিন তেমন ভোগ করতে হয়নি। ইতিহাসে চিরদিন তাঁরা প্রধানত শাসকশ্রেণির পারিষদের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, কাজেই তাঁদের মজুত বুদ্ধিতে বর্তমান সামগ্রিক নৈরাজ্য—বিক্ষোভ—বিদ্রোহের ব্যাখ্যা করা যাবে না। এমনকী যাঁরা বিপ্লবী তাঁরাও যদি তাঁদের গতানুগতিক বৈপ্লবিক চিন্তাধারা নতুন করে revolutionize না করেন, তাহলে বর্তমানের ‘Revolution in the Revolution’—এর প্রকৃত মর্মোদঘাটন করা তাঁদের পক্ষেও অসম্ভব।
নৈরাজ্যের অথবা বিদ্রোহের অথবা বিপ্লবের পূর্বধারণা বর্তমান সমাজে অচল। কারণ এর জাত আলাদা। যন্ত্রবিজ্ঞানের চূড়ান্ত উন্নতির যুগে, সমগ্র মানবসমাজ নিশ্চিহ্ন করতে পারে এরকম নিউক্লিয়ার মারণাস্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, নির্যাতিত মানুষ নিরস্ত্র অবস্থায় গেরিলাবাহিনী গঠন করে যখন বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং সংকল্প করে যে পদে পদে সশস্ত্র সংগ্রামের ভিতর দিয়েই তারা মুক্তির পথে, প্রকৃত স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হবে, তখন মনে হয় না কি যে এ বিদ্রোহের জাত আলাদা! বহুকালের নির্যাতন, পীড়ন, শোষণ ও বৈপ্লবিক শঠতার বিরুদ্ধে এ হল সমগ্র মানবসত্তার বিদ্রোহ। এ হল ‘instinctual revolt’, ‘biological hatred’-এর বিস্ফোরণ (Marcuse, Eros and Civilisation, Political Preface, 1966)। নিউক্লিয়ার মারণাস্ত্রের সামনে নিরস্ত্র মানুষের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের অঙ্গীকার হল তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, স্নায়ু পেশি, শিরা—উপশিরা দিয়ে প্রতিরোধ—সংগ্রামের অঙ্গীকার। দেহের প্রতিটি অঙ্গ তার অস্ত্র এবং দেহের ভিতরে স্নায়ু পেশি শিরায় শিরায় যখন ঘৃণা ও প্রতিহিংসাজনিত জিঘাংসার আলোড়ন হয় তখন প্রতিটি অঙ্গ বুলেট—দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠে, বজ্রমুষ্টিও অ্যাটম বোমাকে রুখে দাঁড়ায়। যেমন কিউবায়, ভিয়েতনামে, বলিভিয়ায়, যেমন তরুণ বিদ্রোহে, ছাত্র বিদ্রোহে। যেমন চন্দ্র গ্রহজয়ী আমেরিকান দৈত্যদের ন্যাপলামি নৃশংসতার বিরুদ্ধে ভিয়েতনামিদের বজ্রমুষ্টির প্রতিরোধ, যেমন চেকোস্লোভাকিয়ায় ব্রেজনেভি স্বাধীনতা উপঢৌকনের বিরুদ্ধে চেক—জনসাধারণের নিজস্ব স্বাধীনতা সংগ্রাম।
সেই ‘স্বাধীনতা’! চারজন তরুণী ও একজন তরুণ বিশ্বরাষ্ট্রসংঘের কার্যালয়ের সামনে চেকোস্লোভাকিয়ার সমাজতান্ত্রিক সতীত্বরক্ষার্থে সোভিয়েটের সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন উলঙ্গনৃত্য করে এবং সমবেত দর্শকদের সামনে সোভিয়েট পতাকা অগ্নিদগ্ধ করার পরে পোশাক পরিধান করে ঘরে ফিরে যান।
উলঙ্গনৃত্য বজ্রমুষ্টি সবই আদিম ব্যাপার। ‘biological hatred’-এর প্রকাশ বলেই আজকের গণবিদ্রোহে আদিমতার উপাদান এত বেশি। অস্থির অশান্ত অবাধ্য তরুণ ছাত্রদের কাছে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক ‘বিদ্বান’ উৎপাদনের কারখানার উপাচার্য—অধ্যাপকদের নাজেহাল বা অপমানিত হওয়া নিশ্চয় তরুণীদের উলঙ্গ প্রতিবাদনৃত্যের মতো আদিম বা অশোভন নয়, অতি নগণ্য ব্যাপার মাত্র।
প্রশ্ন হল, এবং খুব বড় প্রশ্ন, আজকের মানুষের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ ও বিপ্লবের কেবল মাত্রিক নয়, এরকম চারিত্রিক পরিবর্তনের কারণ কী? যে ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে এগুলি ঘটছে তার প্রকৃতি অনুধাবন করতে না পারলে জনসংগ্রামের এই পর্বান্তর দুর্বোধ্য মনে হবে। প্রথম ও প্রধান কারণ হল, গত একশো বছরের মধ্যে নিপীড়িত মানুষের একমাত্র অবলম্বন ও অনুপ্রাণনার উৎস বৈপ্লবিক মার্কসীয় চিন্তাধারায় পরিপার্শ্বের পয়োনালি থেকে রাশি রাশি আবর্জনা এসে ঢুকেছে এবং তার ফলে মানবেতিহাসের সবচেয়ে বেগবতী বলিষ্ঠ চিন্তাপ্রবাহের পথে অনেক পঙ্কিল আবর্ত, অনেক বদ্ধ সংস্কারের ডোবা, অনেক বিকার—বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। মর্মান্তিক হল, যে দেশে অর্ধশতাব্দীর উপর মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষা চলেছে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত যেদেশ ছিল সারা পৃথিবীর শাসিত—শোষিতের শ্রেষ্ঠ আশাভরসাস্থল, সেই দেশ (সোভিয়েট ইউনিয়ন) হয়েছে আজ মার্কসীয় চিন্তাবিকৃতির প্রধান নায়ক। তার সমস্ত ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণ বিশ্লেষণ করার অবকাশ এখানে নেই, কিন্তু কারণ সংক্ষেপে আমরা উল্লেখ করব। তবে মূল কারণ মনে হয়, মার্কসীয় চিন্তাধারায় মধ্যবিত্ত—নিম্নমধ্যবিত্তের প্রাধান্য, এমনকী মার্কসীয় বিপ্লবোত্তরকালেও। তাই মধ্যবিত্তসুলভ যাবতীয় গোঁড়ামি সংস্কার চিত্তদৌর্বল্য স্বার্থপরতা আত্মম্ভরিতা সুবিধাবাদ আজ মার্কসীয় চিন্তাধারাকে পঙ্কিল করে তুলেছে। এরই অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে বলা যায়, মার্কসীয় পার্টিগত নেতৃত্বে পুরুষান্তর ব্যবধান (generation gap) বেড়েছে, উপরে মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর দীর্ঘকালীন প্রভুত্ব কায়েমের ফলে, এবং এত বেড়েছে যে প্রবীণ প্রৌঢ়দের সঙ্গে তরুণ যুবকদের চিন্তাধারার কোনো সংযোগ নেই। আজ পৃথিবীব্যাপী তরুণ বিদ্রোহ ছাত্র বিদ্রোহ এবং ‘student power’ বা ‘youth power’ নামে তৃতীয় শক্তির (শ্রমিক—কৃষক ছাড়া) অভ্যুত্থানের অন্যতম কারণও এই পুরুষান্তর বিচ্ছেদ। গণতন্ত্রের নামে সর্বত্র বৃদ্ধপ্রৌঢ়তন্ত্রের প্রতিপত্তি, ডেমোক্রাসির পরিবর্তে জেরনটোক্রাসি, বৈপ্লবিক মার্কসিস্ট পার্টিতেও। এক নতুন শাসকশ্রেণি—আমলা শ্রেণির আবির্ভাব, অচল অটল অনড়।
দ্বিতীয় কারণ, যে ধনতন্ত্রের স্বরূপ বিশ্লেষণে মার্কসীয় চিন্তাধারার উৎপত্তি, পরবর্তীকালে বিজ্ঞান ও টেকনোলজির ক্রমোন্নতির ফলে সেই ধনতন্ত্রের আদত রূপ ঠিক থাকলেও বাহ্যরূপের এমন ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে যা পঞ্চাশ বছর আগেও সম্ভব হয়নি। এমনকী পঁচিশ—তিরিশ বছর আগেও ধনতন্ত্রের বর্তমান রূপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠেনি। অত্যুন্নত বস্তুশিল্পসমাজে আজও বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে ধনতন্ত্রের অগ্রগতির দরুন সাধারণ মেহনতি মানুষের দুঃখক্রমবৃদ্ধির (increasing immiseration) যে প্রাথমিক মার্কসীয় ধারণা তা আজ অনেকটাই পরিবর্তন করা প্রয়োজন। কারণ বস্তুবিজ্ঞান ও টেকনোলজির ব্যাপক প্রয়োগের ফলে আজ ভোগ্যপণ্যের প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য এমন এক উন্নত স্তরে পৌঁছেছে এবং প্রচারকলাকৌশলে এমন এক লোভনীয় শিখরে ভোগেচ্ছাকে উন্নীত করা হয়েছে এবং নিয়ত হচ্ছে যে মেহনতি মানুষ তাতেই নেশাখোরের মতো বুঁদ হয়ে থাকতে চায়। কৃত্রিম পণ্যময় সমাজে এক বিচিত্র সুখোচ্ছ্বাসের তরঙ্গে ও দিবাস্বপ্নে সকলে সর্বদা ভাসমান। মূলধন ও মেহনত, মালিক ও মজুর, বড়সাহেব ও ছোট কেরানি সকলে আজ একই তরণীর সহযাত্রী, অদম্য ভোগেচ্ছা—তরণীর, সামাজিক অপচয়ের দিগন্তবিস্তৃত পণ্যসমুদ্রে। কোম্পানির চেয়ারম্যান ও তাঁর লেডি টাইপিস্টের মনের গড়নে কোনো পার্থক্য নেই, কারখানার মালিক ও শ্রমিকের শ্রেণিগত বিরোধ শ্রমিকের ক্রমবর্ধিষ্ণু সুখলালসার অন্তরালে ঝাপসা হয়ে গেছে। অত্যুন্নত পণ্যশিল্পসমাজের এই টেকনোলজিক্যাল ঔদার্য অস্বীকার করে, তার অকৃপণ ভোগেচ্ছাপূরণের প্রতিশ্রুতি উপেক্ষা করে, শতকরা ক—জন মেহনতি মানুষ বা কারখানার শ্রমিক আজ তার অন্তরালবর্তী ধনতান্ত্রিক কঙ্কালের দিকে চেয়ে দেখবে এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার আকঙ্কাল পরিবর্তনে উৎসাহিত হবে? অথচ এই উন্নত আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজে মার্কসীয় আত্মবিচ্ছেদের (alienation) সত্যতা শতগুণ বেশি অকাট্য প্রমাণিত হয়েছে। যদিও তার আদল পালটে গেছে, তাহলেও বর্তমান উন্নত ধনতান্ত্রিক সমাজে এই আত্মবিচ্ছেদের ব্যাদান মানুষের মনে যে অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই আত্মবিচ্ছেদের ফলে বেদনা—নৈরাশ্য—আত্মবিকার সমাজে ক্রমেই দৃঢ়মূল হয়েছে, বৈপ্লবিক চেতনায় মরচে ধরে গেছে আরও বেশি। কাজেই সব দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, আধুনিক উন্নত ধনতন্ত্র ও তার টেকনোলজিক্যাল উল্লম্ফন সমাজটাকে এমন এক বিশাল মধুচক্রে রূপান্তরিত করেছে যার মধ্যে মানুষ মৌমাছির মতো আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। উৎপাদনযন্ত্রের মতো প্রশাসনযন্ত্রেরও চরম টেকনোলজিক্যাল উন্নতি হয়েছে এবং তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হচ্ছে বর্তমান সর্বজনতন্ত্র বা mass democracy-র নিমন্ত্রণ। এই ধনতান্ত্রিক সমাজের সর্বজনতন্ত্রের বিশেষত্ব হল এ—ও একটা ‘অ্যাপারেটাস’, ‘ইনস্ট্রুমেন্ট’ অর্থাৎ যান্ত্রিক মুখোশ বা অবগুণ্ঠন, যার অন্তরালে উৎপাদন—উৎসাদনের কলাকৌশলসহ রাষ্ট্রনায়করা সহজেই গা—ঢাকা দিতে পারেন এবং কী পরিমাণ মানবিক শক্তি অপচয় করে সমাজে তাঁরা পণ্যসুখ বিতরণ করছেন তা—ও লোকচেতনা থেকে অপসারিত করতে পারেন। এই অবস্থায় উন্নত ধনতান্ত্রিক সমাজে সামাজিক পরিবর্তনে প্রতিহতি (containment of social change) আজ অনস্বীকার্য রূঢ় সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে (Marcuse ২,৩,) অথচ এই অবস্থা যে ধনতন্ত্রের অতিবার্ধক্যের উপসর্গ অথবা তার প্রাস্থানিক পর্ব তা প্রায় মানুষের বোধশক্তি থেকে বিলীয়মান।
ঐতিহাসিক পরিস্থিতির এই পর্যালোচনা বর্তমান সমাজের জনবিক্ষোভ, বিদ্রোহ ও বিপ্লবের চারিত্রিক পরিবর্তনের কারণগুলির উপর কিছুটা আলোকপাত করতে পারে। কিন্তু পর্যালোচনার আরও একটু বিস্তার প্রয়োজন। তা না হলে আজকের তরুণের বিদ্রোহ অথবা নিরস্ত্র নিপীড়িত মানুষের সশস্ত্র বিপ্লবের অঙ্গীকারের মূলপ্রেক্ষণ সম্ভব নয়।
একালের ধনতন্ত্রের উপসর্গগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল উৎপাদন ও উৎসাদন, ভোগনিবৃত্তি ও উৎপীড়ন—দমন, স্বাধীনতা ও দাসত্ব, যুক্তি ও অযুক্তি, এই ধরনের বিপরীতধর্মী সমাজকর্মগুলি একটি অবিচ্ছেদ্য অখণ্ডমূর্তিতে, যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের গুণে জনমানসে প্রতিভাত হয়। ধনতান্ত্রিক Welfare State হল Warfare State-এর নামান্তর এবং তার লক্ষ্য হল ‘progressive brutalization and moronization of man’ (Marcuse৩)। উনিশ শতকে, এমনকী বিশ শতকেরপ্রথম পর্বেও, ধনতান্ত্রিক সমাজে বুর্জোয়া—প্রলেটারিয়েটের শ্রেণিবিরোধের যে মার্কসীয় চিত্র বেশ স্পষ্টাকারে দেখা যেত, পরবর্তীকালের ধনতান্ত্রিক অগ্রগতির ফলে তা অনেকটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। উন্নত টেকনোলজির যুগে ধনতান্ত্রিক সমাজের বর্তমান রূপ দেখলে মনে হয় না যে বুর্জোয়া—প্রলেটারিয়েটের সেই আদিরূপ অবিকৃত আছে এবং তাদের পরস্পর সংঘাতের ভিতর দিয়ে সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটবে।
তা ছাড়া টেকনোলজিক্যাল গতির প্রবণতাই হল টোটালিটেরিয়ান বা সামগ্রিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণের দিকে। পণ্যশিল্পোন্নত সমাজের উৎপাদন—বণ্টনের টেকনিক্যাল কলাকৌশল (অটোমেশনের অগ্রগতিসহ) শুধু যে সমাজের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম পেশাবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে তা নয়, সমগ্র আর্থিক—রাষ্ট্রিক—সাংস্কৃতিক জীবনের চাহিদা থেকে সেই চাহিদানিবৃত্তির উপাদান পর্যন্ত নির্ধারণ করে। লক্ষণীয় হল টেকনোলজির এই পূর্ণ কর্তৃত্বের প্রভাব বর্তমানে উন্নত ধনতান্ত্রিক সমাজের চৌহদ্দি পেরিয়ে অনুন্নত—অর্ধোন্নত—ক্রমোন্নত সমাজে পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, এমনকী ‘ক্যাপিটালিজম’ ও ‘কমিউনিজম’—এর বিকাশের মধ্যেও উপসর্গগত সাদৃশ্য স্থাপন করেছে (Marcuse ২)।
অগ্রসর ধনতান্ত্রিক সমাজে বুর্জোয়া—প্রলেটারিয়েটের শ্রেণিগত বিস্ফোরণ—সম্ভাবনা যে অনেক কমে গেছে তা অস্বীকার করার অর্থ হল বাস্তব ইতিহাস অস্বীকার করা। শ্রমিকশ্রেণির ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন হয়েছে ঐকত্রিক দর কষাকষির আন্দোলন, বাজারের ক্রেতা—বিক্রেতার মতো, তার মধ্যে বিদ্রোহ—বিপ্লবের কোনো নামগন্ধ নেই, তার কোনো চৈতন্যও নেই। তার ফলে ‘লেবার অ্যারিস্তক্রাসি’, ‘হোয়াইট কলার ইউনিয়নিজম’ এবং অবিমিশ্র ‘ইকনমিজম’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার ঘটেছে ‘সামাজিক শ্রেণি’ সম্বন্ধে বনেদি মার্কসীয় প্রমিতির (Marxian concept) ক্ষেত্রে। গত কুড়ি—পঁচিশ বছরের মধ্যে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে বিশেষ করে) সামাজিক শ্রেণির মার্কসীয় বিচারপদ্ধতিকে এবং মার্কসীয় বিন্যাসকে সমাজতত্ত্ববিদরা এত তরল ও ঘোলাটে করে দিয়েছেন যে তার ল্যাজামাথা কিছুই ধরাছোঁয়া যায় না। আমেরিকান, ফরাসি ও জার্মান সমাজতত্ত্ববিদরাই এই শ্রেণিভেদ তরলীকরণের কাজে অগ্রণী হয়েছেন সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে আমেরিকানরা। বস্তুত সমাজতত্ত্ব ও সামাজিক মনোবিজ্ঞানের ফলনপ্রাচুর্য আমেরিকার অগ্রসর ধনতান্ত্রিক সমাজের উর্বর টেকনোলজিক্যাল জমিনেই সম্ভব হয়েছে, কারণ এই দুটি বিদ্যার অন্তরঙ্গ সহযোগিতাও এই সমাজের সঙ্গে সর্বাধিক। এখানে প্রসঙ্গত ফরাসি ছাত্র বিদ্রোহের (১৯৬৮) কথা মনে পড়ছে। সামাজিক মনোবিজ্ঞানের ছাত্ররা (Nanterre বিশ্ববিদ্যালয়ের) তাদের পাঠ্য বিষয় অনাবশ্যকভাবে অত্যন্ত অ্যাকাডেমিক মনে করে পরীক্ষা বয়কট করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মিলিত কণ্ঠে ‘ইন্টারন্যাশনাল’ গান করে এবং ‘Why do we need sociologists?’ নামে একটি প্রচারপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বিলি করে। এই প্রচারপত্রে বর্তমানকালের সমাজতত্ত্ব সম্বন্ধে বহু বক্তব্যের মধ্যে দু—তিনটি বক্তব্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রথম বক্তব্য, অ্যাকাডেমিক সমাজতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক বুজরুকি বর্তমান ধনতান্ত্রিক টেকনোলজিক্যাল সমাজের ফাঁকা প্রতিধ্বনি ছাড়া কিছু নয়। দ্বিতীয় বক্তব্য, সামাজিক মনোবিজ্ঞান নামক বিদ্যাটি এই ধনতান্ত্রিক সমাজের আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণির সর্বপ্রকার স্বার্থরক্ষার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে। তৃতীয় বক্তব্য, ‘American sociologists have discarded the very concepts of classes and the class struggle, substituting the theory of a continuous scale of increasing status.’ আমেরিকার নয় শুধু, অন্যান্য ধনতান্ত্রিক দেশের সমাজবিজ্ঞানীদের সম্বন্ধেও এই কথা বলা যায়।
যন্ত্রজগতের টেকনিকের মতো আধুনিক সমাজবিজ্ঞানও কেবল অন্তঃসারশূন্য টেকনিকের (’methodology’ বলা হয়) কসরত, বিচিত্র প্রমিতি যুযুৎসু এবং নিছক পারিভাষিক ভোজবাজি প্রদর্শনের প্রশস্ত ক্ষেত্র। দু—তিন কিলোগ্রাম ওজনের, গড়ে আশি—নব্বুই টাকা মূল্যের আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানীদের বইগুলিতে দেখা যায় সারবস্তু সামান্য, বাগাড়ম্বর অত্যধিক এবং অসহ্য। এহেন সমাজবিজ্ঞানের উৎপাদনও আমেরিকায় অটোমোবিল ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আর এই আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক প্রভাববিস্তার, বিশেষ করে এশিয়ার অনুন্নত অর্ধোন্নত দেশগুলিতে, লক্ষণীয় ব্যাপার। অনুন্নত দেশের অর্থনীতিক্ষেত্রে আমেরিকান ডলারের আমদানি ও ইনভেস্টমেন্টের মতো আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানেরও (ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানসহ) আমদানি হয়েছে। উভয়ের উদ্দেশ্য একই, মার্কসীয় নীতির ভিত্তিক্ষয় করা, শ্রেণিবিন্যাস—শ্রেণিসংগ্রাম—শ্রেণিভেদবোধ সম্বন্ধে মার্কসীয় মানগুলিকে নস্যাৎ করা। যেমন আধুনিক ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে অধিকাংশই আমেরিকানদের মন্ত্রশিষ্য এবং তাঁদের গবেষণা ও কাজকর্ম প্রধানত আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানীদের রীতিনীতি অনুযায়ী পরিচালিত।
সমাজে ‘শ্রেণি’ বলে গণ্য হতে পারে এরকম স্থিতিশীল কোনো মানবগোষ্ঠী নেই এবং শ্রেণির কোনো অবিচল সংজ্ঞাও নির্দেশ করা যায় না। এই হল আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীদের প্রতিপাদ্য। class, stratum, status, elite এবং এই ধরনের কতকগুলি প্রত্যয়ের সাহায্যে সমাজের গতিশীল রূপ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে, শুধু ‘শ্রেণির’ মতো কোনো বদ্ধ ধারণা দিয়ে করা যায় না। ক্লাস, স্ট্রেটাম, স্টেটাস, এলিট—এগুলিরও আবার উঁচুনিচু স্তরভেদ আছে অনেক এবং স্তর থেকে স্তরান্তরে ওঠানামার সুযোগ—সম্ভাবনাও আছে সমাজে। সুযোগ—সম্ভাবনা সকল মানুষের সমান নয় এই পর্যন্ত, অবস্থাগুণে ও বংশগুণে ‘automatic increment’-এর দৌলতে (Schumpeter ১) কারও সুযোগ বেশি, তার অভাবে কারও কম। কিন্তু মনোভঙ্গি বাল্যকাল থেকে দৃঢ় হলে (যেমন ‘achievement orientation’–McClelland) এই সুযোগের অসমতা অতিক্রম করা খুব কঠিন হয়। বিজ্ঞানীদের এই ব্যাখ্যার গুণে আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজটাকে মনে হয় যেন ‘snake and ladder’ খেলার বোর্ডের মতো। ব্যক্তিদের খেলার গুণে, এবং সমাজবিজ্ঞানীদের social mobility-র ইন্দ্রজালগুণে, লেজ থেকে মাথায় ওঠা যায়। মইয়ের নীচের ধাপ থেকে উপরের ধাপে লাফ দিয়ে ওঠা যায়, আবার নামাও যায়। সমাজে সকল মানুষই ‘ক্লাইম্বার’ এবং মুনাফা, জীবিকা, প্রতিষ্ঠা সবকিছুর অবাধ প্রতিযোগিতা হল মই—মই খেলার মতো। ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের সামাজিক ‘মোবিলিটি’র এমনই মাহাত্ম্য যে সামান্য ‘লেবার’ বা ‘ফার্মার’ বা ‘লোয়ার মিডল’—চেষ্টা ও লক্ষ্য থাকলে—স্বচ্ছন্দে ধনী—অতিধনী কর্পোরেট—ধনীর স্তরে (Wright Mills ২) আরোহণ করতে পারেন। আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশের সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকে কতখানি বাষ্পীয় পদার্থ মনে করেন, তা নীচের তালিকা থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে :
উপর থেকে নীচে দু—দিকে দুটি তির লাইন দিলে ‘স্পেশ্যাল মোবিলিটি’র ডায়াগ্রামও তৈরি হয়ে যায়। এই তালিকাটির দিকে তাকালেই বোঝা যায়, ‘শ্রেণি’ নামে সামাজিক পদার্থটি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানীর হাতেকলমে কতখানি তরল হয়ে গেছে, মার্কসীয় ধারণায় এ কথাও তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। আসলে ‘শ্রেণি’ কী বস্তু, বর্তমান সমাজবিজ্ঞানীদের মতে? ‘A man’s class is a part of his ego, a feeling on his part of belongingness to something : an identification with something larger than himself.’ (Centers)। এরকম বিচিত্র শ্রেণিসংজ্ঞা আরও অনেক উল্লেখ করা যায়, কিন্তু আপাতত একটিই যথেষ্ট যে—কোনো মানুষের শ্রেণিবোধ তার অহমিকারই প্রতিচ্ছবি, একটা কিছুর সঙ্গে তার একাত্মতার অনুভূতি এবং তার চেয়ে বৃহত্তর কিছুর সঙ্গে তার অভিন্নতাবোধ। এরকম শ্রেণির সোপান দিয়ে যদি সমাজ গঠিত হয় তাহলে তার মধ্যে বিরোধ বা সংঘাত, মার্কসীয় অর্থে, থাকতে পারে না। রেষারেষি, হানাহানি, রাহাজানি সবই থাকতে পারে, শুধু মার্কসীয় অর্থে শ্রেণিসংঘাতজনিত বিদ্রোহ বা বিপ্লব ছাড়া।
সমাজবিজ্ঞানীদের শ্রেণিব্যাখ্যানের এই তারল্যের মধ্যে আর কিছু না হোক আধুনিক উন্নত ধনতন্ত্রের যন্ত্রীকৃত সমাজের ভিতরের চেহারাটা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মার্কসীয় শ্রেণিসমাজের মডেল এবং শ্রেণিবিরোধের মূল প্রত্যয় ধূলিসাৎ করা তাঁদের লক্ষ্য হলেও, বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজের বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন সে মার্কসীয় ‘প্রলেটারিয়েট’ দ্বারা ঘটানো বেশ কঠিন, এই সত্যই তাঁরা পরোক্ষে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। পুঁজিপতি—মালিক আর শ্রমিকে প্রাক্তন সম্পর্কের স্বচ্ছতা—প্রত্যক্ষতা সবকিছুই আজ অতিজটিল টেকনোলজিক্যাল পরদার অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেছে ((Marcuse, ২)। কার্ল মার্কস অবশ্য পুঁজিপতি শ্রেণির এই ভবিষ্যৎ চেহারাবদল তাঁর দূরদৃষ্টিতে ধরতে পেরেছিলেন এবং আধুনিক জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও কর্পোরেশন, অথবা কোঅপারেটিভ ও শিল্পরাষ্ট্রী করণের ফলে মূলধনের গোত্রান্তরও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। জয়েন্ট স্টক কোম্পানি বা কর্পোরেশনের বিকাশের ফল যে ‘complete alienation of capital from the real producers, and its opposition as alien property to all individuals really participating in production, from the manager down to the last day labourer’ (Capital, III)—এ সত্য মার্কসের অবিদিত ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁর অসাধারণ বৈজ্ঞানিক দূরদৃষ্টি দিয়ে যা তাত্ত্বিক সত্য হিসেবে বুঝেছিলেন, তার প্রকৃত রূপ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ তাঁর হয়নি। মালিকানা (ownership) ও পরিচালনার (control) বিচ্ছেদের ফলে একদিকে যেমন ম্যানেজার—মজুরের সামাজিক ব্যবধান হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে তেমনি মালিকরা প্রত্যক্ষ উৎপাদনক্ষেত্রের অন্তরালে থেকে তাঁদের শোষণভূমিকা নিশ্চিন্তে সক্রিয় রাখার সুযোগ পেয়েছেন। এই বিশ্লেষণের পরবর্তী ধাপে এগিয়ে গেলেই বলতে হয়, ‘capitalists without function’ yield to the ‘functionaries without capital’ এবং ধনতান্ত্রিক শিল্পকেন্দ্রের বিশেষ কোনো সাদৃশ্য নেই আগেকার কালের ‘full capitalist’-দের সঙ্গে (Dahrendorf)। এঁদের জাতই আলাদা।
মূলধন ও পুঁজিপতি শ্রেণির এই গোত্রান্তরের মধ্যে যন্ত্রীকরণের অবাধগতি অব্যাহত রয়েছে এবং তার ফলে ভোগ্যপণ্যের অফুরন্ত প্রবাহ সমাজের মেহনতি মানুষের সর্বস্তরে, কারখানার মজুর থেকে কর্পোরেশনের ম্যানেজার পর্যন্ত, এমন এক সুখোচ্ছ্বাসের ক্রমোজ্জ্বল মোহ বিস্তার করেছে যে তাদের শ্রেণিচেতনা তো দূরের কথা, শ্রমদাসত্বের বেদনা পর্যন্ত আজ বিলীয়মান। সর্বজনসমাজের (mass society) প্রসার্যমাণ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা বর্তমান ধনতন্ত্রের অত্যন্ত শক্তিশালী চতুর রাজনৈতিক কৌশল, যেজন্য সাধারণ মানুষের দাসত্ববেদনা ও তজ্জনিত বিদ্রোহী মনোভঙ্গি বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে গেছে আরও বেশি। তাই দার্শনিক মার্ক্যুসে বলেছেন : ‘A comfortable, smooth, reasonable, democratic unfreedom prevails in advanced industrial civilization, a token of technical progress.’ দাসত্বের (unfreedom) বিশেষণগুলি অনুধাবনীয়—মনোরম স্বচ্ছন্দ যুক্তিযুক্ত গণতান্ত্রিক দাসত্ব। এই দাসত্বের বন্ধনমুক্তির জন্য অধীর আগ্রহ অথবা কঠোর সংগ্রামেচ্ছা কি আজ উন্নত ধনতান্ত্রিক সমাজে মার্কসীয় বৈপ্লবিক চেতনার প্রেরণায় জাগা সম্ভব? তাহলে কি বিদ্রোহ—বিপ্লব চিরদিনের মতো আজকের ধনতান্ত্রিক যন্ত্রীকৃত সমাজ থেকে নির্বাসিত হবে? তা হবে না। সেই মুক্তি সংগ্রামের ডায়ালেকটিকস হবে অন্যরকম।
তার আগে মার্কসীয় আত্মবিচ্ছেদের সমস্যার কথা কিছু বলা প্রয়োজন। শ্রমিক ও তার শ্রমোৎপন্ন পণ্যের নিঃসম্পর্কতাই ধনতান্ত্রিক যন্ত্রশিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং এই নিঃসম্পর্কতা আত্মবিচ্ছেদ ও মানুষের খণ্ডিত সত্তার মূল উৎস। এই আত্মবিচ্ছেদের বিশ্লেষণ করেছেন মার্কস তাঁর Capital গ্রন্থে পণ্যভূতপূজা নামে (Commodity Fetishism)। তার আগেই তাঁর প্রথমদিকের রচনায় (অসম্পূর্ণ notes) মার্কস এই আত্মবিচ্ছেদের কারণ বিশ্লেষণ করে বলেছেন :
Under the prevailing economic conditions, the realization of labour appears as its opposite, the negation of the labourer. Objectification appears as loss of an enslavement by the object, and appropriation as alienation and expropriation–Economic and Philosophic Manucripts of 1844
পরবর্তী অনেক রচনায় মার্কস এই আত্মবিচ্ছেদের বিস্তারিত বিশ্লেষণ ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর Critique, The German Ideology, Capital প্রভৃতি গ্রন্থে (Marcuse ৪, ২৭৩—৮৭)। বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজের অতিজটিল যন্ত্রপিঞ্জরে শুধু শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে নয়, সর্বশ্রেণির কর্মরত মানুষের মধ্যে এই আত্মবিচ্ছেদবোধ ভয়াবহরূপে প্রকট হয়ে উঠেছে। তার ফলে দাসত্বচেতনা লুপ্ত হয়েছে এবং যন্ত্রোন্নত ধনতান্ত্রিক সমাজের দাস যারা তারা আজ ‘sublimated slaves’ হলেও আসলে যে অকৃত্রিম দাসানুদাস সেই বোধ নেই। কারণ, বাধ্যতা দিয়ে অথবা কঠোর মেহনত দিয়ে দাসত্ব বিচার করা যায় না। যন্ত্রজগতে একটি উপযন্ত্র বা নাটবল্টুর মতো থাকা এবং বস্তুজগতে নিছক বস্তুতে পরিণত হওয়াই হল আসল দাসত্ব। আত্মবিচ্ছেদের সঙ্গে এই দাসত্ববোধলোপ হল যন্ত্রীকৃত সমাজের লক্ষণ।
আধুনিক সমাজে আত্মবিচ্ছিন্ন মানুষ অনেক নামে পরিচিত—‘stranger’, ‘free floater’, ‘outsider’, এমনকী ‘existentialist’ পর্যন্ত, বলা যায়। সে যেমন ডস্টয়েভস্কির underground-এর মানুষ তেমনি কাম্যুর outsider, তেমনি নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্য মহানগরের ‘lonely crowd’-এ নির্জন মানুষ। মহানগরের বিপুল জনস্রোতে সে নির্জনতার দ্বীপে নির্বাসিত। প্রেম ভালোবাসা শ্রদ্ধা ভক্তি ঘৃণা দুঃখ বেদনা আনন্দ অনুকম্পা অনুভূতি সবই তার কাছে হৃদয় নামক কম্পিউটারের স্নায়ুঝংকার—গণনা। কেউ কেউ বলেন একালের অস্তিবিবেকবাদী (existentialist) জীবনদর্শন এই আত্মবিচ্ছিন্নতারই একটা বিশেষ দার্শনিক রূপ মাত্র। ধর্মবিশ্বাসের মূল যেদিন থেকে নড়ে গেছে, যেদিন থেকে মানুষ হত্যা করেছে ঈশ্বরকে (নিটশের সেই পাগলের ভাষা ‘Whither is God, I shall tell you. We have killed him–you and I.’), সেদিন থেকে তার চিরন্তন জীবনের প্রত্যয়েরও মৃত্যু হয়েছে। জীবন আর মৃত্যুর পথে বিশাল এক শূন্য প্রান্তর, কোনো রং নেই, একমাত্র অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর নিথর কালো রং ছাড়া। এ যুগের বড় বড় কারখানায় পণ্যোৎপাদনের যান্ত্রিক ছন্দের সঙ্গে শ্রমিকের দৈহিক প্রতিক্রিয়ারও কোনো মিল নেই, সেই ছন্দের কোনো মাত্রার সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই, সে শুধু নিছক উপযন্ত্র মাত্র। কাজেই উৎপন্ন পণ্যের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ চরম স্তরে পৌঁছেছে। তার বাইরে যে বিশাল প্রশাসন, সংগঠন ও বিজ্ঞাপনের জগৎ, সেখানকার আত্মবিচ্ছেদ অন্যদিক থেকে আরও ভয়াবহ। এই আত্মবিচ্ছেদের সমগ্র রূপ কী?
Internal darkness, deprivation
And destitution of all property,
Dessication of the world of sense,
Evacuation of the world of fancy,
Inoperancy of the world of spirit:
T.S. Eliot, Burnt Norton
সমগ্র সত্তা আবৃত করে এই যে গভীর অন্ধকার, অরণ্যময় গ্রাম্য শ্মশানের অমানিশার মতো এই যে শূন্যতা ও রিক্ততাবোধ, এই হল বর্তমান সমাজজীবনে মানুষের আত্মবিচ্ছিন্নতার অভিশাপ। এই শাপমোচন যন্ত্রায়িত ধনতান্ত্রিক সমাজে অসম্ভব।
ধনতন্ত্রের উদযোগ ও মধ্যপর্ব পর্যন্ত শিল্পী—সাহিত্যিকদের artistic alienation-এর ঊর্ধ্বায়ন হত এক রকমের বিদ্রোহের মধ্যে, সাধারণভাবে বলা যায় ধনতান্ত্রিক জীবনদর্শন ও জীবননীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে। রোমান্টিক কাব্যে এবং নাটক—গল্প—উপন্যাসের অ—সাধারণ সব চরিত্রের মধ্যে—যেমন ‘the artist, the prostitute, the adulteress, the great criminal and outcast, the warrior, the rebel-poet, the devil, the fool’–যারা কেউ স্বাভাবিক নিয়মে উপার্জন করে অর্থাৎ মেহনত করে বেঁচে থাকে না। প্রচলিত সমালোচনার মানদণ্ডে একে ‘রোমান্টিক’ বলা হয়, কিন্তু এ হল শিল্পীদের নিজস্ব অবাধ্যতা ও প্রতিবাদ, কোনো আরোপিত কৃত্রিম জীবননীতির বশ্যতা স্বীকার না—করা। আজকের যন্ত্রোন্নত ধনসমাজে এই শিল্পীসুলভ আত্মবিচ্ছিন্নতার ঊর্ধ্বায়ন আর প্রয়োজন নেই, শিল্পীদের ‘great refusal’-এর দিন শেষ হয়ে গেছে। তাই দেখা যায় আজকের ‘the vamp, the national hero, the beatnik, the neurotic housewife, the gangster, the star, the charismatic tycoon perform a function very different from and even contrary to that of their cultural predecessors’ (Marcuse, ২ তৃতীয় অধ্যায়)। এসব চরিত্র আগেকার বারাঙ্গনা সমাজত্যাজ্য খুনি শিল্পী বিদ্রোহীদের মতো ‘images of another way of life’ নয়, এরা হল ‘freaks or types of the same life, serving as an affirmation rather than negation of the established order’ (Marcuse ২ পৃঃ ৬০)। অর্থাৎ শিল্পীর বিচ্ছিন্নতাবোধের ঊর্ধ্বায়নের বদলে আজ অবনয়ন (desublimation) হয়েছে। এই অবনয়নের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হল বর্তমান শিল্প—সাহিত্য ও সিনেমায় যৌন উপাদানের বাহুল্য ও চরম বিকৃতি। আগেকার সাহিত্য—শিল্পে (ধনতান্ত্রিক যুগের) বৈধ—অবৈধ প্রেম, যৌনসম্ভোগ, কামকেলি সবই রূপায়িত হত সামগ্রিক—আরতিক (erotic) মূর্তিতে। তখন যৌনজীবনের একটা ‘landscape’ ছিল, যার মধ্যবর্তিতায় ‘libidinal experience’ পূর্ণতা লাভ করত। সেই ল্যান্ডস্কেপ অটোমোবিলের যুগের মহানগরের স্টিলকংক্রিট ও ম্যাকাডামাইজিড পথে একেবারে মুছে গেছে। তার ফলে আজকের যৌনজীবন ‘de-eroticized’ হয়ে গেছে, মানুষ হয়েছে শিশ্নোদরপরায়ণ এবং যৌনজীবন হয়েছে কেবল শিল্পকেন্দ্রিক। ফ্রয়েডীয় ভাষায় বলা যায়, ‘Eros’-এর যুগ শেষ হয়ে গেছে, বর্তমান যুগ ‘Sexuality’-র যুগ। এই ‘localization and contraction of libido, the reduction of erotic to sexual experience and satisfaction’ (Marcuse ২, পৃঃ ৭০), আজকের সাহিত্য—শিল্প—সিনেমায় প্রতিফলিত এবং ‘বিজ্ঞাপন’ নামক প্রচারকলাতেও।
শুধু সাহিত্য—শিল্প—সিনেমায় নয়, পোশাক—পরিচ্ছদেও আঙ্গিক যৌনচেতনা অত্যন্ত প্রখর হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ পরিচ্ছদ হয়েছে বহিরঙ্গের প্রসারণ মাত্র—‘an extension of the outer surface of the body’ (McLuhan)। আমেরিকান মহিলাদের পোশাক প্রসঙ্গে ম্যাকল্যুহান বলেছেন, ‘the American woman for the first time presents herself as a person to be touched and handled, not just to be looked at,’ অর্থাৎ পোশাক পরে সেজেগুজে আজ আর মহিলারা শুধু বলতে চান না ‘আমাকে দেখো’, তাঁরা যেন বলতে চান ‘আমাকে স্পর্শ করো, নেড়েচেড়ে দেখো’ (Mcluhan, পৃঃ ১২১)। আমেরিকান নয় শুধু, সকল দেশেই, ভারতবর্ষে ও বাংলাদেশেও, পোশাক সম্বন্ধে ম্যাকল্যুহানের কথা সত্য হয়ে উঠেছে। পোশাকও ‘de-eroticized’ হয়েছে। তার উৎকট প্রকাশ হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞাপনে (advertisement) এবং সিনেমায়। চটকদার ভাষায় আধুনিক বিজ্ঞাপনের কথা বলেছেন ম্যাকল্যুহান—‘The art of advertising has wonderously come to fulfil the early definition of anthropology as ‘the science of man embracing woman’ (McLuhan, পৃঃ ২২৬)। পোশাক—পরিচ্ছদের বিজ্ঞাপন (যেমন শাড়ি, বক্ষাবরণী), সিগারেটের বিজ্ঞাপন, ইলেকট্রিক ফ্যানের বিজ্ঞাপন (হাওয়াতে শয্যার উপরে মহিলার শাড়ি উড়ছে), স্কুটারের বিজ্ঞাপন (পেছন সিটে মহিলার চুল ও শাড়ি উড়ছে), সিনেমার পোস্টারের কথা তো বলাই বাহুল্য—সর্বত্র শুধু নারীর বিশেষ অঙ্গকেন্দ্রিক যৌনাকর্ষণ। যন্ত্রোন্নত ধনতান্ত্রিক সমাজ যেন নারীকে স্বাধীনতার মোহে ভুলিয়ে তাকেই সবচেয়ে বেশি যান্ত্রিক পণ্যে ও উপযন্ত্রে পরিণত করেছে এবং পর্যাপ্ত ভোগ্যপণ্যের মতো মানুষের যৌনক্ষুধা পরিতৃপ্তির পথও চারদিক থেকে খুলে দিয়েছে। সে পথ বিকার বিকৃতির পথ হলেও পুরুষ—নারী কারও চৈতন্য নেই। এবং সে স্বাধীনতা যে কোন জাতের স্বাধীনতা তা টাইপরাইটার—টেলিফোনের যুগের লেডি টাইপিস্ট ও ‘কল—গার্ল’দের কথা ভাবলেই বোঝা যায় :
The typewriter and the telephone… have taken over the revamping of the American girl with technological ruthlessness and thoroughness. The prostitute was a specialist, and the call-girl is not. A ‘house’ was not a home; but the call-girl not only lives at home, she may be a matron. (McLuhan ২৬৫—৭৪).
যন্ত্রোন্নত আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজের এই মনোরম গণতান্ত্রিক ‘unfreedom’ ও ভোগবিলাসের স্বাচ্ছন্দ্য দেখলে তার আমূল পরিবর্তন অথবা বৈপ্লবিক রূপান্তর সম্বন্ধে কোনো পন্থা নির্দেশ করা, অন্তত মার্কসীয় নীতি অনুসারে, বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। অভ্যস্ত চিন্তাধারায় বিপ্লব—বিদ্রোহের কোনো সম্ভাবনাও এই সমাজে বিশেষ দেখা যায় না। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টির মৃতপ্রায় অবস্থা দেখলেই তা বোঝা যায়, যদিও দুই দেশে বড় বড় ট্রেড ইউনিয়ন এবং অভিজাত পেশাদার একশ্রেণির মজুরনেতার আবির্ভাব অনেককাল হয়েছে। যে দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে শক্তিশালী গণপার্টি হওয়া উচিত ছিল, মার্কসীয় নীতি অনুসারে, সেখানে কেন আজ তা কয়েকজন কমিউনিস্ট তত্ত্ববিলাসীর ঘরোয়া বৈঠকখানায় পরিণত হয়েছে তা ভেবে দেখা কর্তব্য। ফ্রান্স—ইটালির কমিউনিস্ট পার্টি ইউরোপের মধ্যে বড় শক্তিশালী পার্টি, অভিজ্ঞতাও দীর্ঘকালের, কিন্তু আকৈশোর আমরা দেখে আসছি এই দুই পার্টির নেতৃবৃন্দের যেমন বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি, তেমনি তার শক্তির হ্রাসবৃদ্ধিও উল্লেখ কিছু হয়নি, বিপ্লবের বদলে ভোটনীতি পার্টির কর্তৃ,পক্ষের প্রভুত্বরক্ষার প্রধান কৌশল হয়ে উঠেছে। এই অবস্থার কারণ কী?
প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক কমিউনিজমের এতাবৎকালের মহাতীর্থ সোভিয়েট ইউনিয়নে বিপ্লবের কিছুদিন পর থেকে সমাজতন্ত্রের গতিপথে মার্কসীয় নীতির প্রয়োগপদ্ধতিতে নানা রকমের গলদ, বিচ্যুতি, বিভ্রান্তি ও বিকৃতি দেখা দিয়েছে। তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হয়েছে এই যে সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টি আজ কমিউনিস্ট আন্দোলনে সংস্কারবাদী নীতির (Revisionism) শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তার অর্থনৈতিক—সামরিক শক্তির জোরে আজ সে ছোট ছোট প্রতিবেশী কমিউনিস্ট রাষ্ট্রকে তার তাঁবেদারি করার জন্য হুকুম দিচ্ছে। এ কথা ঠিক যে কমিউনিস্ট আন্দোলনে সংস্কারবাদী ধারা প্রবর্তনের জন্য মূলত দায়ী পার্টির কর্ণধার স্তালিন, যদিও সোভিয়েট রাষ্ট্রের দৃঢ় বনিয়াদ গঠনে তাঁর দান স্মরণীয়, কিন্তু যাঁরা স্তালিনের মৃত্যুর পরে বিপ্লবীর ছদ্মবেশে ‘de-Stalinization’-এর ঢাকঢোল বাজিয়ে বর্বরের মতো স্তালিনকে কবরান্তরিত পর্যন্ত করেছেন, তাঁরা আজ সংস্কারবাদকে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সহযোগিতার যে ঘৃণ্য স্তর পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে গেছেন, আত্মম্ভরিতা সত্ত্বেও দৃঢ়চিত্ত স্তালিন আজ বেঁচে থাকলে তা নিতে পারতেন কি না সন্দেহ। কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এই সংস্কারবাদী প্রতিক্রিয়ার কবল থেকে মুক্ত করার জন্য আজ মাও—সে—তুঙের নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভেদ নয় শুধু, দুই কমিউনিস্ট শিবিরের সম্পর্ক আজ ক্যাপিটালিস্ট—কমিউনিস্ট শত্রুতার চেয়েও ভয়ংকর। এইটাই হল বর্তমান পৃথিবীর গতিশীল ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ মর্মান্তিক ঘটনা।
কিন্তু এই মর্মান্তিক ঐতিহাসিক ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে হলে মার্কসীয় সংস্কারবাদের উৎপত্তি, বিস্তার ও স্বরূপ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। অন্তত তার উপসর্গগুলি জানা আবশ্যক। সংক্ষেপে বলা যায়—যুদ্ধ ও শান্তি নীতি, ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের নীতি এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজগঠনের পথে শ্রেণিবিরোধ সমাধানের নীতি সম্পর্কে মার্কসীয় বিচারভঙ্গির পার্থক্য থেকে সংস্কারবাদের উৎপত্তি। ধনতান্ত্রিক—সাম্রাজ্যবাদী শত্রুবেষ্টিত হয়ে সমাজতান্ত্রিক গঠনের সংকটকালে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতির সাময়িক প্রয়োজন থাকলেও, পরে সমাজতন্ত্রের জয়যাত্রাকালে, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, সাম্রাজ্যবাদ—বিরোধী মুক্তিসংগ্রাম যখন বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ল এবং তার ভিতর দিয়ে আগেকার উপনিবেশ ও পরাধীন দেশগুলির মধ্যে শ্রেণিবিরোধ নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করল, তখন সহাবস্থান হয়ে দাঁড়াল ধনতন্ত্র—সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সহযোগিতারই নামান্তর। তার প্রমাণ পাওয়া যায় আলজিরিয়া, কিউবা, লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে, কঙ্গো, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সোভিয়েট, ফরাসি, ইটালি ও অন্যান্য সমভাবাপন্ন কমিউনিস্ট পার্টির বকধার্মিক মনোভাবে এবং পরোক্ষে সাম্রাজ্যবাদী সহযোগিতার নীতি অনুসরণে। শুধু তা—ই নয়, নিউক্লিয়ার বোমার ভয় দেখিয়ে পর্যন্ত সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টি (যে বোমার বড় মালিক সোভিয়েট ও আমেরিকা) শ্রেণিসহযোগিতার নীতি চালু করতে চেয়েছে এবং দুঃখের বিষয় যে ফ্রান্স ও ইটালির কমিউনিস্ট নেতারা তার প্রতিধ্বনি করেছেন। তাজ্জব যুক্তি! ইতিহাসে যদি এতদিন বন্দুক কামান ট্যাঙ্ক বোমারু বিমান সমাজের শ্রেণিগড়ন ও শ্রেণিবিরোধ নিশ্চিহ্ন করতে না পেরে থাকে, তাহলে নিউক্লিয়ার বোমার মারণশক্তি অনেক বেশি মারাত্মক বলে সমাজ থেকে শ্রেণিগুলি পর্যন্ত আজ লোপ পাবে কেন, অথবা অহিনকুলের মধ্যে মৈত্রী স্থাপিত হবে কেন? এ কথাও অতিরঞ্জিত নয় যে নিউক্লিয়ার বিশ্বযুদ্ধ হলে মানবসভ্যতা পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে, কিন্তু শুধু সেই সম্ভাবনায় বা বিভীষিকায় সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য ‘অটোমেটিক্যালি’ অন্তর্ধান করবে কেন? এসব কথাবার্তার শব্দতরঙ্গ যদি গোরস্থানের মাটির গভীরে প্রবেশ করে তাহলে মার্কস ও লেনিন উভয়ের শুকনো হাড়গুলো পর্যন্ত কবরের তলায় কেঁপে উঠবে। শ্রেণিসহযোগিতার উদ্দেশ্যে মার্কসীয় নীতির নিউক্লিয়ার ব্ল্যাকমেইলিং—এও আজ সোভিয়েট পশ্চাৎপদ নয়। এই নীতির পরিপূরক হল—পৃথিবীতে আজ আর কোথাও কোনো বিরোধ নেই, ধনতন্ত্র—সমাজতন্ত্রের বিরোধ ছাড়া। এ ধারণাও সোভিয়েটের বদ্ধমূল। এর নির্গলিতার্থ হল, ধনতন্ত্রের প্রতিভূ আমেরিকা এবং সমাজতন্ত্রের প্রতিভূ সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে বিরোধ ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো বিরোধ নেই কোথাও। এই বিরোধের সমাধানের পথ হল হোয়াইট হাউস—ক্রেমলিনের সভাকক্ষে উভয় দেশের রাষ্ট্রনেতাদের আলোচনা, মধ্যে মধ্যে ভ্রমণ, নিউক্লিয়ার মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা, স্পেস—ফ্লাইটের প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান, বিশ্বরাষ্ট্রসংঘে জমকালো অধিবেশন ও বক্তৃতা এবং অর্থনীতিক্ষেত্রে ধনতান্ত্রিক—সমাজতান্ত্রিক উৎপাদনব্যবস্থার প্রতিদ্বন্দ্বিতা (অবশ্যই foreign aid—সহ)। আর্থিক ক্ষেত্রে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফল হল ধনতান্ত্রিক market economy-র প্রসারণ এবং কেন্দ্রগত পরিকল্পনার (সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের) অন্তরালে ধনতন্ত্রের একটি বড় বৈশিষ্ট্যকে বাঁচিয়ে রাখা (ব্যক্তিগত মূলধনের বিলোপ সত্ত্বেও)। সোভিয়েট সমাজে তাই মানুষের যান্ত্রিক শ্রমদাসত্বের অবসান হয়নি, নতুন যুক্তি ও আদর্শের নাগপাশে তার বন্ধন অনেক বেশি দুশ্ছেদ্য হয়েছে :
the transition from capitalism to socialism appears, in spite of the revolution, still as quantitative change. The enslavement of man by the instruments of his labour continues in a highly rationalized and vastly efficient and promising form– Marcuse ২, পৃ. ৪৮
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি এই নির্গুণ মাত্রিক গতির ফলে সোভিয়েট সমাজের গড়নেরও কোনো মৌল গুণগত পরিবর্তন কিছু হয়নি, বরং দেখা যায় অনেকদিক থেকে যন্ত্রোন্নত ধনতান্ত্রিক সমাজের বর্তমান গড়নের সঙ্গে তার সাদৃশ্য গড়ে উঠেছে। অষ্টাদশ পার্টি কংগ্রেসের রিপোর্টে (১৯৩৯) স্তালিন বলেছিলেন, সোভিয়েট সমাজের সঙ্গে ধনতান্ত্রিক সমাজের পার্থক্য এই যে সোভিয়েটে কোনো ‘antagonistic, hostile classes’ নেই, শোষিত শ্রেণি বিলুপ্ত হয়েছে এবং শ্রমিক, কৃষক ও বুদ্ধিজীবীরা—‘who make up Soviet society’– বন্ধুর মতো সহযোগীর জীবনযাপন করে—‘live and work in friendly collaboration’। কাজেই স্তালিন ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন যে সাম্যবাদী সমাজের উচ্চতর স্তরে উত্তরণ—রাষ্ট্রযন্ত্রের বিলোপ, পার্টির বিলোপ, সীমিত শ্রম ও পর্যাপ্ত ভোগ, সকলরকম দৈহিক—মানসিক বন্ধনমুক্তি—ধীরেসুস্থে উন্নত কৌশলে (যান্ত্রিক) সমাজতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রসারের ভিতর দিয়ে সম্ভব হবে (‘the continuous expansion and perfecting of socialist production on the basis of higher technique’), তার জন্য আর কোনো সামাজিক সংগ্রাম বা আলোড়নের প্রয়োজন হবে না। ধনতন্ত্র থেকে (যদিও জারের রাশিয়াকে সামন্ততন্ত্র—ধনতন্ত্রের মিশ্রণ বলতে হয়) সমাজতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদের গতিপথে কেবল কতকগুলি অবাঞ্ছিত লোককে সোভিয়েট পদ্ধতিতে purge করে, সমাজকে স্থির শান্ত রেখে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, আগেকার ফিউডাল ও বুর্জোয়া শ্রেণি, তাদের বংশধর, নতুন বুর্জোয়াভাবাপন্ন শ্রেণি, মধ্যশ্রেণি, বুদ্ধিজীবী, সকলে হৃদয়ের পরিবর্তনের ফলে de-classed হয়ে যাবে, স্তালিনের এই বিশ্লেষণ থেকে এই কথাই ভাবতে হয়। কিন্তু কোনো মার্কসবাদী—লেনিনবাদীর পক্ষে তা ভাবা বোধহয় সংগত নয়। আমেরিকান অর্থবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরাও তাঁদের সমাজের ভবিষ্যৎ ‘classlessness’ সম্বন্ধে এইভাবে চিন্তা করেন। সোভিয়েট নায়কদের এই অর্থনৈতিক চিন্তা সম্বন্ধে একজন সমাজবিজ্ঞানী মন্তব্য করেছেন:
This means by way of evolution, in the same sosrt of way in which Americans who, while taking the ‘optimistic’ view, do not yet regard the American society of today as a ‘classless’ society, visualize the further democratization of the United States.
আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানীরা অনেকে মনে করেন ‘historical changes in the social structure may well give substance to the American creed of classlessness. (Sjoberg)। অর্থাৎ আমেরিকারও ‘ক্রিড’ হল ‘শ্রেণিহীনতা’ এবং সমাজগড়নের ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ফলে সেই ‘ক্রিড’ বাস্তব সত্য হতে পারে। আমেরিকানরা শুধু সোভিয়েটের মতো ‘সোশ্যালিস্ট’ কথাটি ব্যবহার করেন না, তার পরিবর্তে ‘ডেমোক্রাটিক’ কথা ব্যবহার করেন, এবং ঐতিহাসিক পরিবর্তন হল তাঁদের মতে ডেমোক্রাসি ও টেকনোলজির ক্রমপ্রসার। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের টেকনোলজিক্যাল উন্নতির ফলে গণতান্ত্রিক নীতির মাধ্যমে ‘শ্রেণিহীন সমাজ’ প্রতিষ্ঠা সম্ভব এবং সমাজতান্ত্রিক উৎপাদনেরও টেকনিক্যাল উন্নতির ফলে ‘শ্রেণিহীন সমাজ’ গঠন সম্ভব। একই পদ্ধতিতে সম্ভব, ধীরেসুস্থে মন্থরগতিতে (‘gradual change’), বিনা ঝঞ্ঝাটে, বিনা বিদ্রোহ—বিপ্লবে—আলোড়নে। তা ছাড়া নিউক্লিয়ার মারণাস্ত্রের যুগে বিদ্রোহ—বিপ্লব তো অবাস্তব দিবাস্বপ্ন মাত্র, কারণ তার আতঙ্কে সামাজিক ‘শ্রেণি’—ই তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
অসম্ভবকে সম্ভব করতে গেলে ধনতান্ত্রিক সমাজের যে রূপায়ণ সম্ভব তার পরিচয় আগে দিয়েছি, আমেরিকান সমাজের শ্রেণিগড়নের আলোচনা প্রসঙ্গে। সোভিয়েট সমাজে ব্যক্তিগত মূলধন ও মুনাফার বিলোপের ফলে (যা নিশ্চয় একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং যার জন্য আমেরিকা বা অন্যান্য ধনতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে তার মৌল পার্থক্য অবশ্যই আছে) আজ সেখানে কোনো কোটিপতি ধনিকশ্রেণি নেই বটে, কিন্তু পূর্বোক্ত তিন শ্রেণির (শ্রমিক—কৃষক—বুদ্ধিজীবী) সহযোগিতায় সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক টেকনোলজিক্যাল উন্নতি ও প্রতিযোগিতার ফলে আজ সেখানেও ‘ম্যানেজেরিয়াল রেভল্যুশন’ হয়েছে, মর্যাদা (status) ও কৃতিত্বমুখী (achievement-oriented) সামাজিক স্তরের (social strata) অভিনব বিন্যাস হয়েছে। আমেরিকার মতো ‘কর্পোরেট ধনী’র বিকাশ না হলেও, কেন্দ্রগত রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার ফলে এগজিকিউটিভ ম্যানেজার ব্যুরোক্রাট ও নতুন মধ্যশ্রেণির বিস্ময়কর বিস্তার হয়েছে। এঁদের কোনো ধনিকশ্রেণির দাসত্ব করতে হয় না, কেবল রাষ্ট্রনেতাদের (অর্থাৎ পার্টি বসদের) দাসত্ব করতে হয়। তার উপর সোভিয়েট রাষ্ট্রযন্ত্রের আর্থিক—সামরিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে এই ম্যানেজার—ব্যুরোক্রাট—নব্য মধ্যশ্রেণির প্রতিপত্তিও যথেষ্ট বেড়েছে এবং সোভিয়েট অর্থনীতি—রাষ্ট্রনীতির সংস্কারবাদী আদর্শের প্রতিক্রিয়ায় ক্রমে আরও বাড়ছে। যত বাড়ছে তত সংস্কারবাদী চিন্তা সোভিয়েট সমাজে দৃঢ়মূল হচ্ছে (অবশ্য এই নতুন মধ্যবিত্ত সমাজে), তত ধনতন্ত্র—সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সহযোগিতার ব্যগ্রতা বাড়ছে, তত নিউক্লিয়ার মারণাস্ত্র ও স্পেসফ্লাইটের ক্রমোন্নতির দ্বারা পৃথিবীতে শ্রেণিহীন সমাজগঠনের বিচিত্র ধারণা উগ্রতর হচ্ছে এবং বিপ্লবচিন্তাকে ‘ব্যাকডেটেড’ বলে বিদ্রুপ করার প্রবৃত্তি জাগছে। সোভিয়েট সংস্কারবাদকে তাই সেখানকার সোশ্যালিস্ট সমাজের নতুন ম্যানেজার—ব্যুরোক্রাট—মধ্যবিত্তের মার্কসীয় চিন্তাধারা বলা যায়।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল এই উভয়সংকট থেকে মানুষের মুক্তির উপায় কী? একদিকে যন্ত্রোন্নত আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজের আরামদায়ক অধীনতা, অন্যদিকে যন্ত্রোন্নত আধুনিক সমাজতান্ত্রিক সমাজের আর্মচেয়ারি ক্রমবিকাশতত্ত্ব, এই উভয়সংকট থেকে মানুষের মুক্তি কোন পথে? রাজনৈতিক কর্মীদের তো বটেই, প্রত্যেক বুদ্ধিজীবীর—বিশেষ করে যাঁরা মার্কসীয় সমাজচিন্তার অনুগামী—তাঁদের আজ এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের একটা নৈতিক দায়িত্ব আছে। যাঁরা দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চান, অথবা নিজেদের প্রমাণকে সমস্ত প্রমাণের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে চান, অথবা ন্যায়শাস্ত্রের পণ্ডিতদের মতো তর্কের ধূম্রজাল বিস্তার করে মার্কসীয় তত্ত্বের অভিনব টীকা করতে চান, তাঁদের স্বার্থ কী হতে পারে তা আজকের দিনে বুঝতে কষ্ট হয় না। পেন্টাগন ও ক্রেমলিনের মনোলোভা রজতজালে জড়িয়ে থাকাই তাঁদের কাছে নিরাপদ পন্থা। আমাদের মতো যাঁরা সাম্রাজ্যবাদের অধীন দেশের সদ্যোমুক্ত বুদ্ধিজীবী—জ্যঁ পল সার্ত্র যাঁদের ‘walking lies’ বলেছেন—ফ্যানন যাঁদের বলেছেন অর্থাৎ যাঁরা সবজান্তা কেতাদুরস্ত চতুর, যাঁরা বর্তমানে জাতীয় গভর্নমেন্টের লুণ্ঠন—পরিকল্পনার বুদ্ধির জোগানদার ও সহযোগী অংশীদার, তাঁদের অবস্থা আরও শোচনীয়। তাঁদের পক্ষে বুদ্ধিযুক্তির, ধ্যানধারণার পুরাতন শিকড় উপড়ে ফেলা রীতিমতো কঠিন। কিন্তু যে শিকড়ে পচন ধরেছে তা উপড়ে ফেলাই ভালো এবং যদি তার কোনো জীবন্ত শাখা থাকে তাহলে তা নতুন মাটিতে রোপণ করাই শ্রেয়।
আধুনিক যন্ত্রায়িত ধনতান্ত্রিক সমাজের মুক্তি সমস্যা বাস্তবিকই জটিল। কেবল ব্যক্তিগত মুক্তি কাম্য হলে সহজ পথ অনেক আছে, সবই চোরাগলি ও বাঁকা পথ। যেমন আত্মহত্যা। প্রতিদিন পৃথিবীতে এখন গড়ে এক হাজার ব্যক্তি আত্মহত্যা করে, তার আটগুণ (অর্থাৎ আট হাজার) আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, অর্থাৎ প্রতি বছরে প্রায় তিরিশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যার পথে এই ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি কামনা করে।
আত্মহত্যা ছাড়া আছে আত্মবিচ্ছেদবোধজনিত ব্যর্থতার দ্বীপে নির্বাসিত জীবনযাপন করা, অর্থাৎ হিপি—বিটনিকদের মতো (যাদের ‘new boheme’ ‘poor refuge of defamed humanity’ বলা হয়, (Marcuse ১, পৃ: ১৭) বিচিত্র বিদ্রোহীর বেশে দিন কাটানো। আত্মহত্যাও প্রতিবাদ, হিপি—বিটনিক—বিদ্রোহও প্রতিবাদ, তবে ‘ট্র্যাডিশন্যাল’ প্রতিবাদ নয়, কারণ পুরাতন পদ্ধতিতে প্রতিবাদের পথ আধুনিক one-dimensional সমাজে প্রায় বন্ধ। তবে এই প্রতিবাদের লক্ষ্য বিকৃত ব্যক্তিমুক্তি, সুস্থ সমাজমুক্তি নয়। সমাজমুক্তির লক্ষ্য নিয়েও প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ সম্ভব, নতুন পদ্ধতিতে। কাদের দ্বারা সম্ভব? দার্শনিক মার্ক্যুসে বলেন, ‘the substratum of the outcasts and outsiders, the exploited and persecuted of other races and other colours, the unemployed and the unemployable’ (Marcuse ২, পৃঃ ২০০)। মার্ক্যুসে প্রবীণ মার্কসীয় পণ্ডিত হলেও তাঁর এই ভয়ংকর উক্তি (কৃষক—মজুর শ্রেণিবর্জিত) অ—মার্কসীয় বলতে হয়। মার্কুসে তাঁর এই সম্ভাব্য বিদ্রোহীদের মধ্যে যন্ত্রোন্নত ধনতান্ত্রিক সমাজের শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা সম্বন্ধ অধিক নৈরাশ্যের প্রশ্রয় দিয়েছেন, যদিও তার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। শ্রমিক আন্দোলন যদি ইকনমিজম ও ফর্মইজমের সংস্কারমুক্ত করে প্রকৃত বৈপ্লবিক আদর্শে গড়ে তোলা যায়, তাহলে শ্রমিকদের সুখাচ্ছন্নতা দূর হবে, শ্রমদাসত্বচেতনা তীব্র হবে এবং অন্যান্য বিদ্রোহীদের পাশে তারা প্রবল সংহত শক্তি নিয়ে দাঁড়াবে। তা ছাড়া যন্ত্রোন্নত ধনসমাজে যে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে সর্বাংশে বৈপ্লবিক সম্ভাবনা লোপ পেয়েছে, এমন কথা বলা মার্কসবাদসম্মত নয়। বৈপ্লবিক সম্ভাবনা যে নিশ্চয় আছে তা ফ্রান্সের তরুণ বিদ্রোহে শ্রমিকশ্রেণির একাংশের সহযোগিতা থেকে বোঝা যায় (ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধিতা সত্ত্বেও)। তবে ঐতিহাসিক অবস্থার যুগান্তকারী পরিবর্তন এবং মারণাস্ত্রোন্নত রাষ্ট্রের বিকট ও ব্যাপক মারমূর্তির ফলে এই বিদ্রোহের রূপ অন্যরকম হতে বাধ্য। সশস্ত্র শাসকদের সুসংগঠিত violence-এর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র শোষিতদের বিচ্ছিন্ন অসংলগ্ন violence-ও এর আংশিক প্রকাশ হতে পারে। এমনও সম্ভব যে নিরস্ত্রদের অস্ত্র হবে আদিযুগের পাথুরে হাতিয়ার (এমনকী জীবজন্তুর ‘corporeal tools’ হাত—পা—নখ দাঁত পর্যন্ত) থেকে যে—কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ও বিস্ফোরক। দেহের সমস্ত স্নায়ুপেশির সর্বশক্তি নিয়োগ করে সেগুলি তারা নিক্ষেপ করবে জৈবিক ঘৃণাবোধ থেকে, বর্তমান শোষণদমনযন্ত্রের বিরুদ্ধে। তারা ব্যারিকেড করবে, বর্তমান আইনশৃঙ্খলার শিকল ছিঁড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, প্রতিরোধ করবে। শৃঙ্খলাবাদীদের শাস্ত্রবচন ও শাসানি, হিংস্রতার প্রতিমূর্তিদের মুখে অহিংসার বাণী, কোনো কিছুতে তারা কর্ণপাত করবে না। অনেককাল করেছে, আজ আর করবে না। আজকের বিদ্রোহীদের এই volence বালখিল্যের আস্ফালন নয়, বর্বরবৃত্তির পুনরুজ্জীবন নয়, নিছক প্রতিবাদ বা ক্রোধপ্রকাশও নয়। এ হল বহুকালের পুঞ্জীভূত অন্যায়—অবিচার—অত্যাচারের পর্বতপ্রমাণ স্তূপে অগ্নিসংযোগ এবং সেই আগুনের ভিতর দিয়ে চিরকালের অমানুষদের ‘মানুষ’ রূপে ‘পুনর্জন্ম’। কিন্তু এই ক্রোধ—ঘৃণার হিংসাত্মক প্রকাশ অথবা বিচ্ছিন্ন বিশৃঙ্খলা মার্কস—লেনিন—মাও নির্দিষ্ট প্রকৃত বিপ্লবের প্রস্তুতি কি না, যাঁরা বাস্তব ক্ষেত্রে বিপ্লবী তাঁরা নিশ্চয় তা চিন্তা করবেন। মাওয়ের বিখ্যাত কথা, বিপ্লব ‘ডিনার পার্টি নয়, অনেকেই জানেন। তেমনি বিপ্লব কখনোই নৈরাজ্যবাদের আতশবাজি নয়।
আজকের পৃথিবী ও সমাজের দিকে চেয়ে মনে হয় যদি এতকালের সভ্যতার ইতিহাসে আমরা বেশির ভাগ মানুষকে ‘অমানুষ’ করে থাকি, সমাজে ‘মানুষ’ (বিশেষ করে ‘সভ্য’) বলে তাদের মনুষ্যত্বের মাপকাঠিটাই ঠিক করতে না পেরে থাকি, এবং সেই গণ্যমান্য মানুষরাই যদি নিউক্লিয়ার মারণাস্ত্রের প্রয়োগে খেয়ালবশে সভ্যতাতে যে—কোনো সময় ধ্বংস করার জন্য প্রস্তুত থাকেন, তাহলে চিরকালের অত্যাচারিত অমানুষরা যদি আজ তাদের বিচ্ছিন্ন নাশকর্মের ফলে সমাজ—সভ্যতাকে শেষপর্যন্ত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে নিয়ে যায় তাতেই বা ক্ষতি কী, অথবা সেই কারণে তাদের অন্যায়টাই বা অধিকতর মারাত্মক হবে কেন? যারা বিপর্যয়ের পথে অন্ধবেগে অগ্রগামী, তাদের সামনে বিকল্প সুন্দর মানবিক সমাজেরই বা আশাভরসা কোথায়? বক্তৃতায়? পার্টির নির্বাচনী ইস্তাহারে? কোথায়? বোঝা যায় না, মার্কসীয়—অমার্কসীয় গান্ধীয় খ্রিস্টীয় কোনো যুক্তিতেই বোধগম্য নয়।
তরুণ বিদ্রোহ, ছাত্রবিদ্রোহ আজ যন্ত্রোন্নত ধনতান্ত্রিক সমাজের আর—একটি গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ। Third World-এর মুক্তিসংগ্রামের মতো Third Power যুবশক্তি—ছাত্রশক্তি আজ বিদ্রোহী মানুষের একটি বড় ভরসা, উদ্দীপনার উৎস। এবং অনুন্নত অনগ্রসর একদা—পরাধীন দেশে (যেমন ভারতবর্ষে) যন্ত্রোন্নত ধনতান্ত্রিক সমাজের (যেমন আমেরিকার) অর্থনৈতিক অনুপ্রবেশের (বৈদেশিক সাহায্য ও টেকনিক্যাল সহযোগিতার নামে) মতো নৈতিক—সাংস্কৃতিক পরিব্যক্তিও যেহেতু মারাত্মক সত্য ঘটনা, বিশ্ববিদ্যালয় ও বুদ্ধিজীবীরাই তার অন্যতম বাহক, তাই ছাত্র বিদ্রোহের লক্ষ্য আজ, ধনতান্ত্রিক দেশের মতো আমাদের দেশেও, এই সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আমূল পরিবর্তন। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত গতানুগতিক আদর্শের ধারক—বাহক ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি আর কিছু নয় এবং সেই আদর্শ তার পাঠ্য বিষয়ে, ডিগ্রিতে, গবেষণায় পাশ—ফেলের পরীক্ষায়, কৃতিত্বের বিচারে, সর্বত্র প্রতিফলিত। বিদ্যাও বাণিজ্যের পণ্য, ডিগ্রি হল ক্রেতার জন্য লোভনীয় প্যাকেজ, এবং এই পণ্য ও প্যাকেজ ম্যানুফ্যাকচারিং—এর কারখানা হল বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্যায়তন। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যায়তন, বিদ্বান শিক্ষক—অধ্যাপক, কারও প্রতি আজকের বুদ্ধিমান ইতিহাস—সচেতন তরুণ ছাত্রদের, সেকালের গুরুর আশ্রমের ছাত্রদের মতো অন্ধভক্তি নেই, থাকতে পারে না। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত কী পরিমাণ আমেরিকান অর্থাশ্রিত আদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, স্বাধীনতার পরে ভারতীয় বিদ্যার্থী ও ‘স্কলার’দের আমেরিকায় যাতায়াত ও সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে লেনদেন, বিভিন্ন আমেরিকান ‘ফাউন্ডেশন’—এর গ্র্যান্ট বিতরণ ইত্যাদি বেড়েছে, সে বিষয়ে তদন্ত করলে বিস্ময়কর তথ্য উদঘাটিত হতে পারে সাংবাদিকতা ও প্রকাশনক্ষেত্রেও আমেরিকান অর্থানুকূল্য কম চমকপ্রদ নয়।
এই সমস্ত কারণে আমেরিকা—ইউরোপের মতো উন্নত এবং ভারতের মতো অনুন্নত দেশের তরুণ বিদ্রোহ—ছাত্র বিদ্রোহের মধ্যে পার্থক্য বিশেষ নেই। বর্তমান নীতিহীন আদর্শহীন সমাজের অরণ্যে জীবনের ভবিষ্যৎশূন্য ভরসাশূন্য তরুণরাই অত্যধিক লাঞ্ছিত নিগৃহীত বঞ্চিত, বিশেষ করে দরিদ্র তরুণরা কাজেই ভবিষ্যতে বিদ্রোহী তরুণশক্তির অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী। আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজে, এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার মতো অনুন্নত দেশে, যেখানে সর্বক্ষেত্রে বিদেশি ও দেশীয় ধনতন্ত্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত, সেখানে এই বিদ্রোহী তরুণশক্তি মজুর—কৃষকের বৈপ্লবিক শক্তিসংহতিকে অনেক বেশি দৃঢ় ও দুর্ভেদ্য করবে, এবং বৈপ্লবিক মার্কসবাদকে সংস্কারবাদের বিকারমুক্ত করতেও সক্ষম হবে! বস্তুত চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের (Cultural Revolution) মাধ্যমে সেখানকার বর্ধিষ্ণু কমিউনিস্ট ব্যুরোক্রাসি ও সংস্কারবাদের পরিবর্জন—পরিশোধনে তরুণদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—‘The most picturesque and startling feature of the Cultural Revolution was the part played in it by school children and students.’ (Joan Robinson)–এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সে কথা স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি।
পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো রাষ্ট্রনেতা বা পার্টি নেতা তাঁরই হাতে গড়া রাষ্ট্র ও পার্টির নৈতিক অবনতি ও আদর্শবিচারের কঠোর সমালোচনার জন্য মুক্তকণ্ঠে সর্বজনকে আহ্বান করেছেন, বিশেষ করে তরুণদের—এবং সেই আহ্বানের সাড়ায় যখন ব্যাপক বিদ্রোহ ও তীব্র সমালোচনার জোয়ার শৃঙ্খলার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে তখনও বলেছেন ‘Rebellion is justified’– ‘বিদ্রোহ সংগত’—এ দৃষ্টান্ত বিরল নয় শুধু, কল্পনাতীত। মাও—সে তুং তা—ই করেছিলেন। একসময়ে দেখা যায় তাঁর আহ্বানে দূর গ্রাম—গ্রামান্তর থেকে প্রায় বিশ লক্ষ তরুণ পিকিং শহর অভিমুখে অভিযান করে (এ দৃশ্য আমরা ঠিক কল্পনা করতেও পারব না) এবং পোস্টারে ও বিতর্কে পার্টি নেতাদের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে, কিন্তু তখনও মাও ‘বিদ্রোহ সংগত’ বলতে একটুও দ্বিধাবোধ করেননি। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবে পরিষ্কার বলা হয়েছে। ‘In such great revolutionary movement, it is hardly avoidable that they (তরুণরা) should show shortcomings of one kind or another, but their main revolutionary orientation has been correct from the beginning.’–এত বড় একটা বৈপ্লবিক ঘটনাবর্তের মধ্যে বিদ্রোহী তরুণদের পক্ষে ভুলভ্রান্তি করা স্বাভাবিক কিন্তু তাদের বৈপ্লবিক মনোভঙ্গি গোড়া থেকেই নির্ভুল ছিল। যিনি স্বচ্ছন্দে তাঁর অখণ্ড প্রতিপত্তি ও ব্যক্তিত্বের জোরে বিরুদ্ধবাদীদের ম্যাজিশিয়ানের মতো নিশ্চিহ্ন (purge) করতে পারতেন, তিনি কেন এই পন্থা অবলম্বন করলেন—‘Why did he rely on the young people to open the attack for him?’ (Robinson)। কারণ তিনি জানেন, বেশি বয়সের একটা গোঁড়ামি আছে, একটা ক্ষমতাপ্রিয়তা ও আরামকেদারীয় মনোভাব আছে, একটা সর্বজ্ঞানীর দম্ভ আছে, যা তরুণরা ছাড়া কেউ ধূলিসাৎ করতে পারবে না। পরদার অন্তরালে সোভিয়েট ইউনিয়নের ‘purge’-এর মতো তিনি যদি তাঁর ব্যক্তিত্বের জোরে বিরুদ্ধবাদীদের অপসারিত করেন, তাহলে তাঁর আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। সেই উদ্দেশ্য হল, তিনি চান যে তাঁর অবর্তমানে জনগণের পার্টির কর্তৃত্ব যাতে জনসাধারণের হাতেই থাকে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে না যায়।
তাই তরুণ বিদ্রোহ মাও স্বেচ্ছায় আহ্বান করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যিই এ এক বিচিত্র বিদ্রোহ। বিদ্রোহ যিনি প্রকাশ্যে আহ্বান করেছেন তিনি পার্টি ও তার অধীন রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক, বয়সে অত্যন্ত প্রবীণ, তৎসত্ত্বেও তরুণদের বলেছেন সেই পার্টি ও রাষ্ট্রের নির্ভীক সমালোচনা করতে। বিদ্রোহকে বলেছেন ‘justified’, এবং বিদ্রোহে সমালোচনার আতিশয্য ও ভুলভ্রান্তিকেও বলেছেন ‘hardly avoidable’। মস্কোর গোপন চক্রান্ত আর উচ্ছেদের পথ বর্জন করে পিকিং—এর এই পথ মার্কসীয় বিপ্লবের ইতিহাসে নতুন দিগদর্শন। মস্কোর পথ মধ্যযুগের মোগল বাদশাহদের প্রাসাদচক্রান্তের পথ, পিকিং—এর পথ বৈপ্লবিক জনগণের উন্মুক্ত পথ। এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য কী? ‘To the historian of the future it will appear as the first example of a new kind of class war… against the incipient new class of organization men in the Communist Party’ (Robinson)।
যন্ত্রোন্নত ধনতান্ত্রিক সমাজের ‘অর্গানাইজেশন মেন’, ম্যানেজার, ব্যুরোক্রাট এগজিকিউটিভদের নিয়ে গঠিত নতুন ‘power elite’ কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত সমাজে মার্কসীয় আদর্শের যে কী বিপর্যয় ঘটাতে পারে, সোভিয়েট ও যুগোস্লাভিয়া তার দৃষ্টান্ত। এবং এই পক্বকেশ ব্যূরোক্রাটদের জরদগবতন্ত্র (gerontocracy) যে—কোনো বৈপ্লবিক পার্টিকে যে কত দূর ভেজিটারিয়ান রিভিশনিস্ট পার্টিতে পরিণত করতে পারে, বর্তমানে ফ্রান্স, ইটালি ও আরও অনেক দেশের কমিউনিস্ট পার্টির নৈতিক বিভ্রান্তি তার প্রমাণ। এই সংকট থেকে মুক্তির পথনির্দেশ করেছেন মাও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভিতর দিয়ে। কিন্তু মাওয়ের পক্ষে যে দুঃসাহসিক বৈপ্লবিক কর্তব্য পালন করা সম্ভব হয়েছে, তা তাঁর উত্তরসূরিদের পক্ষে বহন করে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কি না এখনই বলা যায় না, ভবিষ্যতে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। তবে পার্টি ব্যুরোক্রাটদের শাসনমুক্ত থাকতে হলে এবং মার্কসীয় নীতির বিকৃতি না ঘটাতে হলে বিপ্লবী জনগণ, বিশেষ করে বিপ্লবী তরুণদের, অতন্দ্র প্রহরীর মতো সজাগ থাকতে হবে—‘The price of freedom from Party bosses is eternal vigilance’ (Robinson)—একথা ভুললে চলবে না। আমাদের ভারতবর্ষে অবতারদের ও গুরুবাদের ঐতিহ্য অত্যন্ত দৃঢ়মূল বলে, কমিউনিস্ট আন্দোলনে বৈপ্লবিক নীতিগত বিচ্ছেদ সত্ত্বেও অবতার—আর—গুরুর মোহ যে সহজে কাটছে না, তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ভারতের তরুণদের ও ছাত্রদের কমিউনিজমের এই সম্ভাব্য বিকার সম্বন্ধে সেইজন্য আরও বেশি সজাগ থাকা প্রয়োজন।
সংকটমুক্তির তৃতীয় পথ হল ভিয়েতনাম—কিউবা প্রভৃতি দেশের মুক্তিসংগ্রামের পথ—এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার শোষিত অনুন্নত দেশের জনসাধারণের মুক্তির অন্যতম পথ। এই ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক পথেরও প্রথম প্রদর্শক চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং মাও—সে তুং। রুশ বিপ্লবের শহরকেন্দ্রিক শ্রমিকনির্ভর বিপ্লবের প্রাগাদর্শ (model) যে কৃষি—কৃষকপ্রধান অনুন্নত দেশে বর্ণে বর্ণে অনুকরণীয় নয়, চীন বিপ্লব পরিচালনার কঠোর অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে মাও তা প্রমাণ করেন। পরবর্তীকালে ভিয়েতনামে হো—চি মিন, কিউবায় কাস্ট্রো ও গ্যেভারা অনেকটা এই পথের সার্থক অনুগমন করেন। এ পথ হল গ্রামকেন্দ্রিক কৃষকনির্ভর (প্রধানত) বিপ্লবী সংগ্রামের পথ, দীর্ঘ কঠোর পথ এবং সশস্ত্র গেরিলা সংগ্রামের পথ। অবিচলিত নিষ্ঠা, দীর্ঘ প্রস্তুতি, কঠোর সংগঠন, দৃঢ় আত্মবিশ্বাস এই পথের প্রধান অবলম্বন এবং গ্রামের কৃষকরা হল এই সংগ্রামের বৈপ্লবিক শক্তির অন্যতম উৎস।
এখানে একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। গ্যেয়েভারা—ফ্যানন—দেব্রে অনুসৃত বিপ্লবের পথ, নীতি ও তত্ত্বের সঙ্গে লেনিন—মাও অনুমোদিত পথ ও নীতির অনেক ক্ষেত্রে বেশ পার্থক্য আছে। অবশ্য গ্যয়েভারার কথা স্বতন্ত্র, কারণ বাস্তব ক্ষেত্রে তাঁর মতো মুক্তিযোদ্ধা ও বিপ্লবী সাম্প্রতিককালে বিরল, এবং তাঁর বৈপ্লবিক তত্ত্ব (theory) তাঁর জীবনের পরীক্ষিত সংগ্রাম অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত। কিন্তু তবু কিউবায় যেমন তিনি সফল হয়েছিলেন, সেরকম বলিভিয়া বা অন্যান্য দেশে (ল্যাটিন আমেরিকার) হয়নি। এমনকী কৃষকদের বিপ্লব বিরোধী আচরণের অভিজ্ঞতাও তিনি বলিভিয়ায় কম অর্জন করেননি। তাঁর অকালমৃত্যুর কারণও অনেকটা বলিভিয়ার বিপ্লবীদের গণসংগঠন ও গণসমর্থনের অভাব। গ্যেভারার অনেক রচনায় ও উক্তিতে বিপ্লবীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা, হঠকারিতা ও কল্পনাবিলাস সম্বন্ধে সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে, যদিও গ্যেভারা ‘সবুরে মেওয়া ফলার’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। বিপ্লবীদের ভুলচুক হবে, মধ্যে মধ্যে তাঁদের কাজকর্মে আতিশয্যও প্রকাশ পাবে, সবসময় সন্তর্পণে সাবধানে তাঁরা চলতে পারবেন না, এসব কথা যেমন মাও, তেমনি গ্যেভারাও বলেছেন। তবু বিপ্লবীদের পশ্চাদভূমি হবে সুদৃঢ় গণসংগঠন ও জনসমর্থন—সংগ্রামের পথে তা গড়ে তুলতে হবে, যাতে বিপুল গণসলিলে বিপ্লবীরা মৎস্যের মতো সঞ্চরণশীল থাকতে পারেন, এ কথা মাও যত জোর দিয়ে বলেছেন, গুয়েভারা—ফ্যানন—দেব্রে কেউ তা বলেননি। ফ্যানন সম্বন্ধে জ্যঁ—পল সার্ত্র যে বলেছেন, ‘Fanon is the first since Engels to bring the processes of history into the clear light of day’– তা মনে হয় একটু অতিশয়োক্তি। ফ্যানন নিঃসন্দেহে একালের অন্যতম বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী এবং সাম্রাজ্যবাদ—বিরোধী মুক্তিসংগ্রামীদের কাছে তাঁর রচনা আগ্নেয়াস্ত্রের মতো শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হয় যে ফ্যানন বা মার্কুসের বিপ্লবতত্ত্বে ট্রটস্কিবাদ ও নৈরাশ্যবাদের বীজ অনেক ছড়িয়ে আছে এবং তার নির্বিচার গ্রহণে ও অনুসরণে লেনিন—মাওয়ের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সম্ভাবনাও কম নেই। বিজ্ঞানোন্নত ‘অ্যাফ্লুয়েন্ট’ ধনতান্ত্রিক সমাজের স্বরূপ বিশ্লেষণে মার্কুসে অদ্বিতীয়, কিন্তু তাঁর বৈপ্লবিক পথ্য সবটুকু গ্রহণযোগ্য নয়।
নগরকেন্দ্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের আকর্ষণ মধ্যবিত্তের কাছে অত্যধিক, কারণ সেটা স্বচ্ছন্দ পেশায় পরিণত হতে পারে, তাই মার্কসীয় রাজনীতিও এতাবৎকাল নগরকেন্দ্রিক ও শ্রমিকনির্ভর হয়েছে, ভারতের মতো কৃষকপ্রধান অনুন্নত দেশেও। এবং যদি ‘the city can bourgeoisify the proletarians’ (Debray) তাহলে শহর যে মধ্যবিত্ত মার্কসিস্টদের অবস্থা কত দূর শোচনীয় করতে পারে তার দৃষ্টান্ত সব দেশেই যথেষ্ট আছে। গ্রাম্য পরিবেশ ভোগবিলাসী ‘বুর্জোয়া’কেও ‘প্রলেটারিয়ানাইজ’ করতে পারে, করার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু শহুরে পরিবেশ মজুরকে, এমনকী গ্রাম্য কৃষককেও, অল্পদিনের মধ্যে ‘আর্বানাইজ’ অর্থাৎ ‘বুর্জোয়াজিফাই’ করতে পারে, বিশেষ করে গ্যাজেটবহুল জীবনের সুখস্বর্গ আধুনিক মহানগরের পরিবেশ। কাজেই মার্কসীয় সংস্কারবাদের পরিশোধন, অনুন্নত দেশে, মহানগরে যতটা সম্ভব নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি গ্রামে সম্ভব। বিপ্লবের গতি প্রধানত গ্রামকেন্দ্র থেকে মহানগরমুখী হবে, অথবা মহানগর থেকে গ্রামমুখী হবে সেটা নির্ভর করবে বিপ্লবের স্থানকালপাত্রের উপর।
বিপ্লবের কোনো গতিধারাই অচল অটল অপরিবর্তনীয় নয়। বিপ্লবের গতি অনুযায়ী তার ধারা নগর থেকে গ্রাম—অভিমুখীও হতে পারে। সেইরকম শুধু কৃষকই যে বিপ্লবের ধারক—বাহক হবে তা নয়। শহরের সংগঠিত বিপ্লব—সচেতন মজুরশ্রেণি নিশ্চয় বিপ্লবের ধারক—বাহক হতে পারে এবং ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তা—ই হওয়াই বিজ্ঞানসম্মত। কাজেই বৈপ্লবিক সংগ্রামের পথে রোমান্টিক চোরাগলি আছে অনেক, তার মধ্যে প্রধান হল ট্রটস্কাইট (পাতিবুর্জোয়া) রোমান্টিসিজম, অসংগঠিত অতিবিপ্লববাদের কল্পনাবিলাস। বৈপ্লবিক মুক্তিসংগ্রামে এই বিপজ্জনক বিপ্লববিলাস সম্বন্ধেও সজাগ থাকা কর্তব্য।
আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজের সুখভোগের মৃগতৃষ্ণা, সুখস্বর্গ মহানগরের আকর্ষণ, নির্বিকার আত্মদাসত্ব, নিরাকার আত্মবিচ্ছিন্নতা—আধুনিক সমাজতান্ত্রিক সমাজের নব্য—মধ্যবিত্ত মার্কসীয় চিন্তাধারার সংস্কারবাদের নিশ্চিন্ততা—এবং তার সঙ্গে ধনতন্ত্র—সমাজতন্ত্র উভয় ক্ষেত্রে নিউক্লিয়ার মারণাস্ত্র ও স্পেসফ্লাইটের প্রতিযোগিতার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখলে (যখন পৃথিবীর শতকরা ৭০ জন মানুষ আজও দারিদ্র্যরেখার নিম্নস্তরভুক্ত, অর্থাৎ খেয়ে—পরে বাঁচতে পারে না।) বাস্তবিকই মনে হয় যেন সভ্যতার মুক্ত অঙ্গনে আজ মানুষ এক বিচিত্র ‘অ্যাবসার্ড ড্রামা’র অসহায় দর্শক ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু ‘অ্যাবসার্ড ড্রামা’ ছাড়াও যে জীবনমঞ্চে ও সমাজপ্রাঙ্গণে অন্য নাটকও অভিনয় করা সম্ভব—মানবমুক্তির নাটক—সেই কথাই আমরা বলতে চেয়েছি। সেই মুক্তিসংগ্রামের পথ ছাড়া মানুষের সামনে বেঁচে থাকার আর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। অন্য পথ আত্মহত্যার পথ, বিটনিক বিদ্রোহের পথ, বিচ্ছিন্নতার দ্বীপে নির্বাসিতের জীবনযাপনের পথ, নৈরাশ্যের দুর্ভেদ্য অন্ধকারে আত্মবিলোপের পথ।
১৯৬৯—৭০
ক
Regis Debray : Revolution in the Revolution? Pelican 1968.
Herbert Marcuse :
১ Eros & Civilization, Sphere 1969; ২ One Dimensional Man, Sphere, Nov. 1968.; ৩ ‘Liberation from the Affluent Society’ in The Dialectics of Liberation, edited by David Cooper, Pelican 1968.; ৪ Reason and Revolution, London Reprint 1969.; ৫ Negations–Essays in Critical Theory, London 1968. এই গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায় ‘Aggressiveness in Advanced Industrial Society’ দ্রষ্টব্য।
Frantz Fanon : The Wretched of the Earth, Penguin reprint 1969.
Che Guevara : Reminiscences of the Cuban Revolutionary War,
Pelican 1969; Guerilla Warfare, Pelican 1969.
Joan Robinson : The Cultural Revolution in China, Pelican 1969.
Andrew Sinclair : Guevara, London 1970.
David Caute : Fanon, London 1970.
John Gerassi Edited : Venceremos! The Speeches and Writings of Che Guevara (Panther 1968).
খ
Joseph Schumpeter :
১ Imperialism and Social Classes, Meridian 1955.
২ Capitalism, Socialism and Democracy, London 1943.
C. Wright Mills :
১ White Collar, N. Y. 1951. ২ The Power Elite, N.Y. 1961. ৩ The Marxists, Dell 1969.
I. L. Horowitz (ed) : The New Sociology. N.Y. 1965.
T. H. Spear : English Social Differences, London, 2nd Imp. 1956.
R. Centers : The Phychology of Social Classes P. Univ. Press 1949.
Berle & Means : The Modern Corporation and Private Property, N. Y. 1932.
Lewis & Maude : The English Middle Classes, London 1949.
Merton Gray etc. ed. : Reader in Bureaucracy, Glencoe 1952.
L. A. Coser : The Functions of Social Conflict, London 1956.
W. L. Warner : Social Class in America, Chicago 1949.
Bendix and Lipset ed. : Class, Status and Power; A Reader in Social Stratification, Glencoe 1953.
T. B. Bottomore : Classes in Modern Society, London 1955.
G. D. H. Cole : Studies in Class Structure, London 1955.
T. H. Marshall (ed.) : Class, Conflict and Social Stratification, London 1938.
Bendix and Lipset : Social Mobility in Industrial Society, London 1958.
James Burnham : The Managerial Revolution, N. Y. 1941.
P. F. Drucker : The New Society : Anatomy of the Industrial Order, N. Y. 1950
W. H. Scott : Industrial Democracy, A Revolution, Liverpool 1955.
Barbara Wootton : End Social Inequality, London 1941.
Bertrand Russel : Power; A New Social Analysis, London 1938.
J. L. Talmon : The Origins of Totalitarian Democracy, London 1952.
David Reisman : The Lonely Crowd, N. Y. 1950.
In Transactions of the Third World Congress of Sociology (vol.3, London 1956):
T. H. Marshall : ‘General Survey of Changes in Social Stratification in the Twentieth Century’.
Moris Janowitz : ‘Some Consequences of Social Mobility in the United States’.
Stanislaw Ossowski : ‘Old Nations and New Problems : Interpretation of Social Structure in Modern Society’ (vol, 8, London 1957).
P. N. Fedoseyev : ‘Laws of Social Changes in the Twentieth Century’.
V. S. Nemchinov : ‘Changes in the Class Structure of the Propulation of the Soviet Union’.
Gosta Carlsson : Social Mobility and Class Structure, Sweden 1958.
Gunnar Myrdal : Economic Theory and Underdeveloped Regions, London 1959.
David C. McClelland : The Achieving Society, Princeton 1961.
Marshal McLuhan : Understanding Media –The Extensions of Man, London 1964.
Herbert Gans : The Urban Villagers, N. Y. 1962.
H. S. Becker : Outsiders, Studies in the Sociology of Deviance, N. Y. 1963.
Edward Tiryakian : Sociologism and Existentialism, Prentice Hall 1962.
Daniel Bell : The End of Ideology, Glencoe 1960.
A. J. Yates : Frustration and Conflict, N. Y. Science edition 1966.
A. Gunder Frank : Capitalism and Under development in Latin America, N. Y. Monthly Review Press 1967.
R. Dumont : Lands Alive, M. R. Press 1965.
Pierre Jalee : The Pillage of the Third World, M. R. Press 1968.
Stanislaw Ossowski : Class Structure in the Social Consciousness, Glencoe 1963.
Ralf Dahrendorf : Class and Class Conflict in Industrial Society,
London, 2nd Impression 1961.
William H. Whyte : The Organization Man, Pelican 1960.
Vance Packard : The Status Seekers, The Waste Makers, The Hidden Persuaders, Pelican.
গ
F. Musgrove : Youth and the Social Order, London 1964.
Paul Goodman : Growing up Absurd, London 1961.
W. F Whyte : Street Corner Society, Chicago 1964.
Ferdinand Zweig : The Student in the Age of Anxiety, London 1963.
T.R. Fyvel : The Insecure offenders–Rebellious Youth in the Welfare State, London 1961.
Philips H. Coombs : The World Educational Crisis, O.U.P. (N.Y.) 1968.
Cohn-Bendit : Obsolete Communism–The Left Wing Alternative, London 1968.
Cockburn & Blackburn ed. : Student Power, Penguin Special 1969.
Seale & McConville ed. : French Revolution, 1968, Penguin Special 1969.
Priaulx & Unger ed. : The Almost Revolution France 1968, Dell 1969.
Revolt in France, May-June 1968 : A Contemporary Record Compiled from International Press and the Militant. N. Y. 1968.
১. New York, September 9, 1968 : ‘Four girls and a young man danced naked outside the United Nations Headquarters in protest against the Soviet invasion of Czechoslovakia. After burning a Soviet Flag in front of 50 onlookers last night, the protesters put their clothes on and walked away– (Reuter). সোভিয়েট সামরিক অভিযানের বছরপূর্তি উপলক্ষে চেক—জনসাধারণ ও তরুণরা সর্বত্র সোভিয়েট—বিরোধী বিক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করে শোভাযাত্রা করে। ব্রেজনেভ—নীতির বিরোধী মস্কোর ১৬ জন বুদ্ধিজীবী এই উপলক্ষে চেকবাসীদের জানান : ‘We declare our solidarity with the people of Czechoslovakia, who wished to prove that socialism with a human aspect is possible.’ (Moscow, August 21, 1969–Reuter)–Italics লেখকের।
২. Mass democracy provides the political paraphernalia of effectuating this introjection of the Reality Principle… it also allows the masters to disappear behind the technological veil of the productive and destructive apparatus which they control, and it conceals the human (and material) costs of the benefits which it bestows upon those who collaborate. – Herbert Marcuse : Eros and Civilisation, Political Preface, 1966 (England 1969)
৩. …the capitalist development has altered the structure and function of these two classes in such a way that they no longer appear to be agents or historical transformation.– H. Marcuse : One dimensional Man : Ideology of Insdustrial Society. (London, 1968), p. 11.
৪. Daniel Cohn-Bendit and Gabriel Cohn-Bendit : Obsolete Communism The Left-Wing Alternative, London, 1968, pp 35-40.
৫. এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলিতে (যেমন ভারতে) আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানের বই সুলভ মূল্যে প্রকাশ ও বিতরণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তা ছাড়া গত কুড়ি বছর ধরে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানীরাই প্রধানত ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানীদের গুরুগিরি করেছেন। যেমন সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, তেমনি ইতিহাস, অর্থনীতি ও নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে।
৬. C. Wright Mills তাঁর White Collar গ্রন্থে The Managerial Demiurge অধ্যায়ে, The Power Elite গ্রন্থে The Chief Executives, The Corporate Rich ও The Power Elite অধ্যায়ে William H. Whyte তাঁর The Organization Man গ্রন্থে এই মূলধনের গোত্রান্তরজনিত সামাজিক শ্রেণিচিত্রের পরিবর্তন সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রসঙ্গত J.K. Galbraith-এর The Affluent Society দ্রষ্টব্য।
৭. এটি Herbert Marcuse-এর One Dimensional Man গ্রন্থের উদ্বোধন লাইন, unfreedom কথাটির উপর জোর দিয়েছি আমি।
৮. মার্কসীয় ‘alienation’ সম্বন্ধে ‘পরিশিষ্ট’ দ্রষ্টব্য।
* ফরাসি মনীষী Francois Perroux-এর ভাষায়, ‘Slavery is determined neither by obedience nor by hardness of labour but by the status of being a mere instrument, and the reduction of man to the state of a thing.’
(Marcuse 2, p. 41)
৯. Daniel Bell এ বিষয়ে তাঁর The End of Ideology (Glencoe, 1960) আলোচনা করেছেন।
১০. Eli Chinoy : Automobile and The American Dream (N.Y. 1955) দ্রষ্টব্য। এরকম কারখানাকেন্দ্রিক অনুসন্ধান আরও অনেক হয়েছে।
১১. Colin Golby : Eroticism in Modern Advertising (Penguin Survey of Business and Industry, 1965).
Vance Packard : The Hidden Persuaders, Pelican 1962.
১২. এই গ্রন্থের ‘বিজ্ঞাপন ও মন’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।
১৩. ‘…the nuclear bomb does not adhere to the class principle’– Open letter of the CC of CPSU, 14th July 1963, ‘…atomic weapons have changed the very nature of war.’–Togliatti, L’Unita, 22 January 1962. এই ধরনের আরও অনেক উদ্ধৃতি দেওয়া যায়, কিন্তু তার প্রয়োজন নেই। শ্রীসমর সেন সম্পাদিত Frontier পত্রিকায় Monitor লিখিত ‘On Marx’ প্রবন্ধ (১.৬.৬৮—২৯.৬.৬৮) দ্রষ্টব্য। গ্রন্থের শেষে ‘পরিশিষ্ট’ দ্রষ্টব্য।
১৪. Paul M Sweezy, Leo Huberman : ‘Lessons of Soviet Experience’, Monthly Review, November 1967; Sweezy.
‘Peaceful Transition from Socialism to Capitalism’ (যুগোস্লাভিয়া সম্বন্ধে)ৃ Monthly Review, 1964; Sweezy; ‘Czechoslovakia; Capitalism and Socialism’, Monthly Review, October 1968, Charles Beltelheim : ‘On the Transition between Capitalism and Socialism’, Monthly Review, March 1969 and Sweezy’s Reply. এ বিষয়ে মূল্যবান বই হল E. Prearbrazhensky-র The New Economics, Oxford Univ. Press 1965.
১৫. J. Stalin : Economic Problems of Socialism in the U.S.S.R., Moscow 1952
১৬. Stanislaw Ossowski : Class Structure in the Social Consciousness (translated by Shella Patterson), Glencoe 1962, পৃঃ ১১৪—১৫ এবং পাদটীকা।
১৭. Ralf Dahrendorf : Class and Class Conflict in Industrial Society, London, 2nd Impression, 1961. এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়; ‘Karl Marx’s Model of the Class Society.’ দ্বিতীয় অধ্যায় ‘Changes in the Structure of Industrial Society Since Marx’ এবং তৃতীয় অধ্যায় ‘Some Recent Theories of Class Conflict’ এই প্রসঙ্গে পঠিতব্য। এ ছাড়া Transactions of the Third World Congress of Sociology- র (1956) মধ্যে সোভিয়েট সমাজবিজ্ঞানীদের papers এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। গ্রন্থপঞ্জি দ্রষ্টব্য।
* সংস্কারবাদ (Revisionism) প্রসঙ্গে গ্রন্থের শেষে ‘পরিশিষ্ট ১৯৭৭’ দ্রষ্টব্য।
১৮. Frantz Fanon : The Wretched of the Earth, Penguin 1969, ‘Preface’ by Jean-Paul Sartre : The European elite undertook to manufacture a native elite. The picked out promising adolescents; they branded them as with a red-hot iron, with the principles of western culture; they stuffed their mouths full with high-sounding phrases… These walking lies had nothing left to say to their brothers; they only echoed.
১৯. We find in them the manners and forms of thought picked up during their association with the colonialist bourgeosie. Spolit children of yesterday’s colonialism and of today’s national goverments, they organise the loot of whatever national resources exist. Fanon, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৩৭।
২০. Prevention of Suicide : World Health Organisation, UNO 1969.
* এই গ্রন্থে ‘হিপি—বিটনিক—বিদ্রোহ’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।
২১. Cohn-Bendit পূর্বগ্রন্থ, পৃঃ ৯১—১০৩, ১৪৭—৬৮।
২২. Frantz Fanon : পূর্বগ্রন্থ Preface। ফ্যাননের গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় ‘Concerning Violence’ দ্রষ্টব্য। অবশ্য ফ্যাননের ‘violence’-এর পক্ষে যুক্তির মধ্যে বেশ উচ্চগ্রামে নৈরাজ্যবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছে, এবং আলজিরিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশে যে যুক্তি অনেকটা প্রযোজ্য, তা সকল দেশের সামাজিক অবস্থায় অবশ্যই প্রযোজ্য নয়। ফ্যানন যতটা মার্কসবাদী বিপ্লবী নন, তার চেয়ে অনেক বেশি অন্ধ ভাবপ্রবণ সাম্রাজ্যবাদ—বিরোধী। গ্রন্থের শেষে ফ্যানন প্রসঙ্গে ‘পরিশিষ্ট ১৯৭৭’ দ্রষ্টব্য।
২৩. The mediocrity of university teaching is no accident, but reflects the life-style of a civilization in which culture itself has become a marketable commodity and in which the absence of all critical faculties is the safest guarantee of ‘profitable specialisation of university studies.’ The only way to oppose this type of stupidity is to attack all those academic restrictions whose only justification is that they exist… Cohn-Bendit. পূর্বগ্রন্থ, পৃঃ ৩৫।
* এ বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ সংক্ষিপ্ত বিবরণের জন্য Satish Saverwal লিখিত ‘International Social Science : Some Political Aspects’ প্রবন্ধ (Economic and Political Weekly : July 4, 1970) দ্রষ্টব্য।
বিনয় ঘোষ : বাংলার বিদ্বৎসমাজ (দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৭৭)। এই গ্রন্থের ‘বিদ্যা বিদ্বান বিদ্যালয় বিদ্যার্থী—বিদ্রোহ’ প্রবন্ধ (শারদীয় ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় ১৯৭১—এ প্রকাশিত) দ্রষ্টব্য।
২৪. Large numbers of revolutionary young people, previously unknown, have become courageous and daring path-breakers. They are vigorious in action and intelligent– Decision of the C.C. of C. C. P. concerning the Great Proletarian Cultural Revolution, 8 August 1966.
২৫. …If Mao had cleared out the Rightists and attached the Pary more firmly than ever to himself, he would have created the very situation that he was most anxious to avoid– a personal struggle for the succession, such as followed the death of Lenin and the death of Stalin. He wanted the Robinson, The Cultural Revolution in China, Pelican 1969, পৃঃ ২৬।
কিন্তু মাওয়ের মৃত্যুর পরে চীনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের চেহারা দেখে সন্দেহ হচ্ছে যে তাঁর ইচ্ছা—‘succession to go to the people’–সার্থক হবে কি না (১৯৭৭)।
২৬. Miloyan Djilas : The New Class : An Analysis of the Communist System, N.Y. 1957.
Cohn-Bendit : Obsolete Communism. Andre Deutsch 1968 : এই গ্রন্থের ‘The Nature of Communist Bureaucracy’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য, পৃঃ ১৭০—৯৫।
* In the colonial countries the peasant alone are revolutionary, for they have nothing to lose and everything to gain. (Fanon ১, পৃঃ ৪৭)
উপনিবেশে ‘কেবল কৃষকশ্রেণি বিপ্লবী’—ফ্যাননের এই উক্তি মার্কস—লেনিন—মাওবাদসম্মত নয়। আফ্রিকার কোনো কোনো উপনিবেশে এ কথা সত্য হলেও, সকল উপনিবেশ বা আধা—উপনিবেশের ক্ষেত্রে অবশ্যই সত্য নয়।
* গ্রন্থের শেষে ‘পরিশিষ্ট ১৯৭৭’ দ্রষ্টব্য।