বিপ্লব ও বুদ্ধিজীবী

বিপ্লব ও বুদ্ধিজীবী

বুদ্ধিজীবীরা কত দূর পর্যন্ত বিপ্লবী হতে পারেন, বই পড়ে অথবা চিন্তা করে অথবা প্রকৃত লাঞ্ছিত—শোষিতদের গণবিপ্লবের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে, ফ্যানন ও মার্কুসের বক্তব্য প্রসঙ্গে এই গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধে সে কথা বলেছি, বিশেষ করে ‘বিপ্লব মহানগর মধ্যবিত্ত এবং মার্কসবাদ’ অধ্যায়টিতে (১৪৩—১৭২ পৃষ্ঠা : অধ্যায়ের নামটি অবশ্য পৃষ্ঠাশীর্ষে ‘বিপ্লব মহানগর মধ্যবিত্ত মার্কসীয় চিন্তাধারা’ ছাপা হয়েছে)। ‘সংস্কারবাদ’ (Revisionism) প্রসঙ্গেও দু—চার কথা বলেছি (১৬৩ পৃষ্ঠার পাদটীকা), যদিও তার ইতিহাস আলোচনা করিনি, কারণ ‘Revisionism’ এই গ্রন্থের কোনো বিষয় প্রসঙ্গেই আমার প্রধান আলোচ্য নয়। তবু এ বিষয়ে অতিসংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলব, বিশেষ করে সংস্কারবাদের উৎপত্তি প্রসঙ্গে। বিচ্ছিন্নতাবোধ বা alienation সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সম্ভব হল না, কারণ তার জন্য পৃথক একটি বই লেখা যেতে পারে। তবে এ বিষয়ে ইদানীং, গত কয়েক বছরের মধ্যে, মার্কসবাদী ও সাধারণ সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে একাধিক আলোচনাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, উৎসুক পাঠকরা সেগুলি পড়তে পারেন। ফ্যানন ও মার্কুসের ‘বৈপ্লবিক’ চিন্তাধারা সম্বন্ধে আরও দু—চার কথা এখানে বলব, অবশ্য খুবই সংক্ষেপে।

শোধনবাদ (Revisionism)

‘রিভিশনিজম’ বা শোধনবাদের উৎস সন্ধান করতে হলে এঙ্গেলসের একটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক রচনার কথা উল্লেখ করতে হয়। এ কথা শুনে অনেকেই বিস্মিত হবেন এবং হয়তো প্রশ্ন করবেন, তাহলে এঙ্গেলসকেই কি শোধনবাদের ‘গুরু’ বলতে হবে? যদিও এঙ্গেলস সহযোগী ছিলেন মার্কসের এবং তাঁর পাণ্ডিত্য ও বিপ্লবচেতনা, ইতিহাসচেতনা তো বটেই, অসাধারণ, তাহলেও ঐতিহাসিক সত্যের খাতিরে তাঁকে শোধনবাদের গুরু বললে ভুল হয় না।

মার্কসের The Class Struggle in France গ্রন্থের ‘প্রথম পুনর্মুদ্রণ’ হয় ১৮৯৫ সালের মার্চ মাসে, এঙ্গেলসের মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগে। এই সংস্করণের জন্য একটি ‘ভূমিকা’ লেখেন এঙ্গেলস এবং এই ভূমিকাটি শোধনবাদের উৎপত্তির ইতিহাসের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকাতে এঙ্গেলস বলেন যে ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের সময় মার্কস এবং তিনি একটি বড় রকমের ভুল করেছিলেন। সেই ভুলটি হল, তাঁরা ভেবেছিলেন যে ইউরোপের সামাজিক অবস্থা বিপ্লবের অনুকূল। কিন্তু তাঁরা তদানীন্তন ইউরোপের সামাজিক অবস্থার যথাযথ বিশ্লেষণ করতে পারেননি। ভূমিকাতে এঙ্গেলস এ কথাও লেখেন যে ইতিহাসে অতীতে যত বিপ্লব হয়েছে সেগুলি মূলত ‘minority revolutions’ এবং ‘all ruling classes up to now have been only small minorities in relation to the ruled mass of the people.’ কিন্তু ইতিহাস আজ প্রমাণ করেছে যে ‘conscious minorities’ যেভাবে বিশাল ‘unconscious masses’—এর নেতা হয়ে ‘বিপ্লব’ করেছে, আধুনিক যুগে ‘প্রলেটারিয়ান বিপ্লব’ সেভাবে সম্ভব নয়। এঙ্গেলস বলেন, ‘the mode of struggle of 1848 is today obsolete in every respect’ এবং পুরাতন সংগ্রাম—পদ্ধতির পরিবর্তন প্রয়োজন। তার জন্য বিপুল সংখ্যায় জনসাধারণকে বৈপ্লবিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে হবে। তা যদি করতে হয় তাহলে তাদের এ বিষয়ে সচেতন করার একটা দায়িত্ব থাকে এবং তার জন্য ধৈর্য ধরে ‘long persistent work is required.’

দীর্ঘকাল ধৈর্য ধরে এই কাজ কীভাবে করা যেতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে এঙ্গেলস তাঁর ভূমিকায় লিখেছেন যে ‘slow propaganda work and parliamentary activity’ হল সেই কর্মনীতি। এই কর্মনীতি শুধু জার্মানির নয়, ফ্রান্স ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের পার্টির প্রধান নীতি হিসেবে গ্রহণ করা কর্তব্য। জার্মানির ‘সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি’ এই নীতি অনুসরণ করে অন্যান্য পার্টির পথপ্রদর্শকের কাজ করেছে। তারপর এঙ্গেলস ‘ভোট’ (vote) সম্বন্ধে লিখেছেন : ‘The two million voters whom it (জার্মানি) sends to the ballot box, together with the young men and women who stand behind them as non-voters, form the most numerous, most compact mass, the decisive “shock force” of the international proletarian army.’ যদি এই সংসদীয় পন্থা অনুসরণ করা যায় তাহলে, এঙ্গেলস লিখেছেন : ‘by the end of the century (উনিশ শতক) we shall conquer the greater part of the middle strata of society, petty bourgeois and small peasants, and grow into the decisive power in the land, before which all other power wil have to bow, whether they like it or not.’ এই ‘ভোট’ পূর্বে প্রতারণার কৌশল মাত্র ছিল, কিন্তু জার্মানির শ্রমিকশ্রেণি তাকে ‘means of deception’ থেকে একটি শক্তিশালী ‘instrument of emancipation’—এ পরিণত করেছে।

অবশেষে এঙ্গেলস বৈধ ও অবৈধ সংগ্রাম, প্রকাশ্য ও গোপন সংগ্রাম সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন:

The irony of world history turns everything upside down. We the ‘revolutionarists’ the ‘overthrowers’, we are thriving far better on legal methods than an illegal methods and overthrow. They cry despairingly… legality is the death for us; whereas we, under this legality get firm muscles and rosy checks and look like life eternal.

এঙ্গেলসের এই ঐতিহাসিক ‘ভূমিকা’ ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয়। ‘ঐতিহাসিক’ এইজন্য বলছি যে এই ভূমিকা থেকে শোধনবাদের প্রবক্তা বার্নস্টাইন (Bernstein), কাউটস্কি (Kautsky) এঁরা মার্কসবাদকে শোধন ও সংস্কার করার প্রত্যক্ষ প্রেরণা পান। ভূমিকাটি প্রকাশিত হবার কয়েক মাসের মধ্যে যদি এঙ্গেলস মারা না যেতেন এবং বার্নস্টাইন—এর উপর তাঁর লেখার প্রতিক্রিয়া তিনি লক্ষ করতেন, তাহলে কী হত, তিনি তাঁর নিজের বক্তব্য বাস্তব অবস্থাগতিকে পরিবর্তন করতেন কি না, এসব নিয়ে জল্পনাকল্পনা করা অর্থহীন। আসলে যা ঘটেছে সেইটাই বিচার্য। এঙ্গেলসের মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই বার্নস্টাইন Die Neue Zeit পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে সমাজতন্ত্রের সমস্যা সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। এই প্রবন্ধগুলি কিছুটা সংশোধন করে তিনি ১৮৯৯ সালে The Premises of Socialism and the Tasks of Social Democracy নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন (ইংরেজি বইয়ের নাম Evolutionary Socialism)। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৮৩৩ সাল থেকে এঙ্গেলসের ধারণা হয় যে বার্নস্টাইন বা কাউটস্কি মার্কসবাদী চিন্তার প্রকৃত উত্তরাধিকারী হবেন এবং এই চিন্তার বশবর্তী হয়ে তিনি, ১৮৯৫ সালে মৃত্যুর আগে, বার্নস্টাইনকে মার্কস ও তাঁর নিজের ‘literary legacy’—র ‘executor’ করে যান। তার ফলে বার্নস্টাইনের পক্ষে নব্যমার্কসীয় চিন্তাধারার, অর্থাৎ শোধনবাদের, প্রবর্তক হওয়া খুবই সহজ হয়। কাজেই শোধনবাদ বা Revisionism—এর বয়স, আজ থেকে সাত—আট বছর পরে (১৯৮৪—৮৫ সাল), একশো বছর পূর্ণ হবে। এই একশো বছরের মধ্যে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দেশ, এবং মার্কসের প্রকৃত উত্তরাধিকারী লেনিনের দেশ সোভিয়েট ইউনিয়নকেও শোধনবাদ গ্রাস করে ফেলেছে, পৃথিবীর অন্যান্য আরও অনেক দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকেও করেছে।

বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation)

বিচ্ছিন্নতাবোধ সম্বন্ধে একজন সমাজবিজ্ঞানী, গভীর তত্ত্বকথার মধ্যে না গিয়ে, সংক্ষেপে সহজ কথায় যা বলেছেন তা এখানে উদ্ধৃত করছি। পাঠকদের কাছে এই উক্তি সহজবোধ্য হবে :

People ‘involved’ with and subjugated by social machines tend to have a sense of personal disassociation from human groups and their society. They tend to feel disaffiliated and apart. In brief, they have a sense of alienation.

People in modern industrial societies have rapidly become detached from nature, from their old gods, from the technology that has transformed their environment and now threatens to destroy it. Work and its product are no longer meaningful or fulfilling. In the social machines of a technocratic society, people are alienated and are adrift in a world that has little meaning for them and over which they exercise limited power. They become strangers to themselves and to others.

মার্কুসে । ফ্যানন

মার্কুসে ও ফ্যাননের ‘বৈপ্লবিক তত্ত্ব’ সম্বন্ধে Jack Woddis তাঁর New Theories of Revolution গ্রন্থে আলোচনা করেছেন (পরিশিষ্ট ১৯৭৪ দ্রষ্টব্য)। মার্কুসের সঙ্গে মার্কসীয় চিন্তাধারার পার্থক্য প্রসঙ্গে অন্যান্য যাঁরা আলোচনা করেছেন তাঁদের কথাও আগে উল্লেখ করেছি। Lucio Colletti মার্কুসে সম্বন্ধে বলেছেন :

The consequence of Marcuse’s argument is an indiscriminate indictment of science and technology, or, to use Marcuse’s expression, of ‘industrial society’… The book (One-Dimensional Man) is brilliant, it contains a series of minute and honest observations. But when the substance is examined, it is easy to see that it is not an indictment of capital, but of technology… Taken to its extreme, Marcuse’s approach leads to the cult of primitivism and barbarism which the abstract spiritualism of the bourgeois intellectual so easily turns into. His perspective… is one of Luddism…

মার্কুসের এই চমকপ্রদ ‘লাডাইট’ চিন্তার ফাঁদে অনেক সময় মার্কসবাদীরাও অজান্তে আটকে পড়েন। লেখক নিজেও যে তা—ই পড়েছেন মধ্যে মধ্যে, এই বইয়ের একাধিক লেখা পড়তে পড়তে পাঠকদের তা মনে হবে।

……..

১. এঙ্গেল্স লিখিত ‘ভূমিকা’র উদ্ধৃতিগুলি (ইংরেজি) এই গ্রন্থ থেকে গৃহীত : Marx and Engels, Selected Works (one volume), London 1968, pp. 651-68.

২. শোধনবাদ সম্বন্ধে সুন্দর আলোচনা করেছেন Lucio Colletti, তাঁর From Rousseau to Lenin : Studies in Ideology and Society গ্রন্থে (New Left Books, London 1872); ‘Bernstein and the Marxism of the Second International’ অধ্যায়, পৃষ্ঠা ৪৫—১০৮দ্রষ্টব্য)।

৩. Lewis Yablonsky : Robopaths : People as Machines (Pelican 1973), পৃষ্ঠা ৭৭।

৪. Lucio Colletti-র পূর্বোক্ত গ্রন্থের ‘From Hegel to Marcuse’-অধ্যায় পৃষ্ঠা ১১০—৪০ দ্রষ্টব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *