বিপ্লবী তত্ত্বের সমস্যা

বিপ্লবী তত্ত্বের সমস্যা 

১৯৪৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একের পর এক যে বিপর্যয়ের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তার মূল কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রথমেই তা করা দরকার তত্ত্বের ক্ষেত্রে। এই বিশ্লেষণের দুটি নির্দিষ্ট দিক আছে। প্রথমটি তত্ত্ব নির্মাণের প্রক্রিয়া এবং দ্বিতীয়টি নির্মিত তত্ত্বের সঠিকতা। একথা বলাই বাহুল্য যে, প্রথমটির ওপরই দ্বিতীয়টি সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। 

মার্কসবাদী বিপ্লবী তত্ত্ব কোন কল্পনাপ্রসূত ভাববাদী ব্যাপার নয়। সামাজিক বিকাশের নিয়ম, সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর বিন্যাস ও অবস্থান, বিভিন্ন সামাজিক শক্তির দ্বন্দ্ব ইত্যাদির বাস্তব বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণের মাধ্যমেই মার্কস-এঙ্গেলস আবিষ্কার করেছিলেন মার্কসবাদের মূল সূত্রসমূহ। যে কোন দেশে বিশেষ ও নির্দিষ্ট কতকগুলি অবস্থায় প্রয়োজনীয় বিপ্লবী তত্ত্ব নির্মাণও সেই একই ধরনের বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ ব্যতীত সম্ভব নয়। এ জন্যেই পদ্ধতিগত প্রশ্ন এক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। 

কর্ম (practice) ও তত্ত্বের (theory) মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সব সময় বিরাজ করে। কর্মই এই দ্বন্দ্বের প্রধান দিক (aspect)। অর্থাৎ কর্মই এক্ষেত্রে মূল নির্ধারক। সে জন্যেই পূর্ববর্তী দর্শনচর্চার ইতিহাস প্রসঙ্গে মার্কস বলেছেন, ‘এ পর্যন্ত দার্শনিকেরা শুধু জগৎকে ব্যাখ্যাই করেছেন, কিন্তু আসল কাজ হলো তাকে পরিবর্তন করা। তত্ত্ব তাই মার্কসবাদীদের কাছে, কোন বিলাসের বস্তু নয়, তা হলো বাস্তব জীবনকে পরিবর্তন ও পরিচালনার এক অপরিহার্য হাতিয়ার। 

কর্ম-তত্ত্বের দ্বন্দ্বক্ষেত্রে কর্মই প্রধান একথা যেমন সাধারণভাবে সত্য তেমনি এ কথাও আবার সত্য যে, বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক অবস্থায় তত্ত্বই হয়ে দাঁড়ায় এই দ্বন্দ্বের প্রধান দিক। এটা ঘটে তখনই যখন সঠিক তত্ত্বের অভাবে কর্ম অসম্ভব হয়ে পড়ে অথবা বিপথগামী হয়। এই ধরনের পরিস্থিতি প্রসঙ্গেই লেনিন বলেছেন, ‘বিপ্লবী তত্ত্ব ব্যতীত কোন বিপ্লবী আন্দোলন হতে পারে না’। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টিও তার পরিচালনায় বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে লেনিনের এই সুবিখ্যাত উক্তি বিশেষভাবেই প্রাসঙ্গিক ও প্রণিধানযোগ্য। আমাদের দেশে হাজার হাজার সৎ বিপ্লবী কর্মীর জীবন দান এবং লক্ষ লক্ষ বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিদের নিঃস্বার্থ কর্ম যে আজ পর্যন্ত একটি সঠিক ঐক্যবদ্ধ ও জনগণের আস্থাভাজন কমিউনিস্ট পার্টি সৃষ্টি করে বিপ্লবী সংগ্রামকে ব্যাপকতা ও গভীরতা দান করতে ব্যর্থ হয়েছে তার কারণ বিপ্লবী সংগ্রাম এ পর্যন্ত আমাদের দেশের উপযোগী সঠিক বিপ্লবী তত্ত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত না হয়ে তা পরিচালিত হয়েছে একের পর এক কতকগুলি বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়া হাতুড়ে তত্ত্বের ভিত্তিতে। মার্কসবাদী বিপ্লবী তত্ত্বের নামে হাতুড়েপনার নিদর্শন এই সমস্ত তাত্ত্বিক সূত্রায়ন দেশের বাস্তব পরিস্থিতি, সামাজিক বিকাশের পর্যায়, সামাজিক দ্বন্দ্বসমূহের অবস্থান, বৈদেশিক শক্তিসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও স্বার্থের সংঘাত, জনগণের চেতনার মান ইত্যাদির সাথে যথার্থ পরিচিতি ও সেগুলির দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী বিশ্লেষণের মাধ্যমে হয়নি। কতকগুলি ভাববাদী ও আত্মমুখী (subjective) পূর্ব নির্ধারিত চিন্তার (assumption) দ্বারাই এই সমস্ত তত্ত্ব একের পর এক নির্মিত হয়েছে এবং এইভাবে নির্মিত তত্ত্বের যা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি তাই ঘটেছে। সঠিক বিপ্লবী তত্ত্বের অবর্তমানে এদেশের বিপ্লবী আন্দোলনে চূড়ান্ত অথবা প্রকৃত কোন সাফল্য আসেনি। মাঝে মাঝে অতি সাময়িক সাফল্য সত্ত্বেও একের পর এক এসেছে বিপর্যয় ও ব্যর্থতা। ভ্রান্ত তত্ত্বের প্রভাবে শুধু যে বিপ্লবী আন্দোলনের কোন অগ্রগতি ও সাফল্যই আসেনি তাই নয়, তার ধাক্কায় কমিউনিস্ট পার্টি ও হয়েছে দিকভ্রান্ত, বহুধাবিভক্ত এবং দেশের সামগ্রিক রাজনীতি ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে প্রভাবহীন 

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মূল সূত্রগুলিকে বোঝা এবং আয়ত্ত করার ব্যাপারে অপরিসীম ব্যর্থতা, বাস্তব পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে গিয়ে সেগুলিকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে না পারা এবং সাধারণভাবে মার্কসবাদ-লেলিনবাদ ও মাও সেতুঙ চিন্তাধারার অনুশীলনে অক্ষমতা এতো দীর্ঘকাল ধরে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে কেন ঘটেছে তার মূল কারণটি অনুসন্ধান ও উদঘাটন ব্যতীত তত্ত্বক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য আজ বিরাজ করছে তার অবসান ঘটানো সম্ভব নয়। 

এই কারণ অনুসন্ধান ও উদ্ঘাটন করতে গেলে কীভাবে অগ্রসর হওয়া দরকার? এ ক্ষেত্রেও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকেই আমাদের অবলম্বন করতে হবে। কারণ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ একটি সার্বজনীন তত্ত্ব ও পদ্ধতি এবং সেই হিসাবে তার প্রয়োগক্ষেত্রও সর্বব্যাপক। 

কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব পার্টি। কাজেই তার মধ্যে অন্যান্য শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব অথবা স্বার্থের সমন্বয় ঘটতে পারে না। একথা যেমন সত্য, তেমনি অন্যদিকে এ কথাও সত্য যে, অন্যান্য শ্রেণী উদ্ভূত ব্যক্তিরাও অনেকে মার্কসবাদে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নিজেদের শ্রেণী পরিত্যাগ করে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করে থাকেন। এঁরা শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতি আনুগত্য সম্পন্ন এবং নিজেদের শ্রেণীর বিরুদ্ধাচরণে প্রস্তুত ও নিযুক্ত থাকলেও নিজেদের শ্রেণী চরিত্রকে সম্পূর্ণভাবে উত্তীর্ণ হওয়া এবং শ্রেণী অভ্যাস ও আচরণকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা তাঁদের সকলের দ্বারা সম্ভব হয় না। অনেকে সে ক্ষেত্রে সফল হলেও তার জন্যে তাঁদের প্রয়োজন হয় নিরলস সংগ্রাম, কঠিন সতর্কতা ও কঠোর আত্মসমালোচনা। 

এতো গেলো অপরাপর শ্রেণী থেকে আগত ব্যক্তিদের কথা। এ ছাড়া একটি সামন্ত বুর্জোয়া শাসিত সমাজে যে শ্রমিক শ্রেণী থাকে তাঁরাও সামন্ত বুর্জোয়া ভাবধারা, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদির প্রভাবে কিছুটা আচ্ছন্ন থাকে। এই প্রভাবও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে প্রতিফলিত হয়, তাকে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যেও প্রয়োজন হয় বিপ্লবী সংগ্রাম, সতর্কতা ও আত্মসমালোচনার সেই একই প্রক্রিয়া। 

প্রত্যেক দেশেই সামন্ত ও বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত বিপ্লবীদের একটা নির্দিষ্ট এবং প্রাথমিক ঐতিহাসিক ভূমিকা থাকে, যে ভূমিকা ব্যতীত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত ও কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম সম্ভব হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও শ্রমিক শ্রেণীর পার্টিতে এই সমস্ত বহিরাগত ব্যক্তিদের দ্বারা আমদানীকৃত চেতনা, ভাবধারা, ধ্যান- ধারণা, অভ্যাস ও আচরণের সাথে প্রকৃত মার্কসবাদী চেতনা, ধ্যান-ধারণা, অভ্যাস ও আচরণের একটা দ্বন্দ্ব প্রত্যেক দেশের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেই আনিবার্যভাবে সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বের ফলে পার্টির মধ্যেই শ্রমিক শ্রেণী এবং সামন্ত বুর্জোয়া পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণীগুলির দ্বারা সৃষ্ট চেতনা, ভাবধারা, ধ্যান-ধারণা, অভ্যাস ও আচরণের একটা সংঘর্ষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা দেয়। এই শ্রেণী সংঘর্ষই আন্তঃপার্টি সংগ্রামের মূল ভিত্তি। 

সঠিক সাংগঠনিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি ঐক্যবদ্ধ পার্টির মধ্যে এই আন্তঃপার্টি সংগ্রাম পার্টিকে দুর্বল করে না। উপরন্তু অন্য শ্রেণীর চেতনা, ভাবধারা অভ্যাস আচরণকে উচ্ছেদ করে পার্টিকে তত্ত্বগত এবং সাংগঠনিক দিক দিয়ে অধিকতর সমৃদ্ধিশালী ও শক্তিশালী করে এবং তার দ্বারা বিপ্লবী সংগ্রামের অগ্রগতি সাধিত হয়। লেনিন ও ষ্ট্যালিনের নেতৃত্বাধীন রুশ পার্টি, চীনের পার্টি, ভিয়েত্নামের পার্টি প্রভৃতি বিপ্লবী পার্টিগুলিতে আন্তঃপার্টি সংগ্রামের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণী বহির্ভূত চেতনা, ভাবধারা, ধ্যান-ধারণা, অভ্যাস আচরণ ক্রমশঃ পরাজিত ও নিশ্চিহ্ন হয়েছে এবং তাঁদের নেতৃত্বে সঠিক মার্কসবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালিত ও জয়যুক্ত হয়েছে। 

কিন্তু চীনের পার্টির সমসাময়িককালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলেও ভারত এবং পরবর্তীকালে পূর্ব বাঙলার ইতিহাসে এই আন্তঃপার্টি সংগ্রামের পরিণতি হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানকার আন্তঃপার্টি সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণীর পরিবর্তে বারবার অপরাপর শ্রেণীই অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী হয়েছে ও তাঁদের শ্রেণীগত চেতনা, ভাবধারা, ধ্যান-ধারণা ও অভ্যাস আচরণ প্রাধান্যে এসে তত্ত্বক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে নৈরাজ্য এবং বাস্তব কর্মক্ষেত্রে ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে বিভ্রান্তি, বিভেদ ও অনৈক্য। 

ভারত ও পূর্ব বাঙলায় (বর্তমানে বাঙলাদেশে) কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণী ও তার মতাদর্শ মার্কসবাদের পরিবর্তে সামন্ত বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর মতাদর্শ বারবার প্রাধান্যে এলো কিভাবে? এটা এক মহা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং এই প্রশ্নের মীমাংসা ব্যতীত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রগতির, কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐক্যের এবং বিপ্লবী সংগ্রামের সাফল্যের কোন সম্ভাবনা নেই। 

বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে কতকগুলি মৌলিক বিষয়ে মিল এবং সাদৃশ্য থাকলেও প্রত্যেক দেশের পার্টিরই নিজস্ব কতকগুলি বৈশিষ্ট্য থাকে। ভারতের পার্টি, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পার্টি এবং বর্তমানে বাংলাদেশে পার্টিসমূহ এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম নয়। 

বৃটিশ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪৭ সালে বিভক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিলো এবং সেই পার্টি পরবর্তীকালে বহুধাবিভক্ত হয়ে বর্তমান বাঙলাদেশে একাধিক কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট গ্রুপের জন্ম দান করেছে। এজন্যে ভারতীয় পার্টির কতকগুলি মূল বৈশিষ্ট্য আমাদের দেশের বহুধাবিভক্ত কমিউনিস্ট আন্দোলন ও পার্টিগুলিরও বৈশিষ্ট্য। 

এই বৈশিষ্ট্যের চরিত্রকে ভালভাবে অনুধাবনের জন্য প্রয়োজন সমগ্র ভারত-পাকিস্তান- বাংলাদেশ উপমহাদেশের (এই অঞ্চলকে এর পর থেকে এই প্রবন্ধে শুধু দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশ বলে উল্লেখ করা হবে) কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐতিহাসিক মূলকে উদঘাটন ও বিশ্লেষণ করা। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ও সামাজিক ভিত্তিভূমির সাথে রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যসমূহ আমরা নির্দেশ করতে সক্ষম হবো। 

দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো এই যে শ্রমিক আন্দোলন অথবা কৃষক আন্দোলন থেকে তার জন্ম হয়নি, হয়েছে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন থেকে। এর কতকগুলি ঐতিহাসিক কারণ আছে। 

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মধ্যশ্রেণীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন নামে পরিচিত যে আন্দোলনটি শুরু হয় তা ছিলো কৃষক সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। শুধু বিচ্ছিন্ন নয়, কৃষক স্বার্থের প্রতি তা ছিলো শত্রুভাবাপন্ন। তৎকালে সারা ভারতের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে একথা প্রযোজ্য হলেও বাঙলাদেশের ক্ষেত্রে তা ছিলো বিশেষভাবে সত্য। 

আঠারো উনিশ শতকে সারা ভারতব্যাপী যে বৃটিশ বিরোধী কৃষক আন্দোলনগুলি ঘটেছিলো তার নেতৃত্ব বিভিন্ন স্তরের কৃষকদের থেকেই এসেছিলো। ভারতীয় মধ্যশ্রেণী এবং তার মধ্যে সব থেকে অগ্রসর বাঙালী মধ্যশ্রেণীর সাথে, তাঁদের আর্থিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে, সেই সব আন্দোলনের কোন যোগ ছিলো না। কারণ এই মধ্যশ্রেণী ছিলো বৃটিশ শাসনের সৃষ্টি এবং তার ওপরই মূলতঃ নির্ভরশীল। বাঙলাদেশে চিরস্থায়ী ভূমি বন্দোবস্তের ফলে বাঙালী মধ্যশ্রেণীর এই নির্ভরশীলতা অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি দাঁড়ায় এবং এই বাঙালী মধ্যশ্রেণীই উনিশ শতকের ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকে। 

উনিশ শতকের বাঙালী মধ্য শ্রেণী ছিলো মূলতঃ চাকুরীর ওপর নির্ভরশীল। যে অল্পসংখ্যক উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, ব্যবসায়ী প্রভৃতি এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলো চাকুরীজীবী মধ্য শ্রেণীসহ তাঁদের সকলেরই কিছু না কিছু ভূমিস্বার্থ ছিলো। এর মূল কারণ এই যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূস্বামীরাই সেকালে ছিলো অন্যান্যদের তুলনায় অবস্থাপন্ন এবং তাঁদের সন্তানরাই ইংরাজী শিক্ষাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা লাভ করে সব থেকে বেশী। এর ফলে ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প ইত্যাদির পরিবর্তে ভূমি স্বার্থ ও জমিদার শ্রেণী থেকেই মধ্যশ্রেণীর উদ্ভব হয় এবং মধ্যশ্রেণীর সাথে এই ভূমিমালিকদের যোগসম্পর্ক থাকে ঘনিষ্ঠ। 

অপর দিকে কৃষক স্বার্থ ও জমিদার স্বার্থ ছিলো পরস্পর বিরোধী। সেজন্যেই কৃষকদের বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম তাঁদের জমিদার বিরোধী সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো না। উপরন্তু তা ছিলো একই সংগ্রামের দুই দিক। 

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালী মধ্যশ্রেণীর নেতৃত্বে যখন জাতীয় আন্দোলন শুরু হয় তখন সেই তথাকথিত জাতীয় আন্দোলনে কৃষকদের কোন শরীকানা ছিলো না। শুধু তাই নয়। সেই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দেন তাঁরা ছিলেন কৃষক আন্দোলনের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত এবং কৃষক স্বার্থের বিরোধী। কিন্তু তৎকালে কৃষকরাই ছিলো দেশের জনগণের পঁচানব্বই শতাংশেরও বেশী। তাই সেকালের সেই ‘জাতীয় আন্দোলন’ ছিলো জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং মেরুদণ্ডহীন। 

উপরোক্ত আন্দোলনের মেরুদণ্ডহীনতার আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো বৃটিশ বিরোধিতার পরিবর্তে বৃটিশ শাসনের প্রতি তাঁদের আপোসমূলক নীতি। এই নীতির ওপরই ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন উনিশ শতকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিলো (এলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে চাকুরীজীবী মধ্যশ্রেণীর সীমিত সাময়িক বিক্ষোভ সত্ত্বেও) এবং ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই নীতিই কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় আন্দোলনে একটা নির্ধারক ভূমিকা পালন করে।

উনিশ শতকের নব্বই-এর দশকে মধ্যশ্রেণীভুক্ত শিক্ষিত ভারতীয় যুবকদের একটি অংশের মধ্যে বৃটিশ বিরোধী চেতনা অনেকখানি তীব্র হয়। শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রতি বৃটিশ শাসনের বৈষম্যমূলক ব্যবহার, চাকুরী ও অপরাপর ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলমানের প্রতিযোগিতা এবং সেই প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণে বৃটিশের ভূমিকা, চাকুরী ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা নিতান্ত সীমিত থাকা ইত্যাদি কারণসমূহ একত্রিত হয়ে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটা বিক্ষোভ মধ্যশ্রেণীর মধ্যে ধূমায়িত হতে থাকে। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে বৃটিশ শাসনের অবসানের জন্যে কোন সংগ্রাম জাতীয় সংগঠন কংগ্রেসের নেতৃত্বের দ্বারা সম্ভব ছিলো না। কারণ কংগ্রেস সে সময়ে বৃটিশ শাসনের সাথে আপোসের মাধ্যমে ছোটখাটো কিছু কিছু দাবীদাওয়া আদায়ের আন্দোলন ব্যতীত অন্য কোন আন্দোলনে একেবারেই সমৰ্থ অথবা আগ্রহশীল ছিলো না। 

মধ্যশ্রেণীর উপরোক্ত অংশের যুবকদের মধ্যে কংগ্রেস নেতৃত্বের এই মনোভাব ও নীতি একটা বিদ্রোহের ভাব জাগ্রত করে এবং তাঁরা অনেকে কংগ্রেসের কাঠামোর মধ্যে থাকলেও সন্ত্রাসবাদী পথে বৃটিশ শাসন উৎখাত করতে উদ্যত হন। তৎকালে এই যুবকরা সকলেই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনা তখন যথেষ্ট প্রবল ছিলো এবং সে কারণেই বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাধারা ও রচনাবলী তাঁদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো। ‘আনন্দমঠ’, ‘কৃষ্ণচরিত্র’, ‘অনুশীলন’ ইত্যাদির প্রভাবে সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে ভারতে হিন্দু প্রাধান্য ও সনাতন ধর্মের প্রতিষ্ঠাকেই তাঁরা নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের সন্ত্রাসবাদী চিন্তা বৃটিশ শাসনের পরিবর্তে মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেই মূলতঃ স্থাপিত ছিলো।[৩] কিন্তু উনিশ শতকের শেষদিকে শিক্ষিত হিন্দু সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের একটা সাম্প্রদায়িক চরিত্র থাকলেও বঙ্কিমচন্দ্রের সন্ত্রাসবাদের সাথে তার উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিলো এই যে, তা মূলতঃ পরিচালিত হয়েছিলো বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে।

হিন্দু মধ্যশ্রেণীর এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন ক্রমশঃ বিস্তার লাভ ও শক্তি অর্জন করতে থাকে এবং ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর তা এক প্রবল আন্দোলনে পরিণত হয়। এই সন্ত্ৰাসবাদী আন্দোলনকারীরা অনেকেই কংগ্রেসের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুগত থাকলেও কংগ্রেসের নীতির সাথে তাঁদের অনেক মৌলিক বিরোধ ছিলো এবং কগ্রেসের উচ্চতম নেতৃত্ব তাঁদের কার্যকলাপকে কখনই সমর্থন করেনি। শুধু তাই নয়। তাঁরা এর যথাসাধ্য বিরুদ্ধাচরণই করেছিলো। ১৯৩০-এর দশকে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের পর প্রায় চল্লিশ বৎসর স্থায়ী এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ সময়ে বহুসংখ্যক সন্ত্রাসবাদী নেতা ও কর্মীরা ভারতের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী ছিলেন। তাঁদের একটি বিরাট অংশ মার্কসবাদ গ্রহণ করে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। 

কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিতে সন্ত্রাসবাদীদের প্রবেশ ১৯৩০-এর দিকেই প্রথম ঘটেনি। ১৯২০ সালে ইউরোপে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিলো সেই সব প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের দ্বারা যারা সন্ত্রাসবাদ পরিত্যাগ করে মার্কসবাদ গ্রহণ করেছিলেন। এইভাবে পার্টি গঠিত হওয়ার পর তাঁদের উদ্যোগে ভারতের মাটিতেও কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। সেই পার্টিতে মুজাফফর আহমদের মতো অল্প কয়েকজন ব্যক্তি সাংস্কৃতিক এবং কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের থেকে এলেও প্রাক্তন সন্ত্রাসবাদীদের প্রভাব তার মধ্যে যথেষ্ট থাকে। ১৯৩০-এর দশকে পার্টিতে ব্যাপকভাবে প্রাক্তন সন্ত্রাসবাদীদের প্রবেশের পর এই প্রভাব পরিণত হয় প্রবল প্রতাপে। 

আগেই বলেছি, অন্য শ্রেণী থেকে আগত ব্যক্তিরা সততার সাথে মার্কসবাদ গ্রহণ ও নিষ্ঠার সাথে তা অনুশীলনের চেষ্টা করলেও তাঁদের পূর্ববর্তী চেতনা, ধ্যান-ধারণা, অভ্যাস ও আচরণ তাঁদের ওপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানকারী প্রাক্তন সন্ত্রাসবাদীরাও এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন না। শুধু তাই নয়। উপরোক্ত প্রভাব কেবলমাত্র তাঁদের নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁদের প্রভাবে নির্ধারিত পার্টি নীতি, পার্টি প্রচারণা ও তাঁদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে তা অন্য পটভূমি থেকে আগত পার্টি সদস্যদের মধ্যেও প্রভূত প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়। 

কিন্তু শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদীরাই নয় মধ্যশ্রেণীর তথাকথিত ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন থেকে অপরাপর যে সমস্ত ব্যক্তিরা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন তাঁদের ভূমিকা ও উল্লেখযোগ্য ছিলো। তাঁরাও নিজেদের চেতনা, ধ্যান-ধারণা, অভ্যাস ও আচরণের দ্বারা সচেতন এবং অসচেতনভাবে পার্টির অভ্যন্তরে মধ্যশ্রেণীর প্রভাব বিস্তারে যথেষ্ট সহায়ক হন। 

৫ 

মধ্যশ্রেণীর এই প্রভাব বলতে মূলতঃ কি বোঝায়? বোঝায় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন চিন্তা—যার একটি রূপ হলো সন্ত্রাসবাদ সুলভ অস্ত্রধারীর হঠকারিতা এবং অপর রূপটি হলো শাসক শ্রেণীর সাথে সম্পত্তিমালিকসুলভ আপোস। 

জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন চিন্তা উদ্ভূত এই দুই প্রবণতা প্রথম থেকেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ও কর্মকাণ্ডকে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো একবার বাম এবং আরেকবার দক্ষিণ দিকে আন্দোলিত করে। প্রত্যেক দেশের কমিউনিস্ট পার্টিতেই বাম ও দক্ষিণ প্রভাব বর্তমান থাকে। সেদিক দিয়ে আমাদের দেশ কোন ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু লেনিন স্ট্যালিনের নেতৃত্বাধীন রুশ পার্টি এবং চীন, ভিয়েতনাম প্রভৃতি পার্টিগুলির সাথে ভারতীয় পার্টির তফাৎ এই যে, উপরোক্ত দুই ধরনের বিচ্যুতির প্রভাব অন্যান্য পার্টিগুলির ক্ষেত্রে তুলনায় কম। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম মূলতঃ শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের থেকেই হয়েছে এবং শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব চেতনা ও মার্কসবাদের প্রভাবই প্রধান থেকেছে। সেই প্রাধান্যের ফলেই আন্তঃপার্টি সংগ্রামে অন্যান্য শ্রেণীর প্রভাব সেখানে ক্রমশঃ পরাজিত ও দূরীভূত হয়ে পার্টিকে অধিকতর ঐক্যবদ্ধ করে বিপ্লবী সংগ্রামে সাফল্য দান করেছে। অন্যদিকে ভারতীয় পার্টিতে মধ্যশ্রেণীর দোর্দণ্ডপ্রতাপের জন্যে তাঁদের প্রভাবে পার্টি নীতি প্রথম থেকেই আপোস ও হঠকারিতা, এই দুই প্রান্তসীমার মধ্যে দোদুল্যমান থেকেছে এবং শ্রমিক চেতনা ও মার্কসবাদ এখানে মধ্যশ্রেণীর এই দোদুল্যমানতাকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রাধান্যে আসতে পারেনি। এর ফলে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি দক্ষিণ পন্থী ও বামপন্থী বিচ্যুতির (এই দুই বিচ্যুতিরই মূল চরিত্র দক্ষিণপন্থী) মধ্যে দোদুল্যমান থেকে বিভ্রান্ত, বিপথগামী ও বিভক্ত হয়েছে। 

ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম শ্রমিক অথবা কৃষক আন্দোলন থেকে হয়নি, হয়েছে মধ্যশ্রেণীর সন্ত্রাসবাদীর আন্দোলনের থেকে একথা বলার অর্থ এই নয় যে, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান ও বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে যায়নি, তাঁদের মধ্যে আন্দোলন করেনি। সে কাজ তাঁরা করেছে। অসংখ্য পার্টি কর্মী ও নেতা আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কৃষক শ্রমিকদের মধ্যে গেছেন, তাঁদেরকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেছেন। তেলেঙ্গানার কৃষক সংগ্রাম, বাঙলাদেশের তে-ভাগা আন্দোলন, হাজং ও নানকার আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট নেতৃত্বে শ্রমিকদের অনেক গৌরবময় সংগ্রামই তার স্বাক্ষর বহন করে। 

কিন্তু কৃষক শ্রমিকদের মধ্যে যাওয়া এবং তাঁদেরকে সংগঠিত করে সংগ্রাম করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেটা এখানে মূল কথা নয়। মূল কথা হলো, কীভাবে তাঁরা সেটা করেছেন অথবা করছেন, কী ধরনের সাংগঠনিক নীতির ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন প্রকৃত অর্থে বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তাঁরা সেই বিপ্লবী তত্ত্বকে কতখানি সঠিকতা দান করতে পেরেছেন যে তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে সামগ্রিকভাবে বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। 

এ বিষয়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া দরকার এজন্যে যে, শুধু কমিউনিস্টরাই কৃষক শ্রমিকদের মধ্যে যায় না। শুধু তাঁরাই তাঁদেরকে আন্দোলনে সংগঠিত করে না। বুর্জোয়ারাও এ কাজ করে। প্রত্যেক দেশেই তাঁদের নিজেদের স্বার্থে কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে আন্দোলন সংগঠন ও পরিচালনার জন্যে তাঁরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন কৃষক ও শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলে। 

কাজেই কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করাটা কমিউনিস্টদের একটা মৌলিক দায়িত্ব হলেও তাঁদের মধ্যে কাজ করলেই যে সেটা বিপ্লবী অথবা প্রগতিশীল হবে তা নয়। অর্থাৎ এই কাজ করার মধ্যেই আত্যন্তিকভাবে বিপ্লবী অথবা প্রগতিশীল কিছু নেই। কি ধরনের তাত্ত্বিক সূত্রায়নের ভিত্তিতে এবং কি ধরনের সাংগঠনিক নীতির ওপর ভিত্তি করে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে আন্দোলন সংগঠিত ও পরিচালিত হয়েছে বা হচ্ছে সেটাই এ ক্ষেত্রে আন্দোলনের চরিত্রের প্রকৃত নির্ধারক। 

ইতিপূর্বে কমিউনিস্ট পার্টিতে বুর্জোয়া পেটি-বুর্জোয়া প্রভাবের যে কথা বলা হয়েছে সেই প্রভাব কমিউনিস্ট পরিচালিত শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনগুলির মধ্যে সহজেই লক্ষণীয়। সামগ্রিকভাবে সারা ভারত এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান ও বাঙলাদেশের এই সমস্ত আন্দোলনের পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে যে, একদিকে বাম হঠকারিতা এবং অপর দিকে দক্ষিণ আপোসমুখিতার দ্বারা সেগুলি প্রভাবিত। এই নীতিগত বিচ্যুতির ফলে অসংখ্য সৎ ও সংগ্রামী কমরেডদের জীবন দান আত্মত্যাগের দ্বারা এই সমস্ত আন্দোলন চিহ্নিত ও গৌরবান্বিত হলেও তার দ্বারা সামগ্রিকভাবে বিপ্লবী সংগ্রামের অগ্রগতি অথবা কমিউনিস্ট পার্টির ঐক্য রক্ষিত হয়নি। একের পর এক কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনের ব্যর্থতা কমিউনিস্ট পার্টি ও বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যে মধ্যশ্রেণী সুলভ হতাশা, আত্মমুখিতা ও আমলাতান্ত্রিকতার প্রভাব ও প্রাধান্য বিস্তার করে পাটিকে বিভক্ত এবং আন্দোলনকে বিভ্রান্ত ও চুরমার করেছে। 

সঠিক কমিউনিস্ট পার্টি বলতে কি বোঝায়? একটি সঠিক পার্টি কি এমন পার্টি যা কখনো ভুল করে না? যার মধ্যে শ্রমিক শ্রেণী বহির্ভূত কোন শ্রেণীর প্রভাব একেবারেই থাকে না? অথবা যার নেতৃত্বে বিপ্লবী সংগ্রাম কখনো সাময়িকভাবেও ব্যর্থ ও পরাজিত হয় না?, তা নয়। কারণ একটি সঠিক পার্টিও মাঝে মাঝে ভুল করতে পারে, তার মধ্যে শ্রমিক শ্ৰেণী বহির্ভূত শ্রেণীর প্রভাব থাকতে পারে এবং তার নেতৃত্বে বিপ্লবী সংগ্রাম সাময়িকভাবে ব্যর্থ ও পরাজিত হতে পারে। 

একটি সঠিক কমিউনিস্ট পার্টি হলো এমন একটি পার্টি মাঝে মাঝে কিছু ভুলভ্রান্তি করলেও বিপ্লবী তত্ত্ব, রণনীতি ও রণকৌশলের ক্ষেত্রে সাধারণতঃ কোন ভুল করে না, যার মধ্যে শ্রমিক শ্রেণী বহির্ভূত প্রভাব বর্তমান থাকলেও শ্রমিক শ্রেণীর চেতনা, চিন্তাধারা, ধ্যান- ধারণা, অভ্যাস ও আচরণ প্রাধান্যে থাকে এবং যার নেতৃত্বে কোন কোন ক্ষেত্রে বিপ্লবী সংগ্রাম সাময়িকভাবে ব্যর্থ ও পরাজিত হলেও এই ব্যর্থতা ও পরাজয় পার্টিকে বিভক্ত করে না এবং পরবর্তী পর্যায়ে নোতুন নোতুন সাফল্যের মাধ্যমে বিপ্লবী সংগ্রামের সামগ্রিক অগ্রগতি সাধন করে। 

তাই যে কোন দেশে একটি কমিউনিস্ট পার্টির সঠিকতা নির্ণয়ের জন্যে যে দুটি বাহ্যিক লক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হলো – সেই পার্টি শ্রমিক-কৃষক মেহনতী জনগণের মধ্যে বিপ্লবী সংগ্রাম কতখানি গভীর ও ব্যাপকভাবে পরিচালনা করছে এবং নিজের ঐক্য বজায় রাখতে কি পরিমাণ সফল হচ্ছে। বিপ্লবী সংগ্রামে সাধারণ অগ্রগতি অর্জন এবং অভ্যন্তরীণ ঐক্যই একটি কমিউনিস্ট পার্টির সঠিকতার মানদণ্ড। কারণ সঠিক তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত না হলে বিপ্লবী সংগ্রামে সাধারণ অগ্রগতি সাধন এবং সাময়িক ব্যর্থতা ও পরাজয় সত্ত্বেও পার্টির অভ্যন্তরীণ ঐক্য রক্ষা সম্ভব নয়। 

একটি কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবী সংগ্রামে সাধারণ অগ্রগতি সাধন করতে এবং সংগ্রামের চড়াই উত্রাইয়ের মধ্যে দিয়ে নিজেদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য রক্ষা করতে সক্ষম হয় একমাত্র তখনই যখন সেই পার্টিতে বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রভাব অনির্ধারক হয় এবং শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব দর্শন ও আদর্শ মার্কসবাদ লেনিনবাদ সৃষ্ট চেতনা, আচরণ ইত্যাদি প্রাধান্যে থাকে। 

কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর এই চেতনা, আচরণ ইত্যাদি প্রাধান্যে থাকে কখন? একমাত্র তখনই যখন পার্টির তাত্ত্বিক সূত্রায়ন, সাংগঠনিক নীতি নির্ধারণ ও সাংগঠনিক কর্ম নিয়ন্ত্রণ করা হয় দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে। 

সমগ্র পার্টির মধ্যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়োগ এবং অনুশীলন কিভাবে সম্ভব? কোন সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অন্যান্য শ্রেণীর প্রভাবকে অতিক্রম, দমন ও পরাজিত করে শ্রমিক শ্রেণী দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে অবলম্বনপূর্বক নিজেদের শ্রেণী চেতনা, আচরণ ইত্যাদিকে প্রাধান্যে রাখতে পারে? সে প্রক্রিয়া হলো গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। 

গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে পার্টির মধ্যে বিতর্ক ও অভিজ্ঞতার সার সংকলনের এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত সংখ্যালঘিষ্ঠের দ্বারা এবং উচ্চতর পার্টি কমিটির সিদ্ধান্ত নিম্নতর কমিটিগুলির দ্বারা মেনে চলার নীতিকেই বলা হয় গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। মাও সেতুঙ এই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার মর্মবস্তু চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেছেন যে, সঠিক চিন্তার কেন্দ্রীকরণের মধ্যেই তা নিহিত।[৫] 

তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে অবলম্বনের জন্যে প্রয়োজন বিভিন্ন সামাজিক শক্তির অবস্থান ও দ্বন্দ্বকে বোঝা ও নির্ণয় করা। সমাজ ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অথবা এককভাবে কারো পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়। তা সম্ভব একমাত্র যৌথভাবে এবং এমন একটি সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যা খণ্ড খণ্ড আংশিক সত্যকে অবলম্বন ও কেন্দ্রীভূত করে উচ্চতর সত্যের মধ্যে তার সমন্বয় সাধন করতে পারে। 

সাধারণ শ্রমিক কৃষক মেহনতী জনগণের সাথে এবং সমাজের উৎপাদন শক্তিগুলির সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ ব্যতীত খণ্ড খণ্ড আংশিক সত্যের এই সমন্বয় সাধন সম্ভব নয়। পার্টি এই সংযোগ কীভাবে রক্ষা করতে পারে? প্রধানতঃ কেডারদের মাধ্যমে। কেডাররাই জনগণের সাথে পার্টির ঘনিষ্ঠতম সংযোগ রক্ষার প্রধান উপায়। ঠিক এ কারণেই স্ট্যালিন বলেছেন, 

“দুনিয়ার যত মূল্যবান পুঁজি আছে তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান ও সর্বাপেক্ষা নির্ধারক হলো জনগণ, কেডাররা। এটা উপলব্ধি করা দরকার যে, আমাদের বর্তমান অবস্থায় কেডাররাই সব কিছু নির্ধারণ করে।”[৬] 

কেডাররা যাতে এই নির্ধারক ভূমিকা পালন করতে পারে তার জন্যেই পার্টিতে প্রয়োজন গণতন্ত্র। জনগণের মধ্যে সংগ্রামরত অবস্থায় কেডাররা যে বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, যে সাফল্য ও ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়, পার্টির বক্তব্য ও কর্মনীতি জনগণের মধ্যে যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তার সাথে উপযুক্ত ও যথেষ্ট পরিচয় ব্যতীত কোন পার্টি ও তার নেতৃত্বই বিপ্লবকে সঠিক পথে চালনা করতে পারে না। এ জন্যে উপরোক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে পার্টিতে ব্যাপক আলাপ আলোচনা সমালোচনা এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় শুধু অত্যাবশ্যকীয় নয়, একেবারে অপরিহার্য। 

কিন্তু পার্টিতে এই গণতন্ত্রের অর্থ অবাধ, ঢালাও এবং অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা নয়। আলাপ- আলোচনা সমালোচনার স্বাধীনতা যাতে পার্টির মধ্যে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে একটা নৈরাজ্য সৃষ্টি না করে তাকে ‘সত্যের কেন্দ্রিকরণের’ দিকে পরিচালিত করতে পারে তার জন্যে আবার প্রয়োজন কেন্দ্রিকতা। গণতন্ত্রের ভিত্তিতে এই কেন্দ্রিকতার নামই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। এই কেন্দ্রিকতার মাধ্যমে নেতৃত্ব কেডারদের অভিজ্ঞতার সার সংকলন করে বিভিন্ন সামাজিক দ্বন্দ্বের বিকাশের নির্দিষ্ট পর্যায়টি সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে জনগণের চেতনার মান নির্ধারণ করতে পারে এবং তার ভিত্তিতে বিপ্লবী সংগ্রামের বাস্তব পদক্ষেপগুলি সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারে। এই শৃঙ্খলা ব্যতীত কোন কমিউনিস্ট পার্টিই বিপ্লবী সংগ্রামে অগ্রগতি সাধন করতে এবং নিজেদের ঐক্য বজায় রাখতে পারে না। 

গণতন্ত্র ও কেন্দ্রিকতা এবং কেডার ও নেতৃত্বের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সব সময়ে বিরাজ করে। গণতন্ত্র ও কেডাররাই যথাক্রমে এই দ্বন্দ্বের প্রধান দিক। এটা সাধারণভাবে সত্য হলেও বিশেষ বিশেষ অবস্থায় কেন্দ্রিকতা ও নেতৃত্ব এই দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে প্রাধান্যে থাকে। 

আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ও কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। কারণ এখানে শ্রমিক শ্রেণী বহির্ভূত অন্যান্য শ্রেণীর, বিশেষতঃ পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রবল প্রভাবে কেন্দ্রিকতা ও নেতৃত্ব সাধারণভাবে দ্বন্দ্বের প্রধান দিক হিসেবে বিরাজ করেছে। এর ফলে পার্টিতে যে কেন্দ্রিকতা পূর্বে দেখা গেছে এবং এখনো বিভক্ত পার্টিগুলির মধ্যে দেখা যাচ্ছে তা হলো আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা নয়। এই আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাই আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টির অথবা পার্টিগুলির সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব নির্মাণের এবং বিপ্লবী সংগ্রামের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার মূল কারণ। 

একটি দেশের সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব বলতে কি বোঝায়? তা কি এমন এক তত্ত্ব যা চিরকালের মতো নির্ধারিত অথবা যার কোন পরিবর্তন নেই? না, তা নয়। কারণ এ তত্ত্ব এমন একটি বিকাশমান জিনিস যা সামাজিক বিকাশের সাথে সাথে পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়। এ জন্যেই সঠিক বিপ্লবী তত্ত্বের সমস্যাটি একটি দেশের সামাজিক বিকাশের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং বাস্তব অবস্থার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের ওপরই সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। তাই যে কোন দেশে বিপ্লবী তত্ত্ব নির্মাণ করতে গেলে শুধু মার্কসবাদ-লেনিনবাদ- মাও চিন্তাধারার তাত্ত্বিক জ্ঞানই যথেষ্ট নয়। তার জন্যে প্রয়োজন নির্দিষ্ট দেশটির সামাজিক বিকাশের বিশেষ নিয়ম ও নির্দিষ্ট ধারাটির সাথে পরিচিত হওয়া। 

বিপ্লবী সংগ্রাম যেমন বিপ্লবী তত্ত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তেমনি বিপ্লবী তত্ত্বও নির্মিত হয় বিপ্লবী সংগ্রামের মাধ্যমে। তাই বিপ্লবী তত্ত্ব ব্যতীত যেমন বিপ্লবী সংগ্রাম হয় না, তেমনি বিপ্লবী সংগ্রাম ব্যতীত বিপ্লবী তত্ত্বও সম্ভব নয়। 

কিন্তু বিপ্লবী সংগ্রাম বলতে কি বোঝায়? সামাজিক শ্রেণী দ্বন্দ্বের প্রশ্নকে বাদ দিয়ে এ প্রশ্নের আলোচনা সম্ভব নয়। কারণ বিপ্লবী সংগ্রাম এই শ্রেণী দ্বন্দ্বের ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়। ভূস্বামী ও ভূমিহীন কৃষক, শিল্প বুর্জোয়া ও শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করে সে দ্বন্দ্বে ভূস্বামী ও বুর্জোয়া শ্রেণী হলো প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক শক্তি এবং কৃষক ও শ্রমিক হলো প্রগতিশীল সামাজিক শক্তি। দ্বন্দ্বের প্রথম পর্যায়ে এই প্রগতিশীল শক্তিগুলির ভূমিকা অপ্রধান থাকলেও সামাজিক বিকাশের সাথে সাথে সেগুলি ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে প্রাধান্যে আসতে চেষ্টা করে। শক্তি সঞ্চয়ের এই প্রক্রিয়াটিই হলো বিপ্লবী সংগ্রাম। 

বিপ্লবী সংগ্রাম তা হলে সঠিকভাবে পরিচালিত হয় কখন? যখন তার মাধ্যমে শ্রেণী দ্বন্দ্বের প্রগতিশীল দিকটি কমবেশী দ্রুতভাবে শক্তি সঞ্চয় করে প্রাধান্যে আসতে থাকে এবং পরিশেষে সমাজের একটা গুণগত পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হয় ও সমগ্র সমাজকে একটা উচ্চতর স্তরে উন্নীত করতে পারে। এ জন্যেই সামাজিক দ্বন্দ্বগুলির অবস্থান, গুরুত্ব ইত্যাদি সঠিকভাবে নির্ণয় ব্যতীত কোন বিপ্লবী সংগ্রামকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায় না। 

১০ 

পূর্বেই বলেছি, আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে পেটি-বুর্জোয়া চেতনা, চিন্তাধারা, অভ্যাস ইত্যাদির প্রাধান্য একটি মৌলিক সমস্যা। এই প্রধান্যের জন্যই তত্ত্বগত ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে দেখা দেয় নৈরাজ্য। এই নৈরাজ্যের অবসান ঘটিয়ে পার্টিকে সঠিক তাত্ত্বিক ভিত্তি ও সাংগঠনিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠা করাই আজ বাঙলাদেশের কমিউনিস্টদের একটি কেন্দ্রীয় দায়িত্ব। এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হলে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐতিহাসিক মূল্য ও তার বৈশিষ্ট্যসমূহের সাথে পরিচিত হতে হবে এবং তার ভিত্তিতে আন্দোলনের কতকগুলি নির্দিষ্ট সমস্যাকে চিহ্নিত করে সেগুলির সমাধানের জন্যে উপযুক্ত পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। বলাই বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত পদ্ধতি হলো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী বিশ্লেষণ এবং প্রক্রিয়াটি হলো মেহনতী জনগণের মধ্যে যাওয়ার প্রক্রিয়া। 

পার্টি জনগণের মধ্যে যেতে পারে কীভাবে? কেডারদের দ্বারা পরিচালিত গণসংগঠনসমূহের মাধ্যমে। পার্টিকে যদি একটি বৃক্ষের সাথে তুলনা করা যায় তা হলে বলা যেতে পারে যে মাটি হলো জনগণ এবং শিকড় হলো কেডাররা। শিকড় যদি বিভিন্ন স্তর ভেদে করে মাটির মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে তা হলে যেমন বৃক্ষের বৃদ্ধি হয় না, তেমনি কেডাররা গণসংগঠনগুলির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে প্রবেশ করতে সমর্থন না হলে পার্টিরও কোন বৃদ্ধি হয় না। গণসংগঠন ও কেডারদের গুরুত্ব তাই বিপ্লবী সংগ্রামের ক্ষেত্রে অপরিসীম 

দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে অবলম্বন করে, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থেকে, কেডারদের মাধ্যমে শ্রমিক ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি, ছাত্র সংগঠন ইত্যাদি গণ-সংগঠনগুলি পরিচালনা করে জনগণের মধ্যে প্রবেশ করতে পারলেই আমাদের দেশের উপযুক্ত বিপ্লবী তত্ত্ব নির্মাণ ও বিকশিত করা সম্ভব হবে। তত্ত্ব ও কর্মের প্রকৃত ঐক্য এইভাবেই প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এই ঐক্যই বহুধাবিভক্ত কমিউনিস্ট আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ করে আমাদের দেশে বিপ্লবকে সফল করবে। 

তথ্যসূত্র 

১. এই বইয়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘বাঙলাদেশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা’ দ্রষ্টব্য। 

২. এ বিষয়ে অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য : বদরুদ্দীন উমর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ। 

৩. বিস্তৃত আলোচনার জন্যে দ্রষ্টব্য : বদরুদ্দীন উমর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ। 

৪. দ্রষ্টব্য : বদরুদ্দীন উমর, বাঙলাদেশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

৫. Mao Tes-Tung Unrehearsed: Stauart Shram, Penguin Books. 1974. P. 163. 

৬. J. V. Stalin : Address Delivered in the Kremlin Palace to the Graduates from the Red Army Acadamies, May 1935. 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *