পনর
নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া বন্দনার অত্যন্ত গ্লানি বোধ হইতে লাগিল। সে কি নেশা করিয়াছে যে, নির্লজ্জ উপযাচিকার ন্যায় আপন হৃদয় উদ্ঘাটিত করিয়া সমস্ত আত্মমর্যাদার জলাঞ্জলি দিয়া আসিল? অথচ দ্বিজদাস পুরুষ হইয়াও যেমন রহস্যাবৃত ছিল তেমনি রহিল। তাহার মুখের ভাবে না ছিল অগ্রাহ্য, না ছিল উল্লাস, সে না দিল আশা, না দিল সান্ত্বনা, বরঞ্চ পরিহাসচ্ছলে এই কথাটাই বার বার করিয়া জানাইল যে সে তৃতীয় পক্ষ। তাহার ইচ্ছা-অনিচ্ছা এ বাড়িতে অবান্তর বিষয়। শুধু কি এই! মার নাম করিয়া বলিল, বাগ্দান মানেই সম্প্রদান; বলিল, নিরপরাধ সুধীরের শূন্য আসনে গিয়া দয়াময়ীর ছেলে বসিবে না। কিন্তু অপমানের পাত্র ইহাতেও পূর্ণ হইল না, তাহার চোখে জল দেখিয়া সে অবশেষে দয়ার্দ্র-চিত্তে মাত্র এইটুকু কথা দিয়াছে যে বন্দনার এই বেহায়াপনার কাহিনী মায়ের কাছে সে উল্লেখ করিবে।
আবার এইখানেই কি শেষ! দ্বিজদাসের কথার উত্তরে সে যাচিয়া বলিয়াছিল, এই পরিবারের যেখানে যে-কেহ আছে, সকলের ছোট হইয়াই সে আসিতে চায়। আর সে ভাবিতে পারিল না, সেইখানে স্তব্ধভাবে বসিয়া তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, প্রকৃত সে অত্যন্ত ছোট হইয়া গেছে—এত ছোট যে আত্মঘাতী হইলেও এ হীনতার প্রায়শ্চিত্ত হয় না।
বাহিরে হইতে কে আসিয়া জানাইল রায়সাহেব তাহাকে ডাকিতেছেন। উঠিয়া সে পিতার ঘরে গেল, সেখানে তাঁহাকে বারংবার জিদ করিয়া সম্মত করাইল, কালই তাঁহাদের বোম্বায়ে রওনা হইতে হইবে। অথচ, কথা ছিল বিপ্রদাস ফিরিয়া আসিলে রাত্রের ট্রেনে তাঁহারা যাত্রা করিবেন। হঠাৎ এইভাবে চলিয়া যাওয়াটা যে ভালো হইবে না ইহাতে সাহেবের সন্দেহ ছিল না,—ছুটিও ছিল, স্বচ্ছন্দে থাকাও চলিত, তথাপি কন্যার প্রস্তাবে তাঁহাকে রাজি হইতে হইল।
বিছানায় শুইয়া বন্দনার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল, তার পরে এক সময়ে সে ঘুমাইয়া পড়িল। সকালে উঠিয়া সে নিজের এবং বাপের জিনিসপত্র সমস্ত গুছাইয়া ফেলিল, ফোন করিয়া গাড়ি রিজার্ভ করিল এবং বোম্বায়ে তার করিয়া দিল। সন্ধ্যায় ট্রেন, কিন্তু কিছুতেই যেন তাহার বিলম্ব সহে না।
বেলা তখন ন’টা বাজিয়াছে, অন্নদা ঘরে ঢুকিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল,—এ কি কাণ্ড?
বন্দনা ময়লা কাপড়গুলা ভাঁজ করিয়া একটা তোরঙ্গে তুলিতেছিল, কহিল, আজ আমরা যাবো।
সে তো আজ নয় দিদিমণি। যাবার কথা যে কাল।
না, আজই যাওয়া হবে। এই কথা বলিয়া সে কাজ করিতেই লাগিল, মুখ তুলিল না।
অন্নদা একমুহূর্তে মৌন থাকিয়া বলিল, আপনি উঠুন, আমি গুছিয়ে দিচ্চি। আপনার কষ্ট হচ্চে!
কষ্ট দেখবার দরকার নেই, নিজের কাজে যাও তুমি। এ বাড়ির সমস্ত লোকের প্রতি যেন তাহার ঘৃণা ধরিয়া গেছে।
হেতু না জানিলেও একটা যে রাগারাগির পালা চলিতেছে অন্নদা তাহা জানিত। হঠাৎ মা কাল বাড়ি চলিয়া গেলেন, আজ বন্দনাও তেমনি হঠাৎ চলিয়া যাইতে উদ্যত। কিন্তু রাগের বদলে রাগ করা অন্নদার প্রকৃতি নয়, সে যেমন সহিষ্ণু তেমনি ভদ্র, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া কুণ্ঠিতস্বরে কহিল, আমার দোষ হয়ে গেছে দিদিমণি, আজ সময়ে আমি উঠতে পারিনি।
বন্দনা মুখ তুলিয়া চাহিল, বলিল, আমি ত তার কৈফিয়ত চাইনি অন্নদা, দরকার হয় তোমার মনিবকে দিও। দ্বিজুবাবু তাঁর ঘরেই আছেন, তাঁকে বলো গে। এই বলিয়া সে পুনরায় কাজে মন দিল। বন্দনা পিতার একমাত্র সন্তান বলিয়া একটুখানি বেশী আদরেই প্রতিপালিত। সহ্য করার শক্তিটা তাহার কম। কিন্তু তাই বলিয়া কটু কথা বলার কুশিক্ষাও তাহার হয় নাই এবং হয়ত এতবড় কঠোর বাক্য সে জীবনে কাহাকেও বলে নাই। তাই বলিয়া ফেলিয়াই সে মনে মনে লজ্জা বোধ করিতেছিল, এমনি সময়ে অন্নদাই সলজ্জ মৃদুকণ্ঠে কহিতে লাগিল, ডাক্তাররা চলে গেলেন, ফরসা হয়েছে দেখে ভাবলুম আর শোবো না, শুইনিও, কিন্তু দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসতে কি করে চোখ জড়িয়ে এলো, কোথা দিয়ে বেলা হয়ে গেল টের পেলুম না। মনিবের কথা বলচেন দিদিমণি, কিন্তু আপনিও কি আমার মনিব নয়? বলুন ত, এ অপরাধ আর কখনও কি আমার হয়েছে? উঠুন আমি গুছিয়ে দিই।
শেষের দিকে কথাগুলো বোধ হয় বন্দনার কানে যায় নাই, অন্নদার মুখের পানে চাহিয়া বলিল, ডাক্তাররা চলে গেলেন মানে?
অন্নদা কহিল, কাল রাত্তিরে দ্বিজুর ভারী অসুখ গেছে। এখানে এসে পর্যন্তই ওর শরীর খারাপ, কিন্তু গ্রাহ্য করে না। কাল মা’দের নিয়ে বাড়ি যাবার কথায় আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললে, মা যেন না জানতে পারেন, কিন্তু দাদাকে বলে আমার যাওয়াটি মাপ করে দাও অনুদিদি, আজ যেন আমি উঠতে পারচি নে এমনি দুর্বল।
ওকে মানুষ করেছি, ওর সব কথা আমার সঙ্গে। ভয় পেয়ে বললুম, সে কি কথা? শরীর খারাপ ত লুকোচ্চো কেন? ওর স্বভাবই হলো হেসে উড়িয়ে দেওয়া, তা সে যত গুরুতরই হোক। তেমনি একটুখানি হেসে বললে, তুমি ওদের বিদেয় করো না দিদি, তার পরে আপনি চাঙ্গা হয়ে উঠবো। ভাবলুম, মার সঙ্গে ওর বনে না, কোথাও সঙ্গে যেতে চায় না, এ বুঝি তারই একটা ফন্দি। তাই কিছু আর বললুম না। বড়দাদাবাবু ওঁদের নিয়ে চলে গেলেন। তার পরে সমস্ত দিনটা ও শুয়ে কাটালে, কিছু খেলে না। দুপুরবেলা গিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, দ্বিজু, কেমন আছ? বললে, ভাল আছি। কিন্তু ওর চেহারা দেখে তা মনে হলো না। ডাক্তার আনাতে চাইলুম, দ্বিজু কিছুতে দিলে না, বললে, কেন মিছে দাদার অর্থদণ্ড করাবে দিদি, তোমার অপব্যয়ের কথা শুনলে গিন্নী রাগ করবেন। মায়ের উপর এ অভিমান ওর আর গেল না। সমস্ত দিন খেলে না, বিছানায় শুয়ে কাটালে, বিকেলে গিয়ে জিজ্ঞেসা করলুম, দ্বিজু, শরীর যদি সত্যিই খারাপ নেই তবে সমস্ত দিন শুয়ে কাটাচ্ছোই বা কেন? ও তেমনি হেসে বললে, অনুদিদি, শাস্ত্রে লেখা আছে শুয়ে থাকার মত পুণ্য কাজ জগতে নেই, এতে কৈবল্য মেলে। একটু পারত্রিক মঙ্গলের চেষ্টায় আছি। তোমার ভয় নেই। সব তাতেই ওর তামাশা, কথায় পারবার জো নেই, রাগ করে চলে এলুম কিন্তু ভয় ঘুচলো না। ও একখানা বই টেনে পড়তে শুরু করে দিলে।
অন্নদা একটু থামিয়া বলিতে লাগিল, রাত্রি বোধ করি তখন বারোটা, আমার দোরে ঘা পড়ল। কে রে? বাইরে থেকে জবাব এলো, অনুদিদি আমি। দোর খোলো। এত রাত্রে দ্বিজু ডাকে কেন, ব্যস্ত হয়ে দোর খুলে বেরিয়ে এলুম,—দ্বিজুর এ কি মূর্তি! চোখ কোটরে ঢুকেছে, গলা ভাঙ্গা, শরীর কাঁপচে,—কিন্তু তবু হাসি। বললে, দিদি, মানুষ করেছিলে তাই তোমার ঘুম ভাঙ্গালুম। যদি চোখ বুজতেই হয় তোমার কোলেই মাথা রেখে বুজবো। এই বলিয়া অন্নদা ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। তাহার কান্না যেন থামিতে চাহে না এমনি ভিতরের অদম্য আবেগ। আপনাকে সামলাইতে তাহার অনেকক্ষণ লাগিল, তারপরে কহিল, বুকে করে তাকে ঘরে নিয়ে গেলুম, কিন্তু যেমন কাট বমি তেমনি পেটের যন্ত্রণা—মনে হলো রাত বুঝি আর পোহাবে না, কখন নিশ্বাসটুকু বা বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তারদের খবর দেওয়া হলো, তাঁরা সব এসে পড়লেন, ফুঁড়ে ওষুধ দিলেন, গরম জলের তাপ-সেঁক চলতে লাগলো—চাকররা সব জেগে বসে—ভোরবেলায় দ্বিজু ঘুমিয়ে পড়লো। ডাক্তাররা বললে আর ভয় নেই। কিন্তু কিভাবে যে রাতটা কেটেছে দিদিমণি, ভাবলে মনে হয় বুঝি দুঃস্বপ্ন দেখেচি—ও-সব কিছুই হয়নি! এই বলিয়া অন্নদা আবার আঁচলে চোখ মুছিয়া ফেলিল।
বন্দনা আস্তে আস্তে বলিল, আমি কিছুই জানতে পারিনি, আমাকে তুললে না কেন অন্নদা?
অন্নদা কহিল, সকালে ঐ একটা অশান্তি গেলো, আর তোমাকে ব্যস্ত করলুম না দিদিমণি। নইলে দ্বিজু বলেছিল।
বন্দনা এ প্রসঙ্গ ছাড়িয়া দিল, কহিল, দ্বিজুবাবু এখন কেমন আছেন?
অন্নদা কহিল, ভালো আছে, ঘুমোচ্চে। ডাক্তাররা বলে গেছেন, হয়ত সন্ধ্যার আগে আর ঘুম ভাঙ্গবে না। বড়বাবু এসে পড়লে বাঁচি দিদি।
তাঁকে কি খবর দেওয়া হয়েছে?
না। দত্তমশাই বললেন তার আবশ্যক নেই, তিনি আপনিই আসবেন।
ও-ঘরে লোক আছে ত?
হাঁ দিদিমণি, দু’জন বসে আছে।
ডাক্তার আবার কখন আসবেন?
সন্ধ্যার আগেই আসবেন। বলে গেছেন আর ভয় নেই।
চিকিৎসকেরা অভয় দিয়ে গেছেন বন্দনার এইটুকুই সান্ত্বনা। এছাড়া তাহার কি-ই বা করিবার আছে!
বন্দনা গিয়া পিতাকে দ্বিজদাসের পীড়ার সংবাদ দিল, কিন্তু বেশি বলিল না।
তিনি সেইটুকু শুনিয়াই ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন,—কৈ আমি ত কিছুই জানতে পারিনি?
না, আমাদের ঘুম ভাঙ্গানো কেউ উচিত মনে করেনি।
কিন্তু সেটা ত ভালো হয়নি!
বন্দনা চুপ করিয়া রহিল, তিনি ক্ষণেক পরে নিজেই বলিলেন, টিকিট কিনতে পাঠান হয়েছে, গাড়ি রিজার্ভ হয়ে গেছে, আমাদের যাওয়ায় ত দেখচি একটু বিঘ্ন ঘটল।
বন্দনা বলিল, কেন বিঘ্ন হবে বাবা, আমরা থেকেই বা তাঁদের কি উপকার করবো?
না, উপকার নয়, কিন্তু তবু—
না বাবা, এমনি করে কেবলি দেরি হয়ে যাচ্চে, আর তুমি মত বদলিয়ো না। এই বলিয়া বন্দনা বাহির হইয়া আসিল।
বেলা পড়িয়া আসিতেছে, বন্দনার ঘরে ঢুকিয়া অন্নদা মেঝের উপর বসিল। তাঁহাদের যাত্রা করিতে তখনও ঘণ্টা-দুয়েক দেরি। বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, দ্বিজুবাবু ভাল আছেন?
হাঁ দিদি, ভাল আছে, ঘুমুচ্চে।
বন্দনা কহিল, আমাদের যাবার সময়ে কারও সঙ্গে দেখা হলো না। একজনের তখনো হয়ত ঘুম ভাঙবে না, আর একজন যখন বাড়ি এসে পৌঁছবেন তখন আমরা অনেক দূর চলে গেছি।
অন্নদা সায় দিয়া বলিল, হাঁ, বড়দাদাবাবু আসবেন প্রায় নটা রাত্তিরে। একটু পরে কহিল, তিনি এসে পড়লে সবাই বাঁচি। সকলের ভয় ঘোচে।
কিন্তু ভয় ত কিছু নেই অন্নদা!
অন্নদা বলিল, নেই সত্যি, কিন্তু বড়দাদাবাবুর বাড়িতে থাকাই আলাদা জিনিস দিদি। তখন কারও আর কোন দায়িত্ব নেই, সব তাঁর। যেমন বুদ্ধি, তেমনি বিবেচনা, তেমনি সাহস, আর তেমনি গাম্ভীর্য! সকলের মনে হয় যেন বটগাছের ছায়ায় বসে আছি।
সেই পুরাতন কথা, সে বিশেষণের ঘটা। মনিবের সম্বন্ধে এ যেন ইহাদের মজ্জাগত হইয়াছে। অন্য সময় হইলে বন্দনা খোঁটা দিতে ছাড়িত না, কিন্তু এখন চুপ করিয়া রহিল।
অন্নদা বলিতে লাগিল, আর এই দ্বিজু! দুই ভায়ে যেন পৃথিবীর এ-পিঠ ও-পিঠ।
বন্দনা আশ্চর্য হইয়া কহিল কেন?
অন্নদা বলিল, তা বৈ কি দিদি। না আছে দায়িত্ববোধ, না আছে ঝঞ্ঝাট, না আছে গাম্ভীর্য। বৌদি বলেন, ও হচ্চে শরতের মেঘ, না আছে বিদ্যুৎ, না আছে জল। উড়ে উড়ে বেড়ায়, ব্যাপার যত গুরুতর হোক, হেসে খেলে ও কাটাবেই কাটাবে। না গৃহী না বৈরিগী, কত খাতক যে ওর কাছে ‘বুঝিয়া পাইলাম’ লিখিয়ে নিয়ে পরিত্রাণ পেয়েছে তার হিসেব নেই।
বন্দনা কহিল, মুখুয্যেমশাই রাগ করেন না?
করেন না? খুব করেন। বিশেষ মা। কিন্তু ওকে পাওয়া যাবে কোথায়? কিছুদিনের মতো এমন নিরুদ্দেশ হয় যে বৌদি কান্নাকাটি শুরু করে দেন, তখন সবাই মিলে খুঁজে ধরে আনে। কিন্তু এমন করেও ত চিরদিন কাটতে পারে না দিদি, ওরও বিয়ে হবে, ছেলেপুলে হবে, তখন যে এ ব্যবস্থায় একেবারে দেউলে হতে হবে!
বন্দনা কহিল, এ কথা তোমরা ওঁকে বলো না কেন?
অন্নদা কহিল, ঢের বলা হয়েছে, কিন্তু ও কান দেয় না। বলে, তোমাদের ভাবনা কেন? দেউলেই যদি হই বৌদিদি ত আর দেউলে হবে না, তখন সকলে মিলে ওঁর ঘাড়ে গিয়ে চাপবো।
বন্দনা হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করিল, মেজদি কি বলেন?
অন্নদা কহিল, দেওরের ওপর তাঁর আদরের শেষ নেই। বলেন, আমরা খাবো আর দ্বিজু উপোস করবে নাকি? আমার পাঁচ শ টাকা আয় ত আর কেউ ঘুচোতে পারবে না, আমাদের গরিবী-চালে তাতেই চলে যাবে। বড়বাবু তাঁর লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে সুখে থাকুন আমরা চাইতে যাবো না।
শুনিয়া বন্দনার কি যে ভালো লাগিল তাহার সীমা নাই। যে বলিয়াছে সে তাহারই বোন। অথচ যে সমাজে, যে আবহাওয়ার মধ্যে সে নিজে মানুষ, সেখানে এ কথা কেহ বলে না, হয়ত ভাবিতেও পারে না। বলার কখনো প্রয়োজন হয় কিনা তাই বা কে জানে।
কিন্তু অন্নদা যাহা বলিতেছিল সে যেন পুরাকালের একটা গল্প। ইহারা একান্নবর্তী পরিবার, কেবল বাহিরের আকৃতিতে নয় ভিতরের প্রকৃতিতে। অন্নদা এখানে শুধু দাসী নয়, দ্বিজদাসের সে দিদি। কেবল মৌখিক নয়, আজও সকল কথা তাহার ইহারই কাছে। এই অন্নদার বাবা এই পরিবারের কর্মে গত হইয়াছে, তাহার ছেলে এখানে মানুষ হইয়া এখানেই কাজ করিয়া জীবিকানির্বাহ করিতেছে। অন্নদার অভাব নাই, তবু মায়া কাটাইয়া তাহার যাইবার জো নাই। এই সমৃদ্ধ বৃহৎ পরিবারে অনুবিদ্ধ এমন কতজনের পুরুষানুক্রমের ইতিহাস মিলে। দয়াময়ীর অবাধ্য সন্তান দ্বিজদাসও কাল বলিয়াছিল, তাহার মা, দাদা, বৌদি, তাহাদের গৃহদেবতা, অতিথিশালা সমস্ত লইয়াই সে,—তাহাদের হইতে পৃথক করিয়া বন্দনার কোনদিন তাহাকে পাইবার সম্ভাবনা নাই। তখন বন্দনা অস্বীকার করে নাই বটে, তবু আজই এ কথার যথার্থ তাৎপর্য বুঝিল।
কথা শেষ হয় নাই, অনেক কিছু জানিবার আগ্রহ তাহার প্রবল হইয়া উঠিল, কিন্তু বাধা পড়িল। চাকর আসিয়া জানাইল রায়সাহেব ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন, ছ’টা বাজিয়াছে। যাত্রা করিবার সময় একঘণ্টার বেশি নাই। প্রস্তুত হইবার জন্য বন্দনাকে উঠিতে হইল।
যথাসময়ে রায়সাহেব নীচে নামিলেন, নামিতে নামিতে মেয়ের নাম ধরিয়া একটা হাঁক দিলেন, বন্দনার কানে আসিয়া তাহা পৌঁছিল। অন্যায় যতবড় হউক, অনিচ্ছা যত কঠিন হউক যাইতেই হইবে। বারংবার জিদ করিয়া যে ব্যবস্থা নিজে ঘটাইয়াছে তাহার পরিবর্তন চলিবে না। ঘর হইতে যখন বাহির হইল এই কথাই সর্বাগ্রে মনে হইল, ভবিষ্যতে যতদূর দৃষ্টি যায় কোনদিন কোন ছলেই এখানে ফিরিয়া আসার সম্ভাবনা নাই, কিন্তু তাহার অনেক সুখের স্বপ্ন দিয়া এই ঘরখানি যে পূর্ণ হইয়া রহিল তাহা কোনকালে ভুলিতে পারিবে না। সোজা পথ ছাড়িয়া দ্বিজদাসের পাশের বারান্দা ঘুরিয়া নামিবার সময়ে সে ঘরের মধ্যে একবার চোখ ফিরাইল। কিন্তু যে জানালাটা খোলা ছিল তাহা দিয়া দ্বিজদাসকে দেখা গেল না।
মোটরের কাছে দাঁড়াইয়া দত্তমশাই, রায়সাহেব তাঁহাকে ডাকিয়া ভৃত্যদের দেবার জন্য অনেকগুলা টাকা হাতে দিলেন এবং হঠাৎ যাবার জন্য অনেক দুঃখ প্রকাশ করিয়া দ্বিজদাসের খবরটা তাঁহাকে অতি শীঘ্র জানাইবার অনুরোধ করিলেন।
গাড়িতে উঠিবার পূর্বে বন্দনা অন্নদাকে একপাশে ডাকিয়া লইয়া বলিল, দ্বিজুবাবুর তুমি দিদি—তাঁকে মানুষ করেছ,—এই আংটিটি তোমার বৌমাকে দিও অনুদিদি, যে যেন পরে, এই বলিয়া হাতের আংটি খুলিয়া তাহার হাতে দিয়াই বাবার পাশে গিয়া বসিল।
মোটর ছাড়িয়া দিল। এখানে-ওখানে দাঁড়াইয়া কয়েকজন ভৃত্য ও দত্তমশাই নমস্কার করিল।
বন্দনা নিজের অজ্ঞাতসারেই উপরে চোখ তুলিল, কিন্তু আজ সেখানে আর একদিনের মত সকলের অগোচরে দাঁড়াইয়া নিঃশব্দ সংকেতে বিদায় দিতে দ্বিজদাস দাঁড়াইয়া নাই। আজ সে পীড়িত,—আজ সে নিদ্রায় অচেতন।