বিপ্রটিকুরী যাত্রা
বিপ্রটিকুরী যাত্রা নিয়ে বাড়ি গরম—সকাল থেকেই কথা বললেই জয়ন্ত চটে যাচ্ছে। বিরক্ত।
আরে বিপ্ৰটিকুরী কোথায়, কোন স্টেশনে নামতে হবে, সেখান থেকে কোন বাস ধরতে হবে সেসবের বিন্দুবিসর্গ জানা নেই! এরা কী ভাবে! তুই গেছিস, তোর বাবাকে বল দিয়ে যেতে। না, আমায় তিনি যেতে লিখেছেন। মেলোমশাই আমাকে নিয়ে যান। আমি কি বসে আছি। বাড়ির লোকজনও হয়েছে তেমনি! মাসিমা ফোন করেছে ভাগীরথীকে নিয়ে আসতে। মাসিমার সঙ্গে যাবে, আবার চলে আসবে। চলে আসবে যখন আসবে। আমি যেতে পারব না। আমার কি বাড়িতে দাসখত দেওয়া আছে!
ভিতর থেকে জবাব আসছে, মাথা গরম করছ কেন বুঝি না। অফিস থেকে উপরতলার মাসিমাকে ফোন কর না? ফোন করলেই জানতে পারবে। বলে দেবে সব।
–ফোন করেছি। মাসিমা নেই। কবে আসবেন তাও বলেননি। মেয়ে না কার বাড়ি গেছেন। না আমি বুঝি না, তুই গেলি মাসিমার সঙ্গে, চলে এলি না কেন! কোথায় বিপ্ৰটিকুরী সেখানে যেতে হবে। বাড়ি অচল—বোঝ! বাড়ি থাকলে তো তুই ভাগীরথী এটা করলি না, ওটা করলি না, না তোকে দিয়ে হবে না! হবে না, হবে না করেও তো পাঁচ বছর কাটিয়ে দিলে। দু-এক হপ্তার জন্য গেলে মাথা গরম। এত করে বলি—পেছনে লেগ না, গেলে আর আসবে না। নাও ছোটো বিপ্রটিকুরী।
–ও তো আসতেই চাইছে। ওকে না নিয়ে এলে আসবে কী করে! তোমার কথাবার্তা শুনে তো মনে হয় বিপ্রটিকুরী এ গ্রহের নয়। অন্য কোনো গ্রহে। বাড়ি অফিস করলে এই হয়। কোথাও যাবার কথা হলেই মাথায় বাজ পড়ে। মাসিমা তো একবার বলেছিল, বিপ্রটিকুরী যেতে হলে বোলপুরে নামতে হয়। সেখান থেকে বাসে। বোলপুর গেলেই খবর পেয়ে যাবে।
জয়ন্ত অফিস বের হবার মুখে জুতোর ফিতে বাঁধছিল। সে রা করছে না। সত্যি একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে বিপ্রটিকুরীর নামে। বাড়িতে আর কেউ নেই যে যাবে। বড়োছেলে চাকরি নিয়ে বাইরে। ছোটোমেয়ের পরীক্ষা—যেন পরীক্ষা না থাকলে মাধুই যেত ভাগীরথীকে আনতে। তুমি পুরুষমানুষ পার না, দেখ আমি মেয়ে হয়ে পারি কি না।
জয়ন্ত ভেবে দেখল, অশান্তি করে আর লাভ নেই। সময়ে চা, সময়ে জলখাবার, চানের গরম জল। পাঁচ-সাত বছর থেকে ভাগীরথী সংসারে কার কী দরকার সব এত জানে যে রাগ করে ছেড়ে দিলেই আর এক ফাঁপরে। ভাগীরথী মতিলালের মাসির সঙ্গে ফিরে না আসায় ধরেই নিয়েছিল ওর বাবা বিয়ের ব্যবস্থা করছে। মেয়েটি বড়ো ঠান্ডা মেজাজের। কথা কম বলে, এত কালো যে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলেও তাকে দেখা যায়। কালোর মধ্যে আরও গভীর কালো ছাপ মানুষের।
আর এও আশ্চর্য ভাগীরথী অন্ধকার বড়ো ভালোবাসে। অন্ধকারে চুপচাপ বসে থাকারও একটা নেশা আছে। কিছু চাইতে জানে না। বাড়ি থেকে তার চিঠি এলে পড়ে শোনানো হয়, ওতে সে খুশি না অখুশি ঠিক বোঝা যায় না। একটাই দোষ, বেশি খায়। পাঁচ-সাত বছর শহরে থেকেও বেশি খাওয়ার অভ্যাস পালটাতে পারেনি। বিশ-বাইশ দিনে টের পেয়ে গেছে ভাগীরথী না থাকলে সবাই বিশ বাঁও জলে। জয়ন্ত নিজেও। আজই সে অফিসে জেনে নেবে বোলপুর কোন ট্রেনে গেলে সবিধা। কতক্ষণ লাগে। ফিরে আসা যাবে কি না, না বোলপরে হল্ট করতে হবে। কোথাও না বের হয়ে কখন কোথাকার কোন ট্রেন ছাড়ে কিছুই জানে না। অফিসে এসে সে জানল, শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসেই সুবিধা। ন-টা চল্লিশে ট্রেন। বারোটার মধ্যে পৌঁছে গেল, ঘণ্টাখানেক বাসে—এই আড়াইটে ধরে নেওয়া যাক, বোলপুরে ফিরতে চারটে। পাঁচটা সাড়ে-পাঁচটায় ট্রেনে, না হয় বাসে বর্ধমানে–তারপর কলকাতা। কলকাতা মানেই নিশ্চিন্তি। শেষে পৌঁছে যাওয়া।
সকালে সেদ্ধ ভাত খেয়ে জয়ন্ত বের হয়ে পড়ল। আসলে সে ভীতু স্বভাবের। রওনা হবার সময় মাধু বলল, চাদর নিয়েছ তো! এখানে শীত নেই, গাঁ-জায়গায় শীত লাগতে পারে। বাইরে বের হচ্ছ, সঙ্গে বেশি টাকা রেখো।
জয়ন্ত মুখ ব্যাজার করে রেখেছে! যেন সে নির্বাসনে যাচ্ছে। কে বলবে এই সে এক মানুষ, গাঁয়ে জন্মেছে গাঁয়ে বড়ো হয়েছে। শহরে এসে বাড়িঘর করার পর নিজের গাঁয়ে ছাড়া আর কোথাও যেতে ভালো লাগে না—এমনই স্বভাব তার—আর তারই মধ্যে ফ্যাসাদের মতো বিপ্রটিকুরী হাজির-ঝকমারি আর যাকে বলে! খুব সে মিশুঁকেও নয়। একা একা সারাটা দিন-না, ভাবতে গেলেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। তবু যাবে, মরণ হয় সেও ভালো, বুঝবে নিজেদের কাজ নিজেরা করে নিতে না পারলে কী বিপাকে পড়তে হয়। হাতের কাছে জল, গ্যাস, ফ্রিজ এতসব আছে তবু কেউ কুটোগাছটি নাড়বে না। এই ভাগীরথী, বিছানা করেছিস? এই ভাগীরথী জামা-প্যান্ট ভিজিয়ে দে। এই ভাগীরথী জুতো পালিশ করে দে। সবার ফরমাস। আর পারেও মেয়েটা। মুখে রা নেই। চুপচাপ সবাইকার ফাইফরমাস খেটে দুপুরের খাওয়া হলে ওর বিশ্রাম। তখন সে বাথরুমে অনেকক্ষণ ধরে চান করবে, অনেকক্ষণ ধরে রান্নাঘরে বসে খাবে—তারপর ছাদে উঠে রোদে চুল শুকোবে। চুলও বটে, কালো আর ততোধিক ঘন। খোঁপা বাঁধলে বিশাল। অবসর সময়টায় সারাক্ষণ চুলের যত্ন। চুলই তার গর্ব। যা দেখবার মতো চুল—এই অহংকার ভাগীরথী করতেই পারে।
মাঝে মাঝে জয়ন্ত ভাবে, এই ভাগীরথী তাহলে সংসারটা ধরে রেখেছে। পাঁচ বছরে দুবার গেছে, দুবারই মতিলালের মাসির সঙ্গে ফিরে এসেছে। এবারেও বলেছিল, চলে আসবে। এল না বলে দুশ্চিন্তা—তা বিয়ে-টিয়ে দিলে খবর দিতে বলা হয়েছিল। খবর এসেছে, আমাকে নিয়ে যান।
জয়ন্ত একবার ভেবেছিল টাকা মানিঅর্ডার করে দেবে। ওর বাবা যেন দিয়ে যায়। কিন্তু মাধুর এক কথা—না, অভাবী মানুষ, টাকা পাঠালেই খরচ করে ফেলবে। তাছাড়া ওর বাবা গাঁয়ের বাইরে যেতে চায় না। কলকাতায় এলে হারিয়ে যাবে, আর তার ফেরা হবে না, এমনও নাকি আতঙ্ক আছে। ভাগীরথীর অসুখের সময় এটা জয়ন্ত আরো বেশি বুঝেছে। শত হলেও পরের মেয়ে—সে জানিয়েছিল, ভাগীরথী হাসপাতালে। এপেনডিসাইটিস অপারেশন। তবু কেউ আসেনি। খবর নেয়নি। এই পরের মেয়ে এমন যে সে নিজের পুরো নামটাও বলতে পারে না। বলবে—আমার নাম ভাগু।
ভাগু কী?
ভাগু কী এই কথায় ভাগীরথী চেয়ে থাকে। তার বাবার ঠিকানা মাধুর কাছে আছে। মাধুই মাসে মাসে ওর বাবার নামে টাকা পাঠিয়ে দেয়। বাবার নাম মোহন দাস। সুতরাং ভাগু দাসী। ভাগু যে আসলে ভাগীরথী বিপ্রটিকুরী না গেলে জয়ন্ত জানতেই পারত না। সেই ভাগু গ্যাসে রান্না করে। মাধু তাকে হাতে ধরে সব শিখিয়েছে। রান্না, ঘরমোছা থেকে সব। কাপড় কাচাও। ভাগু মোটামুটি সব কাজ একাই সামলাতে পারে। অথচ ভাগু কিছু চাইতে জানে না।
জয়ন্ত হাওড়ায় এসে শুনল, শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস যাবে না। বুধবার শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ছাড়ে না। কেমন মাথা গরম হয়ে গেল। অফিস ছুটি করে বের হয়ে পড়েছে। বোলপুরে আর কোন ট্রেনে যাওয়া যায়। সে খোঁজ নিতে, থাকল। বাইরে বের হলে সে টের পায়, সেও আর এক ভাগু। এত লোকজন, এত কাউন্টার, এত গাড়ি যে, কোনটায় উঠে শেষে কোথায় গিয়ে উঠবে ভাবতেই কেমন আতঙ্কে পড়ে গেল। সে একজন চেকারকে সামনে পেয়ে খুবই বিনয়ের সঙ্গে বলল, স্যার একটা অ্যাডভাইস চাইছি।
জয়ন্ত মধ্যবয়সী মানুষ, এবং অভিজাত চেহারা। অ্যাডভাইস চাইছে! চেকার ভদ্রলোকও গলে গেল।বলুন।
–বোলপুর যাব। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ছাড়ছে না—কোন ট্রেনে গেলে সুবিধা হবে।
–দানাপুর এক্সপ্রেসে যেতে পারেন।
–কটায় ছাড়বে।
–এগারোটা ত্রিশে।
মাথায় বাজ। সে বলল, কতক্ষণ লাগবে?
–ঘণ্টা তিনেক।
তাহলে আজ আর ফেরা যাবে না। আসলে সে যতক্ষণ ফিরে আসতে না পারছে, ততক্ষণ ভূতের মতো ফেরার আতঙ্কটা মাথায় চেপে বসে থাকবে। অজানা অচেনা জায়গায় থাকারও বিড়ম্বনা। নিজের ঘর-বাথরুম ছাড়া সে কিছু বোঝে না। বাইরে বের হলে এই অস্বস্তিগুলি আছে। এত রাগ হচ্ছিল মাধুর উপর যে সে আর কোনো কথা বলতে পারছে না।
মাধুর জন্যই ভাগু মাঝে মাঝে বাড়ি যাবার তাড়া বোধ করে। বোকা বলে অপমান বুঝবে না কেন!-তোকে দিয়ে হবে না। এখন কেন ছুটতে হচ্ছে! ভাগুকে বোকা অচল বললে রাগ করে যখন, বলতে যাও কেন! সে বলল, এর আগে কোনো ট্রেন নেই? আমি আজই ফিরতে চাই।
চেকার ভদ্রলোক বললেন, তুফানে চলে যান। বর্ধমান নেমে কোনো লোকাল পেয়ে যেতে পারেন। এক্ষুনি ছাড়বে।
যেন কিছুটা অস্বস্তি কেটে গেল। গাড়িতে উঠে দেখে তিলমাত্র জায়গা নেই। ইস দুঘণ্টা এইভাবে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে! কত ধানে কত চাল। এ-সময় সে যেন নিজেকে কষ্ট দিয়ে বাড়ির উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। ভাবছে ফিরে গিয়ে এক চোট নেবে।
ট্রেন ছেড়ে দিল। একটুও হাওয়া ঢুকছে না। সে হাঁসফাঁস করছে। বিপ্রটিকুরী যাত্রা এমন একটা মারাত্মক বিষয় আগে যদি জানত! দুর্ভাগ্য কাকে বলে।
বর্ধমানে নেমে শুনল, না কোনো লোকাল নেই। সেই দানাপুর এক্সপ্রেসের জন্যই বসে থাকতে হবে।
প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। রাস্তার জলটল সে খায় না। জন্ডিস থেকে উঠেছে বছরও পার হয়নি। রেলের ক্যান্টিনে খেয়ে নিলে হয়। আর খাওয়া জুটবে কিনা তাও জানে না। একা কোথাও বের হলেই সে বড়ো অসহায় বোধ করে। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তবু রেলব্রিজ পার হয়ে ক্যান্টিনে খেতে গিয়ে বুঝল, এত মোটা চালের ভাত তার সহ্য হবে না। এত বিশ্রী রান্না যে সে কোনোরকমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছুটা খেল, বাকিটা সে ফেলে রাখল। জোড়া ডিমের ঝোল। বোঁদা লাউয়ের ঘন্ট। নেড়েচেড়ে উঠে পড়ল। জীবনে একটা সময় সব সহ্য হত, আর এক জীবনে সবই অসহ্য। মানুষের শরীরে যে এত বিশ্রী গন্ধ থাকে ভিড়ের ট্রেনে সে টের পেয়েছে। গাঁয়ের মানুষজন, গরিব, জনমজুর—সব যেন কাক-চিল হয়ে চারপাশে উড়ছে। দানাপুর এক্সপ্রেস কখন আসবে!
তার পাশে এত মানুষজন, তবু এত একা কেন বুঝছে না। আসলে অভ্যাস মানুষকে খুবই আলগা করে দেয়। এই ভিড়ের মানুষজনের সঙ্গে সে নিজেকে যেন মেলাতে পারছে না। কারো সঙ্গে কথা বললে হয়—কী নিয়ে বলবে! রাজনীতি, না কারো কোনো আগ্রহ নেই। ক্রিকেট টেস্ট চলছে। কেউ ট্রানজিস্টার কানে লাগিয়ে শুনছে না। সব মানুষকে মনে হচ্ছে সত্যি আলাদা গ্রহের।
দানাপুর এলে মাথায় হাত। কোনো কামরায় সে উঠতে পারছে না। ঠেলা খেয়ে নেমে আসছে। গাড়ি ছেড়ে দেবার সময় হাতল ধরে ঝুলে পড়ল। কপালে যা আছে। গুসকরায় গিয়ে মনে হল সে আর পারছে না। যে-কোনো মুহূর্তে কিছু একটা হতে পারে। পাশের লোকটা বলল, আর একটা স্টেশন! সামনে বোলপুর। জয়ন্ত আবার লাফিয়ে হাতল চেপে ধরল। মাঠের ভেতর দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন যাচ্ছে। সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। হুহু করে হাওয়া বইছে। যেন তাকে
উড়িয়ে দেবে। সে চোখ বুজে ছিল।
—বিপ্রটিকুরী কতদূর।
—কেউ জানে না কতদূর।
জয়ন্ত বলল, কে জানে?
–এগিয়ে যান। তারপর কে যেন বলল, বাসস্ট্যান্ডে যান—খোঁজ নিন।
–বিপ্রটিকুরীর বাস কটায়?
—এই আসে এই যায়, একজন বলল।
—কোথায় পাওয়া যাবে?
—এখানে না। দূরপাল্লার বাস এখান থেকে ছাড়ে।
সন্ধ্যা হয়ে গেল। চায়ের দোকানদারকে সে বলল, তুমি জান ঠিক সকাল পাঁচটায় বিপ্রটিকুরীর বাস!
-তাই তো মনে হয় স্যার।
–ঠিক কটায় বলতে পার না?
–না স্যার। ঠিক বলা যাবে না। বাসের মর্জি।
আর যাই করা যাক, আজ আর যাওয়া হবে না। চেনাজানা নেই, অজ্ঞাত পরিচয় একজন মানুষকে কে আশ্রয় দেবে! বিপ্রটিকুরী থেকে হাঁটা পথে ক্রোস খানেক। কেউ বলল, মশায়ের মাথা খারাপ। ফিরে যান। দেখছেন না, যেখানে সেখানে খুনখারাবি হচ্ছে, অচেনা লোক দেখলেই সন্দেহ। জয়ন্ত তাড়াতাড়ি একটা রিকশাকে ডেকে বলল, কাছে কোথাও কোনো ভালো হোটেল আছে ভাই।
—আছে স্যার। যোগমায়া হোটেল। চলুন। ফাস্ট ক্লাস!
আর ফাস্ট ক্লাস, এখন বলির পাঁঠা—কী যে রাগ হচ্ছে। জয়ন্তর মুখ থমথম করছে। হোটেলে ঢুকে ঘরভাড়া ত্রিশ টাকা, খাওয়া খরচ আলাদা। হোটেলের ভিতরের দিকে উঠোনে গাছপালা, গোরু-মোষ। ঘরটার লাগোয়া মেয়েদের বাথরুম। সারারাত দরজা খোলা-বন্ধ করার শব্দ। এটাচড বাথ বলতেই হোটেলওয়ালা কেমন ঘাবড়ে গেছিল। লোকটা বলে কী!
কিছু করার নেই। সারা রাত অনিদ্রায় কাটাতে হবে। বিছানায় চাদরে দুর্গন্ধ। জয়ন্ত কোনোরকমে বলল, এক গ্লাস জল খাওয়াতে পারো ভাই। হোটেল বয় জল আনল, ঘোলা। যা হয় হবে। সে আর পারছে না। এ-সময় দেখল উঠোনে একটা বড়ো মোষ চড়াচ্ছে, ছর ছর করে শব্দ। কোনোরকম রাতটা কাটিয়ে শেষ, পর্যন্ত জীবন নিয়ে বিপ্ৰটিকুরী রওনা হতে পারলে হয়। ভাগীরথী তোর কী যে এত দরকার পড়ল বুঝি না। থেকে গেলি। মতিলালের মাসির সঙ্গে ফিরে গেলে তোর মেসোর এই ভোগান্তি হয় না। রাতে সেই মোটা চালের ভাত। কাঁকর মেশানো। দাঁত আস্ত থাকছে না। আসলে জয়ন্ত বুঝতে পারছে, বিশ-বাইশ বছর আগের জয়ন্ত আর সে নেই। নিশ্চিন্ত চাকরি, স্ত্রীর চাকরি, বাড়িঘর বানিয়ে হালফ্যাসানের মানুষ সে। পূজার ছুটিতে বের হলে বার্থ রিজার্ভ করা ট্যুরিস্ট লজ বুক করা অথবা কোনো বনে-জঙ্গলে ঢুকে গেলে সঙ্গে ফরেস্ট অফিসারের গাড়ি। টিফিন, জল সব সঙ্গে। রাগ করে সে কিছুই সঙ্গে নেয়নি। যাবে কী করে জানে না, কোথায় যাচ্ছে জানে না, সবই যখন অনিশ্চিত, তখন আর টিফিন কতটা নিশ্চয়তা দেবে!
হোটেলওয়ালাকে সে বলল, দেখুন পাঁচটায় বাস-আপনার জানাশোনা কোনো রিকশা আছে, আগে বলে রাখলে বাস ঠিক ধরিয়ে দেবে? টাকার জন্য ভাববেন না।
—এই গোদা! শোন বাবু কী বলছে! গোদা হাজির।
-বাবু পাঁচটার বাস ধরবে। ধরিয়ে দিবি। পারবি কি? গোদা ঘাড় কাত করে চলে গেল। আর চারটেয় উঠে হাতমুখ ধুয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হতেই দেখি করিভোরে গোদা বসে আছে। কোলাপসিবল গেট খুলে রিকশা বের করে বলল, কোথায় যাওয়া হবে বাবুর?
এইরে! কোথায় যাওয়া হবে। সে বলল, বিপ্রটিকুরীর বাস ধরব পাঁচটায়।
–রাত থাকতে বাস ছাড়ে! কার বাস?
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ভোর পাঁচটায় কতটা অন্ধকার থাকে তার জানা নেই। তবু পাঁচটার বাস না ধরতে পারলে জীবনেও বোধহয় বিপ্রটিকুরী বাস সে আর ধরতে পারবে না। ভয়, কৌতূহল এবং অস্বস্তি নিয়ে সে রিকশায় উঠে বসল। গোদা ঠিকই বলেছে। রাস্তায় একটা লোক নেই। কুকুর বাদে কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে সাড়ে-চারটেয় বের হয়েছে। সে বলল, গোদা ভাই, তুমি জান বিপ্রটিকুরী কোথায়? গোদা মাথা-কান গামছায় ঢেকে নিয়েছে। আর ঠান্ডা হাওয়ায় শুনতেও পাচ্ছে না বোধহয়। সে বলল, এই গোদা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ! তার মনে হল গোদা ঠিক পথে যাচ্ছে না। গোদার কি কোনো কু-মতলব আছে। এখনো রাত, অন্ধকার, সব নিঝুম।
ইতস্তত জোনাকির মতো আলো, ঘরবাড়ি কোথাও স্পষ্ট, কোথাও আবছা। গোদা এত নীরব যে সে সওয়ারি নিয়ে যাচ্ছে, না মরা কুকুর নিয়ে যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। জয়ন্ত কেমন ভয় পেয়ে চিৎকার করে ডাকল, এই গোদা কোথায় ছুটলি বাবা!
-এই যে এসে গেছেন বাবু।
সত্যি সে এসে গেছে। কাল সাঁঝবেলাতে কী ভিড়, মানুষজন খুরিতে চা খাচ্ছে। এখন একেবারে ফাঁকা। লম্বা বেঞ্চগুলি আর ভেঁড়া ত্রিপল ছাড়া কিছু নেই, মাথার উপর গাছটা অশ্বত্থ হবে, পাখির কলরব, দুটো কুকুর উনুনের ভিতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে এল। আর কোনো কাক-প্রাণী নেই—গাড়ি নেই, রিকশা নেই, কেমন এক মৃত শহরে দাঁড়িয়ে আছে যেন জয়ন্ত। গোদা বলল, বাস এলেই উঠে পড়বেন। বাস এলেই উঠে পড়তে বললে কেন। গোদা দাঁড়াল না। আসলে সে নিজের মধ্যে আছে তো! অচেনা জায়গায় ভূতুড়ে অন্ধকার তাকে কেমন গ্রাস করছিল। শুধু কুকুর দুটো আছে। ঘড়ি দেখে সে আরো মুষড়ে পড়ল। বের হবার সময় সাড়ে-চারটে দেখেছে, এখন চারটে। এ কিরে বাবা, কাঁটা পেছনে ঘুরছে! ঘড়ি পর্যন্ত বিভ্রাট করছে! না কি চারটেয় বের হয়েছে, মাথা গরম বলে, অনিদ্রা গেছে বলে চোখের ভুল। এইসময় গা-টা তার কাঁটা দিয়ে উঠল।
বুধবার শান্তিনিকেতন বন্ধ সে জানত না। বুধবার দেরিতে রাত শেষ হয় এখানে—সে জানত না। বুধবার ঘড়ির কাঁটা পেছনের দিকে হেঁটে যায় জানত না। গোদা পাঁচটা টাকার বিনিময়ে তেমাথায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে গেছে। এখন যে কেউ এসে তাকে বলতে পারে, যা আছে দিন। সে ঠিকই করেছে, সব দিয়ে দেবে। কোট খুলে দেবে। হাতঘড়ি খুলে দেবে। বেশি টাকা যা আছে দিয়ে দেবে। রাত এত নিশুতি হয়, রাত এত নির্জন হয়, রাত এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে এর আগে সে টের পায়নি। তেমাথা জায়গা কোনোদিন ভালো হয় না। ছেলেবেলার সংস্কার আবার মাথায় পোকা হয়ে ঢুকে গেছে।
রাস্তার আলো, দূরে মাঠ পার হয়ে বাড়ি-ঘরের আলোর রহস্য ক্রমেই ভূতুড়ে হয়ে উঠছে। গাছপালার পাতা ঝরছে। সামান্য ঘূর্ণিঝড় উঠল। না—আর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে সে পড়ে যেতে পারে। ঠকঠক করে কাঁপছে। ঘড়ি দেখবে, তাও ভয় হচ্ছে। যদি দেখতে পায় কাঁটা সাড়ে-তিনটের ঘরে ঢুকে গেছে। আধঘণ্টা হয়ে গেল, তবু আকাশ ফর্সা হচ্ছে না। সে রাস্তার আলোতে আবার ঘড়িটা দেখবে ঠিক করল। যা হয় হবে। বের হবার সময়ই মনে হয়েছে, বিপ্রটিকুরী বড়ো বেশি অচেনা জায়গা। আর তখনই দেখল, দুটি জীব দুলতে দুলতে এদিকে এগিয়ে আসছে। ঘোড়া, গোরু না কুকুর, না ঘোড়া নয়, ঘোড়া এভাবে হাঁটে না, গোরুও নয়, গোরু এভাবে হাঁটে না। কুকুর অত যদি বড়ো হয় তবে তার যাও সাহস অবশিষ্ট আছে সেটুকু নীল হয়ে যাবে। মানুষজন যদি কখনো এখানে আসেই দেখতে পাবে কেউ ভয়ে মরে পড়ে আছে।
ধীরে ধীরে বেশ চালে আসছেন। যত আসছেন, তত জয়ন্ত বড়ো বড়ো চোখে দেখছে। ও-তেনারা দুজন গাধা। রাত থাকতেই বের হয়ে পড়েছেন। সব জোড়ায় জোড়ায়। এক জোড়া কুকুর উনুন থেকে উঠে পথ শুকতে শুকতে চলে গেল। একজোড়া গাধা চলে গেল। তারপরই গেল একজোড়া ঢাকি। চোখের উপর দিয়ে চলে গেল। সে ডাকল, তারা সাড়া দিল না।
সে বোধহয় ভিরমি খেত। আর তখনই পাশের একটা দোকানের ঝাঁপ উঠে গেল। লোকটা বের হয়ে তার সামনেই পেচ্ছাপ করতে বসল। গাছের অন্ধকারে তোকে দেখতে পাচ্ছে না। সে ডাকল, ও দাদা—আপনি কি আবার ঘুমোতে যাচ্ছেন? লোকটার ঘুমের ঘোর কাটেনি বোধহয়। বলল, কে?
–বিপ্রটিকুরীর বাস ধরব আশায় বসে আছি। কটা বাজে।
লোকটা বিন্দুমাত্র দাঁড়াল না। দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল। ঝাঁপ বন্ধ করে দিল। ঘড়ি দেখতেই হয়। যা হয় হবে। ঘড়িটা চলছে। অথচ ঘড়ির কাঁটা পেছনের দিকে ঘুরছে। আবার যদি তাই দেখে! হয় হোক ভেবে তবু সে যা দেখল। চলছে সামনে চলছে। সাড়ে চারটে—এবারে সে কিছুটা সাহস পেয়ে গেছে। আসলে উদ্বেগ, দুর্ভাবনা এবং ভয় তাকে সারারাত জাগিয়ে রেখেছে। সে আসলে বের হয়েছে চারটের আগে। ঘড়িতে সাড়ে-তিনটে দেখতে সাড়ে-চারটে দেখেছে। এখন আর তার ভয় লাগছে না। ভাগীরথীকে নিতে এসে এটা সে কত বড়ো ধৈর্যের পরীক্ষা তার বাড়ির লোক যদি বুঝত।
পাঁচটায় বাস এল সাড়ে-সাতটায়। একজন বলল, পাঁচটায় বাস বিপ্রটিকুরী থেকে ছাড়ে। সাড়ে-ছটায় আসে। সাড়ে-সাতটায় রওনা হয়।
-একখানা বাস।
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
তা শেষ পর্যন্ত বাসে সে সামনের দিকে সিট পেয়ে গেল। একটা ব্রিজ পার হয়ে বাসটা থেকে নেমে সামনে কিছু ঘরবাড়ি পার হতেই দুপাশে শীতের মাঠ। তার ভালো লাগছিল। এখন ভাগীরথীকে নিয়ে ঠিক ঠিক ফিরতে পারলে হয়। ভাগীরথীর আঁচলে তার ঠিকানা লিখে একটা কাগজে গিঁট মেরে দিতে হবে। এত হাবা কিছুতেই বাপের নাম, নিজের নাম, তার নাম মনে রাখতে পারে না। নিয়ে যাবার সময় পথে হারিয়ে গেলে আর এক কেলেঙ্কারি। পরের মেয়ে নিয়ে কত দায় মাধু যদি বুঝত।
শেষ পর্যন্ত বিপ্রটিকুরী পৌঁছোন গেল। জয়ন্ত রাস্তাতেই মতিলালের বাড়ির খবর নিতে গিয়ে জানল, ওরা ওখানকার জমিদার বাড়ির বৌ। জমিদারি যাবার পর সব এখানে ওখানে ছিটকে পড়েছে। দু-চার শরিক এখনো আছে—জয়ন্তর এ যেন আর এক তেলেনাপোতা আবিষ্কার। সে পরিচয় দিতেই একজন তরুণ বের হয়ে এল। বেশ ছিমছাম যুবক। গালে দাড়ি সবে উঠেছে। চেহারা বেশ মার্জিত। গাঁয়ে এইরকমের চেহারা বড়ো একটা দেখা যায় না। আসলে অভিজাত পরিবারের ছেলে। জয়ন্ত তার পরিচয় দিলে সে বলল, ভেতরে আসুন!
জয়ন্ত এখানে তেলেনাপোতা আবিষ্কারের মতো এক যুবতীকেও আবিষ্কার করে ফেলল। দোতলা বাড়ি, ভাঙা ঘর-দালান, পলেস্তারা খসা, চুন-সুরকি ঝুর ঝুর করে খসে পড়ছে। কোথাও দেয়ালের সামান্য রসটুকু নিঠুর বটের চারা শুষে নিচ্ছে। বাড়িতে ঢুকতে তার ভয় করছিল। দোতলায় উঠে বুঝল, সে হাঁটলে বাড়িটা কাঁপে। ভাগীরথীর খবর এদের কাছ থেকেই তার জেনে নেবার কথা। যুবতী গা ঢেকে বারান্দায় এসে উঁকি দিয়ে চলে গেল। প্রৌঢ়া মহিলা এসে বললেন, আমার জা হয়। দারিদ্র্য এবং হতাশা আড়াল দেবার জন্য শাড়ি-সায়া পালটে এসেছেন বোঝা যায়। কিন্তু মুখে-চোখে দুশ্চিন্তার আভাস টের পাওয়া যায়।
জানলা দিয়ে গ্রামটা দেখা যায়। এককালে বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল বোঝা যায়। এখন চারপাশে ছোটো ছোটো সব কুঁড়েঘর, দূরে স্কুলবাড়ি, পিছনে দাওয়া। কোনো ভগ্নস্তূপের ভিতর থেকে সে একটা মন্দিরও দেখতে পেল।
সে বলল, বসব না। ভাগীরথীর চিঠিটা সে দেখাল।
তরুণের নাম বাদল। সে চিঠিটা হাতে নিয়ে উলটেপালটে দেখল। তারপর
বলল, ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে।
-বিয়ে! তবে যে চিঠি লিখল।
–হ্যাঁ। বিয়ে মানে—বলে আমতা আমতা করতে থাকল। প্রৌঢ়াই বললেন, ও আর বিয়ে। ওর মা-বাবা ওকে আসলে বেচে দিয়েছে। হপ্তাখানেক আগে এলে পেতেন।
-কী বলছেন!
–এদিকটায় হামেশা এমন হচ্ছে। অভাবের তাড়না!
জয়ন্ত হতবাক। সে তাকিয়ে আছে।
—কী করবে! বড়ো গরিব। খেতে পায় না। বেচে না দিয়েও উপায় ছিল না। একসঙ্গে এত টাকা কে দেয়!
—কিন্তু।
-কিন্তু আর কী! আপনি তো কাগজের লোক। গ্রামটা ঘুরে দেখে যান না। লিখুন। গরিব চাষাভুষো মানুষের কী অবস্থা দেখে যান।
জয়ন্ত সহসা কেমন ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। আপনারা থাকতে–সে তোতলাতে থাকল, একটা নিরীহ মেয়েকে, না আমার মাথায় আসছে না। এখানে পার্টির লোকেরা কিছু বলে না?
—কী বলবে? এটা তো গণতান্ত্রিক ব্যাপার। বাবা-মা তার মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছে, তার কী বলার আছে!
-বিয়ে?
–ওই শো একটা। তারপর মেয়েগুলির আর খোঁজ পাওয়া যায় না। ইস সে যে কী ভুল করেছে! প্রথম চিঠিটাতেই ছিল—মেসোমশাই, আমাকে নিয়ে যান। বিয়ে-টিয়ে কিছু না। এলে জানতে পারবেন। তাড়াতাড়ি আসবেন। কাউকে দিয়ে সে চিঠিটা লিখিয়েছিল। জয়ন্তর এখন নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে। কোথায় কে নিয়ে গেল ভাগীরথীকে। আসলে পাঁচ-সাত বছরে ভাগীরথী তার বাড়িরই কেউ হয়ে গেছিল। ঘরে কুকুর-বেড়াল থাকলেও মায়া পড়ে যায়, আর এ তো মানুষ। তার চোখ সহসা ঝাপসা হয়ে গেল। সে সারা রাস্তায় শুধু নিজেকে নিয়ে ভেবেছে। ভাগীরথীর কথা একবারও মনে হয়নি তার।
সারা রাস্তায় নিজের অস্তিত্ব নিয়ে দুশ্চিন্তার ছিল, ভাগীরথীর অস্তিত্ব নিয়ে তার কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। সেই ভাগীরথী বিক্রি হয়ে গেছে। রাস্তায় নেমে এবার বোলপুরের বাস ক-টায় কাউকে তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল না। সে হেঁটে যাচ্ছে। রোদের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কেমন বেহুঁশ।
চারপাশে খাঁ খাঁ মাঠ। গাছপালাহীন এক দাবদাহ ক্রমে তাকে গ্রাস করতে থাকল। সে নিজেকে এই প্রথম নির্যাতন করে যেন সবার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। যে জানেই না কোথায় যাচ্ছে–কেন যাচ্ছে। ক-টায় বাস, কখন ট্রেন, তার যেন আর জানার দরকার নেই। গরমে সে হাঁসফাঁস করছিল। কোটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল, মাফলার ছুঁড়ে ফেলে দিল, জলের বোতল—সব। তারপর সে হাঁটতে হাঁটতে কখন ক্লান্ত হয়ে গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না। জেগে দেখল, আকাশে অজস্র নক্ষত্র। এই নক্ষত্রের ভেতর সে শীতের রাতে আবার কোনদিকে রওনা হয়ে গেল। সে এত আত্মপর এই প্রথম টের পেয়ে কোনো নিষ্ঠুর জীবনের স্বাদ গ্রহণের ইচ্ছায় উন্মত্তের মতো হাঁটছে। তার এ আর-এক যাত্রা—কে জানে এ-যাত্রার শেষেও আবার কোনো বিপ্রটিকুরী তার জন্য অপেক্ষা করছে কিনা।