বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম

বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম

নিউ মার্কেটের কালীচরণের দোকান থেকে প্রতি সোমবার আপিস-ফেরতা বই কিনে বাড়ি ফেরেন বিপিন চৌধুরী। যতরাজ্যের ডিটেকটিভ বই, রহস্যের বই আর ভূতের গল্প। একসঙ্গে অন্তত খান পাঁচেক বই না কিনলে তাঁর এক সপ্তাহের খোরাক হয় না। বাড়িতে তিনি একা মানুষ। লোকের সঙ্গে মেলামেশা তাঁর ধাতে আসে না, আড্ডার বাতিক নেই, বন্ধুপরিজনের সংখ্যাও কম। সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে যেসব কাজের লোক আসেন, তাঁরা কাজের কথা সেরে উঠে চলে যান। যাঁরা ওঠেন না বা উঠতে চান না, বিপিনবাবু তাঁদের সোয়া আটটা বাজলেই বলেন— ‘আমার ডাক্তারের আদেশ আছে— সাড়ে আটটায় খাওয়া সারতে হবে। কিছু মনে করবেন না…’। খাওয়ার পর আধঘণ্টা বিশ্রাম, তারপর গল্পের বই হাতে নিয়ে সোজা বিছানায়। এই নিয়ম যে কতদিন ধরে চলেছে বিপিনবাবুর নিজেরই তার হিসেব নেই।

আজ কালীচরণের দোকানে বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে বিপিনবাবুর খেয়াল হল আরেকটি লোক যেন তাঁর পাশে কিছুক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছে। বিপিনবাবু মুখ তুলে দেখেন একটি গোলগাল অমায়িক চেহারার ভদ্রলোক তাঁরই দিকে চেয়ে হাসছেন।

‘আমায় চিনতে পারছেন না বোধহয়?’

বিপিনবাবু কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত বোধ করলেন। কই, এর সঙ্গে তো কোনদিন আলাপ হয়েছে বলে তাঁর মনে পড়ে না। এমন মুখও তো কোন মনে পড়ছে না তাঁর।

‘অবিশ্যি আপনি কাজের মানুষ। অনেক রকম লোকের সঙ্গে দেখা হয় তো রোজ—তাই বোধহয়…’

‘আমার কি আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছে এর আগে?’ বিপিনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

ভদ্রলোক যেন এবার একটু অবাক হয়েই বললেন, ‘আজ্ঞে সাতদিন দু’বেলা সমানে দেখা হয়েছে। আমি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলুম—সেই গাড়িতে আপনি হুড্রু ফল্‌স দেখতে গেলেন। সেই নাইনটিন ফিফটি-এইটে—রাঁচিতে! আমার নাম পরিমল ঘোষ।’

‘রাঁচি?’ বিপিনবাবু এবার বুঝলেন যে ভুল তাঁর হয় নি, হয়েছে এই লোকটিরই। কারণ বিপিনবাবু কোনদিন রাঁচি যান নি। যাবার কথা হয়েছে অনেকবার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠে নি। এবার বিপিনবাবু একটু হেসে বললেন, ‘আমি কে তা আপনি জানেন কি?’

ভদ্রলোক চোখ কপালে তুলে জিভ কেটে বললেন, ‘আপনি কে তা জানব না? বলেন কী? বিপিন চৌধুরীকে কে না জানে?’

বিপিনবাবু এবার বইয়ের দিকে দৃষ্টি দিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, ‘কিন্তু তাও আপনার ভুল হয়েছে। ওরকম হয় মাঝে মাঝে। আমি রাঁচি যাই নি কখনো।’

ভদ্রলোক এবার বেশ জোরে হেসে উঠলেন।

‘কী বলছেন মিস্টার চৌধুরী? ঝরনা দেখতে গিয়ে পাথরে হোঁচট খেয়ে আপনার হাঁটু ছড়ে গেল। আমিই শেষটায় আয়োডিন এনে দিলুম। পরদিন নেতারহাট যাবার জন্যে আমি গাড়ি ঠিক করেছিলুম—আপনি পায়ের ব্যথার জন্যে যেতে পারলেন না। কিচ্ছু মনে পড়ছে না? আপনার চেনা আরেকজন লোকও তো গেস্‌লেন সেবার—দীনেশ মুখুজ্যে। আপনি ছিলেন একটা বাংলো ভাড়া করে—বললেন হোটেলের খাবার আপনার ভালো লাগে না—তার চেয়ে বাবুর্চি দিয়ে রান্না করিয়ে নেওয়া ভালো। দীনেশ মুখুজ্যে ছিলেন তাঁর বোনের বাড়িতে। আপনাদের দুজনের সেই তর্ক লেগেছিল একদিন চাঁদে যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে—মনে নেই? সব ভুলে গেলেন? আরো বলছি—আপনার কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ ছিল—তাতে গল্পের বই থাকত। বাইরে গেলে নিয়ে যেতেন। কেমন—ঠিক কিনা?’

বিপিনবাবু এবার গম্ভীর সংযত গলায় বললেন, ‘আপনি ফিফ্‌টি-এইটের কোন্‌ মাসের কথা বলছেন বলুন তো?

ভদ্রলোক বললেন, ‘মহালয়ার ঠিক পরেই। হয় আশ্বিন, নয় কার্তিক।’

বিপিনবাবু বললেন, ‘আজ্ঞে না। পুজোয় সে বছর আমি ছিলুম কানপুরে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। আপনি ভুল করলেন। নমস্কার।’

কিন্তু ভদ্রলোক গেলেন না। অবাক অপলক দৃষ্টিতে বিপিনবাবুর দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলে যেতে লাগলেন, ‘কী আশ্চর্য! একদিন সন্ধ্যাবেলা আপনার বাংলোর দাওয়ায় বসে চা খেলুম। আপনি আপনার ফ্যামিলির কথা বললেন-বললেন, আপনার ছেলেপিলে নেই, আপনার স্ত্রী বারো তেরো বছর আগে মারা গেছেন। একমাত্র ভাই পাগল ছিলেন, তাই আপনি পাগলা গারদ দেখতে যেতে চাইলেন না। বললেন, ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়…’

বিপিনবাবু যখন বইয়ের দামটা দিয়ে দোকান থেকে বেরোচ্ছেন তখনও ভদ্রলোক তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন।

বারট্রাম স্ট্রীটে লাইটহাউস সিনেমার গায়ে বিপিন চৌধুরীর বুইক গাড়িটা লাগানো ছিল। তিনি গাড়িতে পৌঁছে ড্রাইভারকে বললেন, ‘একটু গঙ্গার ধারটায় ঘুরে চলো তো সীতারাম।’

চলন্ত গাড়িতে বসে মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হতেই বিপিনবাবুর আপসোস হল। বাজে ভণ্ড লোকটাকে এতটা সময় কেন মিছিমিছি দিলেন তিনি! রাঁচি তো তিনি যান নি, কখনই যেতে পারেন না। মাত্র ছ’ সাত বছর আগেকার স্মৃতি মানুষে অত সহজে ভুলতে পারে না, এক যদি না—

বিপিনবাবুর মাথা হঠাৎ বন্ করে ঘুরে গেল।

এক যদি না তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়ে থাকে।

কিন্তু তাই বা হয় কী করে? তিনি তো দিব্যি আপিসে কাজ করে যাচ্ছেন। এত বিরাট আপিস—এত দায়িত্বপূর্ণ কাজ। কোথাও তো কোন ত্রুটি হচ্ছে বলে তিনি জানেন না। আজও তো একটা জরুরী মিটিং-এ আধ ঘণ্টার বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি। আশ্চর্য! অথচ—

অথচ লোকটা তাঁর এত খবর রাখল কী করে? এ যে একেবারে নাড়ী-নক্ষত্র জেনে বসে আছে। বইয়ের ব্যাগ, স্ত্রীর মৃত্যু, ভাইয়ের মাথা খারাপ! ভুল করেছে কেবল ওই রাঁচির ব্যাপারে। ভুল কেন—জেনেশুনে মিথ্যে বলছে। আটান্ন সালের পুজোয় তিনি রাঁচি যান নি; গিয়েছিলেন কানপুরে, তাঁর বন্ধু হরিদাস বাগচির বাড়িতে। হরিদাসকে লিখলেই—নাঃ, হরিদাসকে লেখার উপায় নেই।

বিপিনবাবুর হঠাৎ খেয়াল হল হরিদাস বাগচি আজ মাসখানেক হল সস্ত্রীক জাপানে গেছেন তাঁর ব্যবসার ব্যাপারে। জাপানের ঠিকানা বিপিনবাবু জানেন না। কাজেই চিঠি লিখে প্রমাণ আনানোর রাস্তা বন্ধ।

কিন্তু প্রমাণের প্রয়োজনটাই বা কোথায়। এমন যদি হত যে উনিশ শ’ আটান্ন সালের আশ্বিন মাসে রাঁচিতে কোন খুনের জন্য পুলিশ তাঁকে দায়ী করার চেষ্টা করছে, তখনই তাঁর চিঠির প্রয়োজন হত হরিদাস বাগচির কাছ থেকে। এখন তো প্রমাণের কোন দরকার নেই। তিনি নিজে জানেন তিনি রাঁচি যান নি। ব্যস্‌, ল্যাঠা চুকে গেল।

গঙ্গার হাওয়াতে বিপিন চৌধুরীর মাথা অনেক ঠাণ্ডা হলেও, মনের মধ্যে একটা খটকা, একটা অসোয়াস্তিবোধ যেন থেকেই গেল!

হেস্‌টিংস-এর কাছাকাছি এসে বিপিনবাবু তাঁর প্যান্টের কাপড়টা গুটিয়ে উপরে তুলে দেখলেন যে ডান হাঁটুতে একটা এক ইঞ্চি লম্বা কাটা দাগ রয়েছে। সেটা কবেকার দাগ তা বোঝবার কোন উপায় নেই। ছেলেবেলা কি কখনও হোঁচট খেয়ে হাঁটু ছড়ে নি বিপিনবাবুর? অনেক চেষ্টা করেও সেটা তিনি মনে করতে পারলেন না।

চড়কডাঙার মোড়ের কাছাকাছি এসে তাঁর দীনেশ মুখুজ্যের কথাটা মনে পড়ল। লোকটা বলছিল দীনেশ মুখুজ্যে ছিল রাঁচিতে ওই একই সময়ে। তাহলে দীনেশকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়। সে থাকে কাছেই—বেণীনন্দন স্ট্রীট। এখনই যাবেন কি তার কাছে? কিন্তু যদি রাঁচি যাওয়ার ব্যাপারটা মিথ্যেই হয়—তাহলে দীনেশকে সে সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে তো সে বিপিনবাবুকে পাগল ঠাওরাবে। না না—এ ছেলেমানুষি তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। নিজেকে সেধে সেধে এইভাবে বোকা বানানো কোনমতেই চলতে পারে না। আর দীনেশের বিদ্রূপ যে কত নির্মম হতে পারে তার অভিজ্ঞতা বিপিনবাবুর আছে।…

বাড়ি এসে ঠাণ্ডা ঘরে বসে ঠাণ্ডা শরবত খেয়ে বিপিনবাবুর উদ্বেগটা অনেক কম বলে মনে হল। যত সব বাউন্ডুলের দল! নিজেদের কাজকর্ম নেই, তাই কাজের লোকদের ধরে ধরে বিব্রত করা।

রাত্রে খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে নতুন বইটা পড়তে পড়তে বিপিনবাবু নিউ মার্কেটের ভদ্রলোকটির কথা ভুলেই গেলেন।

পরদিন আপিসে কাজ করতে করতে বিপিনবাবু লক্ষ করলেন যে, যতই সময় যাচ্ছে ততই যেন গতকালের ঘটনাটা তাঁর স্মৃতিতে আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে আসছে। সেই গোলগাল মুখ, সেই ঢুলুঢুলু অমায়িক চাহনি, আর সেই হাসি। তাঁর এত ভেতরের খবরই যদি লোকটা নির্ভুল জেনে থাকে, তবে রাঁচির ব্যাপারটায় সে এত ভুল করল কী করে?

লাঞ্চের ঠিক আগে—অর্থাৎ একটা বাজতে পাঁচ মিনিটের সময়—বিপিনবাবু আর থাকতে না পেরে টেলিফোনের ডিরেক্টরিটা খুলে বসলেন। দীনেশ মুখুজ্যেকে ফোন করতে হবে একটা। ফোনই ভালো। অপ্রস্তুত হবার সম্ভাবনাটা কম।

টু-থ্রি-ফাইভ-সিক্স-ওয়ান-সিক্স।

বিপিনবাবু ডায়াল করলেন।

‘হ্যালো।’

‘কে, দীনেশ? আমি বিপিন কথা বলছি।’

‘কী খবর?’

‘ইয়ে ফিফ্‌টি এইটের একটা ঘটনা তোমার মনে আছে কিনা জানবার জন্য ফোন করছি।’

‘ফিফটি এইট? কী ঘটনা?’

‘সে বছরটা কি তুমি কলকাতাতেই ছিলে? আগে সেইটে আমার জানা দরকার।’

‘দাঁড়াও দাঁড়াও। ফিফটি এইট—আটান্ন…দাঁড়াও, আমার ডায়েরি দেখি। একটু ধরো।’

একটুক্ষণ চুপচাপ। বিপিনবাবু তাঁর বুকের ভেতরে একটা দুরুদুরু কাঁপুনি অনুভব করলেন। প্রায় এক মিনিট পরে আবার দীনেশ মুখুজ্যের গলা পাওয়া গেল।

‘হ্যাঁ, পেয়েছি। আমি বাইরে গেস্‌লাম—দু’বার।’

‘কোথায়?’

‘একবার গেলাম ফেব্রুয়ারিতে কাছেই—কেষ্টনগর—আমার এক ভাগনের বিয়েতে। আরেকবার—ও, এটা তো তুমি জানই। সেই রাঁচি। সেই যে যেবার তুমিও গেলে। ব্যস্‌। কিন্তু কেন বলো তো?’

‘না। একটা দরকার ছিল। ঠিক আছে। থ্যাঙ্ক ইউ…’

বিপিনবাবু টেলিফোনটা রেখে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তাঁর কান ভোঁ ভোঁ করছে, হাত পা যেন সব কেমন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সঙ্গে টিফিনের বাক্সে স্যান্ডউইচ ছিল, সেটা আর তিনি খেলেন না। খাবার কোন ইচ্ছেই হল না। তাঁর খিদে চলে গেছে।

লাঞ্চ টাইম শেষ হয়ে যাবার পর বিপিনবাবু বুঝতে পারলেন, এ অবস্থায় তাঁর পক্ষে আপিসে বসে কাজ করা অসম্ভব। তাঁর পঁচিশ বছরের কর্মজীবনে এর আগে এরকম কখনো হয় নি। নিরলস কর্মী বলে বিপিনবাবুর একটা খ্যাতি ছিল। কর্মচারীরা তাঁকে বাঘের মতো ভয় করত। যত বিপদই আসুক, যত বড় সমস্যারই সামনে পড়তে হোক, বিপিনবাবুর কোনদিন মতিভ্রম হয় নি। মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করে সব সময়ে সব বিপদ কাটিয়ে উঠেছেন তিনি।

আজ কিন্তু তাঁর সমস্ত গোলমাল হয়ে গেছে!

আড়াইটের সময় বাড়ি ফিরে, শোবার ঘরের সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে মনটাকে প্রকৃতিস্থ করে, কী করা উচিত সেটা ভাববার চেষ্টা করলেন বিপিনবাবু। মানুষ মাথায় চোট খেয়ে বা অন্য কোনরকম অ্যাকসিডেন্টের ফলে মাঝে মাঝে পূর্বস্মৃতি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আর সব মনে আছে, শুধু একটা বিশেষ ঘটনা মনে নেই—এর কোন উদাহরণ তিনি আর কখনও পাননি। রাঁচি যাবার ইচ্ছে তাঁর অনেকদিন থেকেই ছিল। সেই রাঁচিই গেছেন, অথচ গিয়ে ভুলে গেলেন, এ একেবারে অসম্ভব।

বাইরে কোথাও গেলে বিপিনবাবু তাঁর বেয়ারাকে সঙ্গে নিয়ে যান। কিন্তু এখন যে বেয়ারাটা আছে সে নতুন লোক। সাত বছর আগে তাঁর বেয়ারা ছিল রামস্বরূপ। তিনি রাঁচি গিয়ে থাকলে সেও নিশ্চয়ই যেত, কিন্তু এখন সে আর নেই, তিন বছর হল নেই।

সন্ধ্যা পর্যন্ত বিপিনবাবু একাই কাটালেন তাঁর ঘরে। মনে মনে স্থির করলেন আজ কেউ এলেও তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন না।

সাতটা নাগাদ চাকর এসে খবর দিল তাঁর সঙ্গে ধনী ব্যবসায়ী শেঠ গিরিধারিপ্রসাদ দেখা করতে এসেছেন। জাঁদরেল লোক গিরিধারিপ্রসাদ। কিন্তু বিপিনবাবুর মানসিক অবস্থা তখন এমনই যে তিনি বাধ্য হয়ে চাকরকে বলে দিলেন যে, তাঁর পক্ষে নীচে নামা সম্ভব নয়। চুলোয় যাক গিরিধারিপ্রসাদ!

সাড়ে সাতটায় আবার চাকরের আগমন। বিপিনবাবুর তখন সবে একটু তন্দ্রার ভাব এসেছে, একটা দুঃস্বপ্নের গোড়াটা শুরু হয়েছে, এমন সময় চাকরের ডাকে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। আবার কে এল? চাকর বলল, চুনিবাবু! বলছে ভীষণ জরুরী দরকার।

দরকার যে কী তা বিপিনবাবু জানেন। চুনি তাঁর স্কুলের সহপাঠী। সম্প্রতি দুরবস্থায় পড়েছে, কদিন থেকেই তাঁর কাছে আসছে একটা কোন চাকরির আশায়। বিপিনবাবুর পক্ষে তার জন্যে কিছু করা সম্ভব নয়, তাই প্রতিবারই তিনি তাকে না বলে দিয়েছেন, আচ্ছা নাছোড়বান্দা লোক তো চুনি!

বিপিনবাবু অত্যন্ত বিরক্তভাবে চাকরটাকে দিয়ে বলে পাঠালেন যে, শুধু আজ নয়—বেশ কিছুদিন তাঁর পক্ষে চুনির সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হবে না।

চাকর ঘর থেকে চলে যেতেই বিপিনবাবুর খেয়াল হল যে চুনির হয়তো আটান্নর ঘটনা কিছুটা মনে থাকতে পারে। তাকে একবার জিজ্ঞেস করাতে দোষ কী?

বিপিনবাবু তরতরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বৈঠকখানায় হাজির হলেন। চুনি যাবার জন্য উঠে পড়েছিল, বিপিনবাবুকে নেমে আসতে দেখে সে যেন একটু আশান্বিত হয়েই ঘুরে দাঁড়াল।

বিপিনবাবু ভণিতা না করেই বললেন, ‘শোনো চুনি, তোমার কাছে একটা—মানে, একটু বেখাপ্পা প্রশ্ন আছে। তোমার তো স্মরণশক্তি বেশ ভালো ছিল বলে জানি—আর আমার বাড়িতে তো তুমি অনেক বছর ধরেই মাঝে মাঝে যাতায়াত করছ। ভেবে দেখো তো মনে পড়ে কিনা—আমি কি আটান্ন সালে রাঁচি গিয়েছিলাম?

চুনি বলল, ‘আটান্ন? আটান্নই তো হবে। নাকি উনষাট?’

‘রাঁচি যাওয়াটা নিয়ে তোমার কোন সন্দেহ নেই?’

চুনি এবার রীতিমত অবাক হয়ে গেল।

‘তোমার কি যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়েই সন্দেহ হচ্ছে?’

‘আমি গিয়েছিলাম? তোমার ঠিক মনে আছে?’

চুনি সোফা থেকে উঠেছিল, সেটাতেই আবার বসে পড়ল। তারপর সে বিপিন চৌধুরীর দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, ‘বিপিন, তুমি কি নেশাটেশা ধরেছ নাকি আজকাল? এদিকে তো তোমার কোন বদনাম ছিল না! তুমি কড়া মেজাজের লোক, পুরোনো বন্ধুদের প্রতি তোমার সহানুভূতি নেই—এসবই তো জানতুম! কিন্তু তোমার তো মাথাটা পরিষ্কার ছিল; অন্তত কিছুদিন আগে অবধি ছিল!’

বিপিনবাবু কম্পিতস্বরে বললেন, ‘তোমার মনে আছে আমার যাবার কথা?’

চুনি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একটা পালটা প্রশ্ন করে বসল। সে বলল—

‘আমার শেষ চাকরি কী ছিল মনে আছে তোমার?’

‘বিলক্ষণ। তুমি হাওড়া স্টেশনে বুকিং ক্লার্ক ছিলে।’

‘তোমার সেটা মনে আছে, আর আমিই যে তোমার রাঁচির বুকিং করে দিলাম সেটা মনে নেই? তোমার যাবার দিন তোমার কামরায় গিয়ে দেখা করলাম, ডাইনিং কারে বলে তোমার খাবারের ব্যবস্থা করে দিলাম, তোমার কামরায় পাখা চলছিল না—সেটা লোক ডেকে চালু করে দিলাম—এসব তুমি ভুলে গেছ? তোমার হয়েছে কী?’

বিপিনবাবু একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন।

চুনি বলল, ‘তোমার কি অসুখ করেছে? তোমার চেহারাটা তো ভালো দেখছি না।’

বিপিনবাবু বললেন, ‘তাই মনে হচ্ছে। ক’দিন কাজের চাপটা একটু বেশি পড়েছিল। দেখি একটা স্পেশালিস্ট-টেশালিস্ট…’

বিপিনবাবুর অবস্থা দেখেই বোধহয় চুনি আর চাকরির উল্লেখ না করে আস্তে আস্তে বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেল।

পরেশ চন্দ্রকে ইয়াং ডাক্তার বলা চলে, চল্লিশের নীচে বয়স, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। বিপিনবাবুর ব্যাপার শুনে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বিপিনবাবু তাঁকে মরিয়া হয়ে বললেন, ‘দেখুন ডক্টর চন্দ্র, আমার এ ব্যারাম আপনাকে সারিয়ে দিতেই হবে। আপিস কামাই করার ফলে যে কী ক্ষতি হচ্ছে আমার ব্যবসার তা আমি বোঝাতে পারব না। আজকাল তো অনেক ওষুধ বেরিয়েছে। আমার এ ব্যারামের জন্য কি কিছুই নেই? আমি যত টাকা লাগে দেব। যদি বিদেশ থেকে আনাবার দরকার হয় তারও ব্যবস্থা করব। কিন্তু এ রোগ আপনাকে সারাতেই হবে।’

ডাক্তার একটু ভেবেচিন্তে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ব্যাপারটা কী জানেন মিস্টার চৌধুরী? আমার কাছে এ রোগ একেবারে নতুন জিনিস; আমার অভিজ্ঞতার একেবারে বাইরে। তবে একটা মাত্র উপায় আমি বলতে পারি। ফল হবে কিনা জানি না, কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ক্ষতির কোন আশঙ্কা নেই।’

বিপিনবাবু উদ্‌গ্রীব হয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসলেন।

ডাক্তার বললেন, ‘আমার যতদূর মনে হচ্ছে—এবং আমার বিশ্বাস আপনারও এখন তাই ধারণা—যে আপনি সত্যিই রাঁচি গিয়েছিলেন, কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, এই যাওয়ার ব্যাপারটা আপনি বেমালুম ভুলে গেছেন। আমি সাজেস্ট করছি যে আপনি আরেকবার রাঁচি যান। তাহলে হয়তো জায়গাটা দেখে আপনার আগের ট্রিপ-এর কথাটা মনে পড়ে যাবে। এটা অসম্ভব নয়। আজ এই মুহূর্তে তো বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। আমি আপনাকে একটি বড়ি লিখে দিচ্ছি—সেটা খেলে হয়তো ঘুমটা হবে। ঘুমটা দরকার, তা নাহলে আপনার অশান্তি এবং তার সঙ্গে সঙ্গে আপনার অসুখও বেড়ে যাবে। আপনি একটা কাগজ দিন, আমি ওষুধটা লিখে দিচ্ছি।’

বড়ির জন্যেই হোক, বা ডাক্তারের পরামর্শের জন্যেই হোক, বিপিনবাবু পরদিন সকালে অপেক্ষাকৃত সুস্থ বোধ করলেন।

প্রাতঃকালীন জলযোগ সেরে আপিসে টেলিফোন করে কিছু ইন্‌স্ট্রাকশন দিয়ে সেইদিনই রাত্রের জন্য রাঁচির টিকিট কিনলেন।

পরদিন রাঁচি স্টেশনে নেমেই তিনি বুঝলেন এ জায়গায় তিনি কস্মিনকালেও আসেন নি।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা গাড়ি করে এদিক ওদিক খানিকটা ঘুরে বুঝলেন যে এখানের রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, প্রাকৃতিক দৃশ্য, মোরাবাদি পাহাড়, হোটেল, বাংলো, কোনটার সঙ্গেই তাঁর বিন্দুমাত্র পরিচয় নেই। হুড্রু ফল্‌স কি তিনি চিনতে পারবেন? জলপ্রপাতের দৃশ্য দেখলেই কি তাঁর পুরোনো কথা সব মনে পড়ে যাবে?

নিজে সে কথা বিশ্বাস না করলেও, পাছে কলকাতায় ফিরে অনুতাপ হয় তাই একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে দুপুরের দিকে হুড্রুর দিকে রওনা দিলেন।

সেইদিনই বিকেল পাঁচটার সময় হুড্রুতে একটি পিকনিকের দলের দুটি গুজরাটি ভদ্রলোক বিপিনবাবুকে অজ্ঞান অবস্থায় একটি পাথরের ঢিপির পাশে আবিষ্কার করল। এই দুই ভদ্রলোকের শুশ্রূষার ফলে জ্ঞান ফিরে পেতেই বিপিনবাবু প্রথম কথা বললেন—‘আমি রাঁচি আসি নি। আমার সব গেল! আর কোন আশা নেই…’

পরদিন সকালে বিপিন চৌধুরী কলকাতায় ফিরে এলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে যদি না তিনি এই রহস্যের উদ্ঘাটন করতে পারেন, তবে তাঁর আর সত্যই কোন আশা নেই। তাঁর কর্মক্ষমতা, তাঁর আত্মবিশ্বাস, তাঁর উৎসাহ বুদ্ধি বিবেচনা সবই তিনি ক্রমে ক্রমে হারাবেন। শেষে কি তাহলে তাঁকে সেই রাঁচির…?

এর পরে আর বিপিনবাবু ভাবতে পারেন না, ভাবতে চান না।…

বাড়ি ফিরে কোনরকমে স্নান করে মাথায় বরফের থলি চাপা দিয়ে বিপিন চৌধুরী শয্যা নিলেন। চাকরকে বললেন ডাক্তার চন্দ্রকে ডেকে নিয়ে আসতে। চাকর যাবার আগে তাঁর হাতে একটি চিঠি দিয়ে বলল, কে জানি ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে গেছে। সবুজ খাম, তার উপর লাল কালিতে লেখা—‘শ্রীবিপিনবিহারী চৌধুরী। জরুরী, একান্ত ব্যক্তিগত।’

অসুস্থতা সত্ত্বেও বিপিনবাবুর কেন জানি মনে হল যে চিঠিটা তাঁর পড়া দরকার। খাম খুলে দেখেন এই চিঠি—

‘প্রিয় বিপিন,

হঠাৎ বড়লোক হওয়ার কুফল যে তোমার মধ্যে এভাবে দেখতে পাব তা আশা করি নি। একজন দুঃস্থ বাল্যবন্ধুর জন্য একটা উপায় করে দেওয়া কি সত্যিই তোমার পক্ষে এত অসম্ভব ছিল? আমার টাকা নেই, তাই ক্ষমতা সামান্যই। যে জিনিসটা আছে আমার সেটা হল কল্পনাশক্তি। তারই সামান্য কিছুটা খরচ করে তোমার উপর সামান্য প্রতিশোধ নিলাম। নিউ মার্কেটের সেই ভদ্রলোকটি আমার প্রতিবেশী; বেশ ভালো অভিনেতা। দীনেশ মুখুজ্যে তোমার প্রতি সদয় নন, তাই তাকে হাত করতে কোন অসুবিধা হয় নি। হাঁটুর দাগটার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে—সেই চাঁদপাল ঘাটে আছাড় খাওয়া—উনিশ শ’ ছত্রিশ সনে?…

আর কী? এবার সেরে উঠবে। আমার একটি উপন্যাস এক প্রকাশকের পছন্দ হয়েছে। কয়েকটা মাস তাতেই কোনরকমে চালিয়ে নেব। ইতি

তোমার বন্ধু চুনিলাল’

ডাক্তার চন্দ্র আসতেই বিপিনবাবু বললেন, ‘ভালো আছি। রাঁচি স্টেশনে নেমেই সব মনে পড়ে গেল।’

ডাক্তার বললেন, ‘ভেরি স্ট্রেঞ্জ! আপনার কেসটা একটা ডাক্তারি জার্নালে ছাপিয়ে দেব ভাবছি।’

বিপিনবাবু বললেন, ‘আপনাকে যেই জন্য ডাকা—দেখুন তো, আমার কোমরের হাড়টাড় ভাঙল কিনা। রাঁচিতে হোঁচট খেয়েছিলাম। টনটন করছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম
1 of 2

বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম

বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম

নিউ মার্কেটের কালীচরণের দোকান থেকে প্রতি সোমবার আপিস-ফেরতা বই কিনে বাড়ি ফেরেন। বিপিন চৌধুরী। যত রাজ্যের ডিটেকটিভ বই, রহস্যের বই আর ভূতের গল্প। একসঙ্গে অন্তত খান। পাঁচেক বই না কিনলে তাঁর এক সপ্তাহের খোরাক হয় না। বাড়িতে তিনি একা মানুষ। লোকের সঙ্গে মেলামেশা তাঁর ধাতে আসেনা, আড্ডার বাতিক নেই, বন্ধুপরিজনের সংখ্যাও কম। সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে যেসব কাজের লোক আসেন, তাঁরা কাজের কথা সেরে উঠে চলে যান। যাঁরা ওঠেন না বা উঠতে চান, বিপিনবাবু তাঁদের সোয়া আটটা বাজলেই বলেন–আমার ডাক্তারের আদেশ আছে সাড়ে আটটায় খাওয়া সারতে হবে। কিছু মনে করবেন না…। খাওয়ার পর আধঘণ্টা বিশ্রাম, তারপর গল্পের বই হাতে নিয়ে সোজা বিছানায়। এই নিয়ম যে কতদিন ধরে চলেছে বিপিনবাবুর নিজেরই তার হিসেব নেই।

আজ কালীচরণের দোকানে বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে বিপিনবাবুর খেয়াল হল আরেকটি লোক যেন তাঁর পাশে কিছুক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছে। বিপিনবাবু মুখ তুলে দেখেন একটি গোলগাল অমায়িক চেহারার ভদ্রলোক তাঁরই দিকে চেয়ে হাসছেন।

আমায় চিনতে পারছেন না বোধহয়?

বিপিনবাবু কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত বোধ করলেন। কই, এঁর সঙ্গে তো কোনওদিন আলাপ হয়েছে বলে তাঁর মনে পড়ে না। এমন কোনও মুখও তো মনে পড়ছে না তাঁর।

অবিশ্যি আপনি কাজের মানুষ। অনেক রকম লোকের সঙ্গে দেখা হয় তো রোজ–তাই বোধহয়…

 আমার কি আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছে এর আগে? বিপিনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। ভদ্রলোক যেন এবার একটু অবাক হয়েই বললেন, আজ্ঞে সাতদিন দুবেলা সমানে দেখা হয়েছে। আমি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলুম–সেই গাড়িতে আপনি হুডু ফল্স দেখতে গেলেন। সেই নাইনটিন ফিটি-এইটে–রাঁচিতে! আমার নাম পরিমল ঘোষ।

রাঁচি? বিপিনবাবু এবার বুঝলেন যে, ভুল তাঁর হয়নি, হয়েছে এই লোকটিরই। কারণ বিপিনবাবু কোনওদিন রাঁচি যাননি। যাবার কথা হয়েছে অনেকবার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এবার বিপিনবাবু একটু হেসে বললেন, আমি কে তা আপনি জানেন কী?

ভদ্রলোক চোখ কপালে তুলে জিভ কেটে বললেন, আপনি কে তা জানব না? বলেন কী? বিপিন চৌধুরীকে কে না জানে?

বিপিনবাবু এবার বইয়ের দিকে দৃষ্টি দিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, কিন্তু তাও আপনার ভুল হয়েছে। ওরকম হয় মাঝে মাঝে। আমি রাঁচি যাইনি কখনও। ভদ্রলোক এবার বেশ জোরে হেসে উঠলেন।

কী বলছেন মিস্টার চৌধুরী? ঝরনা দেখতে গিয়ে পাথরে হোঁচট খেয়ে আপনার হাঁটু ছড়ে গেল। আমিই শেষটায় আয়োডিন এনে দিলুম। পরদিন নেতারহাট যাবার জন্য আমি গাড়ি ঠিক করেছিলুম–আপনি পায়ের ব্যথার জন্য যেতে পারলেন না। কিছু মনে পড়ছে না? আপনার চেনা আরেকজন লোকও তো গেলেন সেবার-দীনেশ মুখুজ্যে। আপনি ছিলেন একটা বাংলো ভাড়া করে বললেন। হোটেলের খাবার আপনার ভাল লাগে না–তার চেয়ে বাবুর্চি দিয়ে রান্না করিয়ে নেওয়া ভাল। দীনেশ মুখুজ্যে ছিলেন তাঁর বোনের বাড়িতে। আপনাদের দুজনের সেই তর্ক লেগেছিল একদিন চাঁদে যাবার ব্যাপার নিয়ে–মনে নেই? সব ভুলে গেলেন? আরও বলছি–আপনার কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ ছিল–তাতে গল্পের বই থাকত। বাইরে গেলে নিয়ে যেতেন। কেমন–ঠিক কি না?

বিপিনবাবু এবার গম্ভীর সংযত গলায় বললেন, আপনি ফিফটি-এইটের কোন মাসের কথা বলছেন। বলুন তো?

ভদ্রলোক বললেন, মহালয়ার ঠিক পরেই। হয় আশ্বিন, নয় কার্তিক।

বিপিনবাবু বললেন, আজ্ঞে না। পুজোয় সে বছর আমি ছিলুম কানপুরে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। আপনি ভুল করলেন। নমস্কার।

কিন্তু ভদ্রলোক গেলেন না। অবাক অপলক দৃষ্টিতে বিপিনবাবুর দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলে যেতে লাগলেন, কী আশ্চর্য! একদিন সন্ধ্যাবেলা আপনার বাংলোর দাওয়ায় বসে চা খেলুম। আপনি আপনার ফ্যামিলির কথা বললেন বললেন, আপনার ছেলেপিলে নেই, আপনার স্ত্রী বারো-তেরো বছর আগে মারা গেছেন। একমাত্র ভাই পাগল ছিলেন, তাই আপনি পাগলা গারদ দেখতে যেতে চাইলেন না। বললেন, ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়…

বিপিনবাবু যখন বইয়ের দামটা দিয়ে দোকান থেকে বেরোচ্ছেন তখনও ভদ্রলোক তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন।

বারট্রাম স্ট্রিটে লাইটহাউস সিনেমার গায়ে বিপিন চৌধুরীর বুইক গাড়িটা লাগানো ছিল। তিনি গাড়িতে পৌঁছে ড্রাইভারকে বললেন, একটু গঙ্গার ধারটায় ঘুরে চলো তো সীতারাম।

চলন্ত গাড়িতে বসে মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হতেই বিপিনবাবুর আফসোস হল। বাজে ভণ্ড লোকটাকে এতটা সময় কেন মিছিমিছি দিলেন তিনি! রাঁচি তো তিনি যাননি, কখনওই যেতে পারেন না। মাত্র সাত বছর আগেকার স্মৃতি মানুষে অত সহজে ভুলতে পারে না, এক যদি না–

বিপিনবাবুর মাথা হঠাৎ বন করে ঘুরে গেল।

এক যদি না তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়ে থাকে।

কিন্তু তাই বা হয় কী করে? তিনি তো দিব্যি আপিসে কাজ করে যাচ্ছেন। এত বিরাট আপিস–এত দায়িত্বপূর্ণ কাজ। কোথাও তো কোনও ত্রুটি হচ্ছে বলে তিনি জানেন না। আজও তো একটা জরুরি মিটিং-এ আধঘণ্টার বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি। আশ্চর্য! অথচ–

অথচ লোকটা তাঁর এত খবর রাখল কী করে? এ যে একেবারে নাড়িনক্ষত্র জেনে বসে আছে। বইয়ের ব্যাগ, স্ত্রীর মৃত্যু, ভাইয়ের মাথা খারাপ! ভুল করেছে কেবল ওই রাঁচির ব্যাপারে। ভুল কেন–জেনেশুনে মিথ্যে বলছে। আটান্ন সালের পুজোয় তিনি রাঁচি যাননি; গিয়েছিলেন কানপুরে, তাঁর বন্ধু হরিদাস বাগচির বাড়িতে। হরিদাস লিখলেই–নাঃ, হরিদাসকে লেখার উপায় নেই।

বিপিনবাবুর হঠাৎ খেয়াল হল হরিদাস বাগচি আজ মাসখানেক হল সস্ত্রীক জাপানে গেছেন তাঁর ব্যবসার ব্যাপারে। জাপানের ঠিকানা বিপিনবাবু জানেন না। কাজেই চিঠি লিখে প্রমাণ আনানোর রাস্তা বন্ধ।

কিন্তু প্রমাণের প্রয়োজনটাই বা কোথায়। এমন যদি হত যে, উনিশশো আটান্ন সালের আশ্বিন মাসে রাঁচিতে কোনও খুনের জন্য পুলিশ তাঁকে দায়ী করার চেষ্টা করছে, তখনই তাঁর চিঠির প্রয়োজন হত হরিদাস বাগচির কাছ থেকে। এখন তো প্রমাণের কোনও দরকার নেই। তিনি নিজে জানেন তিনি রাঁচি যাননি। ব্যস, ল্যাঠা চুকে গেল।

গঙ্গার হাওয়াতে বিপিন চৌধুরীর মাথা অনেক ঠাণ্ডা হলেও, মনের মধ্যে একটা খটকা, একটা অসোয়াস্তি বোধ যেন থেকেই গেল!

হেস্টিংস-এর কাছাকাছি এসে বিপিনবাবু তাঁর প্যান্টের কাপড়টা গুটিয়ে উপরে তুলে দেখলেন যে, ডান হাঁটুতে একটা এক ইঞ্চি লম্বা কাটা দাগ রয়েছে। সেটা কবেকার দাগ তা বোঝবার কোনও উপায় নেই। ছেলেবেলায় কি কখনও হোঁচট খেয়ে হাঁটু ছড়েনি বিপিনবাবুর? অনেক চেষ্টা করেও সেটা তিনি মনে করতে পারলেন না।

চড়কডাঙার মোড়ের কাছাকাছি এসে তাঁর দীনেশ মুখুজ্যের কথাটা মনে পড়ল। লোকটা বলছিল দীনেশ মুখুজ্যে ছিল রাঁচিতে ওই একই সময়ে। তাহলে দীনেশকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়। সে থাকে কাছেই–বেণীনন্দন স্ট্রিট। এখনই যাবেন কি তার কাছে? কিন্তু যদি রাঁচি যাবার ব্যাপারটা মিথ্যেই হয় তা হলে দীনেশকে সে সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে তো সে বিপিনবাবুকে পাগল ঠাওরাবে। না না–এ ছেলেমানুষি তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। নিজেকে সেধে সেধে এইভাবে বোকা বানানো কোনওমতেই চলতে পারে না। আর দীনেশের বিদ্রূপ যে কত নির্মম হতে পারে তার অভিজ্ঞতা বিপিনবাবুর আছে।….

বাড়ি এসে ঠাণ্ডা ঘরে ঠাণ্ডা শরবত খেয়ে বিপিনবাবুর উদ্বেগটা অনেক কম বলে মনে হল। যতসব বাউন্ডুলের দল। নিজেদের কাজকর্ম নেই, তাই কাজের লোকদের ধরে ধরে বিব্রত করা।

রাত্রে খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে নতুন বইটা পড়তে পড়তে বিপিনবাবু নিউ মার্কেটের ভদ্রলোকটির কথা ভুলেই গেলেন।

.

পরদিন আপিসে কাজ করতে করতে বিপিনবাবু লক্ষ করলেন যে, যতই সময় যাচ্ছে ততই যেন গতকালের ঘটনাটা তাঁর স্মৃতিতে আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে আসছে। সেই গোলগাল মুখ, সেই ঢুলুঢুলু অমায়িক চাহনি, আর সেই হাসি। তাঁর এঙ ভিতরের খবরই যদি লোঞ্চটা নির্ভুল জেনে থাকে, তবে যাঁচির ব্যাপারটায় সে এত ভুল করল কী করে?

লাঞ্চের ঠিক আগে–অর্থাৎ একটা বাজতে পাঁচ মিনিটের সময়-বিপিনবাবু আর থাকতে না পেরে টেলিফোনের ডিরেক্টরিটা খুলে বসলেন। দীনেশ মুখুজ্যেকে ফোন করতে হবে একটা। ফোনই ভাল। অপ্রস্তুত হবার সম্ভাবনাটা কম।

টু-থ্রি-ফাইভ-সিক্স-ওয়ান-সিক্স।

বিপিনবাবু ডায়াল করলেন।

হ্যালো।

কে, দীনেশ? আমি বিপিন কথা বলছি।

কী খবর?

ইয়ে ফিফটি এইটের একটা ঘটনা তোমার মনে আছে কিনা জানবার জন্য ফোন করছি।

ফিফটি এইট? কী ঘটনা?

সে বছরটা কি তুমি কলকাতাতেই ছিলে? আগে সেইটে আমার জানা দরকার।

দাঁড়াও দাঁড়াও। ফিফটি এইট-আটান্ন…দাঁড়াও, আমার ডায়েরি দেখি। একটু ধরো।

একটুক্ষণ চুপচাপ। বিপিনবাবু তাঁর বুকের ভিতরে একটা দুরুদুরু কাঁপুনি অনুভব করলেন। প্রায় এক মিনিট পরে আবার দীনেশ মুখুজ্যের গলা পাওয়া গেল।

হ্যাঁ, পেয়েছি। আমি বাইরে গেসলাম–দুবার।

কোথায়?

একবার গেসলাম ফেব্রুয়ারিতে কাছে–কেষ্টনগর–আমার এক ভাগনের বিয়েতে। আরেকবারও, এটা তো তুমি জানোই। সেই রাঁচি। সেই যে যেবার তুমিও গেলে। ব্যস। কিন্তু কেন বলো তো?

না। একটা দরকার ছিল। ঠিক আছে। থ্যাঙ্ক ইউ…

বিপিনবাবু টেলিফোনটা রেখে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তাঁর কান ভোঁ ভোঁ করছে, হাত পা যেন সব কেমন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সঙ্গে টিফিনের বাক্সে স্যান্ডউইচ ছিল, সেটা আর তিনি খেলেন না। খাবার কোনও ইচ্ছেই হল না। তাঁর খিদে চলে গেছে।

লাঞ্চ টাইম শেষ হয়ে যাবার পর বিপিনবাবু বুঝতে পারলেন, এ অবস্থায় তাঁর পক্ষে আপিসে বসে কাজ করা অসম্ভব। তাঁর পঁচিশ বছরের কর্মজীবনে এর আগে এরকম কখনও হয়নি। নিরলস কর্মী বলে বিপিনবাবুর একটা খ্যাতি ছিল। কর্মচারীরা তাঁকে বাঘের মতো ভয় করত। যত বিপদই আসুক, যতবড় সমস্যারই সামনে পড়তে হোক, বিপিনবাবুর কোনওদিন মতিভ্রম হয়নি। মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করে সবসময়ে সব বিপদ কাটিয়ে উঠেছেন তিনি।

আজ কিন্তু তাঁর সমস্ত গোলমাল হয়ে গেছে!

আড়াইটের সময় বাড়ি ফিরে, শোয়ার ঘরের সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে মনটাকে প্রকৃতিস্থ করে, কী করা উচিত সেটা ভাবার চেষ্টা করলেন বিপিনবাবু। মানুষ মাথায় চোট খেয়ে বা অন্য কোনওরকম অ্যাকসিডেন্টের ফলে মাঝে মাঝে পূর্বস্মৃতি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আর সব মনে আছে, শুধু একটা বিশেষ ঘটনা মনে নেই–এর কোনও উদাহরণ তিনি আর কখনও পাননি। রাঁচি যাবার ইচ্ছে তাঁর অনেকদিন থেকেই ছিল। সেই রাঁচিই গেছে, অথচ গিয়ে ভুলে গেলেন, এ একেবারে অসম্ভব!

বাইরে কোথাও গেলে বিপিনবাবু তাঁর বেয়ারাকে সঙ্গে নিয়ে যান। কিন্তু এখন যে বেয়ারাটা আছে সে নতুন লোক। সাত বছর আগে তাঁর বেয়ারা ছিল রামস্বরূপ। তিনি রাঁচি গিয়ে থাকলে সেও নিশ্চয়ই যেত, কিন্তু এখন সে আর নেই, তিন বছর হল নেই।

সন্ধ্যা পর্যন্ত বিপিনবাবু একাই কাটালেন তাঁর ঘরে। মনে মনে স্থির করলেন আজ কেউ এলেও তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন না।

সাতটা নাগাদ চাকর এসে খবর দিল তাঁর সঙ্গে ধনী ব্যবসায়ী শেঠ গিরিধারীপ্রসাদ দেখা করতে এসেছেন। জাঁদরেল লোক গিরিধারীপ্রসাদ। কিন্তু বিপিনবাবুর মানসিক অবস্থা তখন এমনই যে, তিনি বাধ্য হয়ে চাকরকে বলে দিলেন যে, তাঁর পক্ষে নীচে নামা সম্ভব নয়। চুলোয় যাক গিরিধারীপ্রসাদ!

সাড়ে সাতটায় আবার চাকরের আগমন। বিপিনবাবুর তখন সবে একটা তন্দ্রার ভাব এসেছে, একটা দুঃস্বপ্নের গোড়াটা শুরু হয়েছে, এমন সময় চাকরের ডাকে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। আবার কে এল? চাকর বলল, চুনিবাবু। বলছে ভীষণ জরুরি দরকার।

দরকার যে কী তা বিপিনবাবু জানেন। চুনি তাঁর স্কুলের সহপাঠী। সম্প্রতি দুরবস্থায় পড়েছে, কদিন থেকেই তাঁর কাছে আসছে একটা কোনও চাকরির আশায়। বিপিনবাবুর পক্ষে তার জন্য কিছু করা সম্ভব নয়, তাই প্রতিবারই তিনি তাকে না বলে দিয়েছেন, আচ্ছা নাছোড়বান্দা লোক তুমি চুনি!

বিপিনবাবু অত্যন্ত বিরক্তভাবে চাকরটাকে দিয়ে বলে পাঠালেন যে, শুধু আজ নয়–বেশ কিছুদিন তাঁর পক্ষে চুনির সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হবে না।

চাকর ঘর থেকে চলে যেতেই বিপিনবাবুর খেয়াল হল যে, চুনির হয়তো আটান্নর ঘটনা কিছুটা মনে থাকতে পারে। তাকে একবার জিজ্ঞেস করাতে দোষ কী?

বিপিনবাবু তরতরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বৈঠকখানায় হাজির হলেন। চুনি যাবার জন্য উঠে পড়েছিল, বিপিনবাবুকে নেমে আসতে দেখে সে যেন একটু আশান্বিত হয়েই ঘুরে দাঁড়াল।

বিপিনবাবু ভণিতা না করেই বললেন, শোনো চুনি, তোমার কাছে একটা–মানে, একটু বেখাপ্পা প্রশ্ন আছে। তোমার তো স্মরণশক্তি বেশ ভাল ছিল বলে জানি–আর আমার বাড়িতে তো তুমি অনেক। বছর ধরেই মাঝে মাঝে যাতায়াত করছ। ভেবে দেখো তো মনে পড়ে কিনা–আমি কি আটান্ন সালে রাঁচি গিয়েছিলাম?

চুনি বলল, আটান্ন? আটান্নই তো হবে। না কি ঊনষাট?

রাঁচি যাওয়াটা নিয়ে তোমার কোনও সন্দেহ নেই?

চুনি এবার রীতিমতো অবাক হয়ে গেল।

তোমার কি যাবার ব্যাপারটা নিয়েই সন্দেহ হচ্ছে?

আমি গিয়েছিলাম? তোমার ঠিক মনে আছে?

চুনি সোফা থেকে উঠেছিল, সেটাতেই আবার বসে পড়ল। তারপর সে বিপিন চৌধুরীর দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, বিপিন, তুমি কি নেশাটেশা ধরেছ নাকি আজকাল? এদিকে তো তোমার কোনও বদনাম ছিল না! তুমি কড়া মেজাজের লোক, পুরনো বন্ধুদের প্রতি তোমার সহানুভূতি নেই–এ সবই তো জানতুম! কিন্তু তোমার তো মাথাটা পরিষ্কার ছিল; অন্তত কিছুদিন আগে অবধি ছিল।

বিপিনবাবু কম্পিতস্বরে বললেন, তোমার মনে আছে আমার যাবার কথা?

চুনি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একটা পালটা প্রশ্ন করে বসল। সে বলল—

আমার শেষ চাকরি কী ছিল মনে আছে তোমার?

বিলক্ষণ। তুমি হাওড়া স্টেশনে বুকিং ক্লার্ক ছিলে।

তোমার সেটা মনে আছে, আর আমিই যে তোমার রাঁচির বুকিং করে দিলাম সেটা মনে নেই? তোমার যাবার দিন তোমার কামরায় গিয়ে দেখা করলাম, ডাইনিং কারে বলে তোমার খাবারের ব্যবস্থা করে দিলাম, তোমার কামরায় পাখা চলছিল না–সেটা লোক ডেকে চালু করে দিলাম–এসব তুমি ভুলে গেছ? তোমার হয়েছে কী?

বিপিনবাবু একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন।

চুনি বলল, তোমার কি অসুখ করেছে? তোমার চেহারাটা তো ভাল দেখছি না।

বিপিনবাবু বললেন, তাই মনে হচ্ছে। কদিন কাজের চাপটা একটু বেশি পড়েছিল। দেখি একটা স্পেশালিস্ট-টেশালিস্ট…

বিপিনবাবুর অবস্থা দেখেই বোধহয় চুনি আর চাকরির উল্লেখ না করে আস্তে আস্তে বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেল।

পরেশ চন্দ্রকে ইয়াং ডাক্তার বলা চলে, চল্লিশের নীচে বয়স, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। বিপিনবাবুর ব্যাপার শুনে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বিপিনবাবু তাঁকে মরিয়া হয়ে বললেন, দেখুন ডক্টর চন্দ্র, আমার এ ব্যারাম আপনাকে সারিয়ে দিতেই হবে। আপিস কামাই করার ফলে যে কী ক্ষতি হচ্ছে আমার ব্যবসার তা আমি বোঝাতে পারব না। আজকাল তো অনেক ওষুধ বেরিয়েছে। আমার এ ব্যারামের জন্য কি কিছুই নেই? আমি যত টাকা লাগে দেব। যদি বিদেশ থেকে আনাবার দরকার হয় তারও ব্যবস্থা করব। কিন্তু এ রোগ আপনাকে সারাতেই হবে।

ডাক্তার একটু ভেবেচিন্তে মাথা নেড়ে বললেন, ব্যাপারটা কী জানেন মিস্টার চৌধুরী? আমার কাছে এ রোগ একেবারে নতুন জিনিস; আমার অভিজ্ঞতার একেবারে বাইরে। তবে একটামাত্র উপায় আমি বলতে পারি। ফল হবে কিনা জানি না, কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ক্ষতির কোনও আশঙ্কা নেই।

বিপিনবাবু উদগ্রীব হয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসলেন। ডাক্তার বললেন, আমার যতদূর মনে হচ্ছে এবং আমার বিশ্বাস আপনারও এখন তাই ধারণা যে, আপনি সত্যিই রাঁচি গিয়েছিলেন, কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, এই যাবার ব্যাপারটা আপনি বেমালুম ভুলে গেছেন। আমি সাজেস্ট করছি যে আপনি আরেকবার রাঁচি যান। তা হলে হয়তো জায়গাটা দেখে আপনার আগের ট্রিপ-এর কথাটা মনে পড়ে যাবে। এটা অসম্ভব নয়। আজ এই মুহূর্তে তো বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। আমি আপনাকে একটি বড়ি লিখে দিচ্ছি–সেটা খেলে হয়তো ঘুমটা হবে। ঘুমটা দরকার, তা না হলে আপনার অশান্তি এবং তার সঙ্গে সঙ্গে আপনার অসুখও বেড়ে যাবে। আপনি একটা কাগজ দিন, আমি ওষুধটা লিখে দিচ্ছি।

বড়ির জন্যই হোক, বা ডাক্তারের পরামর্শের জন্যই হোক, বিপিনবাবু পরদিন সকালে অপেক্ষাকৃত সুস্থ বোধ করলেন।

প্রাতঃকালীন জলযোগ সেরে আপিসে টেলিফোন করে কিছু ইনস্ট্রাকশন দিয়ে সেইদিনই রাত্রের জন্য রাঁচির টিকিট কিনলেন।

পরদিন রাঁচি স্টেশনে নেমেই তিনি বুঝলেন এ জায়গায় তিনি কস্মিনকালেও আসেননি।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা গাড়ি করে এদিক ওদিক খানিকটা ঘুরে বুঝলেন যে এখানের রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, প্রাকৃতিক দৃশ্য, মোরাবাদি পাহাড়, হোটেল, বাংলো, কোনওটার সঙ্গেই তাঁর বিন্দুমাত্র পরিচয় নেই। হুড্র ফল কি তিনি চিনতে পারবেন? জলপ্রপাতের দৃশ্য দেখলেই কি তাঁর পুরনো কথা সব মনে যাবে?

নিজে সেকথা বিশ্বাস না করলেও, পাছে কলকাতায় ফিরে অনুতাপ হয় তাই একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে দুপুরের দিকে হুডুর দিকে রওনা দিলেন।

সেইদিনই বিকেল পাঁচটার সময় হুড্রতে একটি পিকনিকের দলের দুটি গুজরাটি ভদ্রলোক বিপিনবাবুকে অজ্ঞান অবস্থায় একটি পাথরের ঢিপির পাশে আবিষ্কার করল। এই দুই ভদ্রলোকের শুশ্রূষার ফলে জ্ঞান ফিরে পেতেই বিপিনবাবু প্রথম কথা বললেন–আমি রাঁচি আসিনি। আমার সব গেল! আর কোনও আশা নেই…

এদিন সকালে বিপিন চৌধুরী কলকাতায় ফিরে এলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, যদি না তিনি এই রহস্যের উদঘাটন করতে পারেন, তবে তাঁর আর সত্যই কোনও আশা নেই। তাঁর কর্মক্ষমতা, তাঁর আত্মবিশ্বাস, তাঁর উৎসাহ বুদ্ধি বিবেচনা সবই তিনি ক্রমে ক্রমে হারাবেন। শেষে কি তা হলে তাঁকে সেই রাঁচির…?

এর পরে আর বিপিনবাবু ভাবতে পারেন না, ভাবতে চান না।…

বাড়ি ফিরে কোনওরকমে স্নান করে মাথায় বরফের থলি চাপা দিয়ে বিপিন চৌধুরী শয্যা নিলেন। চাকরকে বললেন ডাক্তার চন্দ্রকে ডেকে নিয়ে আসতে। চাকর যাবার আগে তাঁর হাতে একটি চিঠি দিয়ে বলল, কে জানি ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে গেছে। বুজ খাম, তার উপর লাল কালিতে লেখা–শ্রীবিপিনবিহারী চৌধুরী। জরুরি, একান্ত ব্যক্তিগত।

অসুস্থতা সত্ত্বেও বিপিনবাবুর কেন জানি মনে হল যে, চিঠিটা তাঁর পড়া দরকার। খাম খুলে দেখেন এই চিঠি–

প্রিয় বিপিন,

হঠাৎ বড়লোক হবার কুফল যে তোমার মধ্যে এভাবে দেখতে পাব তা আশা করিনি। একজন দুস্থ বাল্যবন্ধুর জন্য একটা উপায় করে দেওয়া কি সত্যিই তোমার পক্ষে এত অসম্ভব ছিল? আমার টাকা নেই, তাই ক্ষমতা সামান্যই। যে জিনিসটা আছে আমার, সেটা হল কল্পনাশক্তি। তারই সামান্য কিছুটা খরচ করে তোমার উপর সামান্য প্রতিশোধ নিলাম। নিউ মার্কেটের সেই ভদ্রলোকটি আমার প্রতিবেশী; বেশ ভাল অভিনেতা। দীনেশ মুখুজ্যে তোমার প্রতি সদয় নন, তাই তাকে হাত করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। হাঁটুর দাগটার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে–সেই চাঁদপাল ঘাটে আছাড় খাওয়া উনিশ শো ছত্রিশ সনে?..

আর কী? এবার সেরে উঠবে। আমার একটি উপন্যাস এক প্রকাশকের পছন্দ হয়েছে। কয়েকটা মাস তাতেই কোনওরকমে চালিয়ে নেব। ইতি–

তোমার বন্ধু চুনিলাল।

ডাক্তার চন্দ্র আসতেই বিপিনবাবু বললেন, ভাল আছি। রাঁচি স্টেশনে নেমেই সব মনে পড়ে গেল।

ডাক্তার বললেন, ভেরি স্ট্রেঞ্জ! আপনার কেসটা একটা ডাক্তারি জার্নালে ছাপিয়ে দেব ভাবছি।

বিপিনবাবু বললেন, আপনাকে যেজন্য ডাকা–দেখুন তো, আমার কোমরের হাড়টাড় ভাঙল কিনা। রাঁচিতে হোঁচট খেয়েছিলাম। টনটন করছে।

সন্দেশ, শারদীয়া ১৩৭০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *