বিপিনের সংসার – ১২

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ 

সেদিন সকালে বিপিন রোদে পিঠ দিয়া বসিয়া ঔষধ বিক্রির হিসাবের খাতা দেখিতেছে, এমন সময় শান্তি পিছন হইতে একপ্রকার চুপিচুপিআসিল—উদ্দেশ্য বোধ হয় বিপিনকে চমকাইয়া দেওয়া বা অপ্রত্যাশিত ভাবে তাহার সাহচর্যের আনন্দ দান করা। উদ্দেশ্য খুব সুস্পষ্ট নাহইলেও সে এমনি প্রায়ই করে আজকাল। বিপিনও শান্তির সঙ্গে মিলিতে মিশিতে পূর্বের মতোসঙ্কোচ বা জড়তা অনুভব করে না। 

সামনে ছায়া পড়িতেই বিপিন পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল শান্তি হাসিমুখে দাঁড়াইয়া। বিপিন কিছু বলিবার পূর্বে শান্তি বলিল—কি করচেন? 

বিপিন বলিল—এসো শান্তি, হিসেব দেখচি 

—একটা কথা বলতে এলাম, কাল চলে যাচ্চি এখান থেকে— 

বিপিন আশ্চর্য হইয়া বলিল কোথায়? কোথায় যাবে? 

শান্তি হাসিতে হাসিতে বলিল—বাঃ, কোথায় কি! আমার যাবার জায়গা নেই! এখানে কি চিরকাল থাকব? বলেচি তো সেদিন আপনাকে! 

—ও, শ্বশুরবাড়ি যাবে? 

—হুঁ, উনি আসবেন কাল সকালে। 

বিপিন চুপ করিয়া রহিল। দু-একটা কথা যাহা সে ঝোঁকের মুখে বলিতে যাইতেছিল চাপিয়া গেল। মেয়েদের ভালবাসা লইয়া সে আর নাড়াচাড়া করিবে না। যাহা হইয়াছে যথেষ্ট।শান্তি বিবাহিতা মেয়ে, তাহাকে সে কিছুই বলিবে না ওসব কথা। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষই কষ্টপায়। না, উহার মধ্যে আর নয়। 

শান্তি যেন একটু দুঃখিত হইল। সে যাহা বিপিনের মুখে শুনিবার আশা করিয়াছিল তাহা না শুনিতে পাইয়া যেন নিরাশ হইয়াছে। বলিল—এখন আর অনেক দিন আসব না— 

বিপিন বলিল—কবে আসবে? 

—তার কিছু কি ঠিক আছে? তা বেশ, যখনই আসি, আসি আর নাই আসি, আপনারআর কি! 

শান্তি এ ধরনের কথা কেন বলিতে আরম্ভ করিল হঠাৎ? কি জবাব দিবে এ কথার সে? 

তবুও বিপিন বলিল—না, আমার কিছু নয়, আমার কিছু নয়, তোমায় বলেচে। আমারখাওয়ার মজাটা তো সকলের আগে নষ্ট হল! 

—বউদিদিদের বলে যাচ্চি, সে-সবের জন্য কিছু কষ্ট হবে না আপনার। তা হলে আরকোনো কষ্ট রইল না তো?

বলা চলিত এবং বলিতেও ইচ্ছা হইতেছিল, শান্তি তুমি চলে গেলে আমার এ জায়গাআর ভাল লাগবে না। দিনের মধ্যে সব সময় তোমার কথা মনে হবে। কখন আমায় আবার এভাবে জড়ালে শান্তি? 

বিপিন সে ধরনের কথার ধার দিয়াও গেল না! বলিল—তা তোমাদের বাড়ি যত্নযথেষ্টই পেয়ে আসছি, তোমাদের বাড়িতে আশ্রয় না পেলে আমার এখানে ডাক্তারি করাই হোত না— 

শান্তি মুখ ভার করিয়া বলিল—আপনার কেবল ওই সব কথা! কি করছি আমরা? আপনি ব্রাহ্মণ, আমরা আপনাকে আশ্রয় দিইচি—অমন কথা বুঝি লোকে বলে? সত্যি, বলবেনআর ও কথা, বলতে নেই। 

পরদিন শান্তির স্বামী আসিয়া তাহাকে লইয়া চলিয়া গেল। বিপিন ডিসপেন্‌সারি হইতে ফিরিয়া দুপুরে নিজের ছোট্ট চালায় রাঁধিতে বসিয়াছে, শান্তি সেখানে আসিয়া গলায় আঁচল দিয়া দুই পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিয়া বলিল—যাচ্চি। 

—যাচ্চি বলতে নেই, বলতে হয় আসচি। 

—যদি আর না-ই আসি? 

—বলতে নেই ও কথা। এসো, আসবে বৈ কি 

—বলচেন আসতে তো! তা হলে আসব, ঠিক আসব। শান্তি কথা শেষ করিয়া চলিয়াযাইতেছিল, বিপিনের মনে হঠাৎ বড় করুণা ও সহানুভূতি জাগিল ইহার উপর। যাইবার সময় একটা কথা শুনিয়া যদি সে খুশি হয়, আনন্দ পায়! মুখের কথা তো, কেন এত কৃপণতা! 

সে বলিল—তুমি চলে যাচ্চ, সত্যি, মনটা খারাপ হয়ে গেল বড্ড। 

শান্তি বিদ্যুৎবেগে ফিরিয়া দাঁড়াইল, বিপিনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া এক ধরনের অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলিল— আপনার মন খারাপ হবে? ছাই! 

বিপিন অবাক হইয়া গেল শান্তির চমৎকার ফিরিবার ভঙ্গিটি দেখিয়া। 

সে উত্তর দিল—ছাই না, সত্য সত্য বলছি। 

শান্তি হাসিমুখে বলিল—আচ্ছা আসি। 

কথা শেষ করিয়া সে আর দাঁড়াইল না। 

পলকে প্রলয় ঘটাইয়া দিয়া গেল শান্তি। ইহাও ওই শান্ত মেয়েটির মধ্যে ছিল! বিপিনভাবেও নাই কোন দিন। ওর এ অদ্ভুত নায়িকামূর্তি এতদিন প্রচ্ছন্ন ছিল কেমন করিয়া? মেয়েরাপারে—ওদের ক্ষমতার সীমা নাই। অবস্থাবিশেষে দশমহাবিদ্যার মতো এক রূপ হইতে কটাক্ষেঅন্য রূপ ধরিতে উহারাই পারে। 

শান্তি চলিয়া গেলে গোটা বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা ঠেকিতে লাগিল। রোজ সন্ধ্যার সময় শান্তিচা করিয়া আনিত সে ডাক্তারখানা হইতে ফিরিলেই। আজ সন্ধ্যায় আর কেহ আসিল না। দত্তমহাশয়ের পুত্রবধূদের অত দায় পড়ে নাই। বিপিন নিজেই একটু চা করিয়া লইল। সংসারেরব্যাপারই এই, চিরদিন কেহ থাকে না। মানীকে দিয়াই সে জানে। জালে জড়াইব না বলিলেই কি না জড়াইয়া থাকা যায়? কোথা হইতে আসিয়া যে জোটে! 

সন্ধ্যায় উনুনে হাঁড়ি চড়াইয়া বিপিন রান্নাঘরের বাহিরে আসিয়া খানিক বসিল। বেশজ্যোৎস্না উঠিয়াছে—তিন চার দিন আগেও শান্তি এ সময়টা তাহাকে চা দিতে আসিয়া গল্প করিয়াছে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া, রোজই করিত। আজ সত্যই ফাঁকা ঠেকিতেছে, কিছু ভাল লাগিতেছে না। নিজের মনের অবস্থা দেখিয়া সে নিজেই আশ্চর্য হইয়া গেল। শান্তি তাহারকে? কেউ নয়, দু’দিনের আলাপ–এই তো কিছুদিন আগেও সে ভাবিত, মানীর মতোভালবাসা জীবনে আর কাহারও সঙ্গে কখনও হইবার নয়—হইবেও না। মানী ছাড়া আরকাহারও জন্য মন খারাপ হইতে পারে—এ কথা কিছুদিন পূর্বেও কেহ বলিলে সে কি বিশ্বাসকরিত? এখন সে দেখিয়া বুঝিতেছে মনের ব্যাপার বড়ই বিচিত্র, কেহই বলিতে পারে না কোন পথে কখন তাহার গতি! 

বৃদ্ধ দত্ত মহাশয় ঠাণ্ডা লাগিবার ভয়ে আজকাল সন্ধ্যার পর বাহিরে আসেন না। আজ কি মনে করিয়া তিনি বিপিনের রান্নাঘরে আসিয়া পিঁড়ি পাতিয়া বসিয়া খানিক গল্পগুজব করিলেন। শান্তির কথাও একবার তুলিলেন, মেয়েটি আজ চলিয়া গেল। কন্যা-সন্তানের মতো সেবা-যত্নকে করে, পুত্রবধূরাও তো আছে, তেমনটি আর কাহারও নিকট পাওয়া যায় না, ইত্যাদি। 

বিপিন বলিল—শান্তি বড় ভাল মেয়েটি। 

—অমন চমৎকার সেবা আর কারও কাছে পাইনে ডাক্তারবাবু। আমার এই বুড়ো বয়সে এক এক সময় সত্যই কষ্ট পাই সেবার অভাবে। কিন্তু ও এখানে থাকলে—আর ব্রাহ্মণের ওপরবড় ভক্তি। আপনার চাটুকু, জলখাবারটুকুঠিক সময়ে সব দেওয়া, সেদিকে খুব নজর। বাড়িতেযদি কোনোদিন ভাল কিছু খাবার তৈরি হয়েছে, তবে আগে আপনার জন্যে তুলে রেখে দিত। 

দত্ত মহাশয় উঠিয়া গেলে বিপিন খাইতে বসিবার উদ্যোগ করিল। এ সময়টা দু-একদিন শান্তি দালানের জানালায় দাঁড়াইয়া তাহাকে ডাকিয়া বলিত, ও ডাক্তারবাবু, একটু দুধ আজ বেশিহয়েছে আমাদের, আপনার খাওয়া হয়েছে—না হয়নি? নিয়ে আসব? 

মানী গেল, শান্তি গেল। এই রকমই হয়। কেহ টিকিয়া থাকে না শেষ পর্যন্ত। 

পরদিন সকালে ডাক্তারখানায় আসিল ভাসানপোতা মাইনর স্কুলের সেই বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী। বিপিন তাহাকে দেখিয়া আশ্চর্য হইল। শেষবার যখন তাহার সঙ্গে দেখা, তখন মানীদের বাড়িসে চাকুরি করে, মানীর গল্প করিয়াছিল ইহার কাছে। বিশ্বেশ্বর আক্ষেপ করিয়া বলিয়াছিল, তাহার অদৃষ্টে এ পর্যন্ত কোনো নারীর প্রেম জোটে নাই। বিশ্বেশ্বর কি করিয়া জানিল সেপিপলিপাড়ার হাটতলায় ডাক্তারখানা খুলিয়াছে! 

বিশ্বেশ্বর বলিল—আপনি খবর রাখেন না বিপিনবাবু, আমি আপনার সব খবর রাখি। আপনাদের গাঁয়ের কৃষ্ণ চক্কোত্তির সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়—ভাসানপোতায় ওঁর বড়মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন না? তাঁর মুখেই আপনার সব কথা শুনেছি। তা আপনার কাছে এসেচি একটা বড়দরকারি কাজে। আপনাকে একটি রুগী দেখতে এক জায়গায় যেতে হবে! 

বিপিন বলিল—কোথায়? 

—এখান থেকে ক্রোশ দুই হবে—জেয়ালা-বল্লভপুর। 

—জেয়ালা-বল্লভপুর? সে তো চাষা-গাঁ? সেখানকার লোককে আপনি জানলেন কিকরে? রুগী আপনার চেনা? 

বিশ্বেশ্বর কেমন যেন ইতস্তত করিয়া বলিল—হ্যাঁ, তা জানা বই কি। চলুন একটুশীগির করে তা হলে। 

দুপুরের কিছু পূর্বে দুজনে হাঁটিয়া উক্ত গ্রামে পৌঁছিল। বিপিন পূর্বে এ গ্রামে কখনওআসে নাই তবে জানিত জেয়ালার বিল এ অঞ্চলের খুব বড় বিল এবং গ্রামখানি বিলের পূর্বপাড়ে। বিলের মাছ ধরিয়া জীবিকানির্বাহ করে এরূপ ছেলে ও বাগ্দী এবং কয়েক ঘর মুসলমানছাড়া এ গ্রামে কোনো উচ্চবর্ণের বাস নাই 

বিশ্বেশ্বর কিন্তু গ্রামের মধ্যে গেল না। বিলের উত্তর পাড়ে গ্রাম হইতে কিছু দূরে একটা বড় অশ্বত্থ গাছ। তাহার তলায় ছোট একটি চালাঘরের সামনে বিশ্বেশ্বর তাহাকে লইয়া গেল। 

বিপিন বলিল, রুগী এখানে নাকি? 

—হ্যাঁ, আসুন ঘরের মধ্যে। সোজা চলুন, অন্য কেউ নেই। 

ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া বিপিন দেখিল একটি স্ত্রীলোক, জাতিতে বাগ্দী কিংবা দুলে, ঘরেরমেঝেতে পুরু বিচালির উপর ছেঁড়া কাঁথার বিছানায় শুইয়া আছে। স্ত্রীলোকটির বয়স চব্বিশ পঁচিশ হইবে, রং কালো, চুল রুক্ষ, হাতে কাচের চুড়ি, পরনে ময়লা শাড়ি। জ্বরের ঘোরে রোগিণী বিছানায় এপাশ ওপাশ করিতেছে। 

বিপিন ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া বলিল—এর নিমোনিয়া হয়েচে—দু’দিকই ধরেচে। খুবশক্ত রোগ। খুব সেবা-যত্ন দরকার। বড্ড দেরীতে ডেকেচেন আমাকে—তবুও সারাতে পারি হয়তো, কিন্তু এর লোক কই? খুব ভাল নার্সিং চাই—নইলে — 

বিশ্বেশ্বর হঠাৎ বিপিনের দুই হাত ধরিয়া কাঁদো কাঁদো সুরে বলিল—বিপিনবাবু, আপনাকে বাঁচিয়ে তুলতে হবে রুগীকে—যে করেই হোক, আপনার হাতেই সব, আপনি দয়াকরে— 

বিপিন দস্তুরমতো বিস্মিত হইল। বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তীর এত মাথাব্যথা কিসের তাহা ভালবুঝিতে পারিল না। এ বাগদী মাগী মরে বাঁচে তা বিশ্বেশ্বরের কি? ইহার আপন আত্মীয়স্বজনকোথায় গেল? 

বিশ্বেশ্বর বলিল—চলুন গাছতলাটার ধারে মাদুরটা পেতে দি, ওখানটিতে বসুন—তামাক সাজব? 

বিপিন গাছতলায় গিয়া বসিল। বিশ্বেশ্বর তামাক সাজিয়া আনিয়া হুঁকাটি বিপিনকে দিবার পূর্বে মলিন জামার পকেট হইতে একটা টাকা বাহির করিয়া বিপিনের হাতে দিতে গেল। বিপিন বলিল,—আগে বলুন মেয়েটা কে—আপনি এর টাকা দেবেন কেন, এর লোকজন কোথায়? 

বিশ্বেশ্বর বলিল—কেন, আপনি শোনেননি কোনো কথা? 

—না, কি কথা শুনব? 

বিশ্বেশ্বর মাদুরের একপ্রান্তে বসিয়া পড়িল। বলিল—ওর নাম মতি। বাগ্দীদের মেয়ে বটে, কিন্তু অমন মানুষ আপনি আর দেখবেন না। ভাসানপোতায় ওর বাপের বাড়ি, অল্প বয়সেবিধবা হয়। আপনি তো জানেন, আপনাকে বলেছিলাম মেয়েমানুষের ভালবাসা কি জীবনেকখনও জানিনি। কিন্তু এখন আর সে কথা বলতে পারিনে ডাক্তারবাবু। ও বাগ্দী হোক, দুলেহোক, ওই আমায় সে জিনিস দিয়েছে—যা আমি কারো কাছে পাইনি কোনো দিন। তারপর সেঅনেক কথা। ভাসানপোতা ইস্কুলের চাকুরিটি সেই জন্যে গেল। ওকে নিয়ে আমি এইজেয়ালা-বল্লভপুরে এলাম। সামান্য কিছু টাকা পেয়েছিলাম ইস্কুলের প্রভিডেন্ট ফান্ডের, তাতেইচলছিল। আর ও মাছ বেচে, কাঠ ভেঙে শাক তুলে আর কিছু রোজগার করতো। তারপরপুজোর আগে আমি পড়লাম অসুখে। টাকাগুলো ব্যয় হয়ে গেল। ও কি করে আমায় বাঁচিয়েতুলেছে সে অসুখ থেকে! তারপর এই রোজ সকালে ঠাণ্ডা বিলের জলে শাক তুলে তুলে এইঅসুখটা বাধিয়েছে! এখন ওকে আপনি বাঁচান—এ সব কথা নিয়ে ভাসানপোতায় তো খুব রটনা—আমায় গালাগাল আর কুচ্ছো না করে তারা জল খায় না। তাই বলছি আপনি শোনেননি কিছু? 

বিপিন অবাক হইয়া বিশ্বেশ্বরের কথা শুনিতেছিল। এমন ঘটনা সে কখনও শোনে নাই। শুনিয়া তাহার সারা মন বিশ্বেশ্বরের প্রতি বিরূপ হইয়া উঠিল। ছি ছি, ব্রাহ্মণসন্তান হইয়া শেষকালে কি না বাগ্দী মাগীর সঙ্গে— নাঃ, আজ কি পাপই করিয়াছিল সে, কাহার মুখ দেখিয়া না জানি উঠিয়াছিল। 

সে বলিল—টাকা রাখুন, টাকা দিতে হবে না। কিন্তু দামী ওষুধ কিছু লাগবে। 

অ্যান্টিফ্রজিস্টিন একটা কিনে আনুন, আমার কাছে নেই, লিখে দিচ্ছি আনিয়ে নিন। প্রেসক্রিপশনএকটা ধরে দিই—শক্ত রোগ — 

বিশ্বেশ্বর ব্যাকুলভাবে বলিল – বাঁচবে তো ডাক্তারবাবু? 

—নার্সিং চাই ভাল। আর পথ্যি— 

বিশ্বেশ্বর বিপিনের হাত ধরিয়া বলিল, ওষুধগুলো আপনি লিখে দিয়ে গেলে হবে না, আনিয়ে দিন। এ গাঁয়ের কোনো লোক আমার কথা শুনবে না। এই ঘটনার জন্যে সবাইবুঝলেন না, কেউ উঁকি মেরে দেখে যায় না। আপনিই ভরসা, ডাক্তারবাবু। 

বিপিন বিরক্ত হইল। ভাল বিপদে পড়িয়াছে সে! সে নিজে এখন সেই রাণাঘাট হইতে অ্যান্টিফ্লজিস্টিন আনিতে যাইবে? টাকাই বা দিতেছে কে? 

সে বলিল—আমার ডাক্তারখানায় যদি থাকত তবে আলাদা কথা ছিল। আমার কাছে এ সব থাকে না। আপনি এক কাজ করুন, গরম খোলের পুলটিশ দিন। রাই সর্ষের খোল হলে খুবভাল হয়। তাও যদি না পান, গরম ভাতের পুলটিশ দিন। আর আমার ডাক্তারখানায় আসুন, ওষুধ দিচ্চি। 

বিশ্বেশ্বর বিপিনের সঙ্গে আবার ডাক্তারখানায় আসিল। ডাক্তার হিসাবে বিপিন এ কথাওভাবিল যে, ওই কঠিন রোগীর মুখে জল দিবার কেহই রহিল না কাছে, বিশ্বেশ্বরের যাতায়াতে চারক্রোশ হাঁটিয়া ঔষধ লইয়া যাইতে দুই ঘণ্টা তো নিশ্চয় লাগাইবে, এ সময়টা একা পড়িয়াথাকিবে ওই মেয়েটা? 

পরক্ষণেই ভাবিল—তুমিও যেমন! দুলে বাগ্‌দী জাত, ওদের কঠিন জান—ওদের এইঅভ্যেস। 

বিশ্বেশ্বর কিন্তু সারাপথ মতি বাদিনীর নানা গুণ ব্যাখ্যা করিতে করিতে চলিল। অমনমেয়ে হয় না, যেমন রূপ, তেমনি গুণ। বিশ্বেশ্বরের গত অসুখের সময় বুক দিয়া সেবাকরিয়াছে—প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা খরচ করিতে দেয় না, নিজে শাকপাতা তুলিয়া, ঘুনিতে মাছ ধরিয়া বেচিয়া যাহা আয় করে, তাহাতেই সংসার চালাইতে বলে। অমন ভালবাসা বিশ্বেশ্বরকখনো কাহারও কাছে পায় নাই। 

হঠাৎ বিপিন বলিল—রাঁধে কে? 

—ওই রাঁধে। আমি ওর হাতেই খাই—ঢাকব কেন? এ আমায় অত ভালবাসে, তারহাতে খেতে আমার আপত্তি কি? ও আমার জন্যে কম ছেড়েচে? ওর বাবা ভাসানপোতা বাগ্দীপাড়ার মধ্যে মাতব্বর লোক, গোলায় ধান আছে, চাষি গেরস্ত। খাওয়া-পরার অভাব ছিলনা, সে সব ছেড়ে আমার সঙ্গে এক কাপড়ে চলে এসেছে। আর এই কষ্ট এখানে—হিম জলে নেমে শাক তুলে রোজ চিংড়িঘাটার বাজারে বিক্রি করে আসে, কাঠ ভাঙে, মাছ ধরে, ধানভানে। এত কষ্ট ওর বাপের বাড়ি ওকে করতে হোত না—তাও কি পেট পুরে খেতে পায়? আর ওই তো ঘরের ছিরি দেখলেন—ইস্কুলের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে পঞ্চান্নটি টাকা পেয়েছিলাম—তা আর আছে মোট বাইশটি টাকা—আর ঘরখানা করেছিলাম দশ টাকা খরচকরে, আমার অসুখের সময় ব্যয় হয়েছে বারো তেরো টাকা— আর বাকি টাকায় বসে বসেখাচ্ছি আজ চার মাস—তাহলে বুঝুন পেট ভরে খাওয়া জুটবে কোথা থেকে! 

লোকটার জাত নাই। বাগ্‌দিনীর হাতের রান্নাও খায়। স্ত্রীলোকের ভালবাসার দায়ে কিনা শেষে জাতিকুল বিসর্জন দিল! 

ঔষধ লইয়া বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী চলিয়া গেল। যাইবার সময় বার বার বলিয়া গেল, কাল একবার বিপিন যেন অবশ্য করিয়া গিয়া রোগী দেখিয়া আসে। 

বিপিন পরদিন একাই রোগী দেখিতে গেল। জেয়ালা পৌঁছিতে প্রায় বৈকাল হইয়া আসিল, সম্মুখে জ্যোৎস্না রাত—এই ভরসাতেই দুপুরে আহারাদি করিয়া রওনা হইয়াছে। ঘরখানার সামনে গিয়া বিশ্বেশ্বরের নাম ধরিয়া ডাকাডাকি করিয়া উত্তর পাইল না। অগত্যা সে ঘরে ঢুকিয়াদেখিল, ঘরের মধ্যে রোগিণী কাল যেমন ছিল, আজও তেমনি অঘোর অবস্থায় বিচালি ও ছেঁড়াকাঁথার বিছানায় শুইয়া আছে। বিশ্বেশ্বরের চিহ্ন নাই কোথাও। ব্যাপার কি, মেয়েটিকে এঅবস্থায় ফেলিয়া গেল কোথায়? 

বিপিন বিছানার পাশে বসিয়া রোগিণীকে জিজ্ঞাসা করিল, কেমন আছ? 

মেয়েটি চোখ মেলিয়া চাহিল। চোখ দুটি জবাফুলের মতো লাল। অস্ফুট স্বরে বলিল, ভাল আছি। 

বিপিন থার্মোমিটার দিয়া দেখিল জ্বর প্রায় ১০৪-এর কাছাকাছি। সে জানে, রোগীরা প্রায়ই এ অবস্থায় বলে যে সে ভাল আছে। মাথায় জল দেওয়া দরকার, তাই বা কে দেয়? 

সে জিজ্ঞাসা করিল—বিশ্বেশ্বর কোথায়? 

মেয়েটি বিপিনের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল। তাহার পর টানিয়া টানিয়াবলিল—অ্যাঁ—অ্যাঁ- 

—বিশ্বেশ্বরবাবু কোথায়—বিশ্বেশ্বর? 

রোগিণী এবার বোধহয় বুঝিতে পারিল। বলিল—কনে গিয়েছেন। 

ইহাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করা নিরর্থক বুঝিয়া বিপিন একটা জলপাত্রের সন্ধানে ঘরেরমধ্যে ইতস্তত দৃষ্টিনিক্ষেপ করিল। এখনি ইহার মাথায় জল দেওয়া দরকার। এককোণে একটা মেটে কলসিতে সম্ভবত খাবার জল আছে, বিপিন সন্ধান করিয়া একখানা মানকচুর পাতাআনিয়া রোগিণীর মাথার কাছে পাতিয়া কলসির জলটুকু সব উহার মাথায় ঢালিল। পরে বিল হইতে আরও জল আনিয়া আবার ঢালিল। বারকয়েক এরূপ করিবার পর রোগীণীর আচ্ছন্নভাব যেন খানিকটা কাটিল। বিপিন থার্মোমিটার দিয়া দেখিল, জ্বর কমিয়াছে ডাক্তারি করিতে আসিয়া এ কি বিপদ! এমন হাঙ্গামাতে তো সে কখনও পড়ে নাই! 

হঠাৎ তাহার মনে পড়িল মানীর মুখখানা। এই সব দুঃখী, অসহায়, রোগার্ত লোকদের ভাল করিবার জন্যই তো মানী তাহাকে ডাক্তারি পড়িতে বলিয়াছিল। মেয়েদের সেবা পাইয়া আসিয়াছে সে চিরকাল। ইহাকে ফেলিয়া গেলে মানীর, শান্তির, মনোরমার অপমান করাহইবে–কে যেন তাহার মনের মধ্যে বলিল। বিশ্বেশ্বর যদি ইহাকে ফেলিয়া পলাইয়া থাকে, তবে এখন উপায়? 

সে আবার রোগিণীকে জিজ্ঞাসা করিল—বিশ্বেশ্বরবাবু কোথায় গিয়েছে জানো? কতক্ষণগিয়েছে? 

মেয়েটি বলিল—জানিনে। 

বিপিন আর এক কলসি জল আনিতে গেল। জেয়ালার বিস্তৃত বিলের উপর সূর্যাস্তের ঘনছায়া নামিয়া আসিয়াছে। দক্ষিণ পাড়ের তালগাছের মাথায় এখনও রাঙা রোদ। দূর জলের পদ্মফুলের বনে পদ্মপাতা উলটিয়া আছে, যদিও এখন পদ্মফুল চোখে পড়ে না। বল্লভপুরেরদিকে জেলেরা ডিঙি বাহিয়া মাছ ধরিতেছে। একদল জলপিপি ও পানকৌড়ি জলের ধারে শোলাগাছের বনে গুগলি খুঁজিতেছে। বিপিনের মনে কেমন এক অদ্ভুত ভাবের উদয় হইল। যদি বিশ্বেশ্বর ইহাকে ফেলিয়া পলাইয়াই থাকে, তবে তাহাকে থাকিতে হইবে এখানেসারারাত। অর্থ উপার্জন করিলেই কি হয়? তাহার বাবা বিনোদ চাটুজ্জে কম উপার্জন করেননাই—অসৎ উপায়ে উপার্জিত পয়সা বলিয়াই টেকে নাই। কাহারও কোনো উপকার হয় নাইতাহা দিয়া। 

ঘরে রোগীর পথ্য কিছু নাই। ডাব ও ছানার জল খাওয়ানো দরকার এরকম রোগীকে।কিছুই ব্যবস্থা নাই। বিপিন নিকটবর্তী দুলেপাড়া হইতে একটি লোক ডাকিয়া আনিল।বলিল—গোটাকতক ডাব নিয়ে আসতে পারবে? দাম দেব। 

লোকটা বলিল—বাবু, আপনাকে আমি চিনি। আপনি পিপলিপাড়ার ডাক্তারবাবু, দামআপনাকে দিতে হবে না। তবে বাবু ডাব রাত্তিরে পাড়া যাবে না তো? তা আপনি কেন— সেবামুনঠাকুর কোথায় গেল? দেখুন তো বাবু, মেয়েডারে চুঁইয়ে ঘরের বার করে নিয়ে এসে তিনি এখন পালালেন নাকি? এইডে কি ভদ্দরনোকের কাজ? 

একপ্রহর রাত্রে বিশ্বেশ্বর আসিয়া হাজির হইল। সে ফেলিয়া পালায় নাই— চিংড়িঘাটার বাজার হইতে কিছু ফল, খৈল ও সাবু মিছরী কিনিতে গিয়াছিল। বিপিনকে দেখিয়া বলিল—আপনি এসেছেন? বড় কষ্ট দিলাম আপনাকে। আপনি বলে গেলেন খোলের পুলটিশদিতে, এখানে পেলাম না—তাই বাজারে গিয়েছিলাম এই সব জিনিসপত্র আনতে। কতক্ষণএসেছেন? 

দুজনে মিলিয়া সারারাত রোগীর সেবা করিল। সকালের দিকে বিপিন বলিল—আমি ডাক্তারখানা খুলব গিয়ে—বসুন আপনি—এক একা ফেলে কোথাও যাবেন না। আমি ওবেলাআবার আসব। 

একটা অদ্ভুত আনন্দ লইয়া সে ফিরিল। এই সব পল্লী-অঞ্চলের যত অসহায় দুঃস্থলোকদের সাহায্য করিবার জন্যই যেন সে জীবন উৎসর্গ করিয়াছে—এই ধরনের একটামনোভাব সারাপথ তাহাকে নিজের চোখে মহৎ ও উদার করিয়া চিত্রিত করিল।

আবার ওবেলা যাইতে হইবে। বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তীর নীচ-জাতীয় প্রণয়িনীকে বাঁচাইয়াতুলিতে হইবে–দুজনেই ওরা নিতান্ত দুঃস্থ অসহায়। যদি কখনও মানীর সঙ্গে দেখা হয়, তবে সে তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কৃতজ্ঞতার সহিত বলিতে পারিবে—আমায় মানুষ করে দিয়েচমানী। সেই গরিব, অসহায় মেয়েটির রোগশয্যার পাশে তুমিই আমার মনের মধ্যে ছিলে। 

সেই দিনই রাত্রে বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তীর ক্ষুদ্র খড়ের ঘরে বসিয়া সে বিশ্বেশ্বরকে জিজ্ঞাসাকরিল—আচ্ছা বিশ্বেশ্বরবাবু, আত্মীয়-স্বজন ছাড়লেন এর জন্যে, চাকরিটা গেল, জেয়ালারবিলের ধারে এইভাবে রয়েছেন, এতে কষ্ট হয় না? 

—কি আর কষ্ট! বেশ আছি, এখন যদি ও বেঁচে ওঠে তবে। ও আমায় যা দিয়েছে, আমার নিজের সমাজে বসে আমাকে তা কেউ দিয়েছে? 

—দেয়নি মানে কি? বিয়ে করলেই তো পারতেন! 

—আমার সাহস হয়নি ডাক্তারবাবু, সামান্য পণ্ডিতি করি—ভাবতাম সংসার চালাতেপারব না। এ নিজের দিক মোটেই ভাবেনি বলেই আমার সঙ্গে চলে আসতে পেরেছে। 

—শুধু তাই নয়, আপনি ব্রাহ্মণ, ও বাগদী। আপনাকে অন্য চোখেই দেখত, কারণআপনি উচ্চবর্ণের। কি করে আপনি আলাপ করলেন এর সঙ্গে? 

—আমাদের ইস্কুলের কাঁটাল গাছ ওর বাবা জমা রেখেছিল। তাই ও আসতো কাঁটালপাড়তে। এই সূত্রেআলাপ। এখন ওর অসুখ—ওর চেহারা বেশ ভাল দেখতে, যদি বেঁচে ওঠেতবে দেখবেন এর মুখের এমন একটা শ্ৰী আছে— 

বিপিন অন্য কথা পাড়িল—সে নিজের অভিজ্ঞতা হইতেই জানে, প্রণয়ীদের মুখেপ্রণয়িনীদের রূপগুণের বর্ণনার আদি-অন্ত নাই। হলিই বা বাগ্দী বা দুলে! প্রেম মানুষকে কিঅন্ধই করে! 

বিশ্বেশ্বরের উপরে বিপিনের করুণা হইল। তাহার সারাজীবনের তৃষ্ণা—এ অবস্থায়পানাপুকুরের জলও লোকে পান করে তৃষ্ণার ঘোরে। 

বিপিন বলিল—এর বাড়িতে আপনার লোকজনের কাছে খবর পাঠান। যদি ভালমন্দ কিছুহয়, তারা আপনাকে দোষ দেবে। এরও তো ইচ্ছে হয় আপনার লোকের সঙ্গে দেখা করতে। 

—তারা কেউ আসবে না। ওর বাবা অবস্থাপন্ন চাষি গেরস্থ। তারা বলেচে ওর মুখদেখবে না আর। 

অনেক রাত্রে বিপিন একবার জল তুলিতে গেল বিলে। ধপধপে জ্যোৎস্না চারিদিকে, অদ্ভুত শোভা স্তব্ধ গভীর নিশীথিনীর। পদ্মবনে রাত-জাগা সরাল পাখি ডাকিতেছে। দূরেবিলের ধারে জেলেদের মাছ চৌকি দেওয়ার কুঁড়ের কাছে কাঠকুটো জ্বালিয়া আগুন করিয়াছিল, এখন প্রায় নিভিয়া আসিতেছে। বিশ্বেশ্বরের দুর্ভাগ্য, হয়তো মেয়েটি আজ শেষ-রাত্রে কাবারহইবে। বিশ্বেশ্বরের বিপিন সে কথা বলে নাই, জ্বর অতি দ্রুত নামিতেছে, ক্রাইসিস আসিয়াপড়িল, নাড়ীর অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। বিপিন যাহা করিবার করিয়াছে, আর করিবার উপযুক্ততোড়জোড় নাই তাহার। বাঁচানো যাইবে না 

এই স্তব্ধ রাত্রির সীমাহীন রহস্য তাহার মনকে অভিভূত করিল। বিপিন কখনও ও সবভাবে না, তবুও মনে হইল, মেয়েটি আজ কোথায় কতদূরে চলিল, তখনও কি সে জাতেবাগ্দীই থাকিয়া যাইবে? উচ্চবর্ণের প্রতি প্রেমের দায়ে তাহার এই যে স্বার্থত্যাগ, ইহা কি সম্পূর্ণ বৃথা যাবে? কোথাও কোনো পুষ্পমালা অপেক্ষা করিয়া নাই কি তাহার সাদর অভিনন্দনের জন্য? 

মানী যদি থাকিত, এসব কথা তাহার সঙ্গে বলা চলিত। মানী সব বোঝে, সে বুদ্ধিমতী মেয়ে। শান্তি সেবাপরায়ণা বটে, কিন্তু তাহার শিক্ষা নাই, সে খাওয়াইতে জানে বটে, কিন্তু তাহার সঙ্গে কথা বলিয়া সে আনন্দ পাওয়া যায় না। মানী আজ কোথায়, কি ভাবে আছে? আর কখনও তাহার সঙ্গে দেখা হইবে না? যাক সে যেখানেই থাক, সে বাঁচিয়া আছে। নিমোনিয়ার ক্রাইসিস খড়গ লইয়া বলি দিতে উদ্যত হয়নাই তাহাকে। সে বাঁচিয়া থাকুক। দেখিবার দরকার নাই। পৃথিবীর মাটি মানীর পায়ের স্পর্শ পায় যেন, মাটিতে-মাটিতেও যেনযোগটা বজায় থাকে। 

শেষরাত্রের চাঁদ-ডোবা অন্ধকারের মধ্যে এক দিকে বিপিন, অন্য দিকে বিশ্বেশ্বর ধরিয়ামৃতদেহকে কুটিরের বাহির করিল। বিলের চারিধারে ঘনীভূত কুয়াশা। শ্মশান বিলের ওপারে, প্রায় এক মাইল ঘুরিয়া যাইতে হয়। বিপিনের খাতিরে বল্লভপুরের বাগ্দীপাড়া হইতে দুজনলোক আসিল। বিপিন এবং বিশ্বেশ্বরও ধরিল। সৎকারের কোনো ত্রুটি না হয়, প্রেমের মানরাখা চাই, বিপিনের দৃষ্টি সেদিকে। 

 

স্নান করিয়া যখন বিপিন ফিরিল, তখন বেলা প্রায় এগারোটা। 

দত্ত মহাশয় বলিলেন, ও ডাক্তারবাবু, কোথায় ছিলেন কাল রাত্রে? রুগী ছিল? শান্তি যে আপনার জন্যে শ্বশুরবাড়ি থেকে ক’রকমের আচার পাঠিয়ে দিয়েছে! যে গাড়োয়ান গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল, সে কাল রাত্রে ফিরে এসেছে কিনা—সেই গাড়িতেই আপনার জন্যে এক হাঁড়িআচার আলাদা করে—ব্রাহ্মণের ওপর বড্ড ভক্তি আমার মেয়ের— 

বিপিন যেন শক্ত মাটি পাইল অনেকক্ষণ পরে। শান্তি আছে, সে স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, সেদেহমুক্ত জীবাত্মা নয়—শান্তি তাহাকে আচার পাঠাইয়াছে। আবার হয়তো একদিন আসিয়া হাজির হইবে, আবার চা করিয়া আনিয়া দিবে তাহার সে হাতে। 

হতভাগ্য বিশ্বেশ্বর! 

সন্ধ্যার পূর্বে সে আবার বল্লভপুর গেল। বিশ্বেশ্বর কি অবস্থায় আছে একবার দেখা দরকার। গিয়া দেখিল, ঘরের দোর খোলা; বাহির হইতে উঁকি মারিয়া দেখিল, ঘরের মধ্যে বিশ্বেশ্বর ভাত চড়াইয়াছে। 

বিশ্বেশ্বর বলিল, কে? 

বিপিন ঘরে ঢুকিয়া বলিল, আমি। এখন অবেলায় রাঁধছেন যে? 

বিশ্বেশ্বরকে দেখিয়া মনে হয় না, সে কোনো শোক পাইয়াছে। বলিল, আসুন ডাক্তারবাবু। সারাদিন খাওয়া হয়নি। ঘরদোর গোবর দিয়ে নিকিয়ে নিলাম—রুগীর ঘর, বুঝলেন না? আবার নেয়ে এলাম এইসব করে, তখন বেলা তিনটে। তারপর এই ভাত চড়িয়েচি, এইবার দুটো খাব, বড় খিদে পেয়েছে। 

বিপিন চাহিয়া দেখিল ঘরের কোথাও কোনো বিছানা নেই। যে ছেঁড়া কাঁথা ও বিচালির শয্যায় রোগিণী শুইয়া থাকিত, তাহা শবের সঙ্গে গিয়াছে, এখন এই ঠাণ্ডা রাত্রে বিশ্বেশ্বর শুইবে কিসে? ওই একটিমাত্র বিছানাই সম্বল ছিল নাকি? 

বিশ্বেশ্বর ভাত নামাইয়া বড় একখানা কলার পাতায় ঢালিল। শুধু দুটি বড় বড় করলা সিদ্ধ ছাড়া খাইবার অন্য কোনো উপকরণ নাই। তাহা দিয়াই সে যেমন গোগ্রাসে ভাত গিলিতে লাগিল, বিপিন বুঝিল, লোকটার সত্যই অত্যন্ত ক্ষুধা পাইয়াছিল বটে। বেচারি চাকুরিটা হারাইয়া বসিল প্রেমের দায়ে পড়িয়া, এখন খাইবেই বা কি, আর করিবেই বা কি! তাও এমন অদৃষ্ট, একূল ওকূল দুকূলই গেল। 

প্রথম যখন খাইতে আরম্ভ করিয়াছিল, তখন বিশ্বেশ্বর তত কথা বলে নাই, দুটি করলাসিদ্ধের মধ্যে একটা করলা সিদ্ধ দিয়া আন্দাজ অর্ধেক পরিমাণ ভাত খাওয়ার পরে বোধ হয় তাহার কিঞ্চিৎ ক্ষুন্নিবৃত্তি হইল। বিপিনের দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিল, আজ দিনটা কি বিপদেরমধ্যে দিয়েই কেটে গেল! এক একদিন অমন হয়। বড্ড খিদে পেয়েছিল, কিছু মনে করবেন না। 

বিপিন বলিল—তা তো হল, কিন্তু আপনি এখন শোবেন কিসে? বিছানা তো নেই দেখচি! 

ও কিছু না, গায়ের কাপড়খানা আছে, বেশ মোটা, শীত ভাঙে খুব। আর দু আঁটিবিচালি চেয়ে আনব এখন পাড়া থেকে। 

—না চলুন, আমার ওখানে রাত্রে শুয়ে থাকবেন। এমন কষ্টে কি কেউ শুতে পারে? 

—না না, কোনো দরকার নেই ডাক্তারবাবু। ও আবার কষ্ট কিসের? ওসব কষ্টকে কষ্টবলে ভাবিনে। দিব্যি শোবো এখন, একটু আগুন করব ঘরে। তবে প্রথম দিনটা, হয়তো একটুভয়-ভয় করবে। 

—আমি আপনার ঘরে থাকবো আজ আপনার সঙ্গে? 

—কোনো দরকার নেই। আপনি না হয় একদিন শুয়ে রইলেন, কিন্তু আমাকে সইয়ে নিতে হবে তো? সে তো ভালবাসতো আমায়, তার ভূত এসে আর আমার গলা টিপবে না।আচ্ছা, সত্যি ডাক্তারবাবু, কোথায় সে গেল, বলুন তো? 

—নিন, আপনি খেয়ে নিন। ওসব কথা পরে হবে এখন। 

বিশ্বেশ্বর খাওয়া শেষ করিয়া তামাক সাজিল। নিজে দু চার বার টানিয়া বিপিনের হাতেহুঁকাটি দিল। বিপিন প্রথম দিন ইতস্তত করিয়াছিল, লোকটা বাগ্‌দিনীর হাতের রান্না খায়, ইহারজাত নাই, এ হুঁকায় তামাক খাইবে কিনা। কিন্তু কেমন একটা করুণা ও সহানুভূতি তাহার মনেআশ্রয় লইয়াছে, সে যেমন ইহার প্রতি, তেমনি ছিল ইহার মৃতা প্রণয়িনীর প্রতি। সুতরাং এখনও-কথা তাহার আর মনেই ওঠে না। 

বিপিন বলিল, এখন কি করবেন ভেবেচেন? 

—একটা পাঠশালা করব ভাবচি, এই জেয়ালা-বল্লভপুরে অনেক নিকিরি আরজেলেমালোর বাস। ওদের ছেলেপিলে নিয়ে একটা পাঠশালা খুললে, চলবে না? 

—ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে কিছু? 

—কথা এখনও তুলিনি কিছু। কাল একবার পাড়ার মধ্যে গিয়ে দু-একজনের কাছে পাড়িকথাটা। 

বিপিন বুঝিল, ইহা নিতান্তই অস্থির-পঞ্চকের ব্যাপার। কিছুই ঠিক নাই। কোথায় বা পাঠশালা, কোথায় বা ছাত্রদল! ইহার মস্তিষ্কে ছাড়া তাহাদের অস্তিত্ব নাই কোথাও। 

—আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আপনি ভূত মানেন? 

—না, যা কখনও দেখিনি তা কি করে মানব? ওসব আর ভেবে কি করবেন বলুন? 

বিশ্বেশ্বর হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিল। বিপিন অবাক হইয়া গেল পুরুষমানুষ এভাবে কাঁদিতেপারে, তাহা সে নিজেকে দিয়া অন্তত ধারণাই করিতে পারিল না। ভাল বিপদে ফেলিয়াছে।তাহাকে বিশ্বেশ্বর পণ্ডিত! 

দুঃখও হইল। লোকটার লাগিয়াছে খুব! লাগিবারই কথা বটে। কে জানে, হয়তো মনের দিক দিয়া মানীর সঙ্গে তাহার যে সম্বন্ধ, মৃতার সহিত ইহারও সেই সম্বন্ধ ছিল। হতভাগ্য বিশ্বেশ্বরের প্রতি সে অবিচার করিতে চায় না। 

ইহাকে একা এই শোকের মধ্যে ফেলিয়া যাইতে তাহার মন সরিল না। রাত্রিটা বিপিনরহিয়া গেল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *