বিপিনবাবুর কাণ্ড
নন্দবাবু বাজারে চলেছেন। বাঁ—হাতে ছাতা, ডান হাতে বাজারের থলি, পকেটে টাকা আর ব্রহ্মতালুতে রাগ। তা রাগ হওয়ারই কথা। গতকাল বিকেল থেকে তার প্রিয় দুধেল ছাগল রাইকিশোরীর খোঁজ নেই। ছোটোছেলে মদন গতকাল সিংহিদের ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে ঠ্যাং ভেঙেছে। গিন্নির সোনার বালা চুরি হওয়ায় গিন্নি আজ সন্দেহবশে পুরোনো ঝি হিরামোতিকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন, পরে যদিও বালাটা বালিশের নীচে পাওয়া যায়। তাঁর বড়োশালা ভুল করে তার পুরোনো চটি ছেড়ে রেখে নন্দবাবুর নতুন চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে চলে গেছে। বাইরের ঘরের ঘড়িটা দশ মিনিট লেট চলছে বলে আজও তাঁর বাজারে বেরোতে দেরি হয়ে গেছে। আরও আছে। কিন্তু অতসব বলতে গেলে মহাভারত। রাগের চোটে নন্দবাবু একটু জোরেই হাঁটছেন।
হঠাৎ সামনে পথ আটকে একজন বিগলিত মুখের লোক দাঁত বের করে বলল, ‘নন্দবাবু না? কী সৌভাগ্য!’
লোকটা বেজায় বেঁটে, একটু রোগা, কালো এবং মুখে ধূর্তামির ছাপ আছে। নন্দবাবু লোকটাকে কস্মিনকালেও দেখেননি।
নন্দবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি কে? কী চাই?’
‘আজ্ঞে আমি হরিপদ, হরিপদ পাল।’
‘ও, তা হরিপদবাবু, আমার খেজুরে আলাপ করার সময় নেই। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। যা বলার চটপট বলুন।’
‘ছি ছি, দেরি করিয়ে দিলাম নাকি? তা চলুন, বাজারের দিকে যেতে যেতেই দুটো কথা বলি।’
‘কী কথা?’
‘বলছিলাম কী বিপিনবাবুর কাণ্ডটা দেখলেন?’
‘বিপিনবাবু কে?’
‘আহা, বিপিনবাবু হলেন যোগেনবাবুর শালা।’
‘যোগেনবাবু কে?’
‘চিনলেন না! যোগেনবাবু হলেন নরেনবাবুর ভাইপো।’
‘নরেনবাবু কে?’
‘কী মুশকিল! নরেনবাবু যে সুধাংশুবাবুর নাতজামাই।’
‘সুধাংশুবাবু কে?’
‘ওই তো বললাম, উনি হলেন নরেনবাবুর দাদাশ্বশুর। আর নরেনবাবু হলেন যোগেনবাবুর জ্যাঠা। আর যোগেনবাবু হলেন বিপিনবাবুর ভগ্নীপতি। এবার বুঝলেন?’
‘জলের মতো পরিষ্কার। এদের কাউকেই আমি চিনি না।’
‘আহা চেনার দরকারটাই বা কী? কথাটা হল বিপিনবাবুর কাণ্ডটা দেখলেন?’
‘আজ্ঞে না।’
‘উঃ, সে সাংঘাতিক কাণ্ড। কাউকে না বলে—কয়ে বিপিনবাবু যে বাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে গেছেন।’
‘তাই নাকি? তাহলে তো চিন্তার কথা। কিন্তু আমার যে বিপিনবাবুকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই।’
‘মাথা ঘামাবেনই—বা কেন? শুধু বলছি ভদ্রলোকের কাণ্ডটা দেখলেন? বলা নেই, কওয়া নেই, বাড়ি থেকে জলজ্যান্ত মানুষটা গায়েব!’
‘তাহলে পুলিশে খবর দিন।’
‘আহা, পুলিশ তো তাঁকে আগে থেকেই খুঁজছিল।’
‘তাই নাকি?’
‘তা খুঁজবে না? তিনি যে ঢিল ছুড়ে নিত্যানন্দবাবুর অ্যালসেশিয়ান কুকুরের ঠ্যাং ভেঙে দিয়েছেন।’
‘ও, তা হলে তো ভীষণ ব্যাপার! কিন্তু এই নিত্যানন্দবাবুটি আবার কে?’
তিনি হলেন নবকৃষ্ণ দারোগার পিসেমশাই। আর নবকৃষ্ণ দারোগা হল শ্যামাপদর খুড়তুতো ভাই। আর শ্যামাপদ হল তো চারুবাবুর ভাগনে। আর চারুবাবু হলেন…’
‘থাক থাক, ওতেই হবে।’
‘তাহলে থাক। কথাটা হচ্ছে বিপিনবাবুকে নিয়ে।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিপিনবাবুর কথাটাই বরং হোক।’
‘তাই বলছিলাম, বিপিনবাবুর কাণ্ডটা দেখলেন?’
‘হ্যাঁ, বললেন তো, উনি নিরুদ্দেশ।’
‘নিরুদ্দেশ বলতে নিরুদ্দেশ! একেবারে গায়েব। কোথাও তাঁর টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। দিগন্তের চিলের মতো উড়তে উড়তে বিলীন হয়ে গেছেন।’
‘বাঃ, এ তো কাব্য হয়ে গেল দেখছি।’
লোকটা খুব লজ্জা—টজ্জা পেয়ে হাতটাও কচলে বলল, ‘একটু—আধটু আসে আর কী। কবি তমাল রায়ের কাছে তালিম নিয়েছিলাম কিছুদিন।’
‘বাঃ বাঃ। কবি তমাল রায়ের নামটা অবশ্য শুনিনি।’
‘তিনি হলেন কবি সব্যসাচী কাব্যবিশারদের সাক্ষাৎ ভাইঝি জামাই। সব্যসাচী কাব্যবিশারদ হলেন গিয়ে নটবর বিদ্যাবিনোদের ভায়রাভাই। আর নটবর বিদ্যাবিনোদ হলেন গিয়ে….’
‘থাক, থাক, কথাটা হচ্ছিল বিপিনবাবুকে নিয়ে।’
‘হ্যাঁ, কথাটা বিপিনবাবুকে নিয়েই।’
‘সেটাই হোক।’
‘তাই বলছিলাম, বিপিনবাবুর কাণ্ডটা দেখলেন?’
‘হ্যাঁ, উনি দিগন্তে বিলীন হয়ে গেছেন।’
‘বিলীন বলতে বিলীন! একেবারে কর্পূরের মতো উবে গেছেন। অথচ বাড়িতে ছেলে কাঁদছে, বউ কাঁদছে, মা কাঁদছে, পাওনাদাররা কাঁদছে।’
‘তাহলে তো খুবই খারাপ ব্যাপার।’
‘খারাপ বলতে খারাপ! শিবু গয়লার দুধ বাবদ একশো বত্রিশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা পাওনা, পঞ্চানন মুদির পাওনা দু—শো একান্ন টাকা পঁচিশ পয়সা, রহমত দর্জি পাবে একান্ন টাকা পঁচাত্তর পয়সা, পাড়ার মুচি পায় তেরো টাকা কুড়ি পয়সা, খবরের কাগজওয়ালার কাছে বাকি পড়ে আছে একাশি টাকা একান্ন পয়সা, বাড়িওয়ালার দু—মাসের ভাড়া তিনশো চল্লিশ টাকা, বনবিহারীর কাছে মাসকাবারে ধার নিয়েছিলেন আড়াইশো টাকা, গজপতির কাছে দেড়শো, সরখেলবাবুর কাছে ত্রিশ টাকা…’
‘বিপিনবাবু বেশ ধারালো লোক ছিলেন দেখছি।’
‘শুধু কী এই? ফুচকাওয়ালা, বাদামওয়ালা, অফিসের পিয়োন— তাদের হিসেব তো এখনও ধরিনি।’
‘তাহলে আর ধরবেন না।’
‘তাই বলছিলাম, বিপিনবাবুর কাণ্ডটা দেখলেন?’
‘একটু একটু দেখতে পাচ্ছি।’
‘সংসারটা ভেসে যাচ্ছে একেবারে। চাল নেই, ডাল নেই, নুন নেই, তেল নেই।’
‘সত্যিই খুব দুঃখের কথা, কিন্তু বিপিনবাবু গেলেন কোথায়? ভালো করে খুঁজে দেখেছেন?
‘গোরু খোঁজা মশাই, গোরু খোঁজা। এই তো সামতাবেড়ে তাঁর শ্বশুরবাড়ি, পিসির বাড়ি গাইঘাটা, ভাই থাকে কার্মাটারে, দাদা বিষ্ণুপুর, বড়োশালা নবদ্বীপ, ছোটোশালা দুর্গাচক, বড়োশালি গয়েশপুর, মেজোজন হিঙ্গলগঞ্জ, ছোটো শিমুলতলা, বড়োকাকা রানাঘাট, ছোটোকাকা পাঁশকুড়া, খুড়তুতো ভাই একজন কিশোরপুর, অন্য জন কেওনঝড়, বড়োমামা জলপাইগুড়ি….’
‘থাক থাক। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি তো!’
‘এক্কেবারে না। রবি ঠাকুরের ভাষায় উনি একদম ভোঁ হয়ে গেছেন, না হয়ে গেছেন।’
‘আহা খুব দুঃখের কথা।’
‘খুব, চোখের জল রাখা যায় না মশাই। তাই আমরা সবাই মিলে নিখিল ভারত বিপিন বাঁচাও কমিটি তৈরি করেছি। বিপিনবাবু ভোঁ ভোঁ হলেও সংসারটা তো আছে। সেটাকে তো আর ভেসে যেতে দেওয়া যায় না।’
‘সে তো ঠিকই।’
‘কমিটির চেয়ারম্যান হলেন সতীশ ঘোষ। চিনলেন তো। এই যে সুরেনবাবুর বড়োমেসো, সুরেনবাবুকে নিশ্চয়ই জানেন, হারান বোসের…’
‘আচ্ছা, আচ্ছা, কথাটা হচ্ছিল বিপিনবাবুকে নিয়ে।’
‘তা তো বটেই। তা বলছিলাম, বিপিনবাবুর কাণ্ডটা দেখলেন?’
‘দেখছি মশাই, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।’
‘হ্যাঁ, সবাই দেখছে। তা সেই বিপিন বাঁচাও কমিটির সেক্রেটারি হলেন গিয়ে গিরিধারী হালদার, যার শালা মাধব রায় গঙ্গাবক্ষে সাত মাইল সাঁতার কেটে বিখ্যাত, সেই মাধব রায় যার তালুইমশাই হল গিয়ে গোবিন্দ বিশ্বাস…’
‘থাক থাক, বিপিনবাবুর কথাটাই হোক।’
‘তাই হোক। নিখিল ভারত বিপিন বাঁচাও কমিটির আজীবন সদস্যপদ চাঁদা মাত্র দু—হাজার টাকা, দশ বছরের হল দেড় হাজার, পাঁচ বছর হলে হাজার, এক বছরের জন্য মাত্র দু—শো, ছ—মাসের সদস্যপদ…’
‘থাক, থাক। তা আমাকে কত দিতে হবে?’
লোকটা জিভ কেটে বলল, ‘ছিঃ ছিঃ, আপনার কাছে সেই উদ্দেশ্যে আসা নয়। তবে কিনা সবাই শুনে দুঃখ পায়। দুঃখ পেলে লোকে ভাবতে বসে। ভাবতে বসলে লোকের চোখে জল আসে। চোখে জল এলে লোকের মন গলতে থাকে। আর মন গলতে শুরু করলে হাত দিয়ে পকেটে ঢোকে…’
‘থাক, থাক। কত?’
‘কী যে বলেন? তা গোটা পাঁচেক যদি হয়, কোনো চাপাচাপি নেই কিন্তু।’
নন্দবাবু টাকাটা দিয়ে বললেন, ‘চাপাচাপি নেই বলছেন? ওরে বাবা!’
লোকটা একটু লাজুক হেসে বলল, ‘লোকে অবশ্য বিপিন বাঁচাও কমিটিকে খুবই গালমন্দ করছে, মামলামোকদ্দমা করবে বলে শাসাচ্ছে, ঝগড়াঝাঁটিও লেগে যাচ্ছে। তাই বলছিলাম বিপিনবাবুর কাণ্ডটা দেখলেন?’