বিপন্ন
এম. এস-সি পাস করিলাম; সঙ্গে সঙ্গে একটি চাকরিও জুটিয়া গেল। বয়স তখন এত অল্প যে, প্রফেসার সেন তাঁহার নিজস্ব প্রথায় অভিনন্দিত করিয়া বলিলেন, শৈলেন, তুমি, যাকে বলে এঁচড়ে পেকে গেলে।
চাকরি—বেহারে কোন একটি কলেজে প্রফেসারি। সত্বর যোগদান করিবার তাগিদও ছিল, তাহার উপর কাকা ‘শুভস্য শীঘ্রম্ শুভস্য শীঘ্রম্’ করিয়া বাড়িটাতে এমন একটা উৎকট তাড়ানো-ভাব দাঁড় করাইলেন এবং আমি বালকসুলভ অবুঝপনার বশে চাকরিটা হারাইবই জানিয়া শেষ পর্যন্ত এমন নিরাশ হইয়া হাল ছাড়িয়া দিলেন যে, বাহালি-পত্র পাওয়ার পরদিনই তাড়াতাড়ি যাত্রা করিতে হইল। তাহাতে খুঁটিনাটি অনেক প্রয়োজনীয় দ্রব্যই কেনা হইয়া উঠিল না।
কর্মস্থানে পৌঁছিয়া বৈকালের দিকে বাজারে বাহির হইয়া গেলাম এবং একটু ঘুরিয়া ফিরিয়া একটি বড় দেখিয়া মনিহারী দোকানে প্রবেশ করিলাম। দোকানটিতে বেশ ভিড়, বেশির ভাগ লোকই দাঁড়াইয়া; কাউন্টারের সামনে সারি সারি কতকগুলি চেয়ার পাতা, সবগুলিই অধিকৃত। আমার একটু বসিতে পারিলেই ভাল হইত, কেন না, অনেকগুলি জিনিস লইতে হইবে, বিলম্ব হইবার কথা। এদিক-ওদিক চাহিতেছি, হঠাৎ নজর পড়িল, একটি কোণাপানা জায়গায় একটি ছোকরা আমার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। চোখোচোখি হইতেই তাহার চেয়ারটি ছাড়িয়া একটু সরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আপনি এইখানে আসুন না; দাঁড়িয়ে কেন?
হিন্দিতে কথা বলিল, তাহা না হইলে বেহারী বলিয়া চিনিবার উপায় ছিল না। মাথায় আধা-বাবরি-গোছের ব্যাক-ব্রাশ চুল, কোঁচায় কাবুলীফেরতা দেওয়া কাপড় পরা, গায়ে বোতামের কালো ফিতা বাহির করা একখানি পাশ-বোতাম পাঞ্জাবি—টায়টোয়ে কোমরের নীচে পর্যন্ত নামিয়াছে, পায়ে নাগরা—এদেশী নয়, যাহা কলিকাতায় গিয়া বাংলার সুকুমারত্বের ছাপ লইয়া আবার এখানে ফিরিয়া আসিয়াছে। একটু হাসিয়া ইংরেজিতে বলিলাম, না, থাক, ধন্যবাদ। আমি বেশ আছি।
এক ধরনের খাতির আছে যাহা অত্যাচারের নামান্তর মাত্র, দেখিলাম এও তাই। তাও কি হয়?—বলিয়া ছোকরা হাসিতে হাসিতে দুই পা আগাইয়া আসিল এবং আমার হাতটা ধরিয়া চেয়ারে বসাইয়া দিয়া সামনের বিক্রেতাকে বলিল, নাও, আমার এখন থাক্, আগে এঁকে দাও; সেই থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ভদ্রলোক।
সন্দেহ হইল, দালাল নাকি? তাই বা কেমন করিয়া হয়? দেখিলাম, কাউন্টারের উপর তাহার নিজেরই বাছাই করার জন্য একরাশ জিনিস রহিয়াছে। ফুলেল তৈল, সাবান, আরশি, চিরুনি, কয়েক রকম সুগন্ধি, লেটার প্যাড, আরও নানা রকম জিনিস—যাহা শৌখিন ও আবার প্রয়োজনীয়ও হয়। ইতিমধ্যে বিক্রেতা কাউন্টারের কাছ হইতে একখানা চেয়ার তুলিয়া তাহার জন্য এদিকে নামাইয়া দিল। বোঝা গেল, শাঁসালো খদ্দের বলিয়া বেশ খাতির আছে।
আমি বিক্রেতাকে বলিলাম, আগে আমায় একটা স্টোভ দেখাও দেখি; প্রাইমাস হানড্রেড আছে?
দোকানী বলিল, আছে বাবু, তবে একটু দেরি হবে, সামান্য একটু। আজই বাক্স এসে পৌঁছেছে, প্যাকিং খুলে এখুনি নিয়ে আসছি।–—বলিয়া সে ফিরিল; ছোকরা চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া বলিল, খুলে, দাম খতিয়ে নিয়ে এস, নইলে একটা যা-তা দাম ব’লে এঁকে ঠকাবে। কিছু তাড়াতাড়ি নেই এঁর।
তাহার পর আমায় প্রশ্ন করিল, আপনি কি বেশি ব্যস্ত?
বলিলাম, না, তেমন আর কি! তবে ততক্ষণ বরং অন্য একজনকে ব’লে যাক্ না, আমায় তেল, সাবান, ব্লেড এইগুলো দিক বের ক’রে।
আচ্ছা, সে হচ্ছে। তুই যা শিগগির, দেখিস, যেন আবার মেলা তাড়াহুড়ো ক’রে যা- তা নিয়ে আসিস নি। ও-ই আসুক মশাই, ভাল সেলম্যান। সিগারেট খান?
পকেট হইতে একটি সিগারেট-কেস বাহির করিয়া সামনে ধরিল। একটা সিগারেট বাহির করিয়া মুখে দিলাম; ছোকরা নিজেও একটা ঠোঁটের মাঝে আলগা করিয়া ধরিয়া কেতাদুরস্তভাবে দেশলাই জ্বালিয়া আমার সামনে ধরিল। তাহার পর নিজেরটা ধরাইয়া, একমুখ ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল, স্মোক ইজ মাই প্যাশন।
একেবারে আপ-টু-ডেট।
লক্ষ্য করিলাম, সিগারেট খাইতে খাইতে খুব চকিত এবং সংযতভাবে দুই-একবার পাশের জিনিসগুলির উপর দৃষ্টিপাত করিল এবং নিতান্ত অন্যমনস্কভাবে কি যেন ভাবিতে লাগিল; তাহার ভাবটা দেখিলে সন্দেহ হয়, যেন কি একটা কথা বলিতে চাহিতেছে, অথচ যেন জো পাইতেছে না।
নিতান্ত চুপ করিয়া থাকার অস্বস্তি কাটাইবার জন্য বলিলাম, ও জিনিসগুলো বুঝি আপনি পছন্দ করবার জন্যে আনিয়েছেন?
মুখের ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে মাথা নাড়িয়া জানাইল, হ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে যেন হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল এইভাবে বলিল, ঠিক কথা, এই তো আপনাকে পাওয়া গেছে, দিন তো মেহেরবানি ক’রে আমার গোটাকতক জিনিস পছন্দ ক’রে। বলবেন বোধ হয়, কেন, আপনি নিজে কি পছন্দ করতে পারেন না? পারি, কিন্তু জানেনই তো টু হেডস আর বেটার দ্যান ওয়ান।
আমার মুখে এরূপ একটা অশোভন আপত্তি ধরিয়া লওয়ায় আমি একটু লজ্জিত হইয়াই বলিলাম, সে কি কথা? আমার দ্বারা যদি সামান্য সাহায্য হয় তো আমি বিশেষ আনন্দিতই হব।
সে আমি বাঙালিদের জানি, তাঁদের সম্বন্ধে আমার ধারণাও খুব উচ্চ। আচ্ছা, এই সাবানের কথাই ধরা যাক্।
সাবানের বাক্সগুলি একে একে সরাইয়া দিয়া বলিল, এই তো ভিনোলিয়া, ইর্যামিক, হিমানী, ন্যাসকো, পামঅলিভ, ক্যালকাটা সোপ ওয়ার্কস, মাইসোর—আরও এইসব কি কি রয়েছে, আপনি কোন্টা রেকমেন্ড করেন?
আমি বলিলাম, মাফ করবেন, বিলিতীগুলির সম্বন্ধে আমি কিছু বলব না। তবে— ছোকরা ভিনোলিয়া, পামঅলিভ, ইরামিকের বাক্সগুলি সঙ্গে সঙ্গে পাশে সরাইয়া রাখিয়া বলিল, নিন, বলুন এবার। মানে, ভিনোলিয়া দাবি করে, অমন সফ্ট আর ডেলিকেট স্কিন অন্য সাবানে দিতে পারে না। তা যাক গিয়ে; এদিকে আবার স্বরাজও তো চাই মশাই! এখন এগুলোর মধ্যে আপনার কোটা পছন্দ? এক কোম্পানিরই পাঁচ-সাত রকম আছে। আচ্ছা, আপনি সায়েন্স, না, আর্টস?
বলিলাম, সায়েন্স।
আই. এস-সি?
না, এইবার এম. এস-সি পাস করেছি।
ছোকরা গভীর শ্রদ্ধার সহিত আমার দিকে চাহিল, তাহার পর বলিল, তবে তো কথাই নেই, দি ম্যান ফর ইট। আচ্ছা, সাবানে গায়ের রঙ ইমপ্রুভ করতে পারে? ধরুন—
সেকেন্ড কয়েক একটু চিন্তা করিয়া লইল, তাহার পর কহিল, ধরুন—এই ধরুন কেউ যদি পাড়াগাঁয়ে মনে করুন, এই তেরো-চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত কাটিয়ে থাকে, জানেনই তো, পাড়াগাঁয়ে ধুলো কাদা মেঠো হাওয়া—এসবের মধ্যে রঙ তো আর ঠিক থাকে না; তা এখন যদি সে রেগুলারলি সাবান মেখে যায় তো রঙটার জলুস বাড়বে ব’লে আপনাদের সায়েন্স গ্যারান্টি দিতে পারে?
কোথায় ব্যথা এবং আমার এত খাতিরের কারণটাই বা কি এতক্ষণে বুঝিলাম। বলিলাম, কি জানেন? সায়েন্স যে গায়ের রঙ আর সাবানের কথা ধ’রেই কোন বিশেষ কথা বলেছে তা মনে পড়ে না; তবে সাবান জিনিসটা লোমকূপগুলো বেশি পরিষ্কার রাখে, বাইরের ময়লাও জমতে দেয় না, কাজেই গায়ের চামড়ার স্বাস্থ্যটা থাকে ভাল, সেই থেকেই—
ছোকরা গালে হাত দিয়া মাথাটি কাত করিয়া খুব মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনিতেছিল; সোজা হইয়া বসিয়া, তর্জনীটা একটু নামাইয়া বলিল, দেয়ার ইউ আর, হয়েছে। আচ্ছা, যদি হয় তো এক বার করে সাবান মাখলে যে পরিমাণে উন্নতি হবে; দু’ বার করে মাখলে তার চেয়ে বেশি উন্নতিই হবে নিশ্চয়, তিন বার করে মাখলে সেই অনুপাতে তার চেয়েও বেশি? চার বার—ছ বার—আট বার—
হায় রে, চোদ্দ-পনেরো বৎসরের গাত্রচর্ম, তোমার বিপদও অনেক! আমি আর না থাকিতে পারিয়া বলিলাম, হেজে যেতে পারে।
ছেলেটি যেন একটু অপ্রতিভ হইয়া হঠাৎ থামিয়া গেল। ক্ষণমাত্রে সামলাইয়া লইয়া বলিল, না, ছ বার আট বার একটা কথার কথা বলছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সাবান পর্ব যেন চাপা দেওয়ার জন্যই একটা তুলিয়া লইয়া বলিল, তা হ’লে এ সাবানটার সম্বন্ধে কি বলেন? কোম্পানিটাও ভাল, গন্ধটাও ডিসেন্ট–
খুব বড় সাবানবেত্তা বলিয়া আমার কোন কালেই নাম ছিল না; তবু বেচারাকে সপ্রতিভ করিয়া তুলিবার জন্যই বলিলাম, দেখি, হ্যাঁ, এইটিই আজকাল কলকাতায় খুব চলেছে, হট ফেবারিট।
মুখটি পুলকে দীপ্ত হইয়া উঠিল, বাক্সটা একটু তুলিয়া ধরিয়া এক পাশে নামাইয়া রাখিল, মনে মনে, বুঝিবা কাহার দুটি কঙ্কণ-পরা হাতে তুলিয়া দিল। বলিল, এই দেখুন বেয়াদবি, আপনাকে পান অফার করা হয় নি!
পকেট হইতে একটা রূপার ডিবা বাহির করিয়া ডালাটা খুলিয়া ধরিল। জিজ্ঞাসা করিল, জরদা খান?
না।
আচ্ছা, তেল আজকাল কলকাতায় সবচেয়ে কোন্টা বেশি চলছে?
সাবান সম্বন্ধে সমস্ত কলিকাতাকে টানিয়া আনিয়া ভাল করি নাই দেখিতেছি; কি উত্তর দিব ভাবিতেছি, ছোকরা বলিয়া উঠিল, অত কথায় কাজ কি, আপনি নিজে কি ব্যবহার করেন তাই বলুন না? আপনারও তো চমৎকার চুল দেখছি।
উত্তর করিলাম, আমার কথা ছেড়ে দিন, যখন যেটা হাতের কাছে পাই, খানিকটা দিই মাথায় চাপড়ে।—বলিয়া একটু হাসিলাম।
ছোকরা নেহাত যেন খাতিরে পড়িয়া মুহূর্তের জন্য মুখটাতে একটু হাসি টানিয়া আনিল, সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর ব্যস্ততার সহিত জেরা শুরু করিয়া দিল।
আচ্ছা, হাতের কাছে কোন্টা বেশি পান?
তার কি কোন ঠিক আছে। কোনদিন হয়তো দিলামই না তেল মাথায়।
নাছোড়বান্দা। ক্ষণমাত্র ভাবিয়া বলিল, আচ্ছা, না হয় অন্যদিক দিয়েই দেখা যাক্, সবচেয়ে কম কোটা পান?
আমি আর একবার হাসিয়া বলিলাম, সেটা আরও বলতে পারি না। যেটা সবচেয়ে বেশি পাই, সেটার কথাই যখন মনে থাকে না, তখন সবচেয়ে কমের কথা কি করে মনে থাকবে বলুন?
আবার একটু অপ্রস্তুত ভাব; একটু মৌন থাকিয়া বলিল, আচ্ছা আপনাদের সায়েন্স কি বলে, চুলের সঙ্গে তেলের সম্বন্ধ বিষয়ে?
বলিলাম, কেশতৈল সম্বন্ধে সায়েন্স বিশেষ করে কোথাও ব’লে গেছে ব’লে তো মনে পড়ে না। তবে কথা হচ্ছে, তেল-টেল মাখলে, একটু শ্যামপুইং করলে চুলটা থাকে ভাল।
ছোকরা আমার কথার সঙ্গে সঙ্গে তর্জনীটা নামাইয়া বলিল, থাকে ভাল। বেশ এইবার এই দিক থেকে দেখা যাক, কেশতৈল হচ্ছে মোটামুটি তিন ক্লাসের—তিলের, নারকেলের, আর এন্ডির, এই তিনের কোনো-না-কোনো একটা দিয়ে ভাল কেশতৈল তৈরি; এখন দি কোশ্চেন ইজ, এর মধ্যে কোটি চুলের পক্ষে সবচেয়ে ভাল? আপনাদের সায়েন্স কি বলে? ধরুন—। একটা ঢোক গিলিয়া বলিল, এই ধরুন, আমার এক আত্মীয়া প্রায় তের- চৌদ্দ বৎসর পর্যন্ত পাড়াগাঁয়েই ছিল। আমাদের দেশের বাপ-মায়েরা সৌন্দর্য সম্বন্ধে কতটা গাফিল, জানেনই তো। বিশেষ ক’রে বেহারে। এরা আবার স্বরাজ চায় মশাই! আমার হাতে থাকলে আমি এখন দুশো বছর কিছু দিতাম না। চুল যে সৌন্দর্যের একটা কতবড় অঙ্গ, সেটুকুও যারা জানে না, তারা আবার স্বরাজ চায় কোন্ মুখে, মশাই? ‘স্বাস্থ্য ভাল, স্বাস্থ্য ভাল’ ব’লে যে তার বাপ-মা গুমর করে, তাতে তাদের কি বাহাদুরি? সে তো নেচার দিয়েছে, শুধু চুলটার দিকে তোমরা একটু লক্ষ্য রাখতে পারলে না? শেম!
বেজায় চটিয়াছে। একবার মনে হইল, বলি, আজকাল তো সভ্য এবং স্বাধীন জগতে চুলটা বাদই দিতেছে—বলিয়া স্বরাজকামীদের এবং তাহার ‘আত্মীয়া’র বাপ-মায়েদের উপস্থিতির জন্য বিপন্মুক্ত করি; কিন্তু কেশের মোহ তাহাকে যেমন পাইয়া বসিয়াছে, তাহাতে এ ধরনের কথায় ফল হইবে না জানিয়া কহিলাম, আপনি যদি তাঁর চুলের উন্নতি চান তো এখনও যে একান্ত না হয় এমন নয়।
ছোকরা ব্যস্তভাবে বলিল, কি ক’রে? আমি এইজন্যই তো আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, বাঙালি বলেই। আর আমি মশাই, বাঙালিদের একটু ভালবাসি। এদিকে আমরা বলি, বেহার ফর বেহারীজ, ওদিকে আপনারা পাল্টা জবাব দিন, বেঙ্গল ফর বেঙ্গলিজ—এই ক’রে দুটো প্রতিবেশী জাতের মধ্যে ভাবের কিংবা অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে যাক—বাস্, তা হ’লেই স্বরাজ মুঠোর মধ্যে এসে পড়বে আর কি! নিন, সিগারেট খান। চুলোয় যাক সব, তবে আমাকে আপনার বন্ধু ব’লেই জানবেন।
বলিলাম, বড় আনন্দ এবং সৌভাগ্যের বিষয়। বলেছেন ঠিকই, পাশাপাশি দুটি জাতের মধ্যে এ ধরনের মনোমালিন্য থাকা উচিতও নয়, আশা করা যায়, থাকবেও না বেশিদিন। ঠিক কথা, কেশ সম্বন্ধে আমাদের দেশের স্ত্রীলোকেরা যা করেন—
ছোকরা তর্জনীটা উৎসাহভরে টেবিলে ঠুকিয়া বলিল, দেয়ার ইউ আর; আমি সেই কথাই জিজ্ঞাসা করব করব করছিলাম, অথচ লেডিদের কথা তুললে আপনি কি মনে করবেন ভেবে জিজ্ঞাসা করতে পারছিলাম না। হ্যাঁ, তাঁরা কি করেন? বাঙালি ছেলেমেয়েদের কেশসৌন্দর্য নামী। আমাদের এখানে কথায় বলে, ‘ছাজা, বাজা, কেশ— তিনে বাংলা দেশ!’ ‘ছাজা’ হ’ল ঘরের ছাউনি, ‘বাজা’ বুঝতেই পারেন, বাজনা, আর ‘কেশ’—এই তিন নিয়ে বাংলা দেশ। আচ্ছা ধরুন, তাঁরা যে উপায় অবলম্বন করেন, তাতে কতটা পর্যন্ত উন্নতি হতে পারে? যার চুল কোমর পর্যন্ত কায়ক্লেশে যায়, কতটা নামাতে পারে তার চুল? হাঁটু পর্যন্ত? নাঃ, হাঁটু পর্যন্ত আর হতে হয় না, টু লেট, কি বলেন?
নূতন বিবাহ, নূতন সাধ; নিরাশ করিয়া আর পাপের ভাগী হই কেন? বলিলাম, চোদ্দ- পনেরো আর এমন কি বিশেষ দেরি হ’ল। এই তো মোটে চুল হবার সময় আরম্ভ হয়েছে। ছোকরা আমার কথাগুলি শুনিতে শুনিতে স্মিতবদনে পানের ডিবা বাহির করিতেছিল; বলিল, আসুন, পান খান। আচ্ছা, চুল কি হাঁটুর নীচেও নামতে পারে? সে রকম যত্ন নিলে? এই দেখুন না, এই হেয়ার অয়েলটার বাক্সের এই ছবিটা!
বেজায় হাসি পাইল। তবুও ভাবিলাম, যাহার এমনই সঙ্গিন অবস্থা যে তুচ্ছ একটা বিজ্ঞাপনের ছবিকে ধ্রুব সত্য বলিয়া মানিয়া লইয়াছে, তাহাকে দমানো নিতান্ত পাষণ্ডের কাজ। বলিলাম, তুলির টানে যতটা সহজে চুল নীচে নামানো যায়, বাস্তবক্ষেত্রে ততটা আশা করা যায় না, তবে চেষ্টার অসাধ্য তো কিছু নেই।
নিশ্চয়ই, নেপোলিয়ান আল্পস ক্রস করেছিলেন কি ক’রে মশাই? চেষ্টা করেই তো? তা হ’লে ধরুন পায়ের গুলের নীচ পর্যন্ত? যদি খুব যত্ন নেওয়া যায়, প্রাণপণে? সম্ভব?
বড়ই বাড়াবাড়ি হইয়া উঠিতেছে। বিনীতভাবে, যেন এক অনির্দিষ্ট পক্ষের জন্য ওকালতি করিতেছি এইভাবে বলিলাম, দেখুন, ও-রকম যত্ন নেওয়া কি এক উপদ্রবে দাঁড়াবে না? গোড়ালি পর্যন্ত চুল নিয়ে জীবন কাটানো—খোঁপা করে রাখলে তার ভারে মাথা ঠিক রাখা দায়, খুলে রাখলে পায়ে জড়িয়ে আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা।
ছোকরা বোধ হয় ঝোঁকের মাথায় নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষার অধোগতির বহর দেখিয়া লজ্জিত হইয়া পড়িল। একটু আমতা-আমতা করিয়া বলিল, না, ও একটা এমনই জিজ্ঞাসা করছিলাম, কথায় কথায়। কি জানেন, আপনার কোন আত্মীয়ার সৌন্দর্যটুকু যথাসাধ্য বাড়িয়ে যদি একটু উপকার করতে পারেন তো করেন না কি? বললে শুনব কেন? আপনারা, বাঙালিরা, তো এটা একটা কর্তব্যের মধ্যেই ধরেন।
সেই নেহাত গদ্যময় স্থানে, বেচা-কেনার হট্টগোলের মধ্যে রচিত নিভৃতে এই নূতন প্রণয়ীর মূঢ়তা, বিহ্বলতা বেশ মিষ্ট লাগিতেছিল। একবার ইচ্ছা হইল, একটি সুমিষ্ট প্রশ্নের আঘাতে কৃত্রিম অথচ স্বচ্ছ রহস্যটুকু ভাঙিয়া দিয়া ব্যাপারটিকে চরমে আনিয়া ফেলি; শুধাই আত্মীয়াটি কি ধরনের, অর্থাৎ সৌন্দর্য বাড়াইয়া উপকার করিলে উপকারটি আসলে কোথায় পৌঁছিবে বন্ধু?
কি ভাবিয়া প্রশ্নটা আর করিলাম না।
***
ভালই করিয়াছিলাম।
পরের দিন কর্মে যোগদান করিলাম। প্রিন্সিপ্যাল রায় আমায় সমস্ত কলেজটি একবার ঘুরিয়া লইয়া দ্বিতীয় বাৎসরিক শ্রেণীর ঘরে লইয়া গিয়া পরিচিত করিয়া দিলেন; এই ক্লাসেই আমার অধ্যাপনা শুরু।
ক্লাসটির উপর একবার চোখ বুলাইয়া লইতে গিয়া হঠাৎ চতুর্থ বেঞ্চের এক জায়গায় আমার চক্ষু সেকেন্ড কয়েকের জন্য নিরুদ্ধ হইয়া গেল। দেখি, একটি ছোকরা একদৃষ্টে আমার পানে চাহিয়া আছে; চোখে জ্বলন্ত বিস্ময়, তাহাতেই যেন মাথার চিতাইয়া আঁচড়ানো চুল খাড়া হইয়া উঠিয়াছে, মুখে ছোট্ট একটি গোল হাঁ, বাঁ হাতে কালো ফ্রেমের চশমা; শখের জিনিস, দৃষ্টিকে নিঃসন্দেহ করিবার জন্য যেন পথ ছাড়িয়া দাঁড়াইয়াছে।
কালকের সেই ছেলেটি, দোকানে যাহার সহিত পরিচয় হইয়াছিল। আমি তাড়াতাড়ি চোখ ফিরাইয়া লইলাম।
রোল কল করিতে করিতে মনে হইল, যে ছেলেটি ৮৮-তে উত্তর দিয়াছিল, সে-ই যেন আবার ৯২-তেও সাড়া দিল। প্রক্সি; আন্দাজে কাহার প্রকৃসি তাহাও বুঝিলাম, তবুও দৃষ্টি একবার চতুর্থ বেঞ্চে গিয়া পড়িল। দেখিলাম, সেই কেশবিলাসী ছেলেটির জায়গা খালি, হাজরির বন্দোবস্ত করিয়া কখন নিঃসাড়ে চলিয়া গিয়াছে।
৮৮ এবং ৯২-কে আর একবার ডাকিলেই প্রবঞ্চনাটা হাতে হাতে ধরা পড়িত; কিন্তু তাহা আর করিলাম না। ভাবিলাম, যাক, আপাতত সেও যেমন বাঁচিয়াছে, আমিও তেমনই একটা প্রবল অস্বস্তির হাত হইতে রক্ষা পাইয়াছি।