বিপদ-আপদ

বিপদ-আপদ

—হ্যালো

—মল্লিকাদি, কেমন আছ?

—ভাল, কিন্তু জিনা তো এখনও ফেরেনি মুকুট!

—জানি। তোমাকেই ডাকছিলাম।

‘ডাকছিলাম।’ কেমন অদ্ভুত কথাটা। কেউ তাকে ডাকে? ডেকেছে কখনও?

সে বলল, বলো।

—মুসৌরি যাচ্ছি। মল্লিকাদি, তোমরা যাকে বল ‘হনিমুন’। তুমি গিয়েছিলে?

—হ্যাঁ, শাশুড়ি সহযোগে, পুরী।

হাসির শব্দ ভেসে এল।

—তুমি যা ভিতু, তোমার সব সময়েই একটা প্রোটেকশন দরকার হয়। না?

—না মুকুট। তুমি যা ভাবছ আমি সেরকম না।

—সেই দুপুরের স্বপ্নগুলো…দেখ? ম্যমির মতো লোক তাড়া করেছে…

শিউরে উঠে মল্লিকা বলল, না। অনেকদিন দেখিনি। তুমি কি এখনও সেই নিয়ে ভাবছ?

—ঠিক আছে। কেন জানি না বেড়াতে যাবার সময়ে তোমার কথা মনে হল। ভাল থেকো।

মুকুট শেষ কথাটার জবাব দিল না।

—চেষ্টা তো করি। বিপদে পড়লে বিপদভঞ্জন মধুসূদনকে ডাকতেই হয়। —মল্লিকা বলল।

—‘বিপদে আমি না যেন করি ভয়—’ এই মন্ত্র জপ করবে। বুঝলে?

—বুঝলাম। যাও, তোমরা আনন্দ করে এসো। তাড়াতাড়ি ফিরো। আমাদের ভুলে যেয়ো না।

একই পৃথিবীতে নানান মানুষ জন্মাচ্ছে। প্রত্যেকের জিভে জীবনের স্বাদ কেন আলাদা রকম? সে বুঝতে পারে পৃথিবীটা কোথাও খুব সুন্দর, জীবনটাও খুবই চমৎকার। কিন্তু তার অনুভবে ব্যাপারটা ধরা দিতে দিতেও দেয় না। এই অল্প বয়সের দুঃখ-কষ্টের চোঁয়াঢেঁকুর কি সারা জীবনই উঠতে থাকবে? কেন? কেন সে এর ওষুধ খুঁজে পায় না? অথচ, তার তো সবই আছে। দিদি মাঝে মাঝে চিঠি লেখে—‘মল্লি, তুই খুবই ভাল আছিস জানি। আমার একমাত্র ছেলেটা লন্ডনে সেট্‌ল করে গেল, কাউকে বোঝাতে পারি না এ কষ্ট।’ এ কি কাউকে তেমন করে ভালবাসতে না পারার কষ্ট? এ কথাও মল্লিকার এক এক সময়ে মনে হয়। সে কাউকে ভালবাসেনি, তাকেও কেউ ভালবাসেনি। কেউ নেই যাকে বিশ্বাস করে নিজের সব কথা বলা যায়। শাশুড়ি যথেষ্ট আদর দিতেন, কিন্তু তাঁকে বলতে পারেনি, স্বামী সদাশয়, তাকেও বলতে পারেনি—সবাই যেন বড্ড দূরে দূরে। হাত বাড়িয়ে সে কাউকে ছুঁতে পারে না। ভেতরে কথা জমে, কান্না জমে, বুকটা পাথর হয়ে থাকে। তার যদি একটা সত্যিকারের বাবা থাকত! সেইসব গল্পের বাবার মতো যাঁরা মেয়ের সুখশান্তির জন্য কোনও কাজেই পিছপা হন না! একজন অগতানুগতিক বাবা!

গা ধুয়ে একটা হলুদ খড়কে ডুরে পরে সে আয়নার সামনে দাঁড়াল। কপালে ভাল করে একটা টিপ আঁকছে। রঙিন কুমকুম দিয়ে। ফোনটা বাজল। এইসময়ে সাধারণত রং নাম্বারগুলো আসে। ঝুম্পা-মাম্পির বন্ধুরা জানে ওরা এ সময়ে থাকবে না। জিনার বাপের বাড়ির ফোনগুলোও আসে সন্ধের পর।

—এটা কি তেত্রিশ নম্বর ডাফ স্ট্রিট?

—আপনি কাকে চাইছেন?

অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠ বলল, চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউয়ে ডক্টর সেনগুপ্ত’জ ক্লিনিক থেকে বলছি। মল্লিকা দেবী কি আছেন?

—হ্যাঁ। কেন? বলছি।

—আপনার বাবা কল্যাণবাবুর একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আপনারা যে যে আছেন, চলে আসুন। ওঁকে হাসপাতালে রিমুভ করতে হবে।

মল্লিকার হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছিল। কেমন গা-বমি করছে। বাবা? অ্যাকসিডেন্ট? বাসের তলা, না ট্রাকের তলা! দলা পাকানো রক্তাক্ত একটা দেহ ছাড়া চোখের সামনে সে আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। কী করবে? এসব সময়ে কী করতে হয়? সে বিমানের অফিসে ফোন করল। বেজে যাচ্ছে। অফিস বন্ধ। বিমান বেরিয়ে পড়েছে, কিন্তু এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে পারবে না। অন্তত ঘণ্টা দুই সময় তো লাগবেই। তা হলে? নিখিল? না, নিখিল না। কোনওক্রমেই নিখিল নয়। কিন্তু নিখিলও তো বাবার ছেলে। তারও তো খবর পাওয়া উচিত! বোতাম টিপল সে ফোনের। দীর্ঘদিন তার সঙ্গে বাক্যালাপ নেই মল্লিকার।

—হ্যাললো।

গলা কেঁপে গেল তার।

—বউদি বলছি। বাবার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউয়ে ডক্টর সেনগুপ্ত’জ ক্লিনিকে আছেন।

এক মুহূর্ত চুপ। তারপর কণ্ঠ ভেসে এল—বাড়িতে থাকো। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।

প্রতি মুহূর্তে বিমানকে আশা করছে মল্লিকা। জিনা। অন্তত জিনাও তো আসতে পারে। কোথায় ‘রোচনা’ না কী এক প্রজেক্ট নিয়ে মেতেছে। —ঋত্বিকের ব্যাপার। ওরা সম্ভবত জিনাকে একটু দেখাশোনা করতে বলে গেছে।

বেলের শব্দ। কেমন শীত শীত করছে তার। সে দরজা খুলে দিল। নিখিল। সময় নষ্ট না করে বলল, এসো। দরজায় চাবি দিয়ে কোনওমতে গাড়িতে উঠল মল্লিকা।

সামনের দরজাটা খুলে ধরেছে নিখিল, অন্ধের মতো সে উঠে গেল।

—কী হয়েছে?

—কিচ্ছু জানি না। শুধু ওইটুকু বলেই ওঁরা ফোন রেখে দিলেন।

—জিনা কই?

—জানি না। কোথাও বেরিয়েছে। —খুব সাবধানে জিনার গন্তব্যস্থল গোপন রাখে মল্লিকা। ভীষণ রাগ হয় জিনার ওপর। সে যদি থাকত এরকম আতান্তরে পড়তে হত না তাকে। পরক্ষণেই রাগটা নিজের ওপর এসে পড়ে। একটা কাজও কি সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে করতে পারে না! কী হত ফোনটা করেই ডক্টর সেনগুপ্তর ওখানে চলে গেলে! নিখিলের সঙ্গে এক গাড়িতে যাবার গ্লানি তা হলে তাকে ভোগ করতে হত না। বাড়িতে কাউকে কোনও মেসেজ দেওয়া গেল না। কারও কাছে চাবি নেই। সে বাড়িতে থাকে বলে, বিমান সবসময়ে ডুপ্লিকেট রাখে না। কী ভাবে ঢুকবে ওরা?

ক্লিনিকে গিয়ে পরিষ্কার হল ব্যাপারটা। পা ছড়িয়ে ডাক্তারের বেড-এ শুয়েছিলেন। মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন। মাথায় ব্যান্ডেজ।

ডাক্তার বললেন, মাথা ফেটেছে। সতেরোটা স্টিচ দিতে হয়েছে। কিন্তু বাঁ পায়ে কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার। হসপিট্যালে যেতে হবে। খুব সম্ভব অপারেশন করতে হবে।

—কী করে হল? রাস্তায় কি মাথা-টাথা ঘুরে পড়ে গেলেন?

—পড়ে যাবেন কী? ডাক্তার বললেন, মারা হয়েছে ওঁকে পেছন থেকে। লাঠির বাড়ি। সোনাগাছির ব্যাপার…কী কারণে কার ওপর রাগ হয়েছে, মেরে দিল বুড়ো মানুষটাকে…

—সোনাগাছি? —নিখিলের হতবুদ্ধি মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার মুচকি হেসে বললেন—আরে—এদিকে উনি বাচ্চাদের কী সব ক্লাস-ট্‌লাস নেন।

—সোনাগাছিতে?—নিখিল মল্লিকার দিকে তাকাল—বাবা ক্লাস নেবার আর জায়গা পেলেন না?—মল্লিকা কোনও জবাব দিল না।

শ্যামবাজারের দিকে একটা নার্সিং হোমে তাঁকে ভর্তি করে পরের দিনই অপারেশনের প্রস্তুতির কথাবার্তা বলে ফিরতে ফিরতে রাত নটা বেজে গেল। মল্লিকা কয়েকবার ভাবল নিখিলের ওপর এবার সবটা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। সেখানে নিশ্চয় এখন হুলুস্থূল পড়ে গেছে। কিন্তু নিখিল এত গম্ভীর আর বাবা এমন করে তার ওপর একান্তভাবে নির্ভর করে আছেন! দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যন্ত্রণাও হচ্ছে খুব। সে কিছুতেই কথাটা বলতে পারল না।

কিন্তু বাড়িতে এসে দেখল, আলো জ্বলছে, অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে না। নিজের চাবিটা সে খুঁজে পেল না, বেল শুনে দরজা খুলে দিল ঝুম্পা। পেছনে মাম্পি। —‘কোথায় গিয়েছিলে মা?’ বিমান নাকি স্থির করেছিল সাড়ে নটা অবধি দেখে পুলিশে খবর দিতে যাবে। জিনাই আগে আসে, সে-ই সবাইকে দরজাটরজা খুলে দিয়েছে। হারানো চাবিটার কথা কয়েকদিনের ডামাডোলে মল্লিকা বেমালুম ভুলে গেল।

জিনার অনুপস্থিতিতে আসলে তার কাজটা কদিন চালিয়ে দিচ্ছিলেন কল্যাণবাবু। পূর্ণিমা আর বনমালাকে তিনি একটু আলাদা করে কোচ করছেন। এদের দুজনেরই ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত বিদ্যা ছিল। মাথা ভাল। অন্যদের অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। সেদিন পাঁচটা বাজে দেখে তিনি উঠে পড়েছিলেন। তখনও দু-একটা শক্ত অঙ্কের সমস্যা মাথায় ঘুরছিল। অনেকদিন আগের বিদ্যে তো! মরচে পড়ে গেছে। বান্ধবসমিতির চৌকাঠ থেকে দশ-বারো গজও যাননি মাথার পিছনে একটা প্রচণ্ড আঘাতে চোখে সর্ষেফুল দেখলেন কল্যাণবাবু, একটা লাঠি আর গোটা দুই মানুষের আবছা আকৃতি, ব্যস আছড়ে পড়লেন রাস্তায়। অজ্ঞান। লাঠির বাড়ি খেয়ে আঁক করে একটা শব্দ হয়তো করেছিলেন। শোনবার মতো কেউ কাছাকাছি ছিল না। দোকানপাটও তখন সব ঝাঁপ বন্ধ। পূর্ণিমাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরের সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল বনমালা। তখনই দেখে দৃশ্যটা। হাত-পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন কল্যাণবাবু, মাথা থেকে একটা রক্তের ধারা নেমে পাঞ্জাবির পিঠ ভিজিয়ে দিচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে দুজনে চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করে। তারপর তাদের সাহায্যে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। তোলবার সময়ে একবার চিৎকার করেই অজ্ঞান হয়ে যান কল্যাণবাবু। তখনই বোঝা যায় পা-ও ভেঙেছে। সামান্য পরে জ্ঞান আসতে বাড়ির ফোন নম্বর তিনিই বলেন।

পরের দিন তাঁকে দেখতে গিয়ে জিনা চুপিচুপি বলল, বাবা, ও কিন্তু এখনও জানে না আমিও ওখানে যাই। জানলে তুলকালাম করবে। কিন্তু আপনাকে মারল কে বলুন তো?

এ কথা কল্যাণবাবুও অনেক ভেবেছেন। তাঁর ধারণা লাঠিটা ছিল অন্য কারও জন্য। ভুল করে তাঁর মাথায় এসে পড়েছে। তবু তিনি আর ঝুঁকি নিতে চান না। জিনার আর ওসব জায়গায় না যাওয়াই ভাল। জিনাকে পাহারা দিতেই তো তিনি ওখানে ঢুকেছিলেন। তাঁর মনে পড়ে গেল দুটি বাজে লোককে পিছু নিতে দেখেন তিনি বাস থেকে। তবে? তবে কি তাঁর মতো একজন সঙ্গীকে জিনার পাশ থেকে সরানোই কারও উদ্দেশ্য ছিল? এখন কতদিন তিনি অচল হয়ে থাকবেন কে জানে? জিনা একা যাতায়াত করবে?…সর্বনাশ! যতক্ষণ না পরদিন বিকেলে জিনা নার্সিং হোমে এল তিনি ছটফট করতে লাগলেন।

বিকেল চারটে না বাজতেই আসে জিনা আর মল্লিকা। এ সময়ে ছেলেরা আসে না। নাতনিরাও নয়। এ সময়টুকু তাই প্রাইভেট। অপারেশনটা হয়ে গেছে। ফিমার ভাঙেনি এই রক্ষা। কিন্তু হাঁটুর তলায় সাপোর্টিং রড ঢোকাতে হয়েছে।

জিনা বলল, ইস বাবা, আমার জন্যেই আপনার এত দুর্ভোগ।

তখনই কল্যাণবাবু সুযোগ পেয়ে গেলেন, বললেন, বুঝে বলছ? না না-বুঝে কথার কথা বললে?

—কথার কথা? বাবা?—জিনা রীতিমতো অভিমান করে—আমি কি জানি না—আমার জন্যেই আপনি…

—কথাটা তা নয় জিনা। আজকাল ছোট বউমাকে জিনাই বলেন কল্যাণবাবু, যেটা আমাকে ভাবাচ্ছে সেটা হল কেন এই ঘটনাটা ঘটল।

মল্লিকা বলল, কেন ঘটেছে, অত বৃত্তান্ত ভাবতে হবে না। আপনারা তো দিব্যি মানবেন না। নইলে বলতুম আমার মাথার দিব্যি রইল—আপনারা দয়া করে আর ও পাড়ায় যাবেন না।

—আদেশ নাকি?—কল্যাণবাবুর মুখে মৃদু হাসি।

—তাই বলেন তো তাই। একটু হাসি মল্লিকারও মুখে। পরক্ষণেই সেটা মুছে গেল। সে বলল, বাবা এত জানেন শোনেন, এভাবে বাস্তব বুদ্ধি কী করে লোপ পায় আপনাদের আমি জানি না। মুকুটরা করছে, তাদের পেছনে একটা পুরো প্রতিষ্ঠান আছে, আপনারা কার ভরসায় করছেন এসব? একার চেষ্টায় এসব করা যায় না বাবা!

জিনা বলল, একা তো নয়! আমাদের দায়িত্ব তো মুকুটদেরও আছে। আমারটা তো আছেই। আমাকে ওরা পে করে। বাবারও বইপত্তর, ব্ল্যাকবোর্ড সবই তো দিয়েছে। দায়িত্ব এড়াতে পারবে না।

মল্লিকা বলল, উঁহু, জিনা তুমি মুকুটদের কাজ পুরোপুরি করছ না। তুমি নিজের মতো করে করছ। ওদের গাইড-লাইন তুমি মান না, নিজেই বল সে কথা। বল না?

—দিদিভাই, তুমিও কি ওদের মতো বলবে— এইসব মেয়েরা এইভাবেই থাক। অন্ধকার পার হতে না পারুক। আমরা ভাল আছি, ভাল থাকব, আমাদের মুক্তির জন্য, ভাল থাকার জন্য কত চিন্তা, আর এই পৃথিবীতেই দেশে দেশে মেয়েদের একটা বিরাট অংশ এইভাবে… তার মুখ কালো হয়ে গেছে।

কল্যাণবাবু বললেন, ঠিক আছে মা, এখন ক’দিন যাক না! পরে ভেবে দেখা যাবে কী করা যেতে পারে। কিছু না-কিছু একটা উপায় বার হবেই।

ফেরবার পথে ওরা নিখিল বা বিমানের সঙ্গে ফেরে। আলোচনা থেমে যায়।

সকালবেলা মল্লিকা একাই আসে৷ সেদিন এসে দেখল দুটি মেয়ে বসে আছে। তাদের সঙ্গে কল্যাণবাবুর রীতিমতো আলোচনা হচ্ছে কোনও এক অজ্ঞাত বিষয়ে। সে অবশ্য দুয়ে দুয়ে চার করতে পারল। কিন্তু সত্যিই, মেয়েদুটিকে দেখে বোঝবার জো নেই তারা কোথায় থাকে, কী করে। ছোটটি তার ঝুম্পার মতো, ঝুঁটি করে চুল বাঁধা একটা ক্লিপ দিয়ে। মেয়েটি মনে হয় খুব কান্নাকাটি করেছে, চোখদুটো লাল, ঈষৎ ফুলে আছে। শামলা রঙের মুখখানি ভেজা ভেজা। একটু দরিদ্রের ঘরে যেমন লাবণ্য অভাবের তলায় চাপা পড়ে থাকে, এর চেহারার জাত সেইরকম। তা নয়তো বেশ বাড়ন্ত, তরুণীসুলভ। সালোয়ার-কামিজ পরে রয়েছে মেয়েটি, ছাপা কাপড়ের। কোনওরকম প্রসাধন নেই। কল্যাণবাবু বললেন, এর নাম পূর্ণিমা, আমাদের ছাত্রী, ইনি মল্লিকা, তোমাদের দিদিমণিরও দিদিমণি। আর এর নাম বনমালা।

দুজনেই ঢিপ ঢিপ করে সঙ্গে সঙ্গে প্রণাম করে ফেলল। মল্লিকা বাধা দেবার সময় পেল না।

বনমালা মেয়েটি একটা মিলের ছাপা শাড়ি পরেছে। ছোটখাটো, মল্লিকারই ধরনের, তারই মতো দোহারা কাটাকাটা চেহারা, মুখের আদলটা প্রতিমা-ধরনের, যদিও তেমন কোনও শ্রী নেই। এর চুলও তারই মতো ঈষৎ কোঁকড়া। চুলটা ছড়ানো ছিল। মেয়েটিকে দেখে কী যে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি হল মল্লিকার সে বলে বোঝাতে পারবে না। মেয়েটির মাথায় সিঁদুর, ভুরু প্লাক করা, মধ্যবিত্ত গৃহস্থবাড়ির বউয়ের মতো অবিকল।

পূর্ণিমা সঙ্গে করে একটা খাতা আর বই এনেছে। অঙ্ক বুঝে নিচ্ছে কল্যাণবাবুর কাছে।

ওরা চলে গেছে, তবু মল্লিকা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছে। ঝুম্পা আর পূর্ণিমা, সে আর বনমালা কীরকম এক অথচ আলাদা। ঝুম্পা ফিজিক্স নিয়ে বি. এসসি পড়ছে, আর একবার জয়েন্ট দেবে, চান্স পেলেই ইলেকট্রনিকস এঞ্জিনিয়ারিং-এ চলে যাবে। আর ঝুম্পার বয়সি এই মেয়েটি? দেহ খাটিয়ে অন্নসংস্থান করে। কেউ নেই, বাবা, মা, ভাই, বোন, কোনও অভিভাবক যে একে পালন করবে। একভাবে জন্ম, আলাদা জীবন, আলাদা নিয়তি। আর ওই বনমালা? যদি ওর বদলে তারই কোনও অজগাঁয়ে গরিব চাষির ঘরে জনমজুর-খেতমজুরের ঘরে জন্ম হত, আর বনমালার কোনও বিপত্নীক কমপাউন্ডারের ঘরে! ও-ই যদি কোনও আরতি দে সরকারের চোখে পড়ে যেত! তা হলে তাদের ভাগ্য বদলাবদলি হয়ে যেত। আরতি দে সরকার যদি তাকে পছন্দ করে না ফেলতেন, তবে তারই বা কী গতি হত! ভাবতে ভয় পেয়ে গেল মল্লিকা। চুপচাপ সে টিফিন ক্যারিয়ারটা নিজের ব্যাগের মধ্যে থেকে নামিয়ে রাখল। ছোট্ট মিটসেফটার ভেতরে সন্দেশ জমে গেছে, বাকসোগুলো আয়াদের ডেকে দিয়ে দিল। পুরনো টিফিন ক্যারিয়ারটা ভরে নিল। দুটো বই নামিয়ে রাখল টেবিলে। আস্তে বলল—বাবা এবার যাই?

কল্যাণবাবু চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন। এবার খুলে বললেন, রাগ করো না বউমা।

মল্লিকা অবাক হয়ে বলল, রাগ? রাগ করব কেন?

—আমি তোমার আপত্তির কথা জানি। ইউ আর জাস্টিফায়েড। তোমার মতো একজন শুচিশুদ্ধ বাড়ির বউ এদের সংস্পর্শ সহ্য করতে পারবে না, পারার কথা নয়, এটুকু বুঝতে আর অসুবিধে কী! আমরাই কি আগে পেরেছি? জিনাও পারেনি। কিন্তু একবার ব্যাপারটার ভেতর ঢুকলে বড় আত্মগ্লানি হয়! আজকের পৃথিবীতে, এখনও, এত মানবাধিকার কমিশন, এত নারীমুক্তি, এত সর্বহারার একনায়কতন্ত্র হচ্ছে, এরই মাঝখানে মেয়েদের এভাবে সেক্স-স্লেভ করে রেখে দেওয়াটা চলছেই। কারও মনে প্রশ্ন পর্যন্ত ওঠে না। একমাত্র সোভিয়েত রাশিয়া আর চিন কিছুকালের জন্য বন্ধ করেছিল জিনিসটা। এদের মধ্যে ভ্যালুজ গড়ে উঠতে পারেনি তেমন করে, তবু কাজটা জঘন্য, এরকম একটা বোধ এদের এখনও আছে। সেটাকেও কিন্তু নষ্ট করে দেবার চেষ্টা হচ্ছে। অর্গ্যানাইজ্‌ড্‌ ইনস্টিট্যুশন্যাল লিগ্যাল একটা বিশ্বজোড়া মেয়েবাজার তৈরির চেষ্টা চলছে মা। আমাদের কতটুকুই বা শক্তি। কতটুকু পারব, প্রাণপাত করলেও পারব না। কিন্তু এই পূর্ণিমার মতো মেয়েগুলোর জন্য বড় কষ্ট হয়। স্বাভাবিক মেয়ে, বেশ মেধাবী। এসব পাড়ায় বেশির ভাগই বুদ্ধিবৃত্তিতে সাব-হিউম্যান স্তরে রয়ে গেছে। কিন্তু এ মেয়েটা ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিল। ইচ্ছে ছিল, আছে। ধরো, ও যদি সুযোগ পেত! কেন একটা স্বাভাবিক জীবনের সুযোগ ও পাবে না? মানব-সম্পদের কী বিপুল অপচয় হচ্ছে বুঝতে পার? প্রজননের ক্ষমতা আছে বলে মানুষ প্রজননের সীমা কোথাও টানবে না? পৃথিবী যত মানুষকে স্বচ্ছন্দে খাওয়াতে পারে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ভার চাপিয়ে দেওয়া হবে তার ওপর, সৃষ্টি হবে উদ্‌বৃত্ত মানুষ, আর উদ্‌বৃত্তকে নিয়ে চলবে বাকি মানুষদের। প্রিভিলেজ্‌ড্‌ মানুষদের অমানুষিক ব্যবহার? বনমালার তবু একটা আশ্রয় আছে। একটি লোকের সঙ্গে থাকে। একজনই। ঠিক আছে বাবা, সামাজিক পরিচয় না-ই হল, তবু তো একটা অর্থ আছে, শৃঙ্খলা আছে তার জীবনযাত্রার! কিন্তু পূর্ণিমা? আর বনমালার ওই লোকটিই বা কী? কেন দেবে না পরিচয়? কেন এভাবে মার্জিন্যালাইজ করে রাখবে? কেন?

—বাবা, আপনি বড্ড বেশি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন, মাথায় সতেরোটা স্টিচ আপনার! —মল্লিকা বলল।

একটু অসন্তুষ্ট হলেন কল্যাণবাবু, বললেন, সত্যি, আমি অনর্থক নিজের চিন্তা নিয়ে তোমায় বিরক্ত করছি। তোমার নিশ্চিন্ত শান্তির জীবন। তুমি কেন এসব ভাবতে রাজি হবে! আমারই ভুল!

মল্লিকা ছিল তাঁর মাথার দিকে। লজ্জা পেল, দুঃখও পেল ভীষণ। বলল, বাবা, আমি আপনার কথা সব শুনেছি, সবটা বুঝেছি বা মানছি তা বলব না, কিন্তু আপনার উদ্‌বেগ, কষ্ট এ সবই আমি বুঝেছি বাবা। তবে কী জানেন, আপনারা যেটাকে মনে করেন নিশ্চিন্ত শান্তির জীবন, তেমন কিছুও কিন্তু খুব কম আছে। অনেক অনেক জট চারিদিকে, আমার মতো নিরীহ মেয়েরা হয়তো সেইসব জট কী করে খুলবে ভাবতে ভাবতেই জীবন কাটিয়ে দেয়। সে আবার আর একরকম অন্ধকার।

কল্যাণবাবু চমকে বললেন, তুমি একবার এদিকে আমার সামনে এসো তো!

তিনি একটা অপ্রত্যাশিত ধাক্কা খেয়েছেন। বড় বউমাকে এভাবে কথা বলতে তিনি কখনও শোনেননি। অন্ধকার? কীসের অন্ধকার? মল্লিকা কেন এত দুঃখ পেল তাঁর কথায়!

মল্লিকা সামনে এসে দাঁড়াল। প্রশান্ত মুখ। বলল, এবার আসি? ওয়ার্নিং বেল বেজে গেছে।

কল্যাণবাবুকে চিন্তিত রেখে সে নীচে নেমে গেল।

নীচে নামতেই কে ডাকল—দিদিভাই! পাশের দিকের একটা বেঞ্চে বসে আছে পূর্ণিমা আর বনমালা। অর্থাৎ তারই জন্যে অপেক্ষা করছে।

পূর্ণিমা এগিয়ে এসে বলল, দিদির সঙ্গে আমার খুব জরুরি দরকার। কী করি বলুন তো? দিদি তো এখন বেশ কিছুদিন আসবেন না!

মল্লিকা ভাবছিল। বনমালা বলল, যদি দিদির বাড়িতে যাই? একটুখানির জন্যে? ওখানে কি অনেকে থাকেন? বাইরের ঘর থেকে একটু কথা বলেই চলে আসব।

—কী কথা? আমাকে বলা যায় না! অবশেষে বলল মল্লিকা।

মেয়েদুটি মুখ নিচু করে চুপ করে রইল।

ওদের দিকে চেয়ে হঠাৎ মল্লিকার মনে হল চল্লিশের কাছে বয়স হল তার। আজ অবধি একটা বিষয়েও নিজের বুদ্ধিতে, কাউকে জিজ্ঞেস না করে সামান্যতম কাজও করেনি সে। আজ, এতদিন পরে, একটা না-হয় করলই। এখন সকাল এগারোটা। দুই বাড়িতেই কেউ থাকবে না। তার বাড়িতে তবু মলি নামে কাজের লোকটি থাকে এইসময়ে। জিনার বাড়ি একেবারে ফাঁকা। সে বলল, চলো।

—যাব?

—হ্যাঁ, এসো—সে বেরিয়ে একটা ট্যাকসিকে হাত দেখাল।

—আজই যাব?

—বলছিলে যে জরুরি? এখন গেলে কথা বলতে পারবে।

জিনার বেল টিপল মল্লিকা।

—খুলে অবাক হয়ে গেল জিনা। এদিক দিয়ে তো মল্লিকার আসার কথা নয়!

—কী ব্যাপার? দিদিভাই! পরক্ষণেই মেয়েদুটিকে দেখতে পেল সে।

—তোরা? —ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বলল জিনা।

মল্লিকা অপেক্ষা করল না। চলে গেল।

বনমালা বলল—দিদি পূর্ণিমার ওপর ওরা যা-নয়-তাই অত্যেচার করছে।

—কে?

—মাসি৷ পাড়া থেকে কেনাদের দলকে ডেকে এনেছে। কাল সারা রাত দফায় দফায় কেনাদা রবিগুন্ডা সবাই মিলে ওকে রেপ করেছে। মাসি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করিয়েছে এসব। আমি খবর শুনে গিয়ে ছাড়াই।

শিউরে উঠে জিনা বলল—কেন? হঠাৎ?

—এর কোনও ‘কেন’ সবসময়ে থাকে না দিদি। ওদের পাওনা-গন্ডার শেয়ার না দিলে, মাসির রাগ হলে এসব যখন-তখন হয়। ও আসলে বলে ফেলেছিল মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে, কলেজে পড়বে।

—কেন বললি? তোকে এসব বলতে বারণ করে দিয়েছিলাম না?

পূর্ণিমা ক্লান্ত কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—আমি অঙ্ক কষছিলাম দিদি। লোক বসাতে ভাল লাগছিল না। বলেছিলুম—আজকের দিনটা আমায় ছেড়ে দাও না! তাইতে বলল—কেন? বিদ্যেধরী, জজ-ম্যাজিস্টর হবি, না কি? তাতেই বলে দিয়েছি—হবই তো, এ পাড়া আমি ছাড়বই ছাড়ব, কলেজে পড়ব, আইন পড়ব…তারপর তোমাদের দেখে নেব… বলেছি স্বীকার করছি দিদি। আমার মনে হচ্ছে মাসি আমাকে বিককিরি করে দেবে। কেনাদার সঙ্গে কাবলেমতো একটা লোক কথা বলছিল, আমার খুব ভয় করছে দিদি, ওরা আমাকে কোন দূরদেশে পাঠিয়ে দেবে।

তারই জন্য কি এ মেয়েটির জীবনে আরও অন্ধকার ঘনিয়ে এল? অন্ধকারেই ছিল। তাকে এত অন্ধকার বলে জানত না। এখন জানে। তার বাড়িতে থাকার জায়গা দেওয়া যায়। কিন্তু সেটা নিখিলের অনুমতিসাপেক্ষ। কত আর মিথ্যে কথা সে বলবে? দিদিভাইয়ের বাড়িতেও সেই এক প্রবলেম! তার ওপরে আছে দুটি কাজের লোক। তাদের অসীম কৌতূহল। পূর্ণিমার আসল পরিচয় খুঁজে বার করতে তাদের দশ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। আচ্ছা ‘রোচনা’য় নিয়ে গেলে হয় না? ঋত্বিকের অনুপস্থিতিতে সেই এখন কাজ চালাচ্ছে। কারও অনুমতি নেবার দরকার নেই। সে বলল—এক্ষুনি এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারি। এখুনি যেতে হবে কিন্তু।

—এখুনি? জামা কাপড়? টাকা পয়সা? সবই তো…

বনমালা তাড়া দিয়ে বলল, সেসব আনতে গেলে আর ফিরতে পারবি না পূর্ণিমা। ওরা কি তোর ওপর নজর রাখেনি ভেবেছিস? যা-ই এখন পুরো পাড়া ঘুমোচ্ছে, তাই বেরিয়ে আসতে পেরেছিস। দিদি যা বলছেন শোন—আমি তোর যতটুকু পারি উদ্ধার করে দেবার চেষ্টা করব।

জিনা বলল, জামাকাপড়ের প্রবলেমটা আমি এখুনি সল্‌ভ করে দিচ্ছি। দাঁড়া। সে চটপট নিজের কিছু শাড়ি, ব্লাউস, সালোয়ার-কামিজ ইত্যাদি একটা জুটের ব্যাগে ভরে ফেলল। টাকা পঞ্চাশেক নিজের সঞ্চয় থেকে একটা পার্সে ভরে দিল। তারপর জামাকাপড় বদলে এসে বলল, বনমালা তুই ফিরে যা। পূর্ণিমা চল।

পূর্ণিমা ভয়ে ভয়ে বলল, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ দিদি? লোকের বাড়ি কাজ করতে কিন্তু আমি পারব না।

—না, লোকের বাড়ি কাজ করতে নিয়ে যাচ্ছি না। কিন্তু সেভাবেও অনেকে বড় হয় জানিস? কাজকে ভয় করিস কেন?

—কাজের কথা হচ্ছে না। পুরুষ মানুষ থাকলে সে-বাড়ি আমি যাব না দিদি— পূর্ণিমা গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

জিনা বিরক্ত হয়ে বলল, বললাম তো কারও বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি না!

—কোনও হোমটোমেও আমি যাব না।

—না রে বাবা, হস্টেল হয়েছে ‘রোচনা’ শুনেছিস তো? সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি।

—ওখানে তো আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়েও আছে, যদি জানাজানি হয়ে যায়?

—অত ভয় করতে হবে না। আমি তো আছি। ওখানে বন্দুক হাতে দারোয়ান পাহারা দেয়। যে-কেউ ফট করে ঢুকতেই পারে না।

‘রোচনা’তে সুধাদির জিম্মা করে দিল সে পূর্ণিমাকে। বেশি কথা বলল না, খালি জানাল—মেয়েটি কিছুদিন থাকবে। একটু বিপদে পড়ে গেছে। তাকে যেন কোনওমতেই বাইরে পাঠানো না হয়।

আসবার সময়ে পূর্ণিমা ডাকল—দিদি!

—কী?

—তুমি কিন্তু আর অবিনাশ কোবরেজে যেয়ো না।

—কেন?

—তুমি আমাদের পড়াও বলে অনেকের রাগ।

—মুকুটরাও তো পড়ায়।

—ওঁদের পড়ানো আর তোমাদের…ও অনেক আলাদা দিদি। ওঁরা তো শুধু অক্ষর চেনান। মাসিরা সব জোট বেঁধে বেঁধে বলে—তোমরা আমাদের ব্যবসা ছাড়িয়ে দেবে। এত এত টাকার লোকসান হয়ে যাবে। কেনাদা রবিদারা বলে অত লেখাপড়া শেখার তোদের কী দরকার? মেসোমশাই ওইজন্যেই লাঠি খেয়েছেন। তুমি থাকলে তোমাকেও মারত। অনেক খুনে গুন্ডা আছে ও পাড়ায়। তোমাকে ওরা মারের বাড়া করবে। বিশেষ, আমি চলে আসাতে। বনোদিদি ঠিকই বলেছে। আজ গেলে আমি আর ফিরতে পারতুম না।

কেউ তাকে মারতে চায়? মারের বাড়া? জিনা নামে ঊনত্রিশ বছরের একটি মেয়ে, যে পলিটিক্যাল সায়েন্সে এম.এ পাস করে আর করার মতো কিছু না থাকায় বাবা-মা ইত্যাদি অভিভাবকদের কথায় চোখ বুজে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ে, যে ইদানীং হাতে কিছু কাজ না থাকায়, নির্দোষভাবে করবার মতো কিছু চেয়েছিল এবং বন্ধুর মাধ্যমে এই কাজটা পেয়ে সর্বান্তঃকরণে নিঃস্বার্থভাবে কাজটা করছিল, তাকে মারবে? প্রথমটা সমস্ত মন পঙ্গু হয়ে গেল তার। সব জায়গায় সে সম্মান, আদর, প্রশংসা এইসব পেতেই অভ্যস্ত। প্রথমত মেয়ে, দ্বিতীয়ত ভদ্র বাড়ির মেয়ে ও বউ, উপরন্তু আছে তার নিজস্ব রূপ-গুণ। জীবনে করবার মতো কাজ সে কিছুই করেনি কোনওদিন, করতও না, করতে হয় তা-ও জানত না। প্রথম যে কাজটা করতে গেল সেটাতেই গুবলেট করে বসে রইল? কই, মুকুট এত বছর ধরে কাজ করছে, ঋত্বিক করছে, নমিতাদি করছেন, এদের তো কোনও বিপদে পড়তে হয়নি? এরই নাম পেশাদারিত্ব। মুকুট তাকে অনেকবার বলেছে—জড়িয়ে পড়িস না জিনা, বড্ড বেশি ইনভল্‌ভ্‌ড্‌ হয়ে যাচ্ছিস। এ রকম করলে কাজ করবি কী করে? আশ্চর্য! তার ধারণা ছিল লোকহিতকর কাজ করতে গেলে জড়িয়ে পড়তেই হয়। বিদ্যাসাগর মশাই নাকি বালবিধবাদের দুঃখে হাউ হাউ করে কাঁদতেন, বাছুরকে বঞ্চিত করা হয় বলে গোরুর দুধ খাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলেন, বিবেকানন্দের অমন স্পিরিচুয়াল কেরিয়ার? তাকে গৌণ করে দেশ, দেশবাসীর দারিদ্র, জাতিভেদ এই সমস্ত নিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে করতে অকালে জীবন দিলেন। একই কথা আরও বেশি করে খাটে সিসটার নিবেদিতার ক্ষেত্রে। সর্বোত্তম লোকহিতের এইসব নমুনাকেই তো চিরকাল আদর্শ বলে মেনে এসেছে সবাই! আর আজকে! হঠাৎ উলটো কথা শুনতে হচ্ছে? এত ইনভলভ্‌ড্‌ হয়ে গেলে কাজ করবি কী করে? কথাটা তো মুকুট ভুলও বলেনি। অতিরিক্ত ইনভলভ্‌মেন্টের জন্যেই কি আজ কাজের পথ তার সামনে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *