বিপদে বুজুমবুরা – ৫

বুজুমবুরা বিমানবন্দরে ল্যান্ড করল এয়ার আইতালিয়ার সেই বিমানটিই। সবগুলো গ্যাংওয়ে অকুপায়েড থাকায় কোনো গ্যাংওয়ের মুখে ল্যান্ড করতে পারেনি বিমানটি। ল্যান্ড করেছে অ্যারাইভাল লাউঞ্জ থেকে একটু দূরে। বিমানবন্দরের গাড়িতে চড়ে এই দূরত্বটা পার হতে হবে যাত্রীদের।

বিমান থেকে নামছে আনা আরিয়া ও চাওসিকো।

চাওসিকো আগে, আনা আরিয়া তার পেছনে।

বিমানের সিঁড়ি থেকে তারা পা রেখেছে মাটিতে।

তাদের সামনেই বেশির ভাগ যাত্রী, তাদের অল্প কিছু পেছনে। সামনের যাত্রীদের বেশির ভাগ গাড়িতে উঠে গেছে। আরও দুটি গাড়ি আসছে।

গাড়ির কাছেই যাত্রীরা বেশি। আনা আরিয়ারা যেখানে দাঁড়িয়েছে, সে জায়গাটা অনেকটাই ফাঁকা। চারদিকটা আলোকিত।

ইয়ারপোর্ট বিল্ডিংটা বিমানবন্দরের পূর্বাংশে। ইয়ারপোর্ট বিল্ডিং-এর দক্ষিণ পাশে পূর্বদিকের সিকিউরিটি প্রাচীরে দুইটা গেট, একটা ঢোকার আরেকটা বের হবার। ইয়ার ফিল্ডের কর্মীরা এ পথ দিয়ে যাতায়াত করে।

আনা আরিয়াদের রানওয়ের সামান্য কিছু পূর্বে একটা কালো মাইক্রো দাঁড়িয়েছিল। তার থেকে আরেকটু পূর্বে আরেকটা পাজেরো জীপ দাঁড়িয়েছিল, তার গায়ে ইয়ারপোর্ট অথরিটির মনোগ্রাম।

আনা আরিয়া অলস দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক চাইবার সময় এসবই তার চোখে পড়েছিল। যাত্রী বহনকারী আরেকটা গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছিল। যাত্রীদের চোখ সেদিকে। দ্রুত এগুচ্ছিল তারা গাড়ির দিকে।

আনা আরিয়া ও চাওসিকো তাদের হ্যান্ডব্যাগ হাত থেকে কাঁধে ঝুলিয়ে নিচ্ছে সামনে এগুবার জন্যে।

ঠিক এ সময় এদিক ওদিক থেকে চারজন লোক এসে চোখের পলকে ঘিরে ফেলল চাওসিকোকে। একজন লোক চাওসিকোর মাথার উপর একটা কালো কাপড় ছেড়ে দিয়েছে। মুহূর্তে কালো কাপড়ে ঢেকে গেল তার শরীর। দু’জন লোক তাকে কাঁধে তুলে নিল। তারপর ছুটতে শুরু করল মাইক্রোর দিকে। অবশিষ্ট দুজনের একজন একটা বোমা ছুঁড়ল। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেল সবদিক।

আনা আরিয়া প্রথমটায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। কি ঘটছে কি করবে তা ভাবতে পারেনি। সম্বিত ফিরে পেয়েই কিডন্যাপার’

‘কিডন্যাপার’ বলে চিৎকার করতে লাগল। কালো ধোঁয়ায় চারদিক ছেয়ে যাওয়ায় সে বুঝতে পারলো না তার চিৎকার কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলো কি না।

আনা আরিয়া বুঝতে পারল চাওসিকোকে কিডন্যাপাররা মাইক্রোবাসে তুলবে। আনা আরিয়া ছুটল সেদিকে।

আনা আরিয়া যখন পৌঁছল মাইক্রোবাসের কাছাকাছি। দেখল, মাইক্রোটি চলতে শুরু করেছে।

আর কোনো উপায় না দেখে আনা আরিয়া ছুটল জীপটার দিকে।

এক ঝটকায় টান দিয়ে জীপের ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে ফেলল।

জীপের কী হোলে চাবি দেখে আনাঃ আরিয়া আল্লাহর লাখো শোকর আদায় করল।

কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে ঝড়ের গতিতে চলছে মাইক্রোটি। জীপের স্পিড যদিও মাইক্রো’র চেয়ে ভালো, কিন্তু রাস্তার গাড়ি ও জনচলাচলের মধ্যে গাড়ির স্পিড অতটা বাড়াতে ভয় করছে আনা আরিয়ার। আনা আরিয়া চেষ্টা করতে লাগল মাইক্রোটা যাতে চোখের আড়ালে না যেতে পারে, এই ধরনের স্পিড অব্যাহত রাখতে।

মাইক্রোটি ইয়ারপোর্ট রোড থেকে মূল শহরে ঢুকে এপথ ওপথ ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়ায় প্রবেশ করল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়ার পুরানো এলাকায় পৌঁছল। মাইক্রোটি অবশেষে প্রবেশ করল পুরানো ও পরিত্যাক্ত প্রশাসনিক ভবনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালে এটাই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন।

মাইক্রোটি পুরানো প্রশাসনিক ভবনে ঢুকে যাবার পর আনা আরিয়া গাড়ির আলো নিভিয়ে গাছের ছায়ার আড়াল নিয়ে নিঃশব্দে এসে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। গাড়িতে কিছুক্ষণ বসল আনা আরিয়া।

ঘড়ি দেখল রাত দশটা চল্লিশ বাজে।

কি করবে সে এখন? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল আনা আরিয়া। পুলিশকে কি টেলিফোন করবে? পুলিশ ছাড়া চাওসিকোকে উদ্ধার করবে সে কীভাবে। ওরা চারজন ছাড়াও ভেতরে আরও লোক আছে নিশ্চয়। এসব ভাবতে গিয়ে কিছুটা আত্মস্থ হয়ে পড়েছিল আনা আরিয়া। তার গাড়ির দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠে বাইরে তাকাল আনা আরিয়া। দেখল, চারপাঁচজন লোক তার গাড়ি ঘিরে ফেলেছে। একজন তার পাশের দরজা খুলে রিভলভার হাতে দাঁড়িয়ে। রিভলভারের নল তার কপাল বরাবর উদ্যত। সব লোকই মুখোশ পরা।

রিভলভারধারী বলল, ‘তাহলে ম্যাডাম তুমিই আমাদের লোককে ফলো করেছ। তারা আমাদেরকে টেলিফোনে জানাবার পর ভেবেছিলাম সেই বড় শয়তান আহমদ মুসাই আমাদের লোকদের ফলো করল কিনা। সে ছাড়া আমাদের লোকদের ঘাটাবার সাধ্য আর কারও নেই। এখন দেখি বাঘ ধরতে গিয়ে বিড়াল পেয়ে গেলাম। বেরিয়ে এসো ম্যাডাম। মুসলমানের বাচ্চার সাথে ফষ্টিনষ্টি আজ থেকে শেষ।

‘চাওসিকোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো ভবনে ধরে এনেছ তোমরা কারা?’ বলল আনা আরিয়া চিৎকার করে।

‘তোমার কোনো কথার জবাব দেব না। তোমাকে নিয়ে কি করব, সেটা উপর থেকে জানার পর আমরা ঠিক করব। তবে তোমাকে ছাড়বো না। থাকতে হবে তোমাকে আমাদের সাথে।

বলে লোকটি এক হাতে রিভলভার বাগিয়ে অন্য হাত দিয়ে টেনে গাড়ি থেকে বের করল আনা আরিয়াকে। বলল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা সুন্দরীকে প্রভু যিশু আমাদের হাতে এইভাবে তুলে দেবেন, তা আমরা ভাবিনি। চলো সুন্দরী। এসেছিলে মুসলমানের বাচ্চাকে উদ্ধার করতে, এবার তোমাকে কে রক্ষা করবে?’

‘তোমরা কে জানি না। কিন্তু মুখ সংযত করে কথা বলো। ভুলে যেও না, রক্ষা করার একজন আছেন, যিনি…।

আনা আরিয়ার কথায় বাধা দিয়ে সেই রিভলভারধারী বলে উঠল অট্টহাসির সাথে, ‘আহমদ মুসা এখানে কোত্থেকে আসবে। ডাকো একবার দেখি তাকে।

‘আহমদ মুসাকে আমি চিনি না। আমি ডাকছি, সবার রক্ষাকর্তা, পালনকর্তা, সবার স্রষ্টাকে।’ বলল আনা আরিয়া।

অন্য চারজন মুখোশধারীর একজন চিৎকার করে বলে উঠল, এই ছুকরীর বক বক আমরা আর শুনতে পারছি না। এ মাল তো হঠাৎ করে জুটেছে, লণ্ডভণ্ড করে দিল আমাদের প্রোগ্রামকে। এর একটা হাল করে আমাদের তো দ্রুত ফিরে আসতে হবে এখানে। রাতের মধ্যেই তো আমাদের সব কাজ শেষ করতে হবে।’

‘ঠিক বলেছ জীম। একে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলো গাড়িতে। কুইক বলল রিভলভারধারী লোকটি।

দু’জন আগ্রহ ভরে ছুটে এলো আনা আরিয়ার দিকে।

‘দাঁড়াও। মেয়েটার গায়ে কেউ হাত দেবে না। পেছন থেকে বলে উঠল একটা শান্ত, কিন্তু খুবই শক্ত কণ্ঠ।

সবাই মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। সেই সাথে সবার হাতে উঠে এলো রিভলভার। দেখল সবাই, গাছের আড়াল থেকে একজন বেরিয়ে এসেছে। তার হাতে উদ্যত রিভলভার।

উত্তরে পাঁচজনের কেউই কথা বলল না। হঠাৎই চোখ-মুখ হিংস্র হয়ে উঠেছে তাদের। তাদের রিভলভার উঠে আসছে ছায়ামূর্তি লক্ষ্য করে।

ব্ল্যাক ক্রসের কাল সাপগুলোকে ছোবল দেবার কোনো সুযোগ দিল না ছায়ামূর্তিটি। ছায়ামূর্তির হাতের রিভলভার চোখের পলক পড়ার মতো পাঁচবার নড়ে উঠল। পাঁচটি লাশ বোঁটা থেকে খসে পড়া পাকা ফলের মতো মাটিতে আছড়ে পড়ল

আনা আরিয়া বসে পড়েছিল, গাড়ি থেকে তাকে টেনে নামাবার পরই।

ছায়ামূর্তিটি এগিয়ে এলো আনা আরিয়ার কাছে। বলল, ‘গাড়িতে উঠে বসো বোন। আপাতত আর কোনো ভয় নেই। নরম স্নেহমাখানো কণ্ঠ ছায়ামূর্তির।

আনা আরিয়া তাকিয়ে ছিল ছায়ামূর্তির দিকে। তাকিয়ে থেকেই সে উঠে দাঁড়াল। ছায়ামূর্তির এক কথায় তার মনের সব ভয় যেন এক মুহূর্তেই দূর হয়ে গেছে। সে অনেকটা যন্ত্রচালিতের মতো ছায়ামূর্তির নির্দেশ পালন করে গাড়িতে উঠে বসল।

‘তুমি কে? এখানে কেন তুমি? ওরা কারা?’ বলল ছায়ামূর্তিটি। তার সেই আশ্বাসপূর্ণ নরম কণ্ঠ।

‘আমি আনা আরিয়া। এই পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডেলিগেশন নিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরত আসছিলাম ভ্যাটিকানের খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে থেকে। আমার এক সাথীকে এরা কিডন্যাপ করে এখানে নিয়ে এসেছে। উদ্ধারের আশায় তাদের ফলো করে আমি এখানে এসেছি।’ এক নিঃশ্বাসে দ্রুত বলল আনা আরিয়া।

‘তোমাকে বা আর কাউকে কিডন্যাপ না করে তাকে কিডন্যাপ করল কেন?’ বলল ছায়ামূর্তি।

‘তার আগে বলুন প্লিজ আপনি কি আহমদ মুসা?’ জিজ্ঞাসা করল আনা আরিয়া। তার কণ্ঠটি একটু কাঁপা, ভয় মিশ্রিত।

‘তুমি এ প্রশ্ন করছ কেন? তুমি কি আহমদ মুসাকে চেন?’ ছায়ামূর্তিটি বলল।

‘আমি আহমদ মুসাকে চিনি না। কিন্তু এরা বার বার ভয়ের সাথে আহমদ মুসার নাম করছিল। তাদের একটা কথার উত্তরে আমি যখন বললাম, ভুলে যেও না রক্ষার জন্যে একজন আছেন, যিনি…। আমি এর দ্বারা আল্লাহর কথা বলছিলাম। কিন্তু তখন অট্টহাসির সাথে তাদের একজন বলেছিল, আহমদ মুসা এখানে কোত্থেকে আসবে। আমার এখন মনে হচ্ছে আপনিই তাদের সেই আহমদ মুসা।’

আহমদ মুসা বলল, ‘আমি তাদের আহমদ মুসা নই, আমি তোমাদের আহমদ মুসা। ওদের সাথে তোমার শেষ কথাটা আমি শুনতে পেয়েছি। তুমি কি মুসলিম?

‘জি, আমি মুসলিম। আমার যে সাথীকে উদ্ধারের আশায় ওদের ফলো করে এখানে এসেছি, সেই সাথীকে দেখেই আমি ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হয়েছি এবং ইসলাম গ্রহণ করেছি।’ বলল আনা আরিয়া।

‘ভ্যাটিকানের খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে তোমরা গিয়েছিলে কেন? তোমার সাথী নিশ্চয় মুসলিম?’ আহমদ মুসা বলল।

‘সে অনেক কথা স্যার। ডেলিগেশনে অংশ নিতে এবং ডেলিগেশনের প্রধান হতে আমার সেই সাথীকে বাধ্য করা হয়েছে। আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের মেয়ে। আমাকে না জানিয়েই আমাকে ডেলিগেশনের ডেপুটি প্রধান করা হয়েছিল। বলল আনা আরিয়া।

‘কিন্তু তোমার সাথীকে এখন ফেরার পথে কিডন্যাপ করা হলো কেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

মুখটা ম্লান হয়ে গেল আনা আরিয়ার। বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার চোখ-মুখ। অবরুদ্ধ এক আবেগের ভারে কেঁপে উঠল তার শুকনো ঠোঁট। বলল সে, ‘এখানেও অনেক কথা আছে স্যার। আমার সাথী খুবই প্রতিভামান ছাত্র এবং বিজ্ঞানীও। তার সাথে সে একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম। ভ্যাটিক্যানের যুব কংগ্রেসে তাকে মধ্য আফ্রিকা রিজিওনের প্রতিনিধির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। যুব কংগ্রেসে অন্যান্য রিজিওনাল নেতাদের মতো তাকেও যিশু খ্রিস্টের জীবনের ১০ মিনিটের একটা বক্তৃতা দিতে হয়েছিল। তার এই বক্তৃতা নিয়েই গন্ডগোলের সৃষ্টি। তার বক্তৃতা এক্সপাঞ্চ করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তার বক্তৃতা মুসলমানদের চিন্তার একদম কপি। অভিযোগ তোলা হয় সে অনুপ্রবেশকারী। ইতালিতেই তাকে কিডন্যাপ ও হত্যার সিদ্ধান্ত হয়। অল্প সময়ের কারণে ওখানে সে সুযোগ তারা পায়নি। অবশেষে বুজুমবুরায় ফেরার সময় বিমানবন্দরে নামলেই তাকে কিডন্যাপ করা হয়। আমি জানি না, এতক্ষণে তারা ওকে কি করেছে!’ কান্নায় ভেঙে পড়ল আনা আরিয়ার কণ্ঠ।

‘কেঁদো না বোন। আল্লাহর উপর ভরসা করো। তিনি ইচ্ছা না করলে কিছুই ঘটে না, কিছুই হয় না। এসো আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন দয়া করে সব ঠিক করে দেন।’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমিন।’ বলল আনা আরিয়া।

চোখ মুছল সে। বলল, ‘স্যার, চাওসিকোর কাছেও এমন কথা আমি বারবার শুনেছি।’

‘তোমার সাথীর পুরো নাম কি?’ আহমদ মুসা বলল।

‘স্যার তার মুসলিম নাম আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় যে নাম নিতে তাকে বাধ্য করা হয়, সে খ্রিস্টান নাম হলো, অ্যাডাম আব্রাহাম চাওসিকো।’ বলল আনা আরিয়া।

‘ধন্যবাদ বোন।’

কথাটা শেষ করে থামল আহমদ মুসা মুহূর্তের জন্যে। সংগে সংগেই আবার বলে উঠল, ‘শোন আনা আরিয়া, তোমাকে এখন বাড়ির সামনের দিকে আরেকটু এগিয়ে জংগলে লুকিয়ে থাকতে হবে আমি না ফেরা পর্যন্ত। তুমি…।’

আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই আনা আরিয়া বলে উঠল, ‘দুঃখিত স্যার, আপনি কোথায় যাবেন?’

‘আমি এখন এ বাড়িতে ঢুকব চাওসিকোর সন্ধানে।’ বলল আহমদ মুসা। আনা আরিয়ার চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে উঠল। বলল, ‘আপনি একা ঢুকবেন স্যার?’

‘না আমরা দু’জন ঢুকব।’ বলল আহমদ মুসা।

‘কিন্তু আমাকে তো জংগলে অপেক্ষা করতে বললেন।’ আনা আরিয়া বলল। তার চোখে-মুখে প্রশ্ন।

‘না, তুমি জংগলেই অপেক্ষা করবে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘তাহলে তো আপনি একা?’ আনা আরিয়া বলল।

‘একা নয়, আল্লাহ আমার সাথে আছেন।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আল্লাহু আকবর।’ ধ্বনিত হলো শব্দ দু’টি আনা আরিয়ার কণ্ঠে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়-বিমুগ্ধতা। বলল, ‘ভুলে গিয়েছিলাম স্যার আল্লাহর কথা। নতুন ঈমান তো?’

‘ঈমান কারও ক্ষেত্রে নতুন অর্থে নতুন থাকে না বোন। বিশ্বাসের ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথেই আল্লাহকে পাওয়ার শত যোজন পথ সে অতিক্রম করে একনিমেষেই। তখন ঈমান তার পুরানো ও পূর্ণ হয়ে যায়। আসলে কিন্তু মানুষের ঈমান সবসময় চির নতুন থাকে। চলার পথে সৃষ্টির প্রতিটি ঘটনা ও নিদর্শনের মধ্যে ঈমানের নবায়ন হয়, নতুন জীবন পায়, পায় নতুন শক্তি, নতুন গভীরতা।’

একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘তুমি কি রিভলভার চালাতে জানো বোন?’

‘জানি, কিন্তু প্রাকটিক্যালি কখনও ব্যবহার করিনি।’ বলল আনা আরিয়া।

‘তাতেই চলবে। বলে আহমদ মুসা পায়ের মোজায় আটকানো একটা রিভলভার বের করে আনা আরিয়ার হাতে তুলে দিল।

আনা আরিয়া ‘বিসমিল্লাহ’ বলে রিভলভার হাতে নিয়ে বলল, ‘স্যার, রিভলভারের সাথে দোয়াও চাই।’

‘আল্লাহ তার রহম ও করম দিয়ে আমাদের সকলকে ঘিরে রাখুন।’ বলে আহমদ মুসা তার জ্যাকেটের পকেট থেকে তার এম-১৬ বের করে হাতে নিয়ে চলার জন্যে ঘুরে দাঁড়ানোর আগে বলল, ‘আসি বোন। আল্লাহ হাফেজ।’

চলতে শুরু করল আহমদ মুসা। জংগলের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে সে দৃঢ় পায়ে অগ্রসর হচ্ছে পোড়ো ধরনের পুরানো বাড়িটার দিকে।

আনা আরিয়া তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার চলার পথের দিকে।

বুকে তার চিন্তার তোলপাড়। আহমদ মুসাকে এখনই মাত্র সে দেখল। তার পরিচয় এখনও সে জানে না। কিন্তু মনে হচ্ছে যুগ-যুগান্তরের সে চেনা। এক ‘বোন’ ডাকেই সে তাকে আপন করে নিয়েছে।

কে এই আহমদ মুসা?

দেখা গেল কিডন্যাপারদের কাছে সে পরিচিত ও ভয়ের বস্তু। ভয়ের বস্তু তো হবেই। ওদের পাঁচজনকে সে চোখের পলকে পাখির মতো শিকার করল। ওরা একটা গুলি ছোঁড়ারও সুযোগ পায়নি।

কে সে? নিশ্চয় বড় কেউ হবে।

বিনা দ্বিধায় শত্রুপুরীতে সে ঢুকে যাচ্ছে।

চাওসিকো তো তার কেউ নয়, পরিচয়ও তার সাথে নেই।

আরেকটা প্রশ্নেরও সে কোনো জবাব পাচ্ছে না। সে কেন এখানে, এই সময়ে? বোঝাই যাচ্ছে সে আগে থেকেই এখানে কোথাও ছিল। কেন ছিল?

আনা আরিয়া এখানে এসেছে চাওসিকোকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা দেখার জন্যে এবং সম্ভব হলে তাকে উদ্ধারের কিছু ব্যবস্থা করার জন্যে। আহমদ মুসারও কি কোনো মিশন আছে এখানে আসার পেছনে? সে যাইহোক, আল্লাহই তাকে এনেছেন আনা আরিয়াকে এবং চাওসিকোকে সাহায্য করার জন্যে। সে এখন মুক্ত তারই জন্যে। সে সময়ের অবস্থা মনে পড়তেই বুকটা কেঁপে উঠল আনা আরিয়ার। ওদের হাতে থাকলে তার কি হতো। একেবারেই নিম্ন শ্রেণির ক্রিমিনাল ওরা। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আনা আরিয়া। আল্লাহই তাকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহ আহমদ মুসাকে সাহায্য করুন, চাওসিকোকে ভয়ানক বিপদ থেকে রক্ষা করুন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল আনা আরিয়া।

.

পুরনো বাড়িটাতে প্রবেশ করে এঘর ওঘর পেরিয়ে বাড়ির মাঝখানে একটা বড় খোলা চত্বরের সামনে, চারদিকে ঘোরানো খোলা বারান্দায় নিয়ে দাঁড় করানো হলো চাওসিকোকে। বারান্দায় ইতস্তত ছড়ানো কিছু হাতলবিহীন চেয়ার ছিল।

এপাশ ওপাশের রুম থেকে আরো জনা আটেক লোক বেরিয়ে এলো। সকলে একই বয়সের। একজন চিৎকার করে বলল, ‘প্রাভো! প্রভু যিশুর শত্রুকে ধরে এনেছিস। এখনও দেখছি আস্ত রেখেছিস। আধমরা করে জীবন্ত কবর দেব তাকে।’

‘বসের সাথে কথা বলার আগে কিছু করা যাবে না। বসকে মোবাইল করছি আমি।’ বলে একজন তার মোবাইল বের করল এবং তাদের বসকে কল করল।

‘স্যার, আমরা লোকেশনে পৌঁছে গেছি। এখন আপনার নির্দেশ বলুন। বলল এ প্রান্ত থেকে লোকটি।

উত্তরে ও প্রান্ত থেকে কথা এলো। লোকটি ওপার থেকে বসের বলা কথা শুনল, মাঝে মাঝে স্যার, স্যার বলল। ওপারের কথা শেষ হলে সে বলল, ‘স্যার, সে আমাদের প্রভু যিশুর শত্রু। সকলেই চাচ্ছে, তার উপর তাদের কিছু রাগ মেটাতে।’

আবার ওপর থেকে কথা এলো। শুনল লোকটি।

কথা শেষ হলো তাদের দু’জনের।

মোবাইল পকেটে রেখে দিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘শোনো তোমরা, যা তোমরা চেয়েছ, সে আদেশ বসও দিয়েছে। তার জীবন্ত সমাধির হুকুম হয়েছে। রাত বারোটার মধ্যে সব শেষ করে বসকে জানাতে হবে। আরেকটা খারাপ খবর তিনি দিয়েছেন। আমরা চাওসিকোকে নিয়ে আসার সময় তার সহযাত্রী এবং প্রেমিকা আনা আরিয়া একটা গাড়ি নিয়ে আমাদের ফলো করেছিল। এটা জানতে পেরে বসরা আনা আরিয়াকে ধরার জন্যে পাঁচজনের একটা দল পাঠিয়েছিল। এই বাড়ির সামনে আনা আরিয়াকে তারা পেয়ে যায় এবং তাকে আটক করে। তারা জানিয়েছিল আনা আরিয়াকে নিয়ে তারা যাচ্ছে। কিন্তু আনা, আরিয়াকে নিয়ে তারা পৌঁছেনি এবং তাদের সাথে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। সব মোবাইলেই রিং বাজছে, কিন্তু কেউ ধরছে না। এই অবস্থায় বস নির্দেশ দিয়েছেন দ্রুত কবর খুঁড়ে চাওসিকোকে সামলাবার জন্যে।

আর তিনি বলেছেন মারধোর বা গণধোলাই-এর মতো কাজের সময় এখন নেই। আমরা এখন ইমারজেন্সির মধ্যে।

দ্রুত গর্ত খোঁড়ার কাজ চলছে।

চাওসিকো সবই শুনেছে। তার মনে কোনো উদ্বেগ বা ভয় নেই, আল্লাহ তার জন্যে যা নির্ধারিত রেখেছেন সেটাই হবে। এ দুঃখের মধ্যেও তার খুশি লাগছে আনা আরিয়া তার জন্যে শেষ চেষ্টা করেছে। এই সাথে তার মনে একটা ভয় উঁকি দিচ্ছে। আনা আরিয়ার বড় কিছু ঘটেনি তো। আনা আরিয়াকে নিয়ে তার আটককারীরা যেখানে পৌঁছার কথা সেখানে পৌঁছল না কেন? কি হলো আনা আরিয়া এবং তাদের!

চাওসিকোর এই চিন্তার মধ্যে একজন এসে তাকে বলল, ‘এই শয়তানের বাচ্চা শয়তান, দেখছিস ওটা কি খোঁড়া হচ্ছে?’

‘হ্যাঁ জানি, ঐ গর্তে তোমরা আমাকে মাটি চাপা দেবে।’ বলল চাওসিকো। ‘বলছিস এমন করে, যেন তোর শ্বশুর বাড়ি যাবার আয়োজন হচ্ছে। জীবন্ত মাটি চাপা পড়বি, ভয় করছে না?’ লোকটি বলল।

‘সব মৃত্যুই মৃত্যু। একদিন মরতেই হবে। মৃত্যুকে ভয় পেলে কি তোমরা মুক্তি দিরে? দিবে না। তাহলে ভয় করে লাভ?’ বলল চাওসিকো।

লোকটি চিৎকার করে চাওসিকোর কথা সকলকে জানাল।

সংগে সংগে একজন চত্বর থেকে ছুটে এলো। সর্বশক্তি দিয়ে একটা ঘুষি চালাল চাওসিকোর মুখে।

চাওসিকো তার মুখ সরিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেনি।

ঘুষিটি প্রচণ্ডভাবে আঘাত করল চাওসিকোর মুখে।

নাক ও ঠোঁট ফেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এলো।

‘মার শালা শয়তানের বাচ্চাকে, বড় বড় কথা।’ বলে আরও কয়েকজন ছুটে এলো।

কিল, ঘুষি, লাথি চলতে লাগল চাওসিকোর উপর। পড়ে গিয়েছিল চাওসিকো। ঐ অবস্থাতেই তার উপর চলতে থাকল কিল, ঘুষি, লাথির আঘাত।

‘থাম তোমরা?’ একটা বজ্রকণ্ঠ চিৎকার করে উঠল

সবাই তাকাল সেদিকে। দেখল, একহারা গড়নের চেহারার যুবকটিকে। তার এই বজ্রকণ্ঠের ধরন অচেনা লাগছে। যুবকটির পিঠে আটকে আছে একটা ব্যাগ।

লোকরা তাদের আকস্মিকতার বিমূঢ় ভাব কাটিয়ে উঠার আগেই যুবকটির বজ্রকণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো, ‘তোমরা সকলেই হাত তুলে দাঁড়াও।’

হাত তুলে দাঁড়াতে গিয়ে অনেকেই তাদের অস্ত্র তুলে নিয়েছে হাতে। দ্রুত উঠে আসছে তাদের রিভলভারের ব্যারেলগুলো যুবকটির দিকে।

চোখের পলকে যুবকটির এম-১৬ মেশিন রিভলভার লোকদের উপর দিয়ে ঘুরে এলো। গুলি বেরিয়েছিল বৃষ্টির মতো।

মুহূর্তেই বারোটি লাশ পড়ে গেল।

একজন লাফ দিয়েছিল গর্তে। সে বেঁচে গেছে।

যুবকটি আহমদ মুসা। চাওসিকোর উদ্ধারের জন্যে সে ঢুকেছিল পরিত্যক্ত এই পুরানো বাড়িতে। একজন বেঁচে যাওয়ায় খুশি হলো আহমদ মুসা। এদের অন্তত একজনকে সে জীবিত চায়। বারান্দা থেকে নেমে আহমদ মুসা এগোলো গর্তের দিকে। তার হাতের রিভলভার গর্তের দিকে তাক করা। গর্তের উপরের একটা অংশ সে দেখতে পাচ্ছে।

গর্তের মুখের আয়তন দেখে আহমদ মুসা ভাবল, এ ধরনের একটা গর্ত তারা এখানে কেন খুঁড়ছিল! কোনো কিছু লুকিয়ে রাখার জন্যে?

আহমদ মুসার ভাবনার এই মুহূর্তে একটা লোক গর্ত থেকে স্প্রিং-এর মতো উঠে দাঁড়াল এবং গুলি করল আহমদ মুসাকে।

আহমদ মুসার তখন করার কিছুই ছিল না।

কিন্তু তার চিন্তা নতুন করে সক্রিয় হবার আগেই তার সিকথ সেন্স সক্রিয় হয়ে উঠেছিল

আহমদ মুসার দেহ চোখের পলকে ডান দিকে কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার এম-১৬ তার ডান হাতে ঠিকঠাক ছিল। বাম হাতটা মাত্র একবারের জন্যে কেঁপে উঠেছিল লোকটির গুলি আহমদ মুসার কাঁধের নিচে বাম বাহুর মাথায় বিদ্ধ হওয়ার সময়।

আহমদ মুসার দেহ মাটিতে পড়ার আগেই এম-১৬ এর ট্রিগারে রাখা আহমদ মুসার শাহাদাত আঙুলি সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। চেপে বসেছিল ট্রিগারে। বেরিয়ে গিয়েছিল এম-১৬ থেকে এক পশলা গুলি।

লোকটি দাঁড়িয়ে থেকেই দ্বিতীয় গুলি করার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু গুলি করার আর সুযোগ সে পায়নি। আহমদ মুসার এম-১৬ এর গুলি তাকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। তাকাল চাওসিকোর দিকে। বলল, চাওসিকো ওদের আর কোনো লোক কি আশেপাশে আছে?’

চাওসিকো উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার মুখ রক্তাক্ত।

তার চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময় এবং মনে হাজারো প্রশ্নের ভিড়।

যুবকটির বাহুতে গুলি লেগেছে, তাও দেখতে পেয়েছে সে।

আঁৎকে উঠেছিল সে তাকে রক্ষাকারী যুবকটিকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখে। চাওসিকো অবাক হলো, যুবকটি তার আহত স্থানে একবারও হাত দিল না, দেখলও না। সবচেয়ে অবাক হয়েছে চাওসিকো, গুলি খাওয়ার সাথে সাথেই সে গর্তের লোকটিকে মেরেছে গুলি করে।

আহমদ মুসার জিজ্ঞাসার জবাবে চাওসিকো বলল, ‘আমার মনে হয় ওদের আর কোনো লোক এখানে নেই।’

‘ধন্যবাদ চাওসিকো। বারান্দার একটা চেয়ারে তুমি বসো। আমি আসছি।’ আহমদ মুসা বলল।

বিস্ময় কাটছে না চাওসিকোর। এই যুবককে সে দেখেওনি, চিনেও না। পরিচিতজন, বিশ্ববিদ্যালয়, কোথাও এ ধরনের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব তার নেই। সে আসছে ইতালি থেকে। বিমানবন্দর থেকে সে কিডন্যাপ হলো। কিন্তু কোত্থেকে এলো এই লোকটি তাকে উদ্ধারের জন্যে। শুরু থেকেই সে তার নাম ধরে ডাকছে। নাম বলছে এমন করে যেন সে চাওসিকোর কোনো আত্মীয়-পরিজন বা বন্ধু-বান্ধব।

আহমদ মুসা মৃত লোকদের তল্লাসিতে লেগে গেছে। তেরোজনকেই তল্লাসি করল সে। তাদের পকেটে, মানিব্যাগে টাকা ছাড়া আর কিছুই পেল না। তবে প্রত্যেকের কলার ব্যান্ডে পেয়ে গেল সেই ‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা’ (SCA)-এর মনোগ্রাম। আশ্চর্য হলো আহমদ মুসা, ব্ল্যাক ক্রসের এই লোকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো ভবনে এলো কি করে? আসুমানি পরিবারের নিহত দুই মেয়ের ভর্তির ব্যাপারে তাদের কাছে যাওয়া একটা টেলিফোন কলের গ্রেট বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্যেই আহমদ মুসার এখানে আসা। এই বিল্ডিংটাই ছিল টেলিফোন কলটির লোকেশন। এসে পেল ব্ল্যাক ক্রসের লোকদের। তাহলে কি এদেরই কেউ টেলিফোন করেছিল আসুমানি পরিবারে, কিন্তু কেন?

এই ‘কেন’-এর উত্তর খোঁজা আপাতত বন্ধ করে তাকাল চাওসিকোর দিকে। উঠে এলো সে বারান্দায় বসা চাওসিকোর কাছে। বলল, ‘চাওসিকো তুমি কেমন আছ, কেমন বোধ করছ?’

‘ভালো স্যার। কোনো অসুবিধা বোধ করছি না।’ চাওসিকো বলল। ‘তোমার রক্তাক্ত চেহারা, শরীরের অবস্থা তোমার কথাকে সত্য বলছে না চাওসিকো।’ বলল আহমদ মুসা।

‘স্যার, আপনি গুলিবিদ্ধ। বাম কাঁধের এ পাশটা রক্তে ভিজে গেছে। কিন্তু আপনি কোনো অসুবিধা বোধ করছেন বলে মনে হচ্ছে না।’ চাওসিকো বলল।

হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি মানুষ, মানুষের সব অনুভূতি আমার আছে। তাহলে আমি অসুবিধা বোধ করব না কেন? কষ্ট পাব না কেন? আমি যথেষ্ট কষ্ট বোধ করছি। কিন্তু কষ্টকে আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি না ধৈর্যের আশ্রয় নিয়ে। ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ থাকেন।’ সাহায্য করেন।

একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘সত্যিই তুমি ভালো আছো তো চাওসিকো?’

‘স্যার, আপনার মতোই আমি ধৈর্য ধরেছি। শরীরে বড় কোনো অসুবিধা আমি দেখছি না স্যার, আলহামদুলিল্লাহ।’

‘আলহামদুলিল্লাহ। চল চাওসিকো, আমরা চলি। হাঁটতে পারবে তো?’

‘স্যার, দৌড়াতেও পারব স্যার।’ চাওসিকো বলল।

‘গুড, এই তো চাই।’ বলল আহমদ মুসা।

দু’জনে কথা বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করল বাইরে বেরুবার জন্যে।

আহমদ মুসা চাওসিকোর নাক, ঠোঁট, মুখ অ্যান্টিসেপটিক মেশানো লিকুইড দিয়ে মুছে দিয়েছে। ওষুধও খাইয়ে দিয়েছে।

আহমদ মুসার বাহুসন্ধিতে লাগা গুলি একটা পাশকে আহত করে বেরিয়ে গেছে।

আহমদ মুসা তার আহত স্থানের ব্যান্ডেজ নিজেই বাঁধতে যাচ্ছিল। চাওসিকো বলল, ‘স্যার, ফাস্ট এইড ট্রেনিং আমার আছে। ব্যান্ডেজ বাঁধায় আমি খুব দক্ষ। আমাকে সুযোগ দিন প্লিজ। সারা জীবনের জন্যে আমার একটা বড় সঞ্চয় হবে যে, আমি একদিন আহমদ মুসার বাহুতে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলাম।

.

আহমদ মুসার নাম চাওসিকো আনা আরিয়ার কাছ থেকে ইতিমধ্যেই শুনে নিয়েছিল।

আহমদ মুসার নাম শুনে চাওসিকো আবেগে, উত্তেজনায় কেঁদে ফেলেছিল। সিজদায় পড়ে চিৎকার করে বলেছিল, ‘ইয়া আল্লাহ আপনার হাজার শোকর। আহমদ মুসার সাথে আমার দেখা করিয়ে দিয়েছেন আমার ও আনা আরিয়ার কঠিন এক দুঃসময়ে। আপনার এ বান্দার একটা চাওয়া আপনি পূর্ণ করেছেন ‘

সিজদা থেকে উঠে চাওসিকো আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলেছিল, ‘স্যার, ক্যামেরুনের ঘটনাসহ আপনার কথা ইন্টারনেটে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে এত পড়েছি যে, আমি স্বপ্ন দেখতাম আপনার সব ঘটনা নিয়ে। আল্লাহর কাছে কত যে প্রার্থনা করেছি, আল্লাহ আপনার সাথে যেন আমাকে সাক্ষাৎ করান। জানেন, রবিনহুড, শার্লক হোমস, চেগুয়েভারা, হো চি মিন, মাওসেতুং প্রমুখের সব ভালো দিকের যোগফল হিসাবে আপনাকে আমি দেখি। আমার দেখা যে ঠিক আজকের ঘটনা আমাকে তা বলে দিচ্ছে।

একটু আড়ালে গিয়ে আহমদ মুসার বাহুসন্ধিতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিল চাওসিকো।

আহমদ মুসারা কথা-বার্তা বলাসহ এই কাজগুলো করছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানের গাছ-পালা ঘেরা একটা চত্বরে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সেবা-শুশ্রূষার সব কাজ শেষ হয়ে গেলে আহমদ মুসা চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে নিয়ে বসল।

আনা আরিয়ার দু’গণ্ড জুড়ে তখনও অশ্রুর দাগ।

চাওসিকো ও আহমদ মুসার আহত অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল আনা আরিয়া। আহমদ মুসা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, ‘আমার ও চাওসিকোর সামান্য আহত হওয়া দেখে তুমি কাঁদছ, কিন্তু এ দুর্ঘটনায় সতেরজন লোকের প্রাণ গেল। আল্লাহ তো আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।’

‘স্যার, আমি কাঁদছি, আপনার গুলিটা আর কয়েক ইঞ্চি ডানে গিয়ে লাগলে কি হতো এবং আপনাকে আল্লাহ না পাঠালে আমার ও চাওসিকোর কি অবস্থা দাঁড়াতো?’ আনা আরিয়া বলেছিল।

‘আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেছেন। তাঁর শুকরিয়া আদায় করে এসো বর্তমান নিয়ে আলোচনা করি। এখন রাত বারোটা। আমাদের সামনে কিছু জরুরি বিষয় আছে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘স্যার বলুন।’ চাওসিকো ও আনা আরিয়া দুজনেই বলে উঠল

‘আজ এ পর্যন্ত চাওসিকো ও আনা আরিয়ার জীবনে যা ঘটেছে তা নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। চাওসিকো তোমার বিশ্ববিদ্যালয় হলে যাওয়া বা বাড়িতে যাওয়া নিরাপদ কিনা?’

‘না নিরাপদ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় হলের ঠিকানা ওরা জানে, বাড়ির ঠিকানাও ওরা জানে।’ বলল আনা আরিয়া।

‘তৃতীয়, চতুর্থ কোনো জায়গা চাওসিকোর আছে কিনা?’ আহমদ মুসা বলল।

আনা আরিয়া তাকাল চাওসিকোর দিকে।

‘আমার দুই ফুফুর বাড়ি আছে বুজুমবুরাতে। বলল চাওসিকো।

‘তুমি সেখানে নিরাপদ?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

‘জি, নিরাপদ বলে আমি মনে করি।’ বলল চাওসিকো।

‘ঠিক আছে আমি সেখানে তোমাকে পৌঁছে দেব।’ আহমদ মুসা বলল। আহমদ মুখ ঘুরাল আনা আরিয়ার দিকে। বলল, ‘বোন, তুমি তো বাড়িতে যেতে পারবে?’

‘রাত নয়টার পর থেকে যা ঘটেছে, ‘সে সব সংবাদ আমার বাড়িতে পৌঁছে গেছে। অন্তত বাবা সবই জানতে পেরেছেন এবং এখানকার ঘটনাও বিস্তারিত জানবেন। তাই বাড়িতে আমিও নিরাপদ নই।

‘বিকল্প ব্যবস্থা তোমার কি আছে আনা আরিয়া?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

‘আমার কোনো বিকল্প নেই স্যার। যে আত্মীয়ের বাড়িতেই যাব, বাবা সংগে সংগেই তা জানতে পারবেন।’ বলল আনা আরিয়া।

সংগে সংগে কথা বলল না আহমদ মুসা।

ভাবছিল সে।

বলল অনেকটা স্বগতোক্তির মতো, ‘বয়ঃপ্রাপ্ত মেয়েদের নিরাপদ জায়গা বাপের বাড়ি এবং স্বামীর বাড়ি। আনা আরিয়া তুমি বাপের বাড়ি নিরাপদ মনে করছ না। আমিও মনে করি আরও কিছু কারণে তুমি তোমার বাড়িতে নিরাপদ নও। তাহলে তোমরা দু’জন এখন কি বিয়ে করতে রাজি আছ?’

চাওসিকো ও আনা আরিয়া দু’জনেই মাথা নিচু করল। দু’জনের কেউ কিছু বলল না।

আহমদ মুসা বলল, ‘আমরা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে। আমাদের সবাইকে বাস্তববাদী হতে হবে। আনা আরিয়া তুমি খুব সাহসী, স্পষ্টবাদী ও বুদ্ধিমতি মেয়ে। তোমার কাছ থেকে বাস্তব পরামর্শ আশা করি বোন।

আনা আরিয়া মুখ তুলল। বলল ‘ধন্যবাদ ভাইয়া, আমি বিয়েতে রাজি। যে পরিস্থিতিতে দু’জন পড়েছি, তাতে বিয়ে করার মধ্যেই আমাদের কল্যাণ আছে। কিন্তু ভাইয়া, মন বলছে আমি চাওসিকোকে বিয়ে করছি, এটা আমার মা-বাবাকে বলা উচিত।’

‘ধন্যবাদ বোন। তোমার মন ঠিক বলেছে। তাহলে তোমরা ওঠো, আনা আরিয়ার বাড়িতে প্রথম যাব।’ বলে উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।

উঠে দাঁড়াল চাওসিকো এবং আনা আরিয়া।

আনা আরিয়ার চোখে-মুখে বিস্ময়। বলল, ‘ভাইয়া আমাদের বাড়িতে যাবেন? কেন?’

‘তোমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে।’ আহমদ মুসা বলল।

আনা আরিয়ার বিস্ময় আরও বাড়ল। বলল, ‘কি কথা ভাইয়া? বিয়ের ব্যাপারে বাবা-মাকে কিছু বলার সময় এটা নয় ভাইয়া। কিছুই বলা এখন সম্ভব নয় আমার পক্ষে।’

‘তুমি তো কথা বলবে না। কথা বলব আমি।’ আহমদ মুসা বলল।

‘ভাইয়া আরেকটা কথা। বাবা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি শুধু নন, তিনি মধ্য আফ্রিকায় শীর্ষ খ্রিস্টান নেতাদের একজন।’ বলল আনা আরিয়া।

‘ধন্যবাদ, বিষয়টা আমাকে আরও সাহায্য করবে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘ভয় হচ্ছে আমার ভাইয়া, আপনি যদি সেখানে ভালো ব্যবহার না পান।’ বলল আনা আরিয়া।

‘খারাপ ব্যবহার পাবার জন্যে আমি প্রস্তুত আছি।’ আহমদ মুসা বলল।

‘আমাকে আটকে রাখবেন আমার বাবা-মা, আমি ভয় করি ভাইয়া।’ বলল আনা আরিয়া।

‘কোনো ব্যাপারেই কিছু ভেব না। আল্লাহর উপর ভরসা কর।’ আহমদ মুসা বলল।

‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আল্লাহ আমাদের জন্যে যথেষ্ট।’ বলল আনা আরিয়া।

গাড়িতে উঠে বসল সবাই। আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে। তার পাশের সিটে চাওসিকো। আর পেছনের একা বসেছে আনা আরিয়া।

গাড়ি চলতে লাগল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগান থেকে ভিসির বাড়ি খুব কাছেই। ভিসি’র বাড়ির গেট বন্ধ। গাড়িটিকে দাঁড়াতে হলো।

গেট বক্স থেকে বেরিয়ে এলো দারোয়ান। সে গাড়ির সামনের সিটে দু’জন অপরিচিত লোক দেখতে পেল। কিন্তু পেছনের সিটে তাকিয়েই দেখতে পেল ছোট ম্যাডাম, মানে আনা আরিয়াকে। গেটম্যান আনা আরিয়াকে একটা বাউ করে দ্রুত গিয়ে গেট খুলে দিল। ভেতরে ঢুকে গেল গাড়ি। গাড়ি আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল আনা আরিয়াদের গাড়ি বারান্দায়।

কয়েক মুহূর্ত সময় গেল। আনা আরিয়া বলল, ‘ভাইয়া আস্তে তিনটা শর্ট হর্ন দিন। এটাই আমার হর্ন-কোড।

হর্ন দিতে হবে না আনা আরিয়া। তোমার বাবা-মা এখনি এসে পড়বেন।’ আহমদ মুসা বলল।

‘কেমন করে জানবেন তারা। আপনি গেটেও তো হর্ন দেননি।’ বলল আনা আরিয়া।

‘গেটম্যান ওদের জানিয়ে দিয়েছেন।’ আহমদ মুসা বলল।

‘ঠিক ভাইয়া, এ সহজ কথাটা আমার মনে আসেনি। আল্লাহর হাজার শোকর, কোনো ছোট বিষয়ও দেখি আপনার নজর এড়ায় না।’ বলল আনা আরিয়া।

আনা আরিয়ার কথা শেষ না হতেই গাড়ি বারান্দার সামনের বড় গেটটা খুলে গেল। ছুটে বেরিয়ে এলো আনা আরিয়ার বাবা-মা।

এসে দাঁড়াল গাড়ির পাশে। আনা আরিয়াও দ্রুত বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। প্রথমেই পেল বাবাকে।

বাবা দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল আনা আরিয়াকে।

‘প্রভু যিশুকে অনেক ধন্যবাদ। তিনি আমাদের সহায় হয়েছেন?’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।

আনা আরিয়া বাবাকে ছেড়ে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। তার মা শিলা স্টিফেন তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। বলল, ‘গত দুই ঘণ্টায় আমরা শেষ হয়ে গেছি মা। তোমাকে বলেছি না যে, কোনো বিপদে জড়াবে না। কেন বিপদের মধ্যে ছুটে গেলি।

স্ত্রী শিলাকে একটু শান্ত করে ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান গাড়ির দিকে আর একটু এগিয়ে এলো। বলল আহমদ মুসাদের লক্ষ্য করে, ‘তোমাদেরকে ধন্যবাদ। আমাদের মেয়েকে আমরা পেয়ে গেছি। চাওসিকোও উদ্ধার হয়েছে। প্রভু যিশু তোমাদের মঙ্গল করুন। আমাদের আর কিছু বলার নেই, শোনারও নেই। ধন্যবাদ।’

বলে ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান তাকাল স্ত্রী শিলা ও মেয়ে আনা আরিয়ার দিকে। বলল, ‘চলো।

গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে বেরিয়ে এলো আহমদ মুসা। গাড়ির দরজা বন্ধ করে গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মি. স্টিফেন, আপনার বলারও নেই, শোনারও নেই। কিন্তু আমার বলারও আছে, শোনারও আছে। আশা করি আমাকে সুযোগ দেবেন।’ আহমদ মুসার শান্ত, কিন্তু শক্ত কণ্ঠ।

ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান ঘুরে দাঁড়াল।

তাকাল স্থির এবং কিছুটা বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে আহমদ মুসার দিকে। তার কোনো কথার এ রকম জবাব কোনো দিন সে শোনেনি এবং শুনতে তার ভালোও লাগেনি। কিন্তু আহমদ মুসার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন কিছুটা সম্মোহিত হলো। মনে হলো এ যুবক অনর্থক কথা বলে না, অহংকারের ফাঁকা বুলিও এটা নয়। যুবকটির শান্ত চেহারার মধ্যে যেন আগুন দেখতে পাচ্ছে সে। বলল স্টিফেন ফোবিয়ান, ‘আমি কথাটা বলেছিলাম এজন্যে যে, আমাদের বাড়ির উপর পুলিশের দৃষ্টি আছে। কথা আমাদের তাড়াতাড়ি শেষ করাই ভালো।’

‘পুলিশকে আমাদের কোনো ভয় নেই, পুলিশকে আমারও প্রয়োজন।’ বলল আহমদ মুসা।

‘ধন্যবাদ। বলো এবার তোমার কথা।’ ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।

‘যা বলার, তার আগে আরও কয়েকটা কথা বলা প্রয়োজন। বিমানবন্দরের ভেতর বিমানের পাশ থেকে পাঁচজন সন্ত্রাসী চাওসিকোকে কিডন্যাপ করে। আতংকিত আনা আরিয়া চাওসিকোকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা দেখা এবং পারলে উদ্ধার করার উদ্দেশে আনা আরিয়া সন্ত্রাসীদের পিছু নেয়। সন্ত্রাসীরা চাওসিকোকে আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো ও পরিত্যাক্ত প্রশাসনিক ভবনে এনে তুলে। আনা আরিয়া ভবনটির সামনে পৌঁছে পাশের ঝোঁপ এলাকায় একটা অন্ধকারে আশ্রয় নিয়ে ভাবতে থাকে কি করবে সে। এই সময় সন্ত্রাসীদের পাঁচজনের আর একটা গ্রুপ খবর পেয়ে সেখানে এসে আনা আরিয়াকে আটক করে। আনা আরিয়াকে তারা নানা অশোভন কথা বলে এবং শেষে চ্যাংদোলা করে তাকে তারা তাদের গাড়িতে তুলতে যাচ্ছিল। আমি অন্য একটা উদ্দেশ্য নিয়ে ঐ ভবনে এসেছিলাম এবং ঐ ঝোঁপেরই অন্যপাশে বসে সমগ্র বিষয়টা দেখছিলাম। যখন আনা আরিয়াকে চ্যাংদোলা করে তাদের গাড়িতে তুলছিল, তখন আমি গিয়ে তাকে উদ্ধার করি। সংঘর্ষে ওদের পাঁচজনই মারা যায়। মুক্ত আনা আরিয়ার কাছে সবকিছু শোনার পর আমি চাওসিকোকে উদ্ধারের জন্যে ভবনটিতে ঢুকি। আমি যখন চাওসিকোকে খুঁজে পাই, তখন দেখি অনেকে মিলে চাওসিকোকে মারধর করছে এবং তার জন্যে কবর খোঁড়া হচ্ছিল তাকে জীবন্ত কবর দেয়ার জন্যে। আমার সাথে সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষ হয়। সংকর্ষে সেখানে তেরজন’ সন্ত্রাসীর সবাই মারা পড়ে। চাওসিকো উদ্ধার হয়। চাওসিকো ও আনা আরিয়ার সাথে পরে অলোচনা করে আমি বুঝলাম চাওসিকো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাড়ি কোথাও নিরাপদ নয় এবং আনা আরিয়াও বাড়িতে নিরাপদ নয়। এই অব…’

আহমদ মুসার কথার মাঝখানে আনা আরিয়ার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান বলে উঠল, ‘আনা আরিয়া বাড়িতে নিরাপদ নয় কেন?’

‘আনা আরিয়াকে মুক্ত অবস্থায় বাড়িতে দেখলে সন্ত্রাসীরা ছুটে আসতে পারে দুই কারণে, আনা আরিয়ার উপর প্রতিশোধ নেয়া এবং তাকে মুক্তকারী লোকদের খোঁজ করা এবং আনা আরিয়ার কাছ থেকে তাদের পরিচয় জানা। সন্ত্রাসীদের সতেরোজন লোক নিহত হওয়ার জন্যে আনা আরিয়া দায়ী, এ অভিযোগ তারা তুলবে।’ আহমদ মুসা বলল।

‘যদি সন্ত্রাসীরা এ অভিযোগ না তুলে? কারণ আনা কাউকে হত্যা করেনি, বরং সেই কিডন্যাপ হতে যাচ্ছিল।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান।

‘স্যার, আপনি সন্ত্রাসীদের কতটুকু চেনেন জানি না, কিন্তু আমি ওদের ভালো করে চিনি। ব্ল্যাক ক্রসের সন্ত্রাসীরা প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষেত্রে নিজের লোকদেরকেও বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না।’ আহমদ মুসা বলল।

ফাদার স্টিফেন শুধু একবার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। কোনো কথা বলল না। ব্ল্যাক ক্রসরা কেমন, তা সে জানে। কিন্তু এই যুবকটি ওদের নাম পরিচয় জানল কি করে?

‘স্যার, আরেকটা বিষয়। আজ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো প্রশাসনিক ভবনে যা ঘটল, তা আমি পুলিশকে জানাতে চাই, যাতে আমার কোনো দায় না থাকে এবং পুলিশও জানতে পারে চাওসিকোকে • কিডন্যাপ কারা করেছিল। আনা আরিয়াকে পেলে পুলিশ আনা আরিয়াকে সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘শুধু আনা আরিয়া নয়, আমরাও মানে বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশী ঝামেলায় পড়তে পারে।’ আনা আরিয়ার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান বলল। তার কণ্ঠ অনেকটাই নরম।

‘স্যার, ওটা কোনো চিন্তার বিষয় নয়। পরিত্যাক্ত ভবনের দায় বিশ্ববিদ্যালয় সহজেই এড়িয়ে যেতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।

‘ধন্যবাদ ইয়ংম্যান। তুমি ঠিকই বলেছ।’ বলে একটু থামল ফাদার স্টিফেন ফোরিয়ান।

একটু ভাবল। বলল, ‘ইয়ংম্যান তুমি আনা সম্পর্কে যা বলেছ, সেটাও বড় এক বিষয়। সন্ত্রাসীদের সতেরজন লোক মারা গেছে, অবশ্যই ওরা প্রতিহিংসাপরায়ন হবে। তারপর ওদের পেছনে পুলিশ তৎপর হলে ওরা আরও ক্ষেপবে। সুতরাং আনা এখানে নিরাপদ নয়। তাকে অবশ্যই ওদের নজরের বাইরে কিছু দিন থাকতে হবে। ভাবছি আমি এই রাতে তাকে নিয়ে কি করা যায়।’

‘আমি একটা বাস্তব কথা আপনাকে বলতে চাই স্যার।’ বলল আহমদ মুসা।

‘বলো।’ আনা আরিয়ার বাবা বলল।

‘একজন বয়ঃপ্রাপ্ত মেয়ের আত্মগোপনের জায়গা বাবা-মায়ের বাড়ি হতে পারে, অথবা স্বামীর সাথে স্বামীর বাড়ি হতে পারে। আনা আরিয়া বাবা-মায়ের সাথে নিরাপদ নয়, দ্বিতীয় বিকল্প হলো তার স্বামীর সাথে থাকা।’ বলল আহমদ মুসা।

‘ও গড! আমার মেয়ের তো বিয়েই হয়নি। দ্বিতীয় বিকল্পের প্রশ্ন তো তার ক্ষেত্রে ওঠে না।’ আনা আরিয়ার বাবা বলল।

আনা আরিয়ার মা কথা শুনে চমকে উঠে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে, তারপর নিজের মেয়ের দিকে।

‘বিয়ে অবশ্যই হয়নি, তবে বিয়ে হতে পারে।’

কথাটা বলে আহমদ মুসা একটু হেসে আবার বলল আনা আরিয়ার মা- বাবার দিকে তাকিয়ে, ‘এই বিষয় নিয়ে আমি আনা আরিয়া এবং চাওসিকো দু’জনের সাথেই আলোচনা করেছি। বিয়েতে দু’জনেরই মত আছে। বাবা- মা হিসেবে এই ক্ষেত্রে আপনাদের দায়িত্ব বেশি। এখন আপনারা বলুন।’

আনা আরিয়ার বাবা ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে, তবে সেখানে ক্রোধের কোনো চিহ্ন নেই। আর আনা আরিয়ার মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

কিছুক্ষণ দু’জনের কেউ কথা বলল না। আনা আরিয়ার মা শিলা স্টিফেন তাকিয়ে আছে স্বামীর দিকে

‘কোনো ধর্মমতে বিয়ে হবে?’ নীরবতা ভেঙে বলল ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান, আনা আরিয়ার বাবা।

সংগে সংগেই আনা আরিয়ার মা স্বামীকে বলল, ‘এসব প্রশ্নে আমরা এখন না যাই। মেয়ের উপর ছেড়ে দাও এ বিষয়টা।’

ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তুমি ও তোমার মেয়ে যা ইচ্ছে তাই করো। আমাকে কিছু বলো না।’

কথাটা বলেই মেয়ে আনা আরিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দ্রুত হেঁটে বাড়িতে প্রবেশের দরজার দিকে চলে গেল। আনা আরিয়ার মা জড়িয়ে ধরল মেয়েকে। কান্নায় ভেঙে পড়ল মা, মেয়ে দুজনেই।

মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে এক সময় আনা আরিয়ার মা ডাকল চাওসিকোকে। চাওসিকো এলো।

তার দু’চোখ থেকেও অশ্রু গড়াচ্ছিল।

আনা আরিয়ার মা চাওসিকোর ডান হাত নিজের হাতে নিয়ে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘বাবা তুমি খুব ভালো ছেলে, সোনার ছেলে তুমি। তুমি আমাদের মেয়েকে অবশ্যই ভালো রাখবে।’

বলে আনা আরিয়ার ডান হাত এনে চাওসিকোর হাতে তুলে দিল আনা আরিয়ার মা।

আনা আরিয়া ও চাওসিকো দু’জনেই জড়িয়ে ধরল আনা আরিয়ার মাকে। তিনজনের কান্না এক হয়ে মিশে গেল বাতাসে।

আহমদ মুসার দু’চোখ থেকেও তখন অশ্রু গড়াচ্ছিল।

আনা আরিয়ার মা চাওসিকোদের ছেড়ে দিয়ে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘তুমি কে বাবা? সব অসাধ্য সাধনই তুমি করতে পার দেখছি। সতেরোজনকে মেরে আনা আরিয়া ও চাওসিকোকে উদ্ধার করলে, দু’জনকে একজোড়ায় এনে বাঁধলে, ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের মতো লোককেও মাত্র কয়েক কথায় বাগে আনলে, আবার তোমার চোখে মানব- হৃদয়ের মায়াময়তার বিগলিত রূপ অশ্রুও দেখছি। তুমি তো তোমার নামও বলনি, পরিচয়ও তো দাওনি।

‘মা, ওটা এক সময় আনা আরিয়ার কাছ থেকে জেনে নেবেন। মায়ের কাছে ‘সন্তান’ হওয়াই সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমাকেও আপনার এক সন্তান মনে করবেন। আনা আরিয়া আমার বোন।’ বলল আহমদ মুসা।

.

আনা আরিয়াকে এক পশলা চুমু খেয়ে তাকে এনে গাড়িতে বসাল আনা আরিয়ার মা। নিজের গলার হিরের নেকলেসটি পরিয়ে দিল আনা আরিয়ার গলায়।

চাওসিকোকেও হাত ধরে এনে গাড়িতে আনা আরিয়ার পাশে বসাতে গেল।

আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘না মা, চাওসিকো আনা আরিয়ার পাশে বসার অধিকার এখনো পায়নি, বিয়ে হয়নি এখনো তাদের। চাওসিকো সামনে আমার পাশে বসবে।’

‘কি জানি বাবা, তোমাদের ইসলাম ধর্মের, অনুশাসন সব তো আমরা জানি না। তবে এটা ভালো বাবা। আমার ভালো লাগল খুব।’ আনা আরিয়ার মা বলল।

‘না মা, ইসলাম ধর্ম শুধু আমাদের নয়, আপনার, আমার সব মানুষের ধর্ম।’

‘এসব এখন বলো না বাছা, আনার বাবা শুনতে পাবে। তাকে আর কষ্ট দেয়া ঠিক হবে না।’ বলল আনা আরিয়ার মা।

গাড়িতে উঠল চাওসিকো।

আহমদ মুসা বসল ড্রাইভিং সিটে।

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আনা আরিয়ার মা। বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘বাবা, আমার মেয়ে আনাকে নিয়ে এত নিরাপদ বোধ আর কখনই করিনি। তোমাদের সকলের জন্যে আমার শুভকামনা।’

‘আল্লাহ হাফেজ। বিসমিল্লাহ।’ বলে গাড়ি স্টার্ট দিল আহমদ মুসা। মুখে হাসি চোখে অশ্রু নিয়ে হাত নাড়ছিল আনা আরিয়ার মা।

গাড়ির ভেতর থেকে হাত নাড়ছিল, আনা আরিয়া ও চাওসিকো। দু’জনের চোখেও অশ্রু। আনা আরিয়ার হৃদয় জুড়ে আনন্দ-বেদনার এক মধুর-যন্ত্রণা।

.

আহমদ মুসার গাড়ি চলছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে দিয়ে।

ভাইস-চ্যান্সেলরের অফিস পার হয়ে এগিয়ে চলছিল গাড়ি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্দিষ্ট দূরত্বে আলোর ব্যবস্থা আছে। এর পরেও গোটা ক্যাম্পাস জুড়ে আলো-আঁধারির খেলা।

সামনেই ডান দিক থেকে আসা একটা রাস্তা আহমদ মুসাদের রাস্তাকে ক্রস করে বামে মানে উত্তরে চলে গেছে খুব কাছে একটা বিল্ডিং-এর দিকে। বিল্ডিংটির দিকে চোখ গেল আহমদ মুসার। দেখতে পেল, বিল্ডিংটির পাশ থেকে একজন লোক হাত তুলেছে। তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার গাড়ির দিকে।

রাস্তার ক্রসিং-এ গিয়ে আহমদ মুসা তার গাড়ি ঘুরিয়ে নিল বাম দিকে।

আহমদ মুসার গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল লোকটির পাশে।

হাত তুলে দাঁড়ানো লোকটি দুই ধাপ এগিয়ে এসে আহমদ মুসাকে বলল, ‘একজন ছাত্র হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া দরকার। আমাদের গাড়ি অন্য কাজে গেছে।’

লোকটির কথা শেষ হতেই আনা আরিয়া আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, স্যার, উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। আমাদের স্যার, রেভারেন্ড স্যার। ছাত্র-কল্যাণের দায়িত্বে আছেন তিনি।’

আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল।

হ্যান্ডশেক করল রেভারেন্ড স্যারের সাথে। বলল, ‘আপনার উপর একটা মহৎ দায়িত্ব স্যার।’

‘যখন যে দায়িত্ব দেয়া হয়, সেটাই পালন করি। এর আগে ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টরের দায়িত্বে।’ বলল রেভারেন্ড স্যার হেনরি উইলিয়াম।

‘চলুন আপনার ছাত্রকে দেখি।’

বলেই আহমদ মুসা গাড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘আনা আরিয়া তুমি ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসো। চাওসিকো এবং স্যার অসুস্থ ছেলেটিকে নিয়ে বসবেন পেছনে।’

অসুস্থ ছেলেটিকে আহমদ মুসাই পাজা-কোলা করে নিয়ে এসে পেছনের সিটের মাঝখানে বসিয়ে দিল। রেভারেন্ড স্যার ও চাওসিকো বসল তার দুই পাশে। গাড়ি চলছিল হাসপাতালের পথে।

হাসপাতালের নাম ও লোকেশনের বিষয় আগেই বলে দিয়েছে রেভারেন্ড স্যার…।

রাতের বুজুমবুরা। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া নেই বললেই চলে। প্রায় ফুল স্পিডে চলছিল গাড়ি। আহমদ মুসার স্থির দৃষ্টি সামনে।

‘রেভারেন্ড স্যার আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেই চলেছে। আপনার মন ভালো থাকার কথা নয়।’ বলল আহমদ মুসা।

‘যেমন।’ রেভারেন্ড স্যার বলল।

‘বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রতিভাবান মুসলিম ছাত্র আবিউলা আমাদী কিডন্যাপড হলো এবং নিহত হলো মর্মান্তিকভাবে। তার আগে আরেক প্রতিভাবান মুসলিম ছাত্র হেনরি বুফোর্ট মুহিজী এবং সারা সুসান রোজ তাদের বাড়ির সামনে নৃশংসভাবে খুন হলো। আর আজ প্রতিভাবান ছাত্র চাওসিকো কিডন্যাপ হয়েছিল। এছাড়া…।

আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই রেভারেন্ড স্যার হেনরি উইলিয়াম বলল, ‘চাওসিকো কিডন্যাপড হয়েছিল? ও গড! সে তো ভ্যাটিকান গিয়েছিল একটা প্রতিনিধিদল নিয়ে?’

‘আজ ফিরেছে, আজই কিডন্যাপ হয়েছিল।’ বলল আহমদ মুসা।

‘সত্যি বলেছেন, এসবই খুব মর্মান্তিক ঘটনা। আমার খুব মনে পড়ে হেনরি বুফোর্ট ও সারা সুসানের কথা। ঠিক এই মোড়েই হেনরি বুফোর্ট সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়েছিল। সারা সুসান আমার সাহায্য চেয়েছিল হেনরি বুফোর্টকে হাসপাতালে নেয়ার জন্যে। সে ছিল দারুণভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত। তাকে পাঁচশ’ ফ্রাঙ্ক দিয়ে একটা হায়ার্ড ট্যাক্সিতে করে আমি তাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম। পরদিন বিকেলেই হেনরি বুফোর্ট হাসপাতাল থেকে চলে যায়। বাড়ি যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হেনরি বুফোর্ট ও সারা সুসান খুন হয়।

‘হেনরি বুফোর্ট সংজ্ঞা হারিয়েছিল কেন?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

‘আমি জানি না। সারা সুসান জানতো কিনা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। হাসপাতালেও কোনো রেকর্ড নেই।’ বলল রেভারেন্ড স্যার।

‘হাসপাতালে তো অবশ্যই রেকর্ড থাকার কথা। নেই কেন?’

জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।

‘হাসপাতালে এ রেকর্ড কেন, হেনরি বুফোর্টের কোনো রেকর্ডই নেই। সে যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, হাসপাতালে ছিল, সে সবের কোনো কিছুই হাসপাতালের রেকর্ডে নেই। বলল রেভারেন্ড স্যার।

আহমদ মুসা কিছু বলল না। রাজ্যের বিস্ময় এসে ছায়া ফেলেছে তার চোখে-মুখে। ভাবল সে, হাসপাতালে আরও খোঁজ-খবর নিতে হবে এবং হেনরি বুফোর্টের বাড়িতেও একবার তার যাওয়া উচিত।

অসুস্থ ছাত্রকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে রেভারেন্ড স্যারের কাছে বিদায় নিয়ে আহমদ মুসা এলো চাওসিকোর ফুফুর বাড়িতে।

চাওসিকো আগেই তার ফুফা-ফুফিকে মোবাইলে সব কথা বলে রেখেছিল। তাই নতুন করে কোনো বলাবলির দরকার হলো না। ফুফা- ফুফি, ভাই-ভাবিরা সাদরে চাওসিকো ও আনা আরিয়াকে গ্রহণ করল। আহমদ মুসাকে তারা অনেক ধন্যবাদ দিয়ে অনুরোধ করল আপনি আসুন ভেতরে। সবার সাথে আপনার পরিচয় হবে এবং এখনকার করণীয় সম্পর্কে আপনার পরামর্শ দরকার।

‘এখনকার করণীয় একটাই। সেটা হলো আমার এই দুই ভাইবোন, আনা আরিয়া ও চাওসিকোর এখনি বিয়ের ব্যবস্থা করা। আনা আরিয়ার বাবা-মা’র অনুমতি নেয়া হয়েছে, এখন চাওসিকোর বাবা-মা অনুমতি দিলেই হয়ে যায়। আমি এখন বসতে পারছি না।

আমাকে এখনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজি’র সাথে দেখা করা দরকার।

আমি যাচ্ছি। আপনারা চাওসিকোর বাবা-মাদের ডাকুন। আমি কাজ সেরেই চলে আসব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *