৩
মধ্য আফ্রিকা চার্চ আন্দোলনের নেতা এবং মধ্য আফ্রিকা কাউন্সিল অব ক্যাথলিক চার্চের সভাপতি বাতিস্তা সান্ড্রি তার অফিস চেয়ারে বসে। উদ্ধুদ্ধু তার মাথার চুল। কিন্তু চোখ দু’টি তার শান্ত। কথা বলছিল সে সামনে বসা পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের সাথে।
‘না মি: স্টিফেন ফোবিয়ান, একক এক ব্যক্তির হাতেই সকাল ও সন্ধ্যার দুই ঘটনা ঘটেছে। আমাদের খুবই বিশ্বস্ত পুলিশ সোর্স থেকে এটা জানা গেছে। বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
‘বিষয়টা অবিশ্বাসেরই। মুখোমুখি অ্যাকশনে সকালে সে পাঁচ জনকে মারল এবং সন্ধ্যায়ও সে একাই মুখোমুখি লড়াইয়ে সাতজনকে মারল, অথচ তার কিছুই হলো না, এটা কি বিশ্বাস করার মতো? বুজুমবুরা কেন, গোটা বুরুন্ডিতে এমন করিতকর্মা কেউ আছে, এটা বিশ্বাস করার মতো নয়।’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘আপনি ঠিকই বলেছেন মি. স্টিফেন ফোবিয়ান। যে লোকটি এই দুইটি ঘটনা ঘটিয়েছে, সে এদেশের নয়।’ বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
‘সে কোন্ দেশের?’ জিজ্ঞাসা স্টিফেন ফোবিয়ানের।
‘সেটা সোর্স বলেনি। নিশ্চয় জানতে পারেনি।’ বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
‘আমি উদ্বিগ্ন মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। আমরা নীরবে, নিরাপদে খ্রিস্টীয় করণের যে প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলাম, সেটা কোনো মুস্কিলে পড়বে না তো?’ স্টিফেন জোরিয়ান বলল।
‘তা পড়বে কেন? যা ঘটেছে, সেটা রাস্তায় কিডন্যাপ ও খুনোখুনির ব্যাপার। তিনটি মেয়েকে কেন্দ্র করে এটা ঘটেছে। এর সাথে আমাদের প্রোগ্রামের কি সম্পর্ক?’ বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
স্টিফেন ফোবিয়ানের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘ঈশ্বর করুন, তাই যেন হয় মি. বাতিস্তা সান্ড্রি।’
‘উদ্বেগের কিছু নেই মি. স্টিফেন ফোবিয়ান। আমরা তো পুলিশকে বোঝাতে চাচ্ছি যে, বুজুমবুরায় যে সব হত্যা, সন্ত্রাস ও কিডন্যাপ, ইত্যাদির ঘটনা ঘটছে, তার সাথে বাইরের কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপের যোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে তিনজন সুন্দরী মেয়ে তাদের টার্গেট ছিল। মেয়ে ঘটিত কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা এটা হতে পারে অথবা এই পরিবারের সাথে বাইরের সন্ত্রাসীদের কোনো সংঘাত হতে পারে পারস্পরিক স্বার্থের কারণে বা অন্য কোনো কারণে। বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
‘ঠিক মি. সান্ডি, এ দু’টি ঘটনার সাথে তিনটি মেয়ে জড়িত থাকায় ঘটনাকে সবাই মেয়েঘটিত বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে করবে।’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘এসব নিয়ে কোনো চিন্তাই করবেন না মি. স্টিফেন ফোবিয়ান। এখন তো প্রতিপক্ষের মোকাবিলা এবং আমাদের প্রোগ্রামকে সহায়তার সব কাজ করতে হবে ‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা’ (SCA) নামের নতুন সংগঠনটির। সবাইকে আশ্রয় দেয়া ছাড়া আমাদের কোনো দায় দায়িত্ব নেই। কোনো দিকে আমাদের তাকাতে হবে না। আমরা শুধু আমাদের কাজ করে যাব।’ বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
‘ঈশ্বরকে যিশুকে অনেক ধন্যবাদ যে, ব্ল্যাক ক্রস আমাদের মাথার ভার পুরোটাই লাঘব করে দিয়েছেন। আমাদের জন্যে SCA গঠন করে দেয়ায় আমাদের নিরাপত্তা, টার্গেট বাগে আনা এবং প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা, ইত্যাদি সব চিন্তা থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। অসংখ্য ধনবাদ ব্ল্যাক ক্রস প্রধান কলিন ক্রিস্টোফারকে। স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
মোবাইল বেজে উঠল বাতিস্তা সান্ড্রির।
মোবাইল ধরেই সোজা হয়ে বসল বাতিস্তা সান্ড্রি। বলল, ‘গুড ইভেনিং মি. ক্রিস্টোফার।’
‘গুড ইভেনিং মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। জরুরি কথা আছে, আপনি কি অফিস থেকে বলছেন?’ ও প্রান্ত থেকে বলল কলিন ক্রিস্টোফার, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন ব্ল্যাক ক্রসের নতুন চিফ।
‘আমি এখন অফিসে। অফিসে এসেছেন মি. স্টিফেন ফোবিয়ানও বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘ভালোই হলো, দুজনকেই পাওয়া গেল।’
একটু থামল কলিন ক্রিস্টোফার। পর মুহূর্তেই আবার শুরু করল, ঐ লোকটি সম্পর্কে আর কিছু জানা গেছে?’
‘না মি. ক্রিস্টোফার। আপনাকে যা বলেছি, তার বেশি আর কিছু জানা যায়নি। আমি ও স্টিফেন ফোবিয়ান এই বিষয় নিয়েই আলোচনা করছিলাম। আমাদের পুলিশ সোর্সের সাথে পরেও আরও কথা হয়েছে, কিন্তু নতুন কিছু জানা যায়নি।’ বলল বাতিস্তা সান্ড্রি।
‘কিন্তু তার পরিচয় তো জানতেই হবে মি. সান্ড্রি। একদিনে সে আমাদের বারোজন অতি দক্ষ কমান্ডোকে মেরেছে। তাকে আমাদের পেতেই হবে।’ কলিন ক্রিস্টোফার বলল।
‘আপনাকে তো বলেছি, যেদিন ঘটনা দু’টি ঘটেছে, সেদিনই সে বুজুমবুরায় এসেছে ইউজিজি থেকে। কিন্তু কোথায় থাকে, কি করে কিছুই জানা যায়নি।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘লোকটি রাস্তায় যে মেয়েটিকে কিডন্যাপ থেকে বাঁচাল, তার বাড়িতে সে সন্ধ্যায় গিয়েছিল কেন? পরিবারটির সাথে কি তার সম্পর্ক আছে, না তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাদের বাড়িতে? এসব প্রশ্নের জবাব দরকার।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘সন্ধ্যায় ঘটনা ঘটে, অনেক রাত পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্তৃপক্ষ সে বাড়িতে ছিল, পাঁচ সদস্যের একটা পুলিশ টিম প্রহরায় রেখে তারা চলে যায়। সন্ধ্যার পর থেকেই বাড়িটিতে চোখ রাখার জন্যে আমরা নতুন পাহ- ারা বসাই। লোকটিকে বাইরে যেতে তারা দেখেনি। অবাক ব্যাপার হলো, সকালেই আমাদের লোকরা জানতে পারে, বাড়িতে কেউ নেই।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
রাতেই তারা সরে পড়েছে। নিশ্চয় বাড়ি থেকে বেরুবার কোনো গোপন পথ আছে। তারা কোথায় গেল জানার কি আপনারা চেষ্টা করেছেন। ঐ পরিবারকে পেলে লোকটিকে পাওয়া অনেকখানি সহজ হবে।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘সেদিন থেকেই আমরা চেষ্টা শুরু করেছি। কিন্তু কোনো হদিশ করতে আমরা পারিনি। আমরা একটা খবর পেয়েছি, এই পুরনো পরিবারটির একটা অংশ ইউজিজিতে বাস করে। সেখানে তারা চলে যেতে পারে। ওখানেও আমরা খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করছি।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘ধন্যবাদ। এই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ অফিসেও খোঁজ রাখ। যাকে কিডন্যাপ করা হচ্ছিল, সে মেয়েটাতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা যোগাযোগ রাখবেই। তাছাড়া দুটি কেসের ব্যাপারে পুলিশ তাদের সাথে যোগাযোগ করবে এবং তারাও পুলিশের সাথে যোগাযোগ রাখবে।
‘ঠিক বলেছেন মি. ক্রিস্টোফার। এ দু’টো জায়গার কথা আমাদের মাথায় ছিল না। ধন্যবাদ আপনাকে।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘কিছু উদ্বেগের খবর আছে মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। মূলত এ বিষয়ে আলোচনার জন্যেই এই টেলিফোনটা আমি করেছি।’
একটু থামলো কলিন ক্রিস্টোফার। আবার শুরু করল, ‘বুজুমবুরার ভ্যাটিক্যান দূতাবাস সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, SCA নামের একটা গ্রুপ সেদিনের হত্যাকাণ্ড ও কিডন্যাপের সাথে জড়িত বুজুমবুরা পুলিশ তা জানতে পেরেছে। আর…।’
‘মেড ইন স্টিকারের SCA যে একটা গ্রুপ বা দল এটা পুলিশ ধরতে পেরেছে তাহলে? কি করে ধরল? আমাদের পুলিশ তো এতটা যোগ্য হয়ে উঠেনি!’ বলল বাতিস্তা সান্ড্রি কলিন ক্রিস্টোফারের কথার মাঝখানেই।
‘শুধু এটুকুই নয়, তারা এও জানতে পেরেছে যে, গ্রুপটা ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে খ্রিস্টান।’ কলিন ক্রিস্টোফার বলল।
‘কি বলছেন মি. ক্রিস্টোফার? এটা কি করে সম্ভব? ধরে নিলাম SCA বর্ণ সমষ্টির অর্থ ‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা’ তারা অনুমান করেছেন। এই নামের সাথে খ্রিস্টান বিশ্বাসের সম্পর্ক কি? গ্রুপটি যে খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী তা বলতে পারে তারা কি করে? যে লাশগুলো তারা পেয়েছে, তাদের সাথে ক্রস কিংবা কোনো খ্রিস্টান, চিহ্ন অবশ্যই থাকার কথা নয়।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘আমারও বিস্ময় তো এখানেই। SCA কমান্ডো গ্রুপের লোকরা সবাই পুরানো, উপযুক্ত ট্রেনিং প্রাপ্ত এবং খুবই সাবধানী। এঁরা অনেক অভিযানে অংশ নিয়েছে। আমি নিশ্চিত তাদের দ্বারা কোনো ভুল হয়নি।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘পুলিশের এই জানার বিষয়টা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনার পাওয়া তথ্যে কোনো ভুল নেই তো?’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘না মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। আমার তথ্যে কোনো ভুল নেই। বুজুমবুরার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ভ্যাটিকান দূতাবাসকে রিকুয়েস্ট করেছে বিষয়টির একটু খোঁজ নিতে, মধ্য আফ্রিকার খ্রিস্টান দল ও গ্রুপগুলোর মধ্যে এই নাম কারও আছে কিনা।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘আমাদের পুলিশ এই অসাধ্য সাধন করতে পারে বলে আমি মনে করি না। এমন সব ঘটনার সাথে ‘খ্রিস্টান’ নাম সংশ্লিষ্ট করতে তারা যাবেও না। কারণ আমাদের পুলিশের অধিকাংশই চার্চের এনলিস্টেড খ্রিস্টান। এ ধরনের ঘটনা পেলে তারা ভ্যাটিক্যানকে বলার আগে নিশ্চয় চার্চ কর্তৃপক্ষকে জানাবে।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘আপনার সাথে আমি একমত মি. বাতিস্তা। কিন্তু তাহলে ঘটনার ব্যাখ্যা কি?’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘এটা করিতকর্মা ঐ লোকটার কাজ কিনা? একটা তথ্যের কথা আমার মনে পড়ছে। সেদিন সকাল বেলা আমাদের পাঁচজন লোক নিহত হওয়ার পর, হত্যাকারী লোকটি আমাদের নিহত লোকদের উল্টে-পাল্টে দেখেছে, দূরে দাঁড়ানো আমাদের লোক এটা প্রত্যক্ষ করেছে।’ বাতিস্তা সান্ড্রি বলল।
‘ঠিক বলেছেন মি. বাতিস্তা। হতে পারে এটা। যে লোক এমন অনন্য একজন শুটার, তার আইকিউ অনন্য হবে তা বলা যায়। এই লোকটিকে তাহলে হাতে পাওয়া আরও জরুরি হয়ে উঠল মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘অবশ্যই মি. কলিন ক্রিস্টোফার। কিন্তু সমস্যা হলো, যার চাল-চুলা নেই, এমন কি যার চেহারাও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়, তাকে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়।’ বাতিস্তা সান্ড্রি কথা বলার মধ্যেই পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর স্টিফেন ফোবিয়ান তার চেয়ার থেকে উঠে এসে বাতিস্তা সান্ড্রির পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং অনুচ্চ স্বরে বলল, ‘আমি মি. ক্রিস্টোফারের সাথে একটু কথা বলতে চাই।’
‘নিজের কথা শেষ করার সাথে সাথেই বাতিস্তা সান্ড্রি বলে উঠল, ‘মি. ক্রিস্টোফার মি. স্টিফেন ফোবিয়ান আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান।’
‘ওয়েলকাম। তাকে দিন।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘গুড ইভেনিং মি. কলিন ক্রিস্টোফার। কেমন আছেন?’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘যিশু ভালো রেখেছেন। কিন্তু শান্তির জায়গা বুজুমবুরায় দেখছি আমরা বিরাট সমস্যায় পড়লাম।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘মি. ক্রিস্টোফার, মাত্র একজন ব্যক্তি সব ওলটপালট করে দিয়েছে, পুলিশকে জাগিয়ে তুলেছে। বুজুমবুরার প্রতিটি পুলিশ ইউনিট খুব সক্রিয় হয়ে উঠেছে।’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘তা উঠারই কথা। আমি বুজুমবুরার ভ্যাটিকান দূতাবাসের সাথে কথা কলেছি। দেখলাম, তারাও আতংকিত। সন্ত্রাসীরা এবং এই সন্ত্রাসীদের যে হত্যা করেছে দুই পক্ষই তাদের ভীত উদ্বিগ্ন করে তুলেছে, নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মাত্র একজন লোক আক্রমণকারী দুই সন্ত্রাসী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দিল, অসাধারণ সে লোকটি কে হতে পারে? অন্যদিকে সন্ত্রাসীদের খ্রিস্টান পরিচয় সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
স্টিফেন ফোবিয়ানের মুখে সূক্ষ্ম একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল বলল, ‘মি. কলিন ক্রিস্টোফার সরকার তো উদ্বিগ্ন হবেই। কিন্তু আমরা কতটা উদ্বিগ্ন হবো, সেই কথা বলুন।’
‘আমরা উদ্বিগ্ন হবো কেন, আমরা সতর্ক হবো। বাতাস মানুষের জন্যে এবং পানি মাছের জন্যে যেমন জীবনদায়িনী, তেমনি আমাদের কাজ আমাদের জীবনধারণ ও জীবন বিকাশের জন্যে।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘আমি আপনার সাথে একমত। কিন্তু আপনি তো সতর্ক হওয়ার কথা বললেন। তাহলে আমরা কি আমাদের পথ পরিষ্কারের জন্যে যে নির্মূল প্রোগ্রাম চালাচ্ছি সেটা কি আপাতত স্থগিত রাখবো?’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘কার ভয়ে? সরকারের ভয়ে? সরকারকে আমরা গণনার মধ্যেই ধরি না। আমাদের স্বার্থের বাইরে এক ইঞ্চি যাবার ক্ষমতা সরকারের নেই আমরা শুধু আমাদের কাজের গোপনীয়তা প্রকাশের ভয় করি। আমরা চাই না আমাদের কাজ নিয়ে কেউ হইচই করার সুযোগ পাক। হইচই জানাজানি হলেই আমরা বিপদে পড়ব। যেমন পড়েছিলাম ক্যামেরুনসহ মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকায়। আহমদ মুসা যে সর্বনাশ করেছিল তার ক্ষতিপূরণ কোনোদিন হবে বলে মনে হয় না।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘আহমদ মুসা লোকটির কথা আমিও অনেক বার শুনেছি। সে নাকি অলৌকিক শক্তির অধিকারী। সে যেখানে যায়, সৌভাগ্যও তার সাথে সেখানে যায়। আমাদের ইস্ট আফ্রিকায় তো সে কোনো ঝামেলা পাকাবে না?’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘সে আসার মতো পরিস্থিতি এই অঞ্চলে নেই। তবু সাবধানের মার নেই। যে লোক আমাদের ১২ জন লোক মারল, তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে সামনে আনতে হলে আমাদের প্রোগ্রামের কাজ বাড়াতে হবে সে চুপ করে বসে থাকার লোক নিশ্চয় নয়। কাজ বাড়লে আমাদের কাজই তাকে টেনে আমাদের সামনে নিয়ে আসবে। সুতরাং কাজ বাড়ান মি. স্টিফেন ফোবিয়ান। বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
‘ধন্যবাদ মি. কলিন ক্রিস্টোফার। এটাই ছিল আমার বিষয়। আপনি যা বলেছেন তার সাথে আমরা একমত। কিন্তু এর জন্যে প্রয়োজন হবে উপযুক্ত জনবলের। আপনি নিশ্চয় এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছেন।’ স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘হ্যাঁ মি. স্টিফেন ফোবিয়ান শীর্ষ পর্যায়ের ১২ জন কমান্ডোকে আমরা হারিয়েছি। দু’একদিনের মধ্যেই আরও ট্রেইন্ড, আরও চৌকশ একটা দলকে আমি বুজুমবুরায় পাঠাচ্ছি। চিন্তা করবেন না আপনারা, আমাদের লোকবলের অভাব নেই।
‘ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ। আমি মোবাইলটা মি. বাতিস্তা সান্ড্রিকে দিচ্ছি মি. কলিন ক্রিস্টোফার। স্টিফেন ফোবিয়ান বলল।
‘ওয়েলকাম মি. স্টিফেন ফোবিয়ান। যিশু সেভ আস।’ বলল কলিন ক্রিস্টোফার।
.
বাস থেকে নেমে আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো রাস্তার বাম পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটছিল। পোশাকে-আশাকে চাওসিকোকে অন্য দিনের চেয়ে বেশ ফরমাল বলে মনে হচ্ছে। হাল্কা নীল ফুলপ্যান্টের উপর হাল্কা নীল কোট, ভেতরে সাদা শার্ট পরেছে। কেডসের বদলে পরেছে সু। সামনে তাকিয়ে হাঁটছিল সে।
তার পাশে একটা গাড়ি দাঁড়াবার শব্দ পেল। তাকাল চাওসিকো সেদিকে। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আনা আরিয়াকে হাত নাড়তে দেখল। আনা আরিয়া গাড়ি থেকে নেমে ইব্রাহিক চাওসিকোর পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘সালাম আলায় কুম। আমি আন্টির বাড়ি থেকে আসছি। আপনি…’
‘হঠাৎ সালাম আলায় কুম কেন?’ আনা আরিয়ার কথার মাঝখানেই বলে উঠল চাওসিকো।
‘হঠাৎ হবে কেন? আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে মুসলমানদের পারস্পরিক দেখা হওয়ার সময়কার সম্বোধন বের করেছি এবং মুখস্থও করেছি। আপনার সাথে দেখা না হওয়ায় তা ব্যবহার করার সুযোগ হয়নি। বলুন উচ্চারণ ঠিক হয়েছে কিনা?’ বলল আনা আরিয়া।
কথা শেষ করে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরছি। আপনিও তো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন?’
‘হ্যাঁ।’ বলল চাওসিকো।
‘তাহলে আসুন।’ বলে আনা আরিয়া এগোলো গাড়ির দিকে। চোখে-মুখে চাওসিকোর একটা বিব্রত ভাব প্রকাশ পেল। একটু ইতস্তত করে এগোলো গাড়ির দিকে।
আনা আরিয়া তার ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটের দরজা খুলে ডাকল চাওসিকোকে সেদিকে।
চাওসিকো দাঁড়িয়ে পড়ল। আনা আরিয়ার পাশের সিটে বসতে তার মন চাইল না। একটু দ্বিধা করতে লাগল।
মুখে হাসি ফুটে উঠল আনা আরিয়ার। বলল, ‘অসুবিধা নেই। আমার দিকে নয়, সামনের দিকেই তাকিয়ে থাকবেন।’
‘মিস আনা আরিয়া, কাউকে দেখা, কারও দিকে তাকানো থেকে বিরত থাকাকেই শুধু নিষেধ করা হয়নি, আরও কিছু আছে।’ ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসতে বসতে বলল চাওসিকো।
‘হ্যাঁ, সেদিনের আলোচনা তো মুলতবি আছে। এই ‘আরও কিছু তো সেখানে অবশ্যই আসবে। আচ্ছা বলুন তো, সেই ঘনিষ্ঠজন কারা, যারা ছাড়া অন্য কারও সাথে খোলামেলা দেখা সাক্ষাত ও মেলামেশা করা যাবে না?’ আনা আরিয়া বলল।
‘স্ত্রী বাদে অন্যেরা হলো মা, মেয়ে বোন ফুফু, খালা, ভাতিজী, ভাগ্নী, দুধমা, দুধবোন, শাশুড়ি, স্ত্রীর অন্যপক্ষের মেয়ে, ছেলের স্ত্রী, অধিকার ভুক্ত ক্রীতদাসী। আরো একটা তালিকা দিয়েছে আমাদের ধর্মগ্রন্থ। সেই তালিকায় যারা আছে, তারা ছাড়া অন্য পুরুষের সামনে মেয়েরা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে পারবে না।’ বলল ইব্রাহিম চাওসিকো।
‘সৌন্দর্য কি?’ আনা আরিয়া বলল।
‘স্বাভাবিকভাবে যা প্রকাশ হয় যেমন মুখ, হাতের কব্জি পর্যন্ত ও পায়ের টাকনুর নিচের অংশ ছাড়া নারীর অন্যসব অংগই তার সৌন্দর্যের অধীন।’ বলল চাওসিকো।
‘ও গড, এতো একদম প্যাকেট হয়ে যাবার মতো! খুব ভারি ব্যাপার।’ আনা আরিয়া বলল।
‘কারও জন্যে ভারি, কারও জন্যে আনন্দের। এটা মানসিক ব্যাপার।’ বলল চাওসিকো।
‘ব্যাপারটা ভালো মানসিকতার অথবা খারাপ মানসিকতার, তাই কি?’ আনা আরিয়া বলল। তার দৃষ্টি সামনে, ঠোঁটে হাসি।
‘মানসিকতা খারাপ কিংবা ভাল বিষয়টা ঠিক তা নয়। মানসিকতা আসে বিশ্বাস থেকে এবং অনুশীলিত সংস্কৃতি থেকে।’ বলল চাওসিকো।
‘একজন ইসলামী বিশ্বাসের অনুসারী হলেই কি তার এ ধরনের পোশাক ভালো লেগে যাবে?’ আনা আরিয়া বলল।
‘শুধু মুসলিম কেন, অন্য ধর্মের অনেক মেয়ে নিজস্ব ভালো-মন্দের বিশ্বাস থেকে শরীর ঢেকে রাখার মতো পোশাক পরে থাকে। এখানে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের ব্যাপারটাই মুখ্য।’ বলল চাওসিকো।
‘ইসলাম নিশ্চয় এই বিবেচনাতেই মেয়েদের সৌন্দর্য ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করেছে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘ইসলামের সকল আইনই মানুষের কল্যাণ, মানুষের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। ইসলামের বিশ্বাস, আইন-কানুন, বিধি-বিধান, আদেশ-নিষেধ সবই মানুষের মুক্তি ও মঙ্গলের জন্যে। এ সবের কোনোটাই স্রষ্টা আল্লাহর প্রয়োজনে নয়, এসব থেকে আল্লাহর কোনো উপকারও হয় না। বলল চাওসিকো।
আনা আরিয়ার চোখে-মুখে বিস্ময়। সে মুখ ঘুরিয়ে তাকল চাওসিকোর দিকে। বলল, ‘একটা বড় কথা বলেছেন। ধর্ম মানুষের জন্যে, এর সকল বিধি-বিধান মানুষের মঙ্গলের জন্যে। স্রষ্টা বা আল্লাহর এতে কোনো লাভ-ক্ষতি নেই। এ থেকে একটা প্রশ্ন আমার মনে আসছে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির মতো এ বিশাল বিশাল কর্মযজ্ঞ স্রষ্টা তাহলে কেন করলেন? এই পৃথিবী সৃষ্টি করলেন, এই পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করলেন, জীব-জন্তু সৃষ্টি করলেন, গাছ-পালা পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা-সমুদ্র সৃষ্টি করলেন, সৃষ্টি করলেন বাতাস, পানি, আবহাওয়া, শুধু তাই নয়, সৃষ্টি করলেন ভাসমান পৃথিবীকে তার কক্ষপথে সুরক্ষার জন্যে সূর্যকে মধ্যমণি করে বিশাল সৌরজগত, সৌরজগতকে রক্ষার জন্যে সৃষ্টি করলেন লক্ষ কোটি সূর্য বা তারকা নিয়ে গ্যালাক্সি বা তারকা-পুঞ্জ আবার এ গ্যালাক্সির সুরক্ষার জন্যে সৃষ্টি করলেন লক্ষ কোটি গ্যালাক্সি নিয়ে সৃষ্টি করলেন মহাবিশ্ব, যা এখন পর্যন্ত জানা চৌদ্দ বিলিয়ন আলোকবর্ষ ব্যাসের মহাবিশ্ব যার প্রতি স্থানের ভর ও ভারসাম্য বিস্ময়করভাবে একই রকম। এই মহা, মহা কর্মযজ্ঞ স্রষ্টা আল্লাহ সৃষ্টি করলেন শুধু মানুষের জন্যে। কেন এটা, কেন?’
কথা শেষ করল আনা আরিয়া। আবেগে তার মুখ ভারি হয়ে উঠেছে এবং তার সাদা মুখটা হয়ে উঠেছে লাল।
আবেগের স্পর্শ চাওসিকোর চোখে-মুখেও। বলল সে, ‘হতে পারে আনা আরিয়া মানব সৃষ্টি রাব্বুল আলামিন আল্লাহর প্রিয়তম প্রজেক্ট। তিনি তার বান্দাহ মানুষকে অপরিসীম ভালোবাসেন। তার প্রেরিত বাণী বুক অব গাইডেন্স আল কুরআন জুড়ে তার একত্বের বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার পরে মানুষকে তার ভালোবাসার দিকটাই মুখ্য। যত আদেশ-নিষেধ, বিধি- বিধান, তিনি দিয়েছেন সব মানুষকে ভালোবেসেই এবং তিনি পথভ্রষ্ট বিদ্রোহী মানুষদের শাস্তির বিধান তুলে ধরে বারবার যে তাদের সতর্ক করেছেন, সেটাও মানুষকে ভালোবেসেই। আল্লাহর মহা-সৃষ্টিতে মানুষই কেন্দ্রবিন্দু, তাকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টির আবর্তন, মানুষের শেষ থেকেই শেষ এ পৃথিবীর, সমাপ্তি এই মহাবিশ্বেরও। তারপর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সৃষ্টি করবেন নতুন পৃথিবী, নতুন আকাশ, বেহেস্ত-দোযখ সমন্বিত নতুন ব্যবস্থাপনা। সেটাও মানুষেরই জন্যে’ বলল চাওসিকো।
‘ওয়ান্ডারফুল মি. চাওসিকো। আপনার এ কথাগুলো আবারও শুনতে ইচ্ছা করছে। মানুষকে যে আপনি কত বড় করেছেন! এমনটা কখনও কেউ…।’
‘এই ‘বড় মানুষ’-এর স্রষ্টা, প্রতিপালক, প্রত্যাবর্তন স্থল যিনি সেই আল্লাহ কত যে বড়, তা আমাদের চিন্তা, জ্ঞানের আয়ত্ত্বাধীন নয়।’ বলল চাওসিকো আনা আরিয়ার কথার মাঝখানেই।
আনা আরিয়ার মুখ এখনও আবেগে আরক্ত। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ধন্যবাদ মি. চাওসিকো। সত্যি আমার খুব ভালো লাগছে। চিন্তার নতুন দিগন্ত মনে হচ্ছে আমার কাছে খুলে গেছে। মানব সৃষ্টিকে স্রষ্টা আল্লাহর প্রিয়তম প্রজেক্ট বলেছেন। প্রজেক্ট বলতে আমরা একটা পরিকল্পনা, তার বাস্তবায়ন এবং একটা ফল লাভকে বুঝি। স্রষ্টার এই প্রজেক্টটা কি?’
‘সেটা হলো স্রষ্টার মানব সৃষ্টি।’ বলল চাওসিকো।
‘মানুষ তো দুনিয়ার অন্যান্য সৃষ্টির মতোই সৃষ্টি, তাহলে মানব সৃষ্টি আলাদাভাবে প্রজেক্ট হলো কি করে?’ আনা আরিয়া বলল।
দুনিয়ার অন্যান্য সৃষ্টি মানব সৃষ্টির সাথেই সংশ্লিষ্ট। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন বলেই মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজন পূরণের জন্যে সৃষ্টি করেছেন পশু-পাখি, পাহাড়-নদী-সুমদ্র, ফসল, ফল-ফলাদী, গাছ-পালা, মেঘ-বৃষ্টি, আলো-বাতাস, খনিজ দ্রব্য, চন্দ্র-সূর্য, বিশ্ব-মহাবিশ্ব সবকিছু। এ সব কিছুই মহামহিম আল্লাহর মানব প্রজেক্টকে সহায়তা করার জন্যে।’ বলল চাওসিকো।
‘ধন্যবাদ চাওসিকো। কিন্তু প্রকল্পের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, ফলাফলের বিষয়টাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?’ আনা আরিয়া বলল।
‘পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু কি বলার দরকার আছে? শ্রেষ্ঠতম জীব হিসেবে বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন এবং স্বাধীন কর্মউপযোগী মানুষের সৃষ্টি,
পৃথিবীকে মানুষের জীবনধারণ ও বসবাসের উপযোগী করা, মানুষের খাদ্য ও ব্যবহারের জন্যে প্রয়োজনীয় সকল উপকরণের সৃষ্টি, সময় ও সভ্যতার পরিবর্তন-উন্নয়নে নতুন নতুন উপকরণ সৃষ্টির ধারা অব্যাহত রাখা, এসবই তো স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহর মানুষ সৃষ্টির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ফল। বলল চাওসিকো।
‘অনেক ধন্যবাদ মি. চাওসিকো। খুব কঠিন, জটিল এবং জগৎজোড়া একটা বিষয়কে খুব সহজ ও সংক্ষেপ করে দিয়েছেন আপনি৷ কিন্তু ফলাফলের বিষয়টা আপনি বলেননি। এক মানব সৃষ্টির জন্যে আল্লাহ এত বিশাল-বিশাল আয়োজন কেন করেছেন? তিনি কি পেয়েছেন?’ আনা আরিয়া বলল।
‘আল্লাহ কিছু পাবেন কেন? কিছু তো তিনি চান না। কিছু পাবার জন্যে, কিছু চাইবার জন্যে তিনি মানুষ সৃষ্টি করেননি। তিনি সকল প্রকার প্রয়োজন ও অভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, সকল অপূর্ণতা ও অসম্পূর্ণতা থেকে পবিত্র তিনি, কোনো মুখাপেক্ষিতা তাঁর নেই। আর স্রষ্টাকে কিছু দেবার ক্ষমতা তাঁর সৃষ্ট মানুষের কোত্থেকে আসবে? আল্লাহ তার ইচ্ছায় মানুষ সৃষ্টি করেছেন মানুষকে পরীক্ষার জন্যে। একদিকে আল্লাহ মানুষকে তার সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অবয়বে সৃষ্টি করেছেন, পৃথিবীতে তাকে একটা সীমিত জীবন দিয়েছেন। এই জীবনকালে তার সকল প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তার এই জীবনকে সুখী-সুন্দর করার জন্যে পিতা, মাতা, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে একটা সংসার দিয়েছেন। এই সাথে আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের সুস্পষ্ট জ্ঞান এবং তিনি দিয়েছেন মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি। এইভাবে হাজারো নিয়ামত ও স্বাধীন সিদ্ধান্তের ক্ষমতা মানুষকে দিয়ে তাদের চলার জন্যে তাদের জীবন-পথ হিসেবে সামনে রেখেছেন সত্যপথ ও পথভ্রষ্টতা। নবী-রাসুলদের মাধ্যমে আসা সত্যপথ হলো আল্লাহর পথ। আর পথভ্রষ্টতা শয়তানের পথ। আল্লাহ চান, মানুষ তার বিবেক-বুদ্ধির অনুসরণে নবী-রাসুলদের মাধ্যমে আসা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে আল্লাহর পথে চলুক, শয়তানের কুমন্ত্রণার ফল পথভ্রষ্টতা তারা পরিহার করুক। এই সাথে আল্লাহ বলে দিয়েছেন, মানুষ যদি আল্লাহর পথে চলে, তাহলে দুনিয়ার সীমিত জীবন শেষে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে সে অনন্ত সুখের জান্নাত লাভ করবে, আর যদি শয়তানের পথে চলে তাহলে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে তাকে অনন্ত শাস্তির জাহান্নামে গিয়ে পড়তে হবে। এখন মানুষ কোন্ পথ বেছে নেবে, কোন্ পথে চলবে, সেটাই এই দুনিয়াতে আল্লাহর পরীক্ষার বিষয়। রাব্বুল আলামিন আল্লাহর একক ও অনন্য মানব প্রজেক্টের এটাই লক্ষ্য। মানুষ কোন্ পথে চলে কোন্ পরিণতি লাভ করে, সেটাই এই প্রজেক্টের ফল।’ চাওসিকো তার দীর্ঘ কথা শেষ করল।
কোনো কথা এলো না আনা আরিয়ার দিক থেকে। তার মুখ গম্ভীর। আনা আরিয়াই নীরবতা ভাঙল। বলল, ‘কথাগুলো না শুনলেই ভালো ছিল। এখন ভয় করছে। আমি আনা আরিয়া একজন মানুষ। মানুষ হিসেবে আল্লাহর প্রজেক্টের অংশ আমি। প্রজেক্টের বাস্তবায়ন পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু ফলের ব্যাপারটাই ভয় ধরিয়ে দিল। আল্লাহর পথে না চললে অনন্ত শাস্তির জাহান্নামে যেতে হবে। এতো ভয়াবহ এক সতর্কবাণী। এ সতর্কবাণী তো আমার জন্যেও। তাহলে আমি কি করব? আল্লাহর পথ কোনটি? আমার খ্রিস্টধর্ম কি আল্লাহর পথ নয়? এটাই আমার কাছে এখন বড় প্রশ্ন চাওসিকো।’ শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠ আনা আরিয়ার। যেন হৃদয়ের কোন্ অতল থেকে বেরিয়ে এলো কথাগুলো।
হৃদয়ের একান্ত ছোঁয়া নিয়ে বেরিয়ে আসা আনা আরিয়ার কথা চাওসিকোর হৃদয়কেও গভীরভাবে স্পর্শ করল। সংগে সংগে কথা তারও মুখে এলো না। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আনা, এ এক ভয়াবহ সতর্কবাণী আল্লাহর তরফ থেকে। আর এই সতর্কবাণী তিনি কুরআন মজিদে একবার নয়, বার বার করেছেন। এ ছাড়াও আল্লাহ শতবার শত রকমে মানুষকে বুঝিয়েছেন শয়তানের পথে চললে তার সীমাহীন কষ্টদায়ক পরিণতির কথা।
একটু থামল চাওসিকো। আবার শুরু করল তার কথা, ‘আল্লাহর পথ কোটি, আপনার এ প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ। আল্লাহর…।’
চাওসিকোর কথার মাঝখানেই আনা আরিয়া বলে উঠল, ‘আপনি আমাকে ‘আনা’: ডাকলেন, আবার ‘আপনি’ হলাম কেন?’ বলল আনা আরিয়া। তার মুখ জুড়ে লজ্জার লাল আভা।
চাওসিকোর মুখে কিছুটা বিব্রত ভাব ফুটে উঠল। বলল, হঠাৎই বলে ফেলেছি। কিন্তু আপনিও তো আমাকে ‘চাওসিকো’ ডেকে আবার ‘আপনি’ বলেছেন।’
‘প্রত্যাহার করলাম, আর ‘আপনি’ বলব না।’
মুহূর্তের জন্যে থেমেই আবার বলল আনা আরিয়া, ‘গুরুত্বপূর্ণ কথার মাঝখানে কথা বলার জন্যে দুঃখিত। আবার শুরু করার জন্যে কি অনুরোধ করতে পারি?’
‘ধন্যবাদ। তোমার প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ বলেছি। তার কারণ, সব মানুষের পিতা আদম (আ.)। আর আদম (আ.) থেকে আজ পর্যন্ত আল্লাহর পথ একটিই এবং তা চিনে নেয়া খুব সহজ। সব নবী-রাসুল যেমন হযরত আদম (আ.), নূহ (আ.), ইব্রাহিম (আ.), মুসা (আ.), ঈসা (আ.) বা যিশু এবং মুহাম্মদ (স.) সবাই আল্লাহর এক পথের কথাই প্রচার করেছেন। সবারই এক আহ্বান ছিল, আল্লাহ এক, তার কোনো শরিক নেই। শুধু তারই ইবাদত করতে হবে, শুধু তারই আদেশ নিষেধ মানতে হবে। মাত্র…।’
চাওসিকোর কথার মাঝখানেই আনা আরিয়া বলে উঠল, ‘আমি যিশুর ধর্ম পালন করি, তাহলে আল্লাহর পথের উপরই তো আমি আছি।’
‘ঈসা (আ.) বা যিশু প্রচারিত ধর্ম আল্লাহর পথ ছিল, কিন্তু এখন নেই। কারণ যিশুর পর আল্লাহ তায়ালা আরেকজন রাসুল প্রেরণ করেছেন। এখন এই রাসুল (সা.)-এর দেখানো পথ অনুসরণ করলেই আল্লাহর পথে চলা হবে।’ বলল চাওসিকো।
‘কেন, তাদের সকলের পথ একই পথ, আল্লাহর পথ- তুমিই তো বললে?’ আনা আরিয়া বলল।
‘একই পথ হলেও, ধর্মের মূল কথা ঠিক থাকলেও এক নবীর পর যখন আরেকজন নবী এসেছেন, তখন তার মাধ্যমে নতুন আদেশ-নিষেধ, নতুন জীবনাচরণ পাঠানো হয়েছে মানুষের জন্যে। আগের নবীর আইন-কানুন, বিধিবিধান তার ফলে সব বাতিল হয়েছে এবং তার স্থলে নতুন নবীর আইন কানুন, বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন যিশু আসার পর মুসার (আ.) শরিয়ত (আইন-কানুন, বিধিবিধান) বাতিল হয়েছিল, ঠিক তেমনি নবী মুহাম্মদ (সা.) আসার পর ইসা (আ.) বা যিশুর শরিয়ত বাতিল হয়ে গেছে ব্যাপারটাকে তুমি সংবিধান সংশোধনের সাথে তুলনা করতে পার। সংবিধান যখন সংশোধন হয়, সংশোধিত সংবিধানই সকলকে মানতে হয়। আগের সংবিধান কেউ মানে না, মানলে তা অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়। বলল চাওসিকো।
সংগে সংগে কথা বলল না আনা আরয়া। তার চোখে-মুখে বিস্ময় ও ভাবনার চিহ্ন। একটুক্ষণ পর বলল সে, ‘এই সহজ কথাটা খ্রিস্ট ধর্ম, ইহুদি ধর্মের কোটি কোটি লোক মানছে না কেন, বুঝছে না কেন?
‘এটা মানুষের বিপজ্জনক একটা প্রবণতা। নিজের ধর্ম, নিজের বিশ্বাস, নিজের দেশ, নিজের জাতি এবং সবশেষে খোদ নিজেকে সবার চেয়ে ভালো, সবার চেয়ে বড় করে দেখা মানুষের অত্যন্ত ক্ষতিকর একটা ইগো। অতীতে এটাই ঘটেছে, এখনও সেটাই ঘটছে। মুসা (আ.)-এর পর যখন ঈসা (আ.) বা যিশু আসলেন, তখন মুসা (আ.)-এর অনুসারীরা যিশুকে মানেনি, বরং তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে, যিশুর অনুসারীদের উপর অকথ্য নির্যাতন করেছে। অনুরূপভাবে যিশুর পর নবী মুহম্মদ (সা.) আসলে যিশুর অনুসারীরা তাকে মানছে না। শুধু মানছে না তা নয়, শুরু থেকে তারা মুসলমানদের ধ্বংসের চেষ্টা করেছে, ৭টা ক্রসেড চাপিয়ে দিয়েছে মুসলমানদের উপর গোটা ইউরোপ এক হয়ে। বিভিন্ন নামে, বিভি- ন্ন রূপে সে লড়াই এখনও চলছে।’ বলল চাওসিকো।
চুপ হয়ে গিয়েছিল আনা আরিয়া। ভাবছিল সে। এক সময় বলল, ‘তাহলে আল্লাহর পথের প্রতিষ্ঠা কীভাবে সম্ভব? এ লড়াই কি থামবে? আল্লাহ তো থামাতে পারেন, তিনি সর্বশক্তিমান।’
‘কিন্তু আল্লাহ থামাবেন না, যদি মানুষ না থামায়। তিনিই যদি থামান, তাহলে মানুষের পরীক্ষা হবে কেমন করে? পরীক্ষার হলে প্রশ্নের উত্তর যদি স্যার বলে দেন, তাহলে পরীক্ষা হবে কেমন করে? আল্লাহর পথ নিয়ে মানুষ কি করছে, কি করবে, এটাই আল্লাহর পরীক্ষা। তিনি পথ দেখিয়েছেন, সে পথে চললে কি হবে, না চললে কি হবে তা তিনি বিশদভাবে মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, মানুষকে ভালো-মন্দ চেনার জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। সত্য- মিথ্যা বাছাইয়ের ক্ষমতা দিয়েছেন, এখন মানুষের দায়িত্ব, আল্লাহর দেয়া জীবন এবং তাঁর দেয়া হাজারো দান-দয়া-অনুগ্রহে কৃতজ্ঞ হয়ে সে আল্লাহর পথে চলবে, না আদি থেকে মানুষের শত্রু শয়তানের পথে চলবে, সেটা নিজে বাছাই করে নেয়া। বলল চাওসিকো।
চাওসিকো থামলেও নীরব আনা আরিয়া। তার স্থির দৃষ্টি সামনে। ভারি হয়ে উঠেছে তার চোখ-মুখ। তার রক্তাভ ঠোঁটে সূক্ষ্ম একটা কম্পন! তার হৃদয়ের কোনো অস্থিরতার প্রকাশ কি এটা? চলছে গাড়ি। প্রবেশ করল গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
ভাইস-চ্যান্সেলর স্টিফেন ফোবিয়ানের বাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কেন্দ্র প্রশাসনিক ভবন, লাইব্রেরি বিল্ডিং পার হয়ে আরও পশ্চিমে।
আনা আরিয়া গাড়ি থামাল লাইব্রেরি বিল্ডিং-এর গেটে। গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির সামনের দিকটা ঘুরে এসে চাওসিকোর পাশের দরজা খুলে দাঁড়াল আনা আরিয়া। গাড়ি থেকে নামল চাওসিকো।
‘চাওসিকো তুমি লাইব্রেরিতে বসো। আমি ঠিক সাড়ে নয়টায় আসব। আমি তোমাকে কনভেনশন হলে নিয়ে যাব। আপত্তি নেই তো?’ বলল আনা আরিয়া। তার ঠোঁটে এক টুকরো ম্লান হাসি।
‘আমি তো আপত্তি করিনি।’ চাওসিকো বলল।
‘ধন্যবাদ চাওসিকো। তাহলে আসি।’
বলে গাড়ির দিকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল আনা আরিয়া যাওয়ার জন্যে। কিন্তু থমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল চাওসিকোর দিকে। তার গম্ভীর মুখ। বলল, ‘চাওসিকো তোমার আল্লাহকে আমার পক্ষে বোলো তিনি যেন দয়া করে আমার হৃদয়কে শান্ত করে দেন, স্থির করে দেন।’
‘আল্লাহ তো শুধু আমার নয়, তোমারও। তোমার ঘাড়ের যে শাহরগ আছে তার চেয়েও আল্লাহ তোমার বেশি কাছে। তুমি তাঁর সাথে কথা বলো। তোমার সব তিনি জানেন। বান্দার সরাসরি কথা তিনি পছন্দ করেন।’
আনা আরিয়া মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজল। ঠোঁট তার কাঁপছিল ভেতরের কোনো এক উচ্ছ্বাস রোধ করতে গিয়ে। বলল সে, ‘ধন্যবাদ চাওসিকো।’ দুই শব্দের এই কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ ভেঙে পড়ল প্রবল এক উচ্ছ্বাসে। ঘুরে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি সে গাড়িতে উঠল।
লাইব্রেরি বিল্ডিং অতিক্রম করে ছুটে চলল আনা আরিয়ার গাড়ি।
বিস্মিত, বিব্রত চাওসিকো।
তার মন স্বগতই বলে উঠল, ‘খুব বুদ্ধিমান, খুব সরল, খুব ভালো মেয়ে আনা আরিয়া। হে আমার কারিবুম মুজিব আল্লাহ, তাকে দয়া করুন। তার ডাকে দয়া করে সাড়া দিন?’
হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল চাওসিকো। সকাল সাড়ে আটটা বাজে আজ সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশন হলে জগৎবিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী অ্যাডাম আলেস্কিস ইডেলম্যান বক্তৃতা দেবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে। মি. অ্যাডাম ইডেলম্যান ট্রিপল নোবেল প্রাইজ উইনার, দুইটি পদার্থ বিজ্ঞানে, একটি কেমিস্ট্রিতে। আফ্রিকা মহাদেশে মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। তার একটি হলো পোপ ভিক্টর, ইউনিভার্সিটি। অনেকদিন ধরে আয়োজন চলছে এই প্রোগ্রামের। বিজ্ঞানের বিশেষ করে পদার্থ ও রসায়ন বিভাগের ছাত্রদের আকর্ষণ এই প্রোগ্রামের প্রতি বেশি। এজন্যে শিক্ষক ও এই দুই বিভাগের ছাত্রদের কনভেনশন হলের প্রোগ্রামে ডাকা হয়েছে। অন্যান্য ছাত্র ও শ্রোতাদের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে বড় স্ক্রিনের মাধ্যেমে প্রোগ্রাম দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কনভেনশন হলের প্রোগ্রামের জন্যেই সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে চাওসিকো। আনা আরিয়ার গাড়ি চলে যাবার পর চাওসিকো ঘুরে দাঁড়িয়ে লাইব্রেরির দিকে পা পাড়াল।
.
দশটা বাজার আগেই কানায় কানায় ভর্তি হয়ে গেল কনভেনশন হল। পৌনে দশটায় আনা আরিয়া ও চাওসিকো গাড়ি থেকে নামে। কনভেনশন হলের দিকে এগুতে এগুতে বলল আনা আরিয়া, ‘চাওসিকো তুমি হলে গিয়ে বসো। আমি দেখি বাবা কোথায়। বাবা আমাকে তাঁর সাথে বসতে বলেছেন।
‘ঠিক আছে আনা। লিফট দেবার জন্যে ধন্যবাদ তোমাকে।’ বলল চাওসিকো।
আনা আরিয়া ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। থমকে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে ডেকে গাড়িতে তুলেছি। সুতরাং লিফট দেবার সুযোগ দেয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।’ আনা আরিয়ার মুখে হাসি।
চোখ নিচু করে দাঁড়ানো চাওসিকোর ঠোঁটেও এক টুকরো হাসি। বলল, ‘দুই ধন্যবাদ ইজ ইকুয়াল টু প্লাস ওয়ান প্লাস ওয়ান। দুজনেই সমান, দুজনেই বিজয়ী।’
‘দেখ তোমার ইকুয়েশন কিন্তু আমার মুখে আরেকটা কথা এনে দিয়েছে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘কি কথা?’ জিজ্ঞাসা চাওসিকোর
‘আজ নয়, আরেকদিনের জন্যে থাকল। আসি, সালাম।’
বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করল আনা আরিয়া।
চাওসিকো কনভেনশন হলে ঢুকে গেল।
সামনের কিছু সিট বাদে হল কানায় কানায় ভর্তি। হলের সামনের প্রায় অর্ধেকটা রিজার্ভ রাখা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের বাছাই করা কিছু বিজ্ঞান শিক্ষকের জন্যে। এর মধ্যে দু’দশটা সিট রয়েছে শহরের বিশেষ গণ্যমান্যদের জন্যে বরাদ্দ। আর হলের বাকি অর্ধেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ ও রসায়ন বিভাগের ছাত্রদের জন্যে। উপরের ব্যালকনিতে জায়গা দেয়া হয়েছে শহরের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ ও রসায়ন বিভাগের ছাত্রদের।
চাওসিকো তাদের জন্যে বরাদ্দকৃত জায়গায় গিয়ে বসল।
চাওসিকোর হাতে সুন্দর একটা নোট বুক।
ঠিক নয়টা পঞ্চান্ন মিনিটে অতিথি পদার্থ বিজ্ঞানী অড্যাম আলেক্সিস ইডেলম্যানকে নিয়ে ভাইস-চ্যান্সেলর এবং কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক মঞ্চে প্রবেশ করল।
মঞ্চের লাউড স্পিকারে ঘোষণা হলো।
সভাপতির আসনে বসল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান। এবং অতিথির আসনে বসল পদার্থ বিজ্ঞানী ইডেলম্যান। মঞ্চ থেকে সিনিয়র শিক্ষকরা নেমে এসে দর্শকের সারিতে তাদের আসনে বসল। এই শিক্ষকরা বসার আগে মাঝ বয়সী একজন সুবেশধারী মহিলার সাথে আনা আরিয়া এসে সামনের সারিতে সেই মহি- লার পাশে বসল।
‘বিস্মিত হলো চাওসিকো। আনা আরিয়ার এত সম্মান কেন? মহিলা কি আনার মা? মহিলা কে? কিন্তু আনা তো বলেছিল সে তার পিতার সাথে বসবে। তার পিতা কোথায়?
চাওসিকোর চিন্তা আর এগুতে পারল না। মঞ্চের মাইক্রোফোন কথা বলে উঠল। অনুষ্ঠান শুরু হলো।
সূচনা বক্তব্যের পর পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সবচেয়ে প্রবীণ অধ্যাপক প্রফেসর অলিভার ইউজিন এলভিস নোবেল বিজ্ঞানী পদার্থবিদ অ্যাডাম আলেক্সিস ইডেলম্যানকে স্বাগত জানিয়ে ভাষণ দিলেন। ভাষণের শেষের দিকে তিনি জানালেন, বহুদিন থেকে যার কথা শোনার জন্যে আমরা অপেক্ষা করছি, সেই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী মহান পদার্থবিদ অ্যাডাম অ্যালেক্সিস ইডেলম্যান যাকে তিনটি নোবেল পুরস্কার দিয়ে দুনিয়া ধন্য হয়েছে, এখন আমাদের উদ্দেশ্যে কথা বলবেন। তাঁর রীতি অনুসারে তার বক্তৃতার শুরুতে থাকছে একটা প্রশ্নোত্তর পর্ব। স্বাভাবিকভাবেই এ পর্বে একজন মহান শিক্ষক হিসেবে তিনি হবেন প্রশ্নকর্তা। আর আমাদের বিজ্ঞানের ছাত্ররা হবে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দাতা। বিজ্ঞানের ছাত্রদের সাথে মত বিনিময়ের এক মাধ্যম হিসেবেই তিনি এটা করে থাকেন। আমাদের সকলের জন্যে এটা হবে একটা মজার বিজ্ঞান- সংলাপ। আমাদের বিজ্ঞানের ছাত্ররা একে এই দৃষ্টিতেই নেবে আশা করি।
নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী মি. ইডেলম্যান তার টেবিলে বসেই বক্তৃতা করবেন, তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সব ছেড়ে বিজ্ঞানী ইডেলম্যান মাইক্রোফোন স্ট্যান্ডের সামনে এসে দাঁড়াল। শুরু করল তার বক্তৃতা।
প্রাথমিক কথার পর তার প্রশ্ন-উত্তর পর্ব শুরু করল।
বলল বিজ্ঞানী ইডেলম্যান, ‘আমার প্রিয় ছাত্র ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা, তোমাদের পরীক্ষা করার জন্যে আমার প্রশ্ন নয়। তোমাদের প্রশ্ন করার মাধ্যমে আমি নতুন কিছু পেতে চাই, বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিতে চাই।’
মুহূর্তের জন্যে থামার পর বিজ্ঞানী বলল, ‘আমি এ বছর এ পর্যন্ত বত্রিশটি-বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছি। সবটাতেই আমি আমার ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের তিনটি প্রশ্ন করেছি। আমি অনেক উত্তর পেয়েছি, নতুন কথাও পেয়েছি, কিন্তু আমার মন ভরেনি। মনে হয়েছে, আমি যে উত্তর চাই, সে উত্তর এগুলো নয়। বড় বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আমি কি উত্তর চাই সেটা আমি নিজেই জানি না। প্রশ্নের সমাধান তাই এখনও হয়নি। আমার সেই তিনটি পুরানো প্রশ্নই এখানে আমাদের ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের কাছে পেশ করব।’
আবার তিনি মুহূর্তের জন্য বিরতি নিলেন। বললেন তারপর, ‘একটি প্রশ্নের জবাবের পর আরেকটি প্রশ্ন করব, এইভাবে আমি তিনটি প্রশ্ন করব। আর আমি প্রশ্ন করব এক বাক্যে, উত্তর দিতে হবে এক বাক্যে। ব্যাখ্যা চাইলে, সে ব্যাখ্যা ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা স্বাধীনভাবে করতে পারবে, কিন্তু খুব সংক্ষেপে। প্রশ্ন করার পর এক মিনিট সময় থাকবে। এর মধ্যে উত্তর দিতে কেউ না দাঁড়ালে প্রশ্ন বাতিল হয়ে যাবে। এরপর আসবে পরবর্তী প্রশ্ন।’
বিজ্ঞানী ইডেলম্যান একবার চোখ বুলাল হলের উপর। পিনপতন নীরবতা তখন গোটা হলে। ধ্বনিত হলো বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের কণ্ঠ, ‘মেক এ কমেন্ট অন সিংগুলারিটি (সিংগুলারিটি’র উপর মন্তব্য কর)।
প্রথম প্রশ্ন এলো বিজ্ঞানী ইডেলম্যান-এর কাছ থেকে।
নীরব গোটা হল। পলপল করে বয়ে যাচ্ছে সময়। দশ সেকেন্ড, বিশ সেকেন্ড; তিরিশ সেকেন্ড, চল্লিশ সেকেন্ড…। চাওসিকোর হাত ঘড়িতে তখন পঞ্চাশ সেকেন্ড। তার দৃষ্টি তার চারদিকে। কেউ দাঁড়ায়নি উত্তর দেবার জন্যে। দাঁড়াল চাওসিকো। তার ডান হাতে কলম, বাম হাতে তার নোট খাতা।
মনে মনে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার পর তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, ‘সিংগুলারিটি ইজ নাথিং বাট অ্যা রিটার্ন অব অ্যা ক্রিয়েটেড টু ইটস হ্যাঁভেন, দ্যা ক্রিয়েটর। (সিংগুলারিটি স্রষ্টার আশ্রয়ে সৃষ্টির ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।) ‘
চাওসিকোর উত্তর শোনার পর বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের কপাল কুঞ্চিত হলো। বিস্ময়ের একটা ছাপ তার চোখে-মুখে। চাওসিকোর উত্তরটা তার মুখে উচ্চারিত হলো একাধিকবার। বলল সে চাওসিকোকে উদ্দেশ্য করে, ‘মাই বয়, তুমি বলতে চাচ্ছ সিংগুলারিটি প্রকৃতপক্ষে একটা সৃষ্টির তার স্রষ্টার আশ্রয়ে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।’
চাওসিকো দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, ‘ইয়েস স্যার।’
বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘এক্সপ্রেইন মাই বয়।’
‘সিংগুলারিটি বস্তুর সংকোচনের শেষ একটা পর্যায়, যখন সূর্যের মতো বা তার চেয়েও বহুগুণ বড় বস্তু মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ব্যাসহীন অদ্বৈত এক বিন্দুতে পরিণত হয়। যা কার্যত বস্তু নয়, বস্তুর একটা অশরীরী শক্তি। মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগে স্রষ্টার আশ্রয়ে আমাদের মহাজাগতিক বস্তুর অবস্থান মনে হয় এমনই ছিল। যা অন্যকথায় বস্তুর উপস্থিতি শূন্য পরম শূন্যতার পর্যায়ে পড়ে। একেই আমি বস্তুর তার স্রষ্টার কাছে ফিরে যাওয়া মনে করি। থামল চাওসিকো।
বিজ্ঞানী ইডেলম্যান লাউড স্পিকারের সামনে থেকে মঞ্চের মাঝামাঝি জায়গায় সরে এলো। চাওসিকোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ মাই ডিয়ার বয়।’ বলেই বিজ্ঞানী ইডেলম্যান হ্যান্ডক্লাপিং শুরু করল।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ভাইস-চ্যান্সেলরসহ হল ও ব্যালকনির সকলের হ্যান্ডক্লাপিং শুরু হয়ে গেল তার সাথে সাথে।
দাঁড়িয়েছিল চাওসিকো, বসে পড়ল সে।
সামনের সারি থেকে আনা আরিয়া চাওসিকোর প্রথম কথা বলার সময় থেকেই পেছনের দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়েছিল চাওসিকোর দিকে। তার চোখে-মুখে প্রথমে ছিল প্রবল উত্তেজনা, কিন্তু পরে তার মুখ বিস্ময় ও আনন্দে ভরে উঠেছিল।
চাওসিকো বসলে আনা আরিয়া তার মুখ ঘুরিয়ে নিল।
স্পিকারস্ট্যান্ডে ফিরে এলো বিজ্ঞানী ইডেলম্যান। বলল, ‘এবার আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন- ‘বিইং অ্যা মেইডেন ইভেন্ট ইন ক্রিয়েশন হাও দ্যা ‘বিগ ব্যাং’ হ্যাঁপেনড। (সৃষ্টির প্রথম ঘটনা ‘বিগ ব্যাং’ কীভাবে ঘটে?)।’
আবার প্রশ্নের পর সেই নীরবতা।
দেয়ালের ডিজিটাল ঘড়ির সেকেন্ডের ডিজিটটা একটার পর একটা স্টেপ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। সেকেন্ডের ডিজিটটা আবার চারের ঘরে।
কেউ উঠে দাঁড়ায়নি, দেখলো চাওসিকো।
‘বিসমিল্লাহ’ বলে উঠে দাঁড়াল চাওসিকো।
বিজ্ঞানী ইডেলম্যান ছাত্রদের দিকেই তাকিয়েছিল সাগ্রহে। চাওসিকো উঠে দাঁড়াতেই বিজ্ঞানী ইডেলম্যান একমুখ হাসি নিয়ে বলল, ‘ওয়েলকাম মাই বয়, আগেরবার নাম বলনি। এখন তোমার নাম বলে উত্তর বলো।’
‘আমার নাম চাওসিকো।’ বলল চাওসিকো।
‘ধন্যবাদ। এখন তোমার উত্তর বলো।’ বিজ্ঞানী বলল।
‘দ্যা বিগ র্যাং, অ্যা হিউজ এক্সপ্লোসন ফ্রম নাথিং, ইজ অ্যান অর্ডার ফ্রম ক্রিয়েটর। শূন্য থেকে ঘটা মহাবিস্ফোরণ বিগ ব্যাং স্রষ্টার একটা আদেশ মাত্র।’
ঠোঁটে হাসি মাখা কুঞ্চিত কপাল বিজ্ঞানী ইডেলম্যান আগের মতোই চাওসিকের বলা বাক্যটি স্বাগত কণ্ঠে পুনরাবৃত্তি করল।
তার ঠোঁটের হাসিটি বিস্তৃত হলো। বলল, ‘ধন্যবাদ চাওসিকো। এক্সপ্লেইন ইয়োর পয়েন্ট।’
চাওসিকো শুরু করল, ‘বিজ্ঞান অনুমিত বিগ ব্যাং নামক মহা- বিস্ফোরণ, যা পরম শূন্যের মাঝে সংঘটিত হয়েছিল, আমাদের জাগতিক বিচারে অসম্ভব একটি ঘটনা। সে বিস্ফোরণের মাধ্যমে যে বস্তুকণার সৃষ্টি হয়েছিল, সে বস্তুকণাসমূহের সৃষ্টি সম্ভব করতে হলে বিস্ফোরণ শক্তির উপাত্ত হিসাবে সেখানে ‘কোয়ান্টাম ক্ষেত্র, স্থান-কাল ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর উপস্থিতি অপরিহার্য ছিল। কিন্তু এসব কিছুর জন্ম তো মহাবিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে হয়েছে। তখন মহাবিস্ফোরণের আগে এ সবের কিছুই ছিল না, ছিল শুধু পরম শূন্য। এই পরম শূন্যে বিগ ব্যাং-এর মতো সৃষ্টিমূলক বিস্ফোরণ কীভাবে হতে পারে? হতে পারে শুধু স্রষ্টার হুকুমে। আমি একথাই বলেছি।’
গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল বিজ্ঞানী ইডেলম্যান চাওসিকোর কথা। চাসিকোর কথা শেষ হলে ঠোঁট টিপে একটু হাসল বিজ্ঞানী। বলল, ‘চাওসিকো তুমি কি মাদার ইউনিভার্স-তত্ত্বে’র কথা শুনেছ? সেখান থেকেই হয়তো মহাবিস্ফোরণের উপাত্তগুলো এসেছিল।’
‘এক্সকিউজ মি স্যার, সে ক্ষেত্রেও ‘মাদার ইউনিভার্স’ নিয়েও একই প্রশ্ন উঠে। যে কারণে আমাদের ইউনিভার্সের বিগ ব্যাং একটি অসম্ভব ঘটনা, সে কারণেই ‘মাদার ইউনিভার্সের’ বিগ ব্যাংকেও অসম্ভব বলতে হবে আমাদের।’ বলল চাওসিকো।
চাওসিকোর কথা শেষ হতেই হ্যান্ডক্লাপিং শুরু হলো বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের। তার সাথে শামিল হলো মঞ্চ, হল ও ব্যালকনির সবাই।
আনা আরিয়া আগের মতোই পেছন ফিরে শুনছিল চাওসিকোর কথা।
সে হাততালি দিতে গিয়ে আবেগে উঠে দাঁড়িয়েছিল।
মায়ের ইশারায় সংগে সংগে সে বসে পড়ে।
হাততালি শুরু হলে চাওসিকো মাথা নিচু করে বসে পড়েছিল।
হ্যান্ডক্লাপিং শেষ হলে বিজ্ঞানী ইডেলম্যান মাইক্রোফোনের সামনে নড়েচড়ে দাঁড়াল। বলল, ‘এবার আমার তৃতীয় এবং শেষ প্রশ্ন : ‘মাই ডিয়ার বয়েজ, এন্ড গার্লস, হোয়ট ইজ দ্যা রিয়ালিটি এন্ড ইউটিলিটি অব প্যারালাল অ্যান্টি-পার্টিকল ইউনিভার্স?’ (আমার প্রিয় ছেলে-মেয়েরা, প্যারালাল অ্যান্টি-পার্টিকল ইউনিভার্সের বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তা কী?)
এবারও অন্য কোনো ছাত্র জবাবের জন্যে দাঁড়াল না। ঠিক পঞ্চাশ সেকেন্ডের মাথায় চাওসিকো দাঁড়াল জবাব দেবার জন্যে।
‘অভিনন্দন মাই বয়, বলো তোমার এক বাক্যের জবাব।’ বলল বিজ্ঞানী ইডেলম্যান।
‘অ্যাজ দ্য লাইফ এন্ড ম্যাটার ইন ক্রিয়েশন আর ইনপিয়ারস, সো ইউনিভার্স এন্ড প্যারালাল অ্যান্টি পারটিকল ইউনিভার্স অ্যাজ পিয়ার বি টেকেন টু বি অ্যা রিয়ালিটি এন্ড দ্য পিয়ারস, ইউনিভার্স এন্ড প্যারালাল অ্যান্টি পার্টিকল ইউনিভার্স, ফাইনালি নিডেড টু ডেস্ট্রয় দ্য প্রজেক্ট ক্রিয়েশন টু বি রিপ্লেসড বাই নিউ ক্রিয়েশন ফর আওয়ার লাইফ ইন হেয়ার আফটার- যেহেতু সৃষ্টির সব জীবন ও বস্তু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি, তাই জোড় বাধার জন্যে আমাদের ধনাত্মক কণার ইউনিভার্সের পাশে প্রতিকণার ইউনিভার্সকে বাস্তবতা হিসাবে ধরে নিতে হবে এবং এই জোড় দরকার বর্তমান সৃষ্টিকে অবশেষে ধ্বংস করার জন্যে, যা পথ করে দেবে স্থিতি’র এক নতুন ইউনিভার্স গঠনের, আমাদের মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রয়োজনে।’ বলল চাওসিকো।
বিস্ময় ও আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছে বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের মুখে। সে চাওসিকোর এক বাক্যের উত্তরটাকেই পুনরাবৃত্তি করছিল, যা মাইক্রোফোনে সবাই শুনতেও পাচ্ছিল। অনুষ্ঠানের সভাপতি ভাইস- চ্যান্সেলরের মুখে একটা স্তম্ভিত ভাব। সম্মুখভাগে বসা শিক্ষকদের মুখে বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের মতোই বিস্ময়ের সাথে আনন্দ।
আর আনা আরিয়ার দু’চোখ থেকে গড়াচ্ছিল অশ্রু-আনন্দের অশ্রু অনেকক্ষণের আবেগ-উত্তেজনায় তার সাদা মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
পাশে বসা তার মা তার হাতে একখণ্ড টিস্যু গুঁজে দিল।
সপ্রতিভ হয়ে উঠল আনা আরিয়া। তাড়াতাড়ি অশ্রু মুছে ফেলল।
বিজ্ঞানী ইডেলম্যান মাইক্রোফোনে ফিরে এলো। বলল, ‘ধন্যবাদ চাওসিকো, ‘জটিল ও বড় একটা বিষয়কে একবাক্যে যথেষ্ট সুন্দরভাবে তুলে ধরেছ। এখন ব্যাখ্যা কর তোমার কথাটাকে।’
চাওসিকো দাঁড়িয়েই ছিল। বলল, ‘কণা, প্রতিকণা উভয়েরই সৃষ্টি করেছিল মহাবিস্ফোরণ। যতগুলো কণা সৃষ্টি হয়েছিল, ততগুলোই সৃষ্টি হয়েছিল প্রতিকণা। কিন্তু আমাদের এই মহাবিশ্ব কণার সৃষ্টি, এখানে প্রতিকণা নেই। নেই কারণ, বিপরীতধর্মী কণা-প্রতিকণার সংস্পর্শ, সম্মেলন উভয়কেই ধ্বংস করে। কণাদের সৃষ্টির শুরুতে প্রতিকণাকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান-এর তত্ত্ব বলছে, মহাবিস্ফোরণের শুরুতেই সময়ের সম্মুখ গতি ও পিছন গতির সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের ইউনিভার্সের সময়ের সম্মুখ গতি ধনাত্মক ধরলে, পেছন গতির সময় ঋণাত্মক। কণাগুলো সম্মুখ গতি নিয়ে আমাদের ইউনিভার্স গঠন করেছে, আর প্রতিকণারা ছুটে গেছে সময়ের পেছন গতির দিকে। পদার্থ বিজ্ঞানী মিশিও কাকু বলেছেন, বিপরীত দিকে অর্থাৎ সময়ের পেছন গতির দিকে প্রবাহিত প্রতিকণারা প্যারালাল একটা প্রতিকণার ইউনিভার্স সৃষ্টি করেছে। বল বিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে দুই প্যারালাল ইউনিভার্সের স্থিতির সীমা আছে। তারপর স্রষ্টার বিধানেই দুই বিপরীত ইউনিভার্সের সংস্পর্শ ঘটবে এবং দুইয়ের মিলিত আরেক মহাবিস্ফোরণ পুরাতনকে ধ্বংস করে নতুন এক স্থিতির ইউনিভার্সের জন্ম দেবে, আমাদের মৃত্যু পরবর্তী চিরবাসস্থানের জগত হিসাবে। শেষোক্ত মহাবিস্ফোরণ বা আমাদের এই ইউনিভার্সের ধ্বংসের খবর ওহিভিত্তিক ধর্মের সব স্ক্রিপচার আমাদের দেয়, যা আমরা সবচেয়ে বিস্তারিত জানতে পারি ওহিভিত্তিক সর্বশেষ ধর্মের স্ক্রিপচার থেকে।’ থামল চাওসিকো।
বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের মুখে হাসি। তার দুই হাত তালি দেয়া শুরু করলো। গোটা হল, ব্যালকনি এবং মঞ্চ তার সাথে সাথে হাততালি দিল। শত শত হাতের সম্মিলিত তালিতে গোটা হল ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল।
বিজ্ঞানী ইডেলম্যান মাইক্রোফোন থেকে পিছিয়ে গিয়ে মঞ্চে সভাপতির চেয়ারে বসা ভাইস চ্যান্সেলরকে একটা দীর্ঘ বাউ করে বলল, ‘আপনার ছাত্র চাওসিকো আমাকে মুগ্ধ করেছে। চাওসিকোর এই অভাবনীয় মেধার বিকাশে আপনার এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিত্বই বেশি।
বিজ্ঞানী ইডেলম্যান তারপর মঞ্চের সম্মুখ প্রান্তে হলের সামনে বসা শিক্ষকসারীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সকলের উদ্দেশে বাউ করল এবং বলল, ‘সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ চাওসিকোকে আপনারা তৈরি করেছেন, এজন্যে আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।’
মাইক্রোফোনে ফিরে এলো বিজ্ঞানী ইডেলম্যান।
ভাইস-চ্যান্সেলর, শিক্ষকবৃদ্ধ ও ছাত্র-ছাত্রীদের সম্মোধন করে বিজ্ঞানী ইডেলম্যান বলল, ‘আমার এই তিনটি প্রশ্নের যাত্রা শুরু হয়েছিল এ বছর ৩ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড এবং ১১ জানুয়ারি এমআইটি (MIT) থেকে। তারপর বিশ্বের আরও তিরিশটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরেছে আমার এই তিনটি, প্রশ্ন। MIT-সহ অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা তিনটি প্রশ্নের ভালো জবাব দিয়েছে এবং অনেক নতুন কথা এসেছে তাদের কাছ থেকে। বিজ্ঞানকে তারা বিজ্ঞানের গণ্ডির মধ্যে থেকেই দেখেছে। তার বাইরে কোনো সূত্র তারা খুঁজে পায়নি বা খোঁজেনি। তাদের জবাব আমাকে আনন্দিত করেছে, কিন্তু মনকে তৃপ্ত করতে পারেনি। তাই আমার তিন প্রশ্নের যাত্রাও আমি শেষ করতে পারিনি। আমার এ বছরের অভিযাত্রার তেত্রিশতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে আজ আমার যাত্রা বিরতি আপনাদের পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল আফ্রিকায়। সেই সাথে আমার তিন প্রশ্নের যাত্রার শেষ দিন এটা। আমার তিনটি প্রশ্ন তাদের জবাব পেয়ে গেছে। চাওসিকোর সব উত্তরের সাথে আমি পুরোপরি একমত একথা বলতে পারছি না। কারণ এ নিয়ে আমাকে আরও ভাবতে হবে। তার উত্তরগুলো সবদিক দিয়েই সঠিক তাও বলা যাচ্ছে না। তবে তার উত্তরে আমার মন পরিতৃপ্ত, যে পরিতৃপ্তি আমি আগের বত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরে পাইনি। চাওসিকোর বড় বৈশিষ্ট্য হলো সে বিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেনি, স্রষ্টার ইচ্ছা ও কাজকেও সে সন্ধান করেছে। বিজ্ঞানের বিশেষ ইস্যুর যৌক্তিক ব্যাখ্যার জন্যে মানুষের মৃত্যু পরবর্তী জীবন পরকালকেও সে নিয়ে এসেছে। বর্তমান বিজ্ঞানের বস্তুবাদিতা স্রষ্টা, ও পরকাল কোনোটিকেই চোখে দেখে না। কিন্তু স্রষ্টা বাদ দিয়ে সৃষ্টির চিন্তা করা হাস্যকর, তেমনি প্রতিফল-এর জগৎ পরকাল না থাকলে মানব জীবন অযৌক্তিক ও অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। চাওসিকো বিজ্ঞান ও সৃষ্টজগতকে এভাবেই দেখেছে, আমিও এভাবেই দেখতে চাই।
দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে একটু থামল বিজ্ঞানী ইডেলম্যান। তাকাল সে চাওসিকোর দিকে। তারপর সবার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, ‘আমি এটা ঠিক করে রেখেছি, যার উত্তরে আমি সন্তুষ্ট হবো, এ ঘটনার স্মারক হিসাবে তাকে আমি একটা ছোট্ট গিফট দেব। সেটা স্বর্ণের একটা কোটপিন। কোটপিনটা আমাদের ভিজিবল ইউনিভার্সের শিল্পীর আঁকা গোলাকার প্রতিকৃতি। তার বটমে আমার সিগনেচার আছে।’
কথা শেষ করে তাকাল আবার চাওসিকোর দিকে। বলল, চাওসিকো, মাই বয়, একটু কষ্ট করে এসো। তোমাকে কিছুটা সম্মানিত করার সুযোগ দাও।’
চাওসিকো বিনীত পদক্ষেপে উঠে এলো মঞ্চে।
দাঁড়াল বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের সামনে। বলল, ‘স্যার, গোটা বিশ্ব যাকে সম্মানিত করেছে, আমাদের সেই মহান শিক্ষক আপনি। শিক্ষক ছাত্রকে সম্মানিত করে না স্যার। আশীর্বাদ করে, দোয়া করে।’
‘ধন্যবাদ, মাই ডিয়ার বয়।’ বলে বিজ্ঞানী ইডেলম্যান চাওসিকোর কোটে পিন পরিয়ে দিল।
বলল, ‘স্রষ্টার কাছে আমার প্রার্থনা, তিনি যেন তোমাকে ভালো মানুষ, ভালো বিজ্ঞানী বানান।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
বলে সে ভাইস-চ্যান্সেলরের দিকে কিছুটা এগিয়ে তার ক্যাডেট জীবনের অভ্যেস অনুসারে ভিসি’কে একটা স্যালুট দিল। অনুরূপভাবে মঞ্চের সামনের প্রান্তে গিয়ে শিক্ষকদের উদ্দেশে একটা স্যালুট দিয়ে সে নেমে এলো মঞ্চ থেকে। বসল তার সিটে এসে।
সামনের সারিতে একটি সোফায় সুবেশধারী সেই মাঝবয়সী মহিলার পাশে আনা আরিয়াকে বসে থাকতে দেখেছিল চাওসিকো। চোখে অশ্রু, আর মুখভরা হাসি নিয়ে আনা আরিয়া তাকিয়েছিল চাওসিকোর দিকে।
মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলার মুডে এসে দাঁড়াল বিজ্ঞানী ইডেলম্যান।
‘অনারেবল ভাইস চ্যান্সেলর, রেসপেক্টেড টিচারস, মাইডিয়ার স্টুডেন্ট, লেডিজ এন্ড জেন্টেলম্যান’ ধ্বনিত হলো বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের কণ্ঠে। বলল সে, ‘আমার বক্তৃতার একটা অংশ শেষ হয়েছে প্রশ্নোত্তর পর্বে। এই প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি, বিজ্ঞান সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। বরং আমি বলব, সৃষ্টি সম্পর্কিত মৌলিক বিষয়ের খুব কম প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে। আসলে বিজ্ঞান বা মানুষের জ্ঞান মৌলিক কোনো কিছুই সৃষ্টি করে না, সৃষ্ট বিষয় এবং তার গুণাগুণ আবিষ্কার করে ও তা কাজে লাগায় মাত্র। সৃষ্টিগত মৌলিক প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে স্রষ্টাকেই সন্ধান করতে হয়, চাওসিকো যেমন করেছে। এটাই হয়তো বিজ্ঞানের পরিণতি, আমাদের মহাবিশ্বের অব্যাহত বিস্তার অনন্ত নয়, তার সমাপ্তি আছে। তেমনি মানুষের জীবনের মতো তার জ্ঞানও নির্দিষ্ট একটা পরিসীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বড় একটা মৌলিক প্রশ্ন এখানে ওঠে, সময়ের গতি, ইউনিভার্সের গতি, জীবনের গতি থেমে যাওয়ার পর কি আছে? এই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান জানে না। এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে চাওসিকোকে তাই যেতে হয়েছে স্রষ্টার কাছে, স্রষ্টা প্রেরিত ধর্মগ্রন্থের কাছে। সামনে আনতে হয়েছে মানুষের মৃত্যু পরবর্তী চিরন্তন এক স্থিতির জগত ‘পরকাল’-এর কথা। যে ‘পরকাল’-জগতে মানুষ মৃত্যুহীন অনন্ত, স্থির জীবন লাভ করবে, নতুন বিশ্বজগতও হয়ে যাবে স্থির, অনন্ত, যেখানে থাকবে না কোনো কাল বা সময়, কারণ যেখানে গতি নেই, সেখানে সময় বলতে কিছু থাকে না। কিন্তু এই কথাগুলো আমাদের বিজ্ঞান বলতে পারছে না। বলার মতো যোগ্য হতে হলে তাকে আরও সাবজেক্ট নিয়ে ভাবতে হবে, শুধু বস্তু নয়, ‘গায়েবে’ বিশ্বাস করতে হবে। এভাবে স্রষ্টার ইচ্ছা-অভিপ্রায়কেও তাকে জানতে হবে। এটাই হবে আমাদের ভবিষ্যতের বিজ্ঞান। লেডিজ এন্ড জেন্টেলম্যান, আমার বক্তৃতার দ্বিতীয় পর্বে ভবিষ্যতের এই বিজ্ঞান নিয়েই কয়েকটা কথা বলতে চাই।’
একটু থেমে এক ঢোক পানি খেয়ে নিয়ে বিজ্ঞানী আবার শুরু করল তার বক্তৃতা। পিনপতন নীরবতার মাঝে চলল তার কথা। আরও পাকা একঘণ্টা চলল তার বিস্ময়কর বক্তৃতা’। বক্তৃতা শেষ হলো।
অনুষ্ঠান শেষ হলো।
অতিথিকে নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলর ও সিনিয়র শিক্ষকরা প্রথমে বেরিয়ে গেল। তারপর বের হলো অবশিষ্ট শিক্ষকরা। তারপর বের হলো ব্যালকনি ও হলের ছাত্র-ছাত্রীরা। সবশেষে বের হলো চাওসিকো।
তাকে নিয়ে ছাত্রদের নীরব কৌতূহল আছে, কিন্তু উচ্ছ্বাস নেই, আনন্দ নেই। চাওসিকো নামে খ্রিস্টান; কাজে মুসলমান এটা সবাই জানে। আর চাওসিকোও সে মুসলমান এ কথা প্রকাশ করতেই বেশি ভালোবাসে।
চাওসিকো সবাইকে এড়িয়ে ভিড়ের এক প্রান্ত দিয়ে এগিয়ে রাস্তার ফুটপাতে গিয়ে উঠল। এগিয়ে চলল ফুটপাত ধরে।
ঠিক সকালের মতোই একদম তার পাশে ফুটপাত ঘেঁষে একটা কার এসে দাঁড়াল। তাকাল চাওসিকো গাড়ির দিকে। দেখল, ড্রাইভিং সিটে আনা আরিয়া। সে গাড়িতে উঠার জন্যে হাতের ইশারায় ডাকছে তাকে।
তখন রাস্তা দিয়ে চলছে আরও অনেক গাড়ি। ফুটপাত ধরে চলছে ছাত্ররা। চাওসিকোর দাঁড়ানো এবং আনা আরিয়া তাকে ডাকা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
আনা আরিয়া তার পাশের সিটের দরজা খুলে দিয়েছিল। চাওসিকো কিছু বলার সুযোগ পেল না, তাকে উঠে বসতে হলো গাড়িতে। গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
আনা আরিয়া কিছু বলার জন্যে মুখ তুলেছিল চাওসিকোর দিকে। ঠিক সে সময় একটা কার তার ডান পাশ দিয়ে এগিয়ে তার গাড়ির সামনে গিয়ে ব্রেক কষল এবং সে গাড়ির দুই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো রিটা রেমন্ড এবং তার বন্ধু হ্যারি হামিল্টন। দু’জনেই আনা আরিয়ার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। রিটা রেমন্ড মধ্য আফ্রিকার চার্চ গুরু বিশপের মেয়ে। আর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের ছেলে হ্যারি হামিল্টন। দু’জনেই আনা আরিয়ার বন্ধু গ্রুপের সদস্য।
রিটা রেমন্ড ও হ্যারি হামিল্টন দু’জনেই ছুটে এলো আনা আরিয়ার দিকে। ‘আনা, তোকেই আমরা খুঁজছি। ভিসি সাহেব তোকে ডাকছেন, আমাদের খুঁজতে পাঠিয়েছেন। চল।’
কথা শেষ করেই রিটা রেমন্ড তাকাল চাওসিকোর দিকে। বলল, ‘চাওসিকো কনগ্রাচুলেশন তোমাকে। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রেখেছ। আরও ভালো লাগত যদি তুমি…’
কথার মাঝখানে রিটাকে বাধা দিয়ে আনা আরিয়া বলল, ‘কথা বাড়াস না রিটা।’
আনা আরিয়ার কথাটা শেষ হতেই চাওসিকো বলল, ‘ওয়েলকাম, মিস রিটা।
চাওসিকোর কথা শেষ হলে আনা আরিয়া রিটা রেমন্ডকে লক্ষ্য করে বলল, ‘বাবাকে বলো। আমার একটু কাজ আছে। মাকে আমি বলে এসেছি।
‘স্যারের যদি জরুরি কোনো কাজ হয়?’ হ্যারি হামিল্টন বলল।
‘আমি তা মনে করি না। বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের সম্বর্ধনায় বাবা দুপুরে লাঞ্চের আয়োজন করেছেন। সেখানেই অংশ নিতে বাবা আমাকে ডাকছেন। আমি সেখানে যাচ্ছি না।’ বলল আনা আরিয়া।
রিটা রেমন্ড একবার চাওসিকোর দিকে তাকিয়ে আনা আরিয়াকে বলল, ‘কি এমন কাজ তোর আছে?’
‘আমরা করি না বটে, কিন্তু পৃথিবীতে কাজের শেষ নেই।’ বলল আনা আরিয়া।
‘আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছিস।’ রিটা রেমন্ড বলল।
‘কেন শুনলি না, বিজ্ঞানী স্যার ইডেলম্যান বললেন, সব প্রশ্নের জবাব বিজ্ঞানও দিতে পারে না।’
গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে রিটা রেমন্ড আনা আরিয়ার পিঠে একটা কিল দিয়ে বলল, ‘চাওসিকোর বিজ্ঞান কি তোর মাথাতেও ঢুকল?’
‘ঢুকলে খুশি হতাম, খুব খুশি।’ বলল আনা আরিয়া।
রিটা রেমন্ডের মুখে হঠাৎ বিমর্ষতার একটা ঢেউ খেলে গেল। বলল সে, দেখিস খুব খুশির পরিসীমা যেন বিজ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আমরা চলি, স্যারকে গিয়ে আবার বলতে হবে।’
‘ধন্যবাদ।’ বলল আনা আরিয়া।
রিটা রেমন্ড ও হ্যারি হামিল্টন চলে গেল। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে তারা ফিরে চলল।
‘আনা আরিয়া, স্যার ডেকেছেন। তুমি না গিয়ে ঠিক করলে না। চাওসিকো বলল।
আনা আরিয়ার গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে।
‘তুমি এসব নিয়ে ভেব না চাওসিকো। আমার মাথায় এখন অন্য চিন্তা।’ বলল আনা আরিয়া।
‘কি চিন্তা?’ চাওসিকো বলল।
‘তোমাকে বলেছিলাম, আমার জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে। করেছিলে? আমি কিন্তু আল্লাহর সাথে কথা বলেছি। আমার সব কথা বলেছি। তিনি আমার কথা শুনেছেন। আমার মন এখন শান্ত। আমি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।’ বলল আনা আরিয়া।
‘কি সিদ্ধান্ত?’ চাওসিকোর জিজ্ঞাসা।
‘সর্বশেষ ধর্ম ইসলামই এখন আল্লাহর একমাত্র পথ। এই পথ আমি আমার জীবনের জন্যে গ্রহণ করব।’ বলল আনা আরিয়া। তার কণ্ঠ গম্ভীর, ভারি। তার মুখে স্থির সিদ্ধান্তের ছাপ।
চমকে উঠেছে চাওসিকো। তাকিয়েছে আনা আরিয়ার দিকে। হঠাৎ তার মুখে কোনো কথা যোগাল না। আনা আরিয়ার পরিচয় সে জানতো না। এই মাত্র রিটার সাথে আনা আরিয়ার কথার মধ্যে দিয়ে সে জানল পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল আফ্রিকার পাওয়ারফুল ভাইস চ্যান্সেলর ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানের মেয়ে সে। যার বাবা, যার বিশ্ববিদ্যালয় সবাইকে খ্রিস্টান বানাচ্ছে, তার মেয়ে ইসলাম গ্রহণ করবে! চমকে উঠার মতো কথাই এটা। কি বলবে, কি বলা উচিত এই অবস্থায়, ঠিক করতে পারল না চাওসিকো।
আনা আরিয়াই কথা বলল। বলল সে, ‘চাওসিকো ইসলাম কীভাবে গ্রহণ করতে হয়, নিয়ম কি?’
চিন্তার জটটাকে পেছনে ঠেলে সোজা হয়ে বসল চাওসিকো। বলল, ‘সেটা খুব সহজ ব্যাপার। ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রেরিত রাসুল এবং দাস।-এই সাক্ষ্য মুখে ঘোষণা করতে হয়, অন্তরে বিশ্বাস করতে হয়, তা কাজে বাস্তবায়িত করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’
আনা আরিয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘এই সাক্ষ্য কি বিশপ ফাদার ও গির্জার মতো কোথাও গিয়ে, কারও কাছে গিয়ে ঘোষণা করতে হয়?’
‘মসজিদে গিয়ে, মসজিদের ইমামের কাছে গিয়ে সাক্ষ্য দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করা যায়। কিন্তু এটা শর্ত নয়। যে কেউ যে কোনো স্থানে অথবা যে কোনো কারও কাছে গিয়ে এই সাক্ষ্য দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে। চাওসিকো বলল।
‘আমি কি তোমার কাছে এই সাক্ষ্য দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে পারি?’ বলল আনা আরিয়া।
‘কোনো বাধা নেই।’ চাওসিকো বলল।
‘আমাকে ইসলাম গ্রহণ করাও- এই অনুরোধ কি তোমাকে আমি করতে পারি?’ বলল আনা আরিয়া। ভারি, অশ্রুরুদ্ধ তার কণ্ঠস্বর।
চাওসিকো তাকাল আনা আরিয়ার দিকে। বলল, ‘অনুরোধ কেন? এটা আমার দায়িত্ব একজন মুসলিম হিসেবে। কিন্তু…।’ কথা শেষ না করেই থেমে গেল চাওসিকো।
‘কিন্তু কি?’ বলল আনা আরিয়া।
‘তাড়াহুড়োর দরকার নেই। তুমি তো সিদ্ধান্ত নিয়েছই। যে কোনো দিন যে কোনো সময় এটা করা যাবে।’ চাওসিকো বলল।
‘কিন্তু চাওসিকো তুমি বলেছ, আল্লাহর পথ গ্রহণ না করে, আল্লাহর পথে না চলে মৃত্যুবরণ করলে তার জন্যে পরজীবনে রয়েছে অনন্ত শাস্তি। তাহলে দেরি করব কেন? আমি যদি এর মধ্যে মরে যাই কিংবা পরে ইসলাম গ্রহণ করা না হয় কোনো কারণে?’ বলল আনা আরিয়া।
‘তুমি ঠিক বলেছ আনা, তোমাকে ধন্যবাদ। আজই এখনি তোমাকে আমি সাক্ষ্য বা শাহাদাহ পাঠ করাবো, কিন্তু একটা অনুরোধ আছে। চাওসিকো বলল।
‘বলো কি সেটা?’ বলল আনা আরিয়া।
‘তোমার ইসলাম গ্রহণের কথা কিছু দিন গোপন রাখতে হবে। ইসলামের বিরুদ্ধে, আমার বিরুদ্ধে বা কোনো মুসলিমের বিরুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বুজুমবুরায় যাই ঘটুক তুমি ধৈর্য ধরবে, তোমার ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারটি কথায় বা কাজে প্রকাশ করবে না।’ চাওসিকো বলল।
‘তোমার কথা আপাতত মানলাম আমি আমার বয়সের বিবেচনায় এবং আমি আত্মনির্ভরশীল নই এই বিবেচনা সামনে রেখে, যে বিবেচনা তুমিও করেছ। তবে এই আত্মগোপন কতদিন চলবে, তা ঠিক করার অধিকার শুধু আমারই থাকবে।’ বলল আনা আরিয়া।
‘ঠিক আছে।’ বলল চাওসিকো।
‘কিন্তু চাওসিকো, অবশ্য কর্তব্য নামাজ এবং রোযা কীভাবে করব, এ ব্যাপারে তোমার পরামর্শ কি?’ বলল আনা আরিয়া।
‘নামাজ তোমাকে গোপনে পড়তে হবে। দিনে কোনো ওয়াক্ত কোনোভাবে পড়ার সুযোগ না পেলে রাতে কাজা পড়বে এবং আল্লাহর কাছে এজন্যে ক্ষমা চাইবে। আর রোযার ব্যাপার পরে বলবো, রোযার দেরি আছে আরও নয় দশ মাস।’ চাওসিকো বলল।
‘তাহলে শাহাদাহ-এর কাজটা চলো শেষ করি।’ বলল আনা আরিয়া। লেকের ধারে ভিক্টরি পার্কের একটা নির্জন স্থানে গাড়ি পার্ক করল আনা আরিয়া। এ সময় পার্কে লোক থাকে না বললেই চলে।
গাড়ি দাঁড় করিয়ে আনা আরিয়া তার ড্রাইভিং সিটেই চাওসিকোর দিকে মুখ করে বসল।
চাওসিকো বলল, ‘আনা আরেকবার ভাব। তুমি একটা খুব বড় সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছ যা তোমাকে তোমার সমাজ, স্বজন, এমনকি বাবা-মা থেকেও বিচ্ছিন্ন করতে পারে। ভেবে দেখ তুমি নিছক একটা আবেগবশত সিদ্ধান্ত নিচ্ছ না তো!’
সংগে সংগে উত্তর দিল না আনা আরিয়া। মুখ নিচু করল। বয়ে গেল কিছুটা সময়। ধীরে ধীরে মুখ তুলল এক সময়।
তার মুখ গম্ভীর। দুই চোখ ভরা অশ্রু। বলল সে, ‘বড় বিষয় বলেই অনেক ভেবেছি। আমার ভাবনার শুরু সেই রাতের পর থেকে। সে রাতের পরই আমি প্রথম বুঝলাম, সব মানুষ মানুষ নয়। চারদিকে আমি মানুষ নামের পশুদের দেখতে লাগলাম। আমার বড় ভাবনার বিষয় ছিল, প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত রাতে একটা নির্জন বাড়িতে দুর্যোগতাড়িত হয়ে আশ্রয় নেয়া এক সুন্দরী কুমারিকে উপেক্ষা করতে পারল যে সুন্দর যুবক, সে কীভাবে এমন সোনার মানুষ তৈরি হলো! এই চিন্তার মধ্যেই তোমার সাথে আমার দেখা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরিতে। সেদিন আমার জিজ্ঞাসার জবাব পেলাম, তার ধর্ম ইসলাই তাকে এমন সোনার মানুষ তৈরি করেছে। সেদিন তোমার কাছে ইসলাম সম্পর্কে আরও জেনেছিলাম। বুঝেছিলাম ইসলামই আজকের পৃথিবীর একমাত্র জীবন্ত ধর্ম। সেদিন থেকেই আমার মন বদলের শুরু। সেদিনই আমি একজন বিশ্ববিখ্যাত গায়কের কনসার্টে গিয়েছিলাম, কিন্তু একেবারেই বিস্বাদ লেগেছে, মঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকতেও আমার রুচি হয়নি। অথচ সেদিনের আগে পর্যন্ত কনসার্ট ছিল আমার প্রাণ। মন. বদলের সাথে আমার চোখ বদলে গেছে, কান বদলে গেছে, রুচি বদলে গেছে, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি আমার সম্পূর্ণই বদলে গেছে চাওসিকো। আজ গাড়িতে তোমার কথাগুলো পুরানো আনা আরিয়াকে একদম ধ্বংস করে দিয়েছে, নতুন আনা আরিয়া এখন ইসলামের আশ্রয় ছাড়া বাঁচবে না। একটা বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে মনের যে স্থিরতা দরকার, আল্লাহ তা আমাকে দিয়েছেন। আমার সিদ্ধান্ত সুস্পষ্ট, অনড় চাওসিকো।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আনা আমি শাহাদাহ পাঠ করছি, তুমিও আমার সাথে পাঠ কর। প্রথমে আরবিতে তারপর তোমার নিজ ভাষায়। চাওসিকো বলল।
নিজেই প্রথমে বিসমিল্লাহ পড়ল আনা আরিয়া। তারপর চাওসিকোর অনুসরণে শাহাদাহ পাঠ করল, প্রথমে আরবিতে, তারপর নিজের ভাষায়।
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ বলল দুইজনেই শাহাদাহ ঘোষণার পর।
মুখ গম্ভীর আনা আরিয়ার। তার দু’চোখ দিয়ে নামছে নীরব অশ্রুর দু’টি ধারা। চাওসিকো টিস্যু বক্স থেকে একখণ্ড টিস্যু নিয়ে এগিয়ে দিল আনা আরিয়ার দিকে।
‘থাক চাওসিকো, অশ্রু নামতে দাও। এ পাওয়ার অশ্রু, আনন্দের অশ্রু। অনেক দুর্লভ এই অশ্রু। অনেক চাওয়ার পর পাওয়া থেকেই এ অশ্রু নামে। বলল আনা আরিয়া।
‘নতুন জীবনে তোমাকে অভিনন্দন আনা আরিয়া। চাওসিকো বলল। ‘এ নতুন জীবনের কারিগর আল্লাহর পর এ মাটির পৃথিবীতে তুমিই। তুমি আমাকে বদলে দিয়েছ। তোমাকে আমার অভিনন্দন।’ বলল আনা আরিয়া।
‘আমাকে যিনি বদলেছেন, তিনিই তোমাকে বদলে দিয়েছেন। মানুষকে বদলাবার মালিক একমাত্র তিনিই আনা।’ চাওসিকো বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। চাওসিকো তুমি আমাকে ‘আনা’ বলেই ডাকবে। তোমার ‘আনা’ ডাকের চেয়ে মিষ্টি আমার কাছে আর কিছু নেই। এটুকু দয়াময় আল্লাহ মাফ করবেন। সীমালংঘন থেকে অবশ্যই আমরা দূরে থাকব ইনশাআল্লাহ।’ বলে গাড়িতে স্টার্ট দিল আনা আরিয়া।
গাড়ি বেরিয়ে এলো পার্ক থেকে। ছুটে চলল গাড়ি লেক ভিউ এভিনিউ ধরে।
‘কোথায় আমরা যাচ্ছি আনা?’ জিজ্ঞাসা চাওসিকোর।
‘কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে।’ বলল আনা আরিয়া।
‘রেস্টুরেন্টে?’ প্রশ্ন চাওসিকোর।
‘হ্যাঁ রেস্টুরেন্টে। বাবা বড় বিজ্ঞানীকে লাঞ্চ করাবেন, আর আমি লাঞ্চ করাব ছোট বিজ্ঞানীকে।’ বলল আনা আরিয়া। তার ঠোঁটে এক টুকরো হাসি।
‘আমাকে ছোট বিজ্ঞানী বলছ?’ চাওসিকো বলল।
‘বড় বিজ্ঞানী তো হওনি, হলে বড় বিজ্ঞানীই বলব।’ বলল আনা আরিয়া। তার ঠোঁটের হাসি আর একটু বড় হয়েছে।
‘তা নয়। আমাকে বিজ্ঞানী বলছ কেন। তিলকে তাল করা ঠিক নয়।’ চাওসিকো বলল।
‘জান বিজ্ঞানী ইডেলম্যান বিজ্ঞানের ঐ জটিল প্রশ্নগুলোর আলোচনায় কতবার তোমার নাম করেছেন? ঐ তিনটি প্রশ্নের আলোচনায় তিনি তোমার ব্যাখ্যাকে এনডোর্স করে বলেছেন, ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের অনুসন্ধান ও ব্যবহারে স্রষ্টার ইচ্ছা ও অভিপ্রায় সন্ধান করতে হবে। তাঁর মতো বিজ্ঞানীর এই স্বীকৃতি তোমাকে তো বিজ্ঞানী বানিয়ে দিয়েছে। বলল আনা আরিয়া।
‘তার মতো বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের ছাত্রদের ব্যাপারে অমন উদার হয়েই থাকেন। আমার ব্যাপারে তিনি যা বলেছেন, সেটা তাঁর উদারতা। ওটাকে দলিল না বানানো উচিত।’ চাওসিকো বলল।
‘ব্যাপার তা নয় চাওসিকো। তাঁর তিনটি প্রশ্ন বত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরেছে। মনোপুত জবাব তিনি পাননি। তোমার কাছে পেয়েছেন। সুতরাং ওটা উদারতা নয়, সত্যের স্বীকৃতি। তাঁর দেয়া তোমার কোর্টপিন তার সাক্ষ্য বহন করে চলবে।’
কথা শেষ করেই চাওসিকোকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, ‘সত্যি চাওসিকো, সব শিক্ষক, সব ছাত্র, সবাইকে তুমি অবাক করেছ। সবাই ভবিষ্যতের প্রতিভাবান বিজ্ঞানী হিসেবে তোমাকে দেখছে। আমি তোমাকে ছোট বিজ্ঞানী বলে দোষ করিনি। যাক, এই স্মরণীয় অকেশনে তোমাকে একটা গিফট দেবার ইচ্ছা করছে আমার।’ বলল আনা।
‘গিফট তুমি দিয়েছ।’ চাওসিকো বলল।
‘গিফট দিয়েছি? কি বল তুমি?’ বলল আনা আরিয়া।
‘দুইটা গিফট দিয়েছ।’ চাওসিকো বলল।
‘সেটা কি অদৃশ্য বস্তু? অদৃশ্য হলেও তো আমি জানব, গিফট যদি আমার হয়।’ বলল আনা আরিয়া।
‘হ্যাঁ, তাকে অদৃশ্যই বলতে হবে।’ চাওসিকো বলল।
‘বল, এখনি বল। না হলে ঐ সামনে গাড়ি দাঁড় করাব। না বললে গাড়ি চলবে না।’ বলল আনা আরিয়া।
চাওসিকো গম্ভীর হলো। বলল, ‘একটি পুরস্কার তোমার ইসলাম গ্রহণ। আমার জন্যে এটা একটা বড় পুরস্কার।’
আনা আরিয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমাকে ধন্যবাদ চাওসিকো, তুমি একে তোমার জন্যে গিফট মনে করেছ। এবার দ্বিতীয়টা কি বল?’
‘তুমি আমাকে ‘আনা’ বলে ডাকার অধিকার দিয়েছ, এটা দ্বিতীয় পুরস্কার।’ চাওসিকো বলল।
কোনো উত্তর এলো না আনা আরিয়ার কাছ থেকে। আনা আরিয়ার চোখ দু’টি ছিল সামনে স্থির। চোখ দু’টিতে আলোর এক চমক যেন খেলে গেল। সলাজ এক অনুরাগ রাঙিয়ে দিল তার গোটা মুখ। স্নিগ্ধ শিহরণের একটা প্রবাহ খেলে গেল তার গোটা দেহে। তার মাথাটা কিছুটা নুয়ে পড়ল। আনা আরিয়া তার গাড়িটা সরিয়ে নিল রাস্তার পাশে, এটা গাছের ছায়ায়।
ড্রাইভিং সিটে বসেই নিজের মুখটা ঘুরিয়ে নিল আনা আরিয়া কাবার দিকে। একটা সিজদা করল সে সিটে বসেই। ‘আল্লাহু আকবার’ বলে মুখ তুলে বলল আলহামদুলিল্লাহ। অশ্রুধোয়া রাঙা মুখ তুলে তাকাল সে চাওসিকোর দিকে। বলল, ‘আল্লাহর অসীম দয়া, শাহাদার ঘোষণা দেয়ার পর একাকিত্বের শংকা যখন আমার সামনে, তখন তুমি এসে আমার হাত ধরলে। অনেক ধন্যবাদ চাওসিকো।’ কান্নায় ভেঙে পড়ল আনা আরিয়ার শেষ কথাগুলো।
‘ওয়েলকাম আনা, একজন বিশ্বাসী মুসলিমের যা করণীয়, তুমি তাই করলে। একজন মুমিনের সব কাজ, সব চাওয়া, সব পাওয়া এভাবে আল্লাহমুখী হওয়া উচিত। আল্লাহ তোমাকে তাঁর অশেষ বারাকায় ধন্য করুন। আর আল্লাহ আমাদের মাফ করুন। তাঁর রহম ও করম দিয়ে আমাদের ঘিরে রাখুন।’ চাওসিকো বলল
‘আমিন।’ বলল আরিয়া।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিল আনা আরিয়া। ছুটে চলল গাড়ি ভালো রেস্টুরেন্টের উদ্দেশে।
.
মায়ের ঘরে ঢুকতে গিয়েও থেমে গেল আনা আরিয়া
মায়ের ঘরে বাবার কণ্ঠ শুনতে পেল। বাবা ‘হ্যালো’ বলে কার যেন কল রিসিভ করল। কল রিসিভ করে বলে উঠল, ‘গুড ইভেনিং মি. বাতিস্তা সান্ড্রি। কখন পৌঁছলেন বাসায়?’
মধ্য আফ্রিকা চার্চ আন্দোলনের নেতা এবং মধ্য আফ্রিকা কাউন্সিল অব চার্চের সভাপতি বাতিস্তা সান্ড্রি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজির ছিল। বিকালে চার্চ কাউন্সিলের একটা জরুরি বৈঠক ছিল। সেখানে আনা আরিয়ার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্টিফেন ফোবিয়ান এবং বাতিস্তা সান্ড্রি দু’জনেই উপস্থিত ছিল।
ও প্রান্ত থেকে বাতিস্তা সান্ড্রির কথা শোনার পর আনা আরিয়ার বাবা বলল, ‘এইমাত্র পৌঁছেই আবার টেলিফোন! জরুরি কিছু?’
বাতিস্তা সান্ড্রির দীর্ঘ বক্তব্য শুনে আনা আরিয়ার বাবা একরাশ উচ্ছ্বাসের সাথে বলল, ‘তাহলে ভ্যাটিকানের খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে আমরা স্টুডেন্ট ডেলিগেশন পাঠাতে পারছি। গুড। স্টুডেন্ট ডেলিগেশনের নেতা হিসাবে চাওসিকোকে আপনার চয়েস আমার খুব ভালো লেগেছে। তাকে দ্রুত বাগে আনার ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত আমাদের দারুণ সহায়ক হবে। আপনি ঠিকই বলেছেন তার মতো অসাধারণ প্রতিভাকে আমরা ছাড়তে পারি না। হয় সে আমাদের হবে, না হয় কারোই হবে না সে। তবে আমাদের খারাপ চিন্তা করতে হবে না। তাকে বাগে আনার সব চেষ্টাই আমরা করছি।’ থামল আনা আরিয়ার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান।
ওপার থেকে কথা বলল বাতিস্তা সান্ড্রি। আনা আরিয়ার বাবা বলল, ‘ওকে মি. সান্ড্রি, যিশু আমাদের সহায় হোন। বাই।’
কথা শেষ করে মোবাইল’ রেখে দিতে দিতে আনা আরিয়ার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান বলে উঠল, ‘শিলা, আজ একটা ভালো দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে ভালো দিন সেটা তো দেখেই এলে। উন্নত বিশ্বের জগত বিখ্যাত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে আমরা শীর্ষে উঠে গেলাম। আরেকটা বড় খবর হলো, ভ্যাটিক্যানের খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে অংশগ্রহণের সুযোগ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়া হয়েছে এবং সে প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে চাওসিকোকে মনোনীত করেছি আমরা।’
‘ঠিক দু’টিই খুশির খবর। তবে দ্বিতীয় খবরে খুশির সাথে উদ্বেগও আছে। চাওসিকো শুধু অসাধারণ প্রতিভা নয়, তার সাথে ছেলেটিকে আমার খুব নীতিনিষ্ঠ এবং নির্ভিকও মনে হয়েছে।’ বলল শিলা, আনা আরিয়ার মা।
‘দেখ নামের বিষয় নিয়ে সে আমাদের সাথে আপোষ করেছে, তার নীতি থেকে সে সরে এসেছে। নীতি থেকে যখন কিছুটা সরে এসেছে, আরও সরতে পারে। আর না সরে তার উপাই নেই শিলা। শুনলে না মি. বাতিস্তার সাথে কথা হলো, হয় সে আমাদের হবে, না হয় কারোই হবে না।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
‘না স্টিফেন, তাকে নিয়ে খারাপ চিন্তা করো না। সে খুব ভালো ছেলে। মায়া ধরানোর মতো ছেলে সে। আনা আরিয়ার মা শিলা বলল।
‘আরেকটা বড় খবর আছে, তোমার মেয়েকে ডাক। বলল আনা : আরিয়ার বাবা স্টিফেন ফোবিয়ান।
মায়ের ঘরে দরজার ওপাশে দেয়ালে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ানো আনা আরিয়া উদ্বেগ-আতংকে আড়ষ্ট। তার মুখ হয়ে গেছে ফ্যাকাশে। বুকের ভেতরটা তার কাঁপছে। তার মনে চিন্তার সাইক্লোন। ভ্যাটিকানের খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে প্রতিনিধিদলের নেতা হয়ে বা একজন হয়ে চাওসিকোর যাওয়া কি সম্ভব! না গেলে কি হবে, সেটার ইংগিত তো সে পেয়েছে। চাওসিকো হয় তাদের হবে, তা না হলে সে কারোই হবে না। কথাটা মনে করতেই গোটা দেহ কেঁপে উঠল আনা আরিয়ার।
বাবা-মায়ের শেষ কথা, তাকে ডাকার বিষয়, শুনতে পেল আনা আরিয়া। দৌড় দিয়ে সে তার ঘরের দিকে চলে গেল। ঢুকল ওয়াশরুমে। মুখ-চোখ ধুয়ে নিল ভালো করে। তোয়ালেই মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো। তার মা’র সাথে মুখোমুখি দেখা হলো। তার মা বলল, ‘ডাকলাম, তুমি বোধ হয় শুনতে পাওনি। ঘুমিয়ে ছিলে? চল তোমার বাবা আমার ঘরে, ডাকছেন তোমাকে।’
‘চল মা।’ তোয়ালেটা হাত থেকে রাখতে রাখতে বলল আনা আরিয়া।
আনা আরিয়া তার মায়ের সাথে তার মায়ের ঘরে ঢুকল।
‘এসো মা।’ বলে তার সোফার এক পাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দিল আনা আরিয়াকে।
আনা আরিয়া পিতার সাথে না বসে তার পাশের সোফাটায় বসল। তার মা গিয়ে বসল তার পিতার পাশে।
‘মুখটা তোমার কেমন যেন লাগছে। রোদে ঘুরেছ বুঝি? চাওসিকোকে নিয়ে তুমি কোথায় গেলে?’ বলল আনা আরিয়ার বাবা ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান, পোর্ট ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি।
‘রেস্টুরেন্টে বাবা। বাবার দিকে চোখ তুলে বলল আনা আরিয়া।
‘গুড। চাওসিকোর সাথে তোমার পরিচয় কবে হলো?’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
‘লাইব্রেরিতে বাবা। ও খুব পড়ুয়া ছেলে। আনা আরিয়া বলল।
‘পড়ুয়া তো হবেই। সে তো আজ গোটা দুনিয়াকে অবাক করে দেয়ার মতো কাজ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় আজ গর্বিত তাকে নিয়ে। তুমি তো এক সময় খুব ক্ষেপা ছিলে তার উপর।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
‘আমি ক্ষ্যাপা ছিলাম তার উপর! কবে? কেন?’ আনা আরিয়া বলল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘ঐ যে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা হলো, তুমি দ্বিতীয় হয়েছিলে, প্রথম হয়েছিল সে। তুমি কাঁদাকাটি করেছিলে খুব। তোমাকে আমরা…।’
বাবার কথার মাঝখানেই আনা আরিয়া বলে উঠল, ‘সে তো অ্যাডাম আব্রাহামের কথা বাৰা, যাকে তোমরা নাম বদলাতে বাধ্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলে।’
‘সেই অ্যাডাম আব্রাহামই তো এই চাওসিকো। তার পুরো নাম আড্যাম আব্রাহাম চাওসিকো। আর নাম বদলাবার আগে তার মুসলিম নাম ছিল আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো। কেন তাকে তার নাম জিজ্ঞাসা করনি?’
আনা আরিয়ার মনে বিস্ময়, আনন্দ দুই-ই। বলল সে, ‘না বাবা জিজ্ঞাসা করিনি। নিজ থেকে তার নাম চাওসিকো বলেছে। আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি।’
‘আসলেই সে এক বিস্ময়কর প্রতিভা মা। বিশ্বের বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ভর্তির চেষ্টা ভণ্ডুল করে দিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে তাকে আমরা বাধ্য করেছি। আমাদের সিদ্ধান্ত যে কতটা সঠিক ছিল, আজ নতুন করে তার আমরা প্রমাণ পেলাম। যিশুকে অশেষ ধন্যবাদ যে, তোমার সাথে তার সুসম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। শুরু থেকেই এটা আমরা চেয়েছিলাম। আমরা যদি তাকে আমাদের করে নিতে পারি, তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় উপকৃত হবে, সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে আমাদের খ্রিস্টান স্বার্থ।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
বুকের ভেতরটা কাঁপছিল আনা আরিয়ার। তার বাবার কথাই বলে দিচ্ছে সামনের দিনগুলো তাদের জনে, কত ভয়ংকর হবে। বাবার মুখে চাওসিকোর সাথে তার সম্পর্ক গড়ার কথা তার মনে এক প্রবল ঘৃণার সৃষ্টি করল। বাবা কি তার মেয়ে নিয়ে এমন কথা বলতে পারেন! খ্রিস্টান স্বার্থই কি তাহলে বাবার কাছে সব! এর মধ্যেই আনা আরিয়া যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল।
‘মা আনা, আরেকটা বড় খবর আছে মা। ভ্যাটিকানের খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় একটা প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছে। সে প্রতিনিধিদলের নেতা মনোনীত হয়েছে চাওসিকো। তুমি হবে ডিপুটি লিডার অব দ্য মিশন।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
‘কথাটা আনা আরিয়ার মনে নতুন করে আবার যন্ত্রণার সৃষ্টি করল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘চাওসিকো কি রাজি হয়েছে বাবা?’
‘রাজি হবে না কেন? এটা কত বড় একটা সম্মান! গোটা দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের কাছে সে পরিচিত হয়ে যাবে। খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদলের নেতা ও প্রতিনিধিদলের ছবি ও পরিচয় নিয়ে বিরাট আকারের স্মরণিকা বের হচ্ছে।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
‘কিন্তু বাবা, সে নাম বদলেছে বটে, মুসলমান সে রয়েই গেছে। রেস্টুরেন্টেও দেখলাম তাকে দুপুরের নামাজ পড়তে।’ আনা আরিয়া বলল। ‘ওটা একটা আবেগের ব্যাপার। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে মা। তার উপর তোমার মটিভেশন বড় কাজ দেবে বলে আমি মনে করি। তার সাথে তুমিও ভ্যাটিকান যাচ্ছ। খ্রিস্টান জগতের বিরাটত্ব, তাদের শক্তি- সামর্থ্য, প্রাচুর্য, এখানকার রঙিন জীবনের কথা বার বার তার সামনে নিয়ে আসবে। তোমাকে নিশ্চয় সে ভালো মনে করে। তোমার কথাকে, মতকে সে গুরুত্ব দেবে।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
তার বাবার কথাগুলো আনা আরিয়ার বুকে শেলের মতো বিদ্ধ হলো। তার ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছা করল। একজন বাবা তার মেয়েকে এ ধরনের কথা কীভাবে বলতে পারেন? বাবা কি খ্রিস্টান স্বার্থে অন্ধ হয়ে গেছেন?
আনা আরিয়া একটা ঢোক গিলে নিজের মনকে স্থির, শান্ত করার চেষ্টা করল। তার মনে পড়ল চাওসিকো বলেছিল, যে যাই চক্রান্ত করুক, তা সবই আল্লাহর এখতিয়ারের অধীন। তিনি না চাইলে কিছু করার সাধ্য কারও নেই। বলল সে তার বাবাকে, ‘আজ বিজ্ঞানী ইডেলম্যানের সাথে চাওসিকোর যে কথাগুলো শুনলাম বাবা, তাতে আমার মনে হয়েছে সে শুধু অসাধারণ বুদ্ধিমান নয়, সে অত্যন্ত ম্যাচিওর চিন্তার ছেলে।
সেই জন্যেই তো তাকে আমাদের বেশি প্রয়োজন। এরা পৃথিবীর বিরল প্রতিভা। তাকে আমরা খ্রিস্টানরা আমাদের করে পেতে চাই। এতে দুই কাজ হবে, মুসলমানরা বঞ্চিত হবে, আর আমরা লাভবান হবো।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা।
‘বাবা, কোনো প্রতিভাকে কি জোর করে কাজে লাগানো যায়, না তারা আন্ডার কম্পালশন কোনো কাজ করে?’ আনা আরিয়া বলল।
‘আমরা যদি তার কাজ না পাই, তাতে আমাদের ক্ষতি নেই, বিজ্ঞানী আমাদের অনেক আছে। আমাদের আসল লাভ যা, সেটা হলো, মুসলমানরা তার মূল্যবান সার্ভিস থেকে বঞ্চিত হবে। মুসলমানদেরকে চিন্তার ক্ষেত্রে দেউলিয়া বানাবার এ একটা উৎকৃষ্ট প্রোগ্রাম আনা।’ বলল আনা আরিয়ার বাবা ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান, পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটির ভিসি।
‘কিছু মনে করো না, তোমাদের ডেডলি এই প্রোগ্রামে তো জ্ঞান- বিজ্ঞানের পক্ষে নয়, একদমই বিপক্ষে। মুসলমানরা যদি এই মানসিকতার হতো, তাহলে তারা স্পেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইউরোপের খ্রিস্টান ছেলেদের ঢুকতেই দিত না এবং তাহলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ কয়েকশত বছর পিছিয়ে পড়ত অথবা ইউরোপীয় রেনেসাঁ নামের কোনো কিছু সৃষ্টিই হতো না। বলল আনা আরিয়ার মা শিলা।
আনা আরিয়ার বাবা বলল, ‘তুমি দেখি তোমার মেয়ের চেয়েও দু’ধাপ এগিয়ে। দেখ, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ঔদার্য ভালো, কিন্তু জাতীয় ক্ষেত্রে ঔদার্য ভয়ংকর। তুমি স্পেনের মুসলিম সাম্রাজ্য, ভারতের মোগল সাম্রাজ্য, আব্বাসীয় ও তুরস্কের ওসমানি খিলাফতের পতনের কারণগুলো যদি অনুসন্ধান করো অনেক বড় বড় কারণ খুঁজে পাবে, কিন্তু মূল কারণ ছিল তাদের জাতীয় নীতির ক্ষেত্রে অন্যজাতির প্রতি তোষণমূলক ঔদার্য। তুর্কি খিলাফতের অধীনে খ্রিস্টান ব্যবসায়ী ও কৃষকরা যে সুযোগ-সুবিধা পেত, তুর্কি মুসলিম কৃষক-ব্যবসায়ীরা সে সুযোগ পেত না। এটা ছিল তাদের তোষণমূলক ঔদার্য। তারা চেয়েছিল খ্রিস্টান প্রজাদের, সেই সাথে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের খুশি রাখতে। কিন্তু তাদের খুশি রাখতে পারেনি। এ নীতির কারণে অনেক মাশুল গুণতে হয়েছে তুর্কিদের। আমরা সেই ভুল করতে চাই না। আমাদের ক্রসেডের কারণ ছিল এটাই। এশিয়া-আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার ঔপনিবেশিকীকরণের ক্ষেত্রে আমরা এই ভুল করিনি।’
‘আমি সব ব্যাপার জানি না। হয়ত তোমার কথাই সত্য। কিন্তু চাওসিকোকে তোমরা ঐ ধরনের জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখো না। অমন সরল, স্বচ্ছ, নিরহংকার, সুবিবেচক ছেলে আমি দেখিনি। দেখ, অত জ্ঞানী ছেলে, কিন্তু সে তার বিদ্যা জাহির করতে চায়নি। প্রশ্নের সংগে সংগে লাফ দিয়ে দাঁড়াবার মতো অহংকার সে দেখায়নি। প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে, এ সত্ত্বেও সে অন্য কেউ দাঁড়াক, উত্তর দিক এজন্যে শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। কেউ না দাঁড়ানোয় অবশেষে সে দাঁড়িয়েছে। আমি দেখেছি, প্রতিটি উত্তরের ক্ষেত্রে সে বরাদ্দ এক মিনিট সময়ের মধ্যে মানে ৫০ সেকেন্ড পার হবার পর সে উত্তর দেয়ার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। এই একটা গুণ তাকে আমার কাছে আকাশ স্পর্শী করে দিয়েছে। আর যাই কর, এই ছেলেটা নিয়ে তোমরা কোনো খারাপ চিন্তা করো না।’ আনা আরিয়ার মা শিলা বলল।
মায়ের কথা আনা আরিয়ার গোটা দেহে একটা শান্তির পরশ বুলিয়ে দিল। সে ভেবে খুশি হলো, তার মা চাওসিকোকে ঠিক চিনতে পেরেছে। শংকিত আনা আরিয়া মায়ের মধ্যে একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেল।
স্ত্রী শিলার কথা শুনে হাসল ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান আনা আরিয়ার বাবা। বলল, ‘সব মায়েরাই এমন ভালো ছেলেদের সন্তান হিসাবে ভাবতে ভালোবাসে। যাক শোন, তাকে নিয়ে আমরা কোনো খারাপ চিন্তা করব কেন? সে ভালো ছেলে, তাকে আমাদের ভালো লেগেছে বলেই তো তাকে আমরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এনে ভর্তি করেছি। তাকে আমাদের মধ্যে আমাদের কম্যুনিটির একজন সদস্য হিসেবে আপন করে পেতে চাই। অর্থ, যশ, সম্মান, পদ সব দিক দিয়েই আমরা তাকে সম্মানের আসনে রাখতে চাই। তাকে আমরা ভ্যাটিকানে পাঠাচ্ছি এই কারণে যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা খ্রিস্টান যুৰ শক্তির সাথে কয়েকদিন ধরে মেলামেশার ফলে খ্রিস্টান বিশ্বাস ও সমাজের সাথে তার একটা একাত্মতার সৃষ্টি হবে। সবাই যিশুর কাছে প্রার্থনা করো, আমাদের এই আশা যাতে পূরণ হয়।’
‘যদি আশা পূরণ না হয়?’ জিজ্ঞাসা শিলার, আনা আরিয়ার মায়ের। তার চোখে-মুখে কিছুটা উদ্বেগ ভাব।
‘তোমার এ প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না শিলা। তবে একটা কথা পরিষ্কার জানি শিলা, নাম পরিবর্তন করে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সে খ্রিস্টান কম্যুনিটিতে প্রবেশ করেছে, তার এখান থেকে বেরুবার কোনো পথ নেই।’ বলল ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান, আনা আরিয়ার বাবা।
বলেই আনা আরিয়ার বাবা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘তোমরা মা-মেয়ে গল্প কর। আমার স্টাডিতে একটা কাজ আছে। যাই।’
বেরিয়ে গেল আনা আরিয়ার বাবা ঘর থেকে।
বাবার কথায় বুক কেঁপে উঠল আনা আরিয়ার। একটা প্রবল শক এসে যেন আঘাত করল তাকে। মুখটি তার চুপসে গেল।
আনা আরিয়ার মায়ের মুখটাও বিষণ্ন হয়ে উঠেছিল। সে তাকাল আনা আরিয়ার দিকে। আনা আরিয়াও তাকিয়েছে তার মায়ের দিকে।
আনা আরিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মায়ের কষ্টটা আরও বাড়ল। মেয়ের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে ডাকল, ‘এসো মা।’
আনা আরিয়া এসে জড়িয়ে ধরল মাকে।
মা শিলা আনা আরিয়ার মুখ নিজের মুখের কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘তুমি আমার খুব বুদ্ধিমান মেয়ে। তুমি কোনো অন্যায় সহ্য করতে পার না, প্রতিবাদী হয়ে উঠ, সেটাও ভালো মা। ভালো-মন্দ জ্ঞান তোমার আছে। তোমাকে সাবধানে চলতে হবে। তোমাকে কোনো বিপদ বা সমস্যায় জড়ানো চলবে না।’
আনা আরিয়া-মায়ের বুকে মুখ গুঁজে বলল, ‘চাওসিকো খুব ভালো ছেলে মা। অ্যানজেল আমি দেখিনি, কিন্তু মানুষ চাওসিকো অ্যানজেলের চেয়ে ভালো মা। তোমাকে এক রাতের ঘটনা এবং একটা ছেলের কথা বলেছিলাম। তুমি তাকে দেখার আশা প্রকাশ করেছিলে। চাওসিকো হলো সেই ছেলে মা। আশ্চর্যের বিষয় লাইব্রেরিতে তার সাথে একদিন আমার দেখা হয়। সে আমাকে চিনতেই পারেনি। অনেক কথা বলেছিলাম, তারপরও আমাকে চিনতে পারেনি। তার মানে সেই রাতে সে আমাকে ভালো করে দেখেইনি।
আনা আরিয়ার মা আনার মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘সে এক সোনার ছেলে আনা। কিন্তু সে যে মুসলমান! আর সব বিদ্বেষের টার্গেট এখন মুসলমানরা। তোমার বাপের কথা তো শুনলে। ছেলেটা যদি তার বিশ্বাসে অনড় থাকে, তাহলে কি ঘটবে তা ভাবতেও আমার ভয় হয়। তোমাকে কোনো বিপদে জড়াতে দিতে আমি পারবো না।’
‘মুসলমানদের বিরুদ্ধে এত বিদ্বেষ কেন মা? তারা কি দোষ করেছে?’ আনা আরিয়া বলল।
‘মুসলমানরা একত্ববাদী ধর্মের অনুসারী এবং তাদের ধর্মই সর্বকনিষ্ঠ ধর্ম। সে কারণে মানুষের জন্যে ঈশ্বরের বার্তা একমাত্র তাদের কাছে আছে বলে তাদের দাবি। দাবিটা কোনো দিক দিয়েই অমূলক নয়। কিন্তু দোষ তো তাদের এটা নয়। দোষ তাদের অস্তিত্ব, দোষ তাদের ক্রমবর্ধমান বিস্তার। এ বিস্তার না আটকালে, তাদের পেছন দিকে ঠেলে দিতে না পারলে খ্রিস্টানদের অগ্রযাত্রাই শুধু স্তব্ধ হওয়া নয়, তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। সুতরাং মুসলমানদের বিরোধিতা আসলে খ্রিস্টানদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এ কারণে এ লড়াইয়ে খ্রিস্টানরা অন্ধ, কোনো যুক্তির মূল্য তাদের কাছে নেই।’ বলল আনা আরিয়ার মা।
‘এ অন্যায় লড়াই মা। আমি যদি এর প্রতিবাদ করি? আমি সত্যকে যদি সত্য বলতে চাই, যেমন তুমি বললে। কেন…।
আনা আরিয়ার মা তার মুখ চেপে ধরে বলল, ‘খবরদার, ভুলেও তুমি এ ধরনের কথা আর মুখে আনবে না। বরং মা তুমি চেষ্টা করো চাওসিকোকে এ দিকে ফেরাতে। এতে তারও মঙ্গল, আমাদেরও মঙ্গল।’
কোনো জবাব দিল না আনা আরিয়া।
গোটা বুক তার তোলপাড় করে উঠল। মা এটুকুই সহ্য করতে পারছে না, তার ইসলাম গ্রহণের কথা শুনলে মা তাহলে কেমন হবে, কি করবে! বুকের তোলপাড়টা তার বাড়ল। মনকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করল আনা আরিয়া। মা-বাবাকে সে ভালোবাসে। ভালোবাসে সে চাওসিকোকে। সে ভালোবাসে আল্লাহর পথ ইসলামকে। মা-বাবাকে ভালোবাসা তার শেষ দু’টি ভালোবাসার বিকল্প নয়। এই সত্যটা তার বুক ভেঙে দেয়ার মতো, কিন্তু তবু এটাই সত্য।
একদম চুপ হয়ে গিয়েছিল, আনা আরিয়া মায়ের বুকে মুখ গুঁজে। মা শিলা তার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘চিন্তা করো না মা। ঈশ্বরকে ডাক। তিনি সাহায্য করবেন নিশ্চয়।’
আনা আরিয়া মুখ তুলল মায়ের বুক থেকে।
.
রাত ৯টা।
চাওসিকো তার পড়ার টেবিলে এসে বসল খাওয়া-দাওয়া শেষে। একটা বই টেনে নিচ্ছিল পড়ার জন্যে। এমন সময় তার মোবাইল বেজে উঠল।
কল রিসিভ করল সে। ওপার থেকে কথা বলল ভিসির পিএ। বলল, ‘ভিসি স্যার কথা বলবেন আপনার সাথে।’
‘ঠিক আছে, দিন তাঁকে।’ বলল চাওসিকো।
ওপার থেকে ভিসি’র ‘হ্যালো’ সম্বোধন কানে আসার সাথে সাথে চাওসিকো বলল, ‘গুড ইভেনিং স্যার, আমি চাওসিকো বলছি স্যার।’
‘গুড ইভেনিং। তুমি সব সময় তোমার নামের এক তৃতীয়াংশ বল কেন? তুমি অ্যাডাম আব্রাহাম চাওসিকো। বলল ভিসি।
‘এক্সকিউজ মি স্যার। আমার দুই নামের কমন হলো চাওসিকো। সে জন্যে চাওসিকো নামটাই সব সময় ব্যবহার করি স্যার।’ চাওসিকো বলল।
তুমি খুবই বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার আজকের অসাধারণ পারফরমেন্সের জন্যে আবারো তোমাকে ধন্যবাদ চাওসিকো। তোমার জন্যে একটা বড় সুখবর আছে চাওসিকো।’ বলল ভিসি স্টিফেন ফোবিয়ান।
‘কি খবর স্যার? জানতে পারি?’ চাওসিকো বলল।
‘অবশ্যই চাওসিকো। রোমের ভ্যাটিকানে খ্রিস্টান যুব কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার শত বার্ষিকী পালন হচ্ছে। সে কংগ্রেসে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা প্রতিনিধিদল যাচ্ছে। সে প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দান করবে তুমি।’ বলল ভিসি স্টিফেন ফোবিয়ান।
চাওসিকোর চোখ-মুখ মুহূর্তেই অন্ধকারে ছেয়ে গেল। এক পোঁচ কালি যেন কেউ ছড়িয়ে দিল তার মুখে। তার চিন্তা-চেতনায় একটা বিমূঢ় ভাব নেমে এলো। সংগে সংগেই সে কিছু বলতে পারল না।
নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে নিয়ে চাওসিকো বলল, ‘স্যার, খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে পাঠানো প্রতিনিধিদলে আমার শামিল হওয়া, তার নেতৃত্ব দেয়া আমার জন্যে কি উচিত হবে? আপনি তো জানেন স্যার, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির শর্তে আমি খ্রিস্টান নাম গ্রহণ করলেও, আমি তো একজন মুসলিম স্যার। প্রতিনিধি দলে আমার অংশগ্রহণ, নেতৃত্বদান প্রতিনিধিদলের জন্যে এবং আমার জন্যেও বিব্রতকর হবে এবং সমস্যাও হবে স্যার।’
‘চাওসিকো, তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত জানালাম। এখানে তোমার মত প্রকাশের সুযোগ নেই। সিদ্ধান্ত ফাইনাল। তুমি প্রস্তুতি গ্রহণ করো। রাখছি চাওসিকো। বিশ্ববিদ্যালয় ও আমি তোমার শুভ কামনা করছি।’ কথা শেষ করল ভিসি স্টিফেন ফোবিয়ান।
কথা শেষ হলো। মোবাইলটা টেবিলে রাখল চাওসিকো।
মনে হলো, তার হাত কিছুটা কাঁপল। তার মনে প্রবল ঝড়। বিদ্রোহের ঝড়। বিস্বাদে ভরে গেছে তার মনটা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় থেকে তার উপর জুলুমের শুরু। মনে হয় জুলুমটা চূড়ান্ত রূপ নিতে যাচ্ছে। একজন মুসলিম কি করে ভ্যাটিক্যানের মতো জায়গার একটা অনুষ্ঠানে খ্রিস্টান যুব প্রতিনিধিদলকে নেতৃত্ব দিতে পারে! বিশ্ববিদ্যালয় এই সিদ্ধান্তই নিয়েছে। এখন সে কি করবে? মনের বিদ্রোহ কি বাইরে প্রকাশ করার সাধ্য তার আছে? মনে মনে ভাবল, তবে একটা কাজ সে করতে পারে, সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেয়া, পড়াশুনার ইতি ঘটানো। কিন্তু খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করা তার জন্যে যেমন কঠিন, তেমনি কঠিন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেয়া, লেখাপড়ার ইতি ঘটানো। কি করবে সে? সে আর টেবিলে বসে থাকতে পারছে না। মনের সাথে সাথে দেহটাও তার দুর্বল হয়ে পড়েছে।
সে পড়ার টেবিল থেকে উঠল। শুয়ে পড়ল গিয়ে তার বেডে। অস্থির মন তার। শুয়ে শুধুই এপাশ-ওপাশ করতে লাগল।
কত কথা তার মনে জাগছে। বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে তাকে এ সংকটে পড়তে হতো না। হয়তো আল্লাহর ইচ্ছা নয়, সে কারণেই বাইরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আল্লাহর ইচ্ছা না থাকলে পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ে সে নিশ্চয় ভর্তি হতো না। তাহলে তাকে নিয়ে আল্লাহর ইচ্ছা কি? আমি তো আল্লাহরই মুখাপেক্ষী। ঈমানদার বান্দাদের তিনি নেগাহবান। আমার এই সংকটে আল্লাহর দয়া আমি চাই, পথ তিনিই আমাকে দেখাবেন।
অশ্রুতে দুই চোখ ঝাপসা হয়ে গেল চাওসিকোর। তার দু’গণ্ড বেয়ে নেমে এলো অশ্রুর দুই ধারা। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল চাওসিকো। মোবাইলের শব্দে ঘুম ভাঙল চাওসিকোর।
মোবাইলটা টেনে কল অন করতেই ওপার থেকে কণ্ঠ পেল আনা আরিয়ার। সালাম দিল আনা আরিয়া চাওসিকোকে।
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম’ বলে চাওসিকো সালামের উত্তর দেয়ার সংগে সংগেই আনা আরিয়া বলল, ‘তোমার গলা ভাঙা কেন? তুমি ভালো নেই না?’ ভারি কণ্ঠ আনা আরিয়ার।
‘তোমার গলা পানি ভরা মেঘের মতো কেন? মনে হচ্ছে তুমি কেঁদেছ। বলল চাওসিকো।
‘অল্প একটু কেঁদেছি। তুমি আবার একে…।
আনা আরিয়ার কথার মধ্যেই চাওসিকো বলে উঠল, ‘দেখ, কাঁদার মধ্যে অল্প বা বেশি এরকম কোনো বিষয় নেই। মানুষ যতটুকু কাঁদার ততটুকুই কাঁদে। কিন্তু কেঁদেছ কেন, সেটা বল।
‘আমার প্রশ্নের আগে উত্তর দাও।’ বলল আনা আরিয়া।
চাওসিকোর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। মুহূর্তের নীরবতার পর বলল, ‘ভালো আছি বললে মিথ্যা বলা হবে আনা।’ কণ্ঠ তার গম্ভীর শোনাল।
‘সেটা আমি বুঝেছি। অফিস থেকে তোমাকে টেলিফোন করেছিল না?’ বলল আনা আরিয়া।
‘আফিস নয়, তোমার বাবা টেলিফোন করেছিলেন আনা। চাওসিকো বলল।
‘বাবা? তাই হবে, বাবা বিষয়টাকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘তুমি কখন বিষয়টা জেনেছ?’ বলল চাওসিকো।
‘সন্ধ্যার পর মায়ের ঘরে মাকে বাবা এসব কথা বলছিলেন। আমি মায়ের ঘরে ঢুকতে গিয়ে আড়ি পেতে প্রথম এই কথা শুনি। খুব খারাপ লাগে আমার, আমি চলে যাই আমার ঘরে। পরে বাবা আমাকে মায়ের ঘরে ডেকে নেন এবং খুব বড় সুসংবাদ হিসেবে বাবা বিষয়টা আমাকে জানান এবং আরও বলেন যে, আমিও ঐ প্রতিনিধিদলে আছি এবং আমি ডেপুটি লিডার।’ আনা আরিয়া বলল।
‘তুমি ডেপুটি লিডার? তার মানে এক সাথে দুই মুসলিমকে কুরবানির ব্যবস্থা!’
‘সেটাই চাওসিকো।’ আনা আরিয়া বলল। কম্পিত ও কান্না জড়িত কণ্ঠস্বর তার।
ভেঙে পড়ো না আনা। আল্লাহর উপর ভরসা করো। দুনিয়ার সবকিছু তারই নিয়ন্ত্রণে। দেখ, আমার সামনে দুইটা পথ- হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেয়া, নয়তো প্রতিনিধিদল নিয়ে ভ্যাটিকানে যাওয়া। দুটিই আমার জন্যে কঠিন। এই অবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তার ইচ্ছায় যা ঘটবে, তার উপর নিজেকে ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আনা। এসো, আমরা এটাই করি।’ বলল চাওসিকো।
‘ধন্যবাদ চাওসিকো। তুমি অনেক বোঝ, অনেক বড় তুমি, আল্লাহকে যেভাবে তুমি চিন, আমি সেভাবে চিনে উঠতে পারিনি। আমার জন্যে দোয়া করো। আমি যেকোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি যেন দাঁড়াতে পারি। বাবারা খুব অন্যায় করছেন। বাবাদের এ সিদ্ধান্তের আমি প্রতিবাদ করেছি। জেনে বুঝে তারা কেন একজন মুসলিমকে খ্রিস্টান যুব কংগ্রেসে পাঠাচ্ছেন। মা’ও আমার পক্ষ নিয়ে বাবাকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। তার একই কথা চাওসিকোর আমরা ক্ষতি করছি না, তার উপকার করছি। আর কি করার আছে বলো?’ আনা আরিয়া বলল। তার কথা শেষের দিকে আবার ভারি হয়ে উঠেছিল
কিছু করার নেই আনা। আমি শুধু একটা কাজই করতে পারি। সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেয়া।’
‘তুমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে বাঁচবে, আমি বাঁচব কি করে? তুমি তোমার ঈমান রক্ষা করতে পারবে, আমার ঈমান রক্ষা কীভাবে হবে?’ কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল আনা আরিয়া।
‘তুমি কথাটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছ। আমি তো একটা বিকল্পের কথা বলেছি।’ বলল চাওসিকো।
‘না, তুমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার কথা বলবে না কখনও। তুমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লে আমাকে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লে চলবে না, বাড়িও ছাড়তে হবে আমাকে।’ কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে আনা আরিয়া বলল।
‘আগাম এসব ভাবতে নেই আনা। তোমার আমার সব ভাবনা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। মানুষের ইচ্ছায় কিছু ঘটে না, যদি আল্লাহ ইচ্ছা না করেন। এসো আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করি।’ বলল চাওসিকো।
‘আমার ভরসা আল্লাহর উপরই চাওসিকো। এখন বলো ভ্যাটিকান যাওয়া নিয়ে আমাদের করণীয় কি?’ আনা আরিয়া বলল।
‘কিছুই করণীয় নেই। ভিসি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন, সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত ইনফরমেশন আমাকে জানানো হয়েছে। আমার মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই। সুতরাং করণীয় কি থাকবে? সর্বোচ্চ ব্যক্তি তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন।’ বলল চাওসিকো।
‘কেন, রিভিউ আবেদনের সুযোগ সুপ্রিমকোর্টের রায়ের ক্ষেত্রেও আছে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘বিশ্ববিদ্যালয় সুপ্রিমকোর্ট নয়।’ বলল চাওসিকো।
‘তার মানে ভ্যাটিকানে আমাদের যেতে হচ্ছে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘তাও বলতে পারছি না। এর মধ্যে আল্লাহ কিছু না ঘটালে, আল্লাহর যা ইচ্ছা সেটাই হবে।
‘আমি তোমার এই চিন্তার সাথে একমত চাওসিকো। আচ্ছা চাওসিকো একটা কথা কি বলতে পার, যদি আমাদের যেতেই হয়, তাহলে আমাদের সমস্যা কি কি হবে।’ আনা আরিয়া বলল।
‘আমার কোনো ধারণা নেই। এ ব্যাপারে চিন্তা এখন করতেও চাই না। এমন চিন্তার অর্থ হবে ভ্যাটিকানে যাওয়া আমরা শিরধার্য করে নিয়েছি। আমি তা করতে চাই না। আল্লাহর ইচ্ছার উপরই নির্ভর করতে চাই।’ বলল চাওসিকো।
‘ধন্যবাদ চাওসিকো। তোমার কাছে অনেক কিছু শিখছি।
কথা শেষ করেই আনা আরিয়া কণ্ঠটা একটু নামিয়ে বলল, ‘আমার দরজায় নক হচ্ছে চাওসিকো। নিশ্চয় মা এসেছেন। আমি এখন রাখছি। পরে কথা বলব। বাই। সালাম।’
‘ঠিক আছে। আসসালামু আলাইকুম।’
কল অফ করল চাওসিকো।