২
আহমদ মুসা বুজুমবুরার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে বের হয়ে পার্কিং-এ এসে গাড়িতে উঠল। এটা ম্যাকাওদের দেয়া সেই গাড়িটাই।
গাড়ির সিটে বসে পকেট থেকে রুমাল বের করে নিয়ে মুখটা ভালো করে মুছে নিল। চোখে-মুখে তার কিছুটা ক্লান্তির চিহ্ন।
ভোরে ইউজিজি থেকে যাত্রা করে সকাল আটটায় এসে পৌঁছেছে সে বুজুমবুরায়। সকাল আটটা থেকে দশটার মধ্যে সে চীন, মার্কিন, রুশ, সৌদি আরব ও মধ্যএশিয়ার দূতাবাসে গেছে। বুজুমবুরা নিয়ে তাদের সাথে কথা বলেছে। নতুন কিছু বিষয়ে তাদের সাথে মত বিনিময় করেছে। সব শেষে সে এসেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে। গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তার এখানে। সবচেয়ে বড় কাজ ছিল তার অস্ত্রগুলোর অ্যাক্রেডিটেশন নেয়া। দেশীয় ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা কর্মীদের বাইরে কাউকে এ ধরনের অ্যাক্রেডিটেশন দিতে হলে সরকার প্রধানের সম্মতি লাগে। এ নিয়ে আহমদ মুসার কোনো অসুবিধা হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ বারনাবী মোনিমনা আহমদ মুসার নাম শুনেই উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘বসুন জনাব। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কয়েকদিন আগে আপনার ব্যাপারে আমাকে বলেছেন।’
হ্যান্ডশেক করে আহমদ মুসা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দু’জনেই বসে পড়ে।
‘জনাব, ফরমালিটি ও প্রয়োজনীয় স্পেসিফিকেশনের জন্য কাগজপত্র একটু দেখতে হয়।’ আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘অবশ্যই জনাব।’ বলে পকেট থেকে কাগজপত্র বের করতে করতে আহমদ মুসা বলেছিল, ‘অস্ত্রগুলো?’
‘প্রয়োজন নেই। তবে আপনি একটু কষ্ট করলে, আমার আনন্দ হতো, অস্ত্রগুলো আমি দেখার সুযোগ পেতাম। আপনার ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে অনেক কথা বলেছেন। আপনি আমাদের রাষ্ট্রের মেহমান হলে তিনি খুব খুশি হতেন। কিন্তু আপনি নাকি স্বাধীনভাবে থাকতেই পছন্দ করেন। এমনকি আমেরিকা, রাশিয়া, চীনেও নাকি আপনি এভাবেই থেকেছেন।’ বলেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘স্বাধীনভাবে থাকা সবারই পছন্দ। আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন করেই সৃষ্টি করেছেন।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
‘কিন্তু জনাব, সব মানুষ স্বাধীন হলে বা স্বাধীন থাকতে চাইলে তো বিপদ।’ বলেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘মানুষ কোনো ব্যক্তির নয়, আইনের অধীন হবে। তাহলে আর কোনো বিপদের ভয় থাকে না।’ আহমদ মুসা বলেছিল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চোখে-মুখে বিস্ময় ও প্রশংসার জড়াজড়ি। বলেছিল সে, ‘জনাব, আপনি খুব ভারি কথা বলেছেন, খুব সাংঘাতিক কথা বলেছেন। আমাদের বাস এমন এক সমাজে যেখানে আমি এবং আমরা এ কথা বলিও না, মানিও না। অথচ এটাই দরকার ছিল। আপনাকে ধন্যবাদ জনাব।’
আহমদ মুসা কাগজপত্র এবং তার অস্ত্রগুলো বের করে টেবিলে রেখেছিল।
‘ধন্যবাদ’ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঝুঁকে পড়ে অস্ত্রগুলো এক নজর দেখে নিয়ে বলল, ‘বলেছি না জনাব। অস্ত্রগুলো দেখলে আমি খুশি হবো। এ অস্ত্র তিনটির প্রত্যেকটিই আমাদের কাছে নতুন। এর কোনোটিই আমাদের দেশে এখনও আসেনি। এম-১০ আমাদের আছে, কিন্তু এম-১৬ আমরা ছবিতে দেখেছি। এখনও পাইনি। আর রিভলভার দুটির নামও আমার অজানা।’
কথা শেষ করেই ইন্টারকমে সংশ্লিষ্ট অফিসারকে ডেকে এনে এখনি অস্ত্র তিনটির অ্যাক্রেডিটেশন করে দেবার নির্দেশ দিয়ে কাগজপত্র তার হাতে দিয়ে দিয়েছিল।
নাস্তা শেষ হবার আগেই অ্যাক্রেডিটেশন এসে গিয়েছিল।
আহমদ মুসার গাড়ি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় পড়ল।
আহমদ মুসার গন্তব্য এখন ইউজিজির শাকির সাঈদ-এর ভাই আসমানি আব্দুল্লাহর বাসা। আসুমানি আব্দুল্লাহ আসুমানি-সালিহ পরিবারের নিহত দুই মেয়ের বাবা।
ওদের বাসা বুজুমবুরা নগরীর পশ্চিমাংশে লেকভিউ এভিনিউয়ের ফোর্ট কর্নারে, লেকভিউ এভিনিউ ও আসুমানি-সালিহ রোডের মিলনস্থলে। এই ঠিকানাই শাকির সাঈদ তাকে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অফিস, পার্লামেন্ট ভবন, প্রেসিডেন্ট হাউসসহ সকল সরকারি অফিস একই এলাকায়। এখান থেকে লেকভিউ এভিনিউ- এর ফোর্ট কর্নার সোজা পশ্চিমে। আহমদ মুসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে যে সড়কে উঠেছে, সেটা সেন্ট্রাল এভিনিউ। এই এভিনিউ পশ্চিমে এগিয়ে মিশেছে গিয়ে লেকভিউ এভিনিউতে।
চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি।
সামনেই একটা পার্ক এলাকা আহমদ মুসা দেখতে পেল।
পার্কটা এভিনিউ-এর দুপাশ নিয়ে বিস্তৃত। পার্কের মধ্যে দিয়ে একটা লেক। এভিনিউয়ের উপর একটা ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। লেকের উপর দিয়েই ব্রিজটা। রাস্তায় গাড়ি চলাচল বেশি নয়। আর এভিনিউটাও বেশ প্রশস্ত।
এভিনিউ-এর এপাশটা যাওয়ার, ওপাশটা আসার। মাঝে মার্কিং ছাড়া কোনো ডিভাইডার নেই।
পার্কের এরিয়া শুরু হয়েছে। রাস্তার ব্রিজটা সামনেই।
হঠাৎ একটা পাজেরো রং সাইড দিয়ে আহমদ মুসার গাড়িকে ওভারটেক করে রাস্তার মাঝের মার্কিং ডিঙিয়ে রাস্তার ওপাশে গিয়ে পড়ল।
ওপাশের রাস্তা দিয়ে একটা কার পূর্ব দিকে আসছিল। পাজেরোটি রাস্তার ওপাশে পড়েই ছুটে গিয়ে কারটির সামনে গিয়ে রাস্তা ব্লক করে দাঁড়াল।
অ্যাকসিডেন্ট এড়ানোর জন্যে কারটি থেমে গিয়েছিল।
পাজেরোটি কারটির রাস্তা ব্লক করে দাঁড়াবার সংগে সংগেই পাজেরো থেকে চারজন লোক বেরিয়ে ছুটল কারটির দিকে। তাদের তিনজনের হাতে রিভলভার, এক জনের হাতে হাতুড়ি। কারটির পাশে গিয়ে তারা ঝড়ের গতিতে গাড়ির জানালা ভেঙে দরজা খুলে একটা মেয়েকে টেনে বের করে আনল।
কার থেকে মধ্যবয়সী একজন পুরুষ বেরিয়ে মেয়েটিকে রক্ষার চেষ্টা করছিল।
সন্ত্রাসীদের একজন তার মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে বলল, ‘আর এক পা এগোলে বা চিৎকার করলে মাথা গুঁড়ো করে দেব।’
কিন্তু মেয়েটি বাঁচার জন্যে চিৎকার করছিল।
রং সাইড দিয়ে ওভারটেক করা পাজেরোর অস্বাভাবিক ছুটার দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে আহমদ মুসার গতি স্লো হয়ে গিয়েছিল। কারটি ভাংচুর এবং একজন মেয়েকে ছিনিয়ে আনতে দেখে সব পরিষ্কার হয়ে গেল আহমদ মুসার কাছে।
দ্রুত আহমদ মুসা গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে পাজেরোর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। জ্যাকেটের পকেটে অটো-রিভলভারের ট্রিগার বোতামে আঙুল রেখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
মেয়েটিকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে পাজেরোর কাছাকাছি ওরা পৌঁছে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমেই ধীর গলায় কঠোর স্বরে নির্দেশ দিল, ‘মেয়েটিকে ছেড়ে দাও তোমরা।’
আহমদ মুসার নির্দেশ শুনে চারজনই তাকাল আহমদ মুসার দিকে। এ সময় পাজেরোর দিক থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ এলো। আহমদ মুসা সেদিকে তাকিয়ে একটা রিভলভারের নল দেখতে পেল ড্রাইভিং সিটের বিপরীত পাশের জানালা দিয়ে।
আহমদ মুসার চোখের পলক ওদিকে পড়ার সাথে সাথেই তার জ্যাকেটের পকেট থেকে রিভলভার নিয়ে হাতটাও বেরিয়ে এসেছিল এবং টার্গেটে উঠে আসতে পলকমাত্রও দেরি হয়নি। আর সেই সাথে আহমদ মুসা বসেও পড়েছিল চারটি রিভলভারের সহজ টার্গেট হওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্যে।
বসার সময়ই আহমদ মুসা পাজেরোর ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটিকে গুলি করেছিল। তার দিক কোনো গুলি আসেনি। কিন্তু আহমদ মুসা বসে পড়ার সাথে সাথেই গুলি এসেছিল মেয়েটিকে ধরে নিয়ে আসা লোকদের দিক থেকে। আহমদ মুসা বসে পড়ায় তিনটি গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
ওরা আর দ্বিতীয় গুলি করার সুযোগ পেল না।
আহমদ মুসা পাজেরোর ড্রাইভিং সিটের লোকটিকে গুলি করেই রিভলভার ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ওদের রিভলভারের প্রথমগুলির ধোঁয়া বাতাসে মিলিয়ে যাবার আগেই আহমদ মুসার অটো-রিভলভারের তিনটি গুলি প্রায় এক সাথেই আঘাত করেছিল রিভলভারধারী তিনজনকে।
হাতুড়িধারী চতুর্থজন পকেট থেকে বের করে এনেছিল ক্ষুদ্রাকৃতির হাত বোমা। আহমদ মুসার দিকে ছুঁড়ে মারার জন্যে হাত উপরে উঠাচ্ছিল। ওদিকে টার্গেট করা আহমদ মুসার অটো রিভলভার তাকে বোমা ছোঁড়ার সুযোগ দিল না। পঞ্চমগুলিটা ঠিক কপালে গিয়ে বিদ্ধ হলো লোকটির।
বাইশ তেইশ বছরের অনিন্দ্য সুন্দর এক তরুণী ভয়-আতংকে কুঁকড়ে গিয়ে বসে পড়েছিল। তার মাথার হিজাব, মুখের নেকাব, গায়ের ওড়না রাস্তায় ছিটিয়ে পড়েছিল।
আহমদ মুসা একবারই মেয়েটার দিকে তাকিয়েছিল। তারপর ছুটে গিয়ে হিজাব, নেকাব, ওড়না কুড়িয়ে নিয়ে ওগুলো ভয়, আতংকে বোধহীন বোবার মতো দাঁড়ানো মধ্যবয়সী লোকটির হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘আপনি কি ওর বাবা?
এগুলো ওকে পরতে দিন, গাড়িতে নিয়ে আসুন ওকে।’
স্বগতোক্তির মতো লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ, আমি ওর বাবা। কি ঘটল, কেন ঘটল এসব?’ অনেকটা আর্তনাদের মতো শোনা গেল তার কণ্ঠ।
লোকটি গিয়ে মেয়েটিকে ওড়না দিয়ে ঢেকে দিল। বলল, ‘উঠে দাঁড়াও মা। এগুলো পরে নাও।’
এ সময় কয়েকজন পুলিশকে ছুটে আসতে দেখা গেল।
তাদের কারও হাতে স্টেনগান, কারও হাতে রিভলভার।
এসে তারা মহাব্যস্ত হয়ে পজিশন নিয়ে দাঁড়াল।
রিভলভার হাতে একজন অফিসার চারদিকটা দেখে নিয়ে অনেকটা উদ্দেশ্যবিহীনভাবেই বলল, ‘পাঁচজনই তো গুলিতে মারা গেছে! কে এদের মারল?’
কথা শেষ করার পরই পুলিশ অফিসারের চোখ এসে আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ হলো। তার তীব্র চোখের চাহনিতে জিজ্ঞাসার দৃষ্টি।
‘মি. অফিসার, আপনার তো প্রথমেই জানা উচিত কি ঘটেছে এখানে।
বলল শান্ত, কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে আহমদ মুসা।
পুলিশ অফিসার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘পাঁচজন নিহত, তাও আবার গুলিতে। এটাই তো বড় ঘটনা।
‘না মি. অফিসার। এই ঘটনার আগে বড় ঘটনা ঘটেছে, পরের এই ঘটনা আগের ঘটনার অপরিহার্য ফলশ্রুতি।’ আহমদ মুসা বলল।
পুলিশ অফিসার একবার আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে তাকাল মেয়ের বাবার দিকে। বিপর্যস্ত মেয়েটি তার পাশে দাঁড়িয়ে। এগোলো পুলিশ অফিসার তার দিকে। বলল, ‘আপনি কি মেয়ের বাবা? মেয়েটিকে কি ওরা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল?’
হ্যাঁ আমার মেয়ে। আমার মেয়ে বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা। আমি মেয়েকে নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যাচ্ছিলাম। আমার গাড়ি এখানে পৌঁছলে এই ঘটনা ঘটে।
বলে মেয়ের বাবা মধ্যবয়সী লোকটি যা ঘটেছে তার বিররণ দিল সংক্ষেপে।
ঘটনার বিবরণ শেষ হলে পুলিশ অফিসার তাকাল পুলিশদের দিকে। জানতে চাইল সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি শেষ কিনা। পুলিশরা হ্যাঁ জবাব দিল। পুলিশ অফিসার লাশগুলো এবং আলামত হিসাবে তাদের অস্ত্র ও গাড়ি থানায় নিতে বলল।
পুলিশ অফিসার ফিরে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘যে রিভলভার দিয়ে মানুষ মেরেছেন, সেটা কোথায় বের করুন।
রিভলভার বের করতে করতে আহমদ মুসা বলল, ‘মানুষ নয় সন্ত্রাসী মেরেছি।’
পুলিশ অফিসার তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তার মুখে ক্রোধের চিহ্ন।
আহমদ মুসা তাকে রিভলভার দেখাল।
রিভলভার দেখে চমকে উঠল পুলিশ অফিসার। বলল দ্রুত কণ্ঠে, ‘এ অস্ত্র কোথায় পেলেন? এ অস্ত্র তো এদেশে পাওয়া যায় না, এমনকি দুনিয়ার কোনো বাজারেও পাওয়া যায় না। এটা একটা এক্সকুসিভ আমেরিকান অস্ত্র। এ অস্ত্র বৈধ কি না, চোরাই কি না, কাগজপত্র দেখান।
আহমদ মুসা কাগজপত্রসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ‘অ্যাক্রেডিটেশন’ দেখাল। চমকে উঠল পুলিশ অফিসার আবার। অসহায়ের মতো তাকাল আহমদ মুসার দিকে। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, ‘আপনার ভিসা দেখি?’
আহমদ মুসা পাসপোর্ট দেখাল।
ভিসা দেখে আবার তার চমকে উঠার পালা। একেবারে ভিভিআইপি ভিসা। কোনো দেশের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীরাই এ বিশেষ ভিসা পায়।
পুলিশ অফিসার কাচুমাচু হয়ে বলল, ‘স্যরি স্যার, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। মাফ করবেন।’
পুলিশ অফিসার তাকাল মেয়ের বাবা ও মেয়ের দিকে। বলল, আমাদের সাথে আপনাদের থানায় যেতে হবে। আপনাদের প্রাথমিক স্টেটমেন্ট লিখিত আকারে দরকার।’
পুলিশ অফিসারের কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলল, ‘মি. পুলিশ অফিসার, ওরা এখন বিপর্যন্ত, অপ্রস্তুত। ওদের সিটিজেন আইডি’র কপি তো পেয়েছেন। এই স্টেটমেন্ট পরে বাসায় গিয়ে নিলেও ক্ষতি নেই। প্লিজ, ওদের পুলিশ প্রহরা দিয়ে বাসায় পৌঁছে দিন।’
‘তাতে একটু বিলম্ব হবে। ঠিক আছে স্যার। আপনার একটা কার্ড আমাকে দিন।’ বলল পুলিশ অফিসার।
আহমদ মুসা তার নেম কার্ড পুলিশ অফিসারের হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘আমাকে দরকার হলে কার্ডের কন্ট্যাক্ট নাম্বারে ইনফরমেশন দিলেই আমি পেয়ে যাব।’
কার্ডের দিকে একবার তাকিয়েই পুলিশ অফিসার বলল, ‘স্যার, আপনি দূতাবাস ক্লাব রেস্ট হাউজেই কি থাকছেন?’
‘না, ওখানে থাকছি না, তবে আমাকে পাওয়া যাবে ওখানে টেলিফোন করলে।
বলে আহমদ মুসা তাকাল মেয়ের বাবার দিকে। বলল, ‘পুলিশ আপনাদেরকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে। কিছু মনে না করলে একটা কথা বলব, সন্ত্রাসীদের মোটিভ ও তাদের পরিচয় না পাওয়া পর্যন্ত আপনারা একটু সাবধানে চলাফিরা করবেন।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো পরামর্শ দিয়েছেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জনাব। আপনার কাছে আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য।’ বলল মেয়েটির বাবা।
‘ঠিক বললেন না জনাব। ঋণ আমার কাছে নয়, আল্লাহর কাছে।’
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মি. অফিসার, আমাকে অনুমতি দিন, আমি লাশগুলোকে একটু দেখতে চাই।’
‘ওদের পরিচয় জানতে চান? আমাদের পুলিশরা ওদের সার্চ করেছে। কিছুই পায়নি ওদের কাছে। তবু দেখতে চাইলে দেখুন।’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘আমার নিছক একটা কৌতূহল এটা, বলে আহমদ মুসা পাঁচটা লাশেরই বাহু ও জ্যাকেট জামার কলার ব্যান্ড পরীক্ষা করল। পাঁচজনেরই কলার ব্যান্ডের ‘মেড ইন’ স্টিকারে আহমদ মুসা একটা ব্ল্যাক ক্রসকে সার্কল করা SCA বর্ণ তিনটি দেখতে পেল।
মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে উঠে দাঁড়াল। ‘কিছু পেলেন স্যার?’ বলল পুলিশ অফিসার।
‘চেষ্টা করলাম।’ বলে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল আহমদ মুসা।
উঠে দাঁড়িয়েছে আহমদ মুসা। বলল, ‘মি. অফিসার, ওদের বাড়িতে পৌঁছানোর কি ব্যবস্থা হলো?’
‘জি স্যার হয়েছে। আমি অনুমতিও নিয়েছি। পুলিশের একটা গাড়ি রেডি। ওদের সাথে যাচ্ছে।’ বলল পুলিশ অফিসারটি
‘আমিও যাব। তবে আপনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ধন্যবাদ, সেটাই ভালো হবে স্যার। বুজুমবুরার জন্যে অনেক বড় ঘটনা এটা।’
বলেই পুলিশ অফিসার পুলিশদের লক্ষ্য করে বলল, ‘কুইক, ওদের পৌঁছে দিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’
‘ইয়েস স্যার’ বলে অধস্তন এক পুলিশ অফিসার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা বাবা-মেয়েকে তাদেরকে গাড়িতে উঠতে বলে নিজে তার গাড়ির দিকে ছুটল।
মেয়ের বাবা মধ্যবয়সী লোকটি আহমদ মুসার দিকে দু’ধাপ এগিয়ে এলো। বলল, ‘আল্লাহর হাজার শোকর। জনাব আপনি কে আমি জানি না। আপনার মতো একজন মিরাকল মানুষের মাধ্যমে আল্লাহ আমার মেয়েকে নতুন জীবন দিয়েছেন। সংকট কবলিত একজন পিতাকে আরও বড় সংকট থেকে বাঁচিয়েছেন। খুশি হতাম আপনাকে অতিথি হিসাবে পেলে, আপনার পরিচয় জানলে।’ কথা শেষ করে মেয়ের বাবা একটি নেম কার্ড আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরল।
আহমদ মুসা কার্ডটি হাতে নিল। একটু হাসল। কার্ডটা জ্যাকেটের পকেটে রাখতে রাখতে বলল, ‘ওটাও আল্লাহর ইচ্ছার অধীন জনাব।’
‘নিজের ইচ্ছাও চাই জনাব।’ বলল মেয়ের বাবা।
‘আল্লাহর ইচ্ছা হলে বান্দার ইচ্ছা হয়ে যায়।’ আহমদ মুসা বলল। ‘চাই, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইচ্ছা করুন। অনুমতি দিন, আসি।’ বলল মেয়ের বাবা।
‘আসসালামু আলাইকুম।’ আহমদ মুসা সালাম দিল।
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
সালাম নিয়ে আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল গাড়ির দিকে।
তখন কানে এলো ‘আসসালামু আলাইকুম।’ মেয়েটিও সালাম দিল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম’ বলার পর মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াল গাড়ির দিকে।
বাবা-মেয়ের গাড়ি আগে চলল। পেছনে চলল পুলিশের গাড়ি।
.
একটি মুসলিম মেয়েকে প্রকাশ্য দিবালোকে কিডন্যাপ করার এই ভয়ানক ঘটনা এবং এর সাথে একটা গ্যাং বা গ্রুপ কিংবা কোনো গোপন সংগঠন জড়িত থাকার বিষয়টি আহমদ মুসাকে খুবই চিন্তিত করে ফেলেছিল। কিছু প্রশ্নও তাকে পীড়া দিচ্ছিল। সম্প্রতি কিছু মুসলিম ব্যক্তিত্ব যে নিখোঁজ হচ্ছে, মেধাবী মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী নিহত হচ্ছে, এর সাথে কি এই কিডন্যাপের ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে? এসব কি একই গ্রুপের কাজ? কারা এরা? এদের কি কোনো বিশেষ ধর্মীয় বা রাজনৈতিক পরিচয় আছে?
এসব চিন্তা মাথায় আসায় আহমদ মুসা বুজুমবুরার কয়েকটা জায়গায় এখনই যাওয়া উচিত বলে মনে করল। কাজগুলো সেরে সে ইউজিজি’র শাকির সাঈদের ভাই আসুমানি আব্দুল্লাহর বাসায় যাবে ঠিক করল।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিল আহমদ মুসা।
কাজ সারার পর সন্ধ্যা ছয়টায় আহমদ মুসার গাড়ি আসুমানি আব্দুল্লাহর গেটে গিয়ে দাঁড়াল।
আসুমানি আব্দুল্লাহর ভেতর বাড়ির বৈঠকখানায় তখন আসমানি আব্দুল্লাহ, তার বাবা শাকির সাঈদ, আসমানি আব্দুল্লাহর মেয়ে সামিরা সাদিয়া এবং শাকির সাঈদ ও আসমানি আব্দুল্লাহর বাড়ির মহিলারা বসে। সবারই মুখ চোখে দুঃখ ও দুশ্চিন্তার ছায়া।
আসুমানি আব্দুল্লাহ তাকাল শাকির সাঈদের দিকে। বলল, ‘কি বুঝলেন ভাইজান, পুলিশ তো বিষয়টিকে নারীঘটিত কিডন্যাপের ঘটনা হিসাবে সাজাতে চাচ্ছে।’ শুকনো কণ্ঠ আসমানি আব্দুল্লাহর।
‘ঠিক বলেছ। মা সাদিয়াসহ আমাদেরকে তাদের প্রশ্নগুলো অমর্যাদাকর। তাদের সব প্রশ্নেরই লক্ষ্য ঘটনাকে নারীঘটিত বিষয়ের দিকে ঘুরিয়ে নেয়া।’ বলল শাকির সাঈদ। তার কণ্ঠ কাঁপা। খুব বিমূঢ় ভাব চোখে-মুখে।
‘এটাই ওদের জন্যে সহজপথ। ঘটনাকে এভাবে সাজাতে পারলে ওদের দায়-দায়িত্ব অনেকটাই কমে যায়। আমার দুই নাতনির নিহত হওয়ার ঘটনাকেও ঐদিকে ঘুরিয়ে নেবার একটা চেষ্টা ওদের আছে।’ আসুমানি আব্দুল্লাহর বাবা ইদি আসুমানি মোহাম্মদ কথাগুলো বলল। দুর্বল কণ্ঠ তার, কিন্তু খুবই স্পষ্ট। সে ইজি চেয়ারে শোয়া অবস্থায় ছিল। কথা বলার জন্যে সে শোয়া থেকে একটু উঠেছিল।
ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বুজুমবুরার একজন প্রধান সম্মানিত নাগরিক।
তাকে শুধু বুজুমবুরা নয়, গোটা বুরুন্ডির মুসলিম কমিউনিটির একজন মুখপাত্র বলে মনে করা হয়।
‘আব্বাজান, আপনি আমাদের বিষয়টা নিয়ে একবার প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বললে ভালো হয় না?’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘ইতিমধ্যেই তাঁর সাথে কথা বলেছি আব্দুল্লাহ। তিনি বিষয়টি জানেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিন্ত থাকার মতো কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি। তিনি দেখবেন বলেছেন। তিনি বললেন তারা বড় মুসিবতে আছেন। কিডন্যাপ হওয়া, নিখোঁজ হওয়া, নিহত হওয়া ইত্যাদি ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পাচ্ছে। অথচ কোনো ঘটনার সুরাহা হচ্ছে না। আসুমানি আব্দুল্লাহর বাবা ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল। তার কণ্ঠে হতাশার সুর।
এই হতাশার সুরে সবার মুখ মলিন হয়ে পড়ল।
কারও মুখে কোনো কথা নেই।
ইদি আসুমানি মোহাম্মদই আবার মুখ খুলল। বলল, ‘শাকির তুমি যে আহমদ মুসার কথা বললে তার খবর কি?’
‘তিনি আসবেন চাচাজান। আমি না এলেও তিনি এখানে আসতেন।’ বলল শাকির সাঈদ।
ভাইজান, আপনি বলেছিলেন বুরুন্ডিসহ লেক ট্যাংগানিকা অঞ্চলের মুসলমানদের হত্যা, গুম ও সংকট নিয়ে কাজ করার জন্যেই তিনি এসেছেন। কিন্তু তিনি তো একা। তিনি কি সরকারের সাথে মিলে কাজ করবেন?’ শাকির সাঈদকে লক্ষ্য করে বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘আমি বিস্তারিত কিছু জানি না। তিনি নিজে থেকে যা বলেন তার বেশি জিজ্ঞাসা করতে আমার খুব সংকোচ বোধ হয়। অসাধারণ এক কিংবদন্তী তিনি।’ শাকির সাঈদ বলল।
‘বাবা তিনি একাই কাজ করেন। মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকায় তিনি একাই অসাধ্য সাধন করেছেন। অন্য সব ক্ষেত্রেও এমনটাই আমি পড়েছি।’ বলল সামিরা সাদিয়া, আসমানি আব্দুল্লাহর বড় মেয়ে, বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপিকা বলল।
‘তুমি তো দেখি তার সম্পর্কে অনেক কিছু জান।’ শাকির সাঈদ
‘জানতাম না। তাঁর নামটাই জানতাম মাত্র। তিনি আসছেন, একথা আপনার কাছ থেকে শোনার পর আমি ইন্টারনেট সার্চ করে তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু পড়েছি। আপনি তাঁকে কিংবদন্তী বলেছেন, সত্যি এ বিশেষণ তাঁকেই মানায়।’
‘সবই আল্লাহর কাজ বোন। তিনিই যাকে দিয়ে যা ইচ্ছা করান।’
একটু থেমেই সামিরা সাদিয়ার দাদা ইদি আসুমানি মোহাম্মদ ছেলে আসুমানি আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করে বলল, ‘যে লোকটি সাদিয়া বোনকে উদ্ধার করল, তার নাম-ঠিকানা কি রেখেছ?’
‘না আব্বাজান, সে সুযোগ পাইনি। অদ্ভুত লোক তিনি। নিশ্চয় বড় কেউ হবেন। প্রথম দিকে পুলিশ তার সাথে বলা যায় খারাপ ব্যবহারই করেছিল। কিন্তু তার কাগজপত্র দেখে তাঁকে স্যার বলা শুরু করল। অভিভাবকের মতোই তিনি পুলিশকে এবং আমাদেরকে আদেশ-উপদেশ দিয়েছেন। তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ হয়নি, সাহসও পাইনি। তাকে আমার কার্ড দিতে পেরেছি। কিন্তু কার্ডটি তিনি না দেখেই জ্যাকেটের পকেটে রেখে দিয়েছেন।’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘বাবা, আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করেছ, তিনি যে রিভলভার ব্যবহার করেছেন, তা দুনিয়ার কোথাও কোনো বাজারে বিক্রি হয় না। মার্কিন সামরিক অফিসার ও তাদের গোয়েন্দাদের ওটা এক্সক্লুসিভ অস্ত্র। অস্ত্রটি চোরাই নয়, বৈধ কাগজপত্র আছে, তা পুলিশ দেখেছে। আরেকটা বিষয়ও খুব উল্লেখযোগ্য বাবা, বুজুমবুরার দূতাবাস ক্লাবের টেলিফোন তাঁর কনট্যাক্ট নাম্বার।’ সামিরা সাদিয়া বলল।
‘অদ্ভুত! এমন লোক তো আহমদ মুসা ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। কেমন দেখতে লোকটি?’ বলল শাকির সাঈদ।
‘লম্বা, ফর্সা, একহারা, সুঠাম চেহারা। মাথার চুল বড় নয়, খুব ছোটও নয়। বয়স অনুমান করতে পারছি না। এ ধরনের ফিট শরীরের লোকদের যা বয়স হয়, তার চেয়ে সব সময় পাঁচ-দশ বছর কম মনে হয়।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘মনে আছে পায়ের জুতা কেমন? চোখ দু’টো কেমন দেখতে?’ বলল শাকির সাঈদ।
‘অতটা খেয়াল করতে পারিনি ঐ সময় ভাইজান।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘বড় চাচাজান, তাঁর জুতা ব্রাউন এবং কিছুটা পয়েন্টেড। আর গুলিগোলা শেষ হলে একবারই মাত্র তিনি আমার দিকে চোখ তুলেছিলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিকে তখন স্থির গভীর, শান্ত ও লাজুক মনে হয়েছে আমার কাছে।’ বলল সামিরা সাদিয়া।
‘মিলে গেছে। নিশ্চিতই তিনি আহমদ মুসা।’ শাকির সাঈদ বলল। বলার সাথে সাথে ভেতর থেকে প্রবল এক উচ্ছ্বাস তার বেরিয়ে এলো।
শাকির সাঈদের হৃদয়ের উচ্ছ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যাবার সাথে সাথেই বাইরের দরজায় নক হওয়ার শব্দ ভেসে এলো।
উৎকর্ণ হলো আসুমানি আব্দুল্লাহ।
সে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। এ সময় তার স্কুল পড়ুয়া ছোট ছেলে আমর আসুখানি মোহাম্মদ ছুটে এসে বলল, ‘গেটের পুলিশ ডাকছেন।
ঐ বাড়ির দুই মেয়ে নিহত হওয়ার পর থেকে গেটে সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরা বসানো হয়েছে।
‘দেখছি, ধন্যবাদ।’
বলে আসুমানি আব্দুল্লাহ পা বাড়াল যাবার জন্যে।
‘চল আমিও যাই।’ বলে উঠে দাঁড়াল শাকির সাঈদও।
সবার চোখে-মুখেই প্রশ্ন, নতুন আশংকা।
দরজা খুলে বাইরে বেরুতেই আসুমানি আব্দুল্লাহ গেটের বাইরে গাড়ির পাশে দাঁড়ানো দেখল কিডন্যাপারদের হাত থেকে তাদের বাঁচানো সেই লোকটিকে। বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কা শেষ হতেই ছুটল আসুমানি আব্দুল্লাহ গেটের দিকে।
শাকির সাঈদও বাইরে বেরিয়ে এসেছে। সে দেখতে পেল গেটের বাইরে গাড়ির পাশে দাঁড়ানো আহমদ মুসাকে। ছুটল সেও। তারপর পরিচয়, বিস্ময়, আনন্দ ও কুলাকুলির পালা, যেন ঈদের খুশি।
আহমদ মুসার গাড়ি ভেতরে নিয়ে আসার কথা বলে শাকির সাঈদ আহমদ মুসাকে নিয়ে চলল ভেতরে। আসুমানি আব্দুল্লাহ খবরটা জানাবার জন্যে ইতিমধ্যেই ভেতরে চলে গেছে।
শাকির সাঈদ আহমদ মুসাকে নিয়ে বাইরের বৈঠকখানাতেই বসতে যাচ্ছিল।
আসমানি আব্দুল্লাহ এ সময় এলো। বলল, ‘এখানে নয়, আব্বাজান বলেছেন মেহমানকে ভেতরের বৈঠকখানায় নিয়ে যেতে।’
সবাই চলল ভেতরের বৈঠকখানায়। ভেতরের বৈঠকখানাও বেশ বড়। দুই সেট সোফা ছাড়াও বসার কুশন আছে বেশ কয়েকটা। এ ছাড়া আরেকটা সুবিধা এখানে আছে। মেয়েদের বসার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা আছে। মাঝখানে পাতলা একটা স্ক্রিন টাঙানো। বৈঠকখানায় মেয়েদের অংশটাতেও দুইটা সোফাসেটসহ বসার কুশন রয়েছে। দুই পাশেই রয়েছে সমান সংখ্যক সিট। একটু বড় ফ্যামিলি গ্যাদারিং হলে পর্দা রক্ষা করে তা এখানে করা যায়।
বৈঠকখানায় ঢুকে শাকির সাঈদ আসুমানি আব্দুল্লাহর বাবা ইদি আসুমানি মোহাম্মদকে পরিচয় করিয়ে দিল আহমদ মুসার সাথে।
আহমদ মুসা তার সাথে হ্যান্ডশেক করে তার ইজি চেয়ারের পাশেই কার্পেটের উপর বসে পড়ল কথা বলতে বলতে।
‘কি করছ বাবা তুমি! তুমি হলে আমাদের মাথার মুকুট! তুমি নিচে কার্পেটে বসবে কেন?’ বলে মাথা তুলে উঠতে চেষ্টা করল ইদি আসুমানি আব্দুল্লাহ।
আহমদ মুসা তাকে শুইয়ে দিয়ে বলল, ‘ছেলেকে ছেলে হিসাবেই দেখুন, সেটাই উচিত।’
‘কিন্তু বাবা, বড়কে বড় বলাই তার হক।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘কিন্তু সেটা তার সামনে নয় জনাব। সামনে বলাটা তার জন্যে জুলুম। আহমদ মুসা বলল।
বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ একটু নীরব হলো। ভাবল একটু। বলল, ‘বাবা তুমি গভীর জ্ঞানের কথা বলেছ। রাসুল (স.)-এর একটা হাদিসের দিকে তুমি ইংগিত করেছ। শুনি এবং জানি, সংগ্রাম-সংঘাত নিয়ে তুমি থাক। এমন গভীর ভাবনার সময় কখন পাও তুমি?’
‘জনাব আমি প্রথমে আল্লাহর বান্দা এবং রাসুল (স.)-এর উম্মত। তারপর অন্য সব কিছু।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এই যে তোমার ‘অন্য সব কিছু।’ এগুলো কি তোমার আল্লাহর বান্দা এবং রাসুল (স.)-এর উম্মত হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘না জনাব। আমার এই ‘অন্য সব কিছু’ আল্লাহর আদেশ- ‘তা’মরুনা বিল মা’রুফ’ এবং ‘তান হাওনা আনিল মুনকার’-এর মধ্যে পড়ে৷’ আহমদ মুসা বলল।
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
আসুমানি আব্দুল্লাহ বৈঠকখানায় ঢুকে বলে উঠল, ‘জনাব, খাবার টেবিলে আপনার নাস্তা দেয়া হয়েছে।’
একটু থেমেই আসুমানি আব্দুল্লাহ আবার বলে উঠল, ‘জনাব স্ক্রিনের ওপারে বৈঠকখানার ঐ অংশে আমার মা, আমার স্ত্রী, শাকির ভাইজানের স্ত্রী এবং আমার বড় মেয়ে সামিরা সাদিয়া রয়েছে। তারা সকলে আপনাকে সালাম দিয়েছেন। আর আমার আম্মা জানতে চেয়েছেন, আপনি দুপুরে খেয়েছেন কিনা?’
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম’ বলল আহমদ মুসা। একটু থামল, একটু হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘জনাব আব্দুল্লাহ আপনার মা আমাকে মায়ের মতোই প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু খুব ভালো উত্তর আমি দিতে পারছি না। মুসলিম হোটেল কিংবা ভালো হোটেল খোঁজার ঝামেলায় আমি যেতে পারিনি। আমার ব্যাগে দু’টো সিদ্ধ ডিম ছিল, একটা আপেল ছিল। এসবই একটা পার্কে বসে খেয়ে নিয়েছি। যোহরের নামাজের জন্যে পথের পাশে একটি পার্কে গিয়েছিলাম।’
‘আল্লাহু আকবর। সব অবস্থার সাথে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা আল্লাহ তোমাকে দিয়েছেন। যাও বাবা নাস্তা সেরে এসো।’ বলল বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
‘আমরা ঘণ্টা খানেক আগে বিকেলের নাস্তা সেরেছি।’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
আহমদ মুসা ও আসুমানি আব্দুল্লাহ বেরিয়ে গেল বৈঠকখানা থেকে।
তারা বেরিয়ে যেতেই স্ক্রিন সরিয়ে সামিরা সাদিয়া তার দাদাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘দাদাজী, স্যারকে জিজ্ঞাসা করবেন তো বেলা দশটায় আমাদের ঘটনার পর বিকেল পর্যন্ত উনি কি করেছেন? ভালো হোটেল বা মুসলিম হোটেল খুঁজে পাননি কেন? আরেকটা বিষয় দাদাজী, ঘটনায় পাঁচজন সন্ত্রাসী যারা নিহত হয়েছিল, তাদের বাহু, জামার হাতা, কলার তিনি উল্টে-পাল্টে পরীক্ষা করেছেন। তাঁকে খুশি মনে হয়েছিল। কি পেয়েছিলেন তিনি? এ ব্যাপারে পুলিশের প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন তিনি।’
‘তোমার প্রশ্নগুলোও তো গোয়েন্দাদের মতো। তুমি এত কিছু খেয়াল করেছ? তুমিই প্রশ্নগুলো তাকে কর না বোন।’ বলল সামিরা সাদিয়ার দাদা ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘এত প্রশ্ন করা মানায় না আমার জন্যে দাদাজী।’ সামিরা সাদিয়া বলল। তার মুখ জুড়ে লজ্জার ছাপ।
‘কেন? তুমি না অধ্যাপিকা? ছাত্র-ছাত্রীদের তো কত প্রশ্ন করতে হয়। উত্তর দিতে হয়।’ বলল সামিরা সাদিয়ার দাদা।
‘উনি কি আমার ছাত্র-ছাত্রী দাদাজী! প্রশ্ন করা তো দূরে থাক, দু’একটা জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে গেলেও তো বুক কাঁপার কথা।
‘এত আপন, এত সাধারণ সে! তাকে ভয় করলে তোমার ভয় করার বাইরে আর কে থাকে শুনি?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ, সাদিয়ার দাদা।
‘এত সাধারণের মধ্যে অতি অসাধারণ তিনি। ভয়ের কারণ তো এখানেই দাদাজী।’ সামিরা সাদিয়া বলল। তার কণ্ঠে আবেগের কম্পন।
সামিরা সাদিয়ার দাদাজী ইদি আসুমানি মোহাম্মদ চোখ তুলে তাকাল নাতনীর দিকে। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘তোমার কথাই হয়তো ঠিক বোন, কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, চীনের প্রেসিডেন্ট, রাশিয়ার সম্রাজ্ঞীর প্রিয়পাত্র হবার কারণে বিন্দুমাত্র অহংকার তার মধ্যে থাকলে আমার মতো এক বৃদ্ধের পায়ের কাছে কার্পেটে সে বসতে পারতো না। এটাই বাস্তবতা বোন।’
‘এই বাস্তবতা একজনকে আকাশের মতো উঁচু করে দাদাজী।’ বলল সামিরা সাদিয়া। তার কণ্ঠের আবেগের সেই কম্পন এবার আরও গভীর।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। কিন্তু কথা আটকে গেল। ঘরে ঢুকছে তখন আহমদ মুসা এবং আসুমানি আব্দুল্লাহ।
বৈঠকখানার মধ্যেকার স্ক্রিন টেনে দিয়েছে সামিরা সাদিয়া দ্রুত উঠে এসে।
ঘরে ঢুকেই সালাম দিয়েছে আহমদ মুসা। বসল গিয়ে ইদি আসুমানি আব্দুল্লাহর সামনের এক সোফায়। শাকির সাঈদ ও আসমানি আব্দুল্লাহ বসল আরেক সোফায়।
‘ভাই আহমদ মুসা, খেতে পারলে আমাদের গ্রামীণ নাস্তা?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘জনাব জিজ্ঞেস করুন আপনার ছেলেকে টেবিলে কোনো খাবার আমি রেখে এসেছি কিনা।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। দেহের একটা হক আছে, তা পূরণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। তোমাকে ধন্যবাদ।’
কথাটা শেষ করে একটা দম নিয়েই আবার বলে উঠল ইদি আসুমানি আব্দুল্লাহ, ‘ভাই আহমদ মুসা, তোমার কাছে দুটি প্রশ্ন এসেছে আমার বোন সামিরা সাদিয়ার তরফ থেকে। তুমি কি তাকে জান?’
‘এই মাত্র আপনার কাছে তার নাম শুনলাম। তিনি বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। তাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা হচ্ছিল। তিনি আপনার নাতনী, জনাব আসমানি আব্দুল্লাহর বড় মেয়ে। তার ছোট দুইবোন দুইদিন আগে গাড়ি চাপায় নিহত হয়েছে বাড়ির গেটের সামনে। এবার তার প্রশ্নগুলো বলুন জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। তার প্রথম প্রশ্ন হলো, আজ সকালের ঘটনার পর বিকেল পর্যন্ত একটা ভালো হোটেল বা মুসলিম হোটেল খুঁজে না পাবার কারণ কি? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, নিহত পাঁচজন সন্ত্রাসীকে সার্চ করে নিশ্চয় তুমি কিছু পেয়েছ, সেটা কি? দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর না বলার মতো হলে অবশ্যই বলবে না। ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
একটু হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আপনার নাতনীর বুদ্ধিমত্তাকে ধন্যবাদ জনাব। আমি সন্ত্রাসীদের সার্চ করে কিছু পেয়েছি, এটা পুলিশ বুঝতে পারেনি, কিন্তু আপনার নাতনী বুঝতে পেরেছেন।
মুহূর্তের জন্যে একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, ‘প্রশ্ন দু’টির মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন থেকেই শুরু করি। আমি মৃত সন্ত্রাসীদের কলার ব্যান্ডের ‘মেড ইন’ স্টিকার থেকে সন্ত্রাসীদের একটা প্রতীক খুঁজে পেয়েছি। প্রতীকটিতে একটা সিম্বল ছিল এবং তিনটি ইংরেজি বর্ণ ছিল। বর্ণগুলোর অর্থ খুঁজে পেতে দেরি হয়। আর খোঁজাখুঁজি করতেও দীর্ঘ সময় পার হয়। এভাবেই বিকেল হয়ে যায়। থামল আহমদ মুসা।
একটু নীরবতা।
নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করল বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ, ‘এভাবে না খেয়েদেয়ে আজই কি প্রয়োজন ছিল খোঁজাখুঁজির?’
‘একটা বড় সমস্যা সামনে এলে তখনি তার সমাধান আমার কাছে জরুরি মনে হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সমস্যা কি খুব বড় ছিল?’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
‘অবশ্যই বড়। সন্ত্রাসীরা কারা, তারা একটা বড় দল বা গ্রুপ কি না, এ সবের কিছুটা বা সবটা জানা যাবে প্রতীক মনোগ্রাম থেকে। সুতরাং কাজটা খুব বড় ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার কৌতূহল হচ্ছে, জাদুঘর থেকে আপনি কি কিছু পেয়েছেন?’ জিজ্ঞাসা করল শাকির সাঈদ।
‘এক হিসেবে বলা যায়, কিছুই পাইনি, আবার বলা যায় কিছু পেয়েছি। যে সিম্বল ও তার তিনটি ইংরেজি বর্ণের অর্থ খুঁজতে আমি জাদুঘরে গিয়েছিলাম, তার অর্থ আমি পাইনি। তবে দুনিয়ার কয়েকটা দেশে | অনুরূপ সিম্বল এবং একটু ভিন্ন কম্বিনেশনের তিনটি ইংরেজি বর্ণ পেয়েছি। আজ সন্ত্রাসীদের কাছে যে তিনটি বর্ণ পেয়েছি তা হলো SCA, ল্যাটিন আমেরিকায় অনুরূপ সিম্বলের সাথে যে ইংরেজি বর্ণ পেয়েছি, সেটা SCLA, আবার ইন্দোচীনে একই ধরনের সিম্বলের সাথে SIC কম্বিনেশনে তিনটি ইংরেজি বর্ণ পাওয়া গেছে। প্যাসেফিকের কিছু দ্বীপপুঞ্জ এবং ককেশাস অঞ্চলেও এই ধরনের সিম্বল এবং ইংরেজি বর্ণের কম্বিনেশন খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু আফ্রিকায় এ ধরনের সিম্বল ও ইংরেজি বর্ণের কম্বিনেশন পাওয়া গেল না।’ থামল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু আজ সন্ত্রাসী ঘটনায় এই সিম্বল ও ইংরেজি বর্ণমালার কম্বিনেশন তো পাওয়া গেল। বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘এই পরিচয়ের গ্রুপ বা সন্ত্রাসী সংগঠন আফ্রিকায় পুরানো নয়, এ জন্যেই অথবা তাদের নাম পরিচয় ও কাজ কোনো ঘটনার মাধ্যমে প্রকাশ পায়নি বলেই জাদুঘরে তা রেকর্ড হবার সুযোগ হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা। ‘আজকের সন্ত্রাসীদের স্টিকারে পাওয়া সিম্বল এবং SCA বর্ণগুলোর নিশ্চয় আপনি অর্থ করেছেন? কি সেটা?’ শাকির সাঈদ বলল।
‘সর্বদিক বিচার করে একটা অর্থে আমি পৌঁছেছি। দেখুন, বিভিন্ন দেশের যে সিম্বলগুলোর কথা আমি বললাম, প্রত্যেক বর্ণ ও কম্বিনেশনের শুরুর বর্ণ হলো S, এই S-এর আমি অর্থ করেছি ‘সেভিয়ার’ (Saviur)। S-এর পরের বর্ণগুলো দেশ বা অঞ্চলের নাম হবে, এটা আমি মনে করেছি। সুতরাং আজ সন্ত্রাসীদের স্টিকার থেকে যে SCA বর্ণ- কম্বিনেশন পাওয়া গেছে, তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে ‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা’। অনুরূপভাবে ল্যাটিন আমেরিকার SCLA-এর করেছি ‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল ল্যাটিন আমেরিকা।’ এভাবে ইন্দোচীনের SIC- এর অর্থ হচ্ছে ‘সেভিয়ার অব ইন্দোচায়না’।
‘সন্ত্রাসীরা সেভিয়ার? পৃথিবীর অন্যান্য অনুরূপ সংগঠনগুলোও কি সন্ত্রাসী?’ জিজ্ঞাসা শাকির সাঈদের।
‘নিশ্চিত জানি না। তবে সন্ত্রাসী হওয়ার কথা। এ সংগঠনগুলোর নাম আগে আমি শুনিনি। হতে পারে এগুলো বড় কোনো সংগঠনের ছদ্মবেশী সামরিক উইং। এদের নাম তেমন প্রচার করা হয় না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সর্বনাশ, এরা তাহলে ভয়ংকর। আমাদের শান্তির বুরুন্ডিতে কি করে আসল, কেন আসল? কারা এরা? আজকের SCA সন্ত্রাসীরা কোনো বড় সংগঠনের সামরিক উইং হলে বড় সংগঠনটির কি পরিচয়? নিশ্চয় আপনি ভেবেছেন এ নিয়ে?’ শাকির সাঈদ এক সাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করল। সবার চোখে-মুখেই আতংকের ছায়া দেখা যাচ্ছে।
SCA বর্ণ সমষ্টির সাথে যে সিম্বল রয়েছে, সে সিম্বলটা হলো ‘ব্ল্যাক ক্রস’, একক একটি ব্ল্যাক ক্রস। ‘ব্ল্যাক ক্রস’ নামক এক সংগঠনকে আমি চিনি। তাদের বিশ্বজোড়া নেটওয়ার্ক রয়েছে এবং খুবই শক্তিশালী ও বিত্তশালী সন্ত্রাসী সংগঠন। কিন্তু তাদের সিম্বল তিনটা ব্ল্যাক ক্রস। SCA সন্ত্রাসী সংগঠন ব্ল্যাক ক্রসের একটা ছদ্মবেশী ও নতুন উইং হতে পারে অথবা স্বাধীন সংগঠনও হতে পারে এরা। সত্যটা আরও অনুসন্ধান সাপেক্ষ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘যাদের বিশ্বজোড়া সন্ত্রাসী সংগঠন বললেন, সেই ব্ল্যাক ক্রস কি আফ্রিকায় কাজ করে?’ জিজ্ঞাসা শাকির সাঈদের।
‘মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকায় ওরা খুবই সক্রিয় ছিল। সেখানে হাজার হাজার মুসলিম পরিবারকে তারা উচ্ছেদ করে, লক্ষ লক্ষ একর মুসলিম ভূমি তারা দখল করে। এই তো দুই সপ্তাহ আগে বুজুমবুরা আসার পথে দারুস সালাম বিমানবন্দরে ওরা আমাকে কিডন্যাপ করে জাম্বিয়ার লুসাকায় নিয়ে যায়। নিজেকে মুক্ত করে সেখান থেকেই তো আমি সড়ক পথে বুজুমবুরায় আসছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনাকে কিডন্যাপ করেছিল ওরা? আপনার সাথে ওদের শত্রুতা কি?’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
আহমদ মুসা বলল, ‘ওরা আমার পুরানো শত্রু। পশ্চিম ইউরোপে ওদের সাথে আমার সংঘাত হয়। মধ্য-পশ্চিম আফ্রিকায় বাস্তুহারা, সহায়-সম্পদহারা মুসলমানদের পক্ষ নিতে গিয়ে ওদের সাথে আমার সংঘাত বাধে।’
‘স্যার, পশ্চিম আফ্রিকার ক্যামেরুন অঞ্চলে মুসলমানদের সাথে খ্রিস্টানদের যে সংঘাত বাধে, যার পরিণতিতে খ্রিস্টান সংগঠনগুলো মুসলমানদের লাখ লাখ একর সম্পত্তি ফেরত দেয় এবং বাস্তুহারাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুনর্বাসনে বাধ্য হয়, সেই সংগ্রামে কি আপনিই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন? প্রচার মাধ্যমে শুধু সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হয়, সংঘাত- সংগ্রাম এবং নেতৃত্বের কোনো উল্লেখ ছিল না।’ পর্দার ওপার থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো। কণ্ঠটা সামিরা সাদিয়ার।
‘আমি সেখানে ছিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েই নাম প্রচার করা হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘একটু জানতে চাচ্ছি, সেখানে কি কেউ আপনাকে ডেকেছিল? না ইউজিজি, বুজুমবুরায় যেভাবে এসেছেন, সেভাবে ওখানে এসেছিলেন?’ জিজ্ঞাসা করল শাকির সাইদ।
‘সে অনেক কথা। দক্ষিণ ক্যামেরুনের এক বিপদগ্রস্ত যুবককে সাহায্য করতে গিয়ে সমগ্র ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলাম। দক্ষিণ ক্যামেরুনের সব মুসলিম ভূমিই খ্রিস্টানরা দখল করে ফেলেছিল দশ হাজার একরের একটা ফার্ম ছাড়া। নানা প্রলোভন ও শত ভয়-ভীতি দেখানো সত্ত্বেও সেই জমির মালিক খ্রিস্টানদের হাতে সেই জমি তুলে দেয়নি। অবশেষে জমির মালিক গুপ্তহত্যার শিকার হয়। খ্রিস্টান সংগঠনগুলো এবার ধরে জমির মালিকের ছেলে তরুণ বয়সের ওমর বায়াকে। ভয়ে ওমর বায়া উত্তর ক্যামেরুনে পালিয়ে যায়। সেখানেও গিয়ে হাজির হয় জমি কেনার লোকা। ওমর বায়া প্রাণভয়ে পালিয়ে যায় ফ্রান্সে। তাকে ধাওয়া করে ফ্রান্সে যায় সেই সন্ত্রাসী লোকরা। একদিন এক হোটেলে বসে আমি খাচ্ছিলাম। সে সময় আমি দেখি এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে কয়েক জন সাদা চামড়ার লোক টেনে-হিঁচড়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সে বাঁচার জন্যে চিৎকার করছে। কিন্তু বাঁচাবার জন্যে কেউ কোথাও থেকে এলো না। আমি গিয়ে যুবকটিকে উদ্ধার করলাম। এর পরে ফ্রান্সেই যুবকটিকে কেন্দ্র করেই ব্ল্যাক ক্রসের সাথে সংঘাত সংঘর্ষের অনেক ঘটনা ঘটে। এই সংঘাত ফ্রান্স থেকে যায় ক্যামেরুনে। দেশজোড়া ঘটনায় রূপ নেয়। শেষে জয় মুসলমানদেরই হয়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দেখা যাচ্ছে ব্ল্যাক ক্রস এখনও সাংঘাতিকভাবে সক্রিয়। মাত্র দু’সপ্তাহ আগে আপনাকে কিডন্যাপ করেছিল। কেন কিডন্যাপ করেছিল?’ আসমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছা তো ওদের একটা থাকবেই। বন্দি অবস্থায় ওদের লোকদের কাছে শুনেছিলাম, আমেরিকার কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠনের কাছে এক বিলিয়ন ডলারে ব্ল্যাক ক্রস আমাকে বিক্রি করেছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
শাকির সাঈদ, আসুমানি আব্দুল্লাহ সবার চোখে-মুখে বিস্ময়। ‘এক বিলিয়ন ডলারে কিনে আপনাকে নিয়ে ওরা কি করত?’ জিজ্ঞাসা করল, আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘হতে পারে, হত্যা করে প্রতিশোধ চরিতার্থ করতো।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময় বিজড়িত কণ্ঠে আসমানি আব্দুল্লাহ বলল, ‘আপনি সব কিছুই জানেন, ভয় করে না আপনার? এই তো বন্দি হয়েছিলেন। সেখানেই তো আপনার মৃত্যু হতে পারতো!’
‘ভয় আল্লাহকে করি, তাঁর উপরই নির্ভর করি। তাঁর উপর নির্ভরতা থাকলে কোনো ভয়ই আর থাকে না। আর মৃত্যুর ব্যাপার তো একেবারেই আল্লাহর হাতে। তিনি আমার মৃত্যুর দিন ক্ষণ ঠিক করে রেখেছেন। সে সময়টা আসার আগে দুনিয়ার কোনো শক্তিই আমাকে মারতে পারবে না। আর সে সময় এলে আমাকে বাঁচাবার সাধ্য কারও নেই। সুতরাং লড়াইয়ের ময়দানে মৃত্যু ভয় সামনে এনে অহেতুক নিজেকে দুর্বল ও দ্বিধাগ্রস্ত করার প্রয়োজন নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
কারও মুখে কোনো কথা নেই।
নীরব সবাই।
এক সময় বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ আধা শোয়া থেকে মাথা তুলে একটু বসল। বলল, ‘ভাই আহমদ মুসা, তুমি যা বললে সেটা ঈমানের কথা। এটাই প্রকৃত ঈমানের রূপ। এ ঈমান আমাদের নেই। আবেগে গলা কাঁপছিল বৃদ্ধের।
‘আল্লাহু আকবর। জনাব আহমদ মুসা আপনার মুখ নিঃসৃত কয়েকটা বাক্য আমাদের গোটা জীবন গ্রন্থের সারকথা, আমাদের জীবন-সংগ্রামের জয়-পরাজয়ের মূলমন্ত্র, কিন্তু অত্যন্ত কঠিন আমাদের মতো আ’ম মানুষের জন্যে।’ শাকির সাঈদ বলল।
‘আ’ম বা খাস মানুষ বলে কিছু নেই। আমরা সকলেই আল্লাহর বান্দা। আর আল্লাহ সকল বান্দার জন্যেই রহমান, সকল বান্দার জন্যেই রহিম। আমরা যদি তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলি। সর্বক্ষণ হেদায়েত ও সিরাতুল মুস্তাকিম তাঁর কাছে প্রার্থনা করি, তাহলে আমাদের ঈমান আমলে আল্লাহ বরকত দান করবেন। তখন আজ যা কঠিন মনে হচ্ছে, তা সহজ হয়ে যাবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাদের এমন ঈমান আমলের তৌফিক দিন।
কথাটা শেষ করে একটু থেমেই আসুমানি আব্দুল্লাহ আবার বলে উঠল, ‘জনাব আমরা যে সংকটে পড়েছি, তার সমাধান কীভাবে হবে? আমরা এভাবে টার্গেট হলাম কেন? আমার দুই মেয়েকে দু’দিন আগে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আজ বড় মেয়েকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করা হলো। আরও কি ঘটবে কে জানে! ওদিকে পুলিশ দুই ঘটনাকেই নারীঘটিত হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করছে। তার মানে আসল অপরাধী তাহলে ধরা পড়বে না এবং আমাদের বিপদও যাবে না। কি করব আমরা বুঝতে পারছি না। এর মধ্যে আল্লাহ দয়া করে আপনাকে আমাদের মাঝে এনেছেন। মনে হচ্ছে আল্লাহ আমাদেরকে একটা অবলম্বন জুটিয়ে দিয়েছেন।
থামল আসুমানি আব্দুল্লাহ। তার কণ্ঠ শেষ দিকে ভারি হয়ে উঠেছিল। ‘ঠিক বলেছ আব্দুল্লাহ, আল্লাহ আমাদের একটা অবলম্বন জুটিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ ছাড়া এমন বড় অবলম্বন অসহায় মুসলমানদের জন্যে আর নেই।’
একটু থেমে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ আহমদ মুসার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না ভাই আহমদ মুসা, ব্ল্যাক ক্রস কিংবা ব্ল্যাক ক্রসের কোনো ছদ্মবেশী উইং অথবা কোনো সন্ত্রাসী খ্রিস্টান সংগঠন আমাদের পেছনে লাগবে কেন? আমাদের পরিবার রাজনীতি বা সামাজিক কোনো বিতর্কে নেই। আমাদের পারিবারিক কোনো শত্রু নেই। আমাদের ছেলে-মেয়েরাও স্কুল কলেজ ও আত্মীয় বাড়ি ছাড়া কোথাও যায় না, বাইরের কোনো কিছুতেই নেই তারা। তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে ভয়ানক শত্রুর সৃষ্টি হলো কি করে?
আহমদ মুসা তাকিয়েছিল বৃদ্ধের দিকে। তার চোখে-মুখে চিন্তার একটা সুস্পষ্ট প্রকাশ।
বৃদ্ধ থামলেও আহমদ মুসা সংগে সংগে কিছু বলল না। ভাবছিল সে। একটু সময় নিয়ে সে বলল, ‘জনাব সন্ত্রাসীদের পরিচয় নিয়ে আমি চিন্তা করছি, আপনাদের এ বিষয়টা আমি গভীরভাবে ভেবে দেখিনি। তবে শাকির সাইদ সাহেবের বাসায় যখন আপনার দুই নাতনীর নিহত হবার ঘটনা শুনলাম এবং জানলাম যে তারা অত্যন্ত মেধাবী এবং গত অ্যাডভানসড হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় দুই বোন প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল, তখন হঠাৎই আমার মনে হয়েছিল মেধাবী হওয়াই তাদের নিহত হবার কারণ কিনা। এই…’
আহমদ মুসার কথার মধ্যেই আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল, ‘আপনি কি এ রকমই মনে করেন?’ আসুমানি আব্দুল্লাহর কণ্ঠে উদ্বেগ। তার এবং উপস্থিত অন্য সকলের চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া।
‘আমি ঠিক মনে করি না, কিন্তু সে সময় হঠাৎই আমার মনে হয়েছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন মনে হয়েছিল জনাব?’ শাকির সাঈদ বলল।
‘একাধিক মুসলিম প্রতিভাবান ছাত্র নিহত বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আমি পড়েছিলাম সংবাদপত্রে।’ বলল আহমদ মুসা।
কথাটা শেষ করেই আহমদ মুসা আসমানি আব্দুল্লাহর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, প্রতিভাবান ছাত্র সব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ই চায়। আপনার মেয়েকে নিয়ে সেরকম কোনো ঘটনার কি সৃষ্টি হয়েছিল?’
‘প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই যোগাযোগ করেছিল। কেউ টেলিফোনে, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকরা এসে যোগাযোগ করেছিল এবং প্রত্যেকেই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছিল। কিন্তু এ প্রশ্ন কেন জনাব?’
‘মনে এলো তাই প্রশ্নটা করলাম। আর আমাদেরকে ছোট-বড় সব বিকল্প নিয়েই ভাবা উচিত। অনেক সময় ছোট বিষয় বড় হয়ে দাঁড়ায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বাবা,, একটা ঘটনা আছে, প্রয়োজন হবে কিনা জানি না। আমার বোনদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগের রাতে অর্থাৎ মর্মান্তিক ঘটনাটার আগের রাতে একটা টেলিফোন এসেছিল। আম্মা ধরেছিলেন, পরে আমাকে দিয়েছিলেন। কে একজন প্রশ্ন করেছিলেন, আপনাদের মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কি সিদ্ধান্ত নিলেন? আমি বলেছিলাম, ওরা আগামীকাল ইনশায়াল্লাহ বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। উত্তরে সে লোকটি বলেছিল, আপনারা ঠিক করলেন না। আমরা অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতে চেয়েছিলাম। বলেই সে টেলিফোন রেখে দেয়। পর্দার ওপার থেকে বলল আসমানি আব্দুল্লাহর বড় মেয়ে সামিরা সাদিয়া।
‘ধন্যবাদ। লোকটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ছিল?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘তিনি পরিচয় দেননি, আমিও জিজ্ঞাসা করিনি। তবে সে টেলিফোন নাম্বারটা আমাদের টেলিফোন রেজিস্টারে আছে।’ সামিরা সাদিয়া বলল পর্দার ওপার থেকে।
‘ধন্যবাদ। নাম্বারটা আমার দরকার হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ জনাব। আমার এখন মনে হচ্ছে.. ছোট ঘটনাটা বড়ও হতে পারে। আপনি কি মনে করছেন জনাব?’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘আপনারা ঠিক করলেন না’ কথাটাকে এক অর্থে আমরা থ্রেট ধরতে পারি। অন্য অর্থে থ্রেট নাও হতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আরেকটা বিষয় জনাব। ছোট দুই মেয়ের হত্যার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি জড়িত থাকলে, আমার বড় মেয়ে কিডন্যাপের শিকার হলো কেন? আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘আপনারা পুলিশ হেড কোয়ার্টারে যাচ্ছিলেন কেন?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমার বড় মেয়েকে ঘটনার একমাত্র সাক্ষী হিসাবে তার স্টেটমেন্ট নেবার জন্যে ডেকেছিল।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘কারণ এটাই ছিল। আপনার বড় মেয়ে ঘটনার একমাত্র চাক্ষুস সাক্ষী। সে যাতে তার সাক্ষ্য দিতে না পারে, এই জন্যেই তাকে কিডন্যাপের চেষ্টা করা হয়েছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
আসুমানি আব্দুল্লাহসহ সবার মুখ উদ্বেগে ভরে গেল। একটু নীরবতা। নীরবতা ভেঙে কথা বলল শাকির সাইদ। বলল, ‘তাহলে তো তার আরও বিপদ হতে পারে!’
‘সেটা আল্লাহ জানেন। কিন্তু তাকে সাবধান থাকতে হবে।’
বলে আহমদ মুসা একটু চুপ করল। তার চোখে-মুখে ভাবনার ছায়া। একটু ভেবে বলল সে, ‘একটা কথা বলতে চাই, বুজুমবুরায় থাকার আপনাদের কি কোনো বিকল্প জায়গা আছে?’
আসুমানি আব্দুল্লাহ, শাকির সাইদসহ সবার চোখে-মুখে একটা উদ্বেগ নেমে এলো। আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল, ‘বিকল্প জায়গার কথা বলছেন কেন, আমরা কি এখানে নিরাপদ নই?’
‘এ বাড়ি নিরাপদ নয়, তা আমি বলছি না। কিন্তু সাবধান থাকা ভালো। শত্রুদের পরিচয় এখনও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। এরা যদি ব্ল্যাক ক্রসের কোনো শাখা বা তাদের সাথে সংশ্লিষ্টতা আছে এমন কোনো শত্রু হয়, তাহলে তারা খুবই হিংস্র এবং বেপরোয়া হবে। বিশেষ করে শিকার হাত ছাড়া হলে তারা অনেকটাই উন্মাদ হয়ে যায়। কোনো সময় না দিয়ে শিকারকে আবার আটকাবার জন্যে তারা শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।’ বলল আহমদ মুসা।
বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদসহ উপস্থিত সকলেরই মুখ ভয়ে চুপসে গেছে।
শাকির সাইদ বলল, ‘বাড়িতে পুলিশ প্রহরা বসেছে। এই অবস্থায় তারা কি সাহস করবে?’
‘সাহস নাও করতে পারে, আবার করতেও পারে। কোনোটাই আমাদের কাছে নিশ্চিত নয়। সাবধানতার পথ অবলম্বন করাই ভালো। বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি কি মনে করেন এখনি বাড়ির সবাইকে, অন্তত মেয়েদের শিফট করা দরকার? আরও কিছুটা দক্ষিণে লেকের কাছাকাছি আমাদের আর একটা বাড়ি আছে। সেখানে গিয়েও আমরা মাঝে মাঝে থাকি।’
‘আমি মনে করি শুধু মেয়েরা নয়, সবাই আপনারা কয়েক দিনের জন্যে ওখানে চলে যেতে পারেন।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই গেটের দিক থেকে একটা ব্রাশফায়ারের শব্দ হলো।
আহমদ মুসা স্প্রিং-এর মতো উঠে দাঁড়াল। বলল দ্রুত, কিন্তু শান্ত কণ্ঠে আসমানি আব্দুল্লাকে লক্ষ্য করে, ‘আপনাদের দক্ষিণ গেটের অবস্থা কি?’
আসুমানি আব্দুল্লাহ এবং শাকির সাঈদও উঠে দাঁড়িয়েছিল। তাদের চোখে-মুখে প্রবল উৎকণ্ঠা। আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল, ‘দক্ষিণ গেট দু’দিন আগে থেকেই কমপ্লিট বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
আহমদ মুসা ড্রইংরুমটির চারদিকে চাইছিল। বলল দ্রুত কণ্ঠে ‘দুদিকে দরজা সিটকিনি দিয়ে বন্ধ করে আপনারা সকলে এ ঘরেই থাকুন।’
একটু থেমেই আবার বলল, ‘ভয় নেই, আল্লাহ আছেন আমাদের সাথে। আমি ওদিকে যাচ্ছি।’ বলে আহমদ মুসা দরজার দিকে ছুটল।
উৎকণ্ঠা, উদ্বেগে আসমানি আব্দুল্লাহ এবং শাকির সাঈদ বাকহীনের মতো হয়ে গেছে। আহমদ মুসার ছুটে যাওয়াই শুধু দেখল অপলক চোখে।
পূর্ব দিক দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকার একটাই প্রবেশ পথ। সেটা ড্রইংরুম হয়ে। এ গেট দিয়ে অতিথিদেরকেই শুধু স্বাগত জানানো হয়।
আহমদ মুসা ছুটছে। ড্রইং রুমের বাইরের বারান্দায় অনেকগুলো পায়ের শব্দ হচ্ছে। আহমদ মুসা ড্রইংরুমে পৌঁছেছে।
ড্রইংরুমের গেট এক পাল্লার বড় দরজা। দরজা খুললে দরজা উত্তর দিকে সরে গিয়ে দেয়ালের সাথে সেট হয়ে যায়। দরজা আনলক করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা চিন্তা করল, সন্ত্রাসীরা দরজা খোলার পর ওরা দরজার ওপারে থাকতেই কি সে আক্রমণে যাবে, না ওদের ঘরে ঢুকিয়ে আক্রমণ করবে। দরজা খুলে ওদের আক্রমণ করলে দরজা নিয়ন্ত্রণে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ওরা ভেতরে ঢুকলে এই সুযোগ পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে দরজা খুলে আক্রমণ করাটা ঝুঁকিপূর্ণ, যদি ওরা দরজা খোলার সাথে সাথেই গুলি বৃষ্টি শুরু করে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এমনটা হয় না। সাধারণত আক্রমণকারীরা অস্ত্র বাগিয়ে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করে। বিশেষ করে এই ক্ষেত্রে এমনটা ঘটাই স্বাভাবিক। কারণ তারা জানে, তাদের মোকাবিলা করার মতো এ বাড়িতে কেউ থাকার কথা নয়। পুলিশ ছিল, তাদের ব্যবস্থা তো আগেই হয়েছে।
এই চিন্তা করে দরজাতেই ওদের ঠেকিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা তার এম-১৬ মেশিন রিভলভার কাঁধে ঝুলিয়ে দুই হাত খালি রাখল। এম-১৬টা এমনভাবে ঝুলন্ত থাকল যা ডান হাত চোখের পলকে তুলে নিতে পারে ট্রিগারে তর্জনি রেখে।
আহমদ মুসা দরজার পাল্লার পেছনে এমনভাবে দুই হাত দরজার পাল্লার দিকে প্রসারিত করে রাখল যাতে দরজার পাল্লা ওদের ধাক্কায় পেছনে ছুটে এলে আহমদ মুসা আরও বড় ধাক্কায় তা আবার সামনে ফেরত পাঠাতে পারে।
সন্ত্রাসীরা দরজার নব ঘুরিয়ে দেখল দরজা খোলা। পর মুহূর্তে দ্রুত দরজার নব ঘুরিয়ে প্রবল ধাক্কায় ঠেলে দিল ভেতরে। সেই সাথে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঘরে ঢুকতে শুরু করল।
আহমদ মুসা তার হাতের উপর এসে স্থির হয়ে যাওয়া দরজার পাল্লা এবার প্রবল শক্তিতে ছুঁড়ে দিল সামনে।
ঘরে ঢুকতে শুরু করা কয়েকজন সন্ত্রাসী দরজার পাল্লার প্রবল ধাক্কায় দরজার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ওদের গায়ে ধাক্কা খেয়ে দরজার পাল্লা আবার ভেতরের দিকে কিছুটা সরে বড় একটা ফাঁক সৃষ্টি করল।
আহমদ মুসা তার এম-১৬ হাতে তুলে নিয়ে ট্রিগার চেপে সেই ফাঁক দিয়ে এম-১৬ এর ব্যারেল প্রথমে বুক বরাবর উঁচুতে ঘুরিয়ে নিল বারান্দার উপর যাতে দরজার বাইরে বারান্দায় থাকা সন্ত্রাসীরা আক্রমণে আসার সুযোগ না পায়। পরে এম-১৬ এর ব্যারেলকে বাইরের দিকে তাক করে এক ঝটকায় দরজা খুলে ফেলল। দেখল, দরজার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়া দু’জন সন্ত্রাসী আঘাত সামলে নিয়ে উঠে বসেছে। তারা হাতে তুলে নিয়েছে ছিটকে পড়া ওদের স্টেনগান। ওদের স্টেনগানের ব্যারেল উঠে আসছে। আহমদ মুসার এম-১৬ বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করল না। এক পশলা গুলি ছুটে গেল ওদের লক্ষ্যে।
আহমদ মুসা গুণে দেখল বারান্দায় মারা পড়েছে চারজন এবং দরজার উপর মারা পড়েছে দু’জন।
আহমদ মুসা তাকাল গেটের দিকে। একজন পুলিশের দেহ গেটের বাইরে মাটিতে পড়ে আছে। আরেকজন মাটিতে পড়ে থাকা পুলিশ আহমদ মুসার দিকে তাকাচ্ছে।
আহমদ মুসা ছুটল সেদিকে। বসল গিয়ে আহমদ মুসা তার পাশে।
‘স্যার, দেখুন আমাদের একজনের দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। আমার কাঁধে, উরুতে ও পাঁজরে গুলি লেগেছে। আমি হেড কোয়ার্টারে খবর দিয়েছি স্যার। ওরা আসছে।
কথা শেষ করে পুলিশটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল আবার, ‘স্যার ওদের গাড়িতে আরেকজন আছে। দেখুন স্যার, বেরিয়ে এসেছে।
আহমদ মুসা দ্রুত তাকাল সেদিকে, পকেট থেকে তার রিভলভারটাও তার হাতে উঠে এসেছে। আহমদ মুসা চোখের পলকে রিভলভারটা টার্গেটে তাক করেছে। দেখল লোকটার মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে উঠছে।
আহমদ মুসার রিভলভার ইতিমধ্যেই তাকে টার্গেট করেছিল। গুলিও বেরিয়ে গেল। একেবারে তার হাত লক্ষ্যে। হাত গুলিবিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথেই তার হাতেই বিরাট এক বিস্ফোরণ ঘটল।
আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করল।
প্রবল বিস্ফোরণে দেহ শূন্যে উঠে টুকরো টকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল। ঠিক এ সময়েই দূরে বাঁশি বাজিয়ে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি আসমানি আব্দুল্লাহর বাড়ির দিকে আসতে দেখা গেল।
আহমদ মুসা দ্রুত বাড়ির ভেতরে চলে এলো এবং ভেতরের যে ড্রইংরুমে বাড়ির সবাই আশ্রয় নিয়েছিল। সেখান থেকে ডেকে তাদের বের করে আনল।
ঘরের বাইরে দ্রুত বেরিয়ে এলো আসুমানি আব্দুল্লাহ এবং শাকির সাঈদ। উদ্বেগ-আতংকে তারা বিপর্যস্ত। বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ, ‘আপনি ঠিক আছেন? আল্লাহর হাজার শোকর। কি অবস্থা এখন?’ কম্পিত, শুকনো কণ্ঠ তার।
‘আল্লাহর রহমতে ভালো খবর। পুলিশকে মেরে ওরা ভেতরে ঢুকছিল। ওদের সাতজন মারা গেছে। সন্ত্রাসীদের গুলিতে একজন পুলিশ নিহত হয়েছে, আরেকজন মারাত্মক আহত।’
একটু থামল আহমদ মুসা। সংগে সংগেই আবার বলে উঠল, ‘এসব কথা পরে। আপনারা আসুন। পুলিশ আসছে। আপনারাই স্বাগত জানাবেন পুলিশকে।’
আহমদ মুসা আসমানি আব্দুল্লাহ এবং শাকির সাঈদকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। বেরুবার সময় বাইরের ড্রইংরুমের দরজা, বারান্দায় ৬টি লাশ পড়ে থাকতে দেখল।
পুলিশের তিনটি জীপ ও দুইটি ক্যারিয়ার এসে আসুমানি আব্দুল্লাহর বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়াল। পুলিশের তিনটি জীপ থেকে প্রায় এক সাথেই নামল পুলিশ প্রধান এবং পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন অফিসার। গাড়ি থেকে নেমেই তারা বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া মানুষের দেহ ও গাড়ির দিকে নজর করল। তাদের চোখ এরপর ছুটে গেল গেটের সামনে পড়ে থাকা পুলিশের দিকে। তারা ছুটল নিহত, আহত পুলিশের দিকে। তারা তাকাল আহমদ মুসাদের দিকেও।
.
পুলিশ প্রধানসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন অফিসাররা বসেছে আসুমানি আব্দুল্লাহর বাইরের ড্রইংরুমে।
দরজা ও বারান্দার উপরের লাশগুলো পুলিশ নিয়ে গেছে। ড্রইংরুম ও বারান্দা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করেছে বাড়ির কাজের লোকজন।
পুলিশ অফিসারদের সামনে একই সোফায় বসেছে আহমদ মুসা, আসমানি আব্দুল্লাহ ও শাকির সাঈদ।
পুলিশ প্রধান আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অভিনন্দন মি. আবু আব্দুল্লাহ। আমি আতংক বোধ করছি আপনি না থাকলে আজ এ বাড়িতে যা ঘটত তা নিয়ে।
‘না থাকলে আল্লাহ্ অন্য কোনোভাবে বাড়ির লোকদের রক্ষা করতেন, যদি তিনি চাইতেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের কাছে দৃশ্যমান যা তা নিয়েই আমরা কথা বলছি জনাব।’ বলেই পুলিশ প্রধান তাকাল আসুমানি আব্দুল্লাহর দিকে। বলল, ‘আপনাদের নিয়ে এসব কি ঘটছে জনাব আব্দুল্লাহ?’
‘আমাদেরও কথা এটাই স্যার, এসব কি ঘটছে, কেন ঘটছে? আমাদের অপরাধ কি?’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘আমরাও তো সেটাই চিন্তা করছি। কিছু একটা ঘটনাতো আছেই। তা না হলে অন্য কেউ নয় আপনারা টার্গেট হলেন কেন? সেই কিছু একটা ঘটনারই আমরা সন্ধান করছি। আজ সকালে আপনার মেয়ে ম্যাডাম সাদিয়াকে কিডন্যাপ করতে তারা পারেনি। সন্ধ্যায় আবার তারা শিকারকে ধরার জন্যেই এসেছিল, এটাই আমরা মনে করছি। যদি তাই হয়, তাহলে ম্যাডাম সাদিয়াই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু। কেন্দ্রবিন্দু কেন? ম্যাডাম সাদিয়ার সাথে তাদের সম্পর্ক কি? এ প্রশ্নের উত্তর পেলে সামনে অগ্রসর হওয়া আমাদের জন্যে সহজ হবে।’ দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল পুলিশ প্রধান।
‘আমি কিছু বলতে পারি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘অবশ্যই। ওয়েলকাম।’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘সন্ত্রাসীদের সন্ধ্যার আক্রমণের কারণ প্রতিশোধ নেয়াও হতে পারে। তাদের পাঁচজন লোক মারা গেছে সকালের ঘটনায়। এ পরিবারের লোকদের হত্যা করে প্রতিশোধ নেওয়াটাও তাদের লক্ষ্য হতে পারে। আরেকটা বিষয়, আজ সকালে ম্যাডাম সাদিয়া টার্গেট হয়েছিলেন কেন? আমার মনে হয় ম্যাডাম সাদিয়া তাদের টার্গেট ছিল না, টার্গেট ছিল ম্যাডাম সাদিয়া স্টেটমেন্ট রেকর্ড করার জন্যে যাতে পুলিশ অফিসে যেতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা। ম্যাডাম সাদিয়াই একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী, যে ড্রাইভারকে এবং গাড়িকে খুব কাছ থেকে দেখেছে। বিশেষ করে ড্রাইভারকে দেখা তারা বিপজ্জনক মনে করতে পারে।’ বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ প্রধানের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে একটু ঝুঁকে পড়ে পাশের অফিসারের সাথে কথা বলল। ফিরে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ধন্যবাদ আবু আব্দুল্লাহ। আপনি ঘটনার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন, যা খুবই যৌক্তিক। আমারও নিশ্চিত মনে হচ্ছে, ম্যাডাম সাদিয়া টার্গেট হবার এটাই প্রকৃত কারণ হতে পারে।’
‘আরেকটা বিষয় জনাব। প্রথম ঘটনায় ট্রাকটি যখন ম্যাডাম সাদিয়াদের গাড়িটাকে আঘাত করে, তখন গাড়িতে ম্যাডাম সাদিয়ার ছোট দুই বোন ছিল, কিন্তু ম্যাডাম সাদিয়া নেমে গিয়েছিলেন গেট খুলতে। এটা আক্রমণকারী ট্রাক ড্রাইভারের অবশ্যই চোখে পড়েছে। এ সত্ত্বেও সে কারটিকে চাপা দিয়ে ম্যাডাম সাদিয়ার দুই বোনকে মেরেছে। এর অর্থ বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি হয়ে ফেরা ম্যাডাম সাদিয়ার দুই বোনই ছিল তাদের টার্গেট।’ বলল আহমদ মুসা।
পুলিশ প্রধানের চোখে-মুখে প্রসন্নতা। কিন্তু সংগে সংগে কিছু বলল না। ভাবছিল সে।
একটু সময় নিয়ে পুলিশ প্রধান বলল, ‘আপনি একটা সূক্ষ্ম বিষয় ধরেছেন, ধন্যবাদ আবু আব্দুল্লাহ। আপনার যুক্তির সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু ঐ দু’টি ছোট্ট কিশোরী টার্গেট হলো কেন? আপনি কি এ নিয়ে কোনো চিন্তা করেছেন?’
‘আমি অনেকগুলো অপশন নিয়ে ভাবছি জনাব। কিন্তু কোনোটাই সিদ্ধান্তের জন্যে যথেষ্ট হয়নি। সিদ্ধান্তের জন্যে সন্ত্রাসীদের পরিচয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিচয় উদ্ধারে আপনাদের অনুসন্ধান কত দূর জনাব?’ বলল আহমদ মুসা।
‘বলতে গেলে এখনও শূন্যের কোঠায়।
বলে পুলিশ প্রধান তাকালো গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমির দিকে বলল, ‘এ ব্যাপারে আপনার কি কিছু বলার আছে?’
‘স্যার যা বলেছেন, সেটা আমারও কথা। পরিচয় উদ্ধারে আমাদের অগ্রগতি প্রায় শূন্য। ১২টি লাশ ছাড়া আর কোনো তথ্য-উপাত্ত আমরা পাইনি। বিস্ময়কর হলো, লাশগুলোর পকেট থেকে কিছুই পাওয়া যায়নি আগের পাঁচটি লাশের কাছ থেকে যে স্টেনগান রিভলভার পাওয়া গেছে, সে সব লাইসেন্সবিহীন অবৈধ অস্ত্র। এই ঘটনায় যে অস্ত্র পাওয়া গেছে সেগুলোও তাই। যে ১২টি লাশ পাওয়া গেছে তারা সবাই বুরুন্ডির। থামল গোয়েন্দা প্রধান মুইজি বোকুমি।
‘ওদের কাছ থেকে একটা সিম্বল বা মনোগ্রাম পাওয়া গেছে, যা ওদের পরিচয় জ্ঞাপক বলে আমার মনে হচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শুনেই পুলিশ প্রধান রাজ্যের কৌতূহল নিয়ে তাকিয়েছে আহমদ মুসার দিকে। গোয়েন্দা প্রধানও নড়ে-চড়ে বসেছে। ‘আপনি পেয়েছেন? সন্ত্রাসীদের লাশ থেকে?’ পুলিশ প্রধান বলল। ‘সন্ত্রাসীদের জ্যাকেট ও শার্ট থেকে সিম্বল পেয়েছি। লাশগুলো এখনো গাড়িতে আছে নিশ্চয়। আপনি কোনো পুলিশকে নির্দেশ দিন লাশের শার্ট- জ্যাকেটের কলারে ‘মেড ইন’ স্টিকার চেক করার জন্যে।’ বলল আহমদ মুসা পুলিশ প্রধানকে লক্ষ্য করে।
সংগে সংগে পুলিশ প্রধান তাকাল পাশের পুলিশ অফিসারের দিকে।
‘আমি দেখছি স্যার।’ বলে উঠে দাঁড়াল পুলিশ অফিসারটি।
বাইরে বেরিয়ে গেল সে।
‘সিম্বলটি এই ৬টি লাশে পেয়েছেন, না সকালের লাশগুলোতে পেয়েছিলেন মি. আবু আব্দুল্লাহ?’ বলল পুলিশ প্রধান আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘এগারোটি লাশেই আমি পেয়েছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘আমাদের পুলিশরা কিন্তু সার্চ করে কিছুই পায়নি। ধন্যবাদ মি. আবু আব্দুল্লাহ আপনাকে। আপনাকে যতই দেখছি, বিস্ময় আমার বাড়ছে। প্রথমে কাগজ-পত্র দেখেই আমার অবাক লেগেছিল যে, একজন লোকের ব্যাপারে এতগুলো দেশ বিশেষ করে চীন, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ একই রকম আগ্রহ দেখাতে পারে কি করে?’ বলল পুলিশ প্ৰধান।
আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘নানা ঘটনায় দেশগুলো আমাকে চেনে। তারা আমাকে পছন্দও করে। তাই তারা হয়তো আমার উপকার করতে চেয়েছে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘জনাব দেশগুলোকে সবার মতো আমিও চিনি। তারা বড় মানে খুব বড় উপকার না পেলে এভাবে যেচে কারও উপকার করতে আসা তাদের জন্যে স্বাভাবিক নয়।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘আমি বুজুমবুরায় এসে দেশগুলোর দুতাবাসের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। এ কারণে ব্যাপারটা তাদের সৌজন্যমূলক হতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল। হাসল পুলিশ প্রধান। বলল, ‘জনাব, আপনি বুজুমবুরায় এসেছেন আজ সকালে। আমি খবর নিয়ে জেনেছি ইউজিজি এসেছেন আপনি তিনদিন আগে। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনার ব্যাপারে আমাকে ব্রিফ করেছেন তারও আগে। আর…’
পুলিশ প্রধানের কথার মাঝখানেই প্রবেশ করল বাইরে যাওয়া সেই পুলিশ অফিসার।
পুলিশ প্রধান কথা বন্ধ করে তাকাল পুলিশ অফিসারের দিকে। বলল, ‘আসুন মি. অফিসার। কি ফল নিয়ে এলেন?’
‘স্যার, ৬টি লাশের শার্ট ও জ্যাকেটের ‘মেড ইন’ স্টিকারে সত্যিই একটা বিশেষ সিম্বল আছে। ওটা আসলেই ‘মেড ইন’ স্টিকার, না কোনো কিছুর সিম্বল তা হঠাৎ করে বলা মুস্কিল। আমি একটা স্টিকার ছিঁড়ে এনেছি।’
বলে অফিসারটি স্টিকারটা পুলিশ প্রধানের হাতে তুলে দিল।
মনোযোগের সাথে স্টিকারটার উপর নজর বুলিয়ে পুলিশ প্রধান তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘জনাব আবু আব্দুল্লাহ, এটা ‘মেড ইন’ স্টিকার নয় কেন? এটা একটা ব্ল্যাক ক্রস। এর বটমে রাউন্ড করে SCA লিখা। হতে পারে তো এটা একটা ‘মেড ইন’ স্টিকার। SCA কোনো কোম্পানির নাম হতে পারে, যদিও SCA-এর অর্থ করা যাচ্ছে না।’
আহমদ মুসা SCA কোনো রাজনৈতিক বা সন্ত্রাসী সংগঠন কিনা এর উত্তর সন্ধানে তার রাজনৈতিক জাদুঘরে যাওয়ার বিষয় উল্লেখ করে বলল, ‘ব্ল্যাক ক্রস সিম্বল-এর বটমে রাউন্ড করে তিন বা তার চেয়ে বেশি বর্ণের সমষ্টি পাওয়া গেছে। এমন প্রত্যেক মনোগ্রামের বর্ণমালার প্রথম অক্ষর S সবক্ষেত্রেই কমন। এটা একটা দিক, আর একটা বিষয় হলো, জ্যাকেট, শার্ট, টিশার্ট সবক্ষেত্রে ‘মেড ইন’ মনোগ্রামের জায়গায় এই সিম্বলটা আছে এবং কোনো একজন লোকের জামায় এ সিম্বল অনুপস্থিত নেই। এই দুই বিবেচনা থেকে ধরে নিতেই হবে যে, ‘মেড ইন’ নিশ্চয় কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সিম্বল, স্টিকার নয়।’
পুলিশ প্রধানের ভ্রু কুঞ্চিত হয়েছে। অন্যান্য পুলিশ অফিসারের চোখে বিস্ময়।
কেউ কথা বলল না। পুলিশ প্রধানের চোখেও বিস্ময় এবং কৌতূহল। তার দুই চোখ আহমদ মুসার দিকে নিবদ্ধ। এক সময় সে বলে উঠল, ‘মি. আবু আব্দুল্লাহ, আপনার সূক্ষ্ম দৃষ্টি এবং বিবেচনা বোধ অতুলনীয়। মন আমার খুব উদগ্রীব হয়ে উঠেছে জানার জন্যে যে, আপনি আসলে কে? অতুলনীয় আপনার সূক্ষ্ম দৃষ্টি, অতুলনীয় অ্যাকশন। সকালের ঘটনায় এবং এই সন্ধ্যায় আপনি একা এক হাতে আক্রমণে আসা সন্ত্রাসীদের যে নির্মূল করেছেন, তার কোনো দৃষ্টান্ত আমার কাছে নেই। একমাত্র ফিল্ম ছাড়া এমন অ্যাকশন আমি দেখিনি এবং শুনিনি। জনাব আসলে আপনি কে? কেন আপনি আমাদের বুজুমবুরায়?’
আহমদ মুসা সংগে সংগে কথা বলল না। তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে
একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘মি. অ্যান্টোনিও বাতুমবুরা, সাম্প্রতিককালে বুজুমবুরায় কিছু অস্বাভাবিক ঘটনাসহ কয়েকটি বিশেষ হত্যাকাণ্ড ও কিডন্যাপের ঘটনা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমি তার কারণ অনুসন্ধানেই বুজুমবুরায় এসেছি। আমি যে সন্দেহ করেছিলাম, মনে হচ্ছে আমার সে সন্দেহ বাস্তব হতে যাচ্ছে।’
পুলিশ প্রধানসহ উপস্থিত সবার চোখে-মুখেই প্রবল বিস্ময় ও অপার কৌতূহল।
‘কি বাস্তব হতে যাচ্ছে? দয়া করে বলবেন কি? আমাদের অনুসন্ধানেও কাজে লাগবে।’ বলল পুলিশ প্রধান।
‘বিষয়টা এখনো একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। আরও একটু নিশ্চিত হবার পর অবশ্যই আপনাদের জানাব। আমার মনে হয় সেটাই ভালো হবে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘অপেক্ষা একটা কঠিন ব্যাপার, তবে মনে করি আপনার কথাই ঠিক।’
পুলিশ প্রধান একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘ব্ল্যাক ক্রস সিম্বলের সাথে যে তিনটা বর্ণ রয়েছে, তার অর্থ নিশ্চয় করেছেন। সেটা কি?’
‘আমি বলেছি, ‘ব্ল্যাক ক্রস’ সিম্বলের তিন বা ততোধিক বর্ণের সমষ্টি দুনিয়ার অনেক দেশের সংস্থা-সংগঠনের তালিকায় পাওয়া গেছে যেমন SIC, SCC, SPI ইত্যাদি। এগুলোর অর্থ হলো যথাক্রমে Saviour of Indo- China (SIC), Saviour Caucasus Countries (SCC) এবং Saviour Pacific Island (SPI). অনুরূপভাবে এখানে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে আমরা যে সিম্বল পেয়েছি, তার তিনটি বর্ণ SCA-এর অর্থ করতে পারি Saviour of Central Africa.’ বলল আহমদ মুসা।
‘তার মানে এই সন্ত্রাসীরা সেন্ট্রাল আফ্রিকার ত্রাণকর্তা?’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘তাদের নামের দাবি তো সেটাই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এটা বর্ণ তিনটির অর্থ হলে ক্রসের অর্থ কি? ক্রস তো খ্রিস্টানদের সিম্বল। তাহলে SCA কোনো খ্রিস্টান সন্ত্রাসী সংগঠন?’ পুলিশ প্রধান বলল। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের সাথে উদ্বেগ।
‘তাই তো মনে হচ্ছে।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামলেও কথা বলল না কেউ। পুলিশ প্রধানসহ সব পুলিশ অফিসারের চোখে-মুখেই উদ্বেগ এবং বিস্ময়। সবার চোখে-মুখে প্রবল বিব্রত ভাব।
শেষে নীরবতা ভাঙল পুলিশ প্রধানই। বলল, ‘মি. আবু আব্দুল্লাহ, মনে হয় আমরা বিরাট একটা সমস্যায় পড়লাম। ঘটনাগুলোর মোড় তো ঘুরে যাচ্ছে একটা উদ্বেগজনক দিকে।
একটু থামল পুলিশ প্রধান। একটু নড়েচড়ে বসল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘মি. আবু আব্দুল্লাহ আপনার সাহায্য আমাদের দরকার হবে। আপনাকে কি আমাদের সাথে পাব?’
‘অবশ্যই পাবেন। তবে সাথে থাকার দরকার নেই। আপনারা কাজ করুন, আমি আমার মতো করে কাজ করি। প্রয়োজনে আমি আপনাদের সাহায্য চাইব, আর আমিও সব সময় আপনাদের সাহায্যে আসতে প্রস্তুত থাকব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ জনাব। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে এ নিয়ে কথা বলব। প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ও বিষয়টা জানবেন। কিন্তু আপনার পরিচয়টা কি হবে। কি পরিচয় দেব আপনার?’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘আমার পরিচয় মনে হয় প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী মহোদয় জানেন। আপনারাও নিশ্চয় জানবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ জনাব। অনেক ধন্যবাদ। দেখা হবে আবার। উঠছি আমরা এখন। উঠে দাঁড়াল পুলিশ প্রধান। হ্যান্ডশেক করল আহমদ মুসার সাথে।
পুলিশ প্রধান আসুমানি আব্দুল্লাহর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাদের সৌভাগ্য যে জনাব আবু আব্দুল্লাহর মতো লোকের সাহায্য লাভের সুযোগ ঈশ্বর আপনাদের করে দিয়েছেন। চিন্তা করবেন না। আপনাদের বাড়িতে পুলিশ প্রহরা আজ থেকে বাড়বে। আপনারা কেউ বাইরে গেলে পুলিশ প্রহরা পাবেন। এ অবস্থা থাকবে না। অপরাধীরা অবশ্যই ধরা পড়বে।’
পুলিশরা সবাই চলে গেল। পাঁচজনের একটা পুলিশ প্রহরা বসল আসুমানি আব্দুল্লাহদের গেটে।
আহমদ মুসাকে নিয়ে আসুমানি আব্দুল্লাহ, শাকির সাঈদ বাড়ির ভেতরে চলল।
.
‘এটাকে শুধু বিপদ বললে ভুল হবে দাদু। বড় একটা সংকট আমাদের পরিবারে এটা। এর শিকড় শুধু বুরুন্ডি নয়, বুজুমবুরা নয় বাইরেও বিস্তৃত।’ বলল সামিরা সাদিয়া।
তার দাদু ইদি আসুমানি মোহাম্মদ সেই ইজিচেয়ারে আধশোয়া অবস্থায়। সেই ইজি চেয়ার এটা হলেও এটা সেই বাড়ি নয়।
সেই রাতেই সেই বাড়িটা ছেড়ে তাদের আরেকটা বাড়িতে তারা এসে উঠেছে। তাদের এই বাড়িটাও লেক ট্যাংগানিকা-তীরের কাছাকাছি, কিন্তু আগের বাড়ি থেকে প্রায় মাইল খানেক দক্ষিণে। প্রথমে কথা ছিল শুধু বাড়ির মেয়েরাই এ বাড়িতে উঠবে, কিন্তু আহমদ মুসার পরামর্শে সবাই এসে উঠেছে এই বাড়িতে। দুই বাড়ির মধ্যে যাতায়াত চললে এ বাড়ি শত্রুদের চোখে পড়ে যেতে পারে, এই জন্যে সবাই একসাথে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সবার অনুরোধে নিরাপত্তার দিকটা চিন্তা করে অন্তত কয়েক দিন এ বাড়িতে থাকতে রাজি হতে হয়েছে আহমদ মুসাকে। বাড়িটাও বেশ বড়, কয়েকটা পরিবার এক সংগে থাকার মতো।
সামিরা সাদিয়ার কথা শেষ হতেই তার দাদু তার দিকে চোখ টেনে তুলে বলল, ‘কি বলছিস সাদিয়া, ঘটনা বুরুন্ডির রাইরেও বিস্তৃত? তাহলে আমরা কি কোনো ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছি, মানে কোনো ষড়যন্ত্র আমাদের জড়িয়ে ফেলেছে?’
ঘরে ঢুকেছিল সাদিয়ার মা, বাবা। তারাও শুনেছে তাদের বাবার কথা।
বসতে বসতে সাদিয়ার বাবা আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল তার বাবা ইদি আসুমানি মোহাম্মদকে লক্ষ্য করে, ‘ঠিক বাবা, বিরাট এক ষড়যন্ত্রে আমাদের জড়ানো হয়েছে।’
‘কারা জড়াবে? কি ষড়যন্ত্রে জড়াবে? আমাদের তো এ রকম কোনো শত্রু নেই।’ বলল বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘কি ষড়যন্ত্র সেটাই তো জানা যাচ্ছে না বাবা। তবে আমাদের মেহমান আহমদ মুসা সন্ত্রাসীদের একটা সিম্বল দেখে যে গ্রুপ বা সংগঠনের নাম বলছেন, সে সংগঠন ধর্মীয় পরিচয়ে খ্রিস্টান।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘খ্রিস্টান সংগঠন? এই ভয়াবহ কাজগুলো করছে একটা খ্রিস্টান সংগঠন!’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। তাঁর কণ্ঠে বিস্ময়।
‘হ্যাঁ বাবা। নাম ‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা’।’
‘সেভিয়ার অব সেন্ট্রাল আফ্রিকা?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। স্বগত কণ্ঠে প্রশ্নের আকারে নামটি উচ্চারণ করল সে। তার কণ্ঠে হতাশা। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ইদি আসমানি আব্দুল্লাহ। চোখ দু’টিও তার বুজে গেছে। অল্পক্ষণ পরেই চোখ খুলল সে।
ইজি চেয়ারে শোয়া অবস্থায় থেকেই সে ধীরে ধীরে বলল, ‘অতীতের কি পুনরাবৃত্তি হচ্ছে আব্দুল্লাহ! অনেক অনেক বছর আগে কতকটা এই নামেরই একটা সন্ত্রাসী খ্রিস্টান সংগঠনের উদ্ভব ঘটেছিল এই বুজুমবুরায়। নাম ছিল ‘সেভিয়ার অব রাইটস অব আফ্রিকান পিপলস’ (SRAP)। মুসলিম বিদ্বেষী বেলজিয়ান উপনিবেশিক শাসকরা এদের পরিচালনা করতো পর্দার অন্তরালে থেকে। হত্যা-সন্ত্রাসের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি করা ছিল এই সন্ত্রাসী গ্রুপের কাজ। একদিকে এরা যখন প্যানিক সৃষ্টি করছিল মুসলমানদের মধ্যে, ঠিক সে সময় ঔপনিবেশিক সরকার মুসলমানদের উপর এ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় যে, মুসলমানদেরকে বুজুমবুরা শহরের কেন্দ্রীয় এলাকা থেকে সরে গিয়ে শহরের প্রান্ত বা উপকণ্ঠ এলাকায় বসতি স্থাপন করতে হবে। তারা জায়গাও ঠিক করে দেয়। উপমহাদেশীয় ও আরব মুসলমানদেরকে শহরের প্রশাসনিক এলাকার পশ্চিমে লেক ট্যাংগানিকার তীর এলাকায় বসতি স্থাপন করতে হবে। সোহাইলিদের যেতে হবে শহরের প্রান্তে বুয়েনজি এলাকায় এবং আফ্রিকী মুসলিমদের বসতি হবে বেলজি অঞ্চলে। ঔপনিবেশিক শাসকরা আরও আইন করল এক গ্রুপের বসতিতে অন্য গ্রুপ যেতে পারবে না, যোগাযোগও রাখতে পারবে না। এছাড়া অমুসলিম এলাকায়ও তাদের যাওয়া চলবে না এবং ধর্মীয় প্রচারমূলক কোনো কাজও তারা করতে পারবে না। একদিকে ‘এসআরএপি’র সন্ত্রাস ও অন্যদিকে ঔপনিবেশিক সরকারের শাসন-খড়গ মুসলমানদের বাধ্য করে তাদের বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পত্তি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে।’ একটু দম নিল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
এই ফাঁকে আসমানি আব্দুল্লাহ তার বাবাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘বাবা, ঔপনিবেশিক বেলজিয়ান শাসকরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন, কোন্ উদ্দেশ্যে?’
একটু হাসল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। বলল, ‘আজ থেকে সত্তর বছর আগে আমার বাবাকে এই প্রশ্নই করেছিলাম। তিনি সংক্ষিপ্ত জবাবে বলেছিলেন, শতকরা নব্বই ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত বুজুমবুরাকে মুসলিম সংখ্যালঘু শহরে পরিণত করার লক্ষ্যেই ছিল এই পদক্ষেপ। পরে আমি অনেক কাগজ-পত্র ঘেঁটে জেনেছিলাম আরও কিছু।’
‘কি সেটা দাদু?’ প্রশ্ন সামিরা সাদিয়ার। সে এই কথাগুলোকে গোগ্রাসে গিলছিল।
‘আমার বাবা যেটা বলেছিলেন, মূল কথা সেটাই। আসলে ঔপনিবেশিক খ্রিস্টান শাসকরা ভয় করছিল, মুসলমানদের স্বাধীনভাবে থাকতে দিলে তাদের খ্রিস্টান স্বার্থ এক ইঞ্চিও সামনে এগুবে না এবং শুধু বুজুমবুরা নয়, গোটা বুরুন্ডি মুসলিম জনপদে পরিণত হবে। এমনটা তারা তাদের চোখের সামনে দেখেছিল। ১৯১০ সালে বুজুমবুরার মূল বসতি ছিল ২০০০ যাদের সবাই ছিল মুসলমান। এই সময় ঔপনিবেশিক শাসকরা গ্রাম এলাকা ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিয়ে এসে হাজার খানেক অমুসলিম বসতি গড়ে তোলে বুজুমবুরায়। ১৯৩০ সালে বসতির সংখ্যা দাঁড়ায় চার হাজার। ধর্মীয় পরিচয় গণনায় দেখা গেল চার হাজার বসতির প্রায় সবাই মুসলমান। অমুসলিম যারা নতুন বসতি গড়েছিল সবাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এটা দেখার পরই ঔপনিবেশিক খ্রিস্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐ সিদ্ধান্ত গ্রহণ– করে। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। ১৯৬২ সালে বুরুন্ডি যখন স্বাধীন হয়, তখন বুজুমবুরায় বসতি ছিল পঞ্চাশ হাজার, যার মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র বার থেকে চৌদ্দ হাজার।’
থামল একটু ইদি মোহাম্মদ। একটু ভাবল। বলল, ‘ভাবছি তখন সন্ত্রাসী গ্রুপ SRAP উদ্ভব ঘটানো হয়েছিল বুজুমবুরায় মুসলমানদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার জন্যে, আজকের সন্ত্রাসী গ্রুপকে কেন সামনে আনা হলো? কারা আনল? আমরা তার টার্গেট হলাম কেন?’
‘এই ‘কেন’-এর উত্তর পেলে তো সবই পাওয়া হয়ে গেল দাদু। স্যার হয়তো কিছু আন্দাজ করেছেন বা জেনেছেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিত না হয়ে এ সম্পর্কে কিছু বলবেন না, এটা তো তিনি পুলিশকেও জানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং তাঁর কাছ থেকে এখন কিছু জানা যাবে না।’ বলল সামিরা সাদিয়া।
‘তা না বলুন মা, তিনি কিছু জেনেছেন এটাই আমাদের জন্যে সান্ত না। তিনি আমাদের কাছে আল্লাহর রহমত। তিনি যে আমাদের শুধু রক্ষা করেছেন তা নয়, হত্যা-সন্ত্রাসের ঘটনার নিমিত্ত পুলিশ আমাদের উপরই চাপাতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা সেটা ঘুরিয়ে আসল দিকে নিয়ে গিয়েছেন। পুলিশ এটা গ্রহণও করেছে। আসমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘বাবা, স্যার শুধু যুদ্ধ নয়, যুক্তি-বুদ্ধিতেও বিস্ময়কর। কথারও জাদুকর তিনি। কখন কি বলতে হবে, সেটা যেন তার ঠিক করাই থাকে। বলল সামিরা সাদিয়া।
‘তাতো হবেই মা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট, চীনের প্রেসিডেন্ট, রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী যেখানে তাঁকে সমীহ করেন, সেখানে তিনি অসাধারণের মধ্যে এক অসাধারণ তো হবেনই। আল্লাহ তাকে আমাদের সাহায্যে না পাঠালে যে কি হতো সেটা ভাবতেও ভয় লাগে। আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল। তার কণ্ঠ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আসুমানি আব্দুল্লাহর অনুভূতি সকলেরই অনুভূতি হয়ে উঠেছিল। তাদের সকলেরই মুখ ভারি, নিচু। একটা নীরবতাও নেমে এসেছিল।
‘এত বড় মানুষ। আমাদের সকলের অনুরোধে এখানে থাকছেন আমাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। দেখ, সব সময় তার খোঁজ-খবর রেখ তার কোনো অসুবিধা যেন না হয়।’ নীরবতা ভেঙে বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘তিনি যতক্ষণ বাসায় থাকেন, আমরা সব সময় তার আশেপাশে থাকি। আর দাদু, আমরা তার খোঁজ খবর রাখব কি, তিনিই তো আমাদের . সব খোঁজ-খবর রাখেন।’ বলল সামিরা সাদিয়া।
‘কেমন খোঁজ-খবর?’ বৃদ্ধ ইদি মোহাম্মদ বলল।
‘দাদু গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আজ ক্লাস বণ্টনের একটা পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে, যেখানে সব শিক্ষকের উপস্থিতি অপরিহার্য। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব কি না। তিনি বললেন, না যেতে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে এক মাসের ছুটি দিয়েছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কি করে হলো, আমি তো ছুটি চাইনি, দরখাস্ত করিনি? তিনি জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয় আগে থেকেই ঘটনা জানত। আমি আমার পরিচয় দিয়ে ভিসিকে বলেছিলাম, অবস্থার কারণে কিছু দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া তার জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ। শুনেই তিনি আপাতত এক মাসের ছুটি দিয়েছেন।’ একটু থামল সাদিয়া।
সংগে সংগেই তার বাবা জিজ্ঞেস করল, ‘কি পরিচয় উনি দিয়েছিলেন?’
‘আমিও অবাক হয়ে এ প্রশ্ন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন যে, আমাদের কেসটা তিনি দেখছেন।
‘আলহামদুলিল্লাহ। এত দিকে তাঁর নজর! আমাদের নিজেদের ব্যাপারে যে চিন্তা আমরা করতে পারিনি, মাথায়ও আসেনি, সেটা তিনি করলেন! আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন। আল্লাহ্ তাঁকে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়েছ তো বোন?’ ইদি মোহাম্মদ বলল।
‘আমি ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, আমাকে নয়, ধন্যবাদ আল্লাহকে দেবেন। আমি আলহামদুলিল্লাহ! বলেছিলাম। তিনি আর কিছু বলেননি। পর্দার এপারে আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সালাম দিয়ে আমি চলে আসি। সালাম নেয়ার শব্দ আমি শুনেছিলাম। বলল সাদিয়া।
‘তোমার এই শেষ বক্তব্যটা অপ্রাসঙ্গিক। কেন বললে তুমি?’ সাদিয়ার দাদু ইদি মোহাম্মদ বলল। তার মুখে একটু হাসি 1
‘বললাম এই কারণে দাদু যে, তাঁর কাছে আমাদের শেখার বহু কিছু আছে। তখন শয়তান আমার ভেতর থেকে বলছিল, তিনি আরও কিছু আমাকে বলুন। তাঁর নীরবতা, নির্লিপ্ততা আমার ভেতরের শয়তানকে চপেটাঘাত করেছে।’ বলল সাদিয়া।
‘ধন্যবাদ বোন, একথা প্রকাশ করে তুমিও শয়তানকে চপেটাঘাত করলে। সাদিয়ার দাদু ইদি মোহাম্মদ বলল।
‘এ শক্তি আমি পেয়েছি দাদু তাঁর কাছ থেকে, আল্লাহর সাহায্যে।’ বলল সামিরা সাদিয়া।
এ সময় সাদিয়ার ছোট ভাই ঘরে ঢুকেই বলল, ‘আপাজি, স্যার বাইরে গেলেন।
‘তো তুমি সেখানে অপেক্ষা কর। তিনি এলে দরজা খুলে দেবে।’ বলল সামিরা সাদিয়া।
‘সেই বাইরে যাওয়া নয় আপা। তিনি তাঁর ছোট ব্যাগটা নিয়ে, কেটস পরে মুখে মোচ লাগিয়ে বেশ তৈরি হয়ে বেরিয়েছেন। আমাদের গাড়ি নেননি, একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতেই গেলেন।’ আমর ইদি মোহাম্মদ বলল। আসমানি আব্দুল্লাহ তাড়াতাড়ি ঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, ‘এই রাত দশটায় তিনি বেরুলেন! কোথায় বেরুলেন, কিছু বলেছেন? জান কিছু তুমি আমর?’
আমর ইদি মোহাম্মদ কিছু বলার আগেই সামিরা সাদিয়া বলল, ‘তাঁর প্রস্তুতি বলে দিচ্ছে বাবা, তিনি বিশেষ কোনো জায়গায় গিয়েছেন।’
‘বিশেষ কোনো জায়গা মানে? শত্রুর সন্ধানে কোনো অভিযানে?’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘আমি তাই মনে করি বাবা।’ সাদিয়া বলল, তার মুখ মলিন। কণ্ঠ অনেকখানি শুষ্ক।
আসমানি আব্দুল্লাহর চোখে-মুখে কিছুটা উদ্বেগ। আমর মোহাম্মদকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমাকে কিছু বলেছেন তোমার স্যার?’
আমর মোহাম্মদ তার ডান হাতের মুঠো থেকে একটা চিরকুট বের করে তার বাবাকে দেখিয়ে বলল, ‘স্যার আমাকে বলে গেছেন যে, রাত দু’টার মধ্যেও যদি তিনি না ফেরেন? তাহলে আমি যেন এই নাম্বারে টেলিফোন করে তিনি না ফেরার কথাটা বলি।’
‘ফিরবেন না মানে?’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
সামিরা সাদিয়ার চোখে-মুখে আতংকের কালো ছায়া। সে আমরের হাত থেকে টেলিফোন নাম্বার লিখা চিরকুট নিয়ে বলল, ‘বাবা, ফিরবেন না মানে, হয় তিনি শত্রুর হাতে বন্দি হবেন, নয়তো…।’
কথা শেষ করতে পারল না সামিরা সাদিয়া। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।
‘নয়তো কি সাদিয়া?’
‘আমি ঐ কথা উচ্চারণ করতে পারবো না বাবা। ভেঙে পড়ল সাদিয়ার কণ্ঠ।
কষ্ট করে ইজি চেয়ারে সোজা হয়ে বসল বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। বলল, ‘তোমরা মৃত্যুর কথাটাই উচ্চারণ করতে পারছ না, আর আমার সে ভাইটি মৃত্যুকে আগাম বরণ করে নিয়েই বেরিয়েছেন অভিযানে এবং সেটা নিশ্চয় আমাদের জন্যে, তাঁর নিজের কোনো স্বার্থে নয়।’
‘আর বলো না দাদু। আমরা তাঁকে বিপদে ফেলেছি।’ বলল সাদিয়া। আবেগের একটা আর্তনাদ তার কণ্ঠে। চোখ দু’টি অশ্রু সজল।
‘তাঁকে আমাদের পর্যায়ে নামিয়ে দেখলে আমাদের কষ্ট বাড়বে বোন। তিনি আল্লাহর সৈনিক। বিপদ মাথায় থাকে তার সব সময়। জীবন-মৃত্যুর লড়াই যেখানে, তেমন একটা বিপজ্জনক অভিযানে তিনি যাচ্ছেন, আমাদেরকে কিছুই জানালেন না। এর কারণ এ লড়াইকে তিনি জীবনের একটা সাধারণ অংশ মনে করেন। বলল বৃদ্ধ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘জীবন-মৃত্যুর লড়াই যদি সাধারণ হয়, তাহলে তার জীবনে অসাধারণ কি দাদাজী?’ সাদিয়া বলল।
‘জানি না বোন তাঁর জীবনে অসাধারণ কোনো কিছু আছে কিনা। তবে এটা জানি, নববধূ ফেলে, বাসর ঘর ফেলে যারা জেহাদের ময়দানে ছুটে গেছেন, তিনি ও আমরা তাদেরই উত্তরসূরী। এদের কাছে শান্তির গৃহাঙ্গন এবং রক্তঝরা রণাঙ্গন সবই জীবনের অংশ, ভিন্ন কিছু নয়।’ বলল ইদি মোহাম্মদ।
‘তোমার কথা মানলাম দাদু। কিন্তু মানুষ তো মানুষই। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টিগতভাবে দুর্বল বলে অভিহিত করেছেন। স্যার যখন বললেন ‘রাত দুইটার মধ্যেও যদি আমি না ফিরি’, তখন কি তার বুকটা কেঁপে উঠেনি? আমার বুক এখনও তো কাঁপছে দাদু।’ সাদিয়া বলল। উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়া তার কণ্ঠ।
‘জানি না বোন। আমার ভাবনা তোমার মতোই। ভাইটিকে আল্লাহ ফিরিয়ে আনুন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করব।’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল। তাঁর কণ্ঠও ভারি।
কেউ কথা বলল না। সবাই নীরব।
নীরবতা ভেঙে সাদিয়ার মা বলল, ‘রাত হয়েছে, বাবাকে ঘুমাতে হবে। সবাই আমরা উঠি। আমর তুমি তোমার দাদুকে তার শোবার ঘরে নিয়ে যাও।’ বসা থেকে উঠল সাদিয়ার মা।
‘তোমরা যাও। রাত ২টা পর্যন্ত না দেখে আমার ঘুম ধরবে না। আমি এখানেই রেস্ট নেব।’ বলল ইদি আসমানি আব্দুল্লাহ।
‘আমারও ঘুম ধরবে না দাদু। টেলিফোন নাম্বারের চিরকুটটা আমার কাছে থাক। সবাই আমরা দোয়া করি। আল্লাহ করুন এ চিরকুটটা যেন ব্যবহার করতে না হয়।’ সামিরা সাদিয়া বলল বসা থেকে উঠতে উঠতে।
সামিরা সাদিয়ার আব্বা, আম্মাসহ সবাই বলল, ‘আমিন।’