বিপদে পড়ে আপনাকে বলছি
প্রতিদিন সন্ধেবেলা একটা সান্ধ্য আজকাল কেনা রমাপদবাবুর অভ্যেস। সারাদিনের খাটুনির পর অফিসপাড়া থেকে হেঁটে চলে যান বাবুঘাটে। সেখানে লাইন দিয়ে উঠে পড়েন বাসে। একটা সিট দখল করে ঝিমোতে থাকেন। কারণ, দমদম ক্যান্টনমেন্ট অনেক দূরের পথ। সুতরাং তাঁর প্রৌঢ় শরীরটা তখন একটু জিরিয়ে নেয়। নইলে বাড়ি ফেরার পরই তো নিত্যকার অভাবের সঙ্গে জুডোক্যারাটের লড়াই। এ লড়াইয়ে অভাব কখনও ক্লান্ত হয় না। তা ছাড়া তার সঙ্গে হাত মেলায় মনোরমা আর জয়িতা। বউ আর মেয়ে।
বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়লেই রমাপদবাবু ভয় পান। আবার সেই জরাজীর্ণ বট-অশ্বথের শেকড় গজানো আস্তানা। উনুনের ধোঁয়া। জনতা বাথরুম। জলের ভাগাভাগি নিয়ে চুলাচুলি। তার ওপর মনোরমা আর জয়িতা।
জয়িতার বিয়ের বয়েস পেরোতে চলল, তবু একটা পাত্র জুটল না। একটা প্রেম-ট্রেমও করে উঠতে পারল না মেয়েটা! দেখতে মন্দ নয়, কিন্তু ইদানীং খিটখিটে হয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে বোধহয় একটু লোভীও। ওর আর দোষ কী! মায়ের ধাত পেয়েছে।
কতদিন রমাপদবাবুর মনে হয়েছে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। তারপর একলা নিরিবিলি জীবন। বাড়ি ফেরামাত্রই কেউ আর কিচিরমিচির শুরু করে বিরক্ত করবে না, কিন্তু মধ্যবিত্ত সাহসে কুলোয়নি। সমাজ হচ্ছে এক অদ্ভুত অভিভাবক ও খাওয়ানোর মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই।
খরচ বাঁচানোর জন্য সকালে খবরের কাগজ কেনেন না রমাপদবাবু। তবে কম খরচে সান্ধ্য আজকাল কেনাটা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে ঠিক মানিকতলার মোড়ে এলেই তাঁর ঝিমুনি কেটে যায়। কারণ একটা বাচ্চা ছেলে সান্ধ্য আজকাল-এর গোছা নিয়ে বাসে উঠে চিৎকার করতে থাকে, সান্ধ্য আজকাল! সান্ধ্য আজকাল! রমাপদবাবু ওর কাছ থেকে একটা কাগজ কিনে পড়তে শুরু করেন। বেশিভাগই চনমনে খবর। আর প্রতি শুক্রবারে সান্ধ্যবাসর শিরোনামের বিভাগে একটা করে গল্প। রমাপদবাবু কাগজের একটি অক্ষরও বাদ দেন না। এমনকী বিজ্ঞাপনগুলোও রেহাই পায় না তার নজর থেকে।
আজ শুক্রবার। মানিকতলার ক্রসিং-এ এসে সেই চেনা ছেলেটার কাছ থেকে একটা সান্ধ্য আজকাল কিনলেন রমাপদবাবু। তার আশেপাশে আরও কেউ-কেউ কাগজ কিনলেন ছেলেটার কাছ থেকে। |||||||||| বাসের স্তিমিত আলোয় সামান্য ঝাঁকুনির মধ্যেও তিনি কাগজে চোখ বোলাতে শুরু করলেন। প্রথম কটা পাতায় চোখ বুলিয়ে চলে এলেন গল্পের পাতায়। ভারী অদ্ভুত নামের একটা গল্প ছাপা হয়েছে আজ। রমাপদবাবু গল্পটা পড়তে শুরু করলেনঃ
বিপদে পড়ে আপনাকে বলছি
সমীর সরকার
বিশ্বাস করুন, ভীষণ বিপদে পড়ে আপনাকে বলছি। আপনি সান্ধ্য আজকাল-এর পাঠক। সুতরাং আপনিই একমাত্র আমাকে বাঁচাতে পারেন এই বিপদ থেকে। আর কিছুদিন এইভাবে চললে আমি সত্যি-সত্যি পাগল হয়ে যাব।
আমার এই কাহিনি মোটেই গল্প নয়, বরং নিষ্ঠুর সত্যি। আপনার কাছে এ আমার আন্তরিক আবেদনঃ আমাকে বাঁচান! এভাবে আমি আর পারছি না।
ঘটনাটা গোড়া থেকেই তা হলে খুলে বলি।
আজকের মতোই সেদিনটা ছিল শুক্রবার। অফিস থেকে বাসে করে বাড়ি ফিরছি। হাতে ছিল আপনারই মতো এক কপি সান্ধ্য আজকাল। বাসে হকারের কাছ থেকে কেনা। বাসের অল্প আলোয় ঝিমুনি কাটিয়ে খবরের কাগজটার পাতায় চোখ বোলাচ্ছিলাম, এমন সময় পাশ থেকে কে যেন ডেকে বলল, কী ব্যাপার, সমীরবাবু! চিনতে পারছেন?
চমকে তাকিয়ে দেখি, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। আমার পাশের দুজন ভদ্রলোকের ঠিক পরেই বসে আছেন। তারও হাতে সান্ধ্য আজকাল।
বৃদ্ধের থুতনিতে সামান্য খোঁচা-খাঁচা দাড়ি। মাথার চুল প্রায় সাদা। কপালে ও গালে ভাঁজ পড়েছে। ফরসা মুখ। নাকটা বেশ মোটা ও লালচে। চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা। চশমার পাওয়ার যথেষ্ট বেশি। কারণ, কাচের ওপরে রিং-এর মতো দাগ পড়েছে, আর ভদ্রলোকের চোখজোড়া কুতকুতে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
বৃদ্ধ হাসলেন আমার দিকে তাকিয়ে। হাতের কাগজটা ভাঁজ করে বললেন, চিনতে পারলেন না তো!
আমি বেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। কাগজ পড়া মাথায় তুলে হন্যে হয়ে ভাবতে শুরু করলাম? কোথায় দেখেছি এই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে? কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।
বৃদ্ধ রঙ্গ করে বললেন, গত মাসে ব্যান্ডেলে বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলেন ভুলে গেলেন! আপনার তো সকাল-বিকেল ব্রাহ্মীশাক খাওয়া উচিত।
ব্যান্ডেলে যে আমি গত মাসে নেমন্তন্ন খেতে গেছি একথা সত্যি। আমার শ্যালিকার মেয়ের বিয়ে ছিল। কিন্তু…সেখানে এই বৃদ্ধটিকে দেখেছি বলে…।
আশপাশের লোকজন কৌতূহলী হয়ে আমাদের কথা শুনছিল। ফলে আমার অস্বস্তিও ক্রমশ বাড়ছিল।
কী করব ভাবছি, এমন সময় রহস্যময় বৃদ্ধটি আমাকে বাঁচালেন। বললেন, আসুন, একটু নামি। আপনার সঙ্গে খুব দরকারি কথা আছে। কদিন ধরেই আপনাকে খুঁজছি।
আমার যথেষ্ট অবাক লাগছিল। কিন্তু আর কথা না বাড়িয়ে ওঁর প্রস্তাবে রাজি হলাম। বাস থেকে নেমে পড়লে হয়তো নিরিবিলির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির পালাটা শেষ করা যাবে।
মানিকতলার ট্র্যাফিক সিগনালে বাস দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আমরা দুজনে নেমে পড়লাম রাস্তায়।
সামনেই একটা ছোট্ট পেট্রল পাম্প। তার পাশের আধো-অন্ধকার গলিতে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, সমীরবাবু, একটা জিনিস আপনাকে দেব। একদম খাঁটি জিনিস।
বলেই কাপড়ে জড়ানো একটা ছোট পুঁটলি পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে আমার হাতের মুঠোয় একেবারে গুঁজে দিলেন। বৃদ্ধের দড়ির মতো আঙুলের ছোঁয়া লাগল আমার হাতে। আঙুলগুলো হিমঘরের মতো ঠান্ডা।
আমি কী বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে যেন দাঁড়িয়েছিলাম। শুধু দেখলাম, ভদ্রলোকের চোখ দুটো আলোয় বিন্দু হয়ে জ্বলছে।
চলি, সমীরবাবু–পরে আবার দেখা হবে।
বৃদ্ধ চলে যাওয়ার জন্যে তৈরি হলেন।
আমি ওই আচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যেও কোনওরকমে জিগ্যেস করলাম, কোথায় দেখা হবে?
বৃদ্ধ অদ্ভুতভাবে হাসলেন। অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন। তারপর বললেন, কোথায় আবার, এই বাসেই দেখা হবে! আজকের মতন। দেখবেন সান্ধ্য আজকাল হাতে বসে আছি।
কথাটা বলেই ভদ্রলোক সরু গলি ধরে হাঁটা দিলেন। আমি পিছু ডাকতে গিয়েও থমকে গেলাম। কী নামে ডাকব?
তারপর গুটিগুটি পায়ে পুঁটলিটার ওজন পরখ করতে করতে বাস-রাস্তায় এলাম। সেখান থেকে বাস ধরে সোজা বাড়ি।
বাড়িতে ঢুকেই দেরির জন্যে একপ্রস্ত মুখঝামটা খেলাম মল্লিকার কাছে। রেগে গেলে ওকে আরও কুৎসিত দেখায়। আমাদের আস্তানাটার মতো ওর শরীরটাও শুধু হাড় আর পাঁজর দিয়ে তৈরি। তার ওপর বারো মাসের মাথাব্যথার রুগি।
তপতী একটু দূর থেকে আমাদের ঝগড়া দেখছিল। বোধহয় ভাবছিল, ঠিক কখন থেকে ও মায়ের পক্ষ নেওয়া শুরু করবে।
মা-মেয়ের এই নিত্য আক্রমণ আমি আর সইতে পারি না। তপতীটার বিয়ে দিতে পারলে আমি বাঁচতাম। আমার বোঝা অন্তত অর্ধেকটা কমত। কিন্তু সেটাই বা হচ্ছে কই!
সুতরাং নেহাতই আত্মরক্ষার জন্যে হাতের পাকানো খবরের কাগজটা তেলচিটে ময়লা বিছানার ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে বললাম, আজ আমার অফিসের একজন চেনা লোক আমাকে একটা জিনিস দিয়েছে।
ওদের কাছে ভুলেও সত্যি কথা বলা যাবে না। বললে দুজন দু-পাশ থেকে প্রশ্নে-প্রশ্নে আমাকে একেবারে নাজেহাল করে দেবে। ওরা লালবাজার কি সি. বি. আই.-তে চাকরি নিলে দারুণ উন্নতি করতে পারত।
কথা শেষ করেই পুঁটলিটা আমি পকেট থেকে বের করে ফেলেছি। আর ঘরের মলিন বালবের আলোয় সেটা খুলেও ফেলেছি চটপট।
দেখি পুটলির মধ্যে রয়েছে সাতটা ঝিকিমিকি লাল আর সবুজ পাথর।
আমরা তিনজনেই পাথর হয়ে গেলাম।
মল্লিকা আর তপতী লোভ-চকচকে চোখে অপলকে তাকিয়ে রইল পাথরগুলোর দিকে। আমাকে প্রশ্ন করতে ভুলে গেল ওরা। আর করলে কী-ই বা জবাব দিতাম আমি!
পাথরগুলো নিশ্চয়ই খুব দামি। কিন্তু একজন অজানা-অচেনা লোক এগুলো শুধু শুধু কেন দিয়ে গেল আমাকে! ব্যান্ডেলের বিয়েবাড়িতে সত্যিই কি ওই বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার?
প্রশ্ন প্রশ্নই থেকে গেল। পাথরগুলো চলে গেল মল্লিকা আর তপতীর জিম্মায়। ওরাই এখন এগুলোর মালিক। নিজেরা বোঝাঁপড়া করে ভাগাভাগি করে নেবে। তখনও কি ছাই জানি, আর এক আশ্চর্য ঘটনা অপেক্ষা করে রয়েছে আমার জন্যে! সকাল হলেই নতুন এক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে আমাকে।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি মল্লিকা বা তপতী কেউই বাড়ি নেই। ঘর খালি, রান্নাঘর খালি, কলতলা খালি। গোটা বাড়ি শুনসান। কোথায় গেল ওরা।
জুতো-চটি ইত্যাদি পরীক্ষা করে বুঝলাম, ওরা কেউ বাড়ির বাইরে যায়নি। অথচ বাড়ির ভিতরেও নেই। তা হলে কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল?
সকাল থেকে চা নেই, জলখাবার নেই, রান্না বন্ধ। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পাথরগুলোর কথা জানতে পেরে কোনও গুণ্ডার দল ওদের কিডন্যাপ করল নাকি! ঠিক করলাম, ঘণ্টা দু-তিন অপেক্ষা করে তারপর থানায় খবর দেব। কিন্তু পুলিশে জানালেও তো আর-এক ঝকমারি! কোথা থেকে ওই দামি পাথরগুলো পেলাম, তার কী জবাব দেব?
ফাঁকা বাড়িতে নিরিবিলি বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেই কেমন যেন একঘেয়ে লাগতে শুরু করল। মনে পড়তে লাগল আমার বিয়ের কথা, ফুলশয্যের কথা। তারপর তপতীর জন্মের পর আমাদের আড়াইজনের জীবন। তখনও অভাব ছিল, কিন্তু সে-অভাব সইবার মনের জোর ছিল। আর এখন…।
কখন যেন আনমনে মল্লিকার নামটা ডেকে উঠেছিলাম। হঠাৎই সাড়া পেলাম, তুমি কোথায়? তোমাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন! চারপাশটা কী অন্ধকার।
আমি চমকে উঠলাম। চারপাশে তাকালাম। কেউ কোথাও নেই। তা হলে কি ব্যাপারটা আমার মনের ভুল?
মনের ভুল যে নয় সেটা বুঝলাম তপতীর গলা শুনে : বাবা, তুমি কোথায়? আমার এখানে ভয় করছে।
আমি আকুলভাবে ওদের নাম ধরে ডেকে উঠলাম ও মল্লিকা! তপতী!
ওরা ডুকরে কেঁদে উঠল। আমার চোখের সামনে ওরা কি আর কখনও আসতে পারবে না? আমি দু-হাতে শূন্য হাতড়ালাম। সবটাই শূন্য। শুধু ওদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। তা হলে কি ওরা অশরীরী হয়ে গেছে?
আমার কান্না পেতে লাগল। ঘরের চারপাশটা দেখলাম। কত ঝগড়া, কত ভালোবাসার সাক্ষী ঘরের এই চারটে পুরোনো দেওয়াল!
সেদিন অফিসে না গিয়ে আমি সারাদিন ধরে মল্লিকা আর তপতীর সঙ্গে কথা বললাম। ওদের সঙ্গে এত কথা যে আমার বলার আছে তা আগে কখনও বুঝিনি। ওরা আমাকে গোটা ব্যাপারটা খুলে বলল।
লাল আর সবুজ পাথরগুলো ওরা মা-মেয়েতে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। ছুঁয়ে টের পেয়েছিল, পাথরগুলো কী অদ্ভুত ঠান্ডা। রাতে ঘুমোনো পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু তারপরই ওরা দ্যাখে, চারপাশটা অন্ধকার–আর পাথরগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে।
এরপর থেকেই চলেছে এক অদ্ভুত জীবন। আমি একা মানুষ বাড়িতে থাকি। নিজে হাতে চা করি, রান্না করি, খেয়েদেয়ে অফিসে যাই। আর বাড়িতে যতক্ষণ থাকি সারাক্ষণ বউ আর মেয়ের সঙ্গে গল্প করি। মাঝে-মাঝেই ওরা বলে, এখানে কী কষ্ট! এই অন্ধকারে আর থাকতে পারছি না। মা গো!
আমি সেই আর্তনাদ শুনে ডুকরে উঠি, নিষ্ফল আক্রোশে হাত-পা ছুড়ি। কিন্তু তার বেশি আর কিছু করতে পারি না।
যতই দিন যেতে লাগল তপতী আর মল্লিকার কথা অস্পষ্ট হয়ে আসতে লাগল। মনে হতে লাগল, ওরা যেন বহুদূর থেকে আমার সঙ্গে কথা বলছে। ক্রমশ যেন দূরে সরে যাচ্ছে। আমার কাছ থেকে। যেমন, যদি মল্লিকাকে আজ দুপুরে জিগ্যেস করি, তোমার মাথাব্যথাটা কেমন আছে? কমেছে? তা হলে পরদিন ভোরবেলা ওর উত্তর শুনতে পাই। যেন আমার কথা বাতাসে ভেসে ওর কাছে পৌঁছোতে বেশ সময় লাগছে। আবার উত্তর ফিরে আসার সময়েও ঠিক তাই।
তপতী মাঝে-মাঝে বলে, বাবা, তোমার কথা খুব আস্তে শোনা যাচ্ছে।
মল্লিকাও বলে, আর একটু জোরে বলো, শুনতে পাচ্ছি না।
বুঝতে পারছি, আমার হাতে আর সময় নেই। এইভাবে দূরে সরতে সরতে ওরা একেবারে মিলিয়ে যাবে। এমনিতেই আমি আমার অশরীরী সংসার নিয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছি, তার ওপর যদি ওরা চিরকালের মতো হারিয়ে যায় তা হলে…।
তাই আমি প্রতিদিন সন্ধেবেলা বাসের ভিড়ে সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে খুঁজি। থুতনিতে সামান্য খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল প্রায় সাদা। চোখের মণি যেন আলোয় ফুলকি। নাকের ওপরে হাই পাওয়ারের চশমা। আর হাতে সান্ধ্য আজকাল।
আমি পাগলের মতো প্রতিটা দিন কাটাই, আর পাগলের মতো সেই বৃদ্ধ লোকটিকে খুঁজে বেড়াই–যে লাল-সবুজ ঝিকিমিকি পাথর দিয়ে আমার জীবন পাথর করে দিয়েছে।
আপনি কি তাকে দেখেছেন? দেখতে পেলে অবশ্যই সান্ধ্য আজকাল-এর দপ্তরে অন্তত একটা পোস্টকার্ড দিয়ে জানাবেন। আমি যে তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছি।
দয়া করে আমাকে বাঁচান। সংসার-হারানো এক প্রৌঢ়কে দয়া করে সাহায্য করুন। আপনার কাছে এই আমার একান্ত প্রার্থনা।
.
গল্পটা পড়া শেষ করে রমাপদবাবু কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলেন। ভারি অদ্ভুত গল্প তো! গল্প, নাকি সত্যি?
খবরের কাগজটা ভাজ করে সতর্ক চোখে চারপাশটা একবার দেখে নিলেন রমাপদবাবু। যেই একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলতে যাবেন অমনি বাঁ-পাশ থেকে কে যেন ডেকে বলল, কী ব্যাপার, রমাপদবাবু! চিনতে পারছেন?
রমাপদবাবু চোখ ফেরালেন। বাঁ দিকে আড়াআড়ি সিটে জানলার দিকে পাশেই এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে আছেন। তাঁর হাতে এক কপি সান্ধ্য আজকাল।
রমাপদবাবুর দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ হাসলেন। হাতের কাগজটা ভাঁজ করে বললেন, চিনতে পারলেন না তো!