বিপদে পড়ল যুধিষ্ঠির
যুধিষ্ঠিরকে মশা কামড়েছে। এই প্রথম।
তা-ই বলে প্রাচীন ভারতে মশার উৎপত্তি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। কারণ এই যুধিষ্ঠির, মহাকাব্যের নায়ক নয়। এ আমার হাতে গড়া যন্ত্রমানুষ। রোবট নয়, অ্যান্ড্রয়েড।
এই অ্যান্ড্রয়েড প্রসঙ্গটাই প্রথম তুলল যুধিষ্ঠির। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে উঠেছে মশার কামড় খেয়ে। এইখানেই মানুষের সঙ্গে ওর তফাত। যাদবপুরের বাসিন্দা আমরা। কে না জানে, মশার উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য কত কসরত করতে হয়! অথচ যুধিষ্ঠিরের কাছে ব্যাপারটা ঠিক উলটো। মশা না-কামড়ানো অবধি তার অ্যান্ড্রয়েড জন্ম যেন সার্থক হচ্ছিল না।
বাড়িতে পা ফেলামাত্র ছুটে এল যুধিষ্ঠির। সরবে ঘোষণা করল, সত্যিই কামড়েছে। ঘন ঘন কামড়াচ্ছে। এখনই দেখাতে পারি। বাঁ হাতটা বাড়িয়ে ধরল যুধিষ্ঠির। হাতের ওপর ঠিক কবজির পেছনে সত্যিই দুটো মশা বসে আছে। ভালোবাসাভরা চোখে তাদের নিরীক্ষণ করছে যুধিষ্ঠির।
কফি। কফিটা নিয়ে আয় এখন।
যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে আমি গর্বিত, কিন্তু ওর বেয়াদবিগুলো অসহ্য। আমি খেটেখুটে বাড়ি ফেরার পর ওর প্রথম কাজ কফি নিয়ে আসা। সেটা ভুললে চলবে না।
কফির কাপ নামিয়েই যুধিষ্ঠির মুহূর্তের মধ্যে শুরু করে দিল তার কাহিনি। অবিকল মানুষের মতো দেখতে অ্যান্ড্রয়েডরা। রক্ত, মাংস, চামড়া দিয়েই তৈরি। তাই যন্ত্রমানুষ হলেও, নাট-বল্ট লাগানো রোবটের সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না। কিন্তু জ্ঞান হওয়া অবধি যুধিষ্ঠির শুধু মানুষের সঙ্গে তার পার্থক্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর এই পার্থক্যের অন্যতম, যাদবপুরের যন্ত্রমানুষকে মশা কামড়ায় না। কেন কামড়ায় না, এই নিয়ে বারবার আমাকে ও গবেষণা করার জন্য অনুরোধ করেছে। কাজের চাপে সুযোগ হয়ে ওঠেনি। আজ যুধিষ্ঠির যা বলল, বুঝতে অসুবিধে নেই যে, সেই গবেষণায় ও নিজেই সফল হয়েছে। আমার তৈরি রক্তের মধ্যে কোন উপাদানটির অভাবে মশাদের ও আকর্ষণ করতে পারত না, সেটা শুধু আবিষ্কার করাই নয়, সেই ঘাটতি (ওর মতে) যুধিষ্ঠির পূরণও করেছে। প্রায় দশ মিনিট ধৈর্য ধরেছিলাম, যুধিষ্ঠিরের পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার ইতিবৃত্ত শোনার জন্য।
হাতটা উঁচু করতেই যুধিষ্ঠির চুপ করে গেল। চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছি, ওর মনটা খারাপ হয়ে গেছে। ওকে কষ্ট দিলে আমারও কষ্ট হয়, কিন্তু মাঝেমধ্যেই ওর কীর্তিকলাপ আমাকে বাধ্য করে রূঢ় হতে।
বললাম, মোদ্দা কথা যেটা বুঝছি, তুই আমার দোষ ধরতে চাইছিস। আমি যা পারিনি, তুই তা নিজেই করে ফেলেছিস। আমি তোর জন্মদাতা হলেও তুই বিদ্যের জোরে আমাকে টেক্কা দিয়েছিস। খুব ভালো। কিন্তু সমস্যাটা কী জানিস? আমি অকারণে কোনও গবেষণা করি না। মানুষের কল্যাণে যা লাগবে না, তা-ই নিয়ে আমার কোনও উৎসাহ নেই। এইখানেই তোর সঙ্গে…।
এবার যুধিষ্ঠির আমাকে বাধা দিল, এ কথা তুমি বলতে পারো না। আমি এখন প্রমাণ করতে পারি, মানুষের রক্তের কোন উপাদান মশাকে আকৃষ্ট করে। এখন তুমি যদি মানুষের রক্ত থেকে সেটিকে অপসারিত করতে পারো…।
অর্থাৎ মানুষদের যদি আমি অ্যান্ড্রয়েডে পরিণত করি, এই তো! সাবধান যুধিষ্ঠির! ভুলে যেয়ো না, আসিমভের আইন অনুসারে একজন খুনি মানুষেরও কোনও শারীরিক অনিষ্ট ঘটে এমন কোনও কাজ তুমি করতে পারো না। করতে গেলে শুধু যে পারবে না তা-ই নয়, বিপদে পড়বে। সেইভাবেই তোমার মগজকে তৈরি করা হয়েছে।
কী আশ্চর্য! আমি কি একবারও সে কথা বলেছি? ভালো করে তো শুনলেই না। দেখোওনি চোখ খুলে। এই দ্যাখো… যুধিষ্ঠির আবার তার হাতটা বাড়িয়ে ধরেছে, এখনও তিনটে মশা বসে রয়েছে, কিন্তু সবই ওই চার বর্গইঞ্চি ক্ষেত্রের মধ্যে। তার বাইরে আর কোনও জায়গায় মশা বসছে না। এবার দ্যাখো, কী করি।
ডান হাতের এক থাপ্পড়ে মশা দুটো বধ করেই আবার ও শিকার ধরার জন্য বাঁ হাত বাড়িয়ে ধরল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গোটা কুড়ি খতম।
মুচকি হেসে যুধিষ্ঠির বলল, ন্যাটা লোক হলে অবশ্য ডান হাতের ওপর মশা টানতে হবে। যাতে বাঁ হাত চালিয়ে… এবার নিশ্চয় তুমি স্বীকার করবে যে, তোমার অফিসে যারা মশা তাড়ানোর বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা নিয়ে, মানে ওই পিটিসি নিয়ে বাজার গরম করছে, তার চেয়ে আমার দাওয়াই কোনও অংশে কম নয়? বলো?
পিটিসি প্রসঙ্গ উঠতেই মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, নাঃ, চাকরিটা এবার ছাড়তেই হবে।
যুধিষ্ঠির এবার সিরিয়াস, কেন? কী হল আবার?
বলে যখন ফেলেছি, এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তা ছাড়া যুধিষ্ঠির ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই, যার কাছে ভোলা মনে এসব কথা নিশ্চিন্তে আলোচনা করা যায়।
চাকরি না ছাড়লে এত দিনের পুরো গবেষণাটাই বেহাত হবে। তাই ভাবছি, চাকরি ছাড়াটাই বোধহয় ভালো।
কার নজর পড়েছে?
খোদ বড়সাহেবের। যদিও তিনি নিজে আমাকে কিছু বলেননি, কিন্তু প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে নানাভাবে, যাতে আমি স্বেচ্ছায় রাজি হই। তখন আমার কৃতিত্বের সমান অংশীদার হবেন আমাদের সংস্থার অধ্যক্ষ।
কী ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে, শুনতে পারি?
এই তোর কেসটাই ধর। আমি নাকি অফিসের সুযোগ-সুবিধে নিয়েছি তোকে তৈরি করার সময়ে। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য।
প্রমাণ আছে কিছু?
ওদের মতে, আমি অফিসের পর কম্পিউটার নিজের কাজে ব্যবহার করেছি। এখনও নাকি করি।
আমি প্রমাণের কথা জানতে চাইছি। মতের কথা নয়।
ওরা চেষ্টা করছে প্রমাণ সংগ্রহ করার। যেমন, আজই গেটে আমার ব্যাগ সার্চ করেছে। কোনও ডিস্ক নিয়ে বেরোচ্ছি কি না। আমাদের অফিসে গত দশ বছরের মধ্যে এই প্রথম হঠাৎ আজ এই ব্যাপারটা ঘটল।
কিন্তু, তুমি চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার পরে, বাড়িতে বসে কি গবেষণার কাজটা শেষ করতে পারবে? বিশেষ করে, যতটুকু জানি, তোমার সুপারকনডাক্টর নিয়ে গবেষণায় তো নানা ধরনের অত্যন্ত জটিল সব যন্ত্রপাতি দরকার হয়। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ছাড়া…
ধরেছিস ঠিকই, তবে কাজটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মাস তিনেক সময় পেলে তারপর শেষ পর্বটা বাড়িতে বসেও করতে পারি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই তিন মাসের মধ্যেই হয়তো পুরো জিনিসটা ওরা আত্মসাৎ করে…।
জাস্ট এ মিনিট! অধৈর্যভাবে বাধা দিল যুধিষ্ঠির। তোমার সমস্যাটাকে একটু গুছিয়ে নিতে দাও। আমার মনে হচ্ছে, তোমার সমস্যাটার দুটো দিক আছে। প্রথমত, এখনও আরও তিন মাস তোমার চাকরি করা দরকার। দ্বিতীয়ত, এর মধ্যে যেন তোমার গবেষণা কেউ হাতাতে না পারে। ঠিক বলেছি?
ঠিক।
গবেষণাটা কীভাবে হাতাতে পারে?
সবচেয়ে সোজা কাজ, অফিস ছুটির পরে আমার ঘরে ঢুকে ফাইল ক্যাবিনেট থেকে দুটো ফাইল হাতানো।
কিন্তু, ওই ফাইল দুটো তো তোমারও দরকার হবে, মানে, অফিস ছাড়ার পরে?
হবেই তো!
কিন্তু, এখন যদি রোজ গেটে সার্চ করে, কীভাবে ফাইল দুটো নিয়ে বেরোবে বলো দেখি?
লাফিয়ে উঠেছি চেয়ার থেকে। কথাটা সত্যিই ভাবিনি একবারও।
যুধিষ্ঠির একটুও বিচলিত নয়, শান্তকণ্ঠে বলল, তার মানে, তোমাকে এখন তিন মাস কাজ করতে হবে, তারপর ফাইল দুটো নিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে, তারপরেই ইস্তফা। ও.কে.। তুমি কি আমার সাহায্য নেবে? মানে, তোমার ইগোয় যদি না লাগে…
তুই যদি আমার সহগবেষক হিসেবে নিজের নাম ছাপাতে চাস, তাহলে সাহায্য নিতে রাজি নই।
নাঃ, অন্যের কৃতিত্বে ভাগ বসানো আমাদের ধর্মের বিরোধী। তবে, এটা তো সবাই আশা করে যে, সময়মতো যথাস্থানে তুমি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে।
নিশ্চয় করব।
বেশ। তাহলে এখন তোমার প্রথম কাজ হল, কালই অফিসে গিয়ে তোমার ডাইরেক্টরের সঙ্গে দেখা করা। তুমি বলবে, সব ভেবেচিন্তে তুমি ওদের প্রস্তাবে সম্মত। কারণ এ ছাড়া তোমার বাঁচার উপায় নেই। তোমায় বুঝিয়ে দিতে হবে যে, তুমি ভয় পেয়েছ। একটু অভিনয় করবে। তারপর একটাই কথা, তিন মাস সময় চাইবে। বলবে, তিন মাস পরে তুমি সব কাগজপত্র ডাইরেক্টরের হাতে তুলে দেবে। সবটাই তোমার অভিনয়ের ওপরে নির্ভর করছে। সবই তো গেল, শেষ পর্যন্ত ডাইরেক্টর যেন দয়া করে তোমার নামটা দ্বিতীয় গবেষক হিসেবে অন্তত রাখেন! বুঝলে?
চেষ্টা করছি বুঝতে। যা-ই হোক, তোর নামটা কিন্তু আর যুধিষ্ঠির রাখা যাবে না।
কী বলতে চাইছ? আমি তোমাকে মিথ্যে কথা বলতে প্ররোচিত করছি? সরি, এটা মিথ্যের ক্যাটিগরিতে পড়ে না। এটা অশ্বত্থামা হত ইতি গজ জাতীয়। অ্যাপ্রুভড।
.
ইচ্ছে না থাকলেও পরিস্থিতির চাপে যুধিষ্ঠিরের পরামর্শ অনুসারেই কাজ করে চলেছি। ভালো খবর একটাই। মনে হচ্ছে, তিন মাস লাগবে না। তার আগেই আমার পেপার রেডি করার মতো সব মালমশলা সংগ্রহ হয়ে যাবে। আশ্চর্যের কথা, যুধিষ্ঠির কিন্তু একবারও এর মধ্যে আমার গবেষণার অগ্রগতি বা অফিসের অবস্থা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করেনি। মশাদের পর বোধহয় ও আরও বড় কোনও গবেষণা চালাচ্ছে নিজের মতো। প্রশ্ন করলেও এড়িয়ে যায়। শুধু বলে, আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কোরো না। সাকসেসফুল হলে, সব বলব। তার আগে নয়।
তিন দিন পরের কথা। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি, যুধিষ্ঠির একটা কুকুরছানাকে কোলে নিয়ে সোফায় বসে আছে। ও বিলক্ষণ জানে যে, কুকুর, বেড়াল ইত্যাদি কোনও কিছু পোষা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর।
দ্যাখো, ডগিটা কীরকম সুন্দর। এর বয়স এখন এক মাস সাত দিন। যুধিষ্ঠিরের গলায় আদর ঝরে পড়ছে।
তা এটাকে কোত্থেকে আমদানি করা হল?
কেন! রাস্তা থেকে। ওর মা গাড়িচাপা পড়ে মারা গেছে।
রাস্তা থেকে! কী সাংঘাতিক?
ভয়ের কোনও কারণ নেই। ইনজেকশন দিয়েই এনেছি। এখন শুধু পেট ভরতি কৃমি আছে। সেগুলো তো একদিনে যাবে না। ওষুধ খাবে। শুরু হয়ে গেছে খাওয়ানো।
ইনজেকশন, ওষুধ, এত পয়সা পেলি কোত্থেকে?
আজ বাজার করিনি। না করলেও চলবে দেখেছি।
আমার ছোটমাসির অ্যালসেশিয়ানটার কথা মনে পড়ে গেল। প্রতিদিন তাকে পাঁঠার আন্ডারকাট আর কনডেন্সড মিল্ক খাইয়ে মাসি ফতুর হয়ে গিয়েছিলেন। ভবানীপুরের অমন বাড়িটা না হলে বেচে দিতে হত না!
দ্যাখো যুধিষ্ঠির, তোমার ওই কুকুরের পেছনে কিন্তু আমি একটি পয়সাও খরচ করতে রাজি নই!
কোরো না খরচ, তাহলে এবার থেকে আমাকে পকেট মানি দিতে হবে।
কী?
পকেট মানি। হাতখরচ। ক্লাস ফাইভ-সিক্সের ছেলেমেয়েরাও হাতখরচ পায়। আমার বুদ্ধি, বিদ্যা ও মেধা নিশ্চয় তাদের চেয়ে অনেক বেশি।
কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়েছি। নিজের ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে জোর গলায় হাঁক পাড়লাম, ওই কুকুর যদি আমার ঘরে ঢোকে, তাহলে কিন্তু…।
না, না, ডগি লক্ষ্মী ছেলে। ও আমার সব কথা শুনবে। আমার কাছে শোবে। তোমাকে একটুও বিরক্ত করবে না।
যুধিষ্ঠির ডগিকে নিয়ে মেতে উঠেছে। আমার সমস্যার কথা ওর মনে আছে কি না সন্দেহ হয় মাঝে মাঝে। যুধিষ্ঠিরের ওপর ভরসা করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না মনে হচ্ছে। আমার এই মানসিক অস্থিরতার কথা টের পেয়েই যেন কানু মুখার্জি হঠাৎ এত্তেলা পাঠাল আমাকে।
মাসখানেক আগে হলে আমি কখনওই কানু মুখার্জির ডাকে উতলা হতাম না। কারণ লোকটা ক্রোড়পতি হতে পারে, বহু উঠতি তরুণ বিজ্ঞানীকে রাজা করে দিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তার ব্যাবসায়িক সাফল্যের পেছনে দুর্নীতি আছে। ক-জনকে সে রাজা করেছে আর ক-জনকে ফকির, তার শেষ হিসেব কেউ জানে না।
কানু মুখার্জির সঙ্গে দেখা করব ঠিক করেও যুধিষ্ঠিরকে কিছু বলিনি। সত্যি বলতে, যুধিষ্ঠিরের ওপরে আস্থার অভাব না ঘটলে হয়তো আমি যেতামও না। কুকুর পুষলে মানুষের যা হয়, যন্ত্রমানুষেরও যে সেই একই দশা হবে, বুঝতে পারিনি।
কানু মুখার্জি আমাকে স্তম্ভিত করে দিল। এরকম দুদে ব্যাবসাদারের সঙ্গে এই প্রথম পরিচয়। ব্যাবসাদার বলতেই আমরা পচা মাছ, ভেজাল আর বাটখারা-দাঁড়িপাল্লার ম্যাজিক বুঝি। কানু মুখার্জি কিন্তু বিজ্ঞানও বোঝে। ভালোমতোই বোঝে। প্রথমেই আমার গবেষণার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি নিয়ে অভিনন্দন জানাল। তারপরে চায়ের কাপটা হাতে তুলে দিয়ে বলল, কিন্তু আপনার অফিসে যা চলছে, তাতে আপনি বা আপনার গবেষণা, কোনওটার পক্ষেই মঙ্গলকর কিছু ঘটবে না। আপনি বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেও বিশেষ লাভ হবে না। ওরা আপনার কাগজপত্র সব আটকে রাখবে। অন্যদিকে, কাগজপত্র আটকে রেখেও ওরা নিজেরা যে কিছু করতে পারবে, তা-ও মনে হয় না। মোটের ওপর, পুরো প্রচেষ্টাটাই মাঠে মারা যাবে। আপনি কি জানেন, আমেরিকার বেল ল্যাবরেটরি ঠিক একই বিষয় নিয়ে কত দূর এগিয়েছে?
ব্যাগ খুলে একটা খাম এগিয়ে ধরল কানু মুখার্জি। গোটা পাঁচ-ছয় জেরক্স-করা কাগজ। দু-মিনিটও লাগেনি উলটে দেখতে। কানু মুখার্জি সত্যিই বিরাট উপকার করেছে আমার। বেল-এ একই বিষয় নিয়ে কাজ চলছে জানতাম, কিন্তু এতটা অগ্রগতি কল্পনা করিনি। সময়ের বিচারে আর বড়জোর ছ-মাস। তারপরেই ওরা আমাকে ধরে ফেলবে। আর একবার যদি পেটেন্ট নিতে পারে, আমার যাবতীয় পরিশ্রম পণ্ড।
কানু মুখার্জি হাসল। তারপর বলল, কোনও চিন্তা নেই, আপনি রিজাইন করুন। আমাদের এখানে যোগ দিন। বাকি দায়িত্ব আমার।
কিন্তু…।
দেখুন, আমি গবেষক নই, ব্যাবসাদার। কাজেই আপনার গবেষণা থেকে যাতে আমি লাভবান হতে পারি, তার যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব আমার। এবং সে সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে নিশ্চয় এরকম অফার আপনাকে দিতাম না। দু-হাজার টাকা মাইনে বেশি পাবেন আর আপনার গবেষণাভিত্তিক কোনও প্রোডাক্ট যদি বাজারে ছাড়তে পারি, পাঁচ পারসেন্ট কমিশন!
পেটেন্টটা?
আপনার নামেই হবে।
বাড়ি ফিরে দেখি, ডগিকে দুধ খাওয়াচ্ছে যুধিষ্ঠির। কিন্তু সেই মুহূর্তে মাথার ঠিক ছিল না। চেঁচিয়ে উঠলাম, প্লিজ যুধিষ্ঠির, এক্ষুনি কয়েকটা কথা বলা দরকার।
গলার স্বরটা বোধহয় বেশি চড়া হয়ে গিয়েছিল। ডগি তড়াক করে লাফ মেরে, ভয়ংকর ভঙ্গিতে এগিয়ে এল আমার দিকে। যেমন তার চোখের চেহারা, তেমনই ডাক। ভুলে গিয়েছিলাম, এখন ওর বয়স প্রায় তিন মাস।
ডগি!–যুধিষ্ঠির ধমক না দিলে নিশ্চয় ও আমার টুটি কামড়ে ধরত। নিয়মিত মাংস খাওয়ালে দিশি কুকুরও ডোবারম্যান হয়ে ওঠে।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে, এক নিশ্বাসে কানু মুখার্জির প্রস্তাবটা জানিয়ে দিলাম যুধিষ্ঠিরকে। এবার বল, কী করব!
তুমি অকারণে উত্তেজিত হচ্ছ। আমরা যা করব ঠিক করেছিলাম, ঠিক তা-ই করব। তোমার কাজ শেষ হবে, তারপরে পদত্যাগপত্র দাখিল করবে। বাকি দায়িত্ব আমার।
কিন্তু কানু মুখার্জি মাত্র সাত দিন সময় দিয়েছে।
কিন্তু তোমারও তো কাজ প্রায় শেষ, তা-ই না?
প্রায় কেন, পুরো শেষ। এখন ফাইলগুলো সরাতে পারলেই…
চমৎকার! তাহলে ফাইলগুলো সরাও, ইস্তফা দাও, তারপর মনস্থির করো কী করবে। ফাইল সরানোর আগে কানু মুখার্জিকে কথা দিয়ো না। এটা তোমার বোঝা উচিত যে, কানু মুখার্জির সঙ্গে নিশ্চয় তোমার অফিসের বিজ্ঞানীদের বা ডাইরেক্টরের একটা সম্পর্ক আছে। না হলে সে অত গলা উঁচু করে…
মাথাটা আরও গুলিয়ে দিল যুধিষ্ঠির। রেগেমেগে বললাম, স্পষ্ট করে বল, এখন আমার কী করা দরকার!
কালই অফিসে গিয়ে তোমার বন্ধুমহলে, অত্যন্ত গোপনে রটিয়ে দাও যে, দিন সাতেকের মধ্যেই তুমি চাকরি ছাড়ছ এবং অন্য একটা কোম্পানিতে যোগ দিচ্ছ। কানু মুখার্জির অফারের কথাটাও বলতে ভুলো না। তোমার এই গোপন বার্তা অবিলম্বে যথাস্থানে অর্থাৎ ডাইরেক্টরের কানে পৌঁছে যাবে।
কথা শেষ করেই যুধিষ্ঠির পকেট থেকে একটা ছোট্ট শিশি বাড়িয়ে ধরল। ঠিক হোমিয়োপ্যাথিক ওষুধের শিশির মতো।
এটা আবার কী?
একটা সূক্ষ্ম গন্ধ আছে শিশির মধ্যে। আমি বানিয়েছি। ক্রিমের মতো। শুঁকে দ্যাখো, তুমি কোনও গন্ধ পাবে না। কিন্তু আমি আধ কিলোমিটার দূর থেকেও ঠিক ধরে ফেলব। তোমার ফাইল দুটোতেও এটা একটু করে মাখিয়ে দিয়ো, যাতে সময়মতো চিনতে পারি। আজই দেবে কিন্তু।
যুধিষ্ঠিরের কথামতো সব কাজ সেরে বাড়ি ফিরে দেখি তিনি নেই। নেই তো নেই, পুরো দু-দিন নিরুদ্দেশ। এদিকে তার প্রিয় ডগি কেঁদেকেটে, চেঁচিয়ে বাড়িতে কাউকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে মাছ-মাংস হাতে নিয়ে তাকে আমি সাধছি। ভোলাবার চেষ্টা করছি।
তিন দিন বাদে সন্ধের মুখে ফিরল যুধিষ্ঠির। রক্তাক্ত দেহে৷ ঘরে পা রেখেই গোঙিয়ে উঠল, ভীষণ কামড়েছে!
কিন্তু আমার ফাইল?
প্লিজ, অমানুষ হয়ে যেয়ো না। আমার অবস্থাটা আগে দেখো!
সালফা-নিলামাইড পাউডার ছড়িয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি যুধিষ্ঠিরের ডান হাতে। রক্ত বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ডগি এখনও জায়গাটা শুঁকছে আর নাকিসুরে কাঁদছে। মনে হচ্ছে, অভিযোগ করছে।
ব্যাগ খুলে ফাইল দুটো টেনে বের করল যুধিষ্ঠির। না, কোনও ভুল করেনি। আর আমার কোনও দুশ্চিন্তা নেই।
থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ! কিন্তু হ্যাঁ রে, মারপিট করিসনি তো? তাহলে কিন্তু তোর লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। আসিমভের আইন অনুসারে…।
কোনও যন্ত্রমানুষ একজন খুনিকেও–ইত্যাদি প্রভৃতি। জানি জানি। আমি কিছুই করিনি। যা করেছে, ডগির বন্ধুরাই করেছে। তোমার অফিসের সামনে ডগির পরিবারের অনেকেই বাস করে। তারা সবাই আমার কথা শোনে। এমনকী আমার তৈরি গন্ধটাও চেনে। আজ ছুটির পর তোমার ফাইল দুটো হাতিয়ে একজন গেট থেকে বেরোনোমাত্র গন্ধ পাই। সঙ্গে সঙ্গে ডগির বন্ধুরা তাকে তাড়া করে। সত্যি বলতে, ওরাই ফাইলটা কেড়ে নেয় লোকটার হাত থেকে। এত দিন ধরে ডগির সঙ্গে কি অকারণে বন্ধুত্ব করেছি!
কিন্তু তোকে কামড়াল কে? আমি তো এতক্ষণ ভাবছিলাম, কুকুরে কামড়েছে।
তা-ই তো! এইটাই ট্র্যাজেডি। সব ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু সবচেয়ে সাহসী কুকুরটার মুখ থেকে ফাইলটা নিতে যেই হাত বাড়িয়েছি, হঠাৎ খেপে গেল। আসলে ও ভেবেছিল এটা নিশ্চয় দারুণ একটা খাবার। তুমি ডগির মুখ থেকে হাড়ের টুকরো টেনে নিতে পারবে? যাক গে, আমার এখন একটাই অনুরোধ। মনে হচ্ছে, আমার অ্যান্টি-র্যাবিস ইনজেকশন নেওয়া উচিত। কিন্তু প্লিজ, ওই মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিতে পেট ফুড়ে চোদ্দোটা ইনজেকশন নিতে পারব না। তোমার একটু খরচ হবে, কিন্তু আমি ফরাসি ওষুধটাই চাই।
হবে, হবে। তা-ই হবে। যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, তবে গবেষকদের এত অল্পে ভেঙে পড়তে নেই। বিপদ-আপদ তো আসতেই পারে।
গবেষকদের বিপদ মানে?
মশাদের নিয়ে গবেষণাটা না করলে ইনজেকশন নেওয়ার দরকার পড়ত না। আমার তৈরি যন্ত্রমানুষের রক্তের সেরকম গুণ ছিল। কিন্তু তুমি তারপরে নিজে কেরামতি করেছ, এখন আর জোর দিয়ে কিছু বলা যাবে না। ইনজেকশনটা নিয়ে রাখাই ভালো।
এবার আর যুধিষ্ঠির প্রতিবাদ করেনি।
[আনন্দমেলা, পূজাবার্ষিকী ১৯৯৪]