দ্বিতীয় পর্ব
বিনুর পূর্বকথা
একটি আলোকরেখা কোন সুদূর দ্যুলোক থেকে ভূলোকে এসে একদিন মানব রূপ ধারণ করে। সবাই তাকে বিনু বলে ডাকে। শুনতে শুনতে তারও নামটি আপনার হয়ে যায়। একটু একটু করে সেও ভুলে যায় যে একদা সে ছিল এক নামরূপহীন আলোকরেখা। একটু একটু করে মনে রাখে সে একটি মানুষ, একটি পুরুষ, একটি ব্যক্তি।
এখানে কেউ তাকে চেনে না, সেও চেনে না কাউকে। কিন্তু চিনতে চিনতে সকলেই তার চেনা হয়ে যায়। পরিবারে ও পরিবারের বাইরে সকলেই তাকে চেনে। পাড়া ও পাড়ার বাইরে। যারা জন্মসূত্রে আত্মীয় নয় তারাও পাতানো আত্মীয় হয়। আর তাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যায়। পশুপাখি গাছপালাকেও বিনু আপনার করে নেয়—তারাও তাকে। ভালোবাসা পেতে পেতে ও দিতে দিতে সে বড়ো হয়ে ওঠে।
অক্ষরপরিচয়ের পর থেকে সে যা হাতে পেত তাই পড়ত; পাঠ্য-অপাঠ্য বিচার করত না করতে জানত না। একদিন সে চার-ছয় ছত্রের একটি পদ্য লিখে বাড়ির এক জায়গায় টাঙিয়ে রাখে। যার নজরে পড়বে সে-ই পড়বে এটা জানত। এটা কিন্তু তার মনের কথা ছিল না। বিশেষ একটি মেয়ে পড়বে এটাই সে মনে মনে চেয়েছিল। মেয়েটি পড়বে আর ভাববে, বিনু তো সামান্য ছেলে নয়। আর কেউ যা পারে না বিনু তা পারে। সে কবিতা লিখতে পারে। সে একজন কবি।
মেয়েটির প্রশংসাই তার কাম্য ছিল। কিন্তু বিশেষ করে সেই মেয়েটির প্রশংসা কেন? তবে কি বিনু তাকে ভালোবাসত ও তার ভালোবাসা কামনা করেছিল? না, বছর এগারো কি বারো বছর বয়সে সে-বাসনা জাগেনি। বাড়িতে অনেক কাব্যগ্রন্থ ছিল। স্কুলের লাইব্রেরিতে তো ছিলই। বৈষ্ণব পদাবলি পড়তে পড়তে বিদ্যাপতির এ দুটি পদ তার মর্মে গেঁথে যায় :
জনম অবধি হাম রূপ নেহারনু
নয়ন না তিরপিত ভেল।
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়া রাখনু
তবু হিয়া জুড়ন না গেল।
আরও বড়ো হয়ে সেও লিখতে চেয়েছে এমনই দুটি কথাই। সে রূপমুগ্ধ। সে প্রেমবদ্ধ। একদিন সেও হয়ে উঠত একজন বৈষ্ণব কবি। সেই মধ্যযুগের মতো। মধ্যযুগের পাশ্চাত্য প্রেমিক কবিদের সঙ্গে বৈষ্ণব কবিদের কিছু সাদৃশ্য ছিল। বিদ্যাপতির যেমন লছমা দেবী, চন্ডীদাসের যেমন রামী, দান্তের তেমনি বিয়াত্রিস, পেত্রার্কের তেমনি লরা। নর-নারীর সম্পর্ক পরিণয়মূলক নয়, প্রেমমূলক।
বৈষ্ণব সাধকরা তাঁদের সাধনসঙ্গিনীদের বলেন তাঁদের প্রকৃতি। প্রকৃতির সঙ্গেই নারীর তুলনা। ওতে নারীর মর্যাদা বাড়ে। বৈষ্ণবদের কাছে কৃষ্ণের চেয়ে রাধার মর্যাদা বেশি। মধ্যযুগের পাশ্চাত্য ত্রুবাদুর কবিদের চোখেও তাই। সেকালের নাইটরাও সেই মর্মে কবিতা লিখতেন। এক এক নাইটের আরাধ্যা এক এক লেডি। যার সঙ্গে পরিণয় সম্পর্ক নেই। কামগন্ধহীন প্রণয় সম্পর্ক। নিজের বিবাহিতা সহধর্মিণীকে উদ্দেশ্য করে প্রেম নিবেদন সেকালের কবিদের কারও রীতি ছিল না। তাঁদের মতে পরকীয়াতেই প্রেমের স্ফূর্তি হয়, স্বকীয়াতে নয়।
কলেজজীবনের পূর্বেই বিনু অনেক ইংরেজি বই পড়েছিল। কলেজ লাইব্রেরি লুট করে ইংরেজিতে অনূদিত বিস্তর ইউরোপীয় গ্রন্থ পাঠ করেছিল। দেশের দিক থেকে যা পাশ্চাত্য কালের দিক থেকে তা আধুনিক। বিনু ক্রমে ক্রমে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উপনীত হয়। সে কেবল ভারতের সন্তান নয় বিংশ শতাব্দীরও সন্তান। বিংশ শতাব্দীকে ভালো করে চিনতে হলে তার পশ্চিম মুখে যাত্রা করা অত্যাবশ্যক। পশ্চিম ইউরোপই আধুনিকতার মুখ্য স্রোত। মুখ্য স্রোতে অবগাহন না করলে নয়। পশ্চিমের প্রতি তথা আধুনিকতার প্রতি সে এক দুর্বার আকর্ষণ অনুভব করে।
তখন সেটা অসহযোগ আন্দোলনের আমল। দেশ যতদিন না স্বাধীন হচ্ছে ততদিন দেশেই থাকতে হবে। যেতে হবে গ্রামে। জনগণের সঙ্গে একাত্ম হতে হবে। করতে হবে চাষবাস বা কারিগরি। লিখতে হলে জনগণের হৃদয় স্পর্শ করার মতো লেখো। তারা যেমন অকৃত্রিম, তাদের কথাবার্তা যেমন অকপট, তেমনি অকৃত্রিম ও অকপট হবে তাদের জন্যে রচিত কাহিনি বা কবিতা। তাদের উপর তথাকথিত সভ্যতার কৃত্রিমতা ও কপটতা চাপিয়ে দিতে চাওয়া অনুচিত। এই বিষয়ে টলস্টয় যা বলেছেন তাই সার কথা। রুশোও তো বলেছেন প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে। গ্রামে ফিরে যাওয়াও প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া। গান্ধীজির উপদেশই গ্রাহ্য। রবীন্দ্রনাথও তো ডাক দেন—
ফিরে চল মাটির টানে।
বিনু পড়ে যায় দারুণ দোটানায়। জীবন নিয়ে সে কী করবে? কেমন করে কাটাবে? কোথায় কাটাবে? তার ধারণা ছিল সে বেশিদিন বাঁচবে না। তার মা বেঁচেছিলেন মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর। সেও তেমনি দুবলাপাতলা। শেলি, কিটস পড়তে পড়তে তারও মনে হয়েছিল ত্রিশ না পেরোনোই রোমান্টিক। যৌবন চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে জীবনও যেন চলে যায়, এই মর্মে সে একটা কবিতাও লিখেছিল। কিন্তু তার আগেই যেন সে তার জীবনের কাজ সারা করে যেতে পারে।
সে ভাবতে পারেনি যে ইউরোপে গিয়ে আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে গা মিলিয়ে নিতে নিতে তার লেখালেখির পরিকল্পনাও পালটে যাবে। জীবনের সব দিক দেখাতে হলে লিখতে হয় মহাকাব্য বা এপিক। একালে মহাকাব্যের স্থান নিয়েছে বিরাট ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো এপিক উপন্যাস। যেমন রম্যাঁ রল্যাঁর জাঁ ক্রিস্তফ বা টলস্টয়ের ওয়ার অ্যাণ্ড পিস। বিনুর সাধ যায় তেমনি একটি এপিক লিখতে, যদিও তার সাধ্য কেবল লিরিক।
একটা প্রতিযোগিতায় সফল হয়ে সে যখন ইউরোপে যায় তখন তার বয়স তেইশ বছর। দু-বছর বাদে দেশে ফিরে এসে রাজকর্মের অবকাশে সে যখন তার পাঁচ খন্ডের উপন্যাস লিখতে শুরু করে তখন তার বয়স পঁচিশ বছর। সে-বয়সে টলস্টয় বা রল্যাঁ অত বড়ো উপন্যাসে হাত দেননি। জীবনের অভিজ্ঞতা কম। সৃজনের অভিজ্ঞতাও কম। কিন্তু বিনুর কি অপেক্ষা করার জো ছিল? পঁয়ত্রিশ বছরের আগেই তাকে তার বৃহৎ উপন্যাস সম্পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু কেন? কী দরকার অত বড়ো উপন্যাস লেখার? কেনই-বা সে সাধ করে অমন একটা দায় নিজের ঘাড়ে চাপায়? টাকার জন্য নিশ্চয়ই নয়। ওটা তার প্রেমের পরিশ্রম। সে একজন স্রষ্টা ও দ্রষ্টা।
যার প্রধান পটভূমিকা ইউরোপ তা কি বাংলার মহকুমায় বা জেলা সদরে বসে লেখা যায়? কিছুদিন পরেই বিনুর ইউরোপের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যেত। লিখতে গিয়ে সে বিপাকে পড়ত, যদি-না অপরিচিতা এক নারী তার জীবনে পশ্চিম দেশ থেকে আবির্ভূত হতেন। গ্রিক নাটকে যেমন আসমান থেকে দেবতা নেমে আসেন। এরপর থেকে তিনি তাকে পরামর্শ দিয়ে সাহচর্য করতে থাকেন।
কিন্তু সহধর্মিণীর সাহচর্যে উপন্যাস লেখা এক জিনিস আর পুলিশের সাহচর্যে অপরাধ নিবারণ ও জেলের সাহচর্যে অপরাধ দমন অন্য জিনিস। অহিংস নৈরাজ্যবাদী বিনু পুলিশ বা জেল কোনোটাতেই বিশ্বাস করে না। মার্কসবাদী না হলেও সেও বিশ্বাস করে যে রাষ্ট্র ক্রমে ক্রমে শুকিয়ে যাবে। কিন্তু রাজকর্মে নিযুক্ত থাকলে তার আগেই শুকিয়ে যাবে বিনুর অন্তঃকরণ, যা তার সাহিত্য সৃষ্টির উৎস। তাকে হতে হচ্ছে দিন দিন হার্ড হেডেড তথা হার্ড হার্টেড। এমন মানুষ যার মস্তিষ্ক যেমন কঠিন, হৃদয় তেমনি কঠোর। সারস্বত সমাজে হয়তো সে এখন ইন্টেলেকচুয়াল বলে গণ্য হবে, কিন্তু একজন আর্টিস্ট বলে নয়। অথচ আর্টিস্ট হতেই তার দুরাকাঙ্ক্ষা। কেউ যখন বলে বিনু একজন কবি তখন সে ধন্য হয়ে যায়। সে-বর সরস্বতী সবাইকে দেন না। যাঁরা পান তাঁরাই তাঁর বরপুত্র। এক্ষেত্রে সে রবীন্দ্রনাথের অনুগামী। তিনি মহাশিল্পী। সে তাঁর মতো মহান না হলেও সেও তাঁরই মতো রূপদক্ষ হতে চায়।
বিনু উপলব্ধি করে অপরাধ নিবারণ ও দমনের প্রকৃষ্ট উপায় লোকটির অন্তর পরিবর্তন। ভয়ের শাসনে কিছুতেই তা হতে পারে না। প্রেমের প্রভাবেই সেটা সম্ভব। বিচারককে হতে হবে দয়াময়ী মাতা ও ক্ষমাশীল পিতা। সাহেবরা তো দাবি করেন যে সরকার মা-বাপ। কতক হিসাবে সেটা সত্য। কিন্তু মোটের উপর সরকারের যে ভাবমূর্তি সেটা একটা বিরাট নৈর্ব্যক্তিক শাসনযন্ত্রের। বিনু সেই যন্ত্রের ক্ষুদ্র একটি অঙ্গ। তাকে আইন মেনে কাজ করে যেতে হয়। সে দয়াও করে না, মায়াও করে না। করলে উপরওয়ালাদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। পুলিশও চটে। পুলিশের চোখে সে একজন প্রচ্ছন্ন জাতীয়তাবাদী, আর জাতীয়তাবাদীদের চোখে সে একজন প্রকাশ্য দেশদ্রোহী।
কিন্তু একথা বললে সত্যের অপলাপ হবে যে সে তত্ত্বগতভাবে অহিংস নৈরাজ্যবাদী বলে কার্যক্ষেত্রেও তাই ছিল। বিশের দশক শেষ হবার পূর্বাহ্ণে তার ইংরেজ জেলাশাসক তাকে বলেন, ‘আমরা চলে গেলেই জাপানিরা ভারত আক্রমণ করবে। স্বাধীন ভারত আত্মরক্ষা করবে কী করে?’ বিনু আশা করে জাপানিরা আক্রমণ করবে না। সেটা কিন্তু যুক্তি নয়, সেটা বিশ্বাস। সে-বিশ্বাস দূর হয় চল্লিশের দশকে। কলকাতায় জাপানি বোমা যখন পড়ে বিনুর কাছে তখন গোপন নির্দেশ আসে জাপানিরা এলে কী কী করতে হবে জেলাশাসককে, জেলা জজকে। ইংরেজরা যে বর্মা রক্ষা করতে পারল না সেটা তো স্পষ্ট। বাংলাদেশ রক্ষা করতে পারবে না সেটাও সম্ভবপর। অথচ ভারতীয়রা যে একাই দেশরক্ষা করতে পারবে এটার মতো প্রস্তুতি কোথায়?
ত্রিশের দশকে বিনু দেখে, হিন্দু-মুসলমান কথায় কথায় দাঙ্গা বাঁধাচ্ছে আর দোষ দিচ্ছে ইংরেজদের। তাদের সংহত করতে যদি নেতারা অক্ষম হন তাহলে তো বিনুর মতো রাজকর্মচারীদেরই সে-কাজ করতে হবে। হ্যাঁ, গ্রেফতার করতে হবে, জেলে পাঠাতে হবে, নাচার হলে গুলি চালাতে হবে। পারতপক্ষে সৈন্য তলব করা চলবে না। তলব করলে সৈন্যদের কর্তাকেই ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। বিনুকে ততদূর যেতে হয়নি। সে নিজের হাতেই সব ক্ষমতা রেখেছে। কিন্তু তাকে স্বীকার করতে হয়েছে যে দেশকাল অহিংস নৈরাজ্যবাদের জন্যে প্রস্তুত নয়।
ব্রিটিশ অপসরণের পরও কমিউনিস্টদের সহিংস বিপ্লব প্রয়াস লক্ষ করে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়েছে। জনগণ অহিংস বিপ্লবের জন্যে প্রস্তুত নয়। বিপ্লব আর প্রতিবিপ্লবের দ্বন্দ্ব হিংসার সঙ্গে প্রতিহিংসার বলপরীক্ষা। তার পরিণতি হবে অরাজকতায়। বিনু যদি ক্ষমতার আসনে থাকে তাকে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের আইনকানুনের প্রয়োগ করতে হবে। পুলিশের সাহায্যে, জেলের সাহায্যে, দরকার হলে সৈন্যদলের সাহায্যে। দেশ নৈরাজ্য বরণ করলে কাল তা মানে না। নৈরাজ্য অরাজকতা নয়। জনগণ বরাবরই একজন না একজন রাজার অধীনে থেকেছে। সে-রাজা হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক আর ইংরেজই হোক। রাজতন্ত্র ছেড়ে প্রজাতন্ত্র বরণ করলেও রাষ্ট্র জিনিসটা থাকবে আর তার সেই চারটি অঙ্গই কায়েম হবে। পুলিশ আর আদালত এবং জেল আর সৈন্য।
সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ না করলে, কখনো ম্যাজিস্ট্রেট ও কখনো জজ না হলে, ভয়ংকর সব পরিস্থিতির সম্মুখীন না হলে বিনুর প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষা হত না। সে থিয়োরি নিয়েই দিন কাটাত। তবে কি অভিজ্ঞতার ফলে তার আদর্শের পরিবর্তন হল না? না, শুধুমাত্র স্বীকার করতে হল যে এই শতাব্দীতে নয়, বোধহয় আগামী শতকেও নয়, হয়তো তার পরের একশো বছরেও নয়, কিন্তু একদিন-না-একদিন সমাজে কেউ অপরাধও করবে না, কেউ দন্ডদানও করবে না। রাষ্ট্র শুকিয়ে যাবে।
বিনুর মনে হয় সে পড়ে গেছে এক আখমাড়াই কলে। যদি আরও বেশিদিন বহাল থাকে তার চাকরিতে তবে ভিতরকার রসকষ বেরিয়ে যাবে, বাকি থাকবে শুধু ছিবড়ে। তার সতীর্থদের পক্ষে সেটা উন্নতির সোপান, কিন্তু তার পক্ষে অবনতির। তার সেই এপিক উপন্যাস সমাপ্ত হয় ছয় খন্ডে আটত্রিশ বছর বয়সে। সেই সময়ই পদত্যাগ করে পশ্চাৎ-অপসরণ করা উচিত ছিল, কিন্তু বিকল্প তো আবার এক চাকরি। গ্রামে গিয়ে চাষবাসের সেই পুরাতন স্বপ্ন সে ভুলে যায়নি, কিন্তু যুদ্ধকালে অবাস্তব। মন্বন্তর আসন্ন। পরবর্তী ন-বছর ধরে বিনু পায়চারি করে। ন যযৌ, ন তিষ্ঠৌ। দেশের স্বাধীনতা তার নিজের স্বাধীনতা নয়, বরং আরও অক্ষমতা। ইতিমধ্যে তার সাহিত্যসৃষ্টি মাথায় উঠেছিল।
সাতচল্লিশ বছর বয়সে বিনু সেই সিদ্ধান্তটি নেয় যেটি তাকে আর শিল্পী সত্তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়। কোনো উপরওয়ালাকে সন্তুষ্ট করতে হয় না। কোনো নীচেওয়ালাকে চালনা করতে হয় না। সে তার ইচ্ছামতো বাঁচে। তার সৃষ্টিশক্তিকে বাঁচিয়ে রাখে। সৃষ্টিশক্তিও একপ্রকার আগুন। যে আগুন নক্ষত্র নীহারিকায় জ্বলছে সে-আগুন বিনুর অন্তরেও। তাকে জ্বালিয়ে রাখাই তো তার সাহিত্যিক হওয়ার পূর্বশর্ত। সঙ্গে সঙ্গে তার দীর্ঘ আয়ুরও, নতুবা সে কবে মরে যেত।
তার জীবনের তৃতীয় পর্ব শুরু হয় সাতচল্লিশ বছর বয়সে। সেইরকম বয়সে প্রমথ চৌধুরীর প্রার্থনা ছিল দ্বিতীয় যৌবনের।
হারানো প্রাণের ফের করিতে সন্ধান
সভয়ে চলিনু ফের বাণীর ভবনে
যেথায় উঠিছে চির আনন্দের গান
আবার ফুটিল ফুল হৃদয়ের বনে
সেদেশে প্রবেশি গেল মনের আক্ষেপ
করিলাম পদার্পণ দ্বিতীয় যৌবনে।
একদা বিনুর প্রার্থনা ছিল যৌবন চলে গেলে যেন জীবনও চলে যায়। প্রথম যৌবন রইল না, কিন্তু দ্বিতীয় যৌবন তার স্থান নিল। তাই জীবন হল দীর্ঘতর। এটা অপ্রত্যাশিত। জীবনের তৃতীয় পর্ব দ্বিতীয় যৌবন এনে দেয়। বহুদিন ধরে তার মনে লালিত হচ্ছিল আর একটি বৃহৎ উপন্যাস রচনার সাধ। এবার তার জন্যে চাই সর্বাত্মক প্রস্তুতি। প্রেমের উপন্যাসের ভাষা হবে প্রেমিক-প্রেমিকার মনের মতো ভাষা। কোমল মধুর কান্ত পদাবলি, প্রকারান্তরে বৈষ্ণব কবিতা। আধুনিক যুগ থেকে বিনু ফিরে যায় মধ্যযুগে। মননশীলতা থেকে হৃদয়বত্তায়। যৌবনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনে অন্তর্জীবনে। মাঝখানে কেটে গেছে ত্রিশ বছর। কত কী ঘটে গেছে জগতে। লিখতে বসে সে সব ভুলে যায় বিনু।
কাহিনিটা ছিল বেশ রোম্যান্টিক। এক অচেনা অদেখা তরুণী নায়ককে চিঠি লিখে জানায় তার বিয়ে হয়েছে তার অনিচ্ছায় এমন একজনের সঙ্গে যাকে সে ভালোবাসে না, যার অন্য প্রণয়িনী ছিল ও আছে, যার শয্যা থেকে মুক্তির জন্য সে সংগ্রাম করে চলেছে। কোথায়ই-বা সে যাবে? পিতৃগৃহে নয়, সেখানে সকলের ধারণা অমন স্বামী আর হয় না। একাধারে জমিদার ও কংগ্রেস নেতা। ওদের ধারণা নায়িকা বিমুখ বলে তার স্বামী অন্যাসক্ত।
প্রথম দর্শনেই প্রেম, কিন্তু নায়িকা এমন দুটি বাক্য উচ্চারণ করে যা নায়ককে চমকে দেয়। তার স্বামী তাকে ধর্ষণ করেছে। সে তার স্বামীকে বলেছে গর্ভপাত করবে। নায়কের পরামর্শ চাই। নায়ক বলে, না না, ওতে অজাত সন্তানের প্রতি অন্যায়। নায়িকা জানতে চায়, তাহলে মুক্তির কী উপায়? মুক্তি না পেলে তো আবার ধর্ষণ, আবার সন্তান। তা হলে কি সে আত্মহত্যা করবে? নায়ক বলে, না না, ওতে নিজের প্রতি অন্যায়।
নায়িকার এক আত্মীয়কে নায়ক বিশেষ শ্রদ্ধা করত। কলেজত্যাগী, নির্ভীক দেশসেবক। তিনি তার বন্ধু হন। দুই বন্ধুতে মিলে নায়িকার মুক্তির দায় মাথায় তুলে নেয়। কিন্তু মাঝপথে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়, নায়ক নিঃসঙ্গ। তা সত্ত্বেও সে তার অঙ্গীকারে স্থির থাকে। নায়িকার পুত্রসন্তান লাভের পর স্বামী-স্ত্রীতে সন্ধি হয়। আপাতত নায়িকা স্বেচ্ছাবন্দিনি। তাঁর মুক্তির প্রশ্ন সন্তান বড়ো না হওয়া তক জরুরি নয়। সে নায়ককে বলে ততকাল অপেক্ষা করতে। নায়ক অনুভব করে যে বন্দিনিকে মুক্ত করতে এসে সে নিজেই বন্দি হয়েছে। তার নিজের মুক্তিই জরুরি। সে বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরাযাত্রা করে। প্রেমিক হিসাবে সে দোষী। প্রেমিকা হিসাবে নায়িকা নির্দোষ। নায়ক হেরে গেছে। নায়িকা জিতেছে।
কাহিনিটার প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ লেখার পর বিনুর মনে বিষম খটকা বাঁধে। প্রথম দর্শনে নায়িকা নায়ককে যে দুটি উক্তি শুনিয়েছিল সে দুটি কি রাখবে না বাদ দেবে এই নিয়ে মনের মধ্যে তোলপাড় করছে এমন সময় এক চিঠি। ‘ত্রিশ বছর আগে তোমাকে আমি বিশ্বাস করে যা বলেছি তা তুমি যদি প্রকাশ কর তবে তুমি বিশ্বাসভঙ্গ করবে। আমাকে না দেখিয়ে তুমি কিছু প্রকাশ করতে পারবে না। করলে অভিশাপ দেব।’
বিনু লেখা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু বছর দশেক বাদে তার মনে হয় তার বাবার মতো সেও একষট্টি বছর বয়সে দেহ রাখবে। মৃত্যুর পূর্বে অসমাপ্ত উপন্যাসকে সমাপ্ত করাই কর্তব্য। তার জন্যে যদি কিছু বাদ দিতে হয় তো তাও সই। বই থেকে দু-টি বাক্য বাদ যায়। বিনুর ধারণা সে প্রেমের বেলায় হেরেছিল, লেখার বেলায়ও হারল। তার জীবনের তৃতীয় পর্ব শেষ হয় ছেষট্টি বছর বয়সে। দ্বিতীয় যৌবনও নিঃশেষ।
বিনুর উত্তরকথা
বিনুর বয়স যখন মাত্র দশ বছর তখনই তার মনে হত এ জীবন যদি সেই বয়সেই শেষ হয়ে যায় তা হলেও তার খেদ নেই। সে যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছে। যথেষ্ট আস্বাদন পেয়েছে মাধুর্যের। যথেষ্ট দর্শন পেয়েছে সৌন্দর্যের। ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যেও জীবন পরিপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু একথাও তার মনে হত সে যাবার সময় কেবলই তো নিয়ে গেল, দিয়ে গেল কী? ঋণ শোধ হবে কী করে?
বিনু তার এই আনন্দ ঋণ, সৌন্দর্য ঋণ শোধ করতে লেখার কাজে ব্রতী হয়। কৈশোরে খেলার মতো করে। যৌবনে লীলার মতো করে। তার যৌবন গত হলে সে প্রার্থনা করে দ্বিতীয় যৌবনের। যযাতির মতো নয়। প্রমথ চৌধুরির মতো। দ্বিতীয় যৌবন পেয়ে তিনি সবুজপত্র সম্পাদনা করেন, চার ইয়ারী কথা লেখেন। বিনুও তার প্রার্থনার উত্তর পায়। লাভ করে দ্বিতীয় যৌবন। সমাপ্ত করে তার প্রেমের উপাখ্যান। কেটে যায় পনেরো বছর। তার বয়স তখন বাড়তে বাড়তে ছেষট্টি।
না, সে-বয়সে আর তৃতীয় যৌবন প্রার্থনা করা চলে না। জীবনই-বা আর ক-দিন? আয়ু যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকু দিয়ে সম্পন্ন করতে হবে বকেয়া যত কাজ। বেশ কিছু কাল ধরে সে ভাবছিল তার স্বদেশের পুনর্যৌবনের কথা। দেশেরও চাই পুনর্যৌবন। পুনঃস্বাধীনতাই সব নয়। পরাধীনতা দূর হলেও পাঁচ হাজার বছরের এই প্রাচীন দেশ জরাগ্রস্তই থাকবে, তার জরা দূর হবে না। বিনু তাই চিন্তা করে তার স্বদেশের পুনর্যৌবনের কথা। চিন্তার ফল তাকে প্রকাশ করে যেতে হবে। এটা তার কর্তব্য। সৃষ্টি নয়, কৃত্য। বিনু কি কেবল একজন স্রষ্টা? সে একজন নাগরিক—ভারতীয় নাগরিক। সেইসঙ্গে বিশ্বনাগরিক। দেশকে সে বিশ্বের একটি অঙ্গ বলেই জানে। ভারত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ নয়। যাকে প্রাচীনরা বলতেন জম্বুদ্বীপ। বোধহয় সেই ধারণায় সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ হয়েছিল। ফলে এদেশের লোক হয়েছিল কূপমন্ডূক।
সমুদ্রপথে ওপার থেকে কেউ না এলে এপারে রেনেসাঁস হত না। রেনেসাঁস ছিল বিদেশ থেকে আসা রাজপুত্রের সোনার কাঠির স্পর্শ লেগে রাজকন্যার নবজাগরণ। বিদেশের সঙ্গে সম্পর্ক যখন শাসক-শাসিতের সম্পর্ক হয়ে অগৌরবের হেতু হয় তখন তার পালটা রিভাইভাল বা পুনরুজ্জীবন বলে অপর এক শক্তি জেগে উঠে প্রাচীন গৌরবের বাণী শোনায়। ফলে স্বদেশের রেনেসাঁস এক শতাব্দীর মধ্যেই তার গতিবেগ হারায়। জোয়ার পরিণত হয় ভাটায়। অতীতের প্রতি পিছুটান প্রবল হয়ে ওঠে। জরার জয়গান শুনে রবীন্দ্রনাথ লেখেন সবুজের অভিযান ও ফাল্গুনী। বিনু তার কৈশোরেই সেসব পড়ে মুগ্ধ হয়। পরে সেও যৌবনের প্রবক্তা হয়ে ওঠে; দেশের তথা জাতির যৌবনের।
রেনেসাঁস পশ্চিম থেকে এলেও তার মূল কথা শুধু পাশ্চাত্য নয়। সে বলে এ জগতের কেন্দ্রবিন্দু দেবতা নয়, মানব। ধর্মের পরিবর্তে সে প্রচার করে মানবিকবাদ—হিউম্যানিজম। এতে মানবের মহিমা বাড়ে, দেবতার মহিমা কমে। মানবমহিমার নজির প্রাচীন গ্রিসে ছিল, কিন্তু খ্রিস্টধর্মের প্রচলনের ফলে সে নজির লোকে ভুলে যায়। এই বিস্মৃতির যুগকে ধার্মিকরা বললেন আলোকের যুগ, এর পূর্বের যুগকে অন্ধকার যুগ। কিন্তু চাকা ঘুরে যায়। তুর্কদের আক্রমণে স্থানভ্রষ্ট হয়ে গ্রিক পন্ডিতরা আশ্রয় নেন ইটালিতে। শুরু হয়ে যায় গ্রিকদের অনুসরণে কাব্য, নাটক, দর্শন, বিজ্ঞান, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য চর্চা। দেখতে দেখতে ইটালির তথা পশ্চিম ইউরোপের সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটে। একেই বলা হয় রেনেসাঁস বা পুনর্জন্ম। আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয়। তখন আধুনিকরা বলেন মধ্যযুগটা ছিল অন্ধকার যুগ, আধুনিক যুগটা হল আলোকের যুগ। ধর্মগুরুদের সঙ্গে মনীষীদের মতভেদ যেন উত্তর মেরুর সঙ্গে দক্ষিণ মেরুর। মনীষীদের উপর নির্যাতন আরম্ভ হয়। রেনেসাঁসের বিপরীতে কাউন্টার রেনেসাঁস চালানো হয়। শেষপর্যন্ত যেটা হয় সেটা একপ্রকার সহ-অবস্থান। ধর্মও থাকে, মানবিকবাদও থাকে। যার যাতে অভিরুচি সে তাকে গ্রহণ করে। ক্রমে ধর্মের সঙ্গে মানবিকবাদের একপ্রকার সমন্বয়ও হয় অনেক ব্যক্তির চিন্তায় ও বিশ্বাসে। মানবিকবাদীদের মধ্যে যেমন নিরীশ্বরবাদী আছেন তেমনি ঈশ্বরবিশ্বাসীও রয়েছেন।
আজকাল খুব কম ধর্মীয় নেতাই বিশ্বাস করেন যে প্রাচীন গ্রিকরা ছিল আলোকবর্জিত পেগান, অন্ধকার থেকে তাদের বংশধররা আলোকে উত্তীর্ণ হয় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে। তেমনি খুব কম মানবিকবাদী মনে করেন যে মধ্যযুগটা ছিল আলোকবর্জিত অন্ধকার যুগ, রেনেসাঁসই মধ্যযুগের মানুষকে আলোকে উত্তীর্ণ করে। কোনো যুগই শুধুমাত্র আলোকের বা অন্ধকারের ছিল না বা নয়। তা হলেও মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণ একটা ঐতিহাসিক পরিবর্তন। সেটা সম্ভব হয় রেনেসাঁসের কল্যাণেই। একথা যেমন ইউরোপের ইতিহাসে সত্য তেমনি ভারতের ইতিহাসেও। রেনেসাঁসকে পাশ্চাত্য না বলে আধুনিক বলা ভালো। তা দেশনিরপেক্ষ তথা ধর্মনিরপেক্ষ।
এখানেও আবার এক ‘কিন্তু’। পুরাতনের প্রত্যাবর্তন চাইনে, কিন্তু পুরাতনের সমস্তটাই কি পুরাতন? চিরন্তন বা চিরনতুন কি পুরাতনের মধ্যে নেই? নচিকেতার প্রশ্ন, মৈত্রেয়ীর প্রশ্ন কি পুরাতন না সনাতন? বুদ্ধের উপদেশ ‘আত্মদীপো ভব’ কি সেকালের না সব কালের?
বিনুকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চিন্তা করতে হয় পুরাতনের থেকে বাছাই করে কী কী রাখতে হবে, কী কী ফেলতে হবে। ধর্মে, সমাজে, রাষ্ট্রে, সাহিত্যে, চারুকলায়, দর্শনে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিবিদ্যায়। সব কিছুই আজ নতুন আগামী কালে পুরোনো। তারই মধ্যে হয়তো কিছু চিরনতুন। তার লেখাও তো দু-দিন পরে পুরাতন হবে। কালোত্তীর্ণ হবে এমন কিছু কি সে লিখেছে বা লিখবে? বিনু এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম।
চেষ্টা করলে লেখাকে রূপোত্তীর্ণ করা সম্ভব, চেষ্টা করলে রসোত্তীর্ণ করাও সম্ভব, কিন্তু কালোত্তীর্ণ করা লেখকের হাতে নয়। বিশ্বসাহিত্যে যেসব বই ক্লাসিক হয়েছে সেসব বই হাজার দু-হাজার বছরের পুরাতন হয়েও চিরনতুন। যেমন কালিদাসের মেঘদূত কিংবা ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ। বাংলা ভাষায় বহু লেখক অনুবাদ করেছেন।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের যা কালোত্তীর্ণ তাকে বর্জন না করে স্বাধীন ভারতকে নবীন ভারত করতে হবে। রেনেসাঁসের যুগ পার হয়ে গেছে। এখন যেটা চাই সেটার ইংরেজি নাম রিনিউয়াল, বাংলায় নবায়ন। দম সঞ্চয় করতে করতে বিনুর বয়স হয় পঁচাত্তর। আবার একখানা বৃহৎ উপন্যাস লিখতে বিনুর দম ছিল না। চার খন্ডের উপন্যাস তো দমের কাজ। দেশের জন্যে বইখানা লিখে শেষ করতে অন্তত চার বছর তো লাগবেই। স্বাস্থ্য অনুকূল না হলে আরও ক-বছর কে জানে?
এক জ্যোতিষী বলেছিলেন তার পরমায়ু পঁচাত্তরের বেশি নয়। জ্যোতিষে যদিও তার বিশ্বাস নেই তবু মনে হয় পঁচাত্তরটা পার হয়ে যাক আগে, তারপরে শুরু করা চলবে। যদি বেঁচে থাকে। পঁচাত্তর যথাসময়েই অতীত হয়। জ্যোতিষ যে অভ্রান্ত নয় তা সম্যক উপলব্ধি করার পরে বিনু তার বৃহৎ উপন্যাসে হাত দেয়। আশি বছর তাকে বাঁচতে হবে, যদি চার খন্ডে লিখতে হয়। সে বেছে নেয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আরম্ভ থেকে মহাত্মা গান্ধীর আগে পর্যন্ত সময়সীমা আবদ্ধ ভারত-ইতিহাস। সে আপনি যার ভিতর দিয়ে নিশ্বাস নিয়েছে। সে নিজে একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। চল্লিশের দশকের অধিকাংশই এই উপন্যাসের ঘটনাকাল। মহাযুদ্ধের অনুষঙ্গে ঘটেছে জাতীয় সংগ্রাম, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক মহামারি, স্বাধীনতা।
প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হবার ন-বছর বাদে বিনু বিলেত যায় ও তার ফিরে আসার দশ বছর বাদে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বাঁধে। যে দু-বছর সে বিলেতে ছিল সে-সময়টা ছিল দুই যুদ্ধের মধ্যবর্তী শান্তিপ্রচেষ্টার সময়। তখন কারও মাথায় আসেনি যে হিটলার বলে একটা অজানা অচেনা লোক জার্মানদের জননায়ক ও রণনায়ক হয়ে আবার এক মহাযুদ্ধের অঙ্গনে ইংরেজ, ফরাসি, রুশ ও মার্কিনকে সমবেত করবে। দুই ফ্রন্টে লড়তে লড়তে জার্মানরা অবশেষে পরাস্ত হবে এটা তো অবধারিত। কিন্তু নাতসিদের ধারণা ছিল কমিউনিস্ট ও ক্যাপিটালিস্ট কখনো একজোট হবে না, হতে পারে না। সুতরাং ক্যাপিটালিস্টদের ঘায়েল করে তারা কমিউনিস্টদের খতম করবে। ভুলটা হল এই গণনাতেই যে দুই বিপরীত মেরু কখনো পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে না। কিন্তু অঘটন আজও ঘটে। মহাশত্রু স্টালিনের কাছে দূত পাঠিয়ে চার্চিল তাঁকে অবহিত করলেন যে হিটলার তাঁর সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ করে যুদ্ধে নামতে উদ্যত। পরে চার্চিল স্বয়ং স্টালিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মস্কো যান, স্টালিন লণ্ডনে আসেন না। রুজভেল্টও যান স্টালিনের সঙ্গে মিলিত হতে। স্টালিন তাঁর সঙ্গে ইউরোপ ভাগাভাগি করেন। চার্চিলের পরিকল্পনা মান্য করেন না। তবে চার্চিলই ইংল্যাণ্ডকে বাঁচান। কিন্তু তাঁর প্রেস্টিজ যখন তুঙ্গে তখন ইংরেজরা তাঁকে না করে অ্যাটলিকে করে প্রধানমন্ত্রী আর অ্যাটলি ভারতকে মুক্তি দেন। লেবার পার্টি প্রতিশ্রুত হলেও কার্যকালে চার্চিলের সম্মতির প্রয়োজন ছিল। তিনি রাজি হন তাঁর চিরশত্রু গান্ধীকে ভারতের একাংশ থেকে বঞ্চিত আর উভয় অংশকে কমনওয়েলথভুক্ত দেখে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে গান্ধীজির পলিসি ছিল একরকম, কংগ্রেস হাইকমাণ্ডের আরেকরকম, সুভাষচন্দ্রের আরও একরকম, কনিউনিস্টদের আরও একরকম, মুসলিম লিগের আরও একরকম, হিন্দু মহাসভার আরও একরকম। ভারতের জনমত কেবল বিভক্ত নয়, বিভ্রান্ত। ভারতের হয়ে কথা বলার একক অধিকার গান্ধীজির বলে বড়োলাট লিনলিথগাউ স্বীকার করেন না। তিনি জিন্না সাহেবকেও গান্ধীজির সঙ্গে বন্ধনীভুক্ত করতে চান। ফলে গান্ধীজি সরে দাঁড়ান ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে কংগ্রেসের সভাপতি তথা প্রতিভূ করেন। জিন্না সাহেব এটা মেনে নিতে পারেন না, সুতরাং বড়োলাটও মেনে নেন না। কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যায়। তখন কংগ্রেসের অনুরোধে গান্ধীজি ব্যক্তি সত্যাগ্রহ পরিচালনা করেন সিভিল লিবার্টির দাবিতে। অর্থাৎ যুদ্ধবিরোধী প্রচারকার্যের স্বাধীনতার ইসুতে। কোনো সরকারই যুদ্ধকালে তা করতে দেয় না। ব্যক্তি সত্যাগ্রহ চলে। বহুসংখ্যক কংগ্রেস কর্মী কারাবরণ করেন।
গান্ধীজি বলেছিলেন পরে একসময় গণ-অভ্যুত্থান আপনা থেকেই হবে। হত হয়তো যুদ্ধের শেষের দিকে, কিন্তু ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যায় জাপানি অভিযান। বর্মা দখল হয়, ভারত আক্রান্ত হবার মুখে নেতা ও কর্মীরা খালাস হন। আবার কথাবার্তা। এবার ক্রিপসের সঙ্গে। জাপানিরা ভারতে এলে ভারত হয়ে উঠবে রণাঙ্গন। তখন ব্রিটিশ সেনা তাদের রুখতে পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করবে। সরকারে যোগ দিয়ে কংগ্রেস নেতারা তা ঠেকাতে পারবেন না। মাঝখান থেকে কলকারখানা বন্দর ব্রিজ প্রভৃতি ধ্বংসের জন্যে দায়ী হবেন। তাই তাঁরা দাবি করেন যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষমতা। ব্রিটিশ সেনার উপর এক্তার। ক্রিপস নারাজ। কথাবার্তা বন্ধ। তখন ‘কুইট ইন্ডিয়া’ প্রস্তাব পাস। গণসত্যাগ্রহ করার আগে গান্ধীজি বড়োলাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতেন, কিন্তু বড়োলাট তাঁকে বন্দি করে বিদ্রোহের আগুন উসকে দেন। তাঁর মতে সেটা উসকানি নয়, সেটা তড়িঘড়ি নেবানো। দেশজুড়ে হিংসাত্মক কান্ড ঘটে। গান্ধীজিকে দায়ী করে দুনিয়াময় রটানো হয় যে গান্ধীজি জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে ইংরেজের পরাজয় চান। তিনি জাপানিদের আসার পথ সুগম করে দিচ্ছেন। তাঁকে এই অপবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা না দেওয়ায় তিনি একুশ দিন অনশন করে দুনিয়াকে জানান দেন যে তিনি নির্দোষ।
যুদ্ধ শুরু হবার সময় গান্ধীজি বলেছিলেন এ যুদ্ধ শেষ হবে একটি মরাল ইসুতে। হলও তাই। হিরোশিমার উপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে সেই মরাল ইসু। নিরীহ নিরস্ত্র দেড় লক্ষ শিশু, নারী ও বৃদ্ধকে সতর্ক না করে ও পলায়নের সুযোগ না দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা না করলে জাপানিরা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করত না। এটা একটা নৈতিক পরাজয়। বিজেতা পক্ষের। ওদিকে নাতসিরাও যুদ্ধকালে ষাট লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র ইহুদিকে গ্যাস চেম্বারে পুরে হত্যা করে। সেটাও তাদের নৈতিক পরাজয়। উপরন্তু সামরিক পরাজয়।
যুদ্ধকালে বিনুর অর্ধেক নজর ছিল ইংরেজের উপরে, অর্ধেক নজর কংগ্রেসের উপরে। তখন সে ভাবতেই পারেনি যে ওস্তাদের মার শেষ রাত্রে। সেটা জিন্না সাহেবের ডাইরেক্ট অ্যাকশন। এর বিরুদ্ধে গান্ধীজির কোনো আয়ুধ ছিল না। হিন্দু-মুসলমানের যুদ্ধে তিনি হিন্দু শিবিরের যোদ্ধা ছিলেন না। তিনি ছিলেন দুই পক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই পক্ষকে নিবৃত্ত করার জন্যে তৎপর শান্তিবিধায়ক পিসমেকার। ফলে উভয় শিবিরের যোদ্ধাদের চোখে দুশমন। ইংরেজরা যখন স্বেচ্ছায় কুইট করার নোটিস দেয় তখন তিনি পরামর্শ দেন, মুসলিম লিগকে গদি ছেড়ে যাও। কংগ্রেস নেতারা ইতিমধ্যেই গদিয়ান হয়েছিলেন। তাঁরা গদিও ছাড়েন না, গদাযুদ্ধও করেন না। তাঁদের মন্ত্র হল, ‘সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধং ত্যজতি পন্ডিতঃ।’ ইতি পন্ডিত নেহরু। তবে অর্ধেক নয়, এক-চতুর্থাংশ। ভারতের মুসলমান সংখ্যাও ছিল প্রায় এক-চতুর্থাংশ। কাজির বিচারে দেশভাগ ও প্রদেশভাগ হয়ে যায় নিক্তির ওজনে।
গান্ধীজির সত্যিকার কাজ ছিল দুটি। ভারতের স্বাধীনতা অর্জন ও অহিংস উপায়ের মাহাত্ম্য প্রতিপাদন। যার জন্যেই তিনি মহাত্মা। স্বাধীনতা যে উপায়ে অর্জিত হল তা যে পুরোপুরি অহিংস নয় তা তিনি জানতেন ও মানতেন। অর্ধেক অহিংসা আর অর্ধেক হিংসার পরিণাম যে খন্ডিত স্বাধীনতা হবে তা তিনি দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করেন। ইচ্ছা করলে তিনি পার্টিশনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারতেন, কিন্তু তাহলে ঘটে যেত তাঁর নিজের সেনার সঙ্গেই বিচ্ছেদ। জওহরলাল ও বল্লভভাই তাঁকে ছাড়তেন, সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ কংগ্রেসকর্মী। অসহায় মহাত্মার একমাত্র কর্তব্য হল সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপরে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সহিংস আক্রমণ অহিংস উপায়ে রোধ। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায় নিরাপদ হলে পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ও নিরাপদ হবে। কতক হিন্দু এটা বুঝল, কতক বুঝল না। তাদের মতে এটা মুসলিম তোষণ। তাদের ধারণা মুসলিম বিতাড়নই ছিল হিন্দু বিতাড়ন রোধের মোক্ষম উপায়। তাঁকে পীড়া দেয় তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মীদের মধ্যেই উগ্র হিন্দু মনোভাব। তিনি অনশন করেন। সফল হন। সফল হন বলেই নিহত হন। সফল না হলে অবশ্য অনশনে দেহত্যাগ করতেন। তাঁর নিধনের পর অতিপ্রিয় সহকর্মীর মন্তব্য হল, ‘তিনি অনশনে মরলেই ভালো হত।’
রাজনীতিক্ষেত্রে অহিংসার প্রয়োগ গান্ধীজির সঙ্গেই আরম্ভ গান্ধীজির সঙ্গেই শেষ। বিনু আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত অহিংসার পরীক্ষার মনোযোগী ছাত্র। শুধু ভারত-ইতিহাসে নয়, মানবইতিহাসেও তাঁর অহিংসা নিয়ে পরীক্ষা একটি অভূতপূর্ব অধ্যায়। গান্ধীজি যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহের পরীক্ষা শুরু করেছেন তখন টলস্টয় তাঁকে চিঠি লিখে উৎসাহ দেন। যা বলেন তার মর্ম—তিনি যে কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন সেটাই পৃথিবীতে সবচেয়ে আবশ্যক, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্ম। গান্ধীজির পূর্বসূরি ছিলেন টলস্টয় ও থোরো। টলস্টয় প্রেরণা পেয়েছিলেন রুশ দেশের গ্রামীণ কৃষক দুখোবরদের জীবনধারা থেকে। তারা অস্ত্র ধরত না, অস্ত্র ধরতে বাধ্য করলে প্রতিরোধ করত। গণ-প্রতিরোধের অহিংস নজির সেইখানে। শেষপর্যন্ত তাদের দেশান্তরি হতে হয়। রেজারেকশন উপন্যাস লিখে টলস্টয় যা উপার্জন করেন তা দুখোবরদের মহানিষ্ক্রমণে সাহায্য করেন।
বিনু পুনর্নবায়ন নিয়ে চিন্তান্বিত ছিল, কিন্তু তার যেটুকু সংকেত পেল সেটুক গান্ধীজির পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যেই নিহিত। যুদ্ধবিগ্রহের ভিতর দিয়ে নবায়ন হয়, বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের ভিতর দিয়েও হয়, কিন্তু বিনুর আকাঙ্ক্ষিত নবায়ন হবে শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে, ত্যাগ ও তপস্যার ভিতর দিয়ে। হিংসার মতো পুরাতন আর কী আছে?
তার তৃতীয় বৃহৎ উপন্যাস সমাপ্ত হয় বিরাশি বছর বয়সে। আশ্চর্য! তখনও সে বেঁচে আছে! তখনও তার হাতে বহু দিন থেকে ভেবে রাখা অথচ অনারব্ধ লেখা বড়ো মাপের নয়। তবু বিশেষ মূল্যের। পুনর্ভাবনায় অনেক ভুলভ্রান্তির, অনেক মোহের অবসান হয়েছে। তা বলে অতিবাহিত জীবনকে এডিট করা চলে না। পাপ নেই, তাপ নেই, এমন জীবন রক্ত-মাংসের মানুষের জীবনে দেখা যায় না। বিনু রক্ত-মাংসের মানুষ।
তবে সাহিত্যে সব কিছু খুলে বলা যায় না। মিথ্যা না বললেই হল।
বিনুর বিকাশ
ভবভূতি বলে গেছেন, ‘কালোহ্যয়ং নিরবধিঃ বিপুলা চ পৃথ্বী।’ সেই নিরবধি কালকে মানুষ সুবিধামতো শতাব্দীতে ভাগ করে নিয়েছে, আর সেই বিপুলা পৃথ্বীকে বিভিন্ন দেশে। দেশও সত্য, শতাব্দীও সত্য, তবু পূর্ণসত্য নয়। পূর্ণসত্য হচ্ছে নিরবধি কাল ও অখন্ড দেশ।
যে লেখে তার দেশ আছে, যুগ আছে। কিন্তু যা লেখা হয় তা দেশ থেকে দেশান্তরে ও যুগ থেকে যুগান্তরে ছড়িয়ে পড়তে পারে; সূর্যের আলোর মতো, সমুদ্রের তুফানের মতো। বাইরের মানুষটার জাত কুল বংশপরিচয় আছে, ভিতরের মানুষটার তা নেই। তার লেখনীর মুখ দিয়ে যা নিঃসৃত হয় তা যদি অতি গভীর স্তরের বাণী বহন করে আনে তবে তা গ্রিকের না ভারতীয়ের না চৈনিকের না আরবের না পারসিকের না ইংরেজের না ফরাসির না জার্মানের না রুশের না নরওয়েজিয়ানের ও-গণনা লঘুচেতাদের। উদারচরিতের কাছে বসুধার সকলেই কুটুম্ব।
এ শিক্ষা বিনু তার শৈশব থেকেই পেয়েছিল। তার পিতামহী তাকে তাঁর কাছে শুইয়ে রোজ রাত্রে শোনাতেন রামায়ণ মহাভারতের উপাখ্যান, সেইসঙ্গে গোলেবকাওলি পরির কাহিনি, মহারানি ভিক্টোরিয়ার সম্বন্ধে খোশগল্প। তার কাকারা ও তাদের সহপাঠীরা শেক্সপিয়ারের নাটকের দৃশ্য অভিনয় করতেন। সে ছিল কনিষ্ঠ দর্শক। বিনুদের বাড়িতে যে দুর্গা পূজা হত তাতে প্রতিমা থাকত না, পরিবর্তে থাকত একটা জলচৌকির উপরে কিছু বইপত্র ও একটা তলোয়ার। বইপত্রের মধ্যে ইংরেজি শেক্সপিয়ার গ্রন্থাবলি। সরস্বতী পূজার সময় তলোয়ার অন্তর্হিত, কিন্তু শেক্সপিয়ার সুরক্ষিত। তা ছাড়া বাড়িতে বাইবেলও ছিল, ছোটোকাকার পরীক্ষা পাসের দরুন উপহার।
খ্রিস্টানদের সঙ্গে বিনুর সম্পর্ক আজন্ম। যাঁর হেপাজতে সে ভূমিষ্ঠ হয় তিনি একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান লেডি ডাক্তার। বিনুদের বাড়ির সামনে দিয়ে তিনি গাড়ি করে রাজপ্রাসাদে যাতায়াত করতেন। খোঁজ করতেন বিনুর ও তার ভাইবোনের। সকলেরই জন্ম তাঁর হেফাজতে। পাড়ায় একঘর খ্রিস্টানও ছিলেন, তাঁদের পরিবারের ছেলেদের সঙ্গেও বিনু খেলত। বিনুদের বাড়ির পেছনেই থাকতেন একঘর মুসলমান। তাঁদের ছেলে এসে বিনুর সঙ্গে খেলত, মেয়ে বেড়ার ওপার থেকে দুটি-একটি কথা বলত। কাকাদের বন্ধু পাঠান মাস্টার রোজ আসতেন চা খেতে ও গল্প করতে। বোখারি সাহেব মাঝে মাঝে সত্যপিরের সিন্নি দিয়ে যেতেন। রাজকর্মচারী আতাহার মিয়া দিয়ে যেতেন হালুয়া। মহরমের মিছিল বাড়ির সামনে এসে লাঠি খেলা দেখাত। বিনুর ঠাকুমার মানত ছিল বিনুও মহরমে লাঠি খেলবে। বিনু কিন্তু মনে মনে বাঘের নাচ নাচত। নাপিতের ছেলে সিরিয়ার মতো। মহরমে হিন্দুদের উৎসাহ কম নয়। বাজনদাররা সবাই হিন্দু।
অন্দরের দুয়ার খুলে যায় যখন বিনুর আট বছর বয়সে তার মা-বাবা বৈষ্ণব দীক্ষা নিয়ে বাড়িতে গোপাল বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। সপ্তাহে সপ্তাহে কীর্তন, মাসে মাসে মোচ্ছব। আহূত, অনাহূত, রবাহূত সকলেই স্বাগত। কীর্তনিয়ারাও বাইরের লোক বেশিরভাগ। দুর্গা পূজা, সরস্বতী পূজা আর হয় না। বিনুকে বলা হয় না কবিকঙ্কণ চন্ডী সুর করে পড়তে। তার মা সুর করে জয়দেব থেকে গান করেন। আর বাবা সুর করে বিদ্যাপতি থেকে আবৃত্তি করেন। শুনতে শুনতে বিনুর ছন্দের কান তৈরি হয়ে যায়। মা-বাবার কাছে ভগবান হচ্ছেন পুত্রের মতো প্রিয়। তাঁদের সাধনা বাৎসল্যরসের সাধনা। কিন্তু লীলাকীর্তন শুনলে মনে হয় বৈষ্ণবদের সাধনা মধুর রসের সাধনা। ভগবান তাঁদের কান্ত। বিনুর বয়সে এসব বোঝা সম্ভব ছিল না। সেও কীর্তনের শেষে জয়ধ্বনি দিয়ে বলত, ‘রাধারানি কি জয়’। অথচ রাধারানির বিগ্রহ বাড়িতে ছিল না, কিশোর কৃষ্ণেরও না। এর জন্যে তাকে যেতে হত রাজমাতার প্রতিষ্ঠিত রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে—সুন্দর যুগলমূর্তি।
একদিনে নয়, এক বছরেও নয়, দীর্ঘকাল ধরে তার অন্তরে চলতে থাকে ধর্মবিশ্বাসের ক্রমপরিবর্তন। গৃহদেবতা গোপালের প্রতি তার মা-বাবা বাৎসল্যরস অনুভব করতে পারেন, সে কী করে পারবে? ভাইয়ের বেলা যে ভালোবাসা অনুভব করা যায় তা ভগবানের বেলা কি সম্ভব? মা বলতেন গোপাল তার ছোটোভাই। ছোটোভাইকে কি কেউ প্রণাম করে? রবীন্দ্রনাথ তথা ব্রাহ্মসমাজের প্রভাবে সে ক্রমে ক্রমে একেশ্বরবাদী ও নিরাকারবাদী হয়ে ওঠে।
অথচ বৈষ্ণব মত সে সরাসরি ত্যাগ করতে পারে না। আরও বড়ো হয়ে সে যখন আত্মপরীক্ষা করে তখন উপলব্ধি করে সে লীলাবাদী। জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্বন্ধ নিত্যলীলার সম্বন্ধ। বৈষ্ণবদের মতো সেও বিশ্বাস করে যে সমস্তই ভগবানের লীলা।
বোধহয় রক্তের ভিতরে মায়াবাদ নিহিত ছিল। তাই মা বলতেন, ‘এটা মায়ার সংসার, কেউ কারও নয়।’ শঙ্করাচার্য বলছেন, ‘কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ।’ তিনি মায়াবাদী। কথাটা মাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। সেটা তাঁর অন্তর থেকে স্বতঃ উৎসারিত। মা খুব কম বয়সেই ছেলে-মেয়েদের মায়া কাটিয়ে চলে যান। তাঁর প্রিয় পুত্র গোপালেরও। সংসারের ধকল তাঁর দুর্বল শরীরে সহ্য হচ্ছিল না। কখনো তো বিশ্রাম করেননি। তবে তাঁর মৃত্যুর পরও কীর্তন মোচ্ছব একইভাবে চলতে থাকে। যেটা বন্ধ হয় সেটা প্রতি সন্ধ্যায় জয়দেব থেকে গান। বাবা ক্রমশ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অথরিটি হয়ে ওঠেন। স্বয়ং রাজমাতা তাঁকে ডেকে পাঠাতেন ও তাঁর পরামর্শ নিতেন।
আট-দশ বছরের ছেলেকে কি তার বাপ যা ইচ্ছা তাই পড়ার স্বাধীনতা দেন? বিনু যে কেবল ইংরেজি বাংলা সাপ্তাহিক পড়ত তা নয়, তার একটা লাইব্রেরি ছিল। তাতে ছিল বৈষ্ণব পদাবলি, ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর, বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলি, দারোগার দপ্তর প্রভৃতি বই। বেশিরভাগই বসুমতীর উপহার। বুঝুক আর না বুঝুক বিনু গোগ্রাসে গিলত। ওদিকে তার হাই স্কুলের হেডমাস্টারমশাই তার উপর কমনরুমের ভার দিয়েছিলেন। চাবি খুলে যখন ইচ্ছা রাশি রাশি মাসিকপত্র পড়ত। তারমধ্যে কিছু ইংরেজি মাসিক ও সাপ্তাহিকও ছিল। বিনুকে সবচেয়ে আকর্ষণ করত সবুজপত্র। ওড়িশার এক দেশীয় রাজ্যে ‘সবুজপত্রে’র সমজদার বোধহয় শিক্ষকদের মধ্যে বাঙালি হেডমাস্টারমশাই আর ছাত্রদের মধ্যে বিনু।
স্কুলের লাইব্রেরিটি ছিল আশ্চর্যরকম আধুনিক। প্রাক্তন হেডমাস্টারমশাইরা শিক্ষকদের জন্যে আনিয়ে রেখেছিলেন ইতিহাসের বই। তা ছিল কলেজ স্তরের চেয়েও উচ্চতর স্তরের। ইংরেজি শিশু বিশ্বকোষও ছিল। কিছু ব্রাহ্ম ধর্মগ্রন্থ। স্কট, ডিকেন্স প্রভৃতির সংক্ষেপিত নভেল। বিস্তর বই রবীন্দ্রনাথের, সত্যেন্দ্রনাথের, রজনীকান্তের, আরও অনেকের। বিনু একদিন আবিষ্কার করে চারখানি ইংরেজি বই। কেউ পড়েনি, পাতা কাটা হয়নি। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘যা প্রত্যেক বালকের জানা উচিত’, ‘যা প্রত্যেক তরুণের জানা উচিত’ ইত্যাদি। যৌন বিষয়ক জ্ঞান যথেষ্ট শালীনতার সঙ্গে পরিবেশিত। বিনুটা এমন ন্যাকা সে তার বাবাকে বলে, ‘এ বইতে লিখেছে পুরুষের উচিত নয় নারীদের সঙ্গে শোয়া। কেন?’
তিনি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে বসে শাস্ত্র পাঠ করছিলেন। বিনুর প্রশ্ন শুনে দুজনই হেসে ওঠেন। বাবা বলেন, ‘তা না হলে সৃষ্টিরক্ষা হবে কী করে?’ বন্ধুও পুনরুক্তি করেন।
বন্ধুর কন্যার নামও ছিল ‘সৃষ্টি’। মা-মরা মেয়ের বিয়ে দিয়ে যিনি সংসার ত্যাগ করেছেন।
সৃষ্টিরহস্য বিনু সেই সূত্রেই জেনেছিল। ওরকম বই যে কেমন করে ওরকম জায়গায় এল সেইটেই আশ্চর্য। বিষয়টা তখনকার দিনে বিলেতেও নতুন। কিন্তু চিরপুরাতন। সব দেশে সব স্ত্রী-পুরুষ জানে কিন্তু জানায় না। বিনু আরও বড়ো হয়ে অসংখ্য বিদেশি পুস্তক পড়েছে—প্রেমের কাহিনি, অথচ কাম পর্যন্ত এসে সম্পূর্ণ নীরব। কারণটা পরে টের পায়। কড়া আইনকানুন। না মানলে জেল, জরিমানা, বাজেয়াপ্তি। লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক আদালতের কাঠগড়ায়। লাঞ্ছনার শিকার ফ্লোবেয়ার, জোলা, ডি এইচ লরেন্স, জেমস জয়েস, আঁদ্রে জিদ প্রমুখ।
যেখানে যত নিষেধ সেখানে তত কৌতূহল। কৌতূহলই নিষিদ্ধ গ্রন্থের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। নিষেধ তুলে নিয়ে দেখা যায় বইখানা সত্যি এমন কিছু মূল্যবান নয়। কৌতূহল মিটে গেলে চলনসই।
একটি বনেদি শাক্ত পরিবার রাতারাতি বৈষ্ণব বনে যাওয়ায় যে পরিবর্তনটা ঘটে সেটা এক হিসাবে বৈপ্লবিক। এতকাল যে দেবীপ্রতিমা বেদিজুড়ে বসেছিলেন তাঁকে স্থানান্তরিত হতে হয়। গোপাল বসেন রাজআসনে। রান্নাঘরে মাছ-মাংস ঢুকতে পারে না। জীবে দয়া বৈষ্ণব ধর্মের প্রথম অনুশাসন। জীবহত্যা বারণ। সবাই নিরামিষ খায়, বিনু মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরে বাগানের এককোণে মাংস রেঁধে বনভোজন করে। বাবা আঘাত পান। তিনি একদা শিকার করতেন, তাঁর একটি বন্দুক ছিল। সেই তিনি ডুবন্ত পিঁপড়েকে জল থেকে উদ্ধার করেন। মাছি মারলেও তাঁর কষ্ট হয়। এর মধ্যে ভন্ডামি ছিল না। তিনি যখন যেটা করতেন চূড়ান্ত করতেন, মাকেও তা মানতে হত; কিন্তু ছেলে-মেয়েরা যে অবোধ।
বৈষ্ণব ধর্মের দ্বিতীয় অনুশাসন হল নামে রুচি। নামসংকীর্তন! বিনুদের তাতে বিরাগ ছিল না, অনুরাগ ছিল। তিনটে খোল কিনে দেওয়া হয় তিন ভাইকে। মেজোভাই ওস্তাদ হয়ে ওঠে। বিনু বাজাতেই পারে না। কিন্তু নগরসংকীর্তনে বেরিয়ে বাহু তুলে নাচে। কিছুদিন পরে তাতেও অনীহা আসে।
বাবা তাকে বিশ্বাসের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সে যেটুকু বিশ্বাস করত সেটুকু স্বাধীনভাবেই করত, কারও কথায় নয়। বাবাকে প্রণাম করলে তিনি বলতেন, ‘কৃষ্ণে মতি হোক।’ তার বেশি মুখ ফুটে চাইতেন না। কোনো এক বন্ধু তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ছেলেদেরও বৈষ্ণব দীক্ষা দিতে। তিনি সে-পরামর্শ অগ্রাহ্য করেন। তাঁর বিশ্বাস তিনি ওদের উপর চাপিয়ে দেবেন না। ওদের বয়স হলে ওরা নিজেরাই তেমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে, নিলে গুরু বেছে নেবে—তিনি নিজে যা করেছিলেন।
তবে বাবা একবার বিনুকে সকালে কিছুক্ষণ ধ্যান করতে উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি নিজে ধ্যান করতেন। কাকে ধ্যান, কীসের ধ্যান, কেন ধ্যান—বিনু দু-চার দিন চোখ বুজে রয় তারপর ছেড়ে দেয়। চোদ্দো-পনেরো বছর বয়সে একদিন তার চোখ থেকে পর্দা সরে যায়। সব আলো হয়ে যায়। এক মুহূর্তের জন্যে সে বিশ্বরূপ দর্শন করে। দৃশ্যমান জগতের অন্তরালে আরও এক জগৎ আছে, এই জগৎই সমগ্র জগৎ নয়, দুই মিলিয়ে সম্পূর্ণ সৃষ্টি। বিনুর আরও একবার এই উপলব্ধি হয় বিশ-একুশ বছর বয়সে। মুহূর্তের জন্যে সব আলো হয়ে যায়। সে সমগ্রকে দেখতে পায়, কিন্তু খোলা চোখে নয়। কিন্তু ইচ্ছা করলেই আবার এই দিব্যদৃষ্টি লাভ হয় না। এটা পরমাত্মার অনুগ্রহ। আবার কবে তাঁর অনুগ্রহ হবে কে জানে!
বিনুর অন্তরে একজন মিস্টিক ছিল, তাই সে কখনো পুরোপুরি র্যাশনালিস্ট হয়নি। তেমনই তার ভিতরে একজন বিশ্বনাগরিক ছিল, তাই সে কখনো পুরোপুরি ন্যাশনালিস্ট হয়নি।
তার বারো-তেরো বছর বয়সে বাবা একবার বলেছিলেন, ‘তুই হবি জর্জ ওয়াশিংটন আর চিনু হবে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।’ শুনে বিনু পুলকিত হয়নি। তার মতে নেপোলিয়নই বীরশ্রেষ্ঠ। ওয়াশিংটন তাঁর দেশকে স্বাধীন করেছিলেন তা ঠিক, তা বলে নেপোলিয়নের চেয়ে বড়ো নন। বাবা কি মনে করেন বিনু চিনুর চেয়ে খাটো? অবশ্য গায়ের জোরে চিনু বিনুকে হারিয়ে দেয়।
বিনু ওয়াশিংটন হতে চায়নি। তবে পিতার আশীর্বাদ তো ব্যর্থ হবার নয়, সে আমেরিকায় পালিয়ে যাবার প্ল্যান করেছিল। সে-দেশে গিয়ে সন্ত নিহাল সিং বা ধনগোপাল মুখার্জির মতো একজন লেখক হত। সেভাবেও ভারতের স্বাধীনতার জন্যে কাজ করা যায়। কলম তো তলোয়ারের চেয়ে বলবান। লোকে একদিন স্বীকার করবে যে বিনুও একজন মুক্তিদাতা ওয়াশিংটন।
আমেরিকা গেলে সে সেখানেই বিয়ে করত, এটাও তার কল্পনায় ছিল। রূপকথার রাজপুত্র সাতসমুদ্র তেরো নদীর পারে গিয়ে সে-দেশের রাজকন্যাকে বিয়ে করত। গুরুজন সেটা মেনেও নিতেন। বিনুর বেলা অন্যরকম হবে কেন? সে অবশ্য কোনোদিন একথা কাউকে জানতে দেয়নি। কথাটা সত্যি সত্যি ফলে যায় তার জীবনে অনেক বছর বাদে। সাত সাগর পার থেকে আসেন এক মার্কিন কন্যা। বিনুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। মা তখন নেই, থাকলে কী মনে করতেন কে জানে। বাবার তো আপত্তির কোনো সঙ্গত কারণ ছিল না। তিনি বলেও রেখেছিলেন যে বিনু জাতপাত ভেঙে বিয়ে করলেও তিনি সম্মতি দেবেন। অতটা ভেবে দেখেননি যে কন্যাটি বিদেশিনি হবে। যা-ই হোক, সব ভালো যার শেষ ভালো। বিনুর বউকে তিনি আশীর্বাদ করেন। বউমাও শ্বশুরকে যথাযোগ্য সম্মান ও প্রণতি জানায়।
বিনুকে তার বাবা একান্তে বলেন, ‘তোদের ছেলে-মেয়ে হলে তাদের বিয়ে হবে কোন সমাজে?’
‘হিন্দু সমাজ ততদিনে উদার হবে।’ বিনু আশ্বাস দেয়।
বছর ছয়েক বাদে তিনি অকস্মাৎ মারা যান। চিনু মুখাগ্নি করে। বিনু আর তিনু অন্যত্র কর্মরত। শ্রাদ্ধের সময় তিন ভাই একত্র হয়। কুলপুরোহিত বলেন, ‘চিনু মুখাগ্নি করেছে, চিনুই শ্রাদ্ধের অধিকারী। বিনু তো হিন্দুমতে বিয়ে করেনি, বিয়েতে আমাকে তো ডাকেনি। আমি কেমন করে ওকে শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়াব?’ বিনু হতবাক। তিনু বলে, ‘বাবা তো তাঁর বড়োছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেননি। বাবার ইচ্ছা মান্য করতে হবে।’ কুলপুরোহিত বিধান দেন যে তিন ভাই পাশাপাশি বসে শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়বে। তখন সারিবদ্ধভাবে ক্রিয়াকর্ম করে তিন জনে। বিনু মনে মনে আহত হয়, অভিমান ও অপমান চেপে রাখে। মন্ত্রতন্ত্রে ওর বিশ্বাস ছিল না। যন্ত্রের মতো আওড়ায়।
স্থানীয় ব্রাহ্মণরা ভোজনের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন না। বলেন, ‘উনি মেম বউকে ঘরে নিয়েছিলেন। আমরা ওঁর শ্রাদ্ধে খাব না।’ অথচ এঁরাই এককালে বাবার অনুগ্রহে চাকরি বা প্রমোশন পেয়েছেন বা অন্য কোনো সুবিধা। বিনু যদি দোষ করে থাকে তবে তার বাবা কেন শাস্তি পাবেন? চিনু রাগ করে শহরের মুসলমানদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে। ঠাকুরঘরের বারান্দায় পরিবারের লোকজনের সঙ্গে তাদের বসিয়ে দেওয়া হয়। বাবার বিশেষ বন্ধু ছিলেন এক ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব। স্থানীয় নন, বহিরাগত। তিনি আপনি এসে হাজির হন ও প্রধান অতিথির আসনে বসেন। ওসব সংস্কার তাঁর ছিল না। বিনুকে তিনি নৈতিক সমর্থন জোগান। সবচেয়ে আনন্দ মুসলমানদের। এ বাড়ির অন্দরে তারা কখনো ঢুকতে পারেনি। তারা তো কীর্তনিয়া নয়।
স্থানীয় ব্রাহ্মণরা না কি পরে অনুতপ্ত হন। চিনুকে বলেন, ‘আবার আমাদের ডাকো। ডাকিলেই খাইব।’
প্রকৃত প্রতিবেশী কে? বাইবেলে গুড সামারিটানের প্যারাবল আছে। বিপদের দিনে যে-জন সহায় সে বিদেশি বা বিধর্মী হলেও সে-ই প্রকৃত বান্ধব। সামারিটানদের সঙ্গে ইহুদিদের ছিল নিত্য কলহ। ডাকাতের হাতে জখম ইহুদির দিক থেকে স্বজাতি যখন মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে যায় তখন বিজাতীয় পথিক তাকে সরাইতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, নিজের খরচে।
হিন্দু-মুসলমানের নিত্য কলহে উদ্ভ্রান্ত হলেও বিনু ভুলতে পারে না যে মুসলমানদের মধ্যেও গুড সামারিটান আছে। পার্টিশনের অনতিকাল পূর্বে ময়মনসিংহে এক ভদ্রলোক তার সঙ্গে দেখা করেন। কথাপ্রসঙ্গে বিনু জানতে পারে তাঁর গ্রামে তিনিই একমাত্র হিন্দু গৃহস্থ। বাড়িতে স্ত্রীকে একা রেখে টুর করেন। ‘সেকী! আপনার ভয় করে না? বিপদের সময় কে রক্ষা করবে তাঁকে!’ বিনু প্রশ্ন করে।
‘কেন? পাড়ার মুসলমানরা। তারাই তো এতকাল রক্ষা করে এসেছে। আমরা তাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি।’ তিনি উত্তর দেন।
পার্টিশনের ঠিক আগে ঢাকা থেকে এক ভদ্রলোক ময়মনসিংহে আসেন। বিনু জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি কি থাকছেন না যাচ্ছেন?’ তিনি স্মিতমুখে বলেন, ‘আমি থাকছি। মানুষের অন্তর্নিহিত গুডনেসে আমি বিশ্বাস করি।’
এই অন্তর্নিহিত গুডনেসে বিশ্বাস করতেন বিনুর বাবা। তাই তাঁর মুসলিম বন্ধুর অভাব ছিল না। তাঁদেরই একজন বিনুকে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার পূর্বে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে কমিশনারের সকাশে নিয়ে যান। একদা তিনি ছিলেন বাবার স্কুলের সহপাঠী। মাঝখানে কেটে গেছে পঁয়ত্রিশ বছর। তিনি উচ্চপদস্থ, বাবা নিম্নপদস্থ। বন্ধুতা জাতধর্মের বিচার করে না, প্রেমও তেমনি।
বিনুর প্রস্তুতি
ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার সময় বিনুর মাতৃবিয়োগ হয়। তিনি বেঁচে থাকলে তাকে চোখের আড়াল করতেন না। সে কলেজে পড়তে গেলে তিনিও তাকে নিয়ে বাড়িভাড়া করে বাস করতেন। বিনুর কিন্তু অন্যরকম পরিকল্পনা। সে কলকাতা গিয়ে সংবাদপত্রে শিক্ষানবিশি করবে। তারপর সুযোগ পেলেই জাহাজের খালাসি হয়ে আমেরিকা যাত্রা করবে। তার নিজের জীবনকে সে নিজের মতো করে বাঁচবে, গুরুজনের ইচ্ছামতো নয়। তার বাবার ইচ্ছা সে পরের চাকরি না করে স্বাধীনভাবে চাষবাস করে। কিছু জমিও তিনি কিনেছিলেন। তবে সাংবাদিক বৃত্তিও স্বাধীন বৃত্তি। তাতে তাঁর আপত্তি ছিল না। বিনু তাঁর অনুমতি নিয়েই কলকাতা যায়। তিনি তাঁর এক বন্ধুকে চিঠি লেখেন। বন্ধু তাঁর সম্পাদক বন্ধুদের চিঠি লেখেন। বিনু তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।
বাংলা দৈনিকের সম্পাদক তাকে পরামর্শ দেন আগে ইংরেজি শর্টহ্যাণ্ড ও টাইপরাইটিং শিখতে। ওই দুটি বিদ্যা শিখতে গিয়ে বিনু দেখে ট্রেনিং ক্লাসে তার সতীর্থরা সকলেই কেরানি হবার জন্যে তালিম নিচ্ছে। সে তো কেরানি হতে চায়নি, তবে কেন সময় নষ্ট করবে? তারপর ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক বলেন আগে প্রুফ-রিডিং শিখতে। যাঁর কাছে পাঠান তিনি বলেন, ‘আপনাকে যদি শেখাই তো আপনি আমার দানাপানি মারবেন।’ বিনু তাঁকে বোঝায় সে প্রুফ-রিডার হতে আসেনি, সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখতে এসেছে। ‘তাহলে আপনি কলেজে গিয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়ে আসুন।’ ভদ্রলোক পরামর্শ দেন। বিনু অপমানিত হয়ে বিদায় নেয়।
কলকাতায় থাকা নিরর্থক, টাকাও ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু কোন মুখে বাড়ি ফিরে যাবে? চাষবাসে তার মন ছিল না। কায়িক পরিশ্রমকে সে চিরকাল এড়িয়ে এসেছে। সে বর্তে যায় যখন তার ছোটোকাকা তাকে কলেজে ভরতি হতে ডেকে পাঠান। তখন অসহযোগের আমল। কলেজ মানে গোলামখানা। মাথা হেঁট করে বিনু সেই গোলামখানায় নাম লেখায়। সান্ত্বনা এই যে, তারই মতো আরও কয়েক জনও সেখানে জুটেছে। তারা তার সঙ্গে মিলে একটি গোষ্ঠী গঠন করে। পাঁচজনে মিলে একটি হাতে-লেখা পত্রিকায় যে যা খুশি লেখে—যেকোনো ভাষায়। বিনু লেখে বাংলা, ওড়িয়া, ইংরেজি তিন ভাষায়। অন্যেরা একটি বা দুটি ভাষায়। অচিরেই বিনু ও তার বন্ধুদের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখা দিল বিভিন্ন ভাষার পত্রিকায়।
তারা তখন জানত না যে ওড়িয়া ভাষায় একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। তারাই সে-যুগের পুরোধা। যুগটির নাম সবুজ যুগ। তার স্থায়িত্ব প্রায় বারো বছর। বিনু কিন্তু ততদিন সে-যুগের অন্তর্ভুক্ত থাকে না। ছ-বছর পরে সে বিলেত চলে যায় সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় সফল হয়ে। তার এক বছর আগেই সে স্থির করে যে কেবল একটি ভাষাতেই সমস্ত শক্তি নিয়োগ করবে। একই কালে তিনটিতেই সাহিত্যের সাধনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যেমন একই কালে তিনটি নারীকে নিয়ে প্রেমের সাধনা। তার পক্ষে সেই একটি হবে বাংলা ভাষা। তার এই সিদ্ধান্তে বন্ধুরা বিস্মিত হয়। কারণ ওড়িয়া ভাষায় তার কবিতা উৎকল সাহিত্য সম্পাদক প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশ করতেন। এক-একটি সংখ্যায় একাধিক প্রবন্ধ তার স্বনামে বা ছদ্মনামে পত্রস্থ হত। ওদিকে কলেজ ম্যাগাজিনেও তার ইংরেজি প্রবন্ধ বেরোত প্রায় প্রতিটি সংখ্যায়। তার বাংলা রচনা তুলনায় কম। তবে প্রবাসী একবার সম্পাদকীয় প্রসঙ্গের পর সম্মানের আসন দিয়েছিল তার একটি সুদীর্ঘ কবিতাকে। ভারতী-ও তার প্রবন্ধ মাঝে মাঝে প্রকাশ করত। একবার তো বঙ্গনারী (অনিন্দিতা দেবী) তার বিরুদ্ধে মসিতে অসিধারণ করেন। লেখা পড়ে তাঁর মনে হয়েছিল বিনু পূর্ণবয়স্ক পুরুষ। তিনি জানতেন না যে আঠারো-উনিশ বছর বয়সের সেই ছেলেটি পুরীর সমুদ্রকূলে প্রতিদিন তাঁর পিছন পিছন বেড়াত, যখন পুরীতে ছুটি কাটাতে যেত। তাঁর পুত্র অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে পরবর্তীকালে বিনুর বন্ধুতা জমে ওঠে।
বিনুর বাংলা ভাষার শিক্ষানবিশি কেবল মুদ্রিত রচনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। কলেজের শেষ তিন বছর সে রাশি রাশি চিঠি লিখেছিল রোজ এক বার কি দু-বার। ছোটো বড়ো প্রায় হাজার খানেক চিঠি একই নারীকে লেখা। সংগীতের যেমন রেওয়াজ, সাহিত্যেরও তেমন অভ্যাস। নিয়মিত ও নিরলস সেই অভ্যাস ছিল বিনুর আত্মবিশ্বাসের মূলে। সে সব চিঠি হারিয়ে গেছে। সে সব ছিল প্রেমপত্রের চেয়ে কিছু বেশি। বিনু তার অধীত বিষয়ের অংশ দিত তার পাঠিকাকে। আর তার অধীত বিষয় ছিল প্রধানত ইউরোপীয় সাহিত্য তথা ইউরোপের ইতিহাস। লাইব্রেরি উজাড় করে সে বই নিয়ে আসত ও পড়ত।
এক এক সময় বিনুর মনে হত জীবনে দুটি মাত্র আনন্দ আছে। পাটনার গঙ্গায় সন্তরণ ও ইউরোপের ইতিহাস অধ্যয়ন। পরীক্ষার পড়ার চেয়ে বেশি ছিল তার ইতিহাসচর্চা। ইউরোপের মানসলোকের প্রবেশপত্র তার ইতিহাস। ইউরোপের সাহিত্য তো তার চিরপরিচিত। শেক্সপিয়ার ও বাইবেল তার ছেলেবেলা থেকেই চেনা। প্রাইজও সে পেয়েছে স্কুল থেকে কত ইংরেজি বই। কিন্তু কলেজে গিয়ে পেয়ে যায় বিশ্বসাহিত্যের সম্ভার—ইবসেন, ব্যোর্নসেন, স্ট্রিণ্ডবার্গ, টলস্টয়, টুর্গেনিভ, ডস্টয়েভস্কি, আনাতোল ফ্রাঁস, রম্যাঁ রল্যাঁ, বারট্রাণ্ড রাসেল, এইচ ডি ওয়েলস, অস্কার ওয়াইল্ড, বার্নার্ড শ প্রমুখের গ্রন্থ।
এসব বই পড়তে পড়তে লেখার আর্ট সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা জাগে। আশ্চর্যের ব্যাপার, কিছুই টলস্টয়ের মনে ধরে না। আর্ট বলতে তিনি যা বোঝেন তা লোকসাহিত্য বলে গণ্য হয়ে থাকে। তাঁর নিজের সমর ও শান্তি আর আনা কারেনিনা তাঁর মতে আর্টের নিকষে উত্তীর্ণ নয়। কেবল তেইশটি উপকথাই উত্তীর্ণ। বিনু তা পুরস্কার স্বরূপ পায় ও তার থেকে একটি বাংলায় অনুবাদ করে; প্রবাসী-তে বেরোয়।
সে একদিন শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আর্ট কি এতই ভালো যে মানবচিত্তের প্রতিদিনের আহার্য হতে পারে না?’ তিনি উত্তর দেন, ‘তা কী করে হবে? উচ্চতর গণিত কি অনায়াসে বোঝা যায়?’ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নিয়ে ভাষণ দিতে যাচ্ছিলেন। বিনুকে বলেন তাঁর ভাষণ বিশদ করবেন। বিনু সে-ভাষণ শোনেনি। পরে জেনেছিল তাতে তিনি তার প্রশ্নের উল্লেখ করেছিলেন।
তাঁর সঙ্গে শুধু টলস্টয়ের নয়, রম্যাঁ রল্যাঁরও মতপার্থক্য ছিল। আর বিনু তখন এই দুই মনীষীর প্রভাবেও পড়েছে। এঁদের দৃষ্টি বিদগ্ধ নাগরিকদের উপরে নয়, অন্তেবাসী জনগণের উপরে। বিনুর সহানুভূতিও তাদের উপরে। চিরকাল তারা ধনসম্পদ থেকে বঞ্চিত। উচ্চবর্ণের বা উচ্চশ্রেণির দ্বারা নিষ্পেষিত। গান্ধীজিও তো তাদের জন্যেই চরকায় সুতো কেটে একাত্মতা প্রকাশ করতে বলেন। নিজে শ্রমিক না হলে শ্রমিকের অন্তর বোঝা যায় না।
কিন্তু তাদের জন্যে তাদের মতো করে লিখলেই কি সেটা আর্ট হিসাবে উত্তীর্ণ হবে? যদি আর্ট হিসাবে উত্তীর্ণ না হয়, তবে তা কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যাবে না? বিনু নিজের মতো করে লিখতে চায়, পরের মতো করে নয়। পরের গ্রহণযোগ্য হলে সে প্রীত হয়, না হলেও সে সৃষ্টির আনন্দে বিভোর।
তা হলেও সে স্বীকার করে যে জনগণের জন্যে তারও কিছু করা উচিত। সে চরকা কাটে না, কিন্তু খাদি পরে। এমন কী বিষয় আছে যা নিয়ে জনগণের জন্যে সাহিত্য সৃষ্টি করা যায়? সমসাময়িক রাজনীতি বাদে! বিনু ভাবে।
ইতিমধ্যে সে নারীর মুক্তি ও নর-নারীর সাম্য নিয়ে লিখতে শুরু করেছিল। তার এক বন্ধু জাতপাতের বিরুদ্ধে লিখতেন। একদিন সে দেখে কলেজ ম্যাগাজিনে ইংরেজিতে এক কবিতা বেরিয়েছে। লিখেছেন তাদের ইংরেজির অধ্যাপক। কবিতার নাম ‘অ্যান অ্যান্টিফেমিনিস্ট ক্রাই’। বিনুর গা জ্বলে যায়। সেও ইংরেজিতে কবিতা লিখে কবির গানের চাপানের উতোর দেয়। তার কবিতার নাম, ‘আ ফেমিনিস্ট কাউন্টার ক্রাই’। কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদক সেটাও প্রকাশ করেন। অধ্যাপক আর উচ্চবাচ্য করেন না।
আর একদিন বিনুর বিরোধ বাঁধে সংস্কৃতের অধ্যাপক মহামহোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নারী কখনো পুরুষের সমান হতে পারে না শুনে সে দাঁড়িয়ে উঠে প্রতিবাদ করে। তিনি তাকে ক্লাসের শেষে বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়ে একান্তে বলেন, ‘তুমি যা-ই বলো-না কেন, প্রকৃতি ওদের নীচু করেছে। যেমন মৈথুনের সময়।’ পিতৃবয়সির মুখে এ যুক্তি শুনে বিনু তো লজ্জায় নিরুত্তর। ধরা পড়ে যাবে, যদি বলে বিপরীত বিহারের সময় নারী উপরে পুরুষ নীচে। সে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরে পড়েছিল।
ভারতী-তে প্রকাশিত ‘বারোয়ারি উপন্যাস’ বেরোলে ওইরকম একটি যৌথ উদ্যোগের পরিকল্পনা করে বিনু ও তার বন্ধুরা। বিনুকে লিখতে হয় মাঝখানের তিনটি পরিচ্ছেদ। কষ্ট হয় জোড় মেলাতে। বাইরে থেকে কয়েক জনের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। তাদের তিন জন মহিলা। উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে মাসিকপত্রে প্রকাশিত হয়। নিন্দা প্রশংসা দুই-ই জোটে।
সমাজ সম্বন্ধে বিনু এত কম জানত যে তার পক্ষে সামাজিক উপন্যাসে হাত দেওয়া ধৃষ্টতা। নিজেকে জেনে কবিতা লেখা যায়, কিন্তু উপন্যাস লিখতে হলে সমাজকে জানতে হয়; বিশেষত পরের জীবনকে। দশখানা উপন্যাস পড়ে একখানা উপন্যাস লিখতে সকলেই পারে, কিন্তু নিজস্ব জ্ঞান ও নিজস্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে তেমন উপন্যাস যেন কাগজের ফুল। বিনু কাগজ দিয়ে কাগজের ফুল বানাতে চায় না, সে ফোটাতে চায় জীবনের ফুল। তারজন্যে অপেক্ষা করতে হবে। আর ওরকম যৌথ উদ্যোগ সাহিত্যে সাজে না। তবে দুজনে মিলে উপন্যাস লেখার নজির আছে। তার জন্যে হতে হয় অভিন্ন হৃদয়—সেটা দুরাশা।
আর্ট জিজ্ঞাসার মতো জীবনজিজ্ঞাসাও বিনুর চিন্তাজুড়ে ছিল। এ জীবন নিয়ে সে কী করবে? এ জীবন যিনি দিয়েছেন তিনি তাকে কী করতে বলেন? কী হতে? এদেশের রঙ্গমঞ্চে এ যুগের নাটকে তার কী ভূমিকা? একজন শিল্পী না একজন কর্মী না একজন ভাবুক না একজন প্রেমিক? না চারটি ভূমিকায় একই অভিনেতা যখন যেমন তখন তেমন?
তাকে সংকটে ফেলেছিল তার আদর্শের সঙ্গে তার ভাবী জীবিকার অসঙ্গতি। টলস্টয় ও গান্ধীর মতো সেও মনে করত রাষ্ট্র হচ্ছে একটা শাসনযন্ত্র। শাসন বলতে বোঝায় মানুষের উপর মানুষের আধিপত্য। এর জন্য চাই সৈন্যদল, পুলিশ, আদালত, কারাগার। ইদানীং যোগ দিয়েছে আইনসভা। আইন দিয়ে মানুষ মানুষকে চালনা করেন। আদর্শ সমাজে এসব বালাই থাকবে না। মানুষ শাসনমুক্ত হবে, সেইসঙ্গে শোষণমুক্ত। শাসকরা শোষকদেরই অন্তরঙ্গ।
পার্লামেন্ট সম্বন্ধে বিনুর নেতিবাচক মনোভাব ছিল না। তা ছাড়া বাকি সব বিষয়ে সে নেতিবাদী। বলা যেতে পারে নৈরাজ্যবাদী। অবশ্য অহিংস নৈরাজ্যবাদী। এমন মানুষের পক্ষে রাষ্ট্রে শাসনচক্রের একজন চক্রধর হতে চাওয়া কি পরধর্ম নয়? পরধর্ম ভয়াবহ। গ্র্যাজুয়েট হয়ে সাংবাদিক হলেই সে ভালো করত।
কিন্তু চার ইয়ারী কথা-র ইংল্যাণ্ড তাকে টানছে। ফরাসি বিপ্লবের ফ্রান্স তাকে টানছে। আধুনিক জগতের মুখ্য স্রোত এই দুই দেশেই। বিংশ শতকের সন্তান সে, তাকে অবগাহন করতে হবে তার স্বযুগের মুখ্য স্রোতে। তা বলে স্বদেশকে সে ভুলবে না। ভারতে ফিরে আসবে দু-বছর বাদে। চাকরি ছাড়বে আরও পাঁচ বছর বাদে। সম্পাদক হতেই তার সাধ। তবে সাধনা তার সাহিত্যিক হওয়ার। তাকে অন্তত পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যেই সাধনা সাঙ্গ করতে হবে। যে বয়সে মা গত হন।
পূর্ব দিক আর পশ্চিম দিক বলে দুটো দিক আছে, বিনু তা জানে ও মানে। ভৌগোলিক অর্থে পূর্ব ও পশ্চিমের মিলন কোনো কালেই হবে না। কিন্তু ধর্মের ক্ষেত্রে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কি সে কথা খাটে? অবশ্য সংগীতের ক্ষেত্রে, নৃত্যের ক্ষেত্রে অন্য কথা। কিপলিং যে বলেছেন, প্রাচী হচ্ছে প্রাচী আর প্রতীচী হচ্ছে প্রতীচী; তাদের মিলন কোনোকালে হবে না—এতে বিনুর আন্তরিক আপত্তি। সবুজপত্র থেকে সে যেসব আইডিয়া পেয়েছিল তার একটি হল প্রাচী প্রতীচ্য সমন্বয়। এর জন্যে তাকে প্রতীচ্য সম্বন্ধে সমান অভিজ্ঞ হতে হবে; তারজন্যে প্রতীচ্য দেশে বাস করতে হবে; সেখানকার জীবনের সঙ্গে জীবন যোগ করতে হবে। শুধু বই পড়া ও লেকচার শোনাই যথেষ্ট নয়, বিনুকে সশরীরে ইউরোপ যেতে হবে; ভারতের সঙ্গে কোথায় মিল আর কোথায় অমিল তা নিজের চোখে দেখতে হবে ও নিজের মন দিয়ে বিচার করতে হবে।
প্রাচীর মানুষ প্রাচীন আর প্রতীচীর মানুষ আধুনিক। এটা কিন্তু এক হিসাবে ঠিক। প্রাচীনত্বের জন্যে ভারতীয়রা গর্বিত। আধুনিকতার জন্যে ইউরোপীয়রা। কিন্তু প্রাচীও আধুনিক হতে পারে, আধুনিকতার জন্যে গর্বিত হতে পারে। তার দৃষ্টান্ত জাপান। ভারতই-বা সেই অর্থে আধুনিক হতে পারবে না কেন? কিন্তু সত্যিকার আধুনিকতা কেবলমাত্র ফলিত বিজ্ঞানের যান্ত্রিক কুশলতায় নয়, মননশীলতায় ও সামাজিক পুনর্বিন্যাসে। জাপান কি সেই অর্থে অধুনাতন না পুরাতন?
ভারতীয়রাও বাইরে অধুনাতন ও ভিতরে পুরাতন হতে পারে। তার লক্ষণ বিনু স্বদেশের নাগরিক জীবনে লক্ষ করছে। গ্রামগুলি কি শহরগুলোর মতো হবে? গান্ধীজি সেটা চান না। কিন্তু তারা যদি কোনো অর্থেই আধুনিক না হয় তবে তো মধ্যযুগেই থেকে যাবে। শহর আর গ্রামের মধ্যে কি দুই-তিন শতাব্দীর ব্যবধান থাকবে? তবে কি শহরগুলোও মধ্যযুগে ফিরে যাবে? ‘গ্রামে ফিরে যাও’ মানে কি মধ্যযুগে ফিরে যাওয়া? বিনু গ্রামে যেতে রাজি আছে প্রকৃতির আরও কাছাকাছি থাকতে, জনগণের সঙ্গে একাত্ম হতে। রুশোর শিক্ষাও তার মনের উপর কাজ করছিল। সভ্যমানুষ প্রকৃতির কাছ থেকে সরে আসতে আসতে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠছে। টলস্টয়, থোরো, গান্ধী এর জন্যে সভ্যতাকেই দোষ দিচ্ছেন। বিনু এর একটা মীমাংসা চায়। এর জন্যেও তার ইউরোপে যাওয়া দরকার।
প্রতীচীর যৌবনের উপর তার অপরিসীম বিশ্বাস। কচ গিয়েছিলেন অসুরগুরুর কাছে মৃতসঞ্জীবনীর মন্ত্র শিখতে। বিনুর মনে হয় সেও যাচ্ছে আধুনিক প্রতীচীর কাছে অনুরূপ জরা সংযুবনী মন্ত্র শিখতে। যা শিখে আসবে তা শেখাবে। ভারতও হবে নবযৌবনের দেশ। অপরপক্ষে ভারতও প্রতীচীকে শেখাবে গান্ধীজির কাছে সত্য ও অহিংসার সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ।
বিনু ও তার বন্ধুরা মিলে যে বারোয়ারি উপন্যাসে হাত লাগায়, গোষ্ঠীর বাইরে থেকে তিন জন লেখিকাও তাতে হাত মেলান। তাঁদের একজন বিবাহে অসুখী মুক্তিপ্রাণা। বিনুর ভিতরে একজন মধ্যযুগীয় নাইট ছিল। লেডি ইন ডিসট্রেস দেখে তার শিভালরি জাগ্রত হয়। সে তাঁকে মুক্ত করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই সূত্রে সঞ্চারিত হয় প্রেম। প্রণয় থেকে পরিণয়ের অভিলাষ অঙ্কুরিত হয়। ইতিমধ্যেই সাংবাদিকতায় বিনুর অনীহা জন্মেছিল। সে হতে চায় কবি, মনীষী, অন্তর্দর্শী। জীবিকা হিসাবে সে বেছে নেয় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস। প্রতিযোগিতায় সফল হলে আকৈশোর প্রতীক্ষিত সমুদ্রযাত্রা। যাবে আমেরিকার পরিবর্তে ইউরোপে। বিলেতে দু-বছর শিক্ষানবিশি। তাঁকেও সে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। যেটা সম্ভব নয় সেটা বিদেশে সম্ভব। অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদপূর্বক পুনর্বিবাহ। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যে মা হয়েছিলেন। স্বামীর সঙ্গেও সন্ধি হয়েছিল। তিনি মুক্তির প্রশ্ন শিকেয় তুলে রাখেন। বিনু তার প্রতিশ্রুতি থেকে মুক্তি পায়। জীবিকার প্রতিযোগিতায় প্রাণপাত পরিশ্রম করে প্রথম হলেও প্রেমের পরীক্ষায় সে বিফল হয়। এইটুকু তার সান্ত্বনা যে, সে ইউরোপ দর্শনে যেতে পারছে। সেখানেই তার ‘tryst with Destiny’.
প্রেমের উপলব্ধি না হলে প্রেমের কবিতা লেখা যায় না—কিংবা প্রেমের গল্প উপন্যাস। বিশ্বসাহিত্যে প্রেমের কবিতা, প্রেমের কাহিনি আদিকাল থেকেই সর্বমানবের মহামূল্য উত্তরাধিকার। বিনুরও অভিলাষ ভাবীকালের জন্য সেরূপ উত্তরাধিকার রেখে যাওয়া।
তার সে-অভিলাষ কতক পরিমাণে পূর্ণ হয় যখন প্রেম এসে আর্টের সঙ্গে যোগ দেয়। তার জীবনে প্রেম আর আর্ট একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। প্রেম যদি মিলনান্ত নাও হয়, তা হলেও সে আর্টের প্রাণস্বরূপ। বিশ্বসাহিত্যে বিয়োগান্ত প্রেমই তো সংখ্যায় বেশি। কমেডির চেয়ে ট্র্যাজেডিরই আধিক্য। বিদগ্ধ পাঠকের কাছে ট্র্যাজেডিই প্রিয়তর।
বিনুর মনে হয় তার সমবয়সি বন্ধুদের চেয়ে তার বয়স তিন বছর বেড়ে গেছে—বাড়িয়ে দিয়েছে তার প্রেমের অভিজ্ঞতা। তার দেহের তুলনায় হৃদয় হয়েছে আরও পরিণত। তাকে পরিণত করেছে প্রেমের তিক্ত মধুর রস। আনন্দের সঙ্গে বেদনার মিশ্রণ। প্রেম তাকে হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে, নাচিয়েছে, জ্বালিয়েছে, খাটিয়েছে, মাতিয়েছে, খেলিয়েছে, ভাবিয়েছে, লড়িয়েছে। সব কিছু তোলা রয়েছে পরে একসময় সাহিত্যে রূপায়িত হবার জন্যে। শিল্পীর জীবনে কোনো অভিজ্ঞতাই বৃথা নয়। প্রেমের অভিজ্ঞতা তো নয়ই। কারো কারো জীবনে তারই মূল্য সবচেয়ে বেশি। সেদিক থেকে বিচার করলে বিনু একজন ভাগ্যবান শিল্পী।
শেলি, কিটস প্রমুখ রোম্যান্টিক কবিদের সঙ্গেই ছিল তার অ্যাফিনিটি। একইসঙ্গে ছিল বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস প্রমুখ বৈষ্ণব কবিদের সঙ্গেও। কবি হতেই সে চেয়েছিল, ঔপন্যাসিক হতে নয়। কিন্তু ঘটনাচক্রে তাকে ঔপন্যাসিক হতে হয়।
বিনুর নিয়তি
বারো বছর বয়সে সবুজপত্র পড়ার পর থেকে বিনুর মনে গেঁথে যায় চার-পাঁচটি আইডিয়া। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলির বিকাশ হয়। একটি আইডিয়া হল প্রাচ্য-প্রতীচ্য সমন্বয়। প্রতীচ্যে না গেলে, নিজের চোখে না দেখলে, লোকের সঙ্গে না মিশলে কেমন করে তার সঙ্গে সমন্বয় ঘটানো যায়? ইটারনাল ফেমিনিন আর একটি আইডিয়া। তার অর্থ বুঝুক আর না-বুঝুক সে তার সন্ধানে বেরোত চায় রূপকথার রাজপুত্রের মতো সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে। আর একটি আইডিয়া হল আর্ট। কথাটার মানে কী তা জানার জন্যে সে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করে টলস্টয়ের ‘আর্ট কী’ পড়ার পর রবীন্দ্রনাথের সন্নিধানে যায়। আরও এক আইডিয়া অফুরন্ত যৌবন। কায়িক অর্থে নয়, মানসিক অর্থে। এর অর্থ অনুধাবন করতেও আরও কয়েক বছর লাগে। যে আইডিয়াটা সবচেয়ে আগে কাজে পরিণত করা সম্ভব হল সেটা চলতি বাংলায় টলস্টয়ের একটি উপকথা অনুবাদপূর্বক প্রকাশ করায়।
সে সতেরো বছর বয়সে বাড়ি থেকে রওয়ানা হয়েছিল আমেরিকার অভিমুখে সমুদ্রপথে। পাগলামি! কলকাতা থেকে ফিরে এসে কলেজে ভরতি হয়। কথা ছিল গ্র্যাজুয়েট হয়েই কলকাতা ফিরে গিয়ে সাংবাদিকতায় ব্রতী হবে ও পরে একসময় আমেরিকায় যাবে। কিন্তু গ্র্যাজুয়েট হয়ে সে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস প্রতিযোগিতায় সফল হল। এখন তাকে যেতে হবে শিক্ষানবিশির জন্যে বিলেতে, সেখানে থাকতে হবে দু-বছর। এও তো সেই সমুদ্রযাত্রা। যদিও আমেরিকা অভিমুখে নয়, ইউরোপ অভিমুখে। হ্যাঁ, এটাও তার মনের আড়ালে কাজ করছিল বারো বছর বয়সে চার ইয়ারী কথা পড়ার পর থেকে। ইউরোপে না গেলে সে কোথায় দেখা পাবে venus de milo-র। আমেরিকার লিবার্টি মূর্তি তার সমতুল্য নয়। কলেজে গিয়ে বিনু ইউরোপীয় সাহিত্য ও ইতিহাসে বুঁদ হয়ে পড়ে। সেই সূত্রে ইউরোপ তাকে চুম্বকের মতো টানে। ইউরোপে যাবার সুযোগটা এনে দেয় প্রতিযোগিতা। সফল না হলে সে সাংবাদিক ব্রতেই ফিরে যেত। তার কাছে সাংবাদিকতা একটা বৃত্তি নয়, একটা ব্রত। ‘ইটারনাল ভিজিলান্স ইজ দ্য প্রাইস অব লিবার্টি।’ স্বাধীনতার মূল্য অতন্দ্র প্রহরা। সৈনিকদের মতো সংবাদপত্রকাররাও দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করে বলে বিনু সেই ব্রত বেছে নিয়েছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে সে উপলব্ধি করেছিল যে তার লেখনী সাংবাদিকের নয়, সাহিত্যিকের লেখনী। সে রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরির পন্থী, তাই সাংবাদিকতার মায়া কাটাতে কষ্ট হয় না। একটি বিশিষ্ট মাসিকপত্রের ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি লেখার জন্যে সে প্রতিশ্রুতি দেয়। জাহাজে ওঠার আগেই লিখতে শুরু করে। বিলেত থেকে প্রতি মাসেই এক-একটি কিস্তি পাঠায়।
দেশ থেকে বিদায়ের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল প্রিয় নারীর সঙ্গে বিচ্ছেদের বিষাদ। আর সেই বিষাদের সঙ্গে মিশেছিল মুক্তির স্বাদ। সে ফিরে পেয়েছে তার প্রেমে পড়ার স্বাধীনতা। হয়তো আবার প্রেমে পড়বে—কে জানে কোনো এক দেবযানীর সঙ্গে সেকালের সেই কচের মতো। বিনু তার হৃদয়ের দুয়ার খোলা রেখেছিল। তার মনের দুয়ার তো খোলা ছিলই নতুন দেশের জন্যে, নতুন মানুষের জন্যে, নতুন অভিজ্ঞতার জন্যে। তবে ইউরোপ তার কাছে পুরোপুরি নতুন নয়। অসংখ্য বই পড়ে, পত্রিকা পড়ে সে ইউরোপের মানসের সঙ্গে ও মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। যতসব উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা তার চেনা। দেশে থাকতেই সে ইংরেজ অধ্যাপকদের সংস্পর্শে এসেছিল। ইংরেজ লাটসাহেবের হাত থেকে সোনার মেডাল পেয়েছিল।
বিনুকে যিনি পৃথিবীতে আসতে সাহায্য করেছিলেন তিনি একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান লেডি ডাক্তার। বিলেত যাবার আগে সে যায় তাঁর আশীর্বাদ নিতে। তিনি বলেন, ‘তুই ওদেশের মেয়েদের পাল্লায় পড়বি না তো? জানিস ওদেশের মেয়েরা কেন এত ফর্সা হয়? ফল—খুব ফল খায় ওরা। আপেল—আপেল খেয়েই ওরা হয় এত ফর্সা। তুইও যত পারিস আপেল খাস।’ বিনু হাসিমুখে বিদায় নেয়। তার মনে পড়ে অ্যাডামকে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন ইভ।
তার জন্মকাল থেকেই বিধাতার নির্বন্ধ সে একদিন পশ্চিমযাত্রা করবে। সেটা সতেরো বছর বয়সে সম্ভব না হয়ে তেইশ বছর বয়সে হল। জাহাজের ডেকে পা রেখে বিনু ভুলতে আরম্ভ করল ভারতকে, ভাবতে আরম্ভ করল ইউরোপকে। যতদিন ইউরোপে থাকবে ততদিন পুরোপুরি ইউরোপের ভাবনাই ভাববে। দুনিয়াকে দেখবে ইউরোপীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, অথচ লিখবে বাংলা ভাষায় বাঙালি পাঠক-পাঠিকাদের জন্যে। এমনি করে দু-বছর কাটাবে।
তার জীবনে কত দু-বছর এসেছে-গেছে, কিন্তু সেই দু-বছরের মতো আর কোনো দু-বছর নয়। দেশে ফিরে আসার পরও সেই দু-বছর তাকে আবিষ্ট করে রাখে আরও বারো বছর। সেই দু-বছরের পটভূমিকায় পাঁচ খন্ডে উপন্যাস লিখতে বসে ছয় খন্ডের উপন্যাস লেখে। একে নিয়তি না বলে আর কী বলা যেতে পারে?
সাত সাগর পারে নয়, তিন সাগর—আরব সাগর, লোহিত সাগর, ভূমধ্য সাগর—পারে বিনুর জাহাজ ছোঁয় ফ্রান্সের বন্দর মার্সেলস। সেই জাহাজেই বিনু লণ্ডন অবধি যেতে পারত, কিন্তু তার সতীর্থদের সঙ্গে সেও নেমে পড়ে। এই সেই মার্সেলস যেখানে রচিত হয়েছিল বিপ্লবগীতি ‘লা মার্সেইলেস’। বিপ্লবের প্রাক্কালে, বিপ্লবের প্রেরণা দিতে। এখনও ফরাসিদের জাতীয় সংগীত। বিনু ফ্রান্সের মাটিতে পা রেখে শিহরন বোধ করে।
প্যারিসে ট্রেন বদল। ফরাসি বিপ্লবের স্মৃতি। রোমাঞ্চ। ক্যালে থেকে জলপথে ডোভার। ইংল্যাণ্ডের মাটি। বিনুর কতকালের স্বপ্ন সার্থক। এরপরে রেলপথে লণ্ডন। বিনু আনন্দে অধীর। ইতিমধ্যেই সে স্থির করেছিল অক্সফোর্ডের একটি প্রসিদ্ধ কলেজে সিট পেলেও লণ্ডনেই থাকবে। সে তো ডিগ্রি চায় না। শিক্ষানবিশি লণ্ডনেও করা চলে। লণ্ডন শুধু সাম্রাজ্যের রাজধানী নয়, বিশ্বনাগরিকধানী। সে সব কিছু দেখতে, সব কিছু শুনতে, সব কিছু জানতে চায়। থিয়েটার, অপেরা, ব্যালে, কনসার্ট, মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি, স্টুডিয়ো, সভাসমিতি, হাইড পার্ক, পার্লামেন্ট, সেন্ট পলস। জীবনে এমন সুযোগ আর মিলবে না। দু-বছর লণ্ডনবাস। কিন্তু তার হিতৈষীদের চক্ষে সে একটা বোকা ছেলে। ভারতের হাই কমিশনার স্যার অতুল চ্যাটার্জি একদিন তাকে বকুনি দেন। ‘অক্সফোর্ড ছেড়ে লণ্ডন? এক্ষুনি যাও।’
বিনু ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পাঠাগারে পড়ার জন্যে কার্ড জোগাড় করে। সময় পেলেই সেখানে গিয়ে বিচিত্র বা নিষিদ্ধ পুস্তক পড়ে। একটি গুপ্তকক্ষে প্রহরীসমেত যাতায়াত করতে হয়। শিক্ষানবিশির অঙ্গ নয় এটা। শিক্ষানবিশ হিসাবে তাকে যেতে হত চারটি কলেজ ও কলেজসদৃশ স্কুলে। ইউনিভার্সিটি কলেজ, কিংস কলেজ, লণ্ডন স্কুল অব ইকনমিকস, লণ্ডন স্কুল ফর ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ। তা ছাড়া তাকে উচ্চ ও নিম্ন আদালতে গিয়ে মামলার বিচার শুনতে ও টুকে রাখতে হয়। মাঝে মাঝে উলউইচে গিয়ে ঘোড়ায় চড়তে হয়। কিন্তু এহো বাহ্য। তার আসল কাজ হল তার সহকর্মী ইংরেজ সিভিলিয়ানদের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নেওয়া। সার্ভিসটার ব্রিটিশ চরিত্র যেন বজায় থাকে। ওটা নামেই ইন্ডিয়ান।
কিন্তু বিনুর কাছে জীবিকার চেয়ে জীবন বড়ো। তাই সে যত কম সময় সম্ভব তত কম সময় শিক্ষানবিশিকে দিয়ে বাকিটা দেয় জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে। ডিকেন্স প্রতিদিন লণ্ডনের পথেঘাটে ঘুরে বেড়াতেন। বিনু প্রত্যহ না হলেও প্রায়ই পথে পথে ঘোরে। তবে বাসায় ফিরতে রাত করে না। সে চেয়েছিল কোনো এক ইংরেজ পরিবারে পেয়িং গেস্ট হতে। কিন্তু তার এক বন্ধুর অনুরোধে তার দিদি ও জামাইবাবুর সঙ্গে মিলে ফ্ল্যাট ভাড়া করতে হয়। ফলে সে বাঙালিই থেকে যায়, ইংরেজ বনে না। এতে সাহিত্যের সুরাহা হয়। ওঁদের অগণ্য বাঙালি বন্ধু-বান্ধবী বাঙালি সমাজে। বিনু তাঁদের সঙ্গ পায়। তার উপন্যাসের বহু চরিত্রের মডেল আপনি জোটে। না, উপন্যাস সে লণ্ডনে বসে লিখবে না, দেশে ফিরে এসে লিখবে। ইংল্যাণ্ডে লেখা হয় ভ্রমণকাহিনি ছাড়া কবিতা ও প্রবন্ধ, গল্প ও নাটিকা। পরে সে ইংরেজ পরিবারেও পেয়িং গেস্ট হয়েছিল। কিন্তু সেখানে সে তেমন বন্ধু সমাগম দেখেনি।
কলেজের অবকাশে বিনু বেরিয়ে পড়ত লণ্ডনের বাইরে সাগরতীরে বা ভিন দেশে। প্রথম অবকাশেই সে চলে যায় সুইটজারল্যাণ্ডে রম্যাঁ রল্যাঁর সন্নিধানে। তার এক অগ্রজপ্রতিম সাহিত্যিক বন্ধু সে সময় সুইটজারল্যাণ্ড প্রবাসী ছিলেন। তিনিই হন দোভাষী। বিনুর সেই একই জিজ্ঞাসা, যা নিয়ে সে রবীন্দ্রসন্দর্শনে গিয়েছিল কলেজজীবনে। ‘আর্ট কি এতই ভালো যে মানবপ্রকৃতির প্রতিদিনের আহার্য হতে পারে না?’
‘কেন হতে পারবে না?’ রল্যাঁ উত্তেজিত হয়ে উত্তর দেন, ‘রেনেসাঁসের যুগে ইটালির কারিগররা সাধারণ মানুষের নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী সুন্দর করে বানাত। সকলে তা উপভোগ করত।’
রবীন্দ্রনাথের উত্তর ছিল এর বিপরীত। রল্যাঁ পিপলস থিয়েটার বলে একখানি বই লিখেছিলেন। বিনু জানত জনগণের প্রতিই তাঁর টান। কিন্তু উচ্চতর গণিত কী করে তারা বুঝবে, যদি তার উপযোগী প্রস্তুতি না থাকে? বিনু রল্যাঁর সঙ্গে তর্ক করে না। তিনি তাঁর স্বমতে অটল। আর বিনুও জনগণের কাছে পৌঁছোতে উৎসুক।
বিনুর অপর এক প্রশ্নের উত্তরে রল্যাঁ বলেন, ‘হ্যাঁ, সাহিত্যিক সমসাময়িক প্রশ্ন নিয়ে লিখবেন বই কী। শেক্সপিয়ারও লিখেছেন।’
বিনু শেক্সপিয়ার যেটুকু পড়েছিল সেটুকুতে তা লক্ষ করেনি। হয়তো নাট্যকার তির্যকভাবে তাঁর মত প্রকাশ করেছিলেন।
আরও কয়েকটি বিষয়ে কথাবার্তা হয়। বিদায় দেবার সময় রল্যাঁ বলেন, ‘আপনি টাকার জন্যে আর কিছু করবেন, নিজের খুশির জন্যে লিখবেন।’
আর্ট নিয়ে বিনুর ভাবনাচিন্তা সেইখানেই শেষ হয়ে গেল না। কাদের জন্যে লিখবে তার চেয়ে বড়ো কথা কী লিখবে, বিষয়বস্তুটা কী? যেখানে বলবার বিষয় নেই সেখানে বাগবিস্তার কি সাহিত্য? তারপরে আরও এক জিজ্ঞাসা—কেমন করে লিখবে? যেমন-তেমন করে লিখতে অনেকেই পারে, তারা সবাই কি সাহিত্যশিল্পী? না, জনগণের জন্যে লিখলেও শিল্পী হওয়া যায় না, যদি কেমন করে লিখতে হয় তা না জানে। বিনু পরীক্ষানিরীক্ষা চালায়। লেখাও একপ্রকার রান্না। রান্নাও একপ্রকার কলা। থিয়োরি জানাই যথেষ্ট নয়, প্র্যাকটিস চাই। আর্ট হওয়া না হওয়া নির্ভর করে প্র্যাকটিসের উপর।
ফেরার পথে প্যারিসে বিনু লুভর মিউজিয়াম দেখতে যায়। সেখানে দর্শন পায় Venus de Milo-র। এই সেই ইটারনাল ফেমিনিন। গ্রিক ভাস্কর্যের অপরূপ নিদর্শন। এমনই কিছু নিদর্শন দেখেই রেনেসাঁসের ভাস্কররা উদ্দীপিত হন। তাঁরা সাধারণ কারিগর ছিলেন না। তাঁদের সৃষ্টিও নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী নয়। রল্যাঁ কী বলবেন একে? অপর একটি কক্ষে মোনালিসা। লেওনার্দো দা ভিঞ্চির রহস্যময়ী নারীর প্রতিকৃতি। বিনু রহস্যভেদ করতে পারে না, জনগণ কী করে পারবে!
অগস্ত্য ঋষি এক গন্ডূষে সমুদ্র পান করেছিলেন। বিনুরও অভিলাষ দু-বছরে ইউরোপ গ্রাস। পরে একটি অবকাশে সে বেরিয়ে পড়ে তার সেই অগ্রজপ্রতিম বন্ধুর সঙ্গে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ইত্যাদি বেড়াতে। থিয়েটার, অপেরা, জাদুঘর, ক্যাথিড্রাল কত কী দেখা হয়। মানুষও চেনা হয় পথে, হোটেলে, হসপিসে, পাঁসিঅতে। খাদ্য-অখাদ্য কত কী খাওয়া হয়। মিউনিকের বিয়ার-হলে বিয়ারপান। হিটলারের প্রিয় স্থান। তখন কিন্তু নাতসি নায়কের নাম কেউ বলেননি।
বিনু যে দু-বছর ইউরোপে ছিল সে-সময়টা ছিল দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সন্ধিকাল, ১৯২৭ থেকে ১৯২৯। চার বছর ধরে মানুষ একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে বাস করেছিল। তার কুপ্রভাব থেকে জেগে উঠছে। ভাবতেই চায় না যে আবার এক দুঃস্বপ্ন অবশ্যম্ভাবী, দশ বছর পরে নেমে আসবার অপেক্ষায় আছে। মুসোলিনি ইতিমধ্যেই ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটরশিপ জারি করে দেখিয়েছেন গণতন্ত্র কত ঠুনকো। ওদিকে রাশিয়াতে বিপ্লবী জমানা। জার্মানির কমিউনিস্টরা চান তার সম্প্রসারণ। সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট সরকার আন্তর্জাতিক ঋণ শোধ করতে গিয়ে মুদ্রাস্ফীতিতে হিমশিম খাচ্ছেন। লোকের ধারণা ওই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে ইহুদি ব্যবসায়ীরা। সন্দেহ তামাম ইহুদি জাতিটাকে। তারাও জাতি হিসাবে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর, আর্য জাতীয়তায় বিশ্বাসী জার্মানদের সঙ্গে বেজোড়—তেল আর জল।
লণ্ডনে কয়েক জন শান্তিবাদীর সঙ্গে বিনুর পরিচয় হয়। এঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম ফ্রেণ্ডস অব দা লিগ অব নেশনস। এঁদের বিশ্বাস লিগ যদি শক্তিশালী হয় তবে যুদ্ধ বাঁধবে না, বাঁধলে থামাতে পারা যাবে। কিন্তু লিগের সদস্য-নেশনদের মধ্যে না আছে আমেরিকা, না রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়ন, না জার্মানি। অথচ ভারত রয়েছে। ভারতের প্রতিনিধি জাস্টিস স্যার বসন্তকুমার মল্লিক ছিলেন জাহাজে বিনুর সহযাত্রী। তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় সিভিল সার্ভিসের সুবাদে। সার্ভিসের ভিতরে থেকে দেশের কাজ করা সম্বন্ধে।
লিগের বন্ধুজনদের মধ্যে ছিলেন একজন ইংরেজ মহিলা। অসমবয়সিনি কুমারী, চিত্রকর, ভারত হিতৈষিণী। তাঁর সঙ্গে বিনুর সম্পর্ক একটু একটু করে পরিণত হয় বন্ধুতায়। তাঁর সৌজন্যে ব্রিটেনের উচ্চবংশীয় সমাজসেবীদের সঙ্গে বিনুর মেলামেশা সম্ভব হয়। তাঁদের অনেকেই মানবদরদি। অনেকেই ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে। তবে তাঁদের একজনের প্রশ্ন হল ভারত স্বাধীন হলে দেশীয় রাজাদের ভাগ্যে কী আছে। দেশীয় রাজ্যে বিনুর জন্ম, রাজবংশের সঙ্গে সদ্ভাব, তবু সে একটা কঠোর উক্তি করে। রাজাদের জোর করে ফেডারেশনভুক্ত করতে হবে। তিনি মিষ্টি করে বলেন, ‘না না, ওঁদের বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করাতে হবে।’
বান্ধবীর বান্ধবী মুরিয়েল লেস্টার তাঁর যুদ্ধে নিহত ভ্রাতা কিংসলির নামে লণ্ডনের ইস্ট এণ্ডে একটি ‘সেটলমেন্ট’ স্থাপন করে তার নাম রেখেছেন ‘কিংসলি হল’। গরিব এলাকায় শ্রমিকশ্রেণির জীবনের শরিক হবার জন্যে উচ্চশ্রেণির পুরুষ বা মহিলারা এরকম আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে সেখানে বসবাস করেন। তাঁদের জীবনযাত্রা একান্ত সাদাসিধে। সংসারের বন্ধন নেই। একদা শ্রমিকদলের নেতা অ্যাটলি থাকতেন এইরকম একটি সেটলমেন্টে। মুরিয়েল কিন্তু পলিটিকসের ধার ধারেন না। অথচ ধর্মেরও বাধ্যতা নেই। একনিষ্ঠ মানবহিতৈষী সেবাকর্মী। বিনুর বান্ধবী একদিন তাকে মুরিয়েলের আশ্রমে নিয়ে যান। সেটা এক হিসাবে শ্রমিকশ্রেণির ছেলে-মেয়েদের ক্লাব। অবসর পেলেই তারা সেখানে এসে খেলাধুলা করে। গানবাজনাও হয়। নির্দোষ আমোদপ্রমোদে মুরিয়েল তাদের সাথি। বাসযোগ্য কয়েকটি সেল ছিল। বিনু তার একটিতে শুয়ে রাত কাটায়। দু-বছর বাদে মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর দলবল সেইখানেই মুরিয়েলের অতিথি হন। রাউণ্ড টেবিল কনফারেন্সের সময় ব্রিটিশ সরকারের অতিথি হননি। পার্টিশনের পূর্বে মুরিয়েল এসেছিলেন ভারতে। বলেছিলেন, ‘এই ভ্রাতৃহত্যা বন্ধ করো। হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই।’
অ্যাটলি ছিলেন ফেবিয়ান সোশ্যালিস্ট। তাঁরই মতো সোশ্যালিস্ট সিডনি ওয়েব শ্রমিকদের প্রগতির কথা চিন্তা করে লণ্ডন স্কুল অব ইকনমিকস প্রতিষ্ঠা করেন। কালক্রমে সেটি মধ্যবিত্তদেরও সুশিক্ষার অন্যতম পীঠস্থান হয়। বিনু সেখানে লেকচার শুনতে যায়। তখনও অন্যান্য কলেজে তরুণ-তরুণীদের সহশিক্ষা প্রবর্তিত হয়নি, এখানে হয়েছে। বিনুর সঙ্গে যাঁরা ক্লাস করেন তাঁরা তার সমবয়সিনি। কলেজ থেকে বেরিয়ে চাকরির সন্ধান করবেন। আগে চাকরি, তারপরে বিবাহ—যদি বর জোটে। বিনু ‘নিউ উওম্যান’ দেখতে চেয়েছিল। নিউ উওম্যানকে দেখল। যে নারী পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পড়াশোনা করে তাকে হারিয়েও দিতে পারে। লণ্ডন স্কুল অব ইকনমিকসে একজন অধ্যাপিকা ছিলেন। তিনিও বিনুকে পড়াতেন। নারীস্বাধীনতা ও নারী-পুরুষের সাম্য—দুটোই ছিল ফেমিনিস্টদের অন্বিষ্ট। দুটোরই দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করে বিনু অতিশয় প্রীত।
একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে পেয়িং গেস্ট হয়ে সে মায়ের আদরযত্ন পায়। মা সব দেশেই মা। ইতিমধ্যে এক তটবর্তী শহরে বেড়াতে গিয়ে সে তার বোর্ডিং হাউসের কর্ত্রীর সঙ্গে মাতৃ সম্পর্ক পাতিয়ে এসেছে। তিনি হয়েছেন তার দ্বিতীয় মাতা। অথচ তিনি বিয়েই করেননি। এখন যাঁর বাড়িতে পেয়িং গেস্ট তার ভাগনি একদিন বেড়াতে আসে। দুজনের দুজনকে এত ভালো লেগে যায় যে সেইদিনই ওরা ভাই-বোন পাতিয়ে বসে। পরে আর দেখা হয় না কিন্তু চিঠিপত্রে ভাই-বোন মত বিনিময় করতে থাকে। বিদুষী কন্যা। শিক্ষিকা হয়। পরে বিয়েও করে। কিন্তু চাকরি ছাড়ে না।
দেশ এক নয়, ভাষা এক নয়, ধর্ম এক নয়, বর্ণ এক নয়, তা সত্ত্বেও মানুষে মানুষে এত বেশি মিল যে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য বলে দুটো আলাদা সত্তা শনাক্ত করা যায় না। একথাও বলতে পারা যায় না যে প্রাচ্য চিরদিন প্রাচ্য আর প্রতীচ্য চিরদিন প্রতীচ্য, মিলন তাদের কোনোদিন হবে না। কিপলিং-এর উক্তি যেমন অসার তেমনি অসার ভারতীয় মনীষীদের ধারণা যে প্রাচী হচ্ছে অধ্যাত্মবাদী আর প্রতীচী জড়বাদী। কোলোনের ক্যাথিড্রাল আর প্যারিসের নোতারদাম পরিদর্শন করে বিনু উপলব্ধি করে ইউরোপের মানুষও এশিয়ার মানুষের মতোই ধর্মপ্রাণ। মন্দির, মসজিদ, গির্জা তার সাক্ষ্য।
আসলে যেটা ঘটেছে সেটা ইউরোপের রেনেসাঁস, রিফর্মেশন, এনলাইটেনমেন্ট, ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক বিপ্লব, ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব, পশ্চিম ইউরোপের শিল্পবিপ্লব, রুশ দেশের সমাজবিপ্লব। এসব না ঘটলে ইউরোপ এগিয়ে যেত না, এশিয়া পিছিয়ে থাকত না, অগ্রসর আর পশ্চাৎপদের বৈষম্যকে আধ্যাত্মিকতা বনাম জড়বাদের বৈপরীত্য বলে রায় দিত না। প্রভেদটা আসলে মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের। পশ্চাৎপদরাও ক্রমে অগ্রগামীদের ধরে ফেলবে। হয়তো ছাড়িয়ে যাবে—যেমন জাপানে।
কিন্তু সেটার জন্যে চাই জরা সংযুবনী শক্তি। বিনু দেখতে পায় যুবকরা নিজেরাই দ্বিধাগ্রস্ত। একদল যদি চায় সমাজতন্ত্রে উত্তরণ আরেক দল ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে উন্নয়ন। এই দ্বিধা একদিন দ্বন্দ্বের রূপ ধারণ করতে পারে। সে দ্বন্দ্ব লণ্ডনের ইস্ট এণ্ডের সঙ্গে ওয়েস্ট এণ্ডের। কিপলিং যা বলেছেন তা ইস্ট বনাম ওয়েস্ট নয়, ইস্ট এণ্ড বনাম ওয়েস্ট এণ্ডের বেলায় খাটতে পারে। গৃহযুদ্ধ করবে ধনী ও দরিদ্র, নগর ও অঞ্চল। ‘সেটলমেন্ট’ স্থাপন করে হ্যাভ-নট শ্রেণিকে ভুলিয়ে রাখা যাবে না। হ্যাভ শ্রেণিকে ধনসম্পত্তি ভাগ করার কাজে ব্রতী হতে হবে। সেটা কি স্বেচ্ছায় হবে?
শেষের ক-দিন সুধায় গেল ভরে। বিনুর বান্ধবী তাকে নিয়ে গেলেন হল্যাণ্ড হয়ে জার্মানিতে, সেখান থেকে চেকোস্লোভাকিয়ায় তাঁর বান্ধবীর সমীপে, সেখান থেকে আবার জার্মানিতে। তার আগে দেখা হয়ে গেল গ্যেটের ভাইমার। বার্লিন তেমন পছন্দ হয়নি। কিন্তু ড্রেসডেন বিনুর হৃদয় হরণ করল। ইটারনাল ফেমিনিন রাফেলের আঁকা সিসটিন ম্যাডোনা। যিশুজননী। অতুলনীয়। জার্মানি থেকে বিনু লণ্ডনে ফিরে যায়, পাট গুটিয়ে আবার বান্ধবীর সঙ্গে যোগ দেয় ইটালির মিলান নগরে। দেখতে পায় লেওনার্দোর আঁকা দেওযালচিত্র যিশুর শেষ ভোজন—অপূর্ব। ভেনিস আর ফ্লোরেন্সের বিভিন্ন মিউজিয়ামে তাঁর আমলের আরও অনেকের কালজয়ী চিত্রসম্পদ, ভাস্কর্যসম্পদ। পরিশেষে রোম। ভ্যাটিকানে সেন্ট পিটার গির্জায় মিকেল অ্যাঞ্জেলোর আঁকা সিলিংচিত্র। ঈশ্বর অ্যাডামের আঙুলে আঙুল ছুঁইয়ে প্রাণসঞ্চার করেছেন। সেই শিল্পীর গড়া মোজেসমূর্তি দেখল রোমের অন্য এক গির্জায়।
এসব অনবদ্য সৌন্দর্যসৃষ্টি রেনেসাঁস আমলের। স্রষ্টারা ছিলেন ক্যাথলিক ধর্মমতে গভীর বিশ্বাসী। রিফর্মেশন আমলে প্রোটেস্টান্ট ধর্মমতে বিশ্বাসী শিল্পীরা ধর্মীয় বিষয়ে মন দেননি। কিন্তু প্রোটেস্টান্ট সংগীতকাররা সে অভাব পূরণ করেছেন কন্ঠ ও যন্ত্রসংগীতে মহৎ সংগীত সৃষ্টি করে।
এনলাইটেনমেন্টের আমলে ইউরোপ সেকুলার ধারা অবলম্বন করে। ধর্মবিশ্বাস আর তেমন প্রেরণা জোগায় না। প্যারিসই হয়ে ওঠে আর্টের কেন্দ্রস্থল। সংগীতের কেন্দ্র কোনো এক স্থলে নয়, তবে জার্মানি ও অস্ট্রিয়াই সেরা সংগীতকারদের সাধনাভূমি। বিনু প্যারিসে বেশি সময় দিতে পারেনি। তার বান্ধবীও সময় পাননি সেখানে নিয়ে যাবার। সংগীতে তার বিশেষ অভিনিবেশ থাকলেও বিনু পাশ্চাত্য সংগীত আদপেই বুঝত না। হ্যাঁ, সংগীতে প্রাচ্য-প্রতীচ্য ভেদ আছে বই কী, নৃত্যেও। বিনু বিভিন্ন সময়ে পাভলোভার ব্যালে দেখেছে, পাডেরেভস্কির পিয়ানো শুনেছে। তারপরে শুনেছে ক্রাইজলারের বেহালা, শালিয়াপিনের কন্ঠসংগীত। অসাধারণ, অসামান্য, কিন্তু বিনুর পক্ষে দুরূহ। বুঝতে হলে তাকে আরও কয়েক বছর ইউরোপে বাস করতে হত।
মনীষীদের সংসর্গও সে কলেজের বাইরে বড়ো একটা পায়নি। কারণ তাঁদের বাড়ি যায়নি। পাবলিক লেকচার শুনেছে বার্নার্ড শ আর বারট্র্যাণ্ড রাসেলের। দুই মহিরুহের। আরও কিছুকাল থাকতে পারলে ফরাসি ও জার্মান বনস্পতিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করত, আর ইটালিতে বেনেদেত্তো ক্রোচের সঙ্গে।
তার নিজের লেখার কাজও তো ছিল। দু-বছরে যা লিখেছে তা দিয়ে চারখানা কবিতার বই, দুখানা ভ্রমণের বই, একখানা প্রবন্ধের বই দেশে ফেরার আগে ও পরে ছাপা হয়ে যায়। হাতে থাকে এত বেশি মালমশলা যে প্রথমে ভাবে তিন খন্ডের উপন্যাস লিখবে তাই দিয়ে, পরে পাঁচ খন্ডের। কিন্তু তাতেও কি সব কথা বা সকলের কথা বলা হবে? আত্মীয়তা সে পাতিয়েছিল অচেনা অজানা কত লোকের সঙ্গে জার্মানিতে, ফ্রান্সে, চেকোস্লোভাকিয়ায়। ক্ষণিকের জন্যে। সে সব তো তার উপন্যাসের ফ্রেমে আঁটা যাবে না।
তার বান্ধবী তাকে রোম থেকে মার্সেলসে রেলপথে রিভিয়েরার ভিতর দিয়ে নিয়ে যান ও জাহাজে উঠিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। আবার সেই বিষাদ, আবার সেই আনন্দ। বিদায়ের বেদনা, ঘরে ফেরার উল্লাস। বিনু জাহাজের ডেকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ফ্রান্সের উপকূল ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। ইউরোপ হয়ে যায় মায়া।
বিনুর দ্বৈতসভা
পরাধীন দেশে নাগরিক মাত্রই পরাধীন। সরকারি চাকরি যারা করে তারা দ্বিগুণ পরাধীন। আইসিএস যেন একটি সোনার খাঁচা। বিনু সেই খাঁচায় অস্বস্তি বোধ করে। তার সংকল্প সে যৌবন ফুরোবার আগেই আইসিএস থেকে ইস্তফা দেবে। তার বিশ্বাস আইসিএস হয়ে সে ভুল করেছে। সময় থাকতে সংশোধন চাই।
অথচ এটাও তো ঠিক যে আইসিএস প্রতিযোগিতায় সফল না হলে সে বিলেত যেতে পারত না। বিলেত না যেতে পারলে ভ্রমণকাহিনি লিখতে পারত না। ভ্রমণকাহিনি না লিখতে পারলে বাংলা সাহিত্যের আসরে সহজে ঠাঁই পেত না। রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরির তারিফ কি কখনো জুটত!
আইসিএস-এর সুবাদেই তার বাংলায় নিযুক্তি। জীবনের প্রথম পঁচিশ বছর সে বাংলার বাইরেই কাটিয়েছে। ওড়িশায়, বিহারে ও বিলেতে। বাংলার বাইরে নিযুক্ত হলে সে শান্তিতে থাকতে পারত, তার পদোন্নতিও ত্বরান্বিত হত। কিন্তু সে বাংলার জেলায় জেলায় মহকুমায় মহকুমায় ঘুরে রূপসি বাংলাকে চিনত না, তার মানুষের মন জানত না। ভাষাটাও দেশের মাটির সঙ্গে জড়িত। বাংলা ভাষার লেখককে বাংলার মাটির থেকে রস আকর্ষণ করতে হবে। তা নাহলে ওই একখানা কি দুখানা গ্রন্থই রসোত্তীর্ণ হবে। সাহিত্যসাধনা বেশিদূর এগোবে না।
সরকারি চাকরির মতো সাহিত্যেরও নিয়ম অনেক জনকে ডাকা হয়, কয়েক জনকেই বেছে নেওয়া হয়। বিনু হতে চায় সেই কয়েক জনের একজন। এরজন্যে একাগ্র সাধনা করতে হবে, তা সে জানে। সেইজন্যে তার ভয় তার চাকুরে সত্তা আর সাহিত্যিক সত্তাকে অসপত্ন হতে দেবে না। আইসিএস বিনু সাহিত্যসাধক বিনুকে উপরে উঠতে দেবে না। সে নীচে পড়ে থাকবে। আইসিএস-দের পাঁচ-ছ বছর চাকরির পর পদোন্নতি ঘটে। কিন্তু বিনু সেই পাঁচ-ছয় বছরে তার পাঁচ খন্ডের উপন্যাস শেষ করতে পারলে কৃতার্থ হবে। নাই-বা হল পদোন্নতি। তার চেয়ে শ্রেয় সাহিত্যে ঊর্ধ্বগতি।
বিনু নারীশক্তির অভাব অনুভব করে। নারীশক্তির প্রেরণা বিনা কোনো দুঃসাধ্য কীর্তি সম্ভব হয় না। সেই যে আইসিএস প্রতিযোগিতা তার পেছনেও নারীশক্তির প্ররণা ছিল।
‘শুক বলে আমার কৃষ্ণ গিরি ধরেছিল। সারী বলে আমার রাধা শক্তি সঞ্চারিল। নইলে পারবে কেন?’ কোথায় সেই নারী যে তার সাহিত্যিক সৃষ্টিতে শক্তিসঞ্চার করবে। আইসিএস পাত্রকে বিয়ে করতে অনেকেই উৎসুক। বিনু সে আইসিএস ছাড়বে শুনলে কেই-বা বিয়েতে রাজি হবে?
বিনু তার নিজের পরিকল্পনা অনুসারে বাঁচতে পারে, পাঁচ খন্ডের উপন্যাস লিখতে পারে, পাঁচ বছর বাদে সোনার খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, কিন্তু তার নিজের পরিকল্পনা অনুসারে প্রেমে পড়ে প্রেম পেয়ে বিয়ে করতে পারে কি তেমন একটি নারীকে যে তাকে বিনু বলেই ভালোবাসবে, আইসিএস বলে নয়? আর যে তাকে বিয়ে করতে রাজি হবে সে আইসিএস ছাড়বে জানা সত্ত্বেও। স্বদেশে কি তেমন কেউ আছে?
বিনু তার জন্যে দুয়ার খোলা রেখে প্রতীক্ষা করতে পারে, কিন্তু তার যৌবন অপেক্ষা করবে না, বিদ্রোহী হবে। জীবনের পক্ষে পাঁচটা বছর খুব বেশি সময় নয়, কিন্তু যৌবনের পক্ষে অনন্ত কাল। বিনু সেই পলাতককে কোন মন্ত্রে বেঁধে রাখবে। যৌবন প্রেম পরিণয় আর্ট জীবিকা একসূত্রে গাঁথা কি সম্ভব? বিনুর বিশ্বাস হয় না। বিবাহের বেলা সে নেতিবাদী হয়ে প্রত্যেকটি সম্বন্ধ নাকচ করে। কন্যাপক্ষের ধারণা সে নিলামে দর বাড়াতে চায় বলেই নেতি নেতি করছে, বিনু কিন্তু পণ যৌতুক নেবে না, নেবে কন্যাটিকেই।
তবে তার নিজের ভবিষ্যৎ যখন অনিশ্চিত তখন একটি নারীকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করা সমীচীন হবে না। বিবাহবন্ধন তো তার নিজের পক্ষেও বন্ধন, সেটাও একপ্রকার খাঁচা। হয়তো বাঁশের খাঁচা। অথচ নীড় বাঁধতে হলে বিবাহই শ্রেয়। বিবাহের বাইরে নীড় বাঁধার নজির ইউরোপে আছে। শিল্পীরা বোহেমিয়ান জীবনধারা পছন্দ করেন। তাঁরা বিবাহবিমুখ। নীড় বাঁধতে চাইলে বিবাহের বাইরেই বাঁধেন। সন্তান হয় না, হলে অবৈধ হয়। বিনু শিউরে ওঠে। না, অবৈধ সন্তান কিছুতেই না। তার চেয়ে নিঃসন্তান থাকা শ্রেয়। তাহলে আবার বাৎসল্যরসটা অনাস্বাদিত থেকে যায়। সে-রসও বিনু আস্বাদন করতে চায়। তার মধ্যে একজন বৈষ্ণব লুকিয়েছিল। যার চক্ষে শিশু মাত্রেই গোপাল। তার ঘরে গোপাল থাকবে না তা কি হয়? তার জায়া হবে ‘রাধা ও ম্যাডোনা একাকারা।’ মোহিতলালের উক্তি।
এই অলীক দিবাস্বপ্ন সরিয়ে রেখে বিনু তার কাজেকর্মে মন দেয়। প্রথম কাজটি প্রথমে। মাসকাবারের পর মাইনেটি সব আগে। বিনু সময় পেলেই লিখতে বসে যায়। সময় করে নিতে হয়। টেনিস কোর্টে বিলিয়ার্ডস খেলতে ক্লাবে যায়, কিন্তু তাস খেলতে গেলে রাত বাড়ে তাই তাস খেলে না; আড্ডা দেয় না। তার সাহিত্যিক সত্তা যে অসপত্ন নয়, ম্যাজিস্ট্রেট সত্তা যে ওর সপত্নীসমান এরজন্যে সে দুঃখিত। প্রকৃতপক্ষে সাহিত্যই তার অন্দরে দুয়োরানি। সে ষোলো বছর বয়স থেকেই বিভিন্ন পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ করেছিল।
সবচেয়ে ভালো হত যদি সাহিত্যই হত সাহিত্যিকের জীবিকা। কিন্তু রম্যাঁ রল্যাঁ বিনুকে টাকার জন্যে লিখতে বারণ করেছিলেন। টাকার জন্যে লেখা মানে বাজারের চাহিদা অনুসারে জোগান দেওয়া। পাঠকরা দাম দিয়ে কেনে ডিটেকটিভ উপন্যাস, অলৌকিক কাহিনি, ভূতপ্রেতের গল্প, সেন্টিমেন্টাল কমেডি, প্রচ্ছন্ন পর্নোগ্রাফি। তাই সিরিয়াস বিষয়ে যাঁরা লেখেন তাঁদের অন্য কোনো আয়ের উৎস থাকে। কারও চাকরি, কারও জমিদারি, কারও পৈত্রিক বিষয়সম্পত্তি, কারও পিসি-মাসির অর্থসাহায্য। অবশ্য দু-চার জন ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন বার্নার্ড শ, টোমাস মান, ভার্জিনিয়া উলফ, ডি এইচ লরেন্স।
বিনু সিরিয়াস বিষয়ে লিখতে কৃতসংকল্প। তার পাঁচ খন্ডের উপন্যাস ক-জনেই বা পড়বে? ক-জনই বা কিনবে? তার কবিতারই-বা চাহিদা কতটুকু? কিংবা তার প্রবন্ধের। মাসিকপত্রের সম্পাদকরা দক্ষিণা দেন না। প্রকাশক ছাপতে রাজি হন সে যদি ছাপার খরচটা দেয়, কাগজের খরচ তিনি দেবেন। পরে হিসাব-নিকাশ হবে। লাভ হলে সে লাভের অংশ পাবে। বিনু একখানা চটি বইয়ের মুদ্রণব্যয় জোগাতে পারবে, কিন্তু একখানা তিনশো পৃষ্ঠার উপন্যাসের মুদ্রণদায় সে বহন করতে পারবে না, প্রকাশকও নারাজ হবেন কাগজের দাম মেটাতে। হালকা বিষয়ের উপন্যাস হলে অন্য কথা, প্রকাশকই সমস্ত ভার বইবেন। তাহলে বিনুকে কেবল হালকা উপন্যাসই লিখতে হয়, বছরে চারখানা। তাতেও কি জীবনযাত্রার দুই প্রান্ত মেলাতে পারা যাবে। আর কারও পক্ষে সম্ভব হতে পারে, বিনুর পক্ষে নয়। তার ঝুলিতে অতগুলো কাহিনি নেই। স্ত্রীপাঠ্য বা শিশুপাঠ্য কাহিনি লিখে সে সরস্বতীর বর পাবে না। তার অভিপ্রেত পাঠক-পাঠিকারা বিদগ্ধ, জনসংখ্যায় অল্প।
বিনুর আশা এঁরাই তার বড়ো মাপের বই কিনবেন ও এঁদের মুখ চেয়ে প্রকাশক তার বই নিজের ব্যয়ে প্রকাশ করবেন। সত্যি সত্যি তেমন একজন প্রকাশককে পাওয়া গেল। তিনি পাঁচ খন্ডের উপন্যাস শুনে ভয় পেলেন না। বিষয়টা আধুনিক বিশ্বের বিবিধ চিন্তাভাবনা, তাও প্রতীচ্য পটভূমিকায়, একথা শুনেও তিনি প্রকাশ করতে সম্মত। তাঁর অনুরোধ বিনু যে-সপ্তাহে যতটুকু লিখবে ততটুকু তাঁকে পাঠাবে। তিনি অবিলম্বে প্রুফ পাঠাবেন। বিনু প্রুফ দেখে ফেরত পাঠাবার সময় নতুন কপি পাঠাবে। বই বার হবে পুজোর পূর্বে। পুরো বইখানা বিনু প্রেসে দেবার আগে দেখতে পাবে না। সে রাজি হয়ে যায়।
যে-বিষয়ের চাহিদা নেই তার চাহিদা সৃষ্টি করতে হবে। যে-বিষয়ের পাঠক নেই তার পাঠক তৈরি করে নিতে হবে। পরীক্ষা করে দেখা গেল গুরুপাক উপন্যাসেরও চাহিদা আছে, পাঠক আছে। ওটা প্রকাশকের পক্ষে লোকসানের কারবার নয়। আর বিনুর পক্ষে দুধে জল মেশাবার ব্যাবসা নয়। সে খাঁটি দুধই সরবরাহ করে, তবে বিক্রি কম।
রম্যাঁ রল্যাঁর কথামতো বিনু নিজের খুশির জন্যে লিখেছে, পাঠকের খুশির কথা ভেবে দেখেনি। পাঠকসাধারণ যদি তার বই না কেনে তবে সে কাকে দায়ী করবে? ইউরোপের প্রথম যুদ্ধোত্তর তথা দ্বিতীয় যুদ্ধপূর্ব মধ্যবর্তী দু-বছরের একটি মানসচিত্র আর কেউ বাংলা ভাষায় আঁকেনি। বিনুই এঁকেছে। তার সঙ্গে মেলাবার প্রয়াস রয়েছে শাশ্বত ভারতের। নতুন ও পুরাতন বহুবিধ জিজ্ঞাসার উত্তর অন্বেষণ করা হয়েছে। হয়তো মেলেনি, তবু বৃথা নয়। বিনু তার রক্ত দিয়ে যা লিখেছে তা নিছক একজনের খুশির জন্যে নয়। আরও অনেকের অবগতির জন্যেও। তাঁরাও যদি মুষ্টিমেয় হনও তবু তার শ্রম সার্থক। বর্তমান কালের পাঠকরাই একমাত্র পাঠক নন। সত্যভিত্তিক হলে বইটির ভবিষ্যৎ আছে। পাঁচ খন্ডের এই উপন্যাস একটি চওড়া ক্যানভাসে আঁকা মসিচিত্র।
বইটি কি না-লিখলে চলত না? না, চলত না। বিনু ছাড়া আর কেউ কি লিখতে পারত না? না, পারত না। বিনুকেই কি সাহিত্য-সরস্বতী এ কাজের জন্য বরাত দিয়েছেন? তাই তো মনে হয়। সম্পাদক তার ভ্রমণকাহিনি শেষ হবার পর তার কাছে চেয়েছিলেন একটা উপন্যাস। সে লিখতে পারত একখানা বাজারচলতি উপন্যাস। সম্পাদক সানন্দে প্রকাশ করতেন। সে লিখতে শুরু করে দেয় তার পাঁচ খন্ডের উপন্যাস। বলতে গেলে এটা তার ভ্রমণকাহিনির অন্তরালে থাকা অন্তরঙ্গ কাহিনি। এতে ঘটনার চেয়ে ভাবনা বেশি, তথ্যের চেয়ে তত্ত্ব বেশি। দৃশ্যের চেয়ে চরিত্র বেশি। বহি:প্রকৃতির চেয়ে অন্তঃপ্রকৃতি প্রধান। বর্ণনার চেয়ে মানসিক বিবর্তনই প্রধান। বিবরণের চেয়ে বক্তব্য প্রধান। এক কথায় এটি একটি ইন্টেলেকচুয়াল উপন্যাস। যাতে আইডিয়ার সঙ্গে আইডিয়ার ঘাত-প্রতিঘাত ও বোঝাপড়া।
ইউরোপ হতে চলে আসার পর থেকে সেখানকার স্মৃতি ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে আসছিল। খুঁটিনাটি ভুলে যাওয়ার ফলে লিখতে গিয়ে ভুল হয়ে যাচ্ছিল। অন্য কারও সঙ্গে পরামর্শ করার দরকার ছিল। কিন্তু বাংলার মফস্সলে কাকেই-বা হাতের কাছে পাবে? এমনসময় ঘটে যায় এক অঘটন। এক বিদেশিনির সঙ্গে অকস্মাৎ পরিচয়, পরিচয় থেকে প্রণয়, প্রণয় থেকে পরিণয়। সমস্তটাই মাস দুয়েকের মধ্যে। মানতে হয় এটা প্রজাপতির নির্বন্ধ। জীবনদেবতার ইচ্ছা। বিনু তার প্রয়োজনের সময় পরামর্শ পায়, না পেলে তার উপন্যাস ত্রুটিগ্রস্ত হত। তাহলে বলতে হয় সরস্বতী এই বিবাহের পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন, বিনুকে ও মীরাকে জানতে দেননি। মীরা নামকরণ হয় বিবাহের পরে। বিদেশিনি বনে যান স্বদেশিনি। শাড়ি পরেন, বাংলায় কথা বলেন। নিজের দেশ ছাড়েন, ন্য্যাশনালিটি ছাড়েন কিন্তু ধর্ম ছাড়েন না। বিনুও ধর্মান্তরিত হয় না। যার যার ধর্ম তার তার। বিনু অসবর্ণ বিবাহে বিশ্বাস করত। অসধর্ম বিবাহও সে বাল্যকাল থেকে দেখে এসেছিল।
মীরাকে বিনু বিয়ের আগেই জানায় সে আইসিএস-এ বেশিদিন থাকবে না। ও যদি তাকে আইসিএস বলে বিয়ে করে তবে ভুল করবে। মীরা তাকে আশ্বাস দেয় যে আইসিএস বলে সে ওকে বিয়ে করছে না, ভালোবাসে বলেই বিয়ে করছে। তবে বিনু নিজেই দু-বার ভাবে। যেটা একজন অবিবাহিত পুরুষের পক্ষে ঠিক, সেটা একজন বিবাহিত পুরুষের পক্ষে ঠিক নয়। সন্তান হলে তো কথাই নেই। আইসিএস ছাড়ার আগে ওদের জন্যে ব্যবস্থা করতে হবে। ওদের সম্মতি নিতে হবে।
গোলাপ। গোলাপ। গোলাপ। সমস্তটা পথ গোলাপ বিছানো। প্রথমে আপত্তি করলেও বিনুর গুরুজন মীরাকে দেখে ও তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে এ বিবাহ মেনে নেন ও তাকে বধূরূপে বরণ করেন। ধর্মভেদ, বর্ণভেদ, দেশভেদ, ভাষাভেদ অন্তরায় হয় না। সবার উপরে মানুষ সত্য।
কাঁটা। কাঁটা। কাঁটা। মীরার গুরুজন এ বিবাহ মেনে নিতে রাজি নন। বিনুকে জামাতা বলে স্বীকার করেন না। মীরাকে বলেন বিবাহভঙ্গ করতে। সে সম্মত হয় না। তখন তাঁরা তাকে পিতৃগৃহ থেকে বহিষ্কার করেন। সে ত্যাজ্য কন্যা হয়।
বিনুর কাছে যা রোম্যান্টিক মীরার কাছে তা ট্র্যাজিক। এমন বিবাহ সাধারণত সুখের হয় না। কিন্তু বিনু ও মীরা দুজনে দুজনকে নিয়ে সুখী। প্রেম তাদের নীড় বাঁধতে শেখায়। দূর দিগন্তের দুটি পাখির মতো প্রেমের সঙ্গে যোগ দেয় সাহিত্য ও সংগীত। মীরা পিয়ানো নিয়ে এসেছিল। সেও রল্যাঁ ও রবীন্দ্রনাথকে ভক্তি করত। ভারতের স্বাধীনতা তারও কাম্য ছিল। সেও বিনুর মতো খাদি পরত। শ্বেতাঙ্গ সমাজে সে একজন নেটিভ। কে একজন শ্বেতাঙ্গ টিপ্পনি কাটেন, ‘উনি ভারতকে ভালোবাসেন বলেই ভারতীয় বিবাহ করেছেন।’
মীরা যে ভারতকে ভালোবাসে একথা সত্য। তা না হলে এদেশে বরাবরের জন্যে থেকে যেত না, গ্রীষ্মকালে দগ্ধ হত না। স্বামীকে ফেলে পাহাড়ে যাবার মতো মেমসাহেব সে নয়। বাংলার যেখানেই গেছে সেখানেই ঘরের মতো বোধ করেছে, বিনু যেমন ইউরোপের সর্বত্র বোধ করেছিল। সব দেশই মানুষের দেশ। সবাই তার স্বজন। প্রেমের বন্ধন থাকলে তো কথাই নেই।
ইউরোপে ইউরোপীয় স্টাইল মানায়, ভারতে নয়। বিনু পারতপক্ষে ভারতীয় ধরনে থাকত। সে জানত তাকে একদিন পদত্যাগ করতে হবে। তখন সাহেবিয়ানা চলবে না। বাবুয়ানাও এই গরিব দেশে বেমানান। একদিন সে গ্রামে গিয়ে চাষি ও কারিগরদের সঙ্গে জীবন যোগ করবে। মীরাকেও সে তার সাথি করবে। সুতরাং জীবনযাত্রা যত সাদাসিধে হয় তত ভালো। ওরা প্রাতরাশের সময় চিঁড়ে মুড়ি খায়। তা শুনে বাঙালি সাহেব মহলে হাসাহাসি পড়ে যায়। ওটা যে আইসিএস ত্যাগের প্রস্তুতি কে তা বিশ্বাস করবে? বিনুর সে-প্রস্তুতি তলে তলে চলছিল ও মীরা তার সক্রিয় সহযোগিনী ছিল। সে কষ্ট সইতে প্রস্তুত।
প্রথম দর্শনের সময় বিনু মীরাকে—তখন তার নাম মীরা ছিল না—দু-তিনটি বাংলা শব্দ শিখিয়েছিল। তখন সে স্বপ্নেও ভাবেনি যে ওর সঙ্গে তার বিয়ে হবে। বিয়ের পরে মীরা বিনুর সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে শেখে ও বাংলাই হয় ওদের ছেলে-মেয়ের মাতৃভাষা। ওদের ইংরেজি শেখানো হয় না। যদিও ওদের মা ইংরেজিভাষিণী। এতে মীরার আন্তরিক সম্মতি ছিল। নইলে ছেলে-মেয়েরা মিশত কাদের সঙ্গে? মফস্সলে ওদের সমবয়সিরা সবাই বাংলাভাষী। দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজি? না, তাতেও বিনুর আপত্তি ছিল। মীরা তার সঙ্গেই একমত হয়। আট বছর বয়স পর্যন্ত এই শিক্ষানীতি রবীন্দ্রপ্রভাবে। গান্ধীজির প্রভাবও কাজ করছিল। পাছে ইংরেজি শিখতে গিয়ে আত্মমর্যাদা হানি হয়। আগে তো পুরোদস্তুর বাঙালি হোক, তারপরে ইংরেজি ফরাসি জার্মান যেকোনো ভাষা শিখবে।
বিনুর চাকরিতে নিযুক্তির কিছুদিন পরে লাহোরে কংগ্রেস স্বাধীনতা প্রস্তাব গ্রহণ করে। তার কিছুদিন পরে শুরু হয় গান্ধীজির ডান্ডি যাত্রা ও লবণ সত্যাগ্রহ। ঘটে যায় চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুন্ঠন। বিনুকে কাজ করতে হয় অশান্ত পরিবেশে। দেশ দুই শিবিরে বিভক্ত। তার স্থান ইংরেজদের শিবিরে। সে শিবিরে গণ্যমান্য অনেক ভারতীয় ছিলেন। সে তাঁদের তুলনায় নগণ্য। তবু তার বিবেক তাকে দায়ী করছিল। দমনকার্যের জন্যে নয়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার জন্যে।
অথচ সে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সমর্থকও ছিল না। তার মতে হত্যা মাত্রেই পাপ। দেশের মুক্তির জন্যে পাপ করা কিছুতেই ভালো হতে পারে না। রাজনীতির দিক থেকেও তা অদূরদর্শিতা। কয়েক বছর পরে দেখা গেল ম্যাকডোনাল্ডের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ বাংলার হিন্দুদের প্রতি প্রতিকূল অথচ অন্যান্য প্রদেশের প্রতি প্রতিকূল নয়। সে-সময় মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট পদে থাকতে বিনুকেও সশস্ত্র বডিগার্ড নিয়ে ঘোরাফেরা করতে হত। ফলে লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে গেলে বিনু বিব্রত বোধ করত।
চাকরির গোড়ায় বিনু যখন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিল তখন তার উপর কোনো গুরুদায়িত্ব অর্পিত ছিল না, সে আদালতে বসে ছোটো ছোটো মামলার বিচার করত, ক্লাবে গিয়ে টেনিস ও বিলিয়ার্ডস খেলত, রাতে ও সকালে ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষার জন্যে পড়াশোনা করত, তারই ফাঁকে কবিতা বা উপন্যাস লিখত। জেলার সদরে থাকায় সরকারি ও বেসরকারি মহলের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তার আলাপ-পরিচয় হত। লাটসাহেব থেকে আরম্ভ করে রাজা-মহারাজ, নবাব বাহাদুর, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা জজ, সিভিল সার্জন, পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্ট, পুলিশ বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল, জেল বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল, এমনই সব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে খানাপিনা বা খেলাধুলা বা মোলাকাত। অনেকসময় নামমাত্র। তার প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন শিল্পরসিক। পাল যুগের আর্ট সম্বন্ধে তাঁর একখানি বই ছিল। ইউরোপীয় আর্ট প্রসঙ্গে বিনুর সঙ্গে কথাবার্তার পর তাকে ডেকে পাঠান হলঘরের দেওয়াল কোন রঙে রাঙাবেন তা নিয়ে পরামর্শ করতে। তিনি ইউরোপীয়।
কিন্তু মহকুমার ভারপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট পদে বদলির পর বিনু হয়ে যায় উপরমহলের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তার পরিবর্তে আসে গ্রাম অঞ্চলের জনগণের সঙ্গে অবাধ মেলামেশার সুযোগ। তার দ্বিতীয় ইউরোপীয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাকে উৎসাহ দেন ও পথ দেখান। সেও তাঁবু নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তাঁবুতে রাত কাটায়। সুইস কটেজ তাঁবুতে ঘরের আরাম পায়। ততদিনে সে বিবাহিত। মীরাকেও সঙ্গে নিয়ে যায়—শিশুপুত্রকেও। দিনের বেলা শিশুকে নিয়ে দুজনে পায়ে হেঁটে বেড়ায়। গ্রামের লোক এসে আর্জি ও অভিযোগ জানায়। কতরকম সমস্যা। সম্ভব হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয় বিনু। নয়তো নোট করে নিয়ে যায়। পরে ব্যবস্থা নেয়। এমনি করে বিনু বনে যায় একজন ম্যান অব অ্যাকশন। সরকার ও জনগণের মাঝখানে সেতুবন্ধন করে। ক্রমশ উপলব্ধি করে যে রাষ্ট্রের একটা দক্ষিণ মুখও আছে। কেবল রুদ্র রূপ নয়। সে একজন জনসেবক, কেবল দন্ডমুন্ডের কর্তা নয়।
মাঝে মাঝে একজনের বাসযোগ্য কাবুলিপাল তাঁবু নিয়ে দুর্গম অঞ্চলে ডেরা বাঁধে। একবার কালবৈশাখী ঝড়ের মুখে কাবুলিপাল যায় উড়ে। ঝড়ের রাতে তাকে আশ্রয় দেন এক ব্রাহ্মণ গৃহস্থ। বিছানা পাতা হয় একই ঘরে পরিবারের স্ত্রী-পুরুষের সঙ্গে। সকলেই অচেনা। ভদ্রলোক কোনোরকম প্রতিদান চান না। সেটা নিছক অতিথিসেবা।
মাঝে মাঝে হাতির পিঠে চড়েও বিনু আরও দুর্গম অঞ্চলে যায়। জমিদারদের হাতি। একভাবে-না-একভাবে প্রত্যুপকার করতে হয়। তেমনি মাঝে মাঝে হাউসবোট নিয়ে সফর করতে হয়। ঠাকুরবাবুদের কিংবা চৌধুরিবাবুদের হাউসবোট। রবীন্দ্রনাথ যে বোটে চড়তেন পতিসরে যেতে-আসতে বিনুও সেই বোটের যাত্রী। সঙ্গে মীরা। নদীর দু-ধারের দৃশ্য দেখতে দেখতে লেখার কাজও করা যায়। রবীন্দ্রনাথ তাই করতেন। বোট এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে দিনের বেলা যেটা লেখার টেবিল বা খাবার টেবিল, রাতের বেলা সেটা মেঝের সামিল। তখন ঢালা বিছানায় শোওয়া যায়। পতিসরে বিনু ও মীরা বোট থেকে নামে না। সেখানেই রাত কাটায়।
মাঝিমাল্লারা মুসলমান। একান্ত অনুগত প্রজা। প্রধানত মুসলমান প্রজাদের নিয়েই হিন্দুদের জমিদারি, তালুকদারি, জোতদারি। জমিদাররা নানা উপলক্ষ্যে খাজনার উপর আবওয়াব আদায় করেন। পরিবর্তে প্রজার জন্য কিছু করেন, এর দৃষ্টান্ত বিনু লক্ষ করে একমাত্র রবীন্দ্রনাথের জমিদারিতেই। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কল্যাণবৃত্তি তহবিলে প্রজারা দেয় খাজনার টাকায় এক আনা চাঁদা, জমিদার দেন টাকায় এক আনা চাঁদা। তহবিলের খরচে তিনটি হাসপাতাল, তিনটি স্কুল চলে। জমিদারির তিনটি বিভাগে। তাদের একটি হাই স্কুল।
বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে হিন্দু-মুসলিম সমস্যার অপর নাম হচ্ছে জমিদার বনাম প্রজা, মহাজন বনাম খাতক সমস্যা। বিনু বুঝতে পারে বাংলার হিন্দু-মুসলিম সমস্যার মূলে ব্রিটিশ সরকারের ভেদনীতি যার অন্য রূপ জমিদার ও মহাজনদের শোষণনীতি। আইনে এর কোনো প্রতিকার নেই। বিনু আইনের বাইরে কিছু করতে পারে না। শুধু শুভবুদ্ধির কাছে আবেদন করে। ওদিকে মুসলিম প্রজা ও খাতকদের প্ররোচনা জোগাবার জন্যে রাজনীতিক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট গান্ধীপন্থী নেতাও। জমিদারকে খাজনা না দিলে সরকারের রেভিনিউতেও টান পড়ে। সরকারকে বাধ্য হয়ে ধরপাকড় করতে হয়। যেকোনো একটা ইসুতে জেলে যাওয়া কি সত্যাগ্রহ? মুসলমানদের হৃদয় জয় কি অত সহজ?
গাঁজা চাষিদের সমবায় সোসাইটির সদস্যদের নিকট-সংস্পর্শে এসেছিল বিনু। তাদের সকলেই মুসলমান, একজন বাদে। লেখাপড়া না করেও তারা সমিতির পরিচালনায় সুদক্ষ। প্রায় সকলেই সম্পন্ন চাষি। তাদের ছেলেরা সরকারি চাকরির উমেদার না হয়ে যদি কৃষিবিজ্ঞান শিখে আরও ভালোভাবে চাষ করে তবে গাঁজা চাষের উপর নির্ভর করতে হয় না। সেটা সমাজের পক্ষে অহিতকর। গাঁজা সোসাইটির অর্থসাহায্য নিয়ে তিনটে হাই স্কুল চলত। কিন্তু কোনোটারই মান উচ্চ নয়। বিনুর ইউরোপীয় কালেক্টরের বক্তব্য হল তিনটির জায়গায় একটিই সেন্ট্রাল হাই স্কুল হোক, তার অধীনে থাকুক তিনটি মাইনর স্কুল। বিনুর উপর ভার পড়ে এই বক্তব্য অনুসারে কাজ করার। সে তার নিজের বক্তব্য জুড়ে দেয়—সেন্ট্রাল হাই স্কুলের অতিরিক্ত শিক্ষণীয় বিষয় হবে কৃষিবিজ্ঞান। কালচার আর এগ্রিকালচার এটাই আদর্শ। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল চাষির ছেলেরা কেউ কৃষির ক্লাসে যায় না, যায় বিনুর হেডক্লার্কের ছেলে, ব্রাহ্মণ সন্তান, চাকরির আশায়। ওদিকে তিন হাই স্কুলের পরিচালকরা উপরের চারটি ক্লাস সেন্ট্রাল হাই স্কুলে স্থানান্তরিত করেন না। তাঁরা বরং গাঁজা সোসাইটির অর্থসাহায্য নেবেন না, নিজেরাই ভিক্ষা করে চালাবেন। তাঁদের ছেলেরা চাষি হবে কেন? তারাও পাস করে সরকারি চাকুরে হবে।
হিন্দু-মুসলিম সমস্যার মূলে এটাও একটা কারণ। সবাই চায় সরকারি চাকরি, অন্যথা ডাক্তারি ওকালতি ইত্যাদি ভদ্রলোকের পেশা। তা হলেই সমাজে মর্যাদা পাবে। এর পেছনে রয়েছে শ্রমের অমর্যাদা, শ্রমকাতরতা, হীনতাবোধ। মুসলমানরাই যৌথ সমাজের নিম্নতর স্তরে। ইংরেজি লেখাপড়া শিখে হিন্দুর সমান স্তরে ওঠাই তাদের স্বপ্ন। এতদিন পরে ওরা সমঝেছে যে ইংরেজি শিক্ষাকে বয়কট করে মাদ্রাসার শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরা মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষে ভ্রান্তনীতি হয়েছে।
গরিব মুসলমান ছাত্ররা মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে ‘জাগির’ পায়। বিনা খরচে খাবার ও শোবার ব্যবস্থা হয়। খুব একটা ভালো ফল দেখাতে না পারলেও তারা তাদের সম্প্রদায়ের জন্যে নির্দিষ্ট চাকরির কোটায় জায়গা পেয়ে যায়। যোগ্যতর হিন্দুর ছেলেরা পায় না।
যোগ্যতর হিন্দুকে ডিঙিয়ে কম যোগ্য মুসলমানকে চাকরির ভাগ দেওয়ার এই যে নীতি বিনুও এর ভুক্তভোগী। প্রতিযোগিতার প্রথম বারেই সে পঞ্চম হয়েছিল, কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে একজন মুসলমানকে নেওয়া হয়। বিনু তখন প্রতিজ্ঞা করে সে দ্বিতীয় বারের পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করবেই। ভগবান তার মুখরক্ষা করেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার পরীক্ষার জন্যে যদি তার বয়স না থাকত তাহলে সে কোনোদিনই আইসিএস হতে পারত না, বিলেত যেতে পারত না, ফিরে এসে বাংলায় নিযুক্ত হতে পারত না, এতরকম লোকের সঙ্গে মিশতে পারত না। তার সাহিত্যিক সত্তারও ক্ষতি হত। একজন সাংবাদিক হয়ে সে এমন কিছু লিখতে পারত না যা রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরির প্রশংসাযোগ্য হত।
সাম্প্রদায়িক রোমান্সের পর থেকে শিক্ষিত হিন্দুদের মধ্যেও একটু মুসলিমবিদ্বেষ জাগে। কেউ কেউ বলতে আরম্ভ করেন,
O Hindu is Hindu and Muslim is Muslim
And never the twain shall meet.
বিনু তা শুনে ব্যথিত হয়। যারা পরস্পরের নিকটতম প্রতিবেশী, এক ভাষায় কথা বলে, এক মাঠে চাষ করে, এক নৌকায় নদী পার হয়, এক বন্যায় ভাসে, এক দুর্ভিক্ষে মরে তারা কি ইংরেজদের মতোই পর, তারা কি সাত-আট শতাব্দীর পরেও আপন হয়নি? হবেও না ব্রিটিশশাসনের অবসানে? ভেদনীতির অন্তর্ধানে? বিনু হিন্দু-মুসলমানদের বেলাও মনে করে—‘কেউ হিন্দুও নয়, কেউ মুসলমানও নয়, যেখানে উভয়েই ভারতীয়, উভয়েই বাঙালি।’
পরস্পরের প্রতি টান উভয় সম্প্রদায়ের সাধারণ লোকের মধ্যেই। তা না হলে মুসলিম প্রধান গ্রামে পাঁচ-দশ ঘর হিন্দু টিকতে পারত না। অথবা হিন্দুপ্রধান পাড়ায় দু-চার ঘর মুসলমান। তার নিজের জন্মস্থানে তাদের পাশের বাড়ির বাসিন্দারা মুসলমান। ধারেকাছে মুসলিম বসতি নেই। কই, কখনো তো মনোমালিন্য হয়নি। রোজ বিকেলবেলা মুসলিম মাস্টার চা খেতে আসতেন। বিনুর আর একজন কাকা আত্মীয়ের মতো ব্যবহার করতেন ও পেতেন। কলেজেও তার মুসলিম বন্ধু ছিল। তাদের সঙ্গে সে এক হস্টেলে প্রায় দু-বছর থেকেছে।
দাঙ্গার সময় বিনু কড়া হাকিম। হিন্দু বা মুসলমান কাউকেই রেয়াত করে না। সে তখন ধর্মনিরপেক্ষ রাজপুরুষ বা জনসেবক। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন তার কর্তব্য, সেটাই সরকারি নীতি। ইংরেজদের মধ্যে দু-একজন কালো ভেড়া থাকতে পারে, কিন্তু মোটের উপর তারা ধর্মনিরপেক্ষ ন্যায়নিষ্ঠ অফিসার। তবে এটাও ঠিক যে বিনু যে-দুজন আইন অমান্যকারীকে ধরে চালান দিয়েছিল, জেলাশাসক তাদের একজনকে সঙ্গে সঙ্গে খালাস দেন, অন্যজনকে সাত দিন পরে। মুসলিমটিকে বলেন, মুসলমানদের সঙ্গে তো ইংরেজদের কোনো বিরোধ নেই। তারা এই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে কেন? হিন্দুটিকে বলেন, বাড়ি যান, আর এমন আন্দোলনে যোগ দেবেন না।
আইসিএস না হলে সে সরকারের ভিতরের খবর জানতে পেত না। সেই জেলাশাসক তার দিকে একটা ফাইল বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘এঁকে পুলিশের লোক জেল থেকে খালাস করে এনে বিয়ে দিচ্ছে। বিয়ের পরে আর সন্ত্রাসবাদী কাজে লিপ্ত হবেন না।’
ইংরেজদের নীতি নির্বিচারে দমনমূলক ছিল না। পুলিশের ভিতরেও বিবেচক অফিসার ছিলেন, ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যেও। আবার এমন লোক ছিলেন যাঁরা একটি বারো-তেরো বছরের ছেলে মুনসেফের আদালত শীর্ষে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে আর বিনু তাকে শুধুমাত্র ধমক দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে শুনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গেল গেল বলে আঁতকে উঠেছেন। জেলাশাসক—ইনি অন্য একজন—বিনুকে বলেন, ওই পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্ট যুদ্ধে শেল শক পেয়েছেন। তাই একটুতেই অন্ধকার দেখেন।
গান্ধীজির আন্দোলনের আসল ঘাঁটি ছিল মেদিনীপুর জেলা। বিনুর মহকুমা রাজশাহি জেলায়। সে-আন্দোলনের আঁচ অতদূর পৌঁছোয়নি। তাই বিনুকে কড়াহাতে দমন করতে হয়নি। গান্ধীপন্থীদের সঙ্গে তার সদ্ভাব ছিল। সরকারও সেটা জানতেন। বিনুর বরাত ভালো যে সন্ত্রাসবাদী ঘটনা তার এলাকায় ঘটেনি। ঘটলে তাকে মুশকিলে পড়তে হত। দন্ড দিলে দেশের লোক ভাববে দেশদ্রোহী, না দিলে সরকার মনে করবে রাজদ্রোহী। বিনু পাপকে ঘৃণা করত, কিন্তু পাপীকে নয়। অপরাধীর জন্যে তার অন্তরে একটা নরম কোণ ছিল। দন্ড দিলেও সে অত্যন্ত গুরুদন্ড দিত না। তবে ধর্ষণের বেলা সে বজ্রাদপি কঠোর।
লোকাল বোর্ড ও ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচন যৌথ পদ্ধতি অনুসারে হত। হিন্দু প্রার্থী, ভোটার মুসলমান। মুসলিম প্রার্থী, ভোটার হিন্দু। সাধারণত মুসলিম ভোটে হিন্দু প্রার্থীরাই অধিকাংশ স্থলে জয়ী হতেন। যদিও এলাকাটা মুসলিমপ্রধান। এই প্রথা কেন্দ্রীয় তথা প্রাদেশিক স্তরে প্রচলিত থাকলে মুসলিমপ্রধান বাংলার নির্বাচিত আইনসভা হিন্দুপ্রধান হতে পারত। সেটা এড়াবার জন্য মুসলিম রাজনীতিকরা স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতির দাবি তোলেন, পেছনে ইংরেজ শাসকদেরও কূটনীতি ছিল। ওঁরা মনে মনে স্থির করে রেখেছিলেন যে কয়েকটা প্রদেশ হবে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর সেই কয়েকটা প্রদেশের নির্বাচিত সরকারও মুসলিমপ্রধান। আবশ্যক স্বতন্ত্র নির্বাচন পদ্ধতি। সেই জিনিসটিই দাবি করেন মুসলিম রাজনীতিকরা।
মুর্শিদাবাদ, নদীয়া ও রাজশাহি—তিনটি জেলাই ছিল মুসলিমপ্রধান। কিন্তু তিনটি জেলাবোর্ডের চেয়ারম্যানরা ছিলেন হিন্দু। তাঁদের যাঁরা সমর্থক তাঁদের মধ্যে মুসলমানও ছিলেন। জেলাবোর্ডের মধ্যে বিনুরও প্রবেশ ছিল। সেখানে সে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ লক্ষ করেনি। চেয়ারম্যানের স্বপক্ষে তথা বিপক্ষে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সদস্য। কংগ্রেস বা মুসলিম লিগ কোনোটারই অস্তিত্ব জেলাবোর্ডের সভায় ছিল না।
একদিন শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপিকার আর্নল্ড বাকে আসেন বিনুর ও মীরার অতিথি হয়ে। তিনি চান বাংলার লোকগীতি রেকর্ড করতে। সঙ্গে রেকর্ড করার যন্ত্র। বিনুর অনুরোধে লোকগীতি গবেষক মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন কোনখান থেকে নিয়ে আসেন এক ফকির ও তার ফকিরনিকে। ফকিরনি গেয়ে শোনায়—
প্রেম করো মন প্রেমের মর্ম জেনে
প্রেম করা কি কথার কথা রে গুরু লহ চিনে।
চন্ডীদাস আর রজকিনী প্রেম করিত তারাই জানি
এক মরণে দু’জন ম’লো রে প্রেমপূর্ণ প্রাণে।
মুসলমানের মুখে চন্ডীদাস আর রজকিনির প্রেমের আদর্শ শুনে বিনু বিস্মিত হয়। কিন্তু তার জন্যে অপেক্ষা করছিল আরও বিস্ময়কর একটি পদ—
প্রেমের ডোরে আছেন বাঁধা
মহম্মদ আর আপনে খোদা।
বাকিটুকু মনে নেই। বাকে সাহেব গানটি তাঁর যন্ত্রে বাজিয়ে শোনান। মনসুরউদ্দিন সাহেব লিপিবদ্ধ করেন। বিনু বুঝতে পারে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের শ্রীক্ষেত্র বাংলার লোকগীতি। পরে শুনতে পায় চন্ডীদাস আর রজকিনির প্রেম নিয়ে ওই একই পদ অন্য এক জেলায় এক বৈষ্ণবীর কন্ঠে। প্রায় পাঁচশো বছর ধরে সেই প্রেমের কাহিনি বাংলার হিন্দু-মুসলমানকে এক ডোরে বেঁধে রেখেছে।
এক অশীতিপর বয়সি চাষি মুসলমান একদিন বিনুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে। তার হাতে এক বান্ডিল কাগজপত্র। পাঁচ বছর ধরে সরকারের বিভিন্ন অফিসারকে লেখা চিঠিপত্র। আত্রাই নদী থেকে খাল কেটে জল নিয়ে যায় গাঁয়ের কতক লোক তাদের জমিতে সেচের জন্যে। বর্ষাকালে নদীর প্লাবনের সময় সেই খাল দিয়ে ঢোকে কচুরিপানা। গ্রামকে গ্রাম ছেয়ে যায় কচুরিপানায়। ফসল নষ্ট করে সর্বসাধারণের। প্রতিকারের একমাত্র উপায় খালের মুখ বন্ধ করা ও তারপরে কচুরিপানা উচ্ছেদ করা। ষাটখানা গ্রামের লোক শ্রমদান করতে রাজি, কিন্তু খালের মুখ বন্ধ করতে গেলে সরকারের অনুমতি না নিলে নয়। সরকার শুনছেন না।
বিনু খবর নিয়ে জানতে পারে সরকারি নীতি হচ্ছে নদীনালার জলকে অবাধে বহতা রাখা, বাঁধ দেওয়া বারণ। বিনু জেলাশাসকের সঙ্গে দেখা করে। সবাই মিলে পরামর্শ করে এই স্থির হয় যে, বেসরকারিভাবে বাঁধ বাঁধার সময় লোহার কপাট বসাতে হবে। সেটা মাঝে মাঝে খুলে দেওয়া হবে, তারপর বন্ধ করে দেওয়া হবে। দায়িত্ব সরকারের নয়—গ্রামবাসীদের। জেলাশাসক তাঁর দাতব্য তহবিল থেকে কিছু টাকা দেন। স্লুইস গেট কেনা হয়। এইবার আস্তান মোল্লা দেখিয়ে দেয় তার কেরামত। ষাটখানা গাঁয়ের হাজার হাজার মরদ এসে শ্রমদান করে বাঁধ বাঁধে। স্লুইস গেট বসানো হয়। এরপরে সবাই মিলে কচুরিপানা উচ্ছেদ করে। স্থানীয় নেতৃত্বে পল্লির জনগণ কীই-না সাধন করতে পারে। তবে সরকারকেও দরদি হতে হয়।
এইসব পরীক্ষানিরীক্ষার ফলে বিনুর প্রত্যয় দৃঢ় হল যে সদাশয় রাজপ্রতিনিধিরা উপর থেকে তাঁদের আদর্শ চাপিয়ে দিতে গেলে সাড়া পান না। কিন্তু উদ্যোগটা যদি তলা থেকে আসে আর লোকে শ্রমদানে অগ্রসর হয় তবে সরকারের সামান্য অনুদানেও আশ্চর্য সাড়া পাওয়া যায়। সেন্ট্রাল হাই স্কুলের আইডিয়াটা জেলাশাসকের। কালচার আর এগ্রিকালচারের সংযোজনটা মহকুমাশাসকের। দুটোই উপর থেকে চাপানো। ওঁরা যেই বদলি হয়ে গেলেন, ওঁদের স্থাপিত প্রতিষ্ঠান কায়েমি স্বার্থের প্রতিরোধে অকর্মক হয়।
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার, বদলি হতে হতে বিনু যখন অন্য এক জেলার শাসক তখন তার লঞ্চের সহযাত্রী বাংলার গভর্নরের শাসন পরিষদের সদস্য খাজা স্যার নাজিমউদ্দিন খানা টেবিলে বসে অযাচিতভাবে তাকে বলেন, সরকার তার সেই স্কুলের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। ততদিনে বিনুর মন উঠে গেছে। সে নির্বিকার।
এর চেয়েও আশ্চর্য ঘটনা ঘটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে মুজিব সরকারের নিমন্ত্রণে বিনু যখন ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে ঢাকায় যায়। খানা টেবিলে বসে শিক্ষাসচিব তাকে বলেন তার সেই কৃষিশিক্ষাসংযুক্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের আইডিয়া নতুন সরকার গ্রহণ করেছেন। বিনু অভিভূত হয়। সময়ের ব্যবধান ১৯৩২ থেকে ১৯৭৫—তেতাল্লিশ বছর। ব্যক্তির জীবনে খুব বেশি, জাতির জীবনে খুব বেশি নয়।
স্রষ্টা বিনুর সঙ্গে ছিল দ্রষ্টা বিনু। তার কাজ জীবনের বিভিন্ন ও বিচিত্র দিক নিরীক্ষণ করা। আইসিএস তাকে যত বেশি সুযোগ দিয়েছিল তত বেশি বোধহয় আর কোনো জীবিকা দিত না। তবু তার মনে একটা অতৃপ্তি ছিল। সে আরও কত কী দেখতে চায়, দেখতে পাচ্ছে না। আরও কত কী করতে চায়, করতে পারছে না। ইউরোপের সেই দু-বছর তো আর ফিরে আসবে না। তার প্রভাব বিনুকে আচ্ছন্ন করেছিল। সে যেখানেই বদলি হোক-না কেন, তার ইউরোপীয় স্মৃতি তার সঙ্গে সঙ্গে যায়, তার উপন্যাসকে রস ও রসদ জোগায়। ঠিক সেইরকম অভিজ্ঞতা বাংলার মফস্সলে হবার নয়, বিনু তাই অতৃপ্ত। অথচ যা দেখছে, যা শিখছে তাও তো তাকে ভরিয়ে তুলছে। কে জানে হয়তো সাহিত্যের পাথেয় হবে। সে কী লিখবে তা বেছে নিতে পারে, কিন্তু কোথায় বদলি হবে, কী দেখবে, কী করবে তা বেছে নিতে অপারগ।
দিনমান মামলামোকদ্দমা করা পছন্দ নয়; মনে হয় সময়ের অপচয়, জীবনের ক্ষতি। কিন্তু সেই সূত্রে কতরকম চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। যারা খারাপ তাদের মধ্যেও কিছু সদগুণ আছে। যেমন দস্যু রত্নাকরের মধ্যে বাল্মীকির কবিপ্রতিভা। বিনুকে জেলখানা পরিদর্শনেও যেতে হত। কষ্ট হত কয়েদিদের দেখে। দন্ডভোগ করে যারা মুক্তি পেত তারা কাজ না পেয়ে আবার ফিরে যেত। কী দুভার্গ্য!
বিনুর জ্বলন
দেশে ফিরে আসার পরেও বিনুর অন্তরে বিশেষ একপ্রকার জ্বলন, যা সে বয়ে নিয়ে এসেছিল প্রবাস থেকে। পারিবারিক জীবনে সে যতদূর সুখী হতে পারা যায় ততদূর সুখী। চাকরিতে কেউ কোনোদিন সুখী হয়নি, সেও নয়; কিন্তু মোটের উপর ভালোই লাগছিল তার। সামান্য হলেও লোকের কিঞ্চিৎ হিতসাধন করতে পারছিল। আর তার সাহিত্যের কাজ ব্যাহত হলেও বন্ধ ছিল না। বই প্রতিবছরই বার হচ্ছিল।
যে আগুন সূর্য তারকায় জ্বলছে সে আগুন বিনুর অন্তরেও জ্বলছিল, নইলে তার সৃষ্টিকর্ম থেমে যেত। কিন্তু এ জ্বলন যে সৃজনের জ্বালা নয়। এটা একজন স্রষ্টার নয়, একজন চিন্তাশীল মানুষের। সে ভারতে বাস করলেও তার নিশ্বাসবায়ু আসছে দিগদিগন্ত থেকে। তার চক্ষের আলোও সারা আকাশ থেকে।
আধুনিক যুগের সমস্যাগুলো এক দেশে নিবদ্ধ নয়। কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। বিলেত থেকে আসার আগেই সে জানতে পেরেছিল ডিপ্রেশন বা মন্দা শুরু হয়ে গেছে। তার বান্ধবী একদিন বলেন খরচ না কমালে নয়, তাই সাপ্তাহিক স্পেকটেটর পত্রিকার চাঁদা বন্ধ করতে হচ্ছে। মন্দা ক্রমে ক্রমে ভারতের বাজারে এসে হাজির হয়। পাটের দাম পড়ে যায়। প্রজারা জমিদারের খাজনা দিতে গাফিলতি করে। জমিদাররা সরকারের রেভিনিউ দিতে কসুর করেন। একদিন সরকার থেকে নির্দেশ আসে কর্মচারীদের মাইনের শতকরা দশ ভাগ কাটা যাবে; জেলাশাসকেরও, বিনুরও।
জেলাশাসক বিনুকে বলেন, ‘আমাকে দেখছি পাইপ টানা ছাড়তে হবে। তামাক কেনার টাকা ছাড়া আর কিছু ছাঁটাই করতে পারছিনে।’
তিনিও বিবাহিত ও সসন্তান। একজন ইংরেজেরই এই দশা। বিনুও বিবাহিত, তবে তখনও পিতা হয়নি। এমনিতেই টান পড়ছে ভাইকে বিদেশে সাহায্য করতে গিয়ে। মীরা নিজেই রাঁধে, তাকে জোগান দেয় গাঁজা সোসাইটির দেওয়া একটি পিয়োন। নাম সুখলাল। ধুতি পরে, চেহারাও হিন্দুর মতো। দাড়ি নেই। কে বলবে সে মুসলমান? এ তথ্য জানতে বিনুর দেড় বছর লাগল। অন্য এক মহকুমার চাপরাশি বাদলের বেলাও তাই। এসব নাম হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই।
মন্দার দ্বারা আক্রান্ত জার্মানিতে দেখতে দেখতে ষাট লক্ষ শ্রমিক বেকার হয়। সোশ্যাল ডেমক্র্যাট সরকারের পতন ঘটে। ঘটায় ডান দিক থেকে নাতসিরা, বামদিক থেকে কমিউনিস্টরা একযোগে। কিন্তু ক্ষমতায় আসে কেবল নাতসিরাই। কমিউনিস্টরা পালিয়ে বাঁচে। বিনু এ খবর পেয়ে বিচলিত হয়।
ডেমোক্রেসি জার্মানিতে ধোপে টিকল না। সোশ্যালিজম এখন ন্যাশনাল সোশ্যালিজম মূর্তি ধরে এল। রাশিয়ার মতো জার্মানিতেও ডিক্টেটরশিপ। অথচ প্রোলেতারিয়ান নয়। তবে তাদেরও সায় আছে। সৈন্যসংখ্যা বহুত বাড়িয়ে দেওয়ায় বেকারসংখ্যা কমেছে। যুদ্ধোপকরণ নির্মাণের জন্যে কলকারখানা দিনরাত ব্যাপৃত, তাই শ্রমিকদেরও অনেকের বেকার দশা ঘুচেছে। রাস্তা তৈরি হচ্ছে বিরাট আকারে। তাতেও বিস্তর শ্রমিকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। হিটলারি দাওয়াইয়ে মন্দার চিকিৎসা সেটা মন্দ হলেও মন্দের ভালো—বুদ্ধিজীবীদের অনেকের ধারণা।
বিনু তো বিকল্প সমাধান বাতলাতে পারছে না। তাই মনে মনে জ্বলছে। ওদিকে স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকারকে গদিচ্যুত করার জন্যেও দেশের ফ্যাসিস্টরা সংগ্রামরত। ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ থেকে গণতন্ত্রের পক্ষপাতীরা সে-দেশে লড়তে যাচ্ছেন। গিয়ে দেখছেন কমিউনিস্টরাও নানা দেশ থেকে সমাগত, বিশেষ করে রাশিয়া থেকে। মিলেমিশে লড়লে ফ্যাসিস্টদের হারিয়ে দিতে পারা যেত। কিন্তু গণতন্ত্রীদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের বিরোধ বাঁধে। মাঝখান থেকে ফ্যাসিস্টদের জিত। আরও এক ডিক্টেটরশিপ। বিনুর আরও কষ্ট হয়।
মুসোলিনির দম্ভের সীমা নেই। তিনি আবিসিনিয়া জয় করে তাঁর ফ্যাসিস্ট শক্তি বর্ধন করবেন। বিনু ভেবেছিল ইংরেজ আর ফরাসিরা বাধা দেবে। কেউ যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে চান না। মিউনিখে হিটলারের পায়ে চেকদের বলি দিলেন চেম্বারলেন ও দালাদিয়ের। বিনু চেকদের জন্যে বিষাদ বোধ করে। ইংরেজ ও ফরাসিদের ধিক্কার দেয়।
জার্মানরা এক এক ধাপ করে যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে এটা তো বেশ স্পষ্ট। কিন্তু তারা যদি সোভিয়েট ইউনিয়নের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মিত্র হবে কারা? মিউনিখের ভীত ইংরেজ ফরাসি নেতারা? সোভিয়েটকে সাহায্য করা মানে তো কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের জিতিয়ে দেওয়া। কে তেমন সিদ্ধান্ত নেবে?
অপরপক্ষে নাতসিদের জিততে দেওয়াও বিপজ্জনক। পূর্বে নিষ্কণ্টক হয়ে ওরা পশ্চিমের উপর চড়াও হবে। কে তেমন ঝুঁকি নেবে? ইংরেজ ফরাসিরা শঙ্কিত। রম্যাঁ রল্যাঁ গত মহাযুদ্ধে শান্তিবাদী ছিলেন। এবার তিনি নাতসিদের আক্রমণ থেকে শ্রমিকদের রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্যে অস্ত্রধারণের পক্ষপাতী। কমিউনিস্টরা মানবের মঙ্গলের জন্যে অনেক কিছু করেছে ও করবে, নাতসিরা দানব।
বিনু এই ধাঁধার জবাব খুঁজে পায় না। সে ডিক্টেটরশিপের বিরোধী। তবে ফ্যাসিস্ট ও কমিউনিস্ট এই দুই মতবাদের মধ্যে দ্বিতীয়টাই ভালো। সে রল্যাঁর সঙ্গে একমত। কিন্তু স্টালিন যেভাবে বিচারের প্রহসন করে তাঁর নিজের দলের অন্যান্য নেতাদের নিধন ঘটালেন তা বিনু সমর্থন করেনি। সেটাও তার অন্তরের জ্বলনে ইন্ধন জুগিয়েছে। কমিউনিজমের উপরে আর শ্রদ্ধা তার আগের মতো নয়। এ-রকম চলতে থাকলে কমিউনিস্টদেরও পতন হবে।
অদ্ভুত ব্যাপার, জ্বলনের সঙ্গে সঙ্গে ছিল একপ্রকার অসুখ। ইংরেজিতে যাকে বলে malaise। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে বলেন তার কিছুই হয়নি, সে সম্পূর্ণ সুস্থ। সরকারি কাজকর্ম ঠিকমতো করে। সাহিত্যের কাজও। অতএব মানসিক অসুখ নয়। নিয়মিত টেনিস খেলে অতএব কায়িক অসুখ নয়। কিন্তু বিনু জানে ওটা অসুখ। ওর মূলে আবার এক মহাযুদ্ধের আশঙ্কা আর সভ্যতার বিলোপ। বর্বরতার দিকে উভয় পক্ষেরই গতি। যারা জিতবে তারাও হিংস্রতার শরণ নেবে।
ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার রোগই হল অনিয়ন্ত্রিত উৎপাদন ও বণ্টন। তার ফলে সমাজের একটা বৃহৎ অংশের দুর্ভোগ। এরা হয় বেকার, নয় বঞ্চিত, নয় মজুরি-দাস। সমাজতন্ত্র এদের জন্যে আশার বাণী বহন করে এনেছে, কিন্তু তার অর্থ কি এই যে সেই বৃহৎ অংশটা সর্বেসর্বা হয়ে সমাজের উপর চিরকাল কর্তৃত্ব করবে? অন্যেরা তা মাথা পেতে নেবে? বিদ্রোহ করবে না? গৃহযুদ্ধ বাঁধবে না? কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তারাও হতে চায় সর্বেসর্বা, অপরের উপর ডিক্টেটর। ধনতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্রের হুংকারে গণতন্ত্রের কন্ঠস্বর শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা গণতন্ত্র সকলের সবার্থসাধক নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থসিদ্ধির জন্যে কল্পিত।
বিনুকে সত্যের খাতিরে স্বীকার করতে হচ্ছে যে আধুনিক যুগে সকলে ভোট দেবার অধিকারী হলেও সব প্রতিনিধি সরকার গঠন করেন না। যাঁরা অধিকাংশের আস্থাভাজন তাঁরাই সরকার গঠন করেন। অন্যেরা হন বিরোধী পক্ষ। সরকার পক্ষ আস্থা হারালে বিরোধী পক্ষ তাঁদের স্থান নেন। নির্বাচনের সূত্রে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে। সাধারণত চার-পাঁচ বছর অন্তর। কিন্তু ডিক্টেটরশিপের বেলা তেমন কোনো সময়সীমা বা দ্বিপাক্ষিকতা নেই। নির্বাচন সূত্রে আস্থানির্ণয়ও নেই। জোর যার মুলুক তার। সরকারের পেছনে দেশের অধিকাংশ লোক আছে কি না তার প্রমাণ নেই। জোর সেক্ষেত্রে ভোটের জোর নয়, জোটের জোর; কিংবা গায়ের জোর।
গণতন্ত্র বিভিন্ন দলকে শাসনের সুযোগ দেয়। কিন্তু দল যদি শ্রেণির বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে গঠিত হয় তা হলে বিপক্ষের বিপত্তি। সেই বিপত্তির ব্যাখ্যা ওদেশে কমিউনিজম, এদেশে কমিউন্যালিজম। দলপতিরা ক্ষমতা হাতে পেলে নিজেদের শ্রেণির বা সম্প্রদায়ের স্বার্থকেই দেশের বা জাতির স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেবেন। গণতন্ত্রের কাঠামোর ভিতরে থেকেও দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
ভারতের মাটিতে পঞ্চায়েতি গণতন্ত্রের শিকড় ছিল, কিন্তু পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ঐতিহ্য ছিল না। সেটা ব্রিটিশ শাসনের প্রবর্তন। বিনুর বিশ্বাস স্বাধীনতার পর সংবিধান প্রণয়নের সময় যখন আসবে তখন দু-রকম গণতন্ত্রের সমাহার করতে পারা যাবে। কিন্তু শ্রেণির বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে নয়। তা না হলে ভারত ভাগ হয়ে যেতে পারে। বহু শতাব্দী পরে ভারত এক-শাসনাধীন হয়েছে। সেটা পরাধীনতা। তার অবসান হোক। কিন্তু তার সুফল যেন অটুট থেকে যায়। দেশ যেন বলকান না হয়, তুরস্কের অধীনতার শেষে ইউরোপে যা হয়েছে।
বিনুর উপরওয়ালা ইউরোপীয় জেলা জজ তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘প্রাদেশিকতার থেকে সাবধান। খ্রিস্টেনডমকে ভেঙে যেতে দিয়ে আমাদের কী পরিণাম হয়েছে দেখছেন তো। একরাশ নেশন স্টেট, নিত্য কলহ, বার বার যুদ্ধ।’ তার বক্তব্য সমর্থন করেন ইংরেজ কমিশনার। এঁরা ভারতের হিতৈষী। সম্প্রতি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হয়েছে, প্রাদেশিকতার বিষময় ফল মধ্যপ্রদেশে দেখা যাচ্ছে। সেখানে মারাঠিভাষী ও হিন্দিভাষী কংগ্রেস মন্ত্রীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, হাইকমাণ্ডের হস্তক্ষেপ।
ছুটি নিয়ে বিনু সপরিবারে বোম্বাই যায়, সেখান থেকে আরও কয়েকটি জায়গা ঘুরে মাদ্রাজ, সেখান থেকে জাহাজে সিংহল, রেলপথে আবার মাদ্রাজ হয়ে কোচিন। বোম্বাইতে দেখে মারাঠি ও গুজরাতির বিরোধ। মাদ্রাজে তামিল তেলুগুর বিবাদ। সর্বত্র ভাষাভিত্তিক প্রাদেশিকতার কলহ। ভারতীয়রা একটা নেশন—এ বোধ দুর্বল। এক সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই। এ ছাড়া তো মুসলমান খ্রিস্টান আছে।
সুদীর্ঘকাল অহিংস সংগ্রাম চালাবার পর কংগ্রেস যখন নির্বাচনে জিতে বেশিরভাগ প্রদেশে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে তখন আইনের অক্ষর মেনে নিয়ে একজন বা দুজন করে মুসলিম মন্ত্রী করা হয় কংগ্রেস থেকেই। অথবা নির্দলীয় একজনকে। আইনের স্পিরিট মানলে মুসলিম লিগ থেকে মন্ত্রী নিতে হত। কারণ আইনসভাগুলির অধিকাংশ মুসলিম সদস্যই লিগপন্থী। ব্যতিক্রম উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ। এতে জিন্না সাহেব খেপে যান। তাঁর দলটিও রুষ্ট। লিগই নাকি গোটা মুসলিম সম্প্রদায়ের একমাত্র প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠান। কংগ্রেস এটা স্বীকার করে না। দুই দলের মধ্যে সন্ধি অসাধ্য হয়। বিগ্রহই সুনিশ্চিত।
কংগ্রেসের ভিতরেই দেখা গেল দক্ষিণপন্থী বনাম বামপন্থী নামক দুই উপদলের দ্বন্দ্ব। কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনে বামপন্থীরা সুভাষচন্দ্রকে অধিকাংশ ভোটে জিতিয়ে দেয়।
আসলে তা কংগ্রেস হাই কমাণ্ডের উপর অনাস্থাজ্ঞাপন। কংগ্রেস সভাপতি হলেও সুভাষচন্দ্র হাইকমাণ্ডের একজন ছিলেন না। হাই কমাণ্ড তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করেই প্রাদেশিক মন্ত্রীদের পরিচালনা করতেন। দ্বিতীয়বার সভাপতি হয়ে সুভাষচন্দ্র ওয়ার্কিং কমিটিকে ঢেলে সাজাতেন, হাই কমাণ্ডেরও অধিনায়ক হতেন। দক্ষিণপন্থীদেরও ওয়ার্কিং কমিটিতে নিতেন, হাই কমাণ্ডেও রাখতেন। কিন্তু তাঁদের পরাজয়ের গ্লানি মুছত না। তাঁরা সদলবলে ফিরে না এলে সহযোগিতা করতে অসম্মত হন। শুধুমাত্র বামপন্থীদের নিয়ে ওয়ার্কিং কমিটি গড়তে সুভাষচন্দ্রও অনিচ্ছুক। তিনি গদিত্যাগ করেন। রাজেন্দ্রপ্রসাদকে সভাপতি করা হয়। তাঁর নির্দেশ অমান্য করেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র। গান্ধীজি কংগ্রেসের ঐক্য বজায় রাখার জন্য সুভাষচন্দ্রকে ছয় বছরের জন্যে বহিষ্কার করার পরামর্শ দেন। সুভাষচন্দ্র নিজের দল গড়েন।
এরপরে যুদ্ধের ইসুতে কংগ্রেস মন্ত্রীরা ইস্তফা দেন। হাই কমাণ্ডের পরিচালনের ক্ষমতা যায়। গোটা যুদ্ধকালটা কংগ্রেস শাসনক্ষমতাহীনভাবে কাটায়। মুসলিম লিগ দেখে কংগ্রেস শাসনের শূন্যতা পূরণ করল গভর্নরের শাসন। কেন্দ্রেও একদিন কংগ্রেস মন্ত্রীরা পদত্যাগ করলে তাঁদের শূন্যতা পূরণ করবেন রাজপুরুষগণ। কংগ্রেসরাজের বিকল্প ব্রিটিশরাজ। ব্রিটিশরাজের বিকল্প কংগ্রেসরাজ। তা হলে মুসলিম লিগের ভবিষ্যৎ কী? এর উত্তর পাকিস্তান অর্জন। সন্ধিসূত্রে না হলে বিগ্রহসূত্রে।
বিনু উপলব্ধি করে মহাযুদ্ধের পরে বাঁধবে গৃহযুদ্ধ। তার থেকে পরিত্রাণের উপায় কি ব্রিটিশ শাসনের চিরস্থায়িত্ব? না। অন্তঃপরিবর্তন—হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের। সর্বস্তরে ও সর্বত্র উভয়ের কোয়ালিশন। কংগ্রেসই সর্বভারতের একমাত্র প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠান নয়। মুসলিম লিগ সর্ব মুসলমানের একমাত্র প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠান নয়। ব্রিটিশরাজের শূন্যতা পূরণ কোনো একটি দলের একান্ত সাধ্য নয়, না কেন্দ্রের না প্রদেশের। কিন্তু পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা হলে কোয়ালিশনের সাধ্য।
কোয়ালিশন গভর্নমেন্টের অপর নাম ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট। ওদেশে সেইরকম একটি গভর্নমেন্ট গঠিত হয়ে থাকে যুদ্ধকালে। এদেশেও হতে পারে। তা হলে ধরে নিতে হয় যে ভারতীয়রাও একটি নেশন। অথচ এ বিষয়ে তীব্র মতভেদ লক্ষ করা যাচ্ছে। হিন্দু মহাসভার মতে হিন্দুরাই নেশন। মুসলমানরা বহিরাগত বিদেশি অধিবাসী, রেসিডেন্ট এলিয়েন। মুসলিম লিগ বলছে মুসলমানরা আলাদা একটা নেশন। হিন্দু ও মুসলমান দুই নেশন। দুই নেশনের জন্যে চাই দুই কেন্দ্রীয় সরকার। এসব কথা শুনলে বিনুর বুক জ্বলে যায়। এসব সত্য হলে ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট কী করে সম্ভব!
যুদ্ধে যোগদান নিয়েও তীব্র মতভেদ। গান্ধীজি যুদ্ধে বিশ্বাস করেন না। তিনি স্বয়ং যুদ্ধে যোগ দেবেন না, কিন্তু কংগ্রেস যদি দিতে চায় তিনি বাধা দেবেন না। কংগ্রেসের নেতারা যুদ্ধে যোগদানে রাজি হবেন যদি ব্রিটেন প্রতিশ্রুতি দেয় যে যুদ্ধের পরে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটবে ও আপাতত একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে। সুভাষচন্দ্র পান আগে স্বাধীনতা, তারপরে যুদ্ধে যোগ দেওয়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত। মুসলিম লিগ যেখানে ক্ষমতাসীন সেখানে সহযোগিতা করবে, অন্যত্র অসহযোগ, যদি-না স্বতন্ত্র বাসভূমির আশ্বাস পায়। এসব কথা শুনে বিনু অস্বস্তি বোধ করে। তাহলে কি যুদ্ধের প্রশ্নে একমত হওয়া একেবারেই অসম্ভব? ওদিকে ইংরেজরা তাদের নিজেদের দেশেই বিপন্ন। এসব দাবিদাওয়া সময়োচিত নয়।
তার আপনার মধ্যেও একটা মন্থন চলছিল। গত মহাযুদ্ধে ভারত ধন জন ও উপকরণ মুক্তহস্তে জোগায়। লক্ষ লক্ষ জোয়ান প্রাণ দেয়। খেতে না পেয়ে কত লোক মারা যায়। বিনুকেও আধপেটা খেতে হয়। পরিবর্তে ভারত যা লাভ করে তা ব্রিটিশ কর্তাদের কথার খেলাপ। তাই অসহযোগ আন্দোলনে নামতে হয়। এবারেও কি কথার খেলাপ হবে না? ব্রিটিশ কর্তাদের বিশ্বাস কী? অথচ ওদিকে যুদ্ধবাজ জার্মানদের রুখবে কে? ভারত থেকে সিপাহি না গেলে একা ইংরেজ সেনার সাধ্য নয়। নাতসিদের রুখতে না পারলে ওরা তো ইউরোপ জয় করবেই, এশিয়ার দিকেও অগ্রসর হবে। ভারতও বিপন্ন হতে পারে। গান্ধীজি অবশ্য অকুতোভয়। হিংসা যত বলবান হোক-না কেন অহিংসা তার চেয়েও বলবান। বল পরীক্ষার জন্যে তিনি প্রস্তুত। কিন্তু সেকথা কি দেশবাসীদের বলা সাজে! হিটলার আকাশ থেকে নামলে ওরা কি লড়বে না পায়ে পড়বে?
আচমকা জার্মান-সোভিয়েট চুক্তির খবর শুনে বিনু ঘাবড়ে যায়। তার মানে কি এই যে জার্মানরা পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ করুক, পূর্ব ফ্রন্টে নয়? এদেশের হিটলার বিরোধীরা এতদিন স্টালিনের উপর ভরসা রেখেছিলেন। আর কেউ না রুখুন স্টালিন রুখবেন। বিনুও তাঁদের একজন। কিন্তু এমনও হতে পারে যে, যা শত্রু পরে পরে। যুদ্ধে মরুক ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান। অক্ষত থাকুক সোভিয়েট জনগণ। কিন্তু পরে দেখা গেল জার্মানরা ফরাসিদের হারিয়ে দেবার পর রাশিয়ানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের মতলবের খবর স্টালিনকে জানিয়েছেন চার্চিল। চার্চিল ও স্টালিন একদিল। আগের বারের মতো আমেরিকাও জার্মানদের বিপরীত শিবিরে, অথচ ইটালি ও জাপান আগেরবারের মতো নয়, এবার তারা শিবির পরিবর্তন করেছে। তুরস্ক হয়েছে নিরপেক্ষ। জার্মানরা ইংল্যাণ্ড আক্রমণ করে শুধু বিমান থেকে বোমা ফেলে ক্ষতি যা করবার তা করেছে। যাঁরা বলতেন ইংল্যাণ্ডের দুর্যোগই ভারতের সুযোগ, তাঁদের থিসিস ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়। আর ভারতের কমিউনিস্টরা সোভিয়েট ইউনিয়নের মিত্রদের ভারতের মিত্র বলে তাদেরই পক্ষ অবলম্বন করে। বামপন্থীরা পরস্পরের বৈরী হয়। আর দক্ষিণপন্থীরা তো সত্যাগ্রহে নেমে কারাগারে।
বিনু যখন দেশে ফিরে এসে চাকরিতে নিযুক্ত হয় তখনই তার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাকে কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমরা চলে গেলে জাপান এসে ভারত দখল করবে। তখন তাকে রুখবে কারা? ভারতের সৈন্যবল থাকলে তো। সুতরাং এখন থেকেই স্বাধীনতা চাওয়া উচিত নয়।’ বিনুর তখন বিশ্বাস হয়নি যে জাপান সত্যি সত্যি এতদূর আসবে, এত শক্তিশালী হবে। কিন্তু তেরো বছর যেতে-না-যেতেই জাপান এসে বর্মা দখল করে ফেলেছে। বর্মা তো ভারতেরই অঙ্গ ছিল। এখন স্বতন্ত্র হলেও ভারতের পূর্ব দুয়ার। বর্মার পরে পূর্ববঙ্গ ও অসম।
সে-সময় পূর্ববঙ্গে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পদে বহাল থাকলে বিনুকে জাপানিদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হত যদি তারা ঢুকত। ভাগ্যক্রমে সে পশ্চিমবঙ্গে জেলা জজ। তাকে একটি গোপন সার্কুলারে জানানো হয় যে জাপানিরা যদি আসে তবে সে প্রয়োজনীয় বন্দোবস্ত করে বিহারে চলে যেতে পারে। বিহারে তার এক বন্ধু কর্মরত ছিলেন। তিনি পরে তাকে বলেন গোটা বেঙ্গল গভর্নমেন্টটাই বিহারে আশ্রয় নিত। টেলিগ্রাম যেত—বেঙ্গল কামিং। দুজন ইউরোপীয় মিলিটারি অফিসারের সঙ্গে বিনুর আলাপ হয়েছিল। তাঁরাও বলেছিলেন যে তাঁরা পিছু হটতে হটতে রাঁচি পর্যন্ত যাবেন ও সেইখানে লাইন টানবেন।
কলকাতায় ব্ল্যাক আউট। বোমার ভয়। বহু লোক মফস্সলে নিরাপত্তার জন্যে সমাগত। কিন্তু মফস্সলটাও যদি জাপানিদের দখলে চলে যায় তবে নিরাপত্তা কোথায়, অধীনতা বরণ করে? সেই অগ্নিপরীক্ষার সময় কংগ্রেসি বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ক্রিপস উড়ে আসেন যে প্রস্তাব নিয়ে তা স্বাধীনতার খুব কাছাকাছি। কিন্তু জাপান যদি সত্যি সত্যি এগিয়ে আসত তা হলে ইংরেজরা পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে রেললাইন, নদীর পুল, কলকারখানা, লোহার খনি প্রভৃতি ধ্বংস করে দিয়ে পিছু হটত। ইতিমধ্যেই নৌকা আটক করায় খাদ্য চলাচল বাধা পেয়েছিল। ইংরেজ সেনাপতিরা বলতেন এটা মিলিটারি নেসেসিটি। কিন্তু এরজন্যে দেশের লোক নতুন কেন্দ্রীয় সরকারকেই দোষী করত। হয়তো জাপানিরা ভারতে ঢুকত না, ঢুকলেও বেশি দূর এগোতে পারত না। তবু বলা তো যায় না। কংগ্রেস নেতারা ইংরেজ সেনাপতিদের নিরস্ত করার অধিকার চান। ক্রিপস বলেন ব্রিটেনের মিলিটারি হাই কমাণ্ড ভারতেও যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে দায়ী। তাঁদের ক্ষমতা খর্ব করা চলবে না। আলোচনা ব্যর্থ হয়।
যুদ্ধকালে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো আশা নেই দেখে কংগ্রেস গান্ধীর নেতৃত্বে আবার সংগ্রামে নামে। এর নাম কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন। গান্ধীজিকে জেলের বাইরে থাকতে দিলে তিনি হয়তো জনগণকে হিংসা থেকে নিবৃত্ত করতে পারতেন, কিন্তু সরকার সে ঝুঁকি নেন না। হিংসা চরমে ওঠে, প্রতিহিংসাও চরমে। সিপাহিবিদ্রোহের পর এমন ঘাত-প্রতিঘাত ভারতের ইতিহাসে ঘটেনি। সরকার কংগ্রেসকে হিংসার জন্যে দায়ী করেন। গান্ধীজি সরকারকে আরও বড়ো হিংসার জন্যে দায়ী করেন। মুসলিম লিগ আন্দোলনে অংশ নেয়নি। জিন্না মুসলমানদের তফাতে রাখেন। ওটা নাকি হিন্দু রাজত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম। ইংরেজরা ভারত ছাড়লে যা হবে তা নাকি মুসলমানদের মনিব বদল। তাই গান্ধীজি যখন বলেন কুইট ইন্ডিয়া, জিন্না সাহেব জুড়ে দেন ডিভাইড অ্যাণ্ড কুইট। ভাগ করো আর ত্যাগ করো। ডিভাইড অ্যাণ্ড রুল পলিসির পরিণাম।
বিনু মনে মনে গান্ধীজির পক্ষে, কিন্তু তিনি যখন বলেন, কুইট ইন্ডিয়া টু গড অর অ্যানার্কি, বিনু সায় দিতে নারাজ হয়। ভগবানই-বা শূন্যতা পূরণ করবেন কোন উপায়ে যদি রাজনৈতিক দলগুলি একজোট না হয়? আর অরাজকতার হাতে দেশকে সঁপে দিলে জজ ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশকে মানবে কে? সৈন্যরাই-বা কার হুকুমে গুলি চালাবে? বাপু আশা করেন পনেরো দিনের মধ্যেই একটা নতুন সরকার গড়ে উঠবে। সম্ভবত কংগ্রেস-লিগ কোয়ালিশন সরকার। বিনুর বিশ্বাস হয় না যে প্রত্যেকটি প্রদেশে কোয়ালিশন না হলে কেবলমাত্র কেন্দ্রেই কোয়ালিশন হবে। না, অরাজকতা একদিনের জন্যেও নয়। চোর ডাকাত ধর্ষক ঘাতক জেল থেকে ছাড়া পেলে কী সর্বনাশ ঘটায় বর্মা থেকে চলে আসা এক বাঙালি অফিসার বিনুকে তার বিবরণ শোনান। ইংরেজরা জাপানিদের আসার আগে তাঁর হাতে ক্ষমতা সঁপে শহর ছাড়েন। তিনিও জাপানি অধিকর্তার হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে বিদায় নেন তিনদিন বাদে। মাঝখানের সেই তিনটি দিন তাঁর আয়ত্তের বাইরে। জেলখানা থেকে বেরিয়ে পড়ে দীর্ঘমেয়াদি কয়েদিরা। হাতে রকমারি হাতিয়ার, লুঠতরাজ, খুনজখম, ধর্ষণ ইত্যাদির অবাধ মওকা। পুলিশ বেপাত্তা। লোকে বলে এর চেয়ে জাপানি রাজত্ব ভালো। জাপানি সেনা পায় গণসংবর্ধনা।
ত্রিশের দশকের ইউরোপীয় ঘটনাবলি রবীন্দ্রনাথকে হতাশ করেছিল। ইউরোপীয় সভ্যতা সম্বন্ধে তাঁর মোহভঙ্গ হয়েছিল। বিনুও উপলব্ধি করেছিল যে ইউরোপের কাছ থেকে চিন্তাজগতের নেতৃত্ব আশা করা বৃথা। প্রতীচ্য সভ্যতার দেউলিয়াপনা প্রকট। তা হলে কি প্রাচ্য সভ্যতার দিকে মুখ ফেরাতে হবে? প্রাচী বলতে জাপানও বোঝায়, চীনও। ওদের কান্ডকারখানা থেকে শেখবার কী আছে? জাপানিরা কী শেখাতে আসছে বর্মিদের, ভারতীয়দের?
বিনুর একমাত্র ভরসা এখন ভারত। ভারত বলতে গান্ধীজির আদর্শ, তাঁর নৈতিক নেতৃত্ব। সারা বিশ্বের চোখে তিনি অহিংসার প্রতিমূর্তি। কিন্তু তাঁর কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলনে হিংসার প্রাদুর্ভাব বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে তাঁর ভাবমূর্তিকে ম্লান করেছে। ইংরেজরা প্রচার করছে তিনি হিংসার সমর্থক। এটা খন্ডন করা দরকার। কিন্তু আগা খানের প্রাসাদে বন্দি অবস্থায় কী করে তা সম্ভব? তাই তিনি একুশ দিন অনশনের সংকল্প নিয়েছেন। সরকার তাঁকে ছেড়ে দিতে চাইলে তিনি বলেন বাইরে গেলে তিনি অনশন নাও করতে পারেন। তার মানে মুক্তকন্ঠে তাঁর বক্তব্য পেশ করবেন। তা শুনে সরকার তাঁকে ছাড় দেন না। তিনিও নাছোড়বান্দা। অনশনে ব্রতী হন।
বিনু ও মীরা কাউকে না জানিয়ে অনশন করে কিন্তু তিন দিনের বেশি চালাতে পারে না। আদালতে না বসার জন্যে বিনুকে জবাবদিহি করতে বলা হলে সে জানায় সে তার এক প্রিয়জনের জন্যে অনশন করেছিল। প্রিয়জনের নাম উল্লেখ করে না বলে তাকে সেই তিন দিনের জন্যে ছুটি নিতে বাধ্য করা হয়। সরকার তখন গান্ধীজির সম্ভবপর সৎকারের জন্যে সচেষ্ট। তার সহযোগী জেলাশাসক একজন মুসলমান। তিনি তাকে জানান যে গান্ধীজির মৃত্যু হলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হবে তা সামাল দিতে তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিনু তখন জেলা জজ। সেও যেন প্রস্তুত থাকে।
গান্ধীজি সে-যাত্রা বেঁচে যান। চার্চিল ব্যাখ্যা করেন তিনি নাকি জল খাওয়ার সময় পুষ্টিকর পদার্থ খেয়েছেন। আসলে যা খেয়েছেন তা লেবুরস। যাতে বমন রোধ হয়। তিনি যে একুশ দিন অনশন করেও বেঁচে রইলেন এতে প্রমাণ হল তাঁর নির্দোষিতা। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে লিকুইডেশনে না দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চার্চিলের বিচারে নয়। বিনুর এক বন্ধুকে বাংলার লাটসাহেব হার্বার্ট বলেন, ‘মিস্টার চার্চিল ইজ নট ইংল্যাণ্ড।’
স্রোতের মাঝখানে ঘোড়াবদল করতে নেই। ইংরেজদের বক্তব্য আগে তো যুদ্ধ শেষ হোক, তারপর ভারতের সঙ্গে মীমাংসা হবে। আর ভারত বলতে শুধু হিন্দু নয় বা শুধু কংগ্রেস নয়। তার মানে মুসলমানদের সঙ্গে বা মুসলিম লিগের সঙ্গেও মীমাংসা করতে হবে। ইংরেজরা আশা করে এমন একটা মীমাংসাসূত্র মিলে যাবে যেটা ইংরেজ, কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের গ্রহণযোগ্য হবে। শান্তিপূর্ণভাবেই ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটবে। বিনু ইংরেজদের মনোভাবে একটা পরিবর্তন লক্ষ করছিল। জাপানিদের হাতে বর্মায় ও মালয়ে বন্দি হওয়ার ফলে তাদের প্রেস্টিজ হানি হয়েছিল। পরে অবশ্য জাপানিরা হটে যায় ও ইংরেজরা ফিরে পায়। তবে তারা ভারতীয়দের চোখে অপরাজেয় থাকে না।
তাদের বরাত ভালো। রাশিয়া দেয় জার্মানিকে হারিয়ে আর আমেরিকা জাপানকে। রুজভেল্ট আর স্টালিনের সমকক্ষ হন কিনা চার্চিল। তিনজনে মিলে ইউরোপ ভাগাভাগি করেন। জার্মানি দু-ভাগ হয়ে যায়। বিনু জার্মানদের ভালোবাসত, যদিও নাতসিদের নয়। জার্মানদের দশা দেখে তার মনে দুঃখ হয়। ওদিকে জাপানিদের উপর পারমাণবিক বোমা পড়েছে। হিরোশিমা ও নাগাসাকি ধ্বংস হয়েছে। নিরীহ বালবৃদ্ধবনিতা মরেছে বা মারাত্মক জখম হয়েছে। যদিও সেটা পার্ল হারবারের জন্যে শাস্তি তবু অমানবিক তো বটে। সভ্য মানবিক তো নয়ই, নৈতিকও নয়।
গান্ধীজি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এই যুদ্ধ শেষ হবে একটা মরাল ইসুতে। পারমাণবিক বোমার ব্যবহারই সেই মরাল ইসু। যুদ্ধ শেষ হল ঠিকই কিন্তু গ্লানি থেকে গেল যুদ্ধকালে অমানবিকতার। যে মূল্য দিয়ে জয় কেনা গেল সে মূল্য কি অত্যধিক নয়?
অথচ যুদ্ধ চলতে থাকুক এটাই-বা কে চেয়েছিল? সবাই শান্তির জন্যে অধীর। লোকক্ষয় তো বড়ো কম হয়নি। একটু একটু করে জানাজানি হয় হিটলারের আদেশে জার্মানরা ষাট লক্ষ ইহুদিকে গ্যাস চেম্বারে পুরে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরেছে। এমন কাজ যারা করে তারা কি মানব না দানব না শয়তান? বিনু ভেবে পায় না শত্রুতা কোন স্তরে নামলে মানুষ এমন কর্ম করতে পারে। তবে এরজন্যে গোটা জার্মান জাতিকে দায়ী করা যায় না। হাজার হোক ওরা গ্যেটে শিলার বাখ বেঠোফেন কান্ট হেগেলের জাতি।
যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে তার আভাস পেয়ে গান্ধীজি যান জিন্না সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। উদ্দেশ্য ভাইয়ে ভাইয়ে একটা ঘরোয়া মীমাংসা। কিন্তু সতেরো দিন একতরফা সাক্ষাতের পরও জিন্না সাহেবের সঙ্গে মত মেলে না। দুই ভাই নয়, দুই জাতি—যেমন জার্মান আর ফরাসি। মুসলমানদের দিতে হবে পাকিস্তান। নিজেরা রাখবে হিন্দুস্থান। ভারত একটা দেশ নয়, একটা উপমহাদেশ। উপমহাদেশে একাধিক নেশন থাকতে পারে। গান্ধীজি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। কংগ্রেসের হয়ে তিনি কথা দিতে পারেন না। সিদ্ধান্ত যা নেবার তা কংগ্রেস নেতারাই নেবেন, তিনি পরামর্শ দেবেন। তিনি বিশ্বাস করেন না যে মুসলমানরা ভারত ভাগের পক্ষে। তবে তিনি একথাও মানেন যে মুসলমানরা যদি একবাক্যে পাকিস্তান দাবি করে তা হলে তাদের বাধা দেবার শক্তি তাঁর নেই।
বিনু তার মুসলমান বন্ধুবান্ধব ও আলাপীদের মুখে দু-রকম কথা শোনে। একজন বলেন, ‘পাকিস্তান না গোরস্থান! মুসলমানের তাতে চূড়ান্ত ক্ষতি হবে।’ আরেকজন বলেন, ‘ব্রিটিশরাজের পর কংগ্রেসরাজ মানে হিন্দুরাজ। মুসলমান কখনো হিন্দু রাজত্বে বাস করতে রাজি হবে না।’ অন্যরা বলেন, ‘কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ মিলেমিশে রাজত্ব করলে তো ল্যাঠা চুকে যায়। ফিফটি ফিফটি।’
বিনুর ইচ্ছা করে একখানা বই লিখতে। ইংরেজিতে তার নাম হবে ‘আনরিয়ালিস্টস’, অর্থাৎ অবাস্তববাদীরা। সব মুসলমান পাকিস্তানে গিয়ে বসবাস করতে পারে না। সেটা অবাস্তব। সব হিন্দু পাকিস্তান থেকে চলে আসতে পারে না। সেটাও অবাস্তব। শতকরা সত্তর আর শতকরা বাইশ কখনো ফিফটি ফিফটি হয়ে সরকার চালাতে পারে না। সৈন্যদল গড়তে পারে না। সিভিল সার্ভিসও না। নেতারা যদি রাজি হন নেতৃত্ব হারাবেন। ওয়েটেজ মেনে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু প্যারিটি কখনো নয়।
তাহলে কি ব্রিটিশ রাজত্ব অনন্তকাল? না, তাও চলতে পারে না। যুদ্ধে ইংরেজরা জিতলেও নির্বাচনে চার্চিল হেরেছেন সদলবলে। লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ভারতবন্ধু। তিনি ব্রিটিশ রাজত্ব গুটিয়ে নিতে চান। বিনু যতদূর বুঝতে পারে সেটাই ব্রিটেনের অধিকাংশ মানুষের মত। ইংরেজদের যেটা প্রয়োজন সেটা বাণিজ্য। বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। যুদ্ধে তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পূরণ করতে হলে বাণিজ্যবিস্তার চাই, চাই সাম্রাজ্য সংকোচন। শুধু ভারত থেকে নয়, বর্মা থেকে, সিংহল থেকে, আরও অনেক দেশ থেকে সৈন্য অপসারণই ব্রিটিশ পলিসি। সৈন্যদের মোতায়েন করতে হবে পশ্চিম জার্মানিতে। সোভিয়েট ইউনিয়নের সৈন্যদের মুখোমুখি। তারা এখন পূর্ব জার্মানিতে জাঁকিয়ে বসেছে। যেকোনো দিন লাইন পার হতে পারে। ব্রিটেনের এত বেশি সৈন্য নেই যে একদিকে সোভিয়েটকে সামলাবে, আরেকদিকে সাম্রাজ্যকে। অ্যাটলি শুধু একজন আদর্শবাদী নন, তিনি একজন বাস্তববাদীও।
বিনু একদিন শুনতে পায় তার ইউরোপীয় সিভিলিয়ান সহযোগীরা ক্ষতিপূরণ পেলে ভারত ছাড়বার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন। মিশর থেকে ইংরেজরা যখন চলে যান তখন যে হারে ক্ষতিপূরণ পান সে হার নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। ক্ষতিপূরণ কি শুধু ইংরেজরাই পাবেন? ভারতীয়রা নয়? বিনুও কি পেতে পারে না? তা হলে তো তার চাকরিতে থাকার দরকার হয় না। ইংরেজদের ভারত ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেও চাকরি ছাড়বে। ক্ষতিপূরণ না পেলেও আনুপাতিক পেনশন তো এখন ভারতীয়রাও পেতে পারবে।
প্রতি তিন বছর অন্তর লম্বা ছুটি নিয়ে দেশে ঘুরে আসাই ব্রিটিশ অফিসারদের নিয়ম। কিন্তু যুদ্ধকালে এই নিয়ম কার্যকর হয় না। ফলে সবাই ছ-বছর ভারতে আটক থাকেন। কেউ কেউ সাত-আট বছর। এখন সবাই চান একই সময়ে ছুটি নিতে। তা তো সম্ভব নয়। অনেকেই চান ছুটির পর অবসর নিতে। যুদ্ধোত্তর ব্রিটেনে চাকরির বাজারে বহু জায়গা খালি ছিল। অবসর নিয়ে যাঁরা যাবেন তাঁরা ইচ্ছা করলে সহজেই চাকরি পেয়ে নতুন জীবন আরম্ভ করবেন। দেরি করলে সে সব পদ শূন্য থাকবে না। তাই ইউরোপীয় অফিসারদের মধ্যে একটা অধীরতা দেখা দিয়েছিল। তাঁরা ব্যগ্র হয়ে অপেক্ষা করছিলেন কবে তাঁদের ক্ষতিপূরণের দায় ব্রিটিশ তথা ভারত সরকার উভয়েই স্বীকার করবেন। ভারত সরকার মানে ভারতীয় রাজনীতিকদের সরকার। যার সদস্যদের মধ্যে থাকবেন কংগ্রেস, লিগ ও অন্যান্য দলের প্রতিনিধিরা। তেমন একটি সরকারের নাম ইন্টারিম গভর্নমেন্ট।
ইন্টারিম গভর্নমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে গঠিত হবে কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি। তার কাজ হবে নতুন সংবিধান রচনা। যে সংবিধান রচিত হবে তা ব্রিটিশ সরকার মেনে নেবেন। সেই অনুসারে ক্ষমতার হস্তান্তর হবে। ভারত যদি ইচ্ছা করে কমনওয়েলেথের ভিতরে থাকবে। নয়তো বাইরে যাবে।
কিন্তু সমস্ত নির্ভর করছে কংগ্রেস-লিগ ঐকমত্যের উপরে। মুসলিম লিগ যদি কংগ্রেসের প্রস্তাব নাকচ করে বা কংগ্রেস মুসলিম লিগের প্রস্তাব; তাহলে ব্রিটিশ সরকার কার হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর করবেন? ভগবানের বা অরাজকতার হাতে। তাহলে ক্ষতিপূরণ দেবে কে? পেনশনই-বা কার কাছ থেকে পাওয়া যাবে?
জিন্না সাহেবের দাবি হিন্দু-মুসলিম প্যারিটি। কংগ্রেস তাতে নারাজ। বড়োলাট লর্ড ওয়েভেলও কংগ্রেসকে বাধ্য করেন না। স্থির হয় হিন্দু প্রতিনিধিদের সংখ্যা হবে ছয়, মুসলিম প্রতিনিধিদের পাঁচ। জিন্না এর পরে দাবি করেন মুসলিম লিগই খ্রিস্টান ও পারসি প্রতিনিধি মনোনয়ন করবে। আর কংগ্রেস করবে শিখ প্রতিনিধি মনোনয়ন। বড়োলাট সেটা খারিজ করেন।
এরপর কংগ্রেস তার প্রাপ্য ছয়টি আসনের একটি একজন সংগ্রামী মুসলমানকে দিতে চায়। লিগের তাতে ঘোর আপত্তি। লিগই নাকি তামাম মুসলিম সম্প্রদায়ের একমাত্র প্রতিনিধিমূলক দল। বড়োলাট কংগ্রেস নেতাদের বিনীতভাবে অনুরোধ করেন তাঁদের জন্যে নির্দিষ্ট আসনের মধ্যে একজন মুসলমানকে না নিতে। তিনি স্বীকার করেন যে কংগ্রেসের সে অধিকার আছে। বড়োলাটের অনুরোধে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সম্মত হন। মওলানা আবুল কালাম আজাদ সরে দাঁড়ান। এমন সময় প্রবেশ করেন গান্ধীজি। বুঝতে পারেন যে এটা জিন্নার জেদের কাছে নতিস্বীকার। কংগ্রেসি মুসলমানরা স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়ে প্রচুর দুর্ভোগ সহ্য করেছেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশে তো তাঁরাই সরকার গঠন করেছেন। তাঁদের একজনকে নেওয়া কর্তব্য। নইলে কর্তব্যহানি। কংগ্রেস নেতারা গান্ধীজির কথায় বড়োলাটের অনুরোধ অগ্রাহ্য করেন।
বড়োলাটের তখন উভয়সংকট। কংগ্রেস যদি যোগ না দেয় তবে শাসন পরিষদের পুনর্গঠন বৃথা। অপরপক্ষে মুসলিম লিগ যদি যোগ না দেয় তা হলেও পুনর্গঠন বৃথা। দুই প্রধান দলকে দিয়ে মানিয়ে নিতে হবে তাঁরা স্বাধীন হলে ব্রিটিশ অফিসারদের পেনশন ও ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি কি না। ব্রিটেনে সঙ্গে সম্পর্কটাই-বা কী প্রকার হবে। কানাডা-অস্ট্রেলিয়ার মতো না ফ্রান্স-ইটালির মতো।
এমন অচল-অবস্থায় অ্যাটলি নির্দেশ দেন, কংগ্রেসকে সরকার গঠনের ভার দেওয়া হোক। কংগ্রেস লিগকে রাজি করাবে। জিন্না এই পলিসির আঁচ পেয়ে লিগ ওয়ার্কিং কমিটিকে দিয়ে ডাইরেক্ট অ্যাকশনের প্রস্তাব পাস করিয়ে নেন। লিগ সদস্যরা বড়োলাটের শাসন পরিষদে যোগ দেবে না। সংবিধানসভাও বয়কট করবেন। দেশময় চালিয়ে যাবেন প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। সংগ্রামটা শুরু হয় কলকাতায়। বড়োলাট ওয়েভেল গান্ধী ও নেহরুকে অনুরোধ করেন লিগকে কিছু কনসেশন দিতে। তাঁরা নাছোড়বান্দা। ওদিকে জিন্নাও নাছোড়বান্দা। অ্যাটলি আবার নির্দেশ দেন কংগ্রেসকে সরকার গঠনের অগ্রাধিকার দিতে। সেটাই পার্লামেন্টারি কেতা। কেন্দ্রীয় আইনসভায় নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে কংগ্রেসিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
জওহরলাল, বল্লভভাই প্রমুখ নেতারা শাসন পরিষদ পুনর্গঠন করেন। সঙ্গে আসফ আলি। দিল্লিতে যৌথ নির্বাচন প্রথা ছিল। তিনি উভয় সম্প্রদায়ের ভোটে নির্বাচিত। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও পাঁচজন গ্রহণযোগ্য মুসলমান পাওয়া গেল না। সুতরাং মুসলিম জনসাধারণ হল পুনর্গঠিত শাসন পরিষদের প্রতি আস্থাহীন। তারপর এটাও দেখা গেল যে সমগ্র ভারতের শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্যে দায়ী হলেও বাংলা, পাঞ্জাব ও সিন্ধুপ্রদেশের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া স্বরাষ্ট্র দফতরের ভারপ্রাপ্ত সদস্য বল্লভভাইয়ের ক্ষমতার পরিধির বাইরে। ব্রিটিশ শাসকরা থাকতেই এই, তাঁরা চলে গেলে এসব প্রদেশ তো বিদ্রোহী হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করবে। সময় থাকতে দুটি প্রদেশ ভাগ করাই সঙ্গত। ইতিমধ্যে জিন্না যোগ না দিলেও লিয়াকত আলি প্রমুখ লিগপন্থীরা সরকারের ভিতরে ঢুকে ভিতর থেকেই লড়ছিলেন। কংগ্রেস না পারে গিলতে না পারে ওগরাতে। নতুন বড়োলাট মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেসকে ছেড়ে দিয়ে লিগকে সরকারের ভার অর্পণ করতে নারাজ।
কংগ্রেসপন্থীরাই ভিতরে ভিতরে চেয়েছিল যে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভক্ত হোক। তা হলে তারা আরও দুটো প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রীমন্ডল গঠন করতে পারবে। নইলে তাদের চিরকাল শাসনক্ষমতা থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে। বিদ্রোহী হয়ে তারা কংগ্রেস সংগঠনের ভিতরে থেকে দল পাকিয়ে তাদের মনোনীত একজনকে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচন করতে সাহায্য করবে। তিনি হাই কমাণ্ড পুনর্গঠন করবেন। বল্লভভাইরা অপদস্থ হবেন। যেমন হতে হয়েছিল সুভাষচন্দ্রের কংগ্রেস সভাপতি পদে নির্বাচনের সময়। কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ সংকট ক্রমশ ঘনিয়ে আসতই। সময় থাকতে প্রতিকারের একমাত্র উপায় বাঙালি ও পাঞ্জাবি কংগ্রেসপন্থীদের জন্যে দুটো খন্ডিত প্রদেশ গঠন।
ওদিকে পাকিস্তানের নেপথ্য রহস্যও একই প্রকার। পাকিস্তানের প্রয়োজন হয় যুক্তপ্রদেশ, বিহার, বোম্বাই, মাদ্রাজ প্রভৃতি প্রদেশের লিগপন্থী রাজনীতিকদের অন্য কোথাও ক্ষমতার আসনে বসানোর জন্যে। বিহারি মুসলিম লিগ নেতারা যেতেন পূর্ব পাকিস্তানে। যুক্তপ্রদেশের মুসলিম লিগ নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানে। এইভাবে মুসলিম লিগের সংহতি রক্ষা করতে পারা যেত। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে সমগ্র বঙ্গ ও সমগ্র পাঞ্জাব তথা সমগ্র অসম পড়বে মুসলিম লিগের ভাগে। কংগ্রেসের আপত্তি সত্ত্বেও চার্চিলের দাক্ষিণ্যে। চার্চিল নিজেই ক্ষমতাহীন হবেন এটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি।
নোয়াখালির ঘটনার অতিরঞ্জিত বিবরণ পড়ে বাংলার হিন্দুরাও তিতিবিরক্ত। যাঁরা সেকালের পার্টিশন বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপ দিয়ে সন্ত্রাসবাদী হয়েছিলেন ও আন্দামানে গিয়েছিলেন তাঁরাও নতুন করে পার্টিশনের পক্ষপাতী হয়ে ওঠেন। বিনুকে তার এক সহযোগী হিন্দু অফিসার বলেন, ‘দেশের সেই সোনারচাঁদ ছেলেরা গেল কোথায়? গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করতে পারে না?’ বিনু জানতে চায় গান্ধীর কী অপরাধ। তিনি বলেন, ‘পার্টিশন না হলে বাঙালি হিন্দু বাঁচবে না। গান্ধী পার্টিশন হতে দিচ্ছেন না।’ পার্টিশনের পরিণাম দর্শনের পর উলটোটি শোনা গেল। গান্ধী কেন পার্টিশন হতে দিলেন? অতএব তাঁর মরা উচিত। একজন আন্দামান ফেরত বিপ্লবীর এই উক্তি বিনুর নিজের কানে শোনা।
গান্ধীজির আগস্ট ১৯৪২ সালের ‘কুইট ইন্ডিয়া’ প্রস্তাব ইংরেজরা মান্য করল ১৯৪৭ সালে আগস্ট মাসে। জিন্না সাহেবের ‘ডিভাইড অ্যাণ্ড কুইট’ অনুপ্রস্তাবও মেনে নেওয়া হল একই কালে। দুই শতকের ব্রিটিশ শাসন তিন মাসের নোটিশে হাওয়া হয়ে গেল। বিনু তাজ্জব ও হতভম্ব। আদালতের এক কেরানি তাকে হুঁশিয়ার করে দেন, ‘চোদ্দো দিনের বিল তৈরি করে এক্ষুনি জমা দিন। এ গভর্নমেন্টের দায় অন্য গভর্নমেন্ট বহন করবে কি না সন্দেহ। করলেও কবে বিল মঞ্জুর করবে কে জানে?’
পনেরোই আগস্টের সকালে হাওড়ার নেতারা বিনুকে ধরে নিয়ে যান হাওড়া ময়দানে। সে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। সেদিন সন্ধ্যায় তাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার অতুল্য ঘোষের ঘরোয়া সভায়। শ্রোতারা সবাই উঠোনে। সে একা বারান্দায়। তার ভাষণ শেষ হলে পাঁচজন মন্ত্রীকে তার সামনে হাজির করা হয়। সে অভিনন্দন জানায়। বিনু এক্ষেত্রে সাহিত্যিক বিনু।
বিনুর অপসরণ
স্বাধীনতা দিবসটি নিছক আনন্দের দিন ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান সেনাপতি মহাত্মা গান্ধী সেদিন কলকাতায় অনশনরত। তাঁর ধারণা তাঁর জীবনের মিশন ব্যর্থ হয়েছে। হিন্দু-মুসলমান এক হয়নি, হিংসায় উন্মত্ত দেশ। ইংরেজরা চলে গেছে, এইটুকুই যা লাভ। কিন্তু তারা চলে গেছে বলেই কি দেশের হিন্দুপ্রধান অংশ থেকে মুসলমানরাও চলে যাবে, মুসলিমপ্রধান অংশ থেকে হিন্দু ও শিখরাও চলে আসবে?
এককভাবে একটা দল সারা দেশকে স্বাধীন করতে পারে। কিন্তু এককভাবে একটা দল সারা দেশকে শাসন করতে পারে না, যদি-না অন্যান্য দলকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়। কংগ্রেসের তেমন কোনো অভিপ্রায় ছিল না। যুদ্ধে নামলে সে দেখত ভারতীয় সেনা দ্বিধাবিভক্ত ও পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধরত। অনশনে দেহত্যাগ করেও মহাত্মা তাদের নিবৃত্ত করতে পারতেন না। একই কালে দাঙ্গাহাঙ্গামাও লেগে থাকত।
এককভাবে রাজ্য চালানো যায় না, অপরকে ক্ষমতার ভাগ দিতে হয়। তা যদি কার্যকর না হয় তবে রাজ্যের ভাগ দিতে হয়। আর কোনো বিকল্প যদি থাকে সেটা ইংরেজকেই হাতজোড় করে বলা, তোমরাই থেকে যাও অনির্দিষ্টকাল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ইংরেজরা ১৯৪৮ সালের জুন মাসের পর নিজেরাই বিনা শর্তে একতরফা অপসরণে উন্মুখ। কারও কোনো আর্জি শুনবে না। বিনু ব্রিটিশ সরকারের ভিতরে ছিল। শাসকদের মনোভাব জানত। বাংলার লাটসাহেব তাকে বলেছিলেন, ‘হিন্দু-মুসলমান যদি পরস্পরের সঙ্গে লড়তে চায় তবে লড়ুক। আমরা কেন রিং ধরে থাকব। আমরা যাচ্ছি।’ রিং মানে বক্সিং-এর রিং।
ভিতরে থেকে মুসলিম অফিসারদের মনোভাবও তার অজানা ছিল না। ‘আমরা পাকিস্তান চাইনে’ যিনি বলেছিলেন তিনিই বলেন, ‘আমরা এখন পাকিস্তান চাই।’ মাস তিনেকের মধ্যে মত পরিবর্তনের অর্থ ইংরেজরাজের শূন্যতা কংগ্রেসরাজ যদি পূরণ করে তো মুসলিম অফিসারদের শ্রেণিস্বার্থ নিরাপদ নয়। একই উক্তির রকমফের হিন্দু অফিসারদের মুখে। ‘পার্টিশন না হলে বাংলার হিন্দু বাঁচবে না।’
একদা যাঁদের পূর্বপুরুষরা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছিলেন, ইংরেজ বিদায়ের সময় দেখা গেল তাঁরা দেশান্তরিত হয়ে পাকিস্তানি বনেছেন। তাই তাঁরা ইংরেজদের সঙ্গে সঙ্গে ইন্ডিয়া কুইট করলেন। বিনু আন্তরিক দুঃখিত। সে চেয়েছিল তাঁরা থেকে যান। তেমনি এটাও সে কামনা করেছিল যে হিন্দু অফিসাররাও পাকিস্তানে থেকে যান। বিশেষত যাঁদের শিকড় পূর্ববঙ্গে। ছিন্নমূল হয়ে কে কবে রস সংগ্রহ করতে পেরেছে? অফিসার শ্রেণি তো চলে এলেনই, তাঁদের অনুসরণে কেরানি ও পিয়োন, পুলিশ ও ডাক্তার, উকিল ও মোক্তার, জমিদার ও মহাজন, পাচক, পুরোহিত, গোয়ালা, মুচি, ধোপা, নাপিত, চাষি, মজুর। তবু ভালো যে পাঞ্জাবের মতো হিন্দু-মুসলমান পাইকারি হারে মরেনি, মারেনি, শুধুমাত্র পালিয়েছে। যঃ পলায়তি সঃ জীবতি।
এরকম যে হতে পারে তা আন্দাজ করে বিনু ময়মনসিং থেকে বদলি হয়ে আসার সময় বিদায় সভায় বলেছিল, ‘পশ্চিমবঙ্গ একটি ছোটো নৌকো। তাতে যাত্রীর সংখ্যা সীমা ছাড়িয়ে গেলে নৌকাডুবি ঘটবে। যেমন ঘটে গেল সেদিন আমাদের চোখের সামনে ব্রহ্মপুত্রের জলে। পূর্ববঙ্গের সওয়া কোটি হিন্দুর জন্যে সেখানে ঠাঁই নেই। তারা সবাই গেলে পশ্চিমবঙ্গ ডুববে।’
সেই নৌকার বাড়তি যাত্রীরা মাঝিদের হুঁশিয়ারি শোনেনি। ফলে নৌকা ডোবে, মানুষও ডোবে; যারা সাঁতার জানে তেমন কয়েকজন বেঁচে যায়। মাঝিরা পালায়।
ভারতও একটি বড়ো মাপের নৌকা। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেবাক হিন্দু ও শিখ তিন সপ্তাহের মধ্যে উধাও। এমনই বেবাক মুসলমান পূর্ব পাঞ্জাব ছেড়ে গেছে। কিন্তু দিল্লির মুসলমানরা তাদের ঘরবাড়ি, জায়গাজমি, মসজিদ বেদখল দেখে সরকারের শরণাপন্ন। সরকার হিমসিম খাচ্ছেন। বিনুর বন্ধু এক হিন্দু আইসিএস অফিসার মুসলমানদের বাঁচাতে গিয়ে তাঁর অধীনস্থ হিন্দু সিপাহির দ্বারা নিহত। এখন ভরসা গান্ধীজির নৈতিক প্রভাব। তিনি ব্যর্থ হলে সরকারের দেউলেপনা প্রমাণ হবে। সেকুলার স্টেট হবে ভাঁওতা। কাশ্মীরি মুসলমান ভবি ভুলবে না। মহাত্মাকে শেষপর্যন্ত অনশনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
ইতিমধ্যে মুর্শিদাবাদে গন্ডগোল বেঁধেছিল। মুসলিমপ্রধান মুর্শিদাবাদ জেলা সাত দিন পাকিস্তানের শামিল থেকে
র্যাডক্লিফের রোয়েদাদে ভারতের শামিল হয়। সেই সাত দিনে সেখানকার মুসলমানরা উৎসব করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে, পরে আকাশ থেকে পড়ে। বিশ্বাসই করতে চায় না যে এটাই তাদের ভাগ্য। হিন্দুরা সাত দিন মনমরা হয়ে কাটিয়েছে। এখন তারাও উৎসব করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। মারামারি থামাতে সেখানকার নেতারা চেয়ে পাঠান একজন আইসিএস অফিসার।
আঠারো বছর চাকরির পর বিনু এই প্রথম কলকাতায় বদলি হয়েছে। চারটে মাস যেতে-না-যেতেই তার উপর হুকুম, মুর্শিদাবাদ চলো। বিনু প্রতিবাদ করতে পারত। তার ছেলের ম্যাট্রিক পরীক্ষা সামনে। ময়মনসিং থেকে এসে কলকাতার স্কুলে ভরতি হয়েছে। আবার স্থানান্তর। তা সত্ত্বেও বিনু সহজেই রাজি হয়ে যায়। শাসন বিভাগের প্রতি তার বরাবরই পক্ষপাত। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বিচার বিভাগে পদস্থ করা হয়েছিল। প্রায় দশ বছর বাদে সে আবার জেলাশাসক হবে। সেই পদটার প্রতি তার একটা টান ছিল। সেই পদের সঙ্গে জড়িত ছিল ক্ষমতা। জজ তো ঠুঁটো জগন্নাথ। তা ছাড়া মীরার সঙ্গে তার প্রথম দেখা তো বহরমপুরেই। বিয়ের পরে মধুমাস যাপনও সেখানে।
মীরার কিন্তু একেবারেই সায় ছিল না আবার এক বদলিতে। আবার মালপত্র প্যাক করতে হবে। মালপত্রের মধ্যে পড়ে স্টাইনওয়ে বেবি গ্র্যাণ্ড পিয়ানো। ভারতে দুর্লভ, বিয়ের পর আমেরিকা থেকে আনা।
মুর্শিদাবাদ যাবার আদেশ পেয়ে বিনু ঘোষ মন্ত্রীমহলের সদস্য এক পুরাতন বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করে, ‘পূর্ববঙ্গের হিন্দু শরণার্থীদের সম্বন্ধে আপনাদের পলিসি কী?’ তিনি উত্তর দেন, ‘আমরা ওদের উৎসাহ দিতে চাইনে। দিলে সবাই এসে হাজির হবে। আমরা অভিভূত হব।’ কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বে যদি বিন্দুমাত্র সত্য থাকে তবে পাকিস্তানে কেবলমাত্র মুসলিমরাই সিটিজেন হতে পারে, কিন্তু এঁরা রেসিডেন্ট এলিয়েন, সমান স্বত্ববান নন। তাঁরা তো সিটিজেনশিপের জন্যে ভারতে চলে আসতে চাইবেনই। সাধ করে কেউ এলিয়েন হতে রাজি হয়?
না, হয় না। তবে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে কথাবার্তার সময় জিন্না সাহেব বলেছিলেন বাংলাকে দু-ভাগ করা উচিত নয়, যেহেতু বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে এক জাতীয়তার লক্ষণ বিদ্যমান। মাউন্টব্যাটেন তাঁর প্ল্যানে একটি ধারা জুড়ে দেন। বাংলার হিন্দু-মুসলমান যদি একমত হয় তবে বাংলা অবিভক্ত থাকবে। তার মানে দাঁড়ায় অবিভক্ত বাংলা একাই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। জওহরলাল প্রতিবাদ করেন। বাংলা যদি স্বাধীন হয় তো আরও অনেক প্রদেশ বা রাজ্য স্বাধীন হতে চাইবে। ভারত হবে বলকান। কংগ্রেস বলকানিকরণ মেনে নেবে না। মাউন্টব্যাটেন সে-ধারাটি প্রত্যাহার করেন। বাংলা দুই ভাগ হল, কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্ব মেনে নেওয়া হল না। তাহলে তো উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশে রেফারেণ্ডামের আবশ্যক হত না। সিলেট জেলাতেও না। রেফারেণ্ডামের ফল পাকিস্তানের পথে নাও যেতে পারত।
পার্টিশন হল একপ্রকার সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ, যেমন র্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের রোয়েদাদ। সেটা প্রাদেশিক স্তরে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়, এটা কেন্দ্রীয় স্তরে ক্ষমতা হস্তান্তরের বেলা। হিন্দু, মুসলমান, শিখ প্রভৃতিকে সম্প্রদায় হিসাবেই গণ্য করা হয়, নেশন হিসাবে নয়। জিন্না সাহেব পাকিস্তানের পতাকার এক-তৃতীয়াংশ সফেদ রাখেন। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ সবুজ। তাৎপর্য, পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখরাও সমান অধিকারী। তাদের সংখ্যানুপাতও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। তিনি একটি বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানে যে যার ধর্ম অনুসরণ করতে পারবে, রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সব নাগরিকই পাকিস্তানি। সেকুলার স্টেট বলে পাকিস্তানকে চিহ্নিত না করলেও তাঁর বিবৃতির মর্ম পাকিস্তান হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তিনি ভালো করেই জানতেন যে পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখ এলিয়েন হলে ভারতেও মুসলমানরা হবে এলিয়েন। তার মানে চার কোটি মুসলমান ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে হাজির হবে। তারা যদি ভারতে থাকে তবে সেটা হবে কংগ্রেসের সেকুলার পলিসির গুণে।
বিনু মুর্শিদাবাদের শাসনভার নেবার আগেই ঘোষ মন্ত্রীমন্ডলীর পরিবর্তে রায় মন্ত্রীমন্ডলী অধিষ্ঠিত হয়। এটাও তো কংগ্রেস পার্টির মন্ত্রীমন্ডলী। বিনু ধরে নেয় এঁরাও শরণার্থীদের উৎসাহ দিতে অনিচ্ছুক। মুর্শিদাবাদে তখনও লক্ষ করার মতো শরণার্থী সমাগম হয়নি। সেখানকার গন্ডগোলটা অন্য কারণে। মুর্শিদাবাদ মুসলিমপ্রধান জেলা। তাই মাউন্টব্যাটেন তাকে পাকিস্তানের সামিল করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিন মুর্শিদাবাদে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে। মুসলমানরা আনন্দ উৎসব করে। তাদের আনুগত্য পাকিস্তানের প্রতি। কিন্তু দিন সাতেক পরে দেখা গেল মুর্শিদাবাদ পড়েছে ভারতের ভাগে। তার ভিতর দিয়ে যেহেতু গঙ্গা ভাগীরথী প্রবহমান সেহেতু তাকে ভারতের ভিতরে রাখাই সমীচীন। তার বিনিময়ে পাকিস্তানকে দেওয়া হল খুলনা জেলা। সেটা হিন্দুপ্রধান। এই দুটি জেলার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক গণনাকে অগ্রাহ্য করেন স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ। এতে মুর্শিদাবাদের মুসলমানরা স্তম্ভিত। সাত দিন পরে পতাকা পরিবর্তন, আনুগত্য পরিবর্তন, ভাগ্য পরিবর্তন। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও সংখ্যালঘিষ্ঠের অধম! এ কীরকম অন্যায়!
ওদিকে হিন্দুরাও সেই সাত দিন মুসলমান প্রতিবেশীদের চেহারা দেখে স্তম্ভিত হয়েছে। প্রজারা দলবদ্ধ হয়ে জমিদারের ভবন আক্রমণ করেছে। পুলিশ নিষ্ক্রিয়। জমিদার সপরিবার কলকাতা পলাতক। বলা বাহুল্য প্রজারা মুসলমান, জমিদার হিন্দু। দৃশ্যত হিন্দু-মুসলমানের বিবাদ। প্রকৃতপক্ষে জমিদার ও প্রজার বিবাদ। ইংরেজদের অভাবে জমিদাররা নির্বান্ধব। তবে পূর্ববঙ্গের লিগ মন্ত্রীমন্ডলীর শীর্ষস্থানীয়রাও জমিদার। জমিদারি প্রথার বিলোপ যদিও তাঁদের দলের পলিসি তবু অর্থনৈতিক ওলটপালট তাঁদেরও এই মুহূর্তে অভিপ্রেত নয়। মুর্শিদাবাদের হিন্দুরা তটস্থ থাকে। কিন্তু ভারতের শামিল হয়ে তারাও উগ্রমূর্তি ধারণ করে।
বিনু বুঝতে পারে মুর্শিদাবাদের সমস্যাটা আসলে আইন ও শৃঙ্খলার নয়। আইন আছে, পুলিশ আছে, আদালত আছে, জেল আছে। এসবের সাহায্যে দুষ্কৃতীদের দমন করা কঠিন নয়, সময়সাপেক্ষও নয়। পরিস্থিতি আয়ত্তে আসে। কিন্তু বিবাদের বীজ যদি থেকে যায় গন্ডগোল আবার বাঁধবে। যেটা গোড়ায় আবশ্যক সেটা মুসলমানদের আনুগত্য অর্জন। দ্বিজাতিতত্ত্বানুসারে তাদের তো পাকিস্তানে পা চালিয়ে দেবার কথা। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্ব দুই রাষ্ট্রই বাতিল করেছে। মুসলমান মাত্রেই পাকিস্তানি নাগরিক নয়, হিন্দু মাত্রেই ভারতীয় নাগরিক নয়। গান্ধীজির পলিসি, যে যেখানে আছে সে সেইখানেই থাকবে, জোর করে কাউকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা চলবে না। যার ইচ্ছা সে বিনিময় করতে পারে। সেটা কিন্তু সম্পত্তি বিনিময়। লোক বিনিময় নয়। মুসলিমবর্জিত মুর্শিদাবাদ বা হিন্দুশূন্য রাজশাহি কল্পনা করা যায় না। তাতে সাম্প্রদায়িক বিবাদ চিরকালের মতো দূর হবে, কিন্তু ইতিহাসের ধারাভঙ্গ ঘটবে। সে ধারা গঙ্গা যমুনার মিশ্র ধারা। তাকে অবিমিশ্র করতে গেলে এপার-ওপার দুই পারের বাঙালি জাতীয়তা ধ্বংস হবে। দিল্লিকে মুসলিমশূন্য হতে দেবেন না বলে মহাত্মা গান্ধী প্রাণ দেন। বিনু অবশ্য প্রাণ দেবে না, কিন্তু তারও পণ সে গান্ধীনীতি অনুসরণ করবে ও তা করতে গিয়ে যথাসম্ভব ত্যাগ করবে। দেশ বিভক্ত, প্রদেশ বিভক্ত, তাই বলে লোক বিভক্ত হবে না। বিনু বিশ্বাস করে যে অবিভক্ত ভারতের জনগণ সমস্ত প্রতিকূল প্রমাণ সত্ত্বেও এক ও অবিভাজ্য। সমস্ত প্রতিকূল প্রমাণ সত্ত্বেও অহিংস।
মুর্শিদাবাদ ও রাজশাহির লোকজন চিরকাল পদ্মা নদীর এপার-ওপার করে এসেছে। এখন ও-দুটো জেলা দুই আলাদা ডোমিনিয়নের প্রত্যন্ত জেলা। কোনো হিন্দু এলে সেটা খবর নয়, কিন্তু কোনো মুসলমান এলেই পুলিশ থেকে রিপোর্ট আসে অমুক ব্যক্তি অমুক গ্রামে এসেছে। গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। দুই জেলার মধ্যে মাল চলাচল চিরকাল অবাধ ছিল। এখন ওটার নাম মাল পাচার। ইতিমধ্যে বাজার থেকে কাপড় উধাও। কারণ অবাধে মাল পাচার।
বিনু একদিন তাঁবু নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পদ্মার ধারে রাত কাটায়। স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে মাল পাচারের কলাকৌশল। ওপারে আলো জ্বলে ওঠে। যেমন রেলের সিগন্যাল। অমনি এপার থেকে নৌকা ছেড়ে দেয়। পাচার যারা করে তারা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে দুই সম্প্রদায়ের লোক। ওটাকে তারা অপকর্ম মনে করে না। চাহিদা আছে, জোগান দিচ্ছে। মুশকিলটা এইখানে যে মুর্শিদাবাদের চাহিদা মিটছে না, কাপড়ের অভাবে মানুষ কী পরবে? কমিশনার তা শুনে বলেন, কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে উলটো বিপত্তি। ওপারে হিন্দুর মেয়েরা শাড়ি পাবে কোথায়? বিনু বলে না, বলতে পারত, শুধু কি হিন্দুর মেয়েরা?
চালের দামের উপর থেকে সিলিং উঠে যাওয়ায় হঠাৎ দেখা দিল চালের আকাল। ভাগ্যিস কিছু চাল মজুত ছিল সরকারি আড়তে। কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করে চালের অভাব কতকটা মেটানো গেল। বিনুকে এইসব নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকতে হয়। সাহিত্য শিকেয় তোলা থাকে। সামাজিকতারও সময় মেলে না।
একদিন কলকাতার সেক্রেটারিয়েটে ডাক পড়ে। বিভিন্ন জেলা থেকে সমাগত প্রশাসকদের নিয়ে দরবার করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য ওপার থেকে যেসব শরণার্থী আসছে তাদের সমষ্টিগতভাবে বসাতে হবে সীমান্তের এক-একটি গ্রামে। একই গ্রামে চাষি, তাঁতি, কামার, কুমোর, কলু, ছুতোর, ধোপা, নাপিত, মুদি ইত্যাদির স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজ তাঁর স্বপ্ন।
‘অবাস্তব।’ বিনু বলে ওঠে, ‘সীমান্তে কোথাও এক কাঠা জমি খালি নেই। সর্বত্র ঘনবসতি।’
মুখ্যমন্ত্রী তাকে ধমক দেন। সে বলে, ‘আমি ছুটি নেব।’ তিনি বলেন, ‘আমি দিলে তো।’
রাজশাহি ও মুর্শিদাবাদের মাঝখানে গঙ্গা ও পদ্মা নদী। যেখান থেকে ভাগীরথী বেরিয়েছে সেখান পর্যন্ত গঙ্গা, তারপরে পদ্মা। নদীর মুখ্যস্রোত যেটাকে বলা হয় সেটা কখনো রাজশাহি পাড় দিয়ে বইত, কখনো মুর্শিদাবাদের পাড় দিয়ে। পার্টিশনের পূর্বে এ নিয়ে কেউ কোনো তর্ক করেনি। সম্প্রতি মুখ্যস্রোত বহমান মুর্শিদাবাদের পাড় ঘেঁষে। রাজশাহি থেকে এক লঞ্চ এসে সারাদিন টহল দিচ্ছে।
নদীর মাঝখানের তিনটে চর এখন মুখ্যস্রোতের ওপারে। কিন্তু মুর্শিদাবাদের মানচিত্রে চিহ্নিত। লঞ্চের উর্দুভাষী বিহারি কাপ্তেন দাবি করছেন যে মুখ্যস্রোতের আধখানা পার্টিশনসূত্রে পাকিস্তানের, সুতরাং চরগুলো রাজশাহির শামিল। মুর্শিদাবাদের মুসলমান চাষিরা এতকাল ওইসব চরে ফসল ফলিয়ে এসেছে, এ বছরও ফলিয়েছে, কিন্তু কাপ্তেন তাদের চরে যেতে দিচ্ছেন না, নৌকা আটক করেছেন। মগের মুলুক আর কী! লোকগুলি বিনুর কাছে নালিশ করে।
বিনু তার পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্টকে বলে, কাপ্তেন অনধিকারপ্রবেশ করেছে। গোটা মুখ্যস্রোতটাই মুর্শিদাবাদের। অন্তত আধখানা তো মুর্শিদাবাদের বটেই। সেখান দিয়ে তো লঞ্চ চলাচল বেআইনি। পুলিশকে পাঠান লঞ্চ আটক করতে।
তিনি সন্ত্রস্ত হয়ে বলেন, ‘ওরে বাপ রে! পাকিস্তানি লঞ্চকে আটক? ওরা গুলি করবে না? পুলিশের একটি সিপাহিও যদি মারা যায় গোটা পুলিশ ফোর্স বি—বি—বিদ্রোহ করবে।’
ব্রিটিশ আমলে জেলাশাসকদের গোপন পুস্তিকায় নির্দেশ ছিল তাঁরা যেন পারতপক্ষে মিলিটারিকে না ডাকেন। ডাকলে পরিস্থিতি মিলিটারি অফিসাররাই নিয়ন্ত্রণ করবেন। তাঁদের হুকুম অনুসারে কাজ হবে। জেলাশাসকের পক্ষে সেটা অসম্মানকর। মিলিটারিকে নিতান্তই যদি ডাকতে হয় তবে তার আগে সরকারের অনুমতি নিতে হবে।
বিনু অগত্যা সরকারের অনুমতি নিয়ে মিলিটারিকে ডেকে পাঠায়। এক ব্রিগেডিয়ার এসে তার অতিথি হন। মহারাষ্ট্রীয়। বলেন, ‘আমি তিন-তিনটে যুদ্ধে লড়েছি। আমি এখন সারা দেশের সবচেয়ে নন-ভায়োলেন্ট ম্যান। আমার পরামর্শ শুনুন। এ ব্যাপারে মিলিটারিকে জড়াবেন না।’
এরপর আসেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল। শিখ। বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে আমাদের একটিও জওয়ান যদি মারা যায় তা হলে সেটা হবে ভারতের প্রেস্টিজের ইস্যু। তা নিয়ে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। আমার পরামর্শ শুনুন। পশ্চিমবঙ্গের সশস্ত্র পুলিশকে এ ভার দিন।’
ব্যাপারটা যে কতদূর বিপজ্জনক তা উপলব্ধি করে বিনু রাজশাহির জেলাশাসকের সঙ্গে কথাবার্তা চালায়। তিনি তাকে নিমন্ত্রণ করেন। একদা তারই অধীনস্থ বাঙালি মুসলিম অফিসার। অতিশয় সজ্জন। বিনুর সঙ্গে এমন ব্যবহার করেন যেন বিনু এখনও তাঁর উপরওয়ালা। বিনুর পুরোনো কেরানি ও পিয়োনদের সাদর আপ্যায়নের আতিশয্যে তার প্রাণ যায় আর কি! স্থির হয় দুই শাসক চরে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করবেন। কিন্তু তার আগেই তাঁকে বদলি করে এক উর্দুভাষী মুসলিম অফিসারকে জেলাশাসক করা হয়। পাকিস্তানের লাইন হল আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে চরগুলো পাকিস্তানের অন্তর্গত। নদীর মুখ্যস্রোত এখন সীমানা নির্দেশ করছে। তার আধখানা পাকিস্তানে।
দুই সরকার একমত হতে পারেন না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিনুকে সশস্ত্র পুলিশ পাঠান। তাদের সঙ্গে আসে ভয়ানক সব অস্ত্রশস্ত্র। স্টেনগান, ব্রেনগান। এসব অবশ্য ব্যবহার করার জন্যে নয়, ক্ষমতা জাহির করার জন্যে। সিপাহিরা নদী পার হয়ে চরে যাবে কী করে? লঞ্চের দরকার হয়। অবিভক্ত বঙ্গের লঞ্চগুলো ছিল খুলনায়। একটি বাদে খুলনার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানে চলে গেছে। তাই ভারতের নৌবহর থেকে লঞ্চ আনাতে হয়। সেসব লঞ্চ সমুদ্রের জন্যে, নদীর জন্যে নয়। লোহা দিয়ে মোড়া। কণ্টকময়। লশকররা একধার থেকে মুসলমান। অবিশ্বাসী হলে ওরা লঞ্চগুলো নিয়ে ভাগীরথী থেকে পদ্মায় পড়বে ও সরাসরি রাজশাহি চলে যাবে। ওদের দেশ নোয়াখালি, চাটগাঁয়। ওরা পাকিস্তানি নাগরিক। বিনুকে পরামর্শ দেওয়া হয় দক্ষিণী লশকর আনাতে। বিনু বলে, ‘এরা বাঙালি লশকর, এদের সঙ্গে বনিবনা সহজ। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। এরা পেশাদার মানুষ, রাজনীতি বোঝে না। যার নিমক খায় তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকে।’
সশস্ত্র বাহিনী ও লঞ্চের লশকরদের উপরে কর্তৃত্ব করার জন্যে পাঁচজন প্রাক্তন মিলিটারি অফিসারকে বিনুর অধীনে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত করা হয়। এঁরা সবাই এখন আইএএস। একজন উইং কমাণ্ডার ছিলেন, বাঙালি খ্রিস্টান। একজন ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান। দুজন মেজর বাঙালি ব্রাহ্মণ। একজন ক্যাপটেন, অবাঙালি কায়স্থ। উইং কমাণ্ডারকে সদরে রেখে বাকি চারজনকে গঙ্গা-পদ্মার তীরে মোতায়েন করা হয়। সশস্ত্র বাহিনীর হেফাজতে। লঞ্চেরও।
এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয় বেতার দিয়ে। পুলিশ ওয়্যারলেস। তারজন্যে নিজস্ব একটা কোড বানায় বিনু। যারা জানে তারা ছাড়া আর কেউ ডিকোড করতে পারে না। একদিন রাত দুটোর সময় সে ওয়্যারলেস মেসেজ পায়। ‘দুশো রাউড গুলি চলেছে। জলদি আসুন।’ অমনি বিনু রওনা হয়ে যায়। ওয়েপন ক্যারিয়ার সবসময় তৈরি থাকে। যদিও তাতে ওয়েপন থাকে না। বিনু যখন গঙ্গাতীরে পৌঁছোয় তখন ভোর হয়ে এসেছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল বলেন, কেউ মারা যায়নি, সবাই নিরাপদ। রাতের অন্ধকারে শত্রুর পায়ের শব্দ পেয়েছে মনে করে লঞ্চের সিপাহিরা গুলি চালিয়েছে চরের দিকে, দিক ভুল করে সে-গুলি ছুটেছে তীরের সিপাহিদের অভিমুখে। এরাও পালটা গুলি চালিয়েছে লঞ্চের সিপাহিদের শত্রু মনে করে। ভাগ্যি সব ক-টা সিপাহিই আনাড়ি, নইলে একটা ম্যাসাকার ঘটে যেত। ভোরের আলোয় আবিষ্কার করা গেল একটি বাছুর মরে পড়ে রয়েছে চরের উপর। কাদের বাছুর, কোথা থেকে এল, কেউ বলতে পারে না। পরে গোয়ালারা এসে হাজির, সঙ্গে একপাল গোরু। চরে তারা গোরু চরাতে এসেছিল। বাছুরটি কেমন করে দলছুট হয়। তা বলে তাদের বাছুরকে মেরে ফেলবে। এতবড়ো অন্যায়! তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করে। সামলাও ঠেলা।
চর অপারেশন উপলক্ষ্যে বিনুকে মাঝে মাঝে কলকাতা গিয়ে দেখা করতে হত কমিশনারের সঙ্গে, তারপর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। তিনি বলতেন, ‘এই যে প্রিন্স অব ডেনমার্ক। এবার কী খবর!’ তাঁর টেলিফোন পেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজের ঘর থেকে আসেন। বিনুর সঙ্গে তাঁর অনেক দিনের পরিচয়। তিনি একদা সাহিত্যিক ছিলেন। পার্টিশনের পূর্বাহ্ণে ময়মনসিং-এ তিনি বিনুর নিমন্ত্রণে নৈশভোজন করেন।
বিনুর সঙ্গে দুজনেই ভদ্র ব্যবহার করেন। সে যখন যা চাইবে তাঁরা তা মঞ্জুর করবেন। সীমান্তে শরণার্থী বসতির কথা আর উল্লেখ করা হয় না। শরণার্থী যাঁরা মুর্শিদাবাদে এসেছিলেন তাঁরা সীমান্ত থেকে দূরে থাকাই পছন্দ করতেন। শহরের আশেপাশেই তাঁদের বসত। স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজের কোনো প্রয়াস ছিল না। কার যে কী জাত, কী পেশা তা প্রকাশ না করায় বিনু তা জানত না। তাঁরা সরকারি সাহায্য চান। সম্ভব হলে চাকরি কিংবা লাইসেন্স।
একদিন কলকাতা থেকে ডাক পড়ল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে বিনু একখানা পত্রিকা কিনে দেখে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার মুসলমানদের তাড়াতে যাচ্ছেন এটা আদৌ সত্য নয়। যত সব বাজে গুজব। বিনু সরাসরি সেক্রেটারিয়েটে গিয়ে হাজিরা দেয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে। সেখানে ছিলেন স্বরাষ্ট্রসচিব। রুদ্ধদ্বার কক্ষে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেন তার মর্ম অমুক তারিখের মধ্যে সীমান্তের মুসলমানদের ওপারে খেদিয়ে দিতে হবে। বিনু তো অবাক। অপর জেলাশাসক সময়টা একটু বাড়িয়ে দিতে অনুরোধ করেন। কর্তা বাড়িয়ে দেন। তাঁর মুখখানা গম্ভীর। বিনুর মনে হয় তিনি যা বলছেন তা তাঁর নিজের কথা নয়, অন্য কারও কথা। তাঁকে দিয়ে বলানো হচ্ছে। ইতিমধ্যেই বিনু তাঁর পক্ষপাতী হতে সুরু করেছিল। তিনি আর যা-ই হন, কমিউনাল নন। সে মুখ বুজে শুনে যায়। বিনা বাক্যে ঘর থেকে বেরোয়। কথা দেয় না যে অমন কাজ করবে। বাইরে গিয়ে তার সহযোগীকে বলে, ‘রক্তপাত অনিবার্য। লিখিত আদেশ চাই। আপনি ভিতরে গিয়ে লিখিত আদেশ চান।’ তিনি ভিতরে গিয়ে লিখিত আদেশ চাইলে স্বরাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘লিখিত আদেশ মিলবে না। মৌখিক আদেশই যথেষ্ট।’
বিনু ভারত সরকারের সার্কুলার পেয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল জেলাশাসকরা দেখবেন যাতে মুসলমানদের উপর জুলুম না হয়। জুলুম হলে জেলাশাসকদের জবাবদিহি করতে হবে। বিনু কার নির্দেশ মান্য করবে, কেন্দ্রীয় সরকারের না প্রাদেশিক সরকারের? সে একজন আইসিএস অফিসার। কেন্দ্রের প্রতি তার প্রথম অনুগত্য। সে মুখ্যমন্ত্রীর আদেশ উপেক্ষা করে। তার বিশ্বাস বিধানচন্দ্র সেকুলারমনস্ক ব্যক্তি। তিনি ওরকম আদেশ দিতেই পারেন না। হয়তো ভুলেই যাবেন।
টলস্টয় ও গান্ধীর দ্বারা প্রভাবিত বিনু কলেজজীবনে স্টেট ভায়োলেন্সে বিশ্বাস করত না। কিন্তু কর্মজীবনে তাকে স্বীকার করতে হয়েছে যে আইনের শাসন না হলে দেশ অরাজক হবে। জেলাশাসক তথা জেলা জজের প্রথম কর্তব্যই হল আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা। রক্ষক না হয়ে তাঁরা যদি ভক্ষক হন তবে তো নিরীহ নাগরিকের ধন প্রাণ বিপন্ন। তেমন কাজ বিনুর দ্বারা হতে পারে না। তাকে মুর্শিদাবাদে পাঠানো হয়েছে গন্ডগোল থামানোর জন্যে, নতুন করে বাঁধানোর জন্যে নয়। হাজার হাজার নিরীহ মুসলমানকে উৎখাত করতে গেলে স্টেট ভায়োলেন্স ব্যবহার করতে হবেই। সেটা অপব্যবহার। রক্তপাত ঘটলে রাজনীতিকরা বলবেন তাঁরা অমন আদেশ দেননি, লিখিত প্রমাণ কই? বিনুকেই দোষ দেবেন।
অবশেষে বর্ষাকালের প্লাবনের পর চরগুলো জেগে ওঠে। এক নম্বর চরটা মেজর বি অনায়াসে দখল করেন। খোশখবরটা বিনু তৎক্ষণাৎ টেলিফোন করে কলকাতার কর্তাদের জানায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিনন্দন জানাতে পদ্মাতীরে আসেন, সঙ্গে কমিশনার। তাঁদের অভ্যর্থনা করে সরকারি টুরিং লঞ্চের উপরে মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন করা হয়। তাঁদের সঙ্গে মন্ত্রী মহোদয়ের রাজনীতিক পরিকর। এঁরাও ভোজনসঙ্গী। অনাহূত অতিথি।
ভোজনের পর মন্ত্রী ও কমিশনার বিশ্রাম করতে যান। বিনু পরিকরদের সঙ্গে আলাপচারী করে। তার কানে আসে পেছনে বসে থাকা একজন আরেকজনকে বলছেন, ‘দিল্লি থেকে কলকাতায় টেলিফোন এসেছে। ও তো এখন এদেশে নেই। যা করবার এইবেলা করে নাও।’
বিনু ঠাহর করে, জওহরলাল এখন বিদেশে। তাঁর ফেরার আগে যা করবার তা করে নিতে হবে। অমুক তারিখটা তাঁর ফেরার তারিখ। মন্ত্রী এসেছেন তার আগেই বিনুকে দিয়ে যা করবার তা করাতে।
মন্ত্রীর কেবিন থেকে অনুরোধ আসে। বিনুকে তিনি নিভৃতে কিছু বলতে চান। সে কেবিনে গিয়ে দেখে কমিশনারও উপস্থিত। তিনজনের গোপন বৈঠক।
প্রথমে গৌরচন্দ্রিকা। বিনুর সুখ্যাতি। দেশের এই সংকটের ক্ষণে বিনুর মতো করিৎকর্মা অফিসাররাই তো ভরসা। বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হওয়া গেছে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ আসন্ন। ইন্ডিয়ান আর্মি রাজশাহি অধিকার করলে বিনুকেই করা হবে রাজশাহির জেলাশাসক।
বিনু মনে মনে হাসে। রাজশাহির জেলাশাসক সে ছিল এগারো বছর আগে। তার চেয়ে জুনিয়ার অফিসারকে হালে সেক্রেটারি করা হয়েছে।
মন্ত্রী বলে যান—‘যুদ্ধের আগে সন্দেহভাজন হলে জনগোষ্ঠীকে বহিষ্কার করা আবশ্যক। সীমান্তের মুসলমান গোষ্ঠীকে বিশ্বাস কী? ওরা তলে তলে রাজশাহির মুসলমানদের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করে চলেছে। ওরা প্রচ্ছন্ন পাকিস্তানি। আপনি কি অবিলম্বে ওদের সদলবলে বহিষ্কার করতে পারবেন?’
‘আমি বরং ইস্তফা দেব, তবু অমন কাজ করব না।’ বিনু ঘাড় নাড়ে। ‘করতে গেলে রক্তপাত হবে।’
‘হোক-না। হোক-না।’ মন্ত্রী বলে ওঠেন।
‘রক্তপাত হলে এমন হইচই পড়ে যাবে যে বাধ্য হয়ে ও পলিসি প্রত্যাহার করতে হবে। ইতিমধ্যে যে অনর্থ ঘটে যাবে তাকে অঘটিত করতে পারা যাবে না।’ বিনু নিবেদন করে।
এরপর ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে আসে। মন্ত্রী বলেন, ‘দেখুন, ওপার থেকে হাজার হাজার হিন্দু পালিয়ে আসছে সরকারের পোষণে। এখন ওদের আমরা কোথায় রাখি? আমাদের পলিসি কী হবে আপনিই বলুন।’
‘ওদের আর যেখানেই রাখুন সীমান্তে নয়। সীমান্তে এক টুকরো খালি জমি নেই।’ বিনু উত্তর দেয়।
‘পলিসি স্থির করতে আপনাকে কে বলেছে? পলিসি আমরাই ঠিক করব। এই যদি আমাদের পলিসি হয় যে সীমান্তের মুসলমানদের বহিষ্কার করতে হবে তবে আপনি কি সেই পলিসি ক্যারি আউট করবেন?’ মন্ত্রী জানতে চান।
বিনু ঘাড় নাড়ে। ‘আমি দরকার হলে যুদ্ধ করতে পারি, কিন্তু এমনতরো কাজ করতে পারিনে।’
কমিশনারও ক্ষুণ্ণ হন। বলেন, ‘হিন্দুদের ওপার থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বহিষ্কার করা হচ্ছে। ওরা কোথায় যাবে?’
মন্ত্রী যোগ করেন, ‘আপনিই বলুন।’
‘ওরা যেখানেই জায়গা খালি পাবে সেখানেই যাবে। পশ্চিমবঙ্গের ভিতরে না হোক বিহারে, ওড়িশায়, মধ্যপ্রদেশে। ওখানকার নেতারাও তো পার্টিশনের জন্যে দায়ী।’ বিনু মনে করিয়ে দেয়।
‘কিন্তু ওসব জায়গায় শরণার্থীরা যদি না যায়?’ মন্ত্রী তর্ক করেন।
‘তা হলে আমি কী করতে পারি?’ বিনু চুপ করে রইল।
‘আচ্ছা, এবার আপনি আসতে পারেন।’ মন্ত্রী তাকে বিদায় দেন। মুখে বিরক্তির ভাব।
সেদিন চায়ের টেবিলে তিনি এলেন না। কমিশনার এলেন। গম্ভীর ও নীরব। বিনু বুঝতে পারল তিনি তার পক্ষে নন। চায়ের পর সে লঞ্চ থেকে নেমে তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে বাইরে অপেক্ষমান মুসলমানদের বলে, ‘আপনারা নির্ভয়ে থাকুন। আমি থাকতে আপনাদের গায়ে কেউ হাত দেবে না।’ ওদের মুখে দুর্ভাবনার ছাপ।
হ্যাঁ, মধ্যাহ্নভোজনের এলাহি আয়োজন হয়েছিল ওইসব সীমান্তের মুসলমানদেরই চাঁদায়। তুলেছিলেন মহকুমা হাকিম।
রাতে কলকাতার ট্রেনে মন্ত্রী ও কমিশনারকে বিদায় সম্ভাষণ জানায় বিনু। সঙ্গে মহকুমা হাকিম ও উভয়পক্ষের পরিকরগণ। কিন্তু মন্ত্রীর মুখ বেজার। তিনি ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘আশা করি আপনি আরও একটা চর জয় করবেন।’
‘যদি বিনা রক্তপাতে সম্ভব হয়।’ বিনু আশা করে।
বিনুর কাছে মুর্শিদাবাদ ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। যেমন নেহরুর কাছে কাশ্মীর ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। গান্ধীজিকে একজন ইংরেজ বন্ধু প্রশ্ন করেন, ‘হিন্দুপ্রধান ভারতে মুসলিমপ্রধান কাশ্মীর থাকে কোন যুক্তিতে?’ মহাত্মা উত্তর দেন, ‘হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গে যদি মুসলিমপ্রধান মুর্শিদাবাদ থাকতে পারে তবে হিন্দুপ্রধান ভারতে মুসলিমপ্রধান কাশ্মীরও থাকতে পারে। আমাদের এটা সেকুলার স্টেট। এ রাষ্ট্রে যে যার ধর্ম পালন করতে পারে, কিন্তু নাগরিক হিসাবে কেউ হিন্দু বা কেউ মুসলিম নয়, সকলেই ভারতীয়।’
তাই যদি হয় তবে মুসলিম বাছাই করে সীমান্ত উজাড় করা কেন? আসল কারণটা কি সেখানে বেছে বেছে হিন্দু বসানো? তার মানে লোক বিনিময়। লোক বিনিময় ভারত ও পাকিস্তানব্যাপী হলে একটা হবে অবিমিশ্র হিন্দু নেশন, অন্যটা অবিমিশ্র মুসলিম নেশন। পার্টিশন যদি ইভিল হয়ে থাকে এটা গ্রেটার ইভিল। মহাত্মা সেটা হতে দেননি, তাই নিহত হয়েছেন। সেই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির পরও যাঁরা সেই খেলা খেলছেন বিনু তাঁদের নির্দেশে সেই খেলা খেলবে না। শাস্তির জন্যে সে প্রস্তুত।
দিন দুই পরে স্থানীয় বিধায়ক বিনুকে খবর দেন। তিনি শুনেছেন খোদ ঘোড়ার মুখে ‘আপনার জায়গায় আরেকজন আইসিএস আসছেন।’ বিনু এইরকমই প্রত্যাশা করছিল। তবে এমন তড়িঘড়ি নয়। হয়তো অমুক তারিখের মধ্যে কার্যোদ্ধার করার তাগিদ ছিল। কিন্তু সে যেদিন চার্জ দেবে তার একদিন কি দু-দিন আগে সেই গোপন আদেশটি প্রত্যাহৃত হয়। ততদিনে নেহরু দেশে ফিরে এসেছিলেন। ব্যাপারটা কি কাকতালীয়?
বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে বিনুকে বিদায় দিতে একজনকেও দেখা গেল না। কিন্তু বেলডাঙা স্টেশনে কে একজন অজানা অচেনা প্রৌঢ় মুসলমান এসে তার কামরায় এক হাঁড়ি রসগোল্লা রেখে যান। বিনু প্রশ্ন করার আগেই ট্রেন ছেড়ে দেয়। তখন সপরিবারে মিষ্টিমুখ। মধুরেণ সমাপয়েৎ।
কলকাতায় হোমরাচোমরাদের হাঁড়িমুখ। কেউ কথা বলেন না। সে যেন কী একটা গুরুতর অপরাধ করে এসেছে। যিনি ভিতরের খবর জানতেন তেমন এক বন্ধু তাকে বলেন, মন্ত্রী মহোদয়ের মুখে মুর্শিদাবাদের কাহিনি শুনে গোটা ক্যাবিনেট মিটিং একবাক্যে গর্জে ওঠে, ‘এক্ষুনি তাড়ান।’
বিনুর অপসারণে দুঃখিত হন তার পুরাতন বন্ধু এক প্রাক্তন মন্ত্রী। বলেন, ‘দিল্লি থেকে যিনি টেলিফোন করেছিলেন তাঁর পলিসি হচ্ছে তাঁর ভাষায় ভীত সে প্রীত হোতা হ্যায়। ভীতি থেকে প্রীতি উৎপন্ন হয়। ভীত করেই তিনি পাকিস্তানকে প্রীত করবেন। ভীতি দেখিয়েই তিনি সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কেও প্রীত করবেন। ওপার থেকে যদি শরণার্থীরা আসে এপার থেকে মুসলিম শরণার্থীরা যাবে। টু ওয়ে ট্র্যাফিক। রক্তপাত হলে মুসলমানেরই দোষে হবে।’
বিনু ব্যথিত হয়ে বলে, ‘প্রাচীন গ্রিকদের মতে দেবতারা যাদের বিনাশ করতে চান তাদের পাগল করে দেন। এসব পলিসি পাগলের মতো পলিসি। এসব কাজ পাগলের মতো কাজ। বাধা না দিলে বাঙালি জাতিটাই উচ্ছন্ন যাবে। গান্ধী নেই, এখন নেহরু ভরসা।’
অল্পদিনের অসুখে কিরণশঙ্কর রায় মারা যান। বিনু তাঁর শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রিত হয়ে যোগ দেয়। তাঁর পুত্রকে সমবেদনা জানায়। ব্যক্তিগত সম্পর্ক তো রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক সম্পর্ক নয়। তাতে চিড় ধরে না।
চিফ সেক্রেটারি সুকুমার সেন বিনুকে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে উচ্চতর পদের জন্যে সুপারিশ করেন। জওহরলালকেও বলেন বিনুর উপর অবিচার হয়েছে। সে কিন্তু ইতিমধ্যে মনস্থির করেছিল যে আর নয়। সবরকম অভিজ্ঞতাই হয়েছে। মায় অর্ধসামরিক অপারেশন। আজেবাজে মামলার বিচার করা আয়ুর অপচয়। সাহিত্যের সাধনা অখন্ড মনোযোগ দাবি করে। সেটা বহুদিন অবহেলিত রয়েছে। সে বলে, সে আর চাকরি করবে না। জওহরলালকেও বলা নিরর্থক। সময় অর্থের চেয়ে মূল্যবান। সে চায় সাহিত্যের জন্যে সময়।
একদিন তার অসুখ করে। মাথার ভিতরে যেন আগুন জ্বলছে। কথা বলতে গেলে জিব জড়িয়ে যাচ্ছে। একটা কথা বলতে আরেকটা কথা বেরিয়ে আসছে। মুখ বেঁকে গেছে। বিনু বুঝতে পারে এটা প্রকৃতির ওয়ার্নিং। মোমবাতি দু-দিক থেকে পোড়ানোর পরিণাম। বড়ো অফিসার ও বড়ো সাহিত্যিক একসঙ্গে দুই হতে চাইলে অকালমৃত্যু।
সে মীরাকে একটা আধুলি ধরিয়ে দেয়। রাজার মাথা উঠলে পদত্যাগ, নইলে নয়। রাজার মাথা ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগপত্র লেখা হয়। বলা হয় তার শরীরের মোমবাতি দু-দিক থেকে পুড়ছে, তাকে সাহিত্যের জন্যে চাকরি ছাড়তে হবে। মীরা বলে, ‘তোমার উচ্চতা বাড়বে।’
পদত্যাগপত্র গভর্নর জেনারেল মঞ্জুর করেন। কিন্তু তার পরেও চিফ সেক্রেটারি তাকে পুনর্বিবেচনা করতে বলে পাঠান। শান্তিনিকেতনে বাসা মিলছিল না বলে সে আরও কয়েক মাস সময় চায়। মুখ্যমন্ত্রী সে-অনুরোধ মঞ্জুর করেন। শান্তিনিকেতনে বাসা মেলে। বিনু যাবার জন্যে তৈরি, এমন সময় নতুন চিফ সেক্রেটারি সত্যেন্দ্রনাথ রায় একমাসের জন্যে জুডিশিয়াল সেক্রেটারি পদে কাজ চালাতে আহ্বান করেন। একমাসের জায়গায় আরও দু-মাস, তারপরে আরও তিনমাস এমনি করে ছ-মাস কাজ করে বিনু অবশেষে নিষ্কৃতি পায়। সেক্রেটারিয়েটের অভিজ্ঞতাটা বাকি ছিল, সেটাও হল। সেইসঙ্গে লিগাল রিমেমব্রান্সার পদে হাইকোর্টের অভিজ্ঞতাও। ততদিনে তার পুরো পেনশন পাওয়া হয়েছে। একুশ বছরের চেয়ে কয়েক মাস বেশি কার্যকাল। সাতচল্লিশ বছর বয়স। ইচ্ছা করলে আরও তেরো বছর থাকতে পারত, যদি বাঁচত। অথবা যদি সাহিত্যসেবা থেকে বিরত হত।
সেই বাড়তি ছ-মাসের সবচেয়ে বড়ো লাভ বিধানচন্দ্রের সঙ্গে সদ্ভাব। বেলাশেষে তিনি বিনুকে ডেকে পাঠাতেন, দুটো-একটা সরকারি বিষয়ে কথার পর আপনার থেকে বলতেন তাঁর জীবনদর্শনের অপ্রাসঙ্গিক কথা। বোধহয় সাহিত্যিক বিনুকে। ঘরে আর কেউ থাকত না। দুজনে মুখোমুখি।
তাকে বিদায় সংবর্ধনা দেন সেক্রেটারিয়েটের বিচারবিভাগীয় কর্মীরা ও স্বয়ং মন্ত্রী মহোদয়। সব ভালো যার শেষ ভালো।
বিনুর নিভৃতবাস
রুশো টলস্টয় তথা গান্ধীজির প্রভাবে বিনু তার প্রথম যৌবনে ভেবে রেখেছিল যে তাকে একদিন প্রকৃতির আরও কাছাকাছি যেতে হবে। হতে হবে সুদূর গ্রামবাসী, জনগণের জীবনের শরিক। তখনই সে লিখতে পারবে টলস্টয়ের তেইশটি উপকথা-র মতো বই। ইতিমধ্যে মিটিয়ে নিতে হবে সমর ও শান্তি আর আনা কারেনিনা-র মতো বৃহৎ উপন্যাস রচনার সাধ। এক্ষেত্রে তার অন্যতম পূর্বসূরি ছিলেন রম্যাঁ রল্যাঁ। লিখেছিলেন ‘জাঁ ক্রিস্তফ’।
এখন অবসর তো নেওয়া গেল। আপাতত শান্তিনিকেতনই তার নিভৃতবাসের মনোমতো স্থল। এটা পূর্বপরিকল্পিত। পুত্র-কন্যার পড়াশুনার খাতিরে। তারা যেখানেই যাক স্কুল-কলেজে পড়তে চাইবে। তাদের সমবয়সি মধ্যবিত্ত সন্তানদের মতোই তাদের ধ্যানধারণা। মহাত্মা গান্ধী তাঁর পুত্রদের নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় যেসব পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন, গান্ধীভক্ত বিনু ও মীরা পুত্র-কন্যাদের নিয়ে তেমন কিছু করতে ভরসা পায় না। তারা বরং রবীন্দ্রভক্তদের মতো গুরুদেবের অনুসরণ করবে। সুতরাং শান্তিনিকেতনে সপরিবারে নিভৃতবাসই শ্রেয়।
বিনু শান্তিনিকেতনে যাচ্ছে শুনে তার এক শুভানুধ্যায়ী বয়োজ্যেষ্ঠ অফিসার বলেন, ‘শান্তিনিকেতন কি সেই শান্তিনিকেতন আছে? এখন ওটা কলকাতার একটা শহরতলি। তেমনি সব বড়ো বড়ো বাড়ি।’
তার অপর এক শুভানুধ্যায়ী কাজি সাহেব বলেন, ‘ওইখানেই থামবেন না। গভীরভাবে যাবেন আরও অভ্যন্তরে।’
কবিগুরু সেটা ভাবতেন। সেইজন্যেই শ্রীনিকেতনের প্রতিষ্ঠা। শ্রীনিকেতনের কার্যকলাপ গ্রামবাসী কৃষি ও কারুজীবীদের নিয়ে। ছাত্র অবস্থায় বিনু প্রথমবার শান্তিনিকেতনে যায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সে শ্রীনিকেতন দেখতে গিয়ে কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে। নজরে পড়ে একজন কর্মীকে গুরুদেবের উপদেশ—‘গড়ার কাজে ষোলো আনা শক্তি নিয়োগ করো। ভাঙার কাজে সিকি পয়সা শক্তি বাজে খরচ কোরো না।’ ভাষাটা ঠিক মনে নেই। কতকটা এইরূপ। রবীন্দ্রনাথ অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু গান্ধীজি কি অসহযোগীদের গঠনের কাজ করতে নির্দেশ দেননি? চরকা কাটতে তারা বাধ্য। সারা ভারতে অসংখ্য স্বরাজ আশ্রম ছিল। প্রত্যেকটিতে হাতেকাটা সুতো উৎপন্ন হত। খাদি বলে একটা শিল্পই নতুন করে প্রাণ পায়। দেশের লোক একটু বেশি দাম দিয়েই কেনে। বহু দরিদ্রের অন্নসংস্থান হয়।
বিনুর এক ভাই জাপানে শিক্ষার্থী হয়ে যায়। গান্ধীজি অসুস্থ শুনে জাপানিরা রোজ তাদের কাছে এসে জানতে চায় তিনি কেমন আছেন। সে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনাদের এত উৎকন্ঠা কেন?’ তারা বলে, ‘উৎকন্ঠা হবে না? গান্ধী যে গরিবের মা-বাপ।’ ভাই জিজ্ঞাসা করে, ‘আচ্ছা, কে বড়ো? মিকাডো না গান্ধী?’ তারা বলে, ‘গান্ধী। মিকাডোকে জাপানিরাই মানে। গান্ধীকে সব দেশের লোক।’
চরকায় সুতোকাটা ছিল একদা ব্রিটেনের কন্যা ও বধূদের মনোপলি। সেই সূত্রেই তাঁরা কিছু উপার্জন করতে পারতেন। সুতো কাটার কল উদ্ভাবনের পর থেকেই তাঁরা তাঁদের আয়ের সূত্র থেকে বঞ্চিত। এদেশেও বামুনের মেয়েরা চরকায় পৈতের সুতো কাটতেন। কিন্তু সবাইকে চরকায় সুতো কাটতে হবে দিনে অন্তত আধ ঘণ্টার জন্যে, এটা গান্ধীজির নতুন এক ফরমান। পুরুষরা কোনো কালেই বা কোনো দেশেই চরকায় সুতো কাটেনি। বিনু কিছুদিন কেটে মীরার উপর ছেড়ে দেয়। মীরা যেখানেই যায় স্থানীয় মেয়েদের নিয়ে চরকার ক্লাস করে। তাতে তাদের কিছু রোজগার হয়। সেটা তুচ্ছ নয়।
শান্তিনিকেতনে এগারো বছর আগে গুরুদেব মীরাকে বলেছিলেন, ‘শুনেছি তুমি কর্মিষ্ঠা মেয়ে। এখানে এতরকমের বহু বিভাগ। একটা-না-একটাতে তোমার ঠাঁই হবে।’ এখন সে কোনো বিভাগে যোগ দিতে চায় না। আশ্রমে মেয়েদের নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করে। একটা শিশু পাঠশালার প্রতিষ্ঠা হয়। বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের দেখাশোনাও তার একটা স্বেচ্ছাবৃত কর্ম। তারা আসে যায় গানবাজনা করে প্রতি সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট দিনে।
ছেলে-মেয়েরা কলকাতার খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে শান্তিনিকেতনের আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। পড়াশোনা গাছতলায়, খেলাধুলা খেলার মাঠে, সন্ধ্যা বেলা নৃত্যগীতের আসরে বা সভাসমিতিতে, তারপরে নীড়ে ফিরে আসে। রথীবাবুকে বলে রথীদা, ইন্দিরা দেবীকে বিবিদি, প্রতিমা দেবীকে বউঠান, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দাদা ও দিদি। বেশ একটা ঘরোয়া পরিবেশ। এমনটি কলকাতায় ছিল না। ওদের আনন্দে ওদের বাপ-মায়ের আনন্দ।
শান্তিনিকেতনে আসার মুখে বিনুকে জানানো হয় বিশ্বভারতীর নাম হতে যাচ্ছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এটিও হবে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, চ্যান্সেলর হবেন জহরলাল নেহরু, ভাইস-চ্যান্সেলর রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিনুকে অনুরোধ করা হয় রেজিস্ট্রার হতে। যাতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টা দাঁড়িয়ে যায়। বিনু বছর দুয়েকের জন্যে রাজি হয়। কিন্তু শান্তিনিকেতনে এসে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ও পার্লামেন্টের বিশ্বভারতী ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট পড়ে তার মত বদলে যায়। এ পদের দায়িত্ব বহন করলে তার সাহিত্যের কাজ ব্যাহত হবে। সে সাহিত্য নিয়ে থাকবে বলে সরকারি চাকরি ছেড়েছে, এখন বিশ্বভারতী নিয়ে থাকতে হলে সাহিত্যের কাজ ছাড়তে হবে। বিনুর পরামর্শে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন রেজিস্ট্রার নিশিকান্ত সেনকে উক্ত পদ দেওয়া হয়। তাঁর শর্ত বিনু যেন তাঁকে সাহায্য করে।
নিশিকান্তবাবু নাছোড়বান্দা। বিনুকে প্রয়োজনমতো সাহায্যও করতে হয়। কর্মসমিতির সদস্যরূপেও তার উপস্থিতি আবশ্যক। কিন্তু রথীবাবুর পদত্যাগে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন নিয়ে দলাদলি বেঁধে দেয়। বিনুও তাতে জড়িয়ে পড়ে। বিনু পরে সদস্যপদ ত্যাগ করে সাহিত্যে মন দেয়।
দ্বিতীয় যৌবনের জন্যে বিনু অস্থির হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় যৌবন না পেলে প্রথম যৌবনের উপাখ্যান লেখা স্বচ্ছন্দ হয় না। যে লিখবে সে তখনকার দিনের তরুণ। যাদের কথা লেখা হবে তারাও তাই। লিখতে হবে প্রেমের আলাপ প্রেমের ভাষায়। তারজন্যে রাজকর্ম থেকে অবসরের আবশ্যকতা ছিল। সেটাও তার অপসরণের অন্যতম কারণ।
রায় লিখতে লিখতে রিপোর্ট লিখতে লিখতে বিনুর লেখার হাত খারাপ হয়ে গেছিল; অর্থাৎ সাহিত্যের বিচারে খারাপ। বেশ কিছুকাল লেগে যায় লেখার হাত ভালো করতে; অর্থাৎ সাহিত্যের বিচারে ভালো। ছোটো ছোটো উপন্যাস লেখে। ছোটোগল্প লেখে। প্রবন্ধ তো লেখেই, সাহিত্যিক তথা সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রবন্ধ। ছড়াতেই তার হাত খোলে। ছেলেদের জন্যে ছড়া। বড়োদের জন্যে ছড়া।
কিন্তু ব্যাঘাত থেকে নিষ্কৃতি কোথায়? ভারত সরকার তাকে নবগঠিত সাহিত্য আকাদেমির সংসদের সদস্য মনোনয়ন করেন। সংসদের সদস্যরা তাকে কর্মসমিতির সদস্য নির্বাচন করেন। এই সুবাদে তাকে বার বার দিল্লি যেতে হয়। সম্মান বড়ো কম নয়। নেহরু সভাপতি, রাধাকৃষ্ণন সহ-সভাপতি, মওলানা আজাদ, সর্দার পানিক্কর প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিরা সদস্য। এঁদের সঙ্গে এক টেবিলে বসার সৌভাগ্য। কিন্তু কিছুদিন পরে বিনু উপলব্ধি করে যে আকাদেমির স্বীকৃত বারোটা সাহিত্যের বিবর্তন একভাবে হয়নি, বিকাশ এক মানের নয়, সমস্যা এক এক সাহিত্যের এক এক প্রকার। অতএব বিভিন্ন ভাষার জন্যে বিভিন্ন শাখা আকাদেমি আবশ্যক। তার কথা শুনে নেহরু চমকে ওঠেন। বলেন অমন করলে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবি উঠবে, ভারত টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। রাধাকৃষ্ণন নেহরুর প্রতিধ্বনি করেন। আর সবাই নীরব। কিন্তু শ্রীরামুলুর অনশনে প্রাণত্যাগের পর নেহরু চটপট অন্ধ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। একে একে অনেকগুলি ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠিত হয় নেহরু জীবিত থাকতেই। পরে ভাষার ভিত্তিতে পাঞ্জাব তথা অসমের পুনর্বিন্যাস ঘটে।
এসব রাজ্যের অনেকগুলিতেই ভাষাভিত্তিক আকাদেমি স্থাপিত হয়। তখন দিল্লির সাহিত্য আকাদেমিরও চারটি আঞ্চলিক শাখা স্থাপন না করে উপায় থাকে না। ততদিনে বিনু পদত্যাগ করে নিজের কাজে মন দিয়েছে। আকাদেমির কাজ বিনু ছাড়া আরও অনেকে করতে পারেন। যেটা সে ছাড়া আর কারও দ্বারা হবার নয় সেই কাজটি তার করণীয় কাজ। যেমন তার পরিকল্পিত পাঁচ খন্ডের—পরে ছয় খন্ডের উপন্যাস। তেমনি তার পরিকল্পিত চার খন্ডের প্রেমের উপাখ্যান। তার এক সাহিত্যিক বন্ধুর মতে সে বিষয়টাকে বেছে নেয়নি, বিষয়টাই তাকে বেছে নিয়েছে।
বিষয় তো সেই ইটারনাল ফেমিনিন, যার উল্লেখ সে পেয়েছিল প্রমথ চৌধুরির চার ইয়ারি কথা উপাখ্যানের তৃতীয় উপাখ্যানে। সোমনাথের জবানিতে। ভাস্কর্যে তার দৃষ্টান্ত ভিনাস ডি মাইলো। কাব্য ও নাটকে কোথাও সে হেলেন, কোথাও দ্রৌপদী, কোথাও বিয়াত্রিস, কোথাও রাধা, কোথাও শকুন্তলা, কোথাও বসন্তসেনা, কোথাও গ্রেটচেন—যার সম্বন্ধে গ্যেটে লিখেছেন চিরন্তনী নারী আমাদের ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়।
এই যে চিরন্তনী নারী একে একালেও দেখা যায়। এদেশেও, ওদেশেও। বিনুর ধারণা সে একঝলক দেখেছে। তাই সেটুকু অবলম্বন করেই উপন্যাস লিখতে মনস্থ করেছে।
বিষয়টি বিনুকে আবিষ্ট করে রাখে আযৌবন। সে যখন সময় পায় তখন সে পঞ্চাশোর্ধ্বে। ধ্যান করে দ্বিতীয় যৌবনের। কাহিনি লেখে প্রথম যৌবনের। প্রথম দুই ভাগ লিখতে বাধা পায় না। কিন্তু তৃতীয় ভাগ আরম্ভ করতে হাত ওঠে না। গোড়াতেই লিখতে হত এমন দুটি বাক্য যা না লিখলে নয়। তাতেই নিহিত ছিল কাহিনির বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সে দুটি বাক্য লিখলে অনিষ্ট হত একজন নারীর ও তার সন্তানের। লেখা হয়তো রূপোত্তীর্ণ, রসোত্তীর্ণ তথা কালোত্তীর্ণ হবে, লেখক হয়তো অমর হবে, কিন্তু অপরের জীবনে যে প্রতিক্রিয়া সম্ভবপর সেটা কি বিবেকসম্মত না বিবেকবিরুদ্ধ? এই উভয়সংকট থেকে উদ্ধারের উপায় কি সেই দু-টি বাক্যের পরিবর্তন? না, সেটাও সততা নয়।
বিনুর মনে পড়ে আলমোড়ায় এক পর্বতারোহী ইংরেজ ভদ্রলোকের উক্তি। তিনি বলেন আরোহী যখন দেখতে পায় যে আর এক কদম এগোলেই নিশ্চিত মরণ তখন সে আর এগোয় না। সে বোঝে পর্বতের কাছে সে পরাস্ত হয়েছে। সে পরাজয় মেনে নয়। বিনু ঘোষণা করে সে আর লিখবে না। বই সেইখানেই সমাপ্ত। কিন্তু প্রকাশক তা শুনবেন কেন? পাঠকই-বা তা মেনে নেবেন কেন? বিনুর মনে পড়ে মহাত্মা গান্ধী তাঁর এক অনুগামীকে বলেছিলেন, যেটা আরম্ভ করবে সেটা শেষ করবে। মহাত্মার উপদেশ শিরোধার্য করলে বিনুকে আরও লিখতে হয়। কিন্তু সেই দুটি বাক্য বাদ দেয় কী করে? লেখেই-বা কী করে? বছর দশেক লেগে যায় আভ্যন্তরিক সংগ্রামে। ছেলে পরামর্শ দেয় বইখানা লিখে পান্ডুলিপি সিন্দুকে বন্ধ করে রাখতে। মৃত্যুর পরে প্রকাশ করা হবে। মন্দ পরামর্শ নয়। কিন্তু প্রকাশক টের পেলে নিশ্চয়ই দাবি করবেন ও অর্থের টানাটানি থাকলে কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে বিনু সে-পান্ডুলিপি ছাপতে দিতে পারে। তাই বিনু সে-পরামর্শ খারিজ করে।
শেষপর্যন্ত যেটা স্থির হয় সেটা সেই দুটি বাক্যের পরিবর্তন। ‘সত্যং ব্রূয়াৎ প্রিয়ং ব্রূয়াৎ মা ব্রূয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম।’ সত্য বলবে, প্রিয় বলবে, অপ্রিয় সত্য বলবে না। এটা হল ঋষিবাক্য। তারপর লেখা তরতর করে চলে। বই সারা হয়। কিন্তু চার খন্ডে নয়, বর্ধিত তৃতীয় খন্ডে। যথেষ্ট দেরি হয়েছে, আর দেরি নয়।
বিনুর পরিকল্পনা ছিল একই নায়কের তিনবার প্রেমের অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব অবলম্বন করে তিন পর্যায়ের উপন্যাস রচনার। প্রথম পর্যায়ের মাঝখানে থেমে যেতে বাধ্য হওয়ার পর সে ভয় পায় যে আবার হয়তো সেইরকম সংকটে পড়বে। আদালতের সাক্ষীরা শপথ পাঠ করার সময় উচ্চারণ করে, সত্য বলিব, সম্পূর্ণ সত্য বলিব, সত্য ব্যতীত অন্য কিছু বলিব না। লেখকরূপে বিনুও উচ্চারণ করে, সত্য বলিব, সত্য ব্যতীত অন্য কিছু বলিব না, কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য বলার শপথ নিতে সাহস পায় না। সম্পূর্ণ সত্য বলতে গেলে আর পাঁচজনকে জড়াতে হয়, সেটা তাদের দিক থেকে আপত্তিকর হতে পারে, তাদের আপত্তি উপেক্ষা করার স্বাধীনতা কি তার আছে?
আর্ট জীবনের থেকে নেয়। জীবনকে অনুসরণ করেই অতিক্রম করে। তখন জীবন আর্টের অনুসরণ করে। এটাই বিনুর মৌল ধারণা। কল্পনার খাদ মেশাতে হয়, তা বলে কল্পনাই সোনা নয়। সোনা হচ্ছে সত্য উপলব্ধি, যার জীবনে যতটুকু বা যত বেশি। সে প্রকাশ করার মতো কিছু পেয়ে থাকলে তবেই তো দেবে কিন্তু প্রকাশ করতে গিয়ে সবটা ব্যক্ত করা যায় কি? বিনুর ধারণা ছিল হ্যাঁ যায়। ক্রমে প্রত্যয় হল, না, যায় না। সংকট বার বার আসবে। পার হওয়া শক্ত। বিশেষত তৃতীয় পর্যায়ের বেলা। বৈষ্ণব কবিরা রাধাকৃষ্ণের লীলা বলে চালাতেন। সে-যুগ কি আর আছে!
বিনু সম্পূর্ণ সত্যের প্রতিশ্রুতি না দিয়ে যতদূর সম্ভব ততদূর অগ্রসর হয়। তাতে তার মন ভরে না। উপন্যাস তার কাছে একটুখানি সোনা, বাকিটা খাদ নয়। তাই যদি হত তবে সে বিস্তর উপন্যাস লিখত। ভারতচন্দ্রের মতে, সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর। বিস্তর মিছার বেসাতি তার নয়। সম্পূর্ণ সত্য বলতে পারলে সে ভারমুক্ত হত। সেকি ভারমুক্ত হয়ে অপ্রকাশিত রেখে যেতে পারত না? না, সেই পরিমাণ মনের জোর তার ছিল না।
উপন্যাস রচনায় তার আদর্শ ছিল রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নয়, টলস্টয়ের। যেমন সমর ও শান্তি ও আনা কারেনিনা কিন্তু ক্রয়টৎসার সোনাটা নয়। ততদিনে তিনি নীতিনিপুণ হয়ে উঠেছিলেন। আর্ট বিনুর মতে মরালিটির বাহন নয়। তাকে নীতির শাসনে আনলে সে বহুবর্ণ থাকে না, একরঙা হয়ে ওঠে। তাতে সমাজের হয়তো কিছু লাভ হয়। কিন্তু মানুষ কি কেবল সামাজিক জীব? মানুষ হচ্ছে প্রকৃতির মতো ভালোয়-মন্দে, সাদায়-কালোয়, জ্ঞানে-অজ্ঞানে, সুন্দরে-কুৎসিতে মেশা; তা সত্ত্বেও পশুর চেয়ে ঊর্ধ্ব স্তরে কিন্তু অতিমানব বা দেবপ্রতিম নয়। বিনু নিজেকে একজন আর্টিস্ট মনে করে, মরালিস্ট নয়।
তবে এটাও সে মানে যে জগতে মরালিটির স্থান আছে। এ জগৎ কেবল প্রকৃতির নিয়মে নয়, নীতির নিয়মেও শাসিত। আর্টে তার প্রতিফলন পড়তে পারে, কিন্তু আর্টকে তার প্রচারমাধ্যম না করলেই হল। একই কথা রাজনীতি সম্বন্ধেও বলা যায়। জীবনে যদি রাজনীতি থাকে আর্টেও থাকবে। কিন্তু আর্টকে করবে না তার প্রচারমাধ্যম। ফরাসি বিপ্লব নিয়ে কত-না উপন্যাস লেখা হয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়েও হবে। তাতে রাজনীতির প্রতিফলন থাকবেই। না থাকলে তা আলুনি লাগবে।
বিনু কি কেবল জীবনশিল্পী? সেকি একজন নাগরিক নয়? নাগরিক হিসাবে কি তার কোনো বক্তব্য নেই? থাকলে তাকে সে-বক্তব্য পেশ করতে হয়। কখনো কখনো সেটা অবশ্যকর্তব্য, যেমন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় কিংবা অসমের বঙ্গাল খেদা; কিংবা চীন-ভারত সংঘর্ষ; কিংবা কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ ও শেখ আবদুল্লার সঙ্গে বিরোধ।
যার ভোট দেবার অধিকার আছে তার মুখ খোলারও অধিকার আছে। সে তার লেখনীর মুখ খুলতে পারে। লেখা হয়তো রসোত্তীর্ণ তথা রূপোত্তীর্ণ হবে, কিন্তু কালোত্তীর্ণ হবে কী করে? বিষয়টা যে নিতান্তই সাময়িক। তার স্থায়িত্ব কতক্ষণ?
রম্যাঁ রল্যাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় বিনু তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, সাহিত্যিক কি সমসাময়িক সমস্যা নিয়ে লেখনী চালনা করতে পারে? রল্যাঁ বলেন, নিশ্চয়। বিনু জানতে চায়, শেক্সপিয়ারও কি করতেন? রল্যাঁ বলেন, হ্যাঁ। সম্ভবত তাঁর নাটকের ভিতরে তা প্রচ্ছন্ন আকারে ছিল। বিনু সেটা লক্ষ করেনি। তবে রল্যাঁ যে সমসাময়িকের প্রতি কর্তব্য করেছেন ও করতেন এটা বিনুর কাছে স্পষ্ট। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় লেখা তাঁর ‘যুদ্ধের ঊর্ধ্বে’ একটি বিখ্যাত প্রবন্ধ। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও তার মূল্য শেষ হয়ে যায়নি। তিনি ফরাসি জার্মান বিরোধের ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনিই বোধহয় সেদিন একমাত্র ফরাসি যিনি জার্মানদের শত্রু ভাবতেন না। ফরাসি জনমত তাঁকে সেদিন ক্ষমা করেনি। যুদ্ধের পরে তাঁকে ফ্রান্সের বাইরে সুইটজারল্যাণ্ডে স্বেচ্ছানির্বাসিত হতে হয়েছিল। লেখক তার মানবপ্রেমের জন্যে বনবাস বরণ করবে এটি তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে তাঁর পাঠকরা তাঁকে ছাড়েননি—নানা দেশের পাঠক।
সমসাময়িক সমস্যা নিয়ে লিখবে না, বিনু আর এই সংকল্পে দৃঢ় থাকতে পারেনি। ধর্মান্ধ দেশকে দৃষ্টিদান করা চক্ষুষ্মানের অবশ্যকর্তব্য। ফল যে বিশেষ কিছু হল তা নয়। ধর্মের ইসুতে দেশ ও প্রদেশ দ্বিধাবিভক্ত হল। তা বলে কি সে সব লেখা মূল্যহীন? না, তাদের ঐতিহাসিক মূল্য আছে।
ধর্মের ইসুতে আয়ার্ল্যাণ্ড ভাগ হয়ে গেল। অথচ তার স্বাধীনতার সংগ্রাম ভারতের চেয়েও পুরাতন। তাতে ক্যাথলিক প্রোটেস্টান্ট উভয় সম্প্রদায়ের রক্ত মিশেছিল। ইয়েটস, বার্নার্ড শ, জর্জ রাসেল এঁরা সবাই প্রটেস্টান্ট। কিন্তু দেশভাগের সময় দেখা গেল এঁরা নিরুপায়। সিদ্ধান্তটা যাঁরা নিলেন তাঁরা ক্যাথলিক প্রোটেস্টান্টের গৃহযুদ্ধ নিবারণের জন্যই নিলেন। দশ ভাগ খারাপ কিন্তু গৃহযুদ্ধ আরও খারাপ, বিশেষত ধর্মের ইসুতে। লিঙ্কনের সামনে তেমন কোনো সাম্প্রদায়িক ইস্যু ছিল না।
বিনুর ধারণা ছিল আধুনিক যুগের মানুষ ধর্ম নিয়ে লড়তে চায় না, সেটা মধ্যযুগের মানুষের কাছে জীবন-মরণের ব্যাপার। কিন্তু তাই যদি হত তবে আয়ার্ল্যাণ্ডের মানুষ আধুনিক যুগের বিংশ শতাব্দীতে নিশ্বাস নিয়েও ধর্মের প্রভাবে দ্বিধাবিভক্ত হত না। স্বদেশে ক্যাথলিক-প্রোটেস্টান্টের মধ্যে যতটা ব্যবধান এদেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে তার চেয়ে আরও বেশি। পুরাণসর্বস্ব হিন্দু ধর্মের সঙ্গে কোরানসর্বস্ব মুসলিম ধর্মের সমন্বয় যেন বৃত্তের সঙ্গে চতুষ্কোণের সমন্বয়। সেটা সমন্বয় নয়, সহনশীলতা। মিলন যেটুকু হয়েছে সেটুকু সুফি ও বৈষ্ণবদের মতো পুরাণনিরপেক্ষ তথা কোরাননিরপেক্ষ সাধকদের জীবনেই হয়েছে। আর হয়েছে তাঁদের ভক্তদের মধ্যে। পিরদের মাজারে বা উরসে যাঁরা জমায়েত হন তাঁদের সবাই যে মুসলমান তা নয়, বিপুলসংখ্যক হিন্দু। অথচ এঁরাই আবার গোহত্যা নিয়ে বা মসজিদের সামনে বাজনা নিয়ে রক্তারক্তি করতে পেছপাও হন না। শান্তির পথে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ আবশ্যক হয়।
তৃতীয় পক্ষ বিদায় হলে দুই পক্ষের মধ্যে হানাহানি বেঁধে যাবে এ ভয় বিনুর মধ্যে ছিল। তাই দেশভাগের সময় সে আইরিশ কবি ও নাট্যকারের মতোই নিরুপায়। তার ভরসা ছিল মহাত্মা গান্ধীর উপরে। সেতুবন্ধ যদি মহাত্মা গান্ধী ও সীমান্ত গান্ধীর জীবনে সম্ভব হয়ে থাকে, সীমান্তপ্রদেশে যদি কংগ্রেস শাসন সম্ভব হয়ে থাকে তবে কী এক অলৌকিক উপায়ে সর্বত্র সম্ভব হবে। ভারত আয়ার্ল্যাণ্ড নয়। মাভৈঃ। কিন্তু তৃতীয় পক্ষের বিদায়ের সময় যে দৃশ্য দেখা গেল তা তার কল্পনাতীত। পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবে লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান শিখ পরস্পরের হাতে নিহত। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রায় নব্বই লক্ষ হিন্দু শিখ শরণার্থী সমাগত। এদিক থেকেও লক্ষ মুসলমান বিতাড়িত। এর অনুরূপ ব্যাপার দুই বাংলার হিন্দু-মুসলমানের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারত, যদি-না মহাত্মা গান্ধী অহিংস উপায়ে সফল হতেন। তা সত্ত্বেও হিন্দু ওপার থেকে এপারে চলে আসে, বহু মুসলমান এপার থেকে ওপারে চলে যায়। কতকটা নিরাপত্তার খাতিরে, কতকটা চাকরিবাকরির আশায়, কতকটা ক্ষমতার প্রলোভনে।
শান্তিনিকেতনে গিয়ে বিনু সেখানকার ছাত্র ও অধ্যাপকদের মধ্যে কয়েক জন সহকর্মী পায়। তাঁদেরই উৎসাহে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলায় সমমনস্ক কয়েক জন সাহিত্যিককে নিয়ে সাহিত্যমেলা অনুষ্ঠিত হয় বিনুর তত্ত্বাবধানে। তারিখটা, ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারির কাছাকাছি। প্রকারান্তরে জানিয়ে দেওয়া হল যে দেশভাগ সত্ত্বেও বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য এক ও অবিভাজ্য। রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন তার দৃষ্টান্ত। রথীবাবু ও তাঁর সহযোগীরা সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেন। লোকে না চাইতেই চাঁদা দিয়ে যায়।
শান্তিনিকেতনকে বলা যেতে পারে সংস্কৃতির শ্রীক্ষেত্র। এখানে সব দেশের, সব ধর্মের, সব ভাষার সাহিত্য-সংগীত-ললিতকলা রসিকরা স্বাগত। এটা জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারেরও ঐতিহ্য। বলা যেতে পারে শান্তিনিকেতনের এই বৈশিষ্ট্য ঠাকুর পরিবারের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরই সম্প্রসারণ।
তবে শান্তিনিকেতনের সূচনা হয়েছিল সেই নামে একটি অতিথিশালারূপে। সেখানে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের অর্থানুকূল্যে সপ্তাহকাল বাস করতে আসতেন বাইরে থেকে ব্রাহ্মসমাজের সদস্য ও সমভাবাপন্ন ব্যক্তিরা। লোকালয় থেকে দূরে খোলামেলা জায়গায় তাঁরা নিরিবিলিতে ধ্যানধারণা করতেন। সেকালের ঋষিদের আদর্শ অনুসরণই ছিল তাঁদের অন্বিষ্ট। ঋষিরা অনুসরণ করেন বলেই দেবেন্দ্রনাথকে বলা হত মহর্ষি। ডাঙা জমিতে একটি কি দুটি ছাতিম গাছ ছিল। ছাতিমতলায় বিশ্রাম করতে আসন পেতে মহর্ষি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার প্রেরণা লাভ করেন। প্রত্যেক বছর সাতই পৌষ ছাতিমতলায় সেই উপলক্ষ্যে উৎসব হয়। যোগ দেন স্থানীয় ও বহিরাগত ব্রাহ্ম-অব্রাহ্ম সর্বসাধারণ। আশ্রমের বাইরে মেলা বসে। সেখানে যাত্রা, কীর্তন, বাউল প্রভৃতি বিচিত্র অনুষ্ঠান হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় অত্যাশ্চর্য আতসবাজি।
‘শান্তিনিকেতন’ আবাস প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরে ব্রাহ্মমতে উপাসনার জন্যে একটি উপাসনাগার নির্মিত হয়। বলা হয় মন্দির। যেখানে বিগ্রহ নেই সেখানে মন্দির শব্দের প্রয়োগ বিনুর কাছে নতুন ঠেকে। এই মন্দিরে রবীন্দ্রনাথ যেসব ভাষণ দিতেন সেসব বিনুর বাল্যকালে শান্তিনিকেতন নামে ছোটো ছোটো খন্ডে প্রকাশিত হত। সে যে-স্কুলে পড়ত সেখানকার লাইব্রেরিতে কয়েক খন্ড ছিল। বিনু নাড়াচাড়া করে দেখত।
মহর্ষির আধ্যাত্মিক আদর্শকে সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তি দেন কবি রবীন্দ্রনাথ। আশ্রমের নাম হয় ব্রহ্মচর্যাশ্রম, বালক ব্রহ্মচারীদের শিক্ষার জন্য গুরুকুল আদর্শের আবাসিক বিদ্যালয়, তাতে প্রাচীন বিদ্যার সঙ্গে সংযুক্ত করেন আধুনিক বিদ্যা; তা ছাড়া গানবাজনা, ছবি আঁকা, নাট্যাভিনয়, খেলাধুলা, শরীরচর্চা, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ।
ব্রহ্মচর্যাশ্রম আখ্যাটি পরে অপ্রচলিত হয়। ছাত্ররা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়, উত্তীর্ণ হলে কলেজে পড়তে যায়। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর সতীর্থ সন্তোষচন্দ্র মজুমদার কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্য আমেরিকা যাত্রা করেন। কবির ইংরেজ ভক্ত পিয়ার্সন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বিদ্যালয়ের কাজে যোগ দেন। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর গুরুদেব বিশ্বের নানা দেশে সংবর্ধনা পান। পরিবর্তে বিশ্বের বিদ্যার্থী ও বিদ্বানদের আহ্বান করেন শান্তিনিকেতনে এসে কিছুদিন থেকে শিখতে ও শেখাতে। বিদ্যালয়ের চেয়ে উন্নত একটি প্রতিষ্ঠানের নাম রাখেন বিশ্বভারতী। শান্তিনিকেতনে আর একটি মাত্রা যুক্ত হয়।
শান্তিনিকেতনের দীর্ঘকালের জলকষ্ট পরে দূর হয়েছে। গভীর নলকূপ থেকে জল তুলে ঘরে ঘরে সরবরাহ করা হচ্ছে। এত গাছপালা, এত ফুল, এত সবুজ ঘাস এর আগে দেখা যায়নি, কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে। বলা যেতে পারে এটা একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠাকালে যদুনাথ সরকার জানিয়েছিলেন যে জল যেখানে দুর্লভ সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে যাওয়া বৃথা। কিন্তু গুরুদেব তো বিশ্বভারতীকে বিশ্ববিদ্যালয়রূপে কল্পনা করেননি। তিনি উপাচার্য বলে কোনো পদ সৃষ্টি করেননি, পরীক্ষায় বিশ্বাস করতেন না, ডিগ্রির প্রয়োজন দেখতেন না। বিদ্যার্থীরা নিজেদের পছন্দমতো বই পড়তেন, গবেষণা করতেন, অধ্যাপকদের কাছে পাঠ নিতেন। অধ্যাপকরা অধীত বিদ্যার অংশ দিতেন। যে যার সাধ্যমতো গ্রহণ করত।
গুরুদেবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইন্টারমিডিয়েট কলেজ স্থাপন করা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য অনুসরণ করা হয়। যথাকালে পরীক্ষা দেওয়া হয়। পাস করলে অন্যত্র বিএ পড়তে যাওয়া হয়। পরে শান্তিনিকেতনেই বিএ পড়ার ব্যবস্থা হয়। কলকাতার পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হয়। যথাকালে পরীক্ষা দেওয়া হয়। এতদূর অগ্রসর হওয়ার পর বাকিটুকুতে আপত্তি কীসের? এমন সময় দেশ স্বাধীন হয়, নতুন সরকার বিশ্বভারতীকে অর্থাভাব থেকে উদ্ধার করতে রাজি হন, উভয় পক্ষের ইচ্ছায় বিশ্বভারতী হয় কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় হলে নিজস্ব পাঠ্যক্রম, নিজস্ব পরীক্ষা, নিজস্ব ডিগ্রি এসব একে একে প্রবর্তিত হয়। তবে বিশ্বভারতী কোর্স বলে একটা সমান্তরাল পাঠ্যক্রম প্রচলিত ছিল। চার-পাঁচজন ছাত্র-ছাত্রী অনুসরণ করত। সেটা উঠে যায়। সেটাতে নাকি গুরুদেবের নির্বাচিত পাঠ্য ছিল।
অবসর নিয়ে বিনু যখন সপরিবারে বসবাস করতে যায় তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শুরু হচ্ছে। দেশের আর দশটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ডিগ্রির সমতা রক্ষা না করলে বিশ্বভারতীর ডিগ্রির মর্যাদা থাকে না, সুতরাং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো করে বিশ্বভারতীকে ঢেলে সাজাতে হয়। এটা কারও একার সিদ্ধান্ত নয়। রথীন্দ্রনাথকে দায়ী করা অন্যায়। স্থানীয় অধ্যাপকরা এসব পরিবর্তন সাগ্রহে স্বীকার করেন। তাতে তাঁদেরও আর্থিক নিরাপত্তা সুদৃঢ় হয়। লাগে টাকা দেবেন গৌরী সেন। ততদিনে বেসরকারি চাঁদা বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ চাঁদা দেয় না। বিভাগ সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। কলাভবন, সংগীতভবন, চীনভবন ইত্যাদি গড়ে উঠেছে।
গুরুদেবের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎকারের সময় ঘরে প্রবেশ করেন এক চৈনিক আশ্রমিক। কবি পরিচয় করিয়ে দেন। নাম তান ইয়ুনশান। ভদ্রলোক দুটি কথা বলে বিদায় নিলে কবি বলেন, ‘জাপানি বিদ্বানরাও অত্যন্ত কুশলী, কিন্তু চীনা বিদ্বানদের মধ্যে দেখি প্রাচীনতর এক প্রজ্ঞা। যেটা জাপানিদের মধ্যে পাইনে।’ পরে তান সাহেবের সঙ্গে বিনুর পরিচয় প্রগাঢ় হয়। তাঁর চরিত্রে ছিল এক পরিশীলিত বৌদ্ধ স্থিতপ্রজ্ঞতা।
বছর পাঁচেক পরে শান্তিনিকেতন বেড়াতে গিয়ে বিনু চীনভবন দেখতে যায়। সেখানে এক চীনা অধ্যাপক দম্পতির সঙ্গে আলাপ। ভদ্রমহিলা নিবিষ্টমনে কী একখানা বই অনুবাদ করছিলেন। বিনু অবাক হয়ে লক্ষ করে ওখানা তার ও মীরার ইংরেজি বই। কিছুদিন পরে তাঁরা চীন দেশে ফিরে যান। কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করে, যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। তান সাহেব কমিউনিস্ট নন। তিরিশ বছর পরে বিনু ও মীরা শান্তিনিকেতনে আবার সেই দম্পতির সাক্ষাৎ পায়। বইখানার কী হল জানতে চাইলে ভদ্রমহিলা বলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তাঁদের দুজনকে ধরে পাড়াগাঁয়ে চালান করা হয়। সেখানে তাঁর স্বামীকে করতে হত মাঠে গিয়ে চাষ-আবাদ আর তাঁকে ঘরে বসে রান্নাবান্না, বাসনমাজা, কাপড়কাচা, ঝাঁট দেওয়া। বইপত্র কোথায় হারিয়ে যায়। অনুবাদটি নিখোঁজ। বিনু দুঃখিত হয়। তবে আনন্দের বিষয় মাও জে দুং-এর মৃত্যুর পরে নয়া সরকার তাঁদের রাজধানীতে ফিরিয়ে আনেন, চাকরি ফিরিয়ে দেন—বাড়িসমেত, বকেয়া মাইনেসমেত। স্বামী সংস্কৃতের অধ্যাপক। তিনি নিমন্ত্রিত হয়ে আবার এসেছেন শান্তিনিকেতনে। তাঁকে দেশিকোত্তম উপাধি দিয়ে সম্মান জানানো হয়।
একান্ন সালে বসবাস করতে গিয়ে বিনুর আলাপ হয় দুজন ইন্দোনেশিয়ানের সঙ্গে, একজন অধ্যাপক—সংস্কৃত পন্ডিত। এমন একটি ছন্দ আবৃত্তি করেন যেটি ভারতে বিলুপ্ত, জাভায় রক্ষিত। তাঁর নাম বীর্যসুপার্থ শুনে বিনু বিস্মিত হয়। তিনি বলেন, বীর্য মানে বীর, সুপার্থ মানে অর্জুন। ওঁরা সংস্কৃত নামের পূর্বে একটা সু বসিয়ে দেন। যেমন সুকর্ণ। বিনু চমৎকৃত হয় যখন শোনে তিনি ধর্মে মুসলমান। শেষে ফিরে গিয়ে তিনি চিঠি লেখেন, তাঁর একটি পুত্রসন্তান হয়েছে। নাম রেখেছেন আর্যাবর্তপুত্র জয়বিষ্ণুবর্ধন। জন্ম নয়, সূচনা হয়েছিল আর্যাবর্তে অর্থাৎ ভারতে।
অপরজন বালিদ্বীপের হিন্দু ব্রাহ্মণ। নাম ইদা বাগুস মন্ত্র। তিনি ছাত্র। মীরার আমন্ত্রণে মন্ত্র একদিন সন্ধ্যা বেলা নর্তকের সাজ পরে বালিদ্বীপের নৃত্য প্রদর্শন করেন। বালিদ্বীপ নৃত্যের জন্যে প্রসিদ্ধ। মন্ত্র দেশে ফিরে গিয়ে ক্রমে উচ্চপদস্থ হন। পরে ভারতে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত।
বিনু রথীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করে, বিশ্বভারতী কি ইন্দোনেশিয়ান অধ্যাপক ও ছাত্রদের জন্যে একটি ভবন স্থাপন করতে পারে না? তিনি উত্তর দেন, বিস্তর ছাত্র আসতে চায়, তাদের জন্যে ব্যবস্থা করার বাসনাও ছিল, কিন্তু কোথায় এত অর্থ? বিনু জানত না যে চীনভবনের জন্যে অর্থ চিয়াং কাইশেক দান করেছিলেন। নইলে বিশ্বভারতীর সামর্থ্যে কুলোত না। সুকর্ণ কি ইন্দোনেশিয়া ভবনের জন্যে অর্থদান করতে পারতেন না? হয়তো পারতেন, কিন্তু নানা কারণে নেহরুর সঙ্গে সম্পর্ক তিতিয়ে যায়। ইন্দোনেশিয়া কোনো কালেই ভারতের অংশ বা উপনিবেশ ছিল না। ‘দ্বীপময় ভারত’ ধারণাটা ভ্রমাত্মক। ওয়েস্ট ইন্ডিয়া দ্বীপপুঞ্জের বিপরীত দিকে অবস্থান, সেইজন্যেই ইস্ট ইন্ডিয়া দ্বীপপুঞ্জ নামকরণ করেছিলেন ইউরোপীয় আবিষ্কর্তারা, কোনো ভারতীয় নয়। নামকরণ ভ্রমাত্মক।
ইন্দোনেশিয়ানরা আর আসে না। তিব্বতিরা আসে। তাঁদের সঙ্গে বিনুদের আলাপ জমে। একদিন বিনুদের তাঁরা নিমন্ত্রণ করে চা খাওয়ান। ইয়াক নামক প্রাণীর দুধের সঙ্গে আরও কী কী মিশিয়ে যা তৈরি করা হয় তা এক অপূর্ব পানীয়। একপ্রকার পায়েস বললেও চলে, যদিও মিষ্টি নয়। বলা বাহুল্য তিব্বতিরা কমিউনিস্ট চীনের দাপটে দেশত্যাগী। তাদের সংস্কৃতি চৈনিকের চেয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির নিকটতর। তা লিপিতেই প্রমাণ।
এই শতাব্দীতে তিব্বত থেকে শরণার্থীরা ভারতে এসেছে। সকলেই বৌদ্ধ। বহু শতাব্দী পূর্বে যাঁরা তিব্বতে যান তাঁরাও সকলেই বৌদ্ধ। সেই সূত্রে বিপুলসংখ্যক বৌদ্ধ পুথি তিব্বতে স্থানান্তরিত হয়। সংস্কৃত ভাষায় লিখিত। ভারতে বৌদ্ধবিহারগুলি পরিত্যক্ত হওয়ায় অন্যত্র সে সব পুথির আশ্রয় মিলত না। তিব্বতে সে সব গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ প্রচলিত হয়। চীনে চীনা অনুবাদ। জাপানে জাপানি অনুবাদ। মূল গ্রন্থগুলি ক্রমশ লোপ পায়। কিছুকাল থেকে চেষ্টা চলেছে অনুবাদ থেকে মূল গ্রন্থ উদ্ধারের। যাঁরা করেছেন তাঁদের মধ্যে বিশ্বভারতীর চীনভবনের অধ্যাপক বেঙ্কটরমণন অন্যতম। তিনি ইংরেজিতেও অনুবাদ করেন। বিনুকে দেখতে দেন প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের ইংরেজি অনুবাদ। বিনুর কাছে তার মর্মভেদ সহজ হয় না। সেটাও একপ্রকার উচ্চতর গণিত। বিনু তো নিম্নতর গণিতও জানে না। বৌদ্ধদের পদে পদে যুক্তি। যুক্তির সাহায্যেই তাঁরা সত্যে উপনীত হতেন। আদিতে অবশ্য ছিল বোধি। এখানে বলে রাখি, প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র মহাযান সম্প্রদায়ের গ্রন্থ। তিব্বত, চীন, জাপান, কোরিয়া ও মঙ্গোলিয়ায় মহাযান সম্প্রদায়েরই অধিষ্ঠান। অপরপক্ষে শ্রীলঙ্কা, বর্মা, থাইল্যাণ্ড প্রভৃতিতে তথাকথিত হীনযান সম্প্রদায়ের অবস্থান। হীনযানটা পরের দেওয়া নাম। তাঁদের মতে তাঁদের তত্ত্বের নাম থেরবাদ—স্থবিরবাদ।
উপাচার্য প্রবোধচন্দ্র বাগচি ছিলেন বৌদ্ধসংস্কৃতির বিশেষজ্ঞ। তাঁর আহ্বানে শান্তিনিকেতনে আসেন জাপান থেকে অধ্যাপক কাসুগাই সস্ত্রীক। জাপানে প্রচলিত বৌদ্ধ ধর্মে বহু উপসম্প্রদায়। তাদের একটি দেশজ, আর সব ভারতগত। কাসুগাই দম্পতির সঙ্গে বিনু ও মীরা মেলামেশা করে ততটা ঘনিষ্ঠ হতে পারে না, যতটা তান দম্পতির সঙ্গে। তবে জাপান-যাত্রার সময় বিনু কাসুগাইয়ের কাছ থেকে উৎসাহভরা সাহায্য পায়। সে সাহিত্যিকরূপে জাপানে গেলেও বৌদ্ধ ধর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসু হিসাবে আদরলাভ করে। চীন-জাপান যুদ্ধের সময় দুই দেশের বৌদ্ধ পন্ডিতদের মধ্যে ভেদবুদ্ধি ছিল। সেটা শান্তিনিকেতনেও প্রতিফলিত। কাসুগাই বলেন তিনি চীনের সঙ্গে যুদ্ধে যেতে চাননি, তাঁকে কনসক্রিপ্ট করা হয়েছিল। তাঁর শরীরে বুলেট বিদ্ধ হয়। সেটার জন্যে তাঁর ব্যথাবোধ বিদ্যমান। ধর্ম এক হলেও জাতীয়তাবোধ বিভিন্ন, তার থেকে যুদ্ধবিগ্রহ।
ডক্টর বাগচির উদ্যোগে চীনতত্ত্বের বিশেষজ্ঞ ডক্টর লিবেনথল আসেন সস্ত্রীক। এঁরা জার্মান ইহুদি। স্ত্রী পুরোপুরি, স্বামী আংশিক। বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়ে চীন দেশে আশ্রয় নেন। কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর শ্রেণিবিদ্বেষের শিকার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। লিবেনথলের মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চীনতত্ত্ববিদকে বিশ্বভারতী নামমাত্র মাসোহারায় অধ্যাপকরূপে লাভ করেন। এর আগে নাতসি জার্মানি থেকে পলাতক অধ্যাপক আরনসনকে পেয়েছিল। তিনিও ইহুদি। কী জানি কেন ইহুদিদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ও রবীন্দ্রনাথের প্রতি ইহুদিদের একটা টান ছিল। রোটেনস্টাইন ইহুদি, সিলভাঁ লেভি ইহুদি, ভিন্টারনিতস ইহুদি।
বিশ্বভারতী হচ্ছে সেই স্থান, বিশ্ব যেখানে একনীড় হয়। এই যে আদর্শ কবির আমলে কাগজে-কলমে নিবদ্ধ থাকেনি। নানা দেশ থেকে পন্ডিত পক্ষী ও পক্ষিণীরা উড়ে এসে শান্তিনিকেতনে একনীড় হত। রতন টাটার অর্থানুকূল্যে রতনকুঠি বা টাটা বিল্ডিং নির্মিত হয় নানা দেশের অভ্যাগতদের জন্যে। ভারতীয়রাও স্বাগত। বিনু ও মীরা এর আগে কয়েকবার সেখানে ঘর পেয়েছে। একবার তো গুরুদেব স্বয়ং তাদের জন্যে একটি পাকা পেঁপে পাঠিয়ে দেন।
শান্তিনিকেতনের এই কসমোপলিটান আদর্শ রথীন্দ্রনাথের আমলেও ছিল। ইউরোপ আমেরিকা এশিয়া আফ্রিকা থেকে বহু ছাত্র-ছাত্রী ও অধ্যাপক এসেছিলেন। সেই স্রোতটা কেন যে ক্রমে ক্রমে ক্ষীণ হয়ে গেল তার একাধিক কারণ। একটা কারণ ভারতীয়রা ওদের দেশে গেলে ওদের ভাষা শেখে। ওরা কেন এদেশে এসে এদেশের ভাষা শিখবে না? কেন এই দেশের ভাষার মাধ্যমে পড়াশোনা করবে না? ওরা কেন ভারতীয়দের চেয়ে ভালো খাবে, ভালো পরবে, বেশি খরচ করবে, পাশ্চাত্য সংগীতের গ্রামোফোন রেকর্ড বাজাবে? বিদেশি বিদেশিনিরা অনেকেই বিদেশি আচার ছেড়ে এদেশি আচার বরণ করেছিলেন। কেউ তাঁদের বারণ করেনি, অনুরোধও করেনি। কিন্তু অন্যান্যদের রুচি অন্যরূপ ছিল। তাঁরাও রবীন্দ্রভক্ত। তাঁরাও ভারতপ্রেমিক। রবীন্দ্রভক্তির বা ভারতপ্রেমের কষ্টিপাথরে ভারতীয়রা সবাই কি নিখাদ সোনা? আসলে বিশ্বভারতীকে তাঁরা ভারতভারতীতে রূপান্তরিত দেখতে চেয়েছিলেন। কেউ কেউ বঙ্গভারতীতে।
বীরভূম জেলার একটি নির্জন প্রান্তরে মহর্ষির শান্তিনিকেতন আশ্রমভবন একটি পটভূমিকাহীন উৎক্ষেপ। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীও তাই। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থানুকূল্যে এদের টিকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু কেন্দ্রের যদি বড়োরকম পালাবদল হয় তবে এদের অস্তিত্ব হয়তো বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভর করবে। নয়তো এটি হবে আর একটি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। তখন বিশ্ব একনীড় হবে না, শান্তিনিকেতন কসমোপলিটান চরিত্র রক্ষা করবে না। বিশ্ব একটি মুখের কথায় পরিণত হবে। জনা কয়েক বিদেশি টুরিস্ট নিয়ে তো বিশ্ব হয় না। বিশ্বভারতীর ক্রাইসিসটা আইডেনটিটির ক্রাইসিস। শান্তিনিকেতন ক্রাইসিসও তাই। আত্মশক্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।
বিনুর নগরবাস
বিনুর পরিকল্পনা ছিল শান্তিনিকেতনের পর্ব শেষ হলে সে প্রকৃতির আরও কাছাকাছি, জনগণের আরও কাছাকাছি দেশের আরও অভ্যন্তরে কোনো এক অপরিচিত গ্রামে গিয়ে বসবাস করবে। গান্ধীজি যেমন সেবাশ্রমে। তবে শান্তিনিকেতনের পাট একেবারে গুটিয়ে নেবে না। সেখানে তার লাইব্রেরি থাকবে। যখন যেটা খুশি তখন সেটা পড়বে। একজন লেখকের যখন যেমন প্রয়োজন। লেখক হিসাবে সে তার সমকালের মানুষ। তাকে তার যুগের সঙ্গে তাল রাখতে হবে।
শান্তিনিকেতনে ষোলো বছর কাটানোর একটু আগে সেও মীরা একদিন কলকাতায় আসে পারিবারিক কারণে। তিন রাত্রির পর ফিরে যেত। কত বার এরকম হয়েছে, এটা আজব কিছু নয়। কিন্তু এবার ঘটে গেল অঘটন। একুশে ফেব্রুয়ারি আসন্ন। বিনুকে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে। সেটাও আজব কিছু নয়। কিন্তু পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার হাসান ইমাম সাহেব নাকি এবার প্রধান অতিথি হতে রাজি, শুধু বিনুকে একবার তাঁর বাসভবনে গিয়ে সাক্ষাৎ করতে হবে। বিনু মীরা সবে ঘুম থেকে উঠে চা খেতে বসেছে, এমন সময় বন্ধুপুত্র এসে বিনুকে আধঘণ্টার জন্যে পার্কসার্কাসে টেনে নিয়ে যায়। তারই উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। সে দুই বাংলার মিলনপিয়াসি। একুশে ফেব্রুয়ারি মিলনের উপলক্ষ্য।
ডেপুটি হাই কমিশনার রবীন্দ্রভক্ত। শোকে দুখে সান্ত্বনা লাভ করেন রবীন্দ্রকাব্য পড়ে। ইকবালের কাব্য পড়েন না। তাঁর পাকিস্তানি সহযোগীরা এটা পছন্দ করেন না। কলকাতায় নিয়োগের পূর্বে তিনি নিউ ইয়র্কে ছিলেন। বাংলার সঙ্গে যোগসূত্র ছিল না। এখন তিনি খুশি। কিন্তু সেইসঙ্গে অখুশি। তাঁকে মিশতে দেওয়া হচ্ছে না। অনুষ্ঠানে যেতে মন চায়, কিন্তু অনুমতি মেলেনি। তিনি বিষণ্ণ মুখে জানান।
তাহলে বিনুকে ছেড়ে দিলেই পারতেন। না, বিনুর লেখা তিনি পড়েছেন। বিনুর সঙ্গে তিনি একমত যে হিন্দু-মুসলমানের মামলা তত্ত্বের মামলা নয়, স্বত্বের মামলা। মিলন হবে কী করে এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে করতে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট সারা হয়। ভদ্রলোক না খাইয়ে বিদায় দেবেন না। পড়েছে মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে। কেটে গেল প্রায় দুটি ঘণ্টা।
ওদিকে মীরা অভুক্ত থেকে অপেক্ষা করছিল। কে একজন দরজায় টোকা দিচ্ছে শুনে সে বিনু মনে করে শশব্যস্ত হয়ে স্নানের ঘর থেকে ছুটে আসার সময় পা পিছলে পড়ে জখম হয়। সে-লোকটি বিনু নয়। বিনু ফিরে আসার আগেই তার ডাক্তারবন্ধু এসেছিলেন। তিনি বলেন, কেসটা সার্জিকাল, তাই সার্জেনকে খবর দেওয়া হয়েছে।
সার্জেন এসে বলেন, হাসপাতালে গিয়ে অপারেশন করাতে হবে। তা-ই হয়। যিনি অপারেশন করেন তিনি নির্দেশ দেন দু-বছর কলকাতায় বাস করতে হবে। তারপরে তাঁকে আবার দেখাতে হবে।
দু-বছর বাদে মীরাকে দেখে সার্জেন ছাড় দিলেন। কিন্তু তিন ছেলে-মেয়ে তখন সপরিবারে কলকাতায়। তারা ছাড় দিতে নারাজ। নাতি-নাতনির টান এড়ানো যায় না। মীরা ও বিনু কলকাতায় থেকে যায় আরও দু-বছরের জন্যে। তারপরে আরও দু-বছরের জন্যে। এমনি করে পঁচিশ বছর। ইতিমধ্যে ওরা দুজনেই জড়িয়ে পড়ে নানা প্রতিষ্ঠানের কাজে। একটি তো মীরারই সৃষ্টি। সে নিজে অনুবাদ করে, আর পাঁচজনকে অনুবাদ করতে শেখায়।
বিনুর ডাক পড়ে নানা প্রয়োজনে। কোনোটা সরকারের, কোনোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সিলেকশন কমিটি, প্রাইজ কমিটি ইত্যাদিতে তার যোগদান একান্ত আবশ্যক। কিন্তু এহো বাহ্য। এসব কাজ তাকে না হলেও অচল হত না, কিন্তু ইতিহাস বোধহয় চেয়েছিল কলকাতায় বিনুর উপস্থিতি, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ তার মধ্যস্থতায় সম্পন্ন হয়। ওপার থেকে কেউ এলে বিনুর সঙ্গে দেখা করেন। এপার থেকে কেউ গেলে বিনুর সঙ্গে দেখা করে যান। ওপারে প্রকাশিত বই এপারে আসতে দেওয়া হয় না, অতি কষ্টে আনাতে হয়। ওপারের সীমান্তরক্ষীরা আটক করে, অন্যেরাও কেড়ে নেয়।
মুক্তিযুদ্ধের বছর খানেক আগে ঢাকার এক বিশিষ্ট অধ্যাপক কলকাতায় এসে বিনুকে বলেন, ‘আমরা আপাতত স্বাধিকার চাইছি বটে কিন্তু আমাদের আসল লক্ষ্য স্বাধীনতা।’
বিনু তাঁকে হুঁশিয়ার করে দেয় যে পাকিস্তানি সেনা ক্ষমা করবে না। তাহলে যুদ্ধের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। তিনি তাতে রাজি।
সত্যি সত্যিই যুদ্ধ বেঁধে যায়। তখন দলে দলে বুদ্ধিজীবী হিন্দু-মুসলমান পালিয়ে আসেন। এঁরা চান ভারত যেন ওপারে সৈন্য পাঠায়। বিনু বলে, আমরা অর্থ দিতে পারি, অস্ত্র দিতে পারি, কিন্তু সৈন্য নয়। তা যদি করি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে, তার মিতাদের সঙ্গেও। আমরা কেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ব?
তার এক বন্ধুও ওপারে সৈন্য প্রেরণের পক্ষে। তিনি বলেন, ভারতীয় সৈন্য দশ দিনের মধ্যে পশ্চিমাদের হারিয়ে দিতে পারে। তা হলে বহু লক্ষ মানুষ শরণার্থী হয় না। বহু সহস্র মানুষ প্রাণে বেঁচে যায়। বিনু তাঁকে বোঝায় যে তারপরে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়তে হবে। সে-যুদ্ধ দশ দিনে জেতা যাবে না। আন্তর্জাতিক আকার ধারণ করতে পারে। সুতরাং ভারতের উচিত নয় সৈন্য প্রেরণ।
যেটা সে মুখফুটে বলে না, কলমের মুখেও আনে না, সেটা হল ওপারে কি শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই আছেন? না, মোল্লারাও আছে। তারা পরে বলবে, দেখলে তো, ওপার থেকে হিন্দু সৈন্যেরা এসে এপারে মুসলমানদের মেরে চলে গেল। ব্যাপারটা সাম্প্রদায়িক রূপ নেবে। রাগ পড়বে ওপারের হিন্দুদের উপরে।
বিনুর যুদ্ধবিরোধী লেখা একটি পত্রিকায় বেরোয়, সম্পাদিকা তাঁর সঙ্গে একমত হন না। তাঁর মতে ওটা কুরুক্ষেত্রের মতো ধর্মযুদ্ধ।
বোম্বাইয়ের এক বিশিষ্ট অধ্যাপক প্যারিসের একটি সংস্থার কাছ থেকে কিছু অর্থ এনে কলকাতার একটা বেসরকারি কমিটির হাতে দেন। কমিটি ওপারের শরণার্থী বুদ্ধিজীবীদের একটা তালিকা তৈরি করে। বিনুর বাসভবনে বৈঠক বসে। এর নাম পরের ধনে পোদ্দারি। সেই সূত্রে বিনু জানতে পায় ওপারের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন কয়েকজন হিন্দু, তাঁদের স্ত্রী মুসলমান। আর কয়েকজন মুসলমান, তাঁদের স্ত্রীরা হিন্দু। সমাজ তা হলে একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। কলকাতার বহু হিন্দু পরিবারে ওপারের মুসলমান শরণার্থীরা আশ্রয় পান। হিন্দুদের মেসেও মুসলমানরা অতিথি হন। এটাও একপ্রকার বিপ্লব। বিনু যখন সদ্যমুক্ত বাংলাদেশে যায়, ঢাকায় দেখে মুসলমানদের বাড়িতে হিন্দু অতিথি। বলা যেতে পারে বাঙালির বাড়িতে বাঙালি অতিথি, দুই পারেই।
ইন্দিরা গান্ধী সৈন্য পাঠানোর পূর্বে ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে গিয়ে ভারতের অবস্থাটা বুঝিয়েছিলেন। পশ্চিমাদের অত্যাচারে ওপার থেকে এপারে প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে অনন্তকাল এদেশে থাকত, যদি-না ভারত সৈন্য পাঠিয়ে পশ্চিমাদের হটাত। কোথাও সাড়া না পেয়ে তিনি সোভিয়েট ইউনিয়নে যান ও মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করেন। ভারতের বিপদে সোভিয়েট সাহায্য করবে। সোভিয়েটের বিপদে ভারত। বিনু ভয় পায়। তা হলে কি ভবিষ্যতে বিশ্বযুদ্ধ বাঁধলে ভারত সোভিয়েট ইউনিয়নকে সাহায্য করবে!
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে চব্বিশ বছর ধরে যারা অবাধ মেলামেশার সুযোগ পায়নি তারা মুক্তিযুদ্ধের আট মাসের মধ্যে আপনজনের মতো অন্তরঙ্গ ব্যবহার করে। এপার থেকে এক কালচারাল ডেলিগেশনের নেতা হয়ে বিনু বার বার তিন বার স্বাধীন বাংলাদেশে যায়। আদর-আপ্যায়নের মধুর আস্বাদন পায়। কিন্তু এটাও লক্ষ করে যে বাঙালি হিন্দুর বিরুদ্ধে নয়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে। ইন্ডিয়া চায় না যে দুই পারের বাঙালিরা মেলামেশা করতে করতে আবার এক হয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশও কি সেটা চায়? শেখ মুজিবুর রহমানের নিধনের পর কালচারাল ডেলিগেশনের আমন্ত্রণ আসে না। বিনু যত বার উদ্যোগী হয় ওপার থেকে সাহিত্যিকদের এপারে আহ্বান করতে, তত বার ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ চায় না যে দুই পারের বাঙালিরা অবাধে মেলামেশা করতে করতে আবার এক হয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সেই বছরটি ও তার পরের তিন বছর ছিল একটি সুবর্ণ যুগ। তেমনটি চব্বিশ বছর পূর্বেও ছিল না, আঠারো-উনিশ বছর পরেও ফিরে আসেনি। বেসরকারি স্তরে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান চলেছে কিন্তু সরকারি স্তরে কালচারাল ডেলিগেশন এপার থেকেও যায় না, ওপার থেকেও আসে না।
বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের কথাই বিনু বেশি করে ভাবে। নকশাল আন্দোলন তাকে বিশেষ করে ভাবায়। কয়েক বছর তো প্রতিরাত্রেই নকশালদের সঙ্গে পুলিশের গুলিবিনিময় হয়। বিনু আর মীরা কান পেতে শোনে। একদিন তাদের এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে বন্দুক লুট করতে এসে মালিককেই গুলি করে বন্দুক নিয়ে চলে যায় কয়েকটি ছেলে। সকলের চোখের সামনে নকশালরা গ্রামে গিয়ে লোকের সেবা করত, বিনুর গান্ধীপন্থী বন্ধু তাদের প্রশংসা করতেন। কিন্তু সেই তারাই খুনজখম লুটপাট বাঁধিয়ে দিয়ে গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় এসে হামলা বাঁধায়। বিনু বুঝতে পারে না এটা কোন অর্থে মার্কসিজম লেনিনিজম। এদের দ্বারা পুলিশবধের পরিণাম পুলিশের দ্বারা নকশালবধ। বুদ্ধিজীবীরা কাউকেই নিরস্ত্র করতে পারেন না। যার অস্ত্রে জোর বেশি সেই তো জিতবে। বিনু হিংসার বিরোধী, সামাজিক পরিবর্তনের নয়।
না, এভাবে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কীভাবে করা যায় তা নিয়ে বিনুকে গভীরভাবে চিন্তা করতে হয়। রেভোলিউশন কথাটির বিপরীত কাউন্টার রেভোলিউশন। একটি হলে আরেকটি হবেই। সেটা এড়াতে হলে অন্য একটি শব্দ ব্যবহার করতে হয়। বিনুর মতে সেই শব্দটি রিনিউয়াল—পুনর্নবীকরণ। দেশকে, রাষ্ট্রকে, সমাজকে, সংস্কৃতিকে, সভ্যতাকে পুনর্নবীকরণের কথা বিনুর মাথায় ঘোরে। রাজনীতি, অর্থনীতিই সব নয়। ন্যায়নীতির দাবি উপেক্ষা করে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায় না। সোভিয়েট ইউনিয়ন তো কালচারের দিক থেকে বন্ধ্যা। বলশয় ব্যালে ছাড়া আর কী আছে তার দেবার? তাও তো পুরোনো আমলের। তবে হ্যাঁ, বিজ্ঞানে অগ্রগামী হয়ে ওখানকার লোকে মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছে। কিন্তু একজন আমেরিকানও তো চন্দ্রে অবতরণ করতে পেরেছেন।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্যে বিশ্বময় দুই ‘বিশ্বের’ মধ্যে যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলেছিল তা বিনুকে বীতশ্রদ্ধ করেছিল। সে আশা করেছিল তৃতীয় বিশ্ব এর বাইরে থাকবে। কিন্তু তৃতীয় ‘বিশ্বের’ দেশগুলিও তো অস্ত্র প্রতিযোগিতায় বাইরের নয়। এরা বিশ্বযুদ্ধ বাঁধাবে না, কিন্তু ছোটোমাপের যুদ্ধ বাঁধাবে, যদি-না ইউনাইটেড নেশনস বাধা দেয়। এই নবজাত প্রতিষ্ঠানটির উপরে বিনুর কিছুটা ভরসা ছিল। পুরোপুরি নয়, কারণ সেখানেও দলাদলি।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে আদর্শবাদীর বড়ো অভাব। কার দিকে বিনু তাকাবে। যেদিকেই তাকায় হিংসার উপরে বিশ্বাস। ধনতন্ত্রীদেরও, সমাজতন্ত্রীদেরও, মধ্যপন্থীদেরও। যাঁরা গান্ধীজির শিষ্য ছিলেন তাঁরাও অহিংসার উপর আস্থা হারিয়েছেন। ভারত পরমাণু বোমা না বানালেও পারমাণবিক শক্তির সাধনায় নিযুক্ত। অবশ্য শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য। কিন্তু কেন্দ্রে পালাবদল হলে সেই শক্তিই যুদ্ধবিগ্রহের ব্যবহারে লাগবে কি না কে বলতে পারে? যার শেষটা তুমি দেখতে পাচ্ছ না তার আরম্ভটা তুমি করে যাচ্ছ, এটাও কি একপ্রকার দায়িত্বহীনতা নয়? গান্ধীপন্থীদের মধ্যে কেউ কেউ এই প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁরা এককভাবে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছেন।
পৃথিবী থেকে যুদ্ধের সম্ভাবনা যদি সম্পূর্ণ নির্মূল হত তা হলে যে যত ইচ্ছা পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন করলে শঙ্কার কারণ থাকত না। কিন্তু যেখানে যুদ্ধের জন্যে প্রত্যেকটি দেশ প্রস্তুত হচ্ছে সেখানে কয়েকটি দেশ পারমাণবিক শক্তি শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য উৎপাদন করলেও যুদ্ধকালে ব্যবহারের শঙ্কা থেকে যাবে, আর সকলে করলে তো মহাবিপদের বিভীষিকা মানুষের মন থেকে শান্তি কেড়ে নেবে। বিনুর মতে শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্যে পারমাণবিক শক্তির উৎপাদন যদি সব দেশের পলিসি হয় তবে কোথাও তার অপব্যবহার হবেই। মানবচরিত্র এত উচ্চস্তরে উপনীত হয়নি যে কোথাও কেউ তার অপব্যবহার করবে না। গণতান্ত্রিক দেশ হলেই সাধু হয় না। সমাজতান্ত্রিক দেশ হলেও না। ফ্যাসিস্ট হলে তো কথাই নেই।
তা ছাড়া ইদানীং মৌলবাদী বলে আরও এক বিপদ দেখা যাচ্ছে। স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে যারা মৌলবাদী ছিল না পরে কিন্তু তাদের মধ্যে মৌলবাদ জাগছে। ভারতও এর থেকে মুক্ত নয়। কোনো ক্ষেত্রে নবীকরণই মৌলবাদীরা সহ্য করবে না অস্ত্রশস্ত্র বাদে। এদের হাতে যদি পারমাণবিক অস্ত্র পড়ে তবে সমূহ সর্বনাশ। এখনও পড়েনি বলে কখনো পড়বে না এমন কী নিশ্চয়তা আছে? সর্বত্র এটা একটা নতুন আতঙ্ক। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি সব রকমের মৌলবাদী সক্রিয়।
যে কোনো ধর্মের মৌলবাদীদের মতে ধর্মই নিয়ন্ত্রণ করবে জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগ—দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, নৃত্য, নাট্য, সংগীত, অর্থনীতি, রাজনীতি, ন্যায়নীতি, দন্ডবিধি। এক হাজার বছর আগে এটাই ছিল প্রায় সব দেশের নিয়ম। কিন্তু কালক্রমে ধর্মের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছে রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে পার্লামেন্ট বা কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট পার্টি। সেদিনকাল আর নেই যখন ধর্মগুরুদের নির্দেশে দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, ব্যাঙ্কার প্রভৃতি ভাবনাচিন্তা, পরীক্ষানিরীক্ষা, শিক্ষা, শাসন, বিচার, সওদাগরি, মহাজনি ইত্যাদি করবেন। মৌলবাদ হচ্ছে অতীতে প্রত্যাবর্তনের মতবাদ। মানুষের অতীতই হবে তার ভবিষ্যৎ।
অতীতের পূর্বেও অতীত ছিল। সুদূর অতীতে গুণকর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ হতে পারা যেত। পরে তারাই কেবল ব্রাহ্মণ হয় যাদের জন্ম ব্রাহ্মণকুলে। ব্রাহ্মণত্বের দুয়ারটা বন্ধ রয়ে গেলে আরেকটা দুয়ার খুলে যায়। সেটা সন্ন্যাসের দুয়ার। যে কোনো বর্ণের পুরুষ সন্ন্যাসী হতে পারে, যদি কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ করে ও গুরুর কাছে দীক্ষা নেয়। মধ্যযুগে সন্ন্যাসীদের সম্মান ব্রাহ্মণদের চেয়ে কম ছিল না—হয়তো বেশি। কারণ তাঁরা নাকি হিমালয় থেকে দুষ্প্রাপ্য ঔষধ নিয়ে আসতেন ও মরণাপন্নকে বাঁচিয়ে দিতে পারতেন। তা ছাড়া অনেকরকম অলৌকিক ঘটনাও নাকি তাঁরা ঘটাতেন। বৌদ্ধ, জৈন ও রোমান ক্যাথলিক সংঘ সন্ন্যাসীদের যে পার্থিব ক্ষমতা দেয় তা অভূতপূর্ব। রোমান ক্যাথলিক চার্চের তো আলাদা আদালত ছিল। সে-আদালত প্রাণদন্ডও দিতে পারত।
ব্রাহ্মণকে প্রতিপালন করত ক্ষত্রিয়, ক্ষত্রিয়কে নৈতিক সমর্থন জোগাত ব্রাহ্মণ। যেখানে সন্ন্যাসী ছিল সেখানে মঠবাড়ির পৃষ্ঠপোষক ছিল ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য, তাকে নৈতিক সমর্থন জোগাত সন্ন্যাসী। শূদ্রের স্থান ছিল এঁদের সেবকের। নারীর স্থান ছিল পুরুষের সেবিকার। এটাই ছিল মোটামুটিভাবে বিভিন্ন নামে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজের প্যাটার্ন। এককথায় বলা যেতে পারে ওল্ড অর্ডার বা পুরাতন শৃঙ্খলা। শৃঙ্খলের সঙ্গে যার সম্পর্ক।
পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের সময় থেকে শৃঙ্খলাভঙ্গ তথা শৃঙ্খলভঙ্গ শুরু। কিন্তু মানুষ তো বিশৃঙ্খলা সইতে পারে না। তাই একটা নতুন শৃঙ্খলা বা নিউ অর্ডারের কথাও ভাবা হচ্ছে গত দুই শতাব্দী ধরে। আগে এতরকম মতবাদের নাম কখনো শোনা যায়নি। কনজার্ভেটিজম, লিবারালিজম, ক্যাপিটালিজম, সোশ্যালিজম, কমিউনিজম, ন্যাশনাল সোশিয়ালিজম, রেভোলিউশনারি সোশ্যালিজম, রেভোলিউশনারি কমিউনিজম, ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিজম, সোশ্যালিস্ট ডেমোক্র্যাসি, সিন্ডিকালিজম, পপুলিজম, হিউম্যানিজম, ফেমিনিজম, এমনকী অ্যানার্কিজম ও নিহিলিজম। কোনো কোনোটার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রণেতার নাম। মার্কসিজম, লেনিনিজম, স্টালিনিজম, মাওইজম, গান্ধীইজম।
এর প্রত্যেকটির ভিতরে কিছু-না-কিছু সত্য আছে, এমনকী ফ্যাসিজমের ভিতরেও। ভোটের উপর ছেড়ে দিলেই তো প্রতিপন্ন হয় কোনটা অধিকাংশের পছন্দ। ফ্যাসিস্টরা ভোটারদের সে অধিকার দেয় না, কমিউনিস্টরাও না। ভোটারদের কিনে নেওয়া তো বহু দেশের গণতন্ত্রের রীতি। যাদের টাকা নেই তারা সাম্প্রদায়িক নেশা ধরায়। ধনতন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্রের সমাহার নানা দেশেই লক্ষিত হয়। সংবাদমাধ্যমগুলো ধনিকদের হাতে। ইংল্যাণ্ডের লেবার পার্টির পত্রিকা শ্রমিকরাই কেনে না। তার চেয়ে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক একই মূল্যের ধনিকদের পত্রিকা। ওরা প্রচুর বিজ্ঞাপন পায় বলে প্রচুর খরচ করতে পারে। চটকদার বিষয় ছাপে। সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক প্রচার চালায়।
ভারতের পক্ষে কেমনতরো সমাজব্যবস্থা যুগোচিত অথচ নীতিসম্মত এই নিয়ে বিনু নিরন্তর চিন্তিত ও ধ্যানস্থ। নেতি নেতি করে একটার পর একটা মতবাদ খারিজ করে। মৌলবাদ তো যুগোচিতও নয়, সামাজিক ন্যায়সম্মতও নয়। তাতে না আছে ব্যক্তিস্বাধীনতা, না স্ত্রী-স্বাধীনতা, না চিন্তার ও বাক্যের স্বাধীনতা। অথচ এসব যেখানে আছে সেখানে রয়েছে প্রদীপের নীচে অন্ধকার। মহানগরে দীনদরিদ্র গৃহহীন বা বস্তিবাসী লক্ষ লক্ষ মানুষ। যাদের নাম কেউ মুখে আনতে চায় না সেইসব দেহপসারিনি। দেহ কেনাবেচার বিরাট ব্যাবসা। হোয়াইট স্লেভ ট্রাফিক। আনন্দের কথা, ব্ল্যাক স্লেভ ট্রাফিক আর নেই। বহু সহস্র বর্ষ পরে।
যে-গাছের যে-ফল। আম গাছে জাম ফলে না। তেমনি ভারতের ইতিহাসে অবিকল ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা বা রাশিয়ার মতো সমাজব্যবস্থা বিবর্তিত হয় না। তাকে প্রবর্তন করতে হয়। তারজন্য চাই গণসমর্থন, গণপরিশ্রম, গণ-ত্যাগেচ্ছা। বিনা প্রেমসে না মিলে নন্দলালা। বিনা ত্যাগসে না মিলে নয়া সমাজ। আইন করে, জোরজুলুম করে যা হয় তাতে অসন্তোষ চাপা পড়ে যায়, পরে ফেটে পড়ে। অথচ আমরা সকলেই অল্প সময়ের মধ্যে চারাগাছ থেকে বনস্পতি পেতে চাই। আমাদের বিবর্তন যে বিলম্বিত হয়েছে এটা ঠিক, কিন্তু বিপ্লব এর প্রতিকার নয়। তাও যদি সে-বিপ্লব অহিংস বিপ্লব হত, কিন্তু হিংসার সম্মোহন থেকে সে মুক্ত নয়। বিপ্লব যদি কোনোদিন হয় তবে গৃহযুদ্ধের আকার নেবে। বুর্জোয়ারা বিনা রক্তপাতে মঞ্চ থেকে বিদায় নেবে না।
তাহলে কি বিনু চায়, রেভোলিউশন বাই কনসেন্ট না একাদিক্রমে রিফর্মস? বিনু ভেবে পায় না। দু-পক্ষেই বলবার আছে। দেশের লোককেই এর উত্তর দিতে হবে। তাদেরকেই তো পোহাতেই হবে রেভোলিউশন বা রিফর্মসের ঝক্কি।
একদিন বিশিষ্ট গান্ধীপন্থী নেতা প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ বিনুকে বলেন, আপনি রুশো ভলতেয়ারের মতো লিখে যান। যাতে ফরাসি বিপ্লবের মতো ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। বোঝা গেল গান্ধীপন্থীরাও স্বাধীনতার পরবর্তী লক্ষ্য নিয়ে দিগভ্রান্ত। একদিন জয়প্রকাশ নারায়ণও তাকে ডেকে পাঠান। ইন্দিরা গান্ধী দেশের লোকের সিভিল লিবার্টি হরণ করেছেন। সিভিল লিবার্টি উদ্ধার করতে হবে। পরে দেখা গেল তিনি ইন্দিরা গান্ধীকেই গদি থেকে হটাতে চান—ভোটের জোরে নয়, বিদ্রোহ করে। সৈনিকদেরও ডাক দেন। এর নাম সিভিল লিবার্টি উদ্ধার নয়, শাসক পরিবর্তন।
ইমারজেন্সি জারি করে ইন্দিরাজি বিনুর মতো লেখকদের স্বাধীনতা খর্ব করলেন। প্রত্যেকটি লেখাই সেনসরের কাছে পেশ করে প্রকাশের অনুমতি নিতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিধন বিনুকে স্তম্ভিত ও শোকার্ত করে। তাঁকে সে চিনত। কিন্তু তার লেখা শোকনিবন্ধ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় পত্রিকায় প্রকাশ করতে দেন না। বলেন, ‘আপনার লেখা বেরোলে ওপার থেকে এক কোটি লোক শরণার্থী হয়ে আসবে। আমরা মারা যাব।’ ওটি তিনি ইন্দিরাজিকে পাঠান। প্রধানমন্ত্রী সেটি ইংরেজিতে তর্জমা করিয়ে পড়েন। বিনুকে লেখেন, ‘আপনি যা লিখেছেন তা ঠিক, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ার কথাও চিন্তা করতে হবে। আপনার এ লেখা প্রকাশিত হলে সরকার বিব্রত হবেন।’ লেখাটা পত্রিকায় প্রকাশ করা গেল না। কড়া সেনসরশিপ জারি হয়েছিল। বিনু একটি সভায় এর প্রতিবাদ করে। তার বক্তৃতা কেউ প্রকাশ করে না।
মাস কয়েক পরে একদিন বিনুর ফ্ল্যাটে দুজন পুলিশকর্মীর প্রবেশ। তাঁদের হাতে একখানি নিষিদ্ধ পত্রিকা। পত্রিকাটি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ পরিবারের। তাতে ছিল বিনুর সেই বক্তৃতার অনুলিখন। বিনু তো তাজ্জব! গোয়েন্দারা জানতে চান ওসব কথা বিনু কি বলেছে? বিনু বলে, ‘হ্যাঁ, কিন্তু ভুলচুক আছে।’ সে কলম নিয়ে শুধরে দেয়। তাঁরা ফিরে যান।
এরপর বিনু একটি কমিটি গঠনে অগ্রণী হয়। তাতে ছিলেন দুজন প্রাক্তন হাই কোর্ট চিফ জাস্টিস, দুজন অ্যাডভোকেট, দুজন প্রাক্তন জেলা ও দায়রা জজ। কমিটির তরফ থেকে সে ইন্দিরাজিকে একটি প্রস্তাব পাঠিয়ে দিয়ে লেখে ইমারজেন্সি তুলে নিয়ে অবিলম্বে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে। তিনি জবাব দেন না। তিনি যদি কমিটির পরামর্শ অনুসারে কাজ করতেন তা হলে সেই বছর নির্বাচনে জয়ী হয়ে আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতেন।
এক বছর দেরি করার ফলে তিনি হেরে গেলেন সদলবলে। যাঁরা জিতলেন তাঁরা সকলেই ইন্দিরাবিরোধী, সেইসঙ্গে পরস্পরবিরোধী। মোরারজি দেশাই যোগ্য ব্যক্তি, বোধহয় যোগ্যতর ব্যক্তি। কিন্তু সরকার তো ব্যক্তিকে নিয়ে নয়, সমষ্টিকে নিয়ে। কয়েক বছরের মধ্যেই সরকার চৌচির। মোরারজির পরে চরণ সিংহ, তারপর আবার সেই ইন্দিরা গান্ধী। এবার তাঁর শিক্ষা হয়েছিল। ইমারজেন্সি আর নয়। কিন্তু শিখদের স্বর্ণমন্দির বিদ্রোহের ঘাঁটি হলেও সেখানে সৈন্য প্রেরণ ভুল হয়েছিল। বিনুও এর পূর্বে সংবাদপত্রের সাক্ষাৎকারে বলেছিল, পাঞ্জাবের কোনো সামরিক সমাধান নেই, রাজনৈতিক সমাধান চাই।
ভিন্দ্রানওয়ালের নিধনে বিনু ‘শক’ পায়। মনে মনে বলে, এরজন্যে আরও দাম দিতে হবে। সেই দাম যে ইন্দিরাজির নিজের নিধন তা বিনুর কল্পনায় ছিল না। সে আবার ‘শক’ পায়।
ইন্দিরা নিধনে উত্তেজিত হিন্দুরা দিল্লিতে ও অন্যত্র শিখ সম্প্রদায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একমাত্র দিল্লিতেই হাজার তিনেক শিখ বালবৃদ্ধবনিতা নিহত হয়। তাদের একমাত্র অপরাধ তারা শিখ, অতএব ইন্দিরাহত্যার জন্যে দায়ী। এর নাম জাতিবৈর। যেন হিন্দু শিখ একজাতি নয়, দুই জাতি।
বিনুর ছেলেবেলায় তার জন্মস্থানে এক ফরেস্ট অফিসার ছিলেন, তাঁর নাম পৃথ্বীচাঁদ, তিনি হিন্দু। তাঁর পুত্র বলদেও সিং কিন্তু শিখ। তার মাথায় পাগড়ির নীচে ঝুঁটি। হাতে লোহার বালা, শিখরা যাকে বলে কঙ্কণ অথবা কড়া। দাড়ি গজানোর বয়স হয়নি। তার বাবার দাড়ি ছিল না। বলদেও ছিল স্কুলের সহপাঠী ও খেলার সাথি। খলিস্তান হলে বলদেও সিং হবে তার সিটিজেন আর পৃথ্বীচাঁদ হবেন এলিয়েন, যদি বেঁচে থাকেন। এরকম পরিবার শত শত। ওরা দুই জাতি নয় কিন্তু দুই সম্প্রদায়। শিখরা বেদ, ব্রাহ্মণ, দেবদেবী, অবতার, সাকার পূজা মানে না।
এ সমস্যার সামরিক সমাধান নেই, ইন্দিরাজির পলিসি পরিত্যক্ত। যা করবার তা পুলিশই করছে। আইন ও শৃঙ্খলারক্ষা। সেটা রাজনৈতিক সমাধান নয়। রাজীব গান্ধী সন্ত লঙ্গোয়ালের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। সে-চুক্তি কার্যকর হয়নি। কার্যকর হলেও শিখ জঙ্গিরা চন্ডীগড় নিয়ে সন্তুষ্ট হত না। তারা চায় স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম ধর্মভিত্তিক শিখ রাষ্ট্র। ভাষাভিত্তিক পাঞ্জাবি রাষ্ট্র নয়। আর একটি পাকিস্তান, আর একটি বাংলাদেশ নয়। হিন্দুরা কেউ এতে রাজি হবে না, শিখদের মধ্যে যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ তাঁরাও নারাজ। শিখ সম্প্রদায়েরও বেশ কয়েকটি শাখা আছে। যেমন নির্মলি, নিরঙ্করি। গুরু গোবিন্দ সিংহের পূর্বে শিখদের সিংহ পদবি ছিল না। তাঁরা কৃপাণ ধারণ করতেন না। তেমন শিখও বিনু দেখেছে। বাবা পুরুষোত্তমলাল বেদি গুরু নানকের বংশধর। একবার তাঁর পত্নী ফ্রিডা ও পুত্র কবিরকে নিয়ে তিনি দার্জিলিং-এর ঘুম পাহাড়ে বিনু ও মীরার সঙ্গে এক বাড়িতে ছিলেন। তিনিও শিখ কিন্তু তাঁর না ছিল পাগড়ি, না ছিল ঝুঁটি, না দাড়ি, না কড়া।
কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে যে কমিশন গঠিত হয়েছিল তার চেয়ারম্যান জাস্টিস সরকারিয়া শিখ—পাগড়ি ইত্যাদিসমেত। কলকাতায় এসে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা যাঁদের সাক্ষ্য নেন তাঁদের প্রথম জনই ছিল বিনু। রাজ্যগুলিকে আরও অটোনমি দিতে হবে বিনুর এই অভিমতে তিনি সায় দেন না। বলেন, কেন্দ্র দুর্বল হবে সেটা উচিত নয়। শক্তিশালী কেন্দ্র না হলে দেশ ভেঙে পড়বে। পাঞ্জাবে তা হলে রাজনৈতিক সমাধানের কতটুকু সম্ভাবনা?
কেন্দ্রকে দুর্বল করা চলবে না বিনুও এটা মেনে নেয়। কেন্দ্রকে দুর্বল না করে রাজ্যগুলিকে কী কী ছেড়ে দিতে পারা যায় তা বাছাই করতে হবে। নইলে মণিপুর, নাগাল্যাণ্ডের মতো দিল্লি থেকে সুদূর রাজ্যগুলির জনসাধারণ অবহেলিত বোধ করবে; ফলে বিদ্রোহী হবে।
রিনিউয়ালের বা পুনর্নবীকরণের থিম নিয়ে একটি বৃহৎ উপন্যাস লেখার ভাবনা বিনুকে স্বস্তি দেয় না। লিখতে আরম্ভ করে সে দেখে বিষয়টা অতীত থেকে বর্তমানে ও বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে পরম্পরাক্রমে বিবর্তিত হওয়া চাই। নইলে সেটা হবে একপ্রকার ইউটোপিয়া।
তাকে শুরু করতে হল ব্রিটিশ আমলের পটভূমিকায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতীয় মুক্তিসংগ্রাম, হিংসা-অহিংসা, হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ, দেশভাগ, প্রদেশভাগ, স্বাধীনতার অমৃত, লোকবিভাজনের গরল, বিষপান করে নীলকন্ঠ গান্ধীর নিপাত, ব্রিটেনের অন্তঃপরিবর্তন, রাজন্যদের ক্ষমতালোপ, নতুন ভারতের অভ্যুদয়।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় কংগ্রেস নেতাদের বিশ্বাস ছিল যুদ্ধে সহযোগিতা করলে তার বিনিময়ে স্বরাজ লাভ হবে। কিন্তু তা তো হল না। বিশ বছর পরে সংগ্রামের পর তাঁদের ধারণা উলটে গেল। যুদ্ধে সহযোগিতার বিনিময়ে স্বাধীনতা নয়, স্বাধীনতার বিনিময়ে যুদ্ধে সহযোগিতা। মহাত্মা গান্ধী কিন্তু কোনো কিছুর বিনিময়ে যুদ্ধে সহযোগিতা করবেন না। তিনি অহিংসার সাধক। তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্থে যুদ্ধে সহযোগিতা না করার স্বাধীনতা। কংগ্রেস যদি তাঁর সঙ্গে না চলে তবে তিনি একলা চলবেন। সময় যখন আসবে তখন যুদ্ধে জড়ানোর বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ করবেন।
ভারতের ইতিহাসে—শুধু ভারতের ইতিহাসে কেন বিশ্বের ইতিহাসে অমন একটি দশক দেখা যায়নি। চূড়ান্ত হিংসার সাধনা করছেন হিটলার। তাঁর উপরে টেক্কা দেবার জন্যে আইনস্টাইনের পরামর্শে পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছে আমেরিকা। তা দিয়ে ইহুদি রক্ষা করার অভিপ্রায়। কিন্তু সেটা জার্মানিতে পড়ে না। পড়ে হিরোশিমায় জাপানিদের ওপর। তার আগেই ষাট লাখ ইহুদি জার্মানদের গ্যাস চেম্বারে পুড়ে মারা গেল। এমন যে যুদ্ধ এতে সহযোগিতা গান্ধী নেতৃত্বে হত না। কংগ্রেস যে তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়ে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ, কারাবরণ, কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন ইত্যাদি চালিয়ে গেল এটা ইতিহাসে অপূর্ব। তবে জনগণের দ্বারা অহিংসার মান রাখা হয়নি। গান্ধীজি অনশনের দ্বারা এর জন্যে প্রায়শ্চিত্ত করেন।
‘দেশকে স্বাধীন যে-কেউ করতে পারে, আমি চাই জনগণকে জাগাতে।’ বলেছিলেন গান্ধীজি। বিয়াল্লিশ সালের মতো গণজাগরণ ভারতের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তাতে মুসলমানদের অংশ যৎসামান্য। ব্যতিক্রম একমাত্র উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশে সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফ্ফর খানের ব্যক্তিগত প্রভাবে মুসলমানদের যোগদান। ব্যক্তি হিসাবে মুসলমানরা কংগ্রেস পরিচালিত প্রত্যেকটি আন্দোলনেই ছিলেন। যেমন মওলানা আবুল কালাম আজাদ। কিন্তু সমষ্টিগতভাবে অংশগ্রহণ কেবল অসহযোগ আন্দোলনের সময়েই দেখা গিয়েছিল, সেটাও খেলাফতের ইসুতে।
সাধারণভাবে বলতে গেলে ভারতীয় মুসলমানদের বোঝানো হয়েছিল যে ইংরেজ গেলে কংগ্রেস রাজা হবে, তখন মুসলমান হবে হিন্দুর প্রজা। আরও একবার গণ-আন্দোলন করলে সেটাতে কি মুসলমানরা সমষ্টিগতভাবে অংশগ্রহণ করত? আর সেটা কি সম্পূর্ণ অহিংস হত? কংগ্রেস নেতারা তা বিশ্বাস করেন না। তাঁদের সামনে দুটি মাত্র বিকল্প ছিল। মুসলিম লিগকে সঙ্গে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন; মুসলিম লিগকে বাদ দিয়ে একক সরকার গঠন। দ্বিতীয়টি করতে গেলে মুসলিম লিগকে দেশের একভাগ দিতে হবে। সেইসূত্রে বঙ্গের একভাগ, পাঞ্জাবের একভাগ।
প্রথম বিকল্পটিকে ট্রায়াল দেওয়া হয়েছিল। সেটি ব্যর্থ হয়। সুতরাং দ্বিতীয়টি ছাড়া আর কোনো কার্যকর পন্থা ছিল না। বিনুকে স্বীকার করতেই হল যে পার্টিশনই গৃহযুদ্ধের থেকে ভালো, নইলে ইংরেজকেই বরাবরের জন্যে থেকে যেতে হয়। ইংরেজরা নিজেরাই থাকতে চায় না। জুন ১৯৪৮ পর্যন্ত ছিল তাদের রাজত্বের মেয়াদ। তার আগেই অনেকে ছুটি নিয়েছিলেন বা ইস্তফা দিয়েছিলেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যে নেহরু ও প্যাটেল যতখানি ব্যগ্র, মাউন্টব্যাটেন তার চেয়েও বেশি। কে জানে গান্ধীবুড়ো হয়তো সব ভেস্তে দেবেন। গান্ধীজিই যে স্বাধীনতা দিবসে বিষণ্ণতম পুরুষ তা নয়, জিন্নাও ছিলেন তাঁর দোসর। ওরকম পাকিস্তান তিনি চাননি। পাকিস্তানই তিনি চাননি। তিনি চেয়েছিলেন কংগ্রেস লিগ দ্বৈরাজ্য। এক রাজ্যে দুই রাজা।
আশ্চর্যের ব্যাপার, ক্ষমতা হস্তান্তরের পর দেখা গেল সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ একজন ইংরেজ—লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ইংরেজদের সঙ্গে বিবাদ চক্ষের নিমেষে মিটে যায়। ভেলকি না ভোজবাজি! ইংরেজের গায়ে কেউ হাত দেয় না। হাত দেয় মুসলমানদের গায়ে, হিন্দুর গায়ে, শিখের গায়ে। পরস্পরকে মেরে তাড়ানোর ধুম পড়ে যায়। তখন সেই গান্ধীই ভরসা। তিনি যা একাই তাঁর নৈতিক শক্তিতে করেন তা একপ্রকার অসাধ্যসাধন। অহিংসা কত উচ্চে উঠতে পারে তার দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া গেল পৃথিবীতে বহু শতাব্দী পরে। তাঁর তিরোধানও অহিংসার উচ্চতম আদর্শ। বিনুর তৃতীয় বৃহৎ উপন্যাসের এইখানেই সমাপ্তি।
এ গ্রন্থ লিখতে পারাটাও তার জীবনে এক পরম লাভ। সে-অভিজ্ঞতা তাকে সিদ্ধি না দিক শুদ্ধি দেয়। তত দিনে তার বয়স হয়েছে বিরাশি। এত দিন তো বাঁচবার কথা নয়। চার খন্ডের এক এক খন্ড লেখে আর ভাবে এই বোধহয় শেষ। না, চার খন্ডের বেশি লিখতে পারা যেত না। প্রথম যৌবনে দুই বছরের ঘটনা নিয়ে বারো বছরে ছয় খন্ডের উপন্যাস লিখেছিল। দ্বিতীয় যৌবনে তিন বছরের ঘটনা নিয়ে তিন খন্ড লিখতেই তার পনেরো বছর লেগে যায়। পঁচাত্তরের ঊর্ধ্বে সে কোনো অর্থেই যুবক নয়। ওই চার খন্ডই তার পক্ষে দুঃসাধ্য। কিন্তু সাড়ে আট বছরের ঘটনাকে চার খন্ডের ফ্রেমে আঁটা হচ্ছে সংক্ষেপে সারা। বিনুকে সময়ের বিরুদ্ধে দৌড় দিতে হচ্ছিল। যাকে বলে রেসিং এগেনস্ট টাইম। তাই প্রাকৃতিক বর্ণনা একদম বাদ।
এরপরে সে শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন। দম যা ছিল ফুরিয়ে গেছে। উপন্যাস লেখা হচ্ছে দমের কাজ। একখানা ছোটো উপন্যাস লেখার স্বপ্ন এখনও রয়েছে, কিন্তু তার জন্যে দম নেই। আপাতত প্রবন্ধ বা নিবন্ধ, ছড়া বা কবিতা লিখেই সে ক্ষান্ত। তাতে তেমন বেদনা নেই, তেমনি আনন্দও নেই। তার প্রত্যেকটা বড়ো উপন্যাসের অন্তরে নিহিত আছে যেমন বড়ো বেদনা তেমনি বড়ো আনন্দ। সৃষ্টি মাত্রেরই বেলা একথা খাটে। বিনু একজন স্রষ্টা হতে চেয়েছে।
মীরা ও বিনু কলকাতায় বাস করলেও শান্তিনিকেতনেই তাদের হোম। তারাও আশ্রমিক সমাজের অঙ্গ। কলকাতায় থাকলেও মীরা মাসে মাসে শান্তিনিকেতনে যায়, নিজের বাড়িতে কিছুদিন কাটায়। বাগান দেখাশোনা করে। ফিরে আসে তরিতরকারি ফলমূল নিয়ে। বিনু মাঝে মাঝে যায়। না যাওয়ার একটা কারণ সে টাইপরাইটারে লেখে। পুরোনো মডেলের রেমিংটন। বয়ে নিয়ে যাওয়া শক্ত। টাইপরাইটারে লেখালেখি ছাড়া বাঁচতে পারে না। এটা ষাট বছরের অভ্যাস।
বিনু যখনই শান্তিনিকেতনে যায়, মূল আশ্রম চত্বরে ঘুরে বেড়ায়। তাতে সে একপ্রকার আধ্যাত্মিক সুরভি পায়। সেখানে তিন মহাপুরুষ সাধনা করেছেন—দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ। গান্ধীজিও তো সেখানে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। সেই সূত্রে স্থানটির একটি মাহাত্ম্য আছে। আদি শান্তিনিকেতন ভবনে উৎকীর্ণ রয়েছে ‘আনন্দরূপম অমৃতং যদ বিভাতি’। উপনিষদের মর্মবাণী। বিনুকে মনে করিয়ে দেয় প্রাচীন ভারতের ব্রহ্মবাদীদের উপলব্ধি। তাঁদের সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি, যদিও সে আধুনিক যুগের সন্তান।
কলকাতায় তেমন কোনো আধ্যাত্মিক কেন্দ্রস্থল নেই। তবে বিনুদের কাছে এটা সংস্কৃতির পীঠস্থান—বাংলার, ভারতের, বিশ্বের। এখানে গ্রিক চার্চ আর্মেনিয়ান চার্চও আছে। আছে ইহুদিদের সিনাগগ। নিচিরেন সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ বিহার। জৈনমন্দির তো আছেই, আছে মুসলমানদের নাখোদা মসজিদ, ভারতীয় জাদুঘর, এশিয়াটিক সোসাইটি প্রভৃতি মহামূল্য সংগ্রহশালা।
বিনু কলকাতা ছাড়তে পারে না, কারণ কলকাতা তাকে ছাড়তে চায় না। কমলী নেহি ছোড়তি। কিন্তু সে বহুদিন ধরে ভেবে এসেছে যে আবার মীরাকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে ফিরে যাবে ও বাকি জীবনটা কাটাবে। সম্ভব হলে আরও ভিতরে যাবে। মীরার কঠিন অসুখ, চিকিৎসায় আরোগ্য হয় না। শান্তিনিকেতনে গিয়ে প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিলে যদি কিছুটা আরাম পায়। যে-সময় রেলযাত্রার কথা সে-সময় সে শয্যা নেয়। কয়েক দিনের মধ্যেই তার মহাযাত্রা।
ওরা বাষট্টি বছর একসঙ্গে ছিল। পরম সৌভাগ্য। বিরহ বেশিদিন ভোগ করতে হয়নি। এখন তো আজীবন বিচ্ছেদ। চিরবিচ্ছেদ মন মানতে চায় না। মনকে মানা না মানার স্বাধীনতা দেওয়া ভালো। কেই-বা নিশ্চিত জেনেছে যে এই শেষ, এরপরে শূন্য। বিনুর দৃঢ়বিশ্বাস পূর্ণ থেকে পূর্ণ আসে, পূর্ণ থেকে পূর্ণ বিয়োগ করলে পূর্ণই অবশিষ্ট থাকে। তাহলে তো পুনর্মিলনেরও সম্ভাবনা থাকে। কে জানে কোথায় ও কবে! ওসব প্রশ্ন তুলে রেখে যে কাজ করতে আসা সে-কাজ সারা করে যাওয়াই কর্তব্য। মীরা এ জগতে ছিল বিরাশি বছর। বিনুর চেয়ে ছয় বছরের ছোটো। হঠাৎ ক্যান্সার না হলে সে আরও দীর্ঘকাল বাঁচত। শক্তির সীমা ছিল না তার। কত কাজ করে গেছে ভেবে অবাক হতে হয়। ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
বিনুর জীবনদর্শন
প্রতিযোগিতায় সাফল্যের শীর্ষে উঠে বিনুর তো আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কথা, কিন্তু তাকে দেখে মনে হল যে সে সংকটে পড়েছে। হ্যামলেটের মতো সে দোদুল্যমান, আইসিএস হবে কি হবে না? যদি হয় কেন হবে, কার জন্যে হবে? সুশীলা তো আপাতত স্বামী পুত্র নিয়ে ঘরসংসার করতে ব্যস্ত। মুক্তির জন্যে তার তাড়া নেই। বিনুর এখন মনে হচ্ছে সুশীলা মুক্তি বলতে যা বুঝত তা বিবাহবন্ধন থেকে মুক্তি নয়, অন্দরমহল থেকে মুক্তি। সেটার জন্যে বিনুর মতো একজনের সাহিত্যসৃষ্টি ছেড়ে শাসনকর্ম করার দরকার কী? তবে, হ্যাঁ, সেইসূত্রে বিলেত যাওয়ার সাধ মিটিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন বিনুর নিজের দিক থেকে ছিল।
বিশ্বস্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির ক্ষমতার এক-একটি কণা এক-একজন কবিকে বা শিল্পীকে দেন। বিনুও তেমনি একজন। সে যদি তার সৃষ্টিক্ষমতার সদব্যবহার করে তবেই তার জীবন সার্থক হবে। সেটাই তার স্বধর্ম, তার জীবনের কাজ। অথচ জীবিকার জন্যেও কোনো একটা বৃত্তি বেছে নিতে হয়। সতেরো বছর বয়সে বিনুর মতে সেটা ছিল সাংবাদিক বৃত্তি। সত্যিই সে তার সেইটুকু বিদ্যা নিয়ে ইংরেজি বাংলা সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখতে পারত না। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এক প্রুফ-রিডার তার পরম উপকার করেছিলেন। কলেজে না গেলে সে ইউরোপীয় সাহিত্য ও ইতিহাসের এত বই আর কোথাও পেত না। তা ছাড়া লজিক, ইকনমিকস ইত্যাদি বিষয়ে লেকচার শোনা ও পরীক্ষা দেওয়ারও আবশ্যকতা ছিল। কলেজের আরও বড়ো লাভ সমমনস্ক বন্ধুদের সঙ্গ। সবুজগোষ্ঠী গঠন। তা ছাড়া প্রখ্যাত অধ্যাপকের সান্নিধ্য। কলেজে গিয়ে বিনু বার বার প্রথম হয় ও জলপানি পায়। তার থেকে আসে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। সমান্তরালভাবে চলছিল গান্ধীজির সম্পাদিত ইয়ং ইন্ডিয়া পড়া ও তাঁর চিন্তা ও কর্মের সঙ্গে যোগ রাখা। বিনু খদ্দর পরত; কেবল কলেজে নয়, বিলেতে তথা চাকরিজীবনে। সংগ্রামে ঝাঁপ দেয়নি তবে বার বার ভেবেছে তার যোগ দেওয়া উচিত। আসলে সেদিক থেকে সে রবীন্দ্রপন্থী।
তা বলে একেবারে ব্রিটিশ শিবিরে যোগদান? দেশের লোক তো ভাববেই সে দেশদ্রোহী। কখনো যে কোনো সত্যাগ্রহীকে জেলে দিতে হবে না তা কি সম্ভব? বিনু কী করে তার গান্ধীপন্থী বন্ধুদের কাছে মুখ দেখাবে? এই তার আদর্শবাদ! শেষপর্যন্ত বিনু তার বন্ধুদের সম্মতি পায়। এই স্থির হয় যে সে চাকরিতে বেশি দিন থাকবে না। অথচ সংগ্রামেও লিপ্ত হবে না। সাংবাদিক তথা সাহিত্যিক হবে।
আর কোনো পরীক্ষার জন্যে বিনু এমন প্রাণপাত পরিশ্রম করেনি। তার সেই তপস্যার মূলে ছিল এক নারীর প্রেরণা, এক নাইটের বলপরীক্ষার মূলে যেমন এক লেডি। এর থেকে তার এই প্রত্যয় জন্মায় যে নারীই পুরুষের শক্তি। যেমন কৃষ্ণের শক্তি রাধা। বৈষ্ণব পরিবারে তার কৈশোর কেটেছে। সে শুনেছে, ‘সুখ বলে, আমার কৃষ্ণ গিরি ধরেছিল। সারী বলে, আমার রাধা শক্তি সঞ্চারিল। নইলে পারবে কেন?’
বিনু মনে মনে স্বীকার করে সুশীলা শক্তি সঞ্চার না করলে সেও আইসিএস নামক বলপরীক্ষায় প্রথম হতে পারত না। যতদিন-না সে আইসিএস ত্যাগ করছে ততদিন এ নিয়ে তার মনে একটা অধর্মবোধ থাকবে। তা বলে সে সুশীলার প্রতীক্ষা করবে না। তার কামনা এক নূতনা রাধা। তার নতুন শক্তি।
দু-বছর বাদে বিনু বিলেতে তার শিক্ষানবিশি সাঙ্গ করে ভারতে ফিরে এল। বাংলা ভাষার লেখক হিসাবে তার প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশে নিযুক্তি। সেটা সে চাইতেই পেয়ে গেল। ইতিমধ্যে সে এক ভ্রমণকাহিনি লিখে বাংলাদেশের পাঠকমহলে সুপরিচিত হয়েছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরি তার পাঠক। তার প্রথম কর্মস্থল বহরমপুর। সেখানে গিয়ে সে বিভিন্ন বিভাগে হাতে-কলমে তালিম পায়। কিন্তু তার হাতের কলম তো একটা নয় দুটো। একটা রাজকর্মের আর একটা সাহিত্যসৃষ্টির। কলমের সঙ্গে কলমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
কিছুদিন পরে মহাত্মা গান্ধী তাঁর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করেন। বিনুও জেলে যায় কিন্তু কয়েদি হিসাবে নয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাগরেদ হিসাবে। তার সহানুভূতি রাজনৈতিক বন্দিদের প্রতি। একদিন হল কিনা তার নামে এক চিঠি এসে হাজির। এসেছে দক্ষিণ ভারতের ভেলোর জেল থেকে। লিখেছেন কে না সুশীলা দেবী।
আন্দোলনে যোগ দিয়ে অসংখ্য অন্তঃপুরিকা রাজবন্দিনি হন। তাঁদের সেই বন্দিদশাই তাঁদের মুক্তি অভিজ্ঞতা, অবরোধ প্রথা থেকে মুক্তি। আজকের দিনে কেউ কল্পনা করতে পারবেন না সেটা কত বড়ো বিপ্লব। পর্দানশিন কুলবধূ সমদ্রের ধারে গিয়ে নুন তৈরি করছে আর পুলিশের দ্বারা গ্রেফতার হচ্ছে, হাকিমের দ্বারা সে দন্ডিত হচ্ছে, জেলখানায় আবদ্ধ হচ্ছে। তবু কী আনন্দ। তা বলে হাজার মাইল দূরে ভেলোরে চালান!
সুশীলার সাথি ছিলেন এক দক্ষিণী মহিলা। তিনিও বিনুকে চিঠি লিখেছিলেন। জীবনে কতরকম অঘটন ঘটে। পঁয়ত্রিশ বছর পরে বিনু যখন দিল্লিতে এক সম্মেলন উপলক্ষ্যে উপস্থিত তখন তাঁর চাক্ষুষ পরিচয় পেয়ে অবাক হয়। তিনি এক ভারতবিখ্যাত পুরুষের পত্নী, স্বয়ং পার্লামেন্টের মেম্বার! তিনিও ভারতবিখ্যাত হৈমবতী দেবী। তিনি সেদিন ভেলোরের দুর্গতির কাহিনি বলেন। তাঁদের সেলের পাশেই ছিল ফাঁসির আসামিদের সেল। কী নিষ্ঠুরতা।
জেলখানা থেকে যে চিঠি আসে তাতে নিষ্ঠুরতার উল্লেখ থাকে না। তা সত্ত্বেও সুশীলা তার নতুন জীবন সানন্দে মেনে নিয়েছে। বিনু একদা অজস্র চিঠি লিখেছে। আর লিখতে চায় না। যে যার পথ বেছে নিয়েছে। একজন রাজবন্দিনির, অপরজন রাজপুরুষের। কারও সঙ্গে কারও সাযুজ্য নেই। এমনও হতে পারত যে সুশীলাকে একদিন আদালতে হাজির করা হত আর বিনু তাকে কারাদন্ড দিত। এ চাকরির এই হল দোষ। আদালতে দাঁড়িয়ে গান্ধীজি বলেছিলেন, হয় আপনি আমাকে দন্ড দিন, নয় পদত্যাগ করুন। সুশীলাও হয়তো সেই কথাই বলত।
বিনু একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিল। তাই নিয়ে ধ্যানস্থ ছিল। এমন সময় আরও এক চিঠি। লিখেছেন এক মার্কিন মহিলা। এসেছেন ভারত দর্শনে। লণ্ডনে বিনুর এক বন্ধুর সঙ্গে আকস্মিক আলাপ। বন্ধু পরামর্শ দিয়েছেন বিনুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তিনি জানতে চান কী কী দেখবেন, কোথায় কোথায় যাবেন। বিনু উত্তর দেয়, এখানেই আসুন, মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি দেখাব।
তিনি সত্যি সত্যি আসেন। দেখেন। বিদায় নেন। বিনু ধরে নেয় আর কখনো দেখা হবে না। কী মনে করে দু-তিনটি বাংলা কথা শিখিয়ে দেয়। কে জানত যে একদিন তাদের বিয়ে হবে। তিনি আবার আসবেন। এবার বধূ রূপে। জীবনে কত কী অঘটন ঘটে। কে জানত বিনু একদিন সেই জেলার শাসক হয়ে আসবে, সঙ্গে মীরা। এবার ফার্স্ট লেডি।
এতদিন বিনুর জীবন ছিল তার একার জীবন। সে একজনের মতো পরিকল্পনা করেছিল। এখন করতে হল দুজনের মতো। পরে আরও একজনের মতো। কিন্তু বিনু বা মীরা কোনো জনই সংসারী বিজ্ঞজন নয়। যাকে ইংরেজিতে বলে ওয়ার্ডলি ওয়াইজ ম্যান বা ওম্যান। স্কুল থেকে বিনু একবার পুরস্কার পেয়েছিল Bunyan রচিত ‘Pilgrim’s Progress।’
তাতে সংসারী বিজ্ঞজনের প্রতি কটাক্ষ ছিল। বিনু স্থির করেছিল সে বড়ো হয়ে সংসারী বিজ্ঞজন হবে না। সংসারীই হবে না, যদি-না তার নিজের মতো একজন আদর্শবাদিনীকে প্রেমসূত্রে জায়ারূপে পায়। মীরাই ছিল বিনুর নূতনা রাধা। ‘সমাপিবে চির বাঁশরি সাধা।’ বিনু ভাবতেই পারেনি যে মীরা তার জন্যে পিতৃকুল ত্যাগ করবে, মাতৃভূমি ত্যাগ করবে, স্বমনোনীত পিয়ানো বাদনের বৃত্তি ত্যাগ করবে, ভিখিরি শিবের অন্নপূর্ণা হবে। বিয়ের আগেই বিনু জানিয়েছিল আসলে সে একজন আইসিএস নয়, একজন সাহিত্যিক; সাহিত্যের খাতিরে তাকে আইসিএস ত্যাগ করতে হবে বছর কয়েক বাদে। মীরা সায় দিয়েছিল। বিয়ের পর থেকেই তাদের কৃচ্ছ্বসাধন আরম্ভ হয়ে যায়, যাতে পদত্যাগে হঠাৎ কষ্ট না পেতে হয়। মীরা ছিল ছায়ার মতো অনুগতা। বিনু যখনই যেখানে বদলি হয়েছে বিনুর কর্মস্থলে মীরা তার সাথি হয়েছে। গরমের কালে বিনুকে ছেড়ে সে পাহাড়ে যেতে চায়নি। কোনো কোনো জায়গায় বিদ্যুৎ ছিল না। টানাপাখার হাওয়া খেতে হত। মীরা সহ্য করত। বিনুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ত সফরে, রাত কাটাত তাঁবুতে। দিনের বেলা পায়ে হেঁটে বেড়াত। কোলে ছ-মাসের শিশু।
আইসিএস-দের কাজ শুধু মামলার বিচার নয়। জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ পর্যন্ত একশো রকমের কাজ। এসব করতে করতে তারা চৌকস হয়, যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে। মন্ত্রীরা না থাকলে ওরাই সরকার চালায়। সিভিল অথরিটি আর্মিও মেনে নেয়। পুলিশ তো মেনে নেয়ই। সফরে গেলে বিনুর অন্যতম কাজ হয় থানা ইনস্পেকশন। বিনু একজন ম্যান অব অ্যাকশন হয়ে ওঠে। অফিস, আদালত, ট্রেজারি, জেল, থানা, ইউনিয়ন বোর্ড, স্কুল কমিটি, ডিসপেনসারি কমিটি, কো-অপারেটিভ সোসাইটি, ল্যাণ্ড মর্টগেজ ব্যাঙ্ক, কোথায় না তার স্থিতি বা গতি! মহকুমার ভার দিয়ে তাকে তৈরি করা হচ্ছে জেলার ভারের জন্যে। জেলাশাসক হলে উচ্চতর পদের জন্যে। জেলা জজ হলে হাই কোর্টের জন্যে।
এটা ঠিক চাকরি নয়, আমলাতন্ত্র—বুরোক্রেসি। বিনু এই ব্যূহের ভিতরে ঢুকে বেরোবার ফাঁক পায় না। সে ভেবেছিল তাকে ডার্টি ওয়ার্ক করতে বলা হবে। তখন সে অস্বীকার করে ইস্তফা দেবে। তাকে তার বিবেচনামতো কাজ করতে বলা হয়, যেমন সাবালক ছেলেকে। সাহিত্যের জন্যে যাচ্ছে এটা যদিও ঠিক, তবু এটার চেয়ে জুতসই দেশের জন্যে যাচ্ছে বা গুরুতর মতভেদের জন্যে যাচ্ছে। বিনু দোনোমনো করে। সবচেয়ে বড়ো কারণ মীরা ও ছেলে-মেয়ে আর্থিক সংকটে পড়বে। ওদের বোঝাতে পারা যাবে না যে বিনুর পক্ষে ওটা এক আত্মিক সংকট।
জেলাশাসক হয়ে অবধি সে আড়াই বছর সাহিত্যের কলম ধরেনি। এমন অবস্থায় একটি শিশুপুত্রের প্রয়াণ তাকে বিহ্বল করে। বিনু সরস্বতীর কাছে অপরাধী বোধ করে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে উদ্যত হয়। কিন্তু কোথায় বিকল্প? টাকার জন্যে লিখতে রল্যাঁ বারণ করেছেন। টাকার জন্যে অন্য কিছু। সেটা কি সংবাদপত্রের চাকরি? সেখানেও তো কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।
তাকে জজ করে দেওয়া হয়। তখন যথেষ্ট অবসর পায়। উপন্যাস সমাপ্ত হয়। হাত যখন খালি তখন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। বিনু তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রশংসা করলে তিনি তাকে এক চমক দেন। ‘আমি সারাজীবন যা লিখেছি তা সাহিত্য হয়নি। তাই আমি সাহিত্যিক নই। সাহিত্যে আমার স্থান নেই। আপনার রচনা থেকে আমার নাম বাদ দিন।’
চাকরি সত্ত্বেও সাহিত্যিক মহলে বিনুর একটা স্থান আছে। সাংবাদিক হলে সেটা কি আর থাকবে? সে হবে না-ঘরকা না-ঘাটকা। চাকরি যদি অপথ হয়ে থাকে সাংবাদিকতাও অপথ। সে একটা ভুল সংশোধন করতে গিয়ে আরেকটা ভুল করবে। তার চেয়ে পেনশনের জন্যে পায়চারি করা শ্রেয়। মীরাও তার এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করে। যদিও সে বিনুর পদত্যাগের জন্যে প্রস্তুত। আসবাবপত্রের বেশিরভাগ জলের দরে বিক্রি। সে আর ছেলে-মেয়ে পালঙ্ক ছেড়ে তক্তপোশে শোবে। বিনু তো ক্যাম্প খাটে। সবাই মেঝেতে বসে খাবে। টেবিলচেয়ার বাতিল।
বিনুর মনে হল জনগণের জন্যে কিছু-একটা করা উচিত। ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে সে গ্রামে গ্রামে ঘুরে তাদের সঙ্গে মিশত ও তাদের জন্যে যথাসাধ্য করত, যেমন একটা স্কুল বা মেটার্নিটি হোম। কিন্তু এখন সে-সুযোগ নেই, সে স্থাণু। তা ছাড়া জজকে লোকের সঙ্গে মিশতে মানা—পাছে সে প্রভাবিত হয়। বিনু ছড়া লিখতে শুরু করে দেয়। ছড়া হয়তো গ্রামে গঞ্জে লোকের মুখে মুখে ঘুরবে। তারজন্যে ছাপা বই পড়তে হবে না। ওটা হচ্ছে এদেশের ওরাল ট্র্যাডিশন, চর্চার অভাবে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
যারা কায়িক পরিশ্রম করে ফসল ফলায়, কাপড় বোনে, বিনুর মতো মননশীলদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখে তাদের কাছে বিনু প্রাণধারণের জন্যে ঋণী। ঋণশোধের জন্যেই তার এইসব ছড়া লেখা, নিছক আনন্দের জন্যে নয়। কিন্তু এই কি যথেষ্ট? ঝড়ের দাপটে সমুদ্রের ঢেউ এসে কাঁথির উপকূলবর্তী বিশ মাইল পর্যন্ত এলাকা ছারখার করে দিয়ে গেছে। বিপন্ন মানুষকে সাহায্য পাঠানো জরুরি। কিন্তু সরকার বাধা দিচ্ছে, কারণ গ্রামবাসীরা গান্ধীজির ডাকে বিদ্রোহী। মীরা একটি মেডিক্যাল টিম পাঠাতে চায়, ছাত্ররা তৈরি। মেদিনীপুরের জেলাশাসক ঘোর কংগ্রেসবিরোধী মুসলমান। তিনিও একজন আইসিএস। বিনু তাঁকে চিঠি লিখে আশ্বাস দেয় যে মেডিক্যাল টিম যাচ্ছে নিছক মানবিক উদ্দেশ্যে। মানুষকে মানুষ না বাঁচালে কে বাঁচাবে? তাতে ফল হয়। বিনু শুনে অবাক হয় যে কংগ্রেস থেকে রিলিফ পাঠাতে কারও সাহস হয়নি। বহু কর্মী নিরাপদে কলকাতায় বসে আছেন। কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন তেমন সাড়া জাগায়নি মেদিনীপুর জেলার বাইরে।
বিনু রাজনীতির লোক নয়, কিন্তু মূলনীতি নিয়ে চিন্তিত। হিংসার প্রয়োজন যুদ্ধকালেই সবচেয়ে বেশি। যুদ্ধরত বিশ্বকে দৃষ্টান্ত দেখাতে পারে একমাত্র ভারতের জনগণ, গান্ধীজির নেতৃত্বে। কিন্তু তাঁর এই আন্দোলন অহিংস হয়নি।
নিদ্রিত জনগণকে জাগানোই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে তা সিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সেই জাগ্রত জনগণ অহিংসার ধার ধারেনি। তবে তাদের পক্ষে বলবার একটি প্রশংসনীয় কথা তারা একজনও ইংরেজের গায়ে হাত দেয়নি। মীরা বিনুকে একথা মনে রাখতে বলে। অর্থাৎ জাতি হিসাবে ইংরেজদের কোনো অনিষ্ট ঘটেনি। ইংরেজ সরকার আর ইংরেজ জাতি সমার্থক নয়। গান্ধীজির শিক্ষা ব্যর্থ হয়নি।
বিনু ক্রমশ তার বিচারকবৃত্তিতে মনোযোগী হয়। দেশের লোক যে কেবল সুশাসন চায় তাই নয়, সুবিচারও চায়। জজের মর্যাদা ম্যাজিস্ট্রেটের চেয়ে কম তো নয়ই বরং বেশি। ইহুদিদের ওল্ড টেস্টামেন্টে রাজাদের পরেই জজদের স্থান। যিশুর অনুজ্ঞা, ন্যায়পরায়ণতার জন্যে ক্ষুধিত ও তৃষিত হও। বিচারকের আসনে বসে বিনুর মনে হয় তাকেই বিচার করা হচ্ছে, আসামিকে নয়। সে প্রার্থনা করে সে যেন কারও প্রতি অন্যায় না করে। আসামিও তো মানুষ। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের বিচার করার কে? ভগবানই প্রকৃত বিচারক। বিনু তাঁর হাতের যন্ত্র। নিমিত্ত মাত্র ভব সব্যসাচী। যথেষ্ট বিবেচনার সঙ্গেই সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে একটি ক্ষেত্রে তার বিবেক তার হাত চেপে ধরে। না, প্রাণদন্ড নয়।
যে মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য তার প্রাণদন্ডই একমাত্র বিহিত দন্ড। সে-মামলায় প্রাণদন্ড না দেওয়াটাই সমাজের প্রতি অকর্তব্য। বিনু মানে এটাই ঠিক। তবু তার মন মানে না। প্রাণদন্ড নামক দন্ডটাই অন্যায়; টলস্টয়ের মতে, গান্ধীজির মতেও। বিনু কী করবে? চাকরি ছেড়ে দেবে না চাকরি রাখার জন্যে প্রাণদন্ড দেবে? তার বরাত ভালো জুরিরা প্রাণদন্ডের ভয়ে দন্ডবিধি আইনের ধারাটাকে নামিয়ে আনেন। তখন জজ দ্বীপান্তর দন্ড দিয়ে অপরাধীকে বাঁচান। সেইসঙ্গে আপনাকেও।
সে নিকটবর্তী একটি জেলায় বদলি হয়েছে শুনে তার এক সাহিত্যিক বন্ধু তাকে লেখেন, ‘যুবকটি বেকার। দয়া করে তাকে জুরর করবেন।’ বিনুর মনে খটকা বাঁধে। তবে কি জুরররা অনাহারী নন? উৎকোচ আহারী। খোঁজখবর নিয়ে যা জানতে পায় তা রোমহর্ষক। আসামি পক্ষের উকিলদের সঙ্গে জুররদের চোরা সম্পর্ক। তাই পাকা মামলাও কেঁচে যায়। জুরিপ্রথা ইংরেজদের দ্বারা এদেশে পরিবর্তিত। এক ইংরেজ জজ রবীন্দ্রনাথকে বলেন ভারতীয়রা এই প্রথার উপযুক্ত নয়। তিনি তা শুনে মর্মাহত হন। বিনুও ছিল তাঁর মতো ভারতে জুরিপ্রথার পক্ষে। কিন্তু পরিশেষে সেও সেই জজের মতের সঙ্গে মত মেলায়। হাই কোর্টকে চিঠি লিখে জানায় এ জুরিপ্রথার সঙ্গে উৎকোচ জড়িত। বছর তিনেকের জন্যে জুরিপ্রথা রহিত করা হোক।
এটা পার্টিশনের অব্যবহিত পূর্বের সুপারিশ। ব্রিটিশ বিদায়ের পর দেখা গেল জুরিপ্রথাও বিদায় হয়েছে। শুধু একটি জেলা থেকে নয়, পশ্চিমবঙ্গ থেকে, সারা ভারত থেকে। তবে হাই কোর্টে দশ-বারো বছর বহাল ছিল। পরে সেখান থেকেও উঠে যায়। তাহলে কি জুরিপ্রথা ভারতে অনুপযোগী? অথবা ভারত কি জুরিপ্রথার অনুপযুক্ত? বিনু দুঃখিত তার সুপারিশের পরিণাম দেখে।
পার্টিশনের পূর্বেই বিনুর কাছে সরকার থেকে হিন্দু কোডের একটি খসড়া আসে। তখনকার দিনে কেন্দ্রীয় সরকারে কংগ্রেস ছিল না। সুতরাং হিন্দু কোডের প্রস্তাবটা কংগ্রেসের বা জওহরের নয়। বোধহয় বড়োলাটের শাসন পরিষদের আইন বিষয়ক সদস্যের। তিনি হিন্দু। তবে যতদূর মনে পড়ে তাতে প্রাক্তন বিচারপতি বেনেগল নরসিংহ রাওয়ের হাত ছিল। খসড়ার একটি ধারায় ছিল স্বামী যদি হিন্দু হয় তবে স্ত্রী হিন্দু না হলেও সন্তান হিন্দু বলে গণ্য হবে। এ-ই তো বিনু চায়। তার বিয়ের সময় তার বাবা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোদের ছেলে-মেয়ের বিয়ে হবে কোন সমাজে?’ বিনু উত্তর দিয়েছিল, ‘ততদিনে হিন্দুসমাজ আরও উদার হয়ে থাকবে।’ ভগবান কত বার তার মুখরক্ষা করেছেন, এবারেও করলেন। বেনেগল নরসিংহ রাওয়ের পত্নীও ছিলেন মীরার মতো একজন। এখন তো স্থির হয়ে গেছে বাপ হিন্দু না হলেও মা যদি হিন্দু হয় তো সন্তানও হবে হিন্দু। যেমন ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র রাজীব ও সঞ্জয়।
জজের পদে থেকে বিনু আবিষ্কার করেছিল যে ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভায় একটি অ্যাক্ট পাস হয়েছিল। তার সূচনায় ছিল, ‘The term ‘‘Hindu’’ includes an Ismalia Khoja.’ যতদূর মনে পড়ে সেটা উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন। তাই যদি হয় তবে জিন্না সাহেবও উত্তরাধিকার সূত্রে হিন্দু। কারণ তিনি একজন ইসমাইলিয়া খোজা। দ্বিজাতিতত্ত্ব কি তাঁর মুখে মানায়?
বিনুকে পার্টিশনের পর শ্রমিক ক্ষতিপূরণ কমিশনার করা হয়। সেইসঙ্গে কৃষি আয়কর ট্রাইবুনালের প্রেসিডেন্ট। উপরন্তু গুণ্ডা আইনের জজ। গুণ্ডার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে বেশ্যাও আসে। শ্রমিক, কৃষক, গুণ্ডা, বেশ্যা এদের সকলের সঙ্গে ঘটে প্রকাশ্য পরিচয়। কিন্তু পরে একসময় তার ও তার এক সহযোগীর উপরে ভার পড়ে গোপনে বিবেচনা করে দেখতে রাজবন্দি কমিউনিস্টদের কাকে কাকে আটক করে রাখা অনাবশ্যক। আশ্চর্যের ব্যাপার আটকদের মধ্যে ছিল কয়েকটি স্কুলের ছাত্রী। বিনু ও তার সহযোগী জানতে চান কী তাদের অপরাধ। পুলিশের ইনস্পেকটর জেনারেল স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন ওরাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। স্কুলের ছোটো ছোটো মেয়েদের মগজধোলাই করছে। তারা পরে একদিন দুর্ধর্ষ বিপ্লবী বনবে। ভদ্রলোক বিনুদের হাসালেন। তাঁরা ওই বালিকাদের মুক্তির সুপারিশ করেন। কিন্তু সত্যই তিনি ছিলেন ভবিষ্যদবক্তা।
বিনুর জীবনদেবতা তাকে মহাকরণে কিছুদিন সেক্রেটারি পদে রাখেন। এমনি করে তার কর্মজীবনের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। সে ক্যাবিনেট বৈঠকে হাজির হয়ে মন্ত্রীদের মন্ত্রণা শোনে। একজন মন্ত্রী তাকে বলেন, ‘আপনি ভাবছেন চাকরি ছেড়ে দিলে আরও ভালো লিখবেন? দেখবেন এই সময়টাই ছিল আপনার সাহিত্যকর্মের দিক থেকে সবচেয়ে অনুকূল সময়।’
যামিনী রায়ও তাকে বলেন, ‘সৃষ্টির কাজের জন্যে প্রতিকূলতাও চাই। বিরোধ না থাকলে সৃষ্টি এলিয়ে পড়ে। আপনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভুল করছেন।’ অবসর নেবার পর বিনু দশটা থেকে পাঁচটা বাড়িতে কাটায়। অফিস বা আদালতের অভাব বোধ করে। চারদিক জমজমাট থাকত। সকলের মধ্যমণি বিনু। শূন্য ঘরে লেখালেখি করে কি জীবনের স্বাদ মেলে? কোথায় সেই জীবনদর্শন, জীবনের সঙ্গে মুখোমুখি? জীবনদর্শন বলতে জীবনকে দর্শনও বোঝায়। শান্তিনিকেতনে থেকে জীবনের কতটুকু দেখতে পাওয়া যায়? মাঝে মাঝে কলকাতা আসতে হয়, দিল্লি যেতে হয়। দর্শন যা করে তা একজন বাইরের লোকের মতো, একজন ভিতরের লোকের মতো নয়। সে একদা ছিল ইনসাইডার, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ইনসাইডার। এখন সে একজন আউটসাইডার। সরকারি মহলে সে একজন আউটসাইডার, ভিতরের খবর রাখে না। রাজনীতি ক্ষেত্রেও তাই। ব্যাবসার ক্ষেত্রেও তাই। তবে সে প্রচুর সময় পায় ভাববার ও লেখবার। সদর দরজা বন্ধ, অন্দরের দরজা খোলা। জগতেরও তো একটা ইনসাইড আছে। বিনু সেই অন্তর্জীবনের ইনসাইডার হতে আকাঙ্ক্ষা করে। অন্তর্জীবনও জীবন, তার দর্শনও জীবনদর্শন।
বহির্জীবনে যে রিক্ত অন্তর্জীবনে সে ধনী হতে পারে; বহির্জীবনে যে দুর্বল অন্তর্জীবনে সে বলবান হতে পারে; বহির্জীবনে যে নরম অন্তর্জীবনে সে শক্ত হতে পারে; বহির্জীবনে যে কুশ্রী অন্তর্জীবনে সে রূপবান হতে পারে; বহির্জীবনে যে শুষ্ক অন্তর্জীবনে সে সরস হতে পারে; বহির্জীবনে যে বৃদ্ধ অন্তর্জীবনে সে যুবক হতে পারে; বহির্জীবনে যে বদ্ধ অন্তর্জীবনে সে মুক্ত হতে পারে। বহির্জীবনের শূন্যতা অন্তর্জীবনের পূর্ণতা একই মানুষের বেলা সত্য হতে পারে।
মানুষকে লেবেল দিয়ে সনাক্ত করা যায় না। হিন্দু, মুসলমান, ব্রাহ্মণ, হরিজন, বাঙালি, ওড়িয়া, ভারতীয়, ইংরেজ, শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, প্রাচ্য, পাশ্চাত্য, প্রাচীন, আধুনিক, সভ্য, অসভ্য, আর্য, অনার্য ইত্যাদি লেবেল দিয়ে তাদের চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু তারা পুরোপুরি পৃথক নয়। অমিল যত, মিল তার চেয়ে বেশি। তাদের অন্তর্জীবন হয়তো একইরকম। এসব লেবেলের মূল্য নেই তা নয়। কিন্তু অন্তর্জীবনের এসব লেবেল নিতান্তই বাহ্য। মানুষকে ভালোবাসলে তার স্বরূপ জানতে পারা যায়।
মানুষ নিজেই একটা লেবেল। মানুষ বলতে যা বোঝায় তার চেয়েও মানুষ বড়ো। সূর্য তারার সঙ্গে তার সাযুজ্য। তার ভিতরেও জ্বলছে একই আগুন। তার বাইরেও সেই আলোর আভা, সেইজন্যে তাকে বলা হয়েছে অমৃতের সন্তান। সে এসেছে অমৃতলোক থেকে, যাবেও অমৃতলোকে। তার পরমায়ু যত হ্রস্ব হোক-না কেন তা অমৃত।
বিনু বরাবরই চিন্তা করেছে এ জীবন নিয়ে সে কী করবে। এ জীবনে সে কী হবে। এসব অবশ্য তার একার উপর নির্ভর করে না। পরিবার, সমাজ, দেশ, কাল, অবস্থা, পরিবেশ, দৈব সবকিছুই তাকে সাহায্য করে বা তার অন্তরায় হয়। মানুষ করতে চায় এক, ঘটে আরেক। হতে চায় একটা কিছু, হয়ে ওঠে আরেকটা কিছু। একে বলা যেতে পারে নিয়তি। নিয়তি কেন বাধ্যতে? কিংবা জীবনদেবতার ইচ্ছা। তাঁকেই-বা কে বাধ্য করবে?
তা সত্ত্বেও বিনু পদে পদে প্রশ্ন করে, কী কী লিখবে? কেমন করে লিখবে? কাদের জন্যে লিখবে? কেন লিখবে? তেমনি মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করে, কেমন করে বাঁচবে? কেন বাঁচবে? কাদের জন্যে বাঁচবে? কাদের বাঁচাবে?
লেখক হিসাবে সে মোটামুটি স্বাধীন। পরের ফরমাশে সে লেখে না। টাকার জন্যে লেখে না তবে লিখলে টাকা নেয়। এটা বার্নার্ড শ-এর নীতি। মোটামুটি স্বাধীন, পুরোপুরি নয়। একটা কথা আছে, Thus far and no further, এই পর্যন্ত যেতে পারো। তারপরে একটি পা-ও না। লেখকের বিবেক তাকে নিবৃত্ত করে। কিংবা রাজভয়। কিংবা লোকভয়। সব কথা লেখা যায় না। লেখক স্বাধীন হলেও নিরঙ্কুশ নয়।
মানুষ বিনু লেখক বিনুর চেয়েও সাবধান। লোকে কী মনে করবে? স্ত্রী কী মনে করবে? ছেলেমেয়ে কী মনে করবে? পারিবারিক শান্তি কার না কাম্য? তবে তাদের কাছ থেকেও সবুজসংকেত পাওয়া যায়, অন্যদের কাছ থেকে অত সহজে নয়। সকলের জীবনেই এইরূপ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে।
বিনু যেমন করে বাঁচতে চেয়েছে তেমন করে বাঁচতে পারেনি। বাঁচতে গেলে বিপাকে পড়ত। নিজের খেয়ালখুশিমতো না হলেও যেভাবে বেঁচেছে সেটা মোটের উপর ভালোই হয়েছে।
বিনুর ধারণা ছিল জীবনও একটা শিল্প হতে পারে, সে হতে পারে জীবনশিল্পী। কিন্তু জীবনের একটা বড়ো অংশ হল জীবিকা। জীবিকার অনুরোধে আইনকানুন মেনে কাজ করতে হয়, কখনো কখনো ওপরওয়ালার সঙ্গে আপোশও করতে হয়। পাবলিকের কাছেও জবাবদিহির দায় আছে। সে জীবনশিল্পী হবার সাধ ত্যাগ করে। শুধু শিল্পী হওয়ার সাধনাই বজায় থাকে। সে-সাধনার সঙ্গে প্রেমিক হওয়ার সাধনাও ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। যেমন রস আর রূপ তেমনি প্রেম আর আর্ট।
এ ছাড়া ছিল সত্যের অন্বেষণ। জীবনের প্রত্যেক পর্বেই সে সত্যের অন্বেষণ করেছে। পরীক্ষা না করে কিছুই অমনি সত্য বলে মেনে নেয়নি। গুরুবাক্য হলেও তা স্বতঃসিদ্ধ নয়।
তার ভাগ্য ভালো যে তাকে ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে গুলি চালাবার হুকুম দিতে হয়নি, জজ হিসাবেও ফাঁসির হুকুম দিতে হয়নি। তেমন এক পরীক্ষায় পাস করাও খারাপ, ফেল হওয়াও খারাপ। তবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামাতে হলে যদি গুলি চালাবার হুকুম দেওয়া একান্ত আবশ্যক হত তাহলে সে পেছপাও হত না। সে দাঙ্গার সময় গুলি চালাত নিরীহ মানুষদের বাঁচাতে। বাঁচানোই তার উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য সাধনের অহিংস উপায় হয়তো অনশন, কিন্তু সেটা একজন ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে বেমানান। অনশন করতে চাইলে পদত্যাগই কর্তব্য।
এখন সে নব্বইতে পড়েছে। তার জীবনসঙ্গিনী বিগত। এখন নতুন করে তার চাইবার কী আছে? পাবারই-বা আছে কী? আছে, আছে। শৈশবে ও প্রথম যৌবনে দু-বার তার দৃষ্টি খুলে গিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্যে তার ধ্যানদৃষ্টিতে এ বিশ্বের সব কিছু পরিষ্কার দেখা দিয়েছিল। সে আরও একবার ফিরে পেতে চায় সেই দিব্যদৃষ্টি।
বিনুর নিশ্চিতি
বিনুদের বাড়িতে কেবল মানুষজন ছিল না, ছিল পোষা পশু, পোষা পাখি। আর ছিলেন এক দেবতা। ঠাকুরঘরে তাঁর অধিষ্ঠান। ঠাকুমা তাঁর নিত্য সেবা পূজা করেন। বিনুরা তাঁর প্রসাদ পায়। সেই বিগ্রহের নাম বিনুরা শুনত পূর্ণমাসী। বোধহয় পৌর্ণমাসী। শ্রীরাধার এক সখী। শাক্ত পরিবারে ইনি কেমন করে এলেন তা অজ্ঞাত।
দেবতার উপস্থিতি কেবল বিনুদের বাড়িতেই নয়। অদূরে বলরাম মন্দির, সেখানে জগন্নাথ ও সুভদ্রাও উপস্থিত। মাঝে মাঝে মা-ঠাকুমার সঙ্গে বিনুও সন্ধ্যা বেলা পায়ে হেঁটে মন্দিরে যায়। দিনের বেলা যাঁরা অসূর্যম্পশ্যা সন্ধ্যা বেলা তাঁরা মন্দিরে এসে আসর জমান। খুদে বিনুকে পুরুষ বলে গণ্য করেন না।
শহরে আরও মন্দির ও মঠবাড়ি আছে। বিনু তার বন্ধুদের সঙ্গে যায়, ঠাকুর দেখে। হনুমানজিও দেবতার মতো পুজো পান। তবে তাঁর সেটা মন্দির নয়, খোলা জায়গার উপর একটা আস্তরণ। বছরের পর বছর পাড়ায় আগুন লাগে, ঘর পুড়ে যায়। এরজন্যে পুজো করতে হয় হিঙ্গুলেই দেবীকে। যারা গুড়ের পানা দেয় তাদের ঘর পোড়ে না।
বিনু এ সমস্ত বিশ্বাস করে। তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর সেও একজন ভক্ত। তবে তার প্রধান আরাধ্য মা দুর্গা ও মা সরস্বতী। বাড়িতে যখন দুর্গা পূজা হয় তখন একটা জলচৌকিতে রাখা হয় মূর্তি বা পট নয়, একটি তলোয়ার, বংশের পুরাতন উত্তরাধিকার। সেইসঙ্গে কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশিদাসী মহাভারত, কবিকঙ্কণ চন্ডী প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ আর কে জানে কেন শেক্সপিয়ারের ইংরেজি গ্রন্থাবলি। সরস্বতী পূজার সময় তলোয়ার থাকে না, তার বদলে থাকে কলম ও দোয়াত। আর সব একইরকম, বাদ কবিকঙ্কণ চন্ডী। শেক্সপিয়ার যথাস্থানে সমাসীন।
ছোটোকাকা পরীক্ষা পাস করে ইংরেজি বাইবেল উপহার পান। সে-গ্রন্থও এ পরিবারে সমাদৃত। তবে পূজিত নয়। বোখারি সাহেব বলে এক ফকির মাঝে মাঝে সত্যপিরের সিন্নি দিয়ে যান। বিনুরা মুসলমানের হাতে জল খায় না, কিন্তু সিন্নি খেতে হালুয়া খেতে তাদের সংস্কারে বাধে না।
এ যে সংসার এতে এক পটপরিবর্তন ঘটে যায়, যখন বিনুর ঠাকুমা দেহত্যাগ করেন। বাবা-মা রামদাস বাবাজির কাছে বৈষ্ণব দীক্ষা গ্রহণ করে বাড়িতে গোপাল বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। ঠাকুমা তাঁর বিগ্রহকে নিয়ে বড়োছেলের বাড়ি ছেড়ে মেজো ছেলের বাড়ি যান। পরে শাক্তমতে পূজা-আর্চা বন্ধ হয়ে যায়। কীর্তনিয়ারা বাইরে থেকে এসে খোল করতাল বাজিয়ে গান করেন। বিনুকেও খোল বাজাতে শেখানো হয়, কিন্তু সে অপটু। প্রতিদিন মা জয়দেব থেকে একা গান করেন, বাবা বিদ্যাপতি থেকে একা আবৃত্তি করেন। সেসব বিনু বুঝতে পারে না, কিন্তু শুনতে শুনতে তার ছন্দের ও মিলের কান তৈরি হয়ে যায়। বাবা ও মা গোপাল ছাড়া আর কোনো দেব-দেবীর ভক্ত নন। সেটাও একপ্রকার একেশ্বরবাদ।
বিনু কদাচ কখনো বলরাম মন্দিরে যায়, জগন্নাথকে সে ভক্তি করে। তিনিও তো কৃষ্ণ। যাঁর কথা বাবার মুখে। বিনু তাঁকে প্রণাম করলে তিনি বলেন, ‘কৃষ্ণে মতি হোক।’ কিছুদিনের জন্যে বিনু পুরীতে সেজো কাকার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে যায়। প্রায়ই ঠাকুমাকে জগন্নাথ দর্শনে নিয়ে যেতে হত। গর্ভগৃহে প্রবেশ করে সে জগন্নাথের গাত্র স্পর্শ করে। কত বড়ো পুণ্য! গুরুচরণবাবু বলে এক প্রতিবেশীও যেতেন। তিনি করতেন কী, না নিজের দুই হাতে নিজের দুই গালে চড় কষাতেন আর দুই কান মলতেন। বলতেন, ‘প্রতিদিন কত পাপ করছি। এইভাবে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে।’
তবে গুরুচরণের চরণ দুটি গোদের দরুন গুরুভার। বোধহয় তার ধারণা ছিল গোদের মূল কারণ হচ্ছে পাপ। পাপ থেকে যেমন কুষ্ঠ হয় তেমনি যতরকম রোগ হয়। মন্দিরে যারা যায় তারা একটা-না-একটা প্রার্থনা নিয়ে যায়। পাপমুক্তির বা রোগমুক্তির বা ধনসম্পদের বা সাংসারিক সাফল্যের বা পরকালের সদগতির বা সন্তানলাভের। বিনুর তেমন কোনো প্রার্থনা ছিল না। সে যায় শুধু দর্শন করতে, কেবল দেবতাকে নয়, সমবেত মানুষজনকে। কত দূর থেকে, কত দেশ থেকে কত স্ত্রী-পুরুষ এসে হাজির হয়েছে। এদের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে গায়ে গা ঠেকিয়ে যে সুখ পাওয়া যায় সেও তো একপ্রকার সুখ। বিশেষ করে মেয়েদের সঙ্গে। ছেলেবেলা থেকেই মেয়েদের প্রতি ওর একটা টান ছিল। মেয়েদেরও বোধহয় ওর প্রতি।
বিনুর ছোটোকাকার খ্রিস্টধর্মে অনুরাগ ছিল। তিনি তাকে একদিন খ্রিস্টানদের এক গির্জায় নিয়ে যান। সেও বসে যায় সকলের সঙ্গে উপাসনায়। সবাই যখন চোখ বোজে সেও চোখ বোজে। সবাই যখন চোখ মেলে সেও তখন চোখ মেলে। সেও পবিত্র রুটি ও বারি মুখে ছোঁয়ায়। না, মদ নয়। গির্জাটা ব্যাপটিস্ট সম্প্রদায়ের।
বিনুর সতেরো বছর বয়সে তার মাতৃবিয়োগ হয়। শোকে সান্ত্বনার জন্যে সে যেসব বই পড়ে তাদের মধ্যে ছিল রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থ। কতকটা তাঁর প্রভাবে, কতকটা ব্রাহ্মসমাজের প্রভাবে সে ক্রমে ক্রমে দেব-দেবীতে ও সাকার আরাধনায় বিশ্বাস হারায়। রক্ত-মাংসের কোনো মানুষই ঈশ্বর হতে পারেন না, ঈশ্বরের অবতার হতে পারেন না, ঈশ্বরপুত্র হতে পারেন না, কৃষ্ণও না যিশুও না। একবার এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোর পর বিনু আর ঠাকুর দর্শন করতে মন্দিরে যায় না, যায় শিল্প দর্শনের জন্যে। সেদিক থেকে মন্দিরগুলো মহামূল্য।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার সময় তাকে একটি ফর্ম পূরণ করতে দিলে সে তার ধর্মমত এই বলে ব্যক্ত করে যে তার ধর্ম একেশ্বরবাদী অন্য ধর্ম হতে সারসংগ্রহকারী হিন্দুধর্ম। ইংরেজিতে ‘Monotheistic eclectic Hinduism.’
একেশ্বরবাদী হলেই যে তাকে অদ্বৈতবাদী হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। মুসলমানরা একেশ্বরবাদী কিন্তু অদ্বৈতবাদী নয়। অদ্বৈতবাদীদের মতে জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক ও অভিন্ন। সেটা সত্য, কিন্তু মানুষ তো আপনি আপনাকে প্রার্থনা জানাতে পারে না, উপাসনা করতে পারে না। এসবের প্রয়োজন কি নেই? ছেলে বাপের কাছে প্রার্থনা করে, মাকে ভক্তি করে।
তেমনি ঈশ্বরকে পিতা রূপে, মাতা রূপে, প্রভু রূপে, প্রেমিক রূপে, সখা রূপে, পুত্র রূপে, এমনকী কান্তা রূপে কল্পনা করেছে মানুষ। যার যাতে ভক্তি বা প্রীতি বা স্নেহ। অদ্বৈতবাদী বা জ্ঞানমার্গী দ্বৈতবাদীরাও কার্যত ভক্তিমার্গী। বিনু যখন উপনিষদ পড়ে তখন সে জ্ঞানমার্গের রস পায়। যখন বৈষ্ণব পদাবলি পড়ে তখন ভক্তিমার্গের রস।
তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সের বিনু একইসঙ্গে হয়ে ওঠে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতো লীলাবাদী আর ব্রাহ্মদের মতো একমেবাদ্বিতীয়ম বিশ্বাসী। যিনি একা তিনি লীলা করতে পারেন না, নিত্য লীলার জন্যে চান লীলাসঙ্গিনী। পরমাত্মার তেমনি জীবাত্মা, পুরুষের যেমন প্রকৃতি, কৃষ্ণের যেমন রাধা।
ভারতে শত শত মন্দির আছে যেখানে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি পূজিত। তাঁরা দুই অথচ অবিচ্ছিন্ন, দ্বৈত অথচ অদ্বৈত। উভয়ই সমান। তাঁদের একজন হচ্ছেন ভগবান, অপরজন মানুষ। ভগবান আর মানুষ উভয়েই সমান। অন্য অর্থে পুরুষ আর প্রকৃতি উভয়েই সমান। আধুনিকরা বলবেন পুরুষ ও নারী উভয়েই সমান।
ভগবান ও মানুষ কি সমান শক্তিশালী বা সমান ঐশ্বর্যশালী হতে পারে? না কখনো নয়। লক্ষ বর্ষ পরেও না। কিন্তু মানুষের প্রেম তাকে প্রেমের নিরিখে সমান করতে পারে।
খ্রিস্টানরা বলেন ভগবান প্রেম স্বরূপ। যিশু তাঁর শিষ্যদের উপদেশ দিয়েছেন, ভগবানকে সমস্ত মন দিয়ে, সমস্ত হৃদয় দিয়ে, সমস্ত আত্মা দিয়ে ভালোবাসবে। আর প্রতিবেশীদের আপনার মতো ভালোবাসবে। খ্রিস্টীয় সন্তদের জীবন এই আদর্শে পরিচালিত হয়েছে। সুফি সাধকদের জীবনেও এর অনুরূপ লক্ষিত হয়। নানক, কবীর, চৈতন্যের জীবনেও। বৌদ্ধরা ভগবান সম্বন্ধে নীরব। তাঁদের মৈত্রীর ও করুণার আদর্শ কেবলমাত্র মানুষে সীমাবদ্ধ নয়, সর্বজীবে প্রসারিত। জৈনদের আদর্শও অনুরূপ।
প্রেম, মৈত্রী, অহিংসা দুর্বলতার সূচক নয়। শিবি রাজা তো একটি কপোতকে আশ্রয় দিতে গিয়ে নিজের শরীরের মাংস কেটে দেন বাজপাখিকে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে পরের জন্যে জীবনদানের দৃষ্টান্ত আছে। জীবনটা দিয়ে ফেলা অত সহজ নয়, কিন্তু কিছু-না-কিছু নিঃস্বার্থভাবে দান করা অসম্ভব নয়। বিনুর সাহিত্যসৃষ্টিও নিঃস্বার্থদান। তবু তা-ই যথেষ্ট নয়। পরের জন্যে নিঃস্বার্থভাবে কিছু করতে পারলে সে আপনাকে কৃতার্থ মনে করে। পর যাকে বলা হয় সেও তলিয়ে দেখলে আত্মীয়, আত্মার আত্মীয়। দেহের থেকে দেহ আলাদা, এটা স্পষ্ট। কিন্তু মনের সঙ্গে মনের ও হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের অস্পষ্ট যোগ আছে। তাই পরের কল্যাণ করলে নিজেরও কল্যাণ হয়।
বিনু ইংল্যাণ্ডে গিয়ে দেখে সেখানকার নারী ও পুরুষ কতরকম কল্যাণকর্মে সময়, শক্তি ও অর্থব্যয় করছেন। এঁদের মানবপ্রেম ও প্রাণীপ্রেমকে বলা হয় খ্রিস্টীয় প্রেম। এ প্রেম নর-নারীপ্রেম নয়। এঁদের অনেকেই চিরকুমার বা চিরকুমারী। নর-নারীপ্রেমের সাধনা এঁদের জীবনে দৃশ্যমান নয়। কিন্তু প্রেম বা করুণা বা মৈত্রী যে এঁদের নিঃস্বার্থভাবে খাটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এটা তো সত্য। কয়েকজন মহিলা অন্ধদের জন্যে একটি শিল্পশালা চালাচ্ছেন। কয়েকজন একপ্রকার খাদি তৈরি করেন ও পরেন। লণ্ডনের ইস্ট এণ্ডে কিংসলি হলের মতো কয়েকটি হল ছিল। কলেজ থেকে বেরিয়ে কল্যাণব্রতী যুবক-যুবতীরা সেসব হলে বছর কয়েক লোকের সঙ্গে মিলেমিশে নানা হিতকর কাজ করতেন। প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি তাঁদের একজন। রাসকিন লিখে গেছেন আনটু দি লাস্ট। গান্ধীজি তার অনুবাদ করেছেন ‘সর্বোদয়’। কথাটা যিশু খ্রিস্টের। কিন্তু রাসকিন প্রবর্তিত কল্যাণকর্মের প্রেরণা ধর্মীয় প্রেরণা নয়। কর্মীরা খ্রিস্টীয় তত্ত্বে বিশ্বাস না-ও করতে পারেন। ধর্মবিশ্বাস যা-ই হোক-না কেন দীনহীনদের দুঃখ-দৈন্যের শরিক হয়ে দুঃখমোচন করতে হবে।
মুরিয়েল লেস্টারের ভাই কিংসলি প্রথম মহাযুদ্ধে নিহত হন। তাঁর মতো হাজার হাজার যুবক যুদ্ধে গিয়ে ফিরে আসেন না। তাঁদের জন্যে যাঁরা অপেক্ষা করছিলেন সেইসব কুমারীদের বিয়ে হয় না। হবেও না। তেমনি আরও কয়েকজনের সঙ্গেও বিনুর আলাপ হয়। এঁরা যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। লিগ অব নেশনসের উপর তাঁদের ভরসা। অথচ লিগের মেম্বারদের মধ্যে আমেরিকাও নেই, জার্মানিও নেই। কেই-বা আর একটা মহাযুদ্ধের জন্যে অধীর? বিনুর বিশ্বাস হয় না যে জার্মানরা আরও এক হাত লড়বে। জার্মানি ঘুরে দ্বিতীয়বার যুদ্ধের লেশমাত্র আভাস পায় না। তার নজরে পড়ে তরুণ-তরুণীরা উড়ো পাখির মতো দলে দলে ঘরছাড়া হয়ে খোলা হাওয়ায় খোলা আকাশের তলে জমায়েত হচ্ছে। রাজনীতির নামগন্ধ নেই। অর্থোপার্জনেরও না। এইসব তরুণ যে একদিন নাতসি বনবে ও যুদ্ধে নামবে তা ভাবা যায় না। এরা সত্যি খারাপ ছিল না। দেখা গেল ভালো মানুষও খারাপ হতে পারে। খারাপ কাজ করতে পারে।
ফাউস্টকে খারাপ করেছিল মেফিস্টোফেলিস অর্থাৎ শয়তান। জার্মানদের খারাপ করল হিটলার। এটা একটা সরলীকরণ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে দু-কোটি জার্মান মরে ও যাদের মারে তারাও দু-কোটি রাশিয়ান। ব্যক্তিগত শত্রুতা কারও সঙ্গে কারও ছিল না। উপরন্তু মরে ষাট লক্ষ ইহুদি। কাউকেই এরা মারেনি। এক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল না। যুগ যুগ ধরে জমছিল ইহুদিদের প্রতি বিরাগ। তেমনি রুশদের প্রতি।
যিশুর শিক্ষা কি তবে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনের জন্যে? সমষ্টিগত জীবনের জন্যে নয়? তাই যদি হয় তবে গান্ধীজির শিক্ষাও ব্যক্তিগত জীবনের জন্যে। ভারতের জনসমূহ অহিংসা মেনে চলবে না। যিশুর শিক্ষার দু-হাজার বছর পরে যদি এই হয় খ্রিস্টান ইউরোপের হাল তবে গান্ধীর দু-হাজার বছর পরে সত্যাগ্রহী ভারতের হাল কি মহত্তর হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়?
তবে মানবজাতির ইতিহাসে দু-হাজার বছর এমন কিছু বেশি সময় নয়। মানুষ তো একদা নরখাদক ছিল। এখন কি তার কোনো চিহ্ন আছে? রাক্ষস যাদের বলা হত আজ তারা কোথায়? মানুষের জ্ঞান ছিল না, বুদ্ধি ছিল না, বিবেক ছিল না, চেতনা ছিল না, প্রেম ছিল না, কলাবিদ্যা ছিল না, কৃষিবিদ্যা ছিল না। এসব তো হয়েছে। আরও কত কী হতে পারে।
মানুষ জাতিটা যদি ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত না হয়ে যায় তবে হিংসার অবসান একদিন-না-একদিন হবে। মানুষ মানুষকে মেরে গর্ববোধ করবে না। সেটা বীরত্ব বলে বন্দিত করবে না। মানুষের প্রাণরক্ষার জন্যে মানুষের প্রাণত্যাগই কীর্তিত হবে। তা ছাড়া অহিংসার মতো সত্যেরও মর্যাদা সমধিক। সত্যনিষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে মহাভারতকার সশরীরে স্বর্গে নিয়ে যান। মহাবীর ভীম ও অর্জুনকে নয়। সেই যুধিষ্ঠিরেরও একদিনের জন্যে নরকবাস হয়েছিল। কারণ তিনি একটি অর্ধসত্য উচ্চারণ করে দ্রোণের প্রাণহানি ঘটিয়েছিলেন।
বিনু স্বর্গে ও নরকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। ভগবান সম্বন্ধে সে নিঃসংশয়, কিন্তু স্বর্গ-নরক সম্বন্ধে অতটা নিশ্চিত নয়। আত্মা থাকলে পরমাত্মাও থাকে। বিন্দু থাকলে সিন্ধুও থাকে। অংশ থাকলে সমগ্রও থাকে। নামকরণটা ভগবান না হয়ে আর কিছু হতে পারে। নিজের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে বলেই বিনু ভগবানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। তবে তাঁর সংজ্ঞা নির্ণয় করতে পারে না। তিনি কি একজন ব্যক্তি না একটি শক্তি না একটা বিধান, যাঁর দ্বারা বিশ্বজগৎ পরিচালিত? উপনিষদে ব্রহ্মকে তৎ বলা হয়েছে। তৎ ক্লীবলিঙ্গ। মানুষ তাঁরই মতো একজনকে ভক্তি করতে চায়, ভালোবাসতে চায়, তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাতে চায়। কিন্তু সত্যিই কি তিনি একজন ব্যক্তি? একালের বৈজ্ঞানিকরা তা মানবেন না। তাঁরা বলবেন একটি শক্তি বা একটি বিধান। বিনু মনঃস্থির করতে অক্ষম।
সে প্রতিদিন প্রার্থনা করে, ‘অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।’ যিনি তাকে নিয়ে যাবেন তিনি কি একজন ব্যক্তি নন যিনি সর্বশক্তিমান, সর্ববিধাতা? বিনুর বিশ্বাস তিনি তার অন্তরেও বিদ্যমান, বাইরেও বিরাজমান। বিনুও তাঁর অন্তরে বর্তমান, কিন্তু সে তাঁর বাইরে নয়। তাঁর সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে, সেটা আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্পর্ক—অনাদি ও অনন্ত।
মৃত্যুর পরে অমৃত আছে এই পর্যন্ত সে নিশ্চিত। পরলোক, পরকাল ও পরজন্ম সম্বন্ধে সে নিশ্চয় করে কিছু বলতে পারে না। এসব থাকতেও পারে, না থাকতেও পারে। আপাতত ইহকাল ও ইহলোকই সারসত্য।
বিনুর এক অগ্রজপ্রতিম বন্ধু ছিলেন নিরীশ্বরবাদী গান্ধীপন্থী রবীন্দ্রভক্ত নেতা। তাঁর সহধর্মিণীও তাঁর সঙ্গে একমত। কথাপ্রসঙ্গে বন্ধুজায়া বিনুকে বলেন, ‘ঈশ্বর নেই। তা বলে কি ধর্ম নেই? ধর্ম তো আছে।’
ধর্ম মানে এক্ষেত্রে হিন্দু ধর্ম বা মুসলিম ধর্ম নয়। বিশ্বজগৎকে যা ধারণ করে আছে সেই শাশ্বত বিধান। তার এক প্রিয় বন্ধু তাকে একদিন বলেছিল, ‘হ্যাঁ রে, এই অত্যাচার কি চিরকাল চলবে? ধর্ম সইবে?’ সে ঈশ্বরের নাম করে না, যদিও সে ঈশ্বর মানে।
ভারতের সাধারণ মানুষ কথায় কথায় ঈশ্বরের নাম ধরে না। ধর্মের উপর ছেড়ে দেয় অন্যায়ের প্রতিকার। কোনটা ধর্ম আর কোনটা অধর্ম এ বিষয়ে তাদের একটা সহজাত প্রত্যয় আছে। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি নেই। এক ইসলাম প্রচারক মৌলানা সাহেব বিনুর সঙ্গে দেখা করতে এসে বলেন, ‘এটা ধর্মের দেশ।’ তার মানে হিন্দু কিংবা ইসলাম নামক ধর্মের দেশ নয়, ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে ধর্মপ্রাণতার দেশ। তিনি যেমন হিন্দুদের ধর্মপ্রাণতাকে শ্রদ্ধা করেন তেমনি হিন্দুদের অনেকে মুসলমানদের ধর্মপ্রাণতাকে শ্রদ্ধা করেন। বিনুদের বাড়ির বেড়ার ওপারে এক মুসলমান পরিবার বাস করতেন। বৃদ্ধ গৃহকর্তাকে বিনু বিশেষ শ্রদ্ধা করত। বিনুর বাবা তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি বসে তত্ত্বালোচনা করতেন। কেউ কাউকে ভজাবার চেষ্টা করতেন না। পরস্পরকে বোঝবার চেষ্টা করতেন।
ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের অমিল আছে এটা সত্য, কিন্তু পূর্ণসত্য নয়। মিল আছে অনেক বেশি। বিনু মসজিদে গিয়েও আনন্দ পায়। বাল্যকালে মহরমের উৎসবে যোগ দিয়ে সমান আনন্দ পেয়েছে।
একালে যেমন হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ সেকালে তেমনি বৈদিক ও বৌদ্ধের বিরোধ ছিল। সে-বিরোধ এখনও মেটেনি। একবার কালিম্পং শহরে এক বৌদ্ধ সভায় বিনুকে করা হয় সভাপতি। হঠাৎ এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সঙ্গে এক বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর বচসা বেঁধে যায়। হিন্দু স্বামীজি বুদ্ধ সম্বন্ধে অনেক কটূক্তি করেন। সভার সমাপ্তির পর স্বামীজি বিনুর কাছে এসে কৈফিয়ত দেন। তাঁর আপত্তির কারণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী পাহাড়িয়াদের বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করছেন। ফলে বৌদ্ধদের সংখ্যাই বেড়ে যাচ্ছে। নয়তো ওরা হিন্দুদের সংখ্যা বৃদ্ধি করত। বিনুর মনে হল ধর্মীয় বিরোধের একটা বড়ো কারণ ধর্মের সঙ্গে ধর্মের অমিল নয়, দীক্ষিতদের সংখ্যা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। হিন্দুরাও দীক্ষাদান করে। অসমের অহমরা গোড়ায় ছিল বৌদ্ধ। পরে হয় শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত। শাক্ত আর বৈষ্ণবের বিবাদ এখনও মেটেনি। বৈষ্ণবরা কামাখ্যা মন্দিরে যান না। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রবেশদ্বারে লেখা আছে খ্রিস্টান-মুসলমান ও বৌদ্ধদের প্রবেশ নিষেধ। যদিও বুদ্ধকে বলা হয় বিষ্ণুর নবম অবতার।
সর্বধর্ম সমন্বয়ের কোনো লক্ষণ নেই। আপাতত সর্বধর্মের সশ্রদ্ধ সহাবস্থানই যথেষ্ট প্রগতি। প্রত্যেক ধর্মকে অপরাপর ধর্মের ভিতর থেকে সার আহরণপূর্বক শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। গান্ধীজির প্রার্থনাসভা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সেখানে গীতা, কোরান, বাইবেল ও বৌদ্ধশাস্ত্র থেকে পাঠ করা হত।
বাউলরা কিন্তু ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মস্থানের ধার ধারে না। তারা প্রার্থনাও করে না, উপাসনাও করে না, পুজোও করে না। চন্ডীদাস বলে গেছেন সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। বাউলরা বলে এই মানুষে আছে সেই মানুষ। সেই মানুষ এই মানুষের মতো জরা ব্যাধি ও মরণের অধীন নয়। তবে তাঁকে মানুষ বলা কেন? কারণ মানুষই সকলের উপর। বৌদ্ধদের বিশ্বাস বুদ্ধ মানুষ হয়েও সব দেবতার উপরে। মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্ব বৈদিক হিন্দু ঐতিহ্য নয়, অথচ ভারতীয়।
আধুনিককালে বৈজ্ঞানিকরা অতিপ্রাকৃতকে বিশ্বাস করেন না। ভগবান তাঁদের মতে অতিপ্রাকৃত, অতএব বিশ্বাসের অযোগ্য। মানুষের উপরেই তাঁদের বিশ্বাস। এই মানুষ বিবর্তনসূত্রে আরও উন্নত হবে, জরা ব্যাধি জয় করবে, কিন্তু মরণকে নয়। সেইখানেই মানবিকবাদের সীমাবদ্ধতা।
একবার কয়েকজন সোভিয়েট বুদ্ধিজীবী কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে বিনুর দেখা হয়। তাঁদের একজন বলেন তাঁরা আধ্যাত্মিকতার অভাব অনুভব করছেন। তিনি যে শব্দটি ব্যবহার করেন সেটি রিলিজিয়ন নয় স্পিরিচুয়ালিটি। তার বিপরীত শব্দ মেটিরিয়ালিজম। জৈনরা নিরীশ্বরবাদী, তাহলেও তারা আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী। তারা মেটিরিয়ালিস্ট নয়, অথচ কমিউনিস্টরা নিরীশ্বরবাদী আর সেইসঙ্গে মেটিরিয়ালিস্ট। তারা একদিন-না-একদিন আধ্যাত্মিকতার অভাব বোধ করবেই। তার মানে কিন্তু রিলিজিয়নের বা ধর্মবিশ্বাসের অভাব নয়।
যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে সত্যের অন্বেষণে জীবন উৎসর্গ করেন তাঁরাও আধ্যাত্মিকতাসম্পন্ন। মহাত্মা গান্ধীর শিষ্য গোরা ভগবানে বিশ্বাস করতেন না, সত্যে বিশ্বাস করতেন। গান্ধীজি তাঁকে বলেন, ‘সত্যই ভগবান।’ তেমনি প্রেমই ভগবান। সৌন্দর্যই ভগবান। যাঁরা প্রেমের সাধনা বা সৌন্দর্যের সাধনা করেন তাঁরাও ভগবানেরই আরাধনা করেন। ভগবানে বিশ্বাস অনাবশ্যক।
বিনু যদি ইদানীং বিদেশে যেত তবে সেও কি দুঃখ করে বলত না যে তার নিজের দেশেও সত্যের অভাব, প্রেমের অভাব ও সৌন্দর্যের অভাব লক্ষিত হচ্ছে? একই কারণ মেটিরিয়ালিজমের প্রভাব। আজকাল সব দেশেই সবাই কম-বেশি মেটিরিয়ালিস্ট। ধর্মবিশ্বাস এই জলতরঙ্গ রোধ করতে পারছে না। তার পালটা প্রভাব আনুষ্ঠানিকতায় নিবদ্ধ হয়ে বীর্যহীন। ধর্মের সারবস্তু ছেড়ে তার খোলসটাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৌলবাদ। যেমন মুসলিম আরবে, ইরানে, পাকিস্তানে তেমনি হিন্দু ভারতে। অন্ধের দ্বারা নীয়মান অন্ধ জনতা গভীর কর্দমে পতিত হচ্ছে। তবে চিরকালের জন্য নয়।
মানুষের স্বয়ংসংশোধিকা শক্তিতে বিনুর বিশ্বাস অটল। একটা প্রজন্মের ভুল আর একটা প্রজন্ম সংশোধন করবে, একটা শতকের ভুল আর একটা শতক। তবে কতক মানুষকে সদা সজাগ থাকতে হবে। তারা অতন্দ্র প্রহরী।