বিধু দারোগা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
সেবার বিধু দারোগা আমাদের গঞ্জে বদলি হয়ে এল, হইহই পড়ে গেল। ব্রিটিশ আমলে দারোগা পুলিশকে ভারি ভয় খেত গাঁ-গঞ্জের লোকেরা। রাস্তায় ঘাটে বা হাটে-বাজারে পুলিশ দেখলেই নিরীহ সজ্জন মানুষরাও সাঁত সাঁত করে এধার-ওধার লুকিয়ে পড়ত। এক স্বদেশি আন্দোলনের নেতাগোছের লোক বটতলায় বক্তৃতা দিতে এলেন। শ-পাঁচেক লোক জড়ো হয়ে গরম বক্তৃতা শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। ঠিক সেই সময়ে একটা টিং-টিঙে রোগা লাল পাগড়িওলা পুলিশ হাট থেকে পালংশাক কিনে ফিরছিল। তাকে দেখে সেই পাঁচ-শো-জোয়ান-মদ্দ লোক দে-দৌড় দে-দৌড়। স্বদেশি নেতা গাছতলায় বসে বিড়ি ধরিয়ে আপনমনে হতাশভাবে বললেন—হোপলেস। আর একবার, গঞ্জের নদীর ঘাট থেকে লোকভর্তি একটা নৌকা ছাড়ছে বিকেল বেলায়, সেই সময়ে গঞ্জের দারোগা আর কয়েকজন পুলিশও ওপারে যাবে বলে এসে নৌকায় উঠল। সঙ্গেসঙ্গে বিনা কারণে বিস্তর লোক ঝুপ ঝুপ করে হাঁটুজলে নেমে পালাতে লাগল। এমনকী, তাদের মধ্যে গাঁয়ের পাঠশালার পন্ডিতমশাইও ছিলেন। পরে তাঁকে সবাই যখন জিজ্ঞেস করল, তিনি কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘কী জানি বাবা, সবাই পালাল দেখে আমিও জলে নেমে পালালাম। ভয় বড়ো সংক্রামক।’
এই তো ছিল দারোগা-পুলিশদের সে-আমলের দাপট। বিধু দারোগা ছিলেন সেই দাপুটেদের মধ্যেও আর এক-কাঠি দাপুটে। তাঁর দাপটে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খায় এ কেবল কথার কথা নয়। তিনি গঞ্জে এসেই ঢেঁড়া পিটিয়ে দিলেন যে, সামনের হাটবারে সবাই যেন স্বচক্ষে দেখে যায়, থানার উত্তর ধারের দিঘিতে বাঘে আর গোরুতে এক ঘাটে জল খাবে।
সেই হাটবারে দিঘির ধারে লোক ভেঙে পড়ল। বাঁধানো ঘাটে, বিশাল চেহারার বিধু দারোগা চেয়ারে বসে আছেন। তাঁকে কেউ হাসতে দেখেনি কখনো। ভীষণ রাগী চোখে চারদিকে চেয়ে দেখছেন। তাঁর চোখ যার ওপর পড়ছে, সে-ই জায়গা ছেড়ে একটু সরে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের ব্যায়ামবীর ছোটোকাকাও তিনবার জায়গা বদল করে অবশেষে কচুবনের ভিতরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কেউ জোরে কথা বলছে না, ফিসফাস গুজগুজ করছে। সবাই শুনে আসছে বটে বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খাওয়ার কথা, কিন্তু কেউ কখনো দেখেনি। হারু মন্ডলের বাঁকানো শিংওলা গোরুটা খুঁটোয় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বাঘ তখনও দেখা যাচ্ছে না। তাই নিয়ে সকলের কৌতূহল।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। পাশের গাঁয়ের প্রবর্তক সার্কাস গত অমাবস্যা থেকে খেলা দেখাচ্ছে। সেদিক থেকে একটা খাঁচাওলা গাড়ি বলদে টেনে আনল। খাঁচার মধ্যে গলায় দড়ি-বাঁধা বাঘ বসে ঝিমোচ্ছে। অনেকে ফিসফিস করে বলল, বাঘকে আফিং খাইয়ে রাখে কিনা, তাই ওই ঝিমুনি।
তা সে যাই হোক, গায়ে গেঞ্জি আর কালো ফুলপ্যান্ট পরা রোগা রিং মাস্টার লোকটা হাতে চাবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল খাঁচার দরজায়, দু-জন লোক খাঁচার দরজাটা ওপর থেকে টেনে তুলল। খাঁচার দরজা খোলা হতেই লোকজন দুড়দাড় দৌড়ে খানিক তফাতে গিয়ে দাঁড়াল। ঘাটে রইল শুধু রিং মাস্টার, হারু মন্ডল, বিধু দারোগা আর সার্কাসের দু-জন লোক। থানার সিপাইরাও সব তফাতে এসে দাঁড়ল। বাঘ বেরোবে, ইয়ার্কির কথা নয়।
তা বাঘটা আফিংখোরই হবে। রিং মাস্টার বিস্তর চাবুকের শব্দ করল, খোঁচালো, তবু বেরোয় না। বার তিনেক হাই তুলল অবিকল বুড়ো মানুষের মতো শব্দ করে। দারোগামশাই ধমক দিয়ে বললেন, ‘টেনে বের করো কুলাঙ্গারটাকে।’ রিং মাস্টার সেলাম দিয়ে বলল, ‘আপনাকে সামনে দেখে একটু ভয় খেয়েছে।’
অবশেষে দড়ি ধরে টানা-হ্যাঁচড়া করে তাকে বের করা হয়। কী আলিস্যি তার! বাইরে বেরিয়েও অবিকল বেড়ালের মতো ডন মারল একটা, তারপর ঘুমচোখে চারদিকে চাইতে লাগল। মনে হল, বাঘটা চোখে ভালো দেখতে পায় না, ভুরু কোঁচকানো, খুব ঠাহর করে করে দেখছে।
বিধু দারোগা হাঁক ছাড়লেন, ‘দুটোকে জলের কাছে নিয়ে যা।’
তখন হারু মন্ডল তার দুষ্টু গোরুটাকে আর রিং মাস্টার তার অলস বাঘটাকে দড়ি ধরে টানতে লাগল। অনেক টানা-হ্যাচড়ার পর দুটোকে জলের কাছে নিয়ে পাশাপাশি দাঁড় করানো হল বটে, কিন্তু কেউই জলে মুখ দেয় না। বাঘে গোরুতে একঘাটে জল খাওয়ার কথা। জলই যদি না খায় তো দারোগাবাবুর সম্মান থাকে কী করে! তখন হারু মন্ডল তার গোরুর গলকম্বলে হাত বুলিয়ে অনেক আদর করে বলতে লাগল, ‘খাও মা ভগবতী, জল খাও। এই একবারটি খাও মা, আর কখনো বলব না। ওই ছাগলের মতো বাঘটাকে দেখে ডরিয়ো না মা, ওর দাঁত নড়ে, চোখে ছানি, বড়ো ভীতু জীব।’
ওদিকে রিং মাস্টারও সপাসপ চাবুকের শব্দ করে বাঘটার ল্যাজ মলে দিয়ে বলে, ‘ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেঙ্গল-টাইগার, ড্রিঙ্ক, কাম, কাম, হ্যাভ কারেজ, দি কাউ উইল ফ্লাই অ্যাণ্ড শো হার লেজ। ড্রিঙ্ক, ড্রিঙ্ক—’
দারোগাবাবু উঠে ফের হাঁক দিলেন, ‘দুটোর দড়ি খুলে দে। আপসে জল খাবে।’
তো তাই হল। হারু মন্ডল তার গোরুটাকে ছেড়ে দিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ‘কাল থেকে তোকে জল দিইনি মা, দারোগাবাবুর মুখ চেয়ে এতক্ষণ তেষ্টায় কাঠ করে রেখেছি, এবার চোঁ চোঁ করে পেট ভাসিয়ে খা মা।’
রিং মাস্টারও তার বাঘকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘ইউ হ্যাভ নো ওয়াটার টু-ডেজ বেঙ্গল, নাউ ড্রিঙ্ক।’
দৃশ্যটা দেখার মতোই। এই আমরা প্রথম দেখলাম জীবনে। একটা গোরু আর একটা বাঘ পাশাপাশি ভাই-বোনের মতো দাঁড়িয়ে মুখ নীচু করে একঘাটে জল খাচ্ছে। সবাই রইরই করে উঠে দারোগাবাবুর জয়ধ্বনি দিতে থাকল। কবিয়াল দু-কড়ি হালদার গান বেঁধে গাইতে লাগল, ‘ধন্য হে দারোগা বিধু, তুমি ধন্য, ধন্য হে। একই ঘাটে জল খায় গাই আর ব্যাঘ্র বন্য হে—’
কিন্তু জয়ধ্বনির রেশ তখনও মিলিয়ে যায়নি, দু-কড়ি কবিয়াল ‘হে’র টান দিয়ে তখন দম ধরে রেখেছে, এমন সময়ে বাঘটা জল থেকে মুখ তুলে গোরুটার দিকে তাকাল। গোরুটাও তাকাল বাঘটার দিকে। ফোঁস ফোঁস করে দু-জনের নিশ্বাস পড়ল। বাঘটা গোরু চেনে, সে গন্ধ পেয়ে পাশে দাঁড়ানো গোরুটাকে শুঁকছে। চোখে ভালো দেখতে পায় না বলে বোধ হয় ঠিক ঠাহর করতে পারছিল না। কিন্তু হারু মন্ডলের গোরু কখনো বাঘ দেখেনি, তাই সে একটুও ঘাবড়াল না। বরং সে বেশ রাগের চোখে বাঘটাকে দেখতে লাগল। সেটা হাড়-হারামজাদা গোরু, বহুবার খোঁটা উপড়েছে, খোঁয়াড়ে গেছে, তার গুঁতো খায়নি এমন মানুষ গাঁয়ে বিরল। বাঘটার ভাবসাব দেখে সে বোধ হয় বেশ বিরক্ত হয়েছিল, তাই বাঘের মুখের ওপরেই সে ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে একটু এগোল।
দারোগাবাবু মহানন্দে গোঁফ চুমড়ে দৃশ্যটা দেখছেন তখন। হাসেন না বটে, কিন্তু হাসি তাঁর চোখের দৃষ্টি, গালের মাংস, আর ভাবভঙ্গির মধ্যে ফুটে উঠছিল। বাঘে-গোরুতে একঘাটে জল খাচ্ছে।
গোরুর ফোঁস শুনে বাঘটা দু-পা পিছিয়ে এল। বহুকাল অভ্যাস নেই বলেই বোধ হয় হাঙ্গামায় যেতে চাইল না। কিন্তু গোরুটা বদমেজাজি। তার তখন রোখ চেপেছে। সে একটু শিং নাড়া দিয়ে দু-পা এগোল। বাঘটা আবার পিছিয়ে আসে। গোরুটা একটা ‘হাম্বা’ দিয়ে হঠাৎ আড়মোড়া ভেঙে মাথাটা নীচু করে হড়হড় করে এসে হুম করে একটা ঢুঁ দিল বাঘটাকে। বাঘটা মারপিট ভুলেই গেছে। আচমকা ঢুঁ-টা খেয়ে ভ্যাবাচাকা মেরে আলিস্যি ঝেড়ে দুই লাফে উঠে এল ঘাটের চাতালে। পিছনে গোরুটা।
দারোগাবাবু চেয়ার ছেড়ে পৈঠায় উঠে গেলেন সাঁত করে। লোকে থ’। এমনটা হবে কেউ ভাবেনি। এ কী দৃশ্য রে বাবা! প্রকৃতির সব নিয়মকানুন যে ভন্ডুল হয়ে গেল! বাঘটা তখন দিঘির ধারের মাঠটায় প্রাণভয়ে ছুটছে। হারুর গোরু মহাতেজে শিং নেড়ে দৌড়োচ্ছে তার পিছু পিছু, গুঁতোবেই। বাঘটা হালুম-মলুম বলে ডাক ছাড়ছে প্রাণপণে। গোরুটা হাম্বা-খাম্বা বলে তম্বি করছে তাকে। সে কী দৌড়! যেমনি বাঘ ছোটে, তেমনি গোরু। ছুটতে ছুটতে বাঘের দমসম অবস্থা। ভারি কাহিল হয়ে পড়েছে বেচারা। হারু মন্ডল বিস্তর ডাকাকাকি আর সাধাসাধি করে তার গোরুকে ফেরাতে চাইছে, গোরু ফিরছে না। রিং মাস্টার ডুকরে উঠে বলছে, ‘ও ভাই হারু, আমার গরিব বাঘটাকে তোমার গুন্ডা গোরু মেরে ফেলল!’
তা ফেলতই মেরে। বাঘটা ছুটে ছুটে হয়রান হয়ে পড়েছে তখন, গোরুটা মহাতেজে প্রায় ধরো ধরো করে ফেলেছে তাকে, এমন সময়ে হারু মন্ডল গিয়ে সটান শুয়ে পড়ল তার ভগবতীর সামনে, বলল, ‘মা গো, অনেক লীলা দেখিয়েছ মা। অনেক বাঘ-সিংহী ধরে দেব মা তোমায়, সব কটাকে গুঁতিয়ে টি টি কোরো। আজ যে তোমার জাবনার সময় হয়ে গেছে মা।’
এইসব শুনে ভগবতী দাঁড়িয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল। বাঘও ফাঁক বুঝে এক লাফে খাঁচায় ঢুকে ঝাঁপের দরজাটা ফেলবার জন্য নিজেই পিছনের দু-পায়ে দাঁড়িয়ে টানাটানি করতে লাগল। খাঁচার ওপরের লোক দু-জন ঘাপটি মেরেছিল, তাল বুঝে ঝপ করে দরজা ফেলে দিল। বাঘটা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে হ্যা-ল্যা করে হাঁপাতে লাগল।
এই ঘটনার পর বিধু দারোগার নামযশ সহস্র গুণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল গঞ্জে। তাঁর রাজত্বে শুধু বাঘে-গোরুতে একঘাটে জলই খায় না, সেখানে গোরুর তাড়ায় বাঘেরও জান লবেজান হওয়ার জোগাড়। সুতরাং সাবধান!
সবাই তাই সাবধান হয়ে গেল। চুরি-ছ্যাঁচড়ামি বন্ধ, ডাকাতি বাড়ন্ত, ঝগড়াঝাঁটি পর্যন্ত দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। প্রবীণ লোকেরা থানার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে জুতো ছেড়ে রেখে থানার উদ্দেশে হাতজোড় করে ভক্তিভরে প্রণাম করে যায়। যেমন সবাই মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে করে। বিধু দারোগা ব্যাপার দেখেন আর হাসেন। না, হাসেন না ঠিক, কিন্তু হাসি তাঁর গোঁফের ডগায় ঝুলে থাকে, নাকের ডগায় কাঁপে, ভুরুতে নাচে। সবাই বুঝতে পারে, বিধু দারোগা হাসছেন। অথচ হাসছেন না। ময়রারা দারোগা-সন্দেশ, বিধু-অমৃতি বের করে ফেলল। খুব বিক্রি।
ওদিকে ভগবতীর খুব নামডাক। গঞ্জের লোক তো আছেই, আশেপাশের গাঁ-গঞ্জ, বহুদূরের ভিন গাঁ, এমনকী শহর থেকে পর্যন্ত লোক ঝেঁটিয়ে আসছে রোজ। সকলেই ভগবতীর জন্য রাশি রাশি খাবার আনছে। শাক-পাতা, লাউ-কুমড়োটা তো আছেই, সেই সঙ্গে সন্দেশ-রসগোল্লা, দুধ-দই, এমনকী ঘি-মাখন পর্যন্ত। হারু মন্ডলের গোয়ালঘরে পাহাড়-প্রমাণ খাবার জমে গেল। অলৌকিক গোরুর মহিমা শুনে জমিদারমশাই বিলিতি নেট দিয়ে ভগবতীর জন্য ভালো মশারি করে দিলেন, সেই সঙ্গে সাটিনের বালিশ, তাকিয়া পর্যন্ত। ভগবতী সারাদিন ঘরে খায়, রাতে মশারির তলায় তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসে জাবর কাটে আর ঘুমোয়। তার তাগড়াই চেহারা হয়েছে। মোটা হয়ে গরমে হাঁসফাঁস করলে ভক্তরা তাকে হাতপাখার বাতাস করে ঠাণ্ডা রাখে। সাহাগঞ্জে ‘ভগবতী বিদ্যালয়’ নামে ইস্কুল খোলা হল। ‘ভগবতী তৈল’ নামে একটা বাতের মালিশ বেরিয়ে গেল।
তখন কিছুদিনের জন্য ভগবতী গোরু আর বিধু দারোগার কথা ছাড়া লোকের মুখে অন্য কথা নেই। বিক্রি মন্দা বলে সার্কাসওলা তাঁবু গুটিয়ে পালিয়েছে। কাছেপিঠে আর বাঘ-ভালুকও নেই যে ভগবতী গিয়ে গুঁতোবে। খেতে খেতে চোয়াল ব্যথা।
বিধু দারোগার দশাও তাই। চোর নেই, ডাকাত নেই। শুয়ে বসে গতরে জং ধরে গেল। লোকে রোজ পাঁঠা, মুর্গি, ডিম, তরি-তরকারি, মাছ দিয়ে যায়। খেতে খেতে খিদে মরে গেছে। বহুকাল আর খিদে পায় না বিধু দারোগার। খাবার দেখলে হাই ওঠে। দারোগার ঘোড়াটার পর্যন্ত পায়ে চর্বি জমেছে। নিয়মমাফিক রোজ একবার বিধু দারোগা ঘোড়ার পিঠে চড়ে গঞ্জে চক্কর মারেন। না:, কোথাও কোনো হাঙ্গামা হয়নি। বিরক্ত হয়ে ফিরে এসে থানার দাওয়ায় বসে গম্ভীরভাবে হুঁকো টানেন তিনি।
একদিন সকালে একটা লোক আধমন ওজনের একটা পাকা রুইমাছ নিয়ে এসে দারোগা সাহেবকে প্রণাম করে হাতজোড় করে সামনে বসল। বিধু দারোগা প্রকান্ড মাছটা দেখে অরুচিতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। লোকটা ভাবল, দারোগা সাহেবের বুঝি এত ছোটো মাছ পছন্দ হয়নি, তাই ভয় খেয়ে মিনমিন করে বলল, ‘বড়োবাবু, আমার পুকুরে এর চেয়ে বড়ো মাছ আর নেই। আমি ক্ষুদ্র মানুষ, মাছটাও পুঁটিমাছের মতো ছোটো, তবু যদি আপনার ভোগে লাগে তো—’
বিধু দারোগা ফস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘খিদে পায় না যে বাপ, আমার যে আর খিদে পায় না। বড্ড অরুচি।’
লোকটা ফের একটা প্রণাম করে বলে, ‘বড়োবাবু, অপরাধ নেবেন না, তা যদি বলেন তো বলি, ঠাকুর-দেবতারাও কোন জন্মে অমৃত খেয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন, খিদে তো তাঁদেরও পাওয়ার কথা নয়। তবু কী লোকে ভোগ-নৈবিদ্যি দিতে ছাড়ে! ভক্তদের মুখ চেয়েই তাঁরা অরুচি নিয়েও খান। আমি তো বুড়ো হতে চললাম, তবু জন্মেও শুনিনি যে রাজা-জমিদার কিংবা লাট বা দারোগার কখনো খিদে পেয়েছে। খিদে তাঁদের কখনো পায় না, দেবতুল্য লোক সব। তবু খেতে হয় আমাদের মুখ চেয়েই। আমাদের মতো ছোটোলোক হাঘরেদেরই যত খিদে হুজুর।’
লোকটা লাট আর দারোগা একসঙ্গে বলায় দারোগাসাহেব খুশি হলেন। একটু হাসলেন। না, ঠিক হাসি নয় বটে, তবে টাকটা যেন একটু চকচক করে উঠল, গালের মাংসে একটু ঢেউ দিল, ভুঁড়িটা কয়েকবার কেঁপে ওঠল। আবার একটা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘খিদেই-বা পাবে কী করে। নড়াচড়া নেই, কাজকর্ম নেই, একেবারে পাথর হয়ে গেলাম। ছ্যা ছ্যা, তোরাই সব কেমনধারা মানুষ, দারোগাবাবুর খিদে পায় না শুনছিস, সেজন্যও তো একটু শখ করে চুরিচামারি করতে পারিস? চোর-ছ্যাঁচড়ের পিছনে হাঁকডাক দৌড়োদৌড়ি করতে করতে আমারও একটু খিদের মতো হয় তাহলে। কেমন নির্দয় মানুষ তোরা, অ্যাঁ?’
শুনে লোকটা কান পর্যন্ত হাসল। ফের একটা প্রণাম ঠুকে বলল, ‘আজ্ঞে বড়োবাবু, সেই জন্যই আসা। সফরগঞ্জে শ্মশানের ধারে কসারবনের মধ্যে বুড়ো বটের তলায় এক কাপালিক এসে থানা গেড়েছে কদিন হল। বড়ো সাংঘাতিক লোক। বাঘের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। শুনছি, আজ অমাবস্যার রাতে সেখানে নরবলি হবে। ভয়ে ভয়ে আছি আমরা।’
শুনে বিধু দারোগা একটা হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘বটে!’
সেই হুঙ্কারে গঞ্জের বাড়িঘর কেঁপে উঠল, ঘোড়াটা চিঁ-হিঁ ডেকে লাফিয়ে উঠল, ধারেকাছের লোকজন সব সাঁত সাঁত করে লুকিয়ে পড়তে লাগল। বাচ্চারা ককিয়ে উঠল, বেড়াল পালালো, কুকুর কেঁদে উঠল, আর কাকগুলো বন্দুকের আওয়াজ ভেবে কা কা করে ভিড় করতে লাগল আশেপাশে। যে লোকটা মাছ নিয়ে এসেছিল তারও একটু মূর্ছামতো হয়েছিল। খানিকক্ষণ পরে সামলে ওঠে সে চোখ মেলে বড়ো সুখে হাসল। হ্যাঁ, এই হল গিয়ে আসল দারোগা। আবার একটা প্রণাম করল সে।
অমাবস্যার নিশুতি রাতে দারোগাবাবু ঘোড়ায় চেপে সফরগঞ্জের শ্মশানে চললেন। সঙ্গে বিস্তর সিপাই, অনেক লোকজন। তাদের হুঙ্কারে শেয়াল পালাল, পাখিরা ঘুম ভেঙে চেঁচামেচি করতে লাগল। খটাশ, ভাম, বেজি, খরগোশ সব জঙ্গলের ছোটো ছোটো গর্তে সেঁধিয়ে কাঁপতে লাগল। বিধু দারোগা বুড়ো বটগাছের তলায় এসে হাঁক ছাড়লেন, কোথায় কাপালিক?
কাপালিক নেই। দারোগাবাবু পাঁচ ব্যাটারির টর্চ জ্বেলে দেখলেন, খবরটা মিথ্যে নয়। নিভু-নিভু হয়ে একটা ধুনি তখনও জ্বলছে। আশেপাশে বাঘের পায়ের ছাপও দেখা গেল, একটা চকচকে খাঁড়া পড়ে আছে একপাশে, একটা হাড়িকাঠও রয়েছে। দারোগাবাবু পিস্তল বের করে ফের হাঁক দিলেন, কোথায় গেল সেই হারামজাদা কাপালিকটা?
তাই তো! কোথায় পালাল! সবাই ভাবছে।
এমন সময়ে গাছের মগডাল থেকে করুণ স্বরে কে যেন বলে উঠল, ‘হুজুর, আমি এইখানে। ভয়ের চোটে বড্ড উঁচু গাছে উঠে পড়েছি, এখন নামতে পারছি না। বাতিটা একটু ধরুন।’
অবাক হয়ে দারোগাবাবু উঁচুতে আলো ফেললেন। বটগাছের ঝুরি আর পাতার ফাঁক দিয়ে অনেক উঁচুতে কাপালিকের লাল কাপড় ও দাড়িগোঁফ দেখা গেল। দারোগাবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘নেমে আয়।’
শিড়িঙ্গে চেহারার কাপালিকটা সাবধানে নেমে এল। টর্চের আলো মুখে পড়তেই চোখ পিটপিট করে ভারি ভীতু চোখে চাইল, তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল দারোগাবাবুর ঘোড়ার পায়ের ওপর, বলতে লাগল, ‘বড়োবাবু’ মাপ করুন।’ লোকটার চেহারা আর ভাবভঙ্গি দেখে বিধু দারোগা হতাশ হয়ে বললেন, ‘তোর বাঘ কই?’
‘আজ্ঞে আপনাকে দেখে ভয় খেয়ে ওইদিকের একটা আমগাছে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে বসে আছে। বড্ড ভীতু।’
দারোগাবাবু করাল চোখে চেয়ে বললেন, ‘আর নরবলি যাকে দিবি সে লোকটা কোথায়?’
কাপালিক কেঁদে উঠে বলল, ‘কোথায় নরবলি হুজুর! কত লোককে সাধ্যসাধনা করলাম, পায়ে ধরলাম, ভয় দেখালাম, কেউ রাজি হল না। তাদেরও দোষ দিই না, বলি হতে কেই-বা সহজে রাজি হয়! হুজুর, বলির কথা না রটালে লোকে সমীহ করে না। তাই রটিয়েছিলাম। কিন্তু আমি আসলে কাপালিক-টাপালিক নই হুজুর! আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি সেই রিং মাস্টার।’
রিং মাস্টার! সবাই হাঁ হয়ে গেল। তাই তো! দাড়িগোঁফের জঙ্গল ভেদ করে রিং মাস্টারকে তো চেনা যাচ্ছে একটু-একটু। রিং মাস্টার কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘হারু মন্ডলের গুণ্ডা গোরুর তাড়া খেয়ে আমার বাঘটা সেই যে পালিয়েছিল, তাইতে আমার আর বাঘের খুব বদনাম হয়ে যায়। তাই সার্কাস থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেয়। সেই থেকে খিদের জ্বালায় দু-জনে জ্বলে-পুড়ে মরছি। নরবলি-টলি ওসব বাজে কথা, আমরা দু-জনেই ভারি ভীতু জীব বড়োবাবু।’
দারোগাবাবু হাসলেন। না, ঠিক হাসি নয়। তবে তাঁর ভুরু চমকাল। কানটা যেন নড়ে ওঠল, গোঁফের ডগা নীচু থেকে ওপরে উঠে গেল, হাসলেন না, তবু যেন হাসলেন। টর্চের আলোয় সবাই দেখল।
রিং মাস্টার আর তার বাঘকে গ্রেফতার করে আনা হল থানায়। লোক ভেঙে পড়ল দেখতে। রিং মাস্টারের দাড়ি-চুল সব কামিয়ে দেওয়া হয়েছে। থানার হাতায় কদম গাছের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা বাঘটা লজ্জায় থাবায় মুখ লুকিয়ে মাথা নীচু করে বসে আছে।
হারু মন্ডল দারোগাবাবুকে প্রণাম ঠুকে বলল, ‘হুজুর, আমার একটা আর্জি আছে আপনার বরাবর। আমার ভগবতী কিছু খেতে চায় না। খেলার সঙ্গী নেই বলে দৌড়ঝাঁপ করতে পারে না, তাই খিদে হয় না। গাঁ-গঞ্জে ষাঁড়-গোরু সবাই ওকে ভয় খায়, তাই কেউ মেশে না ওর সঙ্গে। তাই বলি হুজুর, বাঘটা আমায় দিয়ে দিন। ভগবতী ওকে ঢুঁ মেরে মেরে খেলবে। তাতে ওর খিদে হবে। আমি বরং বাঘের দাম বাবদ এক-শো টাকা ধরে দিচ্ছি।’
তো তাই হল। হারু মন্ডল দড়ি বেঁধে বাঘটাকে টানা-হ্যাঁচড়া করে নিয়ে গেল। পথে লোকজনকে ডেকে ডেকে বলল, ‘সস্তায় বাঘ কিনলাম হে।’
কিন্তু ভগবতী মোটা হয়ে যাওয়ার পর থেকে খুব অলস হয়ে পড়েছিল। বাঘটাকে দেখেও তেড়ে-টেড়ে গেল না, কেবল একটা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। সেই শ্বাসের শব্দে বাঘটা পালাতে যাচ্ছিল, হারু মন্ডল তাকে খড়মপেটা করে টেনে আনল ফের। ভগবতীর গোয়ালেই বেঁধে রাখল তাকে। সেই থেকে বাঘটা গোয়ালেই থাকে। মাছের কাঁটা বা মাংসের হাড়মাখা ভাত খায়। মাঝে মাঝে ভগবতীর জাবনার গামলাতেও মুখ দিয়ে বিস্বাদে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তবু চেষ্টা রাখে। ভগবতী স্নেহভরে মাঝে মাঝে বাঘটার গা চেটে দেয়। বাঘটা থাবা দিয়ে ভগবতীর পিঠ চুলকোয়।
দেশসুদ্ধ লোক ভেঙে পড়ে দেখতে। হুঁ বাবা, বাঘে-গোরুতে এক গোয়ালে থাকে। দু-কড়ি কবিয়াল গেয়ে গেয়ে ঘুরে বেড়ায়, ‘বিধুর নামে দাও রে জয়ধ্বনি। বিধু মোদের নয়নের মণি।। ভগবতীর নামে দাও গো জয়জয়কার। তার গোয়ালে বাঘের কারাগার।। জয় জয় বিধু ভাগ্যবান। রাতের বেলায় দিনের আলো, দিনে জ্যোৎস্নার বান…’
শুনে বিধু দারোগা হাসেন। না, হাসি নয় ঠিক। তাঁর গোঁফের ডগায় যেন হাসি দোল খায়, চোখের মণির ভিতরে যেন ঝিকমিক করে, ভুঁড়িটা কেঁপে ওঠে, নাকের ডগা নড়ে, কান দুটো ফড়িঙের পাখনার মতো থিরথির করে ওঠে। হাসেন না। তবু যেন হাসেন।