বিধুবাবুর গাড়ি

বিধুবাবুর গাড়ি

বিধুবাবুর একখানা পুরোনো মডেলের অস্টিন গাড়ি আছে। স্পেয়ার পার্টস পাওয়া কঠিন। প্রায়ই অচল হয়ে পড়ে। বুড়ো মিস্ত্রি ইরফান সারিয়ে—টারিয়ে দেয় বটে, কিন্তু প্রায়ই বলে, এ গাড়ি আর বেশি দিন নয়। গাড়িটা তাঁর বাবার। বড্ড মায়া। গাড়িটা বেচে দিলে হয়তো কয়েক হাজার টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু ওই মায়ার জন্যই পারেন না। পথে—ঘাটে গাড়িটা নিয়ে মাঝে মাঝে খুবই বিপদে পড়তে হয়। বাড়িতেও অশান্তি হচ্ছে খুব।

সেইরকমই একটা বিপদে পড়লেন আজ। মফস্সল থেকে কলকাতা ফিরছেন। রাত ন—টা বেজে গেছে। জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ তোড়ে বৃষ্টি এল। এমন বৃষ্টি যে দু—হাত দূরের কিছু দেখা যায় না। ওয়াইপারটা কিছুক্ষণ চলে বন্ধ হয়ে গেল। ইঞ্জিনে জল ঢুকে সেটাও গেল থেমে। বাড়ি এখনও ঘণ্টা খানেকের পথ। গাড়ির মধ্যে বসে বিধুবাবু দুশ্চিন্তায় এতটুকু হয়ে গেলেন। এ যা বৃষ্টি সহজে থামবে না। মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে চারদিকে জল দাঁড়িয়ে যেতে লাগলে।

অসহায় বিধুবাবু চুপ করে বসে রইলেন। গাড়িটারই দোষ সন্দেহ নেই। কিন্তু বিধুবাবু গাড়ির ওপর রাগ করলেন না। গাড়িটার বয়স হয়েছে, যন্ত্রপাতিরও অমিল, কী আর করা যাবে? তিনি স্টিয়ারিঙে নরম করে হাত বুলিয়ে বললেন, তুমি আমার অনেক দিনের বন্ধু, তোমাকে কি ছাড়তে পারি?

কথাটা বলার কারণ আছে। তাঁর বন্ধুবান্ধব শুভানুধ্যায়ীরা অনেকদিন ধরেই গাড়িটা বেচে দেওয়ার কথা বলছে। ইদানীং বিধুবাবুর স্ত্রীও খুব ধরেছেন গাড়িটা বেচে দেওয়ার জন্য। একজন বড়োলোক নাকি এটিকে ভিন্টেজ কার হিসেবে কিনতে চান। বেশ ভালো দাম দেবেন। এই নিয়ে বিধুবাবুর সঙ্গে তাঁর গিন্নির রোজই ঝগড়া হচ্ছে। বিধুবাবুর স্ত্রী গাড়িটা বিদায় করার জন্য এতই অস্থির হয়ে পড়েছেন যে, হবু খদ্দেরের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা অবধি নিয়ে ফেলেছেন। বিধুবাবুর আরও দু—খানা নতুন ঝকঝকে গাড়ি আছে। সুতরাং পুরোনো গাড়িটার যে আর দরকার নেই, এটাই বাড়ির লোকের অভিমত।

বিধুবাবু অচল গাড়ির মধ্যে বসে ভাবছেন, গাড়িটাকে কী করে হস্তান্তর থেকে বাঁচানো যায়। কোনো উপায় তাঁর মাথায় আসছে না। এই যে গাড়িটা খারাপ হল, এর ফলে আজ রাতে তিনি হয়তো বাড়িতে ফিরতে পারবেন না। তার ফলে পুরোনো গাড়ির বিরুদ্ধে বাড়ির লোকের অভিমত আরও জোরদার হবে। বিধুবাবু অন্ধকার গাড়ির মধ্যে বসে বিষণ্ণ মনে গাড়িটার ভবিতব্য নিয়েই ভাবতে লাগলেন।

হঠাৎ তাঁর মনে হল, অন্ধকারে একটা আলো জ্বলে উঠেই নিবে গেল। না, বিদ্যুতের আলো নয়। অনেকটা টর্চের আলোর মতো, তবে অনেক বেশি জোরালো। মনে হল আলোটা এল ওপর থেকে। বিধুবাবু একটু ভাবিত হলেন। নির্জন রাস্তা, জঙ্গল, বিপদ হতে কতক্ষণ?

এরপর বিধুবাবু টের পেলেন, তাঁর গাড়িটা একটা বেশ বড়ো রকমের ঝাঁকুনি খেল। ঠিক যেন, গাড়ির ছাদে একটা ভারী জিনিস এসে পড়ল। গাড়ির কাচ তোলা, বিধুবাবু কাচটা একটু নামিয়ে গলা তুলে বললেন, কে রে? কে গাড়ির ছাদে?

কেউ জবাব দিল না। কিন্তু একটু বাদেই গাড়ির ছাদ থেকে একটা কে যেন লাফ দিয়ে নেমে এল। বিধুবাবু গাড়ির গ্লাভস কম্পার্টমেন্ট থেকে টর্চ বের করে জ্বাললেন। তারপর স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

যা দেখলেন তার চেয়ে বিস্ময়কর বস্তু আর কিছু হতে পারে না। এই প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে একটা ডল পুতুল রাস্তায় দাঁড় করানো রয়েছে। প্রায় দুই ফুট উঁচু ফুটফুটে একটা মেয়ে—পুতুল। কিন্তু যেটা অবাক কাণ্ড সেটা হল, পুতুলটা তাঁর দিকে চেয়ে একটা হাত তুলে নাড়ছে। তাঁকে যেন কিছু বলতে চায়। তা বিদেশে কলের পুতুল অনেকদিন আগেই বেরিয়ে গেছে। এটা সেরকমই একটা রিমোট কন্ট্রোল পুতুল কী? হলেই বা এই জঙ্গলে, বৃষ্টির মধ্যে এটা এল কোথা থেকে?

বিধুবাবু একটু ভয় খেলেন। ঘটনার পিছনে কোনো ষড়যন্ত্র নেই তো! থাকলেও তাঁর উপায় নেই। তিনি জানালার কাচটা নামালেন।

পুতুলটা তুমুল বৃষ্টির শব্দের মধ্যেই বলল, তুমি চিন্তা করো না। চুপচাপ বসে থাকো।

বিধুবাবু একটু কাঁপা গলায় বললেন, তুমি কি পুতুল?

হ্যাঁ, আমি কলের পুতুল।

আমার কথা বুঝতে পারছো কেমন করে? পুতুল কি কথা বুঝতে পারে?

আমরা অন্য জগতের পুতুল।

তার মানে?

আমরা যন্ত্রগ্রহের পুতুল।

বুঝলাম না। বুঝিয়ে বলো।

পুতুলটা গুটগুট করে এগিয়ে এল। তারপর একটা লাফ দিয়ে জানালার ওপর উঠে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে বলল, সব কথা কি তুমি বুঝবে?

বিধুবাবু সিঁটিয়ে গিয়ে বললেন, আমি বুঝবার চেষ্টা করব।

একান্ন আলো—বছর দূরে একটা গ্রহ আছে। সেখানে ঠিক আমাদের মতো দেখতে মানুষেরা বাস করে। তারাই আমাদের তৈরি করেছে। আমরা কলের পুতুল কিন্তু তারা সব মানুষ। মানুষগুলো একটু কুঁড়ে। আমাদের দিয়ে সব কাজ করায় আর নিজেরা কেবল বিশ্রাম করে, আর ফুর্তি করে।

বিধুবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, এখানে এলে কী করে?

বাঃ, আমাদের বুঝি গাড়ি নেই? আমরা তো প্রায়ই তোমাদের গ্রহে আসি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ গো। আমাদের গ্রহের মানুষেরা খুব শৌখিন। সেখানকার শাকপাতা খেয়ে তারা খুশি নয়, নতুন নতুন জিনিস চায়। তাই আমরা ঘুরে ঘুরে তাদের জন্য শাকপাতা, ভালো মাছ, মাখন, মুরগি, ঘি, দুধ, মিষ্টি, চকোলেট নিয়ে যাই। শুধু তোমাদের গ্রহ নয়, অন্য সব গ্রহ থেকেও অনেক জিনিস আনি। কিন্তু সেগুলো কী জিনিস তা তুমি বুঝবে না।

বিধুবাবু কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে বললেন, এখানে এই বৃষ্টির মধ্যে এলে কী করে?

ওই তো কাণ্ড। আমাদের গাড়িটা ওই জঙ্গলের মধ্যে খারাপ হয়ে গেল যে। তখনই আমরা তোমাকে দেখলাম। আমরা কলকবজা খুব ভালো জানি। গাড়িটা আমরা সারিয়ে ফেলেছি। এবার চলে যাব। তোমাকে দেখে একটু মায়া হল। ভাবলাম তোমার গাড়িটাও সারিয়ে দিয়ে যাই। আহা, কত পুরোনো আমলের গাড়ি!

তুমি বাংলা বলছো যে!

ওমা! বলব না? প্রায়ই আসি যে। শুনতে শুনতে শিখে গেছি। আমরা যে অন্য গ্রহের পুতুল তা তো কেউ বুঝতে পারে না। ধরা পড়ার ভাব দেখলেই আমরা অদৃশ্য হয়ে যেতে পারি।

বিধুবাবু একটা ঢোঁক গিলে বললেন, আমার গাড়ির ছাদে কী একটা রয়েছে বলো তো!

পুতুলটা হেসে বলল, আমাদের গাড়িটা। আমার বন্ধুরা তোমার গাড়িটা একটু দেখে নিচ্ছে। এখনই কাজ শুরু করবে।

বলতে বলতেই ঝুপ ঝুপ করে দশ—বারোটা ছেলে এবং মেয়ে পুতুল ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। হাতে নানারকম যন্ত্রপাতি, তারা বনেট খুলে খেলে গাড়ির ইঞ্জিনের ভেতর ঢুকে পড়ল।

বিধুবাবু দুঃখের সঙ্গে বললেন, এ গাড়িটাকে আমি বড়ো ভালোবাসি। কিন্তু তুমি তো জানো না, এ গাড়ি বেশিদিন রাখতে পারব না। সবাই বলছে বেচে দিতে।

পুতুলটা হাসল, তুমি যে গাড়িটাকে ভালোবাসো তা আমরা জানি। তোমার মনের ভাব আমাদের সূক্ষ্ম যন্ত্রে ধরা পড়েছিল। যারা যন্ত্রকে ভালোবাসে তাদের আমরাও ভালোবাসি। যন্ত্র নিষ্প্রাণ বটে, কিন্তু ভালোবাসা সেও ঠিক টের পায়, ভালোবাসার শক্তিই আলাদা কী বলো!

বিধুবাবু দুঃখের সঙ্গে বললেন, তা তো বুঝলাম। কিন্তু ভালোবাসা দিয়েও কি গাড়িটাকে বাঁচাতে পারব? তোমরা না হয় আজ সারিয়ে দিলে, দু—দিন পর আবার খারাপ হবে।

পুতুলটা মাথা নেড়ে বলল, আর খারাপ হবে না।

কোনোদিন না?

পুতুলটা হেসে বলল, খারাপ তো হবেই না, এমনকী এখন থেকে আর গাড়িতে পেট্রল নিতে হবে না, ব্যাটারি বদল করতে হবে না, চাকায় হাওয়া দিতে হবে না। লক্ষ লক্ষ মাইল চললেও না।

সত্যি?

সত্যিই। তোমার পুরোনো গাড়িতে আমরা আমাদের সব যন্ত্রপাতি লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। গাড়িটা হাতছাড়া করো না কিন্তু।

হাতছাড়া করব না? কিন্তু আমি যখন থাকব না, তখন?

পুতুলটা হাসল, সেও আমরা টের পাব। পেয়ে, এসে আমাদের যন্ত্রগুলো খুলে নিয়ে যাব। গাড়ি আবার অচল হয়ে যাবে।

বিধুবাবু চোখ কচলে বললেন, এসব কি সত্যি বলছো? নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি?

পুতুলটা শুধু খিলখিল করে হাসল, তারপর কয়েক মিনিট বাদেই পুতুলরা ইঞ্জিন থেকে বেরিয়ে এসে বনেট বন্ধ করে দিল। জানালার পুতুলটা বলল, চলি, এবার নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যাও।

চলে যাচ্ছো?

হ্যাঁ, আবার হয়তো দেখা হবে। নাও হতে পারে।

গাড়ির ছাদ থেকে হঠাৎ একটা ভারী বস্তু মচাৎ করে শব্দ তুলে চলে গেল। বিধুবাবু গাড়ি স্টার্ট দিলেন। কী সুন্দর মোলায়েম শব্দে গাড়ি স্টার্ট নিল। হেডলাইট জ্বলল। গাড়ি চমৎকার ছুটতে লাগল।

না, বিধুবাবুকে আর গাড়িটা বেচতে হয়নি। বিনা তেলে, বিনা মেরামতিতে, বিনা হাওয়ায় গাড়িটা চলছে তো চলছেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *