বিদ্রোহী

বিদ্রোহী

দেবব্রত আমার বন্ধু ছিল না। কিন্তু আজ এই ক্ষান্তবর্ষণ শ্রাবণসন্ধ্যায় কলকাতা হইতে বহু দূরে বসিয়া ষোল বৎসর পূর্বের এমনি আর একটি সন্ধ্যার কথা বার বার মনে পড়িতেছে। রামতনু লাইব্রেরির রীডিং রুমে আমরা কয়জন টেবিল ঘিরিয়া বসিয়া ছিলাম, আর দেবব্রত আমাদের সম্মুখে শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া। উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলো তাহার উগ্র সুন্দর মুখের উপর পড়িয়াছিল, তাহার বজ্রকঠিন মুখ ধীরে ধীরে রক্তহীন হইয়া গিয়াছিল, ঠোঁট দুটা হঠাৎ কাঁপিয়া উঠিয়াছিল—

সমস্ত দৃশ্যটা যেন চোখের সম্মুখে দেখিতে পাইতেছি।

তখন কলিকাতায় থাকিয়া এম. এ. পড়ি ও সন্ধ্যার পর রামতনু লাইব্রেরিতে বসিয়াই আড্ডা দিই। রামতনু লাইব্রেরি কয়েক বৎসর ধরিয়া আমার মতো আরও গুটিকয়েক প্রবীণ ছাত্রের স্থায়ী আড্ডা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল; তন্মধ্যে দেবব্রত ও সুরেনদাদা উল্লেখযোগ্য। বাকিগুলি বিশেষত্বহীন; তাহাদের নাম পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছি।

সুরেনদাদা একাদিক্রমে বহু বৎসর ল-কলেজের ছাত্র থাকিয়া, অভিজ্ঞতা, কলেবর ও বয়োমর্যাদার বলে সার্বভৌম ‘দাদা’ উপাধিতে ভূষিত হইয়াছিলেন। শুনিয়াছিলাম দেশে তাঁহার গুটি তিন-চার পুত্রকলত্র আছে। আমরা সকলেই তাঁহাকে অতিশয় শ্রদ্ধা করিতাম।

দেবব্রত আমার সহপাঠী ছিল; কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি, সে আমার বন্ধু ছিল না। দেবব্রতের বন্ধুভাগ্যটা ছিল খারাপ; আজ পর্যন্ত সে একটি সত্যকার বন্ধু লাভ করিতে পারিয়াছে কিনা সন্দেহ।

দেবব্রত বড়মানুষের ছেলে হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিল এবং তাহার পিতা যখন তাহার তরুণ হস্তে কয়েক লক্ষ টাকা ও আরও অনেক বিষয়সম্পত্তি রাখিয়া ভবসমুদ্রে পাড়ি দিয়াছিলেন, তখন অনেকেই আশা করিয়াছিল যে, এই অভিভাবকহীন যুবক এইবার বহু ইয়ার জুটাইয়া পিতৃ-অর্থ দু’হাতে উড়াইতে আরম্ভ করিবে। তাহাকে কাপ্তেন পাকড়াইবার চেষ্টাও কেহ কেহ করিয়াছিল। কিন্তু এত সুযোগ সত্ত্বেও সে যেমন ছিল তেমনই রহিয়া গিয়াছিল; তাহার জীবনযাত্রা বা মতামতের কোনও পরিবর্তন হয় নাই।

আমরা রামতনু লাইব্রেরির আড্ডাধারিগণ তাহাকে পছন্দ করিতাম না। তাহার বুদ্ধির এমন একটা কুণ্ঠাহীন অনাবৃত নগ্নতা ছিল যে আমাদের চোখে তাহা অশ্লীল দুর্নীতির রূপান্তর বলিয়া মনে হইত। আমরা বাঙ্গালী জাতি অনাবশ্যক তর্ক করিতে পশ্চাৎপদ, এ অপবাদ কেহ কখনও দিতে পারে নাই; কিন্তু দেবব্রতের সঙ্গে তর্ক বাধিলে আমরা কেমন নিস্তেজ হইয়া পড়িতাম, তর্কে আর রুচি থাকিত না। তাহার তর্ক করিবার রীতি দেখিয়াই আমাদের অত্যন্ত বিরক্তি বোধ হইত। ধর্মনীতি, সমাজতত্ত্ব, ঋষিবাক্য কিছুই সে স্বীকার করিত না, কেবল বুদ্ধির জবরদস্তি দ্বারা সকলকে কাবু করিবার চেষ্টা করিত। বলা বাহুল্য, এরূপ লোক বড়মানুষ হইলেও তাহার সহিত সদ্ভাব রাখা কঠিন হইয়া পড়ে।

তাহারা চেহারা ছিল উগ্র রকমের সুন্দর। ছ’ফুট লম্বা, গৌরবর্ণ, ধারালো মুখের উপর বাঁকা নাকটা যেন খড়্গের মতো উদ্যত হইয়া আছে। চোখের চাহনি এত তীব্র ও নির্ভীক যে, সাধারণত তাহাকে অত্যন্ত দাম্ভিক বলিয়া মনে হয়।

টাকার গর্ব অবশ্য তাহার ছিল না, কারণ টাকা জিনিসটাকে সে গর্বের বস্তু বলিয়া মনে করিত না। অযথা বড়মানুষী করিতে তাহাকে কখনও দেখি নাই, সে হাঁটিয়া কলেজে যাইত। তাহার গর্ব ছিল শুধু বুদ্ধির। তাহার ভাব দেখিয়া মনে হইত, বুদ্ধির বলে সে মানুষের সৃষ্ট সমস্ত প্রতিষ্ঠানের অন্তর্নিহিত ধাপ্পাবাজি ধরিয়া ফেলিয়াছে, তাই আমাদের মতো কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধ জীবের প্রতি তাহার করুণার অন্ত নাই।

তাহার উদ্ধত মতবাদ প্রায়ই নাস্তিকতার পর্যায়ে গিয়া পড়িত। মনে আছে, একবার কি একটা আলোচনার প্রসঙ্গে দাদা বলিতেছিলেন যে, বিবাহ নামক সংস্কারটাই মনুষ্য সমাজকে দৃঢ়ভাবে বাঁধিয়া রাখিয়াছে, যাহারা বিবাহ-বন্ধনকে শিথিল করিতে চায় তাহারা সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করিতেছে। দেবব্রত একটা বিলাতি মাসিক পত্রের ছবি দেখিতেছিল, মুখ তুলিয়া বলিল, ‘বিবাহ জিনিসটার স্বকীয় মূল্য কি?’

দাদা বলিলেন, ‘পৃথিবীতে কোনও জিনিসেরই স্বকীয় মূল্য নেই, সব আপেক্ষিক। বিবাহ আমাদের মহামূল্য সম্পদ, কারণ সমাজকে সে প্রেমের বন্ধনে বেঁধে রেখেছে।’

‘প্রেমের বন্ধন কোথা থেকে এল? বিবাহের সঙ্গে প্রেমের সম্বন্ধ কি?’

দাদা বিরক্ত হইয়া বলিলেন, ‘বিবাহ আর প্রেমের মধ্যে সম্বন্ধ আছে, এটাও বুঝিয়ে দিতে হবে?’

‘অনিবার্য সম্বন্ধ আছে, এটা যদি বুঝিয়ে দিতে পারেন তো ভাল হয়।’

দাদা রুষ্টমুখে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘তা যদি নাও থাকে, তবু সমাজের বন্ধন হিসাবে বিবাহের মূল্য কমে না।’

‘কিন্তু তাহলে প্রশ্ন ওঠে, একটা কৃত্রিম বন্ধন দিয়ে সমাজকে বেঁধে রাখা কি সঙ্গত?’

‘কৃত্রিম বন্ধন? মানে?’

‘যে বন্ধনে স্ত্রী-পুরুষ স্বেচ্ছায় পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধরা দেয় না, সে বন্ধন কৃত্রিম নয় তো কি?’

দাদা চটিয়া উঠিলেন। ধৈর্যচ্যুতি ঘটিলে তাঁহার মুখে কোনও কথা বাধে না, তিনি মোটা গলায় চিৎকার করিয়া বলিলেন, ‘বিবাহ কৃত্রিম বন্ধন! অর্থাৎ তোমার পূর্বপুরুষদের বিবাহকেও তুমি পবিত্র বলে মনে কর না?’

দেবব্রত মুষ্টি পাকাইয়া গর্জন করিয়া উঠিল, ‘না, স্বীকার করি না—

অপবিত্র ও কর-পরশ

সঙ্গে ওর হৃদয় নহিলে।

মনে কি ভেবেছ বঁধু, ও হাসি এতই মধু

প্রেম না দিলেও চলে শুধু হাসি দিলে।’

স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। রবীন্দ্রনাথের কবিতা সগর্জনে আবৃত্তি করিলে শুনিতে মধুর হয় না; বিশেষত নিজের পূর্বপুরুষদের বিবাহ অপবিত্র বলিয়া স্বীকার করিতে যে কুণ্ঠিত হয় না এরূপ বর্বরের মুখে। দাদাও গুম হইয়া গেলেন, এত বড় ব্রহ্মাস্ত্র যে ব্যর্থ হইয়া যাইবে, ইহা তিনি প্রত্যাশা করেন নাই।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া তিনি বলিলেন, ‘তুমি তাহলে কিছুই মান না বল?’

দেবব্রতও কণ্ঠস্বর কিয়ৎ পরিমাণে নামাইয়া বলিল, ‘মানি। কেবল একটা জিনিস।’

দাদা বলিলেন, ‘জিনিসটি কি?’

সংক্ষেপে দেবব্রত বলিল, ‘প্রেম।’

দাদা ভ্রূভঙ্গি করিয়া বলিলেন, ‘বল কি? বিবাহ মান না, তার মানে বিবাহ-সম্ভূত যত কিছু সম্বন্ধ সবই অস্বীকার কর। মাতৃস্নেহ, ভ্রাতৃপ্রেম এসব তোমার কাছে ভুয়ো। অথচ প্রেম মান—তার মানেটা কি?

‘মানেটা খুব সহজ। ভ্রাতৃপ্রেম মাতৃস্নেহ এগুলো মানুষের মনগড়া জিনিস—তাই কখনো কখনো মা নিজের হাতে সন্তানকে খুন করেছে একথা শোনা যায় এবং ভ্রাতৃপ্রেম যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা উপলক্ষে আদালতে গিয়ে উপস্থিত হয় তা সকলেই জানে। সুতরাং ও দুটো ঝুটো জিনিস—খাঁটি নয়। খাঁটি যদি কিছু থাকে তো সে প্রেম—যা আত্মীয়তার অপেক্ষা রাখে না, যার মূল্য আপনার বিবাহের মতো আপেক্ষিক নয়, নিজের মধ্যেই সম্পূর্ণ; স্বকীয়।’

দাদা বলিলেন, ‘হুঁ। প্রেম তো বড় ভাল জিনিস দেখছি। কিন্তু ভ্রাতৃপ্রেম বা মাতৃস্নেহের চেয়েও ওটা উচ্চ কোনখানে তা এখনও হৃদয়ঙ্গম হচ্ছে না।’

দেবব্রত তীক্ষ হাসিয়া বলিল, ‘হৃদয়ঙ্গম হবে কোত্থেকে! হৃদয়ের চারপাশে তিন ইঞ্চি পুরু কুসংস্কার জমা করে রেখেছেন যে। নইলে, প্রেমই মায়ের মনে গিয়ে মাতৃস্নেহে পরিণত হয় এবং ভ্রাতার বুকে প্রবেশ করে, কখনও কখনও লক্ষ্মণের মতো ভাই তৈরি করে, এটা বুঝতে দেরি হত না। মাতৃস্নেহ বলে স্বতঃসিদ্ধ কিছু নেই, তা যদি থাকত তাহলে প্রত্যেক মা তার সবগুলি সন্তানকে সমান ভালবাসত। কিন্তু পৃথিবীতে কোনও মা তা বাসে না। এখন দেখছেন যে, মাতৃস্নেহ বলে বস্তুত কিছু নেই! আছে শুধু প্রেম!’

দাদা আবার ধৈর্য হারাইলেন; বাস্তবিক এরকম কথা শুনিলে ধৈর্য রক্ষা করা কঠিন হইয়া পড়ে। তিনি দুই বাহু শূন্যে আস্ফালিত করিয়া উগ্র কণ্ঠে কহিলেন, ‘মাতৃস্নেহ যদি না থাকে তবে প্রেমও নেই। তুমি প্রেমের এত দালালি করছ কেন হ্যা? আজকাল প্রেম করছ বুঝি?’

দেবব্রত এবার সজোরে হাসিয়া উঠিল, বেশ প্রাণখোলা সকৌতুক হাসি। বলিল, ‘দাদা, প্রেম কি চেষ্টা করে করা যায়? ওটা সহজ—যত্নসাধ্য নয়—তাই ওর আর একটা নাম অহৈতুকী প্রীতি।’

দাদা শ্লেষ করিয়া বলিলেন, ‘জয় রাধেশ্যাম! হরি হরি বল।’

আমি এতক্ষণ চুপ করিয়াছিলাম, এবার খুব শান্তভাবে বলিলাম, ‘দেবব্রত, তোমাকে আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি কি?’

‘পার।’

‘বিবাহকে তুমি যখন সত্য বন্ধন বলে স্বীকার কর না, তখন স্ত্রীপুরুষের অবৈধ মিলনেও তোমার কোনও আপত্তি নেই?’

দেবব্রত বলিল, ‘কিছুই না। আর আপত্তি করলেই বা শুনছে কে?’

‘তাহলে কুস্থানে যেতেও তোমার কোনও নৈতিক বাধা নেই?’

‘কুস্থান?—ও!’ দেবব্রত হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল, ‘দাদা একদিক থেকে কোণঠাসা করবার চেষ্টা করেছিলেন, তুমি আর এক পথ ধরেছ। না, যাকে তুমি কুস্থান বলছ সেখানে যেতে আমার কোনও বাধা নেই।’

আমি তীক্ষস্বরে বলিলাম, ‘তবে যাও না কেন?’

‘রুচি নেই বলে।’

‘অর্থাৎ রুচি থাকলে যেতে?’

‘আলবৎ যেতুম, একশবার যেতুম।’

‘ও! তাহলে আমার আর কিছু বলবার নেই।’

দেবব্রত হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘বলবার তোমার কোনও কালেই কিছু ছিল না, কেবল ‘কুস্থানে’র ভয় দেখিয়ে আমাকে কাৎ করবার চেষ্টায় ছিলে। কিন্তু তা হয় না বন্ধু। ও ব্যর্থ প্রয়াস ছেড়ে দাও। তার চেয়ে বুদ্ধিকে প্রবুদ্ধ কর, সত্যকে সহজভাবে গ্রহণ করবার চেষ্টা কর; দেখবে সুস্থান কুস্থান বলে কোথাও কিছু নেই, সূর্যের আলো সর্বত্র সমানভাবে পড়ে। আরও বুঝবে, পৃথিবীতে একটিমাত্র বন্ধন আছে—মাতৃস্নেহ নয়, ভ্রাতৃস্নেহ নয়, জেলখানার গারদ নয়—তার নাম প্রেম। Omnia Vincit Amor! চললুম, যদি পার ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা কর।’ বলিয়া চক্ষে অসহ্য বিদ্রুপ বর্ষণ করিয়া ছড়ি ঘুরাইতে ঘুরাইতে প্রস্থান করিল।

চিত্তবৃত্তি যাহার এই ধরনের সে যে শীঘ্রই বিপদে পড়িবে তাহা আমরা জানিতাম, বুদ্ধির এমন অমিতাচার ভগবান সহ্য করেন না। কিন্তু স্বখাত-সলিলে দেবব্রত যে এমন করিয়া ডুবিবে তাহা তখনও বুঝিতে পারি নাই।

একটা শনিবারে, রাত্রি ন’টার সময় সিনেমা দেখিতে গিয়াছিলাম; গিয়া দেখি দেবব্রত পাশের আসনে বসিয়া আছে। কথাবার্তা বড় কিছু হইল না, যাহার সহিত প্রত্যহ দেখা হয় তাহাকে নূতন কিছু বলিবার থাকে না। অভিনয় শেষ হইলে দু’জনে একসঙ্গে ফিরিলাম। আমার মেস ও দেবব্রতের বাড়ি একই রাস্তার উপর; মধ্যে দশ-বারটা বাড়ির ব্যবধান। চৈত্র মাসের চমৎকার রাত্রি, তাই পথ অনেকটা হইলেও পদব্রজেই চলিয়াছিলাম।

সাড়ে এগারটা বাজিয়া গিয়াছিল; পথ নির্জন। মিনিট পনের হাঁটিবার পর, একটা গলির ভিতর দিয়া যাইতে যাইতে আমি বলিলাম, ‘আমেরিকায় স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধ যে উদ্ধৃঙ্খল পথে চলেছে তাতে ও জাতের অধঃপতন হতে আর দেরি নেই।’ সদ্যদৃষ্ট ফিল্মটার কথাই মনের মধ্যে ঘুরিতেছিল।

দেবব্রত একটু ভাবিয়া বলিল, ‘আমার তা মনে হয় না। যাকে তুমি উচ্ছৃঙ্খলতা মনে করছ প্রকৃতপক্ষে তা উচ্ছৃঙ্খলতা নয়। ওরা একটা এক্সপেরিমেন্ট করছে, সমাজের প্রত্যেকটি বিধি-বিধান নূতন করে যাচাই করে নিচ্ছে। হয়তো শেষ পর্যন্ত তারা সাবেক নিয়মগুলোই মেনে নেবে; কিন্তু বর্তমানে পুরাতন সম্বন্ধে একটা অসন্তোষ এসেছে, তাই তারা—‘টানিয়া ছিঁড়িয়া ভূতলে নুতন করিয়া গড়িতে চায়।’ যাদের চিন্তা করবার শক্তি আছে, সংস্কারকে যারা বুদ্ধির আসন ছেড়ে দেয়নি—’ দেবব্রতের কথা শেষ হইল না, হঠাৎ বাধা পড়িয়া গেল।

যেখানে আমরা পৌঁছিলাম সেখানে গলিটা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ, ইট বাঁধানো। দু’-ধারে ঘনসন্নিবিষ্ট বাড়ি, দেয়ালে সংলগ্ন গ্যাসবাতির নীচে অন্ধকার ছায়া পড়িয়াছে। হঠাৎ পাশের একটা দরজা খুলিয়া গেল, পুরুষ কণ্ঠের একটা মত্ত কর্কশ আওয়াজ শুনিতে পাইলাম। তারপর সেই অন্ধকার দ্বারপথ দিয়া একটি স্ত্রীমূর্তি যেন প্রবল ধাক্কা দ্বারা তাড়িত হইয়া একেবারে দেবব্রতের গায়ের উপর আসিয়া পড়িল। দরজা আবার সশব্দে বন্ধ হইয়া গেল।

আকস্মিক সংঘাতের তাল সামলাইয়া দেবব্রত স্ত্রীলোকটিকে ধরিয়া ফেলিল। গ্যাসের আলোয় দেখিলাম, একটি ষোল-সতের বছরের মেয়ে, পরনের শাড়িখানা ছিঁড়িয়া প্রায় লজ্জা-নিবারণের অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছে, কপাল কাটিয়া রক্ত পড়িতেছে। সে ব্যাকুল ত্রাসে একবার আমাদের দিকে তাকাইয়া ছুটিয়া গিয়া সেই বন্ধ দরজার উপর আছড়াইয়া পড়িল, চাপা রোদনরুদ্ধ স্বরে বলিল, ‘খোল—ওগো—দোর খুলে দাও।’

দ্বারের অপর পার হইতে কিন্তু কোনও সাড়া আসিল না। সে আবার কবাটে ধাক্কা দিল, কিন্তু এবারও উত্তর আসিল না। তখন সে বুকভাঙ্গা ব্যাকুলতায় সেই দরজার সম্মুখে মাথা গুঁজিয়া ফুঁপাইতে লাগিল।

আমরা এতক্ষণ চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়াইয়া ছিলাম। এখন দেবব্রত অগ্রসর হইয়া কহিল, ‘শুনুন। এটা কি আপনার বাড়ি?’

সে মুখ তুলিয়া আমাদের যেন প্রথম দেখিতে পাইল; লজ্জায় তাহার বসনহীন দেহ সঙ্কুচিত হইয়া ছোট হইয়া গেল। ছেঁড়া কাপড়ে কোনও মতে দেহ আবৃত করিয়া সে জড়সড়ভাবে দরজার পৈঠার উপর বসিয়া রহিল।

দেবব্রত জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি হয়েছে?’

মেয়েটি কোনও উত্তর দিল না।

দেবব্রত আবার প্রশ্ন করিল, ‘যিনি আপনাকে বাড়ি থেকে বার করে দিলেন তিনি কি আপনার স্বামী?’

মেয়েটি হঠাৎ হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজিল।

দেবব্রত তখন ঈষৎ অসহিষ্ণুভাবে বলিল, ‘দেখুন, আপনাকে এভাবে ফেলে আমরা যেতে পারছি না। এ বাড়িতে যদি আপনার কোনও আত্মীয় থাকে তো বলুন, তাকে ডাকবার চেষ্টা করছি; আর যদি না থাকে তাও বলুন, দেখি যদি অন্য কোনও ব্যবস্থা করতে পারি।’

মেয়েটি তখন অস্পষ্ট স্বরে বলিল, ‘আমার কেউ নেই।’

‘কেউ নেই! অর্থাৎ যিনি আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বার করে দিলেন আপনি তাঁর স্ত্রী নন?’

মেয়েটি মাথা নাড়িল।

‘রক্ষিতা?’

বিদ্যুদাহতের মতো মুখ তুলিয়া সে আবার হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজিল।

দেবব্রত বলিল, ‘হুঁ, শহরে আর কোথাও যাবার জায়গা আছে?’

মেয়েটির চাপা কান্না হঠাৎ কোলের ভিতর হইতে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল, ‘না।’

দেবব্রত কিছুক্ষণ নতমুখে চুপ করিয়া রহিল। দুপুররাত্রে অজানা পল্লীতে হঠাৎ এই বিশ্রী ব্যাপারে জড়াইয়া পড়িয়া আমি সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়াছিলাম, এই ফাঁকে বলিলাম, ‘দেবব্রত, চল আমরা যাই—’

দেবব্রত মুখ তুলিয়া মেয়েটিকে বলিল, ‘পুলিসে যেতে রাজি আছেন?’

মেয়েটি এবার মুখ তুলিয়া হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, বলিল, ‘না—আমি পুলিসে যাব না—’ তাহার কপালে রক্তের সহিত চুল জমাট বাঁধিয়া গিয়াছিল, চোখ দিয়া ধারার মতো জল গড়াইয়া পড়িতেছিল; পতিতা হইলেও দেখিলে কষ্ট হয়। কিন্তু দেবব্রত এই সময় যাহা করিয়া বসিল, তাহা সহানুভূতি বা সমবেদনা নয়, চূড়ান্ত পাগলামি। পতিতার প্রতি দরদ দেখাইতে দোষ নাই, কিন্তু দরদেরও একটা সীমা আছে!

দেবব্রত মেয়েটির খুব কছে গিয়া বলিল, ‘পুলিসে যেতে হবে না, আপনি আমার বাড়িতে চলুন। যাবেন? আমি একলা থাকি, কিন্তু কোনও ভয় নেই। আসুন।’

মেয়েটি বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল।

আমি সভয়ে বলিলাম, ‘দেবব্রত, কি পাগলামি করছ?’

দেবব্রত আমার কথা শুনিতে পাইল না, মেয়েটির দিকে ঝুঁকিয়া বলিল, ‘যাবেন তো? না গেলে এই রাত্রে কোথায় থাকবেন? যাবার জায়গাও তো আপনার নেই। কি, আসবেন? আপনি আশ্রয়হীন, আমার বাড়ি আছে, তাই সেখানে যেতে অনুরোধ করছি। যখন ইচ্ছে হবে চলে আসতে পারবেন। ভয় করবেন না, আমার মনে কোনও মতলব নেই।’

মেয়েটি তবু মৌন হইয়া রহিল।

তখন দেবব্রত তাহার হাত ধরিয়া তুলিয়া সদয় কণ্ঠে বলিল, ‘চলুন। আমার বাড়ি এখান থেকে মাইলখানেক দূর—হেঁটে যেতে পারবেন না, বড় রাস্তায় গিয়ে ট্যাক্সি ধরব।’

মেয়েটি বাধা দিল না, আপত্তি করিল না, যন্ত্র-চালিতের মতো দেবব্রতের হাত ধরিয়া তাহার সঙ্গে চলিল।

সদর রাস্তায় ট্যাক্সি পাওয়া গেল। দেবব্রত তাহাকে তুলিয়া দিয়া আমাকে বলিল, ‘এস মন্মথ।’

আমি শক্ত হইয়া বলিলাম, ‘না, তুমি যাও। আমি হেঁটেই যাব।’

চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া দেবব্রত আমার পানে তাকাইল; তাহার মুখে একটা তীক্ষ্ণ বাঁকা হাসি ফুটিয়া উঠিল, সে বলিল, ‘ও, আচ্ছা।’ তারপর নিজে ট্যাক্সিতে উঠিয়া বলিল, ‘হাঁকো।’

ট্যাক্সি চলিয়া গেল।

সোমবার সন্ধ্যায় দেবব্রত লাইব্রেরিতে পদার্পণ করিবামাত্র দাদা বলিলেন, ‘এই যে! শনিবার রাত্রে খুব রোমান্স করেছ শুনলুম?’ বলা বাহুল্য, ঘটনাটা আমি আড্ডায় ব্যক্ত করিয়াছিলাম।

দেবব্রত চেয়ারে বসিয়া সহজভাবে বলিল, ‘হ্যাঁ।’

সকলেই উৎসুকভাবে তাকাইয়া ছিল, কিন্তু দেবব্রত যখন আর কিছু বলিল না, তখন দাদা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তারপর রোমান্স গড়াল কতদূর?’

দেবব্রত হাল্‌কাভাবে হাসিয়া বলিল, ‘বেশীদূর গড়ায়নি এখনও, এই তো সবে আরম্ভ।’ বলিয়া একটা মাসিক পত্ৰ টানিয়া লইল।

গর্হিত কার্যের প্রতি যথোচিত ঘৃণা থাকিলে সেই সঙ্গে একটু কৌতূহল দোষাবহ নয়; বস্তুত অধিকাংশ সজ্জনের মনেই দুষ্কার্য সম্বন্ধে ঘৃণা ও কৌতূহলের নিবিড় সংমিশ্রণ দেখা যায়। দাদাও তাহার ব্যতিক্রম নয়। তিনি আবার প্রশ্ন করিলেন, ‘তবু? ভাব-সাব আলাপ-পরিচয় হয়েছে তো?’

দেবব্রত মুখ তুলিয়া বলিল, ‘খুব সামান্য। সেই যে সে-রাত্রে কাঁদতে আরম্ভ করেছে এখনও থামেনি। কাজেই আলাপের চেয়ে বিলাপই বেশী হয়েছে।’

‘পরিচয় জানতে পারনি?’

‘পরিচয় নূতন কিছু নেই। গেরস্ত-ঘরের শিক্ষিতা মেয়ে। বিয়ে হয়নি—স্কুলে পড়ত। মাস ছয়েক আগে একটা লোকের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসে। সেই লোকটার সঙ্গেই ছিল—লোকটা মাতাল; তারপর পরশু রাত্রের ঘটনা।’

‘তাহলে কুলত্যাগিনী—পেশাদার নয়?’ দাদা কথাগুলি বেশ ভাবিয়া ভাবিয়া বলিলেন।

‘হ্যাঁ—কুলত্যাগিনী।’

‘কোন্ কুল আলো করে ছিলেন, তার কোনও সন্ধান পেলে?’

‘সন্ধান নিইনি।’

‘হুঁ। এখন তাহলে পদ্মিনীটি তোমার স্কন্ধেই আরোহণ করে আছেন? তুমিও একলা মানুষ, তার উপর কুসংস্কারের বালাই নেই। যোগাযোগটা হয়েছে ভাল। তা—এখন এই ভাবেই বসবাস চলবে তাহলে?’

‘চলা ছাড়া আর উপায় কি? যতক্ষণ তিনি নিজে কোথাও না যাচ্ছেন ততক্ষণ আমি তাড়িয়ে দিতে পারছি না।’ বলিয়া সম্মুখস্থ কাগজে মনোনিবেশ করিল।

তাহার প্রখর বুদ্ধির প্রভায় উজ্জ্বল মুখখানার দিকে চাহিয়া আমার মনে কেমন একটা দুঃখ হইতে লাগিল। সমাজ-বন্ধন যে মানে না, বিবাহকে যে কৃত্রিম বন্ধন বলিয়া উপহাস করে, তাহার নৈতিক চরিত্র যে এরূপ অবস্থায় পড়িয়া অতি সহজে নির্বিঘ্নে অধঃপথে যাইবে তাহাতে সন্দেহ করিবার অবকাশ কোথায়?

দাদাও সেই একই কথা বলিলেন; একটা গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, ‘যাক, এতদিন শুধু মুখেই দুর্নীতি প্রচার করছিলে, এবার সত্যি সত্যিই গোল্লায় গেলে?’

চকিতে মুখ তুলিয়া দেবব্রত বলিল, ‘তার মানে?’

‘তার মানে আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। তোমার ভবিষ্যৎ আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আর সকলে ক্রমশ ক্রমশ দেখতে পাবে।’

দেবব্রত হাসিয়া উঠিল, তারপর বলিল, ‘দাদা একজন পাকা রোমান্টিক। বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু রস মরেনি। বৌদি’র বয়স কত হবে দাদা?’

দাদা ক্রুদ্ধভাবে একবার তাহার দিকে তাকাইয়া মুখ গম্ভীর করিয়া বসিয়া রহিলেন। স্ত্রীকে লইয়া রসিকতা তিনি পছন্দ করিতেন না।

ইহার পর যখনই দেবব্রত আড্ডায় আসিত, তখনই আমরা তাহাকে নানাবিধ প্রশ্নের আড়ালে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের খোঁচা দিতাম। আমাদের মধ্যে একজন ছিল ভয়ানক পিউরিটান, তাহার নাম বোধ হয় জিতেন—সে দেবব্রতের সঙ্গে কথা বন্ধ করিয়া দিল। বিদ্রোহীর কিন্তু কিছুমাত্র ভাব-বিপর্যয় দেখা গেল না। সে আমাদের ঠাট্টা-বিদ্রুপের জবাব দিত; আশ্রিতা যুবতী সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলে সহজভাবে উত্তর দিত—লুকোচুরি করিত না। মেয়েটার নাম অণিমা—সে দিব্য আরামে দেবব্রতের বাড়িতে বাস করিতেছে, চলিয়া যাইবার কোনও আগ্রহ নাই; দু’ জনের মধ্যে পরিচয় বেশ ঘনীভূত হইতেছে; এ সমস্ত খবর তাহার নিজের মুখেই শুনিতে পাইতাম। কেবল একটি প্রশ্ন সোজাভাবে বাঁকাভাবে অনেক প্রকারে করিয়াও আমরা জবাব পাইতাম না। দেবব্রত কখনও গম্ভীর হইয়া থাকিত, কখনও হাসিয়া এড়াইয়া যাইত; উত্তরটা আমরা অবশ্য মনে মনে অনুমান করিয়া লইয়াছিলাম।

ক্রমে দেবব্রতের আড্ডায় আসা কমিতে আরম্ভ করিল। মাঝে মাঝে যখন আসিত, তখন তাহার মুখে একটা অতৃপ্ত ক্ষুধিত ভাব দেখিয়া আমরা মনে মনে হাসিতাম। বেশীক্ষণ স্থির হইয়া বসিয়া থাকিতে পারিত না, কিছুক্ষণ ছটফট করিয়া উঠিয়া চলিয়া যাইত। শেষে তাহার লাইব্রেরিতে আসা একেবারে বন্ধ হইয়া গেল।

কলেজেও তাহাকে দু’মাস দেখিলাম না। বুঝিলাম, পড়াশুনায় আর মন নাই, এখন সে অন্য পথে চলিয়াছে। দাদা মাঝে মাঝে দুঃখ করিয়া বলিতেন, ‘ছোঁড়া একেবারে বরবাদ হয়ে গেল। জানতুম, ওরকম চিত্তবৃত্তি যার, সে একদিন না একদিন অধঃপাতে যাবে। তবু আপশোষ হয়, বুদ্ধির দোষে ছোঁড়া নষ্ট হয়ে গেল।’

আমারও দুঃখ হইত। সে-রাত্রে সেই গৃহ-নিষ্কাশিতা মেয়েটার রক্তমাখা মুখ ও অসহায় অবস্থা দেখিয়া যদি তাঁহার শিভাল্‌রি না জাগিত, হয়তো কোনওদিন ভদ্রঘরের একটি মেয়েকে বিবাহ করিয়া সে সুখী হইতে পারিত, ক্রমে বুদ্ধির অহঙ্কারদৃপ্ত নাস্তিকতাও কাটিয়া যাইত। কিন্তু এখন তাহার উদ্ধার নাই। অধঃপথের স্বাদ একবার যে পাইয়াছে সে আর ভাল পথে ফিরিবে না।

তারপর একদিন শ্রাবণের ক্ষান্তবর্ষণ সন্ধ্যায় তাহাকে শেষ দেখিলাম। মাস তিনেক তাহাকে দেখি নাই। লাইব্রেরিতে আমরা সকলে বসিয়া ছিলাম, সে আসিয়া ছড়িটা টেবিলের উপর রাখিয়া দাঁড়াইল।

আকস্মিক আবির্ভাবে আমরা বিস্ময়ে মুখ তুলিয়া চাহিলাম। দেখিলাম সে অনেকটা রোগা হইয়া গিয়াছে, ধারালো মুখ যেন মাংসের অভাবে আরো ধারালো হইয়া উঠিয়াছে, ওষ্ঠে একটা শ্রীহীন শুষ্কতার আভাস।

আমরা কোনও সম্ভাষণ করিলাম না; আমার মনে হইল, দেবব্রত যেন আমাদের নিকট হইতে বহুদূরে চলিয়া গিয়াছে, কোথাও আমাদের মধ্যে যোগসূত্র নাই। সেও যেন এই দূরত্বের ব্যবধান বুঝিতে পারিল, গলাটা একবার ঝাড়িয়া লইয়া বলিল, ‘দাদা, আপনাদের নেমন্তন্ন করতে এসেছি।’

দাদা নিরুৎসুকভাবে বলিলেন, ‘অনেক দিন পরে দেখছি। বস। কিসের নেমন্তন্ন? বিয়ে করছ নাকি?’

দেবব্রত বসিল না, বলিল, ‘হ্যাঁ বিয়ে করছি। আত্মীয়-স্বজন আমার কেউ নেই, বন্ধুর মধ্যে আপনারা। তাই নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছি, সশরীরে উপস্থিত থেকে শুভকার্য সম্পন্ন করাবেন।’ তাহার শুষ্ক মুখে পরিহাসের চেষ্টা ভাল মানাইল না।

দাদা সহসা জবাব দিলেন না; পকেট হইতে কয়েক খণ্ড সুপারি বাহির করিয়া গালে ফেলিয়া চিবাইলেন, তারপর বলিলেন, ‘বিয়ে করছ? বিয়েটা অবশ্য বন্ধন, তোমার মতো জ্ঞানী লোক ইচ্ছে করে কেন এ ফাঁস গলায় পরছে বোঝা যাচ্ছে না, তা সে যাক। তোমার সেই অপদেবতাটি ঘাড় থেকে নেমেছে, এতেই আমরা খুশি। কোথায় বিয়ে করছ?’

দেবব্রতের মুখখানা ফ্যাকাসে হইয়া গেল; সে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, তারপর আস্তে আস্তে বলিল, ‘আমি তাকেই বিয়ে করছি।’

দাদার সুপারি-চর্বণ বন্ধ হইয়া গেল; আরও বিস্ফারিত নেত্রে চাহিলেন। তাহাকেই বিবাহ করিতেছে! সে কি!

দাদা বলিলেন, ‘ঠিক বুঝতে পারলুম না! যে ভ্রষ্টা স্ত্রীলোককে তুমি নিজের কাছে রেখেছিলে তাকেই এতদিন পরে বিয়ে করতে চাও—এই কথাই কি আমাদের জানাতে এসেছ?’

দেবব্রত স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর আস্তে আস্তে অবরুদ্ধ কণ্ঠ হইতে কথা বাহির করিল, ‘সে ভ্ৰষ্টা নয়। ছেলেমানুষ—একজনের প্রলোভনে পড়ে—কিন্তু সে সত্যই মন্দ নয়, আমি তার পরিচয় পেয়েছি—’ দেবব্রতের এরকম কণ্ঠস্বর আমি কখনও শুনি নাই, সে যেন মিনতি করিতেছে। তাহার ঠোঁট দুটা কাঁপিতে লাগিল।

দাদা কঠিন স্বরে বলিলেন, ‘ভাল-মন্দের বিচারক তুমি একলা নয়, আমরাও কিছু কিছু বিচার করতে পারি। মাথার উপর সমাজ রয়েছে। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তোমরা দু’জনে যেভাবে ছিলে সেই ভাবেই থাকতে পারতে, তাতে নিন্দে হত বটে, কিন্তু সমাজের মুখে চুনকালি পড়ত না। এ বিয়ের ভড়ংয়ের দরকার কি?’

তেমনি পাণ্ডুর মুখে দেবব্রত বলিল, ‘দাদা, আমি—আমরা একবাড়িতে আছি বটে, কিন্তু কখনো—’ তাহার কণ্ঠস্বরে হঠাৎ পূর্বতন তীক্ষ্ণতা ফিরিয়া আসিল, ‘ছি! আপনি কি মনে করেন, যার মন পাইনি তাকে আমি—’

দাদা হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিলেন—‘ও, সেই পুরোনো পদ্য—“অপবিত্র ও করপরশ”।’ দাদা আবার খানিকটা হাসিলেন, ‘যাহোক, এতদিনে মন পেয়েছ তাহলে?’

‘পেয়েছি বলেই মনে হয়।’

‘একেবারে অহৈতুকী প্রীতি! খাঁটি জিনিস বটে তো? ও বাজারে মেকিও চলে কিনা, তাই জিজ্ঞাসা করছি। সে যাক। তুমি আমাদের নেমন্তন্ন করতে এসেছ। তুমি আশা কর আমরা এই বিয়েতে যোগ দেব? কেন—তুমি বড়লোক বলে?’

দেবব্রত নীরবে মুঠি শক্ত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

তাহার বিবর্ণ, লাঞ্ছিত মুখখানা দেখিয়া আমার ক্লেশ হইতে লাগিল। দাদার কথাগুলা সত্য হইলেও অত্যন্ত নিষ্ঠুর, তাই সুরটা নরম করিবার জন্য আমি বলিলাম, ‘দেবব্রত, তোমার ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে আমরা কিছু বলতে চাই না, একজন অপরিচিতা নারীকেও আমরা আলোচনার বাইরে রাখতে চাই—কিন্তু এ রকম একটা অনুষ্ঠানে আমি—’

দেবব্রত আমার পানে চাহিল, তাহার চোখের মধ্যে একটা কাতর অনুনয় দেখিতে পাইলাম। সে বলিল, ‘মন্মথ, তুমিও আমার বিয়েতে যাবে না?’

আমি দাদার দিকে চাহিলাম, দাদা জলদগম্ভীর স্বরে বলিলেন, ‘যার ইচ্ছে যেতে পারে, কিন্তু আমি এসব ভ্রষ্টাচারের মধ্যে নেই। সমাজের মাথায় যারা লাথি মারে, তারা সমাজের সহানুভূতি প্রত্যাশা করে কোন্ মুখে?’

দেবব্রত আবার বলিল, ‘মন্মথ, তুমি—’

আমি মাথা নাড়িলাম—‘আমি সত্যই দুঃখিত, কিন্তু আমি পারব না।’

দেবব্রত আর সকলের দিকে ফিরিল, ‘তোমরাও কেউ যাবে না?’

সকলেই মাথা নাড়িল।

দেবব্রত কিছুক্ষণ হেঁটমুখ দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর আস্তে আস্তে ছড়িটা তুলিয়া অস্পষ্ট স্বরে বলিল, ‘আচ্ছা বেশ—’

আমি তাহার মুখের দিকে তাকাইতে পারিলাম না; মনে হইতে লাগিল তাহার কাছে কত বড় অপরাধ করিতেছি।

দেবব্রত চলিয়া গেল।

তারপর ষোল বৎসর দেবব্রতকে দেখি নাই। এতদিনে তাহার বয়স চল্লিশ পার হইয়া গেল। কেমন আছে, কোথায় আছে জানি না, হয়তো সেই পুরাতন বাড়িতেই বন্ধুহীন আত্মীয়হীন ভাবে বাস করিতেছে।

দেবব্রত বিবাহের বিরোধী ছিল, তবু কেন সে সেই মেয়েটাকে বিবাহ করিতে চাহিয়াছিল তাহা আজও ভাল বুঝিতে পারি নাই। হয়তো যাহাকে সে ভালবাসিয়াছিল, অন্যে তাহাকে ঘৃণার চক্ষে দেখিবে তাহা সহ্য করিতে পারে নাই; তাই সেই শ্রাবণ-সন্ধ্যায় সমস্ত বুদ্ধির অহঙ্কার বিসর্জন দিয়া আমাদের সহানুভূতি প্রার্থনা করিতে আসিয়াছিল। কিংবা—কিন্তু আর কি হইতে পারে?

সেদিন দুষ্কৃতির প্রশ্রয় আমরা দিই নাই; তাহাকে অশেষভাবে লাঞ্ছিত করিয়া তাহার ভালবাসার পাত্রীকে অপমান করিয়াছিলাম। অন্যায় করিয়াছিলাম, এমন কথাও বুকে হাত দিয়া বলিতে পারি না। তবু আজ এই ক্ষান্তবর্ষণ সন্ধ্যায় তাহার সেদিনকার পীড়িত মুখখানা মনে পড়িয়া মনটা অন্যায়ভাবে ব্যথিত হইয়া উঠিতেছে।

এখন তাহারা কেমন আছে—কে জানে, আছে কিনা তাই বা কে জানে! আমাদের সার্বভৌম ‘দাদা’র ধারণা, দুষ্কৃতরা অধিকদিন ধরার ভার বৃদ্ধি করিবার সুযোগ পায় না।

২৬ শ্রাবণ ১৩৪২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *