বিদ্রোহী সংঘ

বিদ্রোহী সংঘ

খেলাফত আন্দোলনে সমগ্র দেশটা যখন থৈ-থৈ করিয়া উঠিয়াছিল, তখন আমি পরম উৎসাহেই উহার নিন্দা করিয়াছিলাম। তখন আমি সবেমাত্র বি. এ. পাশ করিয়া কলেজ হইতে বাহির হইয়াছি। ডেপুটিগিরির স্বপ্নে আমি তখন বিভোর।

জালিয়ানওয়ালার ডায়ারী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের বন্যায় যখন ভারতবর্য প্লাবিত হইয়া গিয়াছিল, তখনো আমি নেতাদের খামখেয়ালি বাড়াবাড়িতে বিরক্ত প্রকাশ করিয়াছিলাম। তখনো আমি প্রশংসাপত্রের টাইপ করা নকলের বস্তা-বগলে সাহেব-সুবার বাড়ি-বাড়ি ঘুরা ফেরা করিয়া আশা পাইতেছি।

তারপর যখন ইংরাজ সরকার বিশ হাজার ভারতবাসীকে কারানিক্ষেপ করিলেন, তব ভি হাস কু না কাহা। তখনও আমি কর্মখালি পাঠের জন্য দৈনিক কাগজে এবং চাকুরির দরখাস্তের জন্য ডাক-টিকিট ক্রয় বাবত দু’হাতে খরচ করিতেছি।

এমন কি যখন বাড়ির কাছে চাঁদপুর, সলঙ্গার হাট হইতে আরম্ভ করিয়া কুলকাঠি পর্যন্ত অনেক জায়গায় অনেক অকাণ্ড-কুকাণ্ড ও হত্যাকাণ্ড এক রকম চোখের সামনেই হইয়া গেল, তখনো আমি ইংরাজ ভক্তিতে অবিচলিত থাকিয়া নিরুদ্বেগে ইংরাজের চাকুরির চেষ্টা করিতে থাকিলাম।

কিন্তু অবশেষে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গিয়া গেল। আমার ভিতরে ইংরাজ-বিদ্বেষে বহ্নি দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল সেইদিন- পুনঃ পুনঃ চাকুরির ভরসা দিয়াও যেদিন জেম্স সাহেব আমাকে তাঁহার অফিস গৃহ হইতে বাহির করিয়া দিবার জন্য তাঁহার আরদালিকে হুকুম দিয়া বসিলেন। আমি সাহেবটার অদ্রতায় ভয়ানক চটিয়া গিয়াছিলাম। সুতরাং আরদালি আসিয়া পৌঁছিবার আগেই আমি বাহির হইয়া আসিলাম। ফলে আরদালি আমার কেশ-স্পর্শ করিতেও পারিল না। কিন্তু আমি বুঝিলাম ও ইংরাজ জাতটার মধ্যে সত্যি সত্যি কোন বিচার নাই।

ইহার উপর বিনা টিকিটে ট্রামে চড়ার অপরাধে যেদিন গোরা চেকার আমাকে গোরা সার্জেন্টের হাতে সোপর্দ করিয়া এক টাকা জরিমানা লাগাইল, সেইদিন আমার মধ্যে বিদ্রোহের রক্ত টগবগ করিয়া উঠিল।

স্বরাজের আবশ্যকতা সম্বন্ধে আমার আর কোন সন্দেহ থাকিল না। জরিমানার টাকাটা দিয়া পুলিশ-কোর্ট হইতে বাহির হইয়া দেখিলাম, সার্জেন্টটা আমার দিকে চাহিয়া মুচকি হাসিতেছে। আমি ক্রোধ সম্বরণ করিতে পারিলাম না। চিৎকার করিয়া বলিলাম;

শোন ইংরাজ,
আজ হতে আমি বিদ্রোহী উন্মাদ!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া
গিয়াছে সব বাঁধ।
আমি মুক্ত, আমি সত্য, আমি বিদ্রোহী সৈন্য!
আমি ধন্য! আমি ধন্য!!
মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত,
আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে চাকুরির আশে বাঙালি ফিরিঙ্গীর পায়ে ধরিবে না!
আর ট্রাম কোম্পানি ভাড়া চাহিবার দুঃসাহস করিবে না।

সার্জেন্টের দিকে চাহিয়া দেখিলাম : তাহার হাসি বন্ধ হইয়া গিয়াছে, চক্ষু বড় হইয়াছে। ইংরাজ জাতির অভদ্রতায় আমি ইতিপূর্বেই নিঃসন্দেহ হইয়াছিলাম। তাই সেখানে আর দেরি করিলাম না; দ্রুতগতিতে রাস্তায় জনতার মধ্যে সান্ধাইয়া পড়িলাম। কিন্তু তার পূর্বে গোরাকে শুনাইয়া ‘আমি ফিরিঙ্গী বুকে একে দিই পদচিহ্ন’ বলিয়া সে কার্যে আমার যোগ্যতার প্রমাণস্বরূপ আপাতত ধরণীর বুকেই বাম পায়ের গোড়ালি চিহ্ন রাখিয়া আসিলাম।

বাঙালির ক্রোধ তালপাতার আগুনের মতই ক্ষণস্থায়ী বলিয়া একটা বদনাম আছে। আমিও বাঙালি। অথচ আমি ইংরাজ জাতির উপর সত্যই চটিয়া গিয়াছিলাম, সুতরাং বাঙালির জাতির এই দুর্নাম ঘুচাইবার জন্য আমি আমার ক্রোধটাকে তাজা রাখিবার প্রাণপণ চেষ্টা করিতে লাগিলাম।

আমি স্থির করিলাম। ইংরাজ জাতিকে হয় ভারতবর্ষ হইতে গলাধাক্কা দিয়া তাড়াইয়া দিব, নয় ত উহাদিগকে আমাদের আরদালি করিয়া রাখিব। এই মতলবে আমি এতই কঠোর হইয়া উঠিলাম যে, হাজার অনুরোধ-উপরোধও আমার মনে ইংরাজের প্রতি দয়ার উদ্রেক হইবার কোন সম্ভাবনা থাকিল না।

এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কি উপায় অবলম্বন করা যায়, সে ভাবনায় আমি অস্থির হইয়া উঠিলাম। পূর্বে স্থির করিয়াছিলাম, জেম্‌স সাহেবের নিকট চাকুরির শেষ চেষ্টা করিয়া বিফল হইলে বাড়ি ফিরিয়া আপাতত কিছুদিন বিশ্রাম করিব এবং বাড়িতে আদর আপ্যায়নের ত্রুটি দেখিলে গ্রাম্য কোন স্কুলে মাস্টারি করিব; কিন্তু ইংরাজ তাড়াইবার এই নূতন দায়িত্ব কাঁধে পড়ায় আমার প্রোগ্রাম চেঞ্জ করিতে হইল- আপাতত কিছুদিন কলিকাতায় থাকাই স্থির করিলাম।

প্রথমে নজর পড়িল স্বভাবতই কংগ্রেসের উপর। তাই কংগ্রেস অফিসে হাঁটাহাঁটি করিলাম, কংগ্রেস নেতাদের সহিত আলাপ করিলাম, কংগ্রেসের উদ্দেশ্যসমূহ ভাল করিয়া অধ্যায়ন করিলাম। কিন্তু হতাশ হইলাম। বুঝিলাম ও ইংরাজ তাড়ান ইহাদের কর্ম নয়। ইহারা অন্যসব ব্যাপারে ততটা নন-ভায়লেন্ট না হইলেও ইংরাজ-তাড়ানোর ব্যাপারে সত্য সত্যই ননভায়লেন্ট।

রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধায়োজন ইত্যাদি বড় বড় অপরাধে যাঁহাদের দীর্ঘদিন কারাদণ্ড হইয়াছিল, এমনও দুই-একজন সদ্যমুক্ত বিপ্লবী নেতার সঙ্গে দেখা করিলাম। দেখিলাম ও ষড়যন্ত্রে তাহারা মজবুত বটে, কিন্তু তা রাজার বিরুদ্ধে নয়; নিজেরা সহোদরের বিরুদ্ধে এবং যুদ্ধও তাঁহারা করেন বটে, কিন্তু তা রাজার সঙ্গে নয়, স্ত্রীর সঙ্গে অধিকন্তু তা বাক্‌-যুদ্ধ!

সশস্ত্র বিদ্রোহের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বহুদিন স্টেটপ্রিযনাররূপে যাহারা মান্দালয় ও বক্শা জেলে বাস করিয়া পীড়ার অজুহাতে সম্প্রতি মুক্তি পাইয়া আসিয়াছেন, এমনও অনেকের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। আমার কথা শেষ হইবার আগেই তাঁহারা আমাকে “এজেন্ট-প্রভোকেটর” বলিয়া হাঁকাইয়া দিলেন।

দেখিলাম : সারা বাংলায় আমি ছাড়া ইংরাজের সত্যিকার শত্রু আর একজনও নাই। ইংরাজ তাড়াইয়া দেশ স্বাধীন করা যেন আমার একারই দায়িত্ব, আর সবাই যেন ইংরাজের অধীনে রাম-রাজত্বে বাস করিতেছে।

নেতাদের উপর বিষম রাগ হইল। দেশবাসীর নির্বুদ্ধিতায় আমি একেবারে অতিষ্ঠ হইয়া উঠিলাম। বাঙালির মেষ স্বভাবের উপর ভয়ঙ্কর চটিয়া গেলাম। মনে হইল? হাতে ক্ষমতা থাকিলে ইংরাজের আগে এই বাঙালি জাতিটাই নির্মূল করিয়া ফেলিতাম।

আপাতত কোনটাই সম্ভব ছিল না। তাই স্থির করিলাম : বাঙলা ত্যাগ করিয়া লাখনোয়ে মওলানা হযরত মোহানীর কাছে, কিম্বা নাগপুরে ডাঃ মুঙ্গের কাছে চলিয়া যাইব।

দেশত্যাগের মতলব স্থির করায় মনটা একটু খারাপ হইয়া গেল। তাই গড়ের মাঠে শেষবারের মতো বড়াইতে গেলাম।

উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক-ওদিক অনেকক্ষণ বেড়াইয়া সন্ধ্যা লাগে-লাগে অবস্থায় একটা নির্জন স্থানে বসিয়া পড়িলাম। আকাশ-পাতাল অনেক ভাবিতে লাগিলাম।

একটি ভদ্রলোক আসিয়া আমার পাশে বসিয়াই কোনও ভূমিকা না করিয়া নিতান্ত অপ্রতিভভাবে বলিলেন : জনাবের নিকট ধূমপানের ব্যবস্থা আছে কি?

আমি ইংরাজের উপর চটিয়া যাওয়ার পর হইতে সম্প্রতি সিগারেট বর্জন করিয়াছিলাম, এবং খাইতে পারিতাম না বটে, কিন্তু বিড়ি কিনিয়া পকেট ভর্তি করিয়া রাখিতাম।

বলিলাম : সিগারেট আমি বয়কট করেছি : বিড়ি আছে, দেব?

ভদ্রলোক দন্ত বিকাশ করিয়া আর একটু কাছ ঘেঁষিয়া বসিয়া বলিলেন : বিড়িই আমি ভালবাসি, দিন।

আমি তাঁহার হাতে বিড়ির আস্ত প্যাটাই দিয়া দিলাম।

ভদ্রলোক একটা বিড়ি খুলিয়া প্যাটা বেঞ্চিতে নিজের কাছ ঘেঁষিয়া রাখিয়া বলিলেন :  দেয়াশলাইটাও নিশ্চয় আছে আপনার কাছে?

আমি পকেটে হাত দিয়া দেয়াশলাইটাও তাঁহার হাতে দিলাম। তিনি বিড়িটা ধরাইয়া বিড়ির প্যাকের উপর দেয়াশলাইটা রাখিয়া দিয়া বলিলেন : আপনি সিগারেট বয়কট করেছেন? বড় ভাল করেছেন, সাহেব। ঐ সব রাবিশ দিয়েই ত ইংরাজরা আমাদের দেশটা লুটে খাচ্ছে।

আমি ঈষৎ হেলান দিয়া বসিয়াছিলাম, একেবারে সোজা হইয়া বসিলাম। ভদ্রলোক বলিতে লাগিলেন? বাঙালি জাত ভাল নয়, নইলে বয়কটটা সফল করতে পারলে শ্বেতকুষ্ঠ-মুখো শালাদের মুখ দু’দিনেই একেবারে কালাজ্বরের রোগীর মতো হয়ে যেত!

তাই ত! আমার ভাবের ভাবুক অন্ততঃ একজন লোকও বাঙলায় আছে? আমি পুলকে অধীর হইলাম। ইংরাজের বিরুদ্ধে আমার মুখ খুলিয়া গেল। এতদিনে রুদ্ধ উচ্ছ্বাস ছাড়া পাইয়া আজ নিজেকে একেবারে নিঃশেষে উজাড় করিয়া দিল।

ভদ্রলোক ছিলেন সত্যসত্যই আমারই মতো ইংরাজ-বিদ্বেষী। তিনি শুধু আমার কথায় সায় দিলেন না–আমার কথার সমর্থনে অনেক উদাহরণও দিলেন! দেখিলাম : ইংরাজ তাড়ান ব্যতীত আমাদের মঙ্গল নাই, এ বিষয়ে ভদ্রলোক আমার সঙ্গে একমত।

এ বিষয়ে আমি যে সমস্ত বাধা বিঘ্নের সম্মুখীন হইয়াছি, সে সমস্ত কথা ভদ্রলোকের নিকট খুলিয়া বলিলাম।

ভদ্রলোক বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন : আপনি ঢাকার বিদ্রোহী দলের নাম শোনেন

আমি অপ্রতিভভাবে বলিলাম : জি না, আমি খবরের কাগজ পড়ি না।

ভদ্রলোক বলিলেন : এটা খবরের কাগজের লেখা নয়–সত্যি কথা। ঢাকায় এক বিদ্রোহী দলের সৃষ্টি হয়েছে। রুশিয়ার বলশেভিকরা ওদের আদর্শ বাঙলা সরকার ওদের ভয়ে কম্পিত হয়ে উঠেছেন। ভারত-সরকার সমর-বিভাগের খরচ বাড়াবার মতলব করেছেন। আসামে একটা সামরিক ঘাঁটি তৈরির আয়োজন চলছে। ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল আপাতত ঢাকায় বিদ্রোহীদের গতিবিধি লক্ষ্য করছে।

আমি উৎসাহে লাফাইয়া উঠিলাম। বলিলাম : বলেন কি সাহেব এ-সব কথা কি সত্য? ইংরাজ তাড়াবার সত্যিকার একটা চেষ্টা হচ্ছে তা হলে?

প্রবোধ দিয়া ভদ্রলোক বলিলেন : হচ্ছে বই কি! দেশ কি আর আগেকার মতো ঘুমিয়ে আছে?

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম : আপনিও ইংরাজের শত্রু, তবে ঐ দলে ভর্তি হন নি কেন?

ভদ্রলোক চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টিপাত করিয়া গলার সুর নামাইয়া বলিলেন : কে বলেছে আমি ভর্তি হই নি? আমি ঐ দলেরই একজন নগণ্য সেবক। আপনার মতো লোক খুঁজতেই আমার কলকাতায় আসা।

ভদ্রলোকের সহিত করমর্দন করিয়া বিদায় হইলাম এবং পরদিন ঢাকার মেলে চড়িয়া বসিলাম।

.

দুই

সরকারি চাকুরিয়াদের আমি দুই চক্ষে দেখিতে পারিতাম না। কাজেই অন্য কোন বন্ধু থাকিলে আমি আমার পুরাতন বন্ধু সরকারি স্কুলের শিক্ষক আব হোসেনের বাসায় উঠিতাম না।

অনেকদিন পরে আফতাব হোসেন আমাকে পাইয়া খুব আদর-অভ্যর্থনা করিল। আমি আমার উদ্দেশ্যের কথা গোপন রাখিলাম। কারণ তাহার খাইয়া তাহাদেরই বিরুদ্ধে যড়ন্ত্র করিতে চাই, একথা তাহার নিকট বলিতে কেমন বাধ-বাধ ঠেকিল। আফতাব ও কোন কথা জিজ্ঞাস করিল না।

আমি গোপনে বিদ্রোহী সংঘের আড্ডার ঠিকানা যোগাড় করিলাম। শুনিলাম : রবিবার দিন দুপুরে এবং অন্যান্য দিন সন্ধ্যার পর সংঘের বৈঠক বসে।

সেদিন রবিবার। স্থির করিলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর আফতাব যখন তার সহধর্মিণীকে লইয়া বিশ্রাম করিবে, সেই ফাঁকে আমি বাহির হইয়া পড়িব।

কিন্তু সেদিকে আফতাবের মোটেই গা দেখা গেল না। সে খাওয়া-দাওয়া শেষ করিয়া তাহাদের ক্লাবে যাইতে আমাকে চাপিয়া ধরিল। আমি মাথা ফাঁইবার অনেক চেষ্টা করিলাম। কিন্তু সে ছাড়িল না। অগত্যা আমি জিজ্ঞাসা করিলাম ও তোমাদের ক্লাব কোথায়?

সে যে-ঠিকানা বলিল, তা শুনিয়া আমি চিৎকার করিয়া বলিলাম : সে যে বিদ্রোহীদের আচ্ছা!

আফতাব হাসিয়া বলিল : লোকে তাই বলে বটে!

আমি ঢোক গিলিয়া বলিলাম : তুমি বিদ্রোহী-দলভুক্ত? তুমি যে সরকারি চাকুরে!

আফতাব আরও হাসিতে লাগিল। বলিল : কেন সরকারি চাকুরেরা কি মানুষ নয়?

উভয়ে রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িলাম। যে বিদ্রোহী দলের লোক গবর্নমেন্টের কাজে পর্যন্ত ঢুকিয়াছে সে-দল কত শক্তিশালী, তা ভাবিয়া পুলকে আমার রোমাঞ্চ হইল! কল্পনা নেত্রে দেখিতে লাগিলাম; আমি টোটর্থ সাহেবের জায়গায় কলিকাতায় কমিশনার হইয়া বসিয়াছি, আর জেম্স সাহেব আমার নিকট চাকুরির উমেদারি করিতে আসিয়াছে, আমার আরদালি আমার হুকুমে জেমসকে বারান্দার খুটির সঙ্গে বাঁধিয়া জুতা-পেটা করিতেছে, আর সেই কুষ্ঠ-মুখো সার্জেন্টটা? অত তাড়াতাড়ি সে বেটার উপযুক্ত শাস্তি কল্পনা করিয়া উঠিতে পারিলাম না। যথা সময়ের জন্য সে ভাবনা রাখিয়া দিলাম। শুভদিনের আরামের গরম হাওয়া আমার গাত্র স্পর্শ করিল।

আমি খোদার উদ্দেশ্যে মাথা নত করিলাম।

পথে যাইতে যাইতে আফতাব এক মুদি দোকান হইতে দু’পয়সার দু’পুরিয়া চিনি কিনিয়া এক পুরিয়া আমাকে দিল এবং অপরটি নিজের পকেটে রাখিল।

আমি বিস্ময়ে বলিলাম : চিনি দিয়ে কি হবে?

আফতাব বলিল : আমাদের দলের প্রধান উদ্দেশ্য প্রথা ও সংস্কারের দাসত্ব থেকে মানুষের মানসিক মুক্তি সাধন।

আমি বলিলাম : সাধু উদ্দেশ্য। এই ত চাই। কিন্তু এর সঙ্গে চিনি কেনার সম্বন্ধটা কি, স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না।

আফতাব গভীরভাবে বলিল : আমাদের ক্লাবে চা খাওয়া হয়ে থাকে; তাই বলে চা খাওয়ার নিয়ম আছে, একথা বলতে পার না। কারণ কোন নিয়ম-কানুন আমরা মানি না। নিয়ম-কানুন, আইন-শৃঙ্খলা ও বিধি-নিষেধ নামে মানুষের আত্মার স্বাধীনতার পরিপন্থী। যেসব গতানুগতিকতা আছে, এসব পদদলিত করাই আমাদের সংঘের উদ্দেশ্য।

আমি বলিলাম ও এর সঙ্গে চা খাওরার সম্বন্ধটা কি হল?

আফতাব অসহিষ্ণুভাবে বলিল : আগে শোনোই না। আমাদের দলে চা খাওয়া হয়ে থাকে বটে, কিন্তু তাতে দুধ-চিনি খাওয়ার নিয়ম নেই। কারণ আমাদের মনে ওটা একটা প্রথা, একটা নিয়ম, একট। গতানুগতিকতা। নিয়ম মাত্রেই বাঁধন। চায়ে চিনি খাওয়া একটা নিয়ম! সে নিয়ম ভাঙাই আমাদের আদর্শ। কিন্তু আমরা আজও সম্পূর্ণ সংস্কার মুক্ত হতে পারিনি বলে চিনি ছাড়া চা খেতে পারি না। তাই বলে দলের আদর্শও নষ্ট করতে চাই না। সে জন্য দলের মেম্বররা আড্ডায় যাওয়ার সময় পকেটে চিনি নিয়ে যায়। অবশ্য চিনির দামটা মাসিক চাঁদা থেকে বাদ পেয়ে থাকে। এর উপর যাদের সামর্থ আছে, তারা কনডেনস্ড় মিল্কও নিয়ে যায়; আমি কিন্তু দলের আদর্শের অতটা বিরুদ্ধতা করার আবশ্যকতা বোধ করি না। আমরা চিনি খাই বটে, কিন্তু দলের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনহেতু সেটা সকলে অতি গোপনে খেয়ে থাকি। এই যে আমরা এসে পড়েছি। বলিতে বলিতেই আমরা একটি মাঝারি রকমের একতালা বাড়ির গেটে উপনীত হইলাম।

বাড়িটা আগে ভাল ছিল বলিয়াই বোধ হইল; সামনে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা। সেটাতে নানা প্রকার আগাছা জন্মিয়াছে। তারই মধ্যদিয়া একটি সরু রাস্তা।

আফতাব বলিল? আগে সেখানে একটি বাগান ছিল; কিন্তু বাগান মূর্তিমান নিয়ম শৃঙ্খলা বলিয়া বিদ্রোহীদ সেটা নষ্ট করিয়া দিয়াছে।

আমি কিছু বলিলাম না। ভাবিলাম বাড়িটা বিদ্রোহীদের আড্ডা হইবার মতো বড়ো গাছ বটে, কিন্তু উহা এত খোলা জায়গায় অবস্থিত যে, পুলিশের পক্ষে বিদ্রোহীদের গতিবিধি লক্ষ্য করা খুবই সহজ।

গেটে প্রবেশ করিয়াই একটা বিষম কোলাহল শুনিতে পাইলাম। সে কোলাহল আড্ডা হইতেই আসিতেছিল বলিয়া বোধ হইল।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম : এ আবার কি আফতাব?

আফতাব বলিল : দলের সভ্যরা গান গাইছে।

আমি বিস্ময়ে বলিলাম : গান? এমন তুমুল কোলাহলকে তুমি গান বলছ?

আফতাব গম্ভীর মুখে বলিল : সংস্কারমুক্ত হতে তোমার ঢের দেরি। গান সম্বন্ধে তুমি আজো মান্ধাতার আমলের ধারণা নিয়ে বসে আছ। জগৎ আজ সভ্যতার পথে দৈনিক কি স্পিডে এগিয়ে যাচ্ছে, তার কিছু খবর রাখ?

আমি মনে মনে স্বীকার করিলাম। আমি সত্যই সংস্কারমুক্ত নই।

.

তিন

আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম : সকলেই হা করিয়া চিৎকার করিতেছেন। কেহ হারমনিয়মে, কেহ বলে, কেহবা তদভাবে পাশে বসা বন্ধুর পিঠে হাত চালাইতেছেন। কেহ কথা বলিতেছেন এবং কেহ গান গাইতেছেন নিশ্চয়ই; কিন্তু কে কোন কাজ করিতেছেন, সে সম্বন্ধে নির্ভুল উক্তি করিবার কোনও উপায় নাই।

আফতাবের পিছনে আমাকে দেখিয়া প্রায় সকলেই আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। আমি ঘরে প্রবেশ করিয়াই অভ্যাসবশত ‘আসসালামু আলায়কুম’ বলিলাম। অমনি, সকলে সমস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিলেন? কে এ প্রথার দাস, সংস্কারের গোলাম, আমাদের দলের পবিত্রতা নষ্ট করছে?

আফতাব আমার কানে-কানে বলিল : ভুল করেছ। এখানে সালাম আদাবের নিয়ম নাই। ওটা একটা প্রথা।

তারপর সে অন্যান্য সকলের ন্যায় চিৎকার করিয়া বলিল? আপনারা অস্থির হবেন না, নতুন লোক। ইনি আমার বন্ধু, আমাদের দলে দীক্ষা নেবার জন্য আজ নতুন এখানে এসেছেন।

সকলে শান্ত হইলেন অর্থাৎ আগের ন্যায় গোলমাল আরম্ভ করিলেন।

আমাকে লইয়া আক্তাব একপাশে বসিয়া পড়িল! আমার সামনে লজ্জাবশতই হোক, কিম্বা অন্য কোন কারণেই হোক, আফতাব সদস্যদের ‘গানে যোগ দিল না।

আমিও অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিলাম। কিন্তু আমার বুদ্ধি-বিবেচনা ছিল। আমি মনে করিলাম : হাজার হোক বিদ্রোহের পথে ইহাদের তুলনায় আমি নতুন পথিক; কাজেই ইহাদের কার্যের গূঢ় তাৎপর্য বুঝিতে হয়ত আমার একটু দেরি হইতেছে।

নতুন করিয়া ইহাদের প্রতি শ্রদ্ধার সঞ্চার হইল। মনোযোগ দিয়া ইহাদের কার্যাদি লক্ষ্য করিতে লাগিলাম।

এক ভদ্রলোক ‘গণ্ডগোল আরম্ভ করুন’ ‘গণ্ডগোল আরম্ভ করুন’ বলিয়া তিন-চার বার চিৎকার করিলে সকলে নীরব হইলেন। আফতাব আমার কানের কাছে বলিল : সরদার খুব বড় উকিল।

সরদার দাঁড়াইয়া বলিলেন : ‘ব্রাদার-ইন-ল’গণ (বিস্ময়ে আমি আফতাবের মুখের দিকে চাহিলাম, সে মুখে আঙ্গুল দিয়া আমাকে নীরব থাকিতে ইংগিত করিল) আমাদের আজিকার দরবারে কনক্লডি সং’ শেষ হয়েছে। এখন চা খেয়ে সবার কাজ আরম্ভ করা যাক। ‘ব্রাদার-ইন-ল’ আফতাবের মুখে তোমরা শুনেছ, আজ এক নতুন ‘ব্রাদার-ইন-ল’ আমাদের দলে দীক্ষা নিতে এসেছে; সুতরাং আজকে চা খাওয়ায় তোমরা পুরোপুরিভাবে প্রথা ও সংস্কার মুক্ত হয়ে চলবে, এই আমার কড়া হুকুম।

সকলে সমস্বরে চিৎকার করিলেন : চা।

অমনি জনৈক চাকর চা দিয়া যাইতে লাগিল। কেহ কাহারও অপেক্ষা না করিয়া চা খাইতে লাগিলেন। লক্ষ্য করিলাম : সকলেই পকেট হইতে মুঠ ভরিয়া চিনি মুখে দিয়া তারপর পিয়ালায় চুমুক দিতেছেন, মুখের চিনি ফুরাইয়া গেলে আরেক মুঠা মুখে দিতেছেন। এইভাবে সবাই চা পান করিলেন। আমিও করিলাম।

চা খাওয়ার পর সরদারের হুকুমে আমাকে তাঁহার নিকট লইয়া যাওয়া হইল। তিনি আমাকে পাশে দাঁড় করাইয়া বলিলেন : ‘ব্রাদার-ইন-ল’ আমাদের মতে দীক্ষা নিতে কোন আচার, প্রথা বা অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয় না; কাজেই এখানে বাইয়াৎ পড়া বা মাথা মুড়ানোর দরকার নেই, পাগড়ি বা শালগ্রাম শিলারও আবশ্যকতা নেই। আমাদের আদর্শ কাজে পরিণত করতে যারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন, তাঁরাই আমাদের ‘ব্রাদার-ইন-ল’। তুমি আমাদের দলে ভর্তি হচ্ছ, সুতরাং তোমার সঙ্গে ভদ্রতা করে আমি গতানুগতিকতার প্রশ্রয় দিতে চাই না। আমাদের মটো তোমার মুখস্থ হয়েছে ত?

আমি অপ্রস্তুত হইয়া বলিলাম : জি না, আপনার দলের মটো ত আমার জানা নেই।

সরদার প্রবোধ দিয়া বলিলেন : আচ্ছা, আচ্ছা। দু’চার দিন চেষ্টা করলেই মুখস্থ হয়ে যাবে। ওই দেখ।

–বলিয়া তিনি চারিদিককার দেওয়ালে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন। আমি দেখিলাম, দেওয়ালের বিভিন্নস্থানে বড় বড় হরফে লেখা আছে?

মোরা, অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
মোরা দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম-কানুন শৃঙ্খল!
মোরা ভীম ভাসমান মাইন,
মোরা মানিনাকো কোন আইন।
মোরা বিদ্রোহী বীর,
মোরা চির-উন্নত শির।
বল বীর!

আমি চারিদিকে চোখ ফিরাইলাম : সরদার বলিলেন : যত অনিষ্টের মূল এই আইন। যেদিকে কান পাত, যেদিকে চোখ ফেরাও কেবল নিয়ম-কানুন, আইন-শৃঙ্খলা, প্রথা সংস্কার, ল’ এ অর্ডার। এইসব আইন-শৃঙখলার বন্ধনের জন্যই মানুষের আত্মা মুক্তি পাচ্ছে না। এই সমস্ত বিধি-নিষেধের চাপে মানুষের আত্মা নুয়ে পড়ছে। মানুষের কল্যাণ করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন আত্মার মুক্তি। আত্মার মুক্তি সাধন করতে হলে সমস্ত। আইন-কানুনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হবে, সমস্ত বিধি নিষেধের বন্ধন পদাঘাতে ছিন্ন করতে হবে। এই আইন-কানুনের দোহাই দিয়ে, বিধি নিষেধের ছুতা করে, কত লোক অপর সহস্র লোককে দাস করে রেখেছে, তাদের মুক্তির পথ আগলে বসে আছে। এই। আইন-কানুন বিধি-নিষেধের বেড়ি ভাঙাই আমাদের জীবনের ব্রত। এজন্য আমরা প্রাণপাত করতে প্রস্তুত। আমরা নিজেরা কোনও আইন-শৃঙ্খলা বা বিধি-নিষেধ মানি না। সমস্ত গুতানুগতিকতা বিসর্জন দিয়ে চলি। ওই যে দেখছ, দেওয়ালের লেখা আছে : Spitting liberally allowed (যত ইচ্ছা থুথু ফেল), Simoking strictly prohibited (ধূমপান একেবারে নিষিদ্ধ)-ওর গূঢ় তাৎপর্য অবশ্য তুমি বুঝছ। এ ঘরের ভেতর থুথু কেউ ফেলবে না বটে, কিন্তু সে সম্বন্ধে কোনও বাধ্যবাধকতা থাকলে। সদস্যদের মনে বিধি-নিষেধের দাসত্ব বর্ধিত হবে এবং তাতে করে তাদের আত্মার মুক্তি অসম্ভব হয়ে পড়বে। বরঞ্চ এই যে থুথু ফেলবার অবাধ অধিকার দেওয়া সত্ত্বেও এরা কেউ থুথু ফেলছে না, এতে কি তাদের মুক্ত বুদ্ধিই সূচিত হচ্ছে না? আর ঐ স্মোকিং-এর কথা। ওই বড় বড় অক্ষরের নিষেধ বাক্য চোখের সামনে নিয়েও যে সদস্যরা বেদম ধুমপান করছে, এতে করে কি তাদের মধ্যে একটা বিদ্রোহের ভাবই কর্ষিত হচ্ছে না? তুমি লক্ষ্য করেছ, আমাদের দলের সদস্যরা চুপ করতে বললে গণ্ডগোল করে আর গণ্ডগোল করতে বললে চুপ করে। সদস্যদের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব কর্ষণ করার জন্যই এরূপ করা হয়ে থাকে। আমি সরদার বলে সদস্যরা যে আমার কথামত চলে, তা তুমি মনে করো না। এই যে চা খাওয়ার সময়, বিশেষ করে আজকার দিনটায়, চাতে চিনি খেতে বারণ। করেছিলাম, তার উত্তরে সবাই যে আজ বেশি করে চিনি খেল, তাতে আমি বড়ই আনন্দিত হয়েছি। আমরা কেউ ছোট-বড় নই, সবাই আমরা সমান। আমরা জীবনের সর্বত্র ডিমোক্রেসি প্রবর্তনের পক্ষপাতী। তুমি লক্ষ্য করেছ, সংগীতেও আমরা ডিমোক্রেসি প্রবর্তন করেছি। একজন গান করবে আর সবাই শুনবে, এ ছিল গত যুগের মনাকিকাল সিস্টেম-অব-সং। আমরা সমস্ত মনাকির উচ্ছেদ করতে চাই। সকলের যে গান গাওয়ার। অধিকার আছে, মানুষের এই চিরন্তন জন্মগত অধিকার আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু এই ডিমোক্রেসি প্রবর্তন করতে গিয়েও আমরা প্রথা ও গতানুগতিকার কবলে পড়িনি। আমরা পরস্পরকে সমান মনে করি বটে, কিন্তু সম্বোধন করবার বেল; ‘ভাই’ ‘ব্রাদার’ বলে। গতানুগতিকার প্রশ্রয় দিই না।

এই পর্যন্ত বলিতেই সভায় শোরগোল উঠিলঃ সরদার ‘ব্রাদার-ইন-ল’র বক্তৃতা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। বেশি কথা আমরা শুনব না।

সরদার বলিলেন : ‘ব্রাদার-ইন-ল’গণ, তোমাদের বিদ্রোহের ভাবে আমি গর্ববোধ করছি। আমি আমার বক্তৃতা আর দীর্ঘ করব না। এই নতুন ‘ব্রাদার-ইন-ল’কে আমাদের আদর্শ বুঝাতে গিয়েই আমাকে এত কথা বলতে হয়েছে। সবাই একে ‘ব্রাদার-ইন-ল’ বল।

সকলে সমস্বরে চিৎকার করিল ও ‘ব্রাদার-ইন-ল’।

সরদার আমাকে বলিলেন : ‘ব্রাদার-ইন-ল’।

আমি বলিলাম : ‘ব্রাদার-ইন-ল’।

সরদার বলিলেন : ব্যাস, দীক্ষা কার্যকর হয়ে গেল।

.

চার

দীক্ষা পাইয়া আমি বলিলাম ও আমার গুটিকতক প্রশ্ন করবার আছে।

সরদার বলিলেন : বল।

আমি বলিলাম : ইংরাজ তাড়াবার আপনারা কদুর কি করেছেন?

সরদার একটু চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। বলিলেন : ইংরাজ তাড়ান মানে কি?

আমি বলিলাম : আপনাদের বিদ্রোহ ইংরাজের বিরুদ্ধে ত?

সরদার সমস্ত সদস্যের দিকে একবার চক্ষু ফিরাইয়া লইয়া বলিলেন : কেবল ইংরাজ কেন? বিধি-নিষেধের বেড়াজালে আটকিয়ে যারা মানুষের আত্মাকে খর্ব করছে, তাদের সবারই বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহ।

আমি বলিলাম ও ইংরাজ জাতি আজ বিধি-নিষেধের নিগড়ে ভারতের ত্রিশ কোটি লোকের হাত-পা বেঁধে রেখেছে। ওদের এদেশ থেকে তাড়াতে পারলে তবেই এই ত্রিশ কোটি লোকের মুক্তি হবে, এটা কি আপনারা মনে করছেন না?

সরদার বলিলেন : নিশ্চয়, নিশ্চয়। কিন্তু ইংরাজ আমাদের হাত-পাই বেঁধে রেখেছে, আত্মাতো বাধে নি। আমাদের স্কুল দেহই ইংরাজের অধীন, আমাদের সূক্ষ্ম দেহের উপর তাদের কোন হাত নেই। যত সব বিধি-নিষেধই আমাদের সূক্ষ্ম দেহকে বন্ধনের অধীন করে রেখেছে। সে জন্য ইংরাজের চেয়ে আমাদের বড় শত্রু এই সমস্ত কুসংস্কারপূর্ণ বিধি-নিষেধ। এ সমস্ত নিগড় না ভাঙলে সভ্যতার পথে আমাদের পথ চলা অব্যাহত হবে না। বিধি-নিষেধের বন্ধনের চাইতে তুমি যে ইংরাজের বাধনকেই বড় করে দেখেছ, এতে করে তুমি মানুষের দেহকে আত্মার উপর স্থান দিচ্ছ।

আমি উষ্ণ হইয়া বলিলাম : জালিয়ানওয়ালাবাগ, চরমনাইর, কুলকাঠি প্রভৃতি স্থানে যেভাবে মানুষকে কীট-পতঙ্গের মতো পিষে মারা হয়েছে, দেশবাসীর সাধারণ নাগরিকের অধিকার যেভাবে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে, এ সকলকে কি আপনারা আমাদের আত্ম-বিকাশের পরিপন্থী মনে করেন না?

সরদার কোন কথা বলিবার আগেই সকলে চিৎকার করিয়া উঠিলেন? এ সবই চিন্তার দৈন্য; বুদ্ধির দাসত্ব। নতুন ‘ব্রাদার-ইন-ল’ আজও সংস্কারমুক্ত হতে পারেনি।

সরদার বলিলেন : শুনলে ত? তুমি আজো সংস্কারমুক্ত হতে পারনি। এ-সব তোমার জাতি-বিদ্বেষ-রেশিয়াল হ্যাঁট্রেড, ১৫৩-ক ধারার অপরাধ। সমস্ত বিষয় বিশ্ব মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখো৷ ইংরাজের অত্যাচারে এবং ভারতবাসীর অত্যাচারে মূলত কোন পার্থক্য নেই। এই সমস্ত তুচ্ছ অজুহাতে যারা জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছে, তারা সংকীর্ণ সংস্কারের দাস, বিশ্ব-মানবতার শত্রু।

আমি মনে মনে এই সমস্ত যুক্তির সারবত্তা স্বীকার করিয়া বলিলাম : আমি শুধু অত্যাচারের কথাই বলছি না। ইংরাজদের আমাদের দেশ শাসন করার কি অধিকার আছে?

সরদার হাসিয়া বলিলেন : এ সমস্তই পূর্ব-সংস্কার। ‘ইংরাজ জাতি’ ‘ভারতবাসী’ এ সবই বিশ্ব-মানবতার পরিপন্থী গণ্ডি-সংস্কার। বিশ্ব-মানবতা যাদের আদর্শ তাদের মধ্য ইংরাজ-বাঙালি-তুর্কীতে কোন ভেদজ্ঞান নাই। আর দেশ শাসনের কথা যে বলছ, দেশ শাসন কি আর সবাই করে। কতিপয় নির্দিষ্ট লোকই দেশের শাসনযন্ত্র পরিচালনা করে। এই নির্দিষ্ট কতিপয় কোন জাতের লোক তা যারা দেখে, তাদের দৃষ্টি সম্প্রসারিত হয়নি, তারা গতানুগতিকতার প্রভাব এড়াতে পারেনি, তারা প্রথা ও সংস্কারমুক্ত হতে পারেনি। আশা করি আমাদের দলের শিক্ষায় তোমার দৃষ্টি উন্নত হবে। আজকার সভার কাজ এখানে শেষ করা যাক। ‘ব্রাদার-ইন-ল’গণ তোমরা এবার ‘ওপেনিং সংটা’ গাও ত।

সকলে ডেমোক্রেটিক সংগীত আরম্ভ করিলেন।

আমরা বধির হইবার উপক্রম হইলেও কোন রকমে চোখ কান বুজি বসি রহিলাম।

.

পাঁচ

বিদ্রোহীদলের কাজ-কর্ম দেখিয়া আমি একরূপ নিরাশই হইয়া গিয়াছিল।

তবু কিন্তু দুইটি কারণে আমি ঢাকায় থাকিয়া গেলাম এবং বিদ্রোহীদলের বৈঠকে যোগদান করিতে লাগিলাম। প্রথম কারণ, আমার উত্তেজনা অনেকখানি কমিয়া যাওয়ায় এখন কি করা যায়, সে সম্বন্ধে অনিশ্চয়তা; দ্বিতীয় কারণ, বিদ্রোহীদল হয়ত নতুন বলিয়া আমাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতেছে না, এই সন্দেহে।

কিন্তু সপ্তাহকাল থাকিয়াও বিদ্রোহীদলের অস্ত্রের আড়ার কোন সন্ধান পাইলাম না। বিদ্রোহীদলের উপর রাগ হওয়া সত্ত্বেও কার্যান্তর না থাকায় উহাদের সহিত সম্পর্কচ্ছেদও করিলাম না।

একদিন রমনার মাঠে লেকের ধারে বসিয়া আকাশ-পাতাল ভাবিতেছি, এমন আমার কলিকাতার গড়ের মাঠে বন্ধু আসিয়া হাজির। আমি বিস্ময়ে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলাম : কি ‘ব্রাদার-ইন-ল’ আপনি এখানে? কোলকাতা থেকে কবে এসেছেন? দলে ত আপনাকে দেখতে পাওয়া যায় না।

বন্ধু হাসিয়া বলিলেন : বেশ ত এরই মধ্যে দলের সম্বোধনটা আয়ত্ত করে ফেলেছেন। তা, আছেন কেমন? দল লাগছে কেমন? এই বলিয়া তিনি আবার হাসিলেন।

আমি রাগতস্বরে বলিলাম : খুব বিদ্রোহীদলে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। বলুন ত সাব, আপনার মতলবখানা কি? রাগ করবেন না, আপনাকে আমার সত্যি সত্যি ‘ব্রাদার-ইন-ল’ ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছে।

 ভদ্রলোক উচ্চস্বরে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।

আমি বিরক্তিভরে লোকটার হাসি থামিবার অপেক্ষায় অন্যদিকে মুখ ফিরাই! রহিলাম। অবশেষে হাসি থামাইয়া তিনি বলিলেন : আপনার যে পরিচয় পেয়েছি, তাতে আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা জন্মেছে। আপনি আমার কেবল ‘ব্রাদার-ইন-ল’ নন, আপনি আমার ধর্মের ভাই। আপনার নিকট আসল কথা আর গোপন রাখব না। আমি পুলিশের মি-আই-ডি বিভাগের লোক। এই বেটাদের মুখে দিনরাত বিদ্রোহের বুলি শুনে শুনে আমাদেরও প্রথমটা মনে হয়েছিল, চাই কি এরা ইংরাজের সাম্রাজ্যই চুরমার করে দেয়। তাই বড় মুখে বড় সাহেবের কাছে এদের সম্বন্ধে এত্তেলা নিয়েছিলাম এবং একটা বড় রকমের খানাতল্লাশেরও যোগাড় করে ফেলেছিলাম। আশা করেছিলাম, এতবড় একটা কেসের আশকারা করছি বলে ডবল প্রমোশনও একটা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সন্ধান নিয়ে দেখি কি, ওদের একটা বেটার মধ্যে রিভোলিউশনারি স্পিরিট নেই–সব বেটাই গর্দভ। বন্ধুরা বললে? ঐ গর্দভদের ধরিয়ে দিলে বড় সাহেব রাগ করবেন, চাই কি আমার চাকুরিও যেতে পারে। তাই দু’চার জন সত্যিকার রিভোলিউশনারিকে ঐ দলে ঢুকবার জন্য কিছুদিন আমাকে ঢাকা-কোলকাতা ছুটাছুটি করতে হয়েছে। এখন খোদার ফজলে আমি বেঁচে গিয়েছি। বড় সাহেব ইনকোয়ারির আদেশ না দিয়েই রিটায়ার করে গেছেন। আপনাকে বৃথা তকলিফ দিলাম। মাফ করবেন। আসসালামু আলায়কুম।

–বলিয়া ভদ্রলোক হন হন করিয়া চলিয়া গেলেন। আমি ক্রোধে ফুলিয়া উঠিয়াছিলাম! লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলাম : বেটা ‘ব্রাদার-ইন-ল’।

বাসায় ফিরিয়া আফতাবকে সব খুলিয়া বলিলাম। সে সি-আই-ডির উদ্দেশ্যে কটুক্তি করিয়াই চুপ করিয়া গেল।

আফতাব কথাটা কিভাবে দলে রিপোর্ট করিয়াছিল জানি না। দেখলাম ও দলের সবাই আমাকে এড়াইয়া চলিতে চাহিতেছেন।

সরদার আমাকে বলিলেন : তোমাকে আমরা প্রথমেই জানিয়েছি, বিশ্ব-মানবতাই আমাদের আদর্শ। এতদিনেও যদি তোমার মন থেকে সংকীর্ণ জাতি-বিদ্বেষ দূর হয়ে না থাকে, তবে তোমার আর আশা নেই।

আরেকদিন আড্ডার দ্বারে পা দিয়াই শুনিতে পাইলাম, সরদার বলিতেছেন : লোকটাকে আজই বিদেয় করে দাও। আর ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সাহেবের কাছে এখনই এই মর্মে দু’খানা পত্র লিখে দাও যে, বিশ্বমানবতাই আমাদের আদর্শ, সোশিয়্যাল রিফর্মই তোমাদের কর্মপদ্ধতি, আর রাজ-ভক্তি প্রচারই আমাদের জীবনের ব্রত, বৃটিশ সাম্রাজ্যের জন্য আমরা প্রাণ দিতে পারি। আর শোন, লিখে দাও যে আমাদের সভাপতির মামাত ভাই গত মহাযুদ্ধে সাম্রাজ্যের জন্য প্রাণ দিয়েছেন!

আমি একটু দেরি করিয়া ঘরে প্রবেশ করিলাম।

সরদারই প্রথম কথা বলিলেন : তোমার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করে গতানুগতিকতার প্রশ্রয় দিতে চাই নে। নইলে তোমাকে ‘আপনি’ এবং ‘জনাব’ বলে জানিয়ে দিতুম–আপনার সঙ্গে আমাদের আর সম্বন্ধ নেই। আশা করি, এতেই তুমি বুঝতে পাচ্ছ, কাল থেকে আর তোমার এখানে আসার দরকার নেই! এখনই তোমাকে বিদেয় করলে রাগ প্রকাশ করা হবে। রাগ একটা প্রথা, একটা গতানুগতিকতা। আমরা যে তোমার উপর রাগ করিনি, এখনি তার প্রমাণ দিচ্ছি। ওরে কে আছিস, এক কাপ চা নিয়ে আয় ত।

এত ক্রোধেও আমার হাসি পাইল। আমি হাসিয়া বলিলাম : চা যে দিবেন আমি আজ ত চিনি আনিনি।

সরদার বলিলেন : আত্মার দৈন্য! বেচারা সংস্কারমুক্ত হতে পারেনি। ওহে তোমরা কেউ যদি চিনি এনে থাক, চুপে-চুপে ওকে খানিকটা দিয়ে দাও।

আমি হাসিয়া বলিলাম : না ‘ব্রাদার-ইন-ল’, আমার চার দরকার নেই আমি আসি।

কিন্তু উঠিলাম না। পুলিশ সাহেব ও ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট লিখিত পত্রদ্বয়ের অবস্থা জানিবার জন্য বসিয়া রহিলাম।

আমার সরিবার কোন গতিক না দেখিয়া সরদার হুকুম করিলেন : আমার সেই জরুরী পত্র দু’খানা কি ডাকে দেওয়া হয়েছে? না হয়ে থাকলে জলদি পাঠিয়ে দাও।

বলিয়া তিনি জনৈক সদস্যের দিকে ইংতি করিলেন।

খানিক পরেই চাকর পত্র দু’খানা লইয়া সাইকেলে বাহির হইয়া গেল।

সুতরাং আমিও উঠিবার আয়োজন করিলাম।

এমন সময় হঠাৎ পত্র-বাহক চাকরটা ছুটিয়া আসিয়া হাঁপাইতে-হাঁপাইতে বলিল : এই দিকে একপাল পুলিশ আসছে দেখে এলুম।

সবাই একসঙ্গে চিৎকার করিয়া উঠিলেন? তবেই হয়েছে, শালার পুলিশ আসছে আমাদের গ্রেফতার করতে!

–বলিয়া সবাই ছুটাছুটি করিয়া পালাইতে লাগিলেন।

সরদার চিৎকার করিয়া বলিলেন : ‘ব্রাদার-ইন-ল’ তোমরা গতানুগতিক উপায়ে পালিও না; আত্মরক্ষার চিরন্তন সত্যকে স্বীকার করতে গিয়ে তোমরা অপবিত্র প্রথার প্রশ্রয় নিয়ে আমাদের সংঘের উদ্দেশ্যের অপমান করো না।

–বলিয়া তিনি সম্পূর্ণ অভিনব ধরনের পদক্ষেপ করিয়া নিতান্ত অসাধারণ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সর্বাগ্রে প্রাচীর টপক-ইয়া সৃটকিয়া পড়িলেন! সকলে তাহাকে অনুসরণ করিলেন।

আমি বিদ্রোহী বীরদের কাণ্ডকারখানা দেখিয়া বহুক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া রহিলাম। তারপর যখন বাহিরে আসিলাম, তখন রমনার ময়দান নির্জাতায় খা খা করিতেছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *