3 of 3

বিদ্রোহী ভগবান

বিদ্রোহী ভগবান

আমার সঙ্গে হঠাৎ ভগবানের ‘দেখা’ হয়ে গেল। তিনি আমাকে বললেন, ভগবানের সঙ্গে দেখা হলে মানুষকে কিছু চাইতে হয়। যুগ যুগ ধরে এটাই নিয়ম। ভগবানের কাছে চাও।

আমার খুব রাগ হলো মানুষকে এভাবে ‘কাঙাল’ বলায়। হঠাৎ ঠাকুরের কথা মনে পড়ল। ভগবানকে বললাম, শ্রীরামকৃষ্ণ তো আপনার কাছে কিছু চাননি।

ভগবান হাহা করে হাসলেন। হেসে বললেন, কে বলেছে তোমাকে, রামকৃষ্ণ কিছু চাননি? তাঁর মতো ধুরন্ধর পৃথিবীতে আর একটাও জন্মেছে? তিনি তো ঘটি, বাটি চাননি, চাইলে তো আমার পক্ষে সহজ হতো। ওস্তাদ লোক! তিনি চেয়ে বসলেন আমাকেই! বলেন কিনা, তোমার ঐশ্বর্য-ফৈশ্বর্য চাই না। সে যে চায় চাক, আমি তোমাকে চাই।

প্রশ্ন করলাম, তাই নাকি! এই যে শুনি, তিনি বিবেক-বৈরাগ্য, শুদ্ধাভক্তি চেয়েছিলেন।

ঐ তো তোমাকে বললাম, ‘মহা ধুরন্ধর’! তুমি যদি আমাকে বল—ভগবান, তোমার কাছে আমি একটা পাঞ্জাবির পকেট চাই, তাহলে আমাকে কি করতে হবে?—তোমাকে একটা পাঞ্জাবি দিতে হবে। তুমি যদি কান চাও, আমাকে মাথাটাই দিতে হবে। বিবেক-বৈরাগ্য, শুদ্ধাভক্তি-সে তো আমিই। ‘বাঁশবেড়ে’ আর ‘বংশবাটী’ দুটোই তো এক জায়গা! ভোলানাথকে চাইলে বিশ্বনাথকেই চাওয়া হলো। রমলা শেখরের বউ, উমার মা, রমার মেয়ে। রমলাকে চাওয়া মানে একইসঙ্গে কতজনকে চাওয়া! তোমার রামকৃষ্ণকে বিবেক-বৈরাগ্য আর শুদ্ধাভক্তি দিতে গিয়ে আমার কি হাল হলো বল!

কি হলো! আপনি তো সবকিছুর মালিক ভগবান!

আরে ধুর! আমার কাছে হীরে, জহরত, রাজবাড়ি, সিংহাসন, জমি- জিরেত, রাজ্যপাট চাইলে ব্যাপারটা কিছুই নয়। এখন তুমি যদি বল—’দই পেতে দাও’, তাহলে?

তাহলে আবার কি? দুধও আপনার, সাজাও আপনার।

পাত্রটা?

কেন, মাটিও আপনার, কুমোরও আপনার, একটা ভাণ্ড যোগাড় করা কি আর এমন কঠিন কাজ আপনার পক্ষে!

ওহে, রামকৃষ্ণ চেয়েছিলেন বিবেক-দধি। সেটি পাততে হবে চিত্ত-পাত্রে। দুধ হলো জীবন। তার জন্য নির্জনতা চাই, অচঞ্চল একটি অবস্থান চাই, উপযুক্ত একটু উত্তাপ চাই। এগুলোই দই বসার শর্ত। সেসবও তো তৈরি করে দিতে হলো তাঁর মনে। সে কি সহজ কাজ!

তিনি দই চাইলেন কেন?

ঐ যে বললাম, অতিশয় ধুরন্ধর! দই থেকে ঘোল করবেন, তারপর সেই ঘোল মন্থন করে মাখন তুলবেন।

তার মানে লক্ষ্য হলো মাখন!

হ্যাঁ, তিনি মাখনের মতো সংসার-জলে ভেসে থাকবেন, মিশে যাবেন না। সুখ-দুঃখ, জরা-মৃত্যু, জয়-পরাজয় তাঁর কিছুই করতে পারবে না। তাঁর চাওয়াটা একবার ভেবে দেখ!

তিনি তো সেইভাবেই আমাদের সংসারে থাকতে বলে গেছেন।

শোন, বলা এক, করা আরেক। বই খুললেই অজস্র বলা পাবে, কিন্তু জীবন খুললে কটা জীবনে সেইসব বলা পাবে? ভড়ভড় করে শাস্ত্র আওড়ালেই কি ভগবান মেলে?

আচ্ছা শ্রীভগবান, মনে হচ্ছে আপনার হাতে কিছু সময় আছে, তাহলে আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাবেন?

কেন যাব না, আমার তো এখন ‘ভ্যাকেসান’ চলছে। স্কুলে যেমন সামার ভ্যাকেসান, সেইরকম পৃথিবীতে এখন ‘সিভিলাইজেসান স্যাংসান’ চলছে। সভ্যতায় তো সৎ-চিৎ-আনন্দ-সচ্চিদানন্দ থাকে না। ধর্ম, আদর্শ, ন্যায়, নীতি, সদাচার সব চিৎ হয়ে হাত-পা নাড়ছে অসহায়ের মতো তোমাদের সভ্যতায়। ভাগবত পড়েছ?

ঐ সংক্ষিপ্ত আকারে, তাও অনুবাদ।

যাক, তুমি তো তবু নামটা শুনেছ! নারদ পৃথিবী ভ্রমণ শেষে বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন। জায়গাটার নাম ‘বিশালনগরী’। সনকাদি ঋষিকুমারগণ তাঁকে ঐভাবে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করছেন—”কথং ব্রহ্মণ্ দীনমুখঃ কুতশ্চিন্তাতুরো ভবান্।” (ভাগবত, ১।১।২৬)—আপনি এমন উদাস কেন, চিন্তাতুর কেন?

“ইদানীং শূন্যচিত্তোঽসি গতবিত্তো যথা জনঃ।
তবেদং মুক্তসঙ্গস্য নোচিতং বদ কারণম্।।” (ভাগবত, ১।১।২৭)

ধরেছে ঠিক। নারদ সমস্ত আসক্তিশূন্য মুক্তপুরুষ, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে হৃতধন ব্যক্তির মতো শূন্যচিত্ত, ব্যাকুল। কারণটা কি? বিমর্ষ নারদ বললেন, শোন বাবারা। আমি পৃথিবীকে সর্বোৎকৃষ্ট লোক ভেবে এখানে এসেছিলাম—

“অহন্তু পৃথিবীং যাতো জ্ঞাত্বা সর্বোত্তমামিতি।
পুষ্করঞ্চ প্রয়াগঞ্চ কাশীং গোদাবরীং তথা।
হরিক্ষেত্রং কুরুক্ষেত্রং শ্রীরঙ্গং সেতুবন্ধনম্।।” (ভাগবত, ১।১।২৮-২৯)

—এখানে পুষ্কর, প্রয়াগ, কাশী, গোদাবরী, হরিদ্বার, কুরুক্ষেত্র, শ্রীরঙ্গ, সেতুবন্ধ-রামেশ্বর—সর্বত্র ঘুরে এলাম। “নাপশ্যং কুত্ৰচিচ্ছম মনঃসন্তোষকারকম্।” (ভাগবত, ১১।৩০)–কোথাও আমার মনের সন্তোষপ্ৰদ শান্তি পেলাম না। কলি সব শেষ করে দিয়েছে।

“সত্যং নাস্তি তপঃ শৌচং দয়া দানং ন বিদ্যতে।
উদরম্ভরিণো জীবা বরাকাঃ কূটভাষিণঃ।।” (ভাগবত, ১।১।৩১)

-সত্য, তপস্যা, শৌচ, দয়া ও দান কিছুই নেই। দীন জীবেরা কেবল পেটের চিন্তায় অস্থির, অসত্যভাষী, নিষ্প্রভ, আলস্যপরায়ণ, মন্দবুদ্ধি, ভাগ্যহীন, উপদ্রবগ্রস্ত। যারা সাধু বলে পরিচিত, তারা পাষণ্ডকর্মকারী। মুখে বলে—আমি বৈরাগ্যবান সাধু, কিন্তু স্ত্রী আর ধন উভয়ই গ্রহণ করে।

“তরুণীপ্রভুতা গেহে শ্যালকো বুদ্ধিদায়কঃ।
কন্যাবিক্ৰয়িণো লোভাদ্দম্পতীনাঞ্চ কল্কনম্।।” (ভাগবত, ১।৩৩)

—ঘরে ঘরে স্ত্রীদের প্রবল প্রতাপ, শ্যালকরা হলো পরামর্শদাতা। মানুষ অর্থের জন্য কন্যা বিক্রয় করছে। আর ঘরে ঘরে দাম্পত্যকলহ। আহা! কি ছিরি হয়েছে এই পৃথিবীর—

“অট্টশূলা জনপদাঃ শিবশূলা দ্বিজাতয়ঃ।
কামিন্যঃ কেশশূলিন্যঃ সম্ভবন্তি কলাবিহ।।” (ভাগবত, ১।৩৬)

—এই কলিযুগে প্রায় সকল মানুষেই বাজারে অন্ন বিক্রি করছে, ব্রাহ্মণরা অর্থের বিনিময়ে বেদের অধ্যাপনা করছে আর প্রায় সকল স্ত্রী বেশ্যাবৃত্তিতে রত হয়েছে।

এ আর নতুন কথা কি বলছেন ভগবান! আমার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, কলির মায়া কামিনী-কাঞ্চন। দুটোই তিনি ত্যাগ করেছিলেন। স্বামীজী কামিনীর জায়গায় ‘কাম’, ‘লাস্ট’ শব্দটি বসিয়েছিলেন। ব্যাপার তো সেই একই।

ত্যাগ করেছিলেন? মুখে ত্যাগ?

আজ্ঞে না। প্রকৃত ত্যাগ।

কাম জয় করা যায়?

এই তো ভগবান! ঐ একটি মানুষ আপনার সব গর্ব খর্ব করে দিয়েছেন। বললেন, কাম জয় করা যায় না জানি, তবে এই নাও মুখটা ঘুরিয়ে দি। সর্ব রোমকূপ দিয়ে প্রেমের ভগবানের সঙ্গে পরম মিলনের আনন্দ আস্বাদ করব।

বল কি!

ইয়েস, গদাধর চট্টোপাধ্যায় আপনার সব ছলাকলা শেষ করে দিয়েছেন। আপনার নিজের দোষেই আপনি মানুষের প্রেম, পূজা সব হারিয়েছেন। ‘কলি, কলি’ করছেন, কলির প্রভাব তো নিজেই কাটিয়ে দিতে পারেন প্রভু! আপনিই তো সর্বময়।

না হে, সৃষ্টি আমার হলেও যে-শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছিলাম তিনি আদ্যাশক্তি মহামায়া। তিনি কালী, কালকে কলন করছেন। কালের কর্ত্রী তিনি। আমি শব হয়ে পড়ে আছি বুক পেতে। কালই কলিকে এনেছেন, আমি অসহায়।

শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন, তাই মাকে ধরেছিলেন, বাবাকে নয়। গঙ্গার জলে কাঞ্চন বিসর্জন দিয়ে মাকে বললেন, ‘মা, আপদ গেছে।’ এসব আপনার নাকের ডগায় হচ্ছে। কলি আপনাকে কাবু করলেও আমার ঠাকুরকে কাবু করতে পারেনি। স্বামীজী স্পষ্ট, পরিষ্কার বললেন, ‘ঠাকুরের আগমনে সত্যযুগের সূচনা হয়েছে।’

বুঝতে পারছ?

কেন পারব না! আপনার বহুরূপ তো মন্দির, মসজিদ, গির্জা ছেড়ে মানুষের মধ্যে চলে এসেছে। ওগুলো তো এখন আর্কিটেকচার, ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন, ব্যবসার জায়গা। ঠাকুর আপনাকে ধরার জন্য আমাদের ফাঁদ দিয়ে গেছেন— মনে, বনে, কোণে। আর চুপি চুপি বলে গেছেন—ভগবান ভীষণ লোভী, কেবল ভক্তি চান। ভগবান বড় ভূষিত, চোখের জল চান। এতক্ষণ ‘ভাগবত’ বলছিলেন তো, এইবার আমি শোনাই—নারদ আপনার পৃথিবীর বেহাল অবস্থা দেখতে দেখতে শ্রীকৃষ্ণের লীলাস্থল যমুনার তীরে এলেন। অপেক্ষা করেছিল অতি আশ্চর্য এক দৃশ্য—”তত্রাশ্চর্যং ময়া দৃষ্টং… একা তু তরুণী তত্ৰ নিষণ্ণা খিন্নমানসা।” (ভাগবত, ১।৩৮) বসে আছেন এক যুবতী স্ত্রীলোক—অতিশয় দুঃখিত, বিরস বদন। আর তাঁর পাশে পড়ে আছেন অচেতন দুই বৃদ্ধ পুরুষ। মৃত নয়, অচেতন। দীর্ঘশ্বরে শ্বাস চলছে। রমণী তাঁদের চেতনা আনার জন্য কখনো সেবা করছেন, আবার কখনো কাঁদছেন। সেই রমণীকে ঘিরে রয়েছেন পরমাত্মা। শত নারী পাখার বাতাস করছেন আর মহিলাকে প্রবোধ দিচ্ছেন। নারদ তখন কৌতূহল নিবারণের জন্য কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘দেবি! তুমি কে? এই দুজন পুরুষই বা কে, আর এইসব নারীরাই বা কারা?’ রমণী বললেন-

“অহং ভক্তিরিতি খ্যাতা ইমৌ মে তনয়ৌমতৌ।
জ্ঞান-বৈরাগ্যনামানৌ কালযোগেন জর্জরৌ।।”

—আমি ভক্তি। আর এই বৃদ্ধ দুজন আমার পুত্র—একজন জ্ঞান, আরেকজন বৈরাগ্য। সময়ের ফেরে এদের এই অবস্থা! আমার চারপাশের এই রমণীরা— দেবী গঙ্গাদি নদীসমূহ।

আমার ঠাকুর বললেন, চুলোয় যাক জ্ঞানবিচার। সাধক অবস্থায় রাতের অন্ধকারে দক্ষিণেশ্বরের পথে পথে পাগলের মতো ছুটেছেন আর বলছেন, মা, আমার জ্ঞানবিচার এক কোপে কেটে দে! আমি চাই বিশ্বাস, বালকের বিশ্বাস। শঙ্কর, রামানুজ, বুদ্ধ—এঁরা সব চেয়েছেন জ্ঞান। আমি চাই প্রেম। মহাপ্রভুর প্রেম। বহির্বৈরাগ্য সন্ন্যাস চাই না। চাই বিবেক-বৈরাগ্য, শুদ্ধাভক্তি। ভক্তিদেবীর দুই পুত্র যেমন আছে থাক। ভক্তি! তুমি এসে আমাকে ভক্ত করে দাও। ভক্তের হৃদয় যে ভগবানের বৈঠকখানা।

সেই রামকৃষ্ণ তোমাদের এমন কি দিলেন যে সংসার-যাতনা দূর হবে? সংসার তো আমার ইঁদুরকল, বিশালাক্ষীর দ, শেঁকুলের কাঁটা। ঢুকবে, কিন্তু বেরবে যখন তখন ঝলসাপোড়া।

আমার ঠাকুর তো এক কাণ্ড করে বসে আছেন!

কিরকম?

আপনাকে তেল বানিয়ে ফেলেছেন! এতকাল মানুষ আপনার উদ্দেশে প্রদীপ জ্বালিয়েছে, সেই প্রদীপে যুগ যুগ ধরে তেল ভরেছে। এইবার আপনি হয়েছেন আমাদের তেল—মহাভৃঙ্গরাজ!

কী বলছ পাগলের মতো!

আজ্ঞে, ঠাকুর আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন—হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙতে। সংসার কাঁঠালের আঠা, আপনি হলেন তেল। আর বলেছেন- আপনাকে জাপটে ধরে সংসারে ঢুকতে, বলেছেন সংসারেই থাকবে ভগবানকে পকেটে পুরে। আরেকটা যা বলেছেন, তা আপনার পুরোহিতরা কোনকালে বলেননি, শুনলে আপনার অহঙ্কারে লাগবে। বলেছেন—আমার এই দেহটাকে দিনে একবার অন্তত মানসচক্ষে দেখবে। তোমার সব আছে। ‘নেই নেই’ করলে সাপের বিষও নেই হয়ে যায়। বল—আছে, আছে। ‘পাপ, পাপ’ বলে কুঁকড়ে যেও না। তিনবার হেঁকে বল—আমি পুণ্যাত্মা। আর বলেছেন— মার, কাট, লোট।

কাকে?

আপনাকে। ডাকাতি?

ইয়েস, মাই গড।

কোথায় রাখবে? আমাদের অন্তরে। কি অবস্থায়?

চৈতন্য করে।

সর্বনাশ, রামকৃষ্ণ কঠিনকে সহজ করে দিয়েছেন, যোগকে সরল করে দিয়েছেন, তিনি আমার ‘ঠিকানা’ বলে দিয়েছেন! তিনি তো বিদ্ৰোহী!

ইয়েস, প্রভু! তিনি আমাদের—জনগণের বিদ্রোহী ভগবান!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *