বিদ্যেধরীর বাঁকে – শিশির বিশ্বাস

বিদ্যেধরীর বাঁকে – শিশির বিশ্বাস

জোয়ারের প্রথম ঢেউ যেখানে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে আছড়ে পড়ে, পাল্লা দিয়ে খই ফোটার মতো লাফাতে থাকে পারশে মাছের ঝাঁক, মড়াপোতা গ্রাম তার পাশেই৷ মস্ত চর ফাঁকাই ছিল আগে৷ কেউ ধারে-কাছেও মাড়াত না৷ সেই যেবার মস্ত তুফান হল, তার দুই বর্ষা পরে মোগল রাজার সেনাদের সঙ্গে তাড়দহে বোম্বেটেদের তুমুল যুদ্ধ৷ সে আদ্দিনাথের জন্মেরও আগে৷ ওর জ্যাঠা গদাধর পাইক লড়াই করেছিল মোগল রাজার হয়ে৷ সে কী ভয়ানক লড়াই! বিদ্যেধরীর জল রক্তে লাল৷ মরেছিল কম নয়৷ লড়াই দিয়েছিল একা পাইকের দল৷ মোগল রাজার সেনা বাবু মানুষ৷ ইয়া আরবি ঘোড়া ছাড়া পোষায় না৷ যত তড়পানি ডাঙায়৷ জল-কাদায় যে কেঁচো, বোঝা গিয়েছিল সেবার৷ তা লাঠি সড়কি হাতে কত আর টক্কর দেবে তারা৷ বোম্বেটেরা তাই বাজি মেরে দিয়েছিল৷

যুদ্ধে হেরে মোগল রাজার সেনারা ফের সেই ফরতাবাদের কেল্লায়৷ দেখে বোম্বেটে সেনাপতি গুগলির সে কী ফুর্তি!

জ্যাঠার মুখে এই পর্যন্ত শুনেই হেসে ফেলত আদ্দিনাথ৷ জ্যাঠা গদাধর পাইকের তখন বয়স হলেও স্মরণশক্তি একদম টনটনে৷ পুরোনো দিনের কথা ভোলেনি কিছুই৷ কিন্তু বোম্বেটে সেনাপতির নামে এসেই গোল হয়ে যেত৷ আদ্দিনাথ বাধা দিয়ে বলত, ‘গুগলি নয় জ্যাঠা, ডুডলি৷’

গদাধর পাইক ব্যাজার হয়ে বলত, ‘গেঁড়ি-গুগলি ওই হল একটা৷ তবে লড়াইতে ওস্তাদ মানুষ ছিল গুগলি সাহেব৷ সেই লড়াইয়ের আরও দুই বর্ষা পরে এই বিদ্যেধরীর বাঁকে, ভাটায় জাল নিয়ে মাছ ধরতে গেছি৷ তখনও মড়াপোতা গাঁয়ের পত্তন হয়নি৷ সাহেব তার কোশায় তাড়দহের কেল্লায় ফিরছে৷ আমাকে দেখেই কোশা ভেড়াতে বলল৷ নির্ঘাত সাহেব এবার কোমর থেকে আগুন কল বের করে ফুটুস করে ঠুকে দেবে৷ কম বেগ তো দিইনি সেই যুদ্ধে৷ তা ও হরি, পিঠ চাপড়ে দিয়ে সাহেব বললে, গডাডর, টোমার নাম আমি শুনিয়াছি৷ মোগল রাজার নোকরি করিয়া কী হইবে? উহারা পলাইয়া গিয়াছে৷ টুমি হামাদের দলে আইসো৷

‘সাহেবের কথা সব তো আর সত্যি নয়৷ ফরতাবাদে মোগল রাজার সেইদিন তখন নেই৷ তবু কেল্লা তো আছে৷ পাইকও আছে কিছু৷ অবশ্য মাইনেকড়ি নেই৷ মাঠে চাষ করে পেট চলে৷ আমারও সেই অবস্থা৷ কিন্তু তা বললে কী হয়৷ মোগল রাজাকে কথা দিয়েছি৷’

বুড়ো জ্যাঠার কাছে আদ্দিনাথ এসব গল্প কতবার যে শুনেছে, ঠিক নেই৷ যুদ্ধের পরে মোগল রাজার সেনাপতি উলুঘ খাঁ গদাধর পাইকদের বেজায় ধমকেছিলেন, ‘কী যে ছাই লড়লি তোরা! তাড়দহের কেল্লা দখল হল না!’

উত্তরে ফুঁসে উঠেছিল গদাধর পাইক৷ ‘দখল হবে মানে! তোমরা উল্লুখাঁ বাবুরা ঘোড়ায় চড়ে হাতে ফুটুস কল নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দেখবে৷ এদিকে রামদা, সড়কি হাতে কতক্ষণ ঠেকা দেয়া যায় রে বাপু! বোম্বেটে সাহেবরা সেই থেকে বন্দুক দেগেই চলেছে!’ গদাধর পাইকের সেই তড়পানিতে উলুঘ খাঁর মুখে আর কথা সরেনি৷ পরের দিনই এক ফুটুস কল ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল গদাধর পাইকের হাতে৷ সেই সাথে পাইক দলের সর্দার৷

গদাধর পাইকের ফুটুস কল মানে পলতে বন্দুক৷ ঘরের এক কোণে পড়ে থেকে সেই বন্দুকে মরচে ধরেছে এখন৷ জালের কাঠি পুরে বারুদ ঠাসতেই লাগে অনেকটা সময়৷ তারপর চকমকি ঠুকে পলতেয় আগুন৷ ঠিকমতো তাক করতে পারলে মার নেই বটে, তবে বোম্বেটে সাহেবদের বন্দুক তখনই অন্যরকম৷ বারুদ ঠাসলেই কাজ খতম৷ চকমকি, পলতে কিছুই লাগে না৷ তাক করে ঘোড়া টিপলেই গড়ুম৷ তা সেই পলতে বন্দুক পেয়ে গদাধর পাইক আর দলবল বেজায় খুশি৷ বোম্বেটেগুলোর সঙ্গে এবার সমানে টক্কর দেওয়া যাবে৷

কিন্তু কিছুই আর হয়নি৷ মোগল সেনা দলবল নিয়ে যখন ভেগেই পড়ছে, বোম্বেটে সাহেবরা কী অতই বোকা, অযথা পিছনে ধাওয়া করবে! বরং খবর পেয়ে ফুর্তিতে সেই রাতে খুব খাওয়াদাওয়া করেছিল৷ রাতভোর হুম-হুম করে নাচ গান৷ বাজিও ফুটেছিল৷ আওয়াজ ওদের ফরতাবাদ থেকেও শোনা গিয়েছে৷ গদাধর পাইকের হিসেবে দুই বর্ষা মানে তার দুই বছর পরেই বোম্বেটে ডুডলি সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বিদ্যেধরীতে মাছ ধরতে গিয়ে৷ কিন্তু ডুডলি সাহেবের হাজার অনুরোধেও মন গলেনি গদাধর পাইকের৷ এক কথা, মোগল রাজার নুন খেয়েছি৷ কথার খেলাপ করার জো নেই গো সাহেব৷ উল্লু খাঁকে কথা দেওয়া, যতদিন না ফেরে, কেল্লা পাহারা দিতেই হবে৷

ডুডলি সাহেবের অন্য এক কথা কিন্তু মিলে গেছে৷ সাহেবই সেদিন পরামর্শ দিয়েছিল, ফরতাবাদে পড়ে না থেকে এই মড়াপোতার চরে এসে নতুন বসতি করতে৷ নতুন চর, ফসল হবে দারুণ৷ সেই সাথে বিদ্যেধরী পাহারার কাজও হবে৷ তাড়দহের দিকে অচেনা কোনো বহর দেখলেই যেন গদাধর সাহেবদের আগে থাকতে খবরটা পৌঁছে দেয়৷ সেজন্য পলতে নয়, একেবারে ঘোড়া-টেপা বন্দুক দেওয়া হবে গদাধরকে৷

গদাধর তখন রাজি হয়নি৷ নতুন বন্দুকও মেলেনি৷ কিন্তু যে বছর আদ্দিনাথের জন্ম, তার বছর খানেকের মধ্যেই মা আর বাবা চোখ বুজল৷ মনটা বেজায় খারাপ হয়ে গিয়েছিল গদাধরের৷ ভাই গোবিন্দকে বেজায় ভালোবাসত৷ নিজের হাতে লাঠিখেলা, সড়কিখেলা শিখিয়েছিল৷ বিদ্যেধরীর উপর বোম্বেটে সাহেবদের সঙ্গে লড়াইয়ে গোবিন্দও সেদিন জবর লড়াই দিয়েছিল৷ তারপর কেল্লায় পাইকদের সর্দার হল গদাধর৷ অনেক খুঁজে ভালো কন্যে দেখে বিয়ে দিয়েছিল ভাইয়ের৷ বছর কয়েক পরে আদ্দিনাথের জন্ম হতে বেজায় আহ্লাদ হয়েছিল গদাধরের৷ কিন্তু ধর্মঠাকুর কপালে সুখ লেখেনি৷ বছর ঘুরতেই সান্নিপাতিক জ্বরে তিন দিনের মধ্যে একে একে বাবা-মা দু-জনেই গেছে আদ্দিনাথের৷ ধর্মঠাকুরের থানে হত্যে দিয়ে আনা জলপড়া, তেলপড়া কিছুতেই কিছু হয়নি৷ তেরাত্তির পেরোবার আগেই সব শেষ৷

নিজের ছেলেমেয়ে হয়নি৷ গদাধর পাইকের বউ ফুলমনি আদ্দিনাথকে আঁকড়ে ধরেছিল এরপর৷ জ্যাঠা-জেঠির আদরেই বড়ো হয়েছে আদ্দিনাথ৷ কতকটা ওই আদ্দিনাথের কারণেই কেল্লা ছেড়েছে গদাধর পাইক৷ ভাইয়ের মৃত্যুতে মনটা খারাপ হয়েই ছিল৷ তার উপর চত্তির গাজনের বড়ো সন্নেসি হারাই যোগী সেবার যখন বলে গেল, গড়ের গঙ্গার অবস্থা সুবিধের নয়৷ চর পড়তে শুরু করেছে৷ বরং বিদ্যেধরী অনেক তেজি৷ বর্ষা বা ভরা জোয়ারে খানিক দক্ষিণে ঢেউয়ের এমন দাপট যে, মাতালের মতো টলতে থাকে নৌকো৷ ওদিকে সেই জন্য বিদ্যেধরীর নামই হয়ে গেছে মাতলা৷

হারাই যোগী তন্ত্রসিদ্ধ মানুষ৷ সবাই জানে, ভূত-ভবিষ্যৎ সব তাঁর নখদর্পণে৷ ডুডলি সাহেবের কথা তখনই মনে পড়ে গিয়েছিল গদাধর পাইকের৷ তখন গা করেনি৷ তবে মন্দ বলেনি সাহেব৷ নতুন বসতির জন্য সেরা জায়গা ওই মড়াপোতার চর৷ নতুন জমি৷ এক বছর ফসল ফলাতে পারলে পরের দুই বছর পায়ের উপর পা তুলে খাও৷

কিন্তু মড়াপোতার চরের কথা শুনে সবার তো চোখ ছানাবড়া৷ সেবার মোগল রাজার সঙ্গে বোম্বেটে সাহেবদের সেই যুদ্ধে মানুষ তো আর কম মরেনি৷ বিদ্যেধরীর জল লাল হয়ে গিয়েছিল৷ জোয়ার-ভাটায় শুধু মানুষের লাশের গুঁতোগুঁতি৷ সেই লাশ তুলে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল ওই চরে৷ সেই থেকে নামই হয়ে গেছে মড়াপোতার চর৷ দিনেও নাকি ঘুরে বেড়ায় তাদের ভূত৷ সব উলটোবাগে পা৷ অনেকেই দেখেছে৷ সেই মড়াপোতার চরে নতুন বসতি হবে শুনে গোড়ায় ঘাড় বেঁকিয়েছিল অনেকেই৷ কিন্তু গদাধর পাইক পরোয়া করেনি৷ যারা রাজি হয়েছিল, নিয়ে চলে এসেছিল মড়াপোতার নতুন গ্রামে৷ নতুন মাটিতে চাষ করে তাদের অবস্থা ফিরতে সময় লাগেনি৷ দেখে বাকি যারা কেল্লায় পড়ে ছিল, সুড়সুড় করে চলে এসেছিল তারাও৷ সেই থেকে জমে উঠেছে মড়াপোতা গ্রাম৷ ফি হপ্তায় হাটও বসে এখন৷

আদ্দিনাথ জ্যাঠার কাছে ঘন হয়ে বসে গল্প শুনছিল৷ ফুলমণি এসে ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘বলি সেই থেকে জ্যাঠা-ভাইপোর যে গল্প শুরু হয়েছে, আর যে ফুরোয়নে দেখি৷ বুড়োর সেই একই কথা৷ শুনে শুনে কানে ছাতা পড়ে গেল৷ ওদিকে যে ভাত-বেন্নুন জুড়িয়ে যাবার জোগাড়৷ বলি খেতে হবে নে?’

‘শুধু বেন্নুন? মাছ হয়নি জেঠি?’ আদ্দিনাথ বলল৷

‘হয়েছে রে পাগলা৷ সকালে হঠাৎ বৃষ্টি নামল৷ সেই জলে পুরোনো বিলের মাঠে কই মাছের দাপাদাপি৷ গাঁয়ের অনেকেই গিয়েছিল৷ তোর জ্যাঠাও গোটা কয়েক ধরে এনেছে৷ মরিচবাটা দিয়ে সেই পাকা কইয়ের ঝাল৷’

জেঠির কথায় আদ্দিনাথ বেজায় খুশি হলেও জ্যাঠাকে কিছু বলতে সাহস পেল না৷ একেই তো ঘুম ভাঙতে বেজায় দেরি হওয়ার কারণে জ্যাঠা মোটেই খুশি নয়৷ তার উপর সেদিন ফস করে বলে ফেলেছিল, ‘কাণ্ড শুনেছ জ্যাঠা, পেট্রিক আজ খ্যাপলা জাল ফেলে বড়ো এক ভেটকি মাছ ধরেছে৷’

ব্যস, আর দেখতে হয়নি৷ জ্যাঠা ফোঁস করে উঠেছিল, ‘সাহেবের ছেলে হয়ে ফটকেটা খ্যাপলা জাল ফেলে মাছ ধরল, আর পাইক বাড়ির ছেলে হয়ে এখনও জাল ফেলাটা শিখে উঠতে পারলি না! আর তোকেও বলি, সারাদিন গুগলির ওই ভাইপোটার সাথে কী এত গুজগুজ৷’

জ্যাঠার ‘ফটকে’ মানে ডুডলি সাহেবের ভাইপো পেট্রিক৷ ওর মা এই দেশের মানুষ৷ তাই রং কিছু মাজা৷ কিন্তু বাপ-জ্যাঠার মতোই লম্বা৷ চোখের তারা নীল৷ আদ্দিনাথের বেজায় বন্ধু৷ ডুডলি আরও দক্ষিণে চাঁদখালি কেল্লায় ফিরে গেলেও ওর ভাই গঞ্জালেস তাড়দহেই রয়ে গেছে৷ বিয়ে করে প্রায় এই দেশেরই মানুষ এখন৷

জেঠি রান্না জুড়িয়ে গিয়েছে বললেও আসলে মোটেই তা নয়৷ এক বিঘত লম্বা জোড়া কইয়ের ঝাল দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে আদ্দিনাথ যখন বের হল, পূর্ব আকাশে সূর্য অনেকটাই উঁচুতে৷ জ্যাঠা ওকে বের হতে দেখে গজগজ করে বলল, ‘ঘরের ছেলে খেয়ে-দেয়ে একটু জিরিয়ে নিবি, তা নয়, চললি সেই গুগলির ভাইপো ফটকের কাছে৷ কতবার বলেছি, ওরা বোম্বেটে৷ মানুষ ভালো নয়৷’

আদ্দিনাথ অবশ্য জ্যাঠার কথার জবাব দিল না৷ জ্যাঠাকে অনেকবার বুঝিয়েছে৷ ফরতাবাদের মোগল সেনা বিদায় নিতে তাড়হদের বোম্বেটেরাও এই ক-বছর অনেক বদলে গেছে৷ ব্যাপার হল, তাড়দহ থেকে পাট তুলে ডুডলি আরও দক্ষিণে চাঁদখালি চলে গেলেও ওর ভাই গঞ্জালেস ততদিনে রানিবালা নামে এদেশের এক মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে৷ তাই নিয়ে দাদার সঙ্গে মনকষাকষি কম হয়নি৷ কিন্তু দাদার কথায় কান দেয়নি৷ সেই বউ রানিবালা রাজি হয়নি বলে গঞ্জালেস দাদার সঙ্গে যায়নি৷ রয়ে গেছে এখানেই৷ পেট্রিক তো এখন রাজপুরের রাজাবাবুদের মতো ধুতি মেরজাই পরে৷ তবে অহংকার নেই৷ নইলে পয়সা ওদেরও কম নয়৷ পেট্রিক দিব্যি খ্যাপলা জালে মাছ ধরতে পারে৷ বন্দুক চালাতেও ওস্তাদ৷ সেবার ওদের মড়াপোতায় জোড়া বাঘ ঢুকেছিল৷ ঢাল-সড়কি নিয়ে গাঁয়ের সবাই তৈরি হবার আগেই ওর কাছে খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল পেট্রিক৷ দিন কয়েক তক্কে তক্কে থেকে দুটো বাঘকেই গুলি করে মেরেছিল৷

পেট্রিকই ওকে হাতে ধরে বন্দুক চালানো শিখিয়েছে৷ কিন্তু জ্যাঠা সেকথা বুঝতেই চায় না৷ ওর বাবা গঞ্জালেস এখনও জ্যাঠার কাছে গুললির ভাই গেঁড়ি৷ ওই জন্যই তো আদ্দিনাথ কখনো পেট্রিককে জ্যাঠার ধারেকাছে আসতে দেয় না৷ কী বলতে কী বলে বসবে ঠিক নেই৷ মোগল রাজার পাইক দলের সর্দার ছিল৷ তাই জ্যাঠার এখনও বড্ডো গুমোর৷ অথচ সময় যে পালটে গেছে, মোগল নয়, বরং রাজপুরের বাবুরাই এখন এদিকের রাজা, তা মানতেই চায় না৷

বেলা বাড়ছে, জোরে পা চালিয়ে আদ্দিনাথ যখন বিদ্যেধরীর বাঁকে পৌঁছোল, পেট্রিক তার নৌকো নিয়ে পৌঁছে গেছে৷ পেট্রিকের নিজের এই নৌকোটা চমৎকার৷ আকারে ছোটো হলেও রংচঙে ময়ূরপঙ্খী৷ দাঁড় হাতে চারজন মাঝি৷ মাঝে মজবুত কুঠুরি৷ ছাদের উপর বসে আছে পেট্রিক৷ আদ্দিনাথকে দেখেই হইহই করে উঠল, ‘বড্ড দেরি করে ফেললি রে আদ্দিনাথ৷ অনেকটা পথ তার উপর জোয়ার৷’

পেট্রিকের কথায় একটু লজ্জাই পেল আদ্দিনাথ৷ ওর ধারণা ছিল, বরং পেট্রিকই আসতে দেরি করবে৷ বিদ্যেধরীর এই জোয়ারে পথ তো কম পথ নয়৷ আসলে দেরি হয়ে গেল, সাতসকালে গল্প শুনতে বসে৷ পুরোনো এসব কথা জ্যাঠার কাছে কতবার শুনেছে, তবু নতুন মনে হয়৷ ও তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠে পেট্রিকের পাশে বসল৷ আর তারপরেই বুঝল, হাসিখুশি পেট্রিকের মুখটা কেমন অন্যরকম৷

ততক্ষণে নৌকো ছেড়ে দিয়েছে৷ ও প্রশ্ন করার আগেই বলল, ‘বেজায় খারাপ খবর আছে আদ্দিনাথ৷ তবে রাজপুরে রাজার সেনাদলে তোর চাকরি বাঁধা৷ রাজা হয়তো নিজেই তোকে বাজিয়ে দেখবেন৷’

এই কয় বছর পেট্রিক বন্দুক ছোঁড়া আদ্দিনাথকে প্রায় হাতে ধরে শিখিয়েছে৷ যত কড়া নিশানাই হোক, বিফল হবে না৷ বাপ-জ্যাঠার মতো ওর একেবারেই পাইক হবার সাধ নেই৷ বন্দুক হাতে যুদ্ধ করতে চায়৷ সেজন্য তৈরি হচ্ছে অনেক দিন ধরে৷ কিন্তু এমন ভালো একটা খবরেও আদ্দিনাথের একেবারেই সুখ হল না৷ বলল, ‘কিন্তু খারাপ খবরটা তো বললি না?’

একটু একটু করে পেট্রিকের কাছ থেকে যা শোনা গেল, তা সত্যিই ভালো নয়৷ দিল্লিতে নতুন বাদশা হয়েছেন শাজাহান৷ গদিতে বসেই কাশিম খাঁকে পাঠিয়েছেন বাংলায়৷ বোম্বেটেদের এবার উচ্ছেদ করা চাই৷ চাঁদখালিতে ডুডলি সাহেবের কাছে সেই খবর এসেছে৷ সুতরাং খবর যে পাকা, তাতে সন্দেহ নেই৷ সাগরদ্বীপে চাঁদখালি বোম্বেটেদের বড়ো ঘাঁটি৷ তাই মোগল সেনাদের সঙ্গে লড়াই করতে সমস্যা কম৷ কিন্তু তাড়দহ আর আগের অবস্থায় নেই৷ পেট্রিকের বাবা গঞ্জালেস একা ঘাঁটি আগলে পড়ে আছে৷ নিধিরাম সর্দার৷ ভাইয়ের কথা চিন্তা করে ডুডলি তাই গত রাতে খবর পাঠিয়েছে, গঞ্জালেস যেন অযথা দেরি না করে সব গুটিয়ে চাঁদখালি চলে আসে৷ নইলে বিপদ৷ গঞ্জালেসের আপত্তি ছিল না৷ কিন্তু গোল বাধিয়েছে বউ রানিবালা, পেট্রিকের মা৷ কেঁদেকেটে একশা৷ রাত থেকে কিছুই মুখে তোলেনি৷

এই বয়সেও পেট্রিক মা-অন্ত-প্রাণ৷ সামনে বসে না খাওয়ালে খাওয়া হয় না৷ বেজায় ভক্তি করে৷ তবু কথা রাখতেই আজ বের হয়েছে৷

মনটা ভয়ানক খারাপ হয়ে গেল আদ্দিনাথের৷ তাড়দহে পেট্রিকের মাকে সে রানিমা বলেই ডাকে৷ রাজবাড়ির রানিমায়েদের মতোই রূপ৷ নাকে শিকল টানা মস্ত নথ৷ ঢলঢলে মুখে বড়ো সিঁদুরের ফোঁটা৷ ঠিক যেন রাজবাড়ির পুজো মণ্ডপের দূর্গামা ৷ অথচ ছোঁওয়া-ছুঁয়ির বাছবিচার নেই৷ তাড়দহে গেলে সামনে বসে না খাইয়ে কখনো ছাড়েননি ওকে৷ আর ফি-বছর চত্তিরে ধর্মঠাকুরের গাজনে কবে ওরা সন্নেসি হয়ে তাড়দহের কেল্লায় নাচগান করতে যাবে, সেই আশায় পথ চেয়ে থাকেন৷ চিঁড়ে-মুড়ি-কলা আর পাটালি গুড়ের ঢালাও আয়োজন হয়৷ ঘোষেদের গাঁ থেকে দুধ জোগাড় হলে কোনো বার দইয়ের ব্যবস্থাও৷ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে খাওয়ান৷ ভাবতে গিয়ে চোখে জল এসে গেল আদ্দিনাথের৷

‘রাজপুর গিয়ে আর দরকার নেই পেট্রিক৷ চল ফিরে যাই৷ রানিমার এই অবস্থা!’ বলতে বলতে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারল না আদ্দিনাথ৷ কোঁচার খুঁটে মুছতেই হল৷ কিন্তু দারুণ মনের জোর বোম্বেটে-বাড়ির ছেলে পেট্রিকের৷ এই অবস্থার মধ্যেও হেসে বলল, ‘খেপেছিস তুই! রাজাবাবু আজ সময় দিয়েছেন৷ আগে থাকতে কথা বলা৷ এত ভালো বন্দুক চালাতে শিখেছিস৷ তোর একটা ভালো চাকরি না হলে শান্তি নেই৷ মা এর মধ্যেও তোর নামে ধর্মঠাকুরের কাছে মানত চড়িয়েছে৷’

পেট্রিকের তাগাদায় চারজন দাঁড়ি জোয়ার ঠেলে যথাসময়ের আগেই পৌঁছে দিল৷ রাজবাড়ি সেই গঙ্গার ধারে৷ বিদ্যেধরীর ঘাটে নৌকো থেকে নেমে হাঁটতে হয় অনেকটা৷ ওরা যখন পৌঁছোল, সূর্য মাথার উপর৷ দরবারে রাজা মদনমল্ল হাঁ করে বসে ছিলেন ওদের জন্য৷ আদ্দিনাথের বন্দুক ছোড়া নিজের চোখে দেখবেন, তেমনই কথা রয়েছে৷ কিন্তু তার ধারেকাছ দিয়েও গেলেন না৷ উদভ্রান্তের মতো বললেন, ‘বাবা পেট্রিক, খবর শুনেছ কিছু?’

সুবেদার কাশিম খাঁ বিশাল ফৌজ নিয়ে আসছেন, সেই খবর এখানেও মাত্র গতকাল পৌঁছেছে৷ রাজা মদনলাল সেই খবর শুনে থম মেরে রয়েছেন৷ চোখে-মুখে একরাশ উৎকন্ঠা৷ সেই মুখের দিকে তাকিয়ে পেট্রিক হেসে বলল, ‘মোগল ফৌজ আসছে বোম্বেটে দমনের জন্য৷ আপনার কী?’

‘আমার বিপদ আরও বেশি রে ভাই৷’ কপাল চাপড়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি, ‘ইসলাম খাঁ বিদায় নেবার পরে এক কড়ি খাজনা ছোঁয়াইনি৷ এখন যদি বলে বিশ বছরের বকেয়া খাজনা মেটাও৷ ঘটিবাটি বেচেও যে জোগাড় হবে না৷ হায় হায়!’

রাজা মদনমল্লর সেই মুখের দিকে তাকিয়ে পেট্রিকের তখন বুঝতে বাকি নেই, ভয়ানক চিন্তায় রাজাবাবুর মন মোটেই ভালো নেই৷ এই অবস্থায় আদ্দিনাথের ব্যাপারটা আর তোলা যায় না৷ বাড়িতে বাবা-মায়েরও একই অবস্থা৷ ও ইতস্তত করে পাশে বন্ধুর দিকে তাকাতে আদ্দিনাথ বলল, ‘রাজাবাবু, আজ তাহলে যাই৷ ভাববেন না, কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় হবে৷’

‘আরে যাবে কী আসল কথাই তো হল না!’ প্রায় হাঁ-হাঁ করে উঠলেন রাজা মদনমল্ল৷ ‘গঞ্জালেসের কাছে তোমার কথা শুনেছি৷ এরপর আর কী পরীক্ষা নেব! সেরেস্তাদারকে বলে তোমার চাকরি আগেই পাকা করে দিয়েছি৷ আগামী কাল থেকেই লেগে পড়ো৷ তবে বুঝতেই তো পারছ৷ এই অবস্থায় ক-দিন যে মাইনে দিতে পারব, নিজেই জানি না, হেঁ-হেঁ৷’

রাজা মদনমল্লকে অযথা বিব্রত করতে আদ্দিনাথ আর রাজপুরে যায়নি৷ তারপর ক-দিন বড্ড ব্যস্ত থাকতে হয়েছে তাড়দহে রানিমাকে নিয়ে৷ অনেক বুঝিয়েও রাজি করা যায়নি৷ তাঁর এক কথা, যা হয় হবে৷ তাড়দহ ছেড়ে এক পাও নড়বেন না তিনি৷ মায়ের ভাব দেখে পেট্রিকও ঠিক করে ফেলেছে, সেও মাকে ছেড়ে যাবে না কোথাও৷ অগত্যা গঞ্জালেস প্রায় অথৈ সাগরে৷ শেষে আদ্দিনাথই বুঝিয়েছিল, এই অবস্থায় তাঁর আপাতত চাঁদখালির কেল্লায় চলে যাওয়াই ভালো৷ রানিমা আর পেট্রিকের দায়িত্ব মড়াপোতার পাইকদের৷ একজন পাইকও বেঁচে থাকতে দু-জনের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না৷ হোক না মোগল সেনা৷

গঞ্জালেসের পর্তুগালের মানুষ হলেও এই দেশেই আছেন আজ চল্লিশ বছরের উপর৷ পাইকদের ভালোই চেনেন৷ এরপর একটুও সময় নষ্ট না করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, যা হয় হোক, বউ-ছেলে ফেলে তিনিও কোথাও যাবেন না৷ অনেক বুঝিয়েও তাঁর মত আদ্দিনাথ বদল করতে পারেনি৷

গঞ্জালেস কথা ভেবে তাই খুব চিন্তায় ছিল আদ্দিনাথ৷ জ্যাঠাকে বলেও ফেলেছিল একদিন৷ তাতে গদাধর পাইক তো বেজায় খুশি৷ একগাল হেসে বলেছিল, ‘নাহ, গেঁড়িটাকে যা ভাবতাম, তা নয় দেখছি৷ রোখ আছে!’

জ্যাঠার কথায় আদ্দিনাথের তো হাবুডুবু খাওয়ার জোগাড়৷ ‘আহা, তুমি বুঝতে পারছ না জ্যাঠা৷ রানিমা আর পেট্রিকের ব্যাপারটা মোগল সেনাদের বোঝানো যাবে হয়তো৷ কিন্তু গঞ্জালেস লালমুখো বোম্বেটে! মোগল সেনা কিছুতেই রেয়াত করবে না৷ বেঘোরেই প্রাণটা যাবে!’

‘সে গেলে যাবে৷’ গদাধর পাইক খিঁচিয়ে উঠেছিল এরপর, ‘আর তোকেও বলি হতভাগা৷ এতটা বয়স হল, বুদ্ধি হল না! বউ-ছেলে ফেলে গেঁড়িটাকে পালাবার পরামর্শ দিতে গেলি!’

জ্যাঠাকে এরপর আর ঘাঁটায়নি আদ্দিনাথ৷

এসব মাস কয়েক আগের কথা৷ সব আগের মতোই চলছে বটে, তবে সে উপর থেকে দেখলে৷ ফরতাবাদের দিকে একদল মোগল সেনা রওনা হয়েছে, খবর আসছিল ক-দিন ধরেই৷ সেদিন দুপুরে নাওয়া-খাওয়া সেরে জ্যাঠা-ভাইপো ঘরের দাওয়ার বসে গল্প করছে, খট খট শব্দে ঘোড়ার খুরে গাঁয়ের পথে ধুলো উড়িয়ে তিন মোগল ঘোড়সওয়ার গদাধর পাইকের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল৷ একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘পাইক সর্দার কোথায়?’

‘কে হে বাপু তোমরা?’ বেরিয়ে এসে গদাধর বলল, ‘আমিই পাইক সর্দার৷’

‘সেলাম সর্দার,’ ঘোড়া থেকে নেমে একজন মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, ‘সেনাপতি উলুখ খাঁ তলব করেছেন৷ ফরতাবাদ কেল্লায় এখুনি যেতে হবে৷’

‘সেই উল্লু খাঁ!’ গদাধর পাইক চোখ নাচাল, ‘এতদিন পরে খোঁজ পড়ল পাইক সর্দারের!’

ওদিক থেকে কোনো উত্তর নেই৷ তিন ঘোড়সওয়ার অল্প মাথা নাড়ল৷ গদাধর বলল, ‘যাও বাপু৷ উল্লু খাঁকে গিয়ে বলোগে, একটু পরে আসছে৷ সবে খেয়ে উঠেছি৷’

প্রায় দম বন্ধ করে জ্যাঠার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল আদ্দিনাথ৷ তিন ঘোড়সওয়ার বিদায় নিতে মস্ত এক নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘বাপরে! তোমার এলেম আচে জ্যাঠা! আমার তো ভয় হচ্ছিল, যেভাবে কতা কইছ ফুঁড়ে না দেয়৷ কাঁধে বন্দুক! কোমরে তরোয়াল!’

‘থাম দেখি বাপু৷’ আদ্দিনাথের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে গদাধর বলল, ‘জ্যাঠার এলেম কী দেখেছিস? তখন তো জন্মই হয়নি তোর৷ মোগল সেনার যত তড়পানি ওই ডাঙায়৷ এই জল-কাদার দেশে পাইক ছাড়া ওদের এক পা চলেনে৷’ থামল গদাধর পাইক৷ অল্প মুচকি হেসে বলল, ‘বলেছি বটে, তবে বেশি দেরি করা যাবে না৷ এক কাজ কর৷ ফটকের বন্দুকটা কাঁধে বেশ করে ঝুলিয়ে নে৷ আর মরচে পড়া আমার সেই ফুটুস কলটাও আন৷ উল্লু খাঁর সঙ্গে একটু বোঝাপড়া করে আসি৷’

আদ্দিনাথ তবু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘মোগল কেল্লায় ওই ঘোড়া টেপা বন্দুক নিয়ে যাব! যদি জিজ্ঞেস করে, কোথায় পেলে?’

‘করলে করবে৷’ আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে গদাধর পাইক বলল, ‘সে আমি বুঝব৷ কই গো আদ্দিনাথের জেঠি, ধম্মঠাকুরের গাজনের পাট ছেলের কপালে ছুঁইয়ে আশীব্বাদ করে যাও৷ দেখি ওর কপাল ফেরাতে পারি কি না৷’

জ্যাঠা-ভাইপো অনেকটা পথ হেঁটে যখন ফরতাবাদ কেল্লায় পৌঁছোল, উলুখ খাঁ রাগে গরগর করছেন৷ কেল্লার এই অবস্থা, ভাবতেও পারেননি৷ সাফ করতে গিয়ে সাপের ছোবল খেয়েছে দু-জন৷ তাই ফাঁকায় তাঁবু খাটানো হয়েছে৷ গদাধরকে দেখেই তিনি গর্জে উঠলেন, ‘এটা কী ব্যাপার হল পাইক সর্দার! তোমাকে ভার দিয়ে গিয়েছি, আর কেল্লার এই হাল হয়ে রয়েছে! এর শাস্তি জানো?’

উত্তরে গদাধর পাইক সেই মরচে-পড়া বন্দুক উলুখ খাঁর পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে বলল, ‘এই নাও তোমার সেই ফুটুস কল৷ পাঁচ ছটাক বারুদ কবেই ফুরিয়ে গেচে৷ একটা পাইকের মাইনে দেওয়া যায়নে৷ কোনো দিন খোঁজ কেউ নেয়নে, পাইকগুলো আচে না গেচে৷ একে একে ভেগে পড়েছে সবাই৷ তার আমি কী করব৷ আর মড়াপোতার সব পাইক জানিয়ে দিয়েচে, মোগল কেল্লায় কেউ আর কাজ করবেনে, ওরা মাইনে দেয় না৷’

গদাধর পাইকের কথায় প্রায় আঁতকে উঠলেন উলুখ খাঁ৷ অন্য জায়গা হলে বেয়াদবির জন্য এতক্ষণে এক কোপে উড়িয়ে দিতেন মাথা৷ কিন্তু এই জল-কাদা আর বাঘের জঙ্গলে পাইক ছাড়া সব অচল৷ তার উপর হাতে সময়ও বেশি নেই৷ সুবেদার কাশিম খাঁ ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব চাপিয়েছেন৷ যদিও খবর পাওয়া গেছে তাড়দহের সেই রমরমা এখন নেই৷ ডুডলি অনেক দিন আগেই ভেগেছে৷ তবু যেটুকু আছে, তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করেই ছুটতে হবে হুগলির দিকে৷ বাদশার হুকুম, বাংলা থেকে বেয়াদব বোম্বেটেদের নিকেশ করা চাই৷ হাঁ-হাঁ করে বললেন, ‘অমন বলিসনি বাপু৷ অনেক কাজ এখন৷ খাজাঞ্চিকে বলে দিচ্ছি, এখনই মিটিয়ে দেবে সব৷ কাল ভোরের মধ্যে হাজার পাইকের বহর চাই৷’

‘শুধু পাইকের বহর হলেই হবেনে খান সাহেব!’ ঘাড় বেঁকিয়ে গদাধর বলল, ‘সেবারও তো পাইক কম ছিল না৷ তাড়দা কব্জা করা গিয়েছিল? নিজের চোখেই তো দেখেছেন৷’

‘তা ঠিক৷’ মাথা চুলকে উলুখ খাঁ বললেন, ‘তেমন সেনা পাই কোথায় বল দেখি? জলে কি আর ঘোড়সওয়ার চলে রে?’

‘দরকার নেই৷’ প্রায় মাছি তাড়াবার মতো হাত ছুড়ল গদাধর পাইক৷ ‘আমার এই ভাইপো আদ্দিনাথ থাকলে ওসব গোরু-ঘোড়ার দরকারও নেই৷ তোমাদের ওই ফুটুস কল নয়৷ ঘোড়া-টেপা বন্দুকে ওস্তাদ মানুষ আমার ভাইপো৷ কী রে আদ্দিনাথ, খানসাহেবকে এলেমটা একটু দেখিয়ে দে এবার৷’

জ্যাঠার কথা শেষ হবার আগেই আদ্দিনাথ কাঁধের বন্দুক নামিয়ে ফেলেছে৷ ঝুঁকে একবার সেলাম ঠুকে বলল, ‘কোথায় তাক করব, বলেন হুজুর?’

হঠাৎ এই ব্যাপারে উলুখ খাঁ একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন৷ ছোকরা এমন আনকোরা ঘোড়া-টেপা বন্দুক কোত্থেকে পেল, প্রশ্নটা মাথায় এসেছিল বটে৷ কিন্তু পাইক সর্দারের নতুন এই প্রস্তাবের পরে মিলিয়ে যেতেও সময় লাগেনি৷ চারপাশে একবার চোখ ঘুরিয়ে কাছেই এক গাছের মাথায় বড়ো এক চিল বসে থাকতে দেখে আঙুল তুলে বললেন, ‘হুই যে৷’

‘ও যে বসে রয়েছে, খানসাহেব! উড়িয়ে দিন বরং৷’

গদাধর পাইক তৈরি হয়েই ছিল৷ আদ্দিনাথ থামতেই হুস শব্দে চিৎকার করে একটা ঢেলা ছুড়ে মারল৷ চিলটা উড়তেই তাক করে ঘোড়া টিপল আদ্দিনাথ৷ গুড়ুম করে শব্দ হতেই গোটা কয়েক ডিগবাজি খেয়ে খানিক দূরে লুটিয়ে পড়ল চিলটা৷

এমন দক্ষ লক্ষ্যভেদী বন্দুকবাজ উলুখ খাঁ আগে বেশি দেখেননি৷ চমৎকৃত হয়ে বললেন, ‘তোমার ভাইপোকে আমি আজই সেনাদলে নিয়ে নিচ্ছি পাইক সর্দার৷ দারুণ হাত! লেগে থাকলে ছোকরা অনেক দূর যাবে৷’

‘তা নিন৷’ সামান্য মাথা চুলকে গদাধর বলল, ‘হুজুর যখন খুশি হয়েছেন, একটা আর্জি আছে৷’

‘কী?’

‘ফরতাবাদে এতবড়ো মোগল-কেল্লা, একজন কেল্লাদার না থাকলে কী হাল হয় নিজের চোখেই তো দেখলেন৷ তাই বলি৷ এবার একজন কেল্লাদারের ব্যবস্থা করা দরকার৷’

‘তা ঠিক৷’ মাথা নাড়লেন উলুখ খাঁ৷ ‘কিন্তু তেমন কেল্লাদার এখনই পাই কোথায় বাপু? তারপর হাতে একেবারে সময় নেই৷ তাড়দহের ব্যবস্থা করেই ছুটতে হবে৷’

‘সে যত খুশি ভাবেন হুজুর৷ তবে দায়িত্ব পেলে আমার এই ভাইপো একেবারে মন্দ হবে না৷ লেখাপড়াটাও জানে৷ আর মাইনেটা যদি নিয়মিত পাঠানো হয়, পাইকের দল নিয়ে আমি তো রয়েছি৷ বুড়ো হাড়ে ভেলকি দেখাতে পারি এখনও৷’

এর পরের কথা শোনাতে হলে গল্প অযথা ভারী হয়ে যায়৷ সংক্ষেপে বলি, আদ্দিনাথ ফরতাবাদের কেল্লাদার হতে তাড়দহে তার রানিমা আর পেট্রিকই শুধু নয়, রেহাই পেয়ে গিয়েছিল খোদ গঞ্জালেসও৷ রাজাবাবু মদনমল্লকেও গুনতে হয়নি একটি কড়ি৷ তবে পরে শায়েস্তা খাঁ সুবেদার হয়ে আসতে আর ফাঁকি দেওয়া যায়নি৷ শেষ পর্যন্ত কর গুণতেই হয়েছিল তাঁকে৷ কিন্তু সে অনেক পরে, আওরঙ্গজেবের আমলে৷ অন্য আর এক গল্প৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *