বিদ্যা ও বিশ্বাস
বিদ্বানেরা বলেন, আদিতে মানুষ ছিল অরণ্যচর ও পর্বতবাসী। ফল, মূল ও মাংস ছিল তাদের খাদ্য। ক্রমে তাদের বুদ্ধির বিকাশ হয়। বুদ্ধি ও কর্মশক্তির প্রয়োগে মানুষ জীবিকা-পদ্ধতির উন্নয়ন, খাদ্যবস্তুর উৎকর্ষ এবং নিবাসের রূপান্তর সাধন করে।
ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনবোধের প্রেরণায় তারা অনবরত সন্ধান, পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ চালিয়ে ক্রমে ক্রমে আগুন, পাথর, ধাতু প্রভৃতি আবিষ্কার করে আর উপযোগ-বুদ্ধি প্রয়োগে এগুলোকে নানাভাবে ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। এভাবে তাদের অস্ত্র হল, শাস্ত্র হল, ঘরদোর হল, গরু ঘোড়া-গাধা-মোষ-উট প্রভৃতিকে তারা পুষতে শিখল এবং বাহনও করল। চাকা বানাল, নৌকা ভাসাল, গরু-ঘোড়া-গাধা-মোষ-হাতির গাড়িও চালু হল। বত্রিশব্যঞ্জনে খেতে শিখল, বিচিত্র পোশাকে সাজতে জানল, ধাতব গয়না বানাতে পারল। কাঠ-পাথর, পোড়ামাটি দিয়ে ঘরও তৈরি করল, চাষ করে কত ফসল তুলল, ফুল-ফলের উদ্যানও রচল। এমনি করে সৃষ্টি ও নির্মাণে তারা প্রাণিজগতের ত্রাস ও প্রকৃতি-জগতের প্রভু হয়ে উঠল। আর করল জরু, জমি ও জেবর নিয়ে নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি, মারামারি ও হানাহানি। সমাজ গড়ল, দেব-দৈত্য পূজল, রাজ্য গড়ল। ভেতরে ভেতরে রীতি-নীতি-রেওয়াজ, আইন-কানুন-শাসন, ন্যায়-অন্যায়-সত্য, পাপ-পুণ্য-মিথ্যা, বিচার ক্ষমা-শাস্তি, দয়া-দাক্ষিণ্য-সাহায্য প্রভৃতি কত কত কথা, ভাব, তত্ত্ব, তথ্য, বিশ্বাস, সংস্কার, স্মৃতি, ভয়, ভরসা প্রভৃতির অদৃশ্য বন্ধনে বদ্ধ হয়ে নিশ্চিন্ত জীবন-জীবিকার নিশ্চিত অঙ্গীকারে আশ্বস্ত হতে চেয়েছে মানুষ। বিজ্ঞানের বলে আজ মানুষ মাটি ও আকাশের প্রভু। জ্ঞান তার পরিণতির পথে। বিজ্ঞান তার জগজ্জয়ে উৎসুক।
মানুষের এই ক্রমবিকাশের ধারা বর্ণনাকালে বিদ্বানেরা এতে কোনো দেব-দৈত্যের ভূমিকা স্বীকার করেন না। মানুষের আত্মোন্নয়নের ও আত্মপ্রসারের প্রয়াসে দেবতার সহায়তা কিংবা দৈত্যের প্রতিকূলতার কথা বিদ্বানেরা অবগত নন। বিদ্বানদের সবাই নাস্তিকও নন। তবু তারা উত্তরকালের মানুষের শ্রেষ্ঠত্বই স্বীকার করেন। কিন্তু শাস্ত্রকারেরা বলেন যে গোড়া থেকেই ভূত-ভগবান, দেব দৈত্য, প্রেত-পিশাচ, জিন-পরি ফিরিস্তা-শয়তান প্রভৃতি স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পরিসরে মানুষের সহায়তা ও বিরোধিতা করে আসছে। মিত্রশক্তির পোষণে ও অরিশক্তির পেষণে মানুষ সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও লাভ-ক্ষতি পেয়ে ও সয়ে সংখ্যায় ও সামর্থ্যে বেড়ে উঠেছে। কলিতে দেব-দৈত্যের প্রত্যক্ষ ভূমিকা সমাপ্ত। পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট। নবী-ঋষির কালও অপগত। তাঁদের বাণী দেশ কাল নিরপেক্ষ চির-মানবের দিশারী।
আশ্চর্য এই দুই বিপরীত তত্ত্বে ও তথ্যে– বিদ্যায় ও বিশ্বাসে আমরা বিরোধ স্বীকার করিনে। কাজ চালানো গোছের একটা আপোশ, একটা সন্ধি –একটা সহঅবস্থান নীতি কেমন যেন অবচেতন প্রয়োজন-প্রেরণায় আপনা থেকেই গড়ে উঠেছে। তাই পাঠ্য বইতে ও বিদ্বানের আলোচনায় শাস্ত্র অবহেলিত। আবার শাস্ত্রীয় আলোচনায় ইতিহাসের তথ্য অস্বীকৃত। পাঠক কিংবা শ্রোতারা ঘরে-সংসারে, মন্দিরে-মসজিদে শাস্ত্র মানে। আর ইস্কুলে-কলেজে ও সভায় ইতিহাসকে যথার্থ বলে গ্রহণ করে। বিদ্যায় ও বিশ্বাসে এই দ্বন্দ্ব, জ্ঞানে ও প্রত্যয়ে এই বিবাদ যেন ক্রীড়াসুলভ প্রতিপক্ষতা। বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতির ক্ষেত্রে এই অদ্ভুত আপোশ একালে সর্বত্র সুরক্ষিত। শাস্ত্রকারেরা কিংবা ধর্ম-বিশ্বাসীরা কেন যে এই অশাস্ত্রীয় অতএব মিথ্যা-বিদ্যা নিজেদের ও নিজেদের সন্তানের জন্যে কামনা করে তা বোঝা সহজ নয়। সেই গেলেলিও-ব্রুনো কপার্নিকাসের পর থেকে তারা উদার ও সহিষ্ণু হয়ে উঠেছে এ কি তাদের পর-চিন্তা ও পর বুদ্ধিজীবিতার ফল অথবা বিশ্বাস-নিষ্ঠতার অভাবজাত? যাই হোক না কেন, কোনোটাই তাদের পক্ষে সম্মানজনক নয়। মিশরীয় ব্যাবিলীয়-গ্রীক-ভারতীয়-চৈনিক পুরাণের পাশে পাশে মুসা-ঈসা বুদ্ধ জোরাস্টার-কনফুসিয়াস প্রভৃতির শাস্ত্র এবং এগুলোর পাশে ডারুইন-ফ্রয়েড-মার্কস-হেগেল নীৎসে-সার্জের মতবাদ এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের সহঅবস্থানগত বৈচিত্র্য-বৈপরীত্য ও জটিলতা আজকের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষকে বিচলিত ও বিব্রত করে না– জ্ঞানী-গুণী-বিদ্বানেরাও ঘরোয়া কিংবা মানসজীবনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানে-বিশ্বাসে কোনো বিরোধ, কোনো অসঙ্গতি অনুভব করে না। তাহলে বিষয়ী মানুষকে নির্বোধ কিংবা উদাসীন বলে ভাবতে হবে। বলতে হবে তারা জৈব প্রয়োজন-সচেতন প্রাণী এবং জীবন ও জগৎ, তত্ত্ব ও তথ্য এবং রহস্যচর্চা তাদের কাছে ক্লাবীয় খেলামাত্র।
কিন্তু তাও যে নয়, তার প্রমাণ নিস্তরঙ্গ ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে যদি কোনো ব্যতিক্রম তারা দেখতে পায় তখন তারা সনাতনী সেজে নীড় ভাঙা পাখির মতো হৈচৈ শুরু করে দেয়। বাহ্যত তাঁরা তর্ক করে, যুক্তি মানে, বিজ্ঞান ও দর্শনকে মান্য করে, সমাজবিজ্ঞান স্বীকার করে, কিন্তু স্বার্থ ও প্রয়োজনানুগ গ্রাহ্য না হলে গ্রহণ করে না। সবকিছুর উপর বিশ্বাসজাত আস্থা, সংস্কারজাত ভীতি এবং স্মৃতিপ্রসূত ভরসাই জয়ী হয়।
একে তারা ধর্মভাব, ঐতিহ্য-প্রীতি ও সত্যনিষ্ঠা বলে চালিয়ে দিতে সদা উৎসুক। আর্থনীতিক ও রাজনীতিক পরিবর্তনে তাদের আপত্তি ক্ষীণ। কিন্তু তার সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তনের সম্পর্ক থাকলে তাদের প্রতিরোধ হয় প্রবল, আর ধর্মীয়নীতির ব্যতিক্রম দেখলে তারা খেপে ওঠে। তখন তারা শিক্ষা জ্ঞান, যুক্তি সব পরিহার করে। সনাতন রীতিনীতির মমতায় তারা তখন ধর্মোন্মাদ ও রণ-মত্ত। যুগে যুগে কত নবী-ঋষি-জ্ঞানী-গুণী এভাবে তাদের হাতে লাঞ্ছিত, বিতাড়িত ও নিহত হয়েছেন! সমাজের মানুষের এই চরিত্রই মানুষের সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও আর্থনীতিক জীবনে প্রগতির বড় বাধা। এ কারণেই আরণ্য জীবনের রেশ উন্নততম সমাজেও দুর্লক্ষ্য নয়।
তবু মানববাদীর হতাশ হয়ে বসে থাকা চলবে না। অধ্যবসায়ে কী না হয়! ক্রমাগত মানুষের বদ্ধমনের দ্বারে আঘাত হানতে হবে। অর্গল টুটবেই, দ্বার ভাঙবেই তা যত বিলম্বেই হোক– যেমনটি গুহাযুগ থেকে ঘটে আসছে। তবু এরও একটা স্বাভাবিক পদ্ধতি আছে। ইতিহাস তার সাক্ষ্য। প্রচার-প্রতিরোধ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রক্তপাত, হত্যা প্রভৃতি কোনোটাই এড়ানো যাবে না। এতে সময় লাগবে বটে, কিন্তু সাফল্য সুনিশ্চিত। মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও মুক্তির জন্যেই সনাতনের বেড়া ভাঙতেই হবে। তার জন্যে চাই মানববাদী সৈনিকদের আপোশহীন বিরামহীন নির্ভীক মসীযুদ্ধ।