বিদ্যাসাগর-মদনমোহন : মিত্রলাভ-সুহৃদভেদ
‘‘শ্যাম হে? কি বলিব ও কি লিখিব, আমি এই সবডিভিজনে আসিয়া অবধি যেন মহাসাপরাধীর ন্যায় নিতান্ত ম্লান ও স্ফূত্তিহীনচিত্তে কর্ম্মকাজ করিতেছি, অথবা আমার অসুখের ও মনোগ্লানির পরিচয় আর কি মাথা মুন্ড জানাইব, আমার বাল্যসহচর, একহৃদয়, অমায়িক, সহোদরাধিক, পরমবান্ধব বিদ্যাসাগর আজি ৬মাস কাল হইতে আমার সঙ্গে বাক্যালাপ করে নাই, আমি কেবল জীবন্মৃতের ন্যায় হইয়া আছি। শ্যাম! তুমি আমার সকল জান, এইজন্যে তোমার নিকট এত দুঃখের পরিচয় পাড়িলাম।’’
উদ্ধৃত অংশটি শ্যামাচরণ দে (বিশ্বাস)-কে লেখা মদনমোহন তর্কালঙ্কারের একটি পত্রের অন্তর্গত। চিঠিটি মদমমোহন সম্ভবত নবগঠিত কান্দি মহকুমার প্রথম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে যোগ দেবার (জানুয়ারি ১৮৫৭) দু-তিন মাসের মধ্যে শ্যামাচরণকে লিখেছিলেন। এর আগে বিধবাবিবাহ আইন পাশ (২৬জুলাই ১৮৫৬) হবার পর আগস্ট মাসে মদনমোহন একমাসের ছুটি নিয়ে কলকাতায় যান। বিদ্যাসাগর তখন গুরুতর অসুস্থ। হয়তো এই সময় মদনমোহন অসুস্থ বিদ্যাসাগরকে দেখতে যান, কিন্তু তার কিছুদিন আগেই বিদ্যাসাগর মদনমোহনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন, তাই সম্ভবত বিদ্যাসাগর দর্শনপ্রার্থী মদনমোহনের সঙ্গে দেখা করেননি বা কোনো কথা বলেননি। চিঠির এই অংশে বোধ হয় সেই দুঃখজনক ঘটনার কথাই মদনমোহন স্মরণ করেছেন।
বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) ও মদনমোহন (১৮১৭-১৮৫৮)-এর আজীবন সম্পর্ক নির্ণয়ে উদ্ধৃত পত্রাংশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এতে একদিকে যেমন বন্ধুবিচ্ছেদের ‘মনোগ্লানি’ প্রকাশ পেয়েছে, অন্যদিকে তেমনি আবাল্য সম্পর্কের উজ্জ্বল দিকগুলিও প্রকাশ পেয়েছে। এই চিঠিতে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে মদনমোহন যে বিশেষণগুলি ব্যবহার করেছেন সেগুলির মর্ম অনুধাবন করলেই এই আবাল্য ঘনিষ্ঠতার প্রকৃতি পরিস্ফুট হয়: ‘বাল্যসহচর’, ‘একহৃদয়’ [বহুব্রীহি সমাস], ‘অমায়িক’ [‘অকপট’ অর্থে গ্রাহ্য], ‘সহোদরাধিক’ ‘পরমবান্ধব’। বিদ্যাসাগর ও মদনমোহনের জীবনবৃত্তান্ত পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, মদনমোহনের এই বিশেষণ প্রয়োগে কোনো অত্যুক্তি বা ঊনকথন স্থান পায়নি।
বস্তুত বিদ্যাসাগর-মদনমোহনের আবাল্য বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পেছনে কতকগুলি অভিন্নতার সূত্র সক্রিয় ছিল। যেমন : লেখাপড়ার জন্য দুজনেই সুদূর পল্লিগ্রাম থেকে রাজধানী-শহরে আনীত (১৮২৯), দুজনেই পঠদ্দশায় কিশোর বয়সেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ এবং দুজনেই ছাত্র হিসাবে অত্যন্ত মেধাবী। ‘নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস’ (১৮৮৮) বইতে বিদ্যাসাগর যেভাবে মদনমোহনের মা বিশ্বেশ্বরী দেবী এবং ভগ্নী বামাসুন্দরী ও ভগ্নীপতি মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কথা উল্লেখ করেছেন, তাতে বোঝা যায় যে এঁদের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পরিচয় ও সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ তাঁর মদনমোহন-জীবনীতে উল্লেখ করেছেন যে, মদনমোহনের ভগিনীরা বিয়ের পরও পিত্রালয়ে থাকতেন এবং ভগ্নীপতিরাও শ্বশুরালয়ে বাস করতেন। সেকালের কৌলীন্য প্রথার পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনা তেমন অস্বাভাবিক ছিল না। আমাদের অনুমান ছাত্রাবস্থাতেই বালক-ঈশ্বরচন্দ্র ছুটি-ছাটায় বিল্বগ্রামে গিয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু মদনমোহনের বাড়িতে অবকাশ যাপন করতেন এবং সেই সূত্রে মদনমোহনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছাড়াও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও ঈশ্বরচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কৈশোরে দেখা বিল্বগ্রাম বিদ্যাসাগরকে এমন অভিভূত করেছিল যে পরবর্তীকালে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ভার্নাকুলার স্কুল স্থাপনের জন্য যেসব জায়গাকে ‘fit for establishing vernacular schools’ বলে চিহ্নিত করে ১৮৫৪ সালের ৩জুলাই বাংলার তখনকার ছোট লাটের প্রাইভেট সেক্রেটারি ক্যাপ্টেন এইচ. বি. জেমসকে তিনি যে চিঠি লিখেছেন, তাতে তিনি নদিয়া জেলার তালিকায় ‘‘Billagram’’ (বানান লক্ষণীয়)-কেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। পরে অবশ্য রক্ষণশীল গ্রামবাসীদের সক্রিয় প্রতিরোধে বিদ্যাসাগরের পরিকল্পনা সফল হয়নি। এ থেকে বোঝা যায় পরিণত বয়সেও বিদ্যাসাগর তাঁর বাল্যবন্ধু মদনমোহনের পৈতৃক গ্রামকে ভুলতে পারেননি। শুধু মদনমোহনের পৈতৃক গ্রাম নয়, কর্মজীবনেও অনেকদিন পর্যন্ত মদনমোহনের সঙ্গে তাঁর সখ্য অব্যাহত ছিল। এই সখ্য ও ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখার ব্যাপারে উভয়েই খুব সচেষ্ট ছিলেন। বারাসত ইঙ্গরেজী পাঠশালায় প্রধান পন্ডিতের কাজ করার সময় (মার্চ ১৮৪২-মার্চ ১৮৪৩) ‘কলিকাতা ফোর্ট উইলিয়ম কালেজে সাহেবদিগকে (civil) সম্পত্তি বিষয়ক আইন পড়াইবার জন্য ৪০টাকা বেতনে এক পদ শূন্য হইলে’ (চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়) বিদ্যাসাগরের পরামর্শে ও আনুকূল্যে মদনমোহন এই পদে যোগ দেন। উচ্চতর বেতন ও কর্মস্থলে বিদ্যাসাগরের সান্নিধ্যলাভই বোধহয় বারাসত বিদ্যালয়ের কাজ ছেড়ে দেবার প্রধান কারণ ছিল। এরপর ১৮৪৬ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ স্থাপিত হলে মদনমোহন সেখানকার পন্ডিত হিসাবে যোগ দেন, কিন্তু ইতিমধ্যে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যশ্রেণির অধ্যাপক পদ শূন্য হয়। কলেজ কতৃপক্ষ বিদ্যাসাগরকে ঐ পদে নিযুক্ত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বন্ধুত্বের আকর্ষণে বিদ্যাসাগর তাতে সম্মত না হয়ে মদনমোহনকে নিযুক্ত করার জন্য কতৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করেন। মদনমোহন ২৭ জুন ১৮৪৬ তারিখে ঐ পদে যোগ দেন এবং ১৮৫০ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতা ছেড়ে বহরমপুর যাওয়ার আগে পর্যন্ত (১৫.১১.১৮৫০) তিনি ঐ পদে বহাল থাকেন। সংস্কৃত কলেজের এই কর্মজীবন বিদ্যাসাগর-মদনমোহনের নিবিড় সখ্যসূচক নানা ঘটনায় সমুজ্জ্বল। কোনো কোনো সমসাময়িক স্মৃতিকথায় তার কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন, তাঁদের বন্ধু গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নের পুত্র হরিশচন্দ্র কবিরত্নের স্মৃতিকথা : ‘সেকালের সংস্কৃত কলেজ’ (‘প্রবাসী’, ভাদ্র-আশ্বিন, ১৩২২)।
হরিশচন্দ্র এই স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে, বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে সংস্কৃত কলেজের তরুণ অধ্যাপকেরা খুব প্রত্যূষে কলেজের একটি হলঘরে ‘কুস্তি প্রভৃতি ব্যায়াম করিতেন’। ‘বয়ঃ-কনিষ্ঠ’ এইসব পন্ডিতদের মধ্যে মদনমোহনও ছিলেন। শুধু কর্মজীবনের ঘনিষ্ঠতাই নয়, বন্ধুত্বের সূত্রে বিদ্যাসাগর মদনমোহনের পরিবারেও যে কতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন হরিশ্চন্দ্র তাঁর স্মৃতিকথায় তারও একটা দৃষ্টান্ত দিয়েছেন :
মদনমোহন বিদ্যাসাগরের অপেক্ষা বয়সে কিছু বড় ছিলেন; তজ্জন্য মদনপত্নী বিদ্যাসাগরকে ‘ঠাকুরপো’ বলিয়া ডাকিতেন। বিদ্যাসাগরও তাঁহাকে ‘বৌদিদি’ বলিয়া ডাকিতেন। মদন-পত্নী কিছু প্রগলভা ছিলেন। একদিন বিদ্যাসাগর মহাশয় কলেজ হইতে মদনের বাসায় গিয়া বলিলেন, ‘বৌদিদি, বড় ক্ষুধা পাইয়াছে, কি খাইব?’ মদন-পত্নী তখন মাধ্যাহ্নিক আহার করিতে বসিয়াছিলেন। তিনি কহিলেন, ‘কেন ঠাকুরপো! এই ভাত আছে খাও না।’ বিদ্যাসাগর তৎক্ষণাৎ অম্লানবদনে তাঁহার পার্শ্বে বসিয়া একপাত্র হইতে হাম হাম করিয়া ভাত খাইতে লাগিলেন। এমন সময় মদন আসিয়া বলিলেন, ‘আরে, কি কর, বিদ্যাসাগর। সকল মহাপ্রসাদ খাইও না, আমি খাইব কি?’ এই কথা শুনিয়া তাঁহার পত্নী ভাতের থালাখানি হস্তে লইয়া উঠিয়া বলিলেন, ‘এই লও, মহাপ্রসাদ খাও।’ মদন সেই থালা চাটিতে লাগিলেন। এই গল্পটি আমার পিতৃদেব আমার মাতৃদেবীকে বলিয়াছিলেন। আমি আমার মাতৃদেবীর নিকট শুনিয়াছিলাম।
(মদনমোহন তর্কালঙ্কার স্মারকগ্রন্থ, পৃ. ১২, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা ২০০৮)
মদনমোহন শ্যামাচরণকে লেখা পূর্বোদ্ধৃত চিঠিতে বিদ্যাসাগরকে যে ‘সহোদরাধিক’ বলে অভিহিত করেছেন এই কাহিনিতে তারই সমর্থন পাওয়া যায়। তবে শুধু কর্মক্ষেত্রে বা পারিবারিক পরিসরেই নয় তার বাইরেও কখনও কখনও অবসর যাপনেও দুই বন্ধু যে পরস্পরের সঙ্গী হতেন, তার উল্লেখ পাওয়া যায় নবকৃষ্ণ ঘোষের লেখা প্যারীচরণ সরকারের জীবনী (১৩০৯)-তে। নবকৃষ্ণ এ সম্পর্কে লিখেছেন, প্যারীচরণ (১৮২৩-১৮৭৫) বারাসতে থাকার সময়ে (১৮৪৬-৫৪) ‘কোন কোন রবিবারে বিদ্যাসাগর মহাশয়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রভৃতি উক্ত বন্ধুত্রয়ের কলিকাতাস্থ সুহৃদগণ বারাসতে যাইতেন এবং সেইদিন নবীনবাবুদের (নবীনকৃষ্ণ মিত্র) বাটীতে আমোদ আহ্লাদে অতিবাহিত করিয়া পরদিবস তাঁহারা কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিতেন’ (পৃ. ৭৪-৭৫)। নবকৃষ্ণ লিখেছেন—আমোদ-আহ্লাদের অন্যতম উপকরণ ছিল গান-বাজনা। বিদ্যাসাগর কবিগানের ভক্ত ছিলেন, আর মদনমোহন ছিলেন গীতিকার ও সুরকার। সুতরাং রবিবারের ওইসব আড্ডা যে খুব জমে উঠত তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার। বিদ্যাসাগরের জীবনীকারেরা দেখিয়েছেন যে, বিদ্যাসাগর বন্ধুকৃত্যের নিদর্শন হিসাবে একতরফাভাবে মদনমোহনকে উচ্চতর বেতনের চাকরিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি ঠিক এইরকম নয়। তাঁদের বন্ধুকৃত্য ছিল পারস্পরিক প্রীতি ও আস্থানির্ভর। একটা অনালোচিত প্রসঙ্গের উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। প্রসঙ্গটি ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল (অধুনা বেথুন স্কুল)-এর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক নিয়ে। ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে বেথুন বিদ্যাসাগরকে এই স্কুলের সেক্রেটারি হিসাবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ১৮৪৯ সালের ৭ মে বেথুন যখন এই স্কুলের উদ্বোধন করেন তখন ওই সময়কার বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্রে তার বিস্তৃত বিবরণ প্রকাশিত হয়, ঐ অনুষ্ঠানে কারা উপস্থিত ছিলেন এবং কারা নিজেদের মেয়েকে ওই স্কুলে ভর্তি করতে চেয়েছেন তাঁদের নামও প্রকাশিত হয়, কিন্তু ওই নামের তালিকায় বিদ্যাসাগরেরনাম অনুপস্থিত। এ ছাড়া স্কুল প্রতিষ্ঠার দুই সপ্তাহ পরে ২৩ মে ১৮৪৯ তারিখে স্কুল প্রাঙ্গণে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বেথুন ছাত্রীদের পিতা, অভিভাবক এবং স্কুলের শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে সভা করেন। সমকালীন সংবাদপত্রে তারও বিবরণ ও উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেখানেও বিদ্যাসাগরের উপস্থিতির উল্লেখ নেই। এর পর ৬ নভেম্বর ১৮৫০ মঙ্গলবার হেদুয়ার ধারে স্কুলের বর্তমান বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। সমকালীন সংবাদপত্রে তারও বিবরণ উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের নামসহ প্রকাশিত হয়। এখানেও বিদ্যাসাগরের নাম অনুপস্থিত। শুধু তা-ই নয়, ‘সর্র্ব্ব্যুশুভকরী পত্রিকা’-র (১৭৭২ শকাব্দ = ১৮৫০ খ্রি:) আশ্বিন সংখ্যায় মদনমোহন ‘স্ত্রীশিক্ষা’ নামে যে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন তার শেষ অংশে তিনি স্ত্রীশিক্ষা-বিস্তারের ক্ষেত্রে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এই নামের তালিকায় বিদ্যাসাগরের নাম অনুপস্থিত। এই অনুল্লেখকে মদনমোহনের বিদ্যাসাগর-বিরাগের লক্ষণ বলে চিহ্নিত করলে ভুল হবে। কারণ এই পত্রিকা প্রকাশে দুই বন্ধুর মিলিত পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। পত্রিকার যে-সংখ্যায় মদনমোহনের ‘স্ত্রীশিক্ষা’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়, তার আগের সংখ্যায় (অর্থাৎ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়) বিদ্যাসাগরের ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে, বিদ্যাসাগর তখন প্রধানত বিধবাবিবাহ আন্দোলন নিয়ে ব্যাপৃত, তাই স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার বা বেথুন স্কুলের ঘটনাবলির সঙ্গে তখন তাঁর তেমন যোগ স্থাপিত হয়নি বা স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি তখনও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেননি। বস্তুত এই কারণে বেথুনের সঙ্গেও তখন তাঁর তেমন পরিচয় গড়ে ওঠেনি। আমাদের দৃঢ় অনুমান মদমমোহনই কলকাতা ছেড়ে যাবার আগে বেথুন স্কুলের হাল ধরার জন্য বিদ্যাসাগরের নাম বেথুনের কাছে সুপারিশ করেছিলেন। কারণ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছিলেন যে, স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলনকে বাধা দেবার জন্য তখন সমাজের রক্ষণশীল পক্ষ থেকে যে কুৎসা রটনা ও হীন চক্রান্ত চলছে, তার মধ্যে মাথা উঁচু করে কাজ করার মতো একমাত্র যোগ্য মানুষ বিদ্যাসাগর যাকে তিনি বাল্যাবধি চেনেন এবং সেই কারণেই যিনি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। আমাদের নিশ্চিত ধারণা মদনমোহনের সুপারিশ নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে মদনমোহন কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই বেথুন বিদ্যাসাগরকে স্কুলের সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত করেন। তারপর বিদ্যাসাগর তাঁর নিজস্ব প্রতিভা, নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতায় স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলনকে সংগঠিত ও সুদূর প্রসারী করে তোলেন। এক্ষেত্রে মদনমোহনই হচ্ছেন বিদ্যাসাগরের অনুচ্চারিত বা অঘোষিত পৃষ্ঠপোষক। বলাবাহুল্য, এই ঘটনাকে বিদ্যাসাগরের প্রতি মদনমোহনের নি:স্বার্থ বন্ধুকৃত্য বলে গণ্য করাই সমীচীন হবে।
দুই বন্ধুর পারস্পরিক আস্থাশীলতার সবচেয়ে বড়ো নিদর্শন দুইজনের অংশীদারিত্বে স্থাপিত ‘সংস্কৃত প্রেস’ (১৮৪৭)। এই ছাপাখানা স্থাপনের সঙ্কল্প গ্রহণে মদনমোহনই অগ্রণী। কারণ গ্রন্থপ্রচারের ক্ষেত্রে মুদ্রণ-প্রযুক্তির শক্তি যে কত প্রবল তা একজন পুথিনির্ভর লিপিকরের পুত্র হিসাবে বিদ্যাসাগরের আগে মদনমোহনই অনুধাবন করেছিলেন। কারণ ছাত্রাবস্থাতেই ‘রসতরঙ্গিণী’ (১৮৩৪) ও ‘বাসবদত্তা’ (১৮৩৬)র মুদ্রিত সংস্করণ মদনমোহনকে কবিখ্যাতি এনে দিয়েছিল এবং কবিখ্যাতি লাভের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছাপাখানা ও বই প্রকাশের অর্থকরী সম্ভবনাও লক্ষ করেছিলেন। মদনমোহনের কর্মজীবনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি উত্তরোত্তর উচ্চতর বেতনের চাকুরি গ্রহণ করেছেন। এর উদ্দেশ্য অধিক অর্থ উপার্জন ও সঞ্চয় করা। কারণ তিনি জানতেন: সমাজে মান্যতা লাভ করতে হলে একদিকে বিদ্যার্জন ও অন্যদিকে অথোপার্জন দরকার [তুলনীয় : (১) মূর্খের সম্মান নাই। (২) বিদ্যাধন আছে যার/সকলি সুসাধ্য তার। (৩) আঢ্য জন যারা/গণ্য হয় তারা। (৪) নির্ধনের আদর নাই। (৫) সঞ্চয়ী লোক অবসন্ন হয় না। ইত্যাদি। শিশুশিক্ষা, ২য় ভাগ।] এবং ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫-১৮৮২), রামগোপাল ঘোষ (১৮১৫-১৮৬৮) এবং সমকালীন আরও অনেকের দৃষ্টান্তে তিনি আরও জানতেন যে, চাকুরিতে সঞ্চয়ের যা সম্ভাবনা তার চেয়ে বেশি সম্ভাবনা বাণিজ্যে, কারণ ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী:’। তাই সংস্কৃত কলেজের চাকরির পাশাপাশি ছাপাখানা ও বইপ্রকাশের ব্যাবসার কথাও তাঁর মাথায় আসে। কিন্তু সমস্যা মূলধন সংগ্রহে ও ব্যাবসার ব্যবস্থাপনায়। মদনমোহন বুঝেছিলেন একাজ তাঁর একার পক্ষে সম্ভব নয়, এরজন্য চাই অত্যন্ত সৎ ও নির্ভরযোগ্য অংশীদার। মদনমোহনের কাছে তখন সবচেয়ে সৎ ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি বিদ্যাসাগর। সেজন্য তিনি বিদ্যাসাগরকে ছাপাখানা ও বইয়ের ব্যাবসার কথা বলেন। তারপর তাঁদের যৌথ মালিকানায় ছাপাখানা ও বইয়ের ব্যাবসা শুরু হয়। পরে তাঁদের সঙ্গে কিছুদিনের জন্য যোগ দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের সহপাঠী গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন (১৮২২-১৯০৩)। সকলের চেষ্টায় ও পরিশ্রমে অল্পদিনের মধ্যেই ‘সংস্কৃত প্রেস’কে কেন্দ্র করে তাঁদের বইয়ের ব্যাবসা খুব লাভজনক হয়ে উঠল। বিদ্যাসাগরের অধিকাংশ জীবনীকারের মতে, এই প্রেসের হিসাবপত্র ও ভাগবাঁটোয়ারা নিয়েই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে মদনমোহনের বিচ্ছেদ ঘটে। এটা একটা কারণ হতে পারে, কিন্তু একমাত্র কারণ কিছুতেই নয়। কেননা, বিদ্যাসাগর নিজেই বলেছেন, ‘ক্রমে ক্রমে এরূপ কতকগুলি কারণ উপস্থিত হইল যে, তর্কালঙ্কারের সহিত কোনও বিষয়ে সংস্রব রাখা উচিত নহে।’ অর্থাৎ বন্ধুবিচ্ছেদের কারণ একটি নয়, একাধিক। কারণগুলি কী কী হতে পারে? প্রথম ও প্রত্যক্ষ কারণ নিশ্চয়ই প্রেস-সংক্রান্ত, কিন্তু সেটাই সম্ভবত প্রধান কারণ নয়। দ্বিতীয় এবং প্রধান কারণ সম্ভবত অন্যত্র এবং আরও গভীরে, এবং সেটা আর্থিকভাবে বিপন্ন মদনমোহনের ভগিনী-ভগিনীপতি ও তাঁদের শিশু পুত্রকন্যার প্রতি মদনমোহনের দুর্ব্যবহার-সংক্রান্ত। এই দুর্ব্যবহারের ঘটনা একদিনে বা বিশেষ একটি উপলক্ষ্যে ঘটেনি, বিভিন্ন সময়ে ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে এইসব ঘটনা ঘটেছে। সম্ভবত এইজন্যই বিদ্যাসাগর বলেছেন, ‘ক্রমে ক্রমে এরূপ কতকগুলি কারণ উপস্থিত হইল।’ ‘নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস’ গ্রন্থেই বিদ্যাসাগর এই কারণগুলির আভাস দিয়েছেন। পূর্বতন পরিচয়সূত্রে বিদ্যাসাগর মদনমোহনের ভগ্নীপতি মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের আর্থিক দুরবস্থার কথা জেনে তাঁকে প্রেসের সরকার হিসাবে নিযুক্ত করেন, বিষয়টি মদনমোহনের মনঃপূত ছিল না। এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই মাধবচন্দ্রের নামেই মদনমোহনের প্রথম কাব্য ‘রসতরঙ্গিণী’ মুদ্রিত হয় (১৮৩৪)। যাইহোক, মাধবচন্দ্রের মৃত্যু হলে মদনমোহনের ভগিনী বামাসুন্দরী কলকাতায় এসে নিজের আর্থিক অসহায়তার কথা বিদ্যাসাগরকে জানিয়ে পুত্রকন্যার ভরণপোষণের জন্য তাঁর কাছে সাশ্রুনয়নে আর্থিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। এ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর লিখেছেন:
তর্কালঙ্কারের ভগিনী যাহা বলিলেন, তাহা কোনও অংশে অপ্রকৃত নহে; এজন্য তর্কালঙ্কারেরনিকট প্রস্তাব করিলাম, যতদিন তোমার ভাগিনেয়টি মানুষ না হয়, তাবৎ ছাপাখানার তহবিল হইতে তোমার ভগিনীকে মাস মাস দশ টাকা দিতে হইবেক। তর্কালঙ্কার নিতান্ত অনিচ্ছাপূর্ব্বক, সম্মত হইলেন। তাঁহার ভগিনী ছাপাখানার তহবিল হইতে, মাস মাস দশ টাকা পাইয়া দিনপাত করিতে লাগিলেন। কিছুদিন পরে, তর্কালঙ্কার মুরসিদাবাদ হইতে লিখিয়া পাঠাইলেন, আমার ভগিনীকে ছাপাখানার তহবিল হইতে, মাস মাস যে দশ টাকা দেওয়া হয়, তাহা আমি, আগামী মাস হইতে রহিত করিলাম। এই সংবাদ পাইয়া, তাঁহার ভগিনী কলিকাতায় আসিয়া, আমার নিকটে রোদন করিতে লাগিলেন। আমি বলিলাম, ছাপাখানার তহবিল হইতে আর আমি তোমায় টাকা দিতে পারিব না। আমি এইমাত্র করিতে পারি, আমার অংশের পাঁচ টাকা তুমি মাস মাস, আমার নিকট হইতে পাইবে; ইহার অতিরিক্ত দেওয়া আমার ক্ষমতার বহির্ভূত। তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন, আমার নিকট হইতে, মাস মাস, পাঁচ টাকা পাইয়া, কোনও রূপে দিনপাত করিয়াছিলেন। তাঁহার জীবদ্দশাতেই তদীয় পুত্রটির প্রাণত্যাগ ঘটে। তাঁহার মৃত্যুর পর, তদীয় বিধবা কন্যা, যতদিন জীবিত ছিলেন, আমার নিকট হইতে মাস মাস দুই টাকা লইয়া দিনপাত করিয়াছিলেন।
বিদ্যাসাগরের এই বিবরণ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, নিজের ভগিনী ও ভগিনীর পুত্রকন্যাদের প্রতি মদনমোহনের এই নির্দয় ব্যবহার ‘দয়ার সাগর’ বিদ্যাসাগরকে বিচলিত করেছিল। ফলে ধীরে ধীরে তাঁর মনে বন্ধুর প্রতি বিরূপতা সঞ্চিত হতে থাকে এবং তাঁর সঙ্গে সংস্রব ত্যাগের সঙ্কল্পও ঘনীভূত হতে থাকে।
কিন্তু বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। বন্ধুবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে যেসব কারণের কথা উল্লেখ করা হল, তার সঙ্গে আরও একটি কারণ যোগ করতে হবে। এই কারণটি মদনমোহনের দিক থেকে নয়, বিদ্যাসাগরের দিক থেকে। কারণটি হচ্ছে বিদ্যাসাগরের চরিত্রের একগুঁয়েমি, যা তিনি তাঁর পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের কাছে পেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর নিজেই লিখেছেন, রামজয় ‘সকল বিষয়ে, স্বীয় অভিপ্রায়ের অনুবর্তী হইয়া চলিতেন, অন্যদীয় অভিপ্রায়ের অনুবর্তন তদীয় স্বভাব ও অভ্যাসের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল।’ অর্থাৎ নিজের কর্তব্য নির্ধারণে তিনি একমাত্র নিজের ইচ্ছা বা বিচার-বিবেচনাকে গুরুত্ব দিতেন, সেখানে অন্য কিছু বিবেচনার সুযোগ ছিল না। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রেও তাই ঘটত। তিনি নিজে যেটা ঠিক মনে করতেন, অন্যের বিচারে সেটা ঠিক না হলেও যেহেতু সেটা তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত, সেজন্য তাতেই তিনি অবিচল থাকতেন। এক্ষেত্রে কোনো বস্তুগত ভিত্তির বদলে একান্ত আত্মগত (Subjective) বিবেচনার ভিত্তিতেই তিনি বড়ো বড়ো সিদ্ধান্ত নিতেন। এর ফলে সারাজীবন অনেকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে, অতি নিকটজনের সঙ্গেও বিচ্ছেদ ঘটেছে। যেমন, কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই তিনি নিজের জামাতা সূর্যকুমার অধিকারীকে কর্মচ্যুত করেন, এখানে একমাত্র কারণ তাঁর মনে হয়েছে যে, সূর্যকুমারের কাজকর্মে সততার অভাব। এই মনে হওয়ার তেমন কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই, সবটাই তাঁর নিজের বিবেচনাপ্রসূত। এইরকম আরও দৃষ্টান্ত আছে, যেমন: তাঁর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটান স্কুলে বেত্রদন্ড নিষিদ্ধ ছিল। এক শিক্ষক এই নিষেধাজ্ঞা না মানায় বিদ্যাসাগর সঙ্গে সঙ্গে তাকে কর্মচ্যুত করেন। কয়েকজন শিক্ষক বিদ্যাসাগরের এই কাজের প্রতিবাদ করায় তিনি কোনো দিক বিবেচনা না করে সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও কর্মচ্যুত করেন। এরকম পূর্বাপর বিবেচনাহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আরও দৃষ্টান্ত তাঁর জীবনীগুলিতে পাওয়া যায়। এইরকম আত্মগত বিবেচনার উপর নির্ভর করে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্কচ্ছেদের ঘটনাও একাধিক। যে বিধবাবিবাহকে তিনি জীবনের ‘সর্বপ্রধান সৎকর্ম’ বলে মনে করতেন শুধু নিজের জেদ বজায় রাখার জন্য তিনি জীবনের শেষ দিকে নিজের বীরসিংহ গ্রামের একটি বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করেন। এ প্রসঙ্গে মুচিরাম বন্দোপাধ্যায় ও মনোমোহিনীর বিবাহের ঘটনাটি স্মরণীয়। স্কুলশিক্ষক মুচিরাম বিধবা মনোমোহিনীকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ক্ষীরপাই গ্রামের হালদারেরা এই বিবাহ বন্ধ করার জন্য বিদ্যাসাগরের শরণাপন্ন হন। বিদ্যাসাগর হালদারদের সাহায্য করতে সম্মত হন। কিন্তু তাঁর নিজের কয়েকজন আত্মীয় ও গ্রামবাসীদের সমবেত প্রচেষ্টায় বিবাহ সম্পন্ন হয়। এতে বিদ্যাসাগরের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে এবং আত্মীয় ও গ্রামবাসীদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি চিরতরে বীরসিংহের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এইরকম আহত আত্মাভিমানের কারণে বিদ্যাসাগর তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু ডা: মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩-১৯০৪)-এর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। সুবলচন্দ্র মিত্র তাঁর ‘Isvar Chandra Vidyasagar Story of his life and work’ (1907) বইতে এ সম্পর্কে লিখেছেন যে, একবার বিদ্যাসাগর তাঁর গুরুতররূপে অসুস্থ ছোটো মেয়েকে দেখার জন্য মহেন্দ্রলালকে চিঠি দেন, কিন্তু মহেন্দ্রলাল যেতে অনেক দেরি করেন। মহেন্দ্রলাল বিদ্যাসাগরের চিঠি খুলে পড়তে দেরি করেছিলেন, তাই বিদ্যাসাগরের মেয়েকে দেখতে আসতেও তাঁর দেরি হয়। মহেন্দ্রলাল বিদ্যাসাগরকে একথা বলতেই ‘he (বিদ্যাসাগর) was deeply pained and a little offended. Thus originated the difference, which ultimately grew so serious, that the two hardly met, and if ever they met by accident, their four eyes never met. They met only again for the last few days of Vidyasagar’s life, when Mahendra Lal willingly forgot the difference and called to see the great man in his sickbed’। এখানেও সেই আহত আত্মঅভিমান, যার কাছে অন্য যে-কোনো রকম বস্তুগত বিবেচনা অবান্তর। চিঠি পেয়েও মহেন্দ্রলাল সেই চিঠিকে গুরুত্ব দেননি, এতেই বিদ্যাসাগর ক্ষুব্ধ। পরে সেই ক্ষোভ বাড়তে বাড়তে দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায়।
আমাদের মনে হয় মদনমোহনের ক্ষেত্রেও একইরকম মনোভাব কাজ করেছে। এখানে দুঃস্থ ভগ্নীর পরিবারের প্রতি মদনমোহনের বিরূপতা যতটা না কাজ করেছে, তার চেয়েও বেশি কাজ করেছে মদনমোহনের ভগ্নীর পরিবারের প্রতি বিদ্যাসাগরের সস্নেহ মনোভাবের সাপেক্ষতা না করে মদনমোহনের দিক থেকে তার বিরুদ্ধতা করার ঘটনা। এখানেও বিদ্যাসাগরের আত্মাভিমান আহত, সেজন্য মদনমোহন কেন যে তাঁর ভগিনীরপরিবারের প্রতি বিরূপ তার বস্তুগত বিচার-বিবেচনা বিদ্যাসাগরের কাছে অবান্তর। মদনমোহন বিদ্যাসাগরের মনোভাবকে মর্যাদা না দিয়ে তার বিরুদ্ধতা করেছেন, বিদ্যাসাগরে আত্মাভিমান আহত হবার এটাই যথেষ্ট কারণ। অথচ বস্তুগত বিবেচনায় আমাদের মনে হয় ভগিনীর পরিবারকে অর্থসাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার পেছনে সম্ভবত কিছু বাস্তব কারণ ছিল। এই কারণ সন্ধানে আমাদের হাতে কোনো কাগুজে প্রমাণ নেই, তাই কিছু যুক্তিনির্ভর অনুমানের সাহায্য নিতে হবে। মদনমোহন নিজে ব্যয়কুন্ঠ বা কৃপণ ছিলেন না। সঞ্চয়ে আগ্রহ থাকলেও নানা সৎকাজে তিনি অর্থব্যয়ে পরাঙ্খুখ ছিলেন না। বহরমপুরের কলেজ তহবিলে তিনি ৫০ টাকা (তাঁর মাসিক বেতনের এক তৃতীয়াংশ) চাঁদা দিয়েছেন। এ ছাড়া, বহরমপুরে ও কান্দিতে থাকার সময় নানা জনহিতকর কাজে প্রচুর অর্থব্যয় করেছেন। বিশেষত তিনি কান্দিতে পথশিশুদের নিজব্যয়ে লালনপালন করতেন, দরিদ্রদের মৃতদেহ নিজব্যয়ে সৎকার করাতেন—সৎকাজে অর্থব্যয়ের আরও উদাহরণ যোগেন্দ্রনাথ তাঁর মদনমোহন-জীবনীতে উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া, ‘শিশুশিক্ষা’র তিন ভাগেই দীন-দরিদ্রকে সাহায্য করার ঔচিত্য নিয়ে একাধিক পাঠ রয়েছে। সুতরাং তিনি যে স্বভাবকার্পণ্যবশত ভগিনীর পরিবারকে অর্থসাহায্য করতে চাননি একথা মেনে নেওয়া কঠিন। আসলে আমাদের মনে হয় মদনমোহন কারও প্ররোচনায় এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কার প্ররোচনায়। এখানেও আমাদের হাতে কোনো কাগুজে প্রমাণ নেই, তাই যুক্তিনির্ভর অনুমানই আমাদের একমাত্র সম্বল। আমাদের অনুমান এই প্ররোচনা এসেছিল মদনমোহনের স্ত্রী মুক্তকেশী দেবীর কাছ থেকে। মুক্তকেশীকে হরিশ্চন্দ্র কবিরত্ন ‘কিছু প্রগলভা’ বলে বর্ণনা করেছেন, অন্যদিকে ‘নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াসে’ দেখা যায় মদনমোহনের বিধবা কন্যা কুন্দমালা মায়ের সামনেই বিদ্যাসাগরকে জানাচ্ছেন, ‘দেখ কাকা! পিতা অনেক টাকা রাখিয়া গিয়াছিলেন; মা বুঝিয়া চলিলে, আমাদের স্বচ্ছন্দে দিনপাত হইতে পারিত। কিন্তু উনি বিবেচনা করিয়া চলিতেছেন না, সকলই উড়াইয়া ফেলিতেছেন।’ অর্থাৎ মেয়ের বিবেচনায় মা অমিতব্যয়ী। মুক্তকেশীর এই অমিতব্যয়িতা নিশ্চয়ই মদনমোহনের জীবৎকালেও ছিল। মদনমোহনের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘কলিকাতায়, মুরসিদাবাদে ও কাঁদিতে কর্ম্ম করিবার সময়, তর্কালঙ্কারের পরিবার তাঁহার নিকটে থাকিতেন; তাঁহার বৃদ্ধা জননী বিল্বগ্রামের বাটীতে অবস্থিতি করিতেন।’ বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নও লিখেছেন, ‘মৃত মদনমোহন তর্কালঙ্কার দাদার বাল্যবন্ধু ও সহাধ্যায়ী ছিলেন। এজন্য তাঁহার জননী বিশ্বেশ্বরী দেবীকে দাদা মাতৃ সম্বোধন করিতেন, তর্কালঙ্কারের পত্নীসহ তাঁহার মনের মিল হইত না সুতরাং সর্ব্বদা বিবাদ হইত।’ এইসব বিবরণ থেকে মনে হয় মদনপত্নী মুক্তকেশী দেবী মানুষ হিসাবে কিছুটা আত্মপরায়ণ ছিলেন, নিজের স্বামী ও পুত্রকন্যা ছাড়া পরিবারের আর কারও স্বার্থ দেখার মানসিকতা তাঁর ছিল না। এইজন্য তিনি সেকালের একান্নবর্তী পরিবারের প্রথা মেনে সকলের সঙ্গে একত্র থাকতে চাইতেন না। পারিবারিক বিসংবাদ এড়াবার জন্য মদনমোহন স্ত্রী ও কন্যাদের কর্মস্থলে নিয়ে গিয়ে বসবাস করতেন। একদিকে এই আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা, অন্যদিকে অমিতব্যয়ের অভ্যাস—এইজন্যই হয়তো মুক্তকেশী ননদ ও তার ছেলেমেয়েদের জন্য অর্থসাহায্য করাকে অর্থের অপব্যয় বলে মনে করতেন এবং তাদের অর্থসাহায্য না করার জন্য স্বামীকে প্ররোচনা দিতেন। এই ধরনের ‘অবোধ’ ও ‘ভোগাভিলাষিণী পত্নী’ যে সংসারের সুখ নষ্ট করে এবং সাংসারিক সুখশান্তি রক্ষার জন্য ‘ভর্ত্তা’কে যে ‘ভার্য্যার নির্বন্ধাতিশয্য’ অন্যায় হলেও মেনে নিতে হয় তা ‘স্ত্রীশিক্ষা’ প্রবন্ধে মদনমোহন উল্লেখ করেছেন। মদনমোহনের দাম্পত্যজীবনে কোনো অস্বাচ্ছন্দ্য ছিল না, এই স্বাচ্ছন্দ্যরক্ষার জন্যই হয়তো স্ত্রীর প্ররোচনায় মদনমোহন ভগিনীকে অর্থসাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এই অনুমানের সপক্ষে আমাদের কাছে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই, তবু আনুষঙ্গিক নানা বিষয় বিবেচনা করে স্ত্রীর প্ররোচনাকেই ভগিনীর পরিবার সম্পর্কে মদনমোহনের এই অনুদার অবস্থানের প্রধান কারণ বলে মনে হয়।
বলাবাহুল্য, মদনমোহনের এই অবস্থান বিদ্যাসাগরকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল। এই জন্যই হয়তো তিনি মদনমোহনের সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। প্রেসের পাওনা নিয়ে বৈষয়িক মতান্তরের ঘটনা এই ক্ষোভ প্রকাশের একটা বাহ্য উপলক্ষ্য মাত্র। এই বাহ্য উপলক্ষ্যের অন্তরালে যে অন্য কারণ ছিল তা বোধহয় কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য (১৮৪৩-১৯৩২) পরে জানতে পেরেছিলেন, তাই তিনি লিখেছেন, ‘মদনমোহনের সহিত বিদ্যাসাগরের মনোমালিন্যের কারণ কি, সেটি আমি বিশেষ বিচার করিয়া দেখিলাম যে, প্রকাশ করা উচিত নহে;…এই পর্য্যন্ত বলিতে পারি যে, প্রকাশিত হইলে বিদ্যাসাগরের প্রতি লোকের শ্রদ্ধার হ্রাস না হইয়া বরং বৃদ্ধিই হইবে’। যাইহোক, মদনমোহনের এই অনুদার অবস্থানে বিদ্যাসাগর এতটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে মদনমোহনের মৃত্যুর পরও অনেকদিন তাঁর পরিবারের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখেন নি। যদিও মদনমোহন মৃত্যুর আগে বলে গিয়েছিলেন যে, তাঁর অবর্তমানে তাঁর বন্ধু বিদ্যাসাগরই তাঁদের দেখাশোনা করবেন এবং মদনমোহনের স্ত্রীকন্যারাও সেকথা বিশ্বাস করে প্রতিনিয়ত বিদ্যাসাগরের দিক থেকে আহ্বানের আশায় থাকতেন। মদনমোহনের বিপন্ন স্ত্রী-কন্যাদের এই মানসিক প্রত্যাশার আভাস পাওয়া যায় মদনমোহনের চতুর্থ কন্যা (সম্ভবত হেমবালা দেবী)র ‘কুসুমমালিকা’ কাব্যের (১৮৭১) ‘বিলাপ’ শীর্ষক কবিতায়। কবি এই কবিতায় তাঁর প্রয়াত পিতার উদ্দেশে বলেছেন :
তুমি ত মৃত্যুর কালে সযতনে বলেছিলে,
ভাবনা কি আশ্রয় কারণ।
আমার হৃদয়-সম আছে বন্ধু প্রিয়তম,
আমা-সম করিবে যতন।
গুরুত্বে অচল-সম বিদ্যায় সাগর-সম,
সেই সখা পালিবে সবায়।
হায়! কি করম দোষে, সেই গুণিবর রোষে,
ভাবিল না কি হবে উপায়।।
পিতা গো! কঠোর মনে ফেলে নিজ কন্যাগণে,
কেন গেলে অমর ভবন?
ভেবেছিলে তব ভার, বহিবেক বন্ধুবর,
কিন্তু তাতে হ’ল হায়! অদ্ভুত ঘটন।।
সেই তব প্রাণসখা আর না দিতেছে দেখা
ক্রোধভরে রয়েছে এখন।
তব অভাগিনীগণ, রয়েছে দুখ-মগন,
ভাবে নাকো ভুলে একক্ষণ।।
(পৃ. ২০-২১)
‘কুসুমমালিকা’ কাব্যগ্রন্থটি বিদ্যাসাগরের হাতে পড়েছিল কিনা বা এই কাব্য বিদ্যাসাগর পড়েছিলেন কিনা তা আমরা জানি না। তবে এ থেকে বোঝা যায় যে, মদনমোহনের মৃত্যুর পর বিদ্যাসাগরের দিক থেকে মৃত বন্ধুর বিপন্ন পরিবারের খোঁজখবর নেওয়ার কোনো উদ্যোগ ছিল না। প্রয়াত বন্ধুর পরিবার সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের ঔদাসীন্য দূর হয় যখন মদনমোহনের মা বিশ্বেশ্বরী দেবী এবং কন্যা কুন্দমালা মাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কলকাতায় এসে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। বলাবাহুল্য, এরপর থেকে তিনি নানাভাবে মদনমোহনের মা ও মেয়েকে সাহায্য করতে থাকেন, এমনকি যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের সঙ্গে মদনমোহনের কনিষ্ঠা কন্যা মালতীমালার বিয়েও দিয়ে দেন (১৮৭১)। এ ছাড়া, ‘শিশুশিক্ষা’র গ্রন্থস্বত্ব নিয়ে যোগেন্দ্রনাথ কুন্দমালাকে জড়িয়ে বিদ্যাসাগরকে অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করলেও কুন্দমালা সম্পর্কে তাঁর সস্নেহ মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
মদনমোহনের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্কের বৃত্তান্ত বিশ্লেষণ করলে তার একটা গতিপ্রকৃতি বা রূপরেখা লক্ষ করা যায়। এই রূপরেখা অনুসরণ করলে দেখা যায় : প্রথমে বাল্য থেকে যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘকালীন সৌহাদ্য—তারপর মনোমালিন্য— সম্পর্কচ্ছেদ—মদনমোহনের মৃত্যু এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গেও সম্পর্ক না রাখা—এরপর মদনমোহনের পরিবারের দিক থেকে সংযোগ পুনঃস্থাপনের চেষ্টা—শেষ পর্যন্ত প্রয়াত বন্ধুর স্মরণে তাঁর বিপন্ন পরিবারের প্রতি কর্তব্যপালন। —কিন্তু এটাই কি বিদ্যাসাগর-মদনমোহন সম্পর্কের শেষ কথা? শেষদিকে মদনমোহনের পরিবারের জন্য বিদ্যাসাগর যা করেছেন সেতো সামাজিক-বিদ্যাসাগরের কাজ, তাঁর উইলটি পরীক্ষা করলে দেখা যায় এমন সামাজিক বন্ধুকৃত্য আরও অনেকের ক্ষেত্রে তিনি করেছেন। এখানে ব্যক্তি-বিদ্যাসাগরের পরিচয় কোথায়? ব্যক্তি- বিদ্যাসাগর বলতে বোঝাচ্ছে সেই নি:সঙ্গ বিদ্যাসাগরকে, যিনি পুত্রের সঙ্গে আইনি সম্পর্ক ছিন্ন করার পরও একান্তে পুত্রের ছবি দেখে নীরবে অশ্রুপাত করেছেন। এই ব্যক্তি বিদ্যাসাগরই জীবনের শেষ পর্বে প্রতিজ্ঞা করে ছেড়ে-আসা জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে ফিরে যাবার জন্য মানসিক ব্যাকুলতা বোধ করেছেন। চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এ সম্পর্কে লিখেছেন :
‘শেষ দশায় কলিকাতায় অবস্থান কালে যখন ক্ষুদ্র পল্লী বীরসিংহের গ্রাম্য চিত্রসকল তাঁহার স্মৃতিপথে উদিত হইত, তখণ প্রাণটি দেহত্যাগ করিয়া স্মৃতিশিবিকারোহণে বীরসিংহ অভিমুখে ছুটিত, তখন অজস্রধারে অশ্রুবর্ষণ করিতেন, এরূপ অশ্রুজল আমরা স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছি। অশ্রুপাত করিয়া দারুণ মনঃক্ষোভের পরিচায়ক দীর্ঘনি:শ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিতেন, ‘আর সব শেষ হইয়াছে।’ এই সময়ে একবার ‘বীরসিংহ-জননীর পত্র’ বলিয়া একখানি ক্ষুদ্র পুস্তিকা তাঁহার হস্তগত হয়। সেই পুস্তকান্তর্গত কাতরতার ভাবে তাঁহার কোমল হৃদয় আদ্র হয়। বহুক্ষণ ক্রন্দন করিয়া বাটী যাইবার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। তদনুসারে বাটীর মেরামত কার্যও আরম্ভ হয়, কিন্তু ক্রমে পীড়ার বৃদ্ধি হওয়ায় আর প্রতিজ্ঞাভঙ্গের ও জন্মভূমি দর্শনের অবকাশ হয় নাই।’
(বিদ্যাসাগর, বৈশাখ ১৪০৪ সংস্করণ, পৃ. ৩৫৭)
বিদ্যাসাগরের অপর চরিতকার বিহারীলাল সরকার অবশ্য লিখেছেন, ‘মৈত্রী-বিচ্ছেদে বিদ্যাসাগর মহাশয় কখনও স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া বিগত মৈত্রীর পুনরুদ্ধারার্থ অগ্রসর হইতেন না।’ কিন্তু নিজের পুত্রের ক্ষেত্রে ও জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রাম সম্পর্কে তাঁর অন্তবের্দনা থেকে মনে হয়, নিজের প্রতিজ্ঞারক্ষার ব্যাপারে তিনি সচেতনভাবে যত কঠোরই হোন না কেন, কতকগুলি সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর মনে গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। বলাবাহুল্য এই অন্তর্দ্বন্দ্ব তাঁর মহত্ত্বকে ম্লান করে না, তাঁর মানবিক বৈশিষ্ট্যকেই সমুজ্জ্বল করে তোলে। আমাদের প্রশ্ন : মদনমোহন তো তাঁর ‘বাল্যসহচর’ ও দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গী, তাঁর ব্যাপারেও কি বিদ্যাসাগরের মনে কখনও এই ধরনের অন্তর্বেদনা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব জেগেছিল? আমরা বুঝতে পারি, ১৮৫৬ সালের আগস্ট মাসে মদনমোহন যখন কলকাতায় বিদ্যাসাগরকে দেখতে যান তখন বন্ধুর প্রতি বিদ্যাসাগরের যে রূঢ় প্রত্যাখ্যান সেতাঁর মদনমোহনের সংস্রবত্যাগের কঠোর সঙ্কল্পের জন্য। কিন্তু তাঁর ভিতরে যে অন্তর্লীন নমনীয়তা ছিল যা পুত্র ও বীরসিংহের ক্ষেত্রে পরিস্ফুট তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কৌতূহল হয় যে, কয়েক মাস পরে ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় যে প্রথম বিধবা-বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় এবং যে বিবাহের প্রথম ‘সংযোজনকর্তা’ মদনমোহন স্বয়ং, সেই বিবাহে যদি মদনমোহন উপস্থিত থাকতে পারতেন তাহলে কি এই ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগত? বিশেষত এই ঐতিহাসিক বিবাহ উপলক্ষ্যে যখন বিদ্যাসাগর ও মদনমোহনের অনেক বন্ধু একত্র মিলিত হয়েছিলেন। এইসব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মধ্যস্থতা কি তখন একেবারে নিষ্ফল হত? কী হত তা বলা কঠিন, তবে একথা বলাই যায় যে দুজনের মধ্যে পুনর্মিলনের একটা অনুকূল অবকাশ তখন তৈরি হতে পারত। কিন্তু দুঃখের বিষয় ছুটির অভাবে মদনমোহন এই ঐতিহাসিক বিবাহ-অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি, এবং এর অল্পকালের মধ্যেই তাঁর আকস্মিক অকালমৃত্যুতে পুনর্মিলনের সম্ভাবনা আর দেখা দেয়নি। তবে কয়েকটি ঘটনায় বোঝা যায় যে মদনমোহনের পরিবারের দিক থেকে তাঁর সঙ্গে পুনরায় যোগ স্থাপনের পর, তাঁর মনের গভীরে মদনমোহন সম্পর্কে একটা নিবিড় একাত্মতাবোধ জেগে উঠেছিল। মদনমোহনের দুই মেয়ে কুন্দমালা ও মালতীমালার প্রতি তাঁর আচরণে এই একাত্মতাবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। অন্য অনেকের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর পূর্বাপর বিবেচনা না করেই কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিন্তু কুন্দমালার ক্ষেত্রে তা হয়নি। এ সম্পর্কে বিদ্যাসাগর নিজে লিখেছেন, ‘আমি (যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণকে) বলিলাম, কুন্দমালাকে বলিবে, আমি তাহাকে, মাস মাস, যে দশ টাকা দিতেছি, অনেকে, তোমাদের আচরণ দর্শনে অতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়া, তাহা রহিত করিবার নিমিত্ত আমায় পরামর্শ দিতেছেন। কিন্তু কুন্দমালা নিতান্ত অনাথা, আর, আমি যতদূর বুঝিতে পারিতেছি, এ বিষয়ে তাহার কোনও অপরাধ নাই। এজন্য, আমি তাহাকে মাস মাস যে দশ টাকা দিতেছি, তাহা দিব, কদাচ তাহা রহিত করিব না।’ কুন্দমালার ‘অপরাধ’ বিষয়ে তাঁর এই যে বিচার-বিবেচনা এটাই কুন্দমালা সম্পর্কে তাঁর অবস্থানের স্বাতন্ত্র্য। এই অবস্থান সামাজিক বিদ্যাসাগরের নয়, ব্যক্তি-বিদ্যাসাগরের, যিনি এখানে কুন্দমালার পিতার আসনে প্রতিষ্ঠিত। নিজের ছাত্র যোগেন্দ্রনাথের সঙ্গে মালতীমালার বিবাহ দেওয়ার ক্ষেত্রেও সামাজিক বিদ্যাসাগরের চেয়ে ব্যক্তি-বিদ্যাসাগরই সক্রিয়, কারণ এক্ষেত্রে মদনমোহন বেঁচে থাকলে যে-কাজ করতেন বিদ্যাসাগরও তা-ই করেছেন। দুটি ক্ষেত্রেই বিদ্যাসাগর মদনমোহনের ‘একহৃদয়’ ও ‘সহোদরাধিক’ ‘বাল্যসহচর’।
বস্তুত ১৮৫৮ সালে মদনমোহনের অকালমৃত্যুর পর বিদ্যাসাগর বেশ কয়েক বছর তাঁর পরিবারের কোনো খোঁজখবর রাখেননি, তবে মদনমোহনের পরিবার তাঁর সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন করলে উনিশ শতকের ষাটের দশকের শেষ দিক থেকে তিনি যে মনে মনে মদনমোহনের কাছে ফিরে আসতে শুরু করেছিলেন কুন্দমালা-মালতীমালার বৃত্তান্ত ছাড়াও অন্য ঘটনা থেকেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৮৬৯ সালে হরিমোহন মুখোপাধ্যায় ‘কবিচরিত’ (প্রথম ভাগ) নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন, তাতে ‘সংকলিত’ মোট সাতজন বাঙালি কবির ‘সংক্ষিপ্ত বিবরণের’ মধ্যে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবনচরিত ও কয়েকটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে যোগেন্দ্রনাথের মদনমোহন জীবনী, যার প্রথম প্রকাশকাল ১৮৭১ সাল, তা তখনও প্রকাশিত হয়নি)। এই বইয়ের ‘বিজ্ঞাপনে’ (কলিকাতা, কার্ত্তিক সংবৎ ১৯২৬) হরিমোহন জানিয়েছেন, ‘মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবনবৃত্ত সংগ্রহ বিষয়ে পন্ডিতাগ্রগণ্য মহামান্য শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বিশেষ সাহায্য করিয়াছেন।’ হরিমোহনের বইতে বিদ্যাসাগরের ‘বিশেষ সাহায্য’ নিয়ে সংকলিত মদনমোহনের সংক্ষিপ্ত জীবনীতে তাঁর ছাত্রজীবন ও কর্মজীবন সম্পর্কে এমন তথ্য উল্লিখিত হয়েছে যা যোগেন্দ্রনাথ বা মদনমোহনের আর কোনো চরিতকার উল্লেখ করেননি। যেমন, সংস্কৃত কলেজে মদনমোহনের ছাত্রজীবন সম্পর্কে এখানে বলা হয়েছে :
‘পঠদ্দশায় শাস্ত্রচিন্তায় তাদৃশ পরিশ্রম করিতেন না। গল্পগুজোব ও আমোদ প্রমোদ করিয়াই অধিক কালক্ষেপণ করিতেন। তথাপি অসাধারণ বুদ্ধি ও প্রতিভাবলে তদানীন্তন ছাত্রগণের মধ্যে একজন প্রধান বলিয়া পরিগণিত ছিলেন। কখন কখন এমনও ঘটিত যে প্রায় সমুদায় বৎসর বৃথা ক্ষেপণ করত পরীক্ষার কিছুদিন পূর্ব্বে উপস্থিত হইয়া পরীক্ষা দিয়া পুরস্কৃত হইয়াছেন। এই সময়ে কিছু কিছু ইংরাজী ভাষাও শিক্ষা করিয়াছিলেন।’ (পৃ. ১৫২-১৫৩)
বলাবাহুল্য এই তথ্য বিশ্বাসযোগ্যভাবে তাঁর পক্ষেই দেওয়া সম্ভব যিনি একাধারে মদনমোহনের সহপাঠী ও বাল্যসহচর। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, হরিমোহনকে মদনমোহনের ছাত্রজীবনের এই তথ্য দেওয়ার সময় বিদ্যাসাগরের বাল্যস্মৃতি উদ্বেল হয়ে উঠেছিল এবং মনে মনে তিনি মদনমোহনের সঙ্গে তাঁর বাল্যসাহচর্যের দিনগুলিতে ফিরে গিয়েছিলেন। আবার জীবনীর আর এক জায়গায় আছে :
তর্কালঙ্কার অত্যন্ত সুরসিক ও সদ্বক্তা ছিলেন। তিনি গল্প করিতে আরম্ভ করিলে লোকসকল চিত্রার্পিতের ন্যায় একাগ্র হইয়া শ্রবণ করিত। সামান্য পত্রাদি অনর্গল লিখিয়া যাইতেন তথাপি যেন তাঁহার লেখনী অমৃতধারা বর্ষণ করিয়াছে বলিয়া বোধ হইত। যে কোন বর্ণনা করিয়া শ্রোতৃবর্গকে বিলক্ষণ আদ্র করিতে পারিতেন। বড় অলস ছিলেন, এজন্য কিছু ভাল গ্রন্থ লিখিয়া যাইতে পারেন নাই’ (পৃ. ১৫৬)।
মদনমোহন সম্পর্কে এই বিবৃতিতে একদিকে যেমন তাঁর সম্পর্কে সপ্রশংস গুণগ্রাহিতা আছে, অন্যদিকে তেমনি ক্ষুব্ধ অনুযোগও প্রকাশ পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মদনমোহন বহরমপুরে যাবার পর চাকরির বাইরে কিছু সামাজিক কাজকর্ম করলেও সাহিত্যচর্চা একেবারে ছেড়ে দিয়েছিলেন, যদিও চাকরি ও সমাজসেবা করেও তাঁর হাতে যথেষ্ট সময় থাকত। সমসাময়িক ‘সুধীরঞ্জন’ পত্রে (১৮৫৫) দ্বারকানাথ অধিকারী বাংলা ভাষা-ইংরেজি ভাষার একটি কাল্পনিক সংলাপ-কবিতায় এ বিষয়ে লিখেছেন :
এতদিন কিগো তুমি করনি শ্রবণ।
মদন কবিতা আর করে না রচন।।
ক্রমে ক্রমে তার বড় বাড়িতেছে পদ,
তোমায় ভাবিছে মনে বালাই আপদ।।
এ হল মদন-গর্বিত বাংলা ভাষার প্রতি ইংরেজি ভাষার তীক্ষ্ণ কটাক্ষ। এই কটাক্ষে মদনমোহনের প্রতি যে ব্যঙ্গের অনুগ্র খোঁচা আছে তা ‘কবিচরিতে’র পূর্বোদ্ধৃত বিবৃতিতে নেই। তাতে আছে মদনমোহনের প্রতি উচ্ছ্বসিত প্রশংসার সঙ্গে অকপট অনুযোগ যা একমাত্র তাঁর ‘অমায়িক’ বন্ধু বিদ্যাসাগরের কাছ থেকেই আশা করা যায়। এ থেকে অনুমান করা যায় ১৮৬৯ সাল নাগাদ প্রয়াত মদনমোহনের সঙ্গে ব্যক্তি-বিদ্যাসাগরের মানস পুনর্মিলন ঘটেছিল, কিন্তু সামাজিক বিদ্যাসাগর তা তাঁকে প্রচার করতে দেননি। ‘নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াসে’ (১৮৮৮) মদনমোহন প্রসঙ্গে তাই তিনি নিজেকে নৈর্ব্যক্তিকতার ঘেরাটোপে ঘিরে রেখেছেন।
এ ছাড়া বাল্যস্মৃতি যেমন অন্তিম জীবনে বিদ্যাসাগরকে প্রতিজ্ঞা করে ছেড়ে-আসা বীরসিংহ গ্রামে ফিরে যাবার জন্য ব্যাকুল করেছিল, মদনমোহনের একটি তরুণ বয়সের স্মৃতির নিদর্শনও তেমনি মদনমোহনের মৃত্যুর তেরো বছর পর বিদ্যাসাগরকে বন্ধুর একটি কীর্তি সযত্নে রক্ষা করতে সচেষ্ট করেছে। বিষয়টি মদনমোহনের ‘বাসবদত্তা’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে। বইটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয় (১৮৩৬) তখন মদনমোহন ও ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের সহপাঠী। মদনমোহনের বয়স তখন উনিশ, ঈশ্বরচন্দ্রের ষোলো। এই কাব্য প্রকাশিত হবার পর মদনমোহনের কবিখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্যাসাগর এই ঘটনার সাক্ষী। পরবর্তীকালে মদনমোহন কাব্যটির পুনঃপ্রকাশ বন্ধ করে দেন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কাব্যটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এরপর যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণের সম্পাদনায় ২৫ জুলাই ১৮৭১ তারিখে কাব্যটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে যে বিদ্যাসাগর-সংগ্রহ আছে, তাতে এই তৃতীয় সংস্করণের একটি কপি রক্ষিত আছে (গ্রন্থসংখ্যা বি ৫২)। হয়তো সম্পাদক যোগেন্দ্রনাথই বিদ্যাসাগরকে এই কপিটি উপহার দিয়েছিলেন, কিন্তু এভাবে পাওয়া আরও অসংখ্য উপহারের মধ্যে বিদ্যাসাগর সেটি হারিয়ে ফেলেননি, সযত্নে রক্ষা করেছেন। বাল্যবন্ধুর প্রতি ব্যক্তিবিদ্যাসাগরের এ-ও এক একান্ত ও গোপনচারী একাত্মতাবোধ। এইসব দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায় যে, পুত্রের ক্ষেত্রে ও বাল্যভূমি বীরসিংহের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যেমন তাঁর সামাজিক সত্তাকে লঙ্ঘন করে মনের গভীরে একটা নিবিড় অন্তর্বেদনা বোধ করেছেন, বাল্যবন্ধু মদনমোহনের ব্যাপারেও তেমনি তাঁর মনে ওই একইরকম অন্তর্বেদনা ও ও অর্ন্তদ্বন্দ্ব কাজ করেছে। মদনমোহন আমৃত্যু বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বিচ্ছেদ-বেদনার ‘মনোগ্লানি’র সঙ্গে গভীর আস্থাশীলতা পোষণ করে গিয়েছেন যা একদিক থেকে কিছুটা পরস্পরবিরোধী, অন্যদিকে বিদ্যাসাগরও মদনমোহন সম্পর্কে অন্তবের্দনা ও অন্তর্দ্বন্দ্বে কাতর হয়েছেন, কিন্তু বাইরে তা কখনও প্রকাশ করেননি। তাই আমাদের মনে হয় বিদ্যাসাগর ও মদনমোহনের সম্পর্ক এক বিরল সৌহার্দ্যের নিদর্শন এবং তা এক সুগভীর দ্বান্দ্বিক ভিত্তির উপর স্থাপিত।
বস্তুত ‘বন্ধুত্বের দৃষ্টান্ত’ নিয়ে মদনমোহন একসময়ে (১৮৩৬) যা লিখেছিলেন দুই বন্ধুর জীবনে তা শেষপর্যন্ত সত্য হয়ে উঠেছে :
সজ্জনের প্রীতি প্রতিদিন প্রতি বেলা।
শী [সি?] ত পক্ষ শশিসম বাড়ে প্রতি কলা।।
পাষাণের রেখা সম, সম চিরদিন।
নিধন হইলে তবু নাহি ভাবে ভিন।।