পরিশিষ্ট

বিদ্যাসাগর ও মধুসূদন : বৈপরীত্যের রহস্য

বিদ্যাসাগর ও মধুসূদন : বৈপরীত্যের রহস্য

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

চন্দ্রশেখর ব্রাহ্মণ এবং পণ্ডিত, কিন্তু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নহেন। —বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

বিদ্যাসাগর যে উনিশ শতকের অন্যতম মনীষী এ কথা আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। তাঁর জীবন ও কর্মসমূহ নানাভাবে আলোচিত হয়েছে। এমনকী নানা রাজনৈতিক দলের গত পঞ্চাশ বছরে তপ্ত বাদানুবাদ সাক্ষ্য দেয় তিনি মূর্তি হলেও রক্তমাংসময় এবং রূপকথা হলেও জ্যান্ত। অন্তত বাঙালিরা তাঁকে যতটা প্রতিভাবান ভাবে তার চাইতে চরিত্রবান ভাবে অনেক বেশি। বস্তুত বিদ্যাসাগর ‘চরিত্র’ একটি উপমা বিশেষ। নির্ভীক ও নির্লোভ, দারিদ্র্য সত্ত্বেও স্থিরলক্ষ্য, বিদ্যার্জনে নিবেদিত প্রাণ, পরহিতব্রতী, দুর্গত নারীসমাজের ত্রাণকর্তা, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ। একদিকে ইংরেজ শাসক অন্যদিকে নবীন অভিজাত সমাজ যাঁকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি এমন দৃঢ়চেতা ঈশ্বরচন্দ্র বিষয়ে এমতো ধারণাসমূহ বহুদিন ধরেই জনসমাজে প্রচলিত। তামাক ব্যতীত কোনওরকম নেশাদ্রব্য বা নারীসংসর্গ তাঁর শুভ্র পরিধেয়কে মলিন করতে পারেনি। কিন্তু এহেন তেজস্বী ও শৃঙ্খলাপরায়ণ বিদ্যাসাগর কেন মধুসূদন দত্তের মতো চূড়ান্ত উৎকেন্দ্রিক ও তথাকথিত পতিত চরিত্রকে শর্তহীন সমর্থন জানিয়ে গেলেন? সে কি মাইকেল মধুসূদন প্রতিভা বলেই?

যতদূর পর্যন্ত ইতিহাসের সঙ্গে পরামর্শ করা যায় তাতে দেখি শুধু আর্থিক সাহায্য নয়, মধুসূদন বিদ্যাসাগর মশাইয়ের থেকে নৈতিক অবস্থানের সমর্থনও পেয়েছেন। এই সম্পর্কের মধ্যে হয়তো মধুসূদনের আত্মোপকার প্রেরণা থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু বিদ্যাসাগরের কি ছিল? মনে রাখতে হবে তাঁর যে উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি বাক্যের কথা আমরা স্মরণ করি তা এক মর্মান্তিক বিপদে বিদ্যাসাগর প্রেরিত দেড় হাজার টাকার অকুণ্ঠিত ঋণস্বীকার। ‘The mail will be in today and I am sure to receive news, for the man to whom I have appealed has the genius and wisdom of an ancient sage, the energy of an Englishman, and the heart of a Bengali mother. I was right; an hour afterwards, I received your letter 1500 Rs. you have sent me’ (২.৯.১৮৬৮, নিম্নরেখকরণ আমার)। এমনকী নিষ্ঠুর সত্য এই যে, ১৮৬২ সালের ৪ঠা জুন বন্ধু রাজনারায়ণকে মধুসূদন নিজেই জানিয়েছিলেন তাঁর ইউরোপ যাত্রার পরিকল্পনার সবচেয়ে সক্রিয় সমর্থক বিদ্যাসাগর। এমনকী মধুসূদনের সম্পত্তি বন্ধক রাখার বন্দোবস্ত করে দিয়ে যথেষ্ট টাকা জোগাড় করার দায়িত্বও তিনি স্বেচ্ছায় নিয়েছিলেন। তবু, মধুসূদন বিদেশযাত্রার পরে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আর কোনও সংযোগ রাখেননি। পরবর্তী চিঠিটি লিখেছিলেন ঠিক দু’ বছর বাদে— তাও ভার্সাই থেকে আর্থিক দুর্গতির কারণে, আর সেখানেও বিদ্যাসাগর চরিত্রের মহত্ত্ব উল্লেখ-পূর্বক তিনি নিজের আর্থিক দুর্দশা ও সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। কলকাতায় তাঁর বিষয়ে, বিশেষত তাঁর চরিত্র বিষয়ে আলোচনার প্রাদুর্ভাব ঘটলে বিদ্যাসাগরকে আশ্বস্ত করেছেন যে, ‘আমার পরম শত্রুরাও আমাকে কোনদিন মন্দলোক বলতে পারবে না’। বিদেশ থেকে ফিরে মদুসূদন বিদ্যাসাগর অসুস্থ জেনে সন্তপ্ত চিত্তে লেখেন: ‘There are men whom nature has given the hearts of bill-collecting Sircars. They would keep their wives and daughters naked (if they could) to save money. Such men might tell you anything against me but, I tell you, I have not been so successful as “জনরব” is pleased to give out’। [‘এমন অনেকে আছেন যাদের অন্তঃকরণ প্রকৃতিগতভাবেই রসিদ-আদায়কারী সরকার সম্প্রদায়ের। তারা তাদের স্ত্রী-কন্যাদের (সম্ভব হলে) উলঙ্গও রাখতে পারে টাকা জমানোর জন্য। এই ধরনের লোকজন আমার বিরুদ্ধে অনেক কিছু রটনা করতে পারে কিন্তু আমি আপনাকে জানাই এ বিষয়ে তত সাফল্য অর্জন করিনি জনরব যতটা দেখাতে চায়।’] বিদ্যাসাগর মধুসূদনকে জানতেন, সম্ভবত মধুসূদন তা অনুমান করে কিছু পাপবোধ না-হোক অস্বস্তিতেও কাতর ছিলেন, না-হলে আর একটি পত্রে আর্তনাদ করবেন কেন: ‘If you wave a vulgar fellow, I should (I repeat) hesitate to write to you in this strain for you would say— ‘‘Bah, he has been doing the aristocrat, let him suffer for his folly.’’’ [‘যদি আপনি কদর্য লোক হতেন, আমি অবশ্যই (পুনরায় বলি) দ্বিধা করতাম এই মানসিক চাপে আপনাকে লিখতে। কেননা আপনি বলতেই পারতেন— “বাঃ, বাবুয়ানি দেখাচ্ছিল, এবার পাপের ফল ভোগ করুক!”’] এই ঋণ গ্রহণ ও অবশ্যই ঋণ পরিশোধ পর্ব বিষয়ে অনেক বিস্তারিত তথ্য পেশ করা যায়। বলা যেতে পারে ঈশ্বরপ্রতিম ঈশ্বরচন্দ্র অন্তত একবার মধুসূদনের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে একটি চিঠি লেখেন যাতে নিরুপায় বিলাপ বার্তা ছিল। এমনকী, মধুসূদনের ঋণ পরিশোধের বিলম্বে ও অমিতব্যয়িতায় ক্ষুব্ধ হয়ে স্বভাববিরোধী বাক্যে বিদ্যাসাগর লেখেন— ‘এক্ষণে কিরূপে আমার মান রক্ষা হইবেক, এই দুর্ভাবনা সর্ব্বক্ষণ অন্তঃকরণকে আকুল করিতেছে এবং ক্রমে ক্রমে এত প্রবল হইতেছে যে রাত্রিতে নিদ্রা হয় না। অতএব আপনার নিকট বিনয়বাক্যে প্রার্থনা এই, সবিশেষ যত্ন ও মনোযোগ করিয়া ত্বরায় আমাকে পরিত্রাণ করেন।’ মধুসূদন নিশ্চয়ই কৃতঘ্ন ছিলেন না। কিন্তু বিদ্যাসাগরের কাছে তিনি নানারকম ঐহিক সাহায্য প্রার্থনা করেছেন ও যথাসম্ভব ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে উদ্ধার করেছেন। কলকাতার প্রধান ধর্মাধিকরণে ব্যারিস্টার হিসেবে আবেদন জানালে সবরকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ‘নৈতিকতা’-র কারণে দুরতিক্রম্য বাধার সম্মুখীন হন। সেসময় বিচারপতি শম্ভুনাথ পণ্ডিতের পরামর্শে তিনি কয়েকজন হিতৈষী সমাজপতির শরণাপন্ন হন। বিদ্যাসাগর সেসময় তাঁকে নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছিলেন ‘চরিত্র’ প্রশ্নে। যদিও মধুসূদন ১৮৬৭ সালের এগারোই এপ্রিল স্পেনসার্স হোটেল থেকে পাঠানো চিঠির শেষ পঙ্‌ক্তিতে স্পষ্ট ভাষায় বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘Private— I hope you will destroy this letter after perusal’ [‘ব্যক্তিগত— আশা করি বিবেচনান্তে আপনি চিঠিটি নষ্ট করে ফেলবেন’], তবু সমগ্র চিঠি প্রমাণ করে মধুসূদন বিদ্যাসাগরের দ্বারা কতদূর উপকৃত হয়েছিলেন। অত্যন্ত অন্তরঙ্গ, অত্যন্ত বিশ্বস্ত মনে করলেই গোপনীয় বিষয়ে এত চাপ দেওয়া যায়।

কিন্তু এতক্ষণ যা বলার চেষ্টা হয়েছে তা মাইকেল মধুসূদন দত্তের বহির্জাগতিক প্রয়োজনের দিকে চোখ রেখে। সুতরাং যোগ করা উচিত যে, মধুসূদন কৃতঘ্ন ও স্বার্থপর ছিলেন না। তিনি বীরাঙ্গনা কাব্যের উৎসর্গপত্রে যে ‘বঙ্গকুলচূড়া’ শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয়ের চিরস্মরণীয় নাম ‘উৎকীর্ণ’ করেছিলেন তা নেহাত শিষ্টাচার নয়; তাঁর সামাজিক তাৎপর্য আছে। আর তা এই ঋণগ্রহণ ও ঋণপরিশোধের বহু আগে। বরং কিংবদন্তিতে পরিণত, ‘বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।/ করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,/ দীন যে, দীনের বন্ধু’ প্রবাসকালীন লেখা। বিদ্যাসাগরের অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন মাইকেল আরও একটি রচনা প্রণয়ন করেন দেশে ফিরে: ‘শুনেছি লোকের মুখে পীড়িত আপনি/ হে ঈশ্বরচন্দ্র!/ বঙ্গে বিধাতার বরে বিদ্যার সাগর তুমি;’ রুগ্‌ণ বিদ্যাসাগরের রোগশয্যার পাশে না থাকতে পারায় তিনি অনুতপ্ত ছিলেন, এইসব নিতান্ত ঐতিহাসিক তথ্য। এই প্রসঙ্গেই আমার কাছে জরুরি হয়ে ওঠে যে-অপরপক্ষ, অর্থাৎ, বিদ্যাসাগর কেন নিষ্কলঙ্ক হওয়া সত্ত্বেও, বাস্তব প্রয়োজন ব্যতিরেকেই, উৎকেন্দ্রিক ও উন্মাদপ্রতিম মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রতি সীমাহীন পক্ষপাতিত্ব ও অনুরাগ দেখান— তা কি এইজন্যই যে তিনি মধুসূদনের মধ্যে নিজের ‘অপর’ সন্ধান করেছিলেন? অনেক পরবর্তী কালে স্বদেশীয় কবি, নাট্যকার, ‘অপরাধী’ জঁ জেনে বিষয়ে ফরাসি দার্শনিক ও লেখক জঁ-পল সার্ত্র একটি দার্শনিক সন্দর্ভ প্রণয়ন করেন যার শিরোনাম ছিল সন্ত জেনে: অভিনেতা ও শহিদ। সেই গ্রন্থ আমাদের আলোচ্য নয়, আর মধুসূদন সমকালীন বঙ্গসমাজের চরিত্রবিধি লঙ্ঘন করলেও কোনওক্রমেই মার্কি দ সাদ ও র‌্যাঁবো-র সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন না। তবে ওই গ্রন্থে সার্ত্র একটি মন্তব্য করেছিলেন: ‘Genius is not a gift but the way out that one invents in desperate cases।’১০ বিদ্যাসাগর হয়তো ভেবেছিলেন তাঁর সংকল্পবিদ্ধ পদাতিক জীবনের উলটো প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটি বেপরোয়া আগ্নেয় উচ্ছ্বাস।

যেমন, যদি ধর্মাচরণকে একটি আলোচনাবিন্দু হিসেবে গ্রহণ করি তা হলে বিদ্যাসাগর কুলীন ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ‘চ্যুতি’ আছে। উনিশ শতকে জন্মালেও ধর্ম ও ঈশ্বর বিষয়ে তিনি রহস্যজনকভাবে স্তব্ধ। আবার তিনি মুখর নাস্তিকও ছিলেন না। পত্রোপরি ‘শ্রীশ্রীহরিশরণম’ লিখতে অভ্যস্ত ছিলেন। উপবীত ত্যাগ করেননি অথচ গৃহে নিত্য পূজার চল ছিল না। বিদ্যাসাগর নিরীশ্বরবাদী হয়তো ছিলেন না কিন্তু ব্যাবহারিক উপাসনাপদ্ধতি ও দার্শনিক অধ্যাত্মবাদকে আলাদা আসনে বসাতেন। একটি পাঠ্যসূচি বিষয়ে বিতর্কে অংশ নিয়ে তিনি তৎকালীন শিক্ষা পরিষদের সচিবকে চিঠি (৭.৯.১৮৫৩) লিখে স্পষ্ট জানান যে, ‘for certain reasons, which it is needless to state here, we are obliged to continue the teaching of the Vedanta and Sankya in the Sanskrit College. That the Vedanta and Sankya are false systems of Philosophy is no more a matter of dispute.’১১

বেদান্ত ও সাংখ্য যে ভ্রান্ত দর্শন— এমন কথা একজন শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের পক্ষে সে যুগে ততটাই বিপ্লব যতটা মেঘনাদবধ কাব্যে রামচন্দ্রের অবমূল্যায়ন ও রাবণকে চারিত্রিক মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার দুঃসাহস। প্রচলিত ধারণা-কাঠামোর বিদ্রোহতে বিদ্যাসাগর যে মধুসূদনকে আত্মীয়ের অধিক ভাববেন তাতে আশ্চর্য কী! এই প্রসঙ্গে অলৌকিক সমাপতন যে ১৮৬২ সালে মেঘনাদবধ কাব্য প্রকাশিত হচ্ছে। আর সে বছরই বিদ্যাসাগর হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার পরিচালনা ভার গ্রহণ করে মাইকেল মধুসূদনকে সম্পাদনাভার অর্পণ করছেন।

বিদ্যাসাগর যে সমকালীন হিন্দু ধর্মভাবনার মধ্যে অন্তত বিকল্প না হোক, সংযোজনের তত্ত্ব জুড়তে চেয়েছিলেন তাতে সন্দেহই নেই। এইজন্যই প্রতিষ্ঠান তাঁর সমাজসংস্কারমূলক উদ্যোগ নিয়ে যত সপ্রশংস উল্লেখ করে, তাঁর দার্শনিক অবদান নিয়ে ততটাই মৌন অবস্থান নেয়। বিধবাবিবাহ সংক্রান্ত চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে প্রায় সব্যসাচীতুল্য ক্ষিপ্রতায় সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ সম্পাদনা করে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেন। নাস্তিক ও বস্তুবাদী দার্শনিক চার্বাক সেখানেই প্রথম একটি স্তবকের মধ্যে গ্রথিত হন। তাঁর আগে চার্বাক বা জাবালিকে মহর্ষি বলার রেওয়াজ ছিল কিন্তু বিরোধীদের অবিন্যস্ত উদ্ধৃতিতে তাঁদের সম্বন্ধে ধারণা করা হত। ভারতীয় বস্তুবাদী চিন্তা, বিদ্যাসাগরের সৌজন্যেই, পরোক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধির বিষয় হল। উপরোক্ত চিঠিতেই ঈশ্বরচন্দ্র স্বদেশীয় বিদ্যাচর্চার সংস্কারান্ধ দিকটি কীভাবে ইউরোপীয় বিজ্ঞানবোধের সঙ্গে সাযুজ্য রচনা করতে পারছে না, সে বিষয়েও দূরপ্রসারী একটি ইঙ্গিত করেন। আজ এতদিন পরে ভারতীয় চন্দ্রাভিযানের মুহূর্তেও আমাদের রাজনীতিবিদদের কথা শুনলে মনে হয় প্রায় অসাধ্যসাধনের ব্রত নিয়েছিলেন খর্ব শরীর ও দীর্ঘ মেধার এই বাঙালি।

ফলে মধুসূদনকে যে তিনি দৃষ্টান্তযোগ্য মনে করবেন তা স্বাভাবিক। বলার কথা এই যে, এ শুধু মধুসূদনের প্রতিভার প্রলয়প্রবাহের জন্যই নয়। বিদ্যাসাগর মশাই মেঘনাদবধ কাব্য পাঠ করার আগে ও বিশেষভাবে পরে অনুধাবন করেন যে, মধুসূদন রামায়ণী কথার প্রচলিত স্তরে বিপর্যয় ঘটাচ্ছেন। এই বদল কৃত্তিবাসের মতো আনুভূমিক স্তরে, যেমন তরণীসেন উপাখ্যান সংযোজন নয়, বরং উল্লম্ব স্তরে উদ্যত আততায়ীর মতো অনার্য অর্থের অবতারণা। যে-অর্থ অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম, বিদ্যাসাগর খেয়াল করেন, মাদ্রাজ প্রবাসের অভিজ্ঞতাবশত মধুসূদন রামায়ণকে অন্যভাবে, দ্রাবিড় স্পর্শ দিয়েছেন। সংখ্যালঘু চার্বাককে বিদ্যাসাগর যে কারণে সারস্বত চর্চায় নিমন্ত্রণ জানান, সে কারণেই অনার্য কুলপতি রাবণকে সম্মানিত হতে দেখলে তাঁর আনন্দের সীমা থাকে না। এই গণতান্ত্রিক ঔদার্য ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ বিদ্যাসাগরের কবচ-কুণ্ডল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যে পদার্পণমাত্র মধুসূদনকে সংবর্ধিত করেননি। কবিকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিতে তাঁর সময় লেগেছিল। তিলোত্তমাসম্ভব-এর অমিত্রাক্ষর ছন্দ বিদ্যাসাগরকে প্রথম অভিভূত করে। রাজনারায়ণ বসুকে এক চিঠিতে মধুসূদন লিখছেন— ‘The renowned Vidyasagar has at last condescended to see “great merit” in it, and the Somprokash has spoken out in a favourable manner.’১২ বিদ্যাসাগর মধুসূদনের প্রতিভায় মুগ্ধ হচ্ছিলেন। এমনকী কোচবিহারের মহারাজার কাছে মধুসূদনের কর্মপ্রার্থনার আবেদনপত্রে, ১৮৬০ সালের জানুয়ারি মাসে ব্যঞ্জনাময় সুপারিশ দিয়েছিলেন— ‘একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পাঠাইলাম। দেখিও যেন বাতাসে উড়িয়া না যায়।’১৩

তিলোত্তমাসম্ভব ও অমিত্রাক্ষর প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের সহমর্মিতার একটি অন্যতম প্রধান কারণ যে, বিদ্যাসাগর মধুসূদনকে তখন থেকেই নাট্যকার ও কবি পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বাংলা ভাষার একজন প্রধান স্থপতি হিসেবেও বরণ করে নেন। বিদ্যাসাগর নিজেও অনুরূপ কর্মে ব্রতী ছিলেন।

গদ্যভাষাকর্মী হিসেবে বিদ্যাসাগরের কাজ প্রায় চলচ্চিত্রকারের মতো ছিল। বিশেষ একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে লেখকের অবস্থানকে তিনি শব্দের বা নিয়মাবলির ঐতিহাসিক অবস্থানের সঙ্গে জুড়ে দিতে পারবেন এমন সুযোগ বিদ্যাসাগরের ছিল না। আজ আমরা লেখকের কাজ বলতে বুঝি ভাষা-ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সেতুবন্ধে নিজেকে সংস্থাপিত করা। এক দিক থেকে তা প্রাপ্ত চিহ্ন-ব্যবস্থার সম্প্রসারণ। বিদ্যাসাগর এমন প্রস্তুত অভিধান পাননি। মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের প্রাচীন স্থাপত্য থেকে নবীকৃত উপক্রমণিকা ও ব্যাকরণ কৌমুদী তারই অবদান। বাংলা গদ্যের দিকে তাকালে বিদ্যাসাগরকে শুধু আমরা লেখক ও অনুবাদক বলতে পারি না, তিনি একইসঙ্গে ভাষা-সংগঠকও। রবীন্দ্রনাথ এজন্যই বলেন, ‘তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা।’

ভাষার আধুনিকীকরণের এই প্রক্রিয়াই বিদ্যাসাগরকে উৎফুল্ল করেছিল মধুসূদন বিষয়ে। তাঁর মতোই মধুসূদনের ক্ষেত্রেও লেখকের কাজ শুধুই নন্দনতাত্ত্বিক আবিষ্কার নয়, প্রথমে ভাষাগত, পরে নান্দনিক। আলালের ঘরের দুলাল-এর কথ্য ভাষার তারুণ্য মধুসূদনকে উদ্দীপিত করতে পারেনি বলেই তিনি অন্য ভাষার সন্ধানে ছিলেন, অবশেষে মাতৃভাষায় অমিত্রাক্ষর প্রবর্তনের দায়িত্ব নিলেন। এই পরীক্ষানিরীক্ষা বিদ্যাসাগর সহর্ষে সমর্থন করেছিলেন। নির্যাতিতা নারীসমাজের প্রতি বিদ্যাসাগরের প্রবল মনোযোগ, বিধবাবিবাহ বিধিবদ্ধ করা ও বহুবিবাহ রহিত করার জন্য তাঁর ঐকান্তিক সাধনা নিশ্চয়ই পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও মাইকেলের নজর এড়ায়নি। শুধু তা-ই নয়, এই সাংস্কৃতিক পরিসরটি সম্বন্ধে অবগত ছিলেন বলেই তিনি মেঘনাদবধ কাব্য-এ প্রমীলা বা ‘একাকী অরণ্য মধ্যে কুসুম যেমতি’ চতুর্থ সর্গের সীতা বা সরমা চিত্রণের উপযোগিতা; অংশত হলেও, খুঁজে পাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রায় চূড়ান্ত মিলনবিন্দু বোধহয় বীরাঙ্গনা কাব্য। ওভিদ-এর আদর্শে মধুসূদন অনুপ্রাণিত হতে পারেন কিন্তু বিদ্যাসাগরের নারীবিষয়ক পর্যবেক্ষণ তাঁর অজ্ঞাত ছিল না। নারী যে জড়বস্তু ও ভোগের সামগ্রী মাত্র নয়, পুরুষতন্ত্রে তাঁর অবমাননা বিষয়ে বিদ্যাসাগরের গভীর সহানুভূতি, এমনকী তাঁর দেহজ বাসনার প্রতি বিদ্যাসাগরের অব্যর্থ সমর্থন আধুনিকদের মধ্যে মধুসূদন উৎসাহে ও শ্রদ্ধায় লক্ষ করতেন। এমন অনুমান অযৌক্তিক বা অসংগত নয় যে, বিদ্যাসাগর গভীর মর্মবেদনায় বিলাপ করেন— ‘হা! অবলাগণ! তোমরা কী পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্মগ্রহণ কর, বলিতে পারি না।’১৪ সেই যন্ত্রণা মধুসূদনের হৃদয়কেও মথিত করে। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব পুস্তিকার শেষে শাস্ত্রবচন-অতিরিক্ত পরিসরে আক্ষেপ করেছিলেন— ‘তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না, যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা বলিয়া বোধ হয় না, দুর্জয় রিপুবর্গ এককালে নির্মূল হইয়া যায়। কিন্তু তোমাদের এই সিদ্ধান্ত যে ভ্রান্তিমূলক, পদে পদে তাহার উদাহরণ প্রাপ্ত হইতেছ।’১৫ বীরাঙ্গনা কাব্য-এর চিঠিতে নারীর যে দুর্জয় কামনা সমাজবিধি লঙ্ঘন করে প্রকাশিত হয়েছে তারায় বা শূর্পণখায়, দেহশ্রীলোলুপ পুরুষকে যেভাবে ধিক্কার জানিয়েছেন কৈকেয়ী তা স্বভাবতই বিদ্যাসাগরকে উৎফুল্ল করার যোগ্য। উপরন্তু মধুসূদন নারীকে যে ‘অবলা’ অপবাদ থেকে দূরে সরিয়ে ব্যক্তি স্বরূপে দেখতে চাইছিলেন তাতে বিদ্যাসাগরের নৈতিক সমর্থন থাকাই স্বাভাবিক। কারণ নারীত্ব যে স্বতন্ত্রভাবেই শ্রদ্ধা ও বিবেচনার বিষয় তা সে যুগের যে-মেধাজীবীরা প্রাচ্যে ভেবেছিলেন, বিদ্যাসাগর তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য।

একটি ধর্মাশ্রিত সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে মধুসূদনের জীবনের যে-বৈপরীত্য তা ত্বকের বহিরঙ্গের। মর্মে অন্তরঙ্গে তাঁদের মিল এত গভীর পর্যায়ে যে, পরস্পরের প্রতি তাঁদের অনুরক্তি প্রত্যাশিতই। বিদ্যাসাগর নিরীশ্বরবাদী ছিলেন কি না তা হয়তো তর্কসাপেক্ষ; কিন্তু উনিশ শতকের ব্রাহ্মণের পক্ষে যা স্বাভাবিক তেমন ধর্মীয় আচার-বিচার তাঁর আদৌ ছিল না। মনুসংহিতা-কে তিনি প্রাচীন সমাজের উপযোগী মনে করলেও আধুনিক সমাজে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে খুব আস্থাশীল ছিলেন না। মধুসূদন দত্ত খ্রিস্টান হলেও যিশুখ্রিস্টের সুসমাচারে তাঁর কতটা প্রত্যয় জন্মেছিল এ নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ প্রচুর। এই ধর্মান্তর ঐহিক কারণে, রাজানুগ্রহ ও উচ্চাশা নির্ধারণের জন্য। কৃষ্ণমোহন প্রমুখের মতো দার্শনিক আনুগত্য তাঁর ছিল না। ১৮৭২ সালের জানুয়ারি মাসে পুরুলিয়ায় একটি বালকের খ্রিস্টীয় দীক্ষায় তিনি ধর্মপিতার ভূমিকায় ছিলেন কিন্তু রবিবারে গির্জায় প্রার্থনা করার মানুষ তিনি আমৃত্যু ছিলেন না। এমনকী আঁরিয়েতাকে পত্নিত্বে গ্রহণের সময় তিনি সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় বিধি পালন করেছিলেন কি না সে বিষয়ে সংশয় আছে। তাঁর নৈতিক চরিত্র স্বর্গপ্রবেশের অনুকূল কি না এমন দ্বিধা থাকায় তাঁর অন্তিম মুহূর্ত শান্তিপূর্ণ হয়নি। অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের ‘হিন্দুয়ানি’ ও মধুসূদনের ‘কেরেস্তানি’— দুই-ই নির্ভরযোগ্য নয়।

আর কী আশ্চর্য! অলৌকিকভাবে একাকী এই দু’জন। দু’জনেই বিখ্যাত। দু’জনেই প্রতিভার জন্য স্বীকৃত। কিন্তু যেমন বিদ্যাসাগর, তেমন মধুসূদন: দলপতি বা গোষ্ঠীপতি হওয়ার কোনও আগ্রহ তাঁদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। দু’জনেই শেষজীবনে যন্ত্রণাদগ্ধ হয়েছেন। মধুসূদনের জন্য তবু অন্তর্গত দোষের কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু বিদ্যাসাগরের তেমন কোনও ছন্নমতিত্ব ছিল না। দু’জনেই নানা মতের নানা সংঘে কাজ করেছেন কিন্তু যুক্ত হননি। এক ধরনের দূরত্ব বজায় রেখেছেন। বিদ্যাসাগর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার জন্য দেবেন্দ্রনাথকে সহায়তা করেছেন কিন্তু বান্ধবসভার অন্তর্গত ছিলেন না। মধুসূদন উন্নাসিক ছিলেন এবং উচ্চাশী। তিনি রঙ্গলাল বা হেমচন্দ্র প্রমুখ অনুগামীদেরও ধর্তব্যের মধ্যে আনতেন না। দু’জনেই এত স্বতন্ত্র প্রত্যাশী ও ব্যক্তিসত্যে আস্থাবান যে তাঁরা খুব যূথবদ্ধ কর্মে আস্থাশীল ছিলেন না। মধুসূদনের বাঙালি ‘বাবু’ সমাজের প্রতি তাচ্ছিল্য ছিল, বিদ্যাসাগরের তা ছিল না। কিন্তু তিনিও অধিক নৈকট্যের পক্ষপাতী ছিলেন না। আরও আশ্চর্য, দু’জনেই বনেদি ইংরাজিয়ানার প্রতি অনুরক্তি দেখিয়েছেন আজীবন তাঁদের চরিত্রে— মধুসূদন উচ্ছ্বাসে, অসংযমে, দুঃসাহসে আর বিদ্যাসাগর বিনয়ে, মিতমাত্রায়। মধুসূদনের সৃজনশীল নৈরাজ্যের প্রতিমে ঈশ্বরচন্দ্রের অনমনীয় সংকল্পবোধ। দু’জনেই এক উপনিবেশিক শাসনে স্ব স্ব কারণে বিশ্বাস করতে পারতেন, সার্ত্র-এর মাছি নাটকটিকে যদি সেই কালে স্থাপন করি: ‘আমি আমার নিজের স্বাধীনতা’। আশ্চর্য হয়ে যাই— হিন্দু কলেজে সিনিয়র বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র হিসেবে মধুসূদনের স্বর্ণপদক প্রাপ্তি ঘটেছিল ‘স্ত্রীশিক্ষা’ বিষয়ে ইংরেজি প্রবন্ধের জন্য। অগ্রজ বিদ্যাসাগর তাঁকে প্রশ্রয় দেবেন না? যিনি নারীকে ‘বীরাঙ্গনা’ ভাবেন তাঁর প্রতি দুর্বল হবেন না? বিদ্যাসাগর চরিত্রবান কিন্তু চালকলা ভোজন তাঁর পরিচয়পত্র নয়। তাই তিনি জানতেন মদ্যপান ও পরনারীগমন তুচ্ছ, যিনি ‘আত্মবিলাপ’ লেখেন, শুদ্ধ চৈতন্য তাঁকে পাহারা দেয়। আর মধুসূদনও জানতেন খর্বকায় বাঙালির চণ্ডীমণ্ডপে ঈশ্বরচন্দ্র মনীষার কত বিপজ্জনক অভিমানী। বিদ্যাসাগর ও মধুসূদন আমাদের উপনিষদ কথিত সেই সুপর্ণদ্বয় যাঁরা ডানায় ডানায় সংযুক্ত হয়ে আছেন ইতিহাসে, একজন ভোগ করে, অন্যজন দেখে। একজন চঞ্চল, অপরে স্তব্ধ। এই মুগ্ধতা ঐতিহাসিক ও নির্বিকল্প।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

. গোপাল হালদার (সম্পা.), বঙ্কিম রচনাসংগ্রহ— উপন্যাস খণ্ড (কলকাতা: সাক্ষরতা প্রকাশন, পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি, ১৯৭৪), পৃ. ৩৫৯।

. অজিতকুমার ঘোষ (সম্পা.), মধুসূদন রচনাবলী (কলকাতা: হরফ প্রকাশনী, ১৯৭৩), পৃ. ৩৩৭।

. তদেব, পৃ. ৩৭১-৭২।

. তদেব, পৃ. ৩৬৮।

. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, (কলকাতা: ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৭৩), পৃ. ৪৬৭।

. মধুসূদন রচনাবলী, পৃ. ৩৭০।

. তদেব, পৃ. ৩৩৬।

. তদেব, পৃ. ৩৮৪।

. তদেব, পৃ. ৩৯৮।

১০. Jean-Paul Sartre, Saint Genet: Actor and Martyr, (New York: New American Library, 1953), p. 641.

১১. বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ৫২।

১২. মধুসূদন রচনাবলী, পৃ. ৩২৫।

১৩. তদেব, পৃ. ৩০৮।

১৪. বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ২৫৩।

১৫. তদেব, পৃ. ২৫৩।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *