বিদ্যাসাগরের শিক্ষাচিন্তা : সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যক্রম-সংস্কার কর্মসূচি
শুভেন্দু সরকার
হরনাথ তর্কভূষণের মৃত্যুর পর ১৮৪৪-এ সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের অধ্যাপক হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১)।১ বিকল্প হিসেবে তারানাথ তর্কবাচস্পতির নাম তিনি শুধু সুপারিশই করেননি, কলকাতা থেকে হেঁটে অম্বিকা-কালনা গিয়ে তাঁর সম্মতিও নিয়ে আসেন। অথচ দেখা গেল, দু’বছর পর সে-কলেজের সহকারী সম্পাদক হতে বিদ্যাসাগর এককথায় রাজি। এমনকী, দরখাস্তে আত্মপক্ষ সমর্থনে বেশ কিছু যুক্তিও সাজালেন তিনি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা পড়ানোর সময় সংস্কৃত কলেজের বার্ষিক বৃত্তি পরীক্ষার মূল্যায়নে তাঁর সক্রিয় ভুমিকা থাকত। এ ছাড়া, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ মেজর জি. টি. মার্শাল-এর সুপারিশপত্র বিশেষ কাজে দিল। বিদ্যাসাগর নতুন চাকরিতে ঢুকলেন ৬ এপ্রিল ১৮৪৬-এ। প্রশ্ন জাগে: তাঁর মত পালটানোর হেতু কী? ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে নিজের জায়গায় ভাই দীনবন্ধু ন্যায়রত্নকে নিতে অনুরোধ করার পেছনে এর সম্ভাব্য উত্তরটি পাওয়া যাবে। বিদ্যাসাগরের আশঙ্কা ছিল: সংস্কৃত কলেজে তাঁর চাকরি বেশিদিন না-ও টিকতে পারে। প্রাক্তন ছাত্র বলে সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা-প্রণালীর নানা খামতির কথা বিদ্যাসাগর জানতেন। সেসব দূর করাই ছিল তাঁর আসল উদ্দেশ্য। তাই অধ্যাপক নয়, প্রশাসকের পদ তিনি বেছে নিলেন। কিন্তু তাঁর পথ যে মসৃণ হবে না— তা নিয়ে বিদ্যাসাগরের দুশ্চিন্তা ছিল।
চাকরি পাওয়ার পরই উঠে-পড়ে লাগলেন বিদ্যাসাগর। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৮৪৬-এ সংস্কৃত কলেজের পঠনপাঠন নিয়ে তাঁর সংস্কার-পরিকল্পনাটি শিক্ষাপরিষদে পাঠানোর জন্যে সম্পাদক রসময় দত্তর কাছে দাখিল করলেন। এ ব্যাপারে তিনি চার-পাঁচজন শিক্ষকের সাহায্য পেয়েছিলেন। পরিকল্পনায় ব্যাকরণ পাঠের পদ্ধতি ও পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন চাওয়া হল। এ ছাড়া, ইংরিজি বিভাগের আমূল সংস্কারও ছিল বিদ্যাসাগরের অভীষ্ট। গোড়া থেকেই নিজের কাছে তাঁর শিক্ষাচিন্তার লক্ষ্য ছিল স্থির। বিদ্যাসাগর বরাবর এমন একদল লোক গড়ে তুলতে চেয়েছেন যারা পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করবে। তাই সংস্কৃতর পাশাপাশি ইংরিজি পড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। এ কথাও ঠিক, ভাল বাংলা লেখার জন্যে সংস্কৃতয় দখল থাকা জরুরি। তখন সংস্কৃত কলেজে ইংরিজি ছিল ঐচ্ছিক বিষয়; বিদ্যাসাগর সেটিকে বাধ্যতামূলকভাবে পড়াতে চাইলেন। বিদ্যাসাগরের প্রকল্পটি ব্যক্তিগতভাবে অনুমোদন করেন মার্শাল।
সংস্কৃত কলেজের সাম্মানিক সম্পাদক রসময় দত্ত ছিলেন বিদ্যাসাগরের ঠিক উলটো। কলেজের কাজকর্ম তিনি দেখতেন দায়সারাভাবে। তাই পঠনপাঠন নিয়ে ভাবা দূরে থাক, কলেজ চলাকালীন হামেশাই অনুপস্থিত থাকতেন। বিদ্যাসাগরের সংস্কার-পরিকল্পনা যে তাঁর কাছে কোনও গুরুত্বই পাবে না— এ তো স্বাভাবিক! শিক্ষাপরিষদের কাছে সেটি পাঠাতে তাই অহেতুক টালবাহানা করে চললেন তিনি। অগত্যা ইস্তফা দিলেন বিদ্যাসাগর। সেটি মঞ্জুর হল ১৬ এপ্রিল ১৮৪৭-এ। এর আগে (৩ মে) রসময় দত্তকে পদত্যাগের কারণ দেখিয়ে একটি লম্বা চিঠি লেখেন বিদ্যাসাগর। সেখানেও স্পষ্ট বেরিয়ে আসে যে, শিক্ষা নিয়ে তাঁর সংস্কার-পরিকল্পনাটির উদ্দেশ্য আদতে দীর্ঘমেয়াদি। কয়েকটি নিছক পাঠ্যপুস্তক পালটাতে অথবা ন্যায়দর্শনের আগে স্মৃতিশাস্ত্র পড়াতে না-পারার জন্যে পঞ্চাশ টাকার চাকরি ছাড়েননি তিনি। বিদ্যাসাগরের চিন্তাভাবনা ছিল আরও গভীর। সেই আদর্শর সঙ্গে আপসের কথা ভাবতেও পারতেন না তিনি। আলু-পটল বেচে অথবা মুদির দোকান খুলে দিন গুজরান করতেও তিনি রাজি, কিন্তু মান খুইয়ে চাকরি বজায় রাখা বিদ্যাসাগরের পক্ষে অসম্ভব। তাই সংসার চালানোর জন্যে আগেই ভাইকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ঢুকিয়েছিলেন তিনি।
ভুললে চলবে না, ততদিনে বিদ্যাসাগরের মতাদর্শর ভিত অনেকটাই পোক্ত হয়েছে। সংস্কৃত কলেজে পড়ার সময়েই পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল। তখন ইংরিজি ভাল না জানলেও হিন্দু কলেজ (বিশেষত ইয়ং বেঙ্গল) আর মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের কাছাকাছি এসেছিলেন বিদ্যাসাগর। সেসব তরুণের দেশপ্রেম ছিল প্রশ্নাতীত। তাঁরা শুধু মার্কিন স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৭৭৫-৮৩) বা ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯)-এর কথা জানতেন, তা নয়, ব্রিটিশ বর্ণবিভেদমূলক আচরণ আর সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কেও ছিলেন সমান সজাগ। এসব নিয়ে সেই আগুয়ান ছাত্ররা পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ ও/বা চিঠি লিখতেন আর সভাসমিতিতে ভাষণ দিতেন। পাশাপাশি ডিরোজিয়ো-র ছাত্ররা হিন্দুসমাজের নানা কুসংস্কার— যেমন, বর্ণভেদ, মূর্তিপুজো, দেশাচার ইত্যাদি— নিয়েও সরব ছিলেন সর্বদা। অন্যদিকে, স্ত্রীশিক্ষা আর বিধবাবিবাহ চালু করার ব্যাপারেও ইয়ং বেঙ্গলের উৎসাহ নজর কাড়ে। এককথায়, ডিরোজিয়ো-পন্থীদের মূল লক্ষ্য ছিল: ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় বাংলা ভাষা/সাহিত্যের প্রসার আর সমাজসংস্কার। বলা বাহুল্য যে, বিদ্যাসাগরের চিন্তাভাবনায় এসবের গভীর প্রভাব পড়ল। মূলত হিন্দু কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে তৈরি ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা’ (১৮৩৮)-র দেড়শো জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের তালিকায় তাঁর নাম পাওয়া গেল।২ সেখানকার মাসিক অধিবেশনের বক্তৃতাগুলি— যার বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য দেখলে অবাক হতে হয়— নিশ্চয়ই মন দিয়ে শুনতেন তিনি। একদিকে, ভারতের প্রাচীন ইতিহাস থেকে তৎকালীন সমাজে নারীর দুর্দশা আর অন্যদিকে, নীতিবোধ থেকে শারীরবিদ্যা— সবই ইংরিজি/বাংলায় আলোচনা হত সেই সভায়। সদস্যদের নিজস্ব ধর্মীয় মত যা-ই হোক, তা কখনওই প্রকাশ্যে আসত না। তাঁরা বুঝেছিলেন: হিন্দু আর খ্রিস্ট ধর্মের বিবাদে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে; সমাজের মূল সমস্যা রয়েই গেছে। তবে শুধু লেখা ও/বা ভাষণ দিয়ে নয়, সেসব প্রগতিবাদী যুবক বেশ কিছু ইস্কুল খুলেও অবস্থা পালটাতে চাইলেন। তার বেশিরভাগেই অবশ্য শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরিজি।
হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠাতারা কখনও ভাবেননি, সেখানকার ছাত্ররা পরবর্তীকালে একটি যুগান্তকারী আন্দোলনের শরিক হবে; এমনকী, ডিরোজিয়ো-কে তাড়িয়েও তাদের ঠেকানো যাবে না। ঘটনা হল: উনিশ শতকের প্রথম ভাগে শিক্ষিত বাঙালির মনে যুক্তিবাদ স্থায়ী জায়গা করে নেয়। এর সূচনা অবশ্য করেছিলেন রামমোহন রায়। বলা যায়: ধর্মসংস্কার থেকে শুরু হয়েছিল যুক্তিবাদের যাত্রা। পরবর্তীকালে সেই ধারা ক্রমশ অ-ধর্মীয় (সেকিউলার) হয়ে উঠল। খোলাখুলি বৈজ্ঞানিক চেতনার পক্ষে সওয়াল করলেন অনেকে। আঠেরো শতকে ইউরোপে যুক্তিবাদ ছিল বুর্জোয়া শ্রেণির হাতিয়ার। বাংলার প্রগতিশীল সম্প্রদায়কেও তা প্রেরণা জোগাল। স্রেফ জগৎকে ব্যাখ্যার মাপকাঠি নয়, সমাজের সার্বিক উন্নয়নের জন্যেও যে যুক্তিবাদী মনোভাব দরকার— তা বোঝা গেল। দর্শনের এই ঘরানা পুষ্ট করেছিল বিদ্যাসাগরেরও চিন্তাভাবনা। তাই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (১৮৪৩)-র সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্তর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল আর ১৮৪৮-এ সেটির পেপার কমিটির তিনি সভ্য হলেন। পত্রিকাটি স্রেফ ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র থাকল না, সাহিত্য-ইতিহাস-দর্শন ইত্যাদি নানা বিষয়ে লেখা ঢুকল সেখানে। অক্ষয়কুমার-বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক ছিল বিস্তর।৩ একবার রাজনারায়ণ বসুর একটি বক্তৃতা ওঁরা দু’জনে ছাপানোর যোগ্য মনে করেননি। সেই সূত্রে দেবেন্দ্রনাথ চিঠিতে রাজনারায়ণকে লেখেন:
এ বক্তৃতা আমার বন্ধুদিগের মধ্যে যাঁহারা শুনিলেন তাঁহারাই পরিতৃপ্ত হইলেন; কিন্তু আশ্চর্য্য এই যে তত্ত্ববোধিনী সভার গ্রন্থাধ্যক্ষেরা ইহাকে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে প্রকাশযোগ্য বোধ করিলেন না। কতকগুলান নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষ হইয়াছে, ইহারদিগকে এ পদ হইতে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে আর ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রচারের সুবিধা নাই।৪
এই যুক্তিবাদী আর সমাজসংস্কারকের অবস্থান থেকেই পরে ধ্রুববাদ (পজিটিভিজ়ম্)-এর দিকে ঝুঁকেছিলেন বিদ্যাসাগর। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন:
বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন, এ কথা বোধ হয় তোমরা জান না; যাঁহারা জানিতেন তাঁহারা কিন্তু সে বিষয় লইয়া তাঁহার সঙ্গে কখনও বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হইতেন না; কেবল রাজা রামমোহন রায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র রাধাপ্রসাদ রায়ের দৌহিত্র ললিত চাটুয্যের সহিত তিনি পরকালতত্ত্ব লইয়া হাস্য পরিহাস করিতেন; ললিত সে সময় যেন কতকটা যোগসাধনপথে অগ্রসর হইয়াছেন এইরূপ লোকে বলাবলি করিত। বিদ্যাসাগর তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতেন, ‘হাঁ রে, ললিত, আমারও পরকাল আছে না কি?’ ললিত উত্তর দিতেন, ‘আছে বই কি! আপনার এত দান, এত দয়া, আপনার পরকাল থাকিবে না ত থাকিবে কা’র?’ বিদ্যাসাগর হাসিতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে আমাদের দেশে যখন ইংরাজি শিক্ষার প্রবর্তন আরব্ধ হয়, তখন আমাদের সমাজের অনেকের ধর্ম্মবিশ্বাস শিথিল হইয়া গিয়াছিল; যে সকল বিদেশীয় পণ্ডিত বাঙ্গালাদেশে শিক্ষকতা করিতে আরম্ভ করিলেন, তাঁহাদেরও অনেকের নিজ নিজ ধর্ম্মে বিশ্বাস ছিল না। ডেভিড হেয়ার নাস্তিক ছিলেন, এ কথা তিনি কখনও গোপন করেন নাই; ডিরোজিয়ো ফরাসি রাষ্ট্রবিপ্লবের সাম্যমৈত্রীস্বাধীনতার ভাব হৃদয়ে পোষণ করিয়া ভগবানকে সরাইয়া দিয়া Reason-এর পূজা করিতেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাব বন্যায় এ দেশীয় ছাত্রের ধর্ম্মবিশ্বাস টলিল; চিরকালপোষিত হিন্দুর ভগবান সেই বন্যায় ভাসিয়া গেলেন; বিদ্যাসাগরও নাস্তিক হইলেন, তাহাতে আর বিচিত্র কি?৫
৫ ডিসেম্বর ১৮৫০-এ দ্বিতীয়বার বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে চাকরি নিলেন— এবার তিনি সাহিত্যর অধ্যাপক। শিক্ষাপরিষদের সচিব, ফ্রেডেরিক জন মৌআট-কে তিনি আগেই জানিয়েছিলেন যে, অধ্যক্ষর পদ পেলেই সেখানে ফিরবেন। সেই অনুযায়ী একটি চিঠিও লেখেন বিদ্যাসাগর। সম্ভবত সেই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার ইঙ্গিত তিনি পেয়েছিলেন। এক মাসের মধ্যে সংস্কৃত কলেজ নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন চাওয়া হল তাঁর কাছে। ঘটনাপ্রবাহ দেখে রসময় দত্ত ইস্তফা দিলেন। সাহিত্যর অধ্যাপকের পাশাপাশি ৫ জানুয়ারি ১৮৫১ থেকে অস্থায়ী সম্পাদকের দায়িত্ব বর্তাল বিদ্যাসাগরের ওপর। ২২ জানুয়ারি থেকে তিনি পাকাপাকিভাবে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হলেন।
১৬ ডিসেম্বর ১৮৫০-এ বিদ্যাসাগর যে সংস্কার-প্রকল্পটি দাখিল করলেন সেটি ছিল তাঁর আগের (১৮৪৬) পরিকল্পনার পরিবর্ধিত সংস্করণ। তিনি নিজেই লিখলেন: তাঁর প্রতিবেদনটি দীর্ঘদিনের চিন্তাভাবনার ফসল। বিদ্যাসাগর একদিকে ছাত্রদের প্রথমে সহজভাবে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত ব্যাকরণ শেখানোর কথা বললেন, অন্যদিকে দেশবিদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান বাংলা অনুবাদে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ারও সুপারিশ জানালেন। নিচু ও উঁচু শ্রেণির জন্যে তিনি উল্লেখ করলেন আলাদা আলাদা বিষয়ের বই। সেসবে যেমন থাকবে নীতিকথা আর ইউরোপীয় মনীষীদের চরিত্র— তেমনই ভূমিকম্প, ছাপাখানা আর নৌচালনবিদ্যার তথ্য। শুধু তা-ই নয়, উপযুক্ত বইয়ের অভাব মেটাতে নিজেই সে ভার কাঁধে তুলে নিতে চাইলেন তিনি। এ ছাড়া, ভাস্করাচার্যর লীলাবতী আর বীজগণিত পড়ানোর আগে আধুনিক পদ্ধতির ইংরিজি অঙ্ক বই থেকে বীজগণিত, পাটিগণিত আর জ্যামিতি সাময়িকভাবে চালুর আর্জি রাখা হল। এক্ষেত্রেও ছাত্রদের কাছে বাংলায় লেখা সব স্তরের গণিতের পাশাপাশি জ্যোতির্বিদ্যার বইয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা থাকল বিদ্যাসাগরের পরিকল্পনায়। একইরকম গুরুত্ব পেল ইংরিজি ভাষা ও সাহিত্য যা বাধ্যতামূলকভাবে তিনি পড়াতে চাইলেন টানা সাত-আট বছর। সংস্কৃতয় খানিক দক্ষতা আসার পর অলংকার শ্রেণি থেকে ছাত্রদের ইংরিজির পাঠ শুরু হোক— এই ছিল তাঁর মত।
বিদ্যাসাগর প্রস্তাব করলেন: স্মৃতি আর ন্যায়দর্শনের ছাত্ররা গণিত শিখবে নিয়মিত। এ ছাড়া, স্মৃতি আর ন্যায়দর্শনের পাঠ্যক্রম নিয়েও তাঁর চিন্তাভাবনা সুনির্দিষ্ট শিক্ষাদর্শর হদিশ দিল। স্মৃতির বেলায় মনুসংহিতা, মিতাক্ষরা, বিবাদচিন্তামণি, দায়ভাগ, দত্তকমীমাংসা, দত্তকচন্দ্রিকা অপরিবর্তিত রেখে রঘুনন্দনের অষ্টবিংশতি তত্ত্ব বাদ দেওয়ার ইচ্ছে হল তাঁর। এর কারণ: অষ্টবিংশতি তত্ত্ব শুধু ব্রাহ্মণদের পুজো-আচ্চায় কাজে লাগে। স্মৃতিশাস্ত্রকে সর্বদা বিদ্যাসাগর নিছক অধ্যয়নের বিষয়বস্তু বলে দেখতে চেয়েছিলেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের হিন্দু আইন-কানুন সম্পর্কে জানার জন্যে ছাত্রদের তা পড়া দরকার।
ন্যায়ের (আসলে নব্যন্যায়) বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর ছিলেন বেশি সোচ্চার।৬ তখন পড়ানো হত: ভাষা পরিচ্ছেদ, সিদ্ধান্তমুক্তাবলী, ন্যায়সূত্রবৃত্তি,[ন্যায়-] কুসুমাঞ্জলি, অনুমানচিন্তামণি ও দীধিতি, শব্দশক্তিপ্রকাশিকা, [বেদান্ত-] পরিভাষা, [সাংখ্য-]তত্ত্বকৌমুদী, খণ্ডন [-খণ্ডখাদ্য] আর [আত্ম-]তত্ত্ববিবেক। বিদ্যাসাগরের মত: নব্যন্যায়ের আকর বই— গঙ্গেশ উপাধ্যায়ের তত্ত্বচিন্তামণি ও রঘুনাথ শিরোমণির টীকা দীধিতি পুরোপুরি বাদ দেওয়া উচিত। তাঁর যুক্তি: তত্ত্বচিন্তামণি-র তর্কপদ্ধতি মধ্যযুগীয় ইউরোপের ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষকদের (schoolmen) মতো— যাকে ফ্রান্সিস বেকন সম্ভবত বলতেন বিদ্যার মাকড়সা-জাল (‘cobweb of learning’)। একইসঙ্গে শ্রীহর্ষর খণ্ডনখণ্ডখাদ্য আর উদয়ানাচার্যর তত্ত্ববিবেক পড়ানো বন্ধর প্রস্তাব দিলেন বিদ্যাসাগর। বৈদান্তিক দর্শনের সমর্থনে লেখা শ্রীহর্ষর বইটি সম্বন্ধে কাদা-মাখা অধিবিদ্যা (‘muddy metaphysics’) শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া, এসব বই দুর্বোধ্যও মনে হয়েছিল তাঁর।
ন্যায় শ্রেণির নাম পালটে দর্শন শ্রেণি দেওয়ার ইচ্ছে ছিল বিদ্যাসাগরের। পাঠ্যসূচিতে তাই মীমাংসা বাদ দিয়ে তিনি সাংখ্যপ্রবচন (-সূত্র), পাতঞ্জলসূত্র (যোগ), পঞ্চদশী (বেদান্ত) আর সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ পড়ানোর কথা বললেন। বিদ্যাসাগরের বিশ্বাস: পনেরো বছর পর সংস্কৃত কলেজ থেকে বেরনোর আগে ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে ছাত্রদের সামগ্রিক জ্ঞান হওয়া জরুরি। আবার এ কথাও ঠিক যে, বেশিরভাগ হিন্দু দর্শনতন্ত্রগুলির সঙ্গে আধুনিক ও প্রগতিশীল পাশ্চাত্য ধ্যানধারণার মিল প্রায় নেই বললেই চলে। তাই তাঁর প্রস্তাব: ছাত্ররা ইউরোপের আধুনিক দর্শনগুলিও পড়ুক একইসঙ্গে। সংস্কৃত কলেজে জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩)-এর তর্কপ্রণালী (A System of Logic, 1843) বইটি পুরো পড়ানো হত, পরে (১৮৫৩) ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২০)-এর নয়া তর্কবিদ্যা (Novum Organum, 1620) পড়ানোর প্রস্তাবও মেনে নেওয়া হয়। বিদ্যাসাগরের আশা: তুলনামূলক বিচারে ছাত্ররা নিজেরাই ভারতীয় দর্শনের ভুল সিদ্ধান্তগুলি ধরতে পারবে। যেহেতু ভারতীয় দর্শনের এক প্রণালী অন্যটিকে খণ্ডন করেছে— সেই হেতু সব ক’টি পড়লে প্রত্যেকটির দোষত্রুটি স্পষ্ট ফুটে উঠবে। এর পাশাপাশি, পাশ্চাত্য দর্শনের জ্ঞান সেসব প্রণালীর গুণ চিনতেও ছাত্রদের ভীষণ কাজে দেবে। লক্ষ করার ব্যাপার: মাধবাচার্যর সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ (বিদ্যাসাগর-সম্পাদিত) মারফত তিনি বৌদ্ধ, জৈন ও চার্বাক-এর মতো নাস্তিক দর্শনগুলির সঙ্গেও ছাত্রদের পরিচয় ঘটালেন। ভারতীয় দর্শন বলতে শুধু আস্তিক দর্শনতন্ত্রগুলিই বোঝায় না— এ ব্যাপারে ছাত্রদের গোড়া থেকেই সচেতন করা হল এভাবে। নিঃসন্দেহে বলা যায়: বিদ্যাসাগরের উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের বস্তুবাদমুখী করে তোলা। হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের সঙ্গে তাঁর মূল তফাত: প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও সমাজ সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমালোচনামূলক (critical)।
এমন নয় যে, বিদ্যাসাগরের সব ক’টি প্রস্তাব তখনই বাস্তবায়িত হল। সেটি সম্ভবও ছিল না। কিন্তু দেখার ব্যাপার: তিনি লাগাতার নিজের লক্ষ্য স্থির রেখে কাজ করে চললেন; স্বচ্ছন্দ বাংলায় ছাত্রদের উপযোগী পাঠ্যবই প্রবর্তনের পাশাপাশি পাঠ্যক্রম নিয়ে ভাবনাচিন্তা চালিয়ে গেলেন। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, সব কিছুর পেছনেই সক্রিয় থাকল শিক্ষা নিয়ে বিদ্যাসাগরের মতাদর্শ। একে একে বেরল জীবনচরিত (১৮৪৯), বোধোদয় (১৮৫১), সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১) আর ঋজুপাঠ (১৮৫১-৫২)। বিদ্যাসাগরের বইগুলি কতখানি কাজে এসেছিল, তা কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যর মুখে শোনা যাক:
দশ এগারো বৎসর বয়সে বাঙ্গালা ভাষা-গ্রন্থ অধ্যয়নে আমার প্রথম মনোনিবেশ হয়। ইহার পূর্ব্বে ৭ বৎসর বয়সে সংস্কৃত কলেজে ভর্ত্তি হইয়া মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ পড়িতে আরম্ভ করি। প্রায় ৪ বৎসর পাঠের পর ঐ ব্যাকরণ সায় হইয়া আসিতেছিল, এই সময়ে বাঙ্গালা বহি পড়িবার সাধ হইল। যত দূর মনে হয় এই কয়খানি বহি পড়িয়াছিলাম যথা— (১) পুরুষ-পরীক্ষা, (২) প্রবোধচন্দ্রিকা, (৩) বেতালপঞ্চবিংশতি [১৮৪৭], (৪) বাঙ্গালার ইতিহাস [১৮৪৮], (৫) জীবন-চরিত। শেষের তিনখানি বিদ্যাসাগরের লেখা। তিনখানিই অনুবাদ— বেতাল হিন্দী হইতে, আর দুইখানি ইংরাজী হইতে। তবে এস্থলে বলা উচিত, বেতালের যে অনুবাদ সে নামমাত্র অনুবাদ; হিন্দীতে একখানি কঙ্কাল পাইয়া তাহাতে অস্থি মাংস রক্ত চর্ম্ম যোজনা করিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় এক অতি অপূর্ব্ব গদ্য গ্রন্থ খাড়া করিয়া তুলিয়াছিলেন। ইহাই তাঁর কীর্ত্তির প্রথম সোপান। বাঙ্গালার ইতিহাসখানি মার্শম্যান নামক পাদরীর প্রণীত ইংরাজী গ্রন্থের প্রকৃত অনুবাদ বটে। প্রভাতবাবু একস্থলে বিদ্যাসাগরের রচনাকে ‘গুরুগম্ভীর’ এই আখ্যা দিয়াছেন— বাস্তবিক এই আখ্যা খুব ঠিক হইয়াছে। কিন্তু বিদ্যাসাগর রচিত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ সে প্রকার নহে। উহা অতি সহজ চলিত ভাষাতে লিখিত। ‘জীবনচরিত’ গ্রন্থখানি চেম্বার্স কর্ত্তৃক সঙ্কলিত ও ‘বিওগ্রাফি’ নামক পুস্তক অবলম্বন করিয়া তাহার মধ্য হইতে নিউটন ইত্যাদি কয়েকটি বড়লোকের সংক্ষিপ্ত চরিত্র কীর্ত্তন করা হইয়াছে। ইহার রচনাও গুরুগম্ভীর পদবাচ্য নহে। কেবল বিজ্ঞান শাস্ত্রের বিষয় বলা আবশ্যক হওয়াতে অনেকগুলি নূতন শব্দ বিদ্যাসাগরকে সৃষ্টি ও বাঙ্গালাতে প্রচলিত করিতে হইয়াছিল, যথা, গবেষণা, আবিষ্ক্রিয়া, অণুবীক্ষণ ইত্যাদি। ভাগ্যিস্ সেই সকল শব্দ সৃষ্টি করা হইয়াছিল, তাই এক্ষণকার লেখকেরা সেই শব্দগুলি নাড়াচাড়া করিয়া বাঙ্গালা রচনার বিস্তর সুযোগ পাইয়াছেন। এক্ষণে এমন একটিও লোক দেখিতে পাই না যিনি অমন পরিপাটি রূপে বাঙ্গালা ভাষার শব্দ সম্পত্তি বাড়াইতে পারিতেন। বস্তুতঃ সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্রে তাঁহার মতন ব্যুৎপন্ন ব্যক্তি আর তো নজরে ঠেকে না— এ কথা সকলেই স্বীকার করিবেন। যদি তাঁহার প্রণীত ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’র [১৮৫৩] উদাহরণ সংগ্রহের দিকে দৃষ্টিপাত করেন, দেখিবেন কিরূপ পটুতা, নৈপুণ্য, সহৃদয়তা, অশেষ বিষয় সংগ্রহ এই সমস্ত গুণ অতি চমৎকারিতার সহিত প্রকটীকৃত হইয়াছে। যদি কেহ মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের উদাহরণ আর ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’র উদাহরণ তুলনা করিয়া দেখেন, তবে তিনি বোপদেবের নামে পরিহাস করিবেন, আর বিদ্যাসাগরের নাম শিরোধার্য্য করিবেন।… বিদ্যাসাগর মহাশয় সংস্কৃত কলেজ হইতে বাহির হইয়া ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সাহেবদিগের বাঙ্গালা শিক্ষক নিযুক্ত হইয়াছিলেন। সেই উপলক্ষ্যেই বেতাল-পঞ্চবিংশতি রচনা করা হয়। তাহার কিছু কাল পরে তিনি সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপল নিযুক্ত হন এবং কর্ত্তৃপক্ষেরা ঐ কলেজের শিক্ষাপ্রণালী পরিবর্ত্তন করিতে তাঁহাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়াছিলেন। তদনুসারে উপক্রমণিকা, ঋজুপাঠ, ব্যাকরণ কৌমুদী প্রভৃতি পাঠ্য গ্রন্থগুলি প্রণীত হইয়া ঐকালের ছাত্রদিগকে পড়িতে দেওয়া হইয়াছিল। এইরূপ প্রণালী পরিবর্ত্তন হইবার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত শিক্ষা-প্রণালী এক সম্পূর্ণ নূতন ভাব ধারণ করিল, এবং ঐ ভাষার সর্ব্ব-সাধারণ্যে সহজে সংস্কৃত শিখিবার এক যুগান্তর উপস্থিত হইল।৭
সহজ আঙ্গিকে সংস্কৃত আর বাংলা ছাড়াও বিদ্যাসাগরের লেখার আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল: অ-ধর্মীয় (সেকিউলার) বিষয়বস্তু। সেইজন্যে তাঁর বইগুলি মিশনারি ইস্কুলে চালু করার ব্যাপারে ঘোরতর আপত্তি তুললেন পাদরিরা। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হল: বর্ণপরিচয় (১৮৫৫)-এর কিছু কিছু অংশে আছে নিরীশ্বরবাদী নীতিবোধের ছাপ; বোধোদয়-এ অনুবাদক স্বেচ্ছায় বাদ দিয়েছেন ঈশ্বর, বাইবেল, পরলোক ইত্যাদির সমস্ত উল্লেখ, কোথাও কোথাও আবার যোগ করেছেন এমন কিছু ধারণা যা দুর্গন্ধময় বস্তুবাদ (‘rank Materialism’)! তাঁর বইগুলিই সেকিউলারিস্ট! রবার্ট ওয়েন-এর সঙ্গেও বিদ্যাসাগরকে তুলনা করতেও ছাড়লেন না পাদরিরা।
১২ এপ্রিল ১৮৫২-য় অধ্যক্ষ হওয়ার দেড় বছর পর সংস্কৃত কলেজের শিক্ষাপ্রণালী নিয়ে আর-একটি সংস্কার-পরিকল্পনা দাখিল করলেন বিদ্যাসাগর। শিক্ষাপরিষদের সদস্য (পরে বাংলার প্রথম ছোটলাট) এফ. জে. হ্যালিডে ৩০ জুন লিখলেন: তাঁরই উদ্যোগে অধ্যক্ষর সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনার পর সেটি তৈরি হয়েছে। আগের প্রকল্পের (১৬ ডিসেম্বর ১৮৫০) সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, এবারও নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকলেন বিদ্যাসাগর। পরিষ্কার উল্লেখ করা হল: বাংলাদেশের শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আলোকপ্রাপ্ত বাংলা সাহিত্য রচনা। তার পূর্বশর্ত অবশ্য ইংরিজি আর সংস্কৃত ভাষার ওপর দখল। শুধু ইংরিজি পড়লেই ইউরোপীয় বিষয়বস্তু প্রাঞ্জল বাংলায় হাজির করা যায় না; সংস্কৃতও ভাল জানা চাই। তাই বিদ্যাসাগরের সুপারিশ: পাঠ্যক্রমের জন্যে কাব্য-নাটক-গদ্য বাছতে হবে সেই অনুসারে। এও দেখার: আগের প্রস্তাবের সব পাঠ্যবই এখানে জায়গা পেল না। মতাদর্শর সঙ্গে সংগতি রেখে তিনি যে শিক্ষাপ্রণালী নিয়ে ক্রমাগত ভাবনাচিন্তা করতেন— এ তারই পাথুরে প্রমাণ। যেমন, আগেরবার অলংকার শ্রেণিতে সাহিত্যদর্পণ বাদ গেলেও এবার তার কয়েকটি অধ্যায় ফিরে এল; অন্যদিকে, গণিত শ্রেণিতে পুরোপুরি বাদ গেল লীলাবতী আর বীজগণিত। আরও নির্দিষ্ট হল ইংরিজি ভাষায় পড়ার বিষয়বস্তু— নীতিবোধ আর দর্শন থেকে মনস্তত্ত্ব আর রাষ্ট্রনীতি।
তৃতীয় পরিকল্পনায় দর্শন শ্রেণির পাঠ্যসূচি নিয়ে বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। স্মৃতিশাস্ত্র আর ষড়্দর্শন সম্বন্ধে তাঁর মত অপরিবর্তিত থাকলেও ন্যায়ের বেলা তাঁর সুপারিশ অনেকটাই পালটাল। দেখার ব্যাপার: নব্যন্যায়ের যে-ক’টি বই তখনও ছাত্রদের পড়তে হত (ভাষা পরিচ্ছেদ, ন্যায়সূত্রবৃত্তি, অনুমানচিন্তামণি আর সিদ্ধান্তমুক্তাবলী)— সব বাদ দিতে চাইলেন বিদ্যাসাগর। দর্শন শ্রেণির জন্যে প্রস্তাবিত নতুন পাঠ্যক্রম দাঁড়াল এইরকম:
১. ন্যায়— গৌতমের সূত্র ও কুসুমাঞ্জলি
২. বৈশেষিক— কণাদের সূত্র
৩. সাংখ্য— কপিলের সূত্র [সাংখ্যপ্রবচনসূত্র] ও তত্ত্বকৌমুদী
৪. পাতঞ্জল— পাতঞ্জলসূত্র
৫. বেদান্ত— বেদান্তসার ও ব্যাসের সূত্র [ব্রহ্মসূত্র] অধ্যায় ১ ও ২
৬. মীমাংসা— জৈমিনির সূত্র
৭. সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ
সব ক’টি ভারতীয় দর্শনতন্ত্র পড়ার আর-একটি সুবিধে খুঁজে পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। পাশ্চাত্য দর্শনের ধারণাগুলি বাংলায় (দেশি পোশাকে) হাজির করতে গেলে পারিভাষিক শব্দর যে ভাণ্ডার চাই— তা ছাত্ররা খানিকটা মজুত পাবে ভারতীয় দর্শনেই।
পনেরো শতকে রঘুনাথ শিরোমণির হাত ধরে নব্যন্যায় ব্যাপক সাড়া জাগায় বাংলায়। নবদ্বীপ হয়ে ওঠে তার পীঠস্থান। নব্যন্যায়ের প্রভাবে বেদান্ত ছাড়া সব প্রাচীন দর্শনের চর্চাই ক্রমে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সতেরো শতকের পর নব্যন্যায়ের আর কোনও উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি পাওয়া গেল না। ১৮২৪-এ সংস্কৃত কলেজ খোলার পর পুরনো টোল-চতুষ্পাঠীর পাঠ্যসূচি অনুসারে নব্যন্যায়ের চর্চা আবার ফিরে এল। বিদ্যাসাগরের নব্যন্যায় বিরোধিতার প্রধান কারণ তার উদ্দেশ্যহীন তর্ককৈবল্য। যুক্তি ছিল তাঁর কাছে সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর উপায়। স্রেফ তর্কর জন্যে তর্কে কোনও উৎসাহ পেতেন না তিনি।
বিদ্যাসাগরের তৃতীয় প্রস্তাবটিও অবশ্য পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। নব্যন্যায়ের অন্যান্য বইগুলি বাদ গেলেও ভাষা পরিচ্ছেদ ও তার টীকা সিদ্ধান্তমুক্তাবলী পাঠ্যসূচিতে রয়ে যায়। তবে বিদ্যাসাগরের লাগাতার প্রচেষ্টায় সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যক্রমে নব্যন্যায় তার পূর্বগৌরব হারায়।
বিদ্যাসাগরের শিক্ষাচিন্তা (ও তার মূলে যে মতাদর্শ)-র আর-একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত: ব্যালান্টাইন-এর প্রস্তাব সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া। এবার সে-আলোচনায় আসা যাক।
শিক্ষাপরিষদের আমন্ত্রণে আর উত্তর-পশ্চিম প্রদেশসমূহর সরকারি অনুমোদনে ১৮৫৩-র জুলাই-অগস্টে বারাণসীর সরকারি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, বিখ্যাত সংস্কৃতবিদ ড. জেম্স আর. ব্যালান্টাইন এলেন কলকাতায়। উদ্দেশ্য: কলকাতার সংস্কৃত কলেজের কাজকর্ম পাঠ্যক্রম ইত্যাদি পরিদর্শনের পর তাঁর মতামত জানিয়ে শিক্ষাপরিষদের সচিব মৌআট-কে একটি প্রতিবেদন পেশ করবেন। এ ছাড়া, কলকাতা ও বারাণসী কলেজের উন্নয়নের জন্যে একে অপরের থেকে শিক্ষণীয় উপাদান খোঁজাও ছিল তাঁর অভীষ্ট। বিদ্যাসাগরের ১৬ ডিসেম্বর ১৮৫০-এর সংস্কার-প্রকল্পটি তিনি আগে দেখেছিলেন। ব্যালান্টাইন-এর প্রতিবেদনে মোটের ওপর সংস্কৃত কলেজের পঠনপাঠন ও অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগরের প্রশংসা (বিশেষত আবশ্যিক ইংরিজি বিভাগের জন্যে) রইল। এক ছাদের নীচে হলেও দু’টি আলাদা প্রতিষ্ঠানে সংস্কৃত আর ইংরিজি পড়ানো হত বারাণসীতে। সেখানকার ইংরিজি ইস্কুলে মূলত বাঙালি ছাত্ররা পড়ত অথচ সংস্কৃত ইস্কুলে বাঙালি প্রায় পাওয়াই যেত না। বারাণসী কলেজের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারের পর কলকাতার কলেজের পাঠ্যসূচি নিয়ে একগুচ্ছ প্রস্তাব রাখলেন ব্যালান্টাইন। যদিও স্বকীয়তা বজায় রাখার দোহাই দিয়ে তিনি নিজের কলেজের জন্যে কিছুই গ্রহণ করতে চাইলেন না।
ব্যালান্টাইন-এর প্রধান তিনটি বক্তব্য মোটামুটি এইরকম:
১. কলকাতায় সংস্কৃত আর ইংরিজি একসঙ্গে পড়ার ফলে ছাত্রদের মনে হতে পারে: সত্য দ্বিবিধ। তিনি লক্ষ্য করেছেন: বারাণসীতে এমন সব ব্রাহ্মণ আছেন যাঁরা দু’টি ভাষা ভাল জানেন আর এও মানেন যে, পাশ্চাত্য তর্কবিদ্যা আর প্রাচ্য তত্ত্ব— দুই-ই ঠিক। অথচ সেগুলির তত্ত্বগত ঐক্য না ধরতে পারায় একটির চিন্তারীতি আর-একটির ভাষায় মেলে ধরতে তাঁরা অক্ষম। ইংরিজি না-জানা শিক্ষিত স্বদেশবাসীর কাছে সেই ব্রাহ্মণরা পৌঁছেও দিতে পারেন না মূল্যবান সব জ্ঞান যা ইংরিজি মারফত তাঁরা নিজেরা জেনেছেন। তাই দেখানো সম্ভব হয় না: পাশ্চাত্য বিজ্ঞান আদতে সেসব সত্যর বিকাশ ও ব্যাপ্তি— যার বীজ রয়েছে সংস্কৃত প্রণালীতে। তাঁদের শ্রোতারা সেই কারণে ভাবেন: এসব মূল্যবান বীজ পাশ্চাত্য বিজ্ঞানবিরুদ্ধ। কলকাতায় সংস্কৃত ও ইংরিজি বিভাগ একসঙ্গে চালানোর লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একদল মানুষ তৈরি, যারা ভারতীয় দর্শন আর পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের মধ্যে আপাত অসংগতি হঠাবে আর যেসব জায়গায় ঐকমত্য আছে— সেগুলি চিহ্নিত করবে। তারা পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের অগ্রগতির গ্রহণযোগ্যতা স্থাপন করবে এই দেখিয়ে যে, পাশ্চাত্য বিজ্ঞান সেসব সত্যকে স্বীকৃতি দেয় যেখানে অনেক আগেই হিন্দুরা চিন্তাভাবনার সাহায্যে পৌঁছেছিল।
২. হিন্দু দর্শনতন্ত্রর কোন বক্তব্যগুলির সঙ্গে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান খাপ খায়— তা নির্ধারণের জন্যে কয়েক বছর আগে ব্যালান্টাইন তাঁর একটি বইতে দেখান, ন্যায়ের মতো সর্বাঙ্গীণ দর্শনপ্রণালীর বেশ কিছু উপাদান থেকে কীভাবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বেরিয়েছে। এ ছাড়া, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি যে জন স্টুয়ার্ট মিল-এর A System of Logic-এর সংক্ষিপ্তসার প্রস্তুত করেছেন, সেটি কলকাতায় পড়ানোর প্রস্তাব করলেন। ব্যালান্টাইন-এর যুক্তি: ভূমিকায় তিনি দেখিয়েছেন, একই বিষয়ের জন্যে ব্যবহৃত পরিভাষায় জন স্টুয়ার্ট মিল-এর সঙ্গে ন্যায়দর্শনের সাদৃশ্য কতখানি। উপরন্তু, সেটির দাম মূল বইয়ের চেয়ে কম। তাই বইটি পাঠ্য হলে কলকাতার ছাত্রদের সুবিধে। তিনি আরও বললেন: এভাবে পড়ানোয় বেকন-এর তত্ত্ব বুঝতেও ছাত্রদের সহজ হবে।
৩. যেহেতু ন্যায়ের পাশাপাশি সাংখ্য ও বেদান্ত পড়ানো হত কলকাতায়, তাই ব্যালান্টাইন-এর ইচ্ছে: এসব দর্শনতন্ত্রর জন্যে যে-তিনটি পাঠ্যপুস্তকের টীকাসহ ইংরিজি সংস্করণ বারাণসী কলেজের জন্যে ছাপা হয়েছে, সেগুলি বিদ্যাসাগর চালু করুন। তা হলে শিক্ষক ও ছাত্রদের সম্যক উপলব্ধি হবে, ভারতীয় আর ইউরোপীয় দর্শনতন্ত্রর পারিভাষিক নামপঞ্জির সম্পর্ক কতখানি অভিন্ন। তিনি আরও বললেন: যেহেতু সাংখ্য ও বেদান্তর সঙ্গে বিশপ বার্কলি-র দার্শনিক ধ্যানধারণার মিল পাওয়া যায়, সেইহেতু জর্জ (বিশপ) বার্কলি (১৬৮৫-১৭৫৩)-র মানবজ্ঞানের নীতি-সংক্রান্ত নিবন্ধ (Treatise Concerning the Principles of Human Knowledge, 1710) বইটি পুনর্মুদ্রণের সময়ে ভাষ্যকার হিসেবে সেসব সামঞ্জস্যর দিকে নির্দেশ করেছেন ব্যালান্টাইন।৮ ভৌগোলিকভাবে এতখানি বিচ্ছিন্ন হয়েও যে একইরকম দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়, তা দেখলে দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা বাড়বে।
ব্যালান্টাইন-এর উদ্দেশ্য হল: একদিকে, ভারতীয় ও ইউরোপীয় ভাববাদী দর্শনের মধ্যে সাদৃশ্য দেখিয়ে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যর সমন্বয় নির্ধারণ আর অন্যদিকে, ভাববাদী হিন্দু দার্শনিক চিন্তাভাবনায় আধুনিক ইউরোপীয় বিজ্ঞানের বীজ নির্ণয়। বলা বাহুল্য যে, ভাববাদ আর বস্তুবাদের মৌলিক ফারাক এখানে গুলিয়ে গেছে। ঘটনা এই যে, প্রাচ্য হোক বা পাশ্চাত্য— দু’ক্ষেত্রেই ভাববাদী আর বস্তুবাদী দার্শনিক মতামতের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। এ ছাড়া, বিজ্ঞানের পেছনে রয়েছে বস্তুবাদী ধারণা আর তার অগ্রগতি নির্ভর করে সমাজের বস্তুগত আর্থ-সামাজিক ভিত্তির ওপর। অতীতের চিন্তার মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানের বীজ খুঁজে পাওয়া নেহাতই কালাতিক্রমণ দোষ (anachronism) ছাড়া অন্য কিছু নয়।
বিদ্যাসাগর এসব বিলক্ষণ বুঝতেন। ২৯ অগস্ট ১৮৫৩-য় শিক্ষাপরিষদের কাছ থেকে ব্যালান্টাইন-এর রিপোর্ট পাওয়ার পর ৭ সেপ্টেম্বর মৌআট-কে যে-চিঠি তিনি লিখলেন সেখানে তাঁর শিক্ষাচিন্তা (আর সেইসঙ্গে দর্শনচিন্তা) আবার স্পষ্ট বেরিয়ে এল। মনে রাখা দরকার: এই চিঠিটি সংস্কৃত কলেজের ফাইলে ১৯২৭-এ প্রথম খুঁজে পেয়েছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।৯
ব্যালান্টাইন-এর বক্তব্যগুলির বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর যুক্তি সাজালেন এইভাবে:
১. সংস্কৃত আর ইংরিজি পড়ে ছাত্রদের মনে হবে যে, সত্য দ্বিবিধ— এ কথা মানার কোনো হেতু নেই। বরং ভালভাবে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যর বিজ্ঞান ও সাহিত্য পড়লে পরিষ্কার হবে: সত্য সত্যই। পাশ্চাত্য তর্কবিদ্যা আর প্রাচ্য তত্ত্বপদ্ধতি— একটির ভাষায় আর-একটিকে কেউ প্রকাশ করতে না পারলে বুঝতে হবে যে, সেই ব্যক্তি হয় বিষয়গুলি ভালভাবে বোঝেননি নইলে ভাষার ওপর তাঁর দখলের যথেষ্ট অভাব আছে। এও ঠিক যে, হিন্দু দর্শনতন্ত্রে এমন অনেক অংশ আছে যেগুলির স্বচ্ছন্দ ইংরিজি অনুবাদ অসম্ভব। তার কারণ, সেসবের মধ্যে মর্মবস্তু কিছুই নেই। পাশাপাশি, বিদ্যাসাগর বললেন: হিন্দু শাস্ত্র আর পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের মতৈক্য দেখানোও সর্বদা সম্ভব নয়। যদিও-বা সামঞ্জস্য দেখানো যায়, তবু পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের অগ্রগতির পক্ষে হিন্দু পণ্ডিতদের সায় দেওয়ার আশা নেই। গোঁড়া হিন্দুদের দীর্ঘদিনের কুসংস্কার এতটাই অটল যে, পুরোপুরি নতুন মত অথবা কোনও সত্যর বিকাশ যার বীজ শাস্ত্রে পাওয়া যায়— তাঁদের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য হয় না। তাঁরা অনেকটা সেই খালিফ ওমর-এর মতো যিনি আরব সেনাপতি আমরু-কে আলেক্জান্দ্রিয়া-র গ্রন্থাগারের সব বই নষ্ট করার নির্দেশ দেন। কারণ: সেসব বই নির্ঘাত কোরান-এর বিপক্ষে, নতুবা পক্ষে লেখা। বিরুদ্ধে হলে তো কথাই ওঠে না; পক্ষে হলেও সেগুলি অপ্রয়োজন— কারণ সেক্ষেত্রে কোরান-ই যথেষ্ট। সর্বজ্ঞ ঋষিদের লেখা শাস্ত্রগুলি সেসব ব্রাহ্মণ অভ্রান্ত মনে করেন; পাশ্চাত্য বিজ্ঞান নতুন সত্য হাজির করেছে শুনে অবজ্ঞায় হেসে ওঠেন। বৈজ্ঞানিক সত্যর বীজ শাস্ত্রে পাওয়ার সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে তাঁরা উল্লসিত হন; শাস্ত্রর প্রতি তাঁদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন শ্রদ্ধা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তাঁদের খুশি করার তাই প্রশ্ন ওঠে না। বরং দেখা যাচ্ছে: যতই জনশিক্ষার প্রসার ঘটছে ততই তাঁদের প্রভাব কমছে। বিদ্যাসাগর সেইজন্যে চাইলেন আরও বেশি বাংলা মাধ্যম ইস্কুল, বাংলায় লেখা উপযোগী বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক আর ছাত্রদের পড়ানোর জন্যে একদল বাংলায় পারদর্শী শিক্ষক— যাঁদের আয়ত্তে থাকবে সব দরকারি তথ্য, আর দেশের কুসংস্কারগুলি থেকে যাঁরা মুক্ত। এমন সব শিক্ষক তৈরিই কলকাতার সংস্কৃত কলেজের লক্ষ্য।
২. জন স্টুয়ার্ট মিল-এর বইটির সংক্ষিপ্তসারে বিদ্যাসাগরের সায় ছিল না। বেশি দামের প্রামাণিক বই কিনতে কলকাতার ছাত্ররা রীতিমতো অভ্যস্ত। তা ছাড়া, জন স্টুয়ার্ট মিল নিজেই জানিয়েছেন, তাঁর বইয়ের সবচেয়ে ভাল ভূমিকা লিখেছেন আর্চবিশপ হোয়েট্লি।
৩. ব্যালান্টাইন-এর সুপারিশ অনুযায়ী ইংরিজি অনুবাদে শুধু বেদান্তসার পড়ানোয় রাজি হলেন বিদ্যাসাগর (মূল বইটি সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যক্রমে ছিল)। বাকি দু’টি (তর্কসংগ্রহ আর তত্ত্বসমাস)-র অনুবাদে তিনি আপত্তি তুললেন এই বলে যে, ন্যায় আর সাংখ্যর আরও ভাল সংস্কৃত বই ছাত্ররা পড়ে। বিদ্যাসাগরের মতে: বিশপ বার্কলি-র দর্শন পড়ালে লাভের চেয়ে ক্ষতি হবে বেশি। ভারতীয় দর্শনের সার্বিক জ্ঞানের জন্যে বেদান্ত আর সাংখ্য ছাত্রদের পড়াতেই হয়। হিন্দুরা এই দু’টি দর্শন সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীলও বটে। কিন্তু এগুলি যে ভ্রান্ত দর্শনতন্ত্র— সে-ব্যাপারে বিবাদ নেই। তাই এসবের প্রভাব কাটানোর জন্যে দরকার পাশ্চাত্যর খাঁটি দর্শন পড়ানো।১০
বার্কলি জাগতিক বিষয়ে ঈশ্বরের ভূমিকা স্বীকারের পাশাপাশি মনে করতেন: বাস্তবের কোনও কিছুর আলাদা অস্তিত্ব নেই; সেসব আদতে হল আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ধারণা। বিদ্যাসাগরের সিদ্ধান্ত: যেহেতু সাংখ্য আর বেদান্তর মতো বার্কলি-ও বস্তুজগৎকে অস্বীকারের পথে হেঁটেছেন, তাই তা পড়লে ছাত্রদের মনে ভ্রান্ত ভারতীয় দর্শনগুলি সম্পর্কে শ্রদ্ধা কমার বদলে বাড়বে। তা ছাড়া, ইউরোপেও বার্কলি-র মতামত আর গ্রহণযোগ্য নয়। সেখানে বরং যে দর্শনতন্ত্রে বাস্তবজগতের অস্তিত্ব স্বীকার, তা সম্বন্ধে ক্রমাগত জ্ঞান অর্জন আর মানবসভ্যতার অগ্রগতির জন্যে সে-জ্ঞান ব্যবহারের কথা বলে— তাকে খাঁটি মনে করা হয়।
এখানে একটি কথা বলা দরকার। বেদান্তর সঙ্গে সাংখ্যকে বিদ্যাসাগর এক পর্যায় ফেললেও খেয়াল রাখতে হবে যে, সাংখ্য কিন্তু আদতে বেদ-বিরোধী দর্শন ছিল।১১ আদি সাংখ্যে একইসঙ্গে নিরীশ্বরবাদী ও বস্তুবাদী ধারণা পাওয়া যায় (তার পারিভাষিক তত্ত্ব হল: ‘নিরীশ্বর প্রধান কারণবাদ’— জড়বস্তু (প্রধান বা প্রকৃতি) সব কিছুর মূল। সুতরাং বৈদিক ঐতিহ্যর— যার ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটে উপনিষদে— একেবারে উলটোদিকে এর অবস্থান। বেদান্তর তত্ত্ব হল: ‘ব্রহ্ম করণবাদ’— অর্থাৎ চেতন ব্রহ্মই পরম সত্তা, তার থেকেই সব কিছুর সৃষ্টি। বাদরায়ণ-এর ব্রহ্মসূত্র-র মোট ৫৫৫টি সূত্রর মধ্যে অন্তত ৬০টি লেখার উদ্দেশ্য সাংখ্যমত খণ্ডন। সেই ৬০টির মধ্যে আবার অন্তত ৩৭টি লেখা হয়েছে সাংখ্যর বেদ-বিরোধী (বা বেদানুসারী মনুবচন-বিরোধী) চরিত্র পরিষ্কারভাবে দেখানোর জন্যে। এ ছাড়া, সাংখ্যে এসেছে একাধিক উদাসীন পুরুষ (চেতনা)-এর তত্ত্ব যদিও তা নিয়ে সাংখ্য আর বেদান্তে মতপার্থক্য রয়েই গেছে। সাংখ্য যেখানে কার্য (ফল)-কে বাস্তব পরিণাম (পরিণামবাদ) বলে স্বীকার করে সেখানে বেদান্তে কার্যকে কারণ (বিশুদ্ধ চেতনা বা ব্রহ্ম)-এর অবাস্তব রূপ বা নিছক বিবর্তন ভাবা হয় (বিবর্তনবাদ)। ব্রহ্মসূত্র-র ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য (খ্রি. আট শতক) আর রামানুজ (খ্রি. এগারো শতক)— দু’জনেই সাংখ্যকে তাঁদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছেন। কিন্তু দেখার ব্যাপার: পরবর্তীকালে লেখা সাংখ্যসূত্র আর সাংখ্যকারিকা-য় মূলের বেদ-বিরোধী উপাদান বজায় থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে রক্ষণশীল অবস্থানের সঙ্গে আপস নজরে আসে। মাঝেমধ্যেই শ্রুতি-বিরোধিতার পরপরই দেখা যায় বেদ-প্রামাণ্যর (আপ্তবচন) প্রসঙ্গ। সাংখ্যর পুরুষ-এর তত্ত্বও ক্রমশ বৈদান্তিক হয়ে পড়ে। বোঝা যায়: সাংখ্যকারিকা-র পরবর্তী ভাষ্যকাররা— গৌড়পাদ, অনিরুদ্ধ আর বিজ্ঞানভিক্ষু— আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সাংখ্যকে নিয়ে যেতে বেদান্তর কাছাকাছি। শুধু তা-ই নয়, একইভাবে সময়ের সঙ্গে যোগদর্শন-এরও পরিবর্তন ঘটেছিল। পতঞ্জলী-র যোগসূত্র-য় ভাববাদী ধ্যানধারণা (এমনকী, ঈশ্বরের অস্তিত্ব) ক্রমশ ঢুকে পড়ে আদি-বস্তুবাদী যোগদর্শনে। আবার, বৈদান্তিক সাংখ্য আর ভাববাদী যোগের মিলনে তৈরি হয় সাংখ্যর এক বিশেষ রূপ (সেশ্বর বা ঈশ্বর-সমেত সাংখ্য) যার চরিত্রে মূলের বস্তুবাদী ধারণা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বিদ্যাসাগর সাংখ্য বলতে এইরকম ভাববাদী এক দর্শন বুঝেছিলেন, আদি-সাংখ্য নয়। তাই তার সঙ্গে বেদান্তর কোনও তফাত খুঁজে পাননি তিনি।
এও মনে রাখার: সাংখ্য আর বেদান্তকে ভ্রান্ত দর্শন মনে করলেও বিদ্যাসাগর কখনওই সেগুলি পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না। তিনি বরং চাইতেন: ভারতীয় দর্শনের মূল প্রতিপাদ্যগুলি সম্বন্ধে সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের সম্যক ধারণা হোক; বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর তাত্ত্বিক বিদ্যার এলাকা সর্বদা আলাদা থাকুক। পরে, অধ্যক্ষ না-থাকাকালীনও তাঁর মতের হেরফের হয়নি। ১৮৫৯-এ সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যক্রম থেকে সাংখ্য আর বেদান্ত সরানোর প্রস্তাব হল। সরকার সে-ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের মত জানতে চাইলে, তিনি বললেন:
দেখা যাচ্ছে: কাওয়েল (Cowell) স্মৃতি আর বেদান্ত কলেজে পড়ানো নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। আমি দুঃখিত, এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারছি না। এসব দর্শনতন্ত্র, আমার মনে হয়, একেবারে অপরিহার্য। স্মৃতির প্রচলিত নিবন্ধগুলি দেওয়ানি আইন— যেমন, উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত আইন, দত্তক ইত্যাদি— সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। এসব সম্বন্ধে জানা যে কত প্রয়োজনীয় তা সকলেই স্বীকার করেন। তাই সে-ব্যাপারে সবিস্তারে লেখার দরকার নেই। বেদান্ত হল ভারতে প্রচলিত অন্যতম দর্শনতন্ত্র। সেটি অধিবিদ্যা ধরনের; আর আমি মনে করি না, কলেজে তা ব্যবহারে কোনও যুক্তিযুক্ত আপত্তি থাকতে পারে। দু’টি শাখাই এখন যেভাবে পড়ানো হয়, ধর্মীয় ভিত্তিতে তা নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। আমার বিনীত মত: এগুলি পড়ানো বন্ধ হলে কলেজের পাঠ্যক্রম খুবই ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যাবে।১২
ব্যালান্টাইন-এর সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মতাদর্শগত ফারাক ছিল একেবারে মৌলিক। যেখানে ব্যালান্টাইন-এর উদ্দেশ্য, প্রাচীন আস্তিক ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সমন্বয়সাধন, সেখানে বিদ্যাসাগরের যাবতীয় উৎসাহ বাংলা ভাষায় আধুনিক বস্তুবাদী পাশ্চাত্য ধ্যানধারণার ব্যাপক প্রসার। সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা স্রেফ পণ্ডিত নয়, বরং সেই সামাজিক আন্দোলনের পরিচালক হয়ে উঠুক— এমনটাই চেয়েছিলেন তিনি। নিজে হাতে সেই বিপ্লব বাস্তবায়িত করা ছিল বিদ্যাসাগরের শিক্ষাচিন্তার মূল লক্ষ্য। এতটাই ভবিষ্যৎমুখী তাঁর মতাদর্শ। এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগর যে আগাগোড়া আপসহীন মনোভাব দেখাবেন— এ আর আশ্চর্য কী!
৫ অক্টোবর ১৮৫৩-য় মৌআট-কে একটি আধা-সরকারি চিঠিতে বিদ্যাসাগর সাফ জানালেন: ব্যালান্টাইন-এর প্রস্তাব তিনি যদি মানতে বাধ্য হন তা হলে সংস্কৃত কলেজে তাঁর মর্যাদা শুধু ক্ষুণ্ণ হবে না, উপযোগিতার দিক দিয়েও প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতির সম্ভাবনা প্রচুর। ব্যাপারটি যে বিদ্যাসাগরের আত্মসম্মানবোধে আঘাত করেছে, তাও শিক্ষাপরিষদের সচিবকে পরোক্ষে মনে করালেন তিনি: নিজের আপত্তি সত্ত্বেও ক’জন শিক্ষিত ইংরেজ সমপদমর্যাদার মানুষের প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হবেন? ‘দ্বিবিধ সত্য’-র প্রসঙ্গ টেনে বিদ্যাসাগর আবার বললেন: সংস্কৃত ও ইংরিজি— দু’টি ভাষায় জ্ঞান আছে, এমন বিচক্ষণ বাঙালি পাওয়া দুষ্কর যাঁর মনে হয় সত্য দু’রকম।
এই চিঠিতে বিদ্যাসাগর আবার ফিরলেন সংস্কৃত কলেজ নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনায়। ছাত্রদের বাংলা ভাষায় পারদর্শী করাই সংস্কৃত পড়ানোর মুখ্য উদ্দেশ্য। এ ছাড়া, ভাল ইংরিজির জ্ঞান থাকলে কয়েক বছরেই তাঁরা শিক্ষক হিসেবে লিখে আর পড়িয়ে উপযোগী সব তথ্য জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রসার ঘটাবেন। বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় জনশিক্ষা সম্ভব নয়। তাঁর এই সাধের লক্ষ্য (darling object) বাস্তবায়িত হবে তখনই যখন বিদ্যাসাগর কাজ করতে পারবেন অবাধে। ব্যালান্টাইন-এর যে সুপারিশ তিনি মানলেন (বেকন-এর Novum Organum পাঠ্যসূচিতে ঢোকানো)— তার পেছনে ছিল বিদ্যাসাগরের মতাদর্শগত সমর্থন। সতেরো শতকের গোড়ায় ইউরোপে মধ্যযুগীয় খ্রিস্টীয় ধর্মমণ্ডলীর মতামতের বিরুদ্ধে প্রথমবার আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শনকে দাঁড় করিয়েছিলেন ফ্রান্সিস বেকন। মুনাফার স্বার্থে উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণির কাছে জগতের নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞান তখন ছিল ভীষণ দরকারি। সেই আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনীয়তার দার্শনিক ভিত্তি জোগালেন বেকন। নিছক তাত্ত্বিক ধারণা নয়, বেকন-এর কাছে বেশি গুরুত্ব পেল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা আর যুক্তি। আরোহ-প্রণালী নির্ভর জ্ঞানসঞ্চয় ছিল তাঁর দর্শনের লক্ষ্য। এভাবেই কুসংস্কারমুক্ত এক উন্নত মানবসমাজ গড়তে চাইলেন বেকন। স্বাভাবিক যে, বেকনীয় পদ্ধতিকে গ্রহণ করবেন বিদ্যাসাগর। তাই বলা যায়: নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে যাচাই ছাড়া ব্যালান্টাইন-এর প্রস্তাবগুলি গ্রহণ বা বর্জন করতে চাননি বিদ্যাসাগর। তাই তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করলেন: সেই স্বাধীনতা না পেলে অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া ছাড়া তাঁর কোনও উপায় থাকবে না।
বিদ্যাসাগরকে শেষ অব্দি সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যক্রম বদলাতে চাপ দেয়নি শিক্ষাপরিষদ। নিজের লক্ষ্যে ক্রমশ এগোতে পেরেছেন তিনি। কলেজে ছাত্রসংখ্যাও বেড়েছে। ৪ জানুয়ারি ১৮৫৪-এ সংবাদ প্রভাকর-এ লেখা হয়:
গবর্ণমেণ্টের সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি নানা শাস্ত্রাধ্যাপক পরম পণ্ডিতবর শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পাণ্ডিত্য ও কার্য্যদক্ষতা এবং এই দেশ মধ্যে বিদ্যা প্রভা সন্দীপন বিষয়ে অবিচলিত অনুরাগ দৃষ্টি করিয়া গবর্ণমেণ্ট তাঁহার মাসিক বেতন তিনশত টাকা নিরূপণ করিয়াছেন, পূর্ব্বে তিনি ১৫০ টাকা প্রাপ্ত হইতেন। শিক্ষা কৌন্সেলের মেম্বর মহাশয়দিগের এই বিবেচনা অতি সুবিবেচনার কার্য্য হইয়াছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তুল্য সর্ব্ব বিষয়ে সুযোগ্য এবং সরল স্বভাব ব্যক্তি গবর্ণমেণ্টের অধীনে প্রায় দৃষ্ট হয় না। এতদ্দেশীয় লোকেরা সংস্কৃত ও বঙ্গভাষায় সুপণ্ডিত হয়েন এই উদ্দেশে তিনি অবিশ্রান্তরূপে পরিশ্রম করিতেছেন, স্বয়ং অনেক পুস্তক রচনা করিয়াছেন, তাঁহার দ্বারা সংস্কৃত কালেজে যে সকল সুনিয়ম নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে তত্তাবৎ ছাত্রদিগের পক্ষে অতিশয় মঙ্গলজনক বলিতে হইবেক, অতএব এতাদৃশ সুযোগ্য ও সুপণ্ডিত লোকের মহদ্গুণের পুরস্কার করা গবর্ণমেণ্টের পক্ষে অবশ্য কর্ত্তব্য হইয়াছে, এজন্য তাঁহারা প্রতিষ্ঠা পাইতে পারেন না, না করিলে বরং অবিবেচনা প্রচার হইতে পারে।১৩
১৮৫৪-এ বাংলা ভাষায় শিক্ষাদানের সরকারি সিদ্ধান্তর ভিত্তি ছোটলাট হ্যালিডে-র যে-মিনিট (১৬ নভেম্বর ১৮৫৪), সেটির উৎস ছিল বিদ্যাসাগরের উনিশ দফা মন্তব্য (৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৪)। সংস্কৃত কলেজ ঘিরে তাঁর যে-শিক্ষাচিন্তা গড়ে উঠেছে, তার প্রভাব সেখানেও পড়ল। বাংলা ইস্কুলের পাঠ্যসূচিতে সংস্কৃত বই থাকল না ঠিকই কিন্তু ছাত্রদের সামগ্রিক শিক্ষার জন্যে জায়গা পেল ভূগোল, ইতিহাস, জীবনচরিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা, নীতিবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর শারীরতত্ত্ব। তাঁর লেখা আগের বাংলা বইগুলি ছাড়াও এবার যোগ হল বর্ণপরিচয়। এ ছাড়া, জেলায় জেলায় ঘুরে ইস্কুলগুলি বিনা পারিশ্রমিকে পরিদর্শন শুধু নয়, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্যে সংস্কৃত কলেজে মডেল ইস্কুল প্রতিষ্ঠার ইচ্ছেও প্রকাশ করলেন বিদ্যাসাগর।
সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার আগে, ১১ ডিসেম্বর ১৮২৩-এ বড়লাট লর্ড আমহার্স্ট-কে একটি লম্বা চিঠি লিখেছিলেন রামমোহন রায়।১৪ তখন প্রাচ্যবিদ্যা আর পাশ্চাত্যবিদ্যার অনুরাগীদের মধ্যে বিবাদ চলছিল। সরকার সাবধানবশত গোঁড়া হিন্দুসমাজ (ও মুসলিমসমাজ)-কে চটাতে চায়নি; তাই শেষ অব্দি প্রাচ্যবিদ্যার প্রসারে উৎসাহী হয়। রামমোহন বুঝতে পারেন, হিন্দুধর্মর পাশাপাশি বাঙালির শিক্ষার আমূল পরিবর্তন না হলে সামগ্রিকভাবে হিন্দুসমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাঁর বক্তব্য ছিল: ভারতে ইতিমধ্যেই বহু হিন্দু পণ্ডিত সংস্কৃত পড়ান; এই শিক্ষালয়ে (সংস্কৃত কলেজ) ছাত্রদের স্রেফ ব্যাকরণের খুঁটিনাটি আর অধিবিদ্যাগত ভেদাভেদ সম্বন্ধে শেখানো হবে যা তাদের বা সমাজের কোনও ব্যাবহারিক কাজে লাগবে না। দু’হাজার বছর আগের জ্ঞান (অনেকটা যেমন ইউরোপে ছিল ফ্রান্সিস বেকন-এর সময়কালের আগে) নয়, বরং পাশ্চাত্য শিক্ষাপদ্ধতিতে গণিত, প্রাকৃতিক দর্শন, রসায়ন, শারীরবিদ্যার মতো প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান শেখানোয় অর্থ ব্যয় করুক সরকার। হিন্দু পণ্ডিতদের জায়গায় শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হোক শিক্ষিত ইউরোপীয়রা। এ ছাড়া, সরাসরি ভারতীয় দর্শনেরও (বিশেষত ন্যায়, বেদান্ত আর মীমাংসা) বিরোধিতা করেন রামমোহন। তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল, বাস্তবজগৎ-বিমুখ শিক্ষা দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়; উপযোগী পাশ্চাত্য শিক্ষাই ভারতীয়দের উন্নতি ঘটাতে পারে। একইসঙ্গে রামমোহন চাইতেন, সে-শিক্ষার বাহন হোক ইংরিজি। দুঃখর বিষয়: সরকার সেদিন রামমোহনের প্রস্তাব নাকচ করেছিল।
বলা যায়: রামমোহনের সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা-সংক্রান্ত কর্মসূচি পরবর্তীকালে এগিয়ে নিয়ে গেলেন বিদ্যাসাগর। তিনিও চাইলেন: বাস্তবমুখী পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার হোক শিক্ষার উদেশ্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা নিয়ে সরকারের অবস্থান পালটানোয় বিদ্যাসাগরের খানিক সুবিধে হল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃত কলেজে তাঁর সিদ্ধান্তগুলি অনেকটাই রূপায়ণ করতে পারলেন তিনি। রামমোহনের সঙ্গে অবশ্য তাঁর তফাতও রইল। যেখানে রামমোহন চেয়েছিলেন শুধু সরকারি সংস্কৃত কলেজ হয়ে উঠুক আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার পীঠস্থান, সেখানে কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্যে লড়লেন বিদ্যাসাগর। রামমোহনের পছন্দ ছিল ইউরোপীয় শিক্ষক, বিদ্যাসাগর গড়ে তুলতে চাইলেন এক মুক্তমনা বাঙালি শিক্ষকগোষ্ঠী যাঁরা জনশিক্ষার প্রসার ঘটাবেন মাতৃভাষায়। সংস্কৃত কলেজকে সেই সামাজিক আন্দোলনের উৎসস্থল হিসেবে দেখেছিলেন বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত-বাংলা-ইংরিজি ভাষার পাশাপাশি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যর জ্ঞানবিজ্ঞান— সব ক’টি উপাদানই সেই আন্দোলনে গুরুত্ব পেয়েছে।
টীকা ও সূত্রনির্দেশ
১. বিদ্যাসাগরের জীবন, কর্ম ও অন্যান্য খবরাখবরের জন্যে মূলত এই তিনটি বইয়ের সাহায্য নেওয়া হয়েছে: ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা ১৮ (কলকাতা: বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, শ্রাবণ ১৩৬২ ব.); বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ (কলকাতা, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৯৯); ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৬)।
২. এ ব্যাপারে বিশদ আলোচনার জন্যে, Goutam Chattopadhyay ed., Awakening in Bengal in Early Nineteenth Century (Selected Documents), Vol. One (Calcutta: Progressive Publishers) pp. xi-xix দ্র.।
৩. এ বিষয় নানা তথ্যর জন্যে, গৌতম নিয়োগী ও অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়, তত্ত্ববোধিনী সভার কথা (কলকাতা: সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, ১৪২৪ ব.) দ্র.।
৪. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ১৪০; ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ৫৬১।
৫. কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, রচনা-সংগ্রহ, সম্পা. নির্মাল্য আচার্য (কলকাতা: সুবর্ণরেখা) পৃ. ৩৯৯-৪০০।
৬. এ নিয়ে আলোচনার জন্যে, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, ‘নব্যন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর’, বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ (কলকাতা: চিরায়ত প্রকাশন) পৃ. ১০৭-১২১ দ্র.।
৭. কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, রচনা-সংগ্রহ, পৃ. ১৭৩-৭৪।
৮. ব্যালান্টাইন-এর লেখায় (যা বিভিন্ন জায়গায় উদ্ধৃত হয়) বার্কলি-র বইটির নাম থাকে: Inquiry. কিন্তু সে-নামে বার্কলি-র কোনও বই নেই। সম্ভবত সেটি Treatise Concerning the Principles of Human Knowledge.
৯. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ, পৃ. ১০৭ দ্র.।
১০. বিদ্যাসাগর-ব্যালান্টাইন বিতর্কর জন্যে, Ramkrishna Bhattacharya, ‘Ballantyne-Vidyasagar Controversy: A Re-view’, Vidyasagar College: In Grateful Remembrance of 125 Years (1872-1997), Editor-in-chief Jiban Mukhopadhyay (Kolkata: Vidyasagar College, 2005) pp. 35-43 দ্র.।
১১. এ বিষয়ে জানার জন্যে, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, ‘বিদ্যাসাগর কোন সাংখ্যর কথা ভেবেছিলেন’, বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ, পৃ. ১২২-১২৬ দ্র.। এ ছাড়া, সাংখ্য নিয়ে বিশদ আলোচনা পাওয়া যাবে, Debiprasad Chattopadhyaya, Lokayata. A Study in Ancient Indian Materialism (New Delhi: People’s Publishing House) pp. 359-458.
১২. মূলের জন্যে, ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ৬৮৫ দ্র.।
১৩. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ১৪৬।
১৪. Raja Rammohun Roy, The English Works of Raja Rammohun Roy, Kalidas Nag and Debajyoti Burman (Eds.) (Calcutta: Sadharan Brahmo Samaj, 1995), Part IV, pp. 105-108 দ্র.।