পরিশিষ্ট

বিদ্যাসাগরের ইতিহাস, ইতিহাসে বিদ্যাসাগর

বিদ্যাসাগরের ইতিহাস, ইতিহাসে বিদ্যাসাগর

সেমন্তী ঘোষ

যোগবাশিষ্ঠের একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনীবিষয়ক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। শ্লোকটি হল— ‘তরবোঽপি হি জীবন্তি জীবন্তি মৃগপক্ষিণঃ/ স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি’: ‘গাছপালাও জীবনধারণ করে, পশুপাখিও জীবনধারণ করে, কিন্তু সে-ই প্রকৃতরূপে জীবিত, যে মনের দ্বারা জীবিত থাকে’। আবার, তাঁর প্রবন্ধ থেকে ঠিক এই শ্লোকটি তুলে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিদ্যাসাগর’ নামে প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন ১৩০৫ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৮৯৮ সালে।

সুতরাং, এই শ্লোক বিদ্যাসাগর-জীবনীর ক্ষেত্রে ঘুরে ঘুরে আসা একটি ধুয়ো, এমন কথা বললে খুব ভুল হবে না। আপাতত এই লেখা শুরু করার জন্যও বেশ উপযুক্ত মনে হচ্ছে শ্লোকটিকে, কেননা বিদ্যাসাগরের চরিত্র বিষয়ে পরবর্তী বাঙালি মনীষীদের কৌতূহলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মধ্যে মোক্ষমভাবে ধরা আছে। ইতিহাসে বিদ্যাসাগরকে কত নানাভাবে ফিরে ফিরে দেখা হয়েছে, আমরা এখানে তার একটা মোটের উপর ধারণা তৈরি করতে চাইছি, তাই এই শ্লোক আমাদের সহায়ক হতে পারে। বুঝিয়ে দিতে পারে, বিদ্যাসাগর বিষয়ে শ্রদ্ধাভিভূত রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগরের প্রধান গুণটি কেন এই সূত্রের মধ্যেই প্রকাশিত: ‘সাধারণ বাঙালির সহিত বিদ্যাসাগরের যে একটি জাতিগত সুমহান্ প্রভেদ দেখিতে পাওয়া যায়, সে প্রভেদ শাস্ত্রীমহাশয় যোগবাশিষ্ঠের একটিমাত্র শ্লোকের দ্বারা পরিস্ফুট করিয়াছেন। আমাদের অপেক্ষা বিদ্যাসাগরের একটা জীবন অধিক ছিল। তিনি কেবল দ্বিজ ছিলেন না, তিনি দ্বিগুণ জীবিত ছিলেন।’ এই কারণেই ‘তাঁহার লক্ষ্য, তাঁহার আচরণ, তাঁহার কার্যপ্রণালী আমাদের মতো ছিল না। আমাদের সম্মুখে আছে আমাদের ব্যক্তিগত সুখদুঃখ, ব্যক্তিগত লাভক্ষতি। তাঁহার সম্মুখেও অবশ্য সেগুলো ছিল, কিন্তু তাহার উপরেও ছিল তাঁহার অন্তর্জীবনের সুখদুঃখ, মনোজীবনের লাভক্ষতি। সেই সুখদুঃখ-লাভক্ষতির নিকট বাহ্য সুখদুঃখ-লাভক্ষতি কিছুই নহে।’

অর্থাৎ, উপরের কথাগুলি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে সত্যি কি না, সত্যি হলে কতখানি সত্যি, এসব এক রকম বিবেচনা। আর-এক রকম বিবেচনা হল— উপরের কথাগুলি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে যাঁরা ভেবেছেন, তাঁরা কীভাবে মানুষটিকে দেখতে চেয়েছেন, এবং কেন তেমন করে দেখা জরুরি বলে মনে করেছেন, সেটা বুঝে নেওয়া। অর্থাৎ বিদ্যাসাগর-ইতিহাসের ধারাটি কেন, কখন, কোন দিকে এগিয়েছে, তার কিছু আন্দাজ তৈরি করা হল এই দ্বিতীয় বিবেচনার লক্ষ্য। এই প্রবন্ধের লক্ষ্য এই দ্বিতীয় বিবেচনাই।

‘তাঁহার লক্ষ্য, তাঁহার আচরণ, তাঁহার কার্যপ্রণালী আমাদের মতো ছিল না।’— উনিশ ও বিশ শতকের বহু চিন্তাবিদ এইভাবে বিদ্যাসাগরের কথা ভেবেছিলেন। তাঁদের পাশে যে চলমান সমাজের বহমান ভাবনাচিন্তা, তার থেকে বিদ্যাসাগর একক ‘মহীরুহ’-এর মতো মাথা উঁচিয়ে আছেন, আর সেইজন্য ওই উঁচুর দিকে দৃষ্টি রেখে মানুষটির অনুসরণ বাঙালি সমাজের অবশ্যকর্তব্য, এমনই তাঁদের মনে হত। এ প্রসঙ্গে আমরা আবার পরে ফিরে আসব, এখন কেবল খেয়াল রাখা ভাল যে বাঙালি সমাজের থেকে বিদ্যাসাগরের বিচ্ছিন্নতাই এই বাঙালি চিন্তাবিদদের কাছে বিদ্যাসাগরের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য।

অথচ, ব্যক্তিগুণের বিশিষ্টতা মেনে নিয়েও ব্যক্তিমানুষ তো আসলে সমাজের মধ্যেই কোনও-না-কোনওভাবে প্রোথিত। জীবনীকারকে না হলেও, ইতিহাসবিদকে এ কথা মানতেই হয়। ব্যক্তির মূলে তাই সমষ্টি আছেই, তার সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ করার কাজটা কঠিন হলেও খুবই জরুরি। আর ঠিক এই জায়গাটায় এসে ধন্দে পড়তে হয়েছে বহু ইতিহাসবিদকে: কীভাবে বিদ্যাসাগরের মতো একজন অসম্ভব ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বকে তাঁর চারপাশের স্থবিরভাবাপন্ন, এমনকী পশ্চাৎমুখী, সমাজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা সম্ভব, তা বোঝা রীতিমতো দুরূহ হয়ে পড়েছে। সত্যিই সেই সমাজ ততটাই স্থবিরভাবাপন্ন বা পশ্চাৎমুখী ছিল কি না, তালেগোলে সেই প্রশ্নও উঠেছে। বিদ্যাসাগরের সময় থেকেই বিদ্যাসাগরের ইতিহাস লেখা শুরু হয়েছে, আর ধারাবাহিকভাবে ইতিহাস-রচয়িতারা এই কঠিন সমস্যার মধ্যে ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়েছেন। এক এক ধারার ইতিহাস তাঁকে ও তাঁর সমাজকে এক এক ভাবে ব্যাখ্যা করেছে। সেই কারণে বিদ্যাসাগরের ইতিহাসের আলোচনা পরোক্ষে আমাদের ইতিহাসের পদ্ধতিগত আলোচনারও একটি পাঠ হয়ে ওঠা সম্ভব।

তবে সেসবের গভীরে ঢোকার আগে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল। বিদ্যাসাগর কেবল নিজের জীবৎকালেই একক ও বিশিষ্ট ছিলেন না, প্রখ্যাত বিদ্যাসাগর-বিশেষজ্ঞ ব্রায়ান হ্যাচারের ভাষা ধার করে বলা যায়— তাঁর ‘লাইফ’-এর মতোই তাঁর ‘আফটার-লাইফ’ও বড় বিশিষ্ট।আর কোনও বাঙালি ‘মহাপুরুষ’কে নিয়ে বাঙালি এত সংখ্যক জীবনী লেখেনি, এত ইতিহাসও লেখেনি— এমনকী রামমোহন রায়কে নিয়েও না। বিদ্যাসাগরকে নিয়ে কেন এত ভূরি ভূরি রচনা, সেই প্রশ্নটাকে আলাদা করে ‘প্রবলেম্যাটাইজ়’ করা জরুরি, সুমিত সরকারের এই মন্তব্যটি তাই গুরুত্বপূর্ণ।

বিদ্যাসাগর যে ইতিহাসের কাছে কতটা জটিল বিষয়, সেটা বোঝা যায় জীবনীকারদের এইসব রচনার মধ্যে ক্রমাগত উঠে আসা ‘দয়ার সাগর’ কিংবা ‘মনুষ্যত্বগুণের আধার’ ইত্যাদি বক্তব্য থেকেই। এখানেই ইতিহাসবিদদের সমস্যার শুরু। বিদ্যাসাগরের মধ্যে যে অসীম দয়া, উদারতা, মানবিকতার পারাবার ছিল, তা তো বটেই। এও ঠিক যে এই গুণগুলিকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন, মনে করতেন যারা দুর্ভাগ্যপীড়িত, তাদের কাছে একমাত্র এইভাবেই নিষ্ঠুর ও কর্কশ পৃথিবীকে সামান্য পরিমাণ সহনীয় করে তোলা সম্ভব। কিন্তু তাঁর এই অসীম মানবিকতার ‘ন্যারেটিভ’ থেকে ইতিহাসবিদকে তবুও একটু সরে আসতে হয়। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর চতুষ্পার্শ্বের পরিবেশের সামঞ্জস্য ও অসামঞ্জস্যের বিষয়গুলির খোঁজ লাগাতে হয়। তাঁদের ভাবতে হয়, জাতীয়তাবাদের সূচনা কিংবা প্রসারের সময় বিদ্যাসাগরের জীবনীকারদের এই দয়া বা অক্ষয় মনুষ্যত্বকে প্রধান করে মানুষের সামনে তুলে ধরার একটা অতিরিক্ত প্রয়োজন ছিল কি না, থাকলে কেন ছিল। কোনও ব্যক্তির সমগ্র জীবনকে একসঙ্গে দেখার কোনও বাধ্যবাধকতা থাকে না তাঁর জীবনীকারদের, অনেক প্রশ্নের উত্তর তাঁদের না দিলেও চলে। কিন্তু ইতিহাসবিদদের সমস্যা হল, ওই একই ব্যক্তিচরিত্রের বিশ্লেষণ করতে বসে এও তাঁদের ভাবতে হয় যে, কেন কোনও কোনও সামাজিক প্রশ্নে বিদ্যাসাগর ততটা ঐকান্তিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হননি, কেন খানিকটা সরে থেকেছেন। অর্থাৎ কেবল যে বিষয়গুলি তাঁর মনোযোগ পেয়েছিল, কেবল সেগুলির আলোচনাই নয়— যে বিষয়গুলিতে তিনি মনোযোগ দেননি, সে কথাও ইতিহাসবিদরা বিবেচনা করতে চান। সাফল্যের সঙ্গে তাঁর সীমাবদ্ধতার কথাটিও স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে।

জীবনীর কথাই যদি ধরি, একটা বিষয় আমাদের অবাক করে। বিদ্যাসাগরের প্রথম জীবনীকাররা সকলেই তাঁর গুণগ্রাহী ছিলেন না। আমরা সাধারণত ধরে নিই, কেউ যখন কারও জীবনী লিখছেন, তিনি তাঁর প্রশংসা করতে চান বলেই লিখছেন। অথচ বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে তেমন ঘটেনি। প্রথম দিকের জীবনীকারদের মধ্যে বিদ্যাসাগর-ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে শিবনাথ শাস্ত্রী, কিংবা আরও পরে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— এঁরা ছিলেন বিদ্যাসাগরের গুণমুগ্ধ। কিন্তু সুবলচন্দ্র মিত্রের মনোভাব সেরকম ছিল না। বিধবাবিবাহ বিষয়ে তিনি একেবারেই উৎসাহী ছিলেন না। তবে এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নামটি হল বিহারীলাল সরকার, যিনি ১৮৯৫ সালে তথ্যবহুল একটি জীবনী লেখেন। একে তো ইনি ছিলেন বঙ্গবাসী সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত, যে বঙ্গবাসী প্রায় সবসময় সংস্কারবিরুদ্ধতার পক্ষ নিত। বিতর্কিত যৌন সম্মতি বিলের (‘এজ অব কনসেন্ট’ বিল: যা মেয়েদের যৌন সম্মতির বয়স দশ থেকে বারোতে উঠিয়ে রক্ষণশীল সমাজে প্রতিক্রিয়ার ঝড় তুলেছিল) বিপক্ষে এই পত্রিকা রীতিমতো প্রচার-অভিযান চালিয়েছিল। তার উপর বঙ্গবাসী প্রেস থেকে তাঁরই উদ্যোগে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছিল কতগুলি শাস্ত্রীয় পুস্তিকা, যার অন্যতম ছিল পঞ্চানন তর্করত্নের পরাশরসংহিতা। এই পরাশরসংহিতা-কেই বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় যুক্তির প্রতিযুক্তি হিসেবে পেশ করা হত রক্ষণশীল সমাজের পক্ষ থেকে। বিহারীলালের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের তুলনামূলক অবস্থান এইসব থেকেই স্পষ্ট হয়। বাস্তবিক, বিধবাবিবাহ যে শেষপর্যন্ত একটি সফল কার্যক্রম হতে পারেনি, তাতে আন্তরিকভাবে খুশি হয়েছিলেন বিহারীলাল, বলেছিলেন ‘হিন্দু সমাজের অশেষ সৌভাগ্য’।এসব সত্ত্বেও তিনিই প্রথম সবচেয়ে প্রামাণ্য জীবনীটি লিখলেন, যার তথ্যাদির উপর সুবলচন্দ্র মিত্রের পরবর্তী ইংরেজি জীবনীটি অনেকখানি নির্ভর করেছিল। এমন অদ্ভুত ঘটনা কেন ঘটতে পারল?

সুমিত সরকারের মতে, বিহারীলাল সরকারের বইয়ের শেষে ‘হিন্দু’দের প্রতি যে আবেদন আছে, তার থেকে একটি ইঙ্গিত পাওয়া সম্ভব। হিন্দুদের প্রতি তাঁর আহ্বান— বিদ্যাসাগরের মতো নিষ্ঠা ও মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে চলতে, কিন্তু ‘শাস্ত্রমতে’ নিজেদের ‘কর্তব্য’ পালন করতে। এর থেকে অনুমান করা সম্ভব, ঔপনিবেশিক সমাজের প্রাক্-জাতীয়তাবাদ পর্বে সামাজিক দিগ্‌দর্শনের যে চেষ্টা, তার মধ্যে বিদ্যাসাগরের মতো একটি চরিত্র আদর্শ হিসেবে খুবই আকর্ষণীয় ছিল, আর সেই কারণে, তাঁর কথাবার্তা যুক্তিপদ্ধতিগুলিকে বাদ দিয়ে তাঁর চরিত্র অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়া খুবই দরকার হয়ে পড়েছিল। হিন্দু সমাজের এইসব রক্ষণশীল সংস্কারকরা হয়তো মনে করেছিলেন, বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিত্ব অত্যন্ত আকর্ষক, কিন্তু তাঁর মতামত ও মানসিকতা— বিপজ্জনক। তাই মতামতের দিকটিকে সমালোচনার লক্ষ্য করে, তাঁর চরিত্রবলকে সমাজের একাংশের কাছে তুলে ধরার কাজটা তাঁদের কাছে জরুরি ঠেকেছিল— কেননা তাঁদের সমাজের সামনে তখন বিরাট কাজ: ঔপনিবেশিক প্রভুশাসিত রাষ্ট্রের সঙ্গে সামাজিক মোকাবিলা।

এই অনুমান আমাদের আরও একটি বিষয় বুঝতে সাহায্য করে। সেসময়ে, কিংবা বিশ শতকের গোড়ায়, বিদ্যাসাগরকে যাঁরা পূজাত্মক দৃষ্টিতে দেখতেন, বিভিন্ন জায়গায় তাঁর আবক্ষ মূর্তি বানিয়ে রাখার পন্থী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরাও কিন্তু বিদ্যাসাগরের চরিত্রের সমগ্রতা দিয়ে তাঁকে মনে রাখতেন না, যে যাঁর পছন্দমতো দিক বেছে নিয়ে সেটা তুলে ধরতেন। কেউ নারী-সংস্কার, কেউ ভাষা-সংস্কার, কেউ অসচ্ছল গ্রামীণ পরিবার থেকে তাঁর নাগরিক সমাজের কেন্দ্রে উঠে আসার আপাত-‘সাফল্য’, কেউ-বা আবার বিদেশি শাসকের সামনে তাঁর প্রত্যয়ী আত্মাভিমানকে জোর দিয়ে দেখাতে চান। তাই, বিদ্যাসাগরকে বাঙালি সমাজ কীভাবে মনে রেখেছে, তা নিয়ে কথা বলতে বসে সত্যিকারের রক্তমাংসের বিদ্যাসাগরকে অনেকসময় ছাপিয়ে যেতে থাকে তাঁর সম্পর্কে ব্যবহৃত উপমা, তুলনা, শব্দবন্ধগুলি, আর তাদের অবধারিত একমাত্রিকতার চাপে একটি সাদা-কালো ইমেজ তৈরি হয়ে ওঠে। এক অসামান্য কিন্তু জটিল সংস্কারকের জীবনের সামগ্রিক বিচার পরাভূত হতে থাকে তাঁর জাতিগত প্রয়োজনের ‘ইমেজ’টির কাছে।

এই প্রসঙ্গে, রবীন্দ্রনাথের ‘বিদ্যাসাগরচরিত’-টিকে আলাদাভাবে উল্লেখ না করে উপায় নেই। কেননা প্রথমবার তাঁর লেখার মধ্যেই বিদ্যাসাগরের নানা গুণ ছাপিয়ে তাঁর আসল মহত্ত্বের স্থানটি স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হল, যে স্থান পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে তুলনা ছাড়া বোঝা যায় না। রবীন্দ্রনাথের তীব্র ভর্ৎসনার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠল সেকালের বঙ্গসমাজের নিকৃষ্টতা ও সংকীর্ণতা, আর তার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগরের মহিমা। ‘বৃহৎ বনস্পতি যেমন ক্ষুদ্র বনজঙ্গলের পরিবেষ্টন হইতে ক্রমেই শূন্য আকাশে মস্তক তুলিয়া উঠে, বিদ্যাসাগর সেইরূপ বয়োবৃদ্ধিসহকারে বঙ্গসমাজের সমস্ত অস্বাস্থ্যকর ক্ষুদ্রতাজাল হইতে ক্রমশই শব্দহীন সুদূর নির্জনে উত্থান করিয়াছিলেন; সেখান হইতে তিনি তাপিতকে ছায়া ও ক্ষুধিতকে ফলদান করিতেন; কিন্তু আমাদের শতসহস্র ক্ষণজীবী সভাসমিতির ঝিল্লিঝংকার হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিলেন,’— রবীন্দ্রনাথের এইসব বাক্যের মধ্যে কেবল তো বিদ্যাসাগর একা ছিলেন না, ছিল এই সমগ্রত খর্বিত বঙ্গীয় সমাজ। তাই উপরের বাক্যগুলির ঠিক আগেই আসে আরও কয়েকটি অবিস্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বাক্য— বিদ্যাসাগর এক স্তব্ধ আহত মহীরুহের মতো একক বিশ্বাসে অবিচল দাঁড়িয়ে চারপাশের সমাজকে কীভাবে দেখেছেন, তিনি ‘প্রতিদিন দেখিয়াছেন— আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না, আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি, পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স, এবং নিজের বাক্‌চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।’ এত বড় অনুচ্ছেদও পুরোটা উদ্ধৃত না করে পারা গেল না। ভাষার জোর বা সৌন্দর্যের থেকেও অনেক বেশি জরুরি এখানে— বিদ্যাসাগরের চারপাশের সমাজের ছবিটি, এবং বিদ্যাসাগর সেই সমাজকে কীভাবে দেখেছেন, তার ইঙ্গিত। রবীন্দ্রনাথই বোধহয় প্রথম বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বাঙালি সমাজের এই সম্পূর্ণত বিরোধিতার ছবিটি এঁকে দিলেন। এই ‘সুগভীর ধিক্কার’-এর বোধটির জন্যই রবীন্দ্রনাথের কাছে বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব। ‘দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব,’ এবং তাই ‘বিদ্যাসাগরের চরিত্র বাঙালির জাতীয় জীবনে চিরদিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিবে।’যে জাতিগত প্রয়োজনের কথা আমরা অন্যান্য জীবনীর ক্ষেত্রে অনুমান করছিলাম, সেটাই রবীন্দ্রনাথের লেখার মধ্যে স্বচ্ছভাবে উঠে এল। তিনি বুঝিয়ে দিলেন কেন বাঙালি জাতির কাছে বিদ্যাসাগর প্রতিদিন স্মরণীয়। বললেন, ‘বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এই আধুনিকতার গৌরবকে স্বীকার করতে হবে।… তিনি আমাদের দেশে চলবার পথ প্রস্তুত করে গেছেন।’১০ পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদরা রবীন্দ্রনাথের দেখিয়ে-দেওয়া পথ ধরেই চলেছেন। অমলেশ ত্রিপাঠীর বইটি রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনাকে অনুসরণ করেছে, তাই ত্রিপাঠীর ভাষায় বিদ্যাসাগর হয়ে ওঠেন এক ‘লোনলি প্রমিথিউস’, যিনি ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের অনুশাসনের আগুনটি চুরি করে এনে আধুনিক মানবিকতার পবিত্র যজ্ঞ শুরু করছেন, কিংবা ‘দন কিহোতে ইন আ ধোতি’— একক সংস্কারক, যিনি হেঁটে চলেছেন অজানা বিরুদ্ধতা-পরিকীর্ণ পথ ধরে।১১

অমলেশ ত্রিপাঠীর উদাহরণটি বুঝিয়ে দেয়, কেমন ছিল জাতীয়তাবাদী বিদ্যাসাগর-ইতিহাসের ধরনটি। পুরনো হিন্দু সমাজকে সংস্কার করতে চাওয়ার প্রকল্পটি হয়ে দাঁড়ায় আধুনিকতার দিকে এগোনোর অবধারিত পথ, আর তার সূত্রে বিদ্যাসাগর হয়ে দাঁড়ান আমাদের আধুনিকতার প্রথম কান্ডারি। পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে প্রাচ্য বিশ্বের নতুন সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে, রেনেসাঁস ও এনলাইটেনমেন্ট-এর সঙ্গে যুক্ত করে মধ্য-উনিশ শতকের এই বিরাট মাপের চরিত্রটিকে দেখে, তাঁর মানবিকতা নামক গুণটিকে পাশ্চাত্য হিউম্যানিজ়ম-এর সঙ্গে কার্যকারণ-সূত্রে গাঁথতে চেষ্টা করেছিলেন এই ইতিহাসবিদরা। তবে এই জাতীয়তাবাদী ধারার বিদ্যাসাগর-ইতিহাসের একেবারে প্রথম উদাহরণটি কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘বিদ্যাসাগরচরিত’-এরই সমসাময়িক। সুবলচন্দ্র মিত্রের বিদ্যাসাগর-জীবনীটির যে ভূমিকাটি লিখেছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত, তার গোড়াতেই বলা হয়েছিল, কেন বিদ্যাসাগর সবসময়েই ভারতীয় ইতিহাসের একটি ‘ইউনিক’ স্থান অধিকার করে থাকবেন: কেননা রামমোহন রায় দেশের নতুন উচ্চাশার প্রথম প্রতিমূর্তি ছিলেন, আর বিদ্যাসাগর ছিলেন নতুন কর্মোদ্যোগের প্রতিনিধি। ‘English rule and English education had powerful and far-reaching influences which called forth new ideas and new efforts from the people. Ram Mohan Roy responded to these influences in the commencement of the century; Iswar Chandra, during the next thirty years.’১২ ছোট হলেও বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত ইতিহাসের খোঁজে এই ভূমিকাটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী ও আধুনিক সভ্যতাকাঙ্ক্ষী ভারতীয় দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগরের অবয়বটি বেশ স্পষ্ট ধরা পড়ে এতে, যে অবয়বের পূর্ণাঙ্গ রূপায়ণ তখনও ঘটেনি, এমনকী যে জীবনীগ্রন্থের ভূমিকায় এ কথা লেখা হচ্ছে, সেই জীবনীতেও নয়: ‘To assign to Vidyasagar his true place in history, to trace the influences which he himself created and left behind him, to delineate the true nature of his work and the endeavours of those who lived and worked around him—in one word to point out how the times called forth the man, and the man fulfilled the mission entrusted to him—all this requires a longer preparation and a work of larger proportions.’১৩

খেয়াল না করে থাকা মুশকিল যে, এই ভূমিকাটি শেষ হচ্ছে বিদ্যাসাগরের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের একটি ঘটনার উল্লেখ দিয়ে, যে ঘটনা আবার রবীন্দ্রনাথের ‘বিদ্যাসাগরচরিত’-এও উদ্ধৃত হয়েছে। দুঃস্থ কিশোর ঠাকুরদাস কলকাতায় ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণায় চলচ্ছক্তিরহিত হয়ে পড়ে একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘এক মধ্যবয়স্কা বিধবা নারী’ সেখানে বসে মুড়িমুড়কি বেচছিলেন। ঠাকুরদাসের মুখ দেখে তাঁর কষ্ট বুঝে, ‘এবং ব্রাহ্মণের ছেলেকে শুধু জল দেওয়া অবিধেয়, এই বিবেচনা করিয়া, কিছু মুড়কি ও জল দিলেন।… পরে তাঁহার মুখে সমস্ত অবগত হইয়া জিদ ধরিয়া বলিয়া দিলেন, যে দিন তোমার এরূপ ঘটিবেক, এখানে আসিয়া ফলার করিয়া যাইবে।’১৪ রবীন্দ্রনাথের লেখায় ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে বিদ্যাসাগরের পারিবারিক পরিস্থিতির ছবি আঁকতে গিয়ে। কিন্তু রমেশচন্দ্র দত্ত যখন সুবল মিত্রের বিদ্যাসাগর-জীবনীর ভূমিকা শেষ করছেন এই ঘটনা দিয়ে, তাঁর মন্তব্যটি হচ্ছে অন্যরকম: ‘There is a touch of true Hindu life in this simple story.’১৫ এই মন্তব্যই বলে দেয়, সেই দয়াবতী নারী, সেই ঠাকুরদাস এবং এই বিদ্যাসাগর— সবটা মিলিয়েই ভূমিকালেখক যেন একটি জাতীয়তাবাদী সমাজ-ছবির সন্ধান করছেন, ‘আ ট্রু হিন্দু লাইফ’-এর ছবি। এই ছবি তৈরির জন্যই এত জরুরি, এত ‘ইউনিক’ হয়ে উঠছে বিদ্যাসাগরের মতো তেজস্বী পুরুষের জীবনকাহিনি। ব্রায়ান হ্যাচার সম্ভবত এদিকেই নির্দেশ করতে চেয়েছিলেন তাঁর বিদ্যাসাগর-বিষয়ক বইটিতে: ‘It isn’t only that the life inheres in the narration but that the narration itself gives voice to a range of fundamental values—reason, integrity, manliness, tradition, progress, modernity and national integrity—whose real application lies not in the life of the subject but in the promise of the nation.’১৬

জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের কিছু পরে, প্রায় পাশাপাশি, প্রবাহিত হতে হতে আরও একটি ইতিহাস-ধারা বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য উনিশ শতকীয় সংস্কারককে একটা ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করে। মার্কসবাদী এই ধারার চোখে ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের অনেকটাই দমনাত্মক, ফলত সংকটজনক। ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজে রেনেসাঁস নবযুগ আনার নাম করে এই ধারা আসলে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির অত্যাচার ও শোষণ চালিয়ে যেতে চায়, এবং তার জন্য উপযুক্ত এক সহযোগী গোষ্ঠী তৈরি করে। এই গোষ্ঠীর হাতেই ঘটে নানাবিধ সমাজ-সংস্কার, যা স্বাভাবিক শ্রেণিগত সীমবদ্ধতার কারণেই অর্ধমনস্ক এবং অসম্পূর্ণতায় মণ্ডিত থাকতে বাধ্য হয়। বুঝতে অসুবিধে হয় না, বিদ্যাসাগরের সামাজিক কর্মযজ্ঞ এই ইতিহাস-ধারায় কীভাবে প্রতিফলিত হতে পারে। কেন তাঁর সংস্কার বাধা পেতে পেতে এগিয়েছিল, কেন তা পূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, কেন তিনি সর্বত সামাজিক পরিবর্তনের স্বপ্ন পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি— এই সব কিছুই শ্রেণিস্বার্থ ও শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সহজ হয়ে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে পারি, গোপাল হালদারের বইটি থেকে কিছু অংশ: ‘বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন ইংরেজ রাজপুরুষেরা জনশিক্ষা বিস্তারে আগ্রহহীন; বোঝেননি এটাই শাসক-স্বার্থ। তিনি দেখেছিলেন বাঙালীদের বাংলা স্কুল সম্বন্ধে ঔদাসীন্য; বোঝেননি তাই মধ্যবিত্তদের স্বার্থ। সাধারণ মানুষ বাংলায় লেখাপড়া শিখলে তাদের কী লাভ? চাকরি তো বাংলানবিশরা পাবে না, পাবে ইংরেজিওয়ালারা।’১৭ ‘১৭৯৩-এর ব্যবস্থায় অধিকারহীন প্রজাদের যে কী দুর্দশা, তা বীরসিংহের ঠাকুরদাসের পুত্রের পক্ষে না জানার কথা নয়।’১৮ ‘সেই সময়েরও পূর্ব থেকে বিদ্যাসাগরের সুহৃদ অক্ষয়কুমার দত্ত প্রজার সপক্ষে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রবন্ধ রচনা করেছেন বিদ্যাসাগর তা অন্তত নিশ্চয়ই দেখেছেন, অক্ষয়কুমারের সঙ্গে তাঁর আলোচনাও হয়েছে নিঃসন্দেহ।’১৯ গোপাল হালদার উল্লেখ করেছেন, ওই সময়েই ‘প্যারীচাঁদ মিত্র ও কিশোরীচাঁদ মিত্র ইংরেজিতে পরিষ্কার ভাবে জমিদারিপ্রথার সমালোচনা করছিলেন। কিশোরীচাঁদ বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারের সপক্ষ। এঁদের মতামতও বিদ্যাসাগরের জানার কথা।’২০ নীলবিদ্রোহ ও তার পরবর্তী বাংলার বহু জেলায় প্রজা-অসন্তোষ ইত্যাদি নিয়েও বিদ্যাসাগর মাথা ঘামাননি, যদিও বঙ্কিমচন্দ্র ঘামিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ, বহুবিবাহ ও শিক্ষাবিস্তারের বাইরে অগ্রসর হলেন না। সুতরাং, ‘মানতেই হবে, বিদ্যাসাগর ভারতীয় সমাজের যা মূল দাবি তা মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতে পারেননি, সেদিকে উদ্যোগ দেখাননি।’২১ তাই যদিও গোপাল হালদারের বিদ্যাসাগর সেই রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগরের মতোই ‘একক’ ও ‘নিঃসঙ্গ’, ‘নবজাগরণের ভদ্রসমাজে খাপছাড়া’, ‘আত্মস্বাতন্ত্র্যে একক, আত্মপ্রত্যয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আত্মমর্যাদায় অনমনীয়,’২২ তবু শেষপর্যন্ত গোপাল হালদার তাঁকে দেখবেন ‘শিক্ষিত মধ্যবিত্তের যুগের পুরোধারূপে’, আর তাই তিনি ‘বঞ্চিত জনসমাজকে আশ্রয় করে ভারতীয় সমাজের ঐতিহাসিক নিয়তিকে সংগ্রামী রূপ দান করতে উদ্যোগী হতে পারেননি।’২৩

বিনয় ঘোষের বইটিকে এই ধারার মধ্যে রেখেও একটু আলাদা করে আলোচনা করা দরকার। বিদ্যাসাগরকে ‘নবজাগরণের অগ্রপথিক’ কিংবা ‘মধ্যবিত্ত আধুনিকতার ভ্রান্ত পথিক’, এই দুয়ের কোনওভাবেই যে ব্যাখ্যা করা কঠিন হতে পারে, তার একটা ছাপ পাওয়া গেল বিনয় ঘোষের গবেষণাসমৃদ্ধ আলোচনার মধ্যে। যদিও তিনি ‘নবজাগরণ’ কিংবা ‘সামাজিক পুনরুজ্জীবন’-এর মতো শব্দকে বড্ড বেশি সরলভাবে গ্রহণ করেই আলোচনা করেছেন, এবং মার্কসবাদী ইতিহাস-ধারার নিজস্ব ধরনে বিদ্যাসাগরের ‘শ্রেণীবদ্ধতা, ব্যর্থতা’ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন, তবু বেশ কিছু জরুরি বক্তব্যের সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে দাঁড়িয়েও কেন তিনি একক, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন, এবং স্বীকার করেছেন যে তাঁর ‘মৌলসত্তার গুণটি তাঁর সমাজসত্তাকে অবশ্যই অনেকখানি প্রভাবিত করেছে,’২৪ অর্থাৎ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও চারিত্রবৈশিষ্ট্য দিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্যাসাগর তাঁর সামাজিক সত্তা বা শ্রেণিগত আইডেন্টিটির সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠেছেন। লক্ষণীয় যে, বিদ্যাসাগরের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে বারবার বিনয় ঘোষ তাঁর চারিত্রিক গুণাবলির— ‘জেদ’ ও ‘একগুঁয়েমি’— কথা বলেছেন, বলেছেন বিদ্যাসাগরের পক্ষে তাই ‘ধীরেসুস্থে কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অথবা দীর্ঘকাল কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা সম্ভব হয়নি।’২৫ কেবল তাঁর ব্যর্থতা নয়, তাঁর সাফল্যের কারণটিও সম্পূর্ণত ব্যক্তিচরিত্রগত, বলছেন এই মার্কসীয় গবেষক। তাঁর মতে, ‘ধনতন্ত্রের ঊষাকাল’ বলেই তা সম্ভব হয়েছিল, ইতিহাসের ‘সন্ধিক্ষণ’ বলেই রবীন্দ্রনাথ-বর্ণিত ‘বনস্পতি’র মতো এই ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্ভব হয়েছিল— আজ গণতন্ত্রের মধ্যাহ্নকালে, সচেতন জনসমাজে, ওইরকম ‘ব্যক্তি-বনস্পতি’র বিকাশ আর বোধহয় সম্ভব নয়। ক্ল্যাসিকাল সমাজতত্ত্ববিদ কার্ল মানহেইম-এর ফ্রিডম, পাওয়ার অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটিক প্ল্যানিং বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন বিনয় ঘোষ তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে— ‘In our democracies we are in the process of moving from a high degree of individualism toward development of democratic personality.’২৬ এইসব বিবেচনা করে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের তীক্ষ্ণ মন্তব্যটির সঙ্গে একমত হতেই ইচ্ছে করে: বিনয় ঘোষের ‘ঘোলা সমাজতত্ত্ব, শ্রেণিগত ব্যর্থতা ইত্যাদি অবান্তর বিশ্লেষণ বাদ দিলে বইটি এখনও প্রথম প্রজন্মের জিজ্ঞাসুর বেশ কাজে লাগে।’২৭

বিদ্যাসাগরের মধ্যে ‘সংগ্রামী রূপ’-এর এই ব্যর্থ সন্ধানই বলে দেয়— ষাটের দশকের শেষদিকে ভারতীয় ইতিহাস রচনার এই ধারাটি কীভাবে ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণকে এক বিভ্রান্তিজনক ঘটনা হিসেবে দেখতে শুরু করে। মাওবাদী ঘরানার এই রাজনৈতিক পাঠের ফলে রামমোহন আর বিদ্যাসাগরের মতো চরিত্র ক্রমে হয়ে দাঁড়ান ‘কমপ্রাডোর বুর্জোয়া’ চরিত্র, যাঁরা আসলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘কোলাবরেটর’ কিংবা সহকারী ভূমিকাই পালন করে গিয়েছেন, কোনও সত্যিকারের সামাজিক বিপ্লবের পুরোধা হতে পারেননি। এই ইতিহাসের ধাক্কা সজোরে এসে লাগে কলকাতার গায়ে ১৯৭০-এর জুন মাসের এক সকালে, যখন খবর পাওয়া যায় যে কলেজ স্কোয়্যারে ১৮৯৯ সালের বিদ্যাসাগরের মার্বল মূর্তিটি ছিন্নমস্তক অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে! রণজিৎ গুহ পরে এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন— এই একটি ঘটনার ফলে নকশাল বিপ্লবীরা বাঙালি সমাজের চোখে অনেকখানি ঘৃণিত হয়েছিল, তবে একটি কথা সম্ভবত তারা সেদিন বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিল যে, ‘tradition would not pass unchallenged.’২৮ যাকে ‘নবজাগরণ’ বলে মেনে নেওয়া হয়ে এসেছে এতদিন, তাকে যে পুরনো মার্কসবাদী প্রবণতা অনুযায়ী একেবারে ত্যাগ না করলেও আবার নতুন করে ফিরে দেখতে হবে, সেই প্রয়োজন হয়তো নতুন করে অনুভূত হল এইসব ঘটনার অভিঘাতে।

আর তাই, মার্কসবাদী তত্ত্বকে একেবারে যান্ত্রিকভাবে না দেখে লিবারালিজ়মের আলোয় তাকে সংশোধন করে শুরু হল নব-বামবাদী ইতিহাসের নতুন ঘরানা। এর মধ্য থেকে এবার বেরিয়ে এল বিদ্যাসাগর বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা, যা কেবল বিদ্যাসাগর কেন, বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসকেই নতুন আলোয় বিচার করতে উদ্বুদ্ধ করল। সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার তাঁর চল্লিশ বছরের ইতিহাস লেখার অভিজ্ঞতার আলোচনা করতে গিয়ে এই সময়ের কথা স্মরণ করেছেন। বলেছেন যে, উনিশশো সত্তরের দশকে যাঁরা ইতিহাস লিখছিলেন, তাঁদের অনেকের মধ্যেই তখন বিরাট দ্বন্দ্ব— একদিকে রেনেসাঁস-উত্তরাধিকার জাত এক ধরনের ব্রাহ্ম মূল্যবোধ, আর অন্যদিকে বাম মতাদর্শ— আর সেই দ্বন্দ্ব পরিস্ফুট হচ্ছে ইতিহাসের পাঠে। তিনি নিজে সেই সময়ে রামমোহন রায়ের উপর বেশ সমালোচনামূলক একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন: কেন রামমোহন জাতভেদ দূর করতে আরও গভীর সামাজিক সংস্কারের কথা ভাবেননি।২৯ পরে তিনি এই প্রবন্ধের অবস্থান থেকে একটু সরে আসতে চেয়েছেন বলে তাঁর প্রবন্ধসংকলনে রাখতেও চাননি এটিকে। সুমিত সরকারের এই সমালোচনাধৌত আত্মবীক্ষণে যে সময়কার কথা আমরা জানতে পারছি, ঠিক সেই সময়েই লেখা হল বিদ্যাসাগর বিষয়ে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বই, অশোক সেনের এলিউসিভ মাইলস্টোনস।

বিদ্যাসাগর-ইতিহাসে এই বইয়ের অবদান বেশ মৌলিক। সংশোধিত মার্কসবাদী ইতিহাসের দিক থেকে তিনি ফিরে দেখেন বিদ্যাসাগরের কাজ ও ভাবনা, এবং সময়কাল-আরোপিত বিদ্যাসাগরের সীমাবদ্ধতাকে। সরাসরি গ্রামশ্চিয়ান মডেলের ‘প্যাসিভ রেভলিউশন’-এর তত্ত্বের সাহায্যে অশোক সেন ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির প্রভাবে ভারতের ধনতন্ত্র একটি অর্ধ-আরব্ধ প্রক্রিয়া হয়েই থেকে যায়, আর ফলত এখানকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিও কোনওভাবে তাদের যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করে উঠতে পারে না। ‘The order of things somewhat instrumental in introducing the opportunities for spreading reason, was a veritable drag on reasonable social advance. This antinomy betokens a deceptive nature of our modernization.’৩০ এই কারণেই বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের সামাজিক সংস্কার সমর্থন করার জন্য উপযুক্ত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পায়নি, এবং এই কারণেই বিদ্যাসাগরের মতো অমিতক্ষম সংস্কারকের প্রয়াসও তাঁর নিজের সমাজকে যথেষ্ট পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। অর্থাৎ উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত সমাজের শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়েও আগেকার মার্কসবাদী ইতিহাসে রামমোহন রায় বা বিদ্যাসাগরের যে ‘কমপ্রাডোর’ অভিধা জুটেছিল, তার থেকে অশোক সেন এঁদের বার করে আনতে পারলেন। ‘He could acknowledge the special gifts and initiatives of these individuals while examining critically if the classes they represented had the capacity to advance the economy in a productive direction that could usher in long-term and progressive changes.’৩১ অশোক সেনের মতে, বিদ্যাসাগর হলেন আমাদের ‘ফার্স্ট মডার্ন’দের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। তাঁর বিষয়ে আলোচনা করতে বসে আমাদের মনে রাখতেই হবে কীভাবে তাঁর সমসময়ের সমাজ একটা ঐতিহাসিক ব্যর্থতার (‘হিস্টোরিক ফেলিয়োর’) মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল— তিনি সেই বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির পুরোধা— যে শ্রেণির উন্নয়নের ধরনটি যে কেবল উনিশ শতকের পক্ষে আত্মপরাভবী ছিল, তা-ই নয়, ইতিহাস প্রমাণ যে, পরের শতকের জন্যও তা আদ্যন্ত ব্যর্থতাময় হয়ে উঠেছিল।

কেবল এইটুকুই নয়। ঔপনিবেশিক সমাজের আধুনিকতা ও অর্থনীতির নিজস্ব সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত বিদ্যাসাগরের জীবন কিন্তু অশোক সেনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কয়েকটি বিশিষ্ট অবদান রেখে যায়— যা আমাদের কাছে এখনও দৃষ্টান্তস্বরূপ হতে পারে। এমন একটা সময়ে তাঁর জন্ম হয়েছিল যে দেশের রাজনৈতিক শাসনের ক্ষেত্রে নিজের মত প্রকাশের কোনও জায়গাই তখন ছিল না, ছিল কেবল একটিই আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। সামাজিক দায়িত্বের পারাবারে, মানবিক আত্মোৎসর্গের লক্ষ্যে ব্যক্তিগত জীবনকে ডুবিয়ে দেওয়া: ‘he remains our earliest proponent of individual consciousness immersed in social responsibility and humanitarian commitments.’ সামূহিক জীবনের উন্নতিতেই এইভাবে ব্যক্তিগত জীবনের চরিতার্থতা খোঁজা, রামমোহন সেদিকে প্রথম পা ফেললেও বিদ্যাসাগরকেই বলা যায় এই মূল্যবোধের চরমতম উদাহরণ। এইভাবে অনন্ত সামাজিক কাজের মধ্যে প্রতিনিয়ত বাঁচার অন্য কোনও উদাহরণ ওই সময়ের ভারতে দেখা যায়নি, পরবর্তী কালেও খুব কমই দেখা গিয়েছে। এ কেবল দয়া নয়, উদারতা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। একটা বৃহত্তর আদর্শ, একটা মহত্তর যাপন। সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিত ও শোষিত মানুষটির পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর অভীপ্সা। অশোক সেন একটা উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত টানেন এরপর— বিশ-একুশ শতকে ‘সিভিল সোসাইটি’ আন্দোলন বলতে আমরা যা বুঝেছি, বিদ্যাসাগরই তার সম্ভবত প্রথম রূপকার: ‘This is where civil society movements, their initiative and combined education, cultural and dialogical effects can produce a positive impact on the people who are to make the best of their informal patterns of economic existence, helping them to perceive a renewal of their position and work attitude.’৩২

লক্ষণীয়, এমন ভাবনার কাছাকাছি অবশ্য আমরা আগেও এসেছি, বিনয় ঘোষের বিদ্যাসাগর বই পড়তে পড়তে। এতটা তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি দেখেননি, কিন্তু একই দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, বিদ্যাসাগরের আন্দোলনকে ‘বাংলাদেশের প্রকৃত সামাজিক গণ-আন্দোলনের প্রাথমিক প্রকাশ বলা যায়। ১৮৫৫ সালের ৪ অক্টোবর বিদ্যাসাগর যে আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠিয়েছিলেন, বিধবাবিবাহ আইন প্রবর্তনের জন্য, তাতে বহু ব্যক্তির স্বাক্ষর ছিল।… আমার মনে হয়, আমাদের দেশের সামাজিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে স্বাক্ষরসহ এই আবেদনপত্রখানি অমূল্য দলিল।’ ওই আবেদনপত্রে ৯৮৭ জনের স্বাক্ষর ছিল, শেষ স্বাক্ষরটি বিদ্যাসাগরের। ‘বর্তমান কালে যাঁরা signature campaign করেন তাঁরা এই গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কৌশল ও তার গুরুত্ব নিশ্চয় জানেন’— বিনয় ঘোষের মন্তব্য। খুবই গুরুতর এই মন্তব্য— সাধারণত বিদ্যাসাগরের কর্মকাণ্ড বলতে আমরা যা বুঝি, তাতে এই বিষয়টির কথা পড়ি না। তবে বিদ্যাসাগর-অনুসন্ধানীদের মনে রাখতেই হবে, বিদ্যাসাগরের কাজ অনেক অর্থেই তাঁর একক কাজ হলেও সামাজিক আন্দোলনের একটি আরম্ভের মুহূর্ত হিসেবেও তাকে ফিরে দেখা দরকার।

সংশোধিত মার্কসবাদের পর বলতে হয় সাবঅল্টার্ন গোষ্ঠীর ইতিহাসের কথা। এই ইতিহাসে কিন্তু বিদ্যাসাগরের মতো সমাজ-সংস্কারকদের বিশেষ জায়গা হয়নি, কেননা এই ইতিহাসে ঔপনিবেশিক আধুনিকতা যে ভুল আধুনিকতা, তা প্রমাণের জন্য ধনতন্ত্রের অর্থনৈতিক আলোচনা থেকে নজর সরে গিয়েছিল ‘আধুনিকতা’র মতো নবজাগরণ-পরবর্তী সমাজের জ্ঞানচর্চা ও সমাজচর্চার দিকে। উনিশ শতকের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংস্কারক ও নেতারা এই ব্যাখ্যায় সবাই মোটের উপর এক দলভুক্ত হয়ে যান, যাকে বলা যেতে পারে ‘হোমোজেনাইজ়ড’, এবং তাঁদের সকলেরই মতাদর্শ কিংবা চিন্তাভাবনাকে ধরে নেওয়া হয় পাশ্চাত্য আধুনিকতার নকলনবিশি। এই বিদ্যাচর্চায় অবশ্য বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বেশি আলোচনা হয়নি, কেবলমাত্র শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইটিতে ছাড়া, গোপাল-রাখাল দ্বন্দ্বের মধ্যে তিনি ঔপনিবেশিক আধুনিকতার সংকটকে তুলে ধরেছিলেন।৩৩

বরং সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ় যখন খ্যাতি ও বিস্তৃতির মধ্যগগনে, আর তার পাশাপাশি খানিক ম্লান হয়ে বয়ে চলেছে অন্য ধারার গবেষণা, সেই অন্য পরিসর থেকেই উঠে আসে বিদ্যাসাগর বিষয়ক দু’টি জোরদার গবেষণা, যে দু’টিতে তাঁর সম্পর্কে একটা নিরপেক্ষ প্রেক্ষাপট রাখার সযত্ন প্রয়াস দেখা যায়: বলেছেন সুমিত সরকার। ব্রায়ান হ্যাচার বিদ্যাসাগরের লেখা এবং কাজ দুয়ের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন, কেন তাঁকে যুগসন্ধিক্ষণের মানুষ বলা চলে— কেননা তাঁর মধ্যে ঘটেছিল ‘… bourgeois and Brahmanical educational ideologies within a Bengali idiom of moral pedagogy.’৩৪ বাস্তবিক, ভেবে অবাক লাগতে পারে, বুর্জোয়া আধুনিকতা ও ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রের এই যে সঙ্গম, তার যে একটা বিরাট সদর্থক ক্ষমতার দিকও ছিল, কেবল সীমাবদ্ধতা দিয়েই তাকে বিচার করাটা ভুল হয়ে যায়— তাত্ত্বিক ইতিহাসবিদদের কাছ থেকে এই কথাটা কত কম শোনা গিয়েছে— সুশোভন সরকারের বাংলার নবজাগরণ বিষয়ক আলোচনার কথা যদি বাদ রাখি। তত্ত্বের থেকে বেরিয়ে গিয়ে ‘টেক্সচুয়াল’ বিশ্লেষণে মন দিলেন বলেই হয়তো হ্যাচার এই কথা অনেক সহজে ও প্রত্যয়ে বলতে পারলেন। তাঁর ‘কালচারাল এনকাউন্টার’-এর আলোচনাকে পূর্ণাঙ্গ বলা না গেলেও তাতে বিদ্যাসাগর-গবেষণার সমৃদ্ধি বাড়ল বই কমল না। এই গবেষণারই পূর্ণতর রূপ আমরা পেলাম তাঁর পরবর্তী দু’টি বইতে।৩৫

শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় দেখালেন, বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের সংস্কারটি ও অন্যান্য সংস্কারের ‘ব্যর্থতা’কে কেন সংস্কারকদের সামাজিক প্রেক্ষাপটের গঠনগত দুর্বলতা (structural weaknesses of the reformist effort) দিয়ে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। এভাবে সংস্কারের দুর্বলতা দিয়ে বিষয়টি বুঝতে গেলে ভারতীয় ও বাঙালি সমাজে যে ঐতিহ্য-নির্ভর সমাজের শিকড় কতখানি শক্ত ছিল, এই সংস্কার-প্রয়াসগুলির বিরুদ্ধতা যে কত প্রবল ছিল, সেটা আমরা ভুলে যেতে পারি। নারীর উপর নিয়ন্ত্রণ, এবং জাতব্যবস্থা— এই দুইয়ের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজ তার পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীলতা দৃঢ় রাখত, সুতরাং বিদ্যাসাগরের সংস্কারের পক্ষে তার প্রাচীর ভেদ করা ছিল কঠিন কাজ, কিন্তু তাতে ফাটল যে তিনি ধরাতে পেরেছিলেন, সেটার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেন যে, বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে বাধা কেবল উচ্চ জাত থেকেই আসেনি, নিম্ন জাতেও তা যথেষ্ট বিরোধিতা তৈরি করেছিল।৩৬

সুমিত সরকারের যে সাম্প্রতিক প্রবন্ধটির কথা আগে উল্লেখ করেছি, তাকে এই নতুন সামাজিক বিশ্লেষণেরই পরবর্তী ধাপ বলে মনে করা যায়, কেননা, তাঁর নিজেরই ভাষায়, ‘The Brahmanical focus in both Hatcher and Bandyopadhyay, I feel, needs to be sharpened through a more layered, non-homogenized view of the high-caste literati world that would also give due regard to many changes within it in the course of the nineteenth century.’ বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত জীবনের কথা পড়লে যেমন আমরা এক একক ও অ-সাধারণ ব্যক্তিত্বের কথা জানতে পারি, তেমনই অন্যদিক দিয়ে তিনি এক বড় ও সাধারণ সামাজিক ধারার প্রতিনিধি ছিলেন— ঔপনিবেশিক সমাজের নিজস্ব পালাবদলের মধ্যে যে উচ্চবর্ণের শিক্ষিত মানুষরা গ্রাম ছেড়ে শহরের নতুন জীবনে প্রবেশ করছিলেন, তাঁদের প্রতিনিধি।

এবার তা হলে, যে প্রশ্ন দিয়ে আমাদের এই আলোচনা শুরু হয়েছিল, সুমিত সরকারের অনুসরণে সেখানে ফিরে গিয়ে আমরা বলতে পারি যে, বিদ্যাসাগর নিয়ে এত বেশি লেখালেখির কারণটিও লুকিয়ে আছে এই পরিবর্তনশীল সামাজিক ধাঁচটার মধ্যে। এই কারণেই বিদ্যাসাগরের জীবনের যেসব কাহিনির মধ্যে তাঁর তীব্র আত্মমর্যাদা, কিংবা তাঁর অকৃত্রিম সহজ সাধারণ বাঙালিয়ানা, কিংবা তাঁর স্ব-আরোপিত শৃঙ্খলা এবং আত্মত্যাগের প্রকাশ— সেগুলি বাঙালি জীবনীকারদের তখনও টানত, এখনকার লেখা জীবনীগুলিতেও তা গুরুত্বপূর্ণ।৩৭ সুমিত সরকার এই কারণেই বলেছেন যে, ‘Anecdotes are particularly revealing of the patterns of selectivity and emphasis at work in constituting memories about Vidyasagar.’৩৮ তাঁর যুক্তি, এই কারণেই এমনকী রক্ষণশীল মানুষরাও বিদ্যাসাগরকে নিয়ে কথা বলতে, তাঁর বিষয়ে লিখতে আকৃষ্ট হতেন, বারবার তাঁর পারিবারিক সাধারণত্ব বা দারিদ্র্যের উপর জোর দিতেন। মনে রাখা ভাল, যেখানে সাধারণত নিজের কথা লিখতে বসে লেখকরা নিজের পারিবারিক বিশিষ্টতার কথাই লিখতে চান, সেখানে বিদ্যাসাগরের অসম্পূর্ণ আত্মজীবনীও কিন্তু এককথায় অ-সাধারণ— তিনি নিজের পরিবারের দারিদ্র্যক্লিষ্ট সাধারণত্বের কথাই তাতে বলেছেন।

ইতিহাসের সংশোধনার্থে, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা আমরা সুমিত সরকারের প্রবন্ধটি থেকে বুঝে নেব। প্রথমত, বিধবাবিবাহ সংস্কার প্রচার ও প্রসারে ব্যর্থ হলেও তা কিন্তু কেবল শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। রামজীবনপুর, কিরপাই, চন্দ্রকোনা, বাসুলির মতো বেশ কিছু ছোট গ্রামেও তা ঘটেছিল। শম্ভুচন্দ্রের বইয়ের উপর নির্ভর করে ইন্দ্রমিত্র এই কথা জানিয়েছেন (বস্তুত, বিদ্যাসাগর বিষয়ে সবচেয়ে বেশি তথ্য ও কাহিনি তিনিই জোগাড় করে এনেছেন তাঁর অসাধারণ জীবনীগ্রন্থটিতে)। জানিয়েছেন, ব্রাহ্মণদের সঙ্গে কায়স্থ, তন্তুবায়, বৈদ্য, তেলিদের মধ্যেও তা ঘটে। তবে কিনা, এসবের পরও একটা কথা থেকে যায়। বিধবাবিবাহের কতটা প্রসার ও সাফল্য হয়েছিল ইত্যাদি খুঁটিনাটির সঙ্গে এও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই সংস্কারের আসল সাফল্যটা কিন্তু একেবারে অন্য জায়গায়। বিধবাবিবাহ তো কেবল একটা ছুটকো অনুষ্ঠান নয়, মেয়েদের জন্য একটা পুরোদস্তুর ‘অন্য’ জীবনের সন্ধান— সেই জীবন যা কেবল পুনর্বিবাহিত মেয়েটিকে সমাজে মেয়ে করেই রাখে না, পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি হয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়, কেননা এমন একটি সৃষ্টিছাড়া পদক্ষেপের পর তার সমাজে বিচরণের ধরনটাই পালটে যেতে বাধ্য। সুমিত সরকারের ভাষায়—‘… widow marriage meant, above all, young men, and girls growing up into young women, entering into a domesticity that flouted traditions, in the face of an enormous amount of everyday petty slander, persecution, ostracism.’৩৯

দ্বিতীয়ত, বিধবাবিবাহ সংখ্যায় খুবই কম ঘটেছিল, ইতিহাসবিদের কাছে বোধহয় এটাও শেষপর্যন্ত কোনও গুরুতর বিষয় হওয়া উচিত নয়। কেননা, উনিশ ও বিশ শতকের বাংলার ইতিহাস ঘাঁটছেন যিনি, তিনি নিশ্চয় জানবেন, এই সংস্কারের প্রধান মূল্য অন্যত্র। বিধবাবিবাহ প্রচলনের আইন পাশ হওয়ার ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে, সমাজের এই ধরনের অবিচারময় অন্যায় প্রথাগুলোর আইনি মোকাবিলা সম্ভব, এমনকী বিলুপ্তিও সম্ভব। অর্থাৎ যাকে আমরা আধুনিক আলোচনায় বলব ‘জেন্ডার নর্মস’, সুমিত সরকার বলেছেন যে সেগুলি দিয়ে বিচার করলে আমরা বুঝতে পারি, কত বড় পরিবর্তন সেদিন ঘটে গিয়েছিল: ‘… the legal reform he was able to push through, and even more the debates he provoked, did unsettle grossly unjust gender norms that had been part of a doxa of common sense, immune from rational debate and questioning.’৪০ এইজন্যই, বাল্যবিবাহ বা বহুবিবাহ এরপর বন্ধ না হলেও এগুলিকে ঠিক ‘আদর্শ’ বলে বিবেচনা করার ধারাটাও কমে এল। সুমিত সরকারের মতে, স্ত্রী-কে ‘অর্ধাঙ্গিনী’ ঘোষণা করে মেয়েদের শরীর, যৌনতা ও জীবনের উপর যে দাবিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তার প্রতিই একটা বিরাট কিন্তু প্রচ্ছন্ন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় বিদ্যাসাগরের এই সংস্কার। যে মনোভাব থেকে বিদ্যাসাগর তাঁর চারপাশের সমাজকে পালটাতে গিয়ে এত প্রবল রকম বাধা পেয়েছিলেন, সেই মনোভাবটা কী রকমের, সে বিষয়েও সুমিত সরকারই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে অন্তর্দৃষ্টিময় সূত্রটি দিয়েছেন— এ কোনও সাধারণ দয়া নয়, মহানুভবতা নয়, পরোপকার নয়, এর মধ্যে আছে সমবেদনা (compassion), আর তার সঙ্গে আছে তীব্র রাগ (deep anger) এবং পুরুষ হিসেবে একটা গভীর অপরাধবোধ (male guilt)। এইখানেই তাঁর সংস্কার পরবর্তী আর্যসমাজীয় সংস্কারের থেকে আলাদা। ‘We cannot afford to lose touch with Vidyasagar’s anger and guilt, directed primarily towards gender relations in his own society.’৪১

এইখানে পৌঁছে আমরা একটা খুব দরকারি চাবি পেলাম, যে চাবি দিয়ে খুলে যায় বিদ্যাসাগর ও তাঁর সময়কে বোঝার অনেকগুলো দরজা। সমবেদনার পাশাপাশি, ‘রাগ’ ও ‘অপরাধবোধ’ সেই চাবি।৪২ এই দুই মনোভাব থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণেই হয়তো নিকট ও দূর অতীতে বিদ্যাসাগর তাঁর ইতিহাসে পুরোপুরি ধরা দেননি। তাঁর বহু-আলোচিত ‘ব্যর্থতা’ ঠিক কতটা ব্যর্থতা, সেটা উপলব্ধি করতেই ভুল ঘটে গিয়েছে। তাই সাফল্য ও ব্যর্থতার খামোখা দ্বৈততা, এবং সেই দ্বৈততার মাপকাঠিতে ঘুরন্ত বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে সুমিত সরকারের প্রবন্ধটি অনেকখানি আলো ফেলতে পারে বিদ্যাসাগরের নানারকম পারা ও না-পারার উপর।

শেষ করা যাক বিদ্যাসাগরের উপরে বিভিন্ন প্রবন্ধের একটি ছোট সংকলনগ্রন্থের উল্লেখ দিয়ে, যাতে রাগতভাবে, কিন্তু স্পষ্ট ও যুক্তিনিষ্ঠ-ভাবে কিছু কথা বলা হয়েছে।৪৩ সেই বইয়ে একটি অনবদ্য উপমা পড়তে পাই আমরা। গ্রিক পুরাণকথায় প্রোক্রাস্টেস ছিল ডাকাত, রাস্তার ধারে থাকত, রাত্রিবাসের জন্য যাত্রীদের খাতির করে এনে শুতে দিত একটা খাটে, তারপর যাত্রী যদি খাটের চেয়ে লম্বা হত তবে পা থেকে ছেঁটে তাকে মাপমতো করে নিত, আর বেঁটে হলে তাকে টেনে খাটের সমান লম্বা করে দিত— আর তাই মনে হয়, বিদ্যাসাগর বিষয়ে ‘যত লোক তাঁর সম্বন্ধে লিখেছেন তাঁদের অনেকেরই এর’ম খাট ছিল ও আছে।’৪৪

উপমাটির অনুসরণে, সুমিত সরকারের সঙ্গে মত মিলিয়ে, আমরা বরং এই কথা দিয়েই শেষ করি, বিদ্যাসাগরকে তাঁর সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার অনেক পথ ও পদ্ধতি ইতিহাস-চর্চার অঙ্গনে দেখা গেল। কিন্তু তাঁকে ছেঁটেকেটে নেওয়ার ধরনটা বোধহয় সবসময় খুব সংগত হয়নি।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

. শিবনাথ শাস্ত্রী, প্রবন্ধাবলি, প্রথম খণ্ড, কলকাতা, ১৯০৪।

. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বিদ্যাসাগর’, বিদ্যাসাগরচরিত (কলকাতা: বিশ্বভারতী), পৃ. ৫৫।

. তদেব।

. Brian A. Hatcher, Vidyasagar: The Life and After-life of an Eminent Indian (New Delhi : Routledge, 2014)

. Sumit Sarkar, ‘Vidyasagar and Brahmanical Society’, Essays of a Lifetime: Reformers, Nationalists, Subalterns (New Delhi: Permanent Black, 2018), p. 243.

. তদেব, পৃ. ২৫৮।

. তদেব, পৃ. ২৫৯।

. বিদ্যাসাগরচরিত, পৃ. ৫১।

. তদেব, পৃ. ৫২।

১০. তদেব, পৃ. ৭৪।

১১. Amales Tripathi, Vidyasagar: The Traditional Moderniser (New Delhi: Orient Longman), pp. 74, 64. প্রসঙ্গত, বিদ্যাসাগরের বিষয়ে ‘দন কিহোতে’র তুলনা প্রথমবার ব্যবহার করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘বহুবিবাহ’, বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড (কলকাতা: সাহিত্য সংসদ), পৃ. ৩১৫।

১২. Romesh Chunder Dutt, ‘Introduction’ in Subal Chandra Mitra, Isvar Chandra Vidyasagar: A Story of his Life and Work (First Published 1902; New Delhi: Rupa, 2018), p. ix.

১৩. Ibid., p. xvii.

১৪. বিদ্যাসাগরচরিত, পৃ. ২১।

১৫. Romesh Chunder Dutt, ‘Introduction’, Iswar Chandra Vidyasagar: A Story of his Life and Work, p. xviii.

১৬. Brian A. Hatcher, Vidyasagar: The Life and After-life of an Eminent Indian, p. 18.

১৭. গোপাল হালদার, প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর (কলকাতা: অরুণা, ১৯৯১), পৃ. ২।

১৮. তদেব, পৃ. ৬০।

১৯. তদেব, পৃ. ৬১।

২০. তদেব, পৃ. ৬১।

২১. তদেব, পৃ. ৬১।

২২. তদেব, পৃ. ৯০।

২৩. তদেব, পৃ. ৯২।

২৪. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ (প্রথম প্রকাশ ১৯৫৭; কলকাতা: ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ২০১১), পৃ. ৪৩৫।

২৫. তদেব, পৃ. ৪৩৮।

২৬. তদেব, পৃ. ৪৪৪।

২৭. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, ‘বিনয় ঘোষের বিদ্যাসাগর-চর্চা: ফিরে দেখা’, নির্বাচিত প্রবন্ধ (কলকাতা: অনুষ্টুপ, ২০১৯), পৃ. ২৯৪।

২৮. Ranajit Guha (Ed.), ‘Introduction’, A Subaltern Studies Reader, 1986-1995 (Minneapolis: University of Minnesota Press, 1997), p. Xiii.

২৯. Sumit Sarkar, ‘How to write history the way it should be written: A historian muses on forty years of scholarship’, Scroll, 19 December, 2017.

৩০. Asok Sen, ‘Epilogue’, Iswar Chandra Vidyasagar and His Elusive Milestones (New Delhi: Permanent Black), p. 188.

৩১. Dipesh Chakraborty, ‘Forward’, Ibid., p. xiv.

৩২. Asok Sen, Iswar Chandra Vidyasagar and His Elusive Milestones, p. 224.

৩৩. শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল-রাখাল দ্বন্দ্বসমাস: উপনিবেশবাদ ও বাংলা শিশুসাহিত্য (কলকাতা, ১৯৯১)।

৩৪. Brian A. Hatcher, Idioms of Improvement: Vidyasagar and Cultural Encounter in Bengal (Calcutta: Oxford University Press, 1996)

৩৫. Ishvarchandra Vidyasagar, Hindu Widow Marriage, Trans. by Brian A. Hatcher (New York: Columbia University Press, 2011) এবং Brian A. Hatcher, Vidyasagar: The Life and After-life of an Eminent Indian.

৩৬. Sekhar Bandyopadhyay, ‘Caste, widow-remarriage and the reform of popular culture in colonial Bengal’ in Bharati Ray (Ed), From the seams of history: essays on Indian women (New Delhi: Oxford University Press), pp. 9-14. প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, বিদ্যাসাগরের যেসব সমালোচনা শ্রেণিবিশ্লেষণ-ভিত্তিক, সেগুলির একটি প্রধান বক্তব্য বিদ্যাসাগরের সংস্কার আন্দোলন যা-কিছু, সবই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ। ‘সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন, বিধবাবিবাহ প্রবর্তন ও শিক্ষা বিষয়ক আন্দোলন, সবই ছিল মধ্য শ্রেণীর আন্দোলন।… হিন্দু নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল।’ বদরুদ্দীন উমর, ভাষা ও সাহিত্য প্রসঙ্গ (ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ২০১৩), পৃ ১৯। এই জন্যই শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গবেষণাটি বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে, কেননা তিনি দেখিয়েছেন, যেমন সদগোপ, বারুই, গন্ধবণিক, যোগী, রাজবংশী এবং নমঃশূদ্রদের মধ্যে কিছু কিছু বিধবাবিবাহের অনুষ্ঠান ঘটতে পেরেছিল— বিশেষ করে অল্পবয়সি বালিকাদের জন্য— তেমনই এইসব জাতগোষ্ঠীর মধ্য থেকেও বিরাট বড় প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছিল এই সংস্কারের বিরুদ্ধে। ‘Such symbolic actions did not however mean that the innovation had acquired popular acceptance among such communities.’ Sekhar Bandyopadhyay, ‘Caste, widow-remarriage and the reform of popular culture in colonial Bengal’, p. 13.

৩৭. মজার বিষয়, বিদ্যাসাগরের জীবনের যে আপাত-সাধারণ কাহিনিটি দিয়ে শঙ্খ ঘোষ তাঁর ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত ছোটদের জন্য লেখা বই বিদ্যাসাগর আরম্ভ করেছিলেন, না-জেনেই ইন্দ্রমিত্রও তাঁর করুণাসাগর বিদ্যাসাগর বইটির শুরুতে সেই একই ঘটনার কথা বলেছেন। বিদ্যাসাগরকে যে কোনওভাবেই আর পাঁচজন সাধারণ বাঙালির থেকে আলাদা মানুষ মনে হত না, সাজপোশাক, হাঁটাচলা, আচার-ব্যবহার, কিছুতেই নয়— এই কথাটা সামান্য বলে মনে হলেও সামান্য নয়। বরং এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে বিদ্যাসাগরের প্রতি বাঙালির টানের প্রধান হেতু। ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (কলকাতা: আনন্দ, ১৯৬৯), পৃ. ১, এবং শঙ্খ ঘোষ, বিদ্যাসাগর (কলকাতা: অরুণা প্রকাশনী), পৃ. ১।

৩৮. Sumit Sarkar, ‘Vidyasagar and Brahmanical Society’, p. 259.

৩৯. তদেব, পৃ. ৩০৬।

৪০. তদেব, পৃ. ৩০৯।

৪১. তদেব, পৃ. ৩১১।

৪২. এই প্রসঙ্গে রণজিৎ গুহ-র রামমোহন রায় সম্পর্কে আলোচনা-বইটির কথা মনে করতে পারি। রামমোহনের সতীদাহ-বিরোধী বক্তব্যে যুক্তি ছাড়াও ছিল আর একটি দিক: অনুভূতির কাছে আবেদন, যার মাধ্যম ছিল ‘দয়া’। কেন যুক্তিই যথেষ্ট ছিল না, কেন এমন আবেদন প্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল রামমোহনের কাছে? রণজিৎ গুহ বলবেন, কেননা যুক্তি হল আবেগরহিত, অথচ ‘সেই সংযম যে সর্বত্র কার্যকর নয়, তাও তিনি জানতেন। তাঁকেও যে যুক্তির পরিপূরক হিসেবে আবেগ ব্যবহার করতে হয়েছে, তার কারণ অনুভূতির মূল্য তাঁর বক্তব্যে গৌণ নয়। বস্তুত অনুভূতি ব্যতীত তা অসম্পূর্ণ থাকত। তিনি পৌঁছতে চেয়েছিলেন বুদ্ধির অগম্য কোনো এক গহনতায়, এবং তার ঠিকানা যে কেবল অনুভূতিরই জানা আছে, সে বিষয়েও তিনি নিশ্চিত ছিলেন। সেই আশ্বাসের ফলেই তাঁর রচনায় শাস্ত্র ও যুক্তির সঙ্গে লৌকিক জ্ঞানের যে অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে, তার উদ্দেশ্য স্পষ্টতই করুণানিষিক্ত বুদ্ধির দ্বারা হৃদয়ের অন্তস্তল স্পর্শ করা।’ রণজিৎ গুহ, দয়া: রামমোহন রায় ও আমাদের আধুনিকতা (কলকাতা: তালপাতা, ২০১০), পৃ. ৪৭। বিদ্যাসাগরকে বোঝার জন্যও এই বিশ্লেষণ আমাদের মনে রাখা দরকার, তাঁর যুক্তির মধ্যেও সমবেদনা-র সঞ্চারপ্রয়াস ছিল যথেষ্টই। কিন্তু ‘রাগ’ ও ‘অপরাধবোধ’-এর চিহ্ন খুঁজতে গেলে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে তাঁর যুক্তিবিন্যাসের বাইরে, অন্যান্য লেখাপত্রে। সেখান থেকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব তাঁর ভেতরের মনটিকে।

৪৩. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ (কলকাতা: চিরায়ত প্রকাশন, ২০১১)।

৪৪. তদেব, পৃ. ৫১।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *