বিদ্যাপতির কাল নিরূপণ
বিদ্যাপতির আবির্ভাব কাল তথা জীবকাল নিঃসংশয়ে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি আজো। মুখ্যত লক্ষণ সংবই এরজন্যে দায়ী। মিথিলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই সংবৎ গণনার চারটি ভিন্ন রীতি ছিল ষোলো সতেরো শতক অবধি। মোটামুটিভাবে কোনোটির সঙ্গে ১০৮০, কোনোটির সঙ্গে ১১০৮, কোনোটির সঙ্গে ১১১৯-২০ এবং কোনোটির সঙ্গে ১১২৯ বছর যোগ করলে খ্রীস্টাব্দ মেলে।
আমরা বিদ্যাপতি-রচিত গ্রন্থে ও পদাবলীতে মিথিলার ও প্রতিবেশী রাজ্যের রাজপুরুষ, রানী ও রাজাদের নাম পাই। ভোগীশ্বর, গণেশ্বর, কীর্তিসিংহ, বীরসিংহ, ভবসিংহ, দেবসিংহ, হরসিংহ, শিবসিংহ, পদ্মসিংহ, নরসিংহ, রাঘবসিংহ, ভূপতি সিংহ, রাজবল্লভ, রুদ্র সিংহ, ধীরসিংহ, মিথিলারাজ ভোগীশ্বর-পত্নী পদ্মাদেবী, দেবসিংহ-পত্নী হাসিনী দেবী, শিবসিংহ-পত্নী লক্ষ্মীদেবী, পদ্মসিংহ-পত্নী বিশ্বাসদেবী, নারায়ণ-পত্নী মেনকা দেবী, রেণুকা দেবী, রাজা অর্জুন, চন্দ্ৰসিংহ, রূপিণী দেবী, ভূপতিনাথ, কংসনারায়ণ ও তৎপত্নী সুরমা দেবী, রাঘব সিংহ-পত্নী স্বর্ণমতী দেবী, পুরাদিত্য লক্ষ্মীনারায়ণ-পত্নী চন্দল দেবী প্রভৃতি এবং আরসালান, মালিক বাহারুদ্দিন, গিয়াসুদ্দিন, আলম শাহ, নসরত শাহ, ইব্রাহিম শাহ, হোসেন শাহ, ফিরোজ শাহ প্রভৃতি প্রতিবেশী রাজ্যের সুলতান ও রাজপুরুষদের নাম রয়েছে কবির গ্রন্থে ও পদাবলীতে।
ঐনবার বংশের কামেশ্বর-পুত্র রাজা ভোগীশ্বরই বিদ্যাপতির রচনায় প্রথমোল্লিখিত ব্যক্তি। ভোগীশ্বর দিল্লীর তুঘলক সুলতান ফিরোজ শাহর (১৩৫১-৮৮) সমসাময়িক ও প্রিয় বন্ধু ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন বিদ্যাপতি :
ভোগী সরাঅ বর ভোগ পুরন্দর। …
পিঅ সখা ভণি পিঅরোজ সাহ সুরতান-সমানল।
এই ভোগীশ্বরের রাজত্বকালেই যে বিদ্যাপতি গান রচনা শুরু করেন, তার প্রমাণ–এর পূর্বেকার মিথিলার কোনো রাজা বা রাজপুরুষের নাম মেলে না বিদ্যাপতির পদে। ভোগীশ্বরের পত্নীর নাম ছিল পদ্মাদেবী। বিদ্যাপতি বলেন: বিদ্যাপতি কবি গাবিআরে
তোকে অছ গুণক নিধান
রাউ ভোগিসর গুণ নাগরা রে
পদমা দেবী রমাণ।
ভোগীশ্বরের পুত্র গণেশ্বরের সঙ্গে ২৫২ লক্ষণ সংবতে আরসালান (আসলান) নামের এক রাজ্যলোভী তুর্কীর যুদ্ধ হয়, এই যুদ্ধে আরসালান পরাজিত হয়। কিন্তু পরে একসময় উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এবং সে-সুযোগে আরসালান গণেশ্বরকে হত্যা করে মিথিলার শাসক হয়। কীর্তিলতা সূত্রেই আমরা এ সত্য জানতে পাই :
লখখন সেন নরেশ লিহিঅ জবে পখখ পঞ্চদ্বে
তনুহমাসহি পঢ়ম পখখ পঞ্চমী কহি অজে।
রজ্জলুব্ধ আসলান বুদ্ধি বিক্কম বলে হারল।
পাস বইসি বিসবাসি রাএ গএনেসর মারল।
এর থেকে আমরা দুটো বিষয়ে ইঙ্গিত পাই, ক. ২৫২ সংবতের তথা ১৩৮১ (২৫২– ১১২৯) খ্রীস্টাব্দের পূর্বেই ভোগীশ্বরের মৃত্যু হয় আর ১৩৮১ খ্রীস্টাব্দের পরে কোনো সময়ে গণেশ্বর আরসালানের হাতে প্রাণ হারান। এবং খ. ১৩৮১ খ্রীস্টাব্দের পূর্বেই গান লেখার মতো বয়স হয়েছিল বিদ্যাপতির। অতএব বিদ্যাপতির জন্ম হয় ১৩৬০-৬৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে।
কীর্তিলতা থেকেই জানা যায়, গণেশ-পুত্র বীরসিংহ ও কীর্তিসিংহ জৌনপুরের রাজা ইব্রাহিম শাহ শর্কীর (১৪০১-৪০ খ্রীস্টাব্দে) আশ্রয় ও সহায়তা পেয়েছিলেন। অতএব অন্তত ১৪০১ খ্রস্টাব্দ অবধি মিথিলা আরসালানের অধিকারে ছিল।
ইব্রাহিম শর্কী গণেশ-পুত্র কীর্তিসিংহকে মিথিলার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। কীর্তিসিংহের আগ্রহে তার বীরত্ব-কথা বর্ণিত বলেই গ্রন্থের নাম কীর্তিলতা। কীর্তিসিংহের পরে মিথিলার রাজা হন কামেশ্বরের অপর পুত্র ভবসিংহ। তার পরে রাজত্ব করেন তাঁর পুত্র দেবসিংহ। পিতৃদ্রোহী শিবসিংহ পিতা দেবসিংহকে তাড়িয়ে নিজেই রাজা হলেন। শিবসিংহের পিতা দেবসিংহ আবার সিংহাসন পেয়েছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অপর পুত্র পদ্মসিংহ রাজা হন। অবশ্য এঁদের কেউ বেশিদিন রাজত্ব করেননি। তবে শিবসিংহ প্রতাপশালী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে গৌড়ের রাজা গণেশের মিত্রতা ছিল এবং তিনি সম্ভবত মিথিলাকে জৌনপুরের প্রভাবমুক্ত করেন। শিবসিংহের আমলেই বিদ্যাপতি তার অধিকাংশ পদ এবং গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কাজেই শিবসিংহ ও বিদ্যাপতির যশ ও খ্যাতি পারস্পরিক প্রীতি ও গুণগ্রাহিতার ফল। গণেশের বিরুদ্ধে ইব্রাহিম শর্কীর গৌড় অভিযানকালে (১৪১৫ খ্রীস্টাব্দে) শিবসিংহ ইব্রাহিম শর্কীর হাতে নিহত অথবা বন্দী হন। এবং শর্কী দেবসিংহকে আবার রাজা করেন। কাজেই ১৪১৫ খ্রীস্টাব্দে শিবসিংহের রাজস্ব শেষ হয়। শ্রীধরের কাব্য প্রকাশ গ্রন্থের পুষ্পিকা সূত্রে বলা যায় (২৯১ ল. সং + ১১১৯) শিবসিংহ ১৪১০ সনের দিকে পিতৃসিংহাসন দখল করেছিলেন। দেবসিংহের পরে তাঁর অপর পুত্র পদ্মসিংহ রাজা হন। পদ্মসিংহের পরে হয়তো দেবসিংহের ভাই ত্ৰিপুর সিংহের (নৃপনারায়ণ) পুত্র অর্জুন ও অমর সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেন। এই সুযোগে নেপালের সপ্তরী জনপদের পুরাদিত্য অর্জুন ও অমরকে পরাজিত ও হত্যা করে দ্রোণবারে স্বাধীন রাজা হন। তাঁর সভাতেই বিদ্যাপতি এই বিপর্যয়ের সময় আশ্রয় পান। হয়তো শিবসিংহের পরিবারও রাজবনৌলি গ্রামে বিদ্যাপতির তত্ত্বাবধানে ছিলেন। পদ্মসিংহের পর দেবসিংহের ভাই হর বা হরিসিংহের পুত্র নরসিংহ বা নৃসিংহ রাজত্ব পেয়েছিলেন। এই নৃসিংহ বা নরসিংহের একটি শিলালিপি মিলেছে মাধিপুরা মহকুমার কানাদাহা গাঁয়ে। এতে শক শাশ্ব মদন: তথা ১৩৭৫ শক বা ১৪৫৩-৫৪ খ্রীস্টাব্দ পাওয়া যায়। অতএব নরসিংহ অন্তত ১৪৫৩-৫৪ খ্রীস্টাব্দ অবধি জীবিত ছিলেন। নরসিংহের আদেশে বিদ্যাপতি বিভাগসার, তাঁর স্ত্রী ধীরমতির আগ্রহে দানবাক্যাবলী, পুত্র ভৈরব সিংহের আজ্ঞায় দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী রচনা করেন। দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণীতে কবি নরসিংহ ও তাঁর পুত্র ধীর সিংহকে রাজা বলে বর্ণনা করেছেন। অতএব পিতার জীবিত কালেই পুত্র রাজা বা যুবরাজ হয়েছিলেন। নরসিংহেরই বিরুদ ছিল দর্পনারায়ণ। এই দর্পনারায়ণের আদেশেই কবি ব্যাড়ীভক্তি তরঙ্গিণী রচনা করেন। শিবসিংহের দুই জ্ঞাতি ভাতার নাম ছিল রাঘবসিংহ ও রুদ্ৰসিংহ এবং ধীরসিংহের পুত্র ও পৌত্রেরও যথাক্রমে এ দুটো নাম ছিল। বিদ্যাপতির তিনটে পদে রাঘব সিংহের ও দুটো পদে রুদ্র সিংহের নাম আছে। ধীর সিংহের সময়েই তাঁর পুত্র-পৌত্রকে পাওয়া যায়, কাজেই রাঘব ও রুদ্র শিবসিংহের জ্ঞাতিভ্রাতা না হয়ে যদি ধীরসিংহের পুত্র এবং পৌত্রও হয়, তাতে বিদ্যাপতির জীবৎকালের পরিসরে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। অতএব, বিদ্যাপতি আনুমানিক ১৪৫৫ খ্রীস্টাব্দ অবধি গ্রন্থ ও পদ রচনা করেছেন। আমরা উপরে যা আলোচনা করেছি, ছকে তা এরূপ দাঁড়ায়।
কামেশ্বর [ ঐনবার বংশ ]
ভোগীশ্বর (আ. ১৩৫৩–৫৫- ৮০ খ্রী.)
পত্নী পদ্মাদেবী।
ভবসিংহ
১৪০৪– ০৫}
হরসিংহ
ত্রিপুরাসিংহ
গণেশ্বর
গরুড়নারায়ণ
দেবসিংহ।
(পত্নী হাসিনীদেবী। কীর্তিসিংহ বীরসিংহ রাওসিংহ ( ১৪০৬-৯ এবং ১৪১৬-১৭ [ ১৪০২-০৪ খ্রী.]
অর্জুন. অমর [ অরাজকতা ১৪২৫-২৯ খ্রী:]
রূপনারায়ণ শিবসিংহ
পদ্মসিংহ পিত্নী লক্ষ্মীদেবী ] পত্নী বিশ্বাসদেবী। ( ১৪১০– ১৫ খ্র.]
১৪১৮-২৫ খ্রী. 1 [ এঁর জ্ঞাতিভ্রাতা : রাঘব ও রুদ্ৰসিংহ
দর্পনারায়ণ নরসিংহ পিত্নী ধীরমতি ] [ ১৪৩০– ৫৩ খ্রী. ]
যুবরাজ ভৈরবসিংহ
চন্দ্ৰসিংহ
কংসনারায়ণ ধীরসিংহ পিত্নী সুরমাদেবী ] [ ১৪৫০– ৫৫ খ্র.)
জগন্নারায়ণ
রাঘবসিংহ। [ পত্নী স্বর্ণমতীদেবী
রুদ্ৰসিংহ
গদাধর
ভোগীশ্বর থেকে রুদ্ৰসিংহ অবধি কামেশ্বর বংশীয় সব রাজা, রাজকুমার ও রানীর প্রশংসাসূচক ভণিতা দিয়েছেন বিদ্যাপতি তাঁর রচিত পদে। গ্রন্থগুলোও রচিত হয়েছে তাঁদের কারো-না-কারো নির্দেশে। বংশ তালিকাটি দীর্ঘ হলেও কাল-পরিসর দীর্ঘ নয়। খুব দীর্ঘায়ু না হয়েও এমনি স্বল্পজীবী অনেক সুলতানের (গিয়াসুদ্দীন বলবন থেকে গিয়াসুদ্দীন তুঘলক অবধি প্রতিপোষণ পেয়েছিলেন কবি জামীর খুসরুও (১২৫৩-১৩২৫ খ্রী.]। ভোগীশ্বর থেকে রুদ্ৰসিংহ অবধি কালের বিস্তৃতি হবে মোটামুটি ৭৫ বৎসর (আনু ১৩৮০-১৪৫৫ খ্রীস্টাব্দ]। বিদ্যাপতি দীর্ঘজীবী ছিলেন বলে লোকশ্রুতি আছে। অতএব, বিদ্যাপতির আয়ু [ ১৩৬৪– ১৪৫৪ খ্রী.] নব্বই বছর হলেই ভোগীশ্বর থেকে রুদ্ৰসিংহ অবধি সবাই তার জ্যেষ্ঠ, সমবয়স্ক কিংবা কনিষ্ঠ সমসাময়িক হতে পারেন।
আমাদের ধারণা দর্পনারায়ণ নরসিংহের রাজত্বকালেই যুবরাজ ছিলেন। ধীরসিংহ এবং ভৈরবসিংহ রাজত্ব করেছেন পনেরো শতকের শেষদশকে (মুদ্রার প্রমাণে)। ধীরসিংহের পুত্র রাঘব কিংবা পৌত্র রুদ্ৰসিংহ দর্পনারায়ণ নরসিংহের আমলেই যথাক্রমে প্রৌঢ় ও যুবক ছিলেন। আর সৌজন্যের ভাষায় রাজপরিবারের লোকমাত্রই রায় বা রাজা। এইজন্যে তাঁরা যথার্থ রাজা ছিলেন। বলে মনে করা অসঙ্গত। এ প্রসঙ্গে দীর্ঘজীবী আওরঙজীবের বংশধারা–বাহাদুর শাহ– আজিমুশোন–ফররুখশিয়র প্রভৃতি স্মর্তব্য। আওরঙজীবের মৃত্যুকালে প্রপৌত্র ফররুখশিয়রই প্রায়-প্রৌঢ়।
বিদ্যাপতি যেসব গ্রন্থ রচনা করেছেন, সেগুলোর আদেষ্টানুক্রমিক তালিকা এরূপ :
গ্রন্থ ——— আদেষ্টা
১. কীর্তিলতা ——– কীর্তিসিংহ।
[১৪০২-০৪]।
২. কীর্তিপতাকা ——– রূপনারায়ণ
৩. পুরুষ পরীক্ষা ——– শিবসিংহ
৪. গোরক্ষ বিজয় [নাটক] —- [১৪১০-১৫ খ্রী.]
৫. ভূপরিক্রমা ——— গরুড়নারায়ণ দেবসিংহ।
[১৪১৬-১৭ খ্রী.]
৬. শৈবসর্বস্বসার ——– পদ্মসিংহ ও তৎপত্নী বিশ্বাসদেবী
৭. গঙ্গাবাক্যাবলী। ——- [১৪১৮-২৫ খ্রী.]
৮. লিখনাবলী ——— দ্রোণবারের রাজা পুরাদিত্য
[ল, সং ২৯৯+১১২৯=১৪২৮ খ্রী.]
দ্রষ্টব্য : JASB, 1915, p.422 ]
৯. বিভাগসার ———– দর্পনারায়ণ নরসিংহ।
১০. দানবাক্যাবলী ——– নরসিংহ পত্নী ধীরমতি
১১. দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী —— কংসনারায়ণ ধীরসিংহ আঃ ভৈরবসিংহ [রূপনারায়ণ ও হরিনারায়ণ]।
১২. ব্যাড়ীভক্তিতরঙ্গণী ——- দর্পনারায়ণ নরসিংহ
[৯-১২ —- ১৪৩০-৫৫ খ্রী]
১৩. বর্ষকৃত্য বা ক্রিয়া-অপ্রাপ্ত।
১৪. গয়াবাক্যাবলী বা গয়াপত্তন–অপ্রাপ্ত।
বিদ্যাপতি ব্যাড়ীভক্তি তরঙ্গিণীতে প্রসঙ্গক্রমে দুর্গা ভক্তিতরঙ্গিনীর উল্লেখ করেছেন–অনুত্তং যদন্যম দুর্গাভক্তিতরঙ্গিন্যাম অনুসন্ধেয়ং গ্রন্থ কলেবর শঙ্কয়াএ পুণর্লিখিতমিতি–গণেশচরণ বসুর মতে স্মৃতিকারেরা নিজের রচনা উল্লেখ প্রসঙ্গেই সাধারণত অনুসন্ধেয়ং শব্দটি প্রয়োগ করতেন।
এ থেকে আমরা বুঝতে পারি ব্যাড়ীভক্তি তরঙ্গিণী দুর্গাভক্তি তরঙ্গিণীর পরে রচিত। বিদ্বানদের মতে দুর্গাভক্তি তরঙ্গিণী ভৈরব সিংহের আদেশে প্রণীত। ভৈরব সিংহের পিতা নরসিংহ দর্পনারায়ণ যে ১৪৫৩ খ্রীস্টাব্দ অবধি জীবিত ছিলেন, তার প্রমাণ তার তাম্রশাসন। কাজেই এ সময়ে বা কিছু আগে কিংবা পরে যে ব্যাড়ীভক্তি তরঙ্গিণী রচিত হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং সম্ভবত এটিই বিদ্যাপতির শেষ গ্রন্থ।
সম্ভবত গিয়াসুদ্দীন তুঘলকই (১৩২৪-২৫ খ্রীস্টাব্দে) মিথিলার কর্ণাট-বংশের উচ্ছেদ সাধন করে রাজপণ্ডিত কামেশ্বরকে মিথিলার সিংহাসন দান করেন। মুহম্মদ তুঘলকের রাজত্বকালে হাজী ইলিয়াস ওর্ষে গৌড় সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ১৩৪৫-৪৬ খ্রীস্টাব্দে বিহার জয় করে হাজীপুর শহরের পত্তন করেন। পরে ফিরোজ তুঘলক ইলিয়াস শাহকে বিতাড়িত করে মিথিলার রাজা করলেন কামেশ্বর-পুত্র ভোগীশ্বরকে। হয়তো তাঁর ভাই ভবসিংহও বিহারের এক অংশ শাসনের অধিকার পান, এবং কীর্তিসিংহের পর ভবসিংহের পুত্র শিবসিংহ বাহুবলে বিহারের একচ্ছত্র অধিপতি হন।
এক বিদ্বানের অনুমান, আরসালান কর্তৃক গণেশ্বর নিহত হওয়ার পরে হয়তো গণেশ্বরের পুত্র বীরসিংহ ও কীর্তিসিংহ দিল্লী ও গৌড় সুলতানের দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করে ব্যর্থ হয়ে জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কীর সাহায্য গ্রহণ করেন এবং পরেও নানা রাজনৈতিক বিপর্যয়ে মিথিলারাজকে হয়তো বিভিন্ন দরবারে ধরনা দিতে হয়েছে। এ সূত্রেই মিথিলার দরবারী কবি বিদ্যাপতি–গৌড় সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ, গৌড়ের সুফী-পীর আলম শাহ (হযরত নূর কুতুব-ই-আলম) অথবা দিল্লীর সৈয়দ বংশীয় সুলতান আলম শাহ (১৪৪৪-৪৮ খ্রী.) দিল্লীর তুঘলক সুলতান নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহ (১৩৯৪-৯৯ খ্রী.), গৌড় সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৩৩-৫৯ খ্রীস্টাব্দ) শকী হোসেন শাহ বা মখদুম সুলতান হোসেন শাহ, মালিক বাহারুদ্দীন প্রভৃতির প্রশস্তি যোগ করেছেন তাঁর রচিত পদাবলীতে। যথা:
১. নাসিরুদ্দীন নসরত শাহ (তুঘলক)
কবি শেখর ভণ অপরূপ রূপ দেখি
রাত্র নসরদ সাহ ভজলি কমল মুখি। (গুপ্ত ৩৪৯, মিত্র-মজুমদার ৯৩২)
অথবা
বিদ্যাপতি ভানি অশেষ অনুমানি।
সুলতান শাহ নাসির মধুপ ভুলে কমলবাণী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুথি সং ২৩৫৩)
২. নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ (গৌড়)
নাসির শাহ ভাণে
মুঝে হানল ময়ন বাণে
চিরঞ্জীব রহু পঞ্চ গৌড়েশ্বর
কবি বিদ্যাপতির ভাণে। (গুপ্ত : ৪৪, মিত্র-মজুমদার ৯৩১)
পাঠান্তর; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুথি সং ২৬৪৮
সাহা হুসেন ভাণে
জাকে হানল মদন বাণে
চিরঞ্জীব রহু পঞ্চ গৌড়েশ্বর
কবি বিদ্যাপতি ভাণে।
৩. গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ (গৌড়)
বিদ্যাপতি কবি ভাণ
মহলম যুগপতি চিরেজীব জীবথু
গ্যাসদেব সুরতান। (গুপ্ত, বসুমতী সং পৃ. ৭৪, পদ সং ২৯)
৪. হুসেন শাহ শর্কী বা দ্বারবঙ্গের মখদুম শাহ সুলতান হোসেন:
ভণই বিদ্যাপতি নব কবিশেখর
পৃথিবী পুহবী] দোহর কঁহা
সাহ হুসেন ভৃঙ্গসম নাগর
মালতী সেনিক জহা। (গুপ্ত, বসুমতী সং পৃ. ১৩১, পদ নং ১৫১)
৫. মালিক বাহারুদ্দীন :
বিদ্যাপতি কবি রভবে গাব
মালিক বহারদিন বুবই ভাব। (গুপ্ত, বসুমতী সং পৃ. ১২০, পদ সং ১১০)
৬. আলম শাহ:
দশ অবধান ভন পুরুষ প্রেম গুনি
প্রথম সমাগম ভেলা।
আলম শাহ পহু ভাবিনি ভজি রহু।
কমলিনি ভমর ভুললা।
(রাগতরঙ্গিণী, পৃ. ৮৬, গুপ্ত সাহিত্য পরিষদ, সং পদ সং ৬, পৃ. ৫২৯, মিত্র মজুমদার ভূমিকা পৃ.)
অবশ্য উক্ত সুলতানগণকে গৌড়ের আলাউদ্দীন হোসেন শাহ আর তাঁর পুত্র নুসরতশাহ ও গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহ বলে অনুমান করে এগুলোকে সহজেই শ্রীখণ্ডবাসী বাঙালি কবি বিদ্যাপতির (কবিশেখর, কবিরঞ্জন) পদ বলেও প্রমাণ করা যায়, এবং অনেকেই তা করেছেন। কিন্তু তা করবার প্রয়োজন নাই। কেননা, এগুলোকে মৈলিথিল কবির রচনা বলে গ্রহণ করতে বাধা দেখিনে।
আমাদের ধারণায় বিদ্যাপতি, ১৩৬০-৬৫ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এং ১৪৫৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে পরলোক গমন করেন। আমরা এ-ও বিশ্বাস করি যে মৈথিল কবি বিদ্যাপতি অভিনব জয়দেব, নব কবিশেখর (কবিশেখর), কবিরঞ্জন, কবিকণ্ঠহার, পণ্ডিত ঠকুর, সদুপাধ্যায়, রাজপণ্ডিত প্রভৃতি উপাধি ছিল।
আর আমাদের ধারণায় বিদ্যাপতি শৈবই ছিলেন। আমাদের বৈষ্ণব বিদ্বানেরাই বিশেষ করে একে বৈষ্ণব বলে ভাবতে চান। তার কারণও রয়েছে।
চৈতন্যদেব স্বয়ং বিদ্যাপতির পদ আস্বাদন করতেন, সেই থেকে বিদ্যাপতি হয়েছেন মহাজন গোস্বামী। পাঁচশ বছর পরে আজ যদি বিদ্যপতি শৈব ছিলেন বলে কেউ দাবী করেন, তাহলে বৈষ্ণবের ভক্তি-বিশ্বাসের ভিতেই যেন ফাটল ধরে পায়ের নিচে চোরাবালি যেন সরে যায়! কেননা সাধন-ভজনের পবিত্র বাহন আকস্মিকভাবে যেন আদিরসের পঙ্কমণ্ডিত হয়ে উঠে। তাই বিদ্যাপতিকে বৈষ্ণব রাখতেই হয়, অথচ বিদ্যাপতি ছিলেন রাজপণ্ডিত ও স্মার্ত। সমাজকে স্মৃতির শাসনে রাখা তাঁর পবিত্র দায়িত্ব বলেই তিনি জানতেন। তাই কীর্তিলতা, কীর্তিপতাকা, পুরুষ পরীক্ষা ও গোরক্ষবিজয় নাটক ছাড়া তাঁর সব রচনাই স্মৃতিগ্রন্থ। আর রাধাকৃষ্ণ পদ তাঁর মানবিক প্রণয় সঙ্গীত। তার প্রমাণ তাঁর বিবিধ বিষয়ক গান ও আদিরসাত্মক পদ। যেমন :
অপনা মন্দির বৈসলি অছলহু
ঘর নহি দোসর কেবা
তহিখনে পহিয়া পাহুন আয়ল
বরিষয় লাগল দেবা।
কে জান কি বোলতি পিসুন পরৌসিনী
বচনক ভেল অবকাশে।
ঘর অন্ধার নিরন্তর ধারা।
দিবসহি রজনী ভাণে
কোনক কহব হমে কে পতিয়ায়ত
জগত বিদিত পচবাণে।
[নিগেন্দ্র গুপ্ত, বসুমতী সং পৃ. ২৩৮, পদ সং ১৫]
অথবা—
বালম নিঠুর বয়স পরবাস
চেতন পড়োসিয়া নাহি মোর পাশ।
ননদী বালক বোলউ ন বুঝ।
পহিলহি সঁঝ শাও নহি সুঝ।
হসে ভরে যৌবতী রজনী অন্ধার
স্বপেনেহুঁ নহি পুর ভম কোটবার। ইত্যাদি
(গুপ্ত পৃ. ২৩৯-৪০ পদ সং ২১)
এসব পদও বৈষ্ণবপদের মতোই। কেবল রাধা-কৃষ্ণের নাম নেই। তাছাড়া বিদ্যাপতির হরগৌরী বিষয়ক পদ, প্রহেলিকা পদ, গঙ্গা ও রাম-সীতা বিষয়ক পদ আর রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদে পার্থক্য দুর্লক্ষ্য। রসিক কবি সব দেবতাকে সমভাবেই ভক্তি করেন, বিদ্রূপও করেন অকাতরে। কাজেই পদাবলীতে বিদ্যাপতির ধর্মীয় আবেগ নয়–রসবোধই অভিব্যক্তি পেয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। অতএব রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ তাঁর বৈষ্ণব মতের পরিচায়ক নয়। প্রেম-সঙ্গীতের জন্যে বিষয় হিসেবে রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলাই আর্কষণীয় বলে কবি রাধাকৃষ্ণলীলার পদই অধিক রচনা করেছেন। কবি, রসিক, পণ্ডিত ও ভাষার যাদুকর বিদ্যাপতি সংস্কৃত, অবহট্ট ও মৈথিল বুলিতে তাঁর জ্ঞান, চিন্তা, রসবোধ ও কাব্যকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন অবলীলায়।
.
পরিশিষ্ট
শতেক বছর ধরে বিদ্যাপতি সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছে বাঙলা ও বিহারে। কিন্তু করদ রাজ্য মিথিলার রাজবংশের রাজপঞ্জী, কুলপঞ্জী, লোকশ্রুতি নির্ভর আলোচনা কোনো স্থির সিদ্ধান্তের পথে এগিয়ে দেয়নি। লক্ষ্মণ সংবতের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহারই এজন্যে অনেকটা দায়ী। এজন্যে বিদ্যাপতির জীবকাল সম্বন্ধে নিঃসংশয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ আজো সম্ভব হয়নি। বিদ্বানেরা আজ অবধি যে-সব মত চালু করেছেন, সেগুলো এখানে উদ্ধৃত হচ্ছে। তার আগে বিদ্যাপতি ও তাঁর রচনা সম্বন্ধে যারা আলোচনা করেছেন কিংবা তার পদাবলী সংকলন করেছেন অথবা তাঁর রচিত গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন, তাঁদের নাম উল্লেখ করছি।
রাজেন্দ্রলাল মিত্রই প্রথম (১৮৫৮-৫৯ সনে) বিবিধার্থ সংগ্রহে বঙ্গ ভাষার উৎপত্তি নামক প্রবন্ধে বিদ্যাপতির পরিচয় দেন। এর পর আলোচনা করেন রামগতি ন্যায়রত্ন তাঁর বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাবে (১৮৭২ সনে)। এসব ছাড়াও হরিমোহন মুখোপাধ্যায় কবি চরিতে (১৮৬৯ সন), মহেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বঙ্গ ভাষার ইতিহাসে (১৮৭২ সনে) এবং মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বাঙ্গালা সাহিত্য সংগ্রহে (১৮৭২) বিদ্যাপতির লোকশ্রুতিমূলক পরিচয় দান করেন।
কিন্তু বিদ্যাপতি সম্বন্ধে যথার্থ ঐতিহাসিক অনুসন্ধিৎসা শুরু হয় জন বীমসের প্রবন্ধ দিয়ে। এ প্রবন্ধের সমালোচনা স্বরূপ রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বঙ্গ দর্শন পত্রিকায় বিদ্যাপতি নামে তথ্যবহুল একটি প্রবন্ধ লেখেন। জন বীমস রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বিদ্যাপতি সম্বন্ধে আর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত করেন Indian Antiquary-তে। এরপর G. A. Grierson ১৮৮১ সনে তাঁর An introduction to the Maithili language of North Bihar, containing a grammar, Chrestomathy and vocabulary ( vol II) acts গ্রন্থে এবং পরবর্তী দুটো প্রবন্ধে বিদ্যাপতির বিশেষ পরিচয় দেন। তারপর জগদ্বন্ধুভদ্র ১৮৭৪ সনে মহাজন পদাবলী (১ম খণ্ড) নামে বিদ্যাপতির পদাবলী সংকলন করেন। আর ১৮৭৮ সনে। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ (২য় খণ্ড) গ্রন্থে বিদ্যাপতির পদ সংকলিত হয়। ১৮৯২ সনে (১২৮৫ বঙ্গাব্দে) প্রকাশিত হয় সারদাচরণ মিত্রের বিদ্যাপতির পদাবলী নামক সংকলন গ্রন্থ। এরপর ১৯০৯ সনে (১৩১৬ বঙ্গাব্দে) নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত সংগৃহীত ও সম্পাদিত প্রখ্যাত বিদ্যাপতি ঠাকুরের পদাবলী প্রকাশিত করেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ। পরে বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে নগেন্দ্র গুপ্ত সংকলিত বৈষ্ণব মহাজন পদাবলী (২য় খণ্ড) : মহাকবি বিদ্যাপতির পদাবলী প্রকাশিত হয় ১৩৪২ বঙ্গাব্দে (১৯৩৫ সনে)। এর এক বছর আগে খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ বের করেন (১৩৪১ বাং ১৯৩৪ সন) বিদ্যাপতি পদাবলী। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে তথা ১৯৫২ সনে প্রকাশিত হয় খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও ডক্টর বিমানবিহারী মজুমদারের বিদ্যাপতি পদাবলী, ডক্টর শহীদুল্লাহর সংকলিত বিদ্যাপতি শতক বের হয় ১৩৬১ বঙ্গাব্দে বা ১৯৫৪ সনে। এগুলো ছাড়াও কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের বিদ্যাপতির বঙ্গীয় পদাবলী (১৮৯৪ সন), পঞ্চানন তর্করত্নের বিদ্যাপতি পদাবলী (১৮৯৫) হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নবাবিষ্কৃত বিদ্যাপতি পদাবলী (১৯০০-০৬), কীর্তিলতা (১৯২৫) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব ছাড়াও রয়েছে ব্রজানন্দ সহায়-এর মৈথিল কোকিল বিদ্যাপতি (১৯১০), নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিদ্যাপতি ঠাকুর (১৯১০), রামকৃষ্ণ শর্মার বিদ্যাপতি কি পদাবলী (১৯৩১), বসন্ত কুমার ময়ূরের বিদ্যাপতি কি পদাবলী (১৯৫২), শম্ভু প্রসাদের মৈথিল কোকিল বিদ্যাপতির সংক্ষিপ্ত পদাবলী (১৯৪৭), লালা দেবেন্দ্র সিংহ ও সূর্যাবলী সিংহের বিদ্যাপতি (১৯৫০), সুভদ্র ঝা-র বিদ্যাপতি Songs of Vidyapati (১৯৫৪), অরবিন্দ ঘোষের Songs of Vidyapati (১৯৫৬) প্রভৃতি। এগুলো ছাড়াও যে-কোনো পদাবলী সংকলন গ্রন্থে বিদ্যাপতির পদ রয়েছে, এবং সবাই বিদ্যাপতির অল্প বিস্তর পরিচয় দেবার চেষ্টা করেছেন। বিদ্যাপতির কীর্তিলতা পুরুষ পরীক্ষা ও তাঁর স্মৃতিগ্রন্থগুলোর সম্পাদনা কিংবা আলোচনা প্রসঙ্গেও বিদ্যাপতি সম্বন্ধে নানা তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা হয়েছে। তাছাড়া বাঙলা ও মিথিলার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক ইতিহাসেও রয়েছে বিদ্যাপতি সম্পর্কে নানা তথ্য।
এবার বিদ্যাপতির জন্ম-মৃত্যুর কাল সম্বন্ধে বিভিন্ন বিদ্বানের মতগুলো এখানে তুলে ধরছি।
১. সারদাচরণ মিত্র : খ্রীস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই তাঁহার পদাবলী প্রকাশিত হইয়াছিল। (বিদ্যাপতির পদাবলী ১৮৭৮ খ্র.)
২. জি. এ. গ্রিয়ার্সন : Vidyapati flourished and was a celebrated author during at least the first half of the 15th century (Introduction, p 11, Puruhsa Pariksa).
৩. নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত : ক)] বিদ্যাপতি ১৩৫৮ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং মৃত্যু হয় ১৪৪৮ খ্রীস্টাব্দে (বিদ্যাপতি ঠাকুরের পদাবলী)। [–বা, সা. প. সং ভূমিকা পৃ.]।
খ) বিদ্যাপতি সাতাশী-অষ্টাশী বৎসর বয়স পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। মহাকবি বিদ্যাপতির পদাবলী, বসুমতী সাহিত্য মন্দির পৃ. ১]
৪. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : জীবনকাল ১৩৪৭-১৪৫৬ খ্রীস্টাব্দ (কীর্তিলতা, ভূমিকা পৃ. ]
৫. কুমার গঙ্গানন্দ সিংহ : জন্মসন ১৩৫০ খ্রীস্টাব্দে। (বিদ্যাপতি কি পদাবলী পৃ. ১১, ৩১)
৬. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় : End of 14th, begining of 15th century. (Original and Development of Bengali language vol. 1)
৭. দীনেশ চন্দ্র সেন : জন্মসন ১৩৫৮ কিংবা তদ্রূপ কোনো সময় (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য)।
৮. বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় : জন্ম ১৩৭২, মৃত্যু ১৪৪৮ খ্রীস্টাব্দ, [Journal of Development of Letters, Calcutta. vol. XVI, p 36]
৯. অমূল্য চরণ বিদ্যাভূষণ : জন্ম : ১৩৫০ খ্রীস্টাব্দের পর নিকটবর্তী কোনো সময়। [বিদ্যাপতির পদাবলী : ভূমিকা]।
১০, খগেন্দ্রনাথ মিত্র : (ক) জন্ম চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ পাদে, [পদামৃত মাধুরী পৃ. ৪৮]
(খ) জন্ম : ১৩৯০ খ্রীস্টাব্দে (বৈষ্ণব রস সাহিত্য)।
১১. সতীশচন্দ্র রায় : জন্ম ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দ এবং শতাধিক বৎসর সুস্থ শরীরে জীবিত থাকিয়া নানা গ্রন্থ রচনা করেন [পদকল্পতরু ৫ম খণ্ড পৃ. ১৬৬-১৬৭]
১২. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : জন্ম ১৩৫৪ এবং ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দেও বিদ্যাপতি সজ্ঞানে সুস্থ শরীরে বিদ্যমান ছিলেন। রুদ্ৰসিংহের রাজত্বকালে (১৪৭৫ থেকে শুরু) বিদ্যাপতির মৃত্যু হয়।
(ক) বাংলা সাহিত্যের কথা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭২-৭৬। বিদ্যাপতি শতক, ভূমিকা পৃ.–১০)
১৩. সুকুমার সেন (ক) ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দের পর বিদ্যাপতি বেশিদিন জীবিত ছিলেন বলিয়া মনে হয় না (বিদ্যাপতি গোষ্ঠী, পৃ. ২২-২৩) (খ) বিদ্যাপতি ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত, সমর্থ ও অধ্যাপনরত ছিলেন (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ৩য় সং ১ম খণ্ড, পূর্বার্ধ, পৃ. ৩৮৩)।
১৪. বিমান বিহারী মজুমদার : ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দের কাছাকছি সময়ে বিদ্যাপতির জন্ম এবং ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দে বিদ্যাপতি জীবিত ছিলেন প্রমাণিত হইতেছে। (বিদ্যাপতির পদাবলী, ভূমিকা পৃ.)।
১৫. উমেশ মিশ্র : কবির জীবকাল ১৩৬০ থেকে ১৫০০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে। বিদ্যাপতি ঠাকুর (হিন্দুস্থানী একাডেমী, এলাহাবাদ ১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দ পৃ ৩৬-৩৭)
১৬. শিবনন্দন ঠাকুর : জন্ম ১৩৫১ ও মৃত্যু ১৪৪৮ খ্রীস্টাব্দ। (মহাকবি বিদ্যাপতি পৃ. ৩৭-৩৯)
১৭. জয়কান্ত মিশ্র : জন্ম ১৩৬০ ও মৃত্যু ১৪৩৭ খ্রীস্টাব্দ ( History of Maithili literature )।
১৮. সুখময় মুখোপাধ্যায় : জন্ম ১৩৭০ ও মৃত্যু ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দের মতো সময়ে। (বাংলা সাহিত্যের কালক্রম পৃ. ৪৭-৪৮)
১৯. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় : জন্ম আ. ১৩৮০ ও মৃত্যু আ. ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দ, (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৮-৭৯)।
২০. সুভদ্র ঝা : মৃত্যু ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দের পরে। ( Songs of Vidyapati, Introduction)
লক্ষণীয়, এর মধ্যে অনেকেই বিদ্যাপতির মৃত্যু সন ১৪৪৮ অথবা ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দ ধরেছেন। যারা ১৪৪৮ সন বলে মনে করেন তাদের সিদ্ধান্তের ভিত্তি হচ্ছে বিদ্যাপতির রচনা বলে অনুমিত একটি পদ :
সপন দেখল হম শিবসিংহ ভূপ
বতিস বরস পর সামর রূপ।
বহুত দেখল হম গুরুজন প্রাচীন।
অব ভেলহু হম আয়ুবিহীন। [ নগেন্দ্র গুপ্ত : বসুমতী সং পৃ. ২৩৮ পদ সংখ্যা–১১ মিত্র ও মজুমদার পদসংখ্যা ৯১৪]
এঁরা শিবসিংহের মৃত্যু সন ধরেছেন ১৪১৫-১৬ খ্রীস্টাব্দ এবং বিশ্বাস করেছেন পদোক্ত স্বপ্নফল অবশ্যম্ভাবী। কাজেই ১৪১৬+৩২=১৪৪৮ খ্রীস্টাব্দেই বিদ্যাপতির মৃত্যু হয়েছিল। কেননা ব্ৰহ্মবৈবর্ত পুরাণ-মতে স্বপ্ন মিথ্যে হবার নয়।
আর যারা বিদ্যাপতির মৃত্যু সন ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দ বলে নিরূপণ করেছেন তাঁদের দলিল হচ্ছে একটি পুথির লিপিকাল। হলায়ুধ মিশ্রের ব্রাহ্মণ সর্বস্ব গ্রন্থের একটি প্রতিলিপি তৈরি করেছিলেন বিদ্যাপতির ছাত্র রূপধর। পুষ্পিকায় লিপিকাল ও জীবিত বিদ্যাপতির উল্লেখ আছে। যথা :
লসং ৩৪১ মুড়িয়ার গ্রামে সক্রিয় সদুপাধ্যায় নিজকুল কুমুদিনী চন্দ্রবাদি মওভ সিংহ পরম সচ্চরিত্র পবিত্র শ্রীবিদ্যাপতি মহাশয়েভ্য পঠিতা ছাত্র শ্রীরূপ ধরেণ। লিখিত মদঃ পুস্তকম।
৩৪১ লক্ষ্মণ সংবেতের সঙ্গে ১১১৯ যোগ করেই তারা ১৪৬০ খ্রীস্টাব্দ পেয়েছেন। কিন্তু ৩৪১ এর সঙ্গে ১০৮০, ১১০৮ কিংবা ১১২৯ যোগ করিলে যথাক্রমে ১৪২১ ১৪৪৯ এবং ১৪৭০ খ্রস্টাব্দও পাওয়া যায়। তবে পুস্পিকা সূত্রে মনে হয় বিদ্যাপতি তখন যশ ও মনে অনন্য, কাজেই লিপিকাল ১৪৪১ খ্রীস্টাব্দ ধরাই সঙ্গত। বিশেষ করে যিনি নেপালের দ্রৌণবাররাজ পুবাদিত্যের আশ্রয়ে (রাজাবনৌলি গাঁয়ে) থেকেও জীবকার্জনের জন্যে লিখনাবলী রচনা করেছেন ২৯৯ লং সংবতে তথা (২৯৯+১১২৯) ১৪২৮ খ্রীস্টাব্দে বা তৎপরে, তার তখনো খ্যাতি-প্রতিপত্তি উক্ত সব বিশেষণের আনুপাতিক হয়ে না-উঠারই সম্ভাবনা।
বিদ্যাপতি নাকি তালপাতায় একখানি ভাগবতের প্রতিলিপি তাৈন করেছিলেন। তার পুষ্পিকায় বিদ্যাপতির নাম ও অস্পষ্ট লিপিকাল রয়েছে : শুভমস্ত সৰ্ব্বর্থগতা সংখ্যা লং ৩০৯ শ্রাবণ শুদি ১৫ কুজে রাজাবনৌলি গ্রামে শ্রী বিদ্যাপতের্লিপিরিয়মিতি। দ্বিারবঙ্গের রাজগ্রন্থাগারে রক্ষিত]।
বিস্ফী গাঁয়ের কবি বিদ্যাপতি কিংবা রাজসভার কবি ও রাজপণ্ডিত বিদ্যাপতি ১৪৩৮ সনেও রাজাবনৌলি গায়ে বসে ভাগবত নকল করেছেন, এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। পদ্মসিংহের মৃত্যু ও নরসিংহের সিংহাসন প্রাপ্তির সন্ধিকালে হয়তো রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে কবি নেপালে দ্রৌনবারের রাজার আশ্রয় নিয়েছিলেন। লিখনাবলী সূত্রে বোঝা যায় তিনি ১৪২৮ খ্রীস্টাব্দেও সেখানে ছিলেন। কিন্তু তাই বলে আরো দশ বছর সেখানে বাস করার কথা নয়। কেননা, তিনি নরসিংহ পরিবারের প্রতি অর্জন করেছিলেন। কাজেই উক্ত প্রতিলিপি হয়তো অন্য কোননা বিদ্যপতির কৃতি। নাম-সাদৃশ্যে গুরুত্ব আরোপ না-করাই সঙ্গত। আর (৩০৯+১১২৯=) ১৪৩৮ খ্রীস্টাব্দেই এ পুথি লিপীকৃত। কেননা ঐ বছরের শ্রাবণ মাসের শুদি ১৫ বা পূর্ণিমা তিথি মঙ্গলবারে পড়েছিল এবং ঐদিন তারিখ ছিল ৫ই আগস্ট।
এ ছাড়া বিদ্যাপতি রচিত দানবাক্যাবলীর একটি প্রতিলিপি রয়েছে নেপাল রাজ গ্রন্থাগারে। ওটি নাকি বিদ্যাপতির স্বহস্তে সংশোধিত। নকলের তারিখও রয়েছে লং সং ৩৫১। এর সঙ্গে ১০৮০, ১১০৮, ১১১৯ ও ১১২৯ যোগ করলে যথাক্রমে ১৪৩১, ১৪৫৯, ১৪৭০ ও ১৪৮০ খ্রীস্টাব্দ হয়। তবে ১৪৩১ খ্রীস্টাব্দ ধরাই সমীচীন।
১৩০৭ সালের সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থ বিদ্যাপতির ভনিতাযুক্ত একটি অবহটঠপদ উদ্ধৃত করেছিলেন। পদটি নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিদ্যাপতি পদাবলীর বসুমতী সংস্করণে বিধৃত রয়েছে (পৃ. ২৩৬-৩৭ পদ সং ৯ ও পরিষৎ সং; পদ সং ৫৩১)। পদটির শুরু এভাবে :
অনল রন্ধ্রকর লকখন নরবই সক সমুদ্দকর অগিনি সসী
চৈতকারি ছঠি জেঠা মিলিও বার বেহপ এ জাউলসী।
দেবসিংহে জং পুহবী ছড়িঅ অদ্ধাসন সুররাএ সরূ
দুহু সুরতনি নীলে অবে শোয়উ তপন হীন জগতিমিরে ভরু।
শেষ—
আরন্তিয় অন্তেষ্টি মহামখ রাজসুয় অসমেধ যঁহা।
পণ্ডিতঘর আচার বখানিয় যাচক কা ঘর দান কঁহা।
বিদ্যাপতি কবিবর এহু গাবয় মানব মন আনন্দ ভয়ও
সিংহাসন শিবসিহ বইঠঠো উচ্ছব বৈরস বিসরি গয়েও।
এখানে প্রদত্ত সন (অনল-৩, রন্ধ্র-৯, কর-২) = ল সং ২৯৩ এবং শক (সমুদ্র– ৪, কর– ২, অগ্নি– ৩, শশী-১) = ১৩২৪ শক।
ল, সংবত থেকে ১৩৭৩, ১৪০১, ১৪১২ বা ১৪২২ খ্রীস্টাব্দ মেলে আর শকাব্দ থেকে পাই ১৪০১-০২ খ্রীস্টাব্দ। কাজেই ১৪০১-০২ খ্রীস্টাব্দই নির্দেশিত হয়েছে বলে মানতে হয়। কেউ কেউ শকাব্দের কর স্থলে পুর ধরে একে ১৩৪৩ শক বা ১৪১২ খ্রীস্টাব্দ পেতে চান। এই সন শিবসিংহের (কাব্য প্রকাশবিবেক সূত্রে সিংহাসন আরোহণ ১৪১০ খ্রীস্টাব্দের পূর্বে রাজত্বকালে পড়ে। কিন্তু এ পদটি অনেকের মতেই জাল। কেননা প্রথমত দেবসিংহের মৃত্যুর আগেই পিতৃদ্রোহী শিবসিংহ পিতাকে তাড়িয়ে রাজ্য দখল করেন, এ সংবাদ আমরা মোল্লা তাকিয়ার বয়ায সূত্রে জানতে পাই। দ্বিতীয়ত, পুরুষ পরীক্ষা সূত্রে বোঝা যায়, এই গ্রন্থ রচনাকালে দেবসিংহ জীবিত ছিলেন, ভাতি যস্য জনকোরণজেতা দেবসিংহ গুণরাশি:। তৃতীয়ত নৈমিষারণ্যে আশ্রিত। দেবসিংহের আদেশেই যে বিদ্যাপতি ভূপরিক্রমা রচনা করেছিলেন, তা ভূপরিক্রমা থেকেই জানা যাচ্ছে। অতএব শিবসিংহের রাজত্বকালে দেবসিংহ মৃত নয়, নির্বাসিত অথবা পলাতক ছিলেন।
কেউ কেউ কীর্তিলতার দুটো শ্লোকের তাৎপর্য অনুসরণে বিদ্যাপতির জন্ম সন ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দ নিরূপণে প্রয়াসী। শ্লোক দুটো এরূপ :
১, বালচন্দ্র বিজ্জাবই ভাসা
দুহু নহি লগগেই দুজ্জন হাসা।
ও পরমেসর হরশির সোহই
ঈ নিশ্চই নাঅর-মন মোহই।
বালচন্দ্র ও বিদ্যাপতির ভাষা–এ দুইয়ের কোনোটিতেই দুর্জনের উপহাস লাগিবে না। যেহেতু চন্দ্র পরমেশ্বর মহাদেবের মস্তকে লাগিয়া থাকে, আর বিদ্যাপতির ভাষা নাগর জনের মনোমমাহন করে। [ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
২ মাধুর্য প্রসবস্থলী গুরু যশো শিক্ষাসখী।
যাবদ্বিশ্বমিদঞ্চ খেলনকবের্বিদ্যাপতের্ভারতী।
মাধুর্যের প্রসব স্থলী স্বরূপ যশোবিস্তারের শিক্ষাসখী সদৃশ খেলন কবি বিদ্যাপতির কবিতা সমস্ত বিশ্বে ব্যাপ্ত হইতে থাকুক। [ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
প্রথমটাতে বালচন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যাপতির ভাষা তুলিত হয়েছে। বিদ্বানরা মনে করেছেন, বিদ্যাপতি তখনো তরুণ। আর দ্বিতীয় শ্লোকে খেলনা কবি অর্থে (খেলুড়ে-বাল্যক্রীড়ার বয়স অতিক্রান্ত হয়নি যার) বালক কিংবা কিশোর কবি নির্দেশ করা হয়েছে বলেই তাদের ধারণা। কীর্তিলতা ১৪০১-০৪ সনের মধ্যে রচিত। কাজেই এঁদের মতে এটি কৃবির বিশ-বাইশ বছর। বয়সের রচনা। এজন্যে তাঁরা কবির জন্ম সন ১৩৮০ খ্রীস্টাব্দ বলে অনুমান করেন।
আগে কয়েকটি গীত রচনা করলেও পূর্ণাঙ্গ কাব্য হিসেবে কীর্তিলতাই বিদ্যাপতির প্রথম কৃতি। এজন্যেই কবি এই নব প্রয়াসকে নবচন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন : নবচন্দ্র যেমন নতুন ও ক্ষীণকায় বলে নিন্দনীয় নয়, তেমনি নতুন কবির প্রথম কাব্য বলে কীর্তিলতাও অবহেলার বস্তু নয়। এমনি তাৎপর্যেও উক্ত শ্লোকটি গ্রহণ করা সম্ভব।
সম্প্রতি খেলনকবের্বিদ্যাপিতর্ভারতী পাঠ কেউ কেউ অশুদ্ধ ও অর্থহীন বলে মনে করেন। তাঁদের মতে শুদ্ধ পাঠ হবে খেলতু কবের্বিদ্যাপতের্ভারতী। অতএব যা ছিল বিনয়বচন, তা গর্বিত আহবানে হল পরিণত। কাজেই উক্ত দুই শ্লোক অপরিণত অল্প বয়সের সাক্ষ্য নয়। বিশেষ করে বিদ্যাপতির পদে রাজা ভোগীশ্বরের উল্লেখ রয়েছে। জীবিত রাজা ভোগীশ্বরের প্রশস্তিই গেয়েছেন কবি তাঁর ভণিতায়। ১৩৮১ খ্রীস্টাব্দের আগে ভোগীশ্বরের মৃত্যু হয়। কাজেই এ সময়ে বিদ্যাপতির বয়স ১৫-২০ না হলে পাঠযোগ্য পদ রচনা সম্ভব না।