বিদায় সংবর্ধনা
সত্যসুন্দরের চোখের কোণে ধীরে-ধীরে বাষ্প জমছিল।
ফুলের মালা, ফুলের তোড়া, ছমছমে ধূপের গন্ধ, সবকিছু ক্রমশ তাকে অভিভূত করে ফেলছিল। নিজের অবাক চোখ দুটোকে বড় হলঘরটার চারপাশে বুলিয়ে নিলেন সত্যসুন্দর। কলেজে এই ঘরটাই সবচেয়ে বড় ক্লাস-ঘর। এখানে পাসকোর্সের ছেলেমেয়েদের ক্লাস হয়। কিন্তু এখন সেই ছেলেমেয়েদের নির্ধারিত বেঞ্চিগুলিতে মাননীয় প্রিন্সিপালসাহেব থেকে শুরু করে দশ-বারোজন অধ্যাপক, জনা বিশ সত্যসুন্দরের সহকর্মী, এবং পাঁচ-ছজন ছাত্র-ছাত্রী বসে আছে। সকলেই প্রগাঢ় ভালোবাসা মাখা আতুর চোখে সত্যসুন্দরকে দেখছে। কারণ আজ কলেজ ল্যাবরেটারির মেকানিক সত্যসুন্দর দাসের বিদায় সংবর্ধনা।
খাটো পাটাতনের ওপরে দাঁড় করানো লম্বা টেবিল। টেবিলের পিছনে তিনটে চেয়ার। বাঁ দিকের চেয়ারে সঙ্কুচিতভাবে বসে রয়েছেন সত্যসুন্দর। বাকি দুটি চেয়ার এখনও খালি। ও-দুটো নির্দিষ্ট রয়েছে সভাপতি এবং বিশেষ অতিথির জন্য।
চেয়ারের সারির পিছনেই কুচকুচে কালো বিশাল ব্ল্যাকবোর্ড। তাতে চকখড়ি দিয়ে নানান অঙ্ক কষা ছিল, কিন্তু মাঝামাঝি অংশটা ডাস্টার দিয়ে মুছে গোটা-গোটা হরফে কেউ লিখে দিয়েছে : ১৭ই নভেম্বর বেলা দুটোয় শ্রীসত্যসুন্দর দাসের ফেয়ারওয়েল।
চেয়ার-টেবিল-পাটাতন ইত্যাদি থেকে কিছুটা তফাতে আরও দুটি চেয়ার দাঁড় করানো রয়েছে। তার একটিতে সযত্নে রাখা আছে দুটি ফুলের তোড়া, একটি রজনীগন্ধার গোড়ে মালা এবং একগুচ্ছ জ্বলন্ত সুগন্ধি ধূপ। বাকি চেয়ারটিতে একটি কাচে বাঁধানো তৈলচিত্র ঋজুভাবে দাঁড়িয়ে। চিত্রের ব্যক্তি এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা-প্রিন্সিপাল ডক্টর এস. কে. মিত্র। চোদ্দো বছর হল উনি মারা গেছেন। কিন্তু তারপর থেকে কলেজের লঘুগুরু যে-কোনও অনুষ্ঠানে ডক্টর মিত্রের আবক্ষ চিত্রটি সর্বদাই উপস্থিত থেকেছে। এ ঘটনায় অনুমান হতে পারে তিনি সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র ছিলেন। এবং এ-অনুমান পুরোপুরি সত্যি।
ডক্টর মিত্রের ছবিতে আন্তরিকতার সঙ্গে মালা পরিয়ে দিচ্ছিলেন শচীদুলাল কর্মকার। লম্বা শক্ত দেহের কাঠামো। মাথার চুল ও গোঁফের রং ধবধবে সাদা। বাষট্টি বসন্ত পেরিয়ে গেছেন। শচীদুলাল, কিন্তু তার মধ্যে যে-কোনও একটি বসন্ত তার মাঝারি ফরসা মুখে স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেছে। শচীদুলাল দু-বছর আগেই রিটায়ার করেছেন, কিন্তু কলেজে এখনও নিয়মিত আসেন, অফিসের কাজকর্ম দেখেন। বাড়িতে তার নাকি সময় কাটতে চায় না। হেসে বলেন, ঘানির বলদের কাধ থেকে যদি জোয়াল খুলে ছেড়ে দেন, দেখবেন তখনও ব্যাটা গোল হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা হলুম গে সেইরকম। রিটায়ার্ড হয়েও টায়ার্ড হই না।
ডক্টর মিত্রের ছবিতে মালা পরানো শেষ করে আরও কয়েকটা ধূপকাঠি জ্বেলে দিলেন শচীদুলাল। তার মনে পড়ছিল নিজের ফেয়ারওয়েলের দিনটা। তারপর থেকে রোজই কলেজে আসেন অথচ কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে। ফেয়ারওয়েলের দিনটা শাসনের চোখে তার দিকে তাকায়। নিত্য অফিসসংক্রান্ত যেসব কাজগুলো তিনি করেন, মনে হয় সেগুলো সবই অনধিকার চর্চা। কিন্তু তা হলেও ভালো লাগে। এ কলেজ থেকে রিটায়ার অনেকেই করেছেন, কিন্তু শচীদুলালের মতো হাজিরার ধারাবাহিকতা কেউ রাখেননি। হয়তো এই কারণেই প্রত্যেক বিদায় সংবর্ধনার অনুষ্ঠানে শচীদুলালের ওপরেই দায়িত্ব পড়ে আয়োজনের প্রধান কর্মকর্তার ভূমিকার। এবং শচীদুলাল তা পালনও করেন সাগ্রহে। যেমন এখন করছেন।
ক্লাস-ঘরের প্রথম সারির বেঞ্চিগুলিতে কলেজের অন্যান্য অশিক্ষক কর্মচারী বসেছেন। তাদের নিজেদের মধ্যে গুঞ্জন চলেছে। কেউ-কেউ বা সত্যসুন্দরের কর্মজীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনার স্মৃতিচারণ করছেন। যেসব ছাত্রছাত্রী সত্যসুন্দরকে মাত্র কয়েকবছর দেখেছে তারা পিছনের সারিতে বসে আগ্রহ নিয়ে প্রথম সারির আলোচনা শুনতে চেষ্টা করছিল। ঘড়িতে দুটো বেজে কুড়ি মিনিট, অথচ অনুষ্ঠান এখনও শুরুই হল না, এই অভিযোগও করছিল উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের দু-একজন।
ধূপের সাদা ধোঁয়া ক্রমে হলঘরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছিল। সকলেই তৈরি হচ্ছিলেন শোকতাপসমৃদ্ধ একটি বিদায় সংবর্ধনাসভা প্রত্যক্ষ করার জন্য। চেয়ারে একা বসে থাকা সত্যসুন্দরকে মনে হচ্ছিল পার্ট ভুলে যাওয়া কোনও অসহায় অভিনেতা। এবং পরিচালক এই সঙ্কট-মুহূর্তে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন না তার দিকে।
সামনের সারি থেকে ছোকরা লাইব্রেরি অ্যাসিস্ট্যান্ট হরিশঙ্কর বলে উঠল, শচীদা, শুরু করে দিন।
ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট নরপতি পাশে বসে থাকা লাইব্রেরিয়ান অরুণ সামন্তকে জিগ্যেস করলো, সামন্তদা, প্রেজেন্টেশানের প্যাকেটটা কার কাছে?
অরুণ সামন্ত বললেন, ওই ফুলের তোড়ার পাশে রাখা আছে।
প্রিন্সিপাল ডক্টর নবীন সরকার ও অন্যান্য অধ্যাপক পিছনের দু-সারি বেঞ্চিতে ঘন হয়ে বসেছেন। আজকের অনুষ্ঠান মূলত অশিক্ষক কর্মচারীদের, তাই ওরাই অগ্রণী। অধ্যাপকরা চাঁদা ও উৎসাহ দিয়ে অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতার কাজ করেছেন। সুতরাং অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিত থাকাটাও জরুরি ছিল। তাদের অনেকেই এসেছেন এবং সচেতনভাবেই গৌণভূমিকা নিয়েছেন।
ব্যবস্থাপনার কাজ সেরে শচীদুলালের দীর্ঘ দেহ এগিয়ে এল পিছনের বেঞ্চির দিকে। তার চোখ অধ্যক্ষ নবীন সরকারের চোখে। দু-দিকের বেঞ্চির সারির মাঝের অলিপথ ধরে ডক্টর সরকারের কাছে এসে দাঁড়ালেন শচীদুলাল। সাদা শার্ট, কালো জহরকোট ও ধুতি পরা শরীরটাকে অনেকটা ঝুঁকিয়ে সরকার সাহেবের খুব কাছাকাছি মুখ এনে বললেন, স্যার, তা হলে শুরু করে দিচ্ছি।
নীরব সম্মতি জানালেন ডক্টর সরকার। উনি সাধারণত খুব কম কথা বলেন, তাঁর দু-পাশে বসে থাকা দুই অধ্যাপক, সুরেন পাত্র আর রমেশ সমাদ্দার, হলঘরে হাজির হওয়া ইস্তক ডক্টর সরকারকে নানাভাবে খুশি করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সরকার সাহেবের তরফ থেকে বিশেষ উচ্চবাচ্য শোনায় তারা ঠিক বুঝতে পারছিলেন না, সরকার সাহেব খুশি হয়েছেন কি না। খুশি হলে সুরেন পাত্রের পাওনা ইনক্রিমেন্টটা যথাশীঘ্র কার্যকরী হবে, এবং রমেশ সমাদ্দার যে দীর্ঘদিন বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন সে-চেষ্টাও সফল হবে কারণ বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়েই নবীন সরকারের যথেষ্ট পরিচিতি এবং ওজন আছে।
অশিক্ষক কর্মচারীদের ইউনিয়ন নেতা অনঙ্গ নস্কর প্রথম সারিতে বসেছিলেন। শচীদুলালের সঙ্গে কীসব পরামর্শের পর তিনি বেঞ্চির আসন ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। সোজা গিয়ে উঠে দাঁড়ালেন পাটাতনের ওপরে, চেয়ার-টেবিলের ঠিক পাশটিতে। তার মঞ্চে ওঠার সহজ সাবলীল ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় এ-জাতীয় অভ্যাস তার ভালোরকম আছে। ঘরের সিলিং-এর দিকে একপলক তাকিয়ে বাঁ-হাতটি পিছনে রেখে অনঙ্গ নস্কর বলতে শুরু করলেন, সমবেত অধ্যাপকমণ্ডলী, ছাত্রছাত্রীবৃন্দ ও সহকর্মী কমরেডগণ! আজ আমাদের অত্যন্ত দুঃখের দিন। আমাদের প্রিয় কমরেড শ্রীসত্যসুন্দর দাস রিটায়ার করছেন।
ঘরের সর্বশেষ সারিতে বসা বয়স্ক অধ্যাপক মানব মজুমদার পাশে বসা তরুণ অধ্যাপক দীপক রায়চৌধুরিকে চাপা গলায় বললেন, আজ প্রিয় কমরেড সত্যসুন্দর দাস! যদ্দিন ছিল তদ্দিন তো ওর সঙ্গেও অনঙ্গ বখরা নিয়ে খেয়োখেয়ি করে মরেছে!
দীপক বলল, আর সত্যদাই বা দেবে কেন? অনঙ্গ তো দিনরাত্তির ইউনিয়নের নাম করে ফাঁকি মারে, কাজটা করে আর কখন? আরে বাবা, কাজ না করলে কখনও বখরা পাওয়া যায়। বখরাও যে কষ্ট করে আয় করার জিনিস।
মানব মজুমদার হাসলেন। তাঁর নাকের দুপাশে ভাঁজ প্রকট হল। তিনি এখন সোজা অনঙ্গর দিকে তাকিয়ে। অনঙ্গ তখন বলছেন, এই প্রিয় সতুদাকে নিয়ে আজ যে-অনুষ্ঠান, আমি সেই অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক নবীন সরকারের নাম প্রস্তাব করছি।
প্রথম সারি থেকে কয়েকটি স্বর মিলিতভাবে বলে উঠল, আমরা এই প্রস্তাব সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করছি।
আর বিশেষ অতিথি হিসেবে আমি আমাদেরই প্রাক্তন সহকর্মী কমরেড শ্রীশচীদুলাল কর্মকারের নাম প্রস্তাব করছি।
আবার একইরকম সর্বান্তঃকরণ-সমর্থন পাওয়া গেল প্রথম সারি থেকে। সেই সঙ্গে কিঞ্চিৎ হাততালিও।
একটু পরেই অনঙ্গ নেমে এলেন। শচীদুলালকে সঙ্গী করে এগিয়ে এলেন সরকার সাহেবের দিকে। সরকার সাহেব সভাপতি হওয়ার জন্য অপ্রস্তুত ছিলেন না, সুতরাং, ওঁরা কাছাকাছি এসে পড়ার আগেই বেঞ্চির আসন ছেড়ে উনি বেরিয়ে এলেন বাইরে। তাকে পথ ছেড়ে দিতে সমাদ্দারকেও বাইরে বেরোতে হয়েছিল। ডক্টর সরকার মঞ্চের দিকে এগোতেই সমাদ্দার ফিরে এসে বসলেন পাত্রের পাশে। পরস্পরের চোখাচোখি হল ক্ষণিকের জন্য।
মঞ্চে উঠে সত্যসুন্দরের পাশের চেয়ারটিতে বসলেন ডক্টর সরকার। তার পাশে খালি চেয়ারটিতে বসিয়ে দেওয়া হল শচীদুলালকে। তারপর অনঙ্গ বললেন, সভাপতি হিসেবে মাননীয় ডক্টর সরকারকে আমি কিছু বলতে অনুরোধ করছি
অনঙ্গ নস্কর এবার নিজের আসনে ফিরে গেলেন। সভাপতির ভাষণ শুরু হল।
হলঘরের তিনটে কাচের জানলা। সেগুলো বন্ধ ছিল। কিন্তু দুটো শার্সি ভাঙা থাকায় শীতের হাওয়া ঢুকে পড়ছিল ঘরের মধ্যে। তা ছাড়া একটা কাক এসে বসে পড়েছে ভাঙা জানলার ফ্রেমে। এই কাকটি কলেজ এলাকার বাসিন্দা এবং বিশেষ করে এই ভাঙা জানলাটার প্রতি তার আশ্চর্য টান আছে। ছাত্রছাত্রীরা জানে, ক্লাস চলাকালীনও কাকটি প্রায়শই এসে বসে থাকে। ফলে তারা ঠাট্টা করে বলে, কাকটা হায়ার সেকেন্ডারি পাস। বিএসসি-র ক্লাস করতে এসেছে। সুখের ও স্বস্তির ব্যাপার, কাকটি জানলার বসে মোটেও ডাকাডাকি করে না। চুপটি করে মানুষের কথা শোনে।
নবীন সরকারের চশমা থেকে আলো ঠিকরে পড়ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি তখন বলতে শুরু করলেন ।
সত্যসুন্দরবাবুর পরিচয় আজ আর নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। শুধু বলতে পারি, কলেজের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ একটি খুঁটি সরে গেল। আমাদের ল্যাবরেটরির সমস্ত যন্ত্রপাতি সত্যবাবুর তত্ত্বাবধানে যেরকম সুস্থ ও সবল ছিল তা নিছক নজির হয়ে থাকবে এখন থেকে। তার মতো দক্ষ মেকানিক আমি এর আগে কখনও দেখিনি। তা ছাড়া এই কলেজকে উনি নিজের সংসারের মতো আন্তরিক চোখে দেখতেন। সবসময় বলতেন…।
অশিক্ষক কর্মচারীরা অভিভূত হয়ে বক্তৃতা শুনছিলেন।
তাদের পিছনের সারিতে বসা ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহী চোখে প্রিন্সিপালের দিকে তাকিয়ে। ওরা অল্প-চেনা সত্যদা সম্পর্কে অনেক নতুন-নতুন ঘটনা আজ জানতে পারছে। শ্রদ্ধায় দ্রব হয়ে আসছে। ওদের সুকুমার মন।
কিন্তু একেবারে পিছনের সারিতে ছবিটা অন্যরকম ছিল।
সমাদ্দার চাপা হাসলেন। তাতে অধ্যাপক পাত্র প্রশ্ন করলেন, হাসলেন কেন?
জানেন না, কেন হাসছি! সত্যকে বেলা দুটোর পর কদিন কলেজ চত্বরে পাওয়া গেছে। বলতে পারেন? আমাদের ল্যাবরেটরি থেকেই মাল ঝেড়ে-ঝেড়ে ও নিজের বাড়িতে একটা ইনমেন্ট ওয়ার্কশপ খুলেছেনাকি এ-খবরও রাখেন না?
পাত্র কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, সে কী! ল্যাবরেটরির মালপত্রের কোনও হিসেব নেই? যদি সত্য ধরা পড়ত, তা হলে তো ওর চাকরি নিয়ে টানাটানি হত!
সমাদ্দার ধূর্ত হাসলেন। বললেন, আচ্ছা ভালোমানুষ মশাই আপনি! সরকারি কলেজে আবার মালপত্রের হিসেব থাকে না কী? আর এখানে কে-ই বা ধরা পড়ে, কে-ই বা কার চাকরি খায়। কিছুই বোঝেন না! ওই জন্যেই আপনার ইনক্রিমেন্ট অ্যাদ্দিন ধরে ঝুলে রয়েছে।
নিজের অজ্ঞতায় পাত্র লজ্জা পেলেন। কেমন একটা ভক্ত-ভক্ত ভাব করে তাকালেন প্রভু সমাদ্দারের দিকে। বললেন, সত্যি, আপনি বেশ খবর-টবর রাখেন।
সমাদ্দার হাসলেন। তার পোকায় খাওয়া একজোড়া কষদাঁত দেখা গেল। অবশেষে গলার স্বর নামিয়ে এনে বললেন, সত্যর একটা কালো তাপ্লিমারা ফোলিও ব্যাগ ছিল দেখেননি? ওর ভেতরে থাকত যন্ত্র সারানোর যন্ত্রপাতি। দুটোর পরই ব্যাগ নিয়ে সত্য বেরিয়ে পড়ত। ঘুরে-ঘুরে বিভিন্ন জায়গায় ইনস্ট্রমেন্ট সারাত, নয়তো সারানোর কন্ট্রাক্ট ধরত। ওঃ, প্রচণ্ড ধড়িবাজ!
…সত্যবাবুর আর একটা বড় অ্যাচিভমেন্ট হল, উনি এই কলেজের প্রতিষ্ঠা থেকেই চাকরিতে যোগ দেন, এবং আজ ষাট বছর বয়েসে অবসর নিচ্ছেন। আমাদের কলেজের প্রতিষ্ঠাতা-প্রিন্সিপাল ডক্টর এস. কে. মিত্র নিজে সত্যবাবুকে এই কলেজে নিয়ে আসেন, নিজের হাতে তাকে কাজ শিখিয়েছেন। সত্যবাবুর কাছ থেকেই এসব কথা আমি শুনেছি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ডক্টর সরকার আবার বললেন, খুব খারাপ লাগছে যে আজ উনি অবসর নিচ্ছেন। ফেয়ারওয়েল কথাটা শুনলেই মনে হয় সব সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়ার অনুষ্ঠান। কিন্তু আমি সে-অর্থকে সত্যি বলে মনে করি না। সত্যবাবুকে আমি বলতে চাই, একলেজ তার নিজের কলেজ। উনি যেন কোনওমতেই কলেজের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিন্ন না করেন। আমরা আশা করব, শচীবাবুর মতো উনিও আমাদের আপনার জন মনে করে বরাবর পাশে-পাশে থাকবেন। সত্যবাবুকে আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।
শচীদুলাল মাথা ঝুঁকিয়ে বসেছিলেন। সত্যর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে ভেদাভেদের পাঁচিল তোলা শুরু হল। তবে এরপর সত্য তাঁর মতো কলেজে আসবে না। শচীদুলাল কদিন আগে ওকে জিগ্যেস করেছিলেন। ও বলেছিল, কী করে আসব, শচীদা! আমার কারখানা রয়েছে, নাতি-নাতনি রয়েছে, বড় মেয়েটার বাচ্চা হবে, বাড়ি এয়েছে। না, আমার আসা হবে না।
শচীদুলাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার কারখানা নেই। ছেলেরা ভিন্ন হয়ে গেছে, অতএব নাতি-নাতনিও কাছে নেই। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন জব্বলপুরে। সে শুধু চিঠি লেখে। শচীদুলালের স্ত্রী আছে, পেনশনের টাকা আছে, আর কলেজ আছে। কলেজটাই বেশি করে আছে।
ডক্টর সরকার বক্তৃতা শেষ করে বসতে যাচ্ছিলেন, তক্ষুনি একটা গোড়ে মালা হাতে অনঙ্গ প্রায় ছুটে এলেন তাঁর কাছে। চাপা গলায় কী যেন বললেন। তারপর মালাটা সরকার সাহেবের হাতে ধরিয়ে অনঙ্গ নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন। সরকার সাহেব মালাটা নিয়ে সত্যসুন্দরের গলায় পরিয়ে দিলেন। হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন সত্যসুন্দর। সরকার সাহেব তাঁকে কাঁধে হাত রেখে বসতে বললেন। হলঘরে হাততালির বন্যা বয়ে গেল। ডক্টর সমাদ্দারও হাসিমুখে হাততালি দিলেন।
সত্যসুন্দরের চোখের কোল ভিজে উঠেছে। রুদ্ধস্বরে কোনওরকমে উচ্চারণ করলেন, স্যার, আমি কয়টা কথা বলতে চাই।
ডক্টর সরকার কাঁধে হাত চাপড়ে নরম গলায় বললেন, বলবেন, আগে শচীবাবুর বলা হোক, তারপর।
অনঙ্গ নস্কর উঠে এসে দুটো ফুলের তোড়া নিয়ে তুলে দিলেন শচীদুলালের হাতে।
শচীদুলাল তোড়া দুটো সত্যসুন্দরের হাতে দিলেন। সত্যসুন্দর উঠে দাঁড়িয়ে সামান্য ঝুঁকে সে-দুটো গ্রহণ করলেন। নামিয়ে রাখলেন সামনে, টেবিলের ওপরে। গলার মালাটাও খুলে ফেললেন, রাখলেন তোড়ার পাশে।
ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট নরপতি আর লাইব্রেরি অ্যাসিস্ট্যান্ট হরিশঙ্কর আসন ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। একজন নতুন ধূপের গোছা সতর্ক হাতে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, আর অন্যজন নানান তদারকিতে মনোযোগ দিয়েছে। এই অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কমবয়েসি এই দুটি ছেলে কম দৌড়ঝাঁপ করেনি। অনঙ্গ নস্কর কাছে আসতেই হরিশঙ্কর চাপাগলায় জিগ্যেস করল, অনঙ্গদা, প্রেজেন্টেশানটা কখন দেবেন?
শচীদার বলা শেষ হলেই দেওয়া হবে।
সত্যকে আমি তেইশ বছর ধরে দেখছি..শচীদুলালের ভরাট কণ্ঠ হলঘরের আনাচে-কানাচে বিদ্ধ হয়ে গেল অনায়াসে। ভাঙা জানলায় নিশ্চুপ কাকটি হঠাৎই নড়েচড়ে বসল। একজন ছাত্র হাত বাড়িয়ে দুবার হুস-হুঁস করল, কিন্তু কাকটি সে তাড়ানিকে কোনও আমলই দিল না।
…সতুর মতো বিনয়ী, সৎ, কর্মঠ মানুষ সচরাচর চোখে পড়ে না। গ্যাসট্রিকের গোলমালে মরো-মরো অবস্থায় আমাকে হাসপাতালে ভরতি হতে হয়। তখন এই সতু সত্যসুন্দরের দিকে আঙুল দেখালেন শচীদুলাল, এই সতু তিন-তিনটে রাত আমার বেডের পাশে জেগে বসেছিল। তাতে আমার মনের জোর এত বেড়ে গিয়েছিল যে নিশ্চিত জানতাম আমি বেঁচে উঠব। ওর সেই ঋণ আমি কোনদিনও শুধতে পারব না। না, শুধতে চাইও না। কারণ, কারও কারও কাছে ঋণী থাকার এক অদ্ভুত আনন্দ আছে। আমার মনে পড়ে…।
সত্যসুন্দর মাথা নীচু করে শুনতে লাগলেন। তার বুকের ভেতরে হঠাৎই নির্মম কষ্ট হচ্ছিল। শ্বাসনালীটা যেন আগাপাশতলা ভরতি হয়ে গেছে নোনা জলে। শচীদুলালের আন্তরিক কথাগুলো এক অপূর্ব সম্মোহনপাশে বেঁধে ফেলতে লাগল ঘরের প্রতিটি শ্রোতাকে। সত্যসুন্দরও যেন নতুন করে জানতে পারছেন নিজেকে। কেমন এক সঙ্কোচ, লজ্জা ও পাপবোধ তাঁকে অনুক্ষণ বিব্রত করতে শুরু করল। শচীদা বড় বাড়াবাড়ি করছে। ধূপের সুতীব্র গন্ধ সত্যসুন্দরের সর্দিরা নাকেও ঢুকে পড়ছিল। শীতের হাওয়া কখনও কখনও আঁচড় কাটছে তাঁর রুক্ষ ত্বকে। সত্যসুন্দরের ঝিমুনি আসছিল ক্রমশ।
পিছনের সারিতে অধ্যাপক মানব মজুমদার দীপকের উরুতে টোকা মারলেন। দীপক একমনে শচীদুলালের বক্তব্য শুনছিল, টোকার স্পর্শে ফিরে তাকাল। চোখে নীরব প্রশ্ন। মানব মজুমদার প্রায় ফিসফিসে গলায় বললেন, শচীর অসুখের সময় ওকে দেখতে যাওয়ার নাম করে সতু পাঁচ-ছ দিন সই করেই কেটে পড়েছিল। আর এখন তো শুনলে, ব্যাটা মাত্র তিন রাত্তির জেগেছিল।
আশপাশের আরও কয়েকজন মাস্টারমশাই কৌতূহলী হয়ে মানব মজুমদারের কথা শুনছিলেন। তাঁরা সকলেই মুচকি হেসে উঠলেন।
পিছনের সারির চাঞ্চল্য অনেকক্ষণ ধরেই শচীদুলালের নজরে পড়ছিল। ফলে এক অচেনা অস্বস্তি তার মনের ভেতরে জন্ম নিচ্ছিল। ওই চাঞ্চল্যের কারণ কি শচীদুলাল আঁচ করতে পারছেন না? ব্যাপারটা সত্যসুন্দরের নজরও এড়িয়েছে বলে মনে হয় না। এরকম একটা মানবিক অনুষ্ঠানে এ-ধরনের অমনোযোগ বেশ দৃষ্টিকটু। শচীদুলাল নিজের বক্তব্যের শেষ অংশটুকু গুছিয়ে নিচ্ছিলেন মনে-মনে। অস্বস্তিটুকু ঝেড়ে ফেলে সেটাই বলতে লাগলেন তিনি।
..সত্যর অভাব কোনওদিন পূরণ হওয়ার নয়। ওকে ভুলে যাওয়া আমাদের কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। ওর সুস্থ জীবন কামনা করে আমি আমার কথা শেষ করছি।
শচীদুলাল বসে পড়লেন চেয়ারে। বুকের ভেতরে হাঁফ ধরে গেছে তার। পেটে চিনচিন ব্যথা। অ্যান্টাসিড ট্যাবলেটটা সময়মতো খেতে ভুলে গেছেন।
সরবে হাততালি শুরু হয়েছিল শচীদুলাল বক্তব্য শেষ করার সঙ্গে-সঙ্গেই। এখন অনঙ্গ নস্কর মঞ্চে এসে হাতের ইশারা করতেই হাততালি ও কলগুঞ্জন স্তব্ধ হল।
অনঙ্গ গলার স্বরকে সামান্য খাদে নামিয়ে আস্তে-আস্তে বললেন, এখন কমরেড সত্যসুন্দর দাসকে আমাদের সকলের তরফ থেকে একটি ক্ষুদ্র উপহার দেওয়া হবে। উপহার তার হাতে তুলে দেবেন কমরেড শচীদুলাল কর্মকার।
লাইব্রেরিয়ান অরুণ সামন্ত তাঁর পাশে বসা টাইপিস্ট দ্বিজেন ঘোষকে বিরক্তির স্বরে বললেন, কথায় কথায় কমরেড জুড়ে দেওয়াটা অনঙ্গর রোগে দাঁড়িয়ে গেছে।
দ্বিজেন ঘোষ অনঙ্গকে একদম দেখতে পারে না। তা ছাড়া সে একটু ফিচেল স্বভাবের। সুতরাং অরুণবাবুর কথায় সে বলে উঠল, আচ্ছা অরুণদা, অনঙ্গটা ওর বউকে কী বলে ডাকে জানেন? সেখানেও কি কমরেড জুড়ে দেয়? চোখে সামান্য অর্থপূর্ণ ইশারা করে দ্বিজেন আরও বলল, মানে ওর বউও তো ওর সহকর্মী কিনা।
দ্বিজেনের পাশে বসা অ্যাকাউন্ট ক্লার্ক হীরেন মণ্ডল পানের ছোপধরা দাঁত বের করে ফিকফিক করে হাসতে লাগল। অরুণ সামন্ত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সেই মুহূর্তেই অনঙ্গ রঙিন কাগজে মোড়া লাল ফিতে বাঁধা একটা ছোট প্যাকেট শচীদুলালের হাতে তুলে দিলেন। শচীদুলাল সেটা সত্যসুন্দরের হাতে দিলেন। সত্যসুন্দর উপহার হাতে নিয়ে যথাক্রমে শচীদুলাল, ডক্টর নবীন সরকার এবং সমবেত দর্শকমণ্ডলীকে উদ্দেশ করে মাথা অবনত করে নমস্কার জানালেন। তারপর শ্লেষ্মধরা খসখসে গলায় বললেন, আমার সহকর্মীরা কয়েকদিন আগে আমাকে জিগ্যেস করতে গিয়েছিল আমার কোন উপহার পছন্দ। তা আমি বলেছিলাম কিছুই আমার চাই না। ভগবানের আশীর্বাদে কোনওকিছুরই তো অভাব নেই। যাই হোক, তবু তারা যখন আমাকে ভালোবেসে এই উপহার দিল তখন আমি সেটা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করছি। আমার জীবনে…।
অনঙ্গ মঞ্চের দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন। চাপা স্বরে সত্যসুন্দরকে বললেন, আঃ, সতুদা, আপনার বক্তৃতা পরে, সবার শেষে। এখন বসুন তো!
সত্যসুন্দর কেমন থতথত খেয়ে বসে গেলেন। ডক্টর সরকার অনঙ্গকে কী একটা বলে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। নিজের আসনে গিয়ে বসলেন। অনঙ্গ দর্শকদের লক্ষ করে বললেন, এখন সত্যদা সম্পর্কে আপনাদের মধ্যে কারও যদি কিছু বলার থাকে একে-একে এসে বলতে পারেন…।
সঙ্গে-সঙ্গে অশিক্ষক কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ দেখা গেল। চারজন পালা করে উঠে গিয়ে সহকর্মী সত্যসুন্দর দাস সম্পর্কে বক্তব্য রাখলেন। চরিত্রে বক্তৃতাগুলো প্রায় একইরকম। কিছু-কিছু পুরোনো ঘটনার স্মৃতিচারণ, প্রতিষ্ঠাতা-প্রিন্সিপাল ডক্টর মিত্রের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং ফাঁকে-ফাঁকে বক্তার চারিত্রিক গুণাবলীর কিছু কিছু প্রকাশ করা। কারও কণ্ঠস্বর অতি মৃদু, কেউ বা বারবার যুক্তাক্ষর উচ্চারণ করতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছিলেন, কেউ আবার আবেগ ঝরিয়ে একাকার করে দিলেন।
বিচিত্র তথা বিচিত্রতর বক্তৃতাগুলো শুনতে-শুনতে অধ্যাপকবৃন্দ যথেচ্ছ টিপ্পনী কাটছিলেন। দীপক শুধু একবার বলল, মানবদা, যাই বলুক যেভাবেই বলুক, ওদের কথাগুলো কিন্তু খুব আন্তরিক। তাতে দু-তিনজন সঙ্গে-সঙ্গে ঝঝিয়ে উঠলেন, ওসব আন্তরিক-ফান্তরিক নয়। আসলে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পেলে কে ছাড়!
এ কথা শুনেই দীপক কী একটা বলতে গেল, কিন্তু ঠিক সেই সময়েই অশিক্ষক কর্মচারীদের কয়েকজন পিছনের দিকে এসে অধ্যাপকদের অনুরোধ করতে লাগলেন কিছু বলার জন্য। কিন্তু প্রত্যেকেই তাঁর পাশের লোককে কিছু বলার জন্য উৎসাহ দিতে লাগলেন। সুরেন পাত্র কলেজের সকল মহলেই বেশ জনপ্রিয়। সুতরাং বক্তৃতা দেওয়ার অনুরোধ চাপ তার ওপরেই আসতে লাগল সবচেয়ে বেশি। অগত্যা তিনি রাজি হয়ে ডায়াসের দিকে গেলেন।
ক্লাসে লেকচার দেওয়ার অভ্যস্ত ভঙ্গিতে পাত্র কথা শুরু করলেন। টেবিলের ওপর একহাতের ভর রেখে তিনি জোরালো অথচ হিসেবি গলায় বললেন, আমি শুধু একটা ঘটনার কথাই বলব, যে-ঘটনার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে সত্যবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ। অধ্যাপক পাত্র তাকালেন সত্যসুন্দরের দিকে। সত্যসুন্দর মাথা নামিয়ে বসে আছেন। পাত্র আবার বলতে শুরু করলেন, ঘটনাটা সত্যবাবুর কাছে খুবই তুচ্ছ হয়তো তার মনেও নেই। তবু আমার তরফ থেকে সেটা খুবই দামি। আজকের দিনে সবাইকে সেটা জানাতে পারলে আমার ভালো লাগবে…
তিনি বললেন, কীভাবে সত্যসুন্দর তার গবেষণায় একটি যন্ত্র তৈরি করে দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করেছিলেন। কথা শেষ করে পাত্র দ্রুত পায়ে মঞ্চ থেকে নেমে ফিরে এলেন নিজের আসনে।
হলঘরে এখন গুঞ্জন চলছে। সম্ভবত আরও কোনও বক্তা আছেন কি না তারই খোঁজ-খবর অনুরোধ-উপরোধ ইত্যাদির চেষ্টা হচ্ছে। অনঙ্গ নস্কর ব্যস্ত পায়ে এপাশ-ওপাশ ঘুরছেন। অধ্যাপকেরা উশখুশ করছেন। নরপতি আবার একগোছা ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দিল ডক্টর মিত্রের ছবির সামনে।
হঠাৎই করতালির শব্দে সকলে চোখ তুলে মঞ্চের দিকে তাকালেন। অনঙ্গ নস্কর সত্যসুন্দরের পাশে গিয়ে তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। বললেন, যাঁকে নিয়ে আজকের অনুষ্ঠান তিনিই আমাদের আসরের শেষ বক্তা।
সত্যসুন্দর বেঁটেখাটো মানুষ। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, তার ওপরে একটা তুষের চাদর। মাথার চুল ধবধবে সাদা এবং কিছুটা পাতলা হয়ে এসেছে। কপালে, গালে, থুতনিতে, গলায়, সর্বত্রই ছেয়ে আছে বয়েসের বলিরেখা। গত কয়েকটা ঘণ্টা যেন তাকে আরও বৃদ্ধ করে দিয়েছে।
অনঙ্গ মঞ্চ ছেড়ে নেমে যেতেই শচীদুলালও চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। সতুর বক্তব্য মুখোমুখি বসে শুনবেন বলে প্রথম সারির বেঞ্চিতে জায়গা করে নিলেন তিনি। নিজের ফেয়ারওয়েলের দিনটা আবার তার মনে লম্বা ছায়া ফেলছিল।
একঝলক শীতের বাতাস ঘরে ঢুকতেই জানলার বসা কাকটা চাপা গলায় কাকা করে দুবার ডেকে উঠল। সেটা সকলকে চুপ করতে বলার নির্দেশ কিনা বোঝা গেল না।
থমথমে নিস্তব্ধ হলঘরে সমবেদনা ও সহানুভূতির অনুকণা ভেসে বেড়াচ্ছিল, তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল ঘন ধূপের গন্ধ। সকলে অপেক্ষা করছিলেন। সেই অপেক্ষাকাতর মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে সত্যসুন্দরের গলার কাছটা জ্বালা করতে লাগল। উপহারের ছোট বাক্সটা গাঁটসর্বস্ব আঙুলের প্রাণান্ত বাঁধনে আঁকড়ে ধরে সত্যসুন্দর উঠে দাঁড়ালেন। হাতজোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে তিনদিকে ফিরে তিনবার নমস্কার করলেন। তারপর মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলেন ডক্টর মিত্রের ছবির কাছে। মাথা ঝুঁকিয়ে দীর্ঘ প্রণাম জানিয়ে সোজা হলেন। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে ছবির দিকে ইশারা করে ভাঙা উচ্চারণে বললেন, আমার বাবা!
বাষ্প জমাট বেঁধে সত্যসুন্দরের চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে অশ্রু মোছার চেষ্টা করলেন তিনি। তারপর আবার ফিরে গেলেন মঞ্চে, নিজের চেয়ারের সামনে।
ঘরে উপস্থিত সকলের ওপরে একবার ঝাপসা চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর খসখসে গলায় বললেন, ছেলেবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। ডক্টর মিত্রের পাড়ার ইলেকট্রিকের দোকানে কাজ করতাম। তখন বয়েস কত হবে, পনেরো। মিত্র সাহেব একদিন আমাকে বললেন, সতু, নতুন কলেজ হচ্ছে। তোমাকে সেখানে চাকরি করতে হবে। তুমি হবে ইনস্ট্রমেন্ট মেকানিক। ডক্টর মিত্রকে আমি বাবার মতো দেখতাম। বুঝলাম, তিনি যা করবেন তাতে আমার ভালোই হবে। তাই ওই দেবতার কথায় রাজি হয়েছিলাম। পনেরো বছর বয়েসে ঢুকে পড়লাম এই কলেজে। আজ পঁয়তাল্লিশ বছর চাকরির পর বিদায় নিচ্ছি।
মানব মজুমদার মন্তব্য করলেন, বাঁচা গেল! নইলে ল্যাবরেটরির মালপত্রের হিসেব রাখতে রাখতে আমার জান কয়লা হয়ে যেত, দীপক।
দীপক বোধহয় অন্যমনস্ক ছিল। তাই অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে উঠলো, সত্যদা পঁয়তাল্লিশ বছর চাকরি করেছে। শুনলে বিশ্বাসই হতে চায় না।
তাতে বিরক্ত হয়ে মানব মজুমদার বললেন, কথায় কথায় অবাক হওয়াটা আজকের যুবকদের একটা রোগ। তুমি জানো, সতুর আসল বয়েস কত? চৌষট্টি বছর। সে আমলে তো আর বার্থ সার্টিফিকেটের চল ছিল না। যে বয়েস কলেজের খাতায় লেখাবে সেটাই থেকে যাবে। তা এই চার বছর এক্সট্রা চাকরি করে লোকটা কত টাকা সরকারকে ঠকাল বলো তো? প্রায় সত্তর হাজার টাকা! একি মুখের কথা।
দীপক প্রতিবাদ করতে গিয়েও চুপ করে গেল। কারণ ওর মনে পড়ে গেছে, ওর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার সার্টিফিকেটে যে বয়েস লেখা আছে সেটা আসল বয়েসের চেয়ে দেড় বছর কমানো। তার মানে রিটায়ারমেন্টের সময় ও সরকারকে হাজার তিরিশেক টাকা ঠকাবে? কথাটা ভাবতেই কেমন খারাপ লাগল। পাশে বসা মানব মজুমদারকে ও দেখতে লাগল। ওঁর সার্টিফিকেটে কত বছর কমানো আছে কে জানে!
সরকারকে ঠকিয়ে সত্তর হাজার টাকা আত্মসাৎ করা লোকটা তখন বলে চলেছে, এই কলেজের জন্যে আমি রক্ত দিয়েছি। কথার কথা নয়, সত্যিকারের রক্ত। কারণ কলেজের সমস্ত ওয়্যারিং আমি নিজেই করেছিলাম। তখন হাতে তার ফুটে গিয়ে দু-দিন রক্ত বেরিয়েছিল। ওই মহাপুরুষ ডক্টর মিত্র বলতেন, সতু, এ তোমার নিজের ঘর-বাড়ি। এর কোথাও যেন কোনও কিছুর খামতি না থাকে লক্ষ রেখো। দিন-রাত তিনি থাকতেন আমার পাশে পাশে। সবসময় উৎসাহ দিতেন। তখন তো কলেজে এত লোকজন ছিল না। সব মিলিয়ে আমরা ছিলাম সাতজন।
সমাদ্দার যেন সত্যসুন্দরের কথাগুলো আর সহ্য করতে পারছিলেন না। চাপা গলায় বিষ ঢাললেন, দু-ফোঁটা রক্ত দিয়ে পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে কলেজের রক্ত চুষে গেছে। এস. কে. মিত্তিরকে মা-বাপ করেই যা পেরেছে লুটেপুটে খেয়েছে।
নবীন সরকার সামান্য মুখ ঘুরিয়ে সমাদ্দারকে একবার দেখলেন শুধু। কিছু বললেন না। তাতে সমাদ্দার কিছুটা সাফাইয়ের সুরে বললেন, না স্যার, প্রতিষ্ঠাতা-প্রিন্সিপালকে দেবতা বানিয়ে অন্যান্য প্রিন্সিপালদের ছোট করার চেষ্টা ঠিক নয়।
নবীন সরকারকে তা সত্ত্বেও নীরব দেখে সমাদ্দার চুপ করে গেলেন। ওপাশ থেকে পাত্র চকিতে দুজনকেই দেখে নিলেন।
আজ আমার জীবনে কোনও অভাব নেই। নিজের কারখানা আছে, কলকাতার বুকে ছোট্ট একটা বাড়িও করেছি। ভালো-ভালো ঘরে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি–আর কী চাই? তবে এসবই মহাপুরুষ ডক্টর মিত্র ছবির দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকালেন সত্যসুন্দর আর আপনাদের সকলকার আশীর্বাদে। পঁয়তাল্লিশ বছরে আমার সহকর্মীদের যে-ভালোবাসা পেয়েছি তা ভোলবার নয়। আমি অশিক্ষক কর্মচারী–অশিক্ষিতও বটে। কিন্তু মাস্টারমশাইয়েরা কখনও আমার সঙ্গে ওপরওয়ালা হয়ে ব্যবহার করেননি। আমার পিতা মিত্ৰসাহেবের কাছেই আমি যা কিছু শিখেছি। উনি বলতেন, সতু, সব কিছুর পিছনে একটা কেন আছে। সেটাকে জানতে শেখ। যন্ত্রপাতি খারাপ করে ফেললে উনি কখনও রাগ করতেন না। বলতেন, খারাপ কেন হল সেটা আগে জানো, বোঝো– তারপর নিজেই যন্ত্রটা সারাও। তা হলে আর কখনও খারাপ হলেই সর্বনাশ এ-ভয় মনে থাকবে না। দক্ষ কারিগর বলে আপনারা আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন তা আমরণ মাথায় করে রাখব…
কপালে হাত ঠেকালেন সত্যসুন্দর। তার প্রকট কণ্ঠা তৃষ্ণার্ত মানুষের মতো চঞ্চল হয়ে ওঠানামা করছিল। মনের ভেতরের খচখচানির কাঁটাটা ক্রমাগত বিধছে। পিছনের সারিগুলোয় কিছু উশখুশুনি, চাপা হাসি, সবই তার নজরে পড়ছিল। কথা বলতে বলতে তিনি যেই থেমেছেন অমনি হলঘরে করতালির ফোয়ারা ছুটল। অর্থাৎ সবাই ভেবেছেন সত্যসুন্দরের বলা শেষ। অনুষ্ঠানও শেষ। সত্যসুন্দরের মনে হল করতালির শব্দগুলো যেন তাঁর বলিরেখামাখানো ভাঙা গালে অবিরত চড় মারার শব্দ। মনের ভেতরের ঘূণপোকাগুলো সেই মুহূর্তে তার হৃদয়ে কামড় বসাল।
দীপক রায়চৌধুরী তার সামনের সারির অধ্যাপকদের সঙ্গে তখন আলোচনায় ব্যস্ত ছিল। আলোচনায় বিষয় হল, ইনস্ট্রমেন্ট মেকানিকের চাকরি করে কলকাতার বাড়ি করা সম্ভব কি না। হঠাৎই সত্যসুন্দরের কথায় ওরা চমকে উঠল।
আমার বলা এখনও শেষ হয়নি!–খসখসে ধরা গলায় চিৎকার করে বললেন সত্যসুন্দর। হাত তুলে সবাইকে বসতে ইশারা করলেন। চাদরটাকে ঠিক করে জড়িয়ে নিলেন গায়ে। তার গলার স্বরে এমন একটা কিছু ছিল যে, হলঘরের প্রতিটি মানুষ স্তব্ধ হয়ে গেল। এত স্তব্ধ যে ধূপকাঠি পুড়ে যাওয়ার শব্দও বুঝি স্পষ্ট শোনা যাবে।
শচীদুলালের ভুরু কুঁচকে উঠল। অনঙ্গর চোখেও সংশয়। সত্যসুন্দর হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। হাতের পিঠ দিয়ে অযথাই চোখ মোছার চেষ্টা করতে লাগলেন। অনঙ্গ উঠে এগিয়ে যেতে চাইছিলেন, শচীদুলাল ইশারায় তাকে বারণ করলেন।
সকলেরই মন ভারী হয়ে উঠছিল এই বৃদ্ধের কান্নায়। জানলায় বসা কাকটা ঘাড় বেঁকিয়ে অবাক চোখে সত্যসুন্দরকে দেখছিল।
কান্নার আবেগ সামলে সত্যসুন্দর জড়ানো ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলতে শুরু করলেন, আপনারা অনেকেই আজ আমার সম্পর্কে অনেক ভালো-ভালো কথা বললেন। যেসব ঘটনার কথা শচীদা, অধ্যাপক পাত্র বা প্রিন্সিপাল সাহেব বলেছেন সেগুলো মিথ্যে নয়। কিন্তু আপনাদের এত শ্রদ্ধা-ভালোবাসার যুগ্যি মানুষ নই আমি।
সত্যসুন্দরের গলার শিরা ফুলে উঠছিল। ছানিপড়া ঘোলাটে চোখ এখন দু-টুকরো কয়লার মতো দপদপ করে জ্বলছে। নাকের দুপাশে বহতা অশ্রুর দাগ। আবার বলতে লাগলেন, কলেজের কাজে আমি অনেক ফাঁকি দিয়েছি। কলেজের ল্যাবরেটরি থেকে…।
সত্যসুন্দর ভূতে পাওয়া মানুষের মতো বলে চললেন অনর্গল। সকলে শুনতে লাগল তার অন্যায়-অবিচার আর পাপের কাহিনি। সামনের সারি থেকে শুরু করে শেষ সারি পর্যন্ত কোথাও কোনও শব্দ নেই, কোনও চাপা হাসি নেই, কোনও সন্দিহান কুটিল নজর নেই। সত্যসুন্দরের কথাগুলো জ্বলন্ত লাভাস্রোত হয়ে প্রত্যেকের কানে ও মরমে ঢুকে যেতে লাগল নিষ্ঠুরভাবে।
…এত মিথ্যা প্রশংসা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। এখনও যদি আমি প্রতিবাদ না করি, সত্যি কথা না বলি তা হলে বাবার কাছে আমি ছোট হয়ে যাব।–ডক্টর মিত্রের ছবিটাকে ইশারায় দেখালেন উদভ্রান্ত সত্যসুন্দর। বললেন, আজ এখানে আমার শেষ দিন। শেষ দিনে সত্যি কথা বলতে কাকে আমার ভয়! আমার সহকর্মীরা, শ্রদ্ধেয় মহান মাস্টারমশাইরা, প্রত্যেকে ভালো করেই, জানেন কত পাপ আমি করেছি…।
ঘরের প্রতিটি মানুষ পরস্পরের দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছিল। সত্যসুন্দরের মুখোমুখি বসে তারা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারছিল তারা কত অসহায়। শচীদুলালের পেটের চিনচিনে ব্যথাটা ক্রমে বুকের কাছে উঠে আসছিল। সতুটা কি পাগল হয়ে গেল? কীসব যা তা বকছে! কিন্তু কই, শচীদুলাল তো উঠে গিয়ে ওর মুখ চেপে ধরতে পারছেন না।
সত্যসুন্দরের কষ্টটা ক্রমশ হালকা হচ্ছিল, এবং একইসঙ্গে গলে যাওয়া ব্যথা অশ্রুধারা হয়ে তার আঁকিবুকি কাটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। গলার স্বরে কান্না মিশে গিয়ে কথাগুলো অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হয়ে যাচ্ছে। ছোট নাতনিটার কথা মনে পড়ছিল তাঁর। বাড়ি থেকে আসার সময়ে জিগ্যেস করছিল, দাদু আজ তোমার ফেয়ারওয়েল ফেয়ারওয়েল মানে কী?
সত্যিই তো, ফেয়ারওয়েল মানে কী? ফেয়ারওয়েলের দিনটাই কি কোনও মানুষের চরম অপমানের দিন? একটা বৃদ্ধ মানুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে হরেকরকম মিথ্যের ফাঁস এঁটে দেওয়া হয় তার গলায়, সঙ্গে থাকে উপহারের বোঝা। বৃদ্ধের সাধ্য কি ফাসবদ্ধ গলা দিয়ে কোনও স্বর বের করে। সুতরাং হাজারো মিথ্যে মুখ বুজে সয়ে যায় সে। মন ভারী হয়, চোখ ভিজে যায়, কিন্তু বুকের ভেতরের মানুষটা? সে যে দমবন্ধ হয়ে ছটফট করে মরে।
সত্যসুন্দর বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিলেন। ধূপের গন্ধ এখন আরও মোহনীয় হয়ে উঠেছে। সঙ্গে মিশে গেছে টাটকা রজনীগন্ধার সুবাস। পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখ মুছলেন সত্যসুন্দর। ঘরের সবকটা মানুষ পাথরের মূর্তির মতো চুপচাপ। ওরা সবাই কি যার-যার ফেয়ারওয়েলের দিনটার কথা ভাবছে?
…যা সত্যি তাই আপনাদের এতক্ষণ ধরে আমি বললাম। যদি কোনও অন্যায় করে থাকি মার্জনা করবেন।-খাটো শরীরটা ঝুঁকিয়ে আবার সবাইকে নমস্কার জানালেন সত্যসুন্দর। শরীরটা কেমন ঝরঝরে লাগছে! মনটাও খুশি-খুশি!
বাইরে শীতের বিকেল পড়ে আসছে। বাতাসে ঠান্ডা বেড়ে উঠছে ক্রমশ। জানলায় বসা কাকটা গলা ছেড়ে ডেকে উঠল, কাকা।
সত্যসুন্দর চোখ ফিরিয়ে দেখলেন, জানলায় একটা অপরূপ লালমোহন পাখি বসে আছে। মিষ্টি সুরে ডাকছে। চকচকে চোখে দেখছে তাকে। ছোট নাতনিটার কথা মনে পড়ছিল সত্যসুন্দরের। দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। মেয়েটা তার দাদুর জন্য রোজই পথ চেয়ে বসে থাকে। আজ ওকে গিয়ে বলতে পারবেন, ফেয়ারওয়েলের মানে কী। নিজের মুখোমুখি বসে এক নিষ্ঠুর অথচ সহজ হিসেবনিকেশের পালা।
সত্যসুন্দর মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। হলঘরের একটা মানুষও এখন তার দিকে তাকাতে পারছে না। যেন তার চোখে চোখ পড়লেই ওরা ভস্ম হয়ে যাবে।
ওরা যদি তাকাত তা হলে দেখতে পেত সত্যসুন্দরকে তখন কত সুন্দর দেখাচ্ছিল।