বিদায় দে মা ঘুরে আসি – ৫

অবশেষে সত্যি-সত্যিই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লেগে গেল। তিন ডিসেম্বর। পাকিস্তানি রেডিওতে বলা হল : তিন ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটেয় ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী পশ্চিম ‘পাকিস্তানের শিয়ালকোট, চম্ব, লাহোর— এসব জায়গায় স্থল ও বিমান আক্রমণ শুরু করে। সুতরাং পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীকেও বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার জন্য ভারতীয় সীমান্তের কতকগুলো জায়গায় পালটা আক্রমণ করতে হয়। অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে বলা হল : পাকিস্তানই প্রথম আক্রমণ করেছে বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। তারা ভারতের খেমকারান, অমৃতসর, শ্রীনগর, যোধপুর, আগ্রা— এসব জায়গায় স্থল ও বিমান হামলা চালিয়েছে।

প্রথম আক্রমণ যে-ই করুক না কেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ যে শুরু হয়ে গেছে, তাতে আর সন্দেহ রইল না। কেননা সকাল থেকেই দেখা গেল; ঢাকার আকাশে ভয়ানক কড়কড় শব্দে প্লেন উড়ে যাচ্ছে। ভারতীয় প্লেন দেখামাত্র তীব্র-স্বরে এয়ার রেইড সাইরেন বেজে উঠছে। শব্দে চারদিক ঝালাপালা।

মা ভেতরে ভেতরে খুব উত্তেজনা বোধ করেন। যুদ্ধ তাহলে সত্যিসত্যি লেগেছে। রেডিওতে খানিক পরপরই ঘোষণা করা হচ্ছে : সাইরেন শুনলে কীভাবে নিকটবর্তী ট্রেঞ্চ কিংবা বাড়ির সিঁড়ির নিচে আশ্রয় নিতে হবে, কীভাবে দুই হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে উবু হয়ে বসতে হবে— এই সব নির্দেশ। আরো কত রকমের নিষেধবাণী। কিন্তু ঢাকার লোকেরা ওসব সাইরেন, বিধিনিষেধ কিছুই মানছে না। এয়াররেইড সাইরেন শোনামাত্র সবাই দৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে আর ছাদে উঠে যাচ্ছে। সবার ধারণা, ভারতীয় প্লেন বেসামরিক লোকবসতির ওপর বোমা ফেলবে না। তাদের লক্ষ্য কেবল ক্যান্টনমেন্ট আর ঢাকা বিমানবন্দর। তাই সবাই ভারতীয় প্লেন দেখতে, আকাশ-যুদ্ধ দেখতে রাস্তায় আর ছাদে ভিড় জমাচ্ছে। মা-ও মাঝে মাঝে ছাদে ওঠেন আকাশ-যুদ্ধ দেখতে। শরীফ আর জামী তো প্রায় সর্বক্ষণই ছাদে। মা বেশি সময় ছাদে থাকতে পারেন না, কারণ সংসারের কাজকর্ম আছে। অন্ধ শ্বশুরের দেখাশোনা আছে। তা ছাড়া আরো হাজারটা কাজ আছে। যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গেসঙ্গে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে সকাল পর্যন্ত পূর্ণ নিষ্প্রদীপ পালন করতে হচ্ছে। সেজন্য ঘরের ভেতরের বাল্‌বে কালো কাগজের শেড পরাতে হবে। বাতি জ্বাললে যাতে আলোর রেখা জানালা দিয়ে ঘরের বাইরে না যায়। তাছাড়া, জানালার কাছে কাগজের ফালি আঠা দিয়ে সাঁটতে হবে। বোমা পড়লে যাতে কাচ ভেঙে ছিটকে ঘরে ছড়িয়ে লোকজন জখম না করে। এসব কাজে মাকে সাহায্য করে ভাগনে লুলু।

.

যুদ্ধ ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। এয়াররেইড সাইরেনও ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে। আকাশে ভারতীয় ও পাকিস্তানি প্লেনের যুদ্ধও ঘন ঘন দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, বেসামরিক এলাকায় সত্যিসত্যিই কোনো বোমা পড়ছে না। কিন্তু একেবারেই যে পড়বে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী? অত উঁচু থেকে কি সামরিক-বেসামরিক এলাকা অত হিসেব ক’রে বোমা ফেলা সম্ভব? দু-চারটে ছিটকেও তো এসে পড়তে পারে? তাই মা দুদিন পরেই বাবাকে বললেন, একতলার সিঁড়ির নিচে সবার শোয়ার ব্যবস্থা করে ফেলতে। যুদ্ধকালীন সময়ে এইটাই নিয়ম। বোমাবর্ষণের সময় সিঁড়ির নিচটাই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা।

বাবা, জামীকে সঙ্গে নিয়ে ঘণ্টা দুয়েক কাজ করে সব ঠিক করে ফেললেন। দোতলা থেকে দুটো খাট নামিয়ে জোড়া দিয়ে বেশ বড় বিছানা পাতা হল— যাতে বাবা, মা, জামী, জামীর দাদা সবাই পাশাপাশি শুতে পারেন। দাদা চোখে দেখেন না, তাঁর বসবার ইজিচেয়ারটাও নিচে আনা হল। দিনের বেলা তিনি ওটায় বসে থাকবেন।

ঢাকায় বিমান হামলা ছাড়াও দেশের সর্বত্র রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, ফেনী, সিলেট— সব জায়গায় যেভাবে যুদ্ধ চলছে, তাতে মুক্তিবাহিনীর ঢাকায় ঢুকে পড়তে আর দেরি নেই। বাবা রোজ স্বাধীন বাংলা বেতার, বিবিসি, আকাশবাণী এসব শোনেন, রোজ চার-পাঁচটা খবর-কাগজ পড়ে খবর বিশ্লেষণ করেন। মাকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক ক’টা দল বিভিন্ন দিক দিয়ে ঢাকার পানে এগোচ্ছে। খুব শিগগিরই তারা ঢাকায় ঢুকবে। তখন রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। তখন আমরা যারা শহরের মধ্যে আছি— আমাদেরকে ওদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। যুবক ছেলেরা ওদের সঙ্গে যোগ দেবে পথ-যুদ্ধে, আমরা বয়স্করা ওদের খাবারের যোগান দেব। ওরা জখম হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করব, ওষুধ তৈরি রাখব। তুমি কিন্তু এখন থেকেই চাল, ডাল, আলু, বিস্কুট এসব কিনে রাখতে শুরু কর। এইসঙ্গে টিংচার আয়োডিন, বেঞ্জিন, তুলো, ব্যান্ডেজের কাপড়—’

মা বাধা দিয়ে হেসে বলেন, ‘এসব জিনিস তো কবে থেকেই একটু-একটু করে কেনা হচ্ছে। ঘরের মেঝেয় সব টাল হয়ে রয়েছে। সোয়েটার, সোজা, মাফলার, ওষুধ যে এত কিনলাম, তাও তো কেউ নিতে এল না। সব পড়ে আছে।’

বাবা বলেন, ‘পড়ে থাকবে না, পড়ে থাকবে না। ঢাকায় কতদিন যুদ্ধ চলবে কে জানে? তোমার সোয়েটার, মোজা মাফলার, ওষুধ-পত্র সব কাজে লেগে যাবে, দেখো।’

.

মা রোজ একটু-একটু করে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, বিস্কুট কেনেন আর ঘরে এনে স্তূপাকার করেন। আর প্রতীক্ষা করে থাকেন কবে মুক্তিবাহিনী এসে ঢাকায় প্রবেশ করবে। জামী প্রতীক্ষা করে থাকে কবে সে একটা স্টেনগান হাতে নিয়ে রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়বে, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ করবে। ভাইয়া যখন যুদ্ধে যায় তখন সেও যাবার জন্য জেদ ধরেছিল। কিন্তু দুইভাই একসঙ্গে চলে গেলে জামীর বুড়ো, অন্ধ দাদাকে বুঝ দেওয়া সম্ভব হবে না। পাড়ার লোকেও সন্দেহ করবে। এইসব চিন্তা করে তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। এখন সে দিন গুনছে কখন যুদ্ধে যোগ দিতে পারবে। কিন্তু যুক্তিযোদ্ধারা যে আসছে না। এদিকে ঢাকার জীবন একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছে। প্লেনের কড়কড় শব্দ, সাইরেনের তীক্ষ্ণ চিৎকার ঢাকাবাসীর গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু ক’দিন থেকে কী যে উলটোপালটা কারবার আরম্ভ হয়েছে। যখন-তখন সরকার কারফিউ দিচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত কারফিউ তো আছেই, তারপর দিনেও প্রায়ই কয়েকঘণ্টার জন্য কারফিউ দিচ্ছে। ১২ ডিসেম্বর সারাদিনই কারফিউ উঠল না। মা, বাবা কেউই বুঝতে পারছেন না কেন দিনের বেলাতেও এইরকম এলোপাতাড়ি কারফিউ দেওয়া হচ্ছে। জামী ছাদ থেকে লক্ষ করেছে কারফিউয়ের মধ্যেই রাস্তা দিয়ে সাদা রঙের অনেক মাইক্রোবাস যাতায়াত করে। ওগুলো তো মিলিটারি-গাড়ি নয়। তাহলে কী কাজে ওগুলো কাথায় যাতায়াত করে? জামীরা কেউ টের পায়নি। ওদের কল্পনাতেও আসেনি, কেন অত প্লেনের আনাগোনা, বোমাবর্ষণ, কারফিউয়ের মধ্যেও বেসামরিক মাইক্রাবাস, মোটরগাড়ি চলাচল করছে। ওইসব গাড়িতে করে তখন রাজাকার-আলবদরের ছোট-ছোট দল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে তাঁদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর রায়ের বাজারের একটা জায়গায় গুলি করে মেরে ফেলে দিচ্ছে। মা, বাবা, জামীর আর কোনো কাজ নেই। কারফিউ থাকলে বাসার মধ্যে। কারফিউ উঠলে মা যান বাজারে, বাবা অফিসে, জামী বাসায় থেকে দাদার দেখাশোনা করে। কাজের লোকজন সেই কবেই চলে গেছে। নিজেদের কাজ নিজেদেরই করে নিতে হয়।

১৩ ডিসেম্বর বিনা মেঘে বজ্রপাত। দুপুর দুটোর দিকে হঠাৎ বাবার বুকে ব্যথা শুরু হল, সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। খবর পেয়ে প্রতিবেশী ডাক্তার খান এসে দেখে বললেন, ‘ প্রথম হার্ট অ্যাটাক। এক্ষুনি হাসপাতালে নেওয়া দরকার।’

আরেক প্রতিবেশী ডাক্তার রশীদ পি.জি. হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট। তাকে ব’লে খুব তাড়াতাড়ি এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা সম্ভব হল। এ্যাম্বুলেন্সে বাবার সঙ্গে মা এবং ডা. খানও চললেন হাসপাতালে। কিন্তু সবার সব চেষ্টা বিফল করে বাবা চলে গেলেন, সবাইকে পেছনে ফেলে।

.

মা দিশেহারা হয়ে পড়লেন। ছেলে আগেই গেছে, এবার স্বামীও গেল। কী করবেন তিনি এখন? ব্ল্যাকআউট, প্লেনের কড়কড়ানি, সাইরেনের তীক্ষ্ণ চিৎকার— এর মধ্যে কোথায় পথ, কোথায় উদ্ধার? মার যে আর সহ্য হয় না। এর মধ্যে আরেক বিপদ- সামনের দুটো বাড়ির ছাদে বোমা পড়ে কয়েকজন মারা গেছে, কয়েকজন মারাত্মক জখম হয়েছে। ওসব বাড়ির লোকেরা ভয় পেয়ে সবাই মিলে এ-বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ফলে এতগুলো লোকের দেখাশোনার ভারটা মায়ের ওপর পড়েছে। এত বিপদ, বিপর্যয় যন্ত্রণায় তিনিই বা বেঁচে আছেন কী করে? সে কি ঐ অন্ধ শ্বশুর আর কিশোর ছেলের মুখ চেয়ে? জামীরও যে আর কেউ রইল না মা ছাড়া। ছেলের জন্যই যে তাঁকে বাঁচতে হবে।—

দুঃখের অমানিশা একসময় শেষ হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। উল্লাসে সবাই ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে গেছে। মা কোথাও বেরোন নি। আধা-মূর্ছিতের মতো বিছানায় পড়ে আছেন। দলে দলে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আসছে, মায়ের বিছানা ঘিরে বসে দাঁড়িয়ে কাঁদছে, বিলাপ করছে। মা কিছু বলতে পারছেন না। সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন, ভাবছেন— এরা তো সবাই এই ঢাকাতেই ছিল, বিপদে, দুঃখে সবসময় ছুটে এসেছে, সাহায্য করেছে। এখনও দারুণ দুঃসংবাদ পেয়ে এসে চোখের পানি ঝরাচ্ছে। কিন্তু যারা মনে মনে ‘বিদায় দে মা’ বলে যুদ্ধে গিয়েছিল, তারা কই? মা শুনেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেছে। রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ আর করতে হয়নি, তার্ আগেই নব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্যসহ জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় ঢুকেছে বিজয়ীর বেশে। তাদের স্টেনগানের গুলির ফাঁকা আওয়াজে আকাশ মুখরিত। তিনি যে এখন তাদেরকেই দেখতে চান।

.

ফোন লাইন, বিদ্যুতের লাইন সব বিচ্ছিন্ন। সারতে এখনো দু-চারদিন লাগবে মনে হচ্ছে। ১৭ তারিখে সন্ধ্যার পর একটা মোমবাতি জ্বেলে মা জামীকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসেছিলেন। হঠাৎ দরজায় করাঘাত। তার আগে বাসার সামনে জিপ থামার শব্দ শোনা গেছে। মা উঠে দরজা খুললেন। কাঁধে স্টেনগান-ঝোলানো কয়েকজন তরুণ দাঁড়িয়ে। মা দরজা ছেড়ে দু-পা পিছিয়ে বললেন, ‘এসো বাবারা, এসো।’

ওরা ঘরে ঢুকে প্রথমে নিজেদের পরিচয় দেয়, ‘আমি মেজর হায়দার। এ শাহাদাত, এ আলম,ও আনু, এ জিয়া, ও ফতে আর এ চুল্লু।’

মা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে। যতজন গিয়েছিল, সবাই ফেরেনি, তবু কয়েকজন তো ফিরেছে!

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *