১
ক’দিন থেকে মায়ের মনে একদম শান্তি নেই। একে তো দেশের অবস্থা তপ্ত কড়াইয়ে ফুটন্ত তেলের মতো হয়ে আছে, তার ওপর রুমী যে কখন কোথায় যাচ্ছে, কী খাচ্ছে, কী করছে, মা তার কোনো হদিস পাচ্ছেন না। এমনিতে রুমী খুব ভালো ছেলে, বাধ্য ছেলে। ছোটবেলা থেকে খুব নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে বেড়ে উঠেছে। যা করে, মা-বাবাকে বলেই করে। এখনো বলেই করছে। যেখানে যাচ্ছে ও– বলেই যাচ্ছে; কিন্তু তবু তার এইরকম ছোটাছুটি দেখে মা-ও দিশেহারা হয়ে উঠেছেন। এইরকম গোলমেলে ব্যাপারটা শুরু হয়েছে পহেলা মার্চ থেকে। সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক একাদশ আর পাকিস্তান একাদশের মধ্যে। সবগুলো গ্যালারি লোকে লোকারণ্য, সবাই তন্ময় হয়ে খেলা দেখছেন। দর্শকদের মধ্যে অনেকেই ছোট ট্রানজিস্টার-রেডিও সঙ্গে নিয়ে গেছেন খেলা দেখার সঙ্গে সঙ্গে ধারাবিবরণী শুনবেন বলে।
বেলা একটার সময় রেডিও থেকে ধারাবিবরণী দেয়া বন্ধ হল। একটা পাঁচ মিনিটে সংবাদ প্রচারের সময় সুদূর ইসলামাবাদ থেকে বেতার-তরঙ্গে ভেসে এল সেই কঠিন ঘোষণা : প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিয়েছেন। ব্যস্। আর যায় কোথা! চারদিকে মহা শোরগোল পড়ে গেল। এত যে প্রিয় খেলা ক্রিকেট, সেই খেলা বাদ দিয়ে, চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার দর্শক ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে দিতে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। রুমী-জামীও খেলা দেখতে গিয়েছিল। তারাও জনতার সঙ্গে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। কাছেই দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় ওদের বাবার অফিস—দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। ওখানে জামীকে বাবার কাছে রেখে রুমী ছুটল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। সেখানেও একই ঘটনা। রেডিও’র ঘোষণা শোনামাত্র ছেলেরা সবাই দলে দলে ক্লাস থেকে, হল থেকে বেরিয়ে বটতলায় জড়ো হতে শুরু করেছে। বটতলায় পৌঁছে রুমী দেখে, তখনো হাজার হাজার ছেলে চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে। তার মনে হল, সমুদ্রের একেকটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বটতলায়।
এমনি বিক্ষোভে সেদিন ফেটে পড়েছিল সারা ঢাকা শহর। ঊনিশশো একাত্তর সালের সেই পহেলা মার্চে।
রুমীর মা দেড়টার আগে পর্যন্ত এতসব কাণ্ডের কথা জানতে পারেননি। তিনি গিয়েছিলেন নিউমার্কেটে— পূর্ব পাকিস্তানে তৈরি সাবান, তেল, টুথপেস্ট, বাসন-মাজা পাউডার, এসব খুঁজতে। কিন্তু মজার ব্যাপার, এসব একটা জিনিসও পূর্ব পাকিস্তানে তৈরি হয় না। সব পশ্চিম পাকিস্তানে তৈরি হয়ে এদিকে আসে এবং বাঙালিদের সেগুলোই কিনতে হয়। বাঙালিরা চেষ্টা করেও ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিতে পারে না। অথচ সোনালি আঁশ পাট উৎপন্ন হয় একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানেই, পাকিস্তানের বেশির ভাগ রাজস্বের টাকা আসে পূর্ব পাকিস্তান থেকেই। কিন্তু সোনালি আঁশ বেচা টাকা পূর্ব পাকিস্তানের উন্নতির জন্য খরচ না হয়ে তা খরচ হয় পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নতির জন্য। গত তেইশ বছর ধরে প্রতিটি খাতে এইরকম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা চলে আসছে। এর জন্য গত কয়েক বছর ধরে বাঙালিদের মধ্যে অসন্তোষ আর আন্দোলন। ঊনসত্তর সালে সে আন্দোলন তুঙ্গে উঠে গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়। স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের পতন হয় এবং ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসেন। তাতেও কোনো স্থায়ী ফল হয়নি। গতবছর নভেম্বরে পূর্ব পকিস্তানে যে মহা-সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, তাতে বাঙালিদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তার প্রতি ইয়াহিয়া সরকারের উপেক্ষা ও সাহায্য দেওয়াতে গড়িমসি বাঙালি জাতিকে আরো ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। গত বছর ডিসেম্বরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অনেক বেশি ভোট পেয়ে জিতেছে। নিয়মমাফিক তাদেরই মন্ত্রিসভা গঠন করার এবং শেখ মুজিবের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু তাহলে যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের মুশকিল হয়ে যায়। তাই গত দুমাস থেকে নানা টালবাহানা করছে তারা। বাঙালিরাও আরো ক্ষিপ্ত হয়ে আন্দোলন জোরদার করছে। ইয়াহিয়া খান শেষপর্যন্ত ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসার তারিখ স্থির করেছিলেন।
.
মা বাড়ি ফিরে রুমীর বাবার ফোনে জানতে পারলেন, ইয়াহিয়া সেটাও আজ বাতিল করে দিয়েছেন আর তার ফলে স্টেডিয়ামে খেলা পণ্ড করে দর্শকরা বেরিয়ে গেছে। বাবা তিনটের সময় জামীসহ বাড়ি ফিরে মাকে আরো খবর দিলেন। অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা শুনে অফিস-আদালত থেকেও সব লোকজন বের হয়ে আসে। শেখ মুজিব সেদিন সকাল থেকেই হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির মিটিং করছিলেন। ইয়াহিয়ার ঘোষণার একঘণ্টার মধ্যে পঞ্চাশ-ষাটহাজার লোক বাঁশের লাঠি আর লোহার রড ঘাড়ে নিয়ে মিছিল করে হোটেল পূর্বাণীর সামনের সবগুলো রাস্তা জ্যাম করে ফেলে। মতিঝিল, স্টেডিয়াম, বায়তুল মোকাররম, সব জায়গার দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। অফিসেও আর কোনো লোক নেই।
সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়, রুমীর দেখা নেই। মার মনে উদ্বেগ দানা বাঁধছে। রুমী এল রাত আটটারও পরে। তার মুখে আরো খবর জানা গেল। শেখ মুজিব দুপুর আড়াইটেয় হোটেল পূর্বাণীতে জরুরি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা দিয়েছেন— আগামীকাল থেকে রোজ ছয়টা-দুটো হরতাল, আর ৭ই মার্চ রেসের ময়দানে সভা। বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় দুটোর সময় ছাত্রলীগ আর ডাকসুর নেতারা মিলে তিনটেয় পল্টন ময়দানে মিটিং ডাকেন। সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে শেখ মুজিবও পল্টনের জনসভায় যান। সেখানে এত যে লোক হয়েছিল, সে আর বলার কথা নয়। সারা শহর যেন তপ্ত খোলায় খইয়ের মতো ফুটছে। কেউ আর ঘরে নেই।
গুলিস্তানের মোড়ে কামানের ওপর দাঁড়িয়ে মতিয়া চৌধুরী আগুন-ঝরা বক্তৃতা দিয়েছেন। সেখানেও কামান ঘিরে চারপাশে বিশাল জনতা। রুমী সারাদিন বন্ধুর হোন্ডার পেছনে চড়ে সবখানে টহল দিয়েছে। স্টেডিয়াম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সেখান থেকে পূর্বাণী, পূর্বাণী থেকে গুলিস্তান মোড়ের কামান, সেখান থেকে পল্টন এমনি করে চরকিঘোরা ঘুরেছে। খাওয়া হয়নি সারাদিন। শুধু রুমীর নয়, খাওয়া হয়নি সেদিন কারোও। খাওয়ার কথা কারই বা মনে ছিল।
এখন বাড়ি ফিরে খেয়ে-দেয়ে সবাই যে-যার বিছানায়। কিন্তু মায়ের চোখে ঘুম নেই। রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে, তবু এখনো অনেক দূর থেকে শ্লোগানের শব্দ আসছে। তার মানে এত রাতেও বহু লোক ঘরে ফেরেনি, বিছানায় যায়নি, হয়তো-বা খায়ও নি। ঘরের আরাম, দেহের বিশ্রাম সব হারাম করে তারা পথে পথে মিছিল করছে আর শ্লোগান দিচ্ছে। বাঙালি জাতির ন্যায্য দাবি, স্বাধিকার আদায়ের দাবিতে।
পরদিন হরতাল। সকালে রুমী হেঁটে হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয় গেল, ‘ডাকসু আর ছাত্রলীগ মিটিং ডেকেছে। যাই, একটু দেখে আসি।’
মা বারণ করেছিলেন, ‘তোর এতসব মিটিঙে যাবার দরকারটা কী? তুই তো আর কোনো দলের মেম্বার নোস।’
রুমী জবাব দিয়েছিল, ‘ব্যাপারটা এখন আর দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই আম্মা। এখন তো এ আগুন ছড়িয়ে গেছে সবখানে।’
.
কথাটা সত্যি। স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে সারা জাতি পথে নেমেছে। সারাদিন ধরে কত মিটিং আর মিটিং-শেষে লাঠিসোটা, কাঠ, রড ঘাড়ে নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল, সন্ধ্যার পরেও মশাল মিছিল। এইসব দেখেশুনে সরকার ২ মার্চ রাতে কারফিউ জারি করে। কিন্তু তাতে ফল হয় উলটো। জনতা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে কারফিউ ভঙ্গ করার জন্য আবার পথে নামে, আরো বেশি করে শ্লোগান দেয়। রাতের স্তব্ধতা খাখান্ হয় তাদের শ্লোগানে, তারপর শোনা যায় গুলির শব্দ। কারফিউ ভঙ্গকারী বাঙালির ওপর মিলিটারির গুলি।
তারপরের দিনও হরতাল, মিটিং, মিছিল। আগের রাতের গুলি-খাওয়া লাশগুলো মিছিলের সামনে বহন করে জনতা পল্টন ময়দানের সভায় গেছে, সভার হাজার হাজার মানুষ শপথ নিয়েছে, শহীদদের স্বপ্ন তারা সফল করবেই। সভায় শেখ মুজিব সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। বলেছেন, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না-করা পর্যন্ত বাঙালি জাতি একপয়সা ট্যাক্স-খাজনা দেবে না। তিনি সরকারকে বলেছেন, সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নিতে আর বাঙালি জনগণকে বলেছেন, শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যেতে। মিটিং শেষে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে মিছিল শহীদ মিনারে লাশ রেখে আরেকবার শপথ নিয়েছে পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আদায়ের।
সারাদেশে বিক্ষোভ আর আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ। একদিকে যতই সরকার কারফিউ আর সামরিক আদেশ জারি করে, সৈন্যদের দিয়ে গুলি করিয়ে সে আন্দোলন দমন করতে চাইছে, অন্যদিকে ততই তা ফুঁসে উঠছে। আন্দোলন এখন জলপ্রপাতের গতি নিয়েছে, উঁচু পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ার বেগ সঞ্চয় করে তা এখন একটা অনিবার্য পরিণতির দিকে ছুটে যাচ্ছে। তাকে রোধ করার ক্ষমতা বোধ হয় এখন আর কারো নেই। জনগণ এতদিন স্বাধিকারের আন্দোলনই করছিল, এখন সেটা মোড় নিয়েছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার দিকে। স্বাধীন বাংলার নতুন পতাকাও তৈরি হয়ে গেছে। পল্টনের জনসভায় শেখের উপস্থিতিতে সে পতাকা উত্তোলন করাও হয়েছে।
রুমী সারাদিন বিভিন্ন মিটিং-মিছিলে ঘোরে আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মাকে এইসব খবর দেয়। মায়ের বুক দুরুদুরু করে। দেশে কী ঘটছে না ঘটছে, সে বিষয়ে মা নিজেও সচেতন, খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়ে বিস্তারিত জানবার চেষ্টা করেন, লেখক-সাহিত্যিকদের সভা হলে তাতে যোগ দেন। কিন্তু রুমী বাইরে গেলেই মায়ের প্রাণটা যেন হাতে কাঁপতে থাকে। জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে একটা গুলির ব্যবধান মাত্র, কখন আচমকা কোন্ দিক থেকে তীক্ষ্ণ শিসে ছুটে আসে, কে বলতে পারে? ছোট ছেলে জামীকে নিয়ে অতটা উদ্বেগ নেই। সে রুমীর চেয়ে অনেক ছোট, স্কুলের ছাত্র, তাই তাকে মিটিং-মিছিলে যাবার অনুমতিই দেননি মা। কিন্তু রুমী ক’দিন পরে উনিশ পেরিয়ে বিশ বছরে পা দেবে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এখন। তাকে তো আর ঘরে বেঁধে রাখতে পারে না। কী যে জ্বালা হয়েছে মায়ের।
.
৭মার্চ শেখ মুজিব রেসের ময়দানে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা দিলেন। বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে তৈরি হয়ে যাও।’
.
সারাদেশ জুড়ে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। প্রতিদিন সকাল ছটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত হরতাল। শেখ মুজিব অফিস-আদালতের জরুরি কাজকর্ম চালানোর জন্য সরকারি, বেসরকারি সব অফিস আড়াইটে থেকে চারটে পর্যন্ত খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। রেশন দোকানও ঐ একই সময়ে খোলা। ব্যাঙ্কও তাই। আড়াইটে-চারটের মধ্যে টাকা তোলা যাবে। শেখের প্রতিটি নির্দেশ সারাদেশ জুড়ে সবাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। জরুরি সার্ভিস হিসেবে হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তারের গাড়ি, সংবাদপত্র ও তাদের গাড়ি, পানি, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, দমকল, মেথর ও আবর্জনা-ফেলা ট্রাক — এগুলোকে হরতাল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
.
১৫ মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় এসেছেন। ১৬ তারিখ থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর বৈঠক চলছে। প্রতিদিন শেখ মুজিব তাঁর সাদা গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে প্রেসিডেন্ট হাউসে যাচ্ছেন, বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলছেন : আলোচনা চলছে, মীমাংসায় আসতে সময় লাগবে।
তারপর ২১ মার্চ ভূট্টোও ঢাকায় এসেছেন। ঘন ঘন বৈঠক; আলাপ-আলোচনা চলছে। এই আলোচনা সম্বন্ধে মা খুব আশাবাদী। আলাপ-আলোচনা শেষে নিশ্চয় একটা সমঝোতা হবে, দেশের সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করবে, শেখ প্রধানমন্ত্রী হবেন। তারপরেই হবে ছয় দফার বাস্তবায়ন। পূর্ব পাকিস্তান পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন পাবে। কিন্তু রুমীর ধারণা সম্পূর্ণ উলটো। সে বলছে, ‘আলোচনার ছুতো করে ইয়াহিয়া সরকার সময় নিচ্ছে। তাদের নিশ্চয় অন্য কোনো বদ মতলব আছে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধান, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার এবং আরো কয়েকজন মেজর জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ার এসেছেন। বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে এত সেনাপতি, সামন্ত সঙ্গে আনার মানে কী? তাছাড়া, প্রতিদিন প্লেনে করে সাদা পোশাকে প্রচুর সৈন্য এসে নামছে ঢাকা এয়ারপোর্টে। চাটগাঁ বন্দরে অস্ত্র-বোঝাই জাহাজ এসে ভিড়েছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। এসব কিসের আলামত? আম্মা, তুমি বুঝতে পারছ না, মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এটা ওদের সময় নেবার অজুহাত মাত্র। আমাদের যে দাবি পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, তা তো ওরা দেবেই না, বরং ওরা— গত তেইশ বছর যেমন পূর্ব পাকিস্তানকে ওদের উপনিবেশ বানিয়ে রেখেছে—এখনও ঠিক তাই করবে।’
মায়ের বিশ্বাস হয় না। ‘কিন্তু ওরা তা করবে কী করে? দেখছ না, সারাদেশের জনগণ কীভাবে জেগে উঠেছে? প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন করছে?’ রুমী দুঃখের হাসি হেসে বলে, ‘হায় গো মা-জননী। ওরা সময় নিচ্ছে মাত্র। ভেতরে ভেতরে ওরা অন্যকিছুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই কয়েকটা দিন বাঙালির এইসব লাঠিসোটা ঘাড়ে মিছিল আর শ্লোগান সহ্য করে যাচ্ছে।’
মা হেসে উড়িয়ে দেন, ‘তোর যত সব আজগুবি কথা। মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা যদি ব্যর্থ হয়ও, তাহলেও যেভাবে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চলছে, তাতে জনগণ তাদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ঠিকই আদায় করে নেবে।’
কিন্তু মায়ের আশা পূরণ হয় না। রুমীর আশঙ্কাই সত্যি হয়ে যায়। ২৫ মার্চ রাত বারোটার পর। মা ধারণাও করতে পারেননি যে এ-রকম হতে পারে। দুদিন আগেও তো ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবস পালিত হল, ঢাকার সব বাড়িতে কালো পতাকার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলার নতুন পতাকা উড়তে দেখেছেন, নিজেরাও উড়িয়েছেন। কই, সেদিনও তো কিছু মনে হয়নি যে এমন কল্পনার অতীত মহা-সর্বনাশের ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে? পূর্ব পাকিস্তান এখনও তো পাকিস্তানেরই একটা অংশ— কী ক’রে সরকার নিজের দেশেরই একটা অংশের লোকদের ধ্বংস করার জন্য তাদের ওপর সেনাবাহিনী নামিয়ে দিতে পারে? কী ক’রে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে, বাজার-হাট পুড়িয়ে, ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে এ-রকম নারকীয় কাজ করতে পারে? ২৫ মার্চ কালরাত্রির এই গণহত্যার কোনো নজির নেই পৃথিবীর কোথাও। এটা করবার জন্যই ওরা সময় নিচ্ছিল, নিজেদের তৈরি করছিল, আর বাইরে শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবার ভান করছিল। রুমীর কথাই তাহলে ঠিক হল? এটাই তাহলে ঘটবার ছিল?
রুমী বলেছিল, ‘এখন আর স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নই ওঠে না। বাঁচতে হলে ওদের কাছ থেকে আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হবে সশস্ত্র সংগ্রাম ক’রে।’
.