বিড়াল

বিড়াল

কালো বিড়ালটাকে আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না। হুলো হলে তবু কথা ছিল। কিন্তু ও মেনি!

এমনিতে ওর সঙ্গে আমার কোন দুশমনি নেই। ও কখনও কাঁচাগোল্লা হয়ে, আবার কখনও বা সরলরেখা হয়ে কার্নিশে রোদ পোয়ায়। আর আমি বারান্দায় বসে পেপার পড়ি। ও থাবা চাটতেই ব্যস্ত থাকে, আর আমি চোখ দিয়ে মেয়ে চাটি।

যখন উলটোদিকের বাড়ির সীমাবৌদি নাইটি পরে জানলার সামনে এসে ঝুল ঝাড়েন, আর তার স্লিভলেস নাইটির ফাঁক দিয়ে ওয়াক্স করা বগল, বুক— এইসব মালপত্তর দেখা যায়, তখন আর পেপারের দিকে চোখ থাকে না! সেদিকেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখে পড়ে কালো বিড়ালটা আমার দিকেই নিষ্পলকে তাকিয়ে আছে!

ভয় পাওয়া উচিত নয়, তবু…

ওর চোখে চোখ পড়লেই বুকের ভিতরটা খস খস করে ওঠে। মনে হয় ধূসর রঙের চোখদুটো অদ্ভুত রাগ নিয়ে আমার দিকে একদৃষ্টে দেখছে, যেন অন্তর্যামী… যেন একেবারে ভিতর অবধি দেখে ফেলছে ওর ওই অসহ্য ধূসর চোখ!

আমার এক দাদা কাম বন্ধু, শান্তনুদা বারবার বলত, “বুঝলি কৌশিক, মেয়েরা হল বিড়ালের জাত। বিড়ালের মতোই নরমসরম। আদর পেলেই মাথায় চড়ে। কথায় কথায় রোঁয়া ফুলিয়ে ফ্যাসফ্যাস করে ঝগড়া করে। কিন্তু … “

—“কিন্তু…?”

শান্তনুদা রহস্যময় হাসি হাসে, “নরম-সরম হলেও কখনও পাঙ্গা নিতে যাবি না। বিড়াল আর মেয়েদের সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল। দু’জনেই থাবার মধ্যে নখ লুকিয়ে রাখতে ওস্তাদ! একবার থাবা মেরেছে কি ফুলটু কেলো!”

প্রথমে কথাটা ইয়ারকি হিসাবেই নিয়েছিলাম। পরে যখন মালিনীর সঙ্গে মাখামাখি হল তখন লক্ষ্য করে দেখলাম যে শান্তনুদা নেহাত মিথ্যে কথা বলেনি। মালিনীর গায়ের রঙ কুচকুচে কালো ছিল। চোখদুটো উজ্জ্বল ধূসর রঙের, মনে হত কন্ট্যাক্ট লেন্স পরে বসে আছে। বিড়ালের মতোই পাছা দুলিয়ে হাঁটতো। বেশ আদুরেও বটে। চিলেকোঠায় বা সিঁড়ির তলায় সামান্য আদর পেলেই আহ্লাদে পুরো আইসক্রিম!

কিন্তু থাবার মধ্যে লুকিয়ে রাখা নখের আঁচড় খেতেও বেশি সময় লাগল না।

এক সুন্দর সন্ধ্যায়, গঙ্গার ঘাটে বসে বলল, “তুমি আর কখনও আমায় ফোন কর না।”

অবাক হয়ে বলি, “যাঃ শালা! কেন?”

নির্মম উত্তর, “পরের মাসেই আমার বিয়ে।”

এর চেয়ে মাথায় একটা হাতুড়ির বাড়ি বসিয়ে দিলেও বোধহয় এত যন্ত্ৰণা হত না। অনুভব করছিলাম একটা পিন মাথার মধ্যে ক্রমাগতই বিঁধছে। তিরতির করে হয়ে চলেছে রক্তক্ষরণ।

মুখ থেকে বেরোল শুধু একটাই শব্দ, “কেন?”

মালিনী ধূসর চোখদুটো তুলে নিষ্পলকে তাকাল। অদ্ভুত এক্স রে দৃষ্টি। যেন ভিতরের অস্থিমজ্জা মায় গোটা ‘আমি টাকে দেখে নিচ্ছে!

অসহ্য লেগেছিল ওই চাউনি! ভীষণ ইচ্ছে করছিল ওকে খুন করে ফেলি। ও আস্তে আস্তে জবাব দেয়, “পাড়ার বউদি আর কাজের মাসির এঁটো খেতে চাই না আমি। এতদিন জানতাম না। জানলে আগেই সম্পর্কটা শেষ হত। বাট, বেটার লেট দ্যান নেভার।”

মালিনী আমায় চড় মারেনি। কিন্তু গালটা চিড়বিড় করে উঠেছিল। যেন কেউ আঁচড়ে দিয়েছে নখ দিয়ে! ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ছে অদৃশ্য রক্ত!

সেই নখের আঁচড়ের জ্বালা কোনওদিন ভুলিনি। অসহ্য ক্ষোভে ছটফট করতে করতে ভেবেছি, মালিনী মরে গেলে ভালো হত! ওর লাশ দেখতে পেলে খুশি হতাম আমি। একটা অন্ধরাগ ভেতরে ভেতরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। মালিনী মরে গেলে খুব ভালো হয়, মরে যাক… ও মরে যাক…!

ভগবান আজকাল বোধহয় কানে বিশেষ শোনেন না। কিন্তু মালিনী মরে গিয়েছিল। বিয়ের আগের রাতেই ট্রেনে কাটা পড়ে দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। কী করতে ও ট্রেন লাইনের কাছে গিয়েছিল তা কেউ জানে না। ধূসর মার্বেলের মতো চোখ দুটো বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কী যেন নিষ্পলকে দেখেছিল। শেষ সময়েও সেই অন্তর্ভেদী চোখ দুটো বোজেনি।

বলাই বাহুল্য, মনে বড় শান্তি পেয়েছিলাম।

সেদিন আস্ত একটা মালের বোতল শেষ করি। কাজের মেয়ে পরীকে নিয়ে একটা নৃশংস রাত কাটিয়ে মনে হয়েছিল, আমিই শালা এই পৃথিবীর রাজা! আমায় আঘাত দেওয়ার শাস্তি মৃত্যু!

তারপর থেকে বেশ ফূর্তিতেই ছিলাম। কখনও শিল্পাবউদি, আবার কখনও পরীর অনুদানে সুন্দর রাতগুলো কেটে যাচ্ছিল।

সেদিন দুপুরবেলা সিনটা ভালোই জমেছিল। বেশ ম্যারাথন চুমু খেয়ে বউদিকে গরম করছি। আস্তে আস্তে পারফিউমের গন্ধ সরে গিয়ে নাকে কাঁচা মাংসের খুশবু। জন্মদিনের পোষাক পরে সবে ‘গাদি’ খেলতে শুরু করেছি…

ঠিক তখনই চোখ পড়ল জানলায়!

সেই কালো বিড়াল! আপাদমস্তক কালো! ধূসর মারবেলের মতো জ্বলজ্বলে চোখ মেলে এদিকেই তাকিয়ে আছে! মূর্তির মতো স্থির হয়ে উঁকি মারছে জানলায়। ওর ডান হাতের থাবা থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে ধারালো নখ… হিংস্র, তীক্ষ্ণ ফলা!

সেইদিনই প্রথম জানলাম ভয় কাকে বলে। গিরগিটির মতো একটা ফ্যাকাশে ভয় আমার পিঠ বেয়ে নেমে গেল নীচের দিকে। মনে হল, বিড়ালটা সব জানে! সব কিছু…

আমি ওর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারি না… চুম্বকের মতো ও টেনে রাখে আমার দৃষ্টি! টের পেলাম আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে যাচ্ছি আমি… মড়া মাছের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছি… চোখের সামনে আর কিছু নেই, শুধু দুটো ধূসর চোখ জ্বলজ্বল করছে…

সেদিন থেকেই দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করতে শুরু করেছে সেই চোখ, আর আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসা উদ্যত থাবার গুপ্ত নখ!

বিড়ালটা কি আমায় পাহারা দেয়? কী আছে ওর মার্বেলের মতো চোখে? ঘেন্না? রাগ? প্রতিহিংসা?…কী?

হুলো হলে চিন্তার কিছু ছিল না, কিন্তু শালি মেনি! মেনি বলেই চিন্তা! মেনি বলেই সহ্য করতে পারি না ওকে! সহ্য করতে পারি না ও কালো বলে! কী আশ্চর্য! শরীরে একটা সাদা দাগ থাকলে কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হত? চোখদুটো কি সবুজ বা নীল হতে পারত না? ধূসরই হতে হল?

যতই ভাবি, ততই মনে হয় কেউ বুঝি অলক্ষ্যে আমার উপর নজর রাখছে। ভয় হয়… বড় ভয় হয়…

—“তুমি আজকাল কেমন বদলে গেছ।”

এলোমেলো শাড়ি ঠিক করতে করতে শিল্পাবউদি বলল, “আগের মতো আর গরম নেই…”

গরম থাকব কী বে! নিজে তো একেবারে ফার্নেস! একবার ঢুকলে জান কয়লা করে ছেড়ে দেয়। আমি মানুষ না গোরিলা!

এসব কথা বলাই যেত। কিন্তু যেখানে মাল্লু, সেখানে কথা বলা যায় না। শিল্পাবউদির বর মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। মালদার লোক। শিল্পা বউদির হাতেও তাই পয়সার চুলকানি। আমার মাল, সিগারেটের খরচটা ওখান থেকেই আসে। তাই বেশি কিছু বলতে পারি না।

আমার ব্যাগে বেশ কয়েকটা কড়কড়ে নোট রাখতে রাখতে বউদি বলল,

–“পরের বার আরেকটু ভালো চাই। ক’দিন ধরে ভালো লাগছে না।”

আমি উত্তরে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই চোখ পড়ল জানলায়।

বিড়ালটা …!

ধূসর চোখদুটো থেকে যেন আগুন ঠিকরে পড়ছে। স্থির হয়ে সে দেখছে এদিকেই…

উদ্যত চুমুটা স্থগিতই থেকে গেল। শিল্পাবউদি অবাক, “কী হল?” বুকের ভিতরে একটা অসহ্য ঘূর্ণিঝড় ক্রমশই পাক খাচ্ছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। বিড়ালটা ওখানে কতক্ষণ আছে?…ও কি সব দেখেছে…! ও কি সব জানে…?

একটা হিংস্র অসহায়তা টের পাই! বিড়ালটাকে হাতের কাছে পেলে শেষ করে ফেলতাম। অসহ্য… অসহ্য… এই সিঁটিয়ে সিঁটিয়ে বেঁচে থাকা। তার চেয়ে যদি ওর গলা টিপে মেরে ফেলতে পারি!

ও কি আমার উপর নজর রাখছে? যখনই জানলার বাইরে চোখ পড়ে তখনই দেখি হয় জানলায় থাবা রেখে ভিতরে উঁকি মারছে, নয়তো কার্নিশে চুপ করে বসে এদিকেই তাকাচ্ছে! আজকাল ওর ভয়ে বারান্দায় যেতে পারি না। পরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারি না। কারণ প্রত্যেকবার চরম মুহূর্তে কোথা থেকে উদয় হয় কে জানে! কুঁকড়ে যাই… শেষপর্যন্ত আর টিকে থাকতে পারি না। উত্তেজনার বদলে ঠান্ডা হিমবাহের স্রোত নেমে আসে শরীর বেয়ে….

তারপরই একটা অসহ্য রাগ আমার মনে দানা বাঁধে। একটা ভীষণ হিংস্রতা। আমার সঙ্গে ইয়ারকি! শালা, মেরে দু’টুকরো করে ফেলে দেব! ওর ওই অসহ্য চোখ… ওই চোখ যদি উপড়ে না ফেলি তো…

আমি প্রচণ্ড রাগে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু আশ্চর্য! বিড়ালটা একটু ও ভয় পায় না! বরং আগের মতোই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। ওর চোখ একবারের জন্যও নড়ে না। পলক পড়ে না। তেড়ে গেলে বরং আস্তে আস্তে চলে যায়। কার্নিশ থেকে লাফ মেরে নেমে যায় নীচে। চলে যেতে যেতেও ঘুরে একবার তাকায় আমার দিকে।

বিড়ালরা হাসতে পারে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখি বিড়ালটার মুখে একটা অদ্ভুত হাসির আমেজ ভেসে উঠেছে। একটা অদ্ভুত রহস্যময় হাসি। গা শিরশির করে ওঠে!

ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী? এমন নয় যে ওকে আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছি। বরং প্রাণীদের একটা সহজাত ক্ষমতা থাকে। সেই ক্ষমতায় ও বুঝতে পারে যে আমি ওকে অপছন্দ করি। অথচ তা সত্ত্বেও আমার আশপাশেই ঘুরঘুর করে! কাছাকাছি থাকে!

অসাধারণ কিছু তো নয়। সামান্য বিড়াল! লক্ষ লক্ষ মানবেতর প্রাণীর মধ্যে একটা! অথচ মনে হয় ওকে খুব ভালো করে চিনি…

সেদিন পরী দুপুরে মাছ ভেজেছিল।

বাজারে আজকে খুব ভালো জাতের মাছ পেয়েছিলাম। একদম রুপোলি আঁশের তাজা ইলিশ। দেখেই লোভ হল। লোভ এতটাই বেশি হল যে দামটা গলাকাটা হলেও কিনেই ফেললাম। কী মনে হতেই আরও কিছু কেনাকাটা করে ফেলি। মুগ ডাল, গোবিন্দভোগ চাল, মোটামোটা তাজা বেগুন। ইচ্ছে ছিল দুপুরে সলিড খিচুড়ির সঙ্গে জমিয়ে খাবো। খিচুড়ির সঙ্গে বেগুনভাজা আর ইলিশমাছ ভাজা। ভাবতেই জিবে জল আসছিল। এত আয়েশ করার সামর্থ্য আমার সবসময় হয় না। কিন্তু এখন পকেট গরম আছে। শিল্পাবউদির দেওয়া নোটগুলো এখনও কড়কড় করছে।।

বাজার করে ফেরার পথেই শান্তনুদার সঙ্গে দেখা। সে একটা ঢাউস ব্যাগে শাকপাতা ভর্তি করে ফিরছে।

কী মনে হল কে জানে, ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।

—“কী রে!” ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, “নদের চাঁদ, ভালোই তো কসাইখানা খুলে বসেছিস। ক’টা পাঁঠা কেটে ঝোলালি?”

এইজন্যই শালার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মুখ তো নয়, নর্দমা!

তবু আজ ওর কাছেই আমার দরকার ছিল। একটু দেঁতো হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে যাই। তারপর একটু কিন্তু কিন্তু করে প্রশ্নটা করেই ফেলি,

—“আচ্ছা শান্তনুদা, তুমি বিড়াল সম্পর্কে আর কী কী জানো?” শান্তনুদা কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। পরক্ষণেই সজোরে হেসে উঠেছে,

—“যাঃ শালা, মাগীবাজি ছেড়ে এখন কি বিড়ালবাজি শুরু করেছিস? কামসূত্রের প্রশ্ন থাকলে কর। বিড়াল নিয়ে এত মগজমারি কেন?”

কথাগুলো শুনে ঝাঁট জ্বলে গেল। তা সত্বেও হজম করে নিয়েই বললাম,

—“না, তুমি বলছিলে না, যে মেয়ে আর বিড়াল প্রায় একরকম…”

“হ্যাঁ…. প্রায় একরকম নয়…” বিরক্ত মুখে শান্তনুদা বলে, “একেবারেই একরকম। আদর দিয়েছিস কি তোর বাপ-চোদ্দোপুরুষের তেরোটা বাজিয়ে ছাড়বে। কিছু বললেই ফ্যাসফোঁস শুরু হল। যত্তসব…”

সে আরেকটা অশ্লীল শব্দ বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়েছি, “তুমি বিড়াল সম্পর্কে আর কী কী জানো?”

শান্তনুদা অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাল, “তোর কী হয়েছে কৌশিক? সকাল থেকেই বিড়াল বিড়াল করছিস? বিড়াল পুষবি নাকি? না পাগল হয়েছিস?”

বুঝলাম ওকে ঘাঁটিয়ে বিশেষ লাভ নেই।

বাড়িতে এসে যা কোনওদিন করিনি তাই করতে শুরু করলাম। গুগল সার্চ খুলে বিড়াল সম্পর্কে পড়তে শুরু করলাম। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের সময় এত পড়লে বোধহয় এতদিনে দিগগজ হয়ে যেতাম। কিন্তু এখন মনে হল, বিড়াল সম্পর্কে জানাটা বেশি জরুরী।

পড়তে পড়তে শিরশিরে ভাবটা আরও বাড়তে লাগল। বিড়ালকে এতদিন একটা আদুরে প্রাণী বলেই জানতাম। যখন খুশি কোলে নিয়ে আহ্লাদ করা যায়। আবার যখন খুশি ক্যাৎ করে এক লাথিও মারা যায়।

অথচ ইতিহাস অন্য কথা বলে! প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে দেবী বাস্টের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে বিড়ালের ইতিহাস! বাস্টের মন্দির বুবাস্টিসে শতাধিক বিড়ালের মমি আছে। সসম্মানে মানুষের মতোই তাদের ওখানে সমাধিস্থ করা হয়েছে। এবং দেবীর মূর্তিটাই আসলে এক বিড়ালরূপী নারীমূর্তি! মিশরীয়রা এই বিড়ালের দেবীকে রীতিমতো পুজো করে ও ভয় পায়!

বোঝো! বিড়ালের এত ফান্ডা আছে কেউ জানত!

বিড়ালকে দেবী ফ্রেয়ার বাহনও বলা হয়; এবং ফ্রেয়া যাদুর দেবী! অর্থাৎ বিড়ালের সঙ্গে যাদুর যোগাযোগও আছে। এই যাদুই আবার ডাইনিদের কাছে ব্ল্যাক ম্যাজিকের রূপ ধারণ করেছে। সেখানেও বাহন হিসাবে এক ও অদ্বিতীয়ভাবে হাজির বিড়াল!

সবমিলিয়ে বিড়াল এক রহস্যময় প্রাণী! যতই পড়ছি ততই ভয়টা আমায় চেপে ধরছে। কোথাও বিড়াল পবিত্রতার প্রতীক, কোথাও ভয়ের! কোথাও ভীষণ অমঙ্গল ডেকে আনে, কোথাও আবার কালোযাদুর বাহক

এমনকি মৃত ব্যক্তির আত্মাও বহন করতে পারে এই বিড়ালই! পড়তে পড়তেই ক্রমশ একটা অমঙ্গলের আশঙ্কা চেপে ধরতে শুরু করল আমায়। যা সন্দেহ করছিলাম, তাই যেন এখন অমোঘ সত্য বলে মনে হচ্ছে। আর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নারী কোনও না কোনও ভাবে জড়িত বিড়ালের সঙ্গে! এ কি নিতান্তই কাকতালীয়…!

—“বাবু… খাবে এখন?”

খুব মন দিয়ে আর্টিকলগুলো পড়ছিলাম। হঠাৎ পরী সামনে এসে দাঁড়াতেই চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল।

—“হ্যাঁ, দে।”

সে বিনাবাক্যব্যয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। পরক্ষণেই থালাবাসন উলটে পড়ার ঝনঝন শব্দ! সঙ্গে সঙ্গেই পরীর পরিত্রাহি চিৎকার।

আমি ছুটে যাই রান্নাঘরে …

সেই হতভাগা বিড়াল! সেই বিড়াল… মুখে মাছভাজা! ধূসর চোখদুটো যেন সকৌতুকে তাকিয়ে দেখছে: পরী মেঝের উপর… তখনও চিৎকার করছে!

“শা-লি… মেরেই ফেলব আজকে…”

এতক্ষণ ধরে পড়া আর্টিকলগুলো মাথা থেকে বেরিয়ে গেল। বিড়ালটা গ্যাসের টেবিলের উপরে দাঁড়িয়ে ব্যঙ্গাত্মক ভাবে আমায় দেখছিল। পালাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও নেই। আমি তড়াক করে লাফিয়ে ওকে ধরে ফেলি। প্রায় জাপটেই ধরে ফেলেছিলাম ওকে। কিন্তু ও কী ভাবে যে হাতের ফাঁক গলে সুড়ুৎ করে বেরিয়ে গেল কে জানে! আমি হতবুদ্ধি হয়ে দেখলাম বিড়ালটা তিড়িক করে বিদ্যুতের মতো শূন্যে লাফিয়ে উঠল! ফ্যাস করে একটা শব্দ পরক্ষণেই ডানগালে প্রচণ্ড জ্বালা! থাবার ভেতর থেকে গুপ্ত নখ বেরিয়ে এসে গভীর আঁচড় কেটে গেল গালে

আমি অসহ্য যন্ত্রণায় অক্ষমের মতো দেখলাম মাছভাজাটা মুখে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে ও। মুখে যেন ব্যঙ্গের হাসি!

গাল কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছিল। ডাক্তারের কাছে দৌড়োতে হল।

ডাক্তারবাবু বললেন, —“বিড়ালের আঁচড়! তাও আবার গালে! খেলেন কী করে!”

কোনওমতে সমস্ত ঘটনা বলার পর তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি ক্ষতস্থান ধুয়ে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে দিয়ে বললেন, “ঘরের বিড়াল হলে চিন্তা ছিল না। কিন্তু একেই বাইরের বিড়াল, তার উপর আঁচড়ে রক্ত বের করে দিয়েছে। চান্স নেবেন না। ইঞ্জেকশন নিয়েই নিন।”

গালটা তখনও চিড়বিড় করে জ্বলছিল। তার চেয়েও বেশি জ্বালা ছিল ভিতরে। অমন দামি ইলিশ মাছের সর্বনাশ করল। বিড়ালের এঁটো আর খেতে পারবো? তার উপর মোক্ষম আঁচড়! বিড়ালটার উপর ভীষণ বিদ্বেষে জ্বলছিলাম আমি। অসহ্য জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে ভাবি, মরে যাক বিড়ালটা… নিকুচি করেছে মিথের… ওগুলো সব গপ্পো ছাড়া আর কিছু না… মরে যাক বিড়ালটা… মরে যাক…. মরে যাক….

ভগবান হয়তো এবারও প্রার্থনা শুনতে পেলেন না।

কিন্তু বিড়ালটা সত্যিই মরে গেল! পরদিন রাত্রে কে যেন তাকে বস্তাবন্দী করে ফেলে দিয়েছিল রেল লাইনের উপরে। ট্রেনের চাকায় দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল সে!

তবু তার সেই ধূসর চোখ দুটো খোলাই ছিল! মৃত্যুও সে চোখ বোজাতে পারেনি।

এত আনন্দ অনেকদিন অনুভব করিনি।

আপদ গেছে! বুকের উপর থেকে যেন একটা ভার সরল। আর কেউ জানলার কাছে এসে গুঁড়ি মেরে বসবে না। আর কেউ কটা চোখ নিয়ে বিচারকের ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকবে না। খুব বাঁচা বেঁচেছি।

পরী আর শিল্পাবউদি ছাড়া আজকাল ফূর্তির আরও একটা উৎস হয়েছে। কৃষ্ণকলি। ইন্টারনেটে আলাপ। সেক্স চ্যাট করতে ওস্তাদ। আমার নোংরা নোংরা কথা শোনে। আর পালটা রগরগে কথা বলতেও জানে। কথাতেই যে এত গরম করে, না জানি সে বিছানায় কতটা করবে।

একদিন মুখ ফসকে সে কথা বলতেই বলল, “বেশ তো, চলে এসো আমার ফ্ল্যাটে। লেটস্ এনজয়।”

আমি অবাক হই না। কলকাতাতে এমন মেয়ের অভাব নেই। তবু ভদ্রতাবশত একটু কিন্তু কিন্তু করি, “তোমার বাড়িতে? কিন্তু তোমার মা বাবা?”

—“আমার মা-বাবা এখানে থাকেন না,” তার স্বচ্ছন্দ উত্তর, “আমি একাই থাকি। আর আমার দেখাশোনা করার জন্য আমার মেড থাকে।

এমন সুযোগ পেয়ে কেউ ছাড়ে? আমিও ছাড়িনি।

কৃষ্ণকলি বেশ বড়লোকের মেয়ে বলেই মনে হয়। সাউথ সিটির বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকে সে। বাড়িতে ওর কাজের মেয়ে ঝরনা ছাড়া আর কেউ থাকে না। তার কথা মতো, সে এখানে একটা কল সেন্টারে মোটা মাইনের চাকরিও করে।

কৃষ্ণকলি নামটার মধ্যেও একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। শুনলেই কেমন বুকের ভিতরে আকুলিবিকুলি টের পাওয়া যায়। আর বন্যতার নমুনা তো আগেই তার কথায় পেয়েছি। বলাইবাহুল্য তাকে দেখার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়েছিলাম।

তার ফ্ল্যাট নম্বর, ফ্লোর নম্বর এবং ফোন নম্বর তিনটেই জানা ছিল। সুতরাং খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধে হল না। ফ্ল্যাটের সামনেই নেমপ্লেটে জ্বলজ্বল করছে সোনালি হরফে, কৃষ্ণকলি চ্যাটার্জী। বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই একটা অদ্ভুত উত্তেজনা বোধ করি। মাথায় জেল মেখে যথেষ্ট স্টাইল মেরেই এসেছি। তবু আরেকবার ছোট চিরুনিটা বের করে আরেকবার মাথায় বুলিয়ে নিই। উত্তেজনা যথাসম্ভব গোপন করেই কলিংবেল বাজালাম। একবার… দু’বার…!

ভিতরে সুরেলা কলিংবেল বেজে উঠেছে। কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা তারপরই দরজা খুলে গেল।

ভেবেছিলাম হয়তো কৃষ্ণকলি দরজা খুলবে। আমি তাকে দেখার জন্য যতটা অধীর, সে-ও কি নয়? তাই রীতিমতো ওভার কনফিডেন্ট ছিলাম যে সে-ই হয়তো দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে।

কিন্তু দরজা যে খুলল তাকে দেখে আমি হতভম্ব! এক মধ্যবয়সী মহিলা! গাল ভরতি ব্রণর দাগ। শরীরে চর্বি ঝুলে পড়েছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে রীতিমতো বিষম খেতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই সে হেসে বলে, “আসুন, দিদিমনি ভিতরের ঘরে আছেন। আপনাকে বসতে বললেন।”

যাক, বাঁচা গেল। এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। এ তবে কৃষ্ণকলি নয়, ঝরনা।

ফ্ল্যাটের ভিতরটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। দেওয়ালে সুন্দর সুন্দর অয়েলপেইন্টিং। রট আয়রনের টেবিল, দামী সোফায় সুসজ্জিত আর নরম কার্পেটে মোড়া ঘর। মাখনের মতো দেওয়ালের রং। মাথার উপর ছোট্ট অথচ সুন্দর দামী কাচের ঝাড়বাতি। একপাশে শোকেসে শো-পিস সাজানো। দেওয়াল আলমারিতে থাকে থাকে বই। কৃষ্ণকলি বই পড়তে ভালোবাসে। আলতো করে চোখ বোলাতেই হঠাৎ একটা বই চোখে আটকে গেল।

—“স্কেয়ারি হ্যালোউইন ব্ল্যাক ক্যাট মিথ!”

কালো বিড়াল! এখানেও! কৃষ্ণকলিও কি তবে বিড়াল নিয়ে চর্চা করে? আমি নিতান্তই কৌতুহলবশত উঠে যাই বইয়ের আলমারির দিকে। ভালো করে দেখি ভেতরের বইগুলোকে। আমার বিস্মিত দৃষ্টি বইগুলোর নামের উপর দিয়ে সরে সরে যায়…

ক্যাট মিথোলজি… ব্ল্যাক ক্যাটস… দ্য ডেভিল… ইজিপশিয়ান ক্যাটস… দ্য মিথ অফ চাইনিজ ক্যাট… ক্যাটস ক্যান রিমেম্বার…

সব বিড়ালের উপর বই!

একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ! তার সঙ্গে চুড়ির মিষ্টি আওয়াজ। পেছন থেকেই ভেসে এল একটা রিনিরিনে কণ্ঠস্বর, “ওখানে কি দেখছ কৌশিক? আমি এখানে।”

চমকে উঠে পিছনে তাকাই। পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে এক যুবতী। হাতে হুইস্কির বোতল আর কাচের গ্লাস!

এ কে? কৃষ্ণকলি!

আপাদমস্তক কুচকুচে কালো। বিড়ালের মতো পিচ্ছিল চিকন শরীর। নরম নরম গড়ন। কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে সামনে এল, অবিকল বিড়ালের মতো! টের পেলাম, আমি ঘামছি! হৃৎপিণ্ডটা দ্বিগুণ বেগে চলতে শুরু করেছে! আমার থেকে সামান্য দূরত্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েটা। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওর দুটো চোখ।

একদম ধূসর মার্বেলের মতো…! জ্বলজ্বল করে জ্বলছে! একদম নিষ্পলক চাউনি!

সে দৃষ্টি দাবানলের মতো জ্বলছে… নির্দয় বিচারকের মতো…

বিড়াল রহস্যময়… বিড়ালের গোপন নখ আছে… বিড়াল নিয়ে ছেলেখেলা করা যায় না।

কৃষ্ণকলি অবিকল একটা বিড়ালের মতো গুটিগুটি এগিয়ে এল। আমার বুকের উপর হাত রেখেছে ও। বুকে একটা অব্যক্ত কষ্ট! যেন বুকের চামড়া ফুঁড়ে হৃৎপিণ্ডের দিকে কিছু একটা চলে যাচ্ছে একটু একটু করে! ধারালো কিছু! ওর আঙুলের লুকিয়ে রাখা তীক্ষ্ণ নখগুলো কি এবার আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে? গোপন নখ? ও কি আমায় শাস্তি দেবে? ও কি সব জানে? সব জানে…?

—“কে?” আমি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। কথা বলার শক্তি ছিল না। তবু অতিকষ্টে বলি, “কে তুমি?”

কৃষ্ণকলি হাসল। মুখটা আমার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল,

—“মাছভাজা খাবে?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *