1 of 2

বিড়াল

বিড়াল

ঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে ঠিক সাতটা বেজে সতেরোমিনিট। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ ঠিক তেরোমিনিট আগে ঘুম থেকে উঠেছেন অতীশ সেন। (অর্থাৎ, গত দু-বছর ধরে তিনি ঠিক সাতটা তিরিশমিনিটে ঘুম থেকে উঠেছেন। এই তেরোমিনিটে তাঁকে কতকগুলো কাজ সারতে হবে—জরুরি কাজ।

এক নম্বর, বালিশের তলা থেকে ০.২২ ক্যালিবারের রিভলভারটা বের করা—এবং তিনি তাই করলেন।

দু-নম্বর, রিভলভারের চেম্বার চেক করা…(এবং করলেন)।

এবার লোডেড রিভলভার ডানহাতে নিয়ে বাঁ-হাতে একটা বালিশ টেনে নিলেন অতীশ। এগিয়ে গেলেন রুবির বিছানার দিকে। প্রায় একইসঙ্গে ঘটে গেল দুটো ঘটনা। প্রথম, বালিশ দিয়ে ঘুমন্ত রুবির মুখ চাপা দেওয়া এবং দ্বিতীয়, তৎক্ষণাৎ বালিশের ওপর গুলি করা। ঘড়ির দিকে তাকালেন অতীশ—সাতটা বাইশ।

এমনভাবে তাঁকে কাজগুলো সারতে হবে, যাতে এক সেকেন্ডেরও হেরফের না হয়। রুবির মৃতদেহটা একপাশে ঠেলে দিয়ে ওর তোশকের নীচে হাত ঢোকালেন অতীশ। হ্যাঁ, ঠিক যা ভেবেছেন তাই—থরে-থরে টাকা সাজানো ওর তোশকের নীচে।

রুবিকে বিয়ে করার পর গত দু-বছর ধরে অতীশ শুধু ভেবেছেন এই টাকাগুলোর কথা। নয়তো এ-কথা কে বিশ্বাস করবে যে, শুধুমাত্র প্রেমতাড়িত হয়ে তিনি (অতীশ সেন সুপুরুষ) একটা মোটকা, পঞ্চাশ বছরের বুড়িকে বিয়ে করেছেন?

রুবি সেন খুবই অদ্ভুতভাবে বিয়ের দিনপনেরো পর থেকেই পক্ষাঘাতে কাহিল হয়ে পড়েছেন এবং নিজের বিছানা ছেড়ে আর নড়তেন না—অন্তত যতক্ষণ অতীশ বাড়িতে থাকতেন। প্রথম-প্রথম অতীশ সন্দেহ করেননি, কিন্তু একদিন লক্ষ করলেন যে, রেফ্রিজারেটরে রাখা ডিমগুলো থেকে দুটো ডিম হঠাৎ অদৃশ্য হয়েছে। এ বিষয়ে রুবিকে প্রশ্ন করামাত্রই ওর মুখ পাণ্ডুর হয়ে গেছিল। তখনই অতীশ সন্দেহ করেছিলেন রুবি পক্ষাঘাতে মোটেই কাবু নয়।

তবে কেন এই অভিনয়?

এর উত্তর একটাই হতে পারে। তা হল, ওই বিছানার নীচেই রয়েছে রুবির সমস্ত টাকা—যে-টাকার খবর অতীশ কানাঘুষোয় শুনেছেন।

রুবি কোনওদিনই অতীশকে জানতে দেননি যে, তাঁর টাকা আছে। এবং অতীশও কোনওদিন তাঁকে জানতে দেননি যে, তাঁর টাকার কথা তিনি জানেন। রুবি সেন অতীশের ‘নকল’ ভালোবাসার কথা বিয়ের কিছুদিন পরেই বুঝতে পেরেছিলেন, তাই সবসময় নিজের টাকাকে আগলে রেখেছেন—যখের মতো।

সাতটা সাতাশ।

আর তিনমিনিট। চট করে বাথরুমে গিয়ে শেভ করার সেফটি রেজার, সাবান, ব্রাশ, টুথব্রাশ নিয়ে এলেন অতীশ। একটা ব্রিফকেসে ভরে ফেললেন। তারপর ব্যাগটা বোঝাই করলেন টাকায়—রুবির টাকায়। একশো, দশ, পাঁচ, একটাকার নোটের মোটা-মোটা বান্ডিলগুলো (উত্তরাধিকার সূত্রে রুবি যার মালিক হয়েছে) দেখে অতীশ সন্তুষ্ট হলেন।

সাতটা উনতিরিশ মিনিট তিরিশ সেকেন্ড।

রিভলভারটা ব্রিফকেসে ভরে নিয়ে ব্রিফকেস লক করে দিলেন তিনি। দ্রুতপায়ে এগিয়ে চললেন বারান্দার দিকে। নীচু হয়ে খবরের কাগজটা তুলে নিলেন—মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলেন। তারই ফাঁকে ঘড়ির দিকে তাকালেন—সাতটা তিরিশমিনিট এক সেকেন্ড। যাক, ঠিকই আছে সময়টা। সময়ের গন্ডগোল হলেই বিপদ।

‘এই যে, মিস্টার সেন!’ সামনের খোলা বাগান থেকে নারীকণ্ঠ শোনা গেল।

এই ডাকটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন অতীশ। কারণ গত দু-বছর ধরেই সাতটা তিরিশমিনিট পাঁচ সেকেন্ডের সময় তিনি বারান্দায় কাগজ হাতে উপস্থিত থাকেন। এবং পাশের বাড়ির বাগান থেকে মিসেস সরকার তাঁকে ঠিক এইভাবেই ডাকেন।

মিসেস সরকারের দিকে চেয়ে হাসলেন অতীশ। মিসেস সরকার বাগানে জল দিচ্ছিলেন, পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর বছরসাতেকের বাচ্চা ছেলেটা।

‘হয় আপনি আজ দু-মিনিট আগে উঠেছেন, নয়তো আমার ঘড়ি দু-মিনিট স্লো আছে।’ হাসতে-হাসতে বললেন মিসেস সরকার।

ভীষণভাবে চমকে উঠলেন অতীশ। খবরের কাগজটা আর-একটু হলেই হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল। নাঃ, এই সময়ের ব্যাপারটায় আমাকে খুব সাবধান হতে হবে। কিন্তু দু-মিনিট আগে এলাম কেমন করে? তা হলে কি আমার ঘড়ি ভুল?

‘না মিসেস সরকার, আপনার ঘড়িই স্লো আছে দু-মিনিট।’

‘সে কি আর আমি জানি না!’ একগাল হাসলেন তিনি: ‘আপনাকে দেখেই তো আমার ঘড়ি মেলাই আমি।’

হঠাৎই সুর পালটে প্রশ্ন করলেন ভদ্রমহিলা, ‘একটু আগে কি আপনার বাড়িতে চেয়ার-টেবিল উলটে পড়েছিল?’

‘না তো! কেন?’

‘না, কেমন যেন একটা শব্দ শুনলাম। তাই—।’

মাই গড! আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছিল? ইস, বালিশটা যদি রুবির মুখে না চেপে, রিভলভারের নলে চাপতাম—।

‘ও, ওটা বাথরুমের দরজার শব্দ। দরজাটা কেমন যেন আটকে গেছিল। তাই জোরে খুলতে গিয়ে—।’

হাতঘড়ির দিকে চোখ পড়ল অতীশের—সাতটা আটতিরিশ। খবরের কাগজ ভাঁজ করে ঘরে ফিরে এলেন তিনি। ঘরে ঢোকার সময় শুনলেন মিসেস সরকারের ছেলে বাচ্চু ওর মা-কে বলছে, ‘মা, এখন ঠিক সাতটা বেজে আটতিরিশ মিনিট—।’

মনে-মনে খুশি হলেন অতীশ। ঠিক এইভাবেই তাঁকে চলতে হবে সাড়ে আটটা পর্যন্ত।

গত একবছর ধরেই অতীশ সন্দেহ করছেন যে, তাঁর অনুপস্থিতিতে (সকাল সাড়ে আটটা থেকে সন্ধে সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত) রুবি চলাফেরা করে বেড়াতেন। প্রায়ই দেখতেন, অফিসে যাওয়ার সময় যেটা যেরকম দেখে গেছেন, ফিরে আসার পর ঠিক সেইরকমটি আর নেই। একটু যেন অদলবদল হয়েছে। অথচ রুবি সেই একইভাবে বিছানায় শুয়ে আছেন। বাড়িতে যখন আর কেউ নেই, তা হলে ওগুলো সরাল কে? নিশ্চয়ই রুবি। রুবির চিন্তাকে মগজ থেকে সরিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে গেলেন অতীশ।

সাতটা চল্লিশ।

তিনটে স্যান্ডউইচ বের করলেন ফ্রিজ থেকে। ওঃ, আবার সেই ভুল! মনে-মনে নিজেকে প্রচণ্ড তিরস্কার করলেন অতীশ সেন। তাঁকে ভীষণ সাবধান হতে হবে। তাড়াতাড়ি একটা স্যান্ডউইচ ঢুকিয়ে রাখলেন ফ্রিজে। রোজ এই সময় তিনি দুটো স্যান্ডউইচই খান এবং তৃতীয় একটা নেন রুবির জন্য। গত দু-বছর ধরে তাই করেছেন। সুতরাং অভ্যাসবশে তিনটে স্যান্ডউইচ নিয়ে ফেলেছিলেন।

স্যান্ডউইচ দুটো শেষ করে অত্যন্ত সাবধানে ফ্রিজ থেকে নিজের জন্য একটা (দুটো নয়) ডিম বের করলেন। হিটাদের জল চাপিয়ে তার মধ্যে ডিমটা ছেড়ে দিলেন। হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল, তাড়াতাড়িতে শেভ করতেই ভুলে গেছেন। সর্বনাশ! এরকম উলটোপালটা হলেই মহা বিপদ!

তাড়াতাড়ি ওপরে গিয়ে ব্রিফকেসটা ঘর থেকে বের করে আনলেন (রুবির মৃতদেহের দিকে তাকালেন না অতীশ)। ওটা খুলে টাকার বান্ডিলের নীচ থেকে শেভ করার সাজ-সরঞ্জাম বের করে বাথরুমে ছুটলেন।

শেভ করে ব্রিফকেস আবার গুছিয়ে যখন ডাইনিং রুমে ফিরে এলেন, তখন সাতটা সাতান্ন।

চটপট ডিমটা প্রায় গিলে ফেললেন অতীশ। এরকম ভুল করলে কারও খুন করাই উচিত নয়। এক সেকেন্ডেরও গন্ডগোল তিনি হতে দেবেন না। ঠিক আটটায় পুপুকে সদর দরজা খুলে ঢোকাতে হবে বাড়িতে। রোজকার মতো।

আটটা বেজে এক সেকেন্ড।

তাড়াহুড়ো করে সদর দরজা খুললেন অতীশ। ঠিক পায়ের কাছেই দাঁড়িয়ে বেড়ালটা। দরজা খোলা পেয়ে ওটা ঘরে এসে ঢুকল। অতীশের পায়ে গা ঘষতে লাগল। পুপুকে গত দু-বছর ধরেই আটটায় দরজা খুলে ঘরে ঢোকান অতীশ। ধবধবে লোমের পুঁটলি যেন বেড়ালটা। সুন্দর দেখতে। অথচ রুবি এক্কেবারেই দেখতে পারতেন না ওটাকে। পুপু ছিল ওঁর দু-চক্ষের বিষ! এখন আর কোনও ভয় নেই পুপুর। আপনমনেই হাসলেন অতীশ।

আটটা তিন।

বেড়ালটাকে গত রাতের এঁটো খাবারগুলো রোজকার মতোই খেতে দিলেন অতীশ। তারপর ড্রইংরুমের চেয়ারে বসে জামা-প্যান্ট, জুতো চটপট পরে ফেললেন। এবার খবরের কাগজটা খুলে দেখতে লাগলেন।

আটটা বেজে ন’মিনিট।

ক্রিরি—ং—রি—রি—ং। একটুও চমকালেন না অতীশ। তিনি যেন এতক্ষণ ধরে এই ফোনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আয়েসী পায়ে এগিয়ে গেলেন ক্র্যাডলের কাছে। তুলে নিলেন রিসিভারটা।

‘হ্যালো—’ গম্ভীর স্বর ভেসে এল ও প্রান্তে থেকে।

‘অতীশ সেন স্পিকিং—’ খুব ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে হবে। ভাবলেন অতীশ।

‘আরে, অতীশ…আমি বড়ুয়া বলছি—।’

‘কী, বল।’

‘কী ঠিক করলি? কোথায় যাবি ছুটিতে?’

‘ভাবছি এই দু-সপ্তাহ একটু আশপাশ থেকে ঘুরে আসা যাবে।’ অতীশ দু-সপ্তাহ ছুটি নিয়েছেন অফিস থেকে এবং ছুটির মেয়াদ আজ থেকেই শুরু।

‘মিসেসকে সঙ্গে নিয়ে, না একা?’ বড়ুয়া হেসে জানতে চাইল।

‘তোর তাতে কী দরকার?’ ঠাট্টার সুরে বললেন অতীশ।

‘আচ্ছা—হ্যাভ আ গুড টাইম—’ ফোন রাখার শব্দ শোনা গেল।

রিসিভার নামিয়ে রাখলেন অতীশ সেন। তিনি যে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন, তা পাড়াপড়শিরা কেউই জানে না। ফলে আজও তিনি ঠিক সাড়ে আটটায় বাড়ি থেকে বেরোবেন। আশপাশের সবাই তাঁকে দেখে ঘড়ি মেলাবে। গত দু-বছর ধরে তাই হয়ে আসছে। বাসে করে তিনি অফিসের দিকেই প্রথমে যাবেন। তারপর সেখান থেকে বাসে চড়ে সোজা এয়ারপোর্ট। দশটা একুশে বম্বে যাওয়ার একটা ট্রেন আছে। তাতে চেপে সোজা বম্বে। সেখান থেকে পাঁচটা পঁয়তিরিশের প্লেনটা তাকে ধরতে হবে। গন্তব্যস্থল মাদ্রাজ। বম্বে থেকে যখন তিনি প্লেনে উঠবেন, তখন নাম এবং চেহারা তাঁকে পালটাতে হবে। মাদ্রাজে নেমে নিজেকে লোকের ভিড়ে মিশিয়ে ফেলতে তাঁর এতটুকু অসুবিধে হবে না। তখন কাজে লাগবে রুটির টাকাগুলো। আপনমনেই হাসলেন তিনি।

আটটা সতেরোমিনিট ছ’ সেকেন্ড।

আর দু-মিনিট চুয়ান্ন সেকেন্ড পর তাকে রোজের মতো রেডিও চালাতে হবে।

ক্রিরি—রি—রিং—।

একটু অবাক হয়ে অতীশ এগিয়ে গেলেন ফোনের দিকে। কিন্তু ফোনের কাছে গিয়েই তিনি যেন একটা শক খেলেন। হৃৎপিণ্ড যেন লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে গলা দিয়ে। না—ফোন নয়!

বাজছে দরজার কলিংবেল!

কে এল এই সময়ে (অথবা অসময়ে!)?

দুরুদুরু বুকে দরজার দিকে এগিয়ে এলেন অতীশ। দরজা খুললেন।

সামনে দাঁড়িয়ে একজন সুবশেধারী যুবক। পরনে কোট, প্যান্ট, টাই—ফিটফাট।

‘কী চাই?’ দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রইলেন অতীশ। যাই হোক না কেন, দরজা থেকে কিছুতেই সরব না। ভাবলেন তিনি।

‘এটাই তো আটাশ নম্বর বাড়ি?’

‘হ্যাঁ।’

অতীশ হঠাৎ খেয়াল করলেন, যুবকের পায়ের কাছে দাঁড় করানো একটা বড় প্যাকেট।

‘মিস্টার সেন তো আপনিই?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমি নাহাটা ডিস্ট্রিবিটার থেকে আসছি। আপনার ওয়াইফ একটা অটোমেটিক প্রেশার কুকারের অর্ডার দিয়েছিলেন, তাই—।’

‘না, না, ওসব কুকার-ফুকার লাগবে না আমাদের।’ দরজা বন্ধ করতে গেলেন অতীশ।

‘মিস্টার সেন, যিনি অর্ডার দিয়েছিলেন, তিনি ক্যান্সেল করলেই আমরা অর্ডারটা ক্যান্সেলড বলে মনে করব, নয়তো নয়। আপনি কাইন্ডলি একবার মিসেস সেনকে খবর পাঠান। আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

উঃ—যত জ্বালা। এখন কী করবেন অতীশ?

হঠাৎ খেয়াল হতেই দরজা ছেড়ে ভেতরে এসে রেডিওটা অন করে দিলেন তিনি। আবার ফিরে গেলেন দরজায়।

আটটা একুশ।

‘মিসেস সেন এখনও ঘুম থেকে ওঠেননি।’ পরমুহূর্তেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলে উঠলেন, ‘উঠেছেন—মানে এখন ব্রেকফাস্টে বসেছেন।’

‘আমি একবার ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ ঘরের ভেতর পা বাড়াল যুবক।

‘দাঁড়ান মশাই! আপনি ভেতরে ঢুকছেন কার হুকুমে?’ উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন অতীশ। নাঃ, রাগলে চলবে না। মনে-মনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। লোকটা সন্দেহ করতে পারে।

‘আমার স্ত্রী কি নিজে আপনাকে অর্ডার দিয়েছিলেন?’ এবার কণ্ঠস্বর যথেষ্ট মোলায়েম।

‘হ্যাঁ।’

তা হলে অতীশ এতদিন যা সন্দেহ করেছেন তাই। তিনি অফিসে চলে গেলে রুবি হেঁটে বেড়াতেন।…না, আর ঝামেলা করা ঠিক হবে না। অফিস (?) যাওয়ার সময় হয়ে এল। সময়ের এতটুকু এদিক-ওদিক হলেই তাঁর কল্পনার স্বর্গ ধুলোয় মিশে যাবে।

‘কত হয়েছে আপনার বিল?’

‘দু-শো আট টাকা ষাট পয়সা।’

একমুহূর্তও সময় নষ্ট করলেন না অতীশ। ছুটলেন শোওয়ার ঘরে। ব্রিফকেস খুলে হাতড়ে বের করলেন একশো টাকার বান্ডিলটা। তিনটে নোট টেনে নিয়ে ব্রিফকেস বন্ধ করে দ্রুতপায়ে নীচে নেমে এলেন। হাঁপাতে-হাঁপাতে নোট তিনটে তুলে দিলেন যুবকটির হাতে।

আটটা বাইশ।

‘আমার কাছে ভাঙানি নেই। আচ্ছা, আমার সঙ্গে আসুন—ওই মোড়ের দোকানটা থেকে ভাঙিয়ে দিচ্ছি।’

অতীশের কানে কেউ যেন গরম সীসে ঢেলে দিল। এ তো দেখছি মহা ঝামেলায় পড়া গেল। আর মাত্র আটমিনিট বাকি!

‘ঠিক আছে, এটা দিন।’ একটা নোট ছিনিয়ে নিলেন অতীশ ‘আমার কাছে অন্য আরও নোট আছে—’ অবাধ্য জিভকে শাসন করে আবার বললেন, ‘মানে, দশটাকার নোটও আছে।’

মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হলেন অতীশ। শোওয়ার ঘরে গিয়ে আবার ব্রিফকেস খুলে পাগলের মতো নোটের গাদা হাতড়াতে লাগলেন। কোথায় গেল দশটাকার বান্ডিলগুলো? এই তো! একটা নোট টেনে নিয়ে প্রায় দৌড়েই ফিরে এলেন দরজায়।

আটটা তেইশ।

‘প্যাকিং আর ডেলিভারি মিলিয়ে পড়ল এক টাকা সাঁইতিরিশ পয়সা। তা হলে মোট হল দু-শো ন’টাকা পচানব্বই পয়সা।’ আপনমনেই হিসেব করতে শুরু করল যুবক: ‘তা হলে আপনি পাবেন পাঁচ পয়সা।’

‘ওটা আপনি রেখেই দিন…আমার দরকার নেই।’ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন অতীশ।

আটটা চব্বিশ।

‘না, না…এই তো, আমার কাছে একটা পাঁচ পয়সা আছে।’ জামা-প্যান্টের পকেট হাতড়াতে আরম্ভ করল যুবক: ‘কোথায় গেল—’ একটু আগেই তো ছিল পকেটে।’

‘আমার কোনও দরকার নেই। কোনও ভিখিরিকে দিয়ে দেবেন।’ দরজা বন্ধ করতে গেলেন অতীশ। রাগে তাঁর চোখ-মুখ লাল।

হাত দিয়ে বাধা দিল যুবক।

আটটা পঁচিশ।

‘এই তো—এই যে পেয়েছি। নিন।’

হাত বাড়িয়ে পাঁচ পয়সা নিলেন অতীশ। দরজা বন্ধ করলেন। উঃ!

আবার বেল বেজে উঠল! দরজা খুলতেই চোখে পড়ল সেই যুবকের হাসিমুখ।

আটটা ছাব্বিশ।

‘কুকারটা নিতেই আপনি ভুলে গেছেন, মিস্টার সেন।’ প্যাকেটটা এগিয়ে দিল যুবক।

‘ওঃ—কী ভুলো মন আমার। ধন্যবাদ।’

দরজা বন্ধ করে হাঁফ ছাড়লেন অতীশ। খুব জোর বেঁচে গেছেন! মরে গিয়েও রুবি তাঁকে জ্বালাতে ছাড়ছেন না। এই কুকারের অর্ডার দেওয়ার কী দরকরা ছিল?

আটটা সাতাশ।

ঠক—ঠক—ঠক।

তড়িৎস্পৃষ্টের মতো লাফিয়ে উঠলেন অতীশ। কে? কে এল আবার?

দরজা খুলে দাঁড়াতেই রাগে তাঁর সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল। দরজায় দাঁড়িয়ে সেই যুবক। মুখে কান এঁটো করা হাসি।

‘বিলটা দেওয়ার কথা ভুলেই গেছিলাম। তাই আবার ফিরে এলাম। এই নিন।’

হাত বাড়িয়ে বিলটা নিলেন তিনি। কষ্টকৃত হাসি হেসে দরজা বন্ধ করলেন। কুকারের প্যাকেটের মধ্যে বিলটা গুঁজে দিলেন। তারপর এক-এক লাফে তিনটে করে সিঁড়ি ভেঙে গেলেন দোতলায়। ব্রিফকেসে চাবি এঁটে ওটাকে হাতে নিলেন। রুবির মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নেমে এলেন ড্রইংরুমে। একটুর জন্য আজ বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন।

আটটা উনতিরিশ।

আয়নায় চেহারাটা একবার দেখে তৈরি হলেন। ব্রিফকেস নিয়ে যখন তিনি বাইরের লনে পা দিলেন, তখন ঠিক সাড়ে আটটা বাজতে পনেরো সেকেন্ড বাকি (গত দু-বছরের মতোই)।

মিসেস সরকার তখনও বাগানে দাঁড়িয়ে গাছের পরিচর্যা করছিলেন।

‘মিস্টার সেন, মিসেস আজ কেমন আছেন?’

মিষ্টি হাসি হাসলেন অতীশ: ‘ভালোই আছেন। আজ একটা ওষুধ দিয়েছি ওঁকে—সেই ব্যথাটার জন্যে।’

‘ওই ব্যথাটার জন্যেই তো ভীষণ কষ্ট পান আপনার মিসেস।’ সহানুভূতির গলয় বললেন মিসেস সরকার।

‘আর কখনও কষ্ট পাবেন না উনি।’ নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন: ‘আচ্ছা চলি।’

‘মা,’ বাচ্চু সরকার বলল ওর মা-কে। ‘এখন ঠিক সাড়ে আটটা বাজে।’

‘বৃথা বিলম্বে কালাতিপাত করিও না।’ টাইপের পদক্ষেপে হনহন করে বাস-স্টপের দিকে হাঁটছিলেন অতীশ সেন। আশপাশের পাড়াপড়শিরা তাঁকে দেখে নিজেদের ছেলেমেয়েদের যে সময়ানুবর্তিতা সম্বন্ধে জ্ঞান দিচ্ছেন, তা তিনি রোজকার মতোই (গত দু-বছর ধরে) বুঝতে পারলেন।

সাড়ে ছ’টায় যখন তিনি ফিরবেন না (গত দু-বছরে এই প্রথম ঘটবে) তখন সবাই সেটাকে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মনে করবে।

সাড়ে সাতটা বাজলে সবাই চিন্তিত হয়ে উঠবে।

সাড়ে আটটায় তাঁর বাড়িতে খোঁজ করতে যাবে এবং থানায় ফোন করলে পর সাড়ে ন’টায় পুলিশ এসে পৌঁছবে। ততক্ষণে তিনি হাজার-হাজার মাইল দূরে—পুলিশের নাগালের বাইরে।

এয়ারপোর্টে সিকিওরিটি চেকের জন্য এগোতে যাবেন, এমন সময় পিছন থেকে তাঁর কাঁধে হাত রাখল কেউ। চমকে ফিরে তাকালেন অতীশ।

কঠিন চৌকো চোয়াল। সরু গোঁফ। গালে একটা কাটা দাগ। জোড়া ভুরু। কোট-প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে।

অতীশ আচমকা ঘাবড়ে গিয়ে বোর্ডিং পাসটি ভদ্রলোকের দিকে সাততাড়াতাড়ি এগিয়ে ধরলেন।

উত্তরে ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা আইডেন্টিটি কার্ড বের করলেন। লাউঞ্জের আলোয় কার্ডটা ঝলসে উঠল।

‘মিস্টার সেন, আপনাকে একবার আমার সঙ্গে আসতে হবে। আপনার স্ত্রীর মিস্টিরিয়াস ডেথের ব্যাপারে আপনাকে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করার আছে।’

অতীশ সেনের হঠাৎ মনে হল, তাঁর পা দুটো যেন খুঁজে পাচ্ছেন না। ভদ্রলোক হয়তো আরও কিছু বলছিলেন, কিন্তু অতীশের সেসব বোধগম্য হল না। অবশ দেহে টলে পড়ে যাচ্ছিলেন। ইন্সপেক্টর এগিয়ে এসে তাঁকে ধরে ফেললেন।

খানিকটা স্বাভাবিক হওয়ার পর অতীশ প্রশ্ন করলেন, ‘এত—এত—’ তাঁর গলা দিয়ে কাঁসরঘণ্টার ফ্যাঁসফেঁসে আওয়াজ বেরিয়ে এল, ‘এত তাড়াতাড়ি কী করে জানতে পারলেন আপনারা?’ আর কোনও কথা খুঁজে পেলেন না তিনি।

ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর হাসলেন: ‘মিস্টার সেন, আপনি এবং আপনার স্ত্রী—আপনারা দুজনেই পাংচুয়ালিটির সিম্বল ছিলেন। ডেইলি রুটিনে কখখনো এক সেকেন্ডেরও হেরফের হত না আপনাদের।’

‘আমাদের ডেইলি রুটিনে?’ বিড়বিড় করলেন অতীশ, ‘রুবির ডেইলি রুটিনে?’

‘কেন, আপনি জানেন না?’ ভীষণ মজার হাসি হাসলেন অফিসার: ‘আপনার ওয়াইফ ঘড়ি মেপে সব কাজ করতেন। আমরা সব জানতে পেরেছি ওই পুপুর জন্যে!’

অতীশ হাঁ করে চেয়ে রইলেন অফিসারের দিকে। ব্যাপারটার কিছুই তখনও তাঁর মাথায় ঢোকেনি।

অফিসার একটু হেসে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘মিস্টার সেন, পাড়াপড়শিরা আপনাকে দেখে যে ঘড়ি মেলাত, এ-কথা ঠিক। তবে সেটা শুধুমাত্র সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত। তারপর থেকে তাদের কাছে পাংচুয়ালিটির আইডল ছিলেন রুবি সেন। গত দু-বছর ধরে আপনি যেমন ঠিক আটটায় পুপুকে বাড়িতে ঢোকান তেমনি আপনি বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক দশমিনিট পর—অর্থাৎ, কাঁটায়-কাঁটায় সকাল আটটা চল্লিশমিনিটে মিসেস সেন পুপুকে ছুড়ে দিতেন বাইরের লনে—গত দু-বছর ধরেই।

‘এই মজার দৃশ্য দেখে বাচ্চু—মিসেস সরকারের ছেলে—ঠিক আটটা চল্লিশের সময় মজা করে বলে উঠত, মা, দ্য ক্যাট ইজ আউট অফ দ্য ব্যাগ।

‘আজ আটটা পঞ্চাশেও যখন বেড়ালটা বাইরে এল না, তখন ও অবাক হয়ে মা-কে এ- বিষয়ে প্রশ্ন করে। মিসেস সরকার খুবই কৌতূহলী মহিলা। তা ছাড়া তিনি জানতেন, রুবি সেন অসুস্থ। তাই সন্দেহের বশে মিসেস সরকার আপনার বাড়িতে খোঁজ করতে যান। তারপর—’ হেসে ফেলেন অফিসার: ‘মিস্টার সেন, দ্য ক্যাট ইজ নাউ রিয়্যালি আউট অফ দ্য ব্যাগ।’

হতভম্ব অতীশ সেন হাত দুটো এগিয়ে দিলেন ইন্সপেক্টরের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *