বিজয় কত দূর

বিজয় কত দূর

১৯২২ সাল। মারাকেশ তখন গোলামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ এক রাষ্ট্র। এক দেশের গোলাম নয়। দুই দেশের গেলাম। মারাকেশের এক অংশের দখলদার স্পেনিশরা। অন্য অংশের দখলদার ফ্রান্সীরা। ফ্রান্সীদের দখলেই ছিলো বেশির ভাগ অংশ।

১৯২২ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। মারাকেশের স্পেনীয় এক এলাকায় এক সেনা ক্যাম্প ছিলো। ক্যাম্পে সৈন্যসংখ্যা ছিলো হাজারখানেক। স্পেনিশ জেনারেল সেলিষ্টার সেদিন ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন। জেনারেলের আগমন উপলক্ষে পুরো ক্যাম্প জুড়ে সাজ সাজ রব। প্রত্যেক সৈনিক ও প্রতিটা জিনিস জেনারেলের সামনে পরিদর্শিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত।

জেনারেল সেসিষ্টার ক্যাম্প পরিদর্শন করছিলেন। আচমকা ক্যাম্পে চিৎকার চেঁচামেচি আর হৈ হৈ রোল উঠলো। মুহূর্তেই তা কেয়ামতের বিভীষিকার রূপ নিলো। আসলে ক্যাম্পে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিলো। হামলাকারীরা হলো মারাকেশের মুজাহিদরা। সংখ্যায় তারা স্পেনিশ ফৌজের দশভাগের এক ভাগ। তাদের অস্ত্র হলো, লাঠি, তরবারি, বর্ষা ও খঞ্জর। এসব দিয়ে তারা এমন ফৌজের ওপর হামলা করলো যাদের কাছে আছে দূর পাল্লার রাইফেল, মেশিনগান, হাত বোমা, পিস্তল ও তোপ কামান।

মুজাহিদদের হামলা যেমন আচমকা ছিলো তেমনি ছিলো তীব্র আর অপ্রতিরোধ্য। এই হামলায় সবচেয়ে বড় যে হাতিয়ার ব্যবহৃত হচ্ছিলো সেটা হলো স্বাধীনতার তীব্র আকুতি ও মুক্তির দৃঢ় অঙ্গিকার। এই জযবা ও চেতনাদীপ্ত হামলা এতই শক্তিশালী ছিলো যে, অধিকাংশ স্পেনিশ সেনা অফিসার মারা গেলো বা যখমী হলো। অল্প কিছু পালাতে পারলো। সৈনিকদের মধ্যে দেড় দুইশ পালাতে পারলো। প্রায় সাতশর মতো মারাত্মকভাবে হলো আহত। বাকিরা সব মারা গেলো। মুজাহিদরা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র গনীমত হিসেবে পেলো। তারপর তাদের গোপন ক্যাম্পে ফিরে গেলো।

এ ছিলো মারাকেশের মুজাহিদদের প্রথম হামলা। তাদের নেতা ছিলো গুমনাম এক লোক। যে নাকি পরবর্তীতে সারা দুনিয়ায় বীর আবদুল করীম নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। ফ্রান্স ও স্পেনের ফৌজরা তার নাম শুনলে কেঁপে উঠতো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চার বছর পূর্বে নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাত দিয়ে ফ্রান্সী ফৌজ মারাকেশে প্রবেশ করে। ধোঁকা প্রতারণা আর ষড়যন্ত্র করে এবং ফৌজি শক্তি খাঁটিয়ে মারাকেশের বড় একটি অংশ দখল করে নেয়। স্পেনিশরাও এভাবে জবর দখল চাপিয়ে মারাকেশের কিছু অংশ দখল করে নেয়। তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স আলজাযারের সঙ্গে মারাকেশকেও নয়া প্রদেশ বানিয়ে ফেলে। নিজেদের সেনা সংখ্যাও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করে সেখানে। এভাবে মারাকেশে তারা ফ্রান্সসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের উদ্বাস্তু লোকদের আমদানী করতে থাকে। আরেকদিকে স্পেনিশরাও সমান হারে স্পেনিশ নাগরিকদের মারাকেশে আবাদ করতে থাকে।

এই দুই জবরদখলকারী সাম্রাজ্যবাদীদের জাতাকলে পড়ে মুসলমানরা নিজেদের অস্তিত্ব হারাতে বসলো। তারা বেঁচে থাকার সব উপকরণ যেন মুসলমানদের জন্য হারাম করে দিলো। এই দুই অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী দেশের উদ্দেশ্য ছিলে একটাই। সেটা হলো, মারাকেশকে যেন বিশ্বের কেউ মুসলমান রাষ্ট্র বলতে না পারে।

ফ্রান্সের কমান্ডার ছিলেন জেনারেল লাইটে। যিনি ছিলেন বিশ্ব স্বীকৃত চালবাজ। তিনি মারাকেশের মুসলমানদের গোলাম বানানোর জন্য সেই পুরনো ফর্মুলাই কাজে লাগান যা ইংরেজরা উপমহাদেশে দখলের সময় আবিষ্কার করেছিলো। সে হলো, জেনারেল লাইটে মারাকেশের নেতৃস্থানীয় মুসলমান যারা বিভিন্ন গোত্র ও এলাকার প্রধান ছিলেন। তাদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ ও হিংসা-বিদ্বেষ উস্কে দিলো এবং প্রত্যক্ষ শত্রুতার অবস্থা সৃষ্টি করে জাতিগত ঐক্য ধ্বংস করে দিলো। তাদের মধ্যে যারা ক্ষমতাধর ছিলো তাদেরকে দিলো অঢেল সম্পদ। কাউকে কাউকে দেয়া হলো জায়গীর। আর সাধারণ লোকদের দুবেলার রুটি খাওয়ার অধিকারও ছিনিয়ে নিলো।

এ অবস্থায় যেকোন দেশ-জাতি দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য রুখে দাঁড়ায়। লড়াই করে। কিন্তু মারাকেশের বেলায় ঘটলো উল্টো ব্যাপার। মনে হচ্ছিলো, এদেশ থেকে স্বাধীনতার সামান্য অনুভূতিও মুছে গেছে। যেন গোলামির শিকলকে ফুলের মালা বলে গলায় ধারণ করে নিয়েছে।

জীবন্ত এক জাতি সত্বা সন্তানরা মরে যায় কিন্তু জাতির ঐতিহ্য কখনো মরে না। জীবন্ত থাকে জাতির অন্তর-সত্তা। যা কোন এক মানবের রূপ ধারণ করে জেগে উঠে।

জেগে উঠলো মারাকেশের অন্তরসত্তাও। আবদুল করীম আল খাত্তাবীর রূপ ধারণ করে জেগে উঠলো। যিনি স্বাধীনতার এক অদম্য শ্লোগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তার পিতা ওকে শিক্ষা দিয়েছিলো সর্বোচ্চ শিক্ষা। সেটা হলো আইনের শিক্ষা। কিন্তু শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও সম্মানজনক জীবিকার দ্বার তার জন্য উন্মুক্ত হলো না। কারণ তিনি ছিলেন মুসলমান।

আব্দুল করীমদের বাড়ি হলো মারাকেশের স্পেনীয় এলাকায়। আইনের কোন চাকুরি না পেলেও আবদুল করীম অন্য একটা চাকরি পেয়ে গেলেন। স্পেনিশ আর্মির অফিসারদের ইংরেজির মাধ্যমে মারাকেশি ভাষা শিক্ষা দেয়া। কৈশোর থেকেই আব্দুল করীমের মধ্যে আযাদীর স্বাধীনতার সহজাত চেতনা ও উন্মত্ততা ও বিদেশী মুনিবদের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিলো। যেটা তিনি কখনো চেপে রাখতে পারতেন না।

এক দিন স্পেনিশ আর্মি অফিসারদের পড়াচ্ছিলেন। ক্লাশে স্পেনিশ সেনাবাহিনী প্রধান স্নেষ্টারও ছিলেন। এক অফিসার আবদুল করীমের বেশ কয়েকিট প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারেনি বলে আব্দুল করীম তাকে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন। জেনারেল স্লেষ্টার এটা সহ্য করতে পারলেন না। গোলাম হয়ে তার মুনিবদের ধমকে উঠবে? এত বড় স্পর্ধা

নিজেকে তুমি কর্মচারী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারবে না। ভদ্রতা নিয়ে কথা বলতে শিখে এসো- জেনারেল ষ্টোর যেন চাবুক মারলেন।

আব্দুল করীম মোটেও বিচলিত হলেন না। তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। চোখে তীব্র চাহনি দিয়ে প্রথমে জেনারেলকে আঘাত করলেন আব্দুল করীম। তারপর উল্টো চাবুক ছুড়লেন

এর চেয়ে অসভ্যতা আর কি হতে পারে যে, তুমি তোমার শিক্ষককে ধমকাচ্ছো?

জেনারেল স্লেষ্টার তখন অকথ্য ভাষায় তাকে গালাগাল করলো। আব্দুল করীম তাকে বললেন–

স্পেনীয় অফিসাররা শুনে রাখখ, মারাকেশ মুসলমানদের দেশ। তোমাদের নয়। একদিন না একদিন তোমাদের এখান থেকে পালাতে হবে- আবদুল করীম এই বলে ক্লাশ থেকে বেরিয়ে গেলেন- আমি তোমাদের এই চাকরির ওপর অভিশাপ দিচ্ছি।

আব্দুল করীম ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেন না। জেনারেলকে তিনি যে কথা বলেছিলেন সেটা ছিলো বিদ্রোহের নামান্তর। আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে বের হতেই তাকে গ্রেফতার করা হলো এবং মামলা ছাড়াই জেলখানায় বন্দি করা হলো।

গ্রেফতারির মাত্র বিশ দিন অতিবাহিত হয়েছে। সকাল বেলা জেলখানার অফিসারদের কাছে রিপোর্ট করা হলো, আব্দুল করীম গত রাতে ফেরার হয়ে গেছেন।

আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারেনি, আবদুল করীম জেলখানার ওই দুর্ভেদ্য প্রাচীর কি করে অতিক্রম করলো। কর্তব্যরত প্রহরী ও পুলিশদের ভয়ংকর শাস্তি দেয়া হলো। বহু জায়গায় তল্লাশি চালানো হলো। আব্দুল করীমের ছায়াও কেউ মাড়তে পারলো না। এমনকি তিনি কি করে জেলখানা থেকে ফেরার হলেন তাও বহু তদন্ত করে বের করতে পারলো না। কারণ, সেই জেলখানা থেকে কোন কয়েদীর পালানো একেবারেই অসম্ভব ছিলো।

আব্দুল করীমের ব্যাপারে সংবাদ পাওয়া গেলো, এক পাহাড়ি এলাকায় স্বাধীনতাকামীদের হেড কোয়ার্টার ও ট্রেনিং ক্যাম্প বানিয়েছেন। কিন্তু সে পাহাড়ি এলাকা কোনটা সেটা কেউ খুঁজে বের করতে পারলেন না।

আব্দুল করীম গোপন আন্দোলনের এমন চমৎকার নকশা তৈরী করলো যে, অল্প সময়ের মধ্যেই অসংখ্য মুজাহিদ তার ঝাণ্ডা তলে সমবেত হয়। ফ্রান্সী ও স্পেনীয়দের অসহনীয় জুলুম নির্যাতন মুসলমানদের জেগে উঠতে বাধ্য করে। বিশেষ করে দুই দখলদার বাহিনীর ফৌজদের জনসাধারণের সঙ্গে ছিলো হিংস্র জানোয়ারের মতো আচরণ।

মারাকেশের মুজাহিদদের একটা দুর্বলতা ছিল। সেটা হলো- তাদের কাছে অন্ত্রভাণ্ডার ছিলো না। অথচ একই সঙ্গে স্পেন ও ফ্রান্সীদের মতো দুই পরা শক্তির সঙ্গে তাদের লড়তে হচ্ছিলো। এদিকে ফ্রান্সীরা বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচার করে দিয়েছে, মারাকেশের আসল শাসন ক্ষমতা মারাকেশি মুসলমানদের হাতেই রয়েছে। ফ্রান্সী ফৌজ শুধু একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় মারাকেশের শাসন শৃংখলা অক্ষুণ্ণ রাখার কাজে সহায়তা করছে। কারণ, বিপথগামী কিছু বেদুইন গোত্র বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।

 এই মিথ্যা প্রোপাগান্ডার জবাব দেয়ার মতো কোন কিছুই ছিলো না মারাকেশিদের হাতে। পুরো খ্রিষ্ট জগতই তখন তাদের বিরুদ্ধে। ক্রুসেড়ে সালাহ উদ্দিন আইয়ূবির কাছে পরাজিত হওয়ার বদলা নিচ্ছিলো খ্রিস্ট জগত।

আব্দুল করীম তার সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধার দলে সব রকম বৈচিত্ৰই আনার চেষ্টা করছিলেন। তাই তিনি তার দলের মধ্য থেকে একদল গুপ্তচরও তৈরী করেন। এক বছরের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের এক সেনা বাহিনী দাঁড়িয়ে যায়। তবে অস্ত্রবিহীন বাহিনী। অস্ত্র সংগ্রহ তাই জরুরী ছিলো। যার একমাত্র মাধ্যম ছিলো, ছোট ছোট ফৌজি চৌকিগুলোর ওপর নৈশ হামলা চালানো। আর এজন্য জানবার্য বাহিনীর প্রয়োজন ছিলো। মুজাহিদরা প্রস্তুত হয়ে গেলো জানবাযির জন্য।

এক গুপ্তচর আবদুল করীমকে সংবাদ দিলো, স্পেনিশ জেনারেল ষ্টোর অমুক দিন অমুক ক্যাম্প পরিদর্শনে যাচ্ছেন। সে ক্যাম্পে রয়েছে এক হাজার সৈন্য এবং সব ধরনের আধুনিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ।

এ ধরনের শক্তিশালী বাহিনীর ওপর দিনের বেলা হামলা করা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আব্দুল করীম জেনারেল ষ্টোরের নাম শুনতেই তার রক্তের মধ্যে বিপুল আলোড়ন অনুভব করলেন। তার ভেতর জ্বলে উঠলো প্রতিশোধের আগুন। সেই তো আব্দুল করীমকে অন্যায়ভাবে জেলে ভরে ছিলো। সব মুজাহিদকে এক জায়গায় একত্রিত করে ঘোষণা দিলেন, ক্যাম্পে এই জেনারেল থাকতে থাকতেই হামলা করতে হবে। আর এই জেনারেলকে মেরে ফেলতে পারলে স্পেনীয়দের পা উপড়ে যাবে।

মুজাহিদরা তো এই হুকুমেরই অপেক্ষায় ছিলো। জান কুরবান করা তো তাদের কাছে এখন বড় আগ্রহের এক মিশন। হামলার জন্য তৈরী হয়ে গেলো তারা। সংখ্যায় তারা অনেক কম ছিলো। তাদের ট্রেনিংই দেয়া হয়েছিলো এমনভাবে যে অল্প সংখ্যক সৈন্য অধিক সংখ্যক বাহিনীর ওপর হামলা করে পযুদস্ত করে দেবে।

নির্ধারিত দিনে জেনারেল স্লেষ্টার ফৌজি ক্যাম্পে পৌঁছলেন। ওদিকে আব্দুল করিমের নেতৃত্বে ছোট একটা মুজাহিদ দল ক্যাম্পের কাছাকাছি এমন এক জায়গায় অবস্থান নিলো যেখানে কেউ তাদের দেখার কথা নয়। জেনারেল এসে মাত্র পরিদর্শন শুরু করেছেন এসময় মুজাহিদরা তলোয়ার, বর্শা, খঞ্জর ও ভারি পাখর নিয়ে ক্যাম্পের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।

এমন আচমকা ও ক্ষিপ্র হামলায় স্পেনীরা দিশেহারা হয়ে উঠলো। তারা পাল্টা প্রতিরোধ করার অনেক চেষ্টা করলো। কিন্তু মুজাহিদরা সামলে উঠার সে সুযোগ তাদেরকে দিলো না। আবদুল করীম জেনারেল ষ্টোরকে খুঁজছিলেন। জেনারেল তার অফিসার ও বডিগার্ডদের নিয়ে পালাতে চেষ্টা করছিলেন।

***

আবদুল করীম তাকে দেখে ফেললেন, অফিসার ও বডি গার্ডদের বেষ্টনীতে রয়েছেন জেনারেল। তাদের মেশিনগানগুলো অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে লাগলো। মুজাহিদরাও যখমী ও শহীদ হতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে আব্দুল করীমের গর্জনও শোনা যেতে লাগলো- আমি জেনারেল স্লেষ্টারকে জীবিত বা মৃত নিয়ে যেতে চাই।

এ ছিলো বিস্ময়ে হতভম্ব হওয়ার মতো এক লড়াই। লাঠি তলোয়ার বর্ষা মোকাবেলা করছিলো স্টেনগান ও রিভলবারের। এক দিকে ছিলো অভিজ্ঞ সেনা দল ও সেনাদল থেকে বাছাই করা বডিগার্ডরা। আরেক দিকে ছিলো সৈনিকী অভিজ্ঞতাহীন মুজাহিদ দল। যাদের কাছে জযবা ও নারায়ে তাকবীর ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। মুজাহিদ বাহিনী জযবাদীপ্ত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থাতেই জেনারেলের ফৌজি বেষ্টনী ভেঙ্গে ফেললো। ইতিমধ্যে মুজাহিদদের হাতে মৃত স্পেনিদের অনেক অস্ত্রই উঠে এসেছে। সেগুলো দিয়েই তারা রক্ষি বাহিনীর ওপর হামলে পড়লো এবং হেফাজত বেষ্টনী ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেলো।

একটু পর স্পেনীশদের প্রধান জেনারেল স্লেষ্টার আবদুল করীমের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জেনারেল প্রাণ ভয়ে কাপ ছিলেন। আব্দুল করীম প্রতিশোধের আগুনে উন্মত্ত হয়ে বললেন

আমি তোমাকে বলে ছিলাম না যে মারাকেশ মুসলমানদের? তোমাদেরকে এখান থেকে বের হয়ে যেতে হবে। কিন্তু তুমি জঙ্গি শক্তির নেশায় পড়ে আমাকে জেলে ছুঁড়ে মারতেও দ্বিধা করলে না।

শোন আব্দুল করীম, জেনারেল গলায় জোর দিয়ে বললেন- তোমরা স্বাধীনতার স্বাদ পাবে না কখনো। আর মনে রেখো, আমাকে হত্যার প্রতিশোেধ সারা দেশের প্রতিটি মুসলমানের কাছ থেকে নেয়া হবে। কারণ, তোমাদের কাছে কোন শক্তি নেই।

আমাদের শক্তি হলো আমাদের আল্লাহ ও তার প্রতি আনীত ঈমান। আব্দুল করীম নিজের বুকে চাপড় মেরে বললো- তোমাদের কল্পিত খোদার অস্তিত্ব যদি সত্যিই থেকে থাকে তাকে বলো আমার ও আমার মুজাহিদদের হাত থেকে তোমাকে জীবিত মুক্ত করে নিয়ে যেতে।

জেনারেল স্লেষ্টার প্রথমে কিছু হুমকি দিলো। যখন দেখলো, এসব হুমকিকে তারা মশা মাছির সমানও পাত্তা দিচ্ছে না তখন কোটি কোটি টাকার লোভ দেখালো। বন্ধুত্ব ও সান্ধির প্রস্তাব দিলো। ওয়াদা করলো মারাকেশ থেকে স্পেনিশ বাহিনীকে নিয়ে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু আব্দুল করীমের অনঢ় কণ্ঠ নির্দেশ দিলেন

হে মুজাহিদরা! মারাকেশের সেই অসংখ্য নিরপরাধ মুসলমানদের হত্যার প্রতিশোধ নাও, যারা এই কাফের রক্ত চেষ্টা পিশাচের হুকুমে নিহত হয়েছে।

মুহূর্তের মধ্যে একই সঙ্গে কয়েকটি বর্শা ও তলোয়ার জেনারেলের দেহ ছিন্নভিন্ন করে ফেললো।

লড়াইয়ের ময়দান ততক্ষণে মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। উপরন্তু সারা ক্যাম্পে যখন এ খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, তাদের জেনারেল মারা গেছে তখন তো স্পেনিশদের অবশিষ্ট মনোবলও ভেঙ্গে পড়লো। ক্যাম্পের চার দিকে রক্ত আর রক্ত। এ অবস্থা দেখে দুশমন হাতিয়ার ফেলে পালাতে শুরু করলো। অনেক সৈনিক পালাতে গিয়ে মারা পড়লো। যারা ক্যাম্পে রইলো তারা হলো ভীষণভাবে আহত। বাঁচতে পারলে তারাই যারা নিরাপদে পালাতে পারলো।

মুজাহিদরা বিপুল পরিমাণে অস্ত্র ও অন্যান্য রসদপত্র উঠাতে লাগলো। শহীদদের লাশেরও ব্যবস্থা করে ফেললো অল্প সময়ের মধ্যে। মুজাহিদদের বাহন ছিলো প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম। ক্যাম্প থেকেই অনেক উট, গাধাও পেয়ে গেলো মুজাহিদরা। স্পেনিশ হেড কোয়ার্টারে এই সংবাদ পৌঁছার আগেই মুজাহিদরা নিজেদের গোপন ক্যাম্পে ফিরে গেলো। মুজাহিদদের চলে যাওয়ার পর স্পেনিশ ক্যাম্পে লাশ ও আহত সৈনিকরা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।

***

স্পেনিশরা তাদের দখলকৃত মারাকেশের অংশে জায়গায় জায়গায় বহু ছোট বড় ফৌজি চৌকি বসায়। আবদুল করিমের মুজাহিদ বাহিনী সে সব চৌকিতে গিয়ে বেশ কয়েকবার এধরনের হুমকি সহ ঘোষণা দিলো

ঐ সাদা চামড়াওয়ালারা! হাতিয়ার দিয়ে দাও এবং আমাদের কাছে এসে আত্ম সমর্পণ করো। না হয় এখান থেকে একজনও প্রাণ নিয়ে পালাতে পারবে না।

প্রতি রাতেই কোন না কোন চৌকির আশেপাশে এধরনের ঘোষণা শোনা যেতে লাগলো। মরুর নিঃশব্দ রাতে এ ধরনের গর্জন স্পেনীয়দের কলজে কাঁপিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। মনে হতো এ কোন ভূত প্রেত বা অশারীরিক আওয়াজ। সহস্রাধিক সৈন্যের ক্যাম্পে মুজাহিদদের সফল আক্রমণ এবং জেনারেল ষ্টোরের মতো প্রকাশনী এক জেনারেলের মৃত্যু স্পেনিশদের মধ্যে দারুণ আতংক সৃষ্টি করে।

এতে যে কাজটা হলো সেটা হলো, যে চৌকিতেই রাতে গিয়ে মুজাহিদরা হুমকি দিতো সে চৌকি সকাল পর্যন্ত খালি হয়ে যেতো। এভাবে বেশ কয়েকটি চৌকি খালি হয়ে গেলো। কিছু কিছু চৌকিতে মুজাহিদদের নৈশ হামলাও করতে হলো।

আব্দুল করিম এরপর মুজাহিদদের ফৌজি কায়দায় বিন্যাস করে সে ফৌজ নিয়ে রীতি মতো সামনে এগুতে লাগলেন। এখন তার হেড কোয়ার্টার রীফ পাহাড় সারির কোন কন্দরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এরপর আবদুল করিম মারাকেশের মীলীলা নামক বড় এক শহরের ওপর হামলা করলেন। এই শহরে ফ্রান্সী, স্পেনিশ ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের লোকজন মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ হাজার লোক ছিলো। আব্দুল করীম শহর অবরোধ করলেন।

অবরোধ চলছে নির্বিঘ্নে। কোন ধরনের রক্তপাত হচ্ছে না কোথাও। তবে মুজাহিদরা প্রতিশোধ স্পৃহায় এধরনের মানসিকতা প্রকাশ করে বসলো যে, এই শহরের সমস্ত নাগরিককে হত্যা করে সব ধন-সম্পদ নিয়ে নেয়া হবে। তারপর সেগুলো মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ে কাজে লাগানো হবে।

আমার দৃষ্টি শহরের ওপর শহর বাসীর ওপরো নয়- আব্দুল করিম একদিন মুজাহিদদের বললেন- এটা ঠিক যে, এই কাফেরের দলই নিরপরাধ মুসলমানদের পাইকারী দরে হত্যা করেছে এবং নারীদের ইজ্জত নষ্ট করেছে যত্রতত্র। তারপরও আমি শহরবাসীর ওপর হাত উঠাবো না। নিরস্ত্র করা রক্তপাত করা মুজাহিদদের ব্যক্তিত্বের পরিপন্থী কাজ।

তারপরও মুজাহিদরা মাত্রাতিরিক্ত জবাও আবেগী হয়ে যাচ্ছিলো। এটাই ছিলো প্রথম ঘটনা যেখানে মুজাহিদরা আবদুল করিমের আনুগত্যে শিথিলতা দেখায় এবং শহরবাসীদের হত্যার ব্যাপারে অনঢ় মনোভাব দেখাতে থাকে। আব্দুল করিম ভেবে দেখলেন, শহরে অনেক যুবতী মেয়ে আছে যারা মুজাহিদদের ঈমান দুর্বল করে দিতে পারে। তারপর আছে অঢেল ধন-সম্পদ যা তাদেরকে লোভাতুর করে পদস্খলন ঘটাতে পারে। অবরোধ বেশি দিন ধরে রাখলে মুজাহিদদের পক্ষে তা বুমেরাং হয়ে দেখা দিতে পারে। তাই আব্দুল করিম অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে তার ক্যাম্পে চলে গেলেন।

এই একটি ঘটনার মাধ্যমেই আব্দুল করিমের চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রমাণ মেলে, যা অনেক ইউরোপীয়কে মুগ্ধ করে। এমনকি স্পেনিশ সেনাবাহিনীর কালাইমাস নামক এক সার্জেন্টকেও তা দারুণভাবে আলোড়িত করে। কালাইমাস মূলত স্পেনীয় ছিলেননা। ইউরোপের অন্য এক রাষ্ট্রের লোক ছিলেন। তিনি এক দিন লুকিয়ে ছাপিয়ে ঐ পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছে গেলেন, যেখানে মুজাহিদদের ক্যাম্প রয়েছে। তাকে একা একা দিক ভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে দেখে মুজাহিদরা তাকে গ্রেফতার করলো। গ্রেফতারকারী মুজাহিদরা নিশ্চিত ছিলো যে, এ লোক স্পেনিশ ফৌজের গুপ্তচর।

কিন্তু সার্জেন্ট কালাইমাস আমীরে মুজাহিদ আব্দুল করিমের সঙ্গে সাক্ষাতের মনোবাসনা ব্যক্ত করলেন। আর এও বললেন, তিনি মুজাহিদদের দলে যোগ দিয়ে স্পেনিশদের বিরুদ্ধে লড়তে চান। মুজাহিদরা তার কথা মোটেও বিশ্বাস করলো না। এখানে রীতি হলো, তাদের এলাকায় কোন গাদ্দার বা দুশমনের কোন গুপ্তচর নজরে পড়লে তাকে সেখানেই জীবন্ত দাফন করে দেয়া। ক্যাম্পের কমাণ্ডার থেকে অনুমতি নেয়ারও প্রয়োজন নেই।

সার্জেন্ট কালাইমাসও যেহেতু গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেফতার হয়েছে এজন্য তার জন্য একটা গর্ত খোদাই করা হলো। মূল হেড কোয়ার্টার অর্থাৎ আব্দুল করিমের ক্যাম্প সেখান থেকে একটু দূরে ছিলো। ঘটনাক্রমে আব্দুল করিমের ক্যাম্পের এক লোক সেখানে কি এক কাজে এসে এ দৃশ্য দেখে ফেললো। সে সার্জেন্টের কথা শুনে তাকে আব্দুল করিমের কাছে নিয়ে যাওয়াটা জরুরী মনে করলো। ক্যাম্প কমাণ্ডারের কাছে সে একথা বললো

যদি এই লোক ইউরোপীয় গুপ্তচর হয়ে থাকে তাহলে তো তাকে ওখানেও শাস্তি দেয়া যাবে। আমীরুল মুজাহিদীনের সঙ্গে তার সাক্ষাতের ইচ্ছের মধ্যে নিশ্চয় কোন বিষয়ও তো থাকতে পারে।

সার্জেন্ট কালাইমাসকে আব্দুল করীমের সামনে উপস্থিত করা হলো। আব্দুল করিমের সঙ্গে সার্জেন্ট স্বাভাবিক আচরণ করলেন। নির্ভয়ে তিনি বললেন

সত্যি কথা বলতে কি আমাদের ফৌজ এখানকার মুসলমানদের ওপর যে জুলুম নির্যাতন চালাচ্ছে তা আমার ভেতর আশ্চর্য রকম এক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। ছোট ছোট মুসলমান বাচ্চাদেরকে স্পেনীয় অফিসারদের ওখানে বেগার খাটতে দেখেছি। দেখেছি, ওদেরকে একটি রুটির বিনিময়ে কি যন্ত্রণাই দেয়া হয়। তবুও ওদের ক্ষুধার্তই থাকতে হয়। এসব আমি সহ্য করতে পারতাম না। আবার যাকে খুশি তাকেই সামান্য ছুতোয় গুলি করে মেরে ফেলতো। ছোট ছোট নিষ্পাপ বাচ্চাদের ওপর, নিরপরাধ কিশোরীদের ওপর মোংরা ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো এক সঙ্গে কয়েকজন অফিসার। তারপর তাকে মেরে ফেলতো বা সে এমনিই মরে যেতো। আর ওরা তাদের ছিন্নভিন্ন লাশের পাশে বসে হো হো করে হাসতো …

মুসলমানদেরকে ওরা মানুষ মনে করে না। স্পেনীয়দের যে হিংস্রতা আমি দেখেছি সেটা আপনারা শুধু শুনেছেন। আমার দ্বারাও ওরা অনেক হিংস্র কর্মকাণ্ড করিয়েছে। এজন্য অনেক রাত আমার নির্মুম কাটতো। আমার বিবেক-মন আমাকে অভিশাপ দিচ্ছিলো …

অবশেষে আমি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলাম যে, যে ধর্ম তার পূজারীকেও মানুষকে ভালোবাসতে শেখায় না, মানবতার পথ দেখায় না সেটা সত্য ধর্ম হতে পারে না। আমি জানতে পেরেছি আপনারা নাকি মিসীলা থেকে এজন্য অবরোধ উঠিয়ে নিয়েছেন যে, ওখানে আপনাদের মুজাহিদরা ইউরোপীয়দের পাইকারী দরে হত্যা করবে এমন আশংকা করছিলেন। আর আপনাদের ধর্মে এটা মহা গাপ। এটা শুনতেই আমি আমাদের ক্যাম্প থেকে পালিয়েছি …।

বহু কষ্টে জানতে পেরেছি আপনারা এ এলাকায় আছেন, আমি পায়দল এখানে পৌঁছেছি। আমার রক্ত মাংসও পাপে নিমজ্জিত, পাপের বিরাট এক বোঝা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। সেটা থেকে মুক্তির জন্য আমি এখানে এসেছি। আমাকে সেই আলো দেখান যা আমার অন্তরাত্মাকে আলোকিত করবে …।

আর যদি গুপ্তচর মনে করে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চান তাহলে কমপক্ষে মুসলমান বানিয়ে আমাকে হত্যা করুন। যাতে আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে এমনভাবে হাজির হতে পারি যে, আমি পাপ থেকে ধুয়ে মুছে পবিত্র হয়ে যাওয়া একজন মানুষ। যে মানুষটি পাপ থেকে সত্যিকারের তাওবা করেছে।

***

সার্জেন্ট কালাইমাসের কথায় বেশ প্রভাব ছিলো। কিন্তু আব্দুল করিমের মতো দূরদর্শী এক কমাণ্ডার এ ফয়সালা দিতে পারছিলো না যে, এ লোক গুপ্তচর নয়। তার জন্য তখনই কোন শাস্তি ফয়সালা করা হলো না। আব্দুল করিম তাকে নিজের সঙ্গে রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য কয়েকটি তীক্ষ্ম চোখও তাকে অনুসরণ করে গেলো। যদি এ লোক গুপ্তচর না হয় তাহলে মুজাহিদরা এর মাধ্যমে দারুণভাবে উপকৃত হবে এবং অনেক মূল্যবান তথ্যও পাবে।

কয়েক দিনের মধ্যেই এটা প্রমাণ হয়ে গেলো যে, তিনি গুপ্তচর নন। স্পেনিশ ও ফ্রান্সী ফৌজের অনেক গোপন তথ্য ও ফৌজের প্রধান প্রধান যুদ্ধ কৌশলগুলো জানিয়ে দিলেন। তারপর তাকে মুজাহিদদের গোয়েন্দাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ এক পদাধিকার দেয়া হলো। চমৎকার কাজ দেখালেন তিনি।

কালাইমাস খুব হাস্যরসিকতা পছন্দ করতেন। ক্রমেই তিনি ক্যাম্পের সবার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। তারপরই গ্রহণ করলেন ইসলাম। আব্দুল করিম তার কালাইমাস নাম পাল্টে রাখলেন হুজ্জুল আয়মান।

তত দিনে মারাকেশের পাহাড়ি অঞ্চলের বেশ কিছু গোত্র সরদার আবদুল করিমের মুক্তিযুদ্ধ দলে যোগ দিয়ে ফেলেছে। এক সরদার তার পুরো খান্দান নিয়ে এবং কোটি কোটি টাকার সম্পদসহ জিহাদে শরীক হয়ে গেলেন। সে সরদার আল আয়মানকে এতই পছন্দ করলেন যে, তার নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তার জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা করলেন। আল আয়মানের সঙ্গে এই পরিবারের এমনই ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠলো যে সে সরদার তার একমাত্র অতি রূপসী মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন।

স্পেনিশরা সার্জেন্ট কালাইমাসকে গ্রেফতার করতে সবরকম চেষ্টা চালায়। যখন তারা জানতে পারে, কালামইমাস মুসলমান হয়ে গেছে এবং এক গোত্র সরদারের মেয়েকে বিয়ে করেছে তখন জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে পুরস্কারও ঘোষণা করে। বেশ মোটা অংকের টাকা ও এক শ ভরি সোনা দেয়া হবে এই ঘোষণাও করে। কিন্তু কেউ তাকে পাকড়াও তো দূরের কথা তার খোঁজও তারা বের করতে পারেনি।

হুজ্জুল আয়মান অল্প দিনের মধ্যেই আব্দুল করিমের ডান হাত হয়ে যান। ইতিমধ্যে আব্দুল করিমের নাম ইউরোপের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। বৃটিশরা গোপনে তার মিত্র হওয়ার প্রস্তাব পেশ করে। জার্মানীরা অস্ত্র সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আব্দুল করিম সেসব প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানতেন, যে, দেশই সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিক না কেন এদের আসল উদ্দেশ্য হলো শুভাকাংখী সেজে ভূমিকাংখী হওয়া তারপর এদেশ দখল করা।

সারা দেশের মুজাহিদদের এক মাত্র হাতিয়ার হলো আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং আত্মপ্রত্যয়ী জযবা। মুজাহিদদের মধ্যে যারা সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করছে তাদের একটা তালিকা তৈরী করে ফেলা হলো। আব্দুল করিম তাদেরকে গ্রেনেড, রাইফেল ও রিভলভার তৈরীর কারিগরী প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করলেন। দেখতে দেখতে দুর্গম পাহাড়ের বিভিন্ন গুহা অস্ত্র কারখানায় পরিণত হলো। অস্ত্র তৈরীর নিজস্ব ব্যবস্থাপনা মুজাহিদদের জন্য বেশ সুবিধা এনে দিলো। তবে মুজাহিদরা বেশিরভাগ যে অস্ত্রের ব্যবহার করতো সেগুলো স্পেনিশ ফৌজ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্র।

মুজাহিদদের মধ্যে কিছু এমন মেধাবী সদস্য ছিলো যারা লড়াইয়ের সময়ও অসম্ভব ক্ষিপ্র ও দুঃসাহসী ছিলো। লড়াইয়ের বাইরেও অলস সময় কাটানোর পক্ষে ছিলো না। তারা অস্ত্র তৈরীর কোন রকম প্রশিক্ষণ না নিয়েও অন্যদের দেখাদেখি নিজেদের ঘরে বসে অস্ত্র তৈরী করতে লাগলো। একমাত্র উদ্দেশ্য ভিন দেশের কারো কাছে যাতে হাত পাততে না হয়। সাহায্যের জন্য ছোট হতে না হয়। সাহায্য নেয়ার বিনিময়ে বিক্রি হতে না হয়। আব্দুল করিম মুজাহিদদেরকে বলতেন

যারা তোমাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে বা তোমাদের মিত্র হতে চাইবে একদিন না একদিন তারা যে কোন উপায়ে যেকোন বাহানায় যেকোন রঙে এর বিনিময় আদায় করে নেবে। হতে পারে বিনিময়স্বরূপ তোমাদের অস্তিত্বের একমাত্র প্রতীক ঈমানী জবাটাই ছিনিয়ে নেবে। তাই নিজেদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করো।

আব্দুল করিমের এ কথাগুলো মুজাহিদদেরকে বেশ নাড়া দিলো। মাত্র চৌদ্দ বছরের কিশোর যোদ্ধা আফফান মুজাহিদদের যোগাযোগের সুবিধার জন্য টেলিফোন লাইনের ব্যবস্থা করলো। মুজাহিদরা দুশমনের বিভিন্ন চৌকি ও ফৌজি কাফেলার ওপর হামলা করে অনেক কিছুই লাভ করে। এর মধ্যে অসংখ্য টেলিফোন সেট ইকুইপমেন্ট ও কেবলও ছিলো। প্রথমে তো এসব জিনিস মুজাহিদদের জন্য ছিলো অর্থহীন। কারণ, মুজাহিদরা এগুলোর ব্যবহার জানতো না।

তখন এক ইলেট্রিক ইঞ্জিনিয়ারের দারুণ মেধাবী ছেলে আফফান এগুলো কাজে লাগায়। আব্দুল করিমের জানবার্য বাহিনীর অসংখ্য ক্যাম্পে টেলিফোন সুবিধা পৌঁছে দেয়া হয়। ক্যবল, ইকুইপমেন্টসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস মাটির নিচ দিয়ে ফিট করা হয়। মুজাহিদদের এজন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়। টেলিফোন সুবিধার কারণে যোগাযোগসহ হামলার সময় ক্ষণ ও দুশমনের গতিবিধি ইত্যাদি জানা মুজাহিদদের জন্য অনেক সহজ হয়ে যায়। শত্রুপক্ষও বিস্মিত হয়, মুজাহিদরা কি করে এত দ্রুত তাদের গতিবিধি সম্পর্কে জেনে যায়।

***

মুজাহিদদের হামলা ও নৈশ হামলা এত পরিমাণে বেড়ে গেলো যে, শহর থেকে দূরের স্পেনিশ ফৌজের চৌকিগুলো খালি হয়ে গেলো। এতে অধিকাংশ চৌকির সৈনিকরাই নিহত বা আহত হলো। শত্রুপক্ষের জন্য দূরদূরান্ত পর্যন্ত রসদ পৌঁছে দেয়ার পথ বন্ধ করে দিলো মুজাহিদরা। তাদের রসদের গাড়ি ও গাড়িসহ মালামাল মুজাহিদরা লুট করে নিতে লাগলো।

শহরের বাইরে যেমন স্পেনিশদের পা রাখার জায়গা ছিলো না শহরের ভেতরও তাদের পক্ষে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়লো। শহরের বিধর্মী নগরিকরাও মুজাহিদদের পক্ষ নিতে শুরু করে দিলো। শহরের লোকেরা স্পেনিশ ফৌজদেরকে সবরকম নাগরিক সহযোগিতা বন্ধ করে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে সরকারি আইনের বিরুদ্ধাচরণও শুরু করে দিলো।

দেখতে দেখতে এক সময় অবস্থা এমন হলো যে, কার্যত স্পেনিশ শাসন প্রক্রিয়া এক প্রকার অকেজো হয়ে গেলো। স্পেনিশদের রাজত্ব ছিলো নামমাত্র। কার্যত শাসন কার্য শুরু হয়ে গেলো মুজাহিদদের। সন্দেহ নেই,আসলে এটা ছিলো মুজাহিদদের বিজয়। যা অর্জন করতে গিয়ে তাদের বিশাল রক্ত নদী পাড়ি দিতে হয়েছে। হাজারো মুজাহিদকে জান কুরবানী দিতে হয়েছে। নৈশ হামলা চালাতে গিয়ে কত মুজাহিদ শহীদ হয়েছে। আরো কত হয়েছে যখমী। অঙ্গ বঞ্চিত হয়েছে আরো কত টগবগে মুজাহিদ।

মুজাহিদ দলে অল্প বয়স্ক কিশোর কিশোরীও ছিলো। তাদের কেউ ধরা পড়লে এমন ভয়ংকর শাস্তি দেয়া হতো যে, তা দেখে কয়েকজন স্পেনিশ সৈনিক অজ্ঞান হয়ে পড়ে। জ্ঞান ফেরার পর তারা ফৌজি চাকরি তো ছাড়েই, তারপর নিজেদের খ্রিস্টান ধর্ম ও পরিত্যাগ করে। গ্রেফতারকৃতদের পরিবার পরিজনদেরকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো। ঘরের শিশু বাচ্চাদেরকেও রেহাই দিতো না ওরা। তাদের শরীর থেকে এক এক ফোঁটা করে রক্ত বের করে তাদেরকে মারা হতো। সারা দেশের ধূলিকণার প্রতিটি ইঞ্চি মুজাহিদদের রক্তের রঞ্জিত হয়েছে। এর বিনিময়ে মারাকেশের হারানো অংশের কিছুটা হলেও মুজাহিদরা উদ্ধার করতে পেরেছে। অবশ্য এজন্য হাজার হাজার স্পেনিশ সৈনিকের হাড় গোড় মাটির সঙ্গে মেশাতে হয়েছে।

***

এখানে আব্দুল করিম কৌশলগত একটা ভুল করলেন। তার উচিত ছিলো মারাকেশের যতটুকু অংশ জয় করতে পেরেছেন সেখানে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করা। সঙ্গে সঙ্গে একটি রাষ্ট্রের ও স্বাধীন জাতির অবকাঠামো ঠিক করে নিজেদের ভিত্তিভূমি আরো স্থায়ী করা উচিত ছিলো।

কিন্তু স্পেনিশদের পিছু হটা ও কোনঠাসা অবস্থা আব্দুল করিমের আত্মবিশ্বাস এত বাড়িয়ে দিলো যে, তিনি অনেক বাস্তব পদক্ষেপকে এড়িয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে মুজাহিদরাও আরো আবেগী হয়ে উঠলো। স্পেনিশদের চিন্তা বাদ রেখে ফ্রান্সী ফৌজের ওপর হামলা শুরু করে দিলো। এসব হামলার অধিকাংশই ছিলো নৈশ হামলার আকারে। যেগুলো ফ্রান্সী চৌকিগুলোর ওপর হচ্ছিলো। এই পদ্ধতিতেই মুজাহিদরা স্পেনিশদের বিরুদ্ধে সফল হয়েছিলো।

ওদিকে ফ্রান্সী জেনারেল লাইটে স্পেনিশ বাহিনীর শোচনীয় অবস্থা দেখে প্রতিরোধ ও জবাবী হামলার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন আগ থেকেই। জেনারেল লাইটে জেনারেল স্লেষ্টারের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ ও দূরদর্শী জেনারেল ছিলো। তাই তিনি রণকৌশল আগ থেকেই সাজিয়ে রেখেছিলেন। তা ছাড়া ফ্রান্সী ফৌজের সংখ্যা, অস্ত্র শক্তি এবং দখলকৃত অংশও বেশি ছিলো। এর বিপরিতে মুজাহিদরদের সংখ্যা ছিলো অনেক কম, অস্ত্র-শস্ত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদিও ছিলো হাতে গোনা।

এরপরও মুজাহিদদের গেরিলা অপারেশন এতখানি সফল ছিলো যে, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ফ্রান্সীদের গভীর চিন্তায় পড়তে হলো। অনেক ফৌজি ক্যাম্প ও চৌকি তাদের হাত থেকে ছুটে গেলো। কয়েক জায়গায় সরাসরি লড়াই হলো। সামান্য সংখ্যক মুজাহিদদের সামনেও বিশাল বাহিনীর ফ্রান্সী ফৌজ টিকতে পারলো না। মুজাহিদদের চরম ক্রোধ আর নারায়ে তাকবীরের বজ্র হুংকারে সামনে ফ্রান্সীরা হতবিহ্বল হয়ে পড়লো।

তবে জেনারেল লাইটে আরেকটা চাল চালার চেষ্টা করলো। সেটা হলো সারাদেশের প্রভাবশালী মুসলিম গোত্র সরদারদের ব্যবহার করার পরিকল্পনা নিলো। তাদেরকে বড় বড় উপহার উপঢৌকন ও জায়গীয় দিয়ে ফ্রান্সীদের ওয়াফাদার বানাতে চেষ্টা চালাতে লাগলো। কমপক্ষে ফ্রান্সীদের দলে না ভিড়লেও যেন সরদাররা মুজাহিদদের কোন রকম সহযোগিতা না করে। এটাও ফ্রান্সীদের জন্য কম স্বস্তিদায়ক বিষয় না। একদিন এক প্রভাবশালী গোত্রের সরদার তার গোত্রের সবাইকে এক সমাবেশে একত্রিত করে ভাষণ দিলো,

বন্ধুরা আমার! দেশে স্বাধীনতা ও মুক্তির নামে যারা ফ্রান্সীদের সঙ্গে অন্যায়ভাবে যুদ্ধ করছে তারা আসলে ডাকাত-সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী। তারা এদেশকে ধ্বংস করতে চায়। ফ্রান্সীরা আমাদের বন্ধু। তাই তোমাদের উচিত ফ্রান্সীদের সহযোগিতা করা। আর মুজাহিদদেরকে সব রকম সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত করা। শুধু তাই নয়, আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে ফ্রান্সীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐ মুজাহিদদের রুখতে হবে।

পরদিনই সেই সরদারের লাশ পাওয়া গেলো পরিত্যক্ত একটি জলাশায়। লাশের দুই পা উরু থেকে কাটা ও বাহু এবং মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো। এর পরপরই অন্যান্য সরদারের কাছে কংকালের উল্কিযুক্ত একটি করে খাম বন্ধ চিঠি পৌঁছালো। তাতে লেখা ছিলো

তোমরা তোমাদের এক বন্ধুর বিচারদশা নিশ্চয় দেখেছো। মনে রেখো সে জীবিত থাকতেই তার অঙ্গগুলো বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অবশ্য মাথা কাটা হয়েছে তার প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার পর। বিশ্বাস করো, দেশের সঙ্গে যারা বেইমানী করবে তাদেরকে এর চেয়ে সহজ বিচার আমরা করতে পারবো না। বিশ্বাস না হলে একবার বেইমানী তো দূরের কথা বেইমানীর চিন্তা করে দেখো না। তোমাদের হৃদ কম্পন ও মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম চিন্তার ধরনও আমরা টের পেয়ে যাবো।

***

ফ্রান্সীরা যখন এ হাল দেখলো তখন স্পেনিশদের কাছে এক মৈত্রেয় চুক্তির প্রস্তাব পাঠালো। তাতে বলা হলো,

মারাকেশে আমাদের ও তোমাদের দখল বজায় রাখার একমাত্র পদ্ধতি হলো বিদ্রোহীদের ধ্বংস করা। এজন্য প্রয়োজন আমাদের পারস্পরিক ঐক্যভিত্তিক পদক্ষেপ। আমাদের ও তোমাদের সৈনিকরা এক পতাকাতলে লড়াই করবে।

স্পেনিশদের জন্য এই প্রস্তাব ছিলো হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। পরাজয়ের তাজা ক্ষত শুকানোর জন্য এর চেয়ে ভালো কোন পদ্ধতি ছিলো না। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই দুদেশের ফৌজের সম্মিলিত কার্যক্রম শুরু হয়ে গেলো। সেনা পরিচালনা আরো দক্ষ হওয়ার জন্য ফ্রান্সী জেনারেল লাইটেকে সরিয়ে মার্শাল পার্টীনকে জেনারেল করে মারাকেশে পাঠানো হলো। এই বৃদ্ধ মার্শাল ছিলেন যুদ্ধ কৌশলের উস্তাদ। স্পেনও মার্শাল প্রাইমোদীকে জেনারেল করে মারাকেশ পাঠালো। তারা উভয়ে মিলে সম্মিলিত এক হাই কমাণ্ড স্থাপন করলেন।

উভয় দেশের সৈনিকদের এক ছাউনিতে নিয়ে আসা হলো। উভয় দেশই আরো অতিরিক্ত সৈন্য পাঠালো। ফ্রান্স অতিরিক্ত যুদ্ধ বিমান ও কামান মারাকেশে পাঠালো। মুজাহিদদের জন্য কামান ও যুদ্ধ বিমান ছিলো অত্যন্ত ভয়ংকর অস্ত্র।

মুজাহিদরা শত্রুপক্ষের যুদ্ধ কৌশল অনুযায়ি খোলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। গেরিলা ও কমাণ্ডো অপারেশন অব্যাহত রাখলো। এর মাধ্যমে ফ্রান্সীদের রসদ পৌঁছানোর ব্যবস্থাপনা অকেজো করে দিলো। দূর-দূরান্তের চৌকিগুলোতে মুজাহিদরা প্রয়োজনীয় রসদ পৌঁছাতে দিতো না। ফ্রান্সীরা এবার রসদের কাফেলার সঙ্গে ফৌজি কাফেলাও পাঠাতে লাগলো। মুজাহিদরা এতে দমলো না। তাদের ওপরও হামলা চালিয়ে গেলো মুজাহিদরা। এক এক হামলায় রক্তক্ষয়ী লড়াই হলো এবং শত্রু পক্ষের ক্ষতিও হলো অপূরণীয়।

অবস্থা বেগতিক দেখে ফ্রান্সীরা এবার নিজেদের রসদ হেফাজতের জন্য কাফেলার পেছন পেছন যুদ্ধ বিমান পাঠাতে শুরু করলো। এবার মুজাহিদরা কোণঠাসা হতে লাগলো। মরু অঞ্চলে বিমানের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেদেরকে লুকানো অসম্ভব ছিলো। এই বিমান ব্যবস্থা দ্বারা ফ্রান্সীরা দূরদূরান্ত পর্যন্ত নিরাপদে রসদ পৌঁছে দেয়ার সুযোগ পেলো।

আবদুল করিম মুজাহিদদের হামলার পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনলেন। ফ্রান্সীরা তাদের প্রতিরক্ষা শক্তি অটুট রাখার জন্য ছোট বড় প্রায় ৬৬টি কেল্লা নির্মাণ করলো। আব্দুল করিমের মুজাহিদরা সেগুলোর ওপর হামলা শুরু করলো। ১৯২৪ সালের শেষ দিকে মুজাহিদরা নয়টি কেল্লা জয় করতে সক্ষম হলো। কিন্তু মুজাহিদদের সবচেয়ে বড় সংকট ছিলো, তাদের লোকসংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছিলো। সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্রের অভাবও বোধ করতে লাগলো মুজাহিদরা। তাদের কাছে তো নির্ধারিত কোন অস্ত্র কারখানা ছিলো না।

ও দিকে শত্রুপক্ষের গোয়েন্দা তৎপরতা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠলো। গ্রামে শহর উপশহর ও গ্রামে গুপ্তচররা ছড়িয়ে পড়লো। প্রতিদিন শয়ে শয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী লোকরা গ্রেফতার হতে লাগলো। কারো ওপর যদি সামান্য সন্দেহ হতো সে কোন মুজাহিদকে সহযোগিতা করেছে তাহলে তার পুরো খান্দানকে গ্রেফতার করে জেলের কালো কুঠুরীতে নিক্ষেপ করা হতো। ফ্রান্সীদের কোন কেল্লা মুজাহিদরা দখল করলেই সারাদেশের বিভিন্ন শহরের মুসলমানদের ঘর বাড়িতে সৈনিকরা চড়াও হতো। বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতো। তারপরও মুজাহিদদের মনোবল অটুট থাকতো। নিজেদের দুর্বলতাকে তারা জযবার দীপ্তি দিয়ে পূরণ করে দিতো।

***

আব্দুল করিম তার উদার মানবিক হৃদয়ের আরেকটি দুর্লভ নজির স্থাপন করলেন। মুজাহিদরা অনেক ফ্রান্সী ও স্পেনীয় সৈনিক গ্রেফতার করেছিলো। তারা ছিলো যুদ্ধবন্দী। আব্দুল করিমের হুকুমে তাদের সঙ্গে এত কোমল আচরণ করা হতো যে, মনে হতো তারা ভিনদেশী অতিথি। ১৯২৫ সালে যুদ্ধ বন্দি শত শত কয়দীকে আবদুল করীম ছেড়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, বড় বড় ট্রলারে করে তাদের সাগর পাড়ি দেয়ারও ব্যবস্থা করে দিলেন। বন্দিরা এই অপ্রত্যাশি মুক্তি পেয়ে বিস্মিত না হয়ে পারেনি। এজন্য অধিকাংশ বন্দিই মুসলমানদের এই আচরণে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরে না গিয়ে মুজাহিদদের দলে যোগ দেয় এবং নিজেদের ফ্রান্সী বা স্পেনিশ সৈনিকদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

১৯২৫ এর সেপ্টেম্বরে ফ্রান্স ও স্পেনিশদের সম্মিলিত হাই কমাণ্ড মুজাহিদদের ওপর চূড়ান্ত এক হামলা চালায়। হামলায় তোপ, কামান ও যুদ্ধ বিমানের সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ করা হয়। ইতিহাসে একে এক অমানবিক হামলা বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে।

মুজাহিদদের মোর্চা ও ক্যাম্পের ওপর বিমান থেকে বৃষ্টির মতো বোম্বিং করা হয়। শহর ও আবাদীর কোথাও সন্দেহজনক কিছু দেখলেই সেখানে কয়েক পশলা বোমা বর্ষণ হয়ে যেতো। হাজার হাজার ঘোড় সওয়ার সেই হামলায় শরীক ছিলো। মুজাহিদরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধ করার ও জবাবী হামলার চেষ্টা করে। এমনকি দুশমনদেরও ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। কিন্তু শত্রু পক্ষকে তাদের পরিকল্পনা পাল্টাতে বাধ্য করতে পারলো না।

শত্রুপক্ষ এলো মেলো বোম্বিং অব্যাহত রাখলো। এমনকি ব্যবসায়িদের কোন কাফেলাও যদি পথে পড়েছে বোমার আঘাতে নিমিষেই পুরো কাফেলা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোন সাধারণ জনগণ এবং নিরপরাধ লোকদেরও ক্ষমা করা হলো না। মুজাহিদদের সংখ্যা কমে যেতে লাগলো খুব দ্রুত। ইমোনেশনও শেষ হয়ে গেলো। তারপর তারা তলোয়ার ও বর্ষা নিয়ে লড়তে লাগলো। কিন্তু আগুন ও রক্তপাতের সেই তুফানের সামনে তারা মুহূর্তের জন্যও দাঁড়াতে পারলো না।

মুজাহিদরা তাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে, দুশমনের হাতে নিজেদের জান নজরানা দিয়ে লড়ছিলো। কিন্তু এর শাস্তি পাচ্ছিলো শহরবাসীরা। তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছিলো কোন বাছবিচার না করেই। মুজাহিদদের পরাজয়ের সব লক্ষণ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো। কোথাও থেকে তৎক্ষণাৎ কোন সাহায্য পাওয়ারও আশা ছিলো না।

আবদুল করিম শহরবাসীকে এই পাইকারী হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ বিরতির সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এ মর্মে শত্রু পক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠালেন। কিন্তু দখলদার বাহিনী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিলো। আবদুল করিমের কাছে সৈন্যসংখ্যা তখন একেবারেই হাতে গোনা। তারাও প্রায় নিরস্ত্র। অবশেষে ১৯২৬ এর এপ্রিল মাসে আব্দুল করিম ঘোষণা করলেন–

মারাকেশের রক্তপাত একমাত্র আমার কারণেই হচ্ছে। আর রক্ত ঝরছে তাদেরই যারা লড়তে পারছে না। যারা লড়তে জানতো তারা তো লড়তে লড়তে শহীদ হয়ে গিয়েছে। তবে এক দিন না এক দিন মারাকেশ স্বাধীন হবেই। আমি না থাকলেও আরো অনেক আব্দুল করিমের জন্ম হবে।

এই ঘোষণা দিয়ে তিনি ফ্রান্সী ও স্পেনিশদের গঠিত হাইকমাণ্ডের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তিনি যখন সেখানে পৌঁছলেন সঙ্গে সঙ্গে তাকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বন্দীরূপে গ্রেফতার করা হলো। এবং তাকে তার পরিবারসহ জাযীরা ইউনিয়নের দুর্গম দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হলো।

কিন্তু আব্দুল করিমের নির্বাসনের কারণে তার অদম্য চেতনা-জাবাকে কেউ নির্বাসন দিতে পারেনি। তার চেতনাদীপ্ত আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মারাকেশে আরো হাজার হাজার আবদুল করীমের জন্ম ঘটলো। তারপর ১৯৫৬ এর ৬ই মার্চ দখলদার দুই সাম্রাজ্যবাদীর কবল থেকে মারাকেশ পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন হলো। আব্দুল করিম স্বাধীন মারাকেশে প্রবেশ করলেন স্বাধীনতার লাল গোলাপ হাতে নিয়ে।