বিজ্ঞাপন
এ যুগের কবি লিখেছেন, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’
সেও তো বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তারপরে জল আরও গড়িয়েছে। ঘোলা জল ঢুকে গেছে গৃহস্থের বাড়ির উঠোনে, শোয়ার ঘরের মধ্যে।
খবরের কাগজের পাতায় রঙিন বিজ্ঞাপন, দূরদর্শনে, বেতারে চ্যানেলের পর চ্যানেল, ব্যান্ডের পর ব্যান্ড সংবাদের মধ্যে বিজ্ঞাপন, খেলার মধ্যে বিজ্ঞাপন, ধারাবাহিকের পরতে পরতে বিজ্ঞাপন, নাচগানের আগে-পিছে-মধ্যে বিজ্ঞাপন। শুধু মুখ নয়, এখন সমস্ত শরীর ছেয়ে গেছে বিজ্ঞাপনে।
কিংবা বলা চলে, সমস্ত শরীর খুলে গেছে বিজ্ঞাপনে। নগ্নতার এমন নির্লজ্জ সমারোহ উনিশ শতকের কোনও সামন্তের রঙমহলে, দেবদাসী মন্দিরের নিভৃত গর্ভগৃহেও হয়তো অসম্ভব ছিল।
তাই এই প্রসঙ্গে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় ‘সুখী গৃহকোণ শোভে গ্রামোফোন’ বিজ্ঞাপনের পুরনো জগতে। সেই কালে বিজ্ঞাপনে লেখা হত, ‘পুজায় স্নেহ হইতে বঞ্চিত হইবেন না’ স্নেহ মানে স্নেহ পদার্থ, ঘি, গব্যঘৃতের শারদীয় বিজ্ঞাপন, খুব সম্ভব প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা। এই সময়েই ঘিয়ের আরেকটি বিজ্ঞাপন, ‘বাসি লুচি শ্রীঘৃতে ভাজা হইলেও খাইবেন না।’
কিংবা মনে করুন, ম্যালেরিয়ার ওষুধ প্যালুড্রিনের সেই ঢাক বাজানো ঘোষণা অথবা ও সি গাঙ্গুলির আঁকা জবাকুসুমের বিজ্ঞাপনের সুখের সংসার। আজ আর ভাবা যায় সেই বইয়ের বিজ্ঞাপন:
উপনিষদ বলেছেন।
তুষ্ট হয়ো না অল্পে।
শৈলর আঁকা ছবি আর
শিবরামের গল্পে।
এই সূত্রে হয়তো আরও অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞাপনের কথা পাঠকের মনে পড়তে পারে। তার বদলে এবার আমরা একাধিক ছোটখাটো অনতিখ্যাত বিজ্ঞাপন তথা বিজ্ঞপ্তির কথা স্মরণ করি।
কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের একটা চায়ের দোকানের কথা মনে পড়ছে। সে দোকানে ছাত্র-যুবকদের খুব ভিড়, প্রচুর সিগারেটের ধোঁয়া, প্রচুর হইচই। সাধারণত এসব দোকানে যা হয়ে থাকে, খদ্দেররা চায়ের ফাঁকা পেয়ালায় সিগারেটের দগ্ধ ভগ্নাংশ ফেলেন, নোংরা করেন।
দোকানদার আপত্তি করেও, বাধা দিয়েও এর কোনও বিহিত করতে পারেননি। অবশেষে বাধ্য হয়ে দোকানের ভিতরের দু’দিকের দেওয়ালে বড় বড় করে বিজ্ঞাপন টানিয়ে দিয়েছিলেন।
যাঁরা চায়ের পেয়ালায় সিগারেটের ছাই না ঝেড়ে থাকতে পারেন না, যাঁরা পোড়া সিগারেটের টুকরো চায়ের পেয়ালায় ফেলতে ভালবাসেন, তাঁরা অনুগ্রহ করে চায়ের অর্ডার দেওয়ার সময়ে বেয়ারাকে সেটা জানিয়ে দেবেন, তাঁদের কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ তাঁদের জন্যে ছাইদানিতে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
এই প্রসঙ্গে অনুরূপ আরও দুটি বিজ্ঞাপনের উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথমটি একটি রাস্তার ধারের ম্যাগাজিন স্টলের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল।
আপনি যদি আমাদের দোকানের সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আমাদের পত্রপত্রিকাগুলি পাঠ করেন, তাতে আমরা রাগ করব না। এমনকী আপত্তিও করব না। কিন্তু আমরা প্রকৃতই খুশি হব এবং আপনিও আরাম পাবেন যদি পত্রপত্রিকাগুলি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে শুয়ে বসে পাঠ করেন।
পরের বিজ্ঞাপনটি মদের দোকানের, পানশালার:
যদি পান গ্রাহকদের প্রতি আবেদন করতে করতে কখনও আপনি টের পান যে, পৃথিবীটা দুলছে, টেবিল-চেয়ার কাঁপছে, দেওয়ালগুলো এগিয়ে এগিয়ে আসছে, জানলা দরজাগুলো কাত হয়ে যাচ্ছে, সাবধান, নড়াচড়া করতে যাবেন না, টেবিল ছেড়ে উঠবেন না, যতক্ষণ না কাঁপুনি,দুলুনি এই সব থেমে জগৎ সংসার আবার স্বাভাবিক হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত টেবিলে চুপচাপ ঠায় বসে থাকুন।
পুনশ্চ:
নিবন্ধ শেষে এই কাল্পনিক বিজ্ঞাপনটি শুধুমাত্র ধীমান ও ধীমতীদের জন্যে। বড় রাস্তায় একটি সুসজ্জিত দোকানের সাইনবোর্ড।
বিষের দোকান।
আমাদের দোকানের বিষ খরিদ করার পর অদ্যাবধি কোনও খরিদ্দার অভিযোগ করিতে আসেন নাই।
পরীক্ষা প্রার্থনীয়।