বিজ্ঞাপন ও মন
মানুষ বাড়ছে তাই প্রয়োজন বাড়ছে। কাজেই বিজ্ঞাপন বাড়ছে। যদিও যাদের জন্য আসলে বিজ্ঞাপনের এত বৈচিত্র্য তারা তেমন বাড়ন্ত নয় অর্থাৎ জনসমাজের বিনা প্রয়োজনে বিজ্ঞাপন বাড়ছে, কারণ প্রয়োজন বাড়ছে বলে নয়, প্রয়োজন বাড়ানো হচ্ছে বলে, প্রয়োজন সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে তাই। অনাবশ্যক প্রয়োজনবৃদ্ধিতে ধনবাদী সমাজের বেঁচে থাকার শেষ প্রয়াস তাই বিজ্ঞাপনবৃদ্ধি এবং বিজ্ঞাপনের অত্যাশ্চর্য ব্যয়বৃদ্ধি, কেবল অঢেল সমাজে নয়, অন্যান্য উন্নতিশীল অনটনসমাজেও। অতএব সামগ্রী যত বাড়ছে চাই—চাই তত বাড়ছে বিজ্ঞাপন বাড়ছে আর সমস্ত সামগ্রীবৎ হচ্ছে। যেমন আমি সামগ্রী তুমি সামগ্রী যে সামগ্রী দেবতা সামগ্রী দেশপ্রেম সামগ্রী স্ত্রীলোক সামগ্রী বিদ্যা সামগ্রী বিদ্বান সামগ্রী এবং গোটা সমাজটাই একটা বাজার। জৈছে বড়বাজার আর মাছের বাজার সোনার বাজার নারীদেহের বাজার মাংসের বাজার আলুর বাজার পোস্তার বাজার তেমনি মানুষের বাজার। এদিকে মানুষের সমাজটা যত বাজারবৎ হচ্ছে—যেহেতু বাজারের জন্য সমাজটা হয়নি সমাজের জন্য বাজারটা হয়েছিল একদা—তত মানুষ সামগ্রীবৎ হচ্ছে এবং তত বিজ্ঞাপন বাড়ছে, কেনাবেচার বিজ্ঞাপন। আর চৌষট্টিকলার মধ্যে বেচাকলাই আজ শ্রেষ্ঠ কলা তাই মোড়কের বাহার বাড়ছে আর অন্দরের বস্তু অসার হচ্ছে। যেমন বিদ্যায় তেমনি বাণিজ্যে তেমনি জীবনে।
গ্রাম নরক শহর স্বর্গ। বাজার আর বিজ্ঞাপনের শহর কলকাতা। যে শহরে শুধু মৃতের উৎসব আর স্মৃতিসভা আর জীবনের সামনে শুধু জমাট অন্ধকার। মুখোশ পরা মানুষ আর সঙের শহর কলকাতা, কৃত্রিম পণ্যের শহর, জোব চার্নকের বাণিজ্যকুঠি জুয়াচোর আর জুয়াড়ির শহর। নিয়ন লাইটে বিজ্ঞাপন বেতারে বিজ্ঞাপন সিনেমায় বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন ধর্মপত্রে বিজ্ঞাপন দশ পাতার সংবাদপত্রে সাত পাতা সামগ্রীর বিজ্ঞাপন বাকি তিন পাতা সংবাদের নামে কয়েক ডজন নামের একঘেয়ে বিজ্ঞাপন দেয়ালে দেয়ালে বিজ্ঞাপন পোস্টারে বিজ্ঞাপন মনে হয় যেন কলকাতা শহরের অস্থিমজ্জায় ইট—পাথর—কংক্রিট—লোহায় বিজ্ঞাপন। সাতশ টাকা যে মানুষের দাম * বিজ্ঞাপনের জোরে তার দাম মাসে মাসে সাতাশশত টাকা এবং হুবহু বেড়ালের মতো যে মানুষ বিজ্ঞাপনঢাকবাদ্যে মনে হয় যেন সে সুন্দরবনের বাঘ। যেমন কেন্নোর মতো ঘৃণা মানুষকে মনে হয় ঈশ্বরের অবতার তথাপি।
শিয়ালদহে হাড়গিলেদের ভিড়। কৈবল্যধামে কেবল কলাবিদদের সমাধি। মাছের বাজারে কলরব। গোলদিঘিতে বিদ্যার বাণিজ্যকুঠিতে কেবল বিস্ফোরণ। অবুঝ উন্মার্গ তরুণদের অকাজ। কারণ সুকাজ যাদের স্বধর্ম তারা সর্বদাই সনাতনী মার্গপন্থী যাকে বলে ঐতিহ্য সচেতন। তবু পার্ক স্ট্রিটে খানাপিনা—হল্লা কত নাচনকোঁদন আর তার কী চিত্তচমকদার বিজ্ঞাপন আহা! যেমন ভাব তেমনি ভাষা আর তেমনি তার ব্যঞ্জনা যেন সমস্ত ইন্দ্রিয় ভেদ করে মর্মে পৌঁছোয় :
Cabarets by Blushing Oriental
and Go Go Girls.
Cabarets by angelic A. Blonde bombshell B,
tantalizing L. captivatin M,
and other girls––delovely D With
dynamic B at mike.
Covetous girls! girls!! girls!!! in the
hottest cabaret in town.
Fabulous Floorshows with Dancing Damsels
Midnight Revelry
Roussing Revelry Midningt Madness
Madhouse
only Madhouse in India, except Ranchi
Super Mad Session.
ইংরেজি বিজ্ঞাপন১ যা দেশের বেশি লোক পড়তে অক্ষম। বাংলায় হলেও তা—ই। কারণ নিরক্ষরতা। আর সাক্ষর হলেও বিজ্ঞাপনদাতা হোটেল মালিকদের লাভ হত না কারণ সুপারম্যাড সেশনে তিন প্রহর রাত পর্যন্ত ফুর্তি করার মতো কালো কুচকুচে টাকার বান্ডিল তাদের সিন্দুকে নেই। কেবল লাউ আছে কুমড়ো আছে বেগুন আছে কাঁচকলা আছে কচু আছে অতএব ৩৫ কোটি লোক আজ নিরক্ষর তাই রক্ষে। তৎসত্ত্বেও সার্ধজন্মশতবর্ষে বিদ্যাসাগর স্মৃতি ব্যবসায়ীদের পবিত্র সংকল্প নিরক্ষরতামোচন এবং তদুদ্দেশ্যে কত বক্তৃতা কত বিজ্ঞাপন কত ছুঁচোর কিচিরমিচির। বিদ্যাসাগর ভক্তিপ্রাবল্যের জোয়ার বইবে আদিগঙ্গায়। তথাপি কিন্তু নিরক্ষরের সংখ্যা হবে সাতের দশকে অন্তত ৪৫ কোটি এবং বিদ্যার ঠিকাদাররা কয়েক লক্ষ টাকা উদরস্থ করা সত্ত্বেও। কারণ ২.৫% করে লোক বাড়ছে দেশে প্রতি বছরে এবং ০.৭৫% হারে বাড়ছে অক্ষরপরিচিতের সংখ্যা২। কাজেই শত শত বিজ্ঞাপনেও নিরক্ষরতামোচন সম্ভব হবে না। তা ছাড়া আরও একটা কথা হল কী বিদ্যাসাগরের মস্ত বদভ্যাস ছিল কারও উপর চটে গেলে পায়ের স্বদেশি চটিজুতো তার নাকের ডগার কাছে নাচানো এবং শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন, এ ব্যাপারে রাজা—মহারাজাদেরও তিনি নাকি তোয়াক্কা করতেন না। হায়, তাহলে একালের ভিআইপি—দের কী করতেন এবং বিদ্যা ব্যবসায়ীদের?
তবু কেন গোলদিঘিতে বোমা, বিদ্যালয়ে বোমা! সবই নাকি উন্মাদ তরুণদের বিকট অসভ্যতা, প্রবীণ ধৃতচিত্তদের রায়। হয়তো তা—ই অথবা তা—ই নয়, তবু মনে হয় যদি হোটেল—রেস্তরাঁর খানাপিনা—নাচগানের বিজ্ঞাপনগুলোর মর্ম বঙ্গভাষায় বেতারে প্রচার করা যায় তাহলে কেমন শোনায়। নিয়নলাইটে বিজ্ঞাপন। লাল—নীল আলোয় বিজ্ঞাপন। পার্ক স্ট্রিটে সাহেবদের গোরস্থান অন্ধকার আর মৃতের স্মৃতি উৎসবে আলোর বাহার এবং জীবিতের চারদিকে দুর্ভেদ্য জমাট অন্ধকার। হায়, তবু কে দেখবি আয় ফ্লুয়েরেসেন্ট আলোর বিজ্ঞাপন কেবল। মর্মরমূর্তিতে আলো, কারণ জীবনের আলো নিভুনিভুপ্রায় এবং মৃতের স্মৃতি উৎসবে মুখর শহর, যেহেতু জীবনের উৎসব স্তব্ধ নীরব।
কেবল চাই—চাই খাই—খাই অভাব আর অভাব এবং বিজ্ঞাপনের কাজ মানুষের ভিতরের চাইগুলোকে চাগিয়ে তোলা এবং অনাস্বাদিতপূর্ব নতুন অভাববোধ জাগানো। কত রকমের চাই তার ঠিক নেই তবু চাইয়ের প্রকারভেদ আছে, অন্তত দু—রকমের চাই তো আছেই। সেই দু—রকমের চাইয়ের জন্য দুরকমের বিজ্ঞাপন, কারণ বিশেষভাবে জ্ঞাপন যদি বিজ্ঞাপনের মানে হয় তাহলে সে—ও বিজ্ঞাপন, এ—ও বিজ্ঞাপন। একটু মজুরি বেশি চাই, বাঁচার মতো দুটো খেতে চাই, ঘর চাই—ভিটে চাই এরকম অনেক চাই—চাই তো শহরের পথে পথে, গ্রামের পথে পথে আজকাল শুনতে পাই এবং এ—ও যখন বিশেষভাবে জ্ঞাপন তখন বিজ্ঞাপন। কেবল বাঁচার জন্য বিজ্ঞাপন এই যা, আর তার মাধ্যম আওয়াজ। মাথার কিলিপ কাঁটা চায় মাননীয় ভদ্রমহোদয়গণ। আপনাদের কাছে একটি নিবেদন গেঁটে বাত কোমরে বাত মাজা কনকন করে ধন্বন্তরি ওষুধ আছে যদি কারও চায় তো বলবেন দুখে দুখে জনম গেল দুখ বই সুখ আর হল না বাউলগান বাসন্তী চানাচুর শ্রীরামপুরের অষ্টধাতুর আংটি ভদ্রেশ্বরের মিষ্টি জল চাই কমলালেবু ছুরিকাঁচি যশোরের চিরুনি ভাস্কর লবণ অন্ধ হয়ে ভাই বড়ই কষ্ট পাই গান আট আনায় ফাউন্টেন পেন যদি চান তাহলে। অনর্গল চিৎকার ক্যাকোফোনাস হাজার হাজার বালক—কিশোর—তরুণ ক্যানভাসার নিজেদের দ্রব্যের নিজেরাই প্রচারক মূর্তিমান চলন্ত বিজ্ঞাপন। কারও পিঠে কাঠের ফ্রেমে পোস্টার গলায় ঘণ্টা কাঁধে ঝুমঝুম খদ্দের আকর্ষণের অভিনব কৌশলের প্রতিযোগিতা যেমন কখনো গলার স্বরগ্রামের পরিবর্তনে, কখনো গৌরচন্দ্রিকার চমৎকার ভাষায়, কখনো বা কিশোর বালকের করুণ কাকুতিতে কিছু কিনুন তা না হলে তো—তাই। লাইনে লাইনে চলন্ত বালকরা মূর্তিমান বিজ্ঞাপন। গোটা বাঙালি জাতটাই যেন রাস্তার আর ট্রেনের হকার ক্যানভাসার ভেন্ডার পেডলার ফিরিওয়ালা আর খুদে দোকানদারের জাত। ক্রমপ্রসার্যমাণ কলকাতা শহরের উত্তর—দক্ষিণ—পুবের থিকথিকে শহরতলির অজস্র অলিগলির আনাচকানাচে দোকানদারি, কারণ নেহাত দুনিয়াদারি অত্যন্ত ঝকমারি তাই দোকানদারি এবং তার রকমারিতা সংখ্যাতীত। তবু কিন্তু এসব কোনো নিত্যনতুন চাইসৃষ্টি করা নয় বরং বহুপুরাতন সনাতন কতকগুলি চাওয়া নিয়ে প্রায় চশমখোরের মতো বেচাকেনা। চার পয়সায় দু—পয়সা লাভ তা না হলে সেই লাভটুকু দিয়ে দু—বেলা কোনোরকমে পেট চলে না সুতরাং যে চাইসৃষ্টির কথা আমরা বলছি অথবা বলতে চাইছি সেই চাই অথবা তার স্রষ্টা এরা নয়, এদের দোকানদারিও নয়, যেহেতু এরা কেউ কখনো কাগজে বিজ্ঞাপন দেয় না তাই বলছি।
চাই—চাই খাই—খাইয়ের যে খাদকসমাজ বা কনজিউমার সোসাইটি তার স্রষ্টা কিন্তু একচেটে ধনবাদ বা মনোপলি ক্যাপিটাল এবং ধনবাদী সমাজের এইটাই বোধহয় চরম বিকাশপর্ব। ধনতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিযোগিতার কালে অর্থাৎ ব্যক্তিগত ধনতন্ত্রের যুগে মুনাফার প্রয়োগ বা লক্ষ্য বা পরিসীমা সম্বন্ধে ধনবিজ্ঞানীদের যে ধ্যানধারণা ছিল, এমনকী কার্ল মার্কসের যে উনিশ শতকী প্রত্যয় মুনাফাহারের ক্রমিক হ্রাসের সূত্রের মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল, তা একচেটে প্রতিযোগিতার কালে এবং আজকালকার ম্যানেজেরিয়াল ধনতন্ত্রের যুগে অনেকটাই প্রায় অচল হয়ে গিয়েছে। কারণ মুনাফাহারের গতি আজ আর নিম্নগামী নয়, ঊর্ধ্বমুখী যেহেতু মুক্ত প্রতিযোগিতার প্রতিবেশ আর একচেটিয়া বা মনোপলিস্টিক প্রতিযোগিতার প্রতিবেশ অভিন্ন নয়, অনেক তফাত এবং এত তফাত যে তার জন্য একেবারে পুরোনো ধারণা পালটে ফেলে নতুন করে চিন্তা করা দরকার।৩ কারণ একচেটিয়া ধনতন্ত্র, বিশেষ করে বর্তমানের ম্যানেজেরিয়াল ধনতন্ত্রের যুগে মুনাফাহারের গতি যখন নিম্নগামী নয় বরং তার বিপরীত, তখন ধনপতিদের যে সারপ্লাস তার প্রয়োগব্যবহার সম্বন্ধেও এবং তার নতুন নতুন পন্থা সম্বন্ধেও ভাবতে হয়। একচেটিয়া ধনিকদের ক্রমবর্ধমান সারপ্লাস অথবা মুনাফা আত্মসাৎ করার অভিনব আধুনিক পন্থা হল উৎপন্ন সামগ্রী বিক্রির বিচিত্র পরিকল্পনা এবং যার নাম সেলস এফার্ট বা সেলস প্রোমোশন বা অ্যাডভার্টিজমেন্ট বা বিজ্ঞাপন। কার্ল মার্কস উনিশ শতকে কল্পনাও করতে পারেননি যে বিশ শতকের বার্ধক্যে ধনতন্ত্রের এরকম আশ্চর্য গোত্রান্তর হতে পারে এবং বিজ্ঞাপন নামক একটি ক্রিয়ার এমন ভয়ংকর তাৎপর্য থাকতে পারে। একচেটিয়া ধনতন্ত্রের জীবনীশক্তি ‘বিজ্ঞাপন’ যা মার্কসের কাছেও ছিল কল্পনাতীত।৪
অবশ্য ধনতন্ত্রের একচেটিয়া প্রতিযোগিতার আগেকার পর্বেও বিক্রয়প্রচেষ্টা বা বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন ছিল এবং প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাণিজ্যেও যে একেবারে ছিল না তা নয়। কিন্তু তাহলেও আগেকার বিজ্ঞাপনের সঙ্গে আজকের বিজ্ঞাপনের কোনো তুলনাই হয় না, এমনকী পঁচিশ বছর আগেকার বিজ্ঞাপনের সঙ্গেও আজকের বিজ্ঞাপনের রূপগুণগত কোনো মিল নেই। তার কারণ শ্রীমতী রবিনসনের ভাষাতে বলতে হলে বিগত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ধনতন্ত্রের একটা পরিব্যক্তি বা মিউটেশন হয়েছে বলতে হয় এবং তার মহাকেন্দ্র আমেরিকা।৫ এমনকী যে সমস্ত দেশ ধনতন্ত্রের ডালপালাগুলি দ্রুত টপকে আমেরিকার মতো মগডালে ওঠার ধান্দায় ব্যস্ত, অত্যন্ত অবাস্তব প্রকল্পের ভিতর দিয়ে, যেমন আমাদের দেশ ভারতবর্ষ, সেখানেও গত পঁচিশ বছরের মধ্যে বিজ্ঞাপনের এমন পরিবর্তন হয়েছে, সংখ্যাগত রূপগত গুণগত সর্ব রকমের পরিবর্তন, যা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয় এবং দেখতে হলে যুদ্ধের আগের ও পরের দৈনিক সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলির বিজ্ঞাপন পাশাপাশি রেখে দেখতে হয়। টেকনোলজির অপ্রতিহত অভিযানের যুগে একচেটে ধনতন্ত্রের যে অবাধগতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তাতে অঢেল ভোগদ্রব্য বেচার দায়িত্ব ও তাগিদ ও তজ্জনিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত প্রকট হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। একদিকে ভোগ্যদ্রব্য আর একদিকে যুদ্ধের মারণাস্ত্র এই দুইয়ের অবিরাম উৎপাদনের উপর ভর দিয়ে আমেরিকান বিজ্ঞান ও টেকনোলজি এগিয়ে চলেছে একেবারে চন্দ্রলোক পর্যন্ত মনোপলিকে স্কন্ধে নিয়ে। মারণাস্ত্রেরও বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন হয় তবে তা ভিন্ন জাতের বিজ্ঞাপন। যেমন রাষ্ট্রযন্ত্র ও যাবতীয় প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে যুদ্ধের পরিবেশ ও বিততি জিইয়ে রাখা। যেমন দিনরাত্রি কমিউনিজমবিরোধী কীর্তন গাওয়া। যেমন গণতন্ত্র গেল সভ্যতা গেল সংস্কৃতি গেল একটা সব—গেল—গেল রোল তোলা এবং সবই কমিউনিস্টদের জন্য গেল অতএব ভিয়েতনাম—কাম্বোডিয়া। অতএব মারণাস্ত্র বাড়াও এবং তৎসংশ্লিষ্ট পেন্টাগনরক্ষিত আমেরিকান মনোপলিস্টদের মুনাফা বাড়াও। এই হল মারণাস্ত্রের বিজ্ঞাপন। কিন্তু এই যে দেদার ভোগ্যদ্রব্য যার শতকরা পঁচানব্বুই ভাগ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন নেই, এমনকী বাঁচার মতো বাঁচার জন্যও নেই, শুধু সামাজিক অপচয়, তা বাজারে চালাতে গেলে, বেচতে গেলে তার জন্য চাহিদা সৃষ্টি করতে হয় অর্থাৎ নতুন নতুন অভাববোধ জাগাতে হয় মানুষের মধ্যে এবং যা করতে হলে সকলের আগে এবং সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় বিজ্ঞাপনের। বিজ্ঞাপন তাই একালের মনোপলি ক্যাপিটালের জীবন—মরণ কাঠি এবং তার জন্য বর্তমান সমাজে বিজ্ঞাপনের নৈতিক মানসিক প্রভাব যে কত গভীর স্তর পর্যন্ত প্রসৃত ও কত ব্যাপক তা সহজে ধরা যায় না।৬ ধরা যায় না তার কারণ ধরতে হলে সমাজবিজ্ঞানীদের যে সততা থাকার প্রয়োজন তার অভাব, যেহেতু তাঁদের গবেষণা—অনুসন্ধান সবই মনোপলির সেবায় উৎসর্গিত এবং বিদ্যাবুদ্ধি অথবা আজগুবি প্রতিভা সবই মুনাফাতন্ত্রের ক্রীতদাস।
ক্লাসিক্যাল কিনসইয়ান নব্যকিনসইয়ন ধনবিজ্ঞানের সূত্রানুগামী বিজ্ঞাপনতত্ত্ব আর একটু বাড়িয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমে মনে পড়ছে নর্থকোট পার্কিনসনের কথা যিনি সম্প্রতি মার্চ ১৯৭০—এ আমাদের দেশে এসেছিলেন এবং এ দেশের শিল্পপতি ব্যবসায়ী ও অধ্যাপকদের কাছে বিজ্ঞাপন ও শিল্পোন্নতি সম্পর্কে কিছু জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে গেছেন। বেশ চটকদার বুলি আওড়ে বাজার মাত করার ক্ষমতা আছে পার্কিনসনের, যেমন সকলেই জানেন আমলাতন্ত্র সম্বন্ধে তাঁর বাণী যা পার্কিনসন সূত্র বলে খ্যাত। কিন্তু সে যা—ই হোক, বিজ্ঞাপন সম্বন্ধে পার্কিনসন দিল্লির বিজ্ঞানভবনে বলেছেন যে শিল্পোন্নত সমাজে যদি সত্যিই উন্নতিক্রম অব্যাহত রাখতে হয় তাহলে বিজ্ঞাপনই একমাত্র ভরসা এবং সূত্রাকারে একটি বুলিও তিনি বিতরণ করেছেন Advertise or Perish যা ফলাও করে পত্রিকাতে ছাপাও হয়েছে।৭ অবশ্যই পত্রিকা মালিকদের স্বার্থে। প্রসঙ্গত পার্কিনসন বলেছেন যে ধনবিজ্ঞানের সূত্র ডিম্যান্ড অনুযায়ী সাপ্লাই একেবারে বাজে কথা, কারণ ইতিহাসে ঠিক নাকি তার বিপরীতই দেখা যায়। অর্থাৎ সাপ্লাই তৈরি করে ডিম্যান্ড, কারণ লোকে জানে না তারা কী চায়। তাই বিক্রেতারা বুঝিয়ে দেয় অবশ্যই বিজ্ঞাপন দিয়ে এবং সাধারণ বিজ্ঞপ্তিসূচক বিজ্ঞাপন নয়, ক্রেতার মন হরণ করতে পারে এরকম চতুর বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের মনের গহনের অভাববোধ জাগিয়ে দেয়। তবেই তারা বুঝতে পারে তাদের কী চায়—না চায় এবং তদনুযায়ী ভোগ্যদ্রব্যের বৈচিত্র্যসহ উৎপাদন বাড়তে থাকে, তৎসহ শিল্পোন্নতির অগ্রগতিও অব্যাহত থাকে। মনোপলি ক্যাপিটালের পক্ষে ওকালতির দিক থেকে পার্কিনসনের যুক্তি যথার্থ, কিন্তু তিনিই এ যুক্তির প্রবর্তক নন। কারণ চেম্বারলিন এই মনোপলিস্টিক প্রতিযোগিতার তত্ত্বানুসন্ধানীদের মধ্যে অগ্রগণ্য এবং বিজ্ঞাপন সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। চেম্বারলিন বলেছেন যে বিজ্ঞাপন চাহিদাকে প্রভাবিত করে মানুষের অভ্যস্ত অভাববোধেরও পরিবর্তন ঘটাতে পারে এবং যে বিজ্ঞাপনে ব্যবসায়ীর ট্রেডমার্ক অথবা তার নামের প্রচার করা হয় তাতে সাধারণ মানুষের জ্ঞানলাভের অর্থাৎ জ্ঞাতব্য বিষয় কিছু না থাকলেও বারংবার প্রচারিত হলে সেই মার্ক ও ব্যান্ডের জিনিসের প্রতি ক্রেতারা স্বভাবতই আকৃষ্ট হয়। বিক্রেতারা মনোবিজ্ঞানীদের মতো ক্রেতাদের মনের ইচ্ছা—আকাঙ্ক্ষাগুলোকে বুঝতে পারেন এবং নানা কায়দায় বিজ্ঞাপনের উসকানি দিয়ে সেগুলো জাগিয়ে তুলতেও পারেন। কাজেই জ্ঞানবিতরণ নয় বরং চতুর কৌশলে মন ভোলানোই বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য।৮ অতএব ক্রেতাদের এই নতুন অভাববোধ যত সজাগ হতে থাকে, যত তীব্র তীব্রতর হতে থাকে, তত সেই অভাবপূরণের জিনিসের চাহিদা বাড়তে থাকে এবং তত সেই জিনিসের দাম বাড়তে থাকে আর মালিকের মুনাফার পাহাড় উঁচু হতে থাকে। মুনাফার পাহাড় যত উঁচু হয় তত বিজ্ঞাপনের বাজেট বাড়ে, তত তার ক্রেতা ফুসলানোর কৌশল বদলায় এবং বাজারে মূল্য প্রতিযোগিতা কমে যায়।৯ কাজেই পার্কিনসন নতুন অথবা চমকপ্রদ কোনো কথা বলেননি, উপরন্তু আসল কথাটাকে মুচড়ে এ দেশের মনোপলি ক্যাপিটালের পক্ষে ওকালতি করেছেন। বস্তুত তা—ই করার জন্যই তিনি লেকচার ট্যুর দিতে এসেছিলেন।
ধনবাদী শিল্পসমাজের এই বিশিষ্ট গড়নকে গলব্রেথ বলেছেন টেকনোস্ট্রাকচার, যেখানে সর্বপ্রকারের প্রতিভা কুশলতা কৃতিত্ব বিশেষ জ্ঞানবিদ্যা এবং অভিজ্ঞতার অধিকারীদের সমাবেশ হয় ম্যানেজার গোষ্ঠীর নীতিনির্ধারণের উদ্দেশ্যে। কারণ ব্যক্তিগত ধনতন্ত্রের কাল অর্থাৎ সেই দস্যুবেরনদের কাল শেষ হয়ে গিয়েছে ম্যানেজেরিয়াল বিপ্লবের ফলে। আর এই টেকনোস্ট্রাকচারোদ্ভূত খাদকসমাজের ডিজনেল্যান্ডে যারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকৃষ্ট হয়েছে এবং ক্রমাগত হচ্ছে তারা যে কেবল ধনিকশ্রেণিভুক্ত তা নয়। তা মনে করলে মারাত্মক ভুল হবে, কারণ কেবল ধনিকরা নয় তার সঙ্গে আছে শহরের বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত, যারা বড় বড় কোম্পানির দু—তিনহাজারি মনসবদার, যারা দর্শনীয় পত্নীসমভিব্যাহারে ক্লাবে যায় ককটেল পার্টিতে যায়, বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে মদ্যসহযোগে মশকরা করে, আত্মমর্যাদা ও আধুনিক সংস্কৃতির কেতন ওড়ায়, সিনেমাপত্রিকা ও সেক্সিসাহিত্য পড়ে শিক্ষিতের জৌলুস বজায় রাখে তারাও আছে। এবং তাদের পিছনে আছে গ্রাম্য সমাজের মধ্যশ্রেণির চাষি যারা ট্রানজিস্টার ও দামি রিস্টওয়াচ নিয়ে আলুর ব্যাবসা করে অথবা শহরে সবজি চালান দেয় অথবা মাছের ব্যাবসা করে অথবা পাকা কুমড়োর আড়তদারি করে অথবা ডিমের স্টল মালিক আর আছে ছোট ছোট ব্যবসায়ী দোকানদার যাদের দৈনিক মুনাফা কম নয় অথচ আয়করী কোনো ঝঞ্ঝাট নেই আর বিভিন্ন পেশাজীবী যেমন উকিল ডাক্তার শিক্ষক অধ্যাপক বিলকেরানি হেডকেরানি এমনকী শ্রমিকশ্রেণির এক ভাগ যারা দালাল ইউনিয়নের আওতায় ইউনিয়নিজম ইকনমিজম করে বেশ লাভবান এবং একালের খাদকসমাজের চাহিদাতৃপ্তির ধান্দায় নিজেদের শ্রেণিসত্তা সম্বন্ধেও চৈতন্যহীন। এরা সকলেই আজ খাদকসমাজের দিকে পতঙ্গবৎ ধাবমান।১০
আজকের খাদকসমাজের দিকে চেয়ে আদিম মানবসমাজের জীবনসংগ্রামের কথা মনে হয়। মনে হয় তার কারণ জীবনসংগ্রামের হাতিয়ারের উন্নতি থেকেই তো সভ্যতা তা—ই। আদিম মানুষের জীবনসংগ্রাম গণ্ডিবদ্ধ ছিল কয়েকটি নির্দিষ্ট চাহিদাতৃপ্তির মধ্যে এবং চাহিদা বা তৃপ্তি কখনো বাঁধ ভেঙে উদ্দাম হয়নি তাই। তৃপ্তির পথে আদিম মানুষ যারা অসভ্য আমাদের বিচারে, তারা বিপুল প্রাণোচ্ছ্বাসে অবসর বিনোদন করত, যেমন আনন্দমুখর নৃত্যগীত উৎসব পার্বণ শিল্পকলা এবং আরও অনেক সুন্দর সাধনা যা সভ্য মানুষ আজও ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। চাহিদা ও তৃপ্তির সীমাবদ্ধতা আদিমতা অসভ্যতার লক্ষণ মনে করে সভ্য মানুষ উভয়ের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। তাই দেখা যায় যে বাণিজ্যের ইতিহাসে বিলাসের ও নেশার জিনিসের বেশি লেনদেন হয়েছে, যেমন মণিমুক্তো দামি কারুশিল্প মসলিন রেশম তামাক অ্যালকোহল চা কফি কোকো আফিমজাতীয় বহু জিনিস। আধুনিক শিল্পসমাজে এইসব বিলাস ও নেশার দ্রব্য ছাড়াও সবচেয়ে বেশি প্রতিপত্তি হল অজস্র ফালতু ভোগ্যদ্রব্যের যা ব্যবহার করলে জৈবিক প্রাণশক্তি বাড়ে না, কেবল ভ্যানিটির বেলুন ফুলে ওঠে, কেবল আলেয়াবৎ সামাজিক মর্যাদা ক্রমোজ্জ্বল হয়। তাই আজকাল দেখা যায় না—আছে চাহিদার সীমানা, না—আছে তৃপ্তির শেষ, ভোগের শেষ, না—আছে আয়বৃদ্ধির হাঁসফাঁসানির ছেদ।১১ নিম্নমধ্যবিত্ত শিক্ষক ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত অবিরাম বিদ্যাদান করে আয়বৃদ্ধি করছেন সর্বদা যে পরিবার প্রতিপালনের জন্য তা নয়, বরং খাদকসমাজের পতঙ্গবৎ। তেমনি দেড়হাজারি এক্সিকিউটিভের স্ত্রী—ও চাকরি করছেন আয়বৃদ্ধির জন্য, জীবনের গ্যাজেটবৃদ্ধির জন্য, এদিকে সব ভেসে যাচ্ছে তিস্তার বন্যার মতো। পরিবার ভাসছে, পুত্রকন্যা ভাসছে,মানবিক সামান্য দায়িত্ব—কর্তব্য সব ভেসে যাচ্ছে। তবু যে—কোনো ছলচাতুরী কৌশলে আয়বৃদ্ধি করা চায় এবং খাদকসমাজে অতৃপ্ত খাদক হওয়া চায়।১২
অ্যাফ্লুয়েন্ট বা প্রতুলসমাজে ক্রমাগত অভাবসৃষ্টি হতে থাকে অভাবপূরণের মধ্য দিয়ে এবং কথাটাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করেছেন গলব্রেথ আমেরিকান খাদকসমাজের আচরণ লক্ষ করে। শিল্পসমাজ যত প্রাচুর্যের পথে এগিয়ে যায় বিজ্ঞান ও টেকনোলজির সাহায্যে, তত অভাববৃদ্ধিও হতে থাকে, চাহিদাও বাড়তে থাকে, সেই অভাবপূরণের কৌশল ও পদ্ধতির ভিতর দিয়ে, এবং সেই কৌশল হল বিজ্ঞাপন ও বিক্রয়কলা। উৎপাদকরা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে চাহিদার বাজার ক্রমাগত চষতে থাকেন এবং নানা কৌশলে প্রলোভনের বীজ ছড়ান, যাতে ভালো ফসল ফলে অর্থাৎ নতুন একটা অভাববোধ মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে। এইভাবে বিচার করলে দেখা যায় যে কোনো বিশেষ ভোগ্যদ্রব্যের উৎপাদনের উপর তার অভাববোধ ও চাহিদা নির্ভর করে, যা সাধারণ ধনবিজ্ঞানসূত্রের বিপরীত মনে হয় অথচ বর্তমান সমাজে যা বাস্তব সত্য এবং এইজন্যই গলব্রেথ প্রতুলসমাজের অনির্বাণ অভাববোধকে বলেছেন ডিপেন্ডেন্স এফেক্ট, কারণ অভাব বা চাহিদা উৎপাদননির্ভর।১৩ অতএব উৎপাদনবৃদ্ধি তথা মুনাফাবৃদ্ধি করতে হলে অভাববৃদ্ধি প্রয়োজন এবং অভাববৃদ্ধি করতে হলে বিজ্ঞাপনের বাজেটবৃদ্ধি ও তার কলাকৌশলের অভিনবত্ববৃদ্ধি প্রয়োজন। যেজন্য দেখা যায় আধুনিক শিল্পসমাজে বিজ্ঞাপনশিল্পই রীতিমতো একটি প্রধান শিল্প হয়ে উঠেছে এবং তাতে যে কত শিল্পী—সাহিত্যিকদের প্রতিভা ভাড়া খাটছে তার অন্ত নেই। বিজ্ঞাপনশিল্পের প্রসার যে কী ভীষণ আকার ধারণ করেছে তা বোঝা যায় যখন দেখা যায় যে আমেরিকায় ১৯৫৭ সালে বিজ্ঞাপনের জন্য মোট ব্যয় হয় ১০০০ কোটি ডলার, ১৯৬২ সালে হয় ১২০০০ কোটি ডলার, এবং বর্তমানে প্রায় ২০০০০ কোটি ডলার অর্থাৎ ১৬০০০০ কোটি টাকার মতো।১৪ এই সংখ্যা যদিও সাধারণ গণিতের নাগালের মধ্যে আসে না তাহলেও বিজ্ঞাপনের এই ব্যয়বরাদ্দ থেকে আমেরিকায় মনোপলিস্টদের মুনাফার পরিমাণও কল্পনা করা যায় এবং পরিষ্কার বোঝা যায় যে মুনাফাও সেখানে প্রায় চন্দ্রলোক পর্যন্ত ঠেলে উঠছে।
কিন্তু তা—ই বলে আমাদের মতো অনুন্নত দেশে ও অপ্রতুলসমাজে যে অন্যরকম কিছু ঘটছে তা নয়। কারণ আমরাও প্রাচুর্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছি এবং আধুনিক শিল্পসমাজ গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা করছি। আমাদের মডেল আমেরিকা, মহাজন আমেরিকা অথচ শোনা যায় আমাদের আদর্শ নাকি সমাজতন্ত্র। অন্তত কাগজের বিজ্ঞাপন তো তা—ই। কাজেই আমাদের সমাজে অ্যাফ্লুয়েন্ট সমাজের উপসর্গগুলি অস্বাভাবিকভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে, যেমন অনাবশ্যক ভোগ্যদ্রব্যের উৎপাদনক্ষেত্রে তেমনি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে এবং বিজ্ঞাপন হয়েছে প্রধানত যৌন আবেদন নির্ভর অর্থাৎ সেক্সওরিয়েন্টেড অ্যাড। সমস্ত ভোগ্যদ্রব্যই যে অনাবশ্যক তা নয় বা তা হতে পারে না, তবে বিজ্ঞাপিত ভোগ্যদ্রব্যের অধিকাংশই যে অনাবশ্যক তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই এবং সেটাই আমাদের বক্তব্যের পক্ষে যথেষ্ট। যেমন হরেক রকমের প্রসাধনদ্রব্য পোশাক—পরিচ্ছদ টেরিন টেরিলিন নাইলন প্রিন্ট শার্ট স্যুট ব্রাসিয়ের অন্তর্বাস স্কুটার মোটর রেডিয়ো রেকর্ড ট্রানজিস্টার রেফ্রিজারেটার কুকার হিটার ইলেকট্রিক্যাল গ্যাজেট ফ্যান ফ্লুয়েরেসেন্ট এনামেল প্লাস্টিকের বাসন পাত্র খেলনা ক্রকারি নানা রকমের মাদক ও মদ্য যেমন হুইস্কি জিন রাম ব্র্যান্ডি ক্যানড ফুড সিগারেট ঘড়ি ক্যামেরা তা ছাড়া ব্যাধিগ্রস্ত সমাজে ব্যাধির অজস্র নতুন নতুন ড্রাগ তো আছেই আর আছে শিশুর খাদ্য বিচিত্র সব টনিক আর কুকিং অয়েল কৃত্রিম ঘৃত শুকনো ফলসবজি স্যুপ কাচুপ সস জ্যাম জেলি স্কোয়াশ নতুন নতুন কাব্যিক নামের সব জুতো তৎসহ যৌনসাহিত্য সিনেমা হোটেল রেস্তরাঁ ক্যাবারে টুইস্ট অপাঠ্যবই পত্রিকা আর যৌনগ্রন্থিক্ষরণশীল আধুনিক গান সিনেমার গান অ্যাবসার্ড নাটক আর মহানগরের রঙ্গমঞ্চে রাজধানীতে ফোককালচারের মহড়া। মনে হয় কী নেই এই হবুচন্দ্রের দেশে যেখানে বিজ্ঞাপনের বহর প্রতিদিন এমন বাড়ছে যে প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্রে পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশনের জায়গা থাকছে না, কেবল আঠারো কুড়ি পয়সা দাম যারা দিচ্ছে প্রত্যহ সকালে সেই সংবাদ নেশাখোররা শুধু বিজ্ঞাপন পড়ছে। যথা বম্বে ডায়িং—এর তোয়ালের বিজ্ঞাপন বা সুইটহার্ট শাড়ির বিজ্ঞাপন বা ট্রানজিস্টারের বা সিনেমার হোটেলের। তবু আমরা জানি, তোমরা জানো, তারাও জানে, যারা খায় না, দায় না অথচ মরেও না, যে এসবের কোনোটাই জীবনের উপকরণ নয়, কেবল খাদকসমাজের পতঙ্গ বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত—উচ্চবিত্তের বিলাসিতা আত্মগরিমাবৃদ্ধির উপচার, আর তার চেয়েও বেশি এদেশের মনোপলিস্টদের মুনাফাবৃদ্ধির চতুর কৌশল। মহলানবীশ—হাজারীরা অনুসন্ধান করে দেখিয়ে দিয়েছেন এই পুণ্যভূমি আর্যাবর্ত কীভাবে শিল্পোন্নতির এই গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজির ফলে মনোপলিস্টদের ভূস্বর্গ হয়ে উঠেছে ও উঠছে। যদিও সমাজতন্ত্রের বিজ্ঞাপন নিয়মিত চলছে বক্তৃতায় ও প্রস্তাবে এবং যদিও বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আসন্ন অপমৃত্যুর সম্ভাবনায় শোকার্ত শকুনদের মড়াকান্নায় মধ্যে মধ্যে শিউরে উঠতে হয় তবু—
তবু এই কথা ভেবে অবাক হয়ে যেতে হয় যে এ দেশে এসব কীসের জন্য, কাদের জন্য! কোন ধনবিজ্ঞানের নিয়মে এইটাই জাতীয় উন্নয়নের গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি! হিপি শাড়ি আর টেরিন পরিচ্ছদের উৎপাদনবৃদ্ধি! আর কী আশ্চর্য এই দেশ! যে দেশে ১৯৬০—৬১ সালে দেখা যায় যে ৩৫ কোটি ৫০ লক্ষ গ্রাম্য লোকের মধ্যে ১৮ কোটি ৮০ লক্ষ লোক অতিদরিদ্র অর্থাৎ খেতে পায় না এবং অর্থনৈতিক যোজনার জয়যাত্রার ফলে যে দরিদ্র লোকের সংখ্যা ১৯৬৭—৬৮ সালে হয়েছে ২৪ কোটির মতো আর ক্রমেই বাড়ছে।১৫ যেমন গ্রাম্য সমাজে ভয়াবহ দারিদ্র্যের ক্রমবিস্তার তেমনি নাগরিক সমাজেও, যদিও নগরের দারিদ্র্যের চেহারা একটু আলাদা, কারণ নাগরিক স্মগের ভিতর দিয়ে তা ঘোলাটে দেখায়। একটা আবরণ থাকে তার গায়ে যদিও কলকাতার শহরতলিতে ঘুরলে উলঙ্গ মানুষ আর উলঙ্গ দারিদ্র্য প্রচুর দেখা যায়। তবু কিন্তু এই কথা ভেবে অবাক হতে হয় যে এসব কাদের জন্য! এই কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন, এই বিপুল আবর্জনাস্তূপের মতো খাদকসমাজের ভোগ্যপণ্যের উপকরণবৃদ্ধি! যৈছে কলকাতার পথে পথে নোংরা আবর্জনাস্তূপ মাছিকীটের ভনভনানি, তৈছে কলকাতার ডিপার্টমেন্ট স্টোরে স্টোরে মিউনিসিপ্যাল বাজারে সমবায়ে এমপোরিয়ামে হাজার হাজার দোকানে, শপিং সেন্টারে ভোগ্যপণ্যের আবর্জনাস্তূপ এবং সেখানে মাছির মতো কীটের মতো বিত্তবান ও মধ্যবিত্তের ভনভনানি, যাকে শপিং—এর ফ্যাশন প্যারেড বলা যায়। এই কথা ভেবে তাই বাস্তবিকই অবাক হতে হয় যে সমাজের একটা বিরাট স্তর জুড়ে ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতির ফলে মধ্যশ্রেণির বিস্তার আর সেই মধ্যশ্রেণির মধ্যে বহুস্তরভুক্ত সব উপশ্রেণি যেন স্তূপীকৃত জ্যান্ত কেন্নোর মতো কিলবিল করছে আর গুঁড়ি দিয়ে ক্রল করে এ ওর পিঠের উপর দিয়ে উপরে উঠতে চাইছে। আর সে কী অদ্ভুত দৃশ্য! এই উপরে ওঠার অবিরাম প্রয়াস অর্থাৎ ক্রলিং। কারণ খাদকসমাজের বিজ্ঞাপনের আহ্বান তাই ক্রলিং—এর প্রতিযোগিতা। ওজাঁফাঁ বা পিকাসোর পেইন্টিং—এর উপজীব্য এই মধ্যবিত্তের ক্রলিং, এওর পিঠের উপর দিয়ে, এ ওর ঘাড়ে বেড় দিয়ে এ—ওর কানের পাশ দিয়ে উপরে ওঠার ক্রলিং। কারণ বিজ্ঞাপনের ডার্লিংরা খাদকসমাজের পতঙ্গ, কারণ মোদিপন নাইলন ইয়ার্ন
E X C I T I N G
so exotic, so provocative
that you are bound to
have a second look
G l a m o r o u s
so soft, so smooth, so crisp and
uncrushable
v o l u p t u o u s
makes your heart faster
s o p h i s t i c a t e d
will make you go far into the social spectrum
––advt.
অতএব খাদকসমাজের পতঙ্গরা শোনো! যদি সামাজিক বর্ণচ্ছটা বহু দূর পর্যন্ত বিকীর্ণ করতে চাও তাহলে মোদিপনের নাইলন ইয়ার্ন ব্যবহার করো আর তা না হলে শ্রীরামের সিল্ক টেরিন স্যুট যেহেতু
Chairman is coming, dear, I have to meet
him at the Airport. Then there is luncheon
meeting and cocktail party in the evening.
Really a big day today. So I must have
the best. s h r e e r a m s i l k s Terene suit
and Eightly twenty shirt. Thanks to you for
your wonderful selection.
––advt.
সামাজিক বর্ণচ্ছটা বিকিরণোপযোগী ভলাপচুয়াস নাইলন ইয়ার্নের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে আলুথালুকেশ খাই—খাইভাব এক মহিলার ছবি সত্যিই ভলাপচ্যুয়াস১৬ এবং শ্রীরামের সিল্ক টেরিন স্যুটের বিজ্ঞাপনের সঙ্গেও একটি ছবি আয়নার সামনে দণ্ডায়মান স্যুট—পরা তরুণ ঠিক কদুর মতো চেহারা আর তার পাশে স্মার্ট তরুণী। মনে হয় বিবাহিতা প্রিয়া টেরিন স্যুটের সামাজিক উপযোগিতা বোঝে, কারণ তরুণ এগজিকিউটিভ স্বামী বিমানবন্দরে যাবে, চেয়ারম্যানকে রিসিভ করবে, তারপর সেখান থেকে যাবে লাঞ্চ মিটিং—এ সেখান থেকে ককটেল পার্টিতে। কাজেই সিল্ক টেরিনের স্যুট আর আশীবিষ শার্ট না হলে এরকম গুরুতর সামাজিক দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয় তাই বিজ্ঞাপন।১৭ স্যুটশার্টে দুরস্ত হলে চলবে না শুধু। তার সঙ্গে অটো চাই মোবিলিটির জন্য। অ্যামব্যাসেডার, কারণ সুইটহার্ট শাড়ি—পরিহিতা ডার্লিং যেমন অ্যামব্যাসেডারও তাই, প্রায় দ্বিতীয়া স্ত্রী—র মতো রূপেগুণে চুম্বকটানে অনন্যা অদ্বিতীয়া
Wife takes one half. She needs
you, your time and attention––
a good half of you. What do
you do with your other half
the working half?
… …
Wherever you go, let Ambassador,
take care of you. Lean back,
Stretch out and relax. Steer her
wherever you want to go. She
obeys you silently. She is
dependable. She is beautiful
(next to your wife). She is
smooth, she is strong. She’ll go
a long way and even take a
lot of beating. She’ll make you
feel important, she’ll make you
feel wanted.
She will share you with your family,
ungrudgingly. As your other half,
Ambassador Mark It will respond to
your tender handling.
––advt.
এইজন্য অবাক হয়ে ভাবতে হয় আমাদের দেশ যদিও আমেরিকা নয়, যদিও আমেরিকা আমাদের সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মডেল, যদিও আমেরিকা আমাদের শিল্পোন্নয়নের তহবিলের বড় মহাজন তথাপি এই ভোগ্যদ্রব্যের বিচিত্র সমারোহ আর এই বিজ্ঞাপন কীসের জন্য এবং কাদের জন্য। যাদের জন্য তারা কারা এবং সমাজের পিরামিডের কোন ধাপ পর্যন্ত তাদের অবস্থান। যখন জানি সমাজের প্রায় শতকরা সত্তরজন মানুষ অতিদরিদ্র অনাহারক্লিষ্ট জীর্ণশীর্ণ ব্যাধিগ্রস্ত সামান্য ভাতভুট্টাও খেতে পায় না এবং নিরক্ষর অর্ধাবৃত দেহ। যখন জানি বিজ্ঞাপন মানে কৃত্রিম চাহিদাবৃদ্ধির কৌশল এবং চাহিদাবৃদ্ধি টেরিন টেরিলিনের স্যুট—শার্টের ফ্লু—মাথাব্যাথার অজস্র ড্রাগের আর পিলের এবং উৎপাদনবৃদ্ধি মানে মুনাফাবৃদ্ধি এবং প্রায় পঞ্চাশ কোটি মানুষের মধ্যে পঞ্চাশজন অথবা একশোজন মনোপলিস্টের মুনাফাবৃদ্ধি। যখন জানি শতকরা আঠারোজন লোক এ দেশে নগরবাসী, বাকি সকলে আজও গ্রামবাসী এবং প্রায় পাঁচ লক্ষ সাতষট্টি হাজার গ্রামের অধিবাসী মানুষ। এবং যখন জানি এই বিপুল গ্রামবাসীদের মধ্যে আজ প্রায় শতকরা সত্তরজন দুর্ভেদ্য দারিদ্র্যের কারাগারে বন্দি। তখন মনে হয়, বাস্তবিক ভাবতেও অবাক লাগে, কী বিচিত্র এই দেশ ভারতবর্ষ আর তার কী বিচিত্র যোজনা পরিকল্পনা উন্নয়ন। যেমন ভালো হ্যারিকেন—লন্ঠন নেই কিন্তু আছে নাইলন ইয়ার্ন টেরিন স্যুটিং—শার্টিং। যেমন ভালো হাসপাতাল নেই সাধারণ মানুষের জন্য এবং তার বদলে আছে মুনাফাখোর শকুন ড্রাগ ব্যবসায়ীদের অজস্র পিল ট্যাবলেট মাইসিন অ্যান্টিবায়োটিক। যেমন ভালো স্বাস্থ্যাবাস নেই বিদ্যালয় নেই অথচ লাক্সারি হোটেল আছে যেমন পুনার ব্লু—ডায়মন্ড১৮
Hotel Blue Diamond has
several imaginative touches.
For instance, the Panchali Coffee
Room which is poised over a
pool and has sprinkling foun-
tains all around. And the
Mastani Room decorated in
Peshwa style. The hotel took
two years to build and spells
luxury in every line.
––advt.
চতুর্দিকে বিলাসিতার উপকরণের আবর্জনার পাহাড় আর তার বিজ্ঞাপন। মধ্যিখানে দিগন্তবিস্তৃত দারিদ্র্যের ভূখণ্ড নিয়ে কী অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ—আহা!
আলফ্রেড মার্শাল যদিও মার্কসিস্ট নন তাহলেও তাঁর ‘ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ট্রেড’ গ্রন্থে দু—রকমের বিজ্ঞাপনের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা কনস্ট্রাকটিভ ও কমব্যাটিভ এবং সেই বিজ্ঞাপন কনস্ট্রাকটিভ যা সুস্থ প্রতিযোগিতার বাজারে ক্রেতাদের ইচ্ছেমতো জিনিস বাছাই করে কেনাকাটার সুযোগ করে দেয়, কখনো এটা ভালো, ওটা আরও ভালো, সেটা সবচেয়ে ভালো—এইভাবে অনবরত তাদের কানে মন্ত্রণা দেয় না, যা কমব্যাটিভ বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। পরে তাঁর উত্তরাধিকারী পিন্ড তাঁর ‘ইকনমিকস অফ ওয়েলফেয়ার’ গ্রন্থে প্রায় একই রকমের যুক্তি দেখিয়ে বিজ্ঞাপনের ভালোমন্দ গুণের বিচার করেছেন এবং এমন কথাও প্রসঙ্গত যুক্তির মুখে বলে ফেলেছেন যে একচেটে বাণিজ্যের প্রতাপ কমাতে পারলে হয়তো মন্দ বিজ্ঞাপনের প্রচার বন্ধ করা যেত। মন্দ বিজ্ঞাপন বলতে পিন্ড সেই বিজ্ঞাপনের কথা বলেছেন যার কাজ হল নানা প্রকারের স্তোকবাক্যে ও ছলনায় ক্রেতাদের মন ফুসলানো। এর বেশি কথা মার্শাল বা পিন্ড বলেননি অথবা বিশ্লেষণ শেষ পর্যন্ত করেননি, যেহেতু আজ থেকে চল্লিশ—পঞ্চাশ বছর আগে মনোপলির বর্তমান একাধিপত্য তাঁদের মানসচক্ষে ভেসে ওঠেনি। আমেরিকার মতো মনোপলির ভূস্বর্গে বিজ্ঞাপনের যে কী ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তা ব্যাখ্যা করে ম্যাকগ্রহিলের ধনবিজ্ঞানীরা লিখেছেন যে সত্যি কথা বলতে কী বাজারনিয়ন্ত্রণের যাবতীয় কাজ, যেমন ভোগ্যপণ্যের ডিজাইন থেকে আরম্ভ করে তার মূল্যনির্ধারণ করা, বিজ্ঞাপন দেওয়া, ক্রেতার দরজায় দরকার হলে ক্যানভাসার পাঠিয়ে কলিং বেল বাজানো, অবশেষে জিনিস বিক্রি করা পর্যন্ত কাজের ধারাটাই হল আমাদের ফ্রি সোসাইটির বড় লক্ষণ এবং শুধু লক্ষণ নয়, এই ফ্রি সোসাইটির স্বার্থে একান্ত প্রয়োজনও বটে। আর বিজ্ঞাপনের অভাবে এহেন মার্কিনি ফ্রি সমাজের হাল যে কত দূর শোচনীয় হতে পারে সে সম্বন্ধে একজন বিখ্যাত আমেরিকান ব্যাঙ্কার বলেছেন যে ক্রেতারা অর্থাৎ সমাজের লোকজন যদি কেবল প্রকৃত উপযোগিতা বিচার করে পোশাক—পরিচ্ছদ—জামাকাপড়—জুতো কেনে, অথবা এমন সব খাদ্যদ্রব্য কিনতে ও খেতে থাকে যা পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যপ্রদ ও ন্যায্য মূল্যে পাওয়া যায়, অথবা এমন অটোমোবিল ব্যবহার করে যা দশ পনেরো বছরের আগে বদল না করলেও চলে এবং ঘরবাড়িও নিজের রুচি অনুযায়ী করতে থাকে, তাহলে কী ভয়ংকর শোচনীয় অবস্থা হবে এত নতুন নতুন মডেল, নতুন নতুন স্টাইল আর নতুন নতুন আইডিয়ার।১৯
অর্থাৎ আধুনিক ধনতান্ত্রিক সমাজে কনজাম্পশন—ইনভেস্টমেন্ট—এমপ্লয়মেন্টের ক্রমিক অধোগতি স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী বলে যাবতীয় অস্বাভাবিক উপায়ে, যেমন বিজ্ঞাপনের সাহায্যে, একটা কৃত্রিম খাদকসমাজ সৃষ্টি করে সমগ্রভাবে এফেকটিভ ডিম্যান্ড বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। কারণ তা না রাখতে পারলে উৎপাদনবৃদ্ধি, মূলধন বিনিয়োগ, কর্মযোগ কোনোটারই ক্রমবর্ধমান চাপের সঙ্গে তাল রাখা সম্ভব নয় এবং এইটাই হল টেকনোস্ট্রাকচারনির্ভর ধনতন্ত্রের মূল সমস্যা, যে সমস্যা সমাধানের অন্যতম উপায় হল বিজ্ঞাপন। আর এই কারণেই উৎপাদনকালীন অসারতা, যাকে বিল্ট—ইন অবসোলেসেন্স বলা হয়, তা ছাড়া গতি নেই। কারণ ভালো মজবুত দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহার্য জিনিস বিক্রি হবে বটে কিন্তু তার চাহিদা একবার মিটলে বেশ কিছুদিনের জন্য আর উঠবে না এবং তার ফলে উৎপাদনহার, মূলধন নিয়োগ সবই কমাতে হবে, যার ফলে মুনাফাও কমবে। কাজেই ভোগ্যদ্রব্য এমনভাবে তৈরি করতে হবে যার মেয়াদ অল্পদিনেই ফুরিয়ে যায় এবং সেই জিনিসেরই নতুন মডেল, নতুন স্টাইল, নতুন লেবেল—প্যাকেজ—আঁটা সংস্করণ বাজারে ছাড়লে চালু হয়। তাই দেখা যায় অনবরত লেবেল পালটানো মডেল পালটানো স্টাইল পালটানো ডিজাইন প্যাকেজ—কার্টন—কন্টেনার পালটানো ভোগ্যপণ্য উৎপাদদের প্রধান কাজ, আর সেইসব কাজকর্ম করার জন্য মোটা মাইনের অনেক কর্মচারী কোম্পানির তাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে মাথা ঘামায় এবং যাকে বলে জাতীয় প্রতিভার অতি চমৎকার সদব্যবহার, বিশেষ করে আমাদের মতো দরিদ্র দেশে। যদি কোনো নতুন সাবান, পাউডার, সিগারেট বা যা—ই হোক বাজারে প্রবেশ করে, সঙ্গে সঙ্গে কাগজপত্রে লক্ষ লক্ষ টাকার বিজ্ঞাপন ফলাও করে প্রচার করা হয় আর তার সঙ্গে খাদক বা ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করার নতুন নতুন কৌশল এবং কৌশলের মধ্যে দুটি কৌশল ইদানীং প্রধান হয়ে উঠেছে। যথা যৌনগ্রন্থি উত্তেজক সচিত্র বিজ্ঞাপনের কৌশল এবং লাকি টিকিট লটারি ও উপহারলাভের প্রলোভনকৌশল।
আমাদের দেশের নানাবিধ পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের যদি একটা নমুনাসমীক্ষা করা যায় তাহলে দেখা যাবে কয়েক শ্রেণির বিজ্ঞাপনের পুনরাবৃত্তি ও প্রাধান্য যেমন
রেডিমেড পোশাক—পরিচ্ছদ স্যুটশার্ট বিশেষত আধুনিক সিন্থেটিকের জামাকাপড় শাড়ি ব্রিফ ড্রয়ার ব্রা ভেস্ট প্রভৃতি।
ড্রাগ বা ওষুধপত্র প্রধানত এমন সব ওষুধ যা সাধারণ লোক ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই কিনতে পারে—যেমন ফ্লু—মাথাব্যথা গা—ব্যথার পিল ট্যাবলেট হাঁচি—কাশি—সর্দি অ্যালার্জির পিল নানাবিধ মলম দন্তব্যাধি নিবারক টুথপেস্ট প্রচুর টনিক ভিটামিন ক্যাপসুল ইত্যাদি।
জীবনযাত্রার গ্যাজেট প্রধানত ইলেকট্রিক্যাল এবং পরিবার ও কিচেনের জন্য। যেমন ফ্যান হিটার কুলার কেটলি আয়রন প্রেশার কুকার রেফ্রিজারেটার প্রভৃতি।
অটোমোবিল ও তার সরঞ্জাম যেমন মোটর স্কুটার সাইকেল মোটরবাইক অটো ব্যাটারি টায়ার গ্যারাজ প্রভৃতি।
প্রসাধনদ্রব্য নানা রকমের সাবান পাউডার স্নো ক্রিম লোশন পলিশ প্রভৃতি যেগুলি রূপচর্চার অপরিহার্য উপকরণ।
বিবিধ বিষয় বিবিধের মধ্যে শ্রেণিবদ্ধ ক্যাজুয়াল বিজ্ঞাপন থেকে আরম্ভ করে নতুন কোম্পানি নতুন হোটেল সিনেমা সাহিত্য লাক্সারি ট্যুরিস্ট লজ পরিবার পরিকল্পনা ইদানীং রাজ—সরকারদের লটারি প্রভৃতি সবই আছে।
প্রাধান্যের পর্যায়ক্রমে অনেকটা বিজ্ঞাপনগুলিকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে মনোপলিস্টদের দামি ড্রাগগুলি, যেমন অ্যান্টিবায়োটিকস, প্রধানত মেইলিং—এর সাহায্যেই প্রচারিত হয় এবং তার লিটারেচার স্যাম্পল ইত্যাদি সোজাসুজি রেজিস্টার্ড ডাক্তারদের কাছে যায়, যেহেতু তাঁরাই সেগুলি নিজেদের রুগির প্রেসক্রিশন মারফত চালু করেন আর কিছু মেডিক্যাল জার্নালেও ছাপা হয়।
রেডিমেড পোশাকের প্রচলন আমাদের দেশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে হয়েছে, তা—ও পাঁচের দশকে ধীরে ধীরে এবং ছয়ের দশক থেকে অতিদ্রুত গতিতে, বিশেষ করে যখন থেকে নাইলন পলিয়েস্তার টেরিন টেরিলিন প্রভৃতি সিন্থেটিকস বাজার ছেয়ে ফেলেছে। তার আগে রেডিমেড পোশাকের প্রচলন প্রায় ছিলই না বলা চলে, খুব সামান্য ছিল এবং সাধারণ দরিদ্র থেকে মধ্যবিত্ত ধনী সকলেই তখন দরজির তৈরি বায়না—দেওয়া পোশাকই পরত বেশি। তাই কুড়ি বছর আগেকার সংবাদপত্রে মোট বিজ্ঞাপনের ৫% রেডিমেড পোশাকের বিজ্ঞাপন ছিল কি না সন্দেহ, এমনকী বিজ্ঞাপনই তখন কম ছিল এবং সংবাদপত্র ছিল সংবাদের পত্রিকা তখন, এখনকার মতো প্রধানত বিজ্ঞাপনের পত্রিকা ছিল না। ইউরোপের মতো শিল্পোন্নত দেশে দেখা যায় মোট পরিচ্ছদের মধ্যে রেডিমেড পরিচ্ছদ বিক্রি হয় ৭০% থেকে ৯০%, আমেরিকায় প্রায় ৯০% এবং এখন আমাদের ভারতবর্ষে প্রায় ৪০% যদিও ভারতের মতো দরিদ্র অনুন্নত দেশের পক্ষে তা—ই যথেষ্ট।২০ রেডিমেড পোশাকে যেহেতু প্যাকেজের বাহার দেখাবার সুযোগ কম তা—ই বাইরের বিজ্ঞাপনই তার প্রধান অবলম্বন এবং সেই বিজ্ঞাপনের মধ্যে সেক্সওরিয়েন্টেড বিজ্ঞাপনই এক্ষেত্রে ডিপ ইমপ্যাক্ট প্যাকেজের কাজ করে। গত কয়েক বছরের মধ্যে তাই আমাদের দেশে যৌনাবেদনপ্রধান বিজ্ঞাপন রেডিমেড পোশাকের ক্ষেত্রে খুব বেড়েছে এবং ক্রমেই বাড়ছে।২১ আমেরিকায় ব্রা—গার্ডল অর্থাৎ কাঁচুলি—কোমরবন্ধ—প্রভৃতির বিজ্ঞাপনে যৌবনবস্তুর বিশেষত্ব হল তা অতিমাত্রায় উগ্র মাজোখিজম ও বডি এগজিবিশনিজমের পক্ষপাতী, যথা কাঁচুলি—কোমরবন্ধ—পরা একটি তরুণীর চুলের ঝুঁটি ধরে মেঝের উপর টানছে আধুনিক এক গুহামানব এবং বিজ্ঞাপনের শিরোনামা হচ্ছে Come out of the Bone Age, darling! অথবা যেমন কোমরবন্ধের বিজ্ঞাপনে একটি তরুণী তার তরুণ বন্ধুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর বাতাসে তার স্কার্ট ময়ূরের পেখমের মতো উপরে উড়ছে, ভিতরে দেখা যাচ্ছে কোমরবন্ধ এবং মেয়েটি তার তরুণ বন্ধুর দিকে চেয়ে খিলখিল করে হাসছে।২২ ঠিক এর হুবহু প্রতিলিপি এ দেশের বিজ্ঞাপনে চোখে না পড়লেও যা চোখে পড়ে তা কোনো অংশেই কম নয়। কেবল রেডিমেড পোশাকের ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য বিজ্ঞাপনেও আমাদের দেশে ইদানীং নারী ও সেক্সের প্রাধান্য রীতিমতো বাড়ছে। যেমন বৈদ্যুতিক পাখার বিজ্ঞাপনে সিগারেটের বিজ্ঞাপনে কফি ওভালটিন বোর্নভিটা প্রভৃতি পানীয়ের বিজ্ঞাপনে সাইকেল স্কুটার অটোর বিজ্ঞাপনে জুতোর বিজ্ঞাপনে এয়ারলাইনের হোস্টেসের বিজ্ঞাপনে। কিন্তু প্রশ্ন হল এত যৌনভাব ও নারীপ্রাধান্য বিজ্ঞাপনে কেন? যদিও যে—কোনো যৌনবিজ্ঞানী—মনোবিজ্ঞানীর কাছে এই কেনর উত্তর খুব সহজ এবং সেই উত্তর হল মানুষের আদিমতম কামপ্রবৃত্তির কাছে আবেদন করলে যত সহজে সাড়া পাওয়া যায় তত সহজে আর কোনো উপায়ে পাওয়া যায় না। এই মহাসত্যটি অনেক কোটি ডলার খরচ করে বড় বড় কোম্পানির অ্যাড ও মার্কেট রিসার্চ ও মোটিভেশনাল রিসার্চ দপ্তরের মোটা মাইনের সাইকোলজিস্ট—সোশিওলজিস্টরা আবিষ্কার করেছেন। কী আশ্চর্য আবিষ্কার!
উত্তম আবিষ্কার। কিন্তু এইসব বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য কারা বা সমাজের কোন শ্রেণির মানুষ সে কথা মনে হলে প্রথমে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানীদের ছয়টি সামাজিক শ্রেণির কথা মনে পড়ে যেমন২৩:
১ আপার—আপার প্রাচীন বনেদি অভিজাত শ্রেণি।
২ লোয়ার—আপার নব্যধনিকশ্রেণি।
৩ আপার—মিডল প্রফেশনাল—ম্যানেজার এগজিকিউটিভ বড় বড় ব্যবসায়ী প্রভৃতি।
৪ লোয়ার—মিডল চাকরিজীবী ব্যবসায়ী টেকনিশিয়ান প্রভৃতি।
৫ আপার—লোয়ার কুশলী কারিগর ও দক্ষ মজুরশ্রেণি।
৬ লোয়ার—লোয়ার সাধারণ মজুরশ্রেণি।
আমেরিকান সমাজে হয়তো এই উপশ্রেণিবহুল অমার্কসীয় সামাজিক শ্রেণিভেদ আজকের দিনে অনেকটাই বাস্তব সত্য, কিন্তু আমাদের ভারতীয় সমাজের শ্রেণিভেদ এই পদ্ধতিতে করলেও কিছুটা পরিবর্তন করা দরকার, যেমন :
১ আপার—আপার রাজা—মহারাজা ও মহাধনিকরা বা মনোপলিস্ট শিল্পপতিরা।
২ লোয়ার—আপার বড় ব্যবসায়ী কালোবাজারি মাঝারি শিল্প মালিকদের নিয়ে গঠিত নব্যধনিকশ্রেণি।
৩ আপার—মিডল কতকটা আমেরিকার মতো প্রফেশনাল সিনিয়র একজিকিউটিভ ম্যানেজার মিনিস্টারদের নিয়ে গঠিত।
৪ মিডল—মিডল এই স্তরটি বা মধ্যবিত্তের উপশ্রেণি আমাদের দেশে বেশ প্রসার্যমাণ—যেমন ব্যুরোক্রাসি মোটা মাইনের অফিসার মাঝারি ব্যবসায়ী ইঞ্জিনিয়ার টেকনিশিয়ান কনট্র্যাক্টর ডাক্তার উকিল ব্যারিস্টার অধ্যাপক চিত্রতারকা খেলোয়াড় বড় গাইয়ে—বাজিয়ে এবং গ্রামাঞ্চলের সম্পন্ন চাষি জোতদার আড়তদার প্রভৃতিদের নিয়ে গঠিত।
৫ লোয়ার—মিডল এই স্তরটিও খুব বিস্তৃত। অসংখ্য কেরানি সাধারণ কর্মচারী শিক্ষক ছোট দোকানদার মধ্যবিত্ত চাষি প্রভৃতিদের নিয়ে গঠিত।
৬ আপার—লোয়ার কুশলী কারিগর মজুর মেকানিক প্রভৃতি।
৭ লোয়ার—লোয়ার বৃহত্তম স্তর—সাধারণ চাষি ও মজুরের।
মার্কেট রিসার্চে বিশেষজ্ঞ আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন যে তাঁদের পূর্বোক্ত ছয় শ্রেণির মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি অর্থাৎ লোয়ার—মিডল আপার—লোয়াররাই হল ক্রেতাদের মধ্যে ৬৫%, কারণ প্রথম—দ্বিতীয়—তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত যাঁরা তাঁরা এমনিতেই কোয়ালিটি মার্কেটের ক্রেতা। কাজেই বিজ্ঞাপনের ফোকাস হল চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি, যাঁদের মধ্যে উপরের সামাজিক স্তরে ওঠার ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা অত্যন্ত প্রবল এবং আমাদের দেশে তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ স্তর পর্যন্ত এই বিজ্ঞাপনের ফোকাস প্রসৃত। যেহেতু এই শ্রেণিভুক্তদের মধ্যে মহিলারাই প্রধান ক্রেতা তাই এর নামকরণ করা হয়েছে ‘মিসেস মিডল মেজরিটি’—যাঁরা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞাপনদাতাদের ডার্লিং। আমাদের দেশে বিজ্ঞাপনদাতাদের এই ডার্লিংদের স্তর তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ ধাপ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং যেহেতু সামাজিক ল্যাডারের ধাপে ধাপে উপরে ওঠার জন্য মধ্যবিত্তের এই স্তরগুলি সতত প্রাণপণ প্রয়াসী তাই সামাজিক মর্যাদা ও আভিজাত্যের মানদণ্ডগুলির দিকে তাদের প্রলুব্ধ দৃষ্টিও প্রখর। এই মানদণ্ডগুলি হল দৈনন্দিন জীবনের নানা রকমের গ্যাজেটের বাহুল্য, যেজন্য যাবতীয় ভোগ্যদ্রব্যের প্রধান লক্ষ্য হল এই শ্রেণির লোক যারা বোম্বাই ফিলমের ভায়োলেন্স ও দুর্গন্ধ সেক্সঠাসা ছবি দেখার জন্য উন্মাদ।২৪ অতএব যৌন আবেদনপ্রধান বিজ্ঞাপন ছাড়া ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের আর উপায় কী!
মৃত্যু ব্যবসায়ী ব্যাধি ব্যবসায়ী কেমিস্ট—ড্রাগিস্টদের কিন্তু ভোগ্যপণ্যের মতো মন—ভোলানো যৌনবিজ্ঞাপনের প্রয়োজন হয় না, কারণ এক্ষেত্রে মনোপলিস্টদের একনায়কত্ব এমনই দুর্ভেদ্য এবং প্রাণ বাঁচানোর দায়ে খাদ্যের আগেও যেহেতু মানুষের ওষুধের প্রয়োজন বেশি তাই। ড্রাগ উৎপাদনের মনোপলি আমেরিকায় প্রায় মারণাস্ত্রের সমকক্ষ এবং শেরিং রবিনস কার্টার মার্ক হোয়েখস্ট পার্কডেভিস সিবা ফাইজার প্রভৃতি বড় বড় ড্রাগ ব্যবসায়ীরা কীভাবে কোটি কোটি টাকার ড্রাগ উৎপাদনে পরিবেশনে মূল্যনির্ধারণে সর্বাত্মক কর্তৃত্ব করছে তার লোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছেন কেফাউভের।২৫ এই বিদেশি ড্রাগিস্টরা অনেকে আমাদের দেশে নানা রকমের কোলাবোরেশন ও কম্বিনেশনের ভিতর দিয়ে বিশাল মনোপলির জাল বিস্তার করেছে এবং সম্প্রতি ভারত সরকার এদের আয়ত্তে আনার লোক—দেখানো একটা চেষ্টা করছেন বটে কিন্তু বিশেষ জুত করতে পারছেন না। অবশ্য এ প্রশ্ন আমাদের আলোচ্য নয়, বিজ্ঞাপনই আলোচ্য। তাহলেও জানা দরকার যে বর্তমান মনোপলি বজায় রেখে ড্রাগমূল্য কনট্রোল করা অতীব কঠিন এমনকী প্রায় দুঃসাধ্য। বিজ্ঞাপনের ব্যাপার হল ড্রাগিস্টদের বিজ্ঞাপন প্রধানত মেইলিং স্যাম্পল detail men বা সেলস প্রতিনিধির উপর নির্ভর করে এবং বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য ডাক্তাররা, আদৌ রুগিরা নয়। মেইলিং স্যাম্পল প্রতিনিধিদের বেতন বিক্রেতাদের কমিশন ইত্যাদি খাতে যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয় তা বহন করে ক্রেতারা বা রুগিরা। যেমন Contac নামে একটি ড্রাগ চালু করার সময় আমেরিকান মালিকরা ১৩০ লক্ষ ডলার অর্থাৎ প্রায় ১০ কোটি টাকা বিজ্ঞাপনে খরচ করেন।২৬ কেফাউভের এরকম আরও দৃষ্টান্ত দিয়েছেন নামজাদা সব ড্রাগের উল্লেখ করে যার অধিকাংশই অ্যান্টিবায়োটিকস ট্র্যাঙ্কুইলাইজার ইত্যাদি শ্রেণিভুক্ত। প্রচার ও বিজ্ঞাপন ও কমিশনের সঙ্গে মালিকেরা মুনাফা ধরেল অধিকাংশ ড্রাগের উৎপাদন খরচের সঙ্গে বাজারমূল্যের যে তফাত দাঁড়ায়, তা প্রায় পাঁচ পয়সার জিনিসের পাঁচ টাকা দামের মতো এবং তা শুধু মেইলিং বিজ্ঞাপনের বহর থেকে অনুমান করা যায়। যেমন আমেরিকার প্রত্যেক ডাক্তার প্রতিদিন প্রায় এক পাউন্ড ওজনের ওষুধের বিজ্ঞপ্তিপত্র পান এবং তাতে দেখা যায় যে বছরের শেষে আমেরিকার সমস্ত ডাক্তারের কাছে প্রায় ২৪০০০ টন কাজ জমা হয়। শুধু একটিমাত্র শহরে ওষুধের বিজ্ঞপ্তিপত্র ডেলিভারি দিতে দুটি রেলরোডের সমস্ত মেইলগাড়ি লাগে, ১১০টি মেইলট্রাক লাগে এবং ৮০০ পোস্টম্যান লাগে। তারপর এই কাগজের স্তূপ সাফ করতে হলে অন্তত ২৫টা ট্রাশট্রাকের সাহায্য নিতে হয় এবং শেষকালে যদি এই বিজ্ঞাপনপত্রের আবর্জনাস্তূপে অগ্নিসংযোগ করা হয় তাহলে নাকি ৫০ মাইল দূর থেকেও তার শিখা দেখা যেতে পারে২৭। আমাদের দেশে কত দূর থেকে এই আগুন দেখা যাবে জানি না, তবে আমাদের অবস্থাও যে আমেরিকার মতো হয়ে উঠছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখানকার যে—কোনো ডাক্তারের চেম্বারে—ক্লিনিকে প্রবেশ করলে দেখা যায় যে নানারকম ওষুধের সার্কুলার ফোল্ডার ব্রশিয়ার ইত্যাদির স্তূপ কী পরিমাণ জমা হয়েছে এবং প্রতিদিন হচ্ছে। ভারতবর্ষে কর্মরত ডাক্তারের সংখ্যা ছিল ১৯৬৭—৬৮ সালে ৯৬০০০, বর্তমানে অন্তত এক লক্ষ।২৮ এ দেশের প্রত্যেক ডাক্তার যদি প্রতি মাসে অন্তত কম করে তিন কিলোগ্রাম ওজনের ওষুধের বিজ্ঞাপনপত্র পান তাহলে মাসে তিন লক্ষ কিলোগ্রাম এবং বছরে ছত্রিশ লক্ষ কিলোগ্রাম অর্থাৎ ৩৬০০ মেট্রিক টন ওজনের কাগজপত্র জমা হয়। এই পরিমাণ বিজ্ঞাপনপত্র বিলি করতে কত মেইলট্রেন কত ট্রাক কত পোস্টম্যান লাগতে পারে বলতে পারব না, তবে এ কথা ঠিক যে এই আবর্জনাস্তূপে আগুন লাগালে তা পঞ্চাশ মাইলের অনেক বেশি দূর দেখা যায় এবং সেই ভস্মস্তূপ দিয়ে হয়তো সিন্থেটিকস—জাতীয় পরিধেয় কিছু তৈরি হতে পারে, কিন্তু জমির সার হবে না, কেবল ড্রাগের সংখ্যা বাড়বে বিজ্ঞাপন বাড়বে ড্রাগের দাম বাড়বে, যেমন প্রতিদিন বাড়ছে এবং কোটি কোটি লোকের অর্ধচিকিৎসায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হবে।
ম্যানিপুলেটিভ ও কমব্যাটিভ বিজ্ঞাপনের, বিশেষ করে ভোগ্যদ্রব্যের বিজ্ঞাপনের, ইদানীংকালের যে প্রধান কৌশলের কথা আগে বলেছি অর্থাৎ সেক্সওরিয়েন্টশন, তা ছাড়া দ্বিতীয় কৌশল হল প্যাকেজ ডিজাইন অর্থাৎ ক্রমাগত প্যাকেজের ও ডিজাইনের পরিবর্তন। ভিতরে কী বস্তু আছে না—আছে সেটা বড় কথা নয়, কারণ বেচাবিদ্যাবিশেষজ্ঞরা বলেন যে প্যাকেজটাই নাকি আসল, তার ভিতরের বস্তুটা তেমন কিছু নয়। তা ছাড়া আরও একটা মস্ত বড় জ্ঞানের কথা হচ্ছে কী, লোকে যে ‘কেন’ জিনিস কেনে সেটা নাকি একটা সাংঘাতিক রহস্যময় ব্যাপার যা নিয়ে গবেষণা করার জন্য কোম্পানির মালিকরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বড় বড় মনোবিজ্ঞানী সমাজবিজ্ঞানী অ্যানালিস্ট ডিজাইনার প্রভৃতি মোটা বেতনে পুষে থাকেন। এহেন একজন উচ্চস্তরের গবেষক হলেন ল্যুই চেশকিন যাঁর বক্তব্য হল ভোক্তারা বা ক্রেতারা আসল জিনিসটা সম্বন্ধে কিছুই জানে না, কেবল ব্র্যান্ডের নাম জানে, ট্রেডমার্ক জানে আর লেবেল ও প্যাকেজ দেখে আকৃষ্ট হয়। তাঁর মতে একটা কোনো জিনিস ভালো মানে যে গুণের দিক থেকে ভালো তা না—ও হতে পারে, আসলে চোখের দিক থেকে দেখতে ভালো। কাজেই বিজ্ঞাপনের নিয়মিত ব্রেন—ধোলাইয়ে যে কাজ হয় তা মানতেই হবে, কারণ চেশকিন বলেছেন যে দীর্ঘকাল তিনি প্রত্যক্ষ সামাজিক অনুসন্ধান করে দেখেছেন যে লোকে বিজ্ঞাপনের দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়, কিন্তু সেই প্রভাব সম্বন্ধে তারা সচেতন নয় অর্থাৎ কতকটা অজ্ঞাতসারেই বিজ্ঞাপনের মোহে পড়ে যায়।২৯ তা ছাড়া বিজ্ঞাপনে কাজ না হলেই বা চলবে কেন, কারণ খাদকসমাজে ক্রেতারা যদি একই জিনিস বেশি করে না কেনে অথবা তার বিকল্প বহু জিনিস কিনতে আগ্রহ বা ইচ্ছা প্রকাশ না করে, তাহলে প্রধানত অনাবশ্যক ভোগ্যদ্রব্যের ক্রমবর্ধমান উৎপাদনহার বজায় রাখা সম্ভব হবে কী করে এবং তা না সম্ভব হলে মনোপলিস্টদের মুনাফার অঙ্কই বা মোটা হবে কী করে! কাজেই মনোপলিস্টদের খাদকসমাজে কেবল খাদক নয়, রাক্ষস তৈরি করার প্রয়োজন, যারা কেবল খাইদাই চাই—চাই করবে আর পরিতৃপ্তির কোনো দিগন্ত খুঁজে পাবে না।৩০
সুপারমার্কেট ডিপার্টমেন্ট স্টোর চেইনস্টোর হায়ার—পার্চেজ বা ধারেকিস্তিতে কেনা ইত্যাদি হল খাদকসমাজে খাদক ধরার সুবিস্তৃত জাল এবং খাদকদের অতিভোজী গোগ্রাসীতে পরিণত করার টোপ। খাদক পতঙ্গ কীভাবে সুপারমার্কেটের পণ্যজালের দিকে ধাবমান হয় তার বর্ণনা দিয়েছেন বিখ্যাত মোটিভেশনাল অ্যানালিস্ট জেমস ভাইকেরি। যেমন সাধারণত দেখা যায় যে প্রতি মিনিটে স্বাভাবিক মানুষের চোখে পলক পড়ে বত্রিশবার, কিন্তু ভাইকেরি বলেছেন মানুষ যখন উত্তেজিত হয় তখন চোখের পলক মিনিটে পঞ্চাশ—ষাট পর্যন্ত বেড়ে যায় এবং যখন শান্ত থাকে তখন কুড়ি পর্যন্ত কমে যায়। হাজার ডলারি অ্যানালিস্ট ভাইকেরি তাই ফিলমক্যামেরা নিয়ে মহিলা মক্কেলদের অনুসরণ করেন সুপারমার্কেটে। উদ্দেশ্য হল ভোগ্যদ্রব্যের হরেক রকমের প্যাকেজ কন্টেনার, কার্টন ও শোকেসের বাহার দেখে তাদের কীরকম উত্তেজনা হয় তারই স্টাডি করা, চোখের পলক গুনে। যেমন গবেষণার বিষয়বস্তু তেমনি গবেষক। কিন্তু যে যা—ই হোক তবু ভাইকেরি ক্যামেরা ঘুরিয়ে চোখের পলক রেকর্ড করতে থাকেন এবং তাতে যা দেখেন তা নাকি ভয়ানক চমকপ্রদ। অর্থাৎ সুপারমার্কেটে প্রবেশ করার পরেই মহিলাদের চোখের পলক কমতে কমতে প্রায় চোদ্দোতে নেমে আসে, যা স্বাভাবিক অবস্থার অনেক কম যেহেতু তখন ভদ্রমহিলারা নাকি হিপনোটিক ট্রান্সের স্টেজে, যাকে সমাধিভাব বলে তা—ই। এই হিপনোটিক হতভম্বতার কারণ হল সুপারমার্কেট এমন সব জিনিসপত্রে ঠাসা থাকে যা নাকি কিছুকাল আগেও রাজরানিরা ছাড়া চোখেই দেখতে পেত না কেউ। অতএব মিসেস মিডল যাকে বলে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবাক—নির্বাক। তা ছাড়া হাজারডলারি অ্যানালিস্ট এ কথাও বলেছেন যে স্টোরে ঢুকলে মনে হয় যেন প্রোডাক্টগুলো অর্থাৎ জিনিসপত্রগুলো চারদিক থেকে চিৎকার করে বলছে—আমাকে দেখো আমাকে কেনো অতএব তার জন্যও আরও মিসেস মিডলদের চোখের পলক চোদ্দোতে নেমে আসে, কিন্তু তারপর সমাধিঘোর ক্রমে কাটতে থাকে যত কেনা জিনিসগুলো ক্রমে চেকিং কাউন্টারে যেতে থাকে, তখন চোদ্দো থেকে পঁচিশ পর্যন্ত পলক বেড়ে যায়, তারপর যখন ক্যাশডিপার্টমেন্টের দিকে এগোয় তখন ঘন ঘন নিশ্বাস—প্রশ্বাসের সঙ্গে পলক বেড়ে প্রায় পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত ওঠে, কারণ কেনা মালের দাম শোধ করার মতো ক্যাশ টাকা নেই ক্রেতার কাছে।৩১ বছর পনেরো—ষোলো আগে একবার বিখ্যাত ধনকুবের ডুপন্টরা আমেরিকান গিন্নিদের সুপারমার্কেটে শপিং হ্যাবিট সার্ভে করেছিলেন এবং সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে বর্তমানে সুপারমার্কেটের ক্রেতাদের প্রধান বক্তব্য এই যে মাল যা—ই হোক বা যারই হোক যদি তা চোখে লাগে তাহলে মনে ধরবে এবং তখনই ক্রেতা বলবে I want it এবং এই রিপোর্ট ২৫০ সুপারমার্কেটে ৫৩৩৮ জন ক্রেতার অভ্যাস দেখে লেখা হয়েছিল।৩২ তবে মাল কেনা হল অথচ ক্যাশ টাকা নেই তার জন্য চিন্তা নেই, কারণ খাদকসমাজে ক্রেডিট—কিস্তি—হায়ার—পারচেজ ইত্যাদির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে, কারণ ক্রেতাদের ক্রেডিট কনডিশনড বা ঋণধাতস্থ করাও ব্যবসায়ীদের একটা চতুর কৌশল, যেহেতু তাতে খাদকসমাজের মধ্যবিত্ত পতঙ্গদের নিরন্তর আয় বাড়ানোর এবং তৎসহ ভোগ্যদ্রব্যের তালিকা বাড়ানোর ও তৎসহ সামাজিক স্টেটাস বাড়ানোর সক্রিয় চেষ্টা থাকে। এবং যে চেষ্টা না থাকলে বর্তমান খাদকসমাজ থাকে না অথবা সাপ্লাই দ্বারা ডিম্যান্ড নির্ধারিত হয় না এবং তা না হলে আবার মনোপলি ক্যাপিটালের বর্তমান রাজত্ব বজায় থাকে না।
ক্রেতাদের হিপনোটাইজ করার, বিশেষ করে মিসেস মিডলদের বিমোহিত করার বড় কৌশল হল ভালো ডিজাইনের প্যাকেজ। এ কথা আমেরিকার প্যাকেজ ডিজাইন কাউন্সিলের একজন বড়কর্তা বেশ বড় গলা করেই বলেছেন এবং তাঁর মতে ভালো প্যাকেজের টোপ যে কোনো ধুরন্ধর ক্রেতাকেও গেলানো সম্ভব। অতএব ডিপ ইমপ্যাক্ট প্যাকেজ বা মর্মভেদী মোড়ক নিয়ে স্পেশালাইজ করার জন্য কালার রিসার্চ ইনস্টিটিউট আছে, যেখানে কোন শ্রেণির ক্রেতার কাছে কী ডিজাইনের কী রঙের প্যাকেজ সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হতে পারে তা—ই নিয়ে গভীর গবেষণা করা হয় এবং লুই চেশকিন যাঁর কথা আগে বলেছি তিনি এই ধরনের গবেষকদের মধ্যে নামজাদা। চেশকিন বলেন যে শিক্ষা ও আয়ের দিক থেকে উন্নত শ্রেণির ক্রেতারা হালকা ও নিউট্রাল রং পছন্দ করে বেশি এবং শিক্ষা ও আয়ের দিক থেকে যারা অনুন্নত তাদের কাছে উজ্জ্বল রঙের আকর্ষণ বেশি যেমন লাল—গোলাপি ইত্যাদি।৩৩ বস্তুত চেশকিন বিজ্ঞাপনজগতের লেবেল প্যাকেজ সম্বন্ধে যা বলেছেন তা বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজের সর্বক্ষেত্রে খুব বড় রকমের বাস্তব সত্য হয়ে উঠেছে। যেমন সাহিত্য—সংস্কৃতিক্ষেত্রে তেমনি বিশ্ববিদ্বানের ক্ষেত্রে সবর্তর প্যাকেজ ও তার ঔজ্জ্বল্যই আসল। যেমন বইয়ের মলাট, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি যার যত বেশি ঔজ্জ্বল্য চমকপ্রদতা তার ভিতরের সারবস্তু তত কম, যদিও তাতে বাজারের চাকরির ও বিক্রির সুবিধে। তা ছাড়া ভোগ্যদ্রব্যের যৌনভাবপ্রধান বিজ্ঞাপনের মতো সাহিত্যেরও বাজারপ্রিয়তা যৌনভাবপ্রাধান্যের উপর নির্ভরশীল হয়েছে অত্যন্ত উৎকটভাবে। সাহিত্যগ্রন্থ, বিশেষ করে ক্রিয়েটিভ কথাসাহিত্য, এবং যে ক্রিয়েটিভ প্রত্যয়টি গত দু—শো বছরের বুর্জোয়া ননসেন্স ছাড়া কিছু নয়, তার অনর্থক বিচার—বিশ্লেষণ করার অবকাশ নেই এখানে, প্রবৃত্তিও নেই, তবু সাহিত্যপত্রিকার বিজ্ঞাপনের একটু আভাস দিয়েছি এখানে। এগুলি বিজ্ঞাপনের মর্মলিপি, কারণ হুবহু প্রতিলিপি আরও ভয়াবহ এবং শোনা যায় এইসব পত্রিকা, এবং পুস্তকও বটে, কেনার জন্য নাকি অনেক সময় পত্রিকাস্টলে ক্রেতাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি হয়। বর্তমান খাদকসমাজের প্রভাবে বঙ্গদেশের পাঠকসমাজের এবং ক্রিয়েটিভ সাহিত্যিকসমাজের এই হাল, তাই বাকি কথা না—বলাই ভালো। অন্তত আপাতত থাক।
টেকনোস্ট্রাকচার নির্ভর ধনতান্ত্রিক অ্যাফ্লুয়েন্ট সমাজের যখন এই অবস্থা, তখন অনেকেরই মনে হতে পারে সমাজতান্ত্রিক সমাজের গতি কোন দিকে, কারণ সেখানেও যখন বিজ্ঞান—টেকনোলজি নির্ভর শিল্পায়নের প্রশ্ন আছে এবং ব্যবহার্য পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করা হয়, তখন সেখানেও অ্যাফ্লুয়েন্ট সমাজের লক্ষণ কি দেখা দিতে পারে না অর্থাৎ খাদকসমাজের উপসর্গ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না কি? এ প্রশ্নের সোজা উত্তর হল—না। প্রথম প্রাঞ্জল কারণ হল সমাজতান্ত্রিক সমাজে মূলধনের ব্যক্তিগত বা একচেটে আধিপত্যের কোনো সুযোগ নেই এবং দ্বিতীয় কারণ হল সেখানে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের বিশেষ রীতি আছে, অন্তত উৎপাদনের অবাধ উচ্ছৃঙ্খলতা নেই। সোভিয়েট ইউনিয়নেও নেই, চীনেও নেই। যদিও সোভিয়েট সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ভুলত্রুটির জন্য এবং প্রশাসন বিভাগ পরিচালন দপ্তর ও শ্রমিক কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক যান্ত্রিক শাসক—শাসিতের সম্পর্কে পর্যবসিত হওয়ার জন্য সেখানে একটা নতুন ধরনের শ্রেণিবিন্যাস হয়েছে এবং তৎসহ পাশ্চাত্য ধনতান্ত্রিক খাদকসমাজের উপসর্গও সেখানে দেখা দিতে আরম্ভ করেছে, তাহলেও আমেরিকান সমাজ ও সোভিয়েট সমাজের মধ্যে মৌল পার্থক্য অবশ্যই আছে, যা তার শোধনবাদী ভূমিকা সত্ত্বেও অস্বীকার করা যায় না।৩৪ তবে এদিক দিয়ে চীনের সামাজিক পরীক্ষানিরীক্ষা এবং মাও—সে তুঙের বৈপ্লবিক দূরদর্শিতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কনজিউমার বা ক্রেতা বা যারা সাধারণ মানুষ—প্রধানত তাদের দিকেই সজাগ দৃষ্টি চীনের কমিউনিস্ট পরিকল্পকদের গোড়া থেকেই ছিল, যা সোভিয়েট রাষ্ট্রনায়ক ও পার্টিপ্রধানদের ছিল না এবং ছিল না বলে বহু মারাত্মক ভুলের খেসারত দিতে দিতে সম্প্রতি তাঁরা কিছুটা সচেতন হচ্ছেন।৩৫ প্ল্যান—পরিকল্পনার মধ্যে যে কেন্দ্রনির্ভর অচলতার সমস্যা সাধারণত দেখা যায় তা চীনে খুব সহজ একটি উপায়ে সমাধান করা হয়েছে এবং সেটি হল উৎপাদন ও রিটেলিং বা খুচরো বিক্রির বাজারটাকে পাইকারি স্তর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা। চীনের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের অন্তর্বাণিজ্যের মন্ত্রকের কাজ হল পণ্য উৎপাদনকেন্দ্র বা কলকারখানার সঙ্গে উৎপাদনের সঙ্গে রিটেলারের যোগসূত্র সর্বদা রক্ষা করা। এই চুক্তি অনুযায়ী শুধু যে পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত হয় তা নয়, প্রতিটি দ্রব্যের কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ড ডিজাইন প্যাকেজ ডেলিভারি এবং মূল্যও নির্ধারিত হয়, যার কোনোরকম এদিক—ওদিক হবার উপায় নেই।৩৬ কাজেই চীনের সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনায় সোভিয়েটের মতো ভেজাল ঢোকার সুযোগ হয়নি, যেহেতু গোড়া থেকেই চীনের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রনায়করা যথাসম্ভব ভেজালের প্রত্যেকটি রন্ধ্র বন্ধ করার চেষ্টা করেছেন। তাই আজ চীনে দেখা যায় যে ক্রেতা বা সমাজের মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুপাতে পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রিত হয় এবং ধনতান্ত্রিক খাদকসমাজের মতো বিপরীত ব্যাপার হয় না অর্থাৎ উৎপাদন বা সরবরাহের দ্বারা চাহিদা পরিচালিত হয় না।৩৭ তাই বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন নেই, মাহাত্ম্যও নেই সমাজতান্ত্রিক সমাজে, যা ধনতান্ত্রিক অ্যাফ্লুয়েন্ট সমাজে এবং খাদকসমাজে আছে। সমাজতান্ত্রিক সমাজে বিজ্ঞাপন, বিশেষ করে কমব্যাটিভ ও ম্যানিপুলেটিভ বিজ্ঞাপন, সামাজিক অপচয়, ছাড়া কিছু নয়। বিপুল অপচয়, যেমন—
বিজ্ঞাপন ও মনোপলি ক্যাপিটালের মায়াপুরী আমেরিকায় প্রতিদিন প্রত্যেক মানুষের কাছে অর্থাৎ খাদকসমাজের অধিবাসীর কাছে জমা হয় প্রায় ১০০ পাউন্ড solid waste। যেমন আমেরিকানরা বছরে ৩০০০০০০ টন কাগজ ৪০০০০০০ টন প্লাস্টিক ৪৮০০০০০০০০০ ক্যান অর্থাৎ গড়ে প্রত্যেকে ২৪০ ক্যান ২৬০০০০০০০০০ বোতল অর্থাৎ গড়ে প্রত্যেকে ১৩০ বোতল বাতিল করে দেয় ওয়েস্ট হিসেবে। তৎসহ আছে ৭০০০০০০ গাড়ি এবং ১৪২০০০০০০ টন ধোঁয়া—গ্যাস—বাষ্প।৩৮ এই ধোঁয়া—গ্যাস—বাষ্পের মিশ্রণে যে স্মগ তৈরি হয় তার জমাটবাঁধা মেঘ, যা বর্ষার মেঘ নয়, মারাত্মক কার্বন ও নাইট্রোজেন অক্সাইড ভারাক্রান্ত মেঘ আজ টোকিও, নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া প্রভৃতি শহরের উপর থমথম করছে, যার ফলে মানুষের দমবন্ধ হয়ে আসছে এবং শহর ছেড়ে প্রাণপণে ছুটছে মানুষ বাইরে যেখানে একটু নির্মল বাতাস, একটু নির্মল আলো আছে প্রকৃতির।৩৯ কিন্তু কোথায় আলো, কোথায় বাতাস যাতে মানুষ বাঁচতে পারে? কোথাও নেই। মুনাফার বিষে আলো—বাতাস বিষিয়ে গেছে। মারণাস্ত্রের মুনাফা আর অনাবশ্যক ভোগ্যমালের মুনাফা যা একমাত্র বিজ্ঞাপননির্ভর। তাই আজ ধনতান্ত্রিক শহরে শহরে বাঁচার মতো আলো নিভে যাচ্ছে, বাতাস বিষিয়ে যাচ্ছে আর মুনাফা বাড়ছে, বিজ্ঞাপন বাড়ছে।
এবং যেখানে আলো নিভুনিভু, বাতাস বিষাক্ত, সেই ধনতান্ত্রিক খাদকসমাজ সমগ্র মানবসমাজকে একটি বিশাল সেলসম্যানের সমাজে পরিণত করেছে, যেখানে প্রত্যেক মানুষ সেলসম্যান, কেউ ভেজিটেবল বেচছে কেউ ভোগ্যদ্রব্য বেচছে কেউ সততা—নিষ্ঠা বেচছে কেউ চরিত্র—নীতি বেচছে কেউ বিদ্যা—বুদ্ধি—প্রতিভা বেচছে। কেনাবেচা—মুনাফার বিপুল বাজারে প্রত্যেকেই চেষ্টা করছে লোভনীয় প্যাকেজ হতে, আকর্ষণীয় লেবেল হতে, যার যার মালিক ক্রেতার কাছে চড়া দামে বিকোবার জন্য। এবং প্রত্যেকেই বলছে, ‘আমাকে কেনো, আমাকে কেনো।’
১৯৭১
……
* The Price of the human body in terms of its chemical contents is a meagre $ 3.50 (about Rs. 27)… –The Statesman, September 19, 1969.
১. বিজ্ঞাপনগুলি ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার What’s On In Calcutta—র Restaurants কলাম থেকে সংকলিত।
২. Yojana, 19 October 1969.
৩. When we pass from the analysis of a competitive system to that of a monopolistic system, a radical change in thinking is called for ––Paul A. Baran and Paul M. Sweezy : Monopoly Capital (Pelican 1968), p. 118.
৪. ‘Surplus-utilization’—এর অভিনব পন্থা সম্বন্ধে বারান ও সুইজি বলেছেন : One of these alternative modes of utilization we call the sales effort, conceptually, it is identical with Marx’s expenses of circulation. But in the epoch of monopoly capitalism it has come to play a role, both quantitatively and qualitatively, beyond anything Marx ever dreamed of. ––Baran & Sweezy, op. cit. p. 119 (emphasis লেখকের)।
৫. After the war, capitalism was found to have undergone an important mutation, ––Joan Robinson : Freedom and Necessity, An Introduction to the Study of Society, London 1970.
৬. In its impact on the economy, it is outranked only by militarism. In all other aspects of social existence, its all-pervasive influence is second to none.––Baran and Sweezy, op. cit., p 12.
৭. ‘Advertise or Perish, says Parkinson’ ––The Statesman, March 8, 1970.
৮. Advertisement affects demands… by altering the wants themselves… They are not informative; they are manipulative. They create a new scheme of wants by rearranging his motives. ––E. H. Chamberlin : The Theory of Monopolistic Competition, Massachusetts, 1931, p.119.
৯. বারান ও সুইজির গ্রন্থে উদ্ধৃত স্কিটভস্কির উক্তি (Tibor Scitovsky : Welfare and Competition)––The secular rise in advertising expenditures is a sign of a secular rise of profit margins and decline of price competition.
১০. There is an ever-rising consumption of industrial products by the middle class of farmers, small businesses, professionals including the personnel of the techno-structure itself, and that part of the working class which had become absorbed into the system; the system has come to be known as the consumer society ––Joan Robinson op. cit., p. 84.
১১. গলব্রেথের ভাষায় বলা যায় যে, the pressures of emulation and competition in adornment and display have no clear terminal point ––J. K. Galbraith : The Industrial State, Pelical 1969, p. 275.
১২. To increase income and consumption is held to be socially and morally sound. ––Galbraith, Ibid। এই প্রসঙ্গে James S. Duesenberry : Income Saving and the Theory of Consumer Behaviour, Harvard 1949 দ্রষ্টব্য।
১৩. Increases in consumption, the counterpart of increases in production, act by suggestion or emulation to create wants. Or producers may proceed actively to create wants through advertisement and salesmanship. Wants thus come to depend on output… It will be convenient to call it the Dependence Effect.––Galbraith : The Affluent Society, Pelican 1963, pp. 135-36.
১৪. Baran and Sweezy : op. cit., p. 123.
১৫. ‘A Configuration of Indian Poverty : Inequality and Levels of Living’.––P. D. Ojha : Reserve Bank of India Bulletin, January 1970. এই প্রবন্ধে ওঝা লিখেছেন : As compared to only 52 percent of the rural population in 1960-61, 70 percent of the population in 1967-68 was found to be at poverty levels. p. 24.
তৎসত্ত্বেও বলতে হবে যে আমরা সমাজতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছি, কারণ বড় বড় শিল্প কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত করেছি এবং কিছু ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্ত করেছি আর স্কুটার—ট্র্যাক্টর কিনতে টাকা ধার দিচ্ছে আর কমিটি কমিশন কনফারেন্স কবে সমাজতন্ত্রের পবিত্র প্রস্তাব গ্রহণ ও প্রচার করছি।
১৬. Reader’s Digest, July 1970.
১৭. The Statesman, 22 July 1970.
১৮. The Sunday Statesman, August 2, 1970.
১৯. Clothing would be purchased for its utility value; food would be bought on the basis of economy and nutritional value; automobiles would be stripped to essentials and held by the same owners for the full ten to fifteen years of their useful lives… And what would happen to a market dependent upon new models, new styles, new ideas? ––Paul Mazur : The Standards We Raise, N. Y. 1953, p. 32.
২০. The Statesman, April 30, 1970 : Readymade Garments ক্রোড়পত্রে শ্রীসুব্রাম্যানিয়ামের প্রবন্ধ। গ্রামাঞ্চলেও রেডিমেড পোশাকের বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন সম্বন্ধে লেখক বলেছেন : With the growing rural prosperity, it is time that the industry bestirs itself, in its own interest, to cultivate the rural market by carrying a vigorous sales campaign. গ্রামের সমৃদ্ধি যা—ই হোক, এ কথা ঠিক যে একশ্রেণির সম্পন্ন চাষি জোতদার আলু—কপির আড়তদার মাছের ব্যাবসাদার সচ্ছল দোকানদার প্রভৃতির মধ্যে শহরের রেডিমেড পোশাকের অর্থাৎ নাইলন টেরিনাদির স্যুট—শার্ট—শাড়ির আকর্ষণ বাড়ছে, যাকে আর্বানাইজেশনেরই বিস্তার বলা যায়।
২১. The most obvious change in readymade garment advertising during the last few years has been––apart from the increase in volume and the number of competing brands––the introduction of sex as a motivating factor. ––B. P. Menon : ‘Change in Readymade Wear Advertising’––স্টেটসম্যান পত্রিকার পূর্বোক্ত ক্রোড়পত্র।
২২. Colin Colby : ‘Eroticism in Modern Advertising’ ––Penguin Survey of Business and Industry 1965.
Vance Packard : The Hidden Persuaders (Pelican).
২৩. Lyoyd Warner : Social Class in America, N. Y. 1948.
C. Wright Mills : The White Collar.
২৪. Amita Malik : ‘’Pornography In Films Brought Upto Date’ ––The Sunday Statesman, August 2, 1970. শ্রীমতী মালিক লিখেছেন : …there is no doubt, that portions of the female anatomy, which are wiggled nauseatingly in front of whistling and cheering audiences are deliberately included to appeat to the lowest common denominator in audience tastes.
২৫. Estes Kefauver : In a Few Hands––Monopoly Power in America, Pelican 1965, pp. 99.
২৬. Baran and Sweezy : op. cit. p. 124.
২৭. Kefauver : op. cit, p. 69.
২৮. India 1969 : Govt. of India.
২৯. Louis Cheskin; Why People Buy, London 1960… consumers know little about most producers, they look for labels, trade-marks and brand names….a superior product means superior in the eyes of the consumers. It does not necessarily mean superior interms of objective value… An individual is motivated to buy something by an ad, but be often does not know what motivated him. pp. 54-65.
৩০. …each consumer shoud be induced to buy more of each product than he had been buying. The way to end glut was to produce gluttons, ––Vance Packard : The Waste Makers, Pelican 1963, Ch 4, p. 37.
৩১. Vance Packard : The Hidden Persuaders, Ch 10– ‘Babes in Consumerland’.
৩২. প্যাকার্ড, ওই
৩৩. প্যাকার্ড, ওই, পৃঃ ৯৫
৩৪. এ বিষয়ে Joan Robinson তাঁর সর্বাধুনিক গ্রন্থ Freedom and Necessity––An Introduction to the Study of Sociolism প্রথম অধ্যায় ‘Socialist Affluence’ (পৃ: ৯৪—৯৯) সংক্ষেপে পরিষ্কার আলোচনা করেছেন।
৩৫. Chinese Planners from the start paid the kind of consideration to the consumer that is only now coming into fashion in Soviet Union, Robinson, op. cit., p 102.
৩৬. Robinson : op. cit., Ch. 11––’Another Way’ pp 103-4,
৩৭. Thus the consumers’ requirements govern supply instead of the other way round, ––Robinson, op. cit., p. 102.
৩৮. ‘The Plain Truth’, February, 1970.
৩৯. ‘Smog Over Tokyo, People Urged to Stay Indoors’ : The Statesman, July 29, 1970.
For the fifth day running the air outside was laden with deadly and nitrogen oxides from factories and automobiles… The authorities again warned people to stay indoors. আমেরিকান শহর সম্বন্ধে একটি সম্প্রতি প্রকাশিত বিবরণ—‘Here Comes the Smog’ : Newsweek, August 10, 1970.