বিজলের ডাঙা

বিজলের ডাঙা

হুগলি জেলার রূপরাজপুরের ‘প্রবোধকৃষ্ণ পাল মহাশয় গল্পটি আমাকে বলেছিলেন। তবে এও বলেছিলেন যে, এই গল্পের সময়সীমা সঠিক করে বলা শক্ত। কেননা বহুদিনের পুরনো ঘটনা এটি। হুগলি বর্ধমান বর্ডারে বর্ধমান জেলার মধ্যে বিজলে নামে একটি গ্রাম আছে। সেই গ্রামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। ব্রাহ্মণ একদিন ব্রাহ্মণীর সঙ্গে ঝগড়া করে গ্রামের প্রান্তে ধু-ধু মাঠের ধারে একটি অশ্বত্থ গাছের নীচে বসে মনের দুঃখে কাঁদতে লাগলেন। সংসারে নানা অভাব অভিযোগ। সেই নিয়েই ঝগড়াঝাঁটি। ব্রাহ্মণীর বাক্যবাণে জর্জরিত হয়ে ব্রাহ্মণ তাই আত্মহত্যা করবেন স্থির করে গাছে উঠে সঙ্গে আনা গামছা দিয়ে একটা ফাঁস তৈরি করলেন। তারপর টেনেটুনে দেখে যখন বুঝলেন ছিঁড়ে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই, তখন শেষবারের মতো একবার ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে গলায় ফাঁস দিতে গেলেন। যেই না ওই কাজ করতে যাবেন, অমনই হল কি, একটা কালো হাত হঠাৎ কোথা থেকে এসে গামছাটাকে টেনে ধরল।

তখন সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সেই অবস্থায় অন্ধকারে ব্রাহ্মণ দেখতে পেলেন একটা ছায়াশরীর গাছের মোটা ডালে হেলান দিয়ে বসে ফিকফিক করে হাসছে। সেদিকে তাকাতেই ভয়ে বুক কেঁপে উঠল ব্রাহ্মণের।

ছায়াশরীর বলল, “কী ব্যাপার ঠাকুর! আপনি হঠাৎ আত্মহত্যা করতে এসেছেন যে? আপনি ব্রাহ্মণ। পুরজনের হিতকামনা করবেন, মানুষকে সৎ উপদেশ দেবেন, তার জায়গায় আপনি এসেছেন আত্মহত্যা করতে? এ কাজ কি আপনার সাজে? ছিঃ ঠাকুর! আপনি কি জানেন না আত্মহত্যা মহাপাপ!”

ব্রাহ্মণ বললেন, “সবই জানি ভাই, সবই বুঝি। কিন্তু সব বুঝেও বড় জ্বালায় জ্বলে এই কাজ করতে এসেছি।”

“কিন্তু আমি তো আপনাকে এ কাজ করতে দেব না ঠাকুর। ওই কাজ করে আমি এই অবস্থায় যে কত বছর আছি, তা আপনি ভাবতেও পারবেন না। এর থেকে উদ্ধার নেই। আপনার ছেলে নেই, মেয়ে নেই, শুধু কর্তা আর গিন্নিতে থাকেন। আপনি এ কাজ করতে যাবেন কোন দুঃখে?”

ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে বললেন, “কিন্তু তুমি আমার এত খবর রাখলে কী করে ভাই?”

“তার আগে আপনি আমার কথার উত্তর দিন। বলুন, কেন এ কাজ করতে এসেছেন?”

“দুঃখের কথা কী আর বলব ভাই, আমার গিন্নিকে তো তুমি চেনো না! অমন দজ্জাল মেয়েছেলে এই তল্লাটে দুটি নেই। তার জ্বলনে বাড়িতে কাক চিলও বসতে পারে না। তাই এমনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি যে, ওর হাত থেকে পরিত্রাণ পাব বলেই এ কাজ করতে এসেছি আমি।”

ছায়ামূর্তি এক লাফে গাছের ডালের ওপর খাড়া হয়ে বলল, “ওরে বাব্বা! আপনার গিন্নির কথা আর বলবেন না ঠাকুর। ওরকম মেয়েমানুষ আমি কখনও দেখিনি। ওকে আমিও চিনি হাড়ে হাড়ে। আপনাদের বাড়ির পাশেই যে আমগাছটা আছে, সেই গাছে আমার একশো বছরের বাস। শুধু আপনার গিন্নির চিৎকার চেঁচামেচি আর গালাগালির চোটে আজ বছরখানেক হল আমিই পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি এখানে। কাজেই যার গালাগালিতে ভূত পালায়, আপনি মানুষ হয়ে তাকে নিয়ে ঘর কী করে করবেন? তা ঠিক আছে, আপনাকে আত্মহত্যা করতে হবে না। আপনি এইখানেই থাকুন। আমি আপনার থাকার ব্যবস্থা করছি।”

ব্রাহ্মণ তখন গাছ থেকে নেমে এসে মাটিতে বসলেন। ভূতও নেমে এল। সে এক আশ্চর্য রকমের পরিবেশ। একদিকে ঘন জঙ্গল এবং অপরদিকে ধু-ধু মাঠ। ব্রাহ্মণ বললেন, “সবই তো বুঝলুম। কিন্তু তুমি যে আমাকে থাকতে বলছ, এই জঙ্গলে আমি থাকব কোথায়? আর যদিও থাকি, খাবটা কী?”

“সে চিন্তা আপনার নয় ঠাকুর। সে চিন্তা আমার। আমি এই গাছতলায় আপনাকে একটি ঝোপড়ি বানিয়ে দেব। আপনি দিব্যি বহাল তবিয়তে সেখানে থাকবেন। আর এই যে দেখছেন ধু-ধু মাঠ, এটা হচ্ছে অনাবাদী পতিত জমি। এই জমির দখল নিয়ে আপনি চাষবাস করুন। এতে যা ফসল ফলবে, তা সবই আপনি ভোগ করে সুখে দিন কাটাতে পারবেন।”

“কিন্তু!”

“এর মধ্যে কোনও কিন্তু নেই। আপনার ব্যবস্থা আমি করছি। আপনি একটু বসুন! আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বন্ধুবান্ধবেরা এসে পড়বে। আমি তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই সবকিছু করব আপনার।”

ব্রাহ্মণ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে রইলেন এবং সামনে বসা বন্ধু ভূতের সঙ্গে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে নানারকম আলোচনা করতে লাগলেন।

বেশ কিছুক্ষণ পরে অন্যান্য ভূতেরা দলে-দলে সেখানে এসে হাজির হয়ে ব্রাহ্মণের সব কথা শুনল। তারপর প্রত্যেকেই একমত হয়ে ব্রাহ্মণের পুনর্বাসনের ব্যাপারটা মেনে নিল। সকলে মিলে অনেক যুক্তিতর্কের পর বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ, তালগাছ থেকে পাতা ইত্যাদি এনে সে রাতের মতো ব্রাহ্মণের থাকার একটা আস্তানা করে দিল।

ব্রাহ্মণ মনের আনন্দে সেই আস্তানায় আশ্রয় নিয়ে পুনর্জন্ম লাভ করলেন। রাত শেষ হতেই বিদায় নিল ভূতেরা। যাওয়ার আগে বনের ভেতর থেকে নানাবিধ ফলমূল ব্রাহ্মণের জন্য রেখে গেল তারা। ব্রাহ্মণ তো বেজায় খুশি। এইভাবেই যদি জীবনের ক’টা দিন কেটে যায় তো মন্দ কী?

বিজলের ডাঙা ভূতের উপদ্রবের জন্য সেকালে কুখ্যাত ছিল খুব। এর আশেপাশের গ্রামের লোকেরা যেমন—পাঁচশিমুল, আসতাই, ন’পাড়া, দোগেছে, আবুঝহাটি, গুড়বাড়ি, দশতনপুর, ইটলা, সাপুড়, জরুল প্রভৃতি অঞ্চলের লোকেরা ভুলেও কেউ ওদিকে যেত না। কাজেই সবাই যখন শুনল ব্রাহ্মণীর সঙ্গে ঝগড়া করে ব্রাহ্মণ বিজলের ডাঙার দিকে চলে গেছে, তখন ধরেই নিল সবাই যে, ভূতেরা আস্ত গিলে খেয়েছে ব্রাহ্মণকে। বিশেষ করে কয়েকজন দুঃসাহসী লোক যখন ব্রাহ্মণের খোঁজ করতে করতে এই পথে এসে দূর থেকে অশ্বত্থ গাছের ডালে গামছার ফাঁস ঝুলতে দেখল, তখন ধারণাটাকে একেবারেই সঠিক বলে মেনে নিল। অতএব ব্রাহ্মণ বেঁচে থেকেও সকলের কাছে মৃত প্রতিপন্ন হলেন। কিন্তু তা হলে কী হয়, ব্রাহ্মণীর কবলমুক্ত হয়ে ব্রাহ্মণ দারুণ সুখী। ভূতেরা তাঁর কোনও অভাবই রাখল না।

সারাদিন ব্রাহ্মণ একলা থাকেন। রাত্রিবেলা বন্ধু ভূতেরা সহায় হয়। তাদের দয়ায় এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মালিক হয়ে গেলেন তিনি। একদিন ভূতেরা বলল, “আপনি এক কাজ করুন। এই জমি তো অনাবাদী পড়ে আছে। আপনি একে আবাদ করে ফসল ফলান।”

ব্রাহ্মণ বললেন, “বললি তো বেশ! আমার আপত্তি নেই। কিন্তু এ জমি চষব কী করে? আমি কি চাষের কাজ কিছু জানি?”

ভূতেরা বলল, “হুঁ। এ বড় সমস্যার কথা বটে! তা ঠাকুর, আপনি এক কাজ করুন, রাত্রিবেলা গ্রামের লোক ঘুমিয়ে পড়লে গ্রামবাসীদের ঘর থেকে লুকিয়ে গোটাকতক কোদাল জোগাড় করে নিয়ে আসুন দেখি, বাকি কাজটা আমরাই করে দেব।”

ব্রাহ্মণ তাই করলেন। ভূতের পরামর্শ মতো গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে এর-ওর বাড়ি থেকে কোদাল-কুড়ুল ইত্যাদি যা পেলেন, নিয়ে এলেন।

তাই নিয়ে সারারাত ধরে চলল ভূতের উপদ্রব। সেই বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে রাতারাতি মাটি কুপিয়ে ভূতেরা চাষের উপযোগী করে ফেলল। তারপর বলল, “যান, যাদের জিনিস তাদের ফেরত দিয়ে আসুন।”

ব্রাহ্মণ তাই করলেন।

আর একদিন ভূতেরা বলল, “ঠাকুর, কয়েকটা বালতি চাই যে! জমিতে জল দিতে হবে।”

ব্রাহ্মণ তখনই গ্রামে গিয়ে বালতি নিয়ে এলেন।

এইভাবেই শুরু হল চাষ-আবাদ। দেখতে-দেখতে সবুজ শস্যে খেত ভরে উঠল। মাঠের ধান মাঠে পাকল। ভূত মজুরেই সবকিছু করে। ব্রাহ্মণের গোলাভরা ধান হল। এত ধান যে, আশপাশের গ্রামের লোকের খামারে অত ধান নেই।

সেটা ছিল খরার বছর। চারদিকে অন্নের জন্য হাহাকার পড়ে গেল। কত মানুষ না খেতে পেয়ে মরল। অথচ ব্রাহ্মণের গোলাভর্তি ধান। তাই একদিন ব্রাহ্মণ আর থাকতে না পেরে সন্ধের সময় চুপিচুপি গ্রামে গিয়ে হাজির হলেন। ভাবলেন, ব্রাহ্মণীকে সব কথা বলে ক্ষমা-ঘেন্না করে নিয়ে আসবেন এখানে। কিন্তু হিতে বিপরীত হল।

ব্রাহ্মণকে রাতের অন্ধকারে দেখামাত্রই ভয়ে চিৎকার করে এমন কাণ্ড বাধালেন ব্রাহ্মণী যে, গ্রামসুদ্ধু লোক হইহই করে লাঠি-সোটা নিয়ে ছুটে এল। তারপর ব্রাহ্মণকে দেখেই তো চক্ষুস্থির। সবাই তাঁকে ভূত মনে করে নির্দয় ভাবে লাঠিপেটা করতে লাগল। কয়েক ঘা লাঠির বাড়ি খেতেই রক্তাক্ত কলেবরে লুটিয়ে পড়লেন ব্রাহ্মণ। তারপর যখন একেবারে নিশ্চল হয়ে গেলেন, তখনই গ্রামের লোকেরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারল। কিন্তু তখন সব শেষ। একমাত্র সৎকার ছাড়া করবার আর কিছুই ছিল না তখন।

অপঘাতে মৃত্যু। তাই তৃতীয় দিনে খুব ঘটা করেই শ্রাদ্ধ হল ব্রাহ্মণের। গ্রামের লোকেরা চাঁদা তুলেই ব্রহ্মহত্যার পাপ ঢাকতে সব ব্যবস্থা করল। অনেক লোকজনও খেল। কিন্তু বন্ধু ভূতেরা ব্রাহ্মণের যে শ্রাদ্ধবাসরের আয়োজন বসিয়েছিল সেদিন, তার যেন তুলনাই নেই। গ্রামের লোকেরা বিজলের ডাঙার দিকে না গেলেও দূর থেকেই দেখতে পেল হাঁড়ি ভর্তি মণ্ডা-মিঠাই ক্রমাগত আকাশপথে নেমে আসছে বিজলের ডাঙায়। সারারাত ধরে শুধু নামছে তো নামছেই। সে নামারও আর শেষ নেই! যতক্ষণ না ভোর হল, ততক্ষণ এক নাগাড়ে ওইভাবে নামতেই লাগল সব, তারপর থেকে প্রতি বছরই ওই বিশেষ দিনটিতে গ্রামের লোকেরা দেখতে পেত ওই একইভাবে আকাশ থেকে খাবার নেমে আসছে বিজলের ডাঙায়। তবে এখন আর আসে না। আর সেইসব বন্ধু ভূতেরাই বা এখন কে কোথায়, তাই বা কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *