বিজয়া দশমী
(এক)
‘বলো কী হে! পুজোর বোনাস এখনই!’
ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই কথাটাই কানের মধ্যে বাজছিল কুমুদের৷ তেমন আহামরি কিছু কথা নয়, বোনাসের বায়না ধরলে মালিকপক্ষ বরাবর এই কথাটাই বলে এসেছে৷ কিন্তু আজ কথাটা একটা বিষম ধাক্কা দিয়েছে কুমুদকে৷ যেন এতদিন নিজের অজান্তেই চোখ বুজেছিল, হঠাৎ করে পেটে ঘুসি মেরে কেউ ওর ঝিমুনি ভাঙিয়ে দিয়েছে৷
মোবাইলটা খুলে বারবার ক্যালেন্ডার দেখেছে ও৷ হ্যাঁ, অক্টোবর মাস শুরুর দিকে৷ রাত পোহালেই মহালয়া৷ আর ক-দিন পরেই দুর্গাপুজো, অন্তত তেমনটাই হওয়ার কথা ছিল৷ এতদিনে কাশফুলে মাঠ ভরে যাওয়ার কথা, শহরের অলিগলি, রাস্তাঘাট নারকেলতেল কোল্ডড্রিঙ্কস আর আইসক্রিমের বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যাওয়ার কথা৷ হাতিবাগান, বড়বাজারের মোড় অল্প থেকে মাঝারি সমস্ত বয়সের মহিলার আর দোকানদারের দামাদামির চিৎকারে ভরে যাওয়ার কথা৷ অথচ এবার যেন তার কিছুই হচ্ছে না৷ তার থেকেও আশ্চর্যের ব্যাপার, কুমুদ মনে মনে ভাবে… ও খেয়াল করেনি—বেশ অনেক বছর ধরে কলকাতায় দুর্গাপুজো হচ্ছে না৷
অথচ হত! একটা সময় হত! জাঁকজমক করে মহালয়া শুনত সবাই৷ ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী…
একবার ও ভেবেছিল গত ক’বছর করোনা গেল বলে ভালো করে দুর্গাপূজা হয়নি৷ কিন্তু পরক্ষণে মনে হয়েছে, উঁহু, গত কয়েকবছরের ব্যাপার নয়৷ ও শেষ দুর্গাপুজো হতে দেখেছিল সেই স্কুলে পড়ার সময়৷ তারপর আর হয়নি৷ আরও আশ্চর্যের ব্যাপার এটা ও এতদিন খেয়ালও করেনি৷ আজ হঠাৎ করেই… তাজ্জব!
বাইকটা একটু দূরে দাঁড় করিয়ে রাস্তার উপর ক্যাম্বিসের জুতোর কচকচ শব্দ তুলে আরো কিছুদূর এগিয়ে আসে কুমুদ৷ অন্ধকার নেমে গেছে৷ শহরের অলিগলি বাঘে খাওয়া বাইসনের পাঁজরের মতো খাঁখা করছে৷ রাত এগারোটা৷ আর একটু পরেই বাড়ি ফিরতে হবে কুমুদকে৷ তার মাঝে আধঘণ্টার একটা ছোট্ট বিশ্রাম৷ সারা দিনের পরিশ্রম শেষে বাড়িমুখো হওয়ার আগে এই গাছতলার নিচের বেঞ্চটায় এসে বসে কুমুদ৷ সারা সন্ধে লোকের বাড়ি বাড়ি পার্সেল ডেলিভারি করে ও৷ দূরদূরান্ত থেকে আসা গিফট পৌঁছে দেয় প্রাপকের কাছে৷ আর সব কাজ শেষে রাত্রিবেলা নিজেকে পৌঁছে দেয় এই গাছটার কাছে৷
এ ওর নিজেকে দেওয়া গিফট৷ ধপ করে ও বেঞ্চের উপর বসে পড়ে৷ কয়েকবার আড়মোড়া ভাঙে৷ পিঠ বাঁকিয়ে দু-হাত দিয়ে শক্ত করে ঘাড় চেপে ধরে৷ ভাবনাটা মাথার মধ্যে ছোট হয়ে আসে৷ তারপর হাত ছেড়ে দিতেই কীভাবে যেন সমস্ত শরীরকে গ্রাস করে ফেলে চিন্তাটা৷ না, কিছুতেই নয়, ও শেষ দুর্গাপুজো দেখেছিল প্রায় বছর আটেক আগে৷ সন্দেহটা সকাল থেকেই মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল৷ খানিকটা খেয়ালের বশেই প্রথম যে বাড়িতে ডেলিভারি দিতে গেছিল সেখানে জিজ্ঞেস করেছিল৷ রিসিভার ছিলেন এক মাঝবয়সী মহিলা৷ কুমুদ পার্সেলটা হাতে তুলে দিয়ে সই করতে বলে মিষ্টি করে একগাল হেসে বলেছিল, ‘এবার পুজোটা তাড়াতাড়িই এসে গেল, না মাসিমা?’
‘পুজো? কোন পুজোর কথা বলছ?’
‘কোন পুজো বলতে? দুর্গাপুজো!’
‘সে এখন কোথায়?’
‘এখনই তো হয়! এটা তো আশ্বিন মাস৷ সেই যে… আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি…’
‘দেখো ভাই, এখনকার পুজোতে খালি ওই বাজনাটাজনাই রয়ে গেছে৷
ধম্মেকম্মে তো কারও মতি নেই৷ সারাদিন ইসপিকারে শুধু গান ফুটছে আর ধেই ধেই করে বাঁদরনাচ…’
‘বাঁদরনাচ…’ কথাটা বলতে বলতে মহিলা এমনভাবে কুমুদের দিকে তাকালেন যেন সে-ই এতক্ষণ বাঁদর নাচ নাচছিল হঠাৎ করে থেমে গেছে৷
‘আরে যাও তো ভাই, পুজো টুজোর এখন ঢের দেরি… যত্তসব…’ কথাটা বলে দরজাটা বন্ধ করে দেন মহিলা৷ কুমুদের মনে তখন থেকেই সন্দেহটা জমাট বাঁধে৷ এমনিতে হুজুগে বাঙালির পুজো নিয়ে আদিখ্যেতার শেষ নেই৷ ওর যতদূর মনে পড়ে এই ক-বছর আগেও মাঝখানেক আগে থেকে বাতাসে একটা পুজো পুজো গন্ধ লেগে যেত৷ কোথা থেকে যেন ক-টা পূজাবার্ষিকী এসে জুটত বাড়ির টেবিলে, পড়ার ঘরে৷ সেগুলো কে আনত কেউ জানে না৷ কিন্তু কীভাবে যেন চলে আসত৷ সাদা মেঘ আর কাশফুলগুলোও ঠিক কবে, কোন সময় ফুটতে শুরু করত, তাদেরকে কে আকাশের বুকে আর সবুজ ঘাসের উপর রেখে যেত, তাও কেউ জানে না৷ অথচ আজ সেসব…
তারপর থেকে আজ যে ক-টা বাড়ি ডেলিভারি দিয়েছে সব শেয়ালের ওই এক রা, ‘মহালয়া? কাল! বলো কী হে ছোকরা? রোদে ঘুরে ঘুরে মাথাটা খারাপ হল নাকি?’
পিঠের ব্যাগটা খুলে তার ভেতর থেকে একটা বন পাউরুটি বের করে কুমুদ৷ তারপর দাড়িটা চুলকে রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে প্যাকেট খুলে সেটা খেতে শুরু করে৷ দুশ্চিন্তায় ওর ভুরু কুঁচকে আসে৷ যদিও দুর্গাপুজো এলে যে ওর এমন কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি হবে তা নয়৷ ও গরিব মানুষ, একা থাকে৷ যেটুকু রোজগার করে তাতে কোনওমতে নিজের ফ্ল্যাট ভাড়া আর খরচটুকু চলে যায়৷ তাও ব্যাপারটা ভারি ভূতুড়ে! কুমুদ ঠিক করে আজ আর বসবে না৷ বন পাউরুটিটা খেয়েই উঠে পড়বে এখান থেকে৷ বাড়ি গিয়ে স্নান করে আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ব্যাপারটা মাথা থেকে সরানো দরকার৷ এবার কি তবে দুর্গাপুজো হচ্ছে না? নাকি শহরের সমস্ত লোকেরই মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
পাউরুটিটা খেয়ে ব্যাগটা আবার পিঠে নিতে যাচ্ছিল কুমুদ৷ এমন সময় একটা খসখস শব্দে মুখ তুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখে কখন যেন ওর অজান্তেই একটা অল্পবয়সী মেয়ে এই বেঞ্চেই আরেকটা দিকে এসে বসে পড়েছে৷ চমকে ওঠে ও! মেয়েটা কখন এসে বসেছে ও কিছুই বুঝতে পারেনি৷ ভাবনায় এতটাই মশগুল ছিল যে পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়নি?
চতুর্দিকটা একবার ঘুরে ফিরে দেখে কুমুদ৷ নাঃ, রাস্তাঘাটে জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই৷ তার মানে মেয়েটা একাই এই রাত বারোটার সময় একটা নির্জন রাস্তার ধারের বেঞ্চের উপর এসে বসেছে! বাড়িতে ঝামেলা করে পালিয়ে এসেছে নাকি?
ভালো করে মেয়েটার দিকে তাকায় কুমুদ৷ জামাকাপড় দেখে মোটামুটি ভদ্রস্থ ঘরেরই মনে হয়৷ মাথার দু-পাশে চুল নেমে আছে বলে মুখটা দেখা যায় না, এবং সেই কারণেই বোঝা যায় মাটির দিকে তাকিয়ে সে কিছু একটা ভাবছে!
কুমুদ একটু জবুথবু হয়ে বসে৷ অন্যদিন এই বেঞ্চটায় এসে বসলে নিজেকে একটা রাজাগজা গোছের কিছু মনে হয়৷ যে ক্লাসে একটি মাত্র স্টুডেন্ট আছে সেখানে ক্লাস মনিটর, স্পোর্টস ক্যাপ্টেন আর ফার্স্ট বয় হওয়ার গর্বের মতো৷ আজ সেই ক্লাসে অন্য কেউ এসে যোগ দিতে ওর কাঁচুমাচু মন নিজেই যেন নিজেকে সেকেন্ড করে দেয়৷
কয়েক মুহূর্ত অস্বস্তিকর নীরবতার সমুদ্রে গা ডুবিয়ে ও বসে থাকে৷ উঠবে উঠবে করেও উঠতে পারে না৷ মেয়েটার মুখটা ভালো করে দেখতে পায়নি এখনও তাও একটা অদ্ভুত খেয়াল চেপে ধরে কুমুদকে৷ ওর কেবলই মনে হতে থাকে মেয়েটাকে ও আগে কোথাও দেখেছে৷ সম্ভবত খুব ছোটবেলায়৷ ভাবনাটা ওর মস্তিষ্ককে অস্থির করে তোলে৷ মেয়েটার মুখটা এক ঝলক দেখার জন্য অস্থিরতা শুরু হয় ভিতরে৷ ভারি অদ্ভুত এক ইচ্ছা, যেন ও মুখটা না দেখে ও এই বেঞ্চ থেকে চাইলেও উঠতে পারবে না৷
নিজের মনের উপর জোর আনার চেষ্টা করে ও৷ এ কেমন লুচ্চামি! একটা অপরিচিত মেয়ের মুখ দেখার জন্য এত ছটফটানি৷ তাও কিছুতেই মনের ভাবনাটাকে দমন করতে পারে না কুমুদ৷ শরীরটাকে একটু সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে আড় চোখে চুলের পর্দার ফাঁক দিয়ে মুখটা দেখার চেষ্টা করে ও৷ কয়েকটা টুকরো টুকরো অংশ দেখতেও পায়, এবং ঠিক তখনই হঠাৎ বজ্রপাতের মতো সেই পর্দা সরে যায়৷ একটা দুর্বিনীত ভর্ৎসনা ভেসে আসে, ‘আপনি উঁকি মেরে কী দেখার চেষ্টা করছেন বলুন তো?’
আচম্বিত গর্জনে কুমুদের মুখ দিয়ে সত্যি কথাটাই বেরিয়ে যায়, ‘ইয়ে… আপনার মুখটা…’
‘কেন? আমার মুখ কি পাশের বন্ধুর পরীক্ষার খাতা যে উঁকি মেরে দেখতে হবে?’
কুমুদ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে, ‘না, না ভাবলাম আপনি যদি কোনও বিপদে পড়ে এখানে…’
‘তাতে আপনার কী? আপনি ব্যাটম্যান?’
‘আ… আমি আসলে…’
‘দেখুন, এই ডার্ক নাইটে আপনাকে ডার্কনাইট সাজতে হবে না৷ আমি কোনও বিপদ-টিপদে পড়িনি৷ আর পড়লেও অন্তত আপনার যা চেহারা তাতে সাহায্য কিছু করতে পারবেন মনে হয় না…’
মেয়েটা অকারণেই ওর চেহারা নিয়ে খোঁটা দিল৷ মেজাজ বিগড়ে যায় কুমুদের৷ না হয় একটু মুখটাই দেখতে চেয়েছিল৷ ভাবখানা এমন যেন উঁকি মেরে এটিএম-এর পিন দেখে নেওয়ার চেষ্টা করেছে৷
ও আর কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়ে৷ সেইসময় ওকে পেছন থেকে দেখতে পেয়ে কিছু আন্দাজ করতে পারে মেয়েটা৷ সেরকম ভারীক্কি গলাতেই আবার বলে ওঠে, ‘তা আপনি… আপনি ডেলিভারি বয় নাকি?’
‘হ্যাঁ, কেন?’
বিড়বিড় করে মেয়েটা, ‘এতক্ষণ বুঝতে পারিনি৷ তাহলে… আপনি আমাকে কিছু সাহায্য করলেও করতে পারেন…’
ব্যাটম্যান থেকে ডেলিভারিম্যান৷ কুমুদ মনে মনে একটু হাসে৷ তারপর ঘুরে তাকায়, ‘সমস্যাটা ঠিক কী বলুন তো? এত রাতে এখানে৷’
মেয়েটা একবার চুলের ভিতর হাত ঢুকিয়ে ঘাড় চুলকায়, ‘বাবা আমাকে টাকা দিচ্ছে না…’
‘তো?’
‘তো কী? এটা সমস্যা নয়?’
‘হুম, সমস্যা৷ তবে ঠিক এটা নয়…’
‘তাহলে কোনটা?’
‘এই বয়সেও আপনাকে বাবার থেকে টাকা নিতে হয়, সেটা…’
‘আপনি মানুষ না চলতা-ফিরতা ইশপের গল্প? আর দেখুন টাকার আমার প্রয়োজন নেই৷ আমার আসলে প্রয়োজন একটা ল্যাপটপের৷ আর সেটাও ব্যবসার জন্য…’
‘আপনি ব্যবসা করেন নাকি? কীসের?’
‘ওই গ্রিটিংস কার্ড, কাস্টমাইজড ডায়েরি, লকেট, আরে লোকে গিফট দেয় না? সেইসব…’
‘ও! মানে নিজে তৈরি করে বেচেন, তাই তো?’
‘হ্যাঁ, ক’দিন ফোন দিয়েই করছিলাম৷ কিন্তু ইদানীং সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না৷ অন্তত একটা ল্যাপটপ না হলে… তাছাড়া বাবা বলেওছিল একটা ল্যাপটপ কিনে দেবে পুজোর আগে৷ এখন চাইতে গেলাম, বলল পুজোর নাকি এখনও ঢের দেরি৷ এখন ওসব হবে না…’
কুমুদ একবার থমকে যায়৷ আজ সারাদিনে এই কথাটা যে কতবার শুনল তার ইয়ত্তা নেই৷ একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল৷ হঠাৎ করেই ওর মাথায় অন্য একটা কথা খেলে যায়৷ অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে চায়, ‘আচ্ছা আপনি তো বললেন বাবাকে, মানে আপনার কি মনে হচ্ছে পুজো এসে গেছে?’
রাগত স্বরে ওর দিকে তাকায় মেয়েটা, ‘কেন? আপনিও কি আমাকে কিছু টাকা দেবেন বলেছিলেন নাকি? অক্টোবর মাস! আজ রাত পোহালে মহালয়া… কোন দেশে থাকেন আপনি?’
উৎসাহের আতিশয্যে মেয়েটার হাত প্রায় চেপে ধরতে যাচ্ছিল কুমুদ৷ নিজেকে সামলে উচ্ছাস মাখানো গলায় বলে, ‘আমি একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করছি জানেন৷ এই শহরের কারওর মনে হচ্ছে না দুর্গাপূজা আসছে, সবাই বলছে পুজোর নাকি এখনও অনেক দেরি৷’
‘তাই নাকি? আমার অবশ্য খুব বেশি লোকজনের সঙ্গে কথা হয় না… কিন্তু তাই যদি হয়…’
‘আপনি খেয়াল করেননি এ বছর মাঠকে মাঠ পড়ে আছে৷ একটাও কাশফুল ফোটেনি?’
‘সে কী! আসলে আমাদের ওদিকটায় মাঠঘাট তো বিশেষ…’
‘ঢাকের আওয়াজ? নারকেল তেলের বিজ্ঞাপন? বোরোলিনের অ্যাড?’
এই শেষ কথাটায় কেমন উদাস হয়ে যায় মেয়েটা৷ এতক্ষণ সে সামনে ঝুঁকে বসেছিল৷ এবার পিঠ এলিয়ে দিয়ে বলে, ‘বোরোলিনের অ্যাডে কী একটা ছিল জানেন৷ মন ভালো করে দিত৷ এখন টিভি খুললে শুধু কোথায় কত বড়ো দুর্গা, কোন মন্ত্রীর পুজোয় কোন সেলিব্রিটি এসেছে…’ মেয়েটা বিড়বিড় করছিল, এবার গলা তুলে বলে, ‘আপনি সত্যি বলছেন এবার একটাও কাশফুল ফোটেনি?’
‘আমি তো দেখিনি অন্তত… কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা, শহরের লোকগুলোরও কারওর মনে নেই…’
এতক্ষণে মেয়েটার মুখে যেন ছায়া নামে৷ হঠাৎ পেছন ঘুরে চারদিক ভালো করে দেখে নিয়ে বলে, ‘এই রাস্তাটায় পুজোর আগে প্রচুর আলো লাগানো হত জানেন, অথচ এবার… আমি ব্যাপারটা খেয়ালও করিনি…’
আলোগুলোর খোঁজ করতেই যেন বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়ে মেয়েটা৷ ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে৷ কুমুদও উঠে দাঁড়িয়ে ওর পিছু নেয়৷
দু-পাশে উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি ঘুমিয়ে আছে৷ একটা ঘুমন্ত কুকুরও চোখে পড়ছে না৷ আকাশছোঁয়া বাতিস্তম্ভ থেকে চুঁইয়ে পড়া সাদা আলো রূপালি জলের মতো শুয়ে রয়েছে রাস্তার উপর৷ সেই জলের উপরেই ঢেউ তুলে হাঁটতে লাগল ওরা৷ ‘আপনার আমাকে কী দরকার বলছিলেন?’ কুমুদ প্রশ্ন করে৷
মেয়েটা অন্যমনস্ক হয়েই উত্তর দেয়, ‘আপনি গ্রিটিংস কার্ড ডেলিভারি করেন?’
‘করি না তা নয়… তবে সত্যি বলতে কী গ্রিটিংস কার্ড আজকাল আর কেউ কাউকে দেয় না৷ ওইটুকু একটা প্যাতপ্যাতে কার্ড ক্যুরিয়ার করা মানে ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাওয়া… তার থেকে কোনও কাজের জিনিস দিলে…’
‘কাজের জিনিস মানুষের মন খারাপ করাতে পারে না…’
‘মানে?’
‘কাউকে আমরা কোনও জিনিস দিই কেন?’
‘তাদের খুশি করতে…’
‘উঁহু, চলে যাওয়ার পরেও নিজেদের অস্তিত্ব রেখে যেতে৷ এবার ধরুন, যেসব জিনিস কাজে লাগে সেসব আমরা অন্য কাউকে দিয়ে দিতে পারি৷ আপনার পিসির দেওয়া জামা, দাদুর দেওয়া পুরোনো বাইসাইকেল, এক্স গার্লফ্রেন্ডের দেওয়া শো পিস আপনি দুঃস্থ শিশুকে দিয়ে দিতে পারবেন৷ দুঃখ হলে নিজের মনকে বোঝাতে পারবেন আপনার কাছে না থাক অন্য কারও হয়তো উপকারে লাগছে সেসব৷ কিন্তু গ্রিটিংস কার্ড অন্য কাউকে দেওয়া যায় না৷ ফেলে দেওয়ার সময় এটা জেনেই আপনাকে ফেলতে হবে যে তার স্মৃতি চিরকালের মতো মুছে দিচ্ছেন…’
‘মানে আপনি বলছেন আমরা আসলে গিফট দিই দুঃখ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে?’
‘নয় তো কী? আমরা স্মৃতি তৈরি করি, আপনারা বাড়ি বাড়ি বিলি করেন৷ আর সময় দুধ বসিয়ে দই করার মতো স্মৃতি জমিয়ে দুঃখ বানিয়ে দেয়… আপনার কাছে আছে?’
মেয়েটার প্রশ্নে একটু থতমত খায় কুমুদ, ‘কী?’
‘দুঃখ, স্মৃতি, কিংবা গ্রিটিংস কার্ড?’
কুমুদ একটু হাসে, ‘হ্যাঁ, ওইটা আমার একটা অভ্যাস বলতে পারেন৷ ছোটবেলার সব জিনিসপাতি জমিয়ে রাখি আমি৷ যত কার্ড পেয়েছি সব ড্রয়ারে জমিয়ে রাখা আছে…’
‘মাঝে মাঝে খুলে দেখেন?’
‘না.. কী হবে দেখে? কী জানেন, কিছু দুঃখ আমরা প্রাণ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চাই ঠিকই, কিন্তু রোজ একবার করে ধুলো সরিয়ে তাদের মুখদর্শন করতে চাই না…’
‘করবেন৷ নাহলে…’
‘নাহলে কী?’
‘নাহলে এই দুর্গাপুজোর মতো দুঃখগুলোও কবে আসা বন্ধ হয়ে গেছে বুঝতে পারবেন না…’
একটু হাসে কুমুদ৷ মেয়েটার নাম এখনও জিজ্ঞেস করেনি ও৷ তার দরকারও নেই৷ যেভাবে কথা বলে চলেছে তাতে সেটা একটু পর ও নিজেই বলে দেবে৷ ‘কাজের কথাটা এখনও বললেন না…’
‘ও হ্যাঁ, কাজটা না? সিম্পল৷ আপনাকে আমার কয়েকটা কার্ড পোস্ট করে দিতে হবে৷’
‘আপনার কাস্টমারদের কাছে? সে তো আপনি যে কোনও ক্যুরিয়ার দিয়েই করতে পারেন, আমিই কেন?’
‘আসলে…’ মেয়েটা যেন ইতস্তত করে, ‘ডেলিভারিগুলো রাতে হবে…’
‘রাতে৷ কেন?’
‘কাস্টমারদের সেটাই আবদার৷ হাতে দিলে হবে না৷ রাতে চুপিচুপি গিয়ে তাদের দরজার গোড়ায় রেখে আসতে হবে৷ এমনভাবে যাতে তারা বুঝতেও না পারে৷ বুঝতেই পারছেন আমি একা মেয়ে সেটা করতে গেলে…’
‘বুঝেছি, হয়ে যাবে৷ আছে ক-টা?’
‘বেশি না, এই ধরুন গোটাপাঁচেক… এখন সঙ্গে করে আনিনি, আপনি কাল তো আসবেনই এখানে৷ তখন দিয়ে যাব না হয়…’
‘সে ঠিক আছে কিন্তু আমার পেমেন্টটা…’
মেয়েটা মুখ বাঁকায়, ‘পেমেন্ট দেওয়ার টাকা নেই আমার কাছে৷ তবে হ্যাঁ, একটা গিফট দিতে পারি৷ চিন্তা করবেন না, তেমন দামি গিফট আর কেউ দিতে পারবে না আপনাকে…’
কুমুদ প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, তাতে পাত্তাই দে না সে, ‘যাক গে, আমি এখন আসি…’ শেষ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার হাবেভাবে একটা চটপটে ভাব এসে মেশে৷ যেন হুট করেই ফিরবার তাড়া শুরু হয় তার৷ এগোনোর তোড়জোড় করে সে৷ কুমুদও হেসে ফিরে আসতে যাচ্ছিল৷ এমন সময় একটা খটকা লাগতে ও দাঁড়িয়ে পড়ে, ‘আমি রোজ এই বেঞ্চে আসি আপনি জানলেন কী করে?’
মেয়েটা উত্তর দেয় না, বরঞ্চ রাস্তার উপরেই ঝুঁকে পড়ে কী যেন তুলে নেয়৷ কুমুদ চেয়ে দেখে সেটা একটা পুরোনো ভাঙা রেডিও৷
‘আপনি এফএম পাগলাকে চেনেন৷’
‘সেটা আবার কে?’
‘এই এলাকার এক পুরোনো পাগল৷ রাস্তায় ঘুরে বেড়াত৷ রাত হলে কারও ফ্ল্যাটের দরজার নিচে ঘুমাত৷ এই রেডিওটাই একমাত্র সম্বল ছিল ব্যাটার৷ একমাত্র বাতিক৷ সারাদিন রেডিও চালিয়ে কী যেন শুনত মন দিয়ে৷ সেই থেকে নাম এফএম পাগলা৷ ক-দিন আগেই মারা গেল… আশ্চর্যের কথা হল, ভাঙা রেডিওটা এতদিন এত ঝড়, বৃষ্টিতেও খারাপ হয়নি৷ কিন্তু পাগলা মরে যেতেই…’
নব ঘুরিয়ে স্টেশন ধরার চেষ্টা করে মেয়েটা৷ ঘড়ঘড় শব্দ ছাড়া কিছুই বের হয় না৷ রেডিওটা রাস্তার ধারেই রেখে দেয় সে, তারপর চাপা গলায় বলে, ‘কিছু কিছু মানুষ কারও চলে যাওয়াটা মানিয়ে নিতে পারে না৷ এ রেডিওটাও মনে হয় সেরকমই… পাগলা চলে যেতে দুঃখে একেবারে খারাপ হয়ে গেছে…’
উঠে দাঁড়িয়ে চোখ সরিয়ে আবার সামনের রাস্তাটার দিকে তাকায় সে, ‘নাঃ মনে হচ্ছে এ বছর মহালয়াটাও হবে না… ভালো কথা, আপনার নামটাই তো জানলাম না…’
‘কুমুদ তালুকদার৷ আপনার?’
‘বিজয়া…’ থমকে দাঁড়িয়ে কথাটা বলেই হনহন করে সামনে পা বাড়ায় মেয়েটা৷
(দুই)
পরদিন কাজের প্রেশার ছিল বেশি৷ কুমুদ আর মহালয়া-টয়া নিয়ে মাথা ঘামায়নি৷ পুজো হোক কি না হোক তাতে ওর কী যায় আসে৷ ও একা মানুষ৷ ভাড়ার বাড়িতে থাকে৷ বন্ধুবান্ধব কিছু আছে বটে, কিন্তু তাদের নিজের নিজের জগৎ আছে৷ সারাদিন রোদে ঘুরে মাল ডেলিভারি করে রাতে যেটুকু সময় হয় তাতে আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবের খোঁজ রাখা হয়ে ওঠে না৷
কুমুদের মা মারা গেছে বেশ অনেক বছর আগে৷ তারপর ওর বাবা আর একটা বিয়ে করে৷ সেই থেকেই ওর সঙ্গে সম্পর্ক নেই৷ কুমুদ অল্প বয়স থেকেই রোজগার করতে শিখে যায় বলে নিজেদের মাথা গোঁজার ফ্ল্যাটের ভাড়া গুনতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি ওর৷ বাবার সঙ্গে কথা একরকম হয় না বললেই চলে৷ হলেও কুমুদের ভারি ঘেন্না করে লোকটাকে৷ ভদ্রলোক নিজের নতুন ফ্যামিলি নিয়ে আপাতত গঙ্গার ধারে একটা ভাড়ার বাড়িতে থাকেন৷ কুমুদ সেখানে বোধহয় বারদুয়েক গেছে৷
ঘরের পাখাটা ক-দিন হল খারাপ হয়েছে বলে বাড়ি ফিরে বিকেল থেকে সন্ধের সময়টুকু ছাদে শুয়েই কাটায় কুমুদ৷ আজও বিকেল নামতে ছাদে গিয়ে দাঁড়াল সে৷ একটু পরেই বেরিয়ে যেতে হবে কাজে৷
আজ সারাটা দিন থেকে থেকে মনে পড়েছে বিজয়ার কথা৷ ভারি রহস্যময় মেয়েটা৷ সারাক্ষণ মনে হয় ওকে যেন দেখেছে কোথাও৷ যেন ছেলেবেলায় ফেলে আসা অনেকগুলো চেনা মানুষের মুখের আদল মিশে আছে ওর মুখে৷ মুখচোখ সাদাসিধে আর পাচটা সাধারণ মেয়ের মতোই৷ উপর থেকে মনেও হয় নিরীহ, কিন্তু চোখের কোণে সর্বক্ষণ একটা ধূর্ত ভাব লেগে রয়েছে৷ উঁহু, কিছু একটা উদ্দেশ্য আছে তার৷
‘ছোটবেলায় চেনা মানুষ…’ কথাটা মনে পড়তেই অনেকগুলো মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল কুমুদের৷ গাঁট্টা গাবু বলে একটা বন্ধু ছিল ওর৷ ওকে নিজের বুড়িমার রোল ক্যাপ থেকে অর্ধেক ধার দিত৷ তারপর দু-জনে গোলাগুলি করত৷ পরে গাবুর বাবার বদলি হয়ে যেতে ওরা এখান থেকে চলে যায়৷ আর আসেনি কোনওদিন৷ চলে যাওয়ার দিন খুব কেঁদেছিল কুমুদ৷ তারপর…
‘শুভ মহালয়া কুম্মু…’ পেছন থেকে ডাক শুনে ফিরে তাকায় কুমুদ৷ ছাদে তো একাই ছিল৷ তাছাড়া…
গাঁট্টা গাবু দাঁড়িয়ে আছে৷ ওর দিকে চেয়ে ফিকফিক করে হাসছে৷ কুমুদ অবাক হয়ে যায়, ‘তুই এখানে!’
একটা পাখির ডাকে হুঁশ ফেরে ওর৷ ছাদের পাঁচিলে দাঁড়িয়ে আছে একটা পায়রা৷ ওর দিকে চেয়ে কী যেন দেখছে৷ আরে এই পায়রা… এটা তো তুলসী৷
মা এই পায়রাটাকে তুলসী বলে ডাকত! বিকেলের দিকে ছাদে আসত দানা খেতে৷ বুকের কাছে একটা সাদা লোমের গোছা ছিল৷ কুমুদ খুব ভালবাসত তুলসীকে৷ কিন্তু সে পাখির তো এতদিন বেঁচে থাকার কথা নয়… কী করে?
‘কুমু…’ মা ডাকছে৷ কুমুদ কান পেতে শোনার চেষ্টা করে, ‘দেখ কুমু, তুলু ডাকছে তোকে… খেতে দে ওকে…’
কোথায় দাঁড়িয়ে আছে মা? কুমুদ পাঁচিলের ধার ঘেঁষে মুখ বাড়ায়৷ নিচের রাস্তায় লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে মা৷ তার পেছনে ব্যাট হাতে ওর মাঠের বন্ধুরা, খোকন, কালি, নান্টু, ওকে কি খেলতে ডাকছে?
‘বিকেল হয়ে যাচ্ছে, এরপর গেলে আর ব্যাট দেব না কিন্তু…’
স্কুল ড্রেস পরে ওই মেয়েটা? আরে! ইতি না? ওর প্রথম বান্ধবী৷ প্রথম ভালোলাগা… ওর দিকে না তাকিয়েই বিনুনি দোলাতে দোলাতে আপন মনে হেঁটে যাচ্ছে স্কুলের দিকে৷
‘তোরা সব…’ কথাটা বলতে বলতেই একটা শব্দে থেমে যায় কুমুদ৷ পকেট থেকে কী যেন খসে পড়েছে ছাদের মেঝেতে৷ এক গাল হেসে নিচু হয়ে সেটা কুড়িয়ে নেয় কুমুদ৷ এক গোছা পুরোনো হলদে হয়ে যাওয়া গ্রিটিংস কার্ড৷
ছোটো থেকে আঁকার শখ ছিল তো কুমুদের, পুজোয় ও নিজে হাতে বানিয়ে কার্ড দিত বন্ধুদের৷ বদলে তারাও দিত৷ লাল গোলাপ কিংবা টেডি বিয়ারের উপর ‘ফ্রেন্ডস ফরএভার’ লেখা থাকত তাতে৷ সেই সব কার্ড জমা করে রেখেছে কুমুদ৷
এত বছর কেটে গেছে তাও৷ আচ্ছা তুলসী বলে পায়রাটাও কি কোনও কার্ড দিয়েছিল ওকে?
ও তাকিয়ে দেখে গাঁট্টা গাবু, তুলসী মা আর পাড়ার বন্ধুরা কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে৷ সন্ধ্যে নামতে যাচ্ছে৷ খাঁখাঁ করছে খালি ছাদটা৷
বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, মা-বাবা সবাই এই কার্ডগুলোতেই আটকে আছে৷ মেয়েটা ঠিকই বলেছিল৷
মেয়েটার মুখটা এত চেনা লাগছে কেন এখনও বুঝতে পারেনি কুমুদ৷ ওর সঙ্গে কি ইতির মিল আছে না মায়ের? নাকি… কার্ডগুলো পকেটে ঢুকিয়ে নিচে নেমে আসে কুমুদ৷
সেদিন রাতে বেঞ্চের সামনে গিয়ে দেখে আগে থেকেই বেঞ্চে বসে আছে মেয়েটা৷ গায়ে আগেরদিনের জামাটাই৷ কুমুদ তার পাশে বসতে বসতে বলে, ‘তা ভোরে মহালয়া শুনলেন নাকি?’
‘হয়নি, শালা আজগুবি ব্যাপার মাইরি৷ ভাবলেই মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে৷ ভাবা ছেড়ে দিয়েছি…’
কাঁধ ঝাঁকায় কুমুদ, ‘হ্যাঁ সেই ভালো৷ আমরা আদার ব্যাপারি অত জাহাজের খোঁজে কী লাভ? কার্ডগুলো এনেছেন তো?’
পকেট থেকে কয়েকটা সাদা প্যাক করা খাম বের করে ওর হাতে দেয় বিজয়া৷ সঙ্গে একটা টাকার খাম৷ উপরে ঠিকানা লেখা আছে৷ কলকাতা কিংবা তার আশেপাশের ঠিকানা৷ অসুবিধা হওয়ার কথা নয়৷
সেগুলো পড়ে নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয় কুমুদ৷ আজ ভোরে বাড়ি ফেরার আগে কয়েকটা আশেপাশের ডেলিভারি সেরে নেবে৷
মেয়েটা ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, ‘শুধু একটাই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, জানিস?’
মেয়েটার সম্বোধন পালটে গেছে৷ কুমুদ তাতে আপত্তি করে না অবশ্য৷ ‘কী প্রশ্ন?’
‘সবাই পুজোর কথা ভুলে গেল, শুধু তোর আর আমার মনে থেকে গেল কেন?’
‘পুজোয় আমাদের কিছু যায় আসে না তাই৷ ভোলানোর দেবতা মনে হয় প্রয়োজন বোধ করেনি…’
‘তুই কিছুই করিস না পুজোয়? মানে একদিনও ঘরের বাইরে বেরনো…’
কুমুদ ঘাড় নাড়ে, ‘ঘরের বাইরে বেরই, বাড়ির বাইরে না৷ দূরে ঢাক বাজতে থাকলে ছাদে গিয়ে দাঁড়াই মাঝে মাঝে৷ তারপর একদৃষ্টে নিচের দিকে চেয়ে থাকি…’
‘কী ভাবিস?’
‘মায়ের কথা…’
‘কেন?’
হঠাৎ করেই চুপ করে যায় কুমুদ৷ কয়েক সেকেন্ড৷ তারপর নরম গলাতেই বলে, ‘কারণ ওখান থেকেই আমার মা ঝাঁপ দিয়েছিল নিচে…’
বিজয়া আর কোনও কথা বলে না৷
‘পায়ে আলতা দিয়ে, একটা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে ছাদে উঠে ঝাঁপ দিয়েছিল…’
‘সেজেগুজে কেন?’
‘কেন কী জানি৷ মায়ের মনে হয় দুর্গা সাজার শখ হয়েছিল৷ সাঁতার জানত তো, জলে ঝাঁপ দিলে মরত না৷ তাই উপায়ন্তর না দেখে ছাদ থেকে ঝাঁপ৷ আমি যখন মায়ের শরীরটা দেখেছিলাম তখন টকটকে লাল হয়ে আছে সবকিছু৷ কোনটা আলতা, কোনটা রক্ত বুঝতে পারিনি…’
‘উনি কেন ঝাঁপ দিয়েছিলেন…’
‘মায়ের মাথার অসুখ ছিল৷ বাবাকে ভীষণ সন্দেহ করত৷ উঠতে বসতে ঝগড়া করত, কথা শোনাত৷ আমি জানতাম বাবার কোনও প্রেমিকা-টেমিকা ছিল না৷ তাও মা-বাবার মাঝেমধ্যেই চরম ঠোকাঠুকি লাগত৷ সেখান থেকে হাতাহাতি৷ মা একবার রেগে গেলে আর কিছু বোঝানো যেত না৷ সেদিন ঝাঁপ দেয় সেদিন কিন্তু হঠাৎ করেই মা চুপ করে যায়৷ একদম চুপ৷ বাবা যুক্তি দিয়ে যা বোঝাচ্ছিল, মা লক্ষ্মী মেয়ের মতো সব বুঝে নিচ্ছিল৷ হাসছিলও কয়েকবার৷ তারপর বাবাকে বলল, ‘আজ একটু বেড়াতে নিয়ে যাবে আমাকে?’ বাবা রাজি হল৷ মা বলল ‘তুমি একটু দাঁড়াও আমি সেজে আসি৷’ আমাকে বলল, ‘কুমু, চল ছাদ থেকে ঘুরে আসি’৷ আমি বললাম ছাদে তো রোদ খুব, ও আমার ভালো লাগছে না৷ মা একাই চলে গেল৷ তারপর… আর ফিরল না… শুধু বাইরে থেকে একটা আওয়াজ এল ধপ করে…’
‘কিন্তু তার জন্য এখনও কেন ছাদে গিয়ে দাঁড়াস বুঝতে পারলাম না…’
এবার জোরেই হেসে ওঠে কুমুদ, ‘কারণ মায়ের মতো আমার মাথাতেও একটা ছিট আছে…’
‘কীরকম?’
দুটো পা-ই বেঞ্চের উপর তুলে নেয় সে, মজার গলায় বলে, ‘আমি আসলে ওই এফএম পাগলার রেডিওটার মতোই, আমি বিশ্বাস করি মা ফিরে আসবে৷ যেমন ঝাঁপ দিয়েছিল ছাদ থেকে আবার একদিন ঠিক ছাদের ওখানে উঠে আসবে৷ মা তো ‘ছাদ থেকে আসছি’ বলেছিল, একদিন না একদিন নিশ্চয়ই ফিরে আসবে৷ তাই না?’
‘তুই সত্যিই এটা বিশ্বাস করিস?’
কাঁধ ঝাঁকায় কুমুদ, ‘জানি না রে, তবে আমি সহজে কোনও কিছুকে ছেড়ে যেতে পারি না৷ যেদিন প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম ছোটো থেকে বড়ো হয়ে গেছি, মেনে নিতে পারিনি৷ যেদিন জানতে পেরেছিলাম ভালোবাসার পর বিচ্ছেদ নামের একটা জিনিস অহরহ আসে—সেটা মানতে পারিনি৷ একদিন আমার জমজমাট চারপাশটা ফাঁকা আর বিষণ্ণ হয়ে যাবে, মানতে পারিনি৷ এই যে একটা উৎসবের কথা সবাই ভুলে গেল, কারওর কিছু গেল এল না৷ কিন্তু আমি কিছুতেই মানতে পারছি না…’
ওর দিক থেকে চোখে সরিয়ে নেয় বিজয়া, ‘আজ সকাল থেকে মনে হচ্ছে, জানিস, আমরা ভুল করছি না, বরঞ্চ এই শহরের সবক-টা মানুষ মিথ্যে বলছে…’
কুমুদের গলা ভাবুক শোনায়, ‘এই শহরের বলে নয়, মানুষ মিথ্যেই বলে৷ আচ্ছা ধর, এই যে এত মূর্তি তৈরি হয়, সত্যিকারের আসল যে ঠাকুর তাকে কোনটার মতো দেখতে বলতো?’
‘কী জানি, আছে হয়তো কোনওটার সঙ্গে মিল… আসল ঠাকুরকে তো আর কেউ দেখেনি…’
‘আমাদেরও এরকম অনেক মূর্তি আছে৷ তার কোনটা সত্যিই আমাদের মতো তা কেউ জানে না৷ মিথ্যে হল সেই মৃৎশিল্পী যে চোখে না দেখেই আমাদের হাজার হাজার মূর্তি বানায়৷ একই মানুষের অসংখ্য প্রতিমা৷ সত্যিকারের মানুষটার সঙ্গে হয়তো তার কোনওটার মিল থাকে…’
দুটো ভরাট চোখ তুলে ওর দিকে তাকায় বিজয়া, কুমুদের মনে হয় সে চোখে এমন কিছু আলো খেলছে যা ওর দেখা উচিত না, ‘সেই সত্যিকারের মূর্তিটা যদি কেউ চিনে নেয়?’
কুমুদ হাসে, ‘তখন শুরু হয় মহালয়া, পুজো আর তারপর ভাসান… পরিচিত মুখটা, সত্যিকারের মুখটাকেও ভাসিয়ে দিতে হয়৷ চিরকাল তো আর রেখে দেওয়া যায় না…’
‘ওঃ, তবে এই যে বললি তুই কারওর চলে যাওয়া মেনে নিতে পারিস না-তুইও ভাসিয়ে দিস?’
প্রশ্নটার উত্তর দেয় না কুমুদ৷ ঘুরে তাকায় বিজয়ার দিকে, ‘তোকে এত চেনা লাগে কেন বল তো? কার সঙ্গে যেন ভীষণ মিল আছে তোর মুখের…’
‘ধুর, আমাকে চিনিস না তুই…’
‘তুই আমার ব্যাপারে এত কিছু জানিস কী করে? আমি কবে কোথায় যাই, কী করি না করি, কে তুই?’
বিজয়া নরম দুটো চোখ তুলে চায়৷ এখন আর সেখানে ধূর্ততার কোনও চিহ্ন নেই৷ বরং শীতল সমুদ্রের ঢেউ চোখের শিরা থেকে বেরিয়ে কুমুদকে ডুবিয়ে মারতে চাইছে যেন৷ মেয়েটার নরম ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে, ‘যে মনের ভেতরে থাকে তাকে পরিচয় জিজ্ঞেস করতে নেই…’
‘মানে?’
দু-পা পিছিয়ে যায় বিজয়া৷ তারপর নরম স্বরে বলে, ‘কার্ডগুলো পোস্ট করে দিস৷ অনেকের দুঃখ পাওয়া বাকি আছে…’
ওর ছায়া শরীরটা উলটোদিকে ফিরে আগের মতোই হাঁটতে শুরু করে৷ ভেসে আসা অজানা বাতাসে ওর চুল ওড়ে৷ ঢিলা সালোয়ার কামিজ প্রশস্ত হয়ে ওঠে৷ এক প্রাচীন অনন্তপ্রজ্ঞা সন্ন্যাসিনী মনে হয় ওকে…
কুমুদের কানে তখনও প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ওর গলার স্বর- ‘যে মনের ভেতরে থাকে তাকে পরিচয় জিজ্ঞেস করতে নেই…’ মানে কী কথাটার?
(তিন)
কয়েকটা দিন কাটল নির্বিঘ্নে৷ এর মধ্যে কিছুদিন মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়েছে৷ কয়েকদিন কুমুদ বেঞ্চে বসতে গিয়ে দেখেছে সে নেই৷ বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কার্ডের ঠিকানা মিলিয়ে বাইক ছুটিয়ে দিয়েছে৷
যেটুকু কথা হয়েছে তাতে কুমুদ বুঝেছে বিজয়ার কথাবার্তার মধ্যে কিছু একটা রহস্য আছে৷ উপর থেকে তাকে যতটা সহজ বলে মনে হয় আদৌ সে ততটা নয়৷ সে সামনে থাকলে পেটের ভিতরের কথা নিজে থেকেই যেন উপচে বেরিয়ে এসেছে৷ এই ক-দিনে নিজের সম্পর্কে প্রায় সব কথাই বলে ফেলেছে কুমুদ৷ অথচ বিজয়া ওর ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানায়নি৷
কুমুদের একটা নাম দিয়েছে বিজয়া, ‘ব্যাটম্যান৷’ কোনওদিন ও আসার আগে কুমুদ এসে বসে থাকলে আচমকা পেছন থেকে টোকা দিয়ে ডেকেছে, ‘কী ব্যাপার৷ আজ ব্যাটম্যান আগেই হাজির৷ কাজের চাপ কম নাকি?’
কোনোদিন ফাঁকা রাস্তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কুমুদ হয়তো বলেছে, ‘কার্ডগুলো সব দেওয়া হয়ে গেলে আর তো এখানে এসে বসবি না…’
‘দরকার পড়বে না৷’ উদাস গলায় বলেছে বিজয়া, ‘তাছাড়া আমি চাইও না তোর সঙ্গে বেশিদিন আর দেখা হোক৷’
‘কেন?’
‘আমাকে উপর থেকে যতটা নিরীহ মনে হয় ততটা তো নাও হতে পারে, তাই না?’
‘মানে? কী করেছিস তুই?’
‘ধরে নে একটা খুন করেছি, বা ধর আমি সিরিয়াল কিলার৷ তাহলে?’
‘তোকে দেখে তো সিরিয়াল কিলার মনে হয় না…’
‘ব্যাটম্যানকে দেখে ব্যাটম্যান মনে হত?’
সিরিয়াস থাকতে গিয়েও হেসে ফেলেছে কুমুদ, ‘ধুত্তোর৷ আমার সঙ্গে ব্যাটম্যানের কী মিল?’
‘নেই!’ বিজয়া অবাক হয়, ‘রাত হলে তোর কাজ শুরু হয়, অচেনা অজানা মেয়ে বিপদে পড়লে উদ্ধার করতে এগিয়ে যাস, রাতবিরেতে লুকিয়ে লোকের বাড়ির আনাচে কানাচে চিঠি ফেলে আসিস…’
‘আমারও মা-বাবা নেই…’
‘বাবা আছে তোর…’
দু-দিকে মাথা নাড়ে কুমুদ, ‘আমার বাবা আমার মায়ের সঙ্গেই মরে গেছিল, হয়তো আমিও…’
‘মানুষের চলে যাওয়াটা তুই মানিয়ে নিতে পারিস না, তাও মাঝে মাঝে নিজেই কাউকে কাউকে দূরে পাঠিয়ে দিস…’
বেঞ্চের উপর পা তুলে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে কুমুদ, ‘মোড় ঘোরার আগে গাড়ির ইন্ডিকেটরের মতো কিছু কিছু মানুষের মুখে চলে যাওয়ার ইন্ডিকেটর ব্লিঙ্ক করতে দেখা যায়৷ আমি শুধু সেটা দেখতে পেলে সাইড দিয়ে দিই… বাকি…’ মাঝে মাঝে কথা বলতে বলতে কুমুদ খেয়াল করে না কখন বিজয়ার আঙুল ওর হাতের উপরে ছায়া ফেলেছে৷ ওর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করেছে, ‘আচ্ছা বেশ, আমার মুখে কীসের ইন্ডিকেটর দেখতে পাচ্ছিস?’
ওর দিকে না তাকিয়েই হেসেছে কুমুদ, ‘কিচ্ছু না, তোর মুখে কিচ্ছু দেখতে পাই না৷’
‘কারণ আমরা একই গাড়িতে বসে আছি…’
এমন অদ্ভুত কথার মানে বুঝতে পারে না কুমুদ৷ বিজয়া সিরিয়াল কিলার হোক কী চোরছ্যাঁচোড়৷ ওর কাছে যাওয়ার এক নিষিদ্ধ টান উপেক্ষা করতে পারে না কুমুদ৷
‘কাল লাস্ট দুটো কার্ড পড়ে থাকবে, তারপরেই শেষ…’ কুমুদ ঠিকানা থেকে মুখ তুলে বলে, ‘মানে আজকের পর আর দেখা হচ্ছে না আমাদের, তাই তো?’ বিজয়ার মুখে এক পলকের জন্য একটা করুণ হাসি খেলে যায়, ‘পরক্ষণেই মিলিয়ে যায় সেটা, ‘কী জানি, মন বলছে আবার দেখা হবে আমাদের… আর একবার… তোকে গিফট দেওয়া তো বাকি রয়ে গেছে এখনও, মনে নেই?’
(চার)
বাড়িটার সামনে যখন এসে পৌঁছল কুমুদ ততক্ষণে আড়াইটে পেরিয়ে গেছে৷ ঠিকানাটা ভালো করে দেখে নিল একবার৷ হ্যাঁ, এই বাড়িটাই তো৷
বাইরের গেটটার কাছে এগিয়ে গেল ও৷ কয়েকটা গলি পরেই গঙ্গা৷ তার জোলো বাতাস গলিঘুঁজির ফাঁক গলে যেন ওর গা ছুঁয়ে যাচ্ছে৷ বাড়িটার বাইরে একটা ছোটো বাগান করা৷ একবার ভাবল চিঠিটা ছুঁড়ে ওই বাগানে ফেলে দেয়৷ কিন্তু একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে৷ এখন বাইরে ফেলে রাখলে সকাল অবধি ভিজে চামড়া হয়ে যাবে৷
একটু এগিয়ে গিয়ে বাগানের গেট খুলে ভিতরে ঢুকে এল কুমুদ৷ সামনেই একটা গ্রিল লাগানো বারান্দা৷ সেটা মোটামুটি শুকনোই আছে৷ হাত বাড়িয়ে সেখানে কার্ডটা ফেলে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে৷
ও দু-পা এগিয়ে বারান্দার দিকে হাত বাড়াতেই ওপাশে কিছু যেন নড়ে উঠল৷ এই সেরেছে৷ বারান্দায় মানুষ আছে সেটা এতক্ষণ খেয়াল করেনি ও৷ এত রাতে কে বসে আছে বারান্দায়? চমকে একটু পিছিয়ে আসে৷ পালিয়ে যাবে? কিন্তু ও তো অপরাধ করেনি কিছু… হঠাৎ অন্ধকারের ভিতর থেকে একটা আলো জ্বলে ওঠে৷ বারান্দায় যে বসে ছিল সে সম্ভবত ফোনের আলো জ্বেলেছে৷ আলোটা এসে পড়ে কুমুদের মুখের উপরে…
‘এত রাতে কে আবার এখানে…’ কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যায় মানুষটা৷ আলোটা যার মুখের উপর এসে পড়েছে তাকে চিনতে পেরেছেন তিনি, ‘কুমু৷ তুই এখানে…’
‘বাবা…’
একটা বিদ্যুতের ঝলক যেন ছিটকে ফেলতে চায় কুমুদকে৷ এ কোন বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে সে? তার থেকেও বড়ো কথা কে ওকে পাঠিয়েছে এখানে? বারান্দার গ্রিলের ফাঁকে মুখ চেপে ধরে ওকে দেখার চেষ্টা করছেন ভদ্রলোক৷ পরিচিত মুখটা সত্যিই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কিনা খুঁজে দেখার চেষ্টা করছেন, ‘তুই এত রাতে…’
চকিতে বিদ্যুৎ খেলে যায় কুমুদের মাথায়৷ হাতের খামটা ছিঁড়ে ফেলে টেনে৷ ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা কার্ড৷ হাতে আঁকা একটা কার্ড৷ বড়ো করে দুর্গা ঠাকুরের মুখ আঁকা আছে তাতে৷ ভিতরে প্রেরকের নামটা চোখে পড়ে, কুমুদ৷ ওর মাথার ভিতরটা ধরে আসে৷ দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে৷ উন্মত্তের মতো চারদিকে তাকাতে গিয়ে একটু দূরেই চোখ আটকে যায়৷ বাগানের গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে বিজয়া৷ ও এত রাতে এখানে এল কী করে? এক দৌড়ে সেদিকে এগিয়ে যায় কুমুদ৷
রাতের শনশনে হাওয়া বেড়ে ওঠে, তার মধ্যেই ও উদভ্রান্তের মতো এগিয়ে যায়৷
‘এসব কী? আমার নামে কেন কার্ডগুলো?’
‘কারণ তুই পাঠিয়েছিস ওগুলো…’
‘আমি! তুই আমাকে দিয়ে…’ কুমুদ থতমত খায়৷ মাথার ভিতর অদৃশ্য রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে, কী যেন ভেবে ও বিড়বিড় করতে থাকে, ‘মানে এই ক-দিন আমি যাদের কার্ড দিয়েছি তারা সবাই আমার…’
‘প্রিয়জন, যাদের আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিলি, কিন্তু পারিসনি…’ এগিয়ে এসে ওর দু-গালে হাত রাখে বিজয়া, ওর মুখটা যেন আজ পলিমাটি দিয়ে তৈরি মনে হচ্ছে, ‘আজ থেকে তুই পালটে যাবি কুমুদ৷ তাই বদলে যাওয়ার আগে নিজের কিছুটা স্মৃতি রেখে গেলি ওদের কাছে, ওরা কষ্ট পাবে তোর জন্য, তোর কথা মনে করে… ভালো হবে না, বল?’
‘কিন্তু তুই ওদের চিনলি কী করে?’ চিৎকার করে এক ধাক্কায় হাতদুটো সরিয়ে নেয় কুমুদ৷
বিজয়া মৃদু হাসে, ‘আমি তো তোর থেকে আলাদা কেউ নই৷ তোর ভিতরে অনেকগুলো মানুষ বাস করে৷ আমি তাদের একজন…’
কুমুদের গলার জোর বেড়ে ওঠে, ‘কী বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না৷ এই শহরের বাকি লোকগুলোর মতো তুইও পাগল হয়ে গেলি?’
‘কেউ পাগল হয়নি কুমুদ…’
‘হয়নি? তাহলে বল সবাই এবার দুর্গাপুজোর কথা ভুলে গেল কেন?’
‘কেউ ভোলেনি… তুই কাউকে জিজ্ঞেসই করিসনি পুজোর কথা৷ নিজের মনে যা ছিল তুই সেটাই বিশ্বাস করেছিস৷’
‘মানে… কিন্তু কেন?’ ওর গলা কেঁপে যায়৷
‘কারণ উৎসব মানে তোর কাছে আসলে কিছু মানুষ৷ কিছু সম্পর্ক, কিছু সময়৷ সেগুলো কিছুই আর তোর কাছে নেই৷ তাই তোর মন মাঠভরা কাশফুল দেখেও দেখেনি৷ প্যান্ডেলের পাশ দিয়ে হেঁটে এসেও দেখতে পায়নি…’
বয়ে আসা হাওয়ার হিমেল পরশ যেন কুমুদের চারপাশটা আঁকা ছবির মতো বদলে দেয়৷ দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসে৷ রঙিন হয়ে ওঠে রাস্তাঘাট৷ কাছেই কোন বাড়িতে কাঁসর ঘণ্টা বাজছে৷ রাস্তা ঢেকে দেওয়া ঢাউস বিজ্ঞাপন… দু-হাতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরে কুমুদ, ‘আমি… আমি… পাগল হয়ে যাচ্ছি মনে হয়… মায়ের মতো…’
‘তোর মা পাগল ছিল না কুমুদ৷ তাকে খুন করেছিল কেউ…’
‘মানে! কে?’
মিহি হাসি খেলে যায় বিজয়ার মুখে, ‘আমি…’
কুমুদ এগোতে যায় কিন্তু পারে না৷ বিজয়ার শরীরটা যেন নিমেষে ধুলোর মতো মিলিয়ে যায় হাওয়ায়৷ হাওয়াটা উড়ে যায় নদীর দিকে৷ সেদিক লক্ষ করে উদভ্রান্তের মতো দৌড়তে থাকে কুমুদ৷ পুজো হচ্ছে৷ গোটা কলকাতা শহর জুড়ে পুজো হচ্ছে৷ ছোটো ছোটো ছেলেরা খেলা করে বেড়াচ্ছে রাস্তায়৷ গভীর নিঝুম রাত বলে আর কিছু নেই৷ উৎসবের রঙে ভরে গেছে কলকাতা৷ রঙিন টুনি লাইটের মিছিল শামিয়ানা টাঙিয়েছে রাস্তাজুড়ে৷ সেই আলোয় ভেসে যাওয়া রাস্তা দিয়ে হাওয়ার পিছু ধাওয়া করে ছুটতে থাকে কুমুদ৷ ঢাকের আওয়াজ ওর পায়ের শব্দে তাল মেলায়৷ কাল বিজয়া দশমী৷ জলের আওয়াজ ভেসে আসছে৷
ছুটতে ছুটতে নদীর ঘাটে এসে থমকে দাঁড়ায় কুমুদ৷ বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস পড়ছে ওর৷ সামনে তাকিয়ে দেখে ঘাটের সিঁড়ির একটা ধাপে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিজয়া৷
‘কে তুই?’ চিৎকার করে ওঠে কুমুদ৷ জোলো হাওয়ায় ভেসে নদীর বুকে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিধ্বনিটা৷
ওর দিকে ফিরে তাকায় মেয়েটা৷ কুমুদ পায়ে পায়ে ঘাটে নেমে ঠিক ওর উপরের সিঁড়িটায় গিয়ে দাঁড়ায়৷ দু-জন অপলকে চেয়ে থাকে দু-জনের চোখের দিকে৷ এখন আরও পরিচিত দেখাচ্ছে বিজয়াকে৷ ছোটবেলা নয়, যেন জন্ম-জন্মান্তরের জন্মদাগ মিলিয়ে দিচ্ছে ওদের৷
‘তুই মানুষ নোস, তাই না? আমার মনের কল্পনা…’ কুমুদ ওর শান্ত ভেজা চোখ দুটোর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে৷
‘উঁহু, কেবল এই মানুষের রূপটা তোর কল্পনা৷ আমি আসলে তোর মনের একটা অংশ… যাকে তুই মানুষের মতো ভেবে নিয়েছিস!’
‘কোন অংশ?’
‘আমি মানুষের মনে শত অন্ধকারেও বাসা বেঁধে থাকা আশা, ইচ্ছে… যে চলে গেছে সে আবার ফিরে আসবে৷ যে সম্পর্কের জাহাজ ডুবতে বসেছে সে আবার তরতরিয়ে চলতে শুরু করবে, আমি সেই আশাটুকুনি…’
কুমুদ বুঝতে পারে না কথাগুলো, কেবল না বুঝেই অস্ফুটে বলে, ‘মা ভেবেছিল বাবার সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ মায়ের মাথার পোকাগুলো শান্ত হয়ে যাবে… কিন্তু হয়নি কোনওদিন…’
‘তোর মা বাবার উপর রাগ করে ছাদ থেকে ঝাঁপ দেয়নি কুমুদ৷ দিয়েছিল নিজের উপর হতাশ হয়ে৷ বারবার নিজের উপর আশাহত হয়ে… যদি ধরে নিত কোনওদিন কিছু ঠিক হবে না তাহলে… একদিন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে—এই আশা, চিৎকার, যন্ত্রণা… সব মিলে আমিই খুন করেছি তাকে…’
সব কথা কুমুদের মাথায় ঢোকে না৷ ও চিৎকার করে ওঠে, ‘আর আমাকেও মেরে ফেলতে চাস, তাই না? আমিও বারবার বিশ্বাস করি অসম্ভবকে… আমাকেও…’
হাসতে হাসতেই দু-পাশে মাথা দোলায় বিজয়া, ‘আমি তোকে মেরে ফেলতে চাই না৷ যাতে একদিন তোকেও ওইভাবে ঝাঁপ না দিতে হয় সে জন্যই এসেছি আমি…’
‘কী বলতে চাইছিস তুই?’
‘ওই যে বললাম—আমি তোর আশা, আমি তোর ইচ্ছে… এমন কোনও আশা যে এই বিরাট শহরে তোর নিজের কেউ কোথাও না কোথাও আছে, কোনও বন্ধু, কোনও আত্মীয়, কোনও পরিযায়ী পাখি, কিংবা তুই চিনিসও না এমন কেউ৷ এমন কেউ আছে যে তোকে সত্যিই ভালোবাসে৷ শুধু তোকেই ভালোবাসে৷ একদিন কারওর বৃত্তটা তোর সঙ্গে একেবারে মিলে যাবে… যারা চলে গেছে তারা আবার ফিরে আসবে একদিন৷ যারা তোর ভালোবাসাটা বুঝতে পারেনি তারা একদিন নিশ্চয়ই পারবে… তোর এই সব আশার ডাকনাম বিজয়া…’
কুমুদের দিকে এগিয়ে আসে মেয়েটা, ওর মুখে ডুবন্ত সূর্যের মতো গলিত রং লাগে, ‘জানিস, আমি আছি বলেই কষ্ট হয়৷ আমি আছি বলেই প্রত্যেকবার তোর মনে হয় এবার একটা বড় করে দুর্গাপূজা হবে, ছোটবেলার মতো৷ ক্যাপ ফাটাবি, ক-টা জামা হল গুনতে বসবি৷ আগের মতো কারেন্ট গেলে পাড়ার সবাই বেরিয়ে আসবে রাস্তায়৷ দুঃখ হলে তোর পাশে কেউ বসে থাকবে অনেকক্ষণ… আমি আছি বলেই বারবার সবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করবি তোমরা সবাই প্যান্ডেল বানাচ্ছ না কেন? বারবার সবুজ মাঠে কাশফুল খুঁজবি৷ আর আমি চলে গেলে বাকি সবার মতো…’
নিজের মাথার চুল খামছে ধরে কুমুদ, ‘তুই চলে যা এখান থেকে… আমি এক মুহূর্ত তোকে সহ্য করতে পারছি না…’
‘যাব… কিন্তু যাওয়ার আগে তোকে একটা জিনিস দিয়ে যেতে চাই৷ বলেছিলাম না আমি গিফট দেব তোকে একটা৷ সেটা চেয়ে নিবি না এখন?’
‘কী জিনিস?’
বিজয়ার মিহি গলা যেন আকাশময় ছড়িয়ে পড়ছে, ‘আমি তো মানুষ নই, তাই তোকে বন্ধুত্ব দিতে পারব না৷ ভালোবাসা দিতে পারব না৷ দুর্গাপুজো দিতে পারব না৷ শুধু তোকে একটা ভাসান উপহার দিতে পারি৷ একটা বিজয়া দশমী…’
‘মানে? কীসের বিসর্জন?’
কুমুদের দিকে সরে আসে মেয়েটা, চোখের দিকে চোখ তুলে চায়, ‘আমাকে৷ তুই আমাকে ভাসিয়ে দে কুমুদ…’
‘তোকে? মানে…’
‘তোর সব হিসেব মিলে যাবে৷ সবকিছু ভীষণ, ভীষণ সহজ হয়ে যাবে… আমাকে ভাসিয়ে দে কুমুদ… ওই ঘোলাটে জলের স্রোতে ভাসিয়ে দে…’
মেয়েটা স্বচ্ছ ভরাট চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে৷ কী মিষ্টি দেখাচ্ছে মুখটা তার৷ কী ভীষণ মায়া! এমন মায়াই মানুষকে ছেড়ে চলে যেতে দেয় না৷ অভিমানে ফুলে উঠেছে ঠোঁটদুটো৷ চোখ থেকে গড়িয়ে আসা জল টলমল করছে ঠোঁটের উপর৷ এমন দুটো চোখ কতবার দেখেছে ও৷ চিরকালের মতো বিদায় নেওয়ার সময় হয়তো এমনই হয়ে যায় মানুষের চোখ৷
হাওয়ার ধাক্কায় কুমুদের উপরে টলে পড়ছিল বিজয়া৷ ওর মুখটা কুমুদের বুকের উপরে এসে পড়ে৷
‘তুই চলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?’
‘সব…’
কয়েক সেকেন্ড অপলকে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে কুমুদ৷ তারপর চোখদুটো স্থির হয়ে যায়৷
‘ভাসিয়ে দে আমাকে…’ বিড়বিড় করে বলে মেয়েটা৷
একটু নিচু হয়ে মেয়েটাকে পাঁজাকোলা করে ধরে কোলে তুলে নেয় কুমুদ৷
কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে৷ ওদের বেয়ে গঙ্গার হাওয়া বইতে থাকে৷ যে মাটি থেকে মূর্তি তৈরি হয়, সে মাটির মধ্যে থেকেই কী এক খবর যেন বয়ে এনেছে তারা, ওখানেই টেনে নিয়ে যেতে চায় ওদের৷ ‘মা তোকে ভাসিয়ে দিতে পারেনি, তাই না? ভেবেছিল একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, একদিন মাথার ভিতর পোকাগুলো আর কামড়াবে না৷ মা জানত না যতদিন তুই আছিস ওরা কোনওদিন শান্ত হবে না…’
ওর গালে হাত রাখে মেয়েটা৷ স্থির চোখে চেয়ে থাকে ওর দিকে৷ ওকে বুকে নিয়েই ধীরে ধীরে ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় নিচের দিকে৷ রাতের হাওয়ায় বহু দূরে কোথায় যেন ঢাক বেজে ওঠে৷ অনেক, অনেক মানুষ চিৎকার করে ওঠে যেন৷ আনন্দ করে ভাসান দিতে আসছে কারা… আজ বিজয়া দশমী! আজ বিসর্জনের দিন…
ওর দেহটা বুক থেকে জলের কাছে নামিয়ে আনে কুমুদ৷ হাতে ঠান্ডা জলের স্পর্শ লাগে৷ চুম্বকের মতো মেয়েটার শরীরটাকে টানতে থাকে জলের উপরিভাগ৷
‘আর কোনওদিন কষ্ট হবে না তোর…’ ওর মাথায় হাত রেখে বলে বিজয়া৷ তারপর আচমকাই ওর গলা জড়িয়ে ধরে৷ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা৷
বিসর্জনের আগে ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিমার মতো দেখায় তার ভিজে মুখটা৷ দূর থেকে চিৎকার স্পষ্ট হয়ে আসছে এবার, ‘আসছে বছর, আবার হবে…’
‘আমি আর ফিরে আসব না কোনওদিন…’
‘আমিও না…’
ধীরে ধীরে ওর শরীরটা জলের উপর রেখে হাতটা সরিয়ে নেয় কুমুদ৷ মেয়েটার ডুবন্ত মুখে তাও হাসি লেগে থাকে৷ ওর পায়ের পাতা, কোমর, বুক ডুবে যায় জলের তলায়৷ ওর তাকিয়ে থাকা চোখদুটো ঢেকে দেয় জলের স্রোত৷ ঘোলাটে জলধারার তলায় কোথায় নিমেষে হারিয়ে যায় অচেনা মেয়েটা৷
সঙ্গে সঙ্গে কুমুদের চারপাশের শব্দগুলো থেমে যায়৷ ঘাটে বিসর্জন দিতে আসা লোকগুলো যেন ভূতের মতো মিলিয়ে যায় হাওয়ায়৷ কেবল জলের ছপছপ শব্দ জেগে থাকে৷
কিছুক্ষণ সেভাবেই জলের দিকে চেয়ে দাড়িয়ে থাকে কুমুদ৷ অদ্ভুত এক ঘুম নামছে ওর চোখ বেয়ে৷ শরীরের ভিতরটা গলিত লাভায় ভেঙে গিয়ে নতুন করে সাজিয়ে নিচ্ছে ওকে…
তন্দ্রটা যখন ভাঙে তখনও ঘাটেই বসে আছে কুমুদ৷ উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠে আসে সে৷
একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে শহরের প্রান্তরেখা বেয়ে৷ রাস্তার ধারের ঘুমন্ত বাড়িগুলো এইবার চোখ খুলছে৷
কিছুদূর হেঁটে এসে কাছেই একটা ছোটো পাড়ার প্যান্ডেল দেখতে পেল কুমুদ৷ গেটটা খোলা৷ লোকজনের সমাগম তেমন নেই এদিকটায়৷ এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু শুকনো ফুলের মালা, খাবারের প্যাকেট আর জলের বোতল পড়ে আছে৷ সেগুলো পার হয়ে প্যান্ডেলের সামনে দিয়ে দাঁড়াল৷
দাঁড়াতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল৷ প্যান্ডেলের ভিতরে শুয়ে আছে একটা কুকুর আর তার পাশেই দাড়িয়ে আছে একটা নোংরাটে দেখতে পাগল৷ জামাকাপড় শতচ্ছিন্ন৷ জট পাকানো দাড়ি গোঁফ প্রায় মুখ ঢেকে দিয়েছে৷ পাঁজরের হাড় গোনা যায়৷ কুমুদ বুঝল ওই ঘুমন্ত কুকুরটার সঙ্গেই মারপিট করে খাওয়া জোটে লোকটার, তারপর ওর পাশেই ঘুমায়৷
অথচ কী এক আনন্দে আপাতত দু-হাত দু-দিকে ছড়িয়ে নাচছে পাগলটা৷ যেন ওর চাইতে খুশি এ দুনিয়ায় আর কেউ নেই৷ ফাঁকা প্যান্ডেল, বারণ করার কেউ নেই৷ ঠাকুরের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে দু-হাত দু-দিকে ছড়িয়ে নিজের মনে নেচেই চলেছে সে৷ কুকুরটা একবার চোখ তুলে তাকায় তার দিকে, তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ে নির্বিঘ্নে৷
কুমুদের মজা লাগে দৃশ্যটায়৷ ও পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় পাগলটার দিকে৷ মুখে কী যেন বিড়বিড় করছে লোকটা৷ সম্ভবত কোনও গানের লাইন৷ প্যান্ডেলের ভিতর আর একটা মানুষের অস্তিত্ব খেয়ালই করছে না সে৷
হাসিমুখে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থাকে কুমুদ৷ তারপর আচমকা তারও দুটো হাত ধীরে ধীরে উঠে আসে বাতাসে৷ একই ছন্দে সেও ঘুরে ঘুরে নাচতে শুরু করে৷ মুখে বিড়বিড় করতে থেকে একই গান… দেখে মনে হয় ওর থেকে খুশি আর কেউ নেই এই প্যান্ডেলে, এই শহরে…
একদল স্তব্ধ দেবতার সামনে দাঁড়িয়ে কুমুদ আনন্দে বিভোর হয়ে নাচতে থাকে, নাচতেই থাকে…
***