বিজয়ার প্রণাম

বিজয়ার প্রণাম

এক

হঠাৎ কলকাতা ছাড়তে হয়েছিল৷ মনে আছে, সেদিন দুর্গাপূজার অষ্টমী৷

ঠিক এক বছর পরে, নবমীর দিন আবার কলকাতায় ফিরে এলাম৷ বাড়িতে এসে দেখি, চিঠির বাক্সে আমার নামে খানকয় চিঠি জমা হয়ে আছে৷

একখানা চিঠি লিখেছেন আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় সুরেনকাকা৷ তারিখ দেখে বুঝলাম, চিঠিখানি লেখা হয়েছে গেল বছরের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন৷

চিঠিখানি এই :

‘স্নেহাপদেষু,

প্রিয় নরেশ, একবার আমার সঙ্গে দেখা করো৷ আমার বিশেষ দরকার আছে৷ ইতি

ঊনিত্যশুভাকাঙ্খী

সুরেনকাকা৷’

বিদেশ থেকে সুরেনকাকাকে তিন-চারখানা চিঠি লিখেছিলাম৷ কিন্তু একখানারও জবাব পাইনি৷ ঠিক করলাম, আসছে কাল বিজয়াদশমীর দিন সুরেনকাকাকে প্রণাম করতে যাব৷

দুই

সুরেনকাকার বাড়ি ছিল ভবানীপুরে৷ অনেকগুলো বাড়িতে বিজয়ার কোলাকুলি ও প্রণাম সেরে যখন সুরেনকাকার বাড়ির সামনে গিয়ে হাজির হলাম, রাত তখন সাড়ে নটার কম হবে না৷

গ্যাসের আলোতে দেখলাম, সুরেনকাকার বাড়ির সব দরজা-জানলা বন্ধ৷ ভিতর থেকে একবিন্দু আলোর আভাও বাইরে আসছে না৷ এরই মধ্যে কি বাড়ির সব লোক ঘুমিয়ে পড়েছে? কিন্তু একটা জানলাও খোলা নেই কেন? এখন তো শীতকাল নয়, এই গরমে সব জানলা বন্ধ করে কেউ কি ঘুমোতে পারে? তবে কি বাড়িতে কেউ নেই? বাড়িখানাকে দেখলে তাই-ই মনে হয়৷ সে যেন কাতরভাবে নাচার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ মূর্ছিত হয়ে ভেঙে পড়তে পারে! দু-পা এগিয়ে সদর দরজার কাছে গেলাম৷ দরজা বন্ধ ছিল, কিন্তু ঠেলতেই খুলে গেল৷

সুরেনকাকার বাড়িতে আমার অবারিত দ্বার, কাজেই ভিতরে ঢুকতে কোনো দ্বিধাবোধ করলাম না৷ উঠানের সামনে এসে আমার থমকে দাঁড়ালাম৷ দশমীর চাঁদের আলো এসে উঠানের খানিকটা উজ্জ্বল করে তুলেছে, বাকি সবটা অন্ধকার৷ কোথাও কারুর সাড়াশব্দ নেই, কেবল কতগুলো ঝিঁঝিপোকা কর্কশ স্বরে চিৎকার করছে৷

চেঁচিয়ে ডাকলাম, ‘সুরেনকাকা!’ আমার গলার আওয়াজ শুনে ঝিঁঝিঁপোকাদের কনসার্ট থেমে গেল৷

বাড়ির ভিতর থেকে কোনো সাড়া এল না, কিন্তু বাইরের রাস্তা থেকে আওয়াজ এল ‘রাম-নাম সত্য হ্যায়, রাম-নাম সত্য হ্যায়, রাম-নাম সতত্য হ্যায়!’ কারা মড়া নিয়ে যাচ্ছে৷ অন্ধকারের ভিতরে নিজেকে বড়ো বেশি একলা বলে মনে হতে লাগল!

আবার চেঁচিয়ে ডাকলাম, ‘সুরেনকাকা বাড়িতে আছেন?’

যেন অনেকদূর থেকে ক্ষীণ সাড়া এল, ‘কে? কে ডাকে?’

‘আমি! আমি নরেশ৷’

‘যাচ্ছি৷’

খট খট খট করে খড়মের শব্দ জেগে উঠে সেই অন্ধকার বাড়ির স্তব্ধতা ভেঙে দিল৷ সুরেনকাকা বাড়িতে খড়ম পায়ে দিতেন৷

খড়মের শব্দ বারান্দার কাছে এসে থামল৷ সেইখান থেকেই সুরেনকাকা বললেন, ‘নরেশ, এতদিন পরে তুমি এলে বাবা? আমি যে আজ এক বছর ধরে তোমার অপেক্ষা করছি৷’

আমি বললাম, ‘সুরেনকাকা! আমি যে বিদেশে ছিলাম, আপনার চিঠি পাইনি৷’

‘আচ্ছা, সে-সব কথা পরে শুনব অখন৷ আগে তুমি ওপরে এসো৷’

‘ওপরে কী করে যাব, চারদিকে যে অন্ধকার! আগে আলো জ্বালুন!’

‘তবেই তো মুশকিলে ফেললে! সব আলোর তেল ফুরিয়ে গেছে যে! . . . আচ্ছা নরেশ, তাহলে তুমি ওইখানেই দাঁড়িয়ে শোনো৷ তুমি আমাকে হাজার টাকা ধার দিয়েছিলে, মনে আছে তো? তোমার সেই হাজার টাকা আমার অ্যাটর্নি রামেন্দু বোসের কাছে জমা আছে৷ সেখানে গেলেই তুমি টাকা পাবে!’

আমি বললাম, ‘সুরেনকাকা, ওকথা কেন, আমি তো আপনার কাছে টাকা চাইতে আসিনি, আমি এসেছি বিজয়ার প্রণাম করতে! আমি ওপরে যাব৷’

‘আচ্ছা, তাহলে ওপরেই এসো৷ সিঁড়ির ওপরে চাঁদের আলো আছে, তোমার কোনো কষ্ট হবে না!’

খুব সাবধানে, উঠানের অন্ধকার পেরিয়ে সিঁড়ির উপরে গিয়ে উঠলাম৷ তারপর দ্বিতলের ছাদে গিয়ে দাঁড়াতেই সুরেনকাকা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন৷

সুরেনকাকার মাথায় ছিল বকের পালকের মতন সাদা লম্বা চুল ও মুখে ছিল তেমনই লম্বা ও সাদা দাড়ি; তার উপরে আজ তিনি আবার একখানা সাদা চাদরে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়েছিলেন৷ ম্লান চাঁদের আলোতে আজ তাঁর মূর্তির ভিতরে কেমন একটা অমানুষিক ভাব জেগে উঠেছে! এ মূর্তিকে আজ যদি কোনো অপরিচিত লোক অজানা কোনো জায়গায় দেখতে পায়, তাহলে নিশ্চয়ই তার নাড়ি ছেড়ে যায়!

আমি ভূমিষ্ঠ হয়ে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলাম, কিন্তু হাত বাড়িয়েও তাঁর পা ছুঁতে পারলাম না৷ বললাম, ‘ও সুরেনকাকা, আপনি পা সরিয়ে নিলেন কেন? দিন, পায়ের ধুলো দিন!’

সুরেনকাকা কোনো জবাব দিলেন না৷

আচম্বিতে বাড়ির একটা ঘরের ভিতর থেকে মেয়ে-গলায় আর্তনাদ জেগে উঠল, কে যেন কাতরে কাতরে কাঁদছে আর যাতনায় ছটফট করছে৷

চমকে মুখ তুলে বললাম, ‘সুরেনকাকা, সুরেনকাকা, ও কে কাঁদে?’

সুরেনকাকা এবারেও জবাব দিলেন না৷ তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর দিকে চলে গেলেন, তাঁর খড়মের খটখটানি ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে এল, যেন তিনি দূরে, দূরে, অনেক দূরে এগিয়ে আর এগিয়েই যাচ্ছেন-খটখট খটখট খটখট খট, খট, খট, খট . . .

তিন

হতভম্ব হয়ে বসে আছি৷ চাঁদের আলো আছে বটে, কিন্তু সে যেন আজ মরে গেছে৷ একটা কালপ্যাঁচা তেতলার ছাদের আলিসার কোণে বসে মাঝে মাঝে ঘাড় বেঁকিয়ে আমাকে দেখছে৷ নীচের উঠান থেকে একটা হুলোবেড়াল ক্রমাগত চ্যাঁচাচ্ছে, আউ, আউ, আউ, আউ-

মিনিট পনেরো কেটে গেল, কিন্তু সুরেনকাকার আর দেখা নেই! আজকে এই বাড়ির অবস্থা, সুরেনকাকার ব্যবহার, মেয়ে-গলায় কাতরানি, সবই কেমন রহস্যময়!

আর-একটা প্রশ্ন মনকে বার বার খোঁচা দিতে লাগল৷ সুরেনকাকার পায়ে হাত দিয়েও তাঁর পা ছুঁতে পারলাম না কেন? হ্যাঁ, কেন পারলাম না, কেন?

আরও মিনিট পাঁচেক কাটল৷ আমি আর থাকতে না পেরে ডাকলাম, ‘সুরেনকাকা, অ সুরেনকাকা!’

কোনো সাড়া নেই৷

‘সুরেনকাকা! শুনছেন? অ সুরেনকাকা!’

কোনো সাড়া নেই৷

প্যাঁচাটা ওঁচা গলায় চ্যাঁ চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে উড়ে পালাল, হুলোবেড়ালটাও চুপ মেরে গেল৷ আমি তো এ বাড়ির সর্বত্র যেতে পারি, এখানেই বা বসে থাকি কেন? এই ভেবে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম৷

উঠানের উপরে দু-দিকে বারান্দা৷ তার ভিতরে খানপাঁচেক ঘর৷ সেখানে চাঁদের আলো নেই৷ অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দেখলাম, সব দরজাই কেবল বন্ধ নয়, বাহির থেকে তাদের শিকলে তালা-চাবি লাগানো!

কিন্তু! . . . . . . . . .

সুরেনকাকা যে এদিকেই এসেছেন, সে-বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই! আর এই ঘরগুলোরই কোনো একখানার ভিতর থেকে মেয়ে-গলায় কান্না শুনেছি, এটাও আমি হলপ করে বলতে পারি! . . . . . . সুরেনকাকাই বা কোথায় গেলেন; কাঁদলই বা কে, আর সব ঘর তালাবন্ধই বা কেন?

এতক্ষণ যে সন্দেহ করিনি, এইবারে তা জেগে উঠে আমার মনকে আতঙ্কে একেবারে আচ্ছন্ন করে দিল৷ আমি পাগলের মতন উপর থেকে ছুটে নীচে নেমে এলাম, রুদ্ধশ্বাসে সদরের কাছে এসে একটানে দরজা খুলে ফেলতে গেলাম, কিন্তু পারলাম না, সদর দরজাতেও বাহির থেকে কুলুপ দেওয়া! এই সদর দরজা দিয়েই একটু আগে আমি বাড়ির ভিতরে ঢুকেছি! এর মধ্যে দরজায় তালা দিল কে? আর কেনই বা দিল?

হতাশভাবে সদর দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম৷

হঠাৎ মনে পড়ল, সুরেনকাকার বাড়ির খিড়কিতে পুকুর ও বাগান আছে৷ এ-কথা মনে হতেই বেগে সেইদিকে ছুটলাম৷ বাগানে গিয়ে কোনোরকমে পাঁচিল টপকে আবার রাস্তায় এসে পড়লাম৷

চার

সুরেনকাকা যে পাড়াতে থাকতেন, সেই পাড়াতেই আমার বাল্যবন্ধু অখিলের বাড়ি৷ পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই অখিলের বাড়িতে ছুটলাম৷

বৈঠকখানায় বসে অখিল চা পান করতে করতে খবরের কাগজ পড়ছিল, আমাকে দেখে বিস্মিত স্বরে বলল, ‘এই যে, নরেশ যে! কবে কলকাতায় ফিরলে হে?’

‘পরশু! কাল তোমাদের পাড়ায় বিজয়ার প্রণাম করতে এসেছিলাম, কিন্তু সুরেনকাকার বাড়িতে দেরি হয়ে গেল বলে তোমার সঙ্গে আর দেখা করতে পারিনি৷’

দুই চোখ কপালে তুলে অখিল বলল, ‘কাল তুমি সুরেনবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলে? কিন্তু সেখানে তোমার দেরি হল কেন?’

‘সুরেনকাকার সঙ্গে কথা কইতে কইতে দেরি হয়ে গেল৷’

অখিল গম্ভীর মুখে বলল, ‘নরেশ, কাল তুমি কতটা সিদ্ধি খেয়েছিলে?’

আমি বললাম, ‘কাল বিজয়ার সম্ভাষণ করতে গিয়ে প্রত্যেক বাড়িতেই একটু-আধটু সিদ্ধি খেতে হয়েছিল বটে, তবে বেশি সিদ্ধি নিশ্চয়ই খাইনি৷ কিন্তু তুমি এ-কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?’

অখিল বলল, ‘এই এক বছরের ভেতরে তুমি কি সুরেনবাবুর কোনো খবর পাওনি?’

‘না৷’

‘গেল বছরে ঠিক এমনি সময়ে এ পাড়ায় কলেরার মড়ক দেখা দিয়েছিল৷ সাত দিনের ভেতরে সুরেনবাবু, তাঁর স্ত্রী আর দুটি ছেলে-মেয়ে কলেরায় মারা যান৷ সেই থেকে তাঁর বাড়ি খালি পড়ে আছে৷’

. . . . . . . . . তারপর অনেক বছর কেটে গেছে৷ কিন্তু বিজয়াদশমীর দিন হাজার অনুরোধেও আর আমি সিদ্ধি খাই না৷

তবে একটা জায়গায় আজও আমার খটকা লেগে আছে৷ সমস্ত ব্যাপারটাই না হয় সিদ্ধির খেয়াল বলে উড়িয়ে দিতে পারি, কিন্তু সুরেনকাকার অ্যাটর্নির কাছে গিয়ে আমার হাজার টাকা যে ফিরে পেয়েছি, এটা তো কিছুতেই ভুলতে পারছি না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *