বিজয়নগর – ৮

অবশেষে একদিন ক্রিয়াশক্তি এত লোক থাকতে রাজার অনুমতিক্রমে সভাকবি অমরুকে নিয়ে মলয়াবন্ত পাহাড়ে গেলেন। বনবাসীরা তাঁদের দুজনকে আশ্রমের দিকে যেতে দেখে কৌতূহলোদ্দীপ্ত হয়। তারা এগিয়ে আসে। আশ্রম কোনদিকে জানতে চাইলে তারা দেখিয়ে দিয়ে বলে, সাধুর অসুবিধা হবে না? উনি একা থাকতে ভালোবাসেন।

—জানি। আমি সব বললে, উনি রাগ করবেন না।

একজন বলে–আপনিও তো সাধু। উনি বোধহয় অসন্তুষ্ট হবেন না। ওরা দূর থেকে আশ্রম দেখিয়ে দিয়ে ক্রিয়াশক্তিকে প্রণাম করে।

ব্রহ্মচারী দেবদত্ত এঁদের আসতে দেখেই তাড়াতাড়ি কুটির ছেড়ে এগিয়ে আসেন। তিনি ক্রিয়াশক্তিকে প্রণাম করতে গেলে তিনি বলেন—আমাকে প্রণাম করছ কেন ব্রহ্মচারী?

—আপনি প্রবীণ এবং ব্রহ্মচারী বলে। আমি পশুপতি মন্দিরে শৈশবে অনেক বার গিয়েছি। আপনি আমার অপরিচিত নন।

–তোমার কথা শুনে ভালো লাগল। তোমার গুরুদেব ব্রহ্মানন্দজী হিমালয়ে চলে যাওয়ার আগে আমি দেখা করেছিলাম।

সেই সময় একটি ময়ূর আঙিনায় উড়ে এসে বসল। অমরু সেটিকে দেখে তপস্বীদের অস্তিত্ব ক্ষণিকের জন্য বিস্মিত হল। সে এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় হাত দিল। এই দৃশ্য দেখে দেবদত্ত অবাক হয়ে ক্রিয়াশক্তিকে জিজ্ঞাসা করেন—ইনি কে?

–ও বিজয়নগরের সভাকবি।

-উনি আসার পর থেকে আমি ওঁর চোখের দিকেই চাইছি বারবার। স্বর্গীয় ওই চাহনি। আপনি দেখেননি?

ক্রিয়াশক্তি হেসে বলেন—দেখেছি। ওর বিবাহ দিয়েছি এক দেবদাসীর সঙ্গে। উপযুক্ত পাত্রী।

—ওই ময়ূর কিন্তু পোষা নয়, বনের ময়ূর। ওভাবে নিশ্চিন্তে ওঁর গায়ের সঙ্গে মাথা ছোয়াচ্ছে। ওঁকে সভাকবি করা হয়েছে। উনি তো বিব্রত হবেন।

–না, মহারাজ সেই বিষয়ে খুব সচেতন, ওকে খুবই সম্ভ্রমের চোখে দেখেন। ওর স্ত্রী খুব প্রতিভাময়ী আয়ুর্বেদশাস্ত্রজ্ঞ। আমার কাছে হাতেখড়ি। এখন আমি সম্ভবত ওর কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারি।

দেবদত্ত হাসেন। ক্রিয়াশক্তি বলেন—আমি তোমার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।

—অনুরোধ? বলুন আদেশ।

—তুমি যেভাবে চলছ এটি তার বিপরীত। তাই আদেশ বলা সঙ্গত হবে না। শোন, আমি আর বেশিদিন নেই। আমার বাসনা, তুমি আমার সব কাজের ভার নাও। বিজয়নগরে উপযুক্ত আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না আপাতত।

–এ যে বিপুল কাজ।

—না। তোমার পক্ষে বিপুল নয়। তুমি ব্রহ্মচারী। পশুপতি মন্দিরের একটি অংশ সম্পূর্ণ পৃথক। একদিকে যেমন দেবদাসীরা থাকে। অন্যদিকে তেমনি আমার নির্দেশে কয়েকজন ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করত এক সময়ে। ব্রহ্মচারী হয়ে তারা কেউ থাকল না। চলে গেল। আমি নিষেধ করিনি। তোমাকে রাজপুরী আর পশুপতি মন্দির দুটিরই ভার নিতে হবে। আমি নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে এসেছি। অন্য কাউকে ব্রহ্মচারী করতে পারিনি।

দেবদত্ত কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে—আমাকে দুদিন সময় দেবেন?

—নিশ্চয় দেব। দুদিন পরে তবে আসব?

—আপনি? না, আমিই যাব পশুপতি মন্দিরে। বুধবারে পূর্বাহ্নে। কবিকে সেদিন ওখানে দেখতে পাব?

ক্রিয়াশক্তি কবিকে ডাকেন। অমরু কাছে এলে দেবদত্তর ইচ্ছার কথা বলতে সে বলে—খুব ভালো হবে।

—শ্রীমতীকে নিয়ে যেও। ওখানেই প্রসাদ পাবে।

.

অতীশ বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী ছিল আহত হয়ে। একদিন মঞ্জরী প্রত্যুষে তার ঘুম ভাঙিয়ে মুখে হাত বুলিয়ে হেসে বলে—এবারে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ বীরপুরুষ।

—বিদ্রূপ করছ?

সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জরী স্বামীর বুকের উপর ভেঙে পড়ে বলে—বিদ্রূপ? কল্পনা করাও পাপ। শ্রীমতী ঠিকই বলেছিল, তোমার এই আঘাত একটা অন্য ধরনের শ্রী এনেছে মুখে।

–আমি কাল অমরুর বাড়িতে যাব।

—কালই?

—হ্যাঁ। ওদের সংসার কেমন চলছে দেখতে হবে।

—আমিও যাব।

–তোমার সখী তো রোজই এসেছেন আমাকে দেখতে। তখন তুমি অনেক গল্প করেছ। এবারে আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে গল্প করব। কাল রাজসভা নেই।

—বেশ যেও। অসুবিধা হলে কিন্তু বেশিক্ষণ থেকো না।

সাদা রঙের প্রিয় অশ্বটিতে চেপে অতীশ বের হয়। বরাবর প্রত্যুষে ওঠা তার অভ্যাস। সেই অভ্যাস নিজের রাজ্যের চেয়ে রাজধানীতে থেকে আরও নিয়মিত হয়েছে। সে চেষ্টা করে মহারাজা তাঁর শেষ রাত্রের কুস্তী ইত্যাদি শেষ করে যখন অশ্ব নিয়ে বাহিনী পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে বিদ্যুৎবেগে ছোটেন, সেই সময় অশ্ব নিয়ে ছুটতে। তবে মহারাজ বিরক্ত যাতে না হন, সেদিকে লক্ষ্য রাখে। কিছুদিন শয্যাশায়ী থেকে তার নিয়মের একটু ব্যতিক্রম হয়েছে। খানিকটা দুর্বলও হয়েছে মনে হচ্ছে, অশ্ব চালনা করতে করতে। তাছাড়া এই ঋতুতে গ্রীষ্ম কেটে গেলেও শীত আসতে অনেকটা বাকি থাকে। কিন্তু তার একটু ঠাণ্ডাই লাগছে। বুঝতে পারে, নিরাময় হলেও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। তাই ধীরে ধীরে চলে।

অমরুর গৃহদ্বারে গিয়ে দেখে রাজপুরীর যে লোকটি প্রতিদিন সকালে আসে, সে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অতীশকে দেখে সে অভিবাদন করে।

—সভাকবি?

—আমি আসার আগেই ওঁরা বাইরে গিয়েছেন। এত তাড়াতাড়ি কখনো যান না।

-কেউ জানে?

—হ্যাঁ। প্রতিবেশীদের বলে গিয়েছেন, পশুপতি মন্দিরে রওনা হয়েছেন একটু আগেই।

অতীশ নিশ্চিন্ত হয়। পথিমধ্যে ওদের ধরে ফেলবে। একটু পরেই দেখা মিলল। অশ্ব থেকে নেমে সেটিকে নিয়ে একসঙ্গে চলতে লাগল। সে বলল—আজ আমার বহুদিন পরে খুব ভালো লাগছে। মঞ্জরী থাকলে আরও ভালো লাগত। বুঝতে পারছি, আমি অপরিণামদর্শী।

সবাই হেসে ওঠে।

অমরু বলে, তাদের আসার উদ্দেশ্য। অতীশ কৌতূহলান্বিত হয়। অল্পবয়সী তপস্বীর কথা, সে আগে শুনেছে। কিন্তু গুরুদেব যে তাঁকে এতখানি গুরুত্ব দেবেন কোনোদিন সে কথা ভাবেনি। গুরুদেব নিশ্চয়ই যোগ্য বয়স্ক কোনো ব্রহ্মচারী পাননি

তারা মন্দিরে প্রবেশের একটু আগে দেখতে পায় একজন ক্ষীণদেহী গৌরবর্ণের তাপস দ্রুতগতিতে এসে মন্দিরে প্রবেশ করলেন।

অমরু বলে ওঠে—এই তো তিনি।

শ্রীমতী আর অতীশ তখনো বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়েছিল।

শ্রীমতী বলে—গুরুদেব এঁর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।

অতীশ বলে—কত কম বয়স, অথচ দেখলেই মাথা নত হয়ে যায়।

সবাই গিয়ে গুরুদেবের কাছে আভূমি প্রণাম করে দূরত্ব বজায় রেখে বসে। শ্রীমতী বুঝতে পারে দেবদাসীরা আশেপাশেই রয়েছে, তবে গুরুদেবের আদেশ ছাড়া তারা আসতে পারছে না।

ক্রিয়াশক্তি সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চান। দেবদত্ত বলেন—আমি কবিকে খুব ভালো চিনেছি।

ক্রিয়াশক্তি শ্রীমতীকে দেখিয়ে বলে—এ এখানে দেবদাসী ছিল, এখন কবির পত্নী।

দেবদত্ত বলেন—আয়ুর্বেদজ্ঞ?

–-হ্যাঁ, সেদিন বলেছিলাম বটে।

শ্রীমতী অতীশকে দেখিয়ে ক্রিয়াশক্তিকে বলে—গুরুদেব এঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দিন। অনেকদিন আহত অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন, আজ প্রথম বাইরে বেরিয়েছেন সকালে। ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছে। জ্বর আসবে। মঞ্জরীকে ভুগতে হবে।

অতীশ আপত্তি তুলতে গিয়েছিল। গুরুদেব বলেন—কোনো কথা নয়, তুমি এখনি বাড়ি চলে যাও।

অতীশ মুখ ভার করে গুরুদেব ও দেবদত্তকে প্রণাম করে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে শ্রীমতী অতীশকে বলে—মঞ্জরীর কাছে ওষুধ আছে। শরীরের উত্তাপ তাতেই কমে যাবে। আপনি আর দুদিন বিশ্রাম করুন।

অমরু শ্রীকে অভিযোগের কণ্ঠে বলে—অতীশকে চলে যেতে বললে কেন? ওর কত কষ্ট হল। অনেকদিন পরে একটু আনন্দ পেয়েছিল।

শ্রীমতী বলে—আমি তো মাকে নিয়ে তোমার বন্ধুর কাছে যাব, তখন বুঝিয়ে বোলো। বন্ধুর দুঃখ থাকবে না।

—তা ঠিক। কিন্তু আমার কেমন লাগছে।

শ্রীমতী বিচলিত হয়।

সেই সময় বিগ্রহের বেদীর নিকট থেকে দয়াবতীর সংগীত ভেসে আসে। তপস্বী দেবদত্ত উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ক্রিয়াশক্তি ডাকেন—এসো ব্রহ্মচারী, দেবদাসীর পূজা দেখবে এসো।

সবাই গিয়ে দেখেন নিমীলিত চক্ষে বিগ্রহের সম্মুখে করজোড়ে বসে দয়াবতী তার সুধাকণ্ঠে গেয়ে চলেছে।

কিছুক্ষণ শুনে দেবদত্ত বলে ওঠেন—এ যে স্বৰ্গীয়।

—হ্যাঁ। আমি পূজায় বসার সময় একে ডেকে নিই।

–এতো সংগীত শুধু নয়, এযে স্তব।

—হ্যাঁ। আমি জিজ্ঞাসা করিনি এত স্তব কোথায় পায়। তুমি প্রশ্ন করতে পার।

একটু পরে দয়াবতী আঁখি উন্মীলিত করে সবাইকে দেখে লজ্জিত হয়। সে উঠে দাঁড়ায়।

ক্রিয়াশক্তি বলেন—ইনি তপস্বী দেবদত্ত।

দয়াবতী তাঁদের দুজনকে প্রণাম করে। শ্রীমতীকে দেখে হাসে।

দেবদত্ত বলেন—এইসব স্তব কোথা থেকে পেলে?

—পাইনি তো প্রভু। নিজেই গাই।

—কিভাবে গাও মহেশ্বরের এত স্তব।

—আমি জানি না। আমি কি অন্যায় করেছি?

ক্রিয়াশক্তি বলেন–কে বলেছে তুমি অন্যায় করেছ?

দেবদত্ত বলেন—তোমার স্তব নির্ভুল। তোমার স্তব মহাকাল-প্রদত্ত।

ভোগ গ্রহণের পর ক্রিয়াশক্তি দেবদত্তকে বলেন—তুমি ভেবেছ?

—হ্যাঁ। আমি সম্মত হলাম এই ভেবে যে নইলে রাজপুরীতে অরাজকতা সৃষ্টির সম্ভাবনা। আমি আশ্রম থেকেই আসব।

—আমি নিশ্চিন্ত হলাম। অবশিষ্ট দিনগুলি আমি এই মন্দিরেই থাকব। পরশু রাজপুরীতে আসতে পারবে?

—আমি আগামী কাল আসতে চাই।

—উত্তম। তবে কয়েকজনকে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষাদানের চেষ্টা করো।

—অবশ্যই।

—যদি পার, বুঝতে হবে তুমি ভাগ্যবান।

.

মন্দির থেকে বাড়িতে আসতে বেলা পড়ে আসে। শ্রীমতী কিছুক্ষণ ঘরের কাজ করে এক সময় দেখে অমরু জানলার পাশে বসে অস্তগামী সূর্যের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বসে রয়েছে। তার জন্য বড় কষ্ট হয় শ্রীমতীর। বন্ধুকে সঙ্গে রাখতে চেয়েছিল। এদিক ওদিক কয়েকবার ঘোরাঘুরি করা সত্ত্বেও অমরুর তন্ময়তা ভাঙল না। তখন ধীরে ধীরে পেছনে বসে স্বামীর মাথাটা বুকে চেপে ধরে। অমরু সামান্য একটু চমকে উঠতে গিয়েও নিশ্চিন্তে স্ত্রীর হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়।

—খুব কষ্ট হয়েছে?

– -কেন?

—বন্ধুকে থাকতে দিইনি বলে?

অমরু একটু হেসে বলে—ভুলে গিয়েছি। না না ফেরার পথেও দুঃখটা ছিল।

–জানি। কাল যাবে?

—তুমিও যাবে?

—যাব না? তোমার বন্ধুর জ্বর বেড়েছে কিনা দেখতে হবে যে।

–সত্যিই জ্বর হয়েছে নাকি?

—আমার তাই ধারণা। বেশ তো দেখতে গেলেই বোঝা যাবে। তাছাড়া মঞ্জরীকে বলতে হবে তোমার বন্ধু-প্রীতির কথা।

–না না, ওসব বললে আমার কেমন লাগে।

-তাহলে বলব না। তোমার যাতে একটুও অসুবিধা হয় আমি তা কখনো বলি না, করিও না।

—আমি জানি শ্রীমতী। তোমার রূপ সরস্বতীর মতো, মনটাও তেমন।

–আমার রূপ তোমার চোখে পড়ে?

—পড়ে না?

-শুনিনি তো বেশি।

–সত্যি কথা বলব? –তুমি মিথ্যা বল নাকি?

–না, তা নয়। তবু—

—বল।

—তুমি এত সুন্দর। কিন্তু সে কথা বললে, মনে মনে তুমি হাস। আমি বুঝতে পারি।

শ্রীমতী হেসে ফেলে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে।

—আমি জানতাম। সেই জন্যেই বলি না।

.

এক এক সময় মানুষের নিজের জীবন অথবা দেশের জনসাধারণের জীবন-প্রবাহ মসৃণ গতিতে চলতে থাকে, কোনো বৈচিত্র্য থাকে না। আবার কখনো কখনো সেই প্রবাহ বাত্যবিক্ষুব্ধ তরঙ্গ সংকুল হয়ে ওঠে।

দুই বৎসর অতিবাহিত হয়েছে। অমরু এবং শ্রীমতী উভয়েই ইতিমধ্যে মাতৃহারা। ক্রিয়াশক্তি আরও অশক্ত। সব চেয়ে সর্বনাশ ঘটে গিয়েছে রাজপুরীতে তথা বিজয়নগর সাম্রাজ্যে। ইসমাইল আদিল শাহ আবার বিজয়নগর আক্রমণ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ফিরে গেলেও তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল এবং বিজয়নগরের রাজকুমার নিহত হয়েছেন। মহারাজের বজ্রাহত অবস্থা। রাজকুমারের যত দোষই থাকুক, তিনি ভালো যোদ্ধা ছিলেন। প্রাসাদ প্রাঙ্গণের অন্য অট্টালিকা থেকে পুত্রবধূর ক্রন্দন ধ্বনি তাঁর কানে না এলেও তার গর্ভধারিণী গৌরীদেবী বারবার ছুটে ছুটে আসছেন। কোথায় বা সান্ত্বনা খুঁজবেন আর তিনিই বা কি সান্ত্বনা দেবেন। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি এখন আর মন্দিরের বাইরে আসেন না। একটি কোণে বসে কোনোরকমে ধ্যান করেন কিছুক্ষণ। স্বামী দেবদত্ত প্রাসাদে আসেন নিয়মিত, কিন্তু ক্রিয়াশক্তিকে মহারাজ যেমন পিতার মতো ভালোবাসতেন, স্বামীজীর প্রতি আস্থা থাকা সত্ত্বেও সেইভাবে নিজের মনকে উদ্ঘাটিত করে দিতে সংকোচ হয়। বয়স বড়ই কম। তিনি জানেন ব্যক্তিগত শোক তাপ নিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রাখলে সাম্রাজ্য চলে না। কিন্তু নিজের দেহে যখন বিপদের সংকেত দেখা দেয় তখন তো স্থির থাকা যায় না। কারণ তাঁকে এখন কয়েক বছর সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। তিনি যে পুত্রহারা। এতবড় সাম্রাজ্যের উত্তরাধীকারী যে অষ্টম বর্ষীয় এক বালক। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি এবং স্বামী দেবদত্ত উভয়েই বলেছেন, এই বালক সামান্য নয়। তিনিও বুঝতে পারেন, কিন্তু তাকে তো রক্ষা করতে হবে। যতদিন সে সাবালক না হচ্ছে ততদিন তাঁকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু এক একদিন তাঁর বাঁ হাত কিছুক্ষণের জন্য একটু অসার বলে মনে হয়। কুস্তী তিনি এখনো করেন, কিন্তু আগের মতো কখনই নয়। কুস্তীগীরও যেন বুঝতে পেরেই ঢিলে দেয়। মহারাজ ক্রুদ্ধ হয়ে বলে ওঠেন—তুমি কি আমার জোর কমেছে বলে ভাবছ নাকি?

সে মহারাজের পা দুহাত দিয়ে ছুঁয়ে মাথায় ঠেকিয়ে বলে—মহারাজ কোনো জন্মেই যেন সে কথা না ভাবি।

–সব জন্মেই তুমি আমার কুস্তীগীর হবে নাকি?

—না হলে বাঁচব না।

মহারাজা হেসে ওঠেন। বলেন—মজার কথা বলেছ তো। এ জন্মে কি কি পাপ-পুণ্য করেছ তার উপর তো সব নির্ভর করে।

কুস্তীগীর নিশ্চিন্তে বলে—আমি সব জানি মহারাজ।

মহারাজের ওর সঙ্গে কথা বলতে ভালোই লাগছিল। কোনোদিন দুটো কথাও হয় না, অথচ আজ বলতে ইচ্ছে করছে। বলেন—তুমি হয়তো পাপ তেমন করনি, কিন্তু আমি তো করেছি। কত লোকের প্রাণদণ্ড দিয়েছি, তাছাড়া আরও অনেক ঘটনার কথা তো সাম্রাজ্যের সবাই জানে। আমি আর মহারাজা হব না। নইলে এই জন্মেই শাস্তি শুরু হয়ে যায়? রাজকুমার চলে গেল—

কুস্তীগীর ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে শুরু করল। তার বিরাট দেহটা থরথর করে কেঁপে কেঁপে ওঠে।

মহারাজ ভাবেন, তিনি খুবই ভুল করে ফেললেন, সাধারণ একজন মানুষের কাছে মন খুলে দিয়ে। তাঁর মনের শক্তি কমে গিয়েছে বাঁ হাতও একদিন কয়েক মুহূর্তের জন্য অসার হয়, আর পৌত্র মাত্র অষ্টম বর্ষীয়। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি যখন আসতে পারেন না তখন স্বামী দেবদত্ত ব্রহ্মচারীর কাছে এই প্রশ্ন তিনি তুলবেন। তিনি কি বলেন শুনতে হবে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *