বিজয়নগর – ২

হেমাঙ্গিনীর কথা শ্রীমতীকে কিছুদিন আচ্ছন্ন করে রাখে। অন্যান্য মেয়েদের কারও কারও হয়তো করেছে। তবে তারা মুখ ফুটে কিছু বলেনি। ভেবেছে কিছু বললে হেমাঙ্গিনীকে ছোট করে ফেলা হবে। অথচ আরও তিনদিন হেমাঙ্গিনী তাদের নিয়ে অনেক কিছু দেখিয়েছে। বিজয়নগর সম্বন্ধে ওরা মোটামুটি জেনেছে, পথঘাটও চিনেছে। এখন আর একা একা কোথাও যেতে হলে অসহায় বোধ করবে না।

সব দেখানো শেষ হলে এক অপরাহ্নে হেমাঙ্গিনী সবাইকে গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির কাছে নিয়ে আসে।

—ওদের সব কিছু দেখলাম ঠাকুর। সব তো দেখানো যায় না।

—তাকি সম্ভব? তুমি সন্তুষ্ট হয়েছ তো?

—আমি সন্তুষ্ট। কিন্তু কারও মনে আরও আকাঙ্খা রয়েছে কিনা আমি জানি না। আমাকে কিছু বলেনি। ওরা ভাবতে পারে আমার খুব পরিশ্রম হচ্ছে, সংকোচবোধ করছে।

-ওদের দোষ কি? আমারই তেমন মনে হত।

হেমাঙ্গিনী বিদায় গ্রহণের আগে ক্রিয়াশক্তির পদধূলি গ্রহণ করে। ক্রিয়াশক্তি এদের বলেন—হেমাঙ্গিনীর মতো হওয়া চেষ্টা কর। পারলে তোমাদের ইহজীবন সার্থক হবে। মানুষের মনে সহস্র দুর্বলতা থাকে। সেসব দমন করে নিজেকে মুক্ত রাখার নিয়ত চেষ্টা মানুষকে দেবতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। হেমাঙ্গিনী সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেলে আমি অবাক হব না।

শ্রীমতী মন্তব্য করে—শুনেছি দেবতাদেরও কত দুর্বলতা থাকে। ইনি তাঁদের চেয়ে অনেক উঁচুতে।

ক্রিয়াশক্তি স্তব্ধ হয়ে যায়। একটু পরে তিনি শান্ত স্বরে প্রশ্ন করেন—তুমি বুঝলে কি করে?

–শুধু আমি কেন, সবাই জানে।

হেমাঙ্গিনী ঠাকুরের দিকে চেয়ে বলে—একটি ঘটনা ঘটেছিল। এদের বোধহয় তারপর থেকেই এমন ধারণা হয়েছে। ছেলেমানুষ তো। আমি আপনাকে পরে বলব।

.

মুক্তি যেসব বিদেশিদের দেখে রীতিমতো মুগ্ধ হয় তারা এদেশে এসেছে বাণিজ্যের জন্য। রাজার আরব দেশের অশ্বের উপর প্রচণ্ড লোভ। তিনি জানেন এই অশ্বগুলি এক একটি অগ্নিবাণ। যুদ্ধক্ষেত্রে এবং সর্বক্ষেত্রেই এরা অত্যন্ত কার্যকরী। তাই রাজা কখনই চান ওরা এগুলোকে দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে গিয়ে তিনি সেইজন্য তাঁর লোকজনকে গোয়ায় রাখেন। কোনো জাহাজ সেখানে ভিড়লেই তারা গিয়ে উপস্থিত হয় এবং যত অশ্ব আসে কিনে নেয়। বিজাপুরের শক্তিশালী সুলতান বিজয়নগরের চিরশত্রু। তারা যেন আমদানি করা অশ্বে ভাগ না বসায়। এই বিদেশিরা পর্তুগালের অধিবাসী। তারা অশ্বের সঙ্গে নিজেদের দেশের অনেক কিছু এখানে এনে সওদা করে। পরিবর্তে তারা প্রধানত হীরে জহরৎ সোনা ইত্যাদি নিয়ে যায়। ওরা বিজয়নগরের রাজাদের বরাবর পছন্দ করে এসেছে। কারণ রাজারা তাদের সঙ্গে কখনো দুর্ব্যবহার করেননি। বরং তাঁরা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। ওরাও বুঝেছে যে সারা ভারতবর্ষে বিজয়নগরই একমাত্র সাম্রাজ্য যেখানে তাদের স্বার্থ সবচেয়ে বেশি রক্ষা পাবে। তাই এই রাজ্যে তাদের আধিক্য লক্ষ করার মতো। নগরীর রাজপথে বহু মানুষের যাতায়াত। তাদের মধ্যে ওদের অনেক দেখা যায়। শ্রীমতীরাও ওদের দেখে প্রায়ই। গুরুদেব তো তাদের বন্দি করে রাখেননি। হেমাঙ্গিনী সংস্পর্শে এসে নগরীর পথে চলাফেরা করতে তাদের আর অসুবিধা হয় না। মুক্তি আবার ওই বিদেশিদের চেহারায় খুবই আকৃষ্ট হয়। তার জন্যে দেবদাসীদের মধ্যে হাসাহাসি হয়। একদিন পথ চলতে তারা দেখে পথে কাপড় বিছিয়ে একজন দামি পাথর বিক্রি করছে, আর দুজন বিদেশি পাথরগুলো হুমড়ি খেয়ে দেখছে। মাধবী মঞ্জরীর গা টেপে। মঞ্জরী মুক্তিকে বলে—কোন জনকে পছন্দ করলি? বেশি লম্বা না কম লম্বা? ওরা সবাই তো দীর্ঘদেহী।

মুক্তি খেপে ওঠে—তার মানে? তোরা ভেবেছিস কি? আজই গুরুদেবকে গিয়ে বলব।

–কি বলবি?

মুক্তি কেঁদে ফেলে।

অবলা বলে—চুপ চুপ। লজ্জার সীমা থাকবে না কেউ দেখে ফেললে। তোরা কখনো ওকে রাস্তায় কিছু বলবি না। বিদেশিদের দেখতে তো ভালোই। তোরা অস্বীকার করতে পারিস? তবে ও মাঝে মাঝে অনেক সময় বিদেশির অঙ্গভঙ্গি নকল করে। সেটা খুব খারাপ। ওরা দেখে ফেললে ভুল ভাববে।

মাধবী কপালে হাত রেখে বলে–হে ঈশ্বর।

শ্রীমতী লক্ষ্য করে কয়েকজন পথচারী তাদের দেখছে। সে ফিস্ ফিস্ করে সেকথা বলতেই ওরা তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগ করে।

.

পর্তুগীজ পর্যটক ক্রিস্টোভাও ডি ফিগুয়েইডিডো অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে রাজার কাছে রাজপ্রাসাদ দর্শনের অনুমতি প্রার্থনা করল। রাজা কিছুক্ষণ বিদেশির দিকে চেয়ে বললেন –কেন?

—মহারাজ আমরা পৃথিবীর অনেক দেশেই তো যাই, কিন্তু এত ঐশ্বর্য কোথাও দেখিনি। প্রতাপ, প্রতিপত্তি অনেক দেখেছি, কিন্তু সৌন্দর্য দেখিনি। এই নগরীতে এখন আমাদের দেশের অনেকে রয়েছে। যদি প্রাসাদ দেখতে পাই তাহলে আমার মাধ্যমে সবাই দেখবে। আমাদের দেশে গল্প করার মতো একটা বিষয় পাওয়া যাবে।

রাজা সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিলেন, অতিথিকে প্রাসাদের কিছু কিছু অংশ বাদ দিয়ে অন্য সব দেখিয়ে দিতে। মহিষীরাও ওখানে বাস করেন বলে অবারিত ভাবে সর্বত্র যাওয়া সম্ভব নয়। ক্রিস্টোভাওএর সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। প্রাসাদের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারিরা এক জায়গায় বিদেশিদের থামতে নির্দেশ দিল। যেখানে তারা দাঁড়ালো সেটি একটি দ্বার। পরিচারিকারা রানীদের সেবা করার পরে যে দ্বার দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয় তার বিপরীত দিকে সবাই থামল। এখানে বিদেশিদের কতজন রয়েছে গুণে দেখা হল। তারপর একজন একজন করে ভেতরে একটি ক্ষুদ্র মসৃণ ও বাঁধানো চত্বরে নিয়ে গেল। এর চারদিকে শ্বেতবর্ণের প্রাচীর। এখানে একটি দ্বার রয়েছে সেটাই রাজার বাসভাবন। এই দরজার প্রবেশমুখে দুটি তৈলচিত্র রয়েছে যা চিত্রের ব্যক্তিদের সামনে বসিয়ে শিল্পী এঁকেছেন। ডান দিকের চিত্রটি রাজার পিতার এবং বাঁদিকের চিত্র স্বয়ং রাজার। পিতা ছিলেন কৃষ্ণবর্ণের। তিনি সুঠাম দেহের অধিকারী এবং পুত্রের চেয়েও বলিষ্ঠ ছিলেন। তাঁরা উভয়েই তাঁদের পোশাক পরিচ্ছদ পরিহিত অবস্থায় রয়েছেন। এর পর দরজার ভেতরে প্রবেশের ইচ্ছা প্রকাশ করলে আবার তাদের গণনা করা হল। তারা সবাই একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে। প্রবেশ করেই বাঁদিকে ওপরে নীচে দুটি কক্ষ। নীচেরটি মেঝের চেয়েও নিচু। সেখানে দুটি তাম্রপাতের ধাপ রয়েছে। সেখান থেকে ওপর অবধি সোনা দিয়ে মোড়া এবং বাইরে গম্বুজাকৃতি। এর একটিতে চতুষ্কোণ বারান্দা রয়েছে যা হীরা চুনি এবং দামি পাথর ও মুক্তা দ্বারা মণ্ডিত। এই বারান্দার উপরে স্বর্ণনির্মিত হৃদয়াকৃতি একটি দ্রব্য মণিমুক্তা খচিত অবস্থায় ঝুলছে। এই কক্ষে একটি শয্যা রয়েছে, তার ওপর লম্বিত স্বর্ণ দ্বারা মণ্ডিত এবং তার উপর একটি কৃষ্ণবর্ণের রেশমি গদি রয়েছে। ওপরের কক্ষগুলো দেখা হয়নি। এই অট্টালিকায় একটি খোদিত প্রস্তরের স্তম্ভবিশিষ্ট কক্ষ রয়েছে। সেই কক্ষের সব কিছু হস্তী দত্ত দ্বারা নির্মিত। দেয়ালের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত হস্তীদন্তের লম্বালম্বিভাবে যে বর্গা স্তম্ভের ওপর রয়েছে তাতে গোলাপ ও পদ্ম ফুলগুলি সবই গজদন্তের। তাদের সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। এ দেশের মানুষ কিভাবে জীবনযাপন করে তার চিত্রাবলী এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যার মধ্যে পর্তুগীজদেরও স্থান হয়েছে। রাজার মহিষীরা এই চিত্র দেখে সাধারণ মানুষ সম্বন্ধে বুঝতে পারেন। অন্ধ এবং ভিখারীও বর্জিত হয়নি। এগুলি এত মনোমুগ্ধকর এবং এত জাঁকজমকপূর্ণ যা পৃথিবীর অন্যত্র দেখতে পাওয়া অসম্ভব।

এত দেখেও তৃপ্তি মেটে না। তবু এক সময় বিদেশিরা এটি ত্যাগ করে এল একটি বৃহৎ প্রাঙ্গণে। এটি খুব সুন্দরভাবে বাঁধানো। এর মাঝামাঝি কয়েকটি কাঠের স্তম্ভ রয়েছে। তার ওপর আড়াআড়ি ভাবে তাম্রমণ্ডিত বর্গা রয়েছে। মাঝখানে চারটি রৌপ্য নির্মিত শৃঙ্খল রয়েছে। যেগুলি আঁকড়া দিয়ে একটার সঙ্গে অপরটি যুক্ত রয়েছে। এটি রানীদের দোলনা রূপে ব্যবহৃত হয়। এই প্রাঙ্গণের ডান দিকের প্রবেশ পথে পর্তুগীজ অতিথিরা চার-পাঁচ ধাপ উপরে উঠে সুন্দর কয়েকটি গৃহে প্রবেশ করে, সেগুলি একতলা। এখানে একটি অট্টালিকা রয়েছে, যেটি অনেক স্তম্ভবিশিষ্ট এবং প্রস্তর নির্মিত। স্তম্ভগুলি গিলটি করা, যাতে তাদের স্বর্ণনির্মিত বলে মনে হয়।

এরপরে অট্টালিকার প্রবেশ পথে ঠিক কেন্দ্রস্থলে চারটি স্তম্ভের ওপর একটি চন্দ্রাতপ রয়েছে যেটিতে বহু নৃত্যরতা নারীমূর্তি অংকিত এবং আরও ক্ষুদ্র মূর্তি রয়েছে যেগুলি প্রস্তরে খোদিত। এগুলিও গিলটি করা।

দর-দালানে রৌপ্য শিকলে একটি পালংক ঝুলছে, যার পায়াগুলি স্বর্ণনির্মিত, প্রত্যেকটি সোনার পায়ায় হীরা জহরৎ বসিয়ে কারুকার্য করা। আরও কত কি যে রয়েছে, স্বর্ণনির্মিত বিরাটাকারের কড়াই অনেক রয়েছে রন্ধনের জন্য।

বিদেশিরা সব দেখে মুক হয়ে যায়। এত ঐশ্বর্য পৃথিবীর আর কারও রয়েছে বলে তাদের মনে হয় না। ক্রিস্টোভাও ডি ফিগুয়েই ডিডো তাঁর বিবরণীতে সব কিছু লিখেছেন। তাছাড়া পেজ, নুনিজ ইত্যাদি বহু পর্যটকও তাঁদের বিবরণ লিখে গিয়েছেন।

.

তিন বছর অতিক্রান্ত হয়। ক্রিয়াশক্তির চলনে সামান্য একটু শ্লথতা লক্ষ্য করা যায়। আর শ্রীমতী যেন ফুটন্ত গোলাপ। মঞ্জরী, মাধবীদের মধ্যে কোনো তারতম্য নেই। তবু একটি জিনিস সবাই বুঝতে পারে সাধারণ সময়ে শ্রীমতী অন্য সবার মতো বাইরে গেলেও মহানবমী নববর্ষ বা প্রাসাদের কোনো অনুষ্ঠানে গুরদেব তাকে একবছর হল যেতে দেন না। দু-বছর আগে শুধু একবার সে গিয়েছিল আর যায়নি। অবলা একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় তাদের বলে—আমার একটা কথা মনে হয়।

মঞ্জরী বলে—কি কথা !

—এবারে গুরুদেব কেন শ্রীমতীকে মহানবমীতে যেতে দিলেন না।

– কেন?

—এরমধ্যে হেমাঙ্গিনী দিদির ভূমিকা থাকতে পারে।

–সে আবার কি? উনি শ্রীমতীর এই সর্বনাশ করতে যাবেন কেন?

—সর্বনাশ? উনি শ্রীমতীকে রক্ষা করতে চেয়েছেন! রাজপুরীর সংবাদ তার চেয়ে বেশি কে জানবে?

মঞ্জরী বলে—কি জানি। ও না যাওয়ায় আমার মন খুব খারাপ ছিল। মনটা পড়ে থাকত ওর কাছে।

শ্রীমতী হেসে বলে—সত্যি? আমার খুব ভালো লাগছে তোমার কথা শুনে। অবলা বলে—আমি সত্যি কথা বলছি, হেমাঙ্গিনী দিদি ওকে বাঁচাতে চেয়েছেন। মহানবমীর শেষ দিনের অনুষ্ঠানের সময় আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

–কি করে বুঝলে?

–বলব না। সত্যি হবে এমন কোনো কথা নেই।

সবাই হাল ছেড়ে দিলেও শ্রীমতী পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে শেষ দিনের অনুষ্ঠানের চিত্রটি মনের মধ্যে এনে দেখতে থাকে। কিন্তু ওই প্রকাণ্ড অনুষ্ঠানের শুধু শেষ দিনের দৃশ্যগুলো বেছে নেওয়া খুব কঠিন। তাই মহানবমীর যাবতীয় কিছু তার মনের মধ্যে এসে যায়। কিন্তু সেই চেষ্টা থেকে আপাতত নিবৃত্ত হয়। এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে না পারলেও নিজেকে খুব একটা হতাশ মনে হয় না। কারণ গুরুদেব সেই সব দিনে তাকে অনেক কিছু শেখান।

একদিন তিনি হঠাৎ প্রশ্ন করেন—তোমরা তো দেবদাসী। জানতে ইচ্ছে করে না, তোমাদের ভবিষ্যৎ কি?

-না।

—চিরকাল তো যুবতী থাকবে না! বয়স হবে। নৃত্যে ছন্দ মিলবে না, কণ্ঠস্বরে কর্কশতা ফুটে উঠবে। তখন কি করবে?

গুরুদেবকে খুবই গম্ভীর এবং চিন্তান্বিত বলে মনে হয় তার। ভয় পেল। বলে—তবে আপনি কেন আমাকে গ্রহণ করেছিলেন?

শ্রীমতী দুঃখের সঙ্গে হেসে বলে—কতই তো মরল, আমিও না হয় তাদের মধ্যে একজন হতাম। মা কি বেঁচে আছে? থাকলে এই কয় বছরের মধ্যে একবার অন্তত আমার খোঁজে আসত। শ্রীমতীর চোখ ছলছল করে ওঠে।

সে প্রশ্ন করে—কী হয় ওদের? পথের ভিখারী হতে হয়? না, মন্দিরে মন্দিরে অন্য কাজ করে?

ক্রিয়াশক্তি বলে—অধিকাংশই তো তোমার মতো শিক্ষিতা নয়। এই যেমন আমাদের ভবানী।

—ভবানী? আমাদের ভবানীদি?

—হ্যাঁ। তাই মন্দিরের কাজে রয়েছে।

—উনি তো আমাদের রান্না করে দেন।

—হ্যাঁ ক্ষতি কি? তোমরা নিজের বাসন নিজে মাজো বলে ওকে আর মাজতে হয় না, নইলে মাজত

—এটা ঠিক কি?

—আমি জানি না, তবে শুনেছি একজন সেবাদাসী সত্যিই কয়েক বছর আগে পথের ধারে ভিক্ষাবৃত্তি করতে গিয়েছিল। তাদের মন্দিরের কেউ দেখতে পেয়ে তাকে রাজপুরীতে নিয়ে গিয়ে কোনো রানীর কাজে লাগিয়ে দেয়। সেই রানী তারই গ্রামের মেয়ে ছিলেন। রানীর তো শেষ নেই। কয়েক শো।

—কয়েক শো?

—হ্যাঁ, সহস্রও হতে পারে।

—সহস্রও? কিন্তু অত রানী কোন প্রয়োজনে লাগে?

—রানীর সংখ্যা যত বেশি হয় রাজার মর্যাদা প্রজাদের কাছে তত বাড়ে। প্রজাদের যা বোঝানো হয় তাই বোঝে

—গুরুদেব আমাদের কি হবে?

—সেই কথাই ভাবছি কিছুদিন ধরে। তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই, কারণ এখন তুমি সব বুঝতে পার। তোমরা নৃত্য পটিয়সী। নগরীর নটি হয় অনেকেই। নটীর আসল পরিচয় তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। অনেক নটী সুনাম অর্জন করে। সম্পদশালিনী হয়েও তার জন্য নৃত্যের সঙ্গে রূপ গুণ ও বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। তোমার সবই আছে।

—ছিঃ গুরুদেব!

—অত আতঙ্কিত হতে হবে না। তোমার চাহনি দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। আজ সময় পেয়েছি বলে তোমাকে সব কিছু খুলে বলছি। তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি নিজেই খুব চিন্তিত। শুধু তুমি কেন, মঞ্জরী, মাধবী সবারই। কিন্তু সবার জন্য এই বয়সে আমি হয়তো কিছু করে উঠতে পারব না। যে ক’জনকে পারব দেখব। দুই পুরুষ আগের একটা ঘটনার কথা বলি শোন। এই সাম্রাজ্যের বাইরে মুদকল বলে একটি অঞ্চল রয়েছে, যেখানে এক চাষি পরিবারে একজন পরমাসুন্দরী কন্যা জন্মেছিল। লোকে বলত, ঈশ্বর মনের সবটুকু মাধুর্য ঢেলে দিয়ে ওকে রূপসী করেছিলেন। গ্রামবাসীরা মুগ্ধ। একজন ব্রাহ্মণ ওদের গুরু ছিলেন। তিনি ভাবলেন, এই রূপসীকে কে আশ্রয় দেবে? কে এর রূপের মর্যাদা দেবে? ব্রাহ্মণ অনেক ভেবেচিন্তে বিজননগরের রাজপ্রাসাদে এসে রাজার দর্শনপ্রার্থী হলেন। ভাবলেন, রাজার পুত্র রয়েছে একজন। রাজা যদি সম্মত হন। বিদেশি ব্রাহ্মণ দর্শন প্রার্থী, তাই রাজার দর্শন মিলতে দেরি হল না। ব্রাহ্মণ রাজাকে সেই কন্যার কথা সবিস্তারে বললেন। রাজা দৃঢ় চরিত্রের ছিলেন না। তবে কন্যার চেয়ে তিনি বয়সের তুলনায় অনেক বড়। তবু তিনি বললেন–আমি যদি সম্মত হই তাহলে ক্ষতি আছে? ব্রাহ্মণ সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন-এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব আর কি হতে পারে? এতটা আমি চিন্তা করতে পারিনি। শুনেছি আপনার পুত্র রয়েছেন। কিন্তু আপনি যখন নিজেই সম্মত তখন অন্য কিছু আর ভাবতে চাই না।

রাজা ব্রাহ্মণকে অনেক উপঢৌকন দিলেন। সেই সঙ্গে কন্যার জন্য দুর্লভ অলংকার দিলেন। তার পরিবারকে বহু অর্থ দিয়ে বললেন–কন্যাকে অলংকারাবৃত করে দেবেন। তার পিতা মাতাকে এই অর্থ দেবেন। আমাদের নিয়ম হল কন্যা আমাদের অলংকার পরলেই বিবাহ স্থির হয়ে গেল।

ব্রাহ্মণ মুলে ফিরে কৃষকের গৃহে গিয়ে সমস্ত কথা বলেন। কন্যার বাবা মা খুবই আনন্দিত। তাঁরা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি যে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের মহারাজা স্বয়ং কন্যার পাণিগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করবেন। তারা গুরুকে সঙ্গে নিয়ে অলংকার সমেত কন্যার সামনে এল। কন্যা সব শুনে এই বিবাহ করতে অস্বীকার করল। বলল—ওই রাজপুরীতে একবার রানী হয়ে ঢুকলে কেউ জীবনে আর বাইরে আসে না। তাই আমি এ বিবাহ করব না। কারণ আমি মা বাবাকে না দেখে থাকতে পারব না।

শ্রীমতী তন্ময় হয়ে শোনার পর মনে মনে সেই কবেকার কন্যাকে প্রণাম জানায়। গুরুদেব বলেন—আমারও তোমাদের জন্য এই একই ভয়।

–আপনি কি করবেন?

-পারলে তোমাদের বিবাহ দেব।

শ্রীমতী স্তম্ভিত হয়ে যায়। রাজকুলগুরু ক্রিয়াশক্তি আবাহমানকাল প্রচলিত একটি ধারার সমাপ্তি ঘটাতে চান !

—কিন্তু গুরুদেব একি সম্ভব?

—খুবই কঠিন। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করলে কিছুটা সফল হতে পারি

—এই মন্দিরের একজন সেবাদাসীরও যদি বিবাহ দেন, তাহলে আপনার প্রভাব প্রতিপত্তি সব ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রাসাদ থেকেও বহিষ্কৃত হতে পারেন।

ক্রিয়াশক্তি হেসে বলেন—আমার প্রভাব অত সহজে বিনষ্ট করার ক্ষমতা কারও নেই। রাজারও নেই।

-কিন্তু দেবদাসীকে কেউ বিবাহ করবে কি? আপনার মুখ থেকে না শুনলেও, দেবদাসীরাই আলোচনা করে, তাদের লোকে বারবণিতা ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। এদের থেকে পছন্দমতো সুন্দরীদের বেছে রাজা রানী করে নেন।

–তোমার কথা একেবারে মিথ্যা না হলেও সম্পূর্ণ সত্য নয়। তবে সমাজে এসব নিয়ে কথাবার্তা হয়।

আরও অনেক কথা হয় গুরুদেবের সঙ্গে। তাঁকে মহাপুরুষ বলে মনে হয় শ্রীমতীর। গুরুদেব বলেছেন, তোমরা দেবদাসী শুধু নও, তোমরা পূজারিণী, একথা কখনো ভুলে যেও না। নৃত্যগীতের মাধ্যমে পূজা কর তোমরা। দেশের সর্বত্র মন্দিরে মন্দিরে পূজারিণীর খোদিত মূর্তিই বেশি, রাজা মহারাজার নয়।

সেই সময় মঞ্জরীদের কলবর শোনা যায়। গুরুদেব উঠে দাঁড়িয়ে বলেন—তোমার জন্য একজন পাত্র নির্বাচন করেছি।

-পাত্র? তার অর্থ?

—যার সঙ্গে তোমার বিবাহ দিতে চাই সেই পুরুষটি নির্বাচন করেছি মনে মনে।

কথাটা শুনেই শ্রীমতীর সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। হাত পা হিমশীতল।

সেই সময়ে সবাই ভেতরে এসেই গুরুদেবকে সামনে দেখে প্রাণাম করে।

-কেমন লাগল তোমাদের?

অবলা বলে—বেশ ভালো। প্রত্যেকবারই দেখি, অথচ নতুন বলে মনে হয়।

.

অবলা ঠিকই বলেছে। মহানবমীর উৎসব প্রতি বছর দেখলেও তার আকর্ষণ কমে না। এটি প্রতি বছরে শুরু হয় পয়লা আশ্বিন শুক্লপক্ষের প্রতিপদের দিন। আর নববর্ষ হয় পয়লা কার্তিক শুক্লপক্ষের প্রতিপদে। সেই দিনে নগরীর রাজপথে দীর্ঘ শোভাযাত্রা বের হয়। তাতে রথে করে মন্দিরের অনেক বিগ্রহকে নেওয়া হয়। দেবদাসীরা তো অংশগ্রহণ করেই, এমনকি রাজার বহু রানী যাঁরা নিজের রূপ লাবণ্যের অভাবে শকট পান না, তাঁরা অন্যান্যদের মতো পদব্ৰজে শোভাযাত্রার সঙ্গে চলেন। কিছু রূপসী দামি ডুলিতে আরোহন করে যান। তবে মাল্লাদেবী গৌরীদেবীর মতো বিখ্যাত রানীদের শোভাযাত্রায় সচরাচর দেখা যায় না।

এই মহানবমীর অনুষ্ঠানে একদিন ধার্য থাকে ভূস্বামীদের সম্মান প্রদানের জন্য। রাজ-প্রদত্ত সব চেয়ে মূল্যবান সামগ্রী হল দুটি ব্যজনী যে দুটি স্বর্ণ ও বহুমূল্যবান রত্নরাজি খচিত। এই দুটিও একশ্রেণীর গরুর শ্বেতবর্ণের পুচ্ছদ্বারা নির্মিত। রাজা যদি কোনো করদ রাজাকে উচ্চ সম্মান প্রদান করতে চান তাহলে তিনি তাঁকে পদচুম্বনের অনুমতি দেন। কারণ তিনি কাউকে তাঁর হস্তচুম্বনের অনুমতি দেন না।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যে গোহত্যা নিষিদ্ধ। কারণ তারা গরু বা ষাঁড়কে পূজা করে। এ ছাড়া তারা সবকিছু ভক্ষণ করে। মেষ, শূকর, তিন্তির, খরগোশ, ঘুঘু, কোয়েল, এবং সব জাতীয় পক্ষী, এমনকি চড়ুই, ইঁদুর টিকটিকি, গিরগিটি, সবই বিজয়নগরের বিক্রয়কেন্দ্রগুলিতে বিক্রয় করা হয়। তবে প্রত্যেকটি জীবত অবস্থায় বিক্রিত হয়। এমনকি মৎস্যও, যাতে ক্রেতা বুঝতে পারে সে কি কিনছে। বিক্রয় কেন্দ্রগুলিতে সব সময় ফলের প্রাচুর্য দেখা যায়। সেগুলি হল আঙুর, কমলালেবু, লেবু, ডালিম, কাঁঠাল এবং আম।

রাজা ঝর্ণার জল পান করেন। সেই জল আনার ভার থাকে তাঁর অতি বিশ্বাসী একজনের ওপর। যে সমস্ত পাত্রে এই জল আনা হয়, সেগুলি আবৃত থাকে এবং তাতে শীলমোহর দেওয়া থাকে। এই পাত্রগুলিকে রাজার সেবাদাসীদের হাতে দেওয়া হয়। তারা সেগুলি অন্তঃপুরে রানীদের নিকটে নিয়ে যায়।

.

একদিন মঞ্জরী শ্রীমতীকে বলে—তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? শ্রীমতী বলে—একটা কেন, সহস্র প্রশ্ন কর।

—না না, আমি গুরুত্ব দিয়েই বলছি।

-বল।

—তুই এত গম্ভীর হলি কবে থেকে? আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বুঝি? সেই সময় মাধবী পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। বলে—কি হয়েছে? শ্রীমতী গম্ভীর তো? মঞ্জরী বলে—শুনলি মাধবীর কথা?

-শুনলাম তো। তাই কি?

অবলাও এসে জোটে। সব শুনে বলে—আমি জানি।

মঞ্জরী বলে—কি জানিস?

—শ্রীমতীর মুখে হাসি নেই তো?

মঞ্জরী বলে—শুনলি তো? সবাই বুঝতে পেরেছে। পারবে না কেন? যে মেয়েটার সব সময় হাসি মুখ, তার হাসি মিলিয়ে গেলে সবার চোখে পড়ে। মায়ের কথা মনে পড়ছে, তাই না?

শ্রীমতী ব্যথিত কণ্ঠে বলে—মায়ের কথা ভেবে কত কাঁদি, তোমাদের চোখের আড়ালে। গুরুদেবের কাছে মায়ের প্রসঙ্গে বললে, তিনি চুপ করে থাকেন। আমার মনে হয়, মায়ের অনাহারে মৃত্যু হয়েছে।

অবলা বলে—আজকে গম্ভীর অন্য কারণে। সেটা হল ওকে আমাদের সঙ্গে আজকের অনুষ্ঠানে পাঠানো হয়নি বলে।

শ্রীমতী বলে—তার জন্য আমার বিন্দুমাত্রও দুঃখ নেই।

–তবে?

শ্রীমতী বলে—তোমরা একটা কথা ভেবে দেখেছ?

মাধবী বলে—কোন কথা?

–তোমাদের এই বয়স চিরকাল থাকবে না, যৌবনও থাকবে না। তখন তোমরা কি করবে? কণ্ঠস্বরও থাকবে না। স্থবির হয়ে পড়বে। তখন কি করবে?

–কিছু না হই, ভবানীদিদি হব।

—এত মন্দির রয়েছে মহানগরীতে দেবদাসীও অনেক। সবার ভবানীদিদি হওয়ার ভাগ্য থাকে না। ওঁর ভাগ্য ভালো, তাই মন্দিরে ঠাঁই পেয়েছেন।

মঞ্জরী বলে—এর জন্য তোর মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছে? তাহলে তো মৃত্যুর কথাও ভাবতে হয়।

—মৃত্যু তো ভালো। জরা বার্ধক্য থেকে নিষ্কৃতি দেয়। কিন্তু তার আগের অবস্থা?

-এই জন্য ভাবছিস? ভবিষতের উপর নির্ভর করতে হয়।

শ্রীমতী বলে—হ্যাঁ সবাই তাই করে। কিন্তু ব্যতিক্রমও দু-একজন আছেন, তাঁরা সাধারণ নন। তাঁরা দেবদাসীদের জীবনের শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা ভেবে আকুল হন।

মুক্তি এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। সে এবারে এসে শ্রীমতীর কাছে বসে বলে—তুই যেন কিছু একটা বলতে চাস্। আমরা যা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবি না, ভাবার চেষ্টা করি না, তুই তাই ভেবে বিমর্ষ। সত্যি কথাটা বল্।

–সত্যি কথা হল, নগরীর কোনো বিক্রয় কেন্দ্রের সামনের রাস্তায় জীর্ণ বসনে আবৃত হয়ে ভিক্ষা পাত্র নিয়ে বসতে ভালো লাগবে না তোমাদের

মঞ্জরী বলে—বেশ তো ছিলাম। তুই এই উদ্ভট কথা বলে মন খারাপ করে দিলি।

পরদিন মধ্যাহ্নের আহারের সময়, ভবানীদিদি পরিবেশন করছিল। ওরা সবাই প্রথমে প্রতিবাদ করেছিল। রান্না করাটা এই বয়সে যথেষ্ট পরিশ্রমের, তার ওপর পরিবেশন। ভবানী ওদের কথা মানেনি। বলল, আমি তো প্রত্যেকদিন পরিবেশন করছি না। তোমাদের এই ভাবে খাওয়াতে আমার ভালো লাগে, একটা তৃপ্তি পাই। ভাবি নিজের মেয়েদের খাওয়াচ্ছি।

ওদের সবার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকার পর পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে চায়।

ভবানী বলে—কি হল? খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল কেন?

অবলা বলে—ভবানী দি তোমাকে আমরা যদি মা’ বলে ডাকি তাহলে তোমার ভালো লাগবে?

ভবানীর চোখ ছলছল করে ওঠে। বলে—তাই কি হয়? আসলে তো আমি দেবদাসী। আমাদের ওকথা ভাবতে নেই। মন্দিরের বিগ্রহ আমাদের সব কিছু তিনি আমাদের পতি পুত্ৰ সব।

শ্রীমতী বলে—এতদিন শুদ্ধাচারে থেকেও নারীর চিরকালের গোপন ইচ্ছা কাটিয়ে উঠতে পারেনি?

—কেউ পারে? আমি শুধু তোমাদের আমার সন্তান বলে ভাবছি। যে নারী অনেক উঁচু পর্যায়ে চলে গিয়েছেন, তিনি জগত সংসারের সবাইকে সন্তানের মতো ভাবেন।

ভবানীর এই কথা শ্রীমতীর মনে নাড়া দেয়। সে ভাবে, গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির চিন্তা বোধহয় এই কারণেই। তিনি জানেন, দেবদাসীরা ভগবৎ প্রেমে আকুল হয়ে মন্দিরে ছুটে আসেনি। তাদের মধ্যে সাধারণ নারীর সব প্রবৃত্তিই রয়েছে। পৃথিবীতে অতি সামান্য সংখ্যক নারী-পুরুষ রয়েছেন যাঁদের ঈশ্বর প্রবলভাবে টানেন। তাঁরা সংসারে স্থির হয়ে থাকতে পারে না। সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। যেমন বুদ্ধদেব, মহাবীর।

শ্রীমতী মুখ হাত ধুয়ে এসে ভবানীকে প্রণাম করে। অন্যান্য মেয়েরা বিস্মিত। ভবানী বলে—একি করলে? না না, এটা ঠিক করলে না।

শ্রীমতী বলে—ঠিকই করেছি। তোমাকে তো মা বলে ডাকতে পারব না, দিদি বলেই ডাকব। কিন্তু আসলে তুমি আমাদের মা। নিজের মা বেঁচে আছেন কি না জানি না। বোধহয় নেই। অনেকের থেকেও নেই! এমন সুন্দর মাকে কে না পেতে চায়?

সবাই একে একে প্রণাম করে। আর এককালের দেবদাসী এবং এখনকার রাঁধুনির চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে।

শ্রীমতী এবারে বুঝতে পারে, গুরুদেব দেবদাসীদের জন্য কেন এতটা উতলা হয়েছেন। তিনি জানেন মন্দিরে মন্দিরে দেবদাসীর অভাব হবে না, কিন্তু এই ভাবে অভাবের তাড়নায়, কিংবা অন্য কোনো অত্যাচারের ভয়ে যে সমস্ত কুমারী মন্দিরে দেবদাসী হয়ে প্রবেশ করে তাদের অন্তরে কত সুপ্ত বাসনা থেকে যায়। তাদের কত গুণ সুপ্তই থেকে যায়, যা তারা পরিতৃপ্তির সঙ্গে ব্যবহার করলে কত সংসার সোনার হয়ে উঠত।

কিন্তু কে সেই মানুষ যার কথা বলতে গিয়েও গুরুদেবের বলা হল না? তিনি কি এই বিজয়নগরেরই কেউ? যাঁকে তিনি নির্বাচিত করে রেখেছেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি কি তরুণ না বয়স্ক? গুরুদেব কি তার নিরাপত্তার কথা ভেবে বয়স্ক কাউকে নির্বাচন করে রেখেছেন? না না সেটা কেমন হবে? গুরুদেব কি অতটা অবুঝ হবেন? মুক্তি, মঞ্জরীদের জন্য তিনি চেষ্টা করছেন। কিন্তু, তার বেলায় নির্বাচন করে রেখেছেন কেন? সে তো সবচেয়ে ছোট। ওদের চেয়ে পরে হলেও চলত। তাছাড়া মনকে একভাবে প্রস্তুত করে ফেলে হঠাৎ এই পরিবর্তন বড়ই পীড়াদায়ক। গুরুদেবের কাছে সে নানা বিষয়ে শিক্ষা পেত। এখন কিছু যদি ঘটে যায়, তাহলে শিক্ষার কি হবে? বন্ধ হয়ে যাবে? না না সেটা অসম্ভব। তার ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে গুরুদেবের পায়ে পড়ে প্রার্থনা করে যাতে তাকে এইসব থেকে নিষ্কৃতি দেন। সে দেবদাসীই থাকবে। পরে ভবানীদিদি হতেও সে রাজি। পথের ভিখারিণীও বরং হবে।

.

মহানবমীর শেষ দিনে রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গণে প্রধান অনুষ্ঠান হয়। মঞ্জরীরা সবাই গিয়েছে। সব মন্দিরের দেবদাসীদেরই যেতে হয়। গুরুদেব তাকে যেতে দেন না। এবারের শেষ দিনে সন্ধ্যার পরে মঞ্জরীরা আসে। তাদের হাবভাবে প্রতিদিনের সেই উচ্ছ্বলতার অভাব দেখা যায়। নিশ্চয় একটা কিছু ঘটেছে।

শ্রীমতী অবলাকে জিজ্ঞাসা করে—কি হয়েছে?

—তুই জানলি কি করে?

—আমি কিছুই জানি না। দেখছি তোমরা কেমন যেন মন-মরা। তাই জিজ্ঞাসা করলাম।

অবলা বলে-সরস্বতী মন্দিরের সরস্বতীকে চিনিস?

—না চিনে পারি? সবাই বলে, দেবদাসী সরস্বতীর প্রতিমাই যেন মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

—হ্যাঁ, তাকে তুলে নেওয়া হল অনুষ্ঠান থেকে

—তুলে নেওয়া হল মানে?

—রাজার চোখে পড়েছে। কয়েকজন রানী এসে তাকে অন্তঃপুরে নিয়ে গেলেন। সরস্বতী বুঝতে পেরে অচেতন হয়ে পড়েছিল। সেই অবস্থাতেই তাকে সযত্নে তুলে নিয়ে যাওয়া হল।

শ্রীমতীর বুকের ভেতরে ধক্ ধক্ করে। মুলের সেই পরমাসুন্দরী কৃষক কন্যার উক্তি মনে পড়ল—”ওখানে একবার প্রবেশ করলে বহির্গমনের পথ চিররুদ্ধ।”

মঞ্জরী বলে—তুই সরস্বতীর চেয়ে কম সুন্দরী নোস। গুরুদেব দূরদর্শী। তাই তোকে পাঠান না।

শ্রীমতী গুরুদেবকে মনে মনে প্রণাম করে। সে ঠিক করে গুরুদেব যাকেই নির্বাচন করুন সে কোনো কথা বলবে না। তার মঙ্গল গুরুদেবের চেয়ে আর কেউ বেশি বুঝবে না। তিনি যে মহাপুরুষ।

কদিন পরে রাজপুরী থেকে হেমাঙ্গিনী এল গুরুদেবের কাছে। অনেকক্ষণ একান্তে কথাবার্তা হল। তারপর চলে যাওয়ার সময় তাদের সঙ্গে দেখা করল।

মুক্তি বলে—সরস্বতী কেমন আছে হেমাঙ্গিনীদি?

গম্ভীর মুখে হেমাঙ্গিনী বলে—ভালো নেই।

–কেন?

—বুঝলে না? বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হলেন সমুদ্রের মতো। সেই সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ যদি আছড়ে পড়ে ক্ষীণকায়া তুঙ্গভদ্রার ওপর তাহলে কি দশা হয়? প্রথম দর্শনের পর সেই অবস্থা হয়েছে সরস্বতীর।

হেমাঙ্গিনী যেন চিত্র এঁকে দেখিয়ে দিয়ে গেল। সেই চিত্র দেখার পর এরা সবাই অসুস্থতা বোধ করল। রাতে কারও আহারে রুচি রইল না। ভবানীদি বলল-তোমরা কেউ খাচ্ছ না কেন? কি হয়েছে?

যে দয়াবতী শুধু সঙ্গীত নিয়েই থাকে সে আজ কাঁদতে কাঁদতে সব কথা বলে দিল। অবলা উঠে গিয়ে দয়াবতীর চোখ মুছিয়ে দিল। মুক্তি তাকে ধরে রাখল। সবাই জানে সঙ্গীত ছাড়া ও কিছু জানে না। গুরুদেবও ওকে ভিন্ন চোখে দেখেন। বলে থাকেন—দয়াবতীর কণ্ঠে মা সরস্বতীর ঠাঁই। আজ যেন সেই সরস্বতীর অমার্যাদা করা হয়েছে। তাই দয়াবতী সহ্য করতে পারেনি। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ।

ভবানীদি বলে—নারী সর্বংসহা। নীরবে সে নিজেকে ভস্মীভূত করে ফেলে। সরস্বতীরও সেই দশা হবে। তবে রাজা জানতে পারবেন না। শত শত রানীর মধ্যে জীবনে কয়জনের সঙ্গে একাধিকবার দেখা হয়? খুব কম। এমন বহু রানী রয়েছেন যিনি রাজার স্পর্শ পাননি। সরস্বতী অতটা ভাগ্য নিয়ে আসেনি পৃথিবীতে। তাছাড়া তার রূপ হল তার বৈরী। হরিণী যেমন নিজের সুস্বাদু মাংসের জন্য নিজের ধ্বংস ডেকে আনে ঠিক তেমনি। সরস্বতী-মন্দিরের পূজারী আমাদের গুরুদেবের মতো অতটা পরিনামদর্শী নয়। তাছাড়া তাঁর মতো দেবদাসীদের প্রতি মমত্ববোধ কাউকে দেখিনি।। অন্য সবাইকে তো দেখেছি এত বছরের মধ্যে।

.

বিজয়নগরের রাজার দশ লক্ষ স্থায়ী সেনাদল রয়েছে। তার মধ্যে পঁয়ত্রিশ হাজার সশস্ত্র অশ্বারোহী যারা প্রত্যেকেই নিয়মমতো বেতন পায়। এই সৈন্যদল একই জায়গায় থাকে এবং প্রয়োজন হলে যে কোনো সময়ে যে কোনো স্থানে এদের পাঠানো যেতে পারে। পঞ্চাশজন সেনাপতির অধীনে অশ্বারোহী সহ দেড়লক্ষ সৈন্য পাঠানো হয় এক এক দলে। তাঁর বহু সংখ্যক হস্তীও রয়েছে, যাদের দাঁতের সঙ্গে তরবারি বেঁধে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে এই বিপুল বাহিনীর ব্যয় কি করে সম্ভব হয়? রাজার রাজত্ব কত? আসলে এই সাম্রাজ্যে অনেক সামন্তরাজা রয়েছেন, যাঁরা মহানগরী, অন্য নগরী ছোট ছোট শহর এবং গ্রামগুলির দায়িত্বপ্রাপ্ত। এঁদের প্রত্যেকেই বিপুল রাজস্ব পান। প্রত্যেকের রাজস্ব অনুযায়ী রাজা ধার্য করে দেন কে কত পদাতিক, অশ্বারোহী বা হস্তী যুথ প্রতিপালন করবেন। এই বাহিনী সব সময় যে কোনো স্থানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। এই সেনানায়কগণ সবচেয়ে দক্ষ সেনাবাহিনী প্রদানের জন্য রীতিমতো পরিশ্রম করেন। এদের কুচকাওয়াজ অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন।

সৈন্যদল প্রতিপালন ছাড়াও রাজাকে তাঁদের বাৎসরিক অর্থ প্রদান করতে হয়। তবে রাজার একেবারে নিজস্ব যে বাহিনী রয়েছে, তাদের বেতন তাঁর অর্থ ভাণ্ডার থেকেই দেওয়া হয়।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের নিজস্ব মুদ্রার নাম “পারদাও” এই মুদ্রা শুধুমাত্র এই সাম্রাজ্যেই প্রচলিত। “পারদাও” একটি গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা যা ভারতবর্ষের অন্য কাথাও মুদ্রিত হয় না। এটির একদিকে দুটি প্রতিমূর্তি মুদ্রিত থাকে, অন্যদিকে সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজার নাম সমেত মূর্তি।

বিজয়নগরের উত্তর-পশ্চিমে এই নগরীর সঙ্গে যুক্ত কৃষ্ণপুর নামে আর একটি নগর রয়েছে, তাকে বলা যেতে পারে মন্দিরনগরী। এখানকার অধিবাসীরা সবাই পুরোহিত সম্প্রদায়ের। তারাই সেই নগরীর রাজস্ব ভোগ করে।

নগরীর দক্ষিণ দিকে সমতলভূমিতে নগলাপুর বলে আর একটি নগরী রয়েছে। দক্ষিণ দিকে আরও একটি নগরী রয়েছে। সেটি নাকি রাজা তাঁর এক রানীর প্রতি প্রেমের নিদর্শন রূপে নির্মাণ করেন। নগরীর নাম আবদোগেময়। রাজার রানীর নামও তাই।

হেমাঙ্গিনী একদিন এসে এইসব কথা বলছিল। এরা এমন কিছুই জানে না নগরীর ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে। কিন্তু যখন প্রেমের নিদর্শন রূপে নগরী নির্মাণের কথা শুনল তখন মাধবী মঞ্জরীরা হেসে ফেলল। তবু যদি সরস্বতীর ঘটনা না ঘটত। হাসিও পেত না। হেমাঙ্গিনী যেদিন ওদের মন্দির দেখিয়েছিল, সেদিন মন্দির গাত্রে কামার্ত নারী-পুরুষের মূর্তিগুলি সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করেনি। মঞ্জরী শুধু প্রশ্ন করে ফেলেছিল—এরা কারা? হেমাঙ্গিনী বলেছিল—দেবদেবী বা দেবদাসী নয় এটুকু নিশ্চয় বুঝেছ।

—তাহলে যাদের প্রতিমূর্তি দেবালয়ের গায়ে কেন?

-কারণ তাদের জন্যই এইসব দেবালয়, তারা দেশের সাধারণ নরনারী। তারা দেবতাও নয়, পশুও নয়। অথচ তাদের মধ্যে দেবত্ব আর পশুত্ব দুটোই রয়েছে। ঈশ্বর এই ভাবেই পৃথিবীর জীবজগতকে টিকিয়ে রেখেছেন।

সেদিন এরা হেমাঙ্গিনীর কথার মর্মার্থ অনুভব করেছিল। কিন্তু সরস্বতীর ঘটনার পরে তারা মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। সবচেয়ে অস্বস্তিদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে দয়াবতীর সঙ্গীত বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তিও বিচলিত।

অবশেষে সব কিছুর অবসান ঘটল হেমাঙ্গিনীর আনা একটি সংবাদ। রানী সরস্বতী বিষপান করে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। একটা স্তব্ধতা নেমে আসে মন্দিরে, বোধহয় সব মন্দিরেই। রাজপ্রাসাদের এই ধরনের সংবাদ সাধারণত এতটা প্রচারিত হয় না। রানীর তো শেষ নেই। তাঁদের মধ্যে এক আধজনের দু-চার বছরের মধ্যে মৃত্যুও ঘটে। কিন্তু সাধারণত অনেকে জানতে পারে না। কিন্তু সরস্বতীর ক্ষেত্রে এটি একটি সংবাদ। কারণ সে তার রূপের জন্য আগে থেকেই নগরবাসীর মধ্যে আলোচিত।

যে মঞ্জরী সর্বদা হাস্যময়ী, সেও গম্ভীর হয়ে শ্রীমতীর কাছে এসে বলে—তোর জন্য দুর্ভাবনা হচ্ছে। তোর রূপ আর সরস্বতীর রূপের মধ্যে কোনো তারতম্য নেই। গুরুদেব তোকে আড়াল করে রেখেছিলেন বলে তুই এখনো নিরাপদে আছিস। প্রাসাদ থেকে রাজপুরুষদের কেউ প্রয়োজনে এলে তোকে সামনে রাখা হয় না। রাজপরিবারের রানীরা বিগ্রহ দর্শনে এলে তোকে লুকিয়ে ফেলা হয় বলে তোর দিকে রাজা হাত বাড়াননি। কিন্তু কতদিন?

শ্রীমতী ম্লান হেসে বলে—অসুবিধা নেই। সরস্বতী পথ দেখিয়ে গিয়েছে। তবে আমার একটা দুঃখ থেকে যাবে। অনেক কিছু জানতে চেয়েছিলাম, শিখতে চেয়েছিলাম। এ জীবনে তা হবে না। সরস্বতীরও হয়তো কত ইচ্ছাই ছিল। মুদকলের সেই কৃষকের অসাধারণ রূপবতী কন্যা পারতল রাজার রানী হতে অস্বীকার করার সাহস পেয়েছিল একটি কারণে। কারণ সেই স্থানটি বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল না। ওটি ছিল কোনো সুলতানের অধীনে। রূপসী পারতলের পরে কি হয়েছিল, জানা যায় না। কখনই সে সাধারণ পরিবারের গৃহবধূ হয়নি। কেউ কেউ বলে শেষপর্যন্ত সুলতানের হারেমে ঠাঁই হয়েছিল কিনা কে জানে? রূপসী নারী হয়ে জন্মানো একটা অভিশাপ। অথচ ঈশ্বর সশরীরে সম্মুখে এসে যদি জিজ্ঞাসা করেন—তুমি কি হতে চাও? সাধারণ না রূপসী? তাহলে?

মঞ্জরী বলে—তুই এত গভীরভাবে চিন্তা করিস?

.

রাজপ্রাসাদের বিশাল সীমানার মধ্যে চারহাজার নারী রয়েছে। এদের কেউ কেউ নর্তকী অন্যেরা বহনকারিনী। এরা রানীদের তাদের কাঁধে করে বহন করে। তারা রাজাকেও বহন করে। কারণ প্রাসাদ-সীমানায় অট্টালিকাগুলির মধ্যে দূরত্ব অনেকখানি। রাজার নারী কুস্তিগীর রয়েছে, নারী জ্যোতিষী রয়েছে। রয়েছে নারী ভবিষ্যদবক্তা। প্রাসাদের অভ্যন্তরের জন্য প্রতিদিন বহু অর্থব্যয় হয়। সেইসবের হিসাব যে রাখে সে-ও একজন নারী। অন্যেরা রাজ্যের সমস্ত ইতিবৃত্ত লিপিবদ্ধ করে। সংগীত শিল্পীরা তো রয়েছেই। তারা বাদ্যযন্ত্র বাজায় ও গান গায়। রাজার রানীরাও অনেকে সংগীত বিষয়ে অভিজ্ঞ। কোনো মন্দিরে সুকণ্ঠী কোনো দেবদাসীর সন্ধান পেলে রানীরা অনতিবিলম্বে তাকে ডেকে পাঠান। এত করেও সময় তাঁদের কাটে না। এত ঐশ্বর্য অথচ মনে তৃপ্তি নেই। রানীরা যেন অন্য জগতের প্রাণী। তাঁরা যেন স্বয়ম্ভূ, তাঁদের পিতা-মাতা থাকতে নেই, ভ্রাতা-ভগিনী থাকতে নেই। তাই সরস্বতীর মতো আকস্মিক কোনো মৃত্যুও মাঝে মাঝে ঘটে যায়।

রাজা তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ একবার ছাড়া দ্বিতীয়বার ব্যবহার করেন না। একজন কর্মচারি রয়েছে যে এগুলির হিসাব রাখে। তাঁর পোশাক অতি সূক্ষ্ম রেশম দিয়ে প্রস্তুত, তাতে সোনার বুনুনি রয়েছে। রাজার শিরোভূষণে বুটির কাজ করা এবং অত্যন্ত মূল্যবান। অথচ মাথা থেকে একবার খুললে আর পরেন না।

গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি একদিন শ্রীমতীকে এইসব কথা বলতে বলতে বলেন-শক্তিশালী মুসলমান সাম্রাজ্যকে অগ্রাহ্য করে এত বড় যে হিন্দুসাম্রাজ্য পাশাপাশি গড়ে উঠল তার আয়ুষ্কাল কতদিন জানি না।

শ্রীমতী বলে—আপনার বিবরণ শুনে মনে হয়, বড় বেশি অপব্যয় হয়।

—ঐশ্বর্য থাকলে অপব্যয় হয়ে থাকে। তাকে খুব আসে যায় না। বরং এইভাবে প্রকাশ ঘটলে প্রজারা আর বহিরাগত ব্যক্তিরা মুগ্ধ হয়। প্রজারা গর্ব বোধ করে। এখনকার রাজার কিছু দোষ থাকলেও, তাঁর সময়ে এই সাম্রাজ্যের কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের আগে রাজার নিদ্রাভঙ্গ হয়। অশ্ব প্রস্তুত থাকে। সেই অশ্ব নিয়ে রাজপথ ধরে বিদ্যুৎগতিতে তিনি বহুদূর চলে যান। গ্রামের মধ্যে গিয়ে সাধারণ মানুষদের সঙ্গে মিশে তাদের সুবিধা অসুবিধার খোঁজ নেন। যথাসময়ে রাজসভায় প্রবেশ করেন। দুপুরে সামান্য বিশ্রাম। পরিশ্রম না করলে কারও চেহারা অত সুন্দর হয় না।

শ্রীমতী বলে ফেলে—তবু সরস্বতীর মতো নারীর মৃত্যু ঘটে যায়।

ক্রিয়াশক্তি একটু থেমে যান। তারপর বলেন—হ্যাঁ, তাও হয়। কিন্তু কেন হয়, সেটা তোমার এই বয়সে আমি বলতে পারব না। হেমাঙ্গিনীকে বলে রাখব। দুই বছর পরে শুনে নিও।

—আমি এখনই সবকিছু বুঝতে পারি।

—জানি, তবু বলব না। বুদ্ধিমতী হলেও তোমার মন অপরিণত। তাছাড়া আর একজনকে বলে রাখব যে তোমার সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবে।

—কে সে? ভবানীদিদি?

–না, সে একজন তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন পুরুষ।

—পুরুষ? কোনো পুরুষ তো এখানে আসেন না। শুধু রাজার সভার কয়েকজন মাঝে মাঝে আসেন। শুনেছি সব মন্দিরই তাঁরা পরিদর্শন করেন।

গুরুদেব বলেন, তাদেরই একজন।

সেইদিন থেকে শ্রীমতী মন্দির পরিদর্শন করে যাওয়া পুরুষদের মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করে। এঁরা যখন আসেন তখনও গুরুদেব তাকে এবং মঞ্জরীকেও কোনো কাজের অছিলায় সরিয়ে নেন। এতে মঞ্জরীর খুব গর্ব। সে বলে—আমিও তাহলে সুন্দরী, তাই না রে?

—তুই অসুন্দর কে বলল?

—কেউ বলেনি, তবে আমার ধারণা, আমাকে দেখতে কচি কচি লাগে বলে বোধহয় সামনে আসতে দেন না।

শ্রীমতী মঞ্জরীর কথায় মনোযোগ না দিয়ে মুখগুলো একে একে মনের মধ্যে আনার চেষ্টা করে। এঁদের মধ্যে প্রবীণ ব্যক্তিও দুতিন জন রয়েছেন। শ্রীমতী তাঁদের কথা মাথায় রাখে না।

মাধবীর খুব অভিমান হয় গুরুদেবের উপর। কারণ তাকে সবার সামনে আসতে নিষেধ করেননি তিনি।

সে বলে—আমি তো কুৎসিত। তাই আমাকে ওঁদের সঙ্গে নিয়ে মন্দিরের এটা ওটা দেখাতে বলা হয়। শ্রীমতীদের লুকিয়ে রাখা হয় কেন? এঁরা তো রাজা নন।

দয়াময়ী বলে—রাজা না হলেও ওঁদের কারও কারও ওপর রাজার নির্দেশ থাকতে পারে সুন্দরীর সন্ধান তাঁকে জানাতে। সবাই চুপ করে যায়।

মুক্তি হঠাৎ মন্তব্য করে—ওদের মধ্যে কটা কটা চুলের ওই মানুষটাকে আমার খুব ভালো লাগে।

মাধবী চেঁচিয়ে ওঠে—এ্যাঁ! পছন্দ?

লজ্জায় মুক্তির মরতে ইচ্ছে করে। তবু সে আমতা আমতা করে যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করে বলে—তুই সাধারণ একটা কথার এমন বিশ্রী অর্থ করিস যে কিছুই বলা যায় না।

সবার মুচকি হাসির মধ্যে মাধবী বলে—কোন অর্থ করেছি? তুই পছন্দের কথা বললি বলে অবাক হয়েছিলাম। তুই না দেবদাসী? তোর আবার পছন্দ-অপছন্দ কি?

দয়াবতী বলে—তা থাকতেই পারে। আমার যেমন লাল গরু খুব পছন্দের।

মঞ্জরী বলে—আমার কালো গরু।

শ্রীমতী টিপ্পনি কাটে—যাঁরা আসেন তাঁরা সব তাহলে গরু।

সবাই খিল্‌ খিল্‌ করে হেসে ওঠে।

সেই সময় ভবানী ওখান দিয়ে যাচ্ছিল, একটু থেমে জিজ্ঞাসা করে—এত হাসি কিসের?

অবলা বলে—বাঁচতে হলে হাসির দরকার ভবানীদি। তাই আমরা হাসি আবিষ্কার করি।

ভবানী বলে—ঠিকই বলেছ। আরও আবিষ্কার কর। আমার সেই সব দিন চলে গিয়েছে। আমি শান্তিতেই আছি। তোমরাও শান্তি পাবে একসময়।

অবলা বলে—হ্যাঁ, সরস্বতীর মতো।

—শুধু সরস্বতী বা অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে পৃথিবী নয়।

ওরা যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করল না। ভবানী আজ পনীর দিয়ে কিছু করবে কথা আছে, বিরক্ত না করাই ভালো।

অবসর মতো শ্রীমতী আবার ভাবতে বসে, কে হতে পারে সেই পুরুষটি। সে মঞ্জরীকে বলে—হাসাহাসি করলেও আমরা মুক্তিকে দোষ দিতে পারি না। মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকতেই পারে। পছন্দ হলে যে বিয়ে করতে হবে এমন কথা নেই। তাছাড়া আমরা দেবদাসী, এ কথা ভুললে চলবে না। আমি যদি তোমাকে প্রশ্ন করি, তোমার পছন্দের কোনো ব্যক্তির কথা নিশ্চয় তার উত্তর দেবে।

—দেব না কেন? পছন্দ করা মানে ভালোবাসা নয়।

–কে তোমার পছন্দের?

-আমার সব সময় রূপের দিকে ঝোঁক। কারণ আমি অতটা রূপসী না হলেও আমার মা রূপসী, বাবা রূপবান ছিলেন। এখানে যে মানুষটি সবচেয়ে রূপবান, তাঁর বয়স সামান্য বেশি হলেও আমার ভালো লাগে।

—বয়স কম-বেশির কথা আমি বলিনি।

মঞ্জরী হেসে বলে—এবারে তোর কথা শুনি।

শ্রীমতী হেসে বলে—আমি তো ছোট, আমার এসব কথা বলতে নেই। গুরুদেব রাগ করবে।

মঞ্জরী হেসে লুটিয়ে পড়ে। ছুটে অন্যদের কাছে যায়। সব দেবদাসী এসে উপস্থিত হয়। একজন বলে দেখি গাল টিপলে দুধ বেরোয় কি না? আর একজন বলে—একটু হাঁটো তো খুখু। হাঁটি হাঁটি পা-পা।

অবলা গম্ভীর হয়ে বলে—ওসব কথা থাক্। এখন তোর পছন্দের কথা বল। —আমি একজনকে দেখেছি তার দৃষ্টি অন্তর্ভেদী।

—অন্তর্ভেদী? তুই তো সামনে ছিলি না। তোর অন্তর কি করে ভেদ করল রে?

—দূর থেকেই বোঝা যায়, তোমাদের হাবভাব দেখেও বুঝেছি। আমার ধারণা, তাঁর দৃষ্টির মধ্যে একটু স্বপ্নও ছিল।

অবলার মতো রাশভারী মেয়েও মেঝেতে বসে পড়ে দুহাতে দিয়ে মাথা চেপে ধরে বলে—বাবাঃ। এত বুঝে ফেললি?

—হ্যাঁ। রূপ কিংবা সোনালি চুল সাদা চোখেই দেখা যায়। কিন্তু আমার— মাধবী ওর কথা কেড়ে নিয়ে বলে—তোর দেখা অন্তর দিয়ে দেখা, যেমন পার্বতী শিবের দিকে দেখেন, যেমন রাধা কৃষ্ণকে দেখেন।

শ্রীমতীর মুখ লাল হয়ে ওঠে রাগে। সে বলে—আমারই দোষ। আমি সোজাসুজি বলতে পারিনা। কেন জানি না।

দয়াবতী তার পিঠে হাত রেখে বলে—তোর কোনো দোষ নেই। আসলে তুই সবার চেয়ে একটু আলাদা।

মাধবী বলে ওঠে—তোর রূপ—

দয়াবতী বলে—না, শুধু রূপ নয়, ওর মনও। আর সেই মনের গভীরতাও বটে।

মঞ্জরী বলে—তা ঠিক। ও সব বিষয়ে চিন্তা করে।

মুক্তি বলে ওঠে—আহা, ওই মনের গভীরে যে পুরুষ ডুব দেবে, তার কী শান্তি।

দয়াবতী বলে ওঠে—না, এই প্রসঙ্গ বাদ দিতে হবে। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে দেখে আয় ভবানীদি পনীর দিয়ে কি করছে।

—উনি পছন্দ করেন না। পরিবেশন করার পর মুখে দিয়ে সবার চোখে মুখে যদি পরিতৃপ্তির রেখা ফুটে ওঠে, তাহলে ওঁর মন জুড়িয়ে যায়।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *