বিজনের রক্তমাংস
পঞ্চাশের দশকে ‘বিজনের রক্তমাংস’ নামে এক তরুণ লেখকের একটি গল্প খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
এই রচনার সঙ্গে সেই গল্পের কোনও সম্পর্ক নেই।
এই রচনা যে বিজনকে নিয়ে সে আমার ছোট ভাই। বিজনের কথা আমি মাঝে মধ্যেই লিখি। আপনারা অনেকেই তাকে চেনেন।
বিজন হল সেই ব্যক্তি যে একবার নিউ মার্কেটে মাংস কিনতে গিয়ে শুধু পেঁয়াজ আর আলু কিনে, মাংসের খালি থলে হাতে ফিরে এসেছিল। ‘মাংস কী হল’ জানতে চাওয়ার সে বলেছিল ‘মাংস নেই। পাঁঠারা স্ট্রাইক করেছে।’ অনেক রকম জেরা করার পর অবশেষে জানা যায়, পাঁঠা-খাসি নয়, স্ট্রাইক করেছে নিউ মার্কেটের মাংসের দোকানিরা, পুরসভা নতুন কী বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তারই প্রতিবাদে।
চিনতে পারছেন বিজনকে?
এই বিজনকেই বেড়ালে কামড়ে দিয়েছিল। তখন তার দশ বছর বয়েস, ফোর না ফাইভে পড়ে। ইস্কুলের হোমটাস্কে ছিল বেড়াল-এর ওপরে রচনা লেখার কাজ।
যেহেতু বেড়ালের ওপর রচনা লিখতে দিয়েছে, তাই খাতায় না লিখে একটা হুলো বেড়ালকে কোলের ওপর চিত করে শুইয়ে বিজন সেই হুলোর পেটের ওপরে রচনা লিখছিল। রচনাটির প্রথম পংক্তি ‘আমি বিড়াল ভালবাসি’ লেখার আগেই বুড়ো হুলোটি হঠাৎ খ্যাঁক করে বিজনের হাতে কামড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।
বিজন সমগ্র লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। আমি অতটা পারব না। তা ছাড়া এখানে ওখানে বিজনের নাম উল্লেখ না করে সেসব গল্প অনেকবার অনেক রকম করে লিখেছি।
আপাতত বিশদ গল্পে যাচ্ছি না।
প্রথমে বিজনের বুদ্ধির একটা নমুনা পেশ করছি।
বিজন একদিন বাজার থেকে বেশ বড় একটা এঁচোড় নিয়ে এসেছে। ঠিক বঙ্গীয় এঁচোড় নয়, সুবৃহৎ মাদ্রাজি কাঁচা কাঁঠাল, তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে যেগুলো গ্রীষ্মকালে কলকাতায় চালান আসে। আকারে বড় হলেও তরকারি হিসেবে বাংলা এঁচোড়ের মতো উপাদেয় নয়।
বিজনের বউদি, মানে আমার স্ত্রী মিনতি, এই এঁচোড় দেখে বেশ একটু রাগারাগি করলেন, তার সঙ্গে সঙ্গত করলেন আমাদের কাজের মেয়ে কানন। তিনি কাঁঠালটা সিকি পরিমাণ কুটে আর কুটলেন না, দেখালেন ভেতরটা পেকে হলুদ হয়ে এসেছে, বললেন, ‘পাকা কাঁঠাল দিয়ে এঁচোড়ের ডালনা হবে কী করে?’
যেটুকু কোটা হয়েছিল তাই দিয়েই অল্প করে এঁচোড়ের তরকারি করা হল। বাকি অংশ বিজন দখল নিল। সে একটু শুঁকে আমাদেরও শুঁকতে দিল। হলুদ হয়ে আসা কোয়াগুলোতে পাকা কাঁঠালের অল্প ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। বিজন আমাদের বলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা আছে না, কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো?’ আমি কবুল করলাম, ‘হ্যাঁ তা আছে।’
বিজন তখন একটা চটের থলের মধ্যে কাঁঠালটা ঢুকিয়ে মশলা বাটা নোড়া দিয়ে ধীরে ধীরে পেটাতে লাগল। বিজনের কলাকৌশলে সেদিন দুপুরে এঁচোড়ের তরকারি ছাড়াও ওই একটা কাঁঠালের কোয়া আমরা বিকেলে মুড়ি দিয়ে খেলাম। পিটিয়ে নরম হয়েছে কোয়াগুলো, কিন্তু কেমন যেন ছিবড়ে ছিবড়ে, তা ছাড়া পানসেও বটে মিষ্টি কম।
কী আর করব, কনিষ্ঠ সহোদরের অনুরোধে ওই কাঁঠাল তিন কোয়া খেলাম। কিন্তু শতাধিক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল রাতের ভোজনের জন্যে।
রাতে ডালের সঙ্গে সাধারণত ভাজা কিছু থাকে না। কিন্তু সেদিন ছিল। কাঁঠালের বিচি ভাজা। দুপুরে যে এঁচোড়ের ডালনা খেয়েছি, বিকেলে যে কাঁঠালের কোয়া খেয়েছি তারই বিচি ভাজা। কাঁচা কাঁঠালের বিচি, তাই ভাজার মধ্যে একটু কষা স্বাদ, কিন্তু খেতে খারাপ লাগল না। ডালের সঙ্গে ভাত মেখে মুচ মুচ করে খেলাম।
ব্যাপারটা আমাকে এত চমকিত করে ফেলল যে বর্ণনা করা কঠিন। একই কাঁঠালের দুপুরে তরকারি, বিকেলে পাকা কোয়া, রাতে বিচি ভাজা—একই দিনে শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য। অভিভূত অবস্থায় সাতদিনের মধ্যে এই বিষয়ে একটা উপন্যাস রচনা করেছিলাম। বিশ্বাস না হয়, আমার লেখা নতুন উপন্যাস ‘সর্বনাশ’ পড়ে দেখবেন।