বিছে মানুষের দাঁড়া

বিছে মানুষের দাঁড়া

৷৷ ১ ৷৷

ক্যানভাসের চাদরে মোড়া জিপে ড্রাইভারের পিছনের আসনে পাশাপাশি বসে ছিল সুদীপ্ত, হেরম্যান আর ডক্টর বার্টন। গতকাল রাতেই সুদীপ্তরা সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াধ থেকে এই ছোট্ট মরুশহর আলিঘাইতে এসে পৌঁছেছে। বার্টন অবশ্য অভিযানের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য আরও দিন সাতেক আগেই ঘাঁটি গেড়েছিলেন এখানে। সকালবেলা তার সাথে বেরিয়ে পড়েছে তারা। সবে মাত্র বেলা সাড়ে সাতটা বাজে, কিন্তু এর মধ্যেই উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে বাইরে তাকালে চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে! মসৃণ রাস্তা এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। চারদিকে শুধু বালি আর বালি! রাস্তার একপাশে অবশ্য দূরে দূরে মাঝে মাঝে কিছু ছিরিছাঁদহীন ঘর বাড়ি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু অন্য দিকে শুধু ধু-ধু অন্তহীন মরু সমুদ্র আরবের বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত ‘রাব-আল-খালি’ মরুভূমি ! যেদিকে তাকিয়ে বার্টন বললেন, ‘আমরা যারা প্যালিয়েন্টোলজিস্ট’ বা ‘জীবাশ্মবিদ’ তাদের কাছে এই মরুভূমি অঞ্চল হল স্বর্ণখনি। আরব মরুভূমি, সাহারা, গোবি-এ সব জায়গা হল জীবাশ্মের ভাণ্ডার। ভাবতে পারেন, আজ যেখানে আপনারা মরুভূমি দেখছেন সেখানেই লক্ষ-কোটি বছর আগে ছিল মহাসমুদ্র অথবা জলা ভূমি ! কত আদিম প্রাণীর বাসস্থান ছিল এই মরু অঞ্চল। এককোষী প্রাণী থেকে বিশাল বপুর ডাইনোসরেরা ঘুরে বেড়াত এখানে। তারপর লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চলল ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন। যেখানে ছিল মহাসমুদ্র সেখানে মাথা তুলে দাঁড়াল উত্তুঙ্গ পর্বত অথবা তা ঢেকে গেল বালিতে। কিছু জীব এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে বিবর্তনের ধারায় টিকে গেল, আর কিছু জীব চিরতরে হারিয়ে গেল পৃথিবীর বুক থেকে। না, তবে তারা ঠিক হারায়নি। তাদের দেখা মেলে বালি সমুদ্রর নিচে ফসিল বা জীবাশ্ম রূপে। সারা জীবনতো তাদেরই খোঁজে ঘুরেছি আমি। দেখি শেষ জীবনে যদি বড় কোনো কিছু একটা আবিষ্কার করতে পারি?”

তার কথা শুনে হেরম্যান হেসে বললেন, “আমাদের পক্ষ থেকে সহযোগিতার কোনো অভাব হবে না এটুকু কথা দিতে পারি।’

সুদীপ্ত বলল, ‘আর, আপনার কাজের সাথে আমাদের কাজের বেশ কিছুটা মিল আছে । আপনি জীবাশ্মের সন্ধান করেন আর আমরা জীবন্ত জীবাশ্মর। আপনি যাচ্ছেন কাঁকড়াবিছের দানব পূর্বপুরুষ ইউরিপ্লুটেরাস-এর ফসিল খুঁজতে, আর আমাদের উদ্দেশ্য মরুভূমির লোক-কথায় বর্ণিত সেই দানব কাঁকড়াবিছের সন্ধান করা।

বার্টন বললেন, ‘দেখা যাক আমাদের মনস্কামনা কতটা পূর্ণ হয়। এবং আমাদের এই অভিযানের সফলতা অনেকাংশেই নির্ভর করবে আমাদের পরিশ্রম, সাহস ও কষ্টসহিষ্ণুতার ওপর। এছাড়া কাজের প্রতি একাগ্রতা, ভালোবাসা এসব ব্যাপারতো আছেই । ইন্টারনেটে যখন আমি আমার এই অভিযানের সঙ্গী খোঁজার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম তখন সে ডাকে বেশ কিছু সাড়া মিলেছিল। তাদের মধ্যে কেউ ভূ-তাত্ত্বিক, কেউ জীববিদ, কেউ বা নিছক অ্যাডভেঞ্চারিস্ট, কিন্তু তাদের মধ্যে ক্রিপ্টোজুলজিস্ট কেউ ছিলেন না। আপনাদের এ ব্যাপারটাই আপনাদের সম্বন্ধে প্রথমে আকৃষ্ট করে আমাকে। তারপর কথাবার্তা যত এগোল তত ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম এ অভিযানে আপনারাই আপনার উপযুক্ত সঙ্গী হতে পারেন।

হেরম্যান বললেন, “আপনার এই ভাবনার জন্য ধন্যবাদ। ‘ক্রিপ্টিড’ অর্থাৎ রূপকথা, লোককথা বা পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীর খোঁজে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে বেড়াবার কিছুটা অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। সে সব অভিযানে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে আমাদের। বেশ কয়েকবার তো মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। সে আমাদের ছুঁয়েও শেষ পর্যন্ত ছুঁতে পারেনি। তবু আমাদের অভিযান থেমে থাকেনি।’ এ কথা বলার পর একটু থেমে হেরম্যান তার উদ্দেশ্যে বললেন, তবে আপনার সঙ্গী হবার জন্য আপনি যে শর্তগুলো রেখেছিলেন তার মধ্যে একটা শর্ত কিন্তু বেশ মজার বলে মনে হয়েছিল আমার। ওই যে, অভিযাত্রীদের ভূত-প্রেত, ইত্যাদি অতিপ্রাকৃত ঘটনায় বিশ্বাসী হলে চলবে না। এই শর্তের কারণটা কি?

প্রৌঢ় জীবাশ্মবিজ্ঞানী ঠোঁটের কোণে আবছা হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘কারণ অবশ্যই আছে, সেটা যথা সময় জানতে পারবেন আপনারা।’

সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘এই মরু অঞ্চলের ঠিক কোন জায়গাতে যাব আমরা?”

বার্টন জবাব দিলেন, ‘সৌদি আরব, ওম্যান, আরব এমিরেটস আর ইয়েমেন এই চারদেশের মধ্যে প্রায় আড়াই লক্ষ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে এই মরুভূমি। আমরা যাব মরুভূমির হাজার দুই মাইল গভীরে মরুভূমির পশ্চিম ভাগের এক জায়গাতে। সেখানে সম্ভবত এক মৃত নগরী আছে। খ্রিস্টেরও জন্মের অনেক অনেক আগে গড়ে ওঠা নগরী। তবে নগরী বলতে ভাববেন না যে মিনার-গম্বুজ-বা কারুকাজ শোভিত নগরী। সে সময় মানুষের মনে ওই শিল্প ভাবনা জন্মায়নি। মরু অঞ্চলের আদি বাসিন্দারা তখন পাহাড়ের গায়ে খোপ কেটে, গুহা বা সুড়ঙ্গ নির্মাণ করে তার মধ্যে বসবাস করত। এ সব নগরীর ধ্বংসাবশেষ মরু অঞ্চলের কয়েক হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তবে সব সময় এদের দেখা যায় না। মরু বড় এদের বালিতে ঢেকে দেয়। যতদিন না আবার পালটা একটা ঝড় এসে সে বালি সরিয়ে দিচ্ছে ততক্ষণ আর চিহ্ন মেলে না তাদের। এমনও হয় যে কিছুদিনের জন্য সূর্যালোকে মুখ দেখিয়ে আবার হাজার বছরের জন্য চাপা পড়ে গেল সে নগরী। আর সাধারণত এ নগরীগুলো গড়ে উঠেছিল যেখানে মরুভূমির মধ্যে নদীখাত আছে সেখানে। আর ওই নদীখাতগুলোর স্তরে স্তরে পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রাণীর জীবাশ্ম। ছোট মোলস্কা থেকে শুরু করে ডাইনোসর পর্যন্ত। এমনকি ওই নগরীর গুহাগুলোতেও জীবাশ্মর সন্ধান মেলে।’

হেরম্যান বললেন ; আচ্ছা, মরুভূমির যাযাবর উপজাতিরা যে দানব বৃশ্চিকের গল্প বলে, যারা নাকি মানুষ টেনে নিয়ে যায় তাদের অস্তিত্ব কি থাকা সম্ভব?’ বার্টন মৃদু হেসে বললেন, ‘ইউরিপুটেরাস কিন্তু হিংস্র প্রকৃতির ছিল। খুনে ইউরেপুটেরাস। সেই দানব কাঁকড়া বিছে ইউরিপুটেরাস বাস করত প্রায় ষাট কোটি বছর আগে সিলুরিয়ান কালপর্বে। আকারে তাদের কেউ কেউ বিশ ফুটও ছিল। জল ছেড়ে যে সব প্রাণী প্রথমে ডাঙায় উঠে আসে তাদের মধ্যে সে অন্যতম। যে সব প্রাণী কোটি কোটি বছর ধরে একই রকম দৈহিক গড়ন নিয়ে এখনও টিকে আছে তাদের মধ্যেও কাঁকড়াবিছে অন্যতম। শুধু তার আকারটাই ছোট হয়ে গেছে। এর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। এরা দেহত্বকের ছিদ্র দিয়ে অক্সিজেন নেয়। এদের যখন প্রথম উৎপত্তি হয় সেই উদ্ভিদহীন পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমছিল। এদের দীর্ঘ দেহের অসংখ্য ছিদ্র ওই অক্সিজেন গ্রহণের জন্যই। তারপর ধীরে ধীরে পৃথিবীতে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে এদের আকারও ছোট হয়ে আসতে থাকে । তবে আপনি যদি জীবন্ত জীবাশ্ম সিলিকাস্থ মাছের কথা বলেন তবে বলাই যেতে পারে যে ষাট কোটি বছর আগে যে দানব কাঁকড়াবিছে শ্যাওলা মাড়িয়ে পৃথিবীর বুকে উঠে এসেছিল তাদের ওই দানবীয় আকারেই আজও পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা অসম্ভব নয়। শর্ত শুধু একটাই, যে জায়গাতে তার বাসস্থান তার পরিবেশ সেই ষাট কোটি বছর আগের মতোই হতে হবে। ‘দু’ কোটি বছরের প্রাচীন সিলিকাস্থ মাছ সমুদ্রতলে যেখানে বাস করে সেখানে জলের অন্যান্য বারো ডিগ্রি সেলসিয়াস, জলের চাপ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে পাঁচশো পাউন্ড। দু-কোটি বছরেও সেখানের পরিবেশের কোনো পরিবর্তন হয়নি বলেই তারা একই আকার নিয়ে বেঁচে আছে। ঠিক যেমন উদ্ভিদদের মধ্যে উত্তর ইউরোপের তুষারাবৃত অঞ্চলে জিংগো বাইলোবা’ নামে এক সপুষ্পক উদ্ভিদ তার উনিশ কোটি বছর আগের হুবহু চেহারা নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে সেখানকার পরিবেশ বদলায়নি বলে। সমুদ্রতল, তুষারাবৃত অঞ্চল ও মরুভূমিতে এখনও এমন বেশ কিছু জায়গা আছে যেখানে লক্ষ কোটি বছরেও পরিবেশের বদল ঘটেনি।’

হেরম্যান ও সুদীপ্ত দু-জনেই বেশ খুশি হলো বার্টনের কথা শুনে। হেরম্যান বললেন, “যখন ভিডিও কনফারেন্সে আমাদের প্রথম কথাবার্তা হয় তখন আমি ভেবেছিলাম যে আপনি হয়তো নিছক কৌতূহলবশত আমাদের সাথে যোগাযোগ করছেন। কারণ, অনেক পণ্ডিত মানুষরাও আমাদের নিয়ে পরিহাস করেন। অথচ জায়েন্ট স্কুইড বা দানব অক্টোপাস, ইন্দোনেশিয়ার কোমাডো ড্রাগন ইত্যাদি বেশ কিছু ক্রিপ্টিড বা একদা গল্পকথার প্রাণীদের আবিষ্কারের কৃতিত্ব কিন্তু আমাদের মতো ক্রিপ্টেজুলজিস্টদেরই।’

ডক্টর বার্টন নিজের অবিন্যস্ত চুলে হাত বুলিয়ে বললেন ; আমার যতই চেহারা সুঠাম দেখাক না কেন, বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। আমারও অভিজ্ঞতা কম হল না। জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে আমাদের অদেখা; অজানা বিষয়ের পরিমাণই বেশি। নিজে দেখিনি বা জানিনা বলে অন্যের বক্তব্যকে কখনও উড়িয়ে দিই না। তাকে যুক্তি দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করি। এই দেখুননা ‘টিরানোসেরাস রেক্স’। সে কথার অর্থই হল যে ‘যে রাজার পদভারে মেদিনী কাঁপে।’ সেই পঁয়তাল্লিশ ফুট লম্বা, সাত টন ওজনের ডাইনোসরের মতো কোনো প্রাণী যে হতে পারে তা এক সময় জীববিজ্ঞানীদের কল্পনাতেও ছিল না। তা বলে কি তারা পৃথিবীর বুকে এক সময় দাপিয়ে বেড়ায়নি। জীবাশ্মবিদরা মাটির গহ্বর থেকে তুলে এনেছেন তাদের আস্ত কাঠামো এবং যত বড় বড় জীবাশ্মর সন্ধান পাওয়া গেছে তার সিংহভাগ কিন্তু মিলেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মরু সম্বল থেকে।’ পিচ ঢালা মসৃণ রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়িটা। সুদীপ্ত এরপর জানতে চাইল ; ‘এই মরু অঞ্চলগুলোই জীবাশ্মের আঁতুড়ঘর কেন ?

ডক্টর রার্টন বললেন, ‘ব্যাপারটা আপনাকে বুঝিয়ে বলি। ধরুন কোনো প্রাণীর মৃত্যু হলো। তার মাংস প্রথমে খেয়ে নিল শেয়াল-কুকুর-ি – চিল- [-শুকুন জাতীয় পশু পাখিরা। অথবা বাতাসের জীবাণুর প্রভাবে তাদের চামড়া-মাংস গলে পচে যাবে। পড়ে থাকবে শুধু হাড়ের কাঠামো। সেই হাড়গুলোও আবার এক সময় রোদ, বৃষ্টির প্রভাবে অস্থিচূর্ণে পরিণত হয়ে মিশে যায় মাটিতে। জীবাশ্ম তৈরির প্রাথমিক শর্তই হল তার ওপর বেশি সময় রোদ-ঝড়-বৃষ্টি পড়বে না। তা ঢেকে যাবে খুব দ্রুত। ঠিক এই রকম পরিবেশ মিলবার সম্ভাবনা থাকে মরুভূমি আর তুষারাবৃত অঞ্চলে। সেখানে জীব বা উদ্ভিদদেহ অনেক সময় লক্ষ কোটি বছর ধরে চাপা পড়ে থাকে বালি বা তুষারের নিচে। বালির স্তরের ওপর বিভিন্ন যুগে আরও বালি চাপা পড়ে, তুষারের ওপর আরও তুষার। অথবা নিচের কোনো স্তর হয়তো পরিণত হয় পাথরে, অথবা বালির ওপর মাটি বা পাথরের আবরণ তৈরি হয়। কিন্তু সময় প্রতিস্তরে তার সাক্ষ্য রেখে যায় ওইসব জীবাশ্মর মাধ্যমে। এটা অনেকটা সাজানো কেকের মতো। বাইরে থেকে বোঝা যায় না তার ভিতরে কী কী আছে। কিন্তু কেকটাকে ছুরি দিয়ে কাটলেই যেমন তার বিভিন্ন স্তরে ফল ইত্যাদি দেখা যায়, তেমনই এই মরুভূমির নিচে বিভিন্ন স্তরে তাদের প্রাচীনতা অনুসারে বিভিন্ন যুগের প্রাণীদের ফাসিল পাওয়া যায়। আমরা যে জায়গাতে অভিযান চালাব সে জায়গাতে প্রায় ষাট কোটি বছর আগে সমুদ্র খাড়ি ছিল। যদিও এখন সমুদ্র অনেক দূরে সড়ে গেছে তবে নিশ্চিতভাবে বালির নিচে মাটির গভীরে সেখানে দেখা মেলে বিভিন্ন প্রাণীর ফসিল। ষাট কোটি বছর আগে যে প্রাণী প্রথম জল ছেড়ে ডাঙায় উঠে এসেছিল সেই মহাবৃশ্চিকের ফসিল সংগ্রহ করতে চাই আমি। ইতিপূর্বে তার যে ফসিল উদ্ধার হয়েছে তা আকারে নফুট। তারও দশকোটি বছর আগে তারা যখন প্রায় কুড়ি ফুট ছিল, তেমনই এক ফসিল সংগ্রহ করতে চাই আমি।

হেরম্যান বললেন, ‘মরু অঞ্চলে যে সব যাযাবর গোষ্ঠী ও জায়গাতে ঘুরে বেড়ায় তারা যখন কোনো কারণে সভ্য পৃথিবীতে আসে তখন কিন্তু তারা বহুবার বলেছে যে তারা চাক্ষুস করেছে সেই দানব বৃশ্চিককে। বিশেষত মরুভূমির যে সব জায়গাতে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন দেখা যায় সেই সব জায়গা নাকি তাদের বাসস্থান। এমন কী দলছুট মানুষকে তাদের দাঁড়ার আঘাতে কোমর থেকে দু-টুকরো করে মাটির গভীরেও নাকি টেনে নিয়েছে তারা। সভ্য পৃথিবীর মানুষ অবশ্য ব্যাপারটাকে অশিক্ষিত মরু যাযাবরদের কল্পনা বলে ভাবে। ঠিক যেমন ইন্দোনেশিয়ার ধীবর সম্প্রদায়ের লোকরা বহুদিন ধরে কমোডো ড্রাগনের কথা বললেও সভ্য পৃথিবীর মানুষরা হেসে উড়িয়ে দিত তাদের কথা।

অথচ্ কমেডো ড্রাগন ছিল এবং এখনও আছে। বার্টন বললেন, ‘আমি এর আগে ‘রাব-আল-খালি’তে অভিযান না করলেও আমার বাসস্থান লন্ডনে বসে দীর্ঘদিন ধরে এ তল্লাটের খোঁজ খবর রাখি আমার পেশাগত কারণে। ঠিক যেমন হেরম্যান আপনি জার্মানিতে বসে বা সুদীপ্ত আপনি ইন্ডিয়াতে থেকে সারা পৃথিবীর খবরাখবর রাখার চেষ্টা করেন ক্রিপ্টিডের খোঁজ পাবার জন্য। রাব-আল-খালিতে বেশ কিছু পর্যটক ওই সব প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষের পাথুরে দেওয়ালের গায়ে দানব বৃশ্চিকের ছবি দেখেছে। হতে পারে সেগুলো আসলে ছবি নয় ফসিল।’

সুদীপ্ত জানতে চাইল, “ফসিল কেন?’

বার্টন বললেন, “তাহলে আপনাকে একটা ছোট্ট গল্প বলি। আব্রাহাম বলে এক মার্কিন প্রত্নবিদ একবার এক অভিযান চালিয়েছিলেন গোবি মরুভূমিতে সেখানে তিনি এক হারানো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান। যার পাথরের দেওয়ালে তিনি খুঁজে পান বিভিন্ন অদ্ভুত দর্শন পশুপাখির মূর্তি। তেমনই এক ভাস্কর্যকে তিনি দেওয়াল থেকে অনেক কষ্টে খুলে উটের পিঠে চাপিয়ে হাজির করেন বিজ্ঞানীদের সামনে। জীব বিজ্ঞানীরা সেটা দেখে বুঝতে পারেন যে সেটা পাথর খোদিত ভাস্কর্য নয় সেটা আসলে জুরাসিক যুগের হংসচঞ্চু ডাইনোসর বা ট্রাকোডনের ফসিল। কারণ ইতিপূর্বেই ১৯০৮ সালে স্টানবার্গ নামে এক জীবাশ্ম বিজ্ঞানী আমেরিকার কেনসাসের কাছে বালি খুঁড়ে চামড়া শুদ্ধ এক ট্রাকোডনের জীবাশ্ম উদ্ধার করেছিলেন। প্রাচীন মানুষের যেসব পাথুরে অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন সেসব অঞ্চলে পাথরের বুকে জীবাশ্ম থাকা আশ্চর্য নয়। সমস্যা হল এ সব প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ একবার দেখে আসার পর আবার সেখানে গেলে প্রায়শই খুঁজে পাওয়া যায় না। মরুঝড় ঢেকে দেয় তাদের। তাছাড়া যেসব মরু যাযাবররা মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ায় তারা ওসব জায়গাকে শয়তানের বাসস্থান বলে মনে করে। ওই সব জায়গাগুলোকে তারা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে, কাউকে তারা পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে চায় না সেখানে। ঠিক যেমন আমরা যে জায়গাতে যাব তার নাম মরু যাযাবরদের কাছে শয়তানের কবর।’ স্বয়ং শয়তান নাকি ঘুমিয়ে আছেন সেই মৃতনগরীতে! কেউ কেউ বলে তিনি নাকি দানব বৃশ্চিকদের দেবতা।’

সুদীপ্ত প্রশ্ন করল, “ওই মৃত নগরীতে আমরা পৌঁছব কি ভাবে?’

বার্টন বললেন, ‘ওই অঞ্চলে প্রায় পাঁচশো বর্গ মাইল অঞ্চল জুড়ে প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে আছে। তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ওই মৃতনগরী। এক ইউরোপীয় পর্যটক বহুকাল আগে ও অঞ্চলে গেছিলেন। তাঁর হাতে আঁকা মানচিত্রর একটা প্রতিলিপি আমি সংগ্রহ করেছি লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে। স্যাটেলাইট মানচিত্রে একবার ধরা পড়েছিল ওই অঞ্চলের ছবি। সে ছবিও আমার কাছে আছে। তবে মুশকিলের ব্যাপার একটা আছে। ওই মানচিত্র ও ছবি আমাদের ওই পাঁচশো মাইল পরিধির মধ্যে পৌঁছে দেবে ঠিকই, কিন্তু মূল নগরীটার উপস্থিতি ম্যাপে দেখানো নেই। সেটা আমাদের খুঁজে বার করতে হবে ।

হেরম্যান বললেন, ‘এমন যদি হয় যে ওই মৃত নগরী বালির তলায় বর্তমানে চাপা পড়া অবস্থায় আছে তবে সেক্ষেত্রে কি ভাবে তার খোঁজ মিলবে?”

বার্টন বললেন, হয়তো একজন আমাদের সাহায্য করতে পারে এ ব্যাপারে। আগে সে ওই অঞ্চলে গেছিল। তাকে আমরা এই অভিযানে সঙ্গে নেব। সেই হয়তো আমাদের শেষ পর্যন্ত সেই শয়তানের কবরে পৌঁছে দেবে। তার সাথেই তো তখন আপনাদের সাক্ষাৎ করাবার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। তাকে সঙ্গী করে কাল ভোরে রাব-আল-খালিতে অভিযান শুরু করব আমরা।

সুদীপ্ত প্রশ্ন করল, আমাদের কদিন লাগবে ওই অঞ্চলে পৌঁছতে?’

বার্টন জবাব দিলেন, ‘ওই পাঁচশো বর্গমাইল অঞ্চলে প্রবেশ করতে অন্তত তিনদিন সময় লাগবে। মোট চারটে গাড়ির ক্যারাভ্যান। একটাতে থাকব আমরা, একটাতে থাকবে খাবার এবং জল একটাতে পেট্রোল ও খননের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি জিনিস আর শেষের গাড়িতে দু-জন কুলি। চারজন ড্রাইভার ও কুলি মিলিয়ে তাদের সংস্থা দশ। আর আমরা চারজন। সব মিলিয়ে চোদ্দো জনের দল।

৷৷ ২ ৷৷

গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছে গেল এক সময়। গাড়ি থেকে নেমে জায়গাটা দেখে একটু অবাক হয়ে গেল সুদীপ্তরা। ছিরিছাঁদহীন বেশ লম্বাটে ধরনের বাড়ি বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়িটা। প্রাচীরের মাথায় আবার কাঁটাতার জড়ানো। একটা ওয়াচ টাওয়ারও আছে। লোহার তৈরি বন্ধ প্রবেশ দ্বারের মাথায় আরবি ও ইংরেজিতে লেখা আছে—‘আলি ঘাই জেল।’ অস্ত্র হাতে বেশ কয়েকজন রক্ষী দাঁড়িয়ে আছে বন্ধ প্রবেশ তোরণের সামনে। সুদীপ্ত মৃদু বিস্মিত ভাবে বলল, ‘আপনার গাইড এখানে কাজ করেন নাকি?’

তার কথার জবাবে বার্টন মৃদু হেসে এগোলেন তোরণের দিকে।

তোরণের কাছে পৌঁছতেই রক্ষীরা এগিয়ে এল তাদের কাছে। রক্ষীদের একজন মনে হয় বার্টনকে চিনতে পেরে মৃদু হাসল। কার্টন তাকে বললেন, সুপারেন্টেন্ডেন্টের সাথে দেখা করব। টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে।

এরপর কিছুক্ষণ সুদীপ্তদের সেখানেই অপেক্ষা করতে হল। একজন রক্ষী প্রথমে জেলের ভিতরে ঢুকে সুপারের অফিসে গিয়ে বার্টনের বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করে এল। এরপর একটা খাতায় তাদের নাম ধাম স্বাক্ষর ইত্যাদি লেখার পর ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি মিলল। তোরণের গায়ের একটা ছোট্ট গেট দিয়ে জেলের ভিতর প্রবেশ করল সুদীপ্তরা। একজন রক্ষী তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল জেলারের ঘরে। জেলার সাহেব একজন বিশালবপু আরব। যেমন লম্বা তেমন চওড়া চেহারা। সরকারি এমব্লেম লাগানো মাথার পাগড়িটাও সেই অনুপাতে বিশাল। ভদ্রলোক ইংরেজি জানেন। সুদীপ্ত আর হেরম্যানের দিকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে তিনি বার্টনকে বললেন, ‘তাহলে আপনি রাব-আল-খালিতে সত্যিই যাচ্ছেন?”

বার্টন বললেন, ‘হ্যাঁ যাচ্ছি। আমার এই সঙ্গী দুজনও জীব চর্চা করেন। এরাও যাচ্ছেন।’ সুদীপ্তরা বুঝতে পারল ডক্টর বার্টনের ইতিপূর্বে সাক্ষাৎ হয়েছে জেলার সাহেবের সাথে এবং অভিযানের ব্যাপারটা তিনি জানেন। জেলার সাহেব এরপর বার্টনের উদ্দেশ্যে হেসে বললেন, আপনার গাইডের সেলে গতরাতে গিয়েছিলাম। সে জানতে চাচ্ছিল আপনি কবে এসে তাকে নিয়ে যাবেন? কাগজপত্র আমি সব ঠিক করে রেখেছি। আশা করছি আপনি তাকে উপযুক্ত লোকের হাতে তুলে দেবেন। সে যেন আর এখানে ফিরে না আসে। এমনিতেই সাধারণ চোর-ডাকাত-খুনে কয়েদিদের চাপ। তার ওপর আবার এই লোকগুলোতে বাড়তি ঝামেলা হয়। তার ওপর আবার ওই লোকটা বিদেশি বলে ওর ওপর বাড়তি নজর রাখতে হয়। তার ওপর ওর জন্য রক্ষীরা ওদিকে টহল দিতে ভয় পায়।’ ডক্টর বার্টন বললেন, ‘আমি চেষ্টা করব সে যেন সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে। আমার সঙ্গীদের নিয়ে এসেছি তার সাথে সাক্ষাৎ করাবার জন্য।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জেলার মাঝে বললেন, ‘চলুন তাহলে আগে তার কাছে যাই। তারপর ফিরে এসে কাগজপত্র সইসাবুদ করবেন।’

একজন রক্ষী জেলার সাহেবের ঘরের দেওয়াল থেকে বিশাল একটা চাবির গোছা খুলে নিল। তাকে সঙ্গে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরোবে জেলার। তাদের অনুসরণ করল সুদীপ্তরা।

লম্বা টানা বারান্দার গায়ে সার সার ঘর। তার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েদিরা উৎসুক চোখে তারা দেখছে সুদীপ্তদের। একটার পর একটা অলিন্দ অতিক্রম করে সুদীপ্তরা উপস্থিথ হলো বাড়িটার পিছনের অংশের একটা মেলে। সেখানের যারা বাসিন্দা তাদের আচরণ দেখেই সুদীপ্তরা বুঝতে পারল তারা কেউ স্বাভাবিক নয়। তাদের পোশাক অবিনস্ত, কেউ বা আবার উলঙ্গ। সেলে গরাদের আড়ালে কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ বা আবার বনবন করে ঘুরপাক খাচ্ছে। মানসিক ভাবে অসুস্থ বন্দিরা থাকে এ জায়গায়।

জেলার সাহেবের সঙ্গে তারা এসে দাঁড়াল সে জায়গার শেষ মাথায় একটা গরাদ ঘেরা কুঠুরির সামনে। কুঠুরির ভিতরটা প্রায় অন্ধকার পিছনের দেওয়ালের মাথার ওপরের ঘুলঘুলির মধ্যে ছোট্ট জানলা দিয়ে সামান্য একটু আলো ঢুকছে ঘরে। সুদীপ্ত প্রথমে সে ঘরটার ভিতর তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেরে বার্টনের মুখের দিকে তাকাতেই তিনি ইশারায় ঘরের কোণার দিকে খেয়াল করতে বললেন সুদীপ্তকে। হ্যাঁ, সেখানে দেওয়াল ঘেসে মাটিতে শুয়ে আছে একটা লোক। কিন্তু তার ভঙ্গি দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল হেরম্যান আর সুদীপ্ত। লোকটা আসন বা ব্যায়াম করছে নাকি? বুকের ওপর ভর করে শুয়ে লোকটা। কোমর থেকে পা-দুটো একসাথে পিছনের দিকে শূন্যে অবস্থান অনেকটা সলভাসনের মতো। তবে তার হাত দুটো দু-পাশে প্রসারিত হবার বদলে সামনে দু-পাশে এমন অর্ধবৃত্তাকারে রাখা যেন সে ওই অবস্থায় অদৃশ্য কোনো বৃত্ত বা মোটা গাছের গুড়িকে জড়িয়ে ধরে আছে! লোকটার ঝাঁকড়া চুল ওয়ালা মাথাটা দেওয়ালের দিকে ফেরানো বলে তার মুখ দেখতে পাচ্ছে না সুদীপ্তরা।

সুদীপ্ত আর হেরম্যান তাকে দেখতে পাওয়ার পর ডক্টর বার্টন চাপাস্বরে সুদীপ্তদের উদ্দেশে বললেন। ভালো করে দেখুন লোকটাকে। ওকে নিয়ে একবার ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ‘স্টোরি করে ছিল। বিশেষত ওর শুয়ে থাকার ভঙ্গিমাটা খেয়াল করুন। ওর সাথে কোনো প্রাণীর অবয়বের সাদৃশ্য দেখছেন। ওভাবেই ও ঘুমিয়ে থাকে।

সুদীপ্ত প্রথমে ধরেও যেন ধরতে পারল না ব্যাপারটা। ডক্টর বার্টন চাপা স্বরে বললেন, —ও ভাবেই ও শুয়ে থাকে। ঠিক যেন একটা কাঁকড়া বিছে! ওর সামনের দিকে হাত দুটো ঠিক কাঁকড়া বিছের দাঁড়ার মতো প্রসারিত। কোমরের পিছনের দিকের জোড়া পা দুটো যেন বিছের লেজ। আর পায়ের পাতা দুটো এক সাথে এমনভাবে ঊর্ধ্বমুখে ওঠানো আছে যেন সেটা কাঁকড়া বিছার হুল। ওকে নিয়ে লেখাটার নাম ছিল ‘স্করপিয়ন ম্যান।’ ডক্টর বার্টনের কথা শুনে এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল সুদীপ্ত আর হেরম্যান। সত্যিই লোকটা যেন ‘বিছে মানুষ !”

রক্ষী এরপর চাবি বার করে গরাদের গায়ের তালাটা খুলল। চাবির গোছার ঝনঝন শব্দে সেই বিছে মানুষ বুকের ওপর ভর দিয়েই লাট্টুর মতো ঘুরে তাকাল দরজার দিকে। তার পায়ের অংশটা শূন্যের দিকে আরও উঁচু হয়ে গেল। যেন হুল বাগিয়ে দরজার দিকে ফিরল সে। এক মাথা অবিন্যস্ত চুল তার কপালে নেমে এসেছে, তার আড়াল থেকে সে তাকাল সুদীপ্তদের দিকে। তাকে দেখে কেমন যেন শিরশির করে উঠল সুদীপ্তর গা। লোকটা কি সত্যিই বিছে মানুষ?

দরজা খোলার পর সে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল সবাই। তাই দেখে সম্ভবত একটু ভয় পেয়েই সামনের দু-হাতে সর সর করে কিছুটা পিছু হবে ঘরের অন্ধকারতম কোণে চলে গেল লোকটা। ভালো করে আলো ঢোকেনা বলে কেমন একটা অদ্ভুত স্যাঁত স্যাঁতে পরিবেশ বিরাজ করছে ঘরটার ভিতর। বিছের বাসস্থান হিসাবে উপযুক্ত পরিবেশই বটে! জেলার সাহেব লোকটার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘সুপ্রভাত মিস্টার টিম্বার। উঠে দাঁড়ান। এঁরা আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য এসেছেন।’

জেলার সাহেবের কথা শুনে লোকটা সুদীপ্তদের মুখের দিকে তাকাতে লাগল সে। তার দৃষ্টি এসে থেমে গেল ডক্টর বার্টনের মুখের ওপর। তার ঠোঁটের কোণে আবছা হাসি ফুটে উঠল। ধীরে ধীরে লোকটা উঠে দাঁড়াল। যদিও লোকটার গায়ের রঙ সম্ভবত এ দেশে থাকার কারণে রোদে পুরে তামাটে হয়ে গেছে তবু তার চুল ও গায়ের রঙ দেখে সুদীপ্তরা বুঝতে পারল এ লোকটা সম্ভবত ইওরোপীয়ান হবে। সারা দেহ তার উন্মুক্ত, শুধু কোমরের একটা বস্ত্র খণ্ড তার লজ্জা নিবারণ করছে।

সে বার্টনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে মহান থুলুর কাছে নিয়ে যাবে? সে যে ডাকছে আমায়। কিন্তু এরা আমাকে কয়েদ করে রেখেছে। কিছুতেই বাইরে বেরোতে দেয় না।

ডক্টর বার্টন তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘এবার তোমাকে এরা বেরোতে দেবে।

তোমাকে আমি মহান থুলুর সেই নগরীর কাছে নিয়ে যাব। কিন্তু তুমি সে জায়গা চিনতে পারবে তো?”

বার্টনের প্রশ্ন শুনে যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল বিছে মানুষের চোখ দুটো। সে বলল ; হ্যাঁ, পারব, পারব। সেখানে ঘুমিয়ে আছে আমার ঈশ্বর। তাঁর আবাহন মন্ত্র আমি জানি । কিন্তু সেখানে যেতে হলে তোমাকেও কাঁকড়া বিছে হতে হবে। পারবে তো?’

বার্টন হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, পারব, অবশ্যই পারব।’

লোকটা বলল, “তাহলে তুমি পবিত্র গন্থ নেক্রোনোমিনিকন’-এর নামে শপথ করও যে তুমিও প্রভুর কাছে নিজেকে আমার মতো সমর্পণ করবে?’ বার্টন জবাব দিলেন, ‘নেক্রোনোমিনিকাই’এর নামে শপথ করলাম।’

সুদীপ্ত আর হেরম্যান গীতা, বাইবেল, কোরান ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থের নাম নিয়ে লোককে শপথ নিতে শুনেছে, কিন্তু ‘সেক্রোনোসিনিকন’-এর নাম কখনও শোনেনি। কোন ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ এটা?

টিম্বার নামের লোকটা বলল, ‘চলো, এখনই রওনা হওয়া যাক। প্রভু থুলু সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তার ঘুম ভাঙাব আমি।’ বার্টন বললেন, “কিন্তু এখান থেকে বাইরে বেরোবার আগে কিছু কাজ করতে হবে তোমাকে। চুল দাড়ি কাটতে হবে, স্নান করতে হবে, পোশাক পরতে হবে। এ ভাবে তো আর বাইরে যাওয়া যাবে না। তাছাড়া আমার কিছু কাজ আছে। সে সব মিটতে বিকাল হয়ে যাবে। বিকালবেলা এসে তোমাকে নিয়ে যাব আমি।’

বিছে মানুষ যেন একটু বিমর্ষ হলো তার মুক্তি পেতে বিকাল হবে বলে। একটু চুপ করে থেকে সে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা’, ‘নিউ মুন’ কবে? অর্থাৎ অমাবস্যা করে? বার্টন একটু ভেবে নিয়ে জবাব দিলেন, ‘আর দিন সাতেক পর।’ লোকটা বলল, ‘সে রাতের আগে সেখানে পৌঁছান যাবে তো?”

কার্টন জবাব দিলেন, ‘যদি তুমি সাহায্য করো যাওয়া যাবে।’

জেলার সাহেব এবার তাড়া দিয়ে বললেন, ‘চলুন এবার অফিসে ফিরে কাগজপত্রর কাজ মিটিয়ে খেলা যাক। ওকে আমার লোকরা বাইরে বেরোবার জন্য তৈরি করে দেবে।’ তার কথা শুনে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সুদীপ্তরা জেলারকে অনুসরণ করল আবার তার ঘরে ফেরার জন্য। সেদিকে যেতে যেতে বার্টন জেলার সাহেবকে বললেন, ‘আপনিতো দীর্ঘ দিন ধরে দেখলেন লোকটাকে, ওকে কি হিংস্র বলে মনে হয়েছে আপনার?’

জেলার সাহেব বললেন, ‘যদিও সে দু-দুবার জেল থেকে পালিয়েছিল তবুও ওর কোনো হিংস্রতা চোখে পড়েনি আমার। বরং ও মানসিক রোগীদের থেকে শান্ত। সমস্যাটা হলো ওর ব্যবহার আর অদ্ভুত কথাবার্তায়। মাসের অর্ধেকটা সময় লোকটা নিশ্চিত ভাবেই জেলে কাটায়। কিন্তু অমাবস্যা যত এগিয়ে আসে তত তার মধ্যে মানসিক বৈকল্য শুরু হয়। কাঁকড়া বিছের মতোই বুকে হেঁটে উত্তেজিত ভাবে ঘরের মধ্যে পাক খায়। আবোল তাবোল বকতে থাকে। কখনও তাকে ছেড়ে দেবার জন্য মিনতি করতে থাকে। আর তার এই আবোল-তাবোল কথা শুনে তাকে ভয় পায় আমার অশিক্ষিত রক্ষীরা। তার ওপর এক বদমাশ কয়েদি প্রচার করেছে যে স্টিম্বারকে নাকি সে তার কুটুরির ভিতর বিশাল এক ছায়া মূর্তির সাথে কথা বলতে দেখেছে। টিম্বার তাকে ‘মহান থুলু’ ‘মহান আজিফ বলে সম্বোধন করেছিল! আজিফ শব্দর অর্থ শয়তান।’ আর তারপর থেকেই রক্ষীরা ওর সেলে রাতে পাহারা দিতে চায় না। টিম্বার এখান থেকে গেলে আমার শাস্তি হবে। জেলার সাহেবের ঘরে এসে বসল সুদীপ্তরা। টিম্বার নামের লোকটাকে মুক্ত করার জন্য বেশ কিছু কাগজে স্বাক্ষর করতে হল ডক্টর বার্টনকে। সেসব কাজ মিটলে তিনি জেলার সাহেবকে বললেন, ‘আপনি টিম্বারকে তৈরি করে রাখুন। আমি আমার সঙ্গীদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

জেলখানা থেকে বেরিয়ে সুদীপ্তরা এরপর হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সুদীপ্তরা এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। গাড়ি চলতে শুরু করার পর হেরম্যান এবার ডক্টর বার্টনকে বললেন, ‘ওই বিছে মানুষের ব্যাপারটা আমাদের খুলে বলুন। ও তো মানসিক রোগী! ও আমাদের গাইডের কাজ করবে কি করে? লোকটার আসল পরিচয় কি?’

বার্টন বললেন, ‘এ লোকটাকে প্রথমে বছর দশেক আগে আরব অভিযাত্রীদের একটা দল প্রায় মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার করে রাব-আল-খালির ওই প্রাচীন নগরীর কাছে। আপাদমস্তক কালো রঙ মেখে ওই বৃশ্চিকের মতো ভঙ্গিতে পড়ে ছিল সে। ও কোন দেশের লোক সে সম্বন্ধে কোনো কিছু জানা যায় না। যে কারণে ওর চেহারা দেখে ইউরোপীয় মনে হলেও পরিচয়পত্র না থাকার কারণে ইওরোপের কোনো দেশ ওকে নিতে চায়নি। এ দেশের সরকারের কাছে ওর কোনো নথি নেই। সম্ভবত অন্য কোনো দেশের দিক থেকে রাব-আল-খালিতে প্রবেশ করেছিল সে। তারপর থেকে লোকটা এ দেশেই আছে। এই দশ বছরের মধ্যে দু-দুবার পালিয়ে ছিল সে। একবার এখানকার এক মানসিক হাসপাতাল থেকে, আর একবার এই জেল থেকে। এবং এই দু-দুবারই তাকে প্রথম দু-বারের মতো উদ্ধার করা হয় মরুভূমির গভীর থেকে। মরুভূমির ভিতর অতটা পথ একলা কি ভাবে পাড়ি দিয়েছিল সেটা একটা বিস্ময়! শেষ দুবারের মধ্যে একবার তাকে উদ্ধার করে এক যাযাবার গোষ্ঠী, আর দ্বিতীয়বার সে ধরা পড়ে আরব সেনাদের হাতে। ঘটনা চক্রে পরের দু-দুবারও সে যেখানে ধরা পড়ে তার কাছাকাছি প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ দেখা গেছিল বলেই জানিয়েছিল উদ্ধারকারীরা। এমন হতে পারে যে আসলে তিন তিন বারই তাকে একই জায়গা থেকে ওকে উদ্ধার করা হয়। আর এটা যদি হয় তাহলে বুঝতে হবে লোকটা পাগল হলেও ওই জায়গাটা সে চেনে আমার পরিকল্পনা হল আমরা ওই অঞ্চলে পৌঁছে যুক্ত করে দেব তাকে, তারপর তাকে অনুসরণ করব। দেখা যাক সে আমাদের সেই মৃত নগরীতে পৌঁছে দেয় কিনা? যেখানে আছে আমার প্রাগৈতিহাসিক দানব বিছের জীবাশ্ম অথবা জীবন্ত জীবাশ্ম বলতে পারেন এ ব্যাপারে লোকটাকে নিয়ে একটা ফাটকা খেলছি আমি। অভিযান শেষে তাকে আবার ফিরিয়ে এনে তুলে দেব এখানকার এক মিশনারি সংস্থার হাতে। লোকটাকে বাকি জীবনের ভরণপোষণের জন্য ইতিমধ্যেই ওই সংস্থার হাতে আমি অর্থ তুলে দিয়েছি। সুদীপ্ত জানতে চাইল,’ কিন্তু ওই লোকটা কিসের টানে বারবার ওই মৃতনগরীতে ছুটে যায়? কি আছে ওখানে?’

ডক্টর বার্টন হেসে বললেন, ‘এবার আপনি আসল প্রশ্নটা করলেন। লোকটার নানা অসংলগ্ন কথাবার্তায় সে নগরীতে তার বারবার ছুটে যাবার পিছনে এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। যার কিছুটা আরবের বিভিন্ন মরু যাযাবর গোষ্ঠীও বিশ্বাস করে। এমন কী ইওরোপের কিছু শিক্ষিত মানুষও ব্যাপারটা নিয়ে চর্চা করেন।’

‘সেটা কি ব্যাপার?’ সুদীপ্ত প্রশ্ন করল।

বার্টন বললেন, ‘অদ্ভুত এক তত্ত্ব, অদ্ভুত এক ব্যাপার। আচ্ছা, আপনারা ‘আব্দুল আলহাড্রেজ’ বলে কারো নাম শুনেছেন ?

সুদীপ্তরা আর হেরম্যান এক সাথে বলে উঠল—“না”। ডক্টর বার্টন বললেন, ‘বহু যুগ আগে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে আলহাড্রেজ এক গ্রন্থ রচনা করেন ‘কিতাব আল আজিফ’ নামে। যার অর্থ হল ‘মরুভূমির শয়তান!” আলহাড্রেজ ১০ বছর টানা অভিযান চালিয়েছিলেন আরব-ব্যাবিলন মিশর মরুভূমিতে। সে সময় তিনি আরব মরুভূমিতে এক প্রাচীন নগরীর সন্ধান পান। যে নগরীর প্রস্তর গাত্রে নানা রকম প্রাচীন লিপির সন্ধান পান তিনি এবং তা পাঠোদ্বারে সক্ষম হন। সে লিপিলগুলোতে বলা ছিল ‘আদিম ভয়ঙ্করের’ উৎপত্তির ইতিহাস ও সেই প্রাচীন নগরীতে ঘুমিয়ে থাকা সেই আদিম ভয়ঙ্কর বা শয়তানের আবাহন বন্দনা বা তাকে জাগিয়ে তোলার মন্ত্র। এ সব নিয়েই তিনি রচনা করেন তাঁর গ্রন্থ ‘কিতাব-আল-আজিফ। এই বইটা লেখার পরই পাগল হয়ে যান আলহাড্রেজ। যে কারণে পরবর্তীকালে তিনি পরিচিত হন ‘পাগলা আরব’ নামে। কেউ কেউ বলে সেই আদিম শয়তান ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বি ‘থুলু’-র প্রভাবেই নাকি তিনি পাগল হন। তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন থুলুকে এবং তিনি তার সাক্ষাৎ পান। তিনি থুলুর চেহারার বর্ণনাও দিয়েছেন। তাঁর থলথলে চেহারা, নখর যুক্ত হাত-পা। মাথাটা গোলাকার, অক্টোপাসের মতো অসংখ্য শুড় বেরিয়েছে তার মুখ মণ্ডল থেকে। টকটকে লাল ভয়ঙ্কর তার চোখ আর পিঠে আছে বাদুড়ের মতো বিশাল দুটো ডানা, যা শয়তানের থাকে। আদিম বৃদ্ধ সেই শয়তানের অনুচর হল দানব বিছেরা। থুলু নিজেও দানব বিছের রূপ ধারণ করতে পারেন। থুলুর নারকীয় কর্মকাণ্ডের গা ছমছমে কর্মকাণ্ডও সেই বইতে ব্যক্ত করেন আলহাড্রেজ। পরবর্তীকালে লাভক্রাফট নামক এক ভদ্রলোক এ বিষয় নিয়ে ইংরেজিতে এক গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম ‘থুলু মিথস’। সেখানে তিনি আলহাড্রেজ-এর লেখা গ্রন্থটিকে চিহ্নিত করেন ‘নেপ্রোনোমনিকন পুঁথি’ নামে। যে পুঁথিতে ছিল আদিম ভয়ঙ্কর শক্তির আবাহন মন্ত্র। জানেন তো ইউরোপের বহু মানুষ যেমন ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন তেমনই শয়তানের অস্তিত্ত্বেও বিশ্বাসী। শুধু ইওরোপ কেন পৃথিবীর অন্যান্য বহু মানুষও শয়তানের অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন। একটা গুজব আছে যে আলহাড্রেজের লেখা শুল পুঁথিটি নাকি গোপনে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গোপন প্রোকণ্ঠে সংরক্ষিত আছে। তা কাউকে দেখতে দেওয়া হয় না। আর একটা গুজব হল, সে পুঁথি নাকি লুকিয়ে রাখা আছে ভ্যাটিকানের মাটির গভীরে। সে পুঁথিতে লেখা মন্ত্রোচ্চারণ করলেই নাকি জেগে উঠবে শয়তান। সে জন্যই নাকি এই গোপনীয়তার অবলম্বন। কথায় বলে ভগবান আর শয়তানের শক্তিও নাকি সমান সমান। তাই কেউ কেউ শয়তানকে জাগিয়ে তুলে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে শয়তানের অপার্থিব শক্তির অধিকারী হতে চায়। ওই টিম্বার ও তেমনই একজন লোক। সে নাকি আদিম বৃদ্ধ শয়তান থুলুকে জাগাবার মন্ত্র জানে। ওই প্রাচীন নগরীতেই নাকি ঘুমিয়ে আছেন থুলু। সে জন্যই লোকটা বার বার ছুটে যেতে চায় সেখানে।’

ডক্টর বার্টনের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল সুদীপ্তরা। হেরম্যান বার্টনকে প্রশ্ন করলেন, “আপনি ওই ঘুমন্ত শয়তানের ব্যাপারটা বিশ্বাস করেন?”

বার্টন হেসে জবাব দিলেন, ‘আমি না করলেও পৃথিবীর অনেক মানুষই শয়তানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তবে ওই নগরীতে সেই ঘুমন্ত শয়তান থাক বা না থাক আমরা সে জায়গাতে পৌঁছতে পারলেই হলো।’

বার্টনের কথা শুনতে শুনতে এক সময় হোটেলে পৌঁছে গেল সুদীপ্তরা। তাদের সেখানে নামিয়ে দিয়ে বার্টন ফিরে চললেন সেই অদ্ভুত বন্দিকে মুক্ত করার জন্য।

৷৷ ৩ ৷৷

পরদিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই নিজেদের মালপত্র নিয়ে হোটেল ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ল সুদীপ্তরা। ইতিমধ্যে ডক্টর বার্টনও হাজির হয়ে গেছেন তাঁর ক্যারভান নিয়ে। চারটে জিপের মতো দেখতে গাড়ি। তবে তা একটু উঁচু ধরনের। বালির মধ্যে চলার উপযোগী বড় বড় চাকা। বার্টনের সাথে যে কুলিরা এসেছে তারা সকলেই দীর্ঘ দেহী আরব। কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা দীর্ঘ আলখাল্লার মতো পোশাক। মাথায় কাপড়ের আচ্ছাদন ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। তিনজন লোকের কাঁধে রাইফেলও আছে। তেমনই এক রাইফেলধারীর সাথে একটা গাড়িতে নানা মালপত্রের মধ্যে টিম্বারকেও বসে থাকতে দেখল সুদীপ্তরা। তার মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা হয়েছে, দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে খাঁকি পোশাকও পরানো হয়েছে ভদ্রলোকের মতো। তবে তার চোখের দৃষ্টিতে ঘোলাটে ভাব আছে। সুদীপ্তদের দেখে ডক্টর বার্টন এগিয়ে এসে প্রথমে তাদের করমর্দন করলেন, তারপর টিম্বারকে ইশারায় দেখিয়ে বললেন, ‘ওকে আমাদের সথে নেব না। আমাদের কথা বলার অসুবিধা হতে পারে। তাছাড়া ওর কুলিদের হেফাজতে থাকাই ভালো। বলা যায় না লোকটা আমাদের কাছ থেকেও পালাবার চেষ্টা করতে পারে। যার পাশে ও বসে আছে তার নাম আবদুল্লা। ও লোকটাই কুলিদের সর্দার।’

হেরম্যান মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনার এই আরব সঙ্গীরা আসলে কুলি নাকি রক্ষী বাহিনী ?”

ডক্টর বার্টনও হেসে জবাব দিলেন, ‘দুটোই বলতে পারেন। মরুভূমিতে মরু দস্যুদের উৎপাত আছে। তাই সঙ্গে অস্ত্র রাখে ওরা।’ এ কথা বলার পর একটু চাপা স্বরে তিনি বললেন, ‘এদের চেহারা শক্তপোক্ত হলেও ভূত-প্রেত-শয়তান-এ সব ব্যাপার এরা বিশ্বাস করে। ভয়ও করে। এরা অনেকেই মরুভূমিতে বিদেশিদের নিয়ে যায় বলে ইংরেজি বোঝে। এদের সামনে কথাবার্তা একটু সামলে বলবেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সুদীপ্তদের মালপত্র তুলে ফেলা হলো একটা গাড়িতে। তারপর সুদীপ্ত আর হেরম্যান গিয়ে ডক্টর বার্টনের সাথে উঠে বসল সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর প্রথমটাতে। ক্যারাভান রচনা হলো রাব-আল-খালির উদ্দেশ্যে।

শহর ছেড়ে রাস্তা সোজা ঢুকে গেছে মরুভূমির ভিতর। সেই রাস্তাই ধরল সুদীপ্তরা। হেরম্যান, বার্টনকে প্রশ্ন করলেন, ‘কাল রাতে কোথায় ছিল আপনার বিছে মানুষ? সে কি নতুন কিছু জানাল ? ‘

বার্টন বললেন, ‘হোটেলে আমার ঘরেই ছিল। না, সে তেমন কিছু বলেনি। শুধু জানলা ধরে দাঁড়িয়ে এই মরুভূমির দিকে তাকিয়ে একবার জানতে চাচ্ছিল যে আমরা কখন আজ যাত্রা শুরু করব, আর অমাবস্যার মধ্যে আমরা সে নগরীতে পৌঁছতে পারব কিনা? আমাদের হোটেলের ঘরটা বেশ বড়। তার জন্য আমার পাশেই একটা খাটের ব্যবস্থা করেছিলাম। রাত দশটা নাগাদ বাতি নিভিয়ে দুটো খাটে শুয়েও পড়েছিলাম আমরা। মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছিল আমার। প্রথমে তাকিয়ে দেখি লোকটা খাটে নেই। তারপর দেখি টিম্বার খাট থেকে নেমে বিছের মতো তার সেই ভঙ্গিতে মেঝেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কি মাঝ রাতে আধো অন্ধকার ঘরে তাকে ও ভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখে আমারও একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে গিয়ে আশ্রয় নিল তার জন্য নির্ধারিত খাটের নিচে। বাকি রাতটা লোকটা সেখানেই কাটিয়েছে।’ হেরম্যান মন্তব্য করলেন, ‘দেখা যাক আপনার এই টিম্বার আমাদের নির্দিষ্ট জায়গাতে পৌঁছে দিতে পারে কিনা ? ”

নিজেদের মধ্যে নানা কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলল সুদীপ্তরা। ক্রমশ দূরে সড়ে যেতে লাগল পিছনের ছোট্ট মরু শহর। তাদের যাত্রাপথে এক এক সময় যে উটের কাফেলা বা তৈলবাহী ট্যাঙ্কার গাড়িগুলো চোখে পড়ছিল তারা এক সময় হারিয়ে গেল, আর তারপর এক সময় শেষ হয়ে গেল রাস্তার। সামনে শুধু ধু-ধু মরুভূমি, আর তার মধ্যে জেগে থাকা ছোট বড় বালির পাহাড়। ইতিমধ্যেই সূর্যকিরণে বাইরের বাতাস তেতে উঠতে শুরু করেছে। গাড়ির ড্যাশ-বোর্ডে একটা কম্পাস বসানো আছে। সেটার ওপর নির্ভর করেই এই দিকচিহ্নহীন মরু সমুদ্রে যাত্রা শুরু করল সুদীপ্তরা। কিছুটা এগোবার পরই মরুভূমির আসল রুক্ষতা, আসল পরিবেশ মালুম হতে লাগল তাদের। গাড়িটার চারপাশ ক্যাম্বিসের পর্দা দিয়ে ঢাকা, কিন্তু তার ফাঁক গলেই গরম হলকা এসে লাগলে লাগল তাদের গায়ে। যেন বাইরের পৃথিবীটা ফার্নেসে রূপান্তরিত হয়েছে। ইতিমধ্যে সুদীপ্তরা মাথায়-নাকে-মুখে কাপড় জড়িয়ে নিয়েছে, চোখে রোদ চশমাও পরেছে, তবু তাদের চোখ জ্বলতে শুরু করল, প্রতিটা প্রশ্বাসের সাথে গরম বাতাস যেন ফুসফুসে গিয়ে ধাক্কা মারতে লাগল। জিভ ভারী হয়ে কথাবার্তা কমে আসতে লাগল সুদীপ্তদের।

ডক্টর বার্টন একবার শুকনো হেসে বললেন, ‘আশা করি মরুভূমির এই পরিবেশ আমরা দু-তিন দিনের মধ্যে মানিয়ে নিতে পারব। ভাবতে পারেন লক্ষ কোটি বছর আগে এখানে সমুদ্র ছিল! এই প্রাণহীন মরুভূমিই ছিল জীব জগতের প্রথম আঁতুড় ঘর! সত্যি প্রকৃতি আর সময়ের কী বিচিত্র খেয়াল! হয়তো বা আরও নশো কোটি বছর পর এই মরুভূমিই ঢেকে যাবে বরফের চাদরে!’

—এ কথাগুলো বলার পর বার্টন আর কোনো কথা বললেন না। গাড়ির উইন্ড স্ক্রিন দিয়ে তিনি চেয়ে রইলেন সামনের দিকে। শুধু আরব গাড়ি চালকের মধ্যেই কোনো ভাবান্তর চোখে পড়ল না। সেটা তার এ পথে চলার অভ্যাসগত কারণেই। সুদীপ্তর যেন মনে হলো যে, গাড়ি চালাতে চালাতে লোকটা মাঝে মাঝে গুনগুন করে গানও করছে ! প্রচণ্ড গরম আর গাড়ির দুলুনির জন্যই মনে হয় একটা আচ্ছন্ন ভাব সুদীপ্তদের ঘিরে ধরল। তাদের চোখ বুজে আসতে লাগল ধীরে ধীরে। মাঝে মাঝে বালি পাহাড়ের ঢালগুলো পেরোবার সময় প্রবল ঝাঁকুনিতে যখন সুদীপ্তর চোখ খুলে যেতে লাগল তখন তার মনে হতে লাগল গাড়িটা যেন একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে যেন একই দৃশ্য দেখছে। সেই একই দিকচিহ্নহীন মরুভূমি আর বালির পাহাড়। সেখানে সময় যেন থমকে গেছে!

সময় কিন্তু এগিয়ে চলল। বেলা গড়িয়ে দুপুর হলো, তারপর বিকাল। সুদীপ্তর সেই আচ্ছন্ন ভাবটাও যেন ধীরে ধীরে কেটে গেল। এক সময় থেমে গেল ক্যারাভান গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সবাই। একটা বালি পাহাড়ের ছায়ায় এসে দাঁড়িয়েছে তারা। কিছুটা তফাতে একটা নিচু খাতের মতো জায়াগও আছে। চারপাশটা দেখে নিয়ে ডক্টর বার্টন বললেন এখানেই তাঁবু ফেলব আমরা।

তাঁবু খাটানো শুরু হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে। বিছে মানুষ টিম্বার গাড়িতেই বসে আছে। বার্টনের পিছন পিছন সুদীপ্তরা গিয়ে দাঁড়াল সেই গাড়িটার সামনে। দূরে একটা বালিয়াড়ির দিকে তাকিয়ে আছে টিম্বার। বার্টন তাকে জিজ্ঞেস করলেন ; কি কেমন লাগছে? আমরা ঠিক দিকে এগোচ্ছি তো?”

প্রশ্ন শুনে আবছা একটা হাসি ফুটে উঠল তার ঠোটের কোণে। সে জবাব দিল ভালো। কিন্তু অমাবস্যার আগে আমরা সেখানে পৌঁছতে পারব তো?”

বার্টন জবাব দিলেন, তুমি নিয়ে যেতে পারলে পারব।

চিম্বার সংক্ষিপ্ত জবাব দিল-‘পারব।’-এ কথা বলে সে মনোনিবেশ করল দূরের সেই বালিয়ারির দিকে।

বার্টন হেরম্যান সুদীপ্তর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ও যেদিকে তাকিয়ে আছে সেটাই কিন্তু আমাদের যাত্রাপথ ।

এরপর তাঁবু খাঁটানো, মালপত্র গাড়ি থেকে নামাবার তদারকি করতে লাগল সুদীপ্তরা। রোদের তেজ কমে আসতে শুরু করেছে। মৃদু হাওয়াও বইতে শুরু করল এক সময় মরুভূমিতে দিনের এই সময়টাই সবচেয়ে মনোরম হয়। ঠান্ডা বাতাসে সুদীপ্তদের দেহমন যেন জুড়িয়ে যেতে লাগল। শেষ বিকালে মরুভূমির বুকে সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। লালে লাল হয়ে উঠতে লাগল চারদিক। রুক্ষ মরুভূমি যেন বদলে যেতে লাগল অবর্ণনীয় স্বর্গীয় সৌন্দর্যে! এক জায়গাতে এক সাথে দাঁড়িয়ে ছিল সুদীপ্তরা। হতবাক হয়ে তারা তাকিয়ে রইল সে দৃশ্যর দিকে। হেরম্যান এক সময় মন্তব্য করলেন, ‘কী সুন্দর পৃথিবী!’

তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই একজন বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, এটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর জায়গা। আমার মহান প্রভু থুলুর আবাসস্থল।’

চমকে উঠল সুদীপ্তরা। টিম্বার কখন যেন গাড়ি থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের পাশে! কিন্তু এরপর আর সে কোনো কথা বলল না। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে অন্যদিকে দাঁড়াল।

সূর্য ডুবে গেল। আর সূর্য ডোবার সাথে সাথেই ঠান্ডার চাদর যেন মুড়ে ফেলতে লাগল চারপাশ। মরুভূমির নিয়মটাই এই। দিনে যত গরম, রাতে তত ঠান্ডা নেমে আসে। খাওয়া সেরে নিজেদের তাঁবুতে শুয়ে পড়ল সুদীপ্তরা। তার আগে বার্টন এসে বলে গেলেন যে টিম্বারকে একটা তাঁবুতে পাঠানো হয়েছে এবং তাঁবুর সামনে সারারাত একজন রক্ষী মোতায়ন থাকবে। বাইরে একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়েছে আরব কুলিরা। তাকে ঘিরে বসে পথশ্রমের ক্লান্তি দূর করার জন্য সমবেত সঙ্গীত শুরু করল তারা। সুদীপ্ত যে ভাষা বুঝতে না পারলেও এক অদ্ভুত মূৰ্চ্ছনা আছে তাতে। তাঁবুর বাইরে থেকে ভেসে আসা সেই সঙ্গীত শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল সুদীপ্ত।

পরদিন ভোরবেলা যখন সুদীপ্তরা তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়াল তখনও শুকতারা মুছে যায়নি। যত দ্রুত সম্ভব যাত্রা শুরু করার কথা যাতে গরম কম লাগে। কিন্তু তারা বাইরে আসতেই মুখোমুখি হয়ে গেল বার্টনের। বার্টন উত্তেজিতভাবে বললেন, ‘টিম্বার তাঁবুতে নেই !”

হেরম্যান বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি যে বলেছিলেন রক্ষী থাকবে তার তাঁবুর সামনে?’

বার্টন বললেন, “ছিল তো। সে তাকে তাঁবুর বাইরে বেরোতে দেখেনি। অথচ সে নেই!’ এই বলে তিনি রক্ষী-কুলি সর্দার আবদুল্লাকে নিয়ে এগোলেন সেই তাঁবুটার দিকে। সুদীপ্তরা অনুসরণ করল তাদের।

তাঁবুর পর্দাটা একবার উঠিয়ে দেখা হলো। তার ভিতরটা সত্যিই শূন্য। যে লোকটা তাঁবু পাহারার দায়িত্ব ছিল সে এখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে সে হলফ করে বলল সে রাতে সে ঘুমায়নি আর টিম্বারকে বাইরে বেরোতেও দেখেনি। তাহলে কোথায় গেল লোকটা?

বার্টন চিত্তিতভাবে প্রথমে বললেন, ‘এমন তো হবার কথা নয়!’ তারপর তিনি আবদুল্লার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘চারটে গাড়ি নিয়ে চারদিকে যেতে হবে। হয়তো এখনও সে বেশি দূর যেতে পারেনি।’

আবদুল্লা নির্দেশ পালনের জন্য এগোতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় ছোট্ট তাঁবুটার পিছনে কিছুটা তফাতে বালি হঠাৎ নড়ে উঠল। তারপর বালির তলা থেকে প্রথমে আত্মপ্রকাশ করল একটা শাখা, তারপর ধীরে ধীরে হাত-পা। সবাইকে অবাক করে বুকে হেঁটে বালি থেকে বেড়িয়ে উঠে দাঁড়াল বার্টন। তারপর এগিয়ে এসে সুদীপ্তদের উদ্দেশ্যে বলল ; তাঁবুর ভিতর গরম লাগছিল তাই ঠান্ডা বালির নিচে ঘুমিয়ে ছিলাম।’ বার্টন বললেন ; তুমি তাঁবুর বাইরে বেরোলে কি ভাবে?’

সে জবাব দিল, ‘বালির তলা দিয়েই বেরোলাম।’

তার তাঁবু থেকে অদৃশ্য হবার উপায়টা এবার বুঝতে পারল সুদীপ্তরা ।

লোকটা এরপর বার্টনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘চলো চলো নইলে দেরি হয়ে যাবে। অমাবস্যার আগে আমাকে সেখানে পৌঁছতেই হবে।’

তার তাড়া দেওয়া দেখে হেসে ফেললেন বার্টন। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তাঁবু উঠিয়েই রচনা হব আমরা।’

সুদীপ্তরা এরপর ফিরতে শুরু করল নিজেদের তাঁবুর দিকে। সে দিকে হাঁটতে হাঁটতে আবদুল্লা বার্টনকে প্রশ্ন করল, এ লোকটা কি জেলে বন্দি ছিল?’ বার্টন জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ।’

আবদুল্লা বলল, ‘এ লোকটা যে আমাদের সঙ্গী হবে তা আগে জানানো উচিত ছিল।’ বার্টন প্রশ্ন করলেন, “কেন?”

আবদুল্লা জবাব দিল, ‘ওকে চোখে না দেখলেও ওর কথা শহরের অনেক লোক শুনেছে। আমিও শুনেছি। আমার পরিচিত একজন লোক জেলখানায় চাকরি করে। সে আমাকে বলেছে ও নাকি আসলে মানুষ নয়, ও শয়তানের শাকরেদ।’ ও সঙ্গে আসবে জানলে আসতাম না।’ কথাটা শুনে বার্টন মুহূর্তের জন্য একবার সুদীপ্তদের দিকে তাকিয়ে নিয়ে আবদুল্লাকে আশ্বস্ত করার জন্য বললেন, ‘না, তেমন কোনো ব্যাপার নয়। ওর মাথায় একটু গণ্ডগোল আছে তাই মাঝে মাঝে একটু অদ্ভুত আচরণ করে। সামনে লোকটা নিরীহ। ওর সম্বন্ধে ওসব কথা ঠিক নয়। আবদুল্লা বার্টনের কথার কোনো জবাব না দিলেও তার মুখ দেখে বোঝা গেল যে, সে বার্টনের কথা শুনে ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারেনি। : সে অন্য পাশে চলে যাবার পর বার্টন হেরম্যানকে বললেন, ‘আবদুল্লার অমন দানবের মতো চেহারা, কিন্তু এ সব ব্যাপারে ওর যথেষ্ট আতঙ্ক আছে।’ তাঁবু তোলা হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। সুদীপ্তরা যখন যাত্রা শুরু করল এখন সবে সূর্য উঠতে শুরু করেছে। আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে মরুভূমির বুকে। সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চলল সুদীপ্তরা। আর তার সাথে সাথেই মাথার ওপরে সূর্যদেব ও স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করতে লাগলেন, তেতে উঠতে লাগল বালি, আগুনের হলকা ছড়াতে শুরু করল বাতাস। সুদীপ্তদের যাত্রাপথের পাশেই হঠাৎ একটা উটের কঙ্কাল চোখে পড়ল। সেটা দেখিয়ে বললেন, ‘এই কঙ্কালটাই হয়তো একদিন ফসিলে পরিণত হবে। বালি ঝড়ের নিচে এক সময় চাপা পড়ে যাবে এই কঙ্কালটা। তারপর ধীরে ধীরে মাটির আরও নিচে চলে গিয়ে একদিন পরিণত হবে পাথরে। আমরা এখন এই পৃথিবীতে থাকব না, হয়তো বা মানুষ বলেই কোনো জীব থাকবে না সেই লক্ষ বছর পরে কিন্তু এই কঙ্কালটা রয়ে যাবে। জানেন আমি ক্যালিফোর্নিয়ার এক জায়গাতে তিরিশ কোটি বছর আগের বৃষ্টিপাতের ছবি দেখেছি। মানুষ তখন কোথায়? তার আবির্ভাবতো মাত্র বিশলক্ষ বছর আগে। সেই তিরিশ কোটি বছর আগে সবে ডাইনোসরদের আবির্ভাব হয়েছে। সেই আদিম পৃথিবীতে ওই ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে কোনো একদিন হয়তো কিছু সময়ের জন্য প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টিপাতের ফলে কাদা মাটিতে আঁকা হয়ে ছিল বৃষ্টির ফোঁটার ছাপ। তারপর প্রকৃতির খেয়ালে আর বৃষ্টি হল না সেখানে। কাদা মাটি ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে পাথরে পরিণত হলো। পাথরের ক্যামেরাতে আঁকা হয়ে রইল সেই আদিম বৃষ্টিপাতের ছবি।

যাত্রাপথে মাঝেমাঝেই বার্ধনের কাছ থেকে ফসিল সম্পর্কে নানা তথ্য শুনে চলল সুদীপ্তরা। এ বিষয় যে তার যথেষ্ট পণ্ডিত্ব আছে তার কথা শুনে বুঝে নিতে অসুবিধা হলো না সুদীপ্তদের। বার্টনের কথাই এদিন সুদীপ্তদের যাত্রাপথের একঘেয়েমি অনেকটা দূর করে দিল। গত দিনের মতোই বিকালবেলা এ দিনের মতো যাত্রা শেষ হল। মরুভূমির একটা বেশ গভীর খাতের পাশে গাড়ি থেকে নামার পর তাঁবু খাটাবার প্রস্তুতি শুরু হল।

কুলির দল তাঁবু খাটাচ্ছে আর খাতটার সামনে দাঁড়িয়ে বার্টন সেদিকে তাকিয়ে সুদীপ্ত আর হেরম্যানকে বোঝাচ্ছিলেন—‘এই খাতটা এক সময় নিশ্চিত নদীখাত ছিল। কেমন গভীর আর দীর্ঘ দেখেছেন! খাতের দু-পাশের দেওয়ালগুলো যদি খোঁড়া যায় তবে স্তরে স্তরে বিভিন্ন প্রাণীর ফসিল মিলবে। এমন কি জলজ ডাইনোসরের ফসিলও মিলে যেতে পারে। বহু দানব জলচরের ফসিল উদ্ধার হয়েছে মরু অঞ্চল থেকে। আকারে তাদের কেউ কেউ তিমি মাছের চেয়েও বড় ছিল।’

কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন বার্টন। বিছে মানুষ টিম্বার আসছে তাদের দিকে।

সামনে এসে দাঁড়াল টিম্বার। তার চোখের ঘোলাটে ভাবটা যেন অনেক কেটে গেছে। সুদীপ্তরা সেই মৃত নগরীর দিকে যত এগোচ্ছে তত যেন চনমনে হয়ে উঠছে সে। বার্টন তাকে কিছু বলার আগেই সে বলল, ‘তোমাদের কারো কাছে একটা বোতল বা কৌটো হবে। ছোট কৌটো ?’

বার্টন বললেন, ‘আছে, কিন্তু তুমি তা দিয়ে কি করবে?”

প্রশ্ন শুনে টিম্বার ডান হাতটা তার খাকি পোশাকের বুকের ভিতর ঢুকিয়ে সেখান থেকে একটা জিনিস বার করে এনে সুদীপ্তদের দেখাবার জন্য তার হাতের তালুতে মেলে ধরল একটা কাঁকড়া বিছে! নড়ছে প্রাণীটা। লেজের পিছনে হুলটা ওপরে ওঠানো। মরু ভূমির এই কাঁকড়া বিছে স্যান্ড ভাইপারের মতোই ভয়ঙ্কর। এর এক দংশনেই শেষ হয়ে যায় আস্ত একটা মানুষ! আঁতকে উঠল সুদীপ্তরা। বার্টন বলে উঠলেন, ‘এটা কে কোথা থেকে পেলে! ফেলে দাও, এখনই ফেলে দাও।’ টিম্বার বলল, ‘গাড়ির ভিতরে উঠেছিল। খুব সুন্দরপ্রাণী তাই না? ও আমাকে কিছু করবে না। ওকে পুষব আমি।’ হেরম্যানও বললেন, ‘ওকে ফেলে দাও তুমি। যে কোনো মুহূর্তে ও হুল বসিয়ে দেবে। তুমি বাঁচবে না।’

টিম্বার বলল, ‘না, ও কিছু করবে না আমাকে। আমরা দু-জনের দেবতাই মহান থুলুর ভক্ত। ও তো আমার বুকেই ছিল এতক্ষণ? —এই বলে সে বিছেটাকে আবার বুকের ভিতর ঢোকাতে যাচ্ছিল কিন্তু তা দেখে বার্টন বললেন, ‘না, না, ওখানে নয়, কৌটো নিয়ে আসছি আমি।’

বার্টন ছুটে গিয়ে একটা ছোট কৌটো নিয়ে এলেন। টিম্বার প্রাণীটাকে কৌটোতে ভরে পকেটে রাখল। তারপর হেসে বলল ; ধন্যবাদ, আর একটা কথা, আমার জন্য তাঁবুর দরকার নেই, আমি বালির নিচেই থাকব। ভয় নেই পালাব না। নাহলে অমাবস্যার আগে পৌঁছতে পারব না সেখানে। কথাগুলো বলে চলে গেল টিম্বার।

হেরম্যান মন্তব্য করলেন, ‘সত্যি লোকটা অদ্ভুত !’

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই রঙের খেলা শুরু হল বালিয়াড়িতে। আগের দিনের মতোই তন্ময় ভাবে প্রকৃতির সেই রঙের খেলা দেখল সুদীপ্ত আর হেরম্যান। অন্ধকার নামার পর খাওয়া সেরে তাঁবুতে ঢুকল তারা। হেরম্যান সুদীপ্তকে বললেন, ‘রাতটা একটু সাবধানে কাটিও। ভূত-প্রেত অবদেবতার অন্য নয়। ওই রকম একটা কাঁকড়া বিছে যদি তাঁবুতে ঢোকে তবে সর্বনাশ!’ একটা ব্যাটারি লণ্ঠন জ্বেলে তাঁবুর আনাচে কানাচে ভালো করে একবার দেখে নিয়ে তারপর শুয়ে পড়ল সুদীপ্তরা।

৷৷ ৪ ৷৷

তৃতীয় দিনও আগের দিনের মতোই সূর্যোদয়ের মুহূর্তেই যাত্রা শুরু হল। বিছে মানুষ টিম্বার আগের রাতের মতোই ঘুমিয়ে ছিল বালির তলায়। এদিন অবশ্য তাকে ডাকতে বা খুঁজতে হয়নি। যাত্রা শুরুর আগে নিজেই সে বালি ছেড়ে উঠে এসেছিল। যাত্রা শুরুর সময় বার্টন বললেন ; সম্ভবত আজ বিকাল বা আগামীকাল ভোরেই যাত্রা শুরু করার পর সে জায়গার কাছাকাছি পৌঁছে যাব আমরা। কম্পাসে চোখ রেখে এগিয়ে চলল গাড়ি। এদিন যেন গরমটা আগের মতো অতটা গায়ে লাগছে বলে সুদীপ্তদের মনে হল না। অথচ বাইরের তাপমাত্রা দুপুরবেলা প্রায় পঞ্চাশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। আসলে এ দু দিনে পরিবেশের সঙ্গে বেশ খানিকটা মানিয়ে নিয়েছে তারা। দুপুর নাগাদ এক দীর্ঘ বালি খাতের মধ্যে পৌঁছে গেল তারা। তার মধ্যে দিয়েই চলতে শুরু করল গাড়ি। সে জায়গাটা দেখে বার্টন মন্তব্য করলেন, ‘খাতটা যা চওড়া ও দীর্ঘ তাতে মনে হয় বিরাট কোনো নদী প্রবাহিত হত এখান থেকে। হয়তো বা সে নদী আমাজন, রাইন বা গঙ্গার থেকেও দীর্ঘ ছিল। তারপর প্রকৃতির পরিবর্তনের কারণে জল প্রবাহের উত্তম মুখ বন্ধ হয়ে প্রথমে হলো বদ্ধ জলা, তারপর হাজার হাজার মাইল বিস্তৃত জলাও শুকিয়ে গেল একদিন। মরুভূমি হয়ে গেল জায়গাটা, শুধু লক্ষ কোটি বছরের চিহ্ন হিসাবে রয়ে গেল এই খাতটা।’

দু-পাশে বালির পাহাড়। গাড়ি কখনও উপরে উঠছে, আবার কখনও নীচে নামছে। এক সময় বালির আড়াল থেকে উঁকি মারতে লাগল ছোট-বড়, নানা আকৃতির প্রস্তর খণ্ড। বার্টন বললেন, “আমার মনে হয় সে জায়গার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, কারণ ও জায়গার এমনই বিবরণ শুনেছিলাম আমি, সেখান থেকে টিম্বারকে উদ্ধার করা হয়েছিল।

তার কথা শেষ হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। কি ব্যাপার? ড্রাইভার জানালো যে লুকিং গ্লাসে দেখছে যে পিছনের গাড়িটা হাত দেখিয়ে তাকে থামতে বলছে।

গাড়িটা থামার সঙ্গে সঙ্গেই পিছনের গাড়িটা পাশে এসে দাঁড়াল। যে গাড়িতে টিম্বারকে সঙ্গে নিয়ে বসে আছে আবদুল্লা। বার্টন তার উদ্দেশ্যে জানতে চাইল, ‘কি হল ?’

সে কিছু উত্তর দেবার আগেই টিম্বার বলল, ‘আর এগোবার দরকার নেই, আমরা পৌঁছে গেছি।’

‘পৌঁছে গেছি?’

‘হ্যাঁ, এটাই মহান থুলুর সাম্রাজ্যের প্রবেশ দ্বার। আমার প্রভুর রাজ্যে আপনাদের স্বাগত’ বলে উঠল বিছে মানুষ টিম্বার। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সুদীপ্তরা। চওড়া খাটা এখানে আরও বিস্তীর্ণ। নানা দিকে শিরা-উপশিরার মতো বিভক্তও হয়েছে সেখান থেকে খাতের দু-পাশে কোথাও বালির পাহাড় আবার কোথাও কোথাও জেগে আছে বিরাট বিরাট পাথর। বার্টন চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘এ জায়গা যে ফসিলের যাদুঘর তা দেখেই অনুমান করতে পারছি। খাতের দেওয়ালগুলো একটু খুঁড়লেই তার গা থেকে বেরিয়ে আসবে বিভিন্ন জলজ প্রাণীর ফসিল। ইউরিপুটেরাসের ফসিল ও পাওয়া যেতে পারে।’

হেরম্যান হেসে বললেন, ‘তবে আমরা কিন্তু এসেছি জ্যান্ত ইউরিপুটেরাসের খোঁজে।’ গাড়ি থেকে টিম্বার নামতেই তাকে ঘিরে দাঁড়াল সুদীপ্তরা। বার্টন তাকে বললেন, তুমি ঠিক চিনতে পারছে তো জায়গাটা?’

টিম্বার জবাব দিল, ‘হ্যাঁ। আমি আগে এসেছি এখানে। এই সেই জায়গা। মহান থুলুর দর্শন এবার আমাকে পেতেই হবে, পেতেই হবে. . .।’ কথাগুলো বলে ইশারায় সুদীপ্তদের তাকে অনুসরণ করতে বলে সে হাঁটতে শুরু করল বালি খাত বেয়ে। তার পিছন পিছন এগোন সুদীপ্তরা। বেশ কিছুটা এগোবার পর সে খাতের গায়ের একটা বেশ বড় পাথরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পাথরটার অর্ধেকটা বালিতে ঢাকা পড়ে আছে। সে দু-হাত দিয়ে সরাতে শুরু করল বালিগুলো। ধীরে ধীরে পাথরের গায়ে ফুটে উঠতে লাগল একটা ছবি। হেরম্যান আর সুদীপ্তও হাত লাগল তাকে সাহায্য শুরু করল তাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বালি সরে গিয়ে পাথরের গায়ে ফুটে উঠল একটা কাঁকড়া বিছের আবছা ছবি ! আকারে অন্তত সেটা তিন ফুট হবে! কে ছবি একে রাখল এই পাথরের বুকে? বার্টন তার পোশাকের ভিতর থেকে একটা ব্রাশ বার করে পাথরটার গায়ে বোলাতে শুরু করলেন ছবিটাকে আরও ভালো করে ফুটিয়ে তোলার জন্য। কাজটা করতে করতেই তার মুখটা যেন বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল। এরপর তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘এটা ছবি নয়! ছবি নয়!’

হেরম্যান বললেন, ‘তবে কি ফসিল ?

বার্টন উল্লসিত ভাবে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফসিল। এও এক দানব কাঁকড়াবিছা টেরিগোটাসের ফসিল। ইউরিপুটেরাসের সময় কালেই এদের দেখা মিলত। এরাও আট-ন ফুট লম্বা হতো। লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে এ ফসিল আমি দেখেছি। এখানে পা রেখেই যে এমন কিছু দেখব আমি ভাবিনি। ফসিলটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে।’ এই বলে তিনি তাকালেন টিম্বারের দিকে।

টিম্বারের মুখে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠেছে। সে বলল, ‘এগুলো আমার প্রভুর চিহ্ন। প্রভুর অনুচররা ঘুমিয়ে আছে পাথরের মধ্যে। আমার প্রভু যেদিন জেগে উঠবেন, সেদিন এরাও ঘুম ভেঙে পাথরের বুক থেকে বেরিয়ে নামবে। এর চেয়ে আরও অনেক বড় পনেরো হাত, বিশ হাত প্রাণীও ঘুমিয়ে আছে পাথরের গায়ে। তারা একটা দাঁড়ার চাপে একটা মানুষকে দু-টুকরো করে ফেলতে পারে। আমি দেখেছি তাদের ..

বার্টন বিস্মিত ভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘কোথায় দেখেছ তাদের?’

টিম্বার জবাব দিল, ‘যে নগরীতে প্রভু ঘুমিয়ে আছেন সেখানে পাথরের দেওয়ালে ঘুমিয়ে আছে তারা। মহান থুলু জেগে উঠলে তারাও জেগে উঠবে। তাদের দিয়েই এ পৃথিবী শাসন করবেন থুলু। আর আমি হব তাঁর প্রধান ভৃত্য।’

হেরম্যান প্রশ্ন করলেন, ‘প্রভুর সব অনুচররা কি ঘুমিয়েই আছে? জীবন্ত কেউ নেই?’ হেরম্যানের কথা শুনে চমকে উঠে বার্টন তাকালো হেরম্যানের দিকে। তারপর প্রশ্ন করল, “তুমিও কি ‘নেক্রোনসিকন’, কিতাব আল আজিফ’ পড়েছ ?’

হেরম্যান বললেন, “না, ও বইয়ের নাম শুনেছি, পড়িনি।’

বিছে মানুষ প্রশ্ন করল, ‘তবে কেন, এ প্রশ্ন করলে?”

হেরম্যান বললেন, ‘মরুভূমির যাযাবররা অনেকে এই গল্প বলে। কেউ কেউ নাকি চোখের সামনে সেই দানবকাঁকড়া বিছেকে বালির নিচে মানুষ টেনে নিয়ে যেতে দেখেছে বলে শুনেছি!’

কথাটা শুনে টিম্বারের ঠোঁটের কোণে আবারও কেমন যেন একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। তবে সে আর কোনো কথা বলল না হেরম্যানের উদ্দেশ্যে।

বার্টন এরপর টিম্বারকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি আমাদের নিয়ে যাবে তো সে নগরীতে? যেখানে তোমার দেবতা ঘুমিয়ে আছেন?’ সেই নগরী কত দূর?

একটু চুপ করে থেকে বিছে মানুষ বলল, ‘পারব। এক রাত লাগবে সেখানে পৌঁছতে । কিন্তু তোমরা কি আমার মতো বুকে হাঁটতে পারবে?’

হেরম্যান বললেন ; হ্যাঁ পারব। কিন্তু পা থাকতে বুকে হাঁটব কেন ?”

টিম্বার বলল, ‘পায়েও হাঁটতে হবে, বুকেও হাঁটতে হবে। নইলে মহান থুলু যেখানে ঘুমিয়ে আছেন ঠিক সে জায়গাতে পৌঁছনো যাবে না। সেখানেও সবাই বুকে হাঁটে।’ সুদীপ্ত প্রশ্ন করল, ‘সবাই মানে কারা?’

টিম্বার বলল, ‘মহান থুলুর উপাসক বিছে মানুষরা। যারা তার ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা তাঁর ঘুম ভাঙাতে পারবে না। কারণ, আমি জানি কিতাব আল আজিফ’ এ লেখা আছে যে একজন সাদা মানুষ ঘুম ভাঙাবে মহান থুলুর। কিন্তু তারা সাদা মানুষ নয়। ‘আমি সেই সাদা মানুষ।’

এরপর সে যেন কেমন সন্দিগ্ধ ভাবে একবার হেরম্যান, আর একবার বার্টনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু তোমাদের দুজনের মধ্যে কেউ সেই সাদা মানুষ নয়তো? নইলে তোমরা আমাকে জেল থেকে মুক্ত করে এখানে আনলে কেন?’

বার্টন সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘না, না, আমাদের দু-জনের কেউ সেই সাদা মানুষ ন‍ই । ‘কিতাব-আল-আজিফ’ আমরা পড়িনি। তোমার মুখ থেকেই আমরা এই সাদা মানুষের ব্যাপারটা প্রথম শুনলাম। আমরা শুধু এখানে এসেছি পাথরের গায়ে আঁকা দানব কাঁকড়া বিছের খোঁজে।’

তার কথা শুনে বিছে মানুষ মনে হয় একটু আশ্বস্ত হলো। সে প্রথমে স্বগোতক্তি করল, ‘হ্যাঁ, সে পুঁথি তোমাদের পড়ার কথা নয়।’ তারপর বলল, ‘কিন্তু সেই মৃত নগরীতে গিয়ে যদি তোমরা আর ফিরে না আসো? সাদা মানুষের ব্যাপারটা সেখানের লোকরাও জানে। তাই তারা পছন্দ করে না সাদা লোকদের। তাদের বিশ্বাস, সাদা মানুষদের প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে একদিন অবশেষে তাদের আহ্বানেই জেগে উঠবেন আদিম মহাবৃদ্ধ দেবতা মহান থুলু।’

সুদীপ্ত তার কথা শুনে সেগুলো তার অসংলগ্ন প্রলাপ কিনা বুঝতে পারল না। কিন্তু সে বলে উঠল, ‘কিন্তু তুমিও তো সাদা চামড়ার মানুষ?”

বিছে মানুষ বলে উঠল, ‘সে জন্যই তো আমি প্রথমবার এসে প্রবেশ করতে পারলাম না দেবতার উপসনা স্থলে। সেখানে পৌঁছবার জন্য কিছু উপকরণের প্রয়োজন ছিল আমার। যেখানে সেগুলো রাখা ছিল যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন সময় পেরিয়ে গেল । আমাকেও দেখে ফেলল ওরা। পালিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে হল আমাকে। আচ্ছা অমাবস্যাটা কবে ?

বার্টন জবাব দিলেন, ‘আগামী পরশু। মাঝে আর দুই রাত বাকি।’

বিছে মানুষ বিড় বিড় করে বলল, ‘তার মধ্যেই আমাকে পৌঁছতে হবে সেখানে। পৌঁছাতেই হবে।’

বার্টন সম্ভবত এরপর তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঠিক সেই সময় দূর থেকে আবদুল্লার কণ্ঠস্বর শোনা গেল—‘সাহেবরা জলদি এদিকে আসুন, জলদি।’

নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে! আবদুল্লার ডাক শুনে বালি খাতের মধ্যে দিয়ে সুদীপ্তরা সঙ্গে সঙ্গে এগোল সেদিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আবার ফিরে এলো গাড়িগুলোর কাছে সেখানে আবদুল্লা আমাদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সে জায়গায়। আবদুল্লা একটু উত্তেজিত ভাবে বেশ দূরের একটা বালি পাহাড়ের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘ওই দেখুন!”

সুদীপ্তরা তাকাল সেদিকে। একটা কালো রেখা যেন দেখা যাচ্ছে সেখানে। রেখাটা নড়ছে।’

হেরম্যান প্রশ্ন করলেন, ‘কি ওটা?’

আবদুল্লা বলল, ‘একটা কাফেলা! একদল লোক! এদিকেই আসছে!’ বার্টন বললেন, ‘ওরা কারা?’

আবদুল্লা জবাব দিল, ‘হয় মরু যাযাবর, নয় মরুদসু। এ জায়গার একটু বদনাম আছে। তাই অন্য লোক এদিকে আসে না ।’

সুদীপ্তর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়েছিল বিছে মানুষ টিম্বার। সে যেন সে দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে নিজের মনেই বলে উঠল, “তারা কি তবে এর মধ্যেই খবর পেয়ে গেল যে সাদা মানুষ পা রেখেছে মহান থুলুর রাজত্বে? আমরা তো ওদিকেই যাব।’

কথাটা অন্য কারো কানে না গেলেও সুদীপ্তর কানে যেতেই সে ফিরে তাকাল বিম্বারের দিকে। স্পষ্ট উত্তেজনার ভাব ফুটে উঠেছে তার চোখেমুখে। বার্টন, আবদুল্লাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমাদের কি করণীয়?”

আবদুল্লা জবাব দিল, ‘আমাদেরও বন্দুক আছে। ওরা যদি দস্যু হয় তবে লড়াই দেব। তাছাড়া অন্য কিছু করার নেই। আর যাযাবররাও অনেক সময় এসে এটা দাও—ওটা দাও’ বলে দাবি করে। বিশেষত জল আর শুকনো খাবার চায় ওরা। সেটাও এক ধরনের ডাকাতি। তেমন হলেও বাঁধা দিতে হবে। আমরা এখন যেখানে এসেছি সেখানে জল সোনার চেয়েও দামি।’

এ কথা বলার পর একটু থেমে আবদুল্লা বলল, ‘অবশ্য আর একটা কাজ করা যেতে পারে। গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া যেতে পারে।’

কিন্তু তার কথা শেষ হতে না হতেই বিছে মানুষ বলে উঠল, ‘তোমরা গেলে যাও।

আমি এখানেই লুকিয়ে থাকব। ওরা যেদিক থেকে আসছে সেদিকেই যেতে হবে আমাকে। অন্য কোথাও চলে গেলে আমি হয়তো ঠিক সময় সে জায়গায় পৌঁছতে পারব না । তার কথা শোনা মাত্রই বার্টন বলে উঠলেন, ‘না, আমরা এখানেই থাকব। দেখা যাক ওরা কারা? তারপর যা হবার তা হবে।’

সেই কালো রেখাটা ক্রমশ চওড়া হয়ে এগিয়ে আসছে। এক সময় বোঝা গেল সত্যিই সেটা একটা উঠের কাফেলা। বালি পাহাড়ের আড়াল থেকে বেড়িয়ে খাত বেয়ে সুদীপ্তদের দিকে এগিয়ে থামতে লাগল মরুভূমির আগন্তুকরা।

আবদুল্লার নির্দেশে প্রথমে পাশাপাশি সারা বেঁধে দাঁড় করানো হল চারটে গাড়িকে। প্রতিটা গাড়ির বনেটে উঠে দাঁড়াল একজন করে রাইফেলধারী কুলি। আর জনা চারেক রাইফেল হাতে আশ্রয় নিল খাতের গায়ে বড়বড় পাথরের আড়ালে। যাতে তেমন কিছু হলে তারা আড়াল থেকে গুলি চালাতে পারে। আর বাকি লোকজন সমেত সুদীপ্তরা খাতের একটা প্রশস্ত অংশে দাঁড়িয়ে লোকগুলোর আগমনের প্রতীক্ষা করতে লাগল । এক সময় সুদীপ্তদের বেশ কাছাকাছি চলে এল দলটা। গোটা পনেরো উট। তার পিঠে সওয়ারি আর নানা লটবহর। কাফেলাটা কাছাকাছি আসতেই আবদুল্লা বলল, ‘যাযাবরই মনে হচ্ছে। সঙ্গে জেনেনা আছে দেখছি! তবুও সতর্ক থাকতে হবে আমাদের।’

সুদীপ্তও খেয়াল করল সত্যিই কয়েকটা উঠের পিঠে মহিলা আর বাচ্চাকাচ্চা আছে ! তবুও আবদুল্লার সতর্ক থাকার কথা শুনে সুদীপ্ত একবার নিজেদের অবস্থা বোঝার জন্য চারপাশে লোকজনদের দিকে তাকাল। আবদুল্লা কাঁধ থেকে তার রাইফেল হাতে নিয়েছে। সুদীপ্তদের অনেকেরই হাত তাদের কোমরবন্ধনিতে গোঁজা বাঁকানো ছুরির বাঁটে। ঠিক সেই সময় সে আর একটা জিনিস খেয়াল করল। বিছে মানুষ টিম্বার তাদের সঙ্গে নেই। কোথায় যেন সে উবে গেছে! সুদীপ্ত ব্যাপারটা বলতে যাচ্ছিল হেরম্যানকে কিন্তু তার আগেই হুড়মুড় করে তাদের সামনে এসে দাঁড়াল দলটা। উটের পিঠে বসে থাকা লোকগুলোর মাথায় পাগড়ি, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে পরনে লম্বা ঝুলের পোশাক। মরুভূমির প্রখর তাপ থেকে বাঁচার জন্য প্রায় প্রত্যেকের মুখেই কাপড় জড়ানো! তবে তাদের পোশাক আশাক সবই নোংরা বিবর্ণ। কয়েকটা উটের পিঠ থেকে আবার পশু চর্মের তাঁবু বা চামড়ার জলের থলি ঝুলছে। সুদীপ্তরা যেমন লোকগুলোকে দেখে অবাক হয়েছে তেমনই উটের পিঠে বসে থাকা লোকগুলোর চোখগুলো দেখে মনে হচ্ছে তারাও বেশ অবাক হয়েছে সুদীপ্তদের দেখে। বার্টন আবদুল্লাকে বললেন, ‘তোমাকেই দোভাষীর কাজ করতে হবে। কারণ! আমরা ওদের ভাষা বুঝব না ৷’

সুদীপ্তদের একদম সামনে যে উটটা এসে দাঁড়িয়েছে তাতে মাত্র একজন লোক বসে। সে তার মুখের কাপড়টা উন্মোচন করল। লোকটা বৃদ্ধ। রোদে পোড়া মুখে অসংখ্য বলি রেখা। ধুলো মাথা সাদা দাড়ি। সম্ভবত এ লোকটাই কাফেলার দলপতি। বিস্মিত ভাবে সে দেখতে লাগল সুদীপ্তদের। আবদুল্লা তাকে প্রশ্ন করল, “তোমরা কারা?’

লোকটা জবাব দিল, ‘আমরা মরু যাযাবর।’ তারপর পালটা প্রশ্ন করল, ‘তোমরা কারা ?’

আবদুল্লা জবাব দিল, ‘আমরা শহর থেকে আসছি। সাহেবদের এ জায়গা দেখাতে এসেছি।’

জবাব শুনে মনে হয় আশ্বস্ত হল লোকটা। উটটার হাঁটু মুড়িয়ে সে মাটিতে বসাল। তারপর উটের পিঠ থেকে নেমে সুদীপ্তদের সামনে এসে দাঁড়াল। কাফেলার অন্য উটগুলো কিন্তু একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল।

হেরম্যান আবদুল্লাকে বললেন, ‘ওরা কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাচ্ছে জানার চেষ্টা করো। এ তল্লাটের খবর পাওয়া যেতে পারে এদের থেকে?’ আবদুল্লা যাযাবর সর্দারকে প্রশ্ন করল, “তোমরা কোথা থেকে আসছ? কোথায় যাচ্ছ?”

প্রশ্ন শুনে সর্দার লোকটা বলল, ‘ওই পশ্চিম থেকে আসছি, পুবে যাব। এ তল্লাট ছেড়ে যাচ্ছি আমরা ।

“ছেড়ে যাচ্ছ কেন ?

বৃদ্ধ যাযাবর সর্দার জবাব দিল, ‘বিছে মানুষরা আবার বেড়িয়ে পড়েছে মানুষ ধরতে!’

বেড়িয়ে পড়েছে। তাই পালাচ্ছি আমরা। ওরা মানুষ টেনে নিয়ে যায়।’ হেরম্যান আবদুল্লার মাধ্যমে জানতে চাইলেন ; ওরা মানুষ টেনে নিয়ে যায় কি ভাবে?’

লোকটা বলল, “ওরা বালির নীচে থাকে। ধরো তুমি বালির ওপর দাঁড়িয়ে আছো। হঠাৎ বালি সরে যাবে। ওরা দাঁড়া দিয়ে চেপে ধরবে তোমার দুটো পা। তারপর তোমাকে টেনে নিয়ে যাবে বালির নীচে।’

সুদীপ্তরা বেশ আশ্চর্য হল লোকটার কথা শুনে। যারা বালির নীচে মানুষ টেনে নিয়ে যাচ্ছে তারা তবে কারা? সেই দানব কাঁকড়া বিছে নাকি দাঁড়া অলা মানুষ? কিন্তু মানুষের দাঁড়া থাকবে কি ভাবে?’

আবদুল্লার মাধ্যমে যাযাবর সর্দারের কাছ থেকে ব্যাপারটা বুঝে নিতে যাচ্ছিলেন হেরম্যান। ঠিক সেই সময় হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটল। যাযাবর সর্দারের দৃষ্টি দিয়ে পড়ল কিছুটা তফাতে মাটির ওপর। সর সর করে বালি সরে যাচ্ছে সেখান থেকে, আর তারপরই সেখান থেকে উঁকি মারল টিম্বারের মাথা। সুদীপ্ত বুঝতে পারল যে যাযাবরদের আসতে দেখে তাদের পরিচয় বুঝতে না পেরে টিম্বার লুকিয়ে পড়েছিল বালির নীচে। কিন্তু তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সেই যাযাবর বৃদ্ধ আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, “বিছে মানুষ! বিছে মানুষ বলে। তারপর এক লাফে উটের পিঠে উঠে উটটাকে দাঁড় করিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কে তাকে ছোটাতে শুরু করল সুদীপ্তদের পাশ দিয়ে। অন্য উটগুলোও অনুসরণ করল তাকে। আবদুল্লা-সুদীপ্ত-হেরম্যানরা অনেক ডাকাডাকি করেও আর ফেরাতে পারল না তাদের। আতঙ্কিত যাযাবররা বালির ঝড় তুলে কিছুক্ষণের মধ্যে মরুভূমিতে হারিয়ে গেল ৷

হেরম্যান বললেন, ‘তাহলে কি বিছে মানুষদের ব্যাপারটা কী সত্যি? টিম্বারকে দেখে নইলে এত ভয় পেল কেন ওরা?’

টিম্বার বালি ছেড়ে উঠে এসে দাঁড়াল সুদীপ্তদের সামনে। তারপর জানতে চাইল, ‘যাযাবরের কি বলে গেল?’

বার্টন তাকে জানালেন সে কথা।

হেরম্যান টিম্বারকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা বিছে মানুষদের কাঁকড়ার মতো দাঁড়া থাকে?’

টিম্বার এ প্রশ্নর কোনো জবাব দিল না। শুধু বলল, ‘অন্ধকার নামলেই ওদিকে রওনা হব।’

বার্টন বললেন, ‘আচ্ছা তাই হবে।’

টিম্বার এরপর হাঁটতে শুরু করল অন্য দিকে। সুদীপ্ত খেয়াল করল সবাই যেন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

বেলা পড়ে আসছে। সুদীপ্তরা বড় একটা বালির ঢিপির আড়ালে বসে খাওয়া সাড়তে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে এসে হাজির হল আবদুল্লা। সে বার্টনের উদ্দেশ্যে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘একটা সমস্যা হয়েছে সাহেব। কুলি আর ড্রাইভাররা আর এগোতে চাচ্ছে না।’

‘এগোতে চাচ্ছে না কেন? সবাইকেই তো আগাম পুরো টাকা দেওয়া হয়েছে।’ —বলে উঠলেন বার্টন।

আবদুল্লা বলল, ‘ব্যাপারটা টাকা পয়সার নয়। টাকা ওরা ফিরিয়ে দিতে রাজি, কিন্তু কিছুতেই ওরা এক-পা এগোবে না ওদিকে। যাযাবর সর্দারের কথা ওরা শুনেছে। তার ওপর আপনারা যাকে সঙ্গে এনেছেন তাকে দেখে যাযাবরদের পালানোর ব্যাপারটা দেখেছে। এ দুটো ব্যাপার আমার সঙ্গীদের মনে প্রচণ্ড আতঙ্কর সৃষ্টি করেছে। তাদের অনুমান আমাদের ওই সঙ্গীও বিছে মানুষ অথবা প্রেতাত্মা। সে আমাদের নিয়ে গেলে আমরা কেউ আর ফিরব না।’

তার কথা শুনে বার্টন বললেন, ‘তেমন হলে আমরা ক-জনই ও পথে রওনা হব । জোর করে কুলিদের সেদিকে নিয়ে গেলে লাভের থেকে বেশি ক্ষতি হতে পারে। একটা গাড়ি নিয়ে নিজেরাই চালাব।

আবদুল্লা বলল, তবে আমি কিন্তু আপনাদের সঙ্গী হব। কারণ, আমি কথা দিয়েছিলাম আপনাদের সাথে থাকব বলে।’ কথাগুলো বলে আবদুল্লা চলে গেল অন্য দিকে। আর এরপরই সেখানে হাজির হলো বিছে মানুষ ৷

বার্টনকে টিম্বার বলল, ‘সেই রঙটা দাও।’

সুদীপ্ত, জানতে চাইল, ‘কিসের রঙ?’

বার্টুন বললেন, ‘ও সঙ্গে কিছুটা কালো রঙ আনতে বলেছিল সেটাই চাচ্ছে। বার্চন এরপর টিম্বারকে নিয়ে এগোলেন জিনিসটা তাকে দেবার জন্য। রঙের খেলা শুরু হয়ে গেছে মরুভূমির বুকে। সবকিছু ভুলে সুদীপ্ত তাকিয়ে দেখতে লাগল অপূর্ব সুন্দর সেই দৃশ্য।

৷৷ ৫ ৷৷

রঙের খেলা শেষ হয়ে মরুভূমিতে অন্ধকার নামতে শুরু করল। অন্ধকারের চাদরে মুড়ে গেল মরুভূমি। একটা গাড়িতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়া হল। চাঁদ উঠল এক সময়। নখের কতো সরু চাঁদ। আর দু-দিন বাদেই যে অমাবস্যা, সেই চাঁদ ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সামনে হাজির হলো টিম্বার। এতক্ষণ যেন সে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছিল। তাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল সুদীপ্তরা। সব পোশাক সে খুলে ফেলেছে। পরনে শুধু লজ্জা নিবারণের জন্য এক টুকরো কাপড়া পরা। মুখে, সারা দেহে এমন কি কাপড়ের টুকরোটাতেও সে কালো রঙ মাখিয়ে নিয়েছে। তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গাড়িতে ওঠার আগে সে সুদীপ্তর দিকে তার সেই বিছের কৌটোটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা তুমি তোমার কাছে এখন রাখো। আমার তো পকেট নেই। চাইলে দিয়ে দেবে।’ সুদীপ্ত একটু ইতস্তত করে কৌটোর মুখটা ভালো করে বন্ধ করা আছে নাকি তা দেখে নিয়ে সেটা পকেটে পুরলো।

বিছে মানুষ টিম্বার উঠে বসল ড্রাইভিং সিটের পাশে। ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলেন ডক্টর বার্টন। পিছনে সুদীপ্ত হেরম্যান আর আবদুল্লা। গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করলেন বার্টন।

গাড়ির কাছাকাছি তাদের বিদায় জানাবার জন্য এসে দাঁড়িয়েছিল কুলি ও ড্রাইভারের দল। তারা যেন একযোগে মাথা নিচু করে কী বলতে শুরু করল। সুদীপ্ত তাই দেখে আবদুল্লাকে প্রশ্ন করল, ‘ওরা কি বলছে?’

আবদুল্লা বলল, ‘ওরা ওপর অলার কাছে প্রার্থনা করছে যাতে আমরা নির্বিঘ্নে ফিরে আসতে পারি সে জন্য।’

গাড়ির হেড লাইট জ্বলে উঠল। যাত্রা শুরুর সময় বিছে মানুষ টিম্বার বলল, ‘আমি যে ভাবে গাড়ি চালাতে বলব সে ভাবেই যেন গাড়ি চলে। নইলে বিপদ হবে।’ বার্টন বললেন, ‘হ্যাঁ, সে ভাবেই গাড়ি চলবে। চিন্তা নেই।

আবছা আলোতে বালি খাতের মধ্যে দিয়ে চলতে শুরু করল গাড়ি। খাতের দু-পাশে বালির প্রাচীর। তার গায়ে মাঝে মাঝে উঁকি মারছে ছোট-বড় পাথর খণ্ড। আকাশের বুকে যে চাঁদ জেগে আছে তার আলো পৃথিবীর বুকে প্রায় আসছে না বলা চলে। গাড়ির হেডলাইটই চলার পথে ভরসা। চওড়া খাটটার গা বেয়ে বেরিয়েছে আরও নানা খাত সেগুলো বেশ সঙ্কীর্ণ। মাত্র ফুট পনেরো-কুড়ি চওড়া সেগুলো। ঘণ্টা তিনেক চলার পর টিম্বারের নির্দেশে তেমনই একটা খাতে প্রবেশ করল সুদীপ্তদের গাড়ি। খাতটা যেন ক্রমশ ঢালু হয়ে এগিয়েছে সামনের দিকে। অজস্র শাখা-প্রশাখা তার। মাকড়সার জালের মতো তার এঁকে বেঁকে চলে গেছে নানা দিকে। বড় খাতটা দিয়ে ঘণ্টা তিনেক চলার পর বিছা মানুষ একটা সংকীর্ণ খাতের মুখে হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। সেখানে খাতের গায়ে জেগে আছে একটা পাথর। সুদীপ্তরাও নেমে পড়ল তার সাথে। বিছে মানুষ বলল পাথরটার গায়ে গাড়ির আলো ফেলো। আলো ফেলা হলো। টিম্বার সে পাথরের গা থেকে বালি ঝাড়তেই তার গায়ে ফুটে উঠল একটা কাঁকড়াবিছের ছবি। টিম্বার সেটা দেখে আশ্বস্ত হয়ে বলল, ‘রাস্তা চিনতে ভুল হয়নি আমার। এবার এই মরু খাতটা ধরতে হবে।’

সেই মতো আবার গাড়িতে উঠে পথ চলা শুরু হলো সেই সংকীর্ণ খাত ধরে। বিছে মানুষের নির্দেশ মতোই সে খাতের গলি ঘুঁচি বেয়ে বিভিন্ন বাঁক নিয়ে সুদীপ্তরা এগিয়ে চলল। চলতে চলতে হেরম্যান এক সময় সুদীপ্তকে চাপাস্বরে বললেন, “আমরা ক্রমশ মরুভূমির সাধারণ ভূমিস্তর ছেড়ে নীচের দিকে এগোচ্ছি। দেখছ বালি খাতের দু-পাশের দেওয়ালের উচ্চতা ধীরে ধীরে কেমন বেড়ে চলেছে!’

চলার পথে আরও বার কয়েক সুদীপ্তদের গাড়ি থামাতে হলো বিছে মানুষ টিম্বারের কথামতো। কখনও একলা সে গাড়ি থেকে নেমে আবার কখনও বা সুদীপ্তদের সঙ্গী করে খাতের গায়ে পাথরের গায়ে আঁকা চিহ্ন দেখে গন্তব্য নির্ধারণ করল। সে সব পাথরের গায়ে বিছের ছবি আঁকা। সুদীপ্তরা তাদের যাত্রা শুরু করেছিল চাঁদ ওঠার পর সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। পাঁচ ঘণ্টা পর রাত বারোটা নাগাদ টিম্বারের নির্দেশে এক জায়গাতে থামল সুদীপ্তরা। সে জায়গার বেশ কিছুটা আগে থেকেই খাতের এক পাশের গা থেকে উঁকি দিতে শুরু করেছে পাথুরে দেওয়াল। সেই দেওয়াল প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচু। ভূমিস্তর থেকে এতটাই নীচে নেমে এসেছে সুদীপ্তরা।

গাড়ি থেকে নামল সকলে। বিছে মানুষ বলল, ‘এবার মহান থুলুর নগরীতে পা রাখতে চলেছি আমরা। গাড়ি আর যাবে না। আমি যে ভাব চলব সে ভাবেই তোমরা অনুসরণ করবে আমাকে।’

আবদুল্লা বলল, ‘গাড়ি আর যাবে না কেন? রাস্তা তো রয়েছে সামনে ?” তার কথা শুনে আবছা হাসল বিছে মানুষ টিম্বার। সে বলল, ‘একটা ছোট কাপড় থাকলে দাও।’

হেরম্যান সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে রুমাল বার করে এগিয়ে দিলেন তার দিকে। টিম্বার একটা খুব ছোট্ট পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে তার একপ্রান্তে বাঁধল পাথরটা। গাড়ির হেড লাইট জ্বালানোই আছে। তার আলোতে সামনের রাস্তার বেশ কিছুটা অংশ আলোকিত। টিম্বার পাথরের টুকরো বাঁধা সেই রুমালটা ছুড়ে দিল কিছুটা তফাতে রাস্তার ঠিক মাঝখানে। প্রথমে ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না তারপরই দেখা গেল রুমালটা আস্তে আস্তে যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে! সুদীপ্ত বলে উঠল—’চোরাবালি !’

বিছে মানুষ টিম্বার বলল, ‘হ্যাঁ, চোরাবালি। মহান থুলুর মৃত নগরী ঘিরে রেখেছে এই অদৃশ্য মৃত্যু ফাঁদ। এই নগরীর সন্ধানে এসে কত মানুষ যে এর নিচে হারিয়ে গেছে তার হিসাব নেই। আমি যে ভাবে পা ফেলবে সে ভাবেই চলবে।’

টিম্বারকে অনুসরণ শুরু করল তারা। পাথরের দেওয়ালের পা ঘেসে টিম্বার সাবধানে পা ফেলে হাঁটছে। কখনও থমকে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করছে, তারপর আবার হাঁটছে। মাঝে মাঝে বাঁকও নিচ্ছে সে। ক্রমশ সংকীর্ণ খাতটার গোলোক ধাঁধায় প্রবেশ করতে লাগল তারা। পাথরের দেওয়ালগুলোর গায়ে জেগে আছে অসংখ্য ছোট-বড় গর্ত। তার ভিতর জমাট বাঁধা অন্ধকার। রাত বেড়ে চলল ক্রমশ, তার সাথে এগিয়ে চলল সুদীপ্তরা সেই মৃত নগরীর দিকে। চলার যেন বিরাম নেই। সুদীপ্তর এক এক সময় মনে হতে লাগল এই অন্ধকার মরুখাতে যেন সে এমন ভাবেই যুগ যুগ ধরে হেঁটে চলেছে। শেষ রাতে অবশেষে বিছে মানুষ থামল। বার্টনকে সে বলল, ‘আলো জ্বালাও ।

একটা টর্চ জ্বালালেন বার্টন। টিম্বার সেই টর্চটা হাতে নিয়ে আলো ফেলল পাথরের দেওয়ালের গায়ে। বেশ বড়বড় গর্ত কিছুটা তফাতে তফাতে চলে গেছে দেওয়ালের গা বেয়ে। সুদীপ্তদের দেখে মনে হল যে গর্তগুলো প্রাচীন হলেও যেন প্রাকৃতিক নয়। মানুষের হাতে গড়া গোল নিটোল গর্ত। হেরম্যান তা দেখে প্রশ্ন করলেন, ‘এগুলো কিসের গর্ত?”

টিম্বার জবাব দিল, ‘ওগুলো বিছে মানুষদের যাওয়া আসার পথ।’

টর্চটা নিয়ে একটার পর একটা গর্তর গায়ের বালি ঝেড়ে সেগুলো দেখতে দেখতে এগিয়ে চলল টিম্বার। মাঝে মাঝেই দেওয়ালের গায়ে ফুটে উঠছে বিছের ছবি। এক সময় একটা গর্তের পাশের দেওয়ালের গায়ে বালি ঝাড়তেই বেড়িয়ে এল দুটো বিছের ছবি। দু-পাশের দুটো বিছে যেন তাদের দেহের পিছনের অংশ ওপর দিকে তুলে ধরে ঘিরে রেখেছে গর্তটাকে। সেটা দেখার পর টিম্বার সুদীপ্তদের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘এ পথেই আমি মহান থুলুর আবাসস্থলে পৌঁছে ছিলাম, আবার এ পথেই পালিয়েছিলাম।

আমি প্রবেশ করব এ পথে। তোমরা কি যাবে? এখানে একবার তোমরা ঢুকলে আর নাও ফিরে আসতে পারো। যদি আমি মহান থুলুর প্রধান সেবক না হতে পারি তবে বিছে মানুষরা হত্যা করবে তোমাদের। বিশেষত সাদা মানুষদের উৎসর্গ করবে মহান দেবতা থুলুর উদ্দেশ্যে।’ কথাগুলো শুনে একটু থমকে গেল সুদীপ্তরা। বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তারা। মৌনতা ভঙ্গ করে এক সময় হেরম্যান বললেন, ‘মৃত্যু তো যে কোনো সময় নেমে আসতে পারে জীবনে। এত দূর যখন এসেছি তখন শেষ না দেখে ফিরব না। যার সন্ধানে আমরা এসেছি তাকে দেখার পর যদি মৃত্যুও হয় তবে তেমন আফশোস থাকবে না।’

বিছে মানুষ এরপর প্রশ্ন করল, ‘এ পথে যেতে হলে কিন্তু আমার মতো বিছে মানুষ হতে হবে? পারবে তো?”

বার্টন বললেন, ‘অর্থাৎ, বুকে হাঁটতে হবে তো? পারব।’

আধো অন্ধকারে আবছা একটা হাসি যেন ফুটে উঠল বিছে মানুষ টিম্বারের মুখে। সে বলে উঠল, “আচ্ছা চলো তবে। হে পৃথিবীর অধীশ্বর মহান থুলু, তোমার ঘুম ভাঙাবার জন্ম, পৃথিবীতে তোমার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য তোমার সেবক প্রবেশ করছে তোমার আবাসে। তুমি আমাদের রক্ষা করো।’—এই বলে সে প্রবেশ করল সেই গর্তর মধ্যে। একে একে তাকে অনুসরণ করল অন্যরা। ঠিক যে সময় সূর্যদয়ের প্রত্যাশাতে মরুভূমির আকাশে শুকতারা ফুটে উঠল ঠিক সে সময় সেই সুড়ঙ্গর অন্ধকারে প্রবেশ করল সুদীপ্তরা।

সুড়ঙ্গর ভিতরটা কী ঠান্ডা। মাটি থেকে ছাদের উচ্চতা খুব বেশি হলে চার ফুট হবে। যেন এক ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালীতে প্রবেশ করেছে সবাই। হেঁটে চলার কোনো উপায়ই নেই। দেওয়াল, ছাদগুলো এবড়ো খেবড়ো হলেও মেঝেটা মসৃণ। নইলে বুক ছিঁড়ে যেত সবার। বিছে মানুষ টিম্বারকে অনুসরণ করে বুকে হেঁটে এগিয়ে চলল সুদীপ্তরা। তবে টিম্বারের মতো হাত আর বুকে ভর দিয়ে অত দ্রুত চলতে পারা সম্ভব নয় অন্যদের পক্ষে। কিছুটা করে এগিয়ে টিম্বারকে তাই মাঝে মাঝে থামতে হচ্ছে সুদীপ্তদের জন্য। প্রধান সুড়ঙ্গ থেকে আরও নানা সুড়ঙ্গ বেড়িয়েছে নানা দিকে। ছোট অথবা একই আকারের সুড়ঙ্গ। সুদীপ্তদের সকলের কাছেই টর্চ আছে। চলতে চলতে মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালাতে বলছে টিম্বার। টর্চের আলোতে সুড়ঙ্গগুলোর প্রবেশ মুখের গায়ের দেওয়ালে ফুটে উঠছে কাঁকড়া বিছের ছবি। তা দেখে কোন পথে যেতে হবে তা নির্ধারণ করছে টিম্বার। একটানা বুকে হেঁটে দীর্ঘক্ষণ চলা যায় না। তাই মাঝে মাঝে উঠে বসে জিরিয়ে নিতে হচ্ছে সুদীপ্তদের। তারপর আবার চলা। এভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটতে লাগল ভূগর্ভস্থ সেই সুড়ঙ্গ পথে। বাইরে সূর্য অনেক আগেই উঠে মাঝে আকাশে যাত্রা শুরু করেছে। সে আগুন বৃষ্টি করছে মরুভূমির বুকে। অথচ সুড়ঙ্গর ভিতরে কী ঠান্ডা! অন্ধকার। সত্যিই যেন মৃত পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে তারা।

শুধু চলা, আর মাঝে মাঝে বিশ্রাম। মাঝে মাঝে দেওয়ালের গায়ে আঁকা ছবি দেখে নতুন সুড়ঙ্গে বিছে মানুষের পিছন পিছন প্রবেশ করেছে সুদীপ্তরা। হেরম্যান এক সময় বিছে মানুষকে প্রশ্ন করলেন, ‘সুড়ঙ্গগুলোর মুখের পাশে সবই তো একই রকম কাঁকড়া বিছের ছবি! তবে তুমি রাস্তা চিনছ কি ভাবে?’

টিম্বার জবাব দিল, ‘চিনছি ওদের হুল দেখে। ছবিগুলো একই মনে হলেও আসলে একই নয়। লেজের পিছনের উঁচিয়ে ধরা হুলটা আঙুলের মতো পথ নির্দেশ করছে, রাস্তা দেখাচ্ছে। হুল যদি খাড়া ওপরের দিকে থাকে তবে সে সুড়ঙ্গ ওপরে উঠে গেছে, পিছনে ফেরানো থাকলে সুড়ঙ্গর শেষ প্রান্তে রাস্তা বন্ধ, নীচের দিকে থাকলে মাটির আরও গভীরে নেমেছে সুড়ঙ্গ, আর সুড়ঙ্গর মুখের দিকে তর্জনীর মতো থাকলে সেটাই আমাদের পথ ।

কতক্ষণ তারা চলছে তার হিসাব ছিল না সুদীপ্তর। এক সময় ঘড়ির দিকে তাকাতেই চমকে উঠল সে। পাঁচটা বাজে! অর্থাৎ সারাটা দিন সুড়ঙ্গর মধ্যেই কেটে গেছে তাদের! বাইরের মরুভূমিতে এতক্ষণে নিশ্চই বিদায়ী সূর্যের রঙের খেলা শুরু হয়েছে! এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সুড়ঙ্গ বেয়ে একটা ছোট খাটো ঘরের মতো জায়গায় প্রবেশ করল তারা। অনেকক্ষণ পরে সেখানে ঢুকে উঠে দাঁড়িয়ে বেশ আরাম বোধ করল সকলে। বুকে হেঁটে আর বসে সারা দিন কেটেছে। দাঁড়াবার সুযোগ তারা পায়নি। উঠে দাঁড়িয়ে সুদীপ্তরা আড়মোড় ভাঙার পর বিছে মানুষ বলল, ‘আলো জ্বালাও। এখানেই সেবার জিনিসগুলো লুকিয়ে রেখে গেছিলাম।’

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই এক সাথে চারটে টর্চের আলো ছড়িয়ে পড়ল জায়গাটাতে। বেশ বড় ঘরের মতো জায়গাটা। পাথুরে দেওয়াল, পাথুরে ছাদ। সে ছাদ অন্তত পনেরো ফুট উঁচু হবে। মাথার ওপর ছাদের ঠিক নীচেই চার দেওয়ালে চারটে বেশ বড় গর্ত আছে। সম্ভবত ও পথে ওপর থেকে ঘরে প্রবেশ করা যায়। বার্টনের টর্চের আলো ঘুরতে ঘুরতে এক সময় থমকে দাঁড়াল এক পাশের দেওয়ালের গায়ে। সেখানে খোদিত আছে বিশাল এক কাঁকড়া বিছের মূর্তি। তার আকার অন্তত আট ফুট হবে। সেটা দেখে বার্টন এগিয়ে গেলেন সেখানে। তারপর সেটা পরীক্ষা করে উল্লসিত ভাবে চিৎকার করে উঠলেন, ‘আরে এ যে খুনে বৃশ্চিক ইউরিপুটেরাসের সামিল! এটা ছবি নয়! এর সন্ধানেই তো এসেছি আমি!’ এরপর তিনি আনন্দে প্রায় নাচতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে বিছে মানুষ বলে উঠল, ‘চুপ চুপ। এর চেয়েও অনেক বড় আকারের ও জিনিস এখানে আপনি দেখবেন। আমরা এখন নগরীর একদম ভিতরে প্রবেশ করেছি। শব্দ শুনে বিছে মানুষরা এখনই ছুটে আসবে। আমরা কেউ প্রাণে বাঁচব না। একদম চুপ।

কথাটা শুনে বার্টন থেমে গেলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি বিস্মিত ভাবে হাত বোলাতে লাগলেন দেওয়াল গাত্রের সেই ফসিলের ওপর। ঘরের মতো জায়গাটার মেঝেতে ছড়িয়ে আছে পুরু বালির রাশি। টর্চের আলোতে তার একটা কোণের বালির সরাতে শুরু করল টিম্বার। কিছুক্ষণের মধ্যেই বালির নীচ থেকে বেড়িয়ে এল অদ্ভুত কয়েকটা জিনিস। কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো খাঁজকাটা ধারালো বেশ বড় দুটো ধতব দাঁড়া আর একটা কাঁকড়া বিছের হুলের মতো তীক্ষ্ণ বেশ বড় ধাতব হুল! হেরম্যান জিনিসগুলো ভালো করে দেখার জন্য পিঠের কিট ব্যাগ থেকে একটা ইলেকট্রিক লণ্ঠন বার করে সেটা জ্বাললেন। বিছে মানুষ টিম্বার প্রথমে দু-পায়ের পাতা একসাথে করে সেই ধাতব হুলটার মধ্যে পায়ের পাতা দুটো ঢুকিয়ে নিল। তারপর গ্লাভসের মতো দু-হাতে ধাতব দাঁড়া দুটো পড়ে শুয়ে পড়ে দেহের পিছনের অংশটা ওপর দিকে তুলে ধরল। কালো রঙ মাথা বিছে মানুষের দেহ, দু-হাতে বিরাট দাঁড়া, হুলটা পিছনের দিকে এমন ভাবে তুলে ধরল সে, যেন সে সত্যি একটা কাঁকড়া বিছে! সুদীপ্তরা তাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ সে বুকে ভর দিয়ে শুয়ে তাঁর ধাতব হুল সমেত দেহের পিছনের অংশ অর্থাৎ কোমড় থেকে পা পর্যন্ত অংশটােেক পিছনের দিকে শূন্যে তুলে রাখল। বহুক্ষণ পর আবার যেন কেমন অদ্ভুত ভাব ফুটে উঠেছে তার চোখে মুখে। কিন্তু এরপর আবার সবকিছু তার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল। পা-টা নামিয়ে হাতের দাঁড়া দিয়ে জোড়া পা এর পাতা থেকে তীক্ষ্ণ ধারালো হুলটা খুলে ফেলল সে। তবে হাতের দাঁড়া দুটো সে খুলল না। ডক্টর বার্টন তখনও আচ্ছন্ন হয়ে আছেন দেওয়ালের গায়ে সেই ফসিলটার প্রতি। বিছে মানুষ টিম্বার তার উদ্দেশে বলল, ‘বার্টন এবার আমার কথা শুনুন।’

বার্টন ফিরে তাকালেন বিছে মানুষের দিকে ।

বিছে মানুষ বলল, ‘কালই তো অমাবস্যার রাত তাই না?”

বার্টন জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ।’

বিছে মানুষ বলল, ‘এ দুটো রাত এখানেই লুকিয়ে থাকতে হবে তোমাদের। আজকের রাত আর কালকের দিন রাত। ঘড়ি দেখে নিশ্চয়ই তোমরা দিন রাতের হিসাব বুঝতে পারবে। আজ রাতে অবশ্য আমি তোমাদের সাথেই থাকব, কিন্তু কাল রাতে থাকবে না। পরশু ভোরের মধ্যে যদি আমি না ফিরি তবে বুঝবে মৃত্যু হয়েছে আমার। যে পথে এসেছ সে পথেই তোমরা ফিরে যাবে তবে। সুড়ঙ্গর মাটিতে আমাদের বুকে হাঁটার চিহ্ন আছে ফিরতে তোমাদের অসুবিধা হবে না।’

হেরম্যান প্রশ্ন করলেন, ‘আমাদের ফেলে কোথায় যাবে তুমি?’

বিছে মানুষ একটু চুপ করে থেকে জবাব দিল, ‘এখানে যে বিছে মানুষ আছে তাদের মাঝে। তাদের কাছ থেকে মহান থুলুর সেবকের আসন ছিনিয়ে নিতে হবে আমাকে। যদি আমি আমার কতৃত্ব এখানে প্রতিষ্ঠা করতে পারি তবে তোমাদের মনোবাঞ্ছাও পূর্ণ হবে।

সুদীপ্ত প্রশ্ন করল, “কি ভাবে তোমার অধিকার এখানে প্রতিষ্ঠা করবে তুমি?” বিছে মানুষ টিম্বার এ প্রশ্নর কোনো উত্তর দিল না। শুধু তার হাতে পরা দাঁড়া দুটো দিয়ে পরস্পরের সাথে ঠোকা দিল। দুটো ধাতব দাঁড়ার সংঘর্ষে মৃদু ঝনঝন শব্দ উঠল। বিছে মানুষ টিম্বার এরপর বলল, ‘তোমরা এখানে থাকো। আমি এবার একটু বাইরে যাব। কাছেই একটা ফোকোর আছে। সেখান দিয়ে নীচে তাকালে মহান থুলুর উপাসনাস্থল দেখা যায়। আমি দেখে আসি বিছে মানুষরা সেখানে কি করছে?’

হেরম্যান বললেন, ‘আমরা যাব তোমার সঙ্গে?’

টিম্বার বলল, ‘এতোজন নয়। বিছে মানুষরা দেখে ফেলতে পারে আমাদের। যাযাবর সর্দারতো বলছিল তারা শিকার ধরতে বেরিয়েছে বাইরে।

হয়তো সে দলটা এখনও ফেরেনি। তাদের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারি আমরা। এক সাথে এতগুলো মানুষ এখন লুকাতে পারব না। এ পথেই ফিরবে তারা। তবে একজন আমার সাথে যেতে পারো। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে আবার ফিরে আসব।’ সুদীপ্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘তবে আমি তোমার সাথে যাব।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার বুকে হেঁটে সে ঘরের বাইরে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করল বিছে মানুষ টিম্বার আর সুদীপ্ত। টিম্বারের হাতে দাঁড়া দুটো পরা। এক হাতে সে হুলটাকে ধরে রেখে কখনও অন্য হাতে ভর দিয়ে অদ্ভুত কৌশলে বুকে হেঁটে চলেছে। সে হাতের ধাতব দাঁড়ার সাথে মেঝের ঠোকায় মাঝে মাঝে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। তাকে অনুসরণ করছে সুদীপ্ত। বেশ কিছুটা চলার পর হঠাৎই একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল তারা। ধাতব ঝনঝন শব্দ! সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল টিম্বার। কাছে পিঠে হঠাৎই যেন শুরু হল তীব্র ধাতব ঝনঝনানি। বিছে মানুষ টিম্বার বলে উঠল ; এ হল বিছে মানুষদের দাঁড়ার শব্দ! লুকিয়ে পড়ো।’ এই বলে মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যেন অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেল সে। টর্চ জ্বালাতে ভরসা হল না সুদীপ্তর। কোথায় লুকাবে সে? সেই ঝনঝন শব্দ যেন চারদিক থেকে ছুটে আসছে। পিছন ফিরে সুদীপ্ত দ্রুত বুকে হেঁটে এগোতে লাগল সেই ঘরের দিকে যেখানে হেরম্যান আছেন। সুড়ঙ্গ দিয়ে ঘরের মুখে পৌঁছে গেল সুদীপ্ত। কিন্তু ঘরে ঢোকা হল না তার। ঘরের মতো যে জায়গাটাতে হেরম্যানের বাতিটা এখনও জ্বলছে সেই আলোতে সুদীপ্ত দেখতে পেল ঘরের মতো জায়গাটারা মাথার ওপরের ফোকর গলে নিচে লাফিয়ে নামছে একের পর এক প্রায় উলঙ্গ কালো কালো মানুষ! তাদের হাতে কাঁকড়া বিছের মতো ভয়ঙ্কর ধাতব দাঁড়া। তারা ঘিরে ধরেছে হেরম্যান, বার্টন আর আবদুল্লাকে। বিছে মানুষ !

সুদীপ্ত এরপর দেখল তারা একটা দড়ি বার করে বন্দি করার চেষ্টা করছে তাদের তিনজনকে! সুদীপ্ত বুঝতে পারল ঘরে ঢুকলে সেও সঙ্গে সঙ্গে বন্দি হবে বিছে মানুষদের হাতে। এখন আর হেরম্যানদের মুক্ত করার বা কারোরই বাঁচার পথ খোলা থাকবে না। ঝনঝন শব্দ উঠছে বিছে মানুষদের দাঁড়া থেকে। বীভৎস সেই শব্দ। তাদের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে হিংস্রতা। মুহূর্তর মধ্যে নিজের কর্তব্য স্থির করে নিল সুদীপ্ত। নিঃশব্দে ধীরে ধীরে পিছু হটতে লাগল সে। অন্ধকার দেওয়াল হাতড়ে একটা সুড়ঙ্গর মুখ দেখতে পেয়ে তার মধ্যে সুদীপ্ত আত্মগোপন করল। সেখান থেকেই সে শুনতে পেল ঘরের মতো সে জায়গা থেকে বড়িয়ে দাঁড়ার ঝনঝন শব্দ করতে করতে সুড়ঙ্গ পথ ধরে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে বিছে মানুষদের দল। এক সময় সুড়ঙ্গ পথে সে শব্দ ক্ষীণ হতে হতে মিলিয়ে গেল।

৷৷ ৬ ৷৷

বিছে মানুষরা যে অমন আচম্বিতে হানা দেবে হেরম্যানরা তা অনুমান করতে পারেননি। দেওয়ালের গায়ে ফসিলটা দেখে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন জীবাশ্মবিদ বার্টন। সেই দেওয়ালের সামনে তিনি হেরম্যানকে ডেকে নিয়ে দানব বিছেটার সম্বন্ধে বোঝাচ্ছিলেন তাকে। ঠিক তখনই মাথার ওপরের চারদিকের দেওয়ালের গর্ত থেকে লাফিয়ে নীচে নেমে এল তারা। কালো কালো সব মানুষ, পরনে কৌপিনের মতো নামমাত্র পোশাক। তাদের দুই হাতে ধারালো ধাতব দাঁড়া। আবদুল্লা তার কাঁধের রাইফেল খুলে নিয়ে প্রতিরোধের একটা চেষ্টা করতে যাচ্ছিল ঠিকই কিন্তু একজন বিছে মানুষ তার দাঁড়া দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল তার মাথায়। সে ছিটকে পড়ল মেঝেতে । বিছে মানুষরা তাদের ভয়ঙ্কর দাঁড়া উঁচিয়ে ঘিরে ধরেছে হেরম্যানদের। প্রতিমুহূর্তেই একজন করে বিছে মানুষ লাফিয়ে নামছে ঘরের মতো জায়গাটাতে। ঝনঝন-ঝমঝম শব্দ হচ্ছে তাদের দাঁড়ার। হেরম্যান বুঝতে পারলেন এদের বাঁধা দেবার চেষ্টা করলে বিছে মানুষরা তাদের হিংস্র দাঁড়াগুলো দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেবে সবাইকে। তাই আত্মসমর্পণ করাই ভালো। পরে যা হবার তাই হবে। হেরম্যান বার্টনকে বললেন, এখন বাঁধা দেবেন না, ওরা যা করতে চাচ্ছে করতে দিন।’ হেরম্যানদের দিক থেকে আর বাঁধা আসছে না দেখে বিছে মানুষরা বুঝতে পারল বন্দিরা বশ্যতা স্বীকার করেছে। তারা হেরম্যান আর বার্টনকে শুয়ে পড়তে ইঙ্গিত করল। আবদুল্লা তো আগেই পড়ে ছিল মাটিতে। হেরম্যান আর বার্টন নির্দেশ পালন করলেন তাদের। তারা শুয়ে পড়ার পর তাদের তিনজনের গলাতেই ঘাসের দড়ির ফাঁস পড়িয়ে দেওয়া হলো। তারপর বুকে হেঁটে সে জায়গা ছেড়ে হেরম্যানদের নিয়ে সুড়ঙ্গ পথে এগোল বিছে মানুষরা অন্ধকার সুড়ঙ্গ। হেরম্যানদের আগে পিছে চলেছে বিছে বাহিনী। অন্তত জনা কুড়ি লোক হবে তারা। পাথরের গায়ে তাদের দাঁড়ার ঘর্ষণে ঝমঝম শব্দ হচ্ছে। সেই শব্দে মুখরিত অন্ধকার সুড়ঙ্গ। বিছের দল তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা জানা নেই হেরম্যানদের। বন্দিদের নিয়ে একটার পর একটা সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে চলেছে তারা। কখনও সুড়ঙ্গ বেয়ে ওপরে উঠছে আবার কখনও নীচে নামছে। হেরম্যানরা একটু কেউ দম নেবার জন্য কয়েক মুহূর্ত থামলেই টান পড়ছে গলার ফাঁসে। দম বন্ধ হয়ে নামছে আরও। আবার বুকে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন হেরম্যানরা। বেশ কিছুক্ষণ হেরম্যানদের নিয়ে চলার পর প্রথমে একটা ক্ষীণ আলো দেখা গেল। মশাল জ্বলছে একটা জায়গায়। মশালের আলো ৷

বেশ বড় একটা ঘরের মতো জায়গা সেখানে। একটা গুহাও বলা যেতে পারে সে জায়গাকে। তার দেওয়ালের গায়েই মশালটা গোঁজা। ঘর বা গুহার মতো সে জায়গা মাটির নীচে হলেও সুড়ঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন। ঘরের মুখের সামনে হাত দশেক চওড়া অর্ধচন্দ্রাকৃতির গর্ত বা পরিখার মতো কাটা আছে। সেখানে এসে থামল বিছে মানুষরা। সুড়ঙ্গর মধ্যে একটা লম্বা কাঠের পাটাতন রাখা আছে। কয়েকটা বিছে মানুষ সেই পাটাতনটা পেতে ফেলল গুহাটার প্রবেশ মুখের গর্তর ওপর। তারপর দলটার কয়েকজন পাটাতনটার ওপর দিয়ে বুকে হেঁটে হেরম্যানদেরও বুকে হাঁটিয়ে প্রবেশ করল সেই গুহা মতো জায়গাটাতে। বিছে মানুষদের বাকি দলটা বুকে ভর দিয়েই দাঁড়িয়ে রইল গর্তটার অন্য পাশে সুড়ঙ্গর মধ্যেই। জায়গাটাতে প্রবেশ করার পরই উঠে বসলেন হেরম্যানরা। না বসে কোনো উপায় ছিলনা। এমনভাবে তাদের টেনে আনা হয়েছে যে পাথরের সাথে বুকের ঘমটানিতে জামা ছিড়ে বুকের ছাল উঠে রক্ত বেরোচ্ছে সবার। হাতের তালুরও ছাল উঠে গেছে। ও ভাবে শুয়ে থাকা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। তারা উঠে বসাতে কিন্তু বিছে মানুষরা বাধা দিল না। তবে বিছের ভঙ্গিতে থাকা অবস্থাতেই তারা হেরম্যানদের গলার দড়িগুলো ধরে রাখল, আর কয়েকজন তাদের দাঁড়া বাগিয়ে রইল তাদের দিকে। মশালের আলোতে হেরম্যান ভালো করে দেখলেন লোকগুলোকে। তাদের গায়ের রঙ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মাথায় ছোট ছোট ঘন কুঞ্চিত চুল, ভাবলেশহীন শীতল চোখ সরীসৃপদের মতো। তারা বুকে হেঁটে চলাফেরা করে বলে হাত আর কাঁধের পেশি খুব সুগঠিত। হেরম্যানের মনে হলো আরবদের সাথে আফ্রিকানদের সংমিশ্রণেই হয়তো বা এই মানবগোষ্ঠীর উৎপত্তি।

সবাই নিশ্চুপ। বিছে মানুষরা কোনো শব্দ করছে না। যেন তারা কারো আগমনের জন্য প্রতীক্ষা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য তাদের প্রতীক্ষার অবসান হলো। হেরম্যান দাঁড়ার ঝনঝন শব্দ পেলেন। সুড়ঙ্গর বিছে মানুষদের ভিড় টেনে কে যেন আসছে! বিছেমানুষরা দু-পাশে সরে জায়গা করে দিচ্ছে তাকে আসার জন্য। অবশেষে আবির্ভূত হল সে। দু-হাতে ভর দিয়ে বুকে হেঁটে এত দ্রুত সে গর্তের ওপর পাটাতনটা পেরিয়ে হেরম্যানদের সামনে হাজির হলো যে অবাক হয়ে গেল তারা। এত দ্রুত কেউ বুকে হাঁটতে পারে!

দানবের মতো বুকে হাঁটা একটা লোক। গায়ের রঙ আবলুশ কাঠের মতো কালো। তার দু-হাতে বিশাল দুটো হিংস্র দাঁড়া। সেই ধারালো কাঁকড়া দাঁড়ার এক আঘাতেই মুণ্ডু ছিটকে যেতে পারে যে কোনো মানুষের। তার জোড়া পায়ের পাতায় একটা হুল পরানো আছে কাঁকড়া বিছের মতো। হুলটা মনে হয় সোনার। মশালের আলোতে হলদে ঝিলিক দিচ্ছে সেটা। কাঁকড়া বিছের ভঙ্গিতেই হুল সমেত পা দুটোকে পিছন দিকে তুলে ধরে সে তাকিয়ে আছে হেরম্যানদের দিকে। তার চোখদুটো অস্বাভাবিক রকম লাল আর হিংস্র। তার দিকে তাকিয়ে হেরম্যানের একটা কথাই মনে হল—খুনে ইউরেপুটেরাস!’ দানব কাঁকড়া বিছে। সম্ভবতও লোকটাই সর্দার কাঁকড়া বিছে!

সর্দার বিছে হেরম্যানদের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দুর্বোধ কর্কশ ভাষায় তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে কী যেন বলল। প্রতুত্তরে তারা দাঁড়া বাজিয়ে ঝমঝম শব্দে তুলল। বার কয়েক কথা বলল সর্দার বিছে। আর প্রতিবারই শব্দ তুলল অন্যরা। যেন তারা ওভাবে সম্মতি জানাচ্ছে সর্দারের কথায়। সর্দার বিছে তার নির্দেশ দেবার পর শেষ একবার বন্দিদের দেখে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বুকে হেঁটে মরমর করে সেই কাঠের পাটাতন পেরিয়ে ওপাশে সুড়ঙ্গর মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

সে চলে যাবার পর বিছে মানুষরা হেরম্যানদের গলার দড়ি খুলে নিল। তারপর সে জায়গা ছেড়ে বুকে হেঁটে কাঠের পাটাতনটা অতিক্রম করে ও-পাশে পৌঁছে পাটাতনটা সরিয়ে ফেলল গর্তর ওপর থেকে। এ কাজ শেষ করে বিছে মানুষদের পুরো দলটাই দাঁড়ার ঝমঝম শব্দে করতে করতে অদৃশ্য হয়ে গেল সুড়ঙ্গর মধ্যে। সেখানে রয়ে গেলেন শুধু হেরম্যান বার্টন আর আবদুল্লা ৷

হেরম্যানদের ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগল। হেরম্যান ভাবতে লাগলেন—‘সুদীপ্ত এখন কোথায়?’

বেশ কিছু সময় কেটে যাবার পর মৌনতা ভঙ্গ করে বার্টন বললেন, ‘এরা আমাদের নিয়ে কি করবে?’

হেরম্যান বললেন, “ঠিক জানি না। তবে নিশ্চয় কিছু উদ্দেশ্য আছে। ঠিক এখনই কিছু করবে বলে মনে হয় না। এখন খুন করার হলে ধরা পড়ার মুহূর্তেই খুন করত।’ বার্টন বললেন সর্দার বিছেটা আমাদের দুজনকেই বিশেষভাবে দেখছিল। টিম্বার বলেছিল যে সাদা মানুষকে ওরা একদম পছন্দ করে না। তবে শেষ পর্যন্ত ওরা আমাদের খুনই করবে। একটাই আপশোস আমার রয়ে গেল। এতবড় আবিষ্কারের খবরটা পৃথিবীবাসীকে জানানো হলো না। আমি নিশ্চিত যে ওটা ইউরেপুটেরাসের ফসিল।’ এ কথা বলার পর বার্টন বললেন সুদীপ্ত আর টিম্বারও কি বন্দি হয়েছে বলে মনে হয় ?’

হেরম্যান বললেন, “আমার ধারণা বিছে মানুষরা এখনও তাদের খোঁজ হয়তো পায়নি। তাহলে তাদের বন্দিশালায় আনা হতো যদি না তাদের পরিণতি আমাদের চেয়েও খারাপ হয়ে থাকে।’

আবদুল্লা বলল, ‘এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করতে হবে। সামনের গর্তটা কোনোভাবে পেরোতে পারলেইতো সুড়ঙ্গে ঢুকে যাওয়া যাবে।’

হেরম্যান বললেন, “কিন্তু অত চওড়া গর্ততো লাফ দিয়ে পেরোনো যাবে না। আর গর্তটা কত গভীর তা কে জানে। গর্তটা পেরাবার সময় অন্ধকারে কিছু ঠাহর করতে পারলাম না। নিশ্চয়ই খুব গভীর হবে। নইলে ওই গর্তের ভরসায় ওরা আমাদের ছেড়ে রেখে যেত না।’ আবদুল্লা বলল, ‘তবুও একবার পরীক্ষা করা থাক গর্তটা। কোনো ভাবে একজন গর্তটা কোনো কৌশলে পেরোতে পারলেই পাটাতন ফেলে অন্য দু-জনকে পার করাতে পারবে।’

বিছে মানুষরা যে গর্তটার ওপাশে সুড়ঙ্গর মধ্যে কাছাকাছি নেই তা নিশ্চিত হবার পর গর্তটা পরীক্ষা করার জন্য উঠে দাঁড়াল তারা তিনজন। আবদুল্লা দেওয়া;েলর গা থেকে মশালটা খুলে নিয়ে এগোল সামনের গর্তর দিকে। তার সামনে এসে দাঁড়াল সবাই। আব ধুল্লা আলো ফেলল সেই অর্ধচন্দ্রাকৃতি পরিখার মধ্যে। পরিখাটা বেশি গভীর নয়। তার গভীরতা সম্ভবত হাত পাঁচেক হবে। বার্টন তা দেখে বললেন, ‘আরে এ জায়গাটাতো নীচে নেমে অবাই পেরিয়ে যেতে পারব। কিন্তু তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন পরিখার কালো মাটিতে একটা কম্পন শুরু হলো। সেদিকে তাকিয়ে আতঙ্কে হিম হয়ে গেল সবার শরীর। কালো মাটি নয় কালো কালো বিরাট বিরাট কাঁকড়া বিছে পরিপূর্ণ সেই গর্তটা। সংখ্যায় তারা এত যে মাটি দেখা যাচ্ছে না। মশালের আলোতে চঞ্চল হয়ে উঠেছে তারা। দু-একটা বিছে আবার দেওয়াল বেয়ে ওপরে ওঠারও চেষ্টা করছে। কেউ যদি নীচে ওদের মাঝে পড়ে যায় তবে তার যে কী অবস্থা হবে তা ভাবলে দেহের রক্ত জমে যাবে। হেরম্যানরা তাড়াতাড়ি সরে এলেন সে জায়গা থেকে।

বেশ কিছুক্ষণ তারা কেউই কোনো কথা বললেন না। হেরম্যান এক সময় বললেন, ‘আমার কাছে একটা রিভলবার আছে। যদি দেখি সত্যিই মৃত্যু নেমে আসছে তবে বাঁচার একটা শেষ চেষ্টা করব। আপাতত পালাবার পথ বন্ধ। দেখি যদি সুদীপ্ত বা টিম্বার কোনোভাবে আমাদের মুক্ত করতে পারে?’

মশালটা আগের মতোই দেওয়ালের গায়ে গুঁজে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসলেন তারা তিনজন। মশালের আলো নিবু নিবু হয়ে আসছে। হঠাৎ বার্টন বললেন, “ওই দেখুন একটা কাঁকড়া বিছে-গর্ত থেকে ওপরে উঠে এসেছে!’

তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আবদুল্লা এক লাফে উঠে পা দিয়ে পিষে দিল তাকে। বার্টন ভয়ার্ত ভাবে বললেন, ‘কিন্তু ওরা যদি এক সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে ওপরে উঠে আসে তখন?’

তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই মশালটা দপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেল। অন্ধকারের সাথে সাথে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। অন্ধকার ঘরে অন্যর হাত-পা নড়ার মৃদু খসখস শব্দ হলেও চমকে উঠতে লাগল সবাই। পিঠের কিট ব্যাগটা বন্দি হবার সময় ফেলে আসতে হলেও টর্চটা রয়ে গেছিল বার্টনের পকেটে। মৃদু শব্দ লও তিনি টর্চ জ্বালিয়ে দেখতে লাগলেন বিছের দল গর্ত থেকে ওপরে উঠে আসছে কিনা ? দেওয়ালে হেলান দিয়ে হেরম্যান ভাবতে লাগলেন সুদীপ্তর কথা। সে এখন কোথায়? অন্ধকারে সুড়ঙ্গে সে কি খুঁজে বেড়াচ্ছে হেরম্যানকে? নাকি সেও বন্দি হয়ে আছে?’

হেরম্যান যখন সুদীপ্তর কথা ভাবছিলেন তখন সুদীপ্তও সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গে বসে ভাবছিল হেরম্যানের কথা। হেরম্যানকে কোথায় টেনে নিয়ে গেল বিছে মানুষরা? তারা কি তাকে মেরে ফেলল? কথাটা ভাবতেই প্রবল যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠল সুদীপ্তর হৃৎপিণ্ড। পরক্ষণেই তার মনে হলো না, এ হতে পারে না। পাহাড়-জঙ্গল মরুভূমি সমুদ্রে ক্রিপটিড বা অদ্ভুত প্রাণীর সন্ধানে কত অভিযানে তারা একসাথে সামিল হয়েছে! কত বিপদকে এক সাথে অতিক্রম করেছে তারা, কতবার মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়েছে তারা! ‘না এ হতে পারে না।’ —মনে মনে বলে উঠল সুদীপ্ত। সুদীপ্ত হিসাব করে দেখল যে বিছে মানুষরা হেরম্যানকে ধরে নিয়ে যাবার পর ঘণ্টাখানেক সময় কেটে গেছে। নিস্তব্ধ অন্ধকার সুড়ঙ্গ কোথাও কোনো শব্দ নেই। সুদীপ্ত মনে মনে ভেবে নিল তার এখন একটা কাজ। এই সুড়ঙ্গ নগরীতে যে ভাবেই হোক হেরম্যানকে খুঁজে বার করা। যদি খারাপ কিছু হবার হয় তাহলে যেন এক সঙ্গেই হয়। যে পথে তারা এই সুড়ঙ্গ নগরীতে ঢুকেছে সে পথের ধুলোতে তাদের বুকে হেঁটে আমার চিহ্ন দেখে হয়তো সুদীপ্ত বাইরে বেরোতে পারে। ব্যাপারটা কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু সুদীপ্ত হেরম্যানকে এই মৃত নগরীতে ফেলে রেখে কিছুতেই বাইরে পালাবে না। তার চেয়ে মৃত্যু নেমে আসাও শ্রেয়। সুদীপ্ত কান খাড়া করে একবার শোনার চেষ্টা করল অন্ধকার সুড়ঙ্গে কোথাও কোনো শব্দ হচ্ছে কিনা, তারপর যে সেই ছোট্ট সুড়ঙ্গ থেকে নেমে এল মূল সুড়ঙ্গ পথে। অন্ধকারে সন্তর্পণে বুকে হেঁটে সে প্রথমে পৌঁছল সেই ঘরের মতো জায়গার সামনে। যে জায়গা থেকে হেরম্যানকে ধরে নিয়ে গেছে বিছে মানুষরা। ইলেকট্রিক ল্যাম্পটা কাত হয়ে পড়ে আছে একপাশে। তখন মৃদু আলো ছড়াচ্ছে বাতিটা হেরম্যান, সুদীপ্ত, বার্টনের ব্যাগ ইত্যাদিও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ঘরের মধ্যে। জায়গাটাতে ঢুকে ব্যাগ হাতড়ে দুটো জিনিস সংগ্রহ করল সুদীপ্ত। জলের বোতল আর একটা পেনসিল টর্চ। সুদীপ্তর ঘড়ির কাঁটায় মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। সে জায়গা ছেড়ে এরপর সে আবার সুড়ঙ্গর ভিতরে বেরিয়ে বিছে মানুষরা যে দিকে বন্দিদের ধরে নিয়ে গেছে সেদিকে এগোল। সুড়ঙ্গর মেঝের ধুলো বালিতে স্পষ্ট আঁকা হয়ে আছে বুক ঘষটে চলার দাগ, হাতের ছাপ। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালিয়ে সেগুলো দেখে চলতে লাগল সে। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর এক জায়গাতে সুড়ঙ্গর চারদিকে চারটে রাস্তা বেরিয়েছে। সেখানে চারটে সুড়ঙ্গতেই মাটির ওপর আসা-যাওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। সে জায়গায় পৌঁছে সুদীপ্ত ঠিক বুঝতে পারল না যে কোনো দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হেরম্যানদের। আন্দাজে একটা পথ ধরল সে তারপর সুড়ঙ্গ ও সুড়ঙ্গ বেয়ে খুঁজে বেড়াতে লাগল হেরম্যানদের। সুড়ঙ্গর গোলকধাঁধার মধ্যে সুদীপ্ত হারিয়ে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে সুড়ঙ্গর মেঝেতে উঠে বসে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম, তারপর আবার বুকে হেঁটে চলা। সুদীপ্তর এক সময় মনে হতে লাগল সেও যেন কোনো এক বিছে মানুষ। এটাই তার আস্তানা। আজন্ম এই ভাবেই সে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই সুড়ঙ্গ নগরীতে। ঘুরে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে …। সুদীপ্তর এক সময় রিস্ট ওয়াচের মৃদু রিনিরিনি শব্দ শুনে সুদীপ্ত বুঝতে পারল যে ভোর ছ’টা বাজে। অর্থাৎ হেরম্যানের সন্ধানে সারা রাত সুড়ঙ্গর মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছে সে। বাইরের পৃথিবীতে নিশ্চয়ই এতক্ষণে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ সুড়ঙ্গর ভিতরে জমাট বাঁধা অন্ধকার। একটা চার মাথার মোড়ে এসে থামল সুদীপ্ত। টর্চ জ্বালিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে প্রথমে সে বেশ উৎফুল্ল হল। বিছে মানুষদের অজস্র চিহ্ন সেখানে মাটিতে আঁকা আছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে হতাশায় ভেঙে পড়ল। আরে ওটাইতো সে জায়গা, যেখান থেকে সে যাত্রা শুরু করেছিল! অর্থাৎ সারা রাত ঘুরে আবার সে একই জায়গায় ফিরে এসেছে! ক্লান্ত বিধ্বস্ত সুদীপ্ত সে জায়গাতেই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল। ধীরে ধীরে চোখের পাতা বুজে এল সুদীপ্তর।

৷৷ ৭ ৷৷

ক্লান্ত-অবসন্ন-সুদীপ্ত ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখছিল হেরম্যানের সাথে কখনও সে চলেছে তুষারধবল পর্বত মালায় তুষার মানব বা ইয়েতির খোঁজে, কখনও বা তারা অভিযান চালাচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার গভীর অরণ্যে সোনার কমোডো ড্রাগনের সন্ধানে, আবার কখনও স্কুবা ডুবুরির পোশাক পরে ঝাঁপ দিচ্ছে দানব অক্টোপাসের খোঁজে সমুদ্র তলে। স্বপ্নের মধ্যে ইতিপূর্বে তাদের অভিযানগুলো যেন ছায়াছবির মতো ভেসে উঠতে লাগল। অবশেষে এক সময় ঘুম ভাঙল তার। চারপাশে অন্ধকার। প্রথমে সে বুঝে উঠতে পারল না সে কোথায় আছে। হেরম্যানকে সে ডাকতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই তার মনে পড়ে গেল সব কথা। মৃত নারীর সুড়ঙ্গে ঘুরপাক খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছিল যে ঘড়ি দেখল সুদীপ্ত। প্রায় একটানা পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়েছে সে। ঘুমাবার কারণেই সুদীপ্তর মনে হলো ক্লান্তিটা তার অনেকখানিই যেন কেটে গেছে। ঘুমন্ত অবস্থায় দেখা স্বপ্নগুলোর রেশ তখনও কাটেনি। সেই স্বপ্নগুলো যেন একটা উদ্দীপনা জাগাল সুদীপ্তর মনে । পাহাড়-জঙ্গল-সমুদ্রে অনেক অভিযান চালিয়েছে সুদীপ্ত আর হেরম্যান। সে সব অভিযানে অনেক সময় মৃত্যু তাদের পায়ে পায়ে ঘুরেছে। সিংহর থাবা। কমোডো ড্রাগনের হিংস্ৰদাঁত, অসভ্য উপজাতিদের বিষ মাখানো তির অথবা নর-পশুদের তীক্ষ্ণছোরা বা রাইফেলের বুলেট শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। বারবার তারা মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে বেঁচে ফিরেছে। তারপর আবার সামিল হয়েছে নতুন অভিযানে, নতুন প্রাণীর সন্ধানে। তাহলে এখনই বা সে এত হতাশ হবে কেন? তাকে শেষ চেষ্টা করতে হবে হেরম্যানকে খোঁজার জন্য।

কিন্তু কোন পথে যাবে সে? ঠিক পথ ধরতে না পারলে তো আগের মতোই গোলোক ধাঁধায় ঘুরে মরতে হবে তাকে। বোতল থেকে কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে সে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগল কোন পথে গেলে পাওয়া যেতে পারে হেরম্যানের খোঁজ?

ভাবতে ভাবতে এক সময় তার মনে হলো বিছে মানুষ টিম্বারের কথা। সে এখন কোথায়? সেও কি ধরা পড়ে গেছে বিছে মানুষদের হাতে। টিম্বার এই সুড়ঙ্গ নগরীর রাস্তা চিনত। সে থাকলে নিশ্চয় হেরম্যান কোন পথে গেছেন, কোথায় আছেন তা খুঁজে পাওয়া যেত। টিম্বারের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার একটা ব্যাপার ঝিলিক দিয়ে উঠল তার মনে। টিম্বার তো রাস্তা চিনছিল দেওয়ালে আঁকা বিছের হুল দেখে ওই চিহ্ন দেখেও তো রাস্তা চেনা যেতে পারে! ব্যাপারটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই সে টর্চের আলো ফেলতে লাগল সুড়ঙ্গর মুখগুলোর দেওয়ালে। সব দেওয়ালেই বিছের ছবি আঁকা। তাদের হুলগুলো বিভিন্ন ভঙ্গিতে রয়েছে। ভালো করে সেগুলো লক্ষ করার পর সুদীপ্ত দেখল একটা বিছের হুল যেন তর্জনীর মতো সুড়ঙ্গর ভিতরটা নির্দেশ করছে। সুদীপ্ত ঢুকে পড়ল সেই সুড়ঙ্গে, তারপর বুকে হেঁটে বা হামাগুড়ি দিয়ে চলতে শুরু করল সে। মাঝে মাঝে যেখানে নানা দিকে সুড়ঙ্গ বেড়িয়েছে সেখানে থামা। তারপর আবার দেওয়ালের হুলের চিহ্ন দেখে নতুন সুড়ঙ্গে প্রবেশ করা এই ভাবে চলতে লাগল সে। বাইরের পৃথিবীর সূর্যদেবও তখন মধ্যগগন অতিক্রম করে অন্যদিকে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেছে। এক সময় সুদীপ্তর মনে হলো সুড়ঙ্গ যেন ঢালু হয়ে ক্রমশ নীচের দিকে নামছে আর তার সাথে সাথে সুড়ঙ্গর পরিবেশ যেন আরও স্যাতস্যাতে, আরও ঠান্ডা মনে হচ্ছে। সেই সুড়ঙ্গ ধরে নীচে নামতে নামতে এক সময় সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে গেল। সুদীপ্ত দেখতে পেল তার সামনে বিরাট বড় একটা ছিদ্র। তার পাশে দেওয়ালের গায়ে আঁকা বিছের হুল যেন সেই ফোঁকরের ভিতরটা নির্দেশ করছে। ফোঁকরের সামনে উপস্থিত হয়ে সুদীপ্ত আলো ফেলল ভিতরে। বিরাট বড় একটা ঘরের মতো জায়গা। সে টর্চের আলো ফেলল ঘরের চারপাশে। ঘরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে লম্বা একটা পাথরের বেদি। আকারে সেটা অন্তত বারো ফুট লম্বা, পাঁচ ফুট চওড়া হবে। চারপাশের দেওয়ালগুলো ধুলোর চাদরে ঢাকা থাকলেও তারা আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে বিরাট বিরাট কাঁকড়া বিছের অস্পষ্ট মূর্তি। আকারে তারা এক একটা বারো-চোদ্দো ফুট হবে। সেগুলো পাথর খোদিত মূর্তি নাকি সেই খুনে ইউরিপুটেরাসের ফসিল তা জানা নেই সুদীপ্তর। বার্টন থাকলে নিশ্চয়ই বলতে পারতেন। কী বিরাট বিরাট দাঁড়া তাদের! চারপাশে এতো গা ছমছমে পরিবেশ সুদীপ্ত সারা সুড়ঙ্গ ঘুরেও কোথাও পায়নি। চারপাশে টর্চের আলো ফেলতে লাগল সে। সুদীপ্ত যে ফোঁকর গলে ঘরের ভিতর ঢুকেছে তার ঠিক উল্ট দিকের দেওয়ালের একই রকম একটা ফোকর। সুদীপ্ত অনুমান করল সেটা সম্ভবত বাইরে বেরোবার রাস্তা। সুদীপ্তর টর্চের আলো ঘুরতে ঘুরতে এক সময় স্থির হয়ে গেল মাথার ওপর পৌঁছে। বেদিটা যেখানে রয়েছে ঠিক তার ওপরেই ছাদের মাঝখানে বিরাট এক গহ্বর! সুদীপ্ত নীচ থেকে টর্চের আলো ফেলল মাথার ওপরের সেই গহ্বরে। দেখে মনে হলো সেটা যেন একটা চিমনির মতো সোজা ওপর দিকে উঠে গেছে। টর্চের আলো তার শেষ পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না। সুদীপ্ত সেটা ভালো করে দেখার জন্য ঘরের মাঝখানে এগোতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় মাথার ওপরের গহ্বর থেকে একটা অস্পষ্ট খচমচ শব্দ শুরু হল। সঙ্গে সঙ্গে সুদীপ্তর মনে হলো মাথার ওপরের গহ্বর থেকে বিছে মানুষরা ঘরের মধ্যে নেমে আসবে না তো? হ্যাঁ, একটা স্পষ্ট খচমচ শব্দে শোনা যাচ্ছে মাথার ওপরের গহ্বর থেকে! শব্দটা যেন ওপর থেকে ধীরে ধীরে নীচে নেমে নামছে! ভয় পেয়ে গেল সুদীপ্ত। সে আর কাল বিলম্ব না করে ছুটল যে গহ্বর দিয়ে সে ভিতরে ঢুকে ছিল তার উলটোদিকের গহ্বরের দিকে। সে যখন সেই গহ্বর দিয়ে বাইরে বেরোল ঠিক তখনই তার মনে হলো ওপর থেকে ভারী কোনো একটা জিনিস যেন খসে পড়ল ঘরের ভিতর !

সে ঘরের বাইরে বেরিয়ে সুদীপ্ত দেখতে পেল সামনে একটা সুড়ঙ্গ। সে সুড়ঙ্গ দিয়ে আবার বুকে হাঁটতে শুরু করল সে। এ সুড়ঙ্গ আবার ওপর দিকে উঠে গেছে। সুদীপ্ত বুঝতে পারল নীচে থেকে সে ওপরে উঠছে। এগোতে লাগল সে। সময়ও এগিয়ে চলল তার সাথে। এক সময় ওপরে ওঠা শেষ হলো তার। আবার সমতল সুড়ঙ্গ। নানা গলি খুঁজি। বাঁকগুলো যেখানে নানা ভাগে বিভক্ত সেখানে সুদীপ্ত আবার দেওয়ালের গায়ে আঁকা বিছের হুলের চিহ্ন দেখে পথ নির্ধারণ করতে লাগল। এক সময় তার কানে আসতে লাগল অতি ক্ষীণ অদ্ভুত নানা রকম শব্দ! মানুষের চিৎকার, ধাতব ঝনঝনানি এমন নানা শব্দ। সুদীপ্ত বুঝতে পারল সে সম্ভবত বিছে মানুষদের বাসস্থানের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে! খুব সাবধানে সে এগোতে লাগল দেওয়াল চিহ্ন অনুসরণ করে। হঠাৎ একটা বাঁকের মুখে সে একটা ক্ষীণ আলোর সন্ধান পেল। বাঁকে ফিরতেই সে দেখতে পেল কিছুটা তফাতে সুড়ঙ্গর দেওয়ালে একটা মশাল গোঁজা। এই প্রথম সুড়ঙ্গর মধ্যে সে আলো দেখল। অন্তত একশো হাত লম্বা একটা সুড়ঙ্গ। বেশ কয়েকটা উপ সুড়ঙ্গ বেরিয়েছে তার গা বেয়ে। তার ভিতরে কেউ আছে কিনা সুদীপ্তর জানা নেই তবে সামনের সুড়ঙ্গটা ফাঁকা। বেশ কিছুটা এগিয়ে সেটা আবার বাঁক নিয়েছে। তবে এ সুড়ঙ্গর ছাদটা বেশ উঁচু। মাথা একটু ঝুঁকিয়ে দাঁড়ানো যায় সুড়ঙ্গর মধ্যে। তবে সে কিন্তু উঠে দাঁড়াল না। তাতে হঠাৎ কেউ বসে গেলে চোখে পড়ার সম্ভাবনা। তাই সে বুকে হেঁটেই এগোতে থাকল দেওয়ালের গা ঘেঁসে। আসে পাশে যে উপ সুড়ঙ্গগুলো বেড়িয়ে গেছে তার ভিতর খেলা করছে জমাট বাঁধা অন্ধকার। সুদীপ্ত সে জায়গাগুলো সন্তর্পণে অতিক্রম করতে লাগল। সুদীপ্ত তখন মশালের আলোতে আলোকিত সুড়ঙ্গ প্রায় অতিক্রম করে উলটো দিকের বাঁকের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ঠিক তখনই পিছনে অস্পষ্ট একটা শব্দ শুনে সে ফিরে তাকাল ।

সুদীপ্ত দেখতে পেল একজন বিছে মানুষ আবির্ভূত হয়েছে সুড়ঙ্গে। সম্ভবত দেওয়ালের গায়ের কোনো পথ বেয়ে এই সুড়ঙ্গে নেমেছে সে। সুদীপ্ত আর তার মধ্যে হাত পঁচিশের ব্যবধান। বুকে হেঁটেই সুড়ঙ্গে নেমেছে লোকটা। মাটিতে এক হাতে ভর দিয়ে বুকটাকে মাটির ওপরে উঁচিয়ে সে বিস্মিতভাবে তাকিয়ে দেখছে সুদীপ্তকে। সে যেন ওখানে সুদীপ্তর উপস্থিতি আশা করেনি। লোকটা তার অন্য হাত দিয়ে অদ্ভুত কৌশলে মাথার ওপর ধরে রেখেছে একটা মুখ বন্ধ মাটির বড় হাঁড়ি। সুদীপ্তর সাথে কয়েক মুহূর্ত দৃষ্টি বিনিময়ের পরই সেই বিছে মানুষের চোখের দৃষ্টি কেমন যেন হিংস্র হয়ে উঠল। লোকটার হাতে দাঁড়া পড়া। সে যদি চিৎকার করে অন্য লোক ডাকে অথবা সুদীপ্তকে আক্রমণ করে তবে তার দাঁড়ার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সুদীপ্তর দেহ। সুদীপ্ত বুকে হেঁটে ছুটে পারবে না বিছে মানুষের সাথে। লোকটা সম্ভবত তার মাথার পাত্রটা মাটিতে নামিয়ে সুদীপ্তকে ধাওয়া করতে যাচ্ছিল কিন্তু সুদীপ্ত আর কোনো উপায় না দেখে পাশে পড়ে থাকা একটা পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে সজোরে দূরে ছুড়ে মারল লোকটার মাথা লক্ষ করে। পাথরটা লোকটার মাথায় না লেগে লাগল গিয়ে তার মাথার হাড়িটাতে। সঙ্গে সঙ্গে পাথরের আঘাতে চুরমার হয়ে গেল মেঠে হাড়িটা। একটা আর্তনাদ করে উঠল লোকটা। সুদীপ্ত দেখতে পেল ভাঙা হাড়ি থেকে রাশিরাশি কাঁকড়াবিছে ছড়িয়ে পড়েছে লোকটার দেহে। বাইরে বেরিয়েই সম্ভবত একসাথেই বেশ কয়েকটা কাঁকড়া বিছে একসাথে হুল বসিয়ে দিল তার দেহে। আবার একটা শুধু অস্পষ্ট আর্তনাদ করল সেই বিছে মানুষ। পরপর মৃত্যু যন্ত্রণায় তার দেহটা সুড়ঙ্গর মেঝেতে মোচড় দিতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে গেল তার দেহ। কী ভয়ঙ্কর মৃত্যু! পুরো ঘটনাটা ঘটতে সম্ভবত পনেরো সেকেন্ডে সময় লাগল। সুদীপ্ত একটা জিনিস বুঝতে পারল ঘটনাটা দেখে যে বিছে মানুষরাও বিছের বিষের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। এরপর হঠাৎ সুদীপ্ত শুনতে পেল বিছে মানুষদের দাঁড়ার শব্দ। সম্ভবত মৃত মানুষটার চিৎকার শুনে তার সঙ্গীরা ছুটে আসছে। সুদীপ্ত আর সেখানে দাঁড়াল না, বাঁক ফিরে সে প্রবেশ করল নতুন সুড়ঙ্গে। অন্ধকারে সেই সুড়ঙ্গ হাতড়ে এগিয়ে চলল সে।

টর্চ জ্বালাতে ভরসা হচ্ছে না সুদীপ্তর। কারণ, আসে পাশে নানা শব্দ শোনা যাচ্ছে। সুদীপ্ত অন্ধকার হাতড়ে এগোতে লাগল। সময়ও এগোতে লাগল তার সাথে। বাইরের পৃথিবীতে সূর্য ডুবে রাত নামল। অমাবস্যার রাত। নিশ্চিন্ত অন্ধকারে ঢেকে গেল মরুভূমি। সুড়ঙ্গর ভিতরও জমাট বাঁধা অন্ধকার। কোনোদিকে সুদীপ্ত এগোচ্ছে তা সে জানেনা। তবে নানা অদ্ভুত শব্দ কানে আসছে তার। অনেকের কলরব, ধাতব ঝনঝনাদি এ সব শব্দ! প্রতি মুহূর্তে তার মনে হতে লাগল যে এই বুঝি তার সামনে উপস্থিত হলো বিছে মানুষের দল। তাদের উপস্থিতির শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। চোখে না দেখা গেলেও সম্ভবত খুব কাছেই আছে তারা। হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরে একটা আলোক রেখা দেখতে পেল সে। সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে গেছে বাঁক ঘুরে। সামনে একটা দেওয়াল তার গায়ে বেশ বড় একটা গর্ত। আলো আসছে তার ভিতর থেকেই। নানা রকম শব্দও ভেসে আসছে। বিশেষত বিছে মানুষদের দাঁড়ার ঝনঝনানির শব্দ। বিছে মানুষরা নিশ্চয়ই আছে ওখানে। হেরম্যানও কি ওখানে আছেন? সুদীপ্ত সাহস করে এগিয়ে গিয়ে সন্তর্পণে উঁকি দিল সেই গহ্বরে। তার চোখে ফুটে উঠল ওপাশে এক অদ্ভুত দৃশ্য—

ফোকোরের ওপাশে বিশাল একটা হল ঘরের মতো জায়গা। মাথার বেশ উঁচুতে ছাদ। দেওয়ালের গায়ে সার সার মশাল জ্বলছে। তার আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সব কিছু। দেওয়ালের গা গুলোতে খোদিত আছে দাঁড়াঅলা বিছে মূর্তি। অসংখ্য গহ্বরও আছে দেওয়ালে। সম্ভবত বিভিন্ন জায়গা থেকে সুড়ঙ্গ এসে মিশেছে সেখানে। সুদীপ্ত যে গহ্বরের মুখে রয়েছে তার কয়েক হাত নিচেই ঘরটার মেঝে সে ইচ্ছে করলেই লাফিয়ে ঘরটার মধ্যে নামতে পারে। ঘরটার ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটু বাঁধানো কুয়োর মতো গহ্বর। তার বেশ কিছুটা তফাতে পাথুরে মেঝেতে সার বেঁধে বিছের ভঙ্গিতে শুয়ে আছে বিছে মানুষরা। সংখ্যায় তারা প্রায় জনা পঞ্চাশ হবে। সবার হাতেই কাঁকড়া বিছের দাঁড়া পড়া। মাঝে মাঝে নড়লে চড়লে শব্দ হচ্ছে তাতে। কালো শরীরের দাঁড়া পড়া লোকগুলোকে সত্যিই যেন বিছে বলে মনে হচ্ছে! ভালো করে দেখার পর হেরম্যানদেরও দেখতে পেল সুদীপ্ত। ঘরের এক কোণে একসাথে দড়ি বাঁধা অবস্থায় বসে আছেন হেরম্যান। আর বার্টন তাদের কিছুটা তফাতে একই অবস্থায় আবদুল্লা। এটাই কি তবে খুলুর উপাসনাস্থল? যার কথা বলেছিল বিছে মানুষ টিম্বার। তবে টিম্বারকে সে ঘরে দেখতে পেল না সুদীপ্ত। বিছে মানুষরা খুব বেশি নড়াচড়া করছে না। সুদীপ্তর মনে হলো তারা যেন কোনো কিছুর জন্য প্রতীক্ষা করছে। কিসের প্রতীক্ষা?”

৷৷ ৮ ৷৷

ঘরের ভিতরে ভালো করে দেখার পর সুদীপ্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারল না তার ঠিক কি করা উচিত? ভিতরে লাফিয়ে নামলে সে নিশ্চই ধরা পড়ে যাবে বিছে মানুষদের হাতে। তার কাছে কোনো অস্ত্রও নেই। সে যদি আবদুল্লার রাইফেলটাও কুড়িয়ে আনত তবে একবার একটা শেষ চেষ্টা করা যেত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবে সে চেয়ে রইল ঘরের ভিতর। মিনিটের পর মিনিট সময় কাটতে লাগল।

ঘরের ভিতরে তাকিয়েছিল সুদীপ্ত। হঠাৎ যেন তার মনে হলো বিছে মানুষরা একটু চঞ্চল হয়ে উঠেছে। দু-হাতে ভর দিয়ে বুকটাকে মাটি থেকে একটু ওপরে তুলে ধরে তারা তাকাচ্ছে ঘরের ডানপাশের একটা দেওয়ালের দিকে। সেখানে বেশ বড় একটা ছিদ্র আছে। কয়েক মুহূর্তর মধ্যেই সেই ছিদ্র গলে ঠিক বিছের মতোই ঘরের মধ্যে বুকে হেঁটে নামল মিশ কালো একটা লোক। তার দুই হাতে বিশাল ভয়ঙ্কর ধাতব দাঁড়া, জোড়া পায়ে রয়েছে কাস্তের মতো বাঁকানো ধারালো হুল। তার এক আঘাতে কোনো লোকের মুণ্ডু নেমে যাবে। কুয়োটার কাছাকাছি পৌঁছে সেই লোকটা ঘুরে দাঁড়াল বিছে মানুষদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বিছে মানুষরা স্থির হয়ে গেল প্রথমে। তারপর তাদের হাতের দাঁড়া একসাথে মাটিতে বুকে ঝনঝন শব্দ তুলে যেন সম্ভাষণ জানাল লোকটাকে। সুদীপ্ত অনুমান করলই দানবের মতো লোকটাই সম্ভবত বিছে মানুষদের দলপতি। সর্দার কাঁকড়া বিছে!

সর্দার বিছে এরপর দুর্বোধ্য ভাষায়, কর্কশ স্বরে কি যেন বলতে লাগল তার সঙ্গীদের উদ্দেশে, আর মাঝে মাঝে তাকাতে লাগল পিছনের কুয়োটার দিকে। বেশ অনেকক্ষণ কথা বলার শেষে সে একটা দাঁড়া ঠুকল মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে বিছে মানুষদের পাগুলো হুলের মতো পিছনে উঠে গেল। আর তারপরই শুরু হল এক অদ্ভুত নৃত্য। বুকে ভর দিয়ে শুয়ে হুল সমেত দেহের পিছনের অংশকে ছন্দবদ্ধ ভাবে নাচাতে শুরু করল তারা। আর দু-হাতের দাঁড়া ঠুকতে লাগল মেঝেতে। ঝমঝম শব্দে মুখরিত হয়ে উঠল বিশাল হল ঘরের মতো জায়গাটা। বেশ কিছুক্ষণ সে নাচ চলার পর দলপতির নির্দেশেই সে নাচ থামল। বিছের মতো হুলগুলোকে পিছনে উঁচিয়ে ধরে স্থির হয়ে গেল বিছে মানুষরা, সর্দার বিছে এবার একবার বুকে হেঁটে চক্কর কাটল ফাঁকা জায়গাটাতে। তারপর বুকে শুয়ে বিছারা যেমন লড়াইয়ের আগে দু-হাতে গ্লাভস ঠোকে ঠিক সে ভাবে দাঁড়া দুটো ঠুকে কি যেন বলতে লাগল সমবেত বিছে মানুষদের প্রতি। প্রতিবার দাঁড়া ঠোকার পর সর্দার বিছে কয়েক মুহূর্ত থামছে। প্রত্যুত্তরে যেন বিছে মানুষরা বুকে শুয়ে মাথা নীচু করে হুলটা একপাশে নাড়াচ্ছে। যেন সর্দার বিছে কোনো কিছুর জন্য তাদের আহ্বান করছে আর বিছে মানুষরা সসম্মানে প্রস্তাব করছে তার আহ্বান। মশালের আলোতে সুদীপ্ত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সর্দার বিছের মুখটা। সেই হিংস্র মুখটাতে ধীরে ধীরে যেন বীভৎস হাসি ফুটে উঠছে।

হঠাৎ একটা ঝুপ করে শব্দ হলো ঘরের মধ্যে। একপাশের দেওয়াল গলে ঘরের মধ্যে একই ভাবে লাফিয়ে নেমেছে একটা লোক। বিছে মানুষ। তারও হাতে দাঁড়া। জোড়া পায়ে বাঁধা ধারালো হুল। তাকে দেখেই সর্দার বিছের হুলটা পিছনে খাড়া হয়ে গেল আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে। কর্কশ ভাষায় সে চিৎকার করে নবাগত বিছে মানুষের উদ্দেশ্যে কী যেন বলল। তার প্রত্যুত্তরে নবাগতও কী যেন চিৎকার করে বলল। তারপর এগিয়ে এসে হুল তুলে সর্দার বিছের কিছুটা তফাতে তার মুখোমুখি দাঁড়াল।

সুদীপ্ত এবার মশালের আলোতে চিনতে পারল তাকে। আরে এ যে বিছে মানুষ টিম্বার !

সর্দার বিছের মুখোমুখি হয়ে টিম্বার একবার পাশ ফিরে কী যেন বলল। তাই শুনে স্পষ্ট বিশ্বাসের ভাব ফুটে উঠল বিছে মানুষদের চোখে। সর্দার বিছে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু একটা টিম্বারের উদ্দেশ্যে বলে দু-হাতে দাঁড়া ঢুকল। ঝমঝম শব্দ উঠল। টিম্বারও একই কাজ করল। সেও ঝমঝম শব্দে তাল ঠুকল। দু-জনের লড়াই হবে নাকি?

সুদীপ্তর অনুমানই সত্যি হলো কিছুক্ষণের মধ্যে। টিম্বার আর সর্দার বিছের তাল ঠোকাঠুকি দেখে পিছনে সড়ে দাঁড়াল বিছে মানুষদের দল। লড়াইয়ের ময়দান হিসাবে বেশ একটা প্রশস্ত জায়গা সৃষ্টি হলো সেই কুয়োটার সামনে। কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপর ঝমঝম শব্দে দাঁড়া বাজিয়ে বুকে হেঁটে টিম্বার আর সর্দার বিছে ধেয়ে এলো পুরস্কারের দিকে দু-জনেই দাঁড়া চালাল পরস্পরকে লক্ষ করে। দুই দাঁড়ার সংঘাতে আগুনের ফুলকি উঠল। শুরু হলো এক ভয়ঙ্কর লড়াই।

দু-জনেই দুজনকে কখনও দাঁড়া দিয়ে আবার কখনও পায়ে বাঁধা ধারালো হুল দিয়ে আঘাত হানার চেষ্টা করতে লাগল। কখনও ঘরের দেওয়ালের একপাশে কখনও দেওয়ালের অন্যপাশে ঘুরে ঘুরে চলতে লাগল লড়াই। দাঁড়ার হুলের বীভৎস ধাতব শব্দে কেঁপে উঠতে লাগল ঘর। হঠাৎ একবার বিছে মানুষ টিম্বারের পায়ে বাঁধা ফলাটা ছুঁয়ে গেল সর্দার বিছের কাঁধের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে লাল হয়ে উঠল সে জায়গা। ক্রুদ্ধ চিৎকার করে উঠল সে। আর তারপরই যুদ্ধর কৌশল বদলাল সর্দার বিছে। এক হাতে ভর দিয়ে সে তার লম্বা দেহটাকে লাট্টুর মতো ঘোরাতে লাগল। তার পায়ে বাঁধা কাস্তের মতো ছলটা পাখার ব্লেডের মতো সব কিছুকে কেটে ফেলার জন্য চারপাশে ঘুরতে লাগল। এ ভাবে সে এগোল টিম্বারের দিকে। টিম্বারের লড়াইয়ের এ কৌশল জানা নেই সম্ভবত। সে এবার পিছু হটতে লাগল সুদীপ্ত যে দিকের দেওয়ালের দিকে রয়েছে সেদিকে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে যে সর্দার বিছের জোড়া পায়ে বাঁধা ধারালো ফলার আঘাত থেকে নিজে বাঁচতে পারল না। কোমড়ের নিচে ছোবল দিল সর্দার বিছের হুল। কিছুটা তফাতে ছিটকে পড়ল সে। রক্তে ভিজে যেতে থাকল ঘরের মেঝে।

বিছে মানুষ টিম্বার উঠবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। এবার জয়ের আনন্দ ফুটে উঠল সর্দার বিছের মুখে। সুদীপ্ত যেখানে রয়েছে সেই ফোকরের কাছাকাছি কিছুটা পিছু হটে চলে এল সে। কারণটা বুঝতে অসুবিধা হল না সুদীপ্তর। সর্দার বিছে এবার প্রবল বেগে ধেয়ে গিয়ে দাগ দিয়ে শেষ আঘাত হানবে বিছে মানুষ টিম্বারের ওপর। আর কিছু মুহূর্তর মধ্যেই লড়াই শেষ হয়ে যাবে। ফোকর দিয়ে কয়েক হাত নিচেই বিছে সর্দারের কুচকুচে কালো পিঠটা দেখতে পাচ্ছে সুদীপ্ত। বন্দুকটা যদি থাকত সে এখনই থামিয়ে দিতে পারত শয়তানটাকে। ঠিক সেই মুহূর্তেই সুদীপ্তর মনে পড়ে গেল অন্য একটা অস্ত্রর কথা। পকেট হতাড়ে টিম্বারের কৌটটা বার করে সেটা কয়েকবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে কৌটর মুখ খুলে ভিতরের জিনিসটা ছুড়ে দিল সর্দার বিছের পিঠে।

সর্দার বিছে আক্রমণের জন্য টিম্বারের দিকে ছুটল ঠিকই কিন্তু তার কাছাকাছি পৌঁছতে পারল না। হঠাৎই যে বীভৎস চিৎকার করে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল। মরু বিছে তার মারণ হুল বসিয়ে দিয়েছে সর্দার বিছের ঘাড়ে। ঠিক এই অবস্থাতেই বিছে মানুষ টিম্বার কোনোক্রমে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ার উলটো পিঠ দিয়ে আঘাত হানল সর্দার বিছের মাথায়। কিছুটা গড়িয়ে সর্দার বিছের দেহটা স্থির হয়ে গেল।

হতভম্ব বিছে মানুষরা তাকিয়ে আছে টিম্বারের দিকে। বিছে মানুষ টিম্বার ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বাঁধানো কুয়োটা ধরে উঠে দাঁড়াল। তারপর কী যেন বলল বিছে মানুষদের লক্ষ করে। বিছে মানুষরা এবার ঝমঝম শব্দে দাঁড়া বাজাতে লাগল টিম্বারের উদ্দেশ্যে। না, আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে নয়। যেন তারা দাঁড়া বাজিয়ে অভিবাদন জানাতে লাগল টিম্বারকে। সুদীপ্ত এবার লাফিয়ে নেমে পড়ল ঘরটার মধ্যে। তাকে দেখে কয়েকজন বিছে মানুষ এগিয়ে আসতে যাচ্ছিল কিন্তু টিম্বার হাসতে বলল তাদের। টিম্বার এরপর সুদীপ্তর উদ্দেশ্যে বলল—’আর ভয় নেই, বিছে মানুষদের দলপতি এখন আমি। ওরা আমার নির্দেশ এখন পালন করবে।’ কথাটা শোনার সাথে সাথে সুদীপ্ত ছুটে গিয়ে মুক্ত করে ফেলল হেরম্যান, বার্টন আর আবদুল্লাকে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল তারা। পুরো ব্যাপারটাতে সবাই মিশ্রিত, হতচকিত। তারা চেয়ে রইল বিছে মানুষ টিম্বারের দিকে। টিম্বার এবার এক দীর্ঘ বক্তৃতা শুরু করল বিছে মানুষদের উদ্দেশ্যে। বিছে মানুষরা শুনতে লাগল তার কথা। আর মাঝে মাঝে তালি বুজাবার মতো ঝমঝম শব্দে তাদের দাঁড়া বাজাতে লাগল। এক সময় কথা শেষ হলো টিম্বারের। তখনও রক্ত ঝরছে টিম্বারের কোমর থেকে। বাইরের রক্তটা মুছল সে। রক্ত মোছার সাথে সাথে কালো রঙ উঠে গিয়ে টিম্বারের দেহের সাদা চামড়া ফুটে উঠল। সে সেটা দেখাল সমবেত বিছে মানুষদের। আরে এ যে এক সাদা মানুষ! সাদা মানুষেরই তো ঘুম ভাঙাবার কথা বিছে মানুষদের দেবতা মহান থুলুর। আরও বিশ্রিত হয়ে গেল বিছে মানুষরা। তাহলে কি সত্যিই সাদা মানুষ ঘুম ঙোতে এসছে মহান থুলুর?

টিম্বার একজন বিছে মানুষকে শুধু কাছে ডেকে নিল। আর অন্য বিছে মানুষদের উদ্দেশ্যে কী যেন নির্দেশ দিল দাঁড়া বাজিয়ে। সারবদ্ধ হলো বিছে মানুষরা। তারপর সম্মিলিত ভাবে দাঁড়া বাজিয়ে একটা ফোকর গলে সে ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে যেতে লাগল। এক সময় ফাঁকা হয়ে গেল ঘর। সে ঘরে রইল শুধু সুদীপ্তরা, টিম্বার, একজন বিছে মানুষ আর কিছুটা তফাতে পড়ে থাকা বিছে সর্দারের মরদেহ। মৃত নগরীর বিছে মানুষটার সাথে কিছুক্ষণ দুর্বোধ্য ভাষায় কথোপকথন চালাল টিম্বার। তারপর হেরম্যান আর বার্টনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এ লোকটা বলছে যে তোমাদের দু-জনকে আজ এখানে আনা হয়েছিল সর্দার নির্বাচনের পর দেবতাকে উৎসর্গ করার জন্য। মৃত সর্দার বিছে মানুষ অন্যদের আহ্বান জানাচ্ছিল তাকে পরাস্ত করে অন্য কেউ দলপতি হয় কিনা তা দেখার জন্য। প্রতিবছরই সে দলপতি নির্বাচিত হয়েছে। অন্য কেউ তার আহ্বান গ্রহণ করতে, তার সাথে লড়াই করতে সাহস পায়নি। আর আবদুল্লাকে হত্যা করা হতো তার গায়ে বিছের পাত্র ঢেলে দিয়ে।’ কথাটা শুনেই সুদীপ্তর মনে পড়ে গেল সুড়ঙ্গর সেই লোকটার কথা ৷ হয়তো সে আবদুল্লার জন্যই সেই বিছের ভাণ্ড আনছিল। রক্তপাত হলেও টিম্বারের আঘাত তেমন গুরুতর নয়। কাপড় বেঁধে দেওয়া হল ক্ষতস্থানে। একটু সামলে ওঠার পর বিছে মানুষ টিম্বার বলল, ‘এবার আমরা অন্য জায়গায় যাব। এই বিছে মানুষ আমাদের সেখানে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।’ হেরম্যান জানতে চাইলেন, ‘কোথায় যাব আমরা?’

বিছে মানুষ টিম্বার বলল, ‘মরুভূমির আদি বৃদ্ধ শয়তান মহান থুলুর কবরে। আজতো অমাবস্যা। তাকে জাগাবার দিন।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘর ছেড়ে সুড়ঙ্গ বেয়ে বুকে হেঁটে তারা এগোল মহান থুলুর কবরে পৌঁছবার জন্য।

চলতে চলতে হেরম্যান টিম্বারকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি অন্য বিছে মানুষদের কোথায় পাঠালে?”

টিম্বার জবাব দিল, ‘মহান থুলুর ঘুম ভাঙালে প্রলয় হবে। তাই তাদের আমি না বলা পর্যন্ত মৃত নগরীর বাইরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছি। এই সুড়ঙ্গর বাইরে যাবার জন্য রওনা হয়েছে তারা। আমি বলেছি আমার নির্দেশ না পেলে যেন তারা সুড়ঙ্গনাগরীতে না ফিরে আসে? পথ ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমেছে নিচের দিকে। নানা সুড়ঙ্গ, উপসুড়ঙ্গ বেয়ে এক সময় তারা পৌঁছে গেল সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে। আরে এই তো সেই ঠান্ডা ঘরটা। যেখানে আগে এসেছিল সুদীপ্ত। এখানেই তাহলে ঘুমিয়ে আছেন থুলু। টর্চের আলো জ্বলে উঠল। সুদীপ্তদের সঙ্গী বিছে মানুষ আঙুল তুলে দেখাল ঘরের মাঝখানে বেদিটার দিকে। ওটা তবে বেদি নয় থুলুর কবর! যেখানে ঘুমিয়ে আছেন থুলু। সুদীপ্তদের সঙ্গী বিছে মানুষটা ধীরে ধীরে এগোতে লাগল সেই কবরের দিকে। উপাসনা ঘর থেকে আসার সময় হেরম্যান একটা মশাল এনে ছিলেন সেটা এবার জ্বালিয়ে ফেলা হল । মশালের আলোতে আলোকিত হয়ে উঠল ঘর। দেওয়ালের গায়ে ফুটে উঠল বীভৎস দানব কাঁকড়াবিছের মূর্তিগুলো !

আস্তে আস্তে কবরটার একপাশে গিয়ে দাঁড়াল সবাই। ধুলো ঝাড়া শুরু হলো সেই পাথরের কফিনের গা থেকে। সবাই প্রস্তুত হল কফিনের ঢাকনাটা সরাবার জন্য। হঠাৎ বিছে মানুষ টিম্বার বলে উঠল, ‘হে ঈশ্বর তুমি আমাকে শক্তি দাও যাতে আমি শয়তানকে ধ্বংস করে পৃথিবীকে তার আতঙ্ক থেকে মুক্ত করতে পারি।’

তার কথা শুনে চমকে উঠল সুদীপ্তরা। তারা আরাধ্য শয়তানকে ধ্বংস করার কথা বলছে কেন টিম্বার ? ”

হেরম্যান বলে উঠলেন, ‘কি বলছ তুমি?’

স্মিত হেসে বিছে মানুষ টিম্বার বলল, “ঠিকই বলছি। এই শয়তানকে ধ্বংস করাই আমার ব্রত। আমি বিছে মানুষও নই, টিম্বারও নই। আমি ঈশ্বর বিশ্বাসী এক মানুষ ফাদার প্যাট্রিক। এ জায়গায় পৌঁছবার জন্য আমি বছরের পর বছর বিছে মানুষ সেজে ছিলাম। চার্চ আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল শয়তানকে ধ্বংস করার। যে চার্চে রক্ষিত আছে উন্মাদ আরব আব্দুল হালহাড্রেজের লেখা শয়তানকে জাগাবার পুঁথি। একই সাথে এই অশুভ শক্তিকে কি ভাবে ধ্বংস করা যায় তার মন্ত্রও লেখা আছে তাতে। সে পুঁথি পড়েছি আমি।’

তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেল সবাই।

ফাদার প্যাট্রিক এরপর বললেন, “তবে এবার শয়তানের কফিন খোলা হোক।’ সবাই মিলে ঠেলতে শুরু করল ওপরের ঢাকনাটা। সরে যেতে লাগল সেটা। কিন্তু সেটা বেশ কিছুটা ফাঁকা হতেই তার ভিতর থেকে প্রথমে যা আত্মপ্রকাশ করল তাতে কফিনের গা থেকে ছিটকে সরে এল সবাই। বিশাল একটা দাঁড়া!

তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল তার পুরো শরীরটা। বিশাল একটা কাঁকড়া বিছে।

আকারে অন্তত দশ ফুট হবে। প্রাগৈতিহাসিক খুনে ইউরেপুটেরাস দানব কাঁকড়া বিছে! হেরম্যান আর সুদীপ্ত যেন বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের চোখকে। এও কী সম্ভব? কী বিশাল কাঁকড়া দাঁড়া তার! ও দাঁড়া যে কোনো মানুষকে ছিঁড়ে ফেলতে পারে ! আর তার হুলটাও গেঁথে ফেলতে পারে যে কোনো মানুষকে! দুটো দাঁড়ায় টোকা দিল প্রাণীটা। তারপর কফিন থেকে নেমে তার বিশাল হুলটাকে উঁচিয়ে ধরে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল সুদীপ্তদের দিকে। পিছু হটতে লাগল সবাই। কিন্তু সেই সঙ্গে আসা বিছে মানুষটা অদ্ভুত একটা কাণ্ড করল হয়তো তার বিশ্বাস বশেই। সে বিছের ভঙ্গিতে মাটিতে শুয়ে পড়ল শয়তান দেবতাকে প্রণাম জানাবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্রাণীটা দেবতা নয়, সে খুনে ইউরেপুটেরাস। তার রক্তে বহমান প্রাগৈতিহাসিক জিঘাংসা। সে তার ভয়ঙ্কর দাঁড়া সরল আলিঙ্গনে মাটি থেকে খুলে নিল লোকটাকে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল লোকটা। সম্বিত ফিরে পেলেন হেরম্যান। তিনি জ্বলন্ত মশালটা ছুড়ে মারলেন বীভৎস প্রাণীটাকে লক্ষ করে। সেটা আছড়ে পড়ল তার পিঠে। ভয় পেলেও প্রাণীটা কিন্তু লোকটাকে ছাড়ল না। তাকে দাঁড়াবন্দি অবস্থাতেই সরসর করে দেওয়াল বেয়ে উঠে হারিয়ে গেল মাথার ওপরের খাড়া সুড়ঙ্গে।

পুরো ঘটনাটা দেখে ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল সুদীপ্তদের। ডক্টর বার্টন এক সময় বললেন, ‘ও এখন আর সম্ভবত ফিরবে বলে মনে হয় না। আগুনকে সবাই ভয় পায় । সুদীপ্তরা এবার আবার এগিয়ে গিয়ে সাবধানে উঁকি দিল কফিনের ভিতরে। না সেখানে কিছু নেই। শুধু তার নীচে দিয়ে আরও একটা গহ্বর নেমে গেছে নীচের দিকে। সেটাই হয়তো ইউরেপুটেরাসের আসল ডেরা। কফিন শূন্য দেখে ফাদার প্যাট্রিক একটু বিনয় ভাবে বললেন, ‘হয়তো শয়তান হিসাবে নেক্রোনসিকনে আলহাড্রেক এর কথাই বলেছিল। যদি এই দানব বিছে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তবে সত্যিই তো কোনো প্রাণী বাঁচবে না। ইটরিপুটেরাসই হয়তো থুলু। কিছউক্ষণের মধ্যেই সে ঘর ছেড়ে সুড়ঙ্গ নগরীর বাইরে বেরোবার জন্য রওনা হন সুদীপ্তরা। পরদিন শেষ বিকালে আলোর মুখ দেখল তারা।

রঙের খেলা শুরু হয়েছে আকাশে। মৃত নগরীর সুড়ঙ্গ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে সুদীপ্তরা। এখন তাদের মনে হচ্ছে সেটা যেন দুঃস্বপ্ন ছিল। কিন্তু তারা যেটা দেখল সেটাও কি নিছক দুঃস্বপ্ন? সেই খুনে দানব কাঁকড়া বিছে ইউরেপুটেরাস ?”

হেরম্যান এক সময় প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত করে বসলেন ডক্টর বার্টনকে—যা দেখলাম তা কি সত্যি? ন-কোটি বছর পরেও কি ভাবে বেঁচে আছে ইউরেপুটেরাস?”

একটু ভেবে নিয়ে ডক্টর বার্টন জবাব দিলেন, ‘সম্ভবত যেমন ভাবে বেঁচে আছে সাগরতলের সিলিকাস্থ মাছ বা বরফাবৃত অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক উদ্ভিদ জিনগোবাইলোবা। কোটি কোটি বছরে পৃথিবীর ভূ-প্রকৃতির নানা পরিবর্তন হলেও তাদের বাসস্থানের পরিবেশের কোনো পরিবর্তন হয়নি বলেই তারা বেঁচে আছে। মাটির নিচের ঘরটা কেমন ঠান্ডা দেখেছিলেন! হয়তো ওই ভূগর্ভস্থ জায়গার পরিবেশেরও কোনো পরিবর্তন হয়নি কোটি কোটি বছর ধরে। ওই রকম ঠান্ডা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশই তো ওদের বেঁচে থাকার পক্ষে আদর্শ জায়গা।’

কথাগুলো বলে বার্টন বললেন, ‘দুর্ভাগ্য আপনি প্রাণীটাকে পৃথিবীর কাছে হাজির করতে পারলেন না। তবে আমি বড় ইউরেপুটেরাসের ফসিল সংগ্রহ করতে না পারলেও খাতের দেওয়ালে সে ফসিলটা পেয়েছি সেটা নিয়ে যাব। ওটাও কম বড় নয়।’

হেরম্যান বললেন, ‘আমার তেমন আক্ষেপ নেই। প্রমাণ দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার নয়। পাথরের ক্যামেরায় যেমন আপনার ইউরেপুটের ছবি আঁকা হয়ে আছে তেমন মামার মনের ক্যামেরায় আঁকা হয়ে রইল জ্যান্ত ইউরেপুটেরাসের ছবি। আমি মানলাম রূপকথা বা গল্পকথা এই প্রাণী, এই ক্রিপ্টিড মিথ্যা নয়। সে আছে, সে আছে. .

সুদীপ্ত সমর্থন জানাল তার কথায়।

মাঝরাতে সেই খাতের ভিতর গাড়ির কাছে ফিরে এল সুদীপ্তরা। বার্টন বললেন আজ রাতটা এখানেই কাটানো যাব। বাইরে বেশ ঠান্ডা। গাড়িতে একটাই তাঁবু ছিল। সেটা খাটানো হল মাটিতে। সুদীপ্তরা সব মিলিয়ে পাঁচজন। আবদুল্লা বলল সে গাড়িতেই শোবে। কিন্তু তাঁবুর ভিতর তিনজন লোকের শোবার জায়গা। আর একজন কোথায় শোবে? হেরম্যান সমস্যাটা উত্থাপন করতেই ফাদার প্যাট্রিক বললেন, ‘চিন্তা নেই। আমি বাইরেই থাকব।’

সুদীপ্ত বলল, ‘কোথায় ?

প্যাট্রিক বললেন, ‘কেন এই বালির নীচে। অনেকদিনের অভ্যাসতো ও ভাবে ঘুমানোর। অভ্যাস বদলাতে কিছুদিন সময় লগাবে।’—এই বলে সুদীপ্তদের চোখের সামনেই শুয়ে পড়ে বিছের মতো সর সর করে বালির নীচে ঢুকে গেল বিছে মানুষ টিম্বার বা ঈশ্বরের অনুচর ফাদার প্যাট্রিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *