বিছানা

বিছানা

যাচ্ছিলুম ডায়মন্ডহারবারের দিকে। আমি আর আমার বন্ধু অমল। পথের মাঝখানে গেল মোটর সাইকেল খারাপ হয়ে। সেখান থেকে ডায়মন্ডহারবার মাইল চারেকের বেশি হবে না। স্থির করলুম, সাইকেল চালাতে না পারি, পদযুগলকে চালিয়েই এটুকু পথ পার হয়ে যাব।

কিন্তু সেদিনকার যাত্রাটাই ছিল খারাপ। মাইল খানেক পথ এগিয়ে যেতে-না-যেতেই গোটা আকাশটা মেঘে মেঘে কালো হয়ে উঠল। চারিদিকে ঠান্ডা বাতাস ছুটোছুটি শুরু করলে। বুঝলুম, বৃষ্টি আসতে আর দেরি নেই।

অবিলম্বেই আত্মরক্ষা করা দরকার। কিন্তু পথের দুই দিকেই মাঠ করছে ধু-ধু। মাঝে মাঝে খাল-বিল, বড়ো বড়ো গাছ আর ঝোপঝাপ। এখানে আশ্রয় মিলবে কোথায়?

অমল একদিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিপাত করে বললে, ‘ওই বাঁশবাগানের ওপাশ থেকে একখানা বাড়ির মাথা দেখা যাচ্ছে না?’

আমি ভালো করে দেখে বললুম, ‘হুঁ, বাড়ি বলেই তো মনে হচ্ছে!’

টপ করে আমার নাকের ডগায় পড়ল বৃষ্টির একটা মস্ত ফোঁটা!

আমি বললুম, ‘ছোটো অমল, ছোটো! এক ফোঁটা বৃষ্টি আমার নাসিকাকে সবেগে আক্রমণ করেছে!’

দুজনে প্রাণপণে ছুটতে লাগলুম। বাঁশবাগান পেরিয়ে দেখলুম, চারিদিকে পুরানো পাঁচিল নিয়ে একখানা মাঝারি দোতালা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির ভিতরটা গোরস্থানের মতন স্তব্ধ এবং তার ফটকেও তালা লাগানো! এখন উপায়?

এমন সময়ে বৃষ্টি নামল। বেশ বড়ো বড়ো ফোঁটা!

আমি তাড়াতাড়ি বললুম, ‘যা থাকে কপালে পাঁচিল ডিঙিয়ে ভেতরে চলো! এ বাড়িতে কেউ নেই বলেই বোধ হচ্ছে।’

অমল প্রতিবাদ করতে উদ্যত হল, কিন্তু বৃষ্টির বিক্রম হঠাৎ আরও বেড়ে উঠে তার প্রতিবাদের চেষ্টাকে একেবারে ব্যর্থ করে দিলে।

পাঁচিল ডিঙোতে দেরি লাগল না। পাঁচিলের পরেই খানিকটা খোলা জমি, সেখানে আগে বোধ হয় বাগানের বাহার ছিল, কিন্তু এখন আগাছা ছাড়া আর কিছু নেই। সামনে একটা ছোটো পুকুর, কিন্তু তার জলের উপরে এমন ছিদ্রহীন পানার প্রলেপ যে, পুকুরটাকে দেখাচ্ছে একটি সবুজ খেতের মতো।

আমরা যখন একতালার দালানে গিয়ে দাঁড়ালুম, তখন সারা আকাশ আচ্ছন্ন করে যেন বিশ্বব্যাপী জলপ্রপাত ঝরে পড়ছে এবং জলে ভিজতে ভিজতে বাতাস গাছপালার ভিতরে ঢুকে মহা হই চই লাগিয়ে দিয়েছে!

এদিকে-ওদিকে উঁকিঝুঁকি মেরে আমি বললুম, ‘ওহে অমল, বাড়ির অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এখানে অনেক দিন কোনো মানুষ বাস করেনি!’

অমল বললে, ‘তাহলে একটা ঘরের ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালেই তো হয়। এখানে জলের ছাট আসছে!’

‘আপত্তি নেই। কিন্তু দরজা খোলা পাব কি?’

অমল এগিয়ে গিয়ে সামনের একটা দরজায় ঠোকা দিলে। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তারপর সে অন্য দরজাগুলোও পরীক্ষা করে দেখলে। সব দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।

আমি বললুম, ‘এ দরজাগুলো ভিতর থেকে বন্ধ করে বাড়ির মালিক বোধ হয় পিছনের কোনো দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে।’

‘কিন্তু এই বৃষ্টিতে বাড়ির পিছনে যাই কেমন করে?’

‘তাহলে এইখানেই আমাদের বিশ্রাম। পিছনে যাবার জন্যে আমি স্নান করতে রাজি নই!’

হঠাৎ একটা কনকনে ঠান্ডা দমকা বাতাস সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে আমার পাশ দিয়ে চলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে একটা দরজা খোলার শব্দ হল! চমকে ফিরে দেখি, অমল সর্বপ্রথমে যে-দরজায় ধাক্কা মেরেছিল সেটা আর বন্ধ নেই!

অমল হতভম্বের মতো আমার মুখের পানে তাকালে।

আমি হেসে বসলুম, ‘অমন করে তাকিয়ে দেখছ কী? দরজাটা তুমি ভালো করে ঠেলে দেখনি, এখন দমকা হাওয়ায় খুলে গেল।’

অমল মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললে, ‘আমাকে অবশ্য সেই কথাই মানতে হবে। আমি কিন্তু ভালো করেই ঠেলেছিলুম।’

‘পাগল নাকি? তুমি কি বলতে চাও, ভূত এসে আমাদের দরজা খুলে দিলে?’

‘সে কথাই বা বলবার উপায় কই? আমরা তো ভূতেদের জন্যে রাতটাই রিজার্ভ করে রেখেছি। কিন্তু এখন হচ্ছে বেলা দুটো। এ সময়ে কোনো অভদ্র ভূতও কোনো পোড়োবাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করতে চাইবে না!’

‘চলো। ঘরের ভেতরে গিয়ে দাঁড়াই।’

ঘরের ভিতরে ঢুকলুম। চারিদিকে অযত্ন ও মলিনতার চিহ্ন! দেয়ালের চুন-বালি খসে পড়েছে, কার্নিশের কোণে কোণে চামচিকেরা বাসা বেঁধেছে, মেঝের উপরে বোধ হয় দুই ইঞ্চি পুরু ধুলো জমে রয়েছে। একদিকে খান-দুয়েক কাঠের চেয়ার, আর একদিকে একখানা ইট। দূর থেকেই অবাক হয়ে দেখলুম, এই ধুলো ও শ্রীহীনতার রাজ্যেও খাটের উপরে যে বিছানা পাতা রয়েছে, তা ধবধব করছে সাদা! তাহলে এমন ঘরেও কেউ কি বাস করে? নিজের বিছানাটুকুই পরিষ্কার রেখে সে খুশি, এই বছরের পর বছর ধরে জমা ধুলোর স্তূপ তার নজরেই পড়ে না! আশ্চর্য মানুষ তো!

অমল কাঁপতে কাঁপতে বললে, ‘উঁহু, বড্ড শীত করচে যে! কী ঠান্ডা ঘর, বাইরের চেয়েও ঠান্ডা!’

সত্যিই তাই! প্রত্যেকবার নিঃশ্বাস টানছি আর মনে হচ্ছে, যেন খানিকটা করে অদৃশ্য বরফ আমার বুকের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে! এতটা অসম্ভব শীতের কারণ কী? একটা দরজা ছাড়া ঘরের আর সব জানলা-দরজা বন্ধ, ঘরটা আর যাইই হোক স্যাঁৎসেঁতে বলেও বোধ হচ্ছে না, তবু— তবু—

হঠাৎ আর একটা ব্যাপার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

যে-দরজাটা খোলা, তার সামনে থেকে মেঝের উপর দিয়ে একসার পায়ের দাগ সমান চলে গিয়েছে খাটের দিকে! এ দৃশ্য তো এতক্ষণ চোখে পড়েনি!

অমলকে ডেকে দাগগুলো দেখালুম। সে বললে, ‘কেউ খালি পায়ে ধুলো মাড়িয়েও খাটে গিয়ে উঠছিল!’

আমি মাথা নেড়ে বললুম, ‘উঠেছিল নয় অমল, এখনি উঠেছে।’

‘তার মানে?’

‘দাগগুলো দেখে বুঝতে পারছ না? এগুলো হচ্ছে ভিজে পায়ের দাগ! ভালো করে লক্ষ করে দেখ, পায়ের জলে ধুলো এখনও ভিজে রয়েছে! কেউ এইমাত্র বাইরের বৃষ্টি ছেড়ে আমাদের মতোই ঘরের ভিতরে এসে ঢুকেছে! তবে আমাদের পায়ে জুতো আছে, আর সে এসেছে খালি পায়ে।’

ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে অমল বললে, ‘কিন্তু সে কোথায়? সে কখন এল? ঘরের আর সব দরজা বন্ধ, সে কখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল? অদৃশ্য মানুষ শোভা পায় এইচ জি ওয়েলসের উপন্যাসেই, বাস্তব জীবনে সে হচ্ছে মস্ত বড়ো অর্থহীন কৌতুক!’

‘কিন্তু ঘরের ভিতরে কেউ যে এখনি ঢুকে আবার বেরিয়ে গিয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই!’

‘যে এসেছিল সে চুলোয় যাক! কিন্তু আমি যে শীতে মলুম, আর তো সইতে পারচি না!’

তার কথা কানে না তুলে আমি পায়ের দাগগুলো ধরে খাটের দিকে অগ্রসর হলুম। কিন্তু যতই এগিয়ে যাই যেন শীত ততই বেড়ে ওঠে!

খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালুম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিছানা, রোজ যেন খুব যত্ন করেই চাদর পাতা হয়!

মাথার বালিশের মাঝখানটা বসে গিয়েছে— যেন কেউ একটু আগেই ওখানে মাথা রেখে শুয়েছিল! কেবল তাই নয়, বালিশের উপরেও জলের দাগ! যেন এখানে কেউ ভিজে মাথা রেখেছিল।

আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার অনুভব করলুম। উনুনের কাছে গেলে যেমন আগুনের আঁচ পাওয়া যায়, এই বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তেমনি যেন শীতের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। হতে পারে এটা আমার মনের ভ্রম, কিন্তু এমন সত্যিকার ভ্রম আমার আর কখনো হয়নি।

সেই দিনের আলোতেও আমার বুকের কাছটা ছম-ছম করতে লাগল। ভয় পাবার মতো বিশেষ কিছু দেখিনি বটে, কিন্তু কেবলি মনে হচ্ছে, পোড়ো বাড়ির এই স্তব্ধ ঘরের মধ্যে আমরা দুজন ছাড়া এমন এক তৃতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব আছে, যে আমাদের মতো স্বাভাবিক নয়— যার কাছে আমাদের থাকা উচিত নয়!

বিছানার উপরে ঝুঁকে পড়ে ভিজে বালিশটা পরীক্ষা করতে লাগলুম কিন্তু— … … … ও আবার কী? কান পেতে দু-মিনিট ধরে শুনলুম তবু নিজের কানকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলুম না!

অমল আমাকে ডাক দিয়ে বললে, ‘ওহে ওখানে অমন সং-এর মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? চলো, এই বিশ্রী ঘরটা ছেড়ে আবার বাইরে যাই। বৃষ্টি থেমে এসেছে।’

‘অমল, একবার এইখানে এসো তো!’

‘কেন, এখানে আবার নতুন কী আবিষ্কার করলে হে? ওরে বাবা, এখানটা যে আরও ঠান্ডা!’

‘হোক গে ঠান্ডা! কান পেতে শোনো দেখি। কিছু শুনতে পাচ্ছ?’

‘কী সর্বনাশ!’

‘কী শুনচ অমল?’

‘কার নিঃশ্বাসের শব্দ! না, না— এ অসম্ভব! আমার শোনবার ভ্রম!’

‘ভ্রম নয় অমল, ভ্রম নয়! তুমিও শুনছ— আমিও শুনছি, আর নিঃশ্বাসের শব্দ এখনও হচ্ছে!’

অমল বিছানায় বালিশের উপরে হাত বাড়ালে, কিন্তু তারপরেই ভয়ানক একটা আর্তনাদ করে বিদ্যুতের মতন হটে গেল!

তারপরেই খাটখানা হঠাৎ মচ মচ করে উঠল; কেউ যেন ধড়মড় করে বিছানার উপরে উঠে বসল।

অজানা একটা বিষম ভয়ে আমিও তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এসে থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লুম। এবং তারপরেই মনে হল, একটা ঠান্ডা কনকনে দমকা হাওয়া যেন আমার পাশ দিয়ে হুশ করে চলে গেল, ঘরের খোলা দরজাটার দিকে!

… … …প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে আমরা দুজনে সেই ঘরের ভিতরে আচ্ছন্ন ও আড়ষ্টের মতো দাঁড়িয়ে রইলুম।

তারপর প্রথমে কথা কইলে অমল। বিবর্ণ মুখে থেমে থেমে বললে, ‘বুঝতে পারছ? ঘরের ভেতরে আর একটুও ঠান্ডা নেই!’

‘না। নিঃশ্বাসের শব্দও আর শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু অমল, বালিশের উপরে হাত বাড়িয়েই তুমি অমন চেঁচিয়ে উঠলে কেন?’

‘বলছি। কিন্তু ভগবানের দোহাই, আগে এ ঘর থেকে বেরিয়ে এসো, নইলে আমি পাগল হয়ে যাব!’

বাইরে বেরিয়ে এলুম। বৃষ্টি তখন ধরে গিয়েছে।

অমল বললে, ‘আমার হাত বালিশ ছোঁয়নি। কিন্তু আমার হাত পড়ল গিয়ে ঠিক যেন একখানা ঠান্ডা কনকনে জল-মাথা মড়ার মুখের উপরে!’

অবাক হয়ে ভাবতে লাগলুম, এসবই কি ভ্রম? আমাদের দেহ অনুভব করেছে প্রচণ্ড শীত, চোখ দেখেছে জলে-ভেজা তাজা পায়ের দাগ, কান শুনেছে শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ এবং অমলের হাত ছুঁয়েছে একখানা জলমাখা মড়ার মুখ! এসবই কি কল্পনা?

… … … কাছের গ্রামে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানলুম, ওই বাড়িতে মানিকচন্দ্র বসু নামে এক ভদ্রলোক সপরিবাসে বাস করতেন। পাঁচবছর আগে হঠাৎ কলেরা রোগে মানিকবাবুর মৃত্যু হয়। স্বামীর শোক সইতে না পেরে মানিকবাবুর স্ত্রীও খিড়কির পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তারপর থেকে ও-বাড়িতে আর কেউ বাস করতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *