বিচিত্র সেই রামধনু
ঘাটশিলায় বেড়াতে গিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ। আমরা একই বাড়িতে ভাড়াটে ছিলাম। আমি থাকতাম বাড়ির পশ্চিম দিকে—সস্ত্রীক। উনি থাকতেন পুবের দিকে। একা।
ভদ্রলোকের নাম শিবতোষ মৈত্র। বয়েস বছর বাহান্নর বেশি হবে না। কিন্তু ওঁকে দেখলে মনে হত প্রায়-বৃদ্ধ। মাথার চুল একেবারে সাদা, গায়ে মাংস না-থাকার মতনই, হাড় হাড় চেহারা। চোখ দুটি গর্তে ডোবানো, চোখের তলায় নীলচে দাগ কালো হয়ে উঠেছে। ওঁর গায়ের রং খুবই ফরসা, ধবধবে বলা যায়। তবে অমন ফরসা রঙের ওপর শ্বেতী ধরলে কেমন যেন দেখায়! মনে হত, সর্বাঙ্গ যেন পুড়ে গিয়েছিল।
মানুষটিকে বড় নিঃসঙ্গ, অসহায় দেখাত। লক্ষ করে দেখতাম, উনি সকাল বিকেল ছাড়া বাইরে বড় একটা বেরোন না। স্টেশনের কাছের একটা দোকান থেকে টিফিন কেরিয়ারে করে ওঁর খাবার আসত। চায়ের ব্যবস্থা নিজেই করে নিয়েছিলেন।
আমার স্ত্রীর ধারণা হয়েছিল, ভদ্রলোক নিশ্চয় বিপত্নীক। এক আধ বছরের মধ্যে স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে। এমন ধারণা আমার গৃহিণীর কেন হয়েছিল আমি জানি না।
এক আধ দিন অপেক্ষা করে নিজেই শিবতোষবাবুর সঙ্গে আলাপ করলাম। শুনলাম, উনি কলকাতার লোক, থাকেন শোভাবাজারের দিকে। এল. আই. সি-তে চাকরি করেন। ভাল চাকরি।
প্রথম আলাপেই লক্ষ করলাম, ভদ্রলোক অত্যধিক সিগারেট খান। ওঁর গলার স্বর সরু এবং ভাঙাভাঙা। কথা বলার সময় অগোছালো হয়ে যান, খানিকটা যেন বেশি অন্যমনস্ক থাকেন। হাত কাঁপার রোগ আছে।
দিন কয়েক আলাপের পর একটা জিনিস আমার নজরে পড়ল। শিবতোষ প্রায়ই এমন ব্যবহার করেন যেন তিনি চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছেন না। ‘আকাশে কি মেঘ করল?’ ‘ওগুলো কি উড়ে গেল বলুন তো, বক?’ ‘ডালিমগাছের তলায় একটা লোক বসে আছে না ?’—এই রকম সব কথা। চোখে দেখেছেন ঠিকই—তবু সন্দেহ প্রকাশ করছেন।
একদিন আমি বললাম, “আপনি কি চোখে কম দেখেন?”
“না।”
“তা হলে?”
সামান্য চুপ করে থেকে শিবতোষ বললেন, “চোখে যা দেখি সব সময় বিশ্বাস করতে পারি না।”
অদ্ভুত জবাব। হেঁয়ালি।
বার কয়েক কেন প্রায়ই উনি ওই কথাটা বলেন দেখে আমি একদিন বললাম, “আপনি চোখে ভালই দেখেন। কাগজ পড়ার সময় ছাড়া চশমাও পরেন না। অথচ বলেন, চোখে যা দেখেন সব সময় বিশ্বাস করতে পারেন না। কেন বলুন তো?”
“বলে কী হবে?”
আমি হেসে বললাম, “হয়ত কিছুই হবে না। তবে আমি চোখের ডাক্তার। আগে হয়ত আপনাকে বলেছি। বড় ডাক্তার নই। ডাক্তার হিসেবেই জানতে ইচ্ছে করে।”
শিবতোষ কথার কোনো জবাব দিলেন না। অনেকটা পরে বললেন, “ও, আপনি তো চোখের ডাক্তার!…না, ডাক্তার আমি আগেও দেখিয়েছি। চোখের দোষ নেই।”
“তবে?”
“তবে!…কী জানি, আপনাকে কী বা বলব! নিজের চোখকে কে আর অবিশ্বাস করে! কিন্তু আমার চোখকে আমি আর বিশ্বাস করতে পারি না। কেন পারি না—সে-কথা শুনলে আপনি আমায় পাগল বলবেন!”
“আমি কিছুই বলব না!”
“দেখুন, আমি অনেককেই কথাটা বলেছি। সবাই ভেবেছে আমি হয় বানানো গল্প বলছি, না হয় আমার মাথার মধ্যে একটা পাগলামি ঢুকে গিয়েছে।”
“মাথার মধ্যে পাগলামি ঢুকলে তার একটা কারণ থাকে। আপনাকে দেখে তো আমার পাগল মনে হয় না।” বলে আমি হাসলাম।
শিবতোষ আবার সিগারেট ধরালেন। তাঁর হাত কাঁপছিল। আঙুলগুলো হলুদ। উনি একেবারে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।
আমি অপেক্ষা করে থাকলাম।
শেষে উনি বললেন, “ঠিক আছে। বলেছি অনেককে, আপনাকেও না হয় বলব। আপনি বিশ্বাস করবেন না, আমি জানি।…আজ থাক। কাল শুনবেন।”
পরের দিন সন্ধেবেলায় শিবতোষ আমাকে তাঁর কাহিনী শোনান।
“আমার এই অভিজ্ঞতা আপনি বিশ্বাস করবেন বলে মনে হয় না। না করাই স্বাভাবিক। বছর দুই আগে, অন্য কেউ যদি আমাকে এ-রকম একটা ঘটনার কথা শোনাত আমিও বিশ্বাস করতাম না। ভাবতাম, গল্পের গরু গাছে উঠেছে।” বলে শিবতোষ তাঁর কথা শুরু করলেন:
“সামান্য ভূমিকা দিয়ে শুরু করি।
“গত বছরের আগের বছর বর্ষার পর আমার শরীরটা হঠাৎ খারাপ হতে শুরু করে। মাঝে মাঝে জ্বর, মাথায় যন্ত্রণা, অনিদ্রা, শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট—এই সব উপসর্গ দেখা দিতে লাগল। পাড়ার বলাই ডাক্তার আমার বন্ধু। প্রথমটায় ফ্লু ডেঙ্গু—যা মনে এল বলল সে; বলে কয়েকটা সাধারণ বাজারি ওষুধ খাওয়াল। তাতে কোনো লাভ হল না। তখন বলল, ম্যালেরিয়া হতে পারে। কলকাতায় এখন ঘরে ঘরে ম্যালেরিয়া। হয় ম্যালেরিয়া না হয় মিক্সড টাইফয়েড। বলাই ডাক্তার আমার রক্ত মলমূত্র পরীক্ষা করাল। কিছু পেল না। তবু সে ম্যালেরিয়া টাইফয়েড দুই চিকিৎসাই চালিয়ে গেল কিছুদিন। শেষে ই সি জি হল, এক্সরে হল। না, কিছু নেই। বলাই ডাক্তার তখন তামাশা করে বলল, ‘দেখো হে শিবু, তোমার এই অসুখটা হল বুড়ো হবার অসুখ। বিয়ে-থা করলে না, বয়েস পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। মেয়ে হলে বলতাম, ইয়ের সময় হয়েছে, এখন খানিকটা গোলমাল হবে। তুমি একে মদ্দা, তায় আইবুড়ো। তোমায় যে কী বলব!…এক কাজ করো, মাসখানেক বাইরে কোথাও গিয়ে কাটিয়ে এসো। হ্যাভ্ এ চেঞ্জ। তবে তীর্থ করতে যাবার মতন মন নিয়ে যেও না। হালকা মন নিয়ে যাবে, মজা করে থাকবে, ফুর্তিফাতা করবে। এন্জয় করবে বুঝলে। দু-চার পাত্র টানতেও পার। মোটকথা, বুড়ো হয়ে যাচ্ছ—এই ভাবনা ঝেড়ে ফেলবে মন থেকে, শরীর থেকে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
বলাই ডাক্তার বন্ধু লোক, সে আমাকে নিয়ে তামাশা করতেই পারে। হেসে বললাম, তা হলে তুমি বলছ, এটা বুড়ো হয়ে আসার রোগ?
‘হ্যাঁ। মানে, কোনো রোগই নয়। জ্বরজ্বালা এমনি হয়েছিল সেটা সেরে গিয়েছে। তোমার যা আছে, এখন তা হল ফেটিগ্, ডিপ্রেশান, খানিকটা সাইকোলজিক্যাল লোন্লিনেস।…হ্যাভ এ চেঞ্জ। অল রাইট হয়ে যাবে।’
আমি চলে আসছিলাম। হঠাৎ বলাই ডাক্তারের কী যেন মনে পড়ে গেল। বলল, ‘একটু বসো। রিসেন্টলি দু-একটা ফাইল পেয়েছি ওষুধের। আমার স্যার আমেরিকা গিয়েছিলেন, লেকচার ট্যুরে। কিছু স্যাম্পল নিয়ে এসেছেন ওষুধের। আই হ্যাভ ওয়ান অর টু ফাইলস্। নার্ভে ভাল কাজ দেবে। তোমায় একটা দি।’
বলাই খুঁজে পেতে ছোট একটা শিশি বার করল। শিশির মধ্যে ছটা ক্যাপসুল। দেখতে একেবারে লাল, টকটকে লাল। ছোট্ট পুঁতির মতন অনেকটা।
বলাই বলল, কলকাতায় থাকতে থাকতে একটা খাবে। খেয়ে আমার কাছে আসবে। একবার দেখে নেব।’
‘কেন?’
‘বাইরের ওষুধ। খাঁটি আমেরিকান, হে! সব ওষুধ সবাইকে সুট্ করে না। সাবধান হওয়া ভাল।’
‘একটা খেয়েই যদি ফটাশ হয়ে যাই।’
‘আমি আছি।’ বলে বলাই হাসল। ‘আরে অত ঘাবড়ে যেও না। মরবে না। স্রেফ ড্রাগ।’
ওষুধের শিশিটা পকেটে পুরে আমি চলে এলাম।
তার পরের ঘটনা তেমন কিছু নয়। প্রথম ক্যাপসুলটা খেয়ে বলাইয়ের কাছে গেলাম। সে আমায় ভাল করে দেখল। বলল, ‘ঠিক আছে। নাথিং রং।’
‘তা হলে? ’
‘বেরিয়ে পড়ো।…ওষুধটা সপ্তাহে একবার করে খাবে। খালি পেটে খেয়ো না। ছ’টা ক্যাপসুলে তোমার দেড় মাস কেটে যাবে। যদি দেখো শরীরে কোনো অস্বস্তি বোধ করছ, স্টপ ইট, আর খেয়ো না। ঘুমের গোলমাল হলেও বন্ধ করে দিয়ো। তবে আমার মনে হয় না, কিছু গোলমাল হবে। ওকে।’
বলাই ডাক্তারের কথা মতন আমি পুজোর ক’দিন পরই কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। অফিসে ছুটি নিয়েছি টানা। কলকাতা থেকে বেরুবার সময় মা, ছোট ভাই, ভাইয়ের বউ বার বার বলে দিল, যাচ্ছি যখন শরীর সারাতে, হুট করে না ফিরে আসি। আমার ভাইঝি টুকি আমার গার্জেন। বড্ড পাকা। বলল, ‘জেঠু, বেশি চা সিগারেট খাবে না। আর রোজ গার্গেল করবে। তোমার গলা খসখস সেরে যাবে।’
কলকাতা থেকে অনেক দিন পরে বেরুলাম। ভালই লাগছিল।
যাবার অনেক জায়গা থাকলেও আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম—বারকিবুইয়া যাব। জায়গাটা মধ্যপ্রদেশে। নাগপুরে নেমে গাড়ি বদলেও যাওয়া যায়, আবার আজকাল বাসেও যাওয়া চলে। নাগপুর থেকে শ’ মাইল মতন।
বারকিবুইয়ায় আমার বন্ধু রাজশেখর থাকে। রাজশেখর আমার বন্ধু এবং দূর সম্পর্কের মাসতুতো ভাই। অনেকবার সে আমাকে তাদের কাছে যেতে বলেছে। যাব যাব বলি—যাই না, মানে হয়ে ওঠে না যাওয়া।…এখানে একটা কথা বলি। রাজুর স্ত্রী সুনন্দার সঙ্গে আমার একবার বিয়ের কথা উঠেছিল বাড়ি থেকে। আমি রাজি হইনি। এমনিই হইনি—কেননা আমার বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না। বিয়ের সম্বন্ধটা পরে রাজুর সঙ্গে পাকা হয়।
হোটেল মোটেল ধর্মশালা আমার ভাল লাগে না। আমি বরাবরই গৃহপালিত পশুর মতন গৃহই পছন্দ করি। বারকিবুইয়াই আমার পছন্দ হয়েছিল। নিজেদের আত্মীয়জনের কাছে থাকব, গল্পগুজব করব, খাব দাব ঘুমোব, গাদা গাদা ডিটেকটিভ বই পড়ব, বেড়াব—আবার কী চাই!
দেওয়ালির ঠিক আগেই আমি বারকিবুইয়া পৌঁছে গেলাম। রাজশেখর আর সুনন্দা আমায় অভ্যর্থনা করল। রাজ একেবারে আহ্লাদে আটখানা।
বারকিবুইয়ায় আমি পৌঁছেছিলাম দেওয়ালির দু দিন আগে। দেখতে দেখতে আট দশ দিন কেটে গেল। সময় যে এমন হুহু করে কেটে যায় আমার জানা ছিল না।
দেওয়ালির ধুম বলতে যে কী বোঝায় আমি কাশীতে দেখেছি। কানপুরেও। বছর সাত আট আগে বেড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম। বারকি-তে তার চার আনাও ছিল না। হ্যাঁ, এখানকার লোক বারকিবুইয়াকে ছোট করে বারকি বলে। জায়গাটা ছোট। কালিয়ারি এলাকা। শ খানেক কি দেড়েক লোক। তবে মাইল পাঁচ ছয় দূরে এদের শহর। সেখানে লোকজন, বাজারঘাট, সিনেমা হাউস সবই আছে।
ছোট জায়গা, লোকজন অল্প, তবু দেওয়ালিতে আলো জ্বলল মন্দ নয়, বাজি পুড়ল, হইচই হল, নেশা আর জুয়া বসল তিন নম্বর সার্কেলে। ওটা কোলিয়ারির লেবার এলাকা। এদিকে ম্যানেজার এঞ্জিনিয়ারের কোয়ার্টার কথায় বলে বাংলো। আসলে খানিকটা বড়সড় কটেজ। মাথায় খাপরার ছাদ, ছাদের তলায় অ্যাসবেসটসের সিলিং, সাদা রঙ করা। কল নেই, জল আছে। কুয়ার জল। চমৎকার স্বাদ।
এখানে বাঙালি তিন চার ঘর। কম্পাসবাবু সরকারমশাইয়ের বাড়িতে কালীপুজো হল। ম্যানেজার চাড্ডাসাহেবের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া হল রাত্রে। একেবারে নিরামিষ। চাড্ডা পরিবারে মাছমাংস চলে না। তবে মদ চলে অল্পস্বল্প।
আমার ভালই লাগছিল। জায়গাটা চুপচাপ, শান্ত। গাছপালা ঝোপ জঙ্গলে ভরতি। পাহাড়ি জায়গা। দিনের বেলায় খানিকটা কাজকর্মের হইহল্লা বিকেলের পর থেকে একেবারে শান্ত হয়ে আসে।
সকাল থেকে সময়টা যে কেমন করে কাটছিল নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। বেড়ানো, খাওয়া দাওয়া, গল্পগুজব, দুপুর-ঘুম, এ-বাড়ি ও-বাড়ির লোকের সঙ্গে পরিচয় করে সন্ধে হল কি হল না—তাসের আসর বসে গেল। রাজশেখরের বাড়িতেই।
আমি কাজ-চালানো গোছের তাস খেলতে পারি। রাজশেখর আর তার বউ সুনন্দা দুজনেই পাকা তাসুড়ে। চাড্ডাসাহেবও ভাল তাস খেলেন। তবে রোজ হাজির থাকতে পারেন না। মাথুর আর তার বউ এসে তাসের আসরে বসে যায়। নয়ত প্রাণ। প্রাণময় ঘোষ।
এ-রকম একটা জায়গায় সময় কাটাবার জন্যে যে একটা নেশা, তাস পাশার থাকা দরকার সেটা বুঝতে পারি। ওদের অবশ্য ছেলেমেয়ে আছে। কিন্তু দুজনেই হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। এবারে তারা তাদের কাকার বাড়ি জব্বলপুরে গিয়ে দেওয়ালি করছে। বারকিতে এসে কেউ বেশিদিন থাকতে চায় না।
সুনন্দা দুঃখ করে বলে, ‘কী, জানি এ বনবাস কবে শেষ হবে!’
রাজু—মানে রাজশেখরকে জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘আমার সয়ে গেছে। এখন আর খারাপ লাগে না। তাছাড়া কি জানো, শিবুদা, আমি পাস করা ডিগ্রি পাওয়া এঞ্জিনিয়ার নই। ছিলাম অ্যাপ্রেনটিশ্ শ’ওয়ালেসের কোলিয়ারিতে। হাতে কলমে কাজ শিখেছি। একটা ডিপ্লোমাও জুটিয়েছি। বড় জায়গায় কে আমাকে চাকরি দেবে। এখানে পুরনো হয়ে গিয়েছি। মাইনেপত্র মন্দ পাইনা। কয়লা, ইলেকট্রিসিটি ফ্রি। একটা কাজের লোকের জন্যে টাকা দেয়। বড় কোলিয়ারিতে কেউ আমায় পুছবে না। আমি ভাল আছি।’
রাজু সত্যিই ভাল ছিল।
সুনন্দা বোধহয় অতটা ভাল ছিল না। তবে অসুখী নয়। তারও বয়েস হয়ে এসেছে। ঠিক বলতে পারব না, হয়ত চল্লিশের বেশি। দেখতে ভাল। তবে সামান্য মোটা। একটা জিনিস আমার ঠিক ভাল লাগত না। সুনন্দার চোখ। বড় বেশি ডাগর, অত্যন্ত উজ্জ্বল। মনে হত সে যেন আমার ব্যাপারে একটু বেশি কৌতূহল নিয়ে সব কিছু দেখে। কখনো কখনো তার চাপা হাসিও আমাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিত। কেন সে অমন করে মাঝে মাঝে হাসে—আমি বুঝতে পারতাম না।
তা প্রায় দিন পনেরো কেটে যাবার পর একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারলাম মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে। না, ঠিক মাথা ধরা নয়—মাথার মধ্যে যেন কিছু চাপ হয়ে আছে। চোখের চারপাশেও সামান্য ব্যথা।
সুনন্দা বলল, ‘ঠাণ্ডা লেগেছে। শীত পড়তে শুরু করার মুখে এমন ঠাণ্ডা লাগে। আপনি কলকাতার লোক, এই ঠাণ্ডাও চট করে আপনার সহ্য হয়নি।’
কথাটা ঠিকই। ঠাণ্ডা পড়ছিল।
চা জলখাবার খাবার পর আমি আমার ওষুধটা খাই। সেই ক্যাপসুল। বলাই ডাক্তার যেটা দিয়েছিল। এ-যাবৎ দুটো খাওয়া হয়েছে। একটা কলকাতায়, একটা এখানে এসে। তৃতীয়টা খাবার কথা।
খাব কি খাব না করে যথারীতি ওষুধটা খেয়ে ফেললাম। না খাবার কোনো কারণ ছিল না। ওষুধটা খেয়ে আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং লাভ হয়েছে। যেমন বারকিতে এসে আমি চনমনে বোধ করি, ভাল ক্ষিদে হয়, আর রাত্রে মড়ার মতন ঘুমোই।
মাথা সময় মতন ঠিক হয়ে যাবে ভেবে নিয়ে আমি রোজকার মতন একটু ঘোরাফেরা করতে বেরুলাম।
এখানে ভাল সিগারেট পাওয়া যায় না। শহর থেকে আনাতে হয়। রদ্দি সিগারেট কিনে হাঁটতে হাঁটতে কোলিয়ারির অফিস। ছোট অফিস। তবু যাই। সামান্য গল্পগুজব করি। বাসি কাগজ দেখি।
অফিসে সরকারবাবু ছিলেন না। কাজে বেরিয়েছেন। রাজু গিয়েছে তার নিজের কাজে। অল্পক্ষণ বসে চলে আসার সময় মনে হল, মাথার অবস্থা একই রকম আছে।
বাইরে রোদ মরামরা দেখাচ্ছিল। ঘোলাটে।
বাড়ি ফিরতে সুনন্দা বলল, ‘চা করি?
‘করো।…কী ব্যাপার বলো তো, আকাশটা ঘোলাটে দেখছি!’
‘বৃষ্টি হতে পারে।’
‘বৃষ্টি? ’
‘কেন, কাল রাত থেকেই বুঝতে পারছেন না—কেমন বাদলা বাদলা হাওয়া রয়েছে।’
‘আমি ভেবেছি শীতের বাতাস।’
‘শীতের সঙ্গে বাদলা। এরকম হয়, এক আধ পশলা হঠাৎ বৃষ্টি হয়—থাকে না।’
‘আর কিছু বললাম না। নিজের ঘরের দিকে চলে গেলাম।’
রাজুদের বাড়ি বড় নয়, কিন্তু বাড়ির চৌহদ্দি অনেকটা। কাঁটালতা, লোহার জালি, মোটা রশির মতন মোটা মোটা তারের টুকরো, কাঠকুটো দিয়ে চৌহদ্দি ঘেরা রয়েছে। গাছপালার শখ আছে রাজুদের। ফুলবাগান ফলবাগান থেকে সবজিবাগান—কোনোটারই অভাব দেখি না। তবে টুকরো টুকরো বাগান। কুয়াতলার কাছে মস্ত এক কুলঝোপ। ফটকের কাছে একসার মোরগ-ঝুঁটি ফুল।
আমার ঘরের সামনে বারান্দায় ক্যাম্বিসের চেয়ার সব সময় পাতা থাকে। অনেকটা সময় ওখানে বসেই কেটে যায়। বইটই যা জোটে পড়ি, গাছপালা, দেখি, আকাশ রোদ দেখি, পাখির ডাক শুনি। আলস্য যে কত উপভোগ্য সেটা যেন এখানে এসে বুঝতে পারছিলাম।
সুনন্দা চা দিয়ে গিয়েছিল। এটা তৃতীয় দফার চা।
চা খেয়ে সিগারেট ধরিয়ে একবার ঘরে গেলাম। ফিরে এলাম গোটা দুই বই হাতে করে। পুরনো বই। চাড্ডাসাহেবের বাড়ি থেকে আনা ডিটেকটিভ আর থ্রিলার। পরে ছিল ছেঁড়াখোঁড়া একটা ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’। পুরনো।
মাথা কিন্তু একই রকম। বাড়ছে না, কমছেও না, চোখ দুটো মাঝে মাঝে অকারণে ঝাপসা হয়ে আসছিল।
অন্যমনস্কভাবে ছেঁড়াখোঁড়া পত্রিকাটার পাতা ওলটাতে ওলটাতে চোখে পড়ল পাতার পাদপূরণের জন্যে মাঝে মাঝে জ্ঞানীবচন ছাপা রয়েছে। পড়তে বেশ লাগে। বেশ।
প্রায় আচমকা নজরে পড়ল একটি ছোট্ট বাণী। প্রাচীন কোনো চীনা জ্ঞানীজনের। ছোট্ট, কিন্তু চমৎকার। বাণীটির বাংলা ভাবার্থ করলে দাঁড়ায়; ‘একটুকরো সময়ের গণ্ডিতে মানুষের জীবন বাঁধা। একটি মাত্র মুহূর্ত, তারপর আর কিছু নেই। মানুষের জীবন হল, ক্ষণিক স্ফুলিঙ্গ। যেন একটা ফুটো দিয়ে দেখা রেসের ঘোড়া।’
জ্ঞানীদের সব কথা স্পষ্ট করে বোধ হয় বোঝা যায় না, অনুভব করা যায়। আমি যে কী অনুভব করেছিলাম কে জানে! মনে হচ্ছিল, অনন্ত সময়ের স্রোতে জীবন তো সত্যিই একটি মুহূর্ত। মুহূর্তমাত্র।
অন্যমনস্কভাবে বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। রোদ মোটেই উজ্জ্বল নয়, ধুলোর মতন রঙ হয়ে আছে। বেশ ঘোলাটে। মোরগফুলের লাল ঝকঝক করছে না। কয়েকটা গোলাপ ফুটেছে বাগানে। এক গুচ্ছ মুরসুমি ফুল সদ্য ফুটতে শুরু করেছে। কুলঝোপে কয়েকটা পাখি নাচছে। দু চারটি প্রজাপতি উড়ছিল।
সুনন্দা এসে বলল, ‘স্নানের আগে বলবেন, গরম জল করে দেব।’
‘কটা বাজল?’
‘সাড়ে দশটা হবে।’
‘ঘুম ঘুম পাচ্ছে কেন বল তো?’
‘রাত্তিরে ভাল ঘুম হয়নি?’
‘কই! ভালই ঘুম হয়েছে।’
‘তা হলে গা মাথা ভারের জন্যে অমন হচ্ছে। একটু গড়িয়ে নিন না। ঘন্টাখানেক পরে আমি ডেকে দেব। উঠে স্নান করে নেবেন।’
আমি সুনন্দাকে দেখেছিলাম। ওর রঙ খুব ফরসা নয়, কিন্তু যতটুকু ফরসা তার মধ্যেই মসৃণ ভাব রয়েছে। হাত পায়ের গড়ন ভাল। মাথায় ঘন চুল। তবে চোখ দুটি বড় ডাগর। মণি যেন নীলচে।
সুনন্দা বলল, ‘আজ বিকেলে আপনাকে নিয়ে বেড়াতে বেরুবো। আপনার ভাই দুপুরে ওদের বড় অফিসে যাবে চাড্ডাসাহেবের সঙ্গে।’
‘বেশ তো যাওয়া যাবে। রাজু ফিরবে কখন?’
‘কোলিয়ারির থেকে তাড়াতাড়ি ফিরবে। আবার বেরিয়ে পড়বে।’
সুনন্দা আর দাঁড়াল না।
আমিও হাই তুলে উঠে পড়লাম। একটু গড়িয়ে নেওয়াই যাক।
ঘরে এসে দেখি এক জোড়া প্রজাপতি জানলার কাছে উড়ে বেড়াচ্ছে। বাগান থেকে এসেছে। বাগানেই চলে যাবে।
বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়লাম।
সুনন্দা ঠিকই বলেছিল। শেষ বিকেলে বৃষ্টি হয়ে গেল। ঠিক যেন কালবৈশাখীর বৃষ্টি। ঝড় উঠল, বিদ্যুৎ চমকালো ভীষণ করে। বাজ পড়ল আর ঝোড়ো বৃষ্টি। আধঘন্টা বড় জোর। তারপর সবই স্বাভাবিক। আকাশে অল্পস্বল্প মেঘ থাকলেও তাতে আর জলের ভার ছিল না। শেষ বিকেলের আলো উঠেই ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। হেমন্ত কাল, শীত আসি আসি করছে, কতক্ষণ আর আলো থাকবে!
সুনন্দা ছিমছাম হয়ে বেরিয়ে এসে বলল, ‘চলুন।’
আমিও তৈরি ছিলাম। বললাম, ‘চলো। কিন্তু যাব কোথায়? যেরকম বৃষ্টি হয়ে গেল!’
সুনন্দা হেসে বলল, ‘এ কি আপনাদের কলকাতা? এখানে জল দাঁড়ায় না, কাদা হয় না। পাহাড়ি খটখটে জায়গা। একটু ভিজে ভিজে ভাব ছাড়া আর কিছু দেখবেন না!’
‘যাবে কোথায়?’
‘ভেবেছিলাম আপনাকে নিয়ে ডুলি পাহাড় যাব। এখন আর সময় নেই। কাছাকাছি জায়গা থেকে ঘুরে আসি।’
আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। মাথা ভারের ভাবটা কমেছে। কিন্তু চোখ দুটো জড়িয়ে আসছিল।
সুনন্দা বলল, ‘ও দিকটায় চলুন। আরও ফাঁকা।’
‘চলো।’
রাজুদের কোলিয়ারি ছোট। গোটা দুই পিট্। কয়লা শুনেছি তেমন ভাল নয়। কয়লার পাঁজা করে ওরা চব্বিশ ঘন্টা কয়লা পোড়ায়। সুনন্দা বলে রাবণের চিতা। সত্যিই তাই। পশ্চিমের দিকটায় সকাল সন্ধে খালি ধোঁয়া আর ধোঁয়া। রাত্রে পাঁজার আগুন চোখেও পড়ে। এই কয়লা-পোড়া গন্ধটা এখানের বাতাসে চব্বিশ ঘন্টাই পাওয়া যায়। নয়ত বারকি অন্য সব দিক থেকে চমৎকার। এখানকার মাটি শক্ত, মাঠ-ঘাট ঢেউ খেলানো, গাছপালা অজস্র।
সুনন্দার সঙ্গে তাড়াতাড়ি হাঁটা যায় না। সে একটু ধীরেসুস্থে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে। গল্প করে। আমি দোষ দিই না তাকে। যাকে সে ঠাট্টা করে ‘বনবাস’ বলে সেই বনবাসে থাকতে থাকতে তার কথা বলার সঙ্গী ফুরিয়ে গিয়েছে। আমি নতুন মানুষ। কত কথাই না তার থাকতে পারে আমাকে শোনাবার জন্যে।
আমরা খানিকটা এগিয়ে আসতেই দেখি, গোটা চারেক কালিঝুলি মাখা ভাঙাচোরা ট্রাক কোলিয়ারির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এগুলো কয়লা-বওয়া ট্রাক। এখানে রেল লাইন নেই। কয়লা বোঝাই করতে ট্রাক আসে। প্রায় দেখি, সন্ধের গোড়ায় ট্রাকগুলো আসে। ফাঁকা। রাতটা এখানেই কাটায়। পরের দিন সকাল থেকে কয়লা বোঝাই করে। দুপরের আগেই চলে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, খানিকটা আগে বৃষ্টি হয়েছে বলে মনেই হয় না। মাটি গাছপালা সামান্য ভিজে আছে, নয়ত অন্য কোনো লক্ষণ নেই ঝড়বৃষ্টি হবার। আকাশও প্রায় পরিস্কার। আলোও মরে এল। পাতলা অন্ধকার দেখতে দেখতে ঘন হয়ে আসছে। এলেও ক্ষতি নেই। শুক্লপক্ষ এখন। আজ কোন তিথি কে জানে! এয়োদশী না চতুর্দশী। চাঁদ উঠে আসবে এখুনি।
সুনন্দা প্রায় একতরফাই কথা বলছিল।
আমরা অনেকটা এগিয়ে এসেছি। আধ মাইলটাক হবে। অন্ধকার হয়ে গেল। এবার বাতাসে সিরসিরে ভাব রয়েছে। শীতের বাতাস হয়ত।
‘টর্চ এনেছ? আমি বললাম।
‘না,’ সুনন্দা মাথা নাড়ল।
‘তাহলে আর এগিয়ে কাজ নেই।’
‘চলুন ওইটুকু যাই তারপর ফিরব। এখুনি চাঁদ উঠবে।’
এখানে জায়গাটা ঢালু মাঠের মতন। এবড়ো খেবড়ো জমি। ছোট ছোট পাথর। মাঝে মাঝে সেগুনচারা, না হয় কাঁটা ঝোপ। ফণিমনসার মতন গাছও চোখে পড়ে।
মাঠ শেষ করে সুনন্দা বলল, ‘বসবেন একটু?’
কাছেই একটা পাথর পড়েছিল। বড় পাথর। বললাম, ‘বসা যাক।’
আমরা বসলাম।
ভালই লাগছিল। জায়গাটা নির্জন। গাছপালা মাঠের গন্ধ। দূরে কোলিয়ারির বাতি জ্বলছে। কয়েকটি টিমটিমে তারা যেন ফুটে উঠেছে ও পাশে।
সুনন্দা বলল, ‘আপনি যদি ডিসেম্বর মাসে আসতেন, কিংবা জানুয়ারিতে, আরও ভাল লাগত।’
‘শীত পড়ে যেত জোর! তাই না?’
‘হাড়কাঁপানো শীত। দিনের বেলায় যেমন রোদের আরাম; রাত্তিরে শীতের—’
‘আরাম!’ বলে আমি হেসে উঠলাম।
সুনন্দাও হাসল।
ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরানো গেল।
সুনন্দা এখানকার শীতের গল্প বলতে লাগল। ওদের সবজিবাগানে কপি, পালংশাক, কড়াইশুঁটি হয়। কুয়ার জল আরও মিষ্টি হয়ে যায় খেতে। রাত্রে তাদের ঘরে ফায়ার প্লেসের মতন করে আগুন জ্বালাতে হয়—এত শীত।
‘আবার একবার আসা যাবে—!’
‘আর এসেছেন!’
‘আসব। জায়গাটা আমার পছন্দ হয়েছে। তোমরা যা খাতির করছ সেটাও কম কী!’ আমি হাসলাম।
সুনন্দা বলল, আমাদের কাছে কেউ তো আসে না। দু’ চারবার বড় জোর কেউ এসেছে।
‘চলো, ওঠা যাক।’
আমি উঠে পায়চারি করার মতন কাছেই দু চার পা হাঁটছি সামান্য তফাতে দেখি বিশাল এক দীঘির মতন গর্ত! দীঘি বলা ঠিক হল না। জল নেই। অন্তত চোখে দেখা যাচ্ছে না। পুরো জায়গাটা যেন মাটির তলায় নেমে গিয়েছে। বিরাট কোনো ভূমিকম্পে মাটি ধসে পাতালে নেমে যাবার মতন অবস্থা। অনেকখানি জায়গা। ঝোপঝাড় জঙ্গলে ভরতি। এভাবে অতটা জায়গা মাটির তলায় নেমে যেতে আমি আর দেখিনি। জায়গাটার এপাশে খানিকটা বেড়া মতন। কাঠের ভাঙা খুঁটি, লোহার খুঁটি, কোনো রকমে ঝোলানো একটা তার কাঁটা। অও পুরোটা নয় বলে আমার মনে হল।
ততক্ষণে আকাশে চাঁদ উঠেছে। হালকা জ্যোৎস্না ফুটছিল।
‘কী ব্যাপার বলো তো!’ আমি সুনন্দাকে বললাম, ‘জায়গাটা এভাবে পাতালে তলিয়ে গেছে কেন?’
সুনন্দা উঠে এল। বলল, ‘ওখানটায় একসময়ে পুকুরে-খাদ ছিল।’
‘পুকুরে-খাদ!’
‘মাটি কেটে পুকুরের মতন করে নিয়ে কয়লা তুলত।’
‘তাহলে তো মাটির একেবারে গায়ে গায়ে কয়লা ছিল।’
‘এ-রকম খাদ এখানে অনেক ছিল। সব জায়গাতেই থাকে।’
‘তুমি দেখছি অনেক শিখে গেছ!’ বলে আমি ঠাট্টা করে হাসলাম।
সনন্দা বলল, ‘বারে, কয়লাঅলার সঙ্গে ঘর করছি—শিখব না!’
আমরা দু জনেই হেসে উঠলাম।
সুনন্দা বলল, ‘এ-জায়গাটা ওই ভাবেই পড়ে আছে। আমরা এসেও দেখেছি। কত বছর পড়ে আছে কে জানে! পঞ্চাশ ষাট…, বেশিও হতে পারে।’
‘ফেন্সিং দিয়ে রেখেছে যেন!’
‘নামে। অনেক সময় গরুছাগল ঢুকে পড়ে। তারপর পা হড়কে পড়ে গেলে একেবারে পাতালে। মরে।’
‘কত নিচু?’
‘তা বলতে পারব না। দিনের বেলায় দেখলে আন্দাজ করতে পারবেন। তা তিন চারতলা বাড়ির সমান।’
সামান্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে মুখ যখন প্রায় ফিরিয়ে নিচ্ছি হঠাৎ আমার মনে হল, হালকা ধোঁয়ার মতন একরাশ ধোঁয়া যেন ওই বিশাল দীঘির মতন জায়গাটার মাঝামাঝি থেকে উঠে এসে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
‘ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছে না?’ আমি বললাম।
সুনন্দা বলল, ‘কুয়াশা। জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে জায়গাটা, বৃষ্টি হয়েছে, এদিকে হেমন্তকাল কুয়াশা জমছে।’
হয়ত সুনন্দা ঠিকই বলেছিল, গাছগাছালির মধ্যে এই অক্টোবর মাসের সন্ধের গোড়ায় কুয়াশা নামতেই পারে। হালকা জ্যোৎস্নায় জড়িয়ে গিয়েছে কুয়াশা; ধোঁয়ার মতন দেখাচ্ছে।
কুয়াশা জমছিল জমুক। আমার উচিত ছিল ফিরে আসা। কিন্তু ফেরা হল না। চোখের ভুল কিনা জানি না, আমার মনে হল, কুয়াশার সাদার সঙ্গে নীল—নীলচে আভা মিশে যাচ্ছে। সামান্য তাকিয়ে থাকতেই বুঝতে পারলাম, চোখের ভুল নয়। খুব দ্রুত নীলের রং ছড়িয়ে যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে নীলচে আভা মেশানো জ্যোৎস্না-জড়ানো কুয়াশা যেন বয়ে যেতে লাগল। কিন্তু কোথায়!
কয়েক পা এগিয়ে গেলাম।
সুনন্দা বলল, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘একটু দেখি নীল কুয়াশা।’
‘ওদিকে যাবেন না। সন্ধে হয়ে গেল। ঝোপজঙ্গল। সাপখোপ কোথায় কী আছে?’
‘যাচ্ছি না। একটু এগিয়ে দেখছি। তুমি দাঁড়াও।’
পনেরো বিশ পা হয়ত, ভাঙাচোরা ফেন্সিংয়ের ওপারে এসে দাঁড়ালাম। সুনন্দা আমার পেছনেই ছিল। সে আমার সঙ্গে আছে স্পষ্ট বুঝতে পেরে আরও খানিকটা এগিয়ে গেলাম। তারপর আর পা বাড়াতে পারলাম না। আমার হাত পা থেমে গেল।
আমি ঠিক জানি না, চোখের সামনে কী ঘটছিল। কিন্তু ঘটছিল। সেই নীল কুয়াশা গাঢ় হতে হতে আচমকা যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপর আগুনের শিখার মতন জ্বলতে লাগল। অদ্ভুত দৃশ্য। সহস্র নীল শিখা যদি ক্রমাগত দমকা বাতাসে কাঁপতে থাকে যদি ঢেউয়ের মতন ফণা তুলে এক পাশ থেকে আরেক পাশে ক্রমাগত আছড়াতে থাকে—কেমন লাগতে পারে!
ভয় পেয়ে আমি সুনন্দাকে ডাকলাম চিৎকার করে। গলা উঠল কি উঠল না—জানি না; কোনো সাড়া পেলাম না সুনন্দার।
আমার হাত পা তখন অসাড় না আমি অচেতন অবস্থায় ছিলাম বলতে পারব না। চারপাশে কেমন এক তাপ অনুভব করছিলাম। শরীর জ্বালা করছিল। আর হঠাৎ অনুভব করলাম, আমি যেন বজ্রাহত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি। নিজের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কে আমার কোনো সাড় নেই। আমার চারপাশের তাপ বাড়তে বাড়তে অসহ্য হয়ে উঠল। গায়ের পাশে যেন চুল্লি জ্বলছে। হয়ত দরদর করে ঘামছিলাম। হয়ত গায়ের চামড়া পুড়ে যাচ্ছিল। কী যে হচ্ছিল বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা আমার নেই; এমন কি তখন কী অনুভব করছিলাম—তাও বোঝানো যায় না।
আমার মনে হল, এবার আমি মারা যাব। হয়ত আর দু চার মুহূর্ত। এখন আর আমার করার কিছু নেই। শুধু কয়েক মুহূর্ত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা। তাহলে কি তাই হল? এ জীবন শুধু একটি মুহূর্ত হয়ে থাকল। কেউ আমাকে অদৃশ্য থেকে দেখল, রেসের ঘোড়ার মতন আমি এক নিমেষের জন্যে তার চোখে পড়ে হারিয়ে গেলাম।
মৃত্যুর জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম। প্রতিটি মুহূর্ত যেন জলের ফোঁটার মতন একটি একটি করে আমার মধ্যে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য আমি মরছিলাম না। কেন, কে জানে!
ক্রমশ দেখি আমার চারপাশের তাপ কমে আসছে। দ্রুতই কমে যাচ্ছিল। আর সেই নীল শিখাও ক্রমেই মিলিয়ে আসতে লাগল। যা, মিলিয়ে এসে রামধনুর মতন বেঁকে আকাশের দিকে উঠে গেল। তারপর মিলিয়ে গেল কোন অদৃশ্যে কে জানে!
কী যে হচ্ছিল ঈশ্বরই জানেন। সমস্ত তাপ চলে গেল। মুছে গেল নীল শিখা। শুধু সাদা কুয়াশা ভাসতে লাগল। ঝিঁঝিঁর ডাক কানে এল।
তারপর দেখি, কুয়াশার মধ্যে একটি মানুষ। যেন ভেসে আছে।
লক্ষ করতে করতে একসময় মনে হল, কোন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কে? কে ও? কে? ওখানে কেন?
আরও কিছুটা স্পষ্ট হল মেয়েটি। সুনন্দা নাকি?
সুনন্দা বলেই মনে হল। কিন্তু এ কেমন সুনন্দা? ওকে লম্বা দেখাচ্ছিল। ভীষণ লম্বা। যেন গাছের লম্বা পাতার মতন আকৃতি। মাথার দু পাশ থেকে চুল গড়িয়ে এসে পায়ের পাতা ছুঁয়েছে। সম্পূর্ণ নগ্ন। অথচ মাথায় সেই বিশাল চুল—যা দু পাশ থেকে ওর পায়ের পাতা পর্যন্ত নেমে এসেছিল—সেই চুল ওর নগ্নতা ঢেকে রেখেছে।
সুনন্দা এগিয়ে আসছিল না। ছবির মতন দাঁড়িয়ে ছিল।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সে আরও দীর্ঘ হল। তারপর হারিয়ে গেল। আর তাকে দেখতে পেলাম না।
চারদিক স্তব্ধ। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। কুয়াশা আর জ্যোৎস্না মিলেমিশে মিহি বৃষ্টির মতন ছড়িয়ে রয়েছে।
আমি জানি না, কেমন করে কখন আমি বাড়ি ফিরতে শুরু করলাম। সাধারণ সুস্থ মানুষের মতন যে আমি হাঁটছি না—নিজেই বুঝতে পারছিলাম। আমার পা কাঁপছিল, টলছিল; হাত যেন নড়ছিল না। বুক আর মাথা অদ্ভুত লাগছিল। নিশ্বাস প্রশ্বাস নেবার ক্ষমতা আমি কী হারিয়ে ফেলেছিলাম! মাথা একেবারে ফাঁকা।
বাড়ির কাছাকাছি এসে আমার যেন সামান্য হুঁশ হল।
সুনন্দা আমার পাশে পাশে রয়েছে। ও আমায় কী বলছিল আমি খেয়ালই করতে পারছিলাম না।
প্রথম যখন খেয়াল হল আমি শুনলাম সুনন্দা বলছে, ‘আপনার কী হয়েছে?’
ওর দিকে তাকালাম। এই সুনন্দা সাধারণ সুনন্দা, যেমন তাকে আমি রোজই দেখছি। কোথাও কোনো বিকৃতি নেই।
‘কথা বলছেন না?’ সুনন্দা বলল।
আমি কথা বললাম। গলার স্বর কেমন শোনাল জানি না। ‘তুমি কোথায় ছিলে?’
‘কখন?’
‘আমি যখন ওই জায়গাটায় ছিলাম?’
‘আপনি এগিয়ে গেলেন। আমি বারণ করলাম। খানিকটা পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম।’
‘পাশে ছিলে না?’
‘না।’
‘আমি তোমায় ডেকেছিলাম। শুনতে পাওনি?’
‘না। কখন ডাকলেন?’
‘আমি তোমায় ডেকেছিলাম।…তুমি কিছু দেখতে পাওনি?’
‘না। কী দেখব?’
‘সেকি।…কুয়াশা কেমন নীল হয়ে উঠল! উঠে জ্বলজ্বল করতে লাগল। শেষে আগুনের মতন…!’
‘কী বলছেন আপনি?’
‘আমি যে দেখলাম। নীলে নীল, ফণার মতন মাথা তুলে নীলের শিখা দুলছিল। এপাশ থেকে ওপাশ…। তারপর রামধনুর মতন আকাশে…।’
সুনন্দা হেসে ফেলল। ‘আপনার চোখের ভুল।’
‘চোখের ভুল! এত বড় ভুল কেমন করে হবে। আমি যে তোমাকেও দেখলাম।’
‘আমাকে! কোথায়?’
‘ঠিক ওই খানটায়।’
সুনন্দা হাসতে লাগল। বলল, ‘আপনার মাথা খারাপ। আমি ওখানে যাব কেন? আমি তো প্রায় বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওদিকে যেতে আমার ভয় করে। সাপ খোপ পোকামাকড়, জঙ্গল…। আপনাকে আমি বারণও করলাম যেতে!’
আমি অবাক হয়ে সুনন্দার মুখ দেখছিলাম। ও কি কিছুই দেখেনি? তাহলে আমি কেন দেখলাম? চোখের ভুল? মনের ভুল? মতিভ্রম।
‘কিন্তু আমি যেন নিজের চোখে সব দেখলাম, সুনন্দা। এমন আশ্চর্য অবিশ্বাস্য জিনিস আর কখনও দেখিনি। তোমায় কেমন করে বোঝাব, কী আমি দেখেছি।’
সুনন্দা বলল, হালকা করে, ‘ভুল দেখেছেন। আর আমাকে আপনি দেখবেন কেমন করে? আমি অনেকটা পেছনে ছিলাম। সামনে যাইনি।’
‘ঠিক। তবু—?’
‘তবুটবু কিছু নয়।…আপনি আমায় প্রথম দেখেছিলেন কুড়ি বাইশ বছর আগে। আমাকে আপনার বোধ হয় পছন্দ হয়নি। আমার বিয়ে হয়েছিল আসানসোলে। বিয়েতেও আপনি যাননি। আর দু যুগ পরে এখানে আমাকে দেখছেন।…আমাকে হঠাৎ অত কষ্ট করে অজায়গায় দেখতে যাবেন কেন!’
আমি আর কিছু বললাম না। সুনন্দার কথার মধ্যে খোঁচা ছিল হয়ত।
বাড়ি ফিরে ভাল করে চোখমুখ ঘাড় হাত-পা ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। নিজেকে অসুস্থ দুর্বল মনে হচ্ছিল। সেই কুয়াশা, নীল শিখার ঢেউ, বিচিত্র রামধনু, অসহ্য তাপ, গাছের লম্বা পাতার মতন সুনন্দার সেই অদ্ভুত চেহারা আমার মাথার মধ্যে জড়িয়ে জট পাকিয়ে আমাকে যেন পাগল করে তুলছিল।
রাজু তার বড় অফিসের কাজ সেরে শহর ঘুরে ফিরল সামান্য রাত করে।
আমার ইচ্ছে ছিল না সেদিনই কথাটা তুলি। আমাদের দুজনকে খেতে বসিয়ে সুনন্দাই তামাশার গলায় কথাটা তুলল।
রাজু বলল, ‘কী হয়েছে, শিবুদা?’
আমি যতটা পারি তাকে বললাম।
রাজু সব শুনে হাসতে লাগল। বলল, ‘ওই জায়গাটা ডেজার্টেড। এখানকার কোলিয়ারি খোলার সময় কাজ হয়েছিল ওখানে। সে কী আজকের কথা! পঞ্চাশ ষাট বছর আগের ব্যাপার। একে কোয়ারি, তার ওপর আবার অনেকটা সাবসাইড্ করে গেছে। ওদিকে তুমি গেলে কেন? বেকায়দায় গিয়ে পড়লে ষাট সত্তর ফিট তলায় চলে যেতে। ওখানে কেউ যায় না।’
‘কিন্তু আমি হঠাৎ এরকম অদ্ভুত জিনিস দেখলাম কেন?’
‘দেখনি। তোমার…তোমার হয়ত তখন ওই রকম মনে হয়েছিল। কী যে বলে ইলিউশান না কী—তাই হয়ত হবে। ও নিয়ে ভেব না। চোখের ভুল অমন হয়। আমার নিজেরই কতবার হয়েছে, এক দেখতে এক দেখেছি।’
চোখের ভুল মানুষ মাত্রেরই হয়। তবে তার একটা সীমা আছে, বা মাত্রা রয়েছে।
আমার এত বড় ভুল কেন হবে আমি বুঝতে পারলাম না।
সেদিন সারারাত আমার ছটফট করে কাটল। কেন, কেন আমি অমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম আমার মাথায় আসছিল না! একে কী হ্যালুসিনেশন বলে? কী জানি! আমার চেতনা আর অবচেতনার মধ্যে কি কোনো গোলমাল হয়ে গিয়েছিল? বলাই ডাক্তার যে ওষুধটা দিয়েছিল—বিদেশি ক্যাপসুল—সেটা খাবার জন্যেই কি এইরকম স্নায়বিক একটা কাণ্ড ঘটল?
কোনো কিছুই আমার মাথায় আসছিল না।
পরের দিন সকালে বেড়াতে বেড়াতে সেই একই জায়গায় গেলাম। দেখলাম তফাত থেকে। কোনো রকম অদ্ভুত কিছু চোখে পড়ল না।
বারকিবুইয়ার ব্যাপারটা আমি হয়ত ভুলে যেতে পারতাম, বা কখনো কখনো মনে পড়ত হয়ত—ভাবতাম আমার মতিভ্রম ঘটেছিল কিংবা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম—কিন্তু আরও কিছু কিছু ঘটনা ঘটল যার জন্যে ঘটনাটা আমি ভুলতে পারলাম না।
ওই আশ্চর্য ঘটনার পর আমার শরীর আবার খারাপ হতে লাগল। এই যে দেখছেন, আমার গায়ের চামড়ায় শ্বেতীর মতন দাগ ধরেছে—এটা শ্বেতী নয়। অন্তত ডাক্তাররা বলে না। অবশ্যই এটা পিগম্যানটেশন—কিন্তু কেন ? কেন আমার সমস্ত মাথার চুল সাদা হয়ে গেল—দেখতে দেখতে, তারও কোনো কারণ নেই। আপনি জানেন না, আমার শরীর এ-রকম রোগা ছিল না। দিন দিন আমি রোগা হয়ে যেতে লাগলাম । অ্যানেমিয়ায় ধরল। কিডনির গোলমাল শুরু হল।
বারকি থেকে ফিরে এসে আমি বলাই ডাক্তারকে ব্যাপারটা বলেছিলাম। সে আমায় নিয়ে তামাশা করল। তারপর বলল, ওষুধের জন্যে এমন হতে পারে না। আজগুবি ব্যাপার দেখার জন্যে ওষুধকে দায়ী করা উচিত নয়। সে বলল, ‘ঠিক আছে; এখন তুমি কলকাতায় রয়েছ। আবার একটা ক্যাপসুল খাও—আমি দেখতে চাই তোমার কী হয়!’
আমিও সাহস করে আবার ওষুধ খেলাম। না, কোনো ঘটনাই ঘটল না যাকে আমি অবিশ্বাস্য বলতে পারি। তবে হ্যাঁ, আমার শরীর খারাপ হতে লাগল।
আরও একটা ঘটনা আমাকে বড় মুষড়ে দিল। বারকি থেকে চলে আসার মাস তিনেক পরে রাজুর চিঠি থেকে আমি জানতে পারলাম, সুনন্দার পেটের বাচ্চা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। হবার কোনো কারণ ছিল না সঙ্গত, তবু হয়েছে। তার মাথার চুলও পাতলা হয়ে পড়ে যাচ্ছে। দিন দিন রোগা হয়ে পড়ছে। চোখ খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর খুব তাড়াতাড়ি।
আপনি হয়ত বলবেন, আমার দেখা অদ্ভুত সেই দৃশ্যের সঙ্গে এ-সবের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্য কারণ থাকতে পারে।
যে কারণই থাকুক, আমি নিজে ব্যাপারটাকে আলাদা করে ভাবতে পারি না। হ্যাঁ, আমি জানি—সুনন্দা আমার মতন অদ্ভুত কিছু দেখেনি। কিন্তু সে যে আমার কাছাকাছি ছিল এটা তো ঠিকই। গায়ের পাশে না থেকে খানিকটা তফাতে ছিল এই পর্যন্ত।…যে যাই বলুক, আমি নিজে যা দেখেছি তা মিথ্যে বলতে পারি না, ভাবতেও পারি না। কিছু একটা হয়েছিল, সেটা কী আমি জানি না, কিন্তু হয়েছিল।…আমি মশাই, আজ দু বছর ধরে তারই জের টেনে যাচ্ছি ; শরীরে মনে।”
শিবতোষ তাঁর কথা শেষ করে উঠে পড়লেন। বললেন, “একটু বসুন, আসছি। জল তেষ্টা পাচ্ছে, খেয়ে আসি।”
উনি চলে গেলেন আমি বসে থাকলাম।
ভদ্রলোকের কথা আমি অবিশ্বাস করছিলাম না। কিন্তু তাঁর দেখা দৃশ্য সম্পর্কে আমার পুরোপুরি সন্দেহ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যে কোনো কারণেই হোক—শিবতোষবাবু সাময়িকভাবে একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। এটা সম্ভব। এক একসময় মানুষের মন তার অধিকারের বাইরে চলে যায়। সে অন্য কোনো জগতের বা অবস্থার মানুষ হয়ে পড়ে। আজকাল নানান ওষুধপত্র বেরিয়েছে যাতে একজন স্বাভাবিক মানুষকে সাময়িকভাবে তার বোধ বুদ্ধি চেতনার অন্য স্তরে নিয়ে যাওয়া যায়।
শিবতোষবাবুর ক্ষেত্রে এমন কি ঘটেছে? মনে হয় আবার হয় না। বলাই ডাক্তারের দেওয়া বিদেশি ওষুধ খেয়ে যদি এমন হত—তবে আগেই হতে পারত। এবং পরেও। কিন্তু হয়নি।
তাহলে?
খানিকটা পরে শিবতোষ ফিরে এলেন। হাতে দু কাপ চা। এগিয়ে দিয়ে বললেন, “ফ্লাস্কে ভরে রাখি। বারবার করার হাঙ্গামা বেশি। নিন, খান।
আমি চা নিলাম।
শিবতোষও বসলেন। চুমুক দিলেন চায়ে। দিয়ে সিগারেট ধরালেন, আমার দিকে প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন।
আমি বললাম, “আপনি অনেককেই আপনার এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। কেউ কোনো কারণ বলতে পারেনি?”
“না। তবে আমি একটা ব্যাখ্যা নিজেই বার করার চেষ্টা করেছি। …আপনি হয়ত মনে মনে হাসবেন। কিন্তু উপায় কী বলুন! সবাই যদি আমায় অবিশ্বাস করে, পাগল ভাবে—অথচ আমি নিজে জানি—আমি যা দেখেছি তা ঠিক—তবে একটা ব্যাখ্যা তো আমার পাওয়া দরকার।”
“আপনার কথাই বলুন।”
“দেখুন, একটা কথা আমরা সবাই বলি, এ-জগৎ বড় বিচিত্র, কত কী অদ্ভুত ঘটনাই না ঘটে। কিন্তু আমরা জানি না, আমাদের ভাবনা চিন্তার মধ্যে অদ্ভুত বলতে যে ধারণা রয়েছে তার বাইরেও এমন অদ্ভুত ঘটনা আগে ঘটেছে পরেও ঘটবে যার কোনো উত্তর আমরা খুঁজে পাব না বোধ হয়। আমাদের ধারণায় যা অদ্ভুত তার বাইরেও অনেক অদ্ভুত হল এ—জগৎ। …যাক গে, আপনাকে আমি যা বলছি সেগুলো আমার মনগড়া ব্যাখ্যা। আপনি নিশ্চয় বিশ্বাস করবেন না।…সত্যি বলতে কি, সবাই যখন আমাকে পাগলটাগল ভাবতে লাগল, বিশ্বাস করতে চাইল না আমার কথা—আমি তখন নানা রকম বইপত্র ঘাঁটতে লাগলাম। অবিশ্বাস্য ঘটনা নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে বিদেশে। সেসব বই কিছু কিছু এখানেও খোঁজ করলে পাওয়া যায়।” বলে শিবতোষ থামলেন, দম নিলেন যেন; সিগারেট ধরালেন আবার।
শিবতোষ বললেন, “আপনি নিশ্চয় জানেন, আমাদের বিশ্বজগতে তিনটি আদি—মানে বেসিক—শক্তি কাজ করে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘ফোর্স। এই তিনটি শক্তি হল: ইলেকট্রোম্যাগনেটিক, গ্র্যাভিটেশানাল আর নিউক্লিয়ার, এদের তিনের মধ্যে কী যে অদ্ভুত নাড়ির সম্পর্ক, একে অন্যকে যেন জড়িয়ে আছে। …সত্যি বলতে কি—ম্যাগনেটিজম ব্যাপারটার গুপ্ত রহস্য নাকি যৎসামান্যই জানা গেছে। পণ্ডিতরা তো তাই বলেন।…যাক গে, আমি শুধু ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিকের ব্যাপারটার কথাই বলছি। গত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে আমেরিকার, জার্মানি, ইংল্যান্ডে নানা রকম গোপন গবেষণা হতে থাকে—কী করে শত্রুকে ঘায়েল করার মতন ভীষণ ভীষণ অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করার উপায় কব্জা করা যায়। অ্যাটম বোমার মতন ভয়াবহ অস্ত্রটা আমেরিকাই আগে তৈরি করে ফেলে। তার ফলে কী হয়েছিল—সে তো সকলেরই জানা। কিন্তু আর-একটা ঘটনা ঘটেছিল, কিংবা ঘটানো হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। এই ঘটনা হল, যে কোনো বস্তুকে সাময়িকভাবে অদৃশ্য করে ফেলা। প্রচণ্ড শক্তিশালী—মানে ইনটেনসিফায়েড ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করতে পারলে এটা নাকি সম্ভব হয়। একে বলা যেতে পারে ‘এক্সপেরিমেন্ট ইনভিজিবিলিটি’। এ-ব্যাপারেও আমেরিকা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। এমন কি তারা ফিলাডেলফিয়ার সামরিক নৌ-ঘাঁটিতে একটা গবেষণা চালায়। সেটা ১৯৪৩ সালের কথা। একটা ডেস্ট্রয়ারকে কিছুক্ষণের জন্যে অদৃশ্য করে রাখে। অবশ্য সরকারিভাবে কোনোদিন কথাটা স্বীকার করা হয়নি। কারণ গবেষণা সফল হলেও তার ফলাফল হয়েছিল মারাত্মক। ডেস্ট্রয়ারের নাবিকরা কেউ আর স্বাভাবিক অবস্থায় জীবন কাটাতে পারেনি। তাদের অনেকের মতে, যখন তাদের ডেস্ট্রয়ারকে অদৃশ্য করা হয়—তখন তারা এমন এক অদ্ভুত জগতে চলে যায়—যা অকল্পনীয়। দৃশ্যত অদ্ভুত, এমন কি সেই জগতের সবই অদ্ভুত।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “আপনি কি বলতে চান, আপনি নিজে এই রকম কোনো—”
আমাকে বাধা দিয়ে শিবতোষ বললেন, “না আমি তা বলতে চাই না। আমি আমেরিকায় ছিলাম না, ছিলাম বারকিবুয়াইয়ায়। আমি কোনো নেভির লোক নই, ন্যাভাল ইয়ার্ডেও ছিলাম না। আমার ওপর কোনো এক্সপেরিমেন্ট করা হয়নি।”
“তবে?”
“তবে?…তবে, এমন হতে পারে, হয় প্রাকৃতিক কোনো কারণে, তার খেয়ালে, কিংবা অদ্ভুত কোনো যোগাযোগের ফলে আচমকা ওই জায়গায় অত্যন্ত দুর্বল কোনো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়ে যায়। ফিলাডেলফিয়ায় যা ঘটেছিল—সেখানে বিজ্ঞানীরা একটা ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক আবরণ তৈরি করেছিলেন। বলতে পারেন ক্যামাফ্লেজ। এখানে মানুষ নিজে কিছু করেনি প্রকৃতিগত কোনো কারণে হয়ে গিয়েছিল। কেন হয়েছিল আমি জানি না।…পরিত্যক্ত পুকুরে-কয়লা-খাদ খানিকটা আগে হয়ে যাওয়া ঝড়বৃষ্টি, বজ্রপাত। জ্যোৎস্না…! কী জানি!”
‘তা যদি হয়ে থাকে তবে আপনি আর আপনার বন্ধুর স্ত্রী তো একই অবস্থায় ছিলেন—”
“হ্যাঁ, সেটাই থাকার কথা। কিন্তু আমার মনে হয়, এখানে একটা অন্য ব্যাপার ঘটেছিল। আমি যে জায়গায় গিয়ে পড়েছিলাম—বা যেখানে আমি দাঁড়িয়েছিলাম সেই জায়গাটা সরাসরি ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মধ্যে পড়েছিল। আর সুনন্দা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে ওই ফিল্ডের সীমা শেষ হয়ে গেছে। তার ফলে আমি একটা আবরণের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। আমাকে সুনন্দা দেখতে পাচ্ছিল না। আমি যখন তাকে চিৎকার করে ডাকি সে শুনতেও পায়নি। আমি যে অদ্ভুত বিচিত্র দৃশ্য দেখেছি—সে দেখতে পায়নি।”
“আপনারা তো খুব তফাতে ছিলেন না।”
“না। পঁচিশ তিরিশ বা চল্লিশ গজ তফাতে থাকতে পারি। কিন্তু তাতে কী! সব জিনিসেরই সীমা আছে। নদী এক জায়গায় শেষ হয়ে ডাঙা শুরু হয়। আমি যে ফিল্ডের মধ্যে ছিলাম, সুনন্দা তার বাইরে পড়ে গিয়েছিল। তাতে সে আমার মতন অদ্ভুত দৃশ্য অবশ্য দেখেনি। তবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস—ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের বাইরে থাকলেও তার কিছু খারাপ ফলাফল—যাকে আমরা ব্যাড এফেক্ট বলি সেই এফেক্ট সে এড়াতে পারেনি।…না, পারেনি। খুব সম্ভব তার সন্তান নষ্ট হওয়া, শরীর খারাপ, মাথার চুল পাতলা হওয়ার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে।”
“আপনার বেলায় ক্ষতি বেশি হয়েছে—ওঁর বেলায় কম?”
“হ্যাঁ। আমার তাই মনে হয়।…আমার কী মনে হয় জানেন ডাক্তারবাবু, যে কোনো কারণেই হোক আমি একটা খুবই সামান্য—যৎসামান্য ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেইনবো—বা ধরুন ওই ধরনের একটা রামধনুর মতন কোনো কিছুর মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, সুনন্দা তার সামান্য বাইরে ছিল। সে আমার মতন আশ্চর্য জিনিস দেখেনি, কিন্তু এই বিশ্রী ব্যাপারটার ছোঁয়া পুরোপুরি এড়াতে পারেনি। বেচারা!…দেখুন, আমি অবিবাহিত, আমার বয়েস হয়েছে, আমার এই নষ্টস্বাস্থ্য, গায়ের এই দাগ, নানান মানসিক অশান্তি নিয়ে আমি হয়ত আর দু এক বছর বাঁচতে পারি। নাও পারি। তাতে ক্ষতি নেই বিশেষ। কিন্তু সুনন্দার কী হবে? তার স্বামী আছে, ছেলেমেয়ে আছে। তার যদি আরও কোনো ক্ষতি হয়—! হতেও তো পারে!… না—আমি ভাবতে পারি না। …আপনি বিশ্বাস করুন, আজকাল আমি সুনন্দার কথাই বেশি করে ভাবি।”
“আপনি কি ওঁকে বা ওঁদের কিছু জানিয়েছেন ?”
“না না, তাই কি কেউ জানায়! তাতে সুনন্দার আরও ক্ষতি হবে। মানসিক ক্ষতি।”
এখন তাহলে?
“এখন আর আমার কী করার আছে! আমি নিজের দেখা দুঃস্বপ্ন নিয়ে যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি। আর আছি সুনন্দার চিন্তা নিয়ে। ওর কথা আজকাল এত ভাবি, রোজই ভাবি যে মনে হয় একসময় যদি ওকে আমি বিয়ে করতাম, ও আমারই স্ত্রী হত—তবু হয়ত এর চেয়ে বেশি ওকে নিয়ে ভাবতাম না। কী জানি ওকে বিয়ে না করে ওর ক্ষতি করেছিলাম কি না! কিন্তু এই বয়েসে কিছু না জেনেই ওর ভীষণ ক্ষতি করলাম, ডাক্তারবাবু! আমি বড় ভয়ে ভয়ে থাকি। ভাবি কোনোদিন আবার রাজুর চিঠি পেয়ে জানব, সুনন্দার চোখের দৃষ্টি নষ্ট হয়ে গেছে, মাথার চুল সব পড়ে গেছে কিংবা সাদা হয়ে গিয়েছে আমার মতন। ও রক্তহীনতায় অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। …জানি না কী হবে! কেন এমন হল ? সবই আমার দুর্ভাগ্য।”
শিবতোষ চুপ করে গেলেন। তাকিয়ে থাকলেন শূন্য চোখে।
শিবতোষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে হল, উনি হয়ত অকল্পনীয় অ-জাগতিক কোনো দৃশ্য দেখে থাকলেও থাকতে পারেন। তার কোনো সুদত্তর উনি পাননি। আমারও জানা নেই। কিন্তু এখন আমি স্পষ্টই অনুভব করছি, এই পঞ্চাশোর্ধ্বে প্রায়-প্রৌঢ় বয়েসে ভদ্রলোক এই পার্থিব জগতের অন্য এক বিচিত্র রামধনুর এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে অন্য একজনকে দেখছেন। মুগ্ধ দৃষ্টিতে নয়। বিষণ্ণ প্রেমের দৃষ্টিতে। উনি কি সেটা অনুভব করেন? জানি না। সুনন্দা কি কোনোদিন অনুভব করবে? তাও জানি না।